তুষার-মানব

তুষার-মানব

একজন তুষার-মানবকে বিয়ে করেছি আমি।

তার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল একটা স্কী-অবকাশ যাপন কেন্দ্রে। তুষার মানবের সঙ্গে সাক্ষাতের ওটাই সম্ভবত প্রকৃষ্ট স্থান। ওকানকার হোটেল লবীতে প্রাণবন্ত সব তরুণ-তরুণীদের ভিড়। কিন্তু তুষার-মানব ফায়ার প্লেস থেকে অনেকটা দূরে একটা সোফায় বসে একা একা বই পড়ছিলেন। যদিও তখন প্রায় দুপুর, কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের আলো তার ওপর এসে পড়েছিল।

“ওই দেখ তুষার-মানব,” ফিসফিস করে বলে আমার বান্ধবী। সেই সময়টাতে তুষার-মানব সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। বান্ধবীও জানত না তেমন কিছু। “নির্ঘাত ভদ্রলোক বরফ দিয়ে তৈরি বুঝলি? যে কারণে লোকে তাকে তুষার মানব বলে ডাকে।” চোখ-মুখের ভঙ্গিতে সিরিয়াসনেস প্রকাশ করে এমনভাবে কথাগুলো বলেছিল, যেন সে ভুত-প্রেত কিংবা ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত কারও সম্বন্ধে বিবৃতি দিচ্ছে।

তুষার-মানব ছিলেন লম্বা। দেখে মনে হচ্ছিল যুবক। তবে তারের মতো ছোট ছোট তার চুলের ওপর ছোপ-ছোপ সাদা, যেন গলে না যাওয়া বরফ। চোখের নিচের হাড়গুলো জমাট পাথরের মতো চোখা। তার আঙ্গুলগুলো সাদা তুষারে ঘেরা, মনে হচ্ছে কোনো দিনও গলবে না ওগুলো। ওসব বাদ দিলে ভদ্রলোক খুব সাদাসিধে সাধারণ একজন মানুষ। তাকে খুব সুদর্শন বলা না-গেলেও আকর্ষণীয় বলতে বাধা নেই, তবে তা নির্ভর করবে আপনি তাকে কী দৃষ্টিতে দেখছেন তার ওপর।

যে ভাবেই হোক তার কিছু জিনিস আমার হৃদয়কে প্রচণ্ডভাবে বিদ্ধ করল। অন্য কোনো জায়গার চেয়ে তা সবচেয়ে বেশি অনুভব করলাম তার চোখে। তার দৃষ্টি নির্বাক ও এমন স্বচ্ছ যেন শীতের সকালে তুষারিকার ভেতর দিয়ে ঢুকে যাওয়া আলোর রেখা।…

কিছুক্ষণের জন্যে ওখানে দাঁড়ালাম আর দূর থেকে তুষার-মানবকে প্রত্যক্ষ করলাম। চোখ তুলে তাকালেন না। নড়াচড়া না করে বই পড়তে লাগলেন, যেন তার আশপাশে কেউ নেই।

পরের দিন সকালে তুষার-মানবকে একই জায়গায় বসে একই ভাবে গ্রন্থপাঠরত অবস্থায় দেখা গেল। লাঞ্চ সেরে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে স্কীইং করে সন্ধ্যায় যখন ফিরলাম দেখা গেল তখনও তিনি সেখানে বসে ওই একই বই পড়ছেন। তারপরের দিনও সেই একই ব্যাপার। সূর্য পাটে বসল, সময় গেল বয়ে; তিনি বাইরের শীতের দৃশ্যাবলীর মতো চেয়ারে বসে রইলেন।

চতুর্থ দিন কিছু ছুতো-ছল করে স্কীইং করতে বেরুলাম না। হোটেলের লবীতে পায়চারি করতে লাগলাম একা একা। সেখানে তখন ভৌতিক নীরবতা। বাতাস খানিকটা ভেজা-ভেজা। ঘরের ভেতর কেমন যেন বিষণ্ণতার ঘ্রাণ। মনে হয় লোকজনের জুতোর তলায় করে আসা বরফের গন্ধ ওটা। ওই বরফের কণাগুলো ফায়ারপ্লেসের সামনের জায়গাটাতে গলছিল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। তারপর একটুখানি নার্ভ শক্ত করে তুষার-মানবের কাছে গিয়ে কথা বললাম।

যথার্থ কারণ ছাড়া অপরিচিত লোকেদের সামনে গেলে বরাবরই আমি লজ্জা বোধ করি। অচেনা মানুষের সাথে সাধারণত আমি কথা বলি না। কেন জানি না তুষার মানবের সঙ্গে আলাপ করার জন্য নিজের ভেতর চাপ অনুভব করলাম। ওটা ছিল হোটেলে আমার শেষ রাত আর এখন যদি না করি তাহলে হয়ত জীবনে আর কোনো তুষার-মানবের সঙ্গে আলাপ করা হবে না।

“আপনি স্কীইং করেন না?” যতখানি স্বাভাবিকভাবে বলা যায় ততখানি স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম।

তিনি এমনভাবে ধীরে ধীরে আমার দিকে তাকালেন যেন দূরে কোনো গোলমাল শুনতে পেয়েছেন। তারপর মাথা নাড়িয়ে বললেন, “স্কীইং আমি করি না। এখানে বসে বসে বই পড়ি আর বাইরের তুষারের দিকে তাকিয়ে থাকি।” তার কণ্ঠনিঃসৃত বাক্য তার ওপরে মেঘের সৃষ্টি করল। কমিক-স্ট্রিপ ক্যাপশনের মতো। বাতাসের ওপর কথাগুলো দেখতে পেলাম যতক্ষণ না তিনি ওগুলো তুষার ঘেরা আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে দিলেন।

তারপর কী বলতে হবে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না আমার। লজ্জায় আরক্তিম আমি শুধু দাঁড়িয়ে রইলাম ওখানটায়। তুষার-মানব আমার চোখের দিকে তাকালেন, মনে হলো মুচকি হাসলেন।

“বসতে চাও আমার পাশে?” জিজ্ঞেস করলেন তিনি, “আমার প্রতি তোমার আগ্রহ আছে, তাই না? তুমি জানতে চাও তুষার-মানব বস্তুটা আসলে কী।” তিনি হাসলেন অতঃপর। “ভাবনার কিচ্ছুটি নেই। আমার সঙ্গে কথা বললে ঠাণ্ডা লাগবে না তোমার।”

লবীর এক কোণায় স্থাপিত একটা সোফায় পাশাপাশি বসলাম আমরা তারপর জানালা দিয়ে বাইরের তুষার নৃত্য অবলোকন করতে লাগলাম। গরম কোকাকোলা আনিয়ে পান করলাম আমি; কিন্তু তুষার-মানব কিছুই খেলেন না। মনে হলো আলাপ সালাপে তিনি আমার থেকে খুব বেশি একটা পটু নন। শুধু তা-ই নয় কথা বলবার মতো কোনো কমন বিষয়ও আমাদের ছিল না। প্রথমে আমরা আবহাওয়া নিয়ে আলাপ করলাম। তারপর হোটেল বিষয়ে। “একা এসেছেন এখানে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি। “হ্যাঁ।” বললেন তিনি। স্কীইং আমি পছন্দ করি কিনা শুধালেন। আমি বললাম, “তেমন একট নয়। বন্ধুবান্ধবের পীড়াপীড়িতে আসতে হয়েছে। স্কীইং আমি খুব কম করি।”

অনেক কিছু জানবার ছিল। তার শরীর কি আসলেই বরফের তৈরি? তিনি কী খান? গ্রীষ্মে কোথায় থাকেন? তার কি পরিবার পরিজন আর আত্মীয়স্বজন আছে। এইসব আর কী। কিন্তু তুষার-মানব নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে নারাজ। ফলে ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা থেকে বিরত থাকলাম।

তিনি আমার সম্পর্কে আলাপ করতে লাগলেন। বিশ্বাস করা কঠিন হলেও এটা সত্যি যে, যেমন করেই হোক আমার সম্পর্কে তিনি সবকিছু জানেন। আমার পরিবারের লোকজন, আমার বয়স, ভালোগা-মন্দলাগা, স্বাস্থ্যের অবস্থা, আমার লেখাপড়া এমনকি আমার বন্ধু-বান্ধবী সম্পর্কেও জানেন তিনি। আমার অতীতে কী ঘটেছে যা খোদ আমিও ভুলে গেছি সে সবও জানা আছে তার।

রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “কিছুতো বুঝতে পারছি না, আপনি আমার সম্পর্কে এতকিছু…” মনে হলো একজন আগন্তুকের সামনে উদোম হয়ে গেছি। “মানুষের মনে কী আছে আপনি তা পড়তে পারেন?”

“না, মানব হৃদয় পাঠের ক্ষমতা আমার নেই বা ওরকম কিছু আমি জানি না। এমনি জানি,” বললেন তুষার-মানব, “যেন বরফের গভীরে চোখ মেলে দিয়েছি। এমন করে যখন কারও দিকে তাকাই সব স্পষ্ট হয়ে যায়।”

“আপনি কি আমার ভবিষ্যত দেখতে পারবেন?”

“না,” ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলেন তিনি, “ভবিষ্যতের ব্যাপারে মোটেও আগ্রহ নেই আমার। আর সংক্ষেপে বলতে গেলে ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোনো ধারণাই আমার নেই। যে কারণে বরফের কোনো ভবিষ্যত নেই। এর ভেতরে অতীত ভরে দেয়া আছে। বরফ এভাবেই সবকিছু পরিচ্ছন্ন ও স্পষ্টতার সাথে সংরক্ষণ করতে পারে যেন তারা এখনও জীবন্ত। এটাই হচ্ছে বরফের মূল ব্যাপার বা নির্যাস বলা যেতে পারে।”

“চমৎকার তো,” মৃদু হেসে বললাম আমি, “এ কথা শুনে স্বস্তি পেলাম। আসলে ভবিষ্যত জানার কোনো আগ্রহ ছিল না আমার।”

শহরে ফিরে আসার পর বেশ ক’বার মিলিত হলাম আমরা। বলতে গেলে ডেটিং-ই করতে লাগলাম। যদিও সিনেমা কিংবা কফি হাউসে যাইনি। এমনকি রেস্তোরাঁতেও নয়। তুষার-মানব বলতে গেলে কিছুই খান না। আমরা প্রায়ই কোনো পার্কের বেঞ্চে বসে কথাবার্তা বলি, তবে তুষার-মানব নিজের সম্পর্কে একেবারেই নীরব থাকেন।

“এটা কেন?” একদিন বলি আমি, “নিজের সম্পর্কে তুমি কিছুই বল না যে?” আমি তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে চাই। কোথায় তোমার জন্ম, তোমার বাবা-মা দেখতে কেমন? কেমন করে তুমি তুষার-মানবে পরিণত হলে এসইব…”

আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে তুষার মানব বললেন, “আমি কিছুই জানি না। সবকিছুর অতীত আমি জানি। কিন্তু আমার নিজের কোনো অতীত নেই। বর্তমান আছে কিনা তা-ও জানি না। জন্ম কোথায় আমার, কিংবা বাবা-মা দেখতে কেমন সে সবও জানা নেই আমার। এখন আমার বয়স কত সে সম্পর্কেও কোনো ধারণা আমার নেই।”…

তুষার-মানব অন্ধকার রাতে পাথরের মতো ভাবলেশহীন মানুষের মতো নিঃসঙ্গ। আমি গভীরভাবে তার প্রেমে পড়ে গেলাম। বর্তমানের মতো তিনি ভালবাসেন আমাকে। আমার ভবিষ্যতের কোনো অস্তিত্বই স্বীকার করেন না। আমি তাকে বর্তমান সমেত ভালবাসি- তার অতীতকে অস্বীকার করে। বিয়ের ব্যাপারেও কথাবার্তা বলতে শুরু করি আমরা।

আমার বয়স এখন বিশ। তুষার-মানবই প্রথম ব্যক্তি যাকে আমি ভালবেসেছি। একজন তুষার-মানবকে ভালবাসার মানে কী কল্পনাতেও আনতে পারছি না। একজন স্বাভাবিক মানুষকেও যদি ভালবাসতাম তাহলেও হয়ত ভালবাসার মানে আমি বুঝতাম না।

আমার মা ও বড়বোন তুষার-মানবকে বিয়ের ব্যাপারে তীব্র বিরোধিতা করলেন। “বিয়ের জন্য এখনও উপযুক্ত বয়সে পা দাওনি তুমি। তাছাড়া, পাত্রের অতীত ইতিহাসও তোমার অজানা,” বললেন তারা, “তার জন্ম কোথায় সে কথাটি পর্যন্ত জান না তুমি। আত্মীয়স্বজনদেরই বা বলব কী করে এমন একটা মানুষকে তুমি বিয়ে করছ। তার ওপর সে আবার তুষার-মানব, যদি গলেটলে যায় তখন কী করবে? তুমি মনে হয় জান না বিয়ের জন্য সত্যিকারের অঙ্গীকারের দরকার হয়।”

যদিও তাদের এই উদ্বেগের কোনো ভিত্তি ছিল না। তুষার-মানব তো আসলে বরফে তৈরি নয়। যত গরমই পড়ুক না কেন গলে যাবে না। তার শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা থাকে বলে তাকে সবাই তুষার-মানব বলে ডাকে। তবে যা দিয়ে সে তৈরি তা বরফ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আর ওটা এমন ধরনের ঠাণ্ডা নয় যা অন্য লোকের উত্তাপ দূর করতে পারে।

.

একটা ভাল দিন দেখে বিয়ে করে ফেললাম আমরা। এই বিয়ের জন্য কেউ আশীর্বাদ করল না। কোনো আত্মীয়-স্বজনই আমাদের পরিণয়ে খুশি হলো না। আমরা কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজনও অবশ্য করিনি। তুষার-মানবের পারিবারিক রেজিস্টারে আমার নাম ভুক্তির বিষয় উঠলে দেখা গেল কোনো রেজিস্টারই নেই। আমরা দুজনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বিয়ে করব, বিয়ে করে ফেলেছি এই আর কি। একটা কেক কিনে মজা করে খেলাম দু’জনে। ওই রকমই ছিল আমাদের সংযত বিবাহ।

ছোট্ট একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলাম। তুষার-মানব সাহেব একটা চাকরি নিলেন কোল্ড স্টোরেজে। যে কোনো ধরনের ঠাণ্ডা তিনি সইতে পারেন আর কখনোই ক্লান্ত হন না তার কাজ যত পরিশ্রমেরই হোক না কেন। তার কাজকর্মে ওপরঅলা খুব খুশি আর এ কারণে তাকে বেতনও দেন অন্যদের চেয়ে বেশি। কাউকে জ্বালাতন না করে আর কারও জ্বালাতনের শিকার না হয়ে সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকি আমরা।

তুষার-মানব যখন রমণ করেন মনের ভেতর আমি একটা বরফের খণ্ড প্রত্যক্ষ করি। আমি নিশ্চিত যে, কোথাও তার নীরব অস্তিত্ব বিদ্যমান। ভাবি তুষার-মানব সম্ভবত জানেন বরফের খণ্ডটি কোথায়। জমে একেবারে শক্ত হয়ে আছে ওটি। এত শক্ত যে এর চেয়ে শক্ত আর কিছুই হতে পারে না। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বরফের টুকরো ওটা। ওটার অবস্থান অনেক দূরের কোনো স্থানে। আর তুষার-মানব সেই স্মৃতি তুলে দিচ্ছেন আমার কাছে ও পৃথিবীর কাছে। প্রথম যখন তুষার মানবের সঙ্গে আমার যৌন-মিলন ঘটে আমি খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। পরে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। তার সঙ্গে মিলিত হতে খুবই ভাল লাগে আমার। রাতে আমরা ওই বিশালকায় পাথরটি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেই, যার ভেতর জমা হয়ে আছে কোটি কোটি বছরের অতীত।

আমাদের বিবাহিত জীবনে সমস্যা নেই কোনো। আমরা একে অপরকে গভীরভাবে ভালবাসি। আমাদের মাঝখানে কোনো রকমের বাঁধার দেয়াল নেই। আমরা একটা সন্তান চাইছিলাম; কিন্তু তা হয়ত সম্ভব ছিল না। সম্ভবত মানবজীন আর তুষার-মানবের জীন সহজে মিলতে পারে না। তবে বাচ্চাকাচ্চা না থাকায় আমার হাতে বেশ সময় থাকে। সকালে কাজকর্ম শেষ হয়ে গেলে করবার মতো কিছুই থাকে না। কথা বলার মতো কোনো বন্ধুবান্ধবীও নেই। প্রতিবেশীদের সাথেও মেলামেশার সুযোগ নেই। তুষার-মানবকে বিয়ে করার কারণে মা ও বোন এখনও আমার ওপর রেগে আছেন। আমার সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের কোনো লক্ষণই টের পাচ্ছি না। বিয়ের পর বেশ ক’মাস অতিক্রান্ত হলেও কেউই আমাদের বিয়েটা মেনে নিতে পারছে না। আমরা তাদের থেকে ভিন্ন রকমের, কাজেই যতই সময় অতিক্রান্ত হোক না কেন আমাদের ভেতরকার ব্যবধান ঘুচবে না কোন দিন।

তুষার-মানব কাজে চলে গেলে আমি বাসাতেই থাকি, বইটই পড়ি কিংবা গান শুনি। বাসায় থাকতেই ভাল লাগে আর একা থাকতেও খারাপ লাগে না। কিন্তু আমার বয়স কম, রোজ রোজ একই কাজ করতে করতে প্রকারান্তরে নিজেকে একঘেয়ে করে তুলেছি। এটা অবশ্য সেই ধরনের একঘেয়েমি নয় যা বিরক্তিকর। এটাকে বলা যায় পুনরাবৃত্তি।

তাই একদিন আমার স্বামীকে বলি, “বেড়াতে গেলে কেমন হয়? একটুখানি চেঞ্জের জন্য আর কী?”

চোখ ছোট ছোট করে সে বলে, “বেড়াতে যাবে? মানুষ যায় বেড়াতে। কেন। এখানে সুখ পাচ্ছ না?”

“তা কেন হবে গো,” আমি বললাম, “সুখেই তো আছি। কিন্তু একঘেয়েমি লাগে না? দূরে কোথাও চল যাই, যেখানে আগে কখনো যাওয়া হয়নি, দেখা হয়নি, বুঝলে? তাজা বাতাসে নিশ্বাস নিতে চাই। তাছাড়া আমরা তো ধর হানিমুনেও যাইনি। হাতে কিছু টাকা জমেছে। ছুটিও পাওনা আছে তোমার…।”

“বেশ তুমি যখন এত করে বলছ তখন আর মানা করি কিভাবে। তোমার সুখের জন্য যে কোনোখানে যেতে পারি। কিন্তু কোথায় যেতে চাও?”

“দক্ষিণ মেরুতে গেলে কেমন হয়?” বললাম আমি। দক্ষিণ মেরু নির্বাচন করেছি এ কারণে যে আমি নিশ্চিত ছিলাম তুষার-মানব ঠাণ্ডা কোনো স্থানে যেতে অবশ্যই আগ্রহ দেখাবেন। আর সত্যি কথা বলতে কি সব সময়ই ওখানে যেতে চেয়েছি আমি। মনের মধ্যে সাধ, টুপি সমেত ফারকোট গায়ে দেব, কুমেরু উষা আর পেঙ্গুইনের ঝাঁক দেখব।

এসব কথা বলতেই আমার স্বামী পলকহীন চোখে সোজা আমার দিকে তাকালেন। মনে হলো চোখা একটা বরফের টুকরো আমার মাথার পিছন দিয়ে ঢুকে গেছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি শেষে বললেন, “ঠিক আছে, তুমি যখন চাইছ। তাহলে দক্ষিণ মেরুতেই যাওয়া থাক। সত্যিই কী যেতে চাও ওখানে?”

ঠিক তখনই তার কথার জবাব দেয়া সম্ভব হলো না আমার পক্ষে। তুষার-মানব এত দীর্ঘ সময় আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন যে আমার মাথা অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়ল। তারপরও মাথা নাড়লাম।

সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর দক্ষিণ মেরুতে যাওয়ার পরিকল্পনার জন্য অনুশোচনা এল আমার মনে। কেন জানি না। তবে আমার মনে হয়েছে দক্ষিণমেরু কথাটা উচ্চারণ করা মাত্র তার ভেতরে একটা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তার চোখের দৃষ্টি হয়ে উঠেছে তীক্ষ্ম, নিশ্বাস আরও সাদা আর আঙ্গুলগুলো ভরে উঠেছে তুষার কণায়। আমার সঙ্গে কথা বলা ও খাওয়া-দাওয়া এক রকম ছেড়েই দিলেন তিনি। ফলে আমি প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে লাগলাম।

আমাদের সফরের নির্ধারিত তারিখের পাঁচ দিন আগে নার্ভ শক্ত করে আমি বললাম, “দক্ষিণ মেরুতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিলে হয় না? ভেবে দেখলাম ওখানে এখন ভীষণ ঠাণ্ডা, শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আচ্ছা ইউরোপের দিকে গেলে কেমন হয়? স্পেনেও তো যাওয়া যায়। ওখানে খুব করে মদ পান করা যাবে, পায়েলা খাওয়া যাবে, উপভোগ করা যাবে ষাড়ের লড়াই। কি বল?”

কিন্তু আমার ওই কথায় কোনো গুরুত্বই দিলেন না তিনি। বললেন, “বিশেষ করে স্পেনে যেতে চাই না আমি। আমার পক্ষে জায়গাটা খুব গরম হবে। ধুলোবালি খুব বেশি ওখানে আর খাবারে মশলাও ওরা বেশি দেয়। তাছাড়া দক্ষিণ মেরুতে যাবার টিকেটও কিনে ফেলেছি। তোমার ফারকোট, জুতো এসবও কেনা হয়ে গেছে। ওগুলো তো আর নষ্ট করা যায় না। এতদূর অগ্রসর হয়ে এখন এই সফর বাতিল করা ঠিক হবে না।”

আসল ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, খুব ভয় পেয়ে গেছি। আমার ভেতর একটা পূর্বাশঙ্কা কাজ করছে দক্ষিণ মেরুতে গেলে এমন একটা অঘটন ঘটবে যা আমরা সামাল দিতে পারব না। বার বার আমি একই দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। হেঁটে বেড়ানোর সময় একটা হিমবাহের তুষারের উপরিভাগের গভীর ফাটলের ভেতর পড়ে যাচ্ছি। ওখানে পড়ে গেলে কেউ খুঁজে পাবে না আমাকে। মরে একেবারে জমে থাকব। বরফের নিচে থেকে ওপরে তাকাব, আকাশ দেখব, হয়ত জ্ঞান হারাবোনা, তবে নড়াচড়া করা সম্ভব হবে না। বুঝতে পারব ক্রমে ক্রমে অতীতে পরিণত হচ্ছি। আমার দিকে তাকিয়ে লোকে বুঝবে তারা অতীতের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি হব। তাদের থেকে দূরের একটি দৃশ্য মাত্র। …

জেগে উঠে দেখি তুষার-মানব আমার পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছেন। সব সময়ই তিনি খুব বাজেভাবে ঘুমান। মরা মানুষের মতো। তবে আমি খুবই ভালবাসি তাকে। আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ে। সেই পানি গিয়ে পড়ে তার গালে। জেগে ওঠেন তিনি। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। “খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি।” তাকে বলি!

“ও তো স্বপ্ন মাত্র,” তিনি বলেন, “স্বপ্নের জন্ম হয় অতীত থেকে, ভবিষ্যত থেকে নয়। তাদের বন্ধনে তুমি আবদ্ধ নও। তারা তোমার বন্ধনে আবদ্ধ। বুঝতে পেরেছ?”

বুঝিনি তা-ও বলি, “হ্যাঁ।”

সফর বাতিল করার যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে আমরা দক্ষিণ মেরুগামী বিমানে চেপে বসি। বিমানবালারা সবাই খুব মিতভাষী। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম প্রকৃতি দর্শনের জন্য; কিন্তু ওখানে ঘন মেঘ জমেছিল বলে কিছু দেখা গেল না। একটু পরেই জানালার কাঁচ তুষারের পর্দায় ঢাকা পড়ল। আমার স্বামী চুপচাপ বই পড়ছিলেন। অবকাশ যাপনে যাওয়ার কোনো উত্তেজনাই স্পর্শ করল না আমাকে। কিছু না করে গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাচ্ছিলাম শুধু, হয়ত ভাগ্যে যা ছিল সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে সব।

বিমানের সিঁড়ি বেয়ে দক্ষিণ মেরুর মাটিতে পা রাখতেই টের পেলাম আমার স্বামীর পা টলমল করছে। খুব অল্প সময়ের জন্য তা স্থায়ী হলো এবং তার চেহারায় কোনো পরিবর্তন সাধিত হলো না। কিন্তু ব্যাপারটা দেখতে পেলাম আমি। তুষার মানবের ভেতরে খুব গোপনে বড় রকমের ঝাঁকুনি গেছে একটা। ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে যান তিনি এবং প্রথমে আকাশ ও পরে নিজের হাতের দিকে তাকান। দীর্ঘ একটা শ্বাস গ্রহণ করেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন। বলেন, “এই জায়গাতেই তো আসতে চেয়েছিলে তুমি?”

“হ্যাঁ,” আমি বলি।

দক্ষিণমেরু আমার কল্পনার চেয়েও বেশি নির্জন। লোকজন নেই বলতে গেলে। ভূত-ভবিষ্যতহীন একটি ছোট্ট শহর। একটিমাত্র ছোট্ট হোটেল, তারও কোনো ছিরিছাদ নেই। এটা কোনো ট্যুরিস্ট স্পটও নয়। একটা পেঙ্গুইনও চোখে পড়ছে না। কুমেরু উষাও দেখা গেল না। গাছপালা, ফুল, নদী, পুকুর কিছুই নেই এখানে। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। বরফের নিষ্ফলা জমিন।

আমার স্বামী প্রচণ্ড উৎসাহে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগলেন। দ্রুত ওখানকার ভাষা শিখে তিনি শহরবাসীর সঙ্গে তুষার ঝড়ের বেগে জলদগম্ভীর কণ্ঠে বাতচিত করতে লাগলেন। কথা বলার সময় তার চোখে মুখে সিরিয়াসনেস ফুটে উঠল, তবে ওসবের মাথামুণ্ডু উদ্ধার করা আমার জন্য অসম্ভব ছিল। মনে হলো আমার স্বামী বেঈমানি করেছেন আমার সঙ্গে, আর আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন আমার নিজের জিম্মায়।

বরফে আচ্ছন্ন বাক্যহীন ওই জগতে অচিরেই আমি আমার সকল শক্তি ও সাহস হারিয়ে ফেললাম। শেষের দিকে বিরক্ত হওয়ার ক্ষমতাও চলে গেল আমার ভেতর থেকে। মনে হলো আবেগের দিকনির্ণয় যন্ত্রটাও খুইয়ে বসে আছি। সময়, দিক ও নিজ সত্তার বোধ সম্পর্কিত জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছি। কখন এর শুরু কখন এর শেষ জানি না। যখন চেতনা ফিরে পেলাম, দেখলাম এক বরফের জগতে বসে আছি সব রঙ ধুয়ে মুছে গেছে। নিজের ভেতর আবদ্ধ হয়ে আছি একা।

এমন কি আমার অধিকাংশ অনুভূতিই লুপ্ত হয়েছে। দক্ষিণমেরুতে আসবার পর আমার স্বামী আর আগের মানুষ নেই। আগের মতোই তিনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন আর দরদ দিয়ে কথা বলেন। আমি বলতে পারতাম, সত্যিকারভাবে যা বোঝাতে চেয়েছিলেন তাই বলেছেন তিনি। তবে আমি এ-ও জানি যে, অবকাশ যাপন কেন্দ্রের হোটেলে যে তুষার-মানবকে আমি দেখেছিলাম তিনি আর এখন সেই মানুষ নন।

এসব কথা তো এখন কাউকে বলতেও পারব না। দক্ষিণমেরুর সবাই তাকে পছন্দ করে। আমি যে- পৃথিবীর কথা বলেছি তারা সেটা বুঝতেই পারে না। মুখ থেকে সাদা তুষারের শ্বাস ছড়াতে ছড়াতে তারা ঠাট্টা-মস্করা করে, তর্কে মেতে ওঠে কিংবা নিজেদের ভাষায় গান গায়। আমি তখন একা বসে বাইরের ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। যে- বিমানটিতে করে আমরা এখানে এসেছি সেটি চলে গেছে অনেক দিন আগে। আমার হৃদয়ের মতো রানওয়েটা বরফের নিচে ঢাকা পড়েছে।

“শীত এসে গেছে, একদিন বললেন আমার স্বামী, “এটা খুব লম্বা হবে, কোনো বিমান কিংবা জাহাজ পাওয়া যাবে না। সবকিছুইতো জমে বরফ হয়ে গেছে। আগামী বসন্তের আগে মনে হয় এখান থেকে যেতে পারব না আমরা।”

দক্ষিণমেরুতে আসার তিনমাস পরে টের পেলাম আমি অন্তঃসত্ত্বা। জানি, যে বাচ্চাটার জন্ম হবে সে হবে তুষার-মানব। আমার গর্ভ জমে গেছে। আমি তা অনুভব করতে পারি। আমার সন্তান দেখতে হবে ওর বাবার মতো। চোখ হবে তুষারিকার মতো। আর আঙ্গুলগুলোতে জমে থাকবে তুষার। এই নতুন পরিবারটি কোনো দিনও দক্ষিণমেরুর বাইরে যেতে পারবে না। আমাদের অলৌকিক অতীত সব অনুমানের চেয়েও প্রচণ্ড ভারী, করায়ত্ত করে রাখবে আমাদেরকে। তাকে নাড়াতে পারব না কখনো।

এখন হৃদয় বলতে আমার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। উষ্ণতাও চলে গেছে অনেক দূরে। কখনো কখনো ভুলেই যাই এক সময় উষ্ণতা ছিল আমার মধ্যে। এখানে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ এক রমণী। আমি কাঁদলে তুষার-মানব আমার চিবুকে চুমু দেন আর তখন আমার চোখের পানি বরফে পরিণত হয়। আমার অশ্রুর বরফখণ্ড হাতে তুলে নিয়ে তিনি তার জিহ্বার ওপর রাখেন। বলেন, “দেখ আমি তোমাকে কত্তো ভালবাসি।” সত্যি কথাই বলেন তিনি; কিন্তু কোথা থেকে যেন তীব্র একটা বাতাস এসে তার সেই কথা উড়িয়ে নিয়ে যায়, সেই বাতাস আবার ফিরে যায় অতীতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *