ঘুম

ঘুম

গত সতের দিনে এক ফোঁটাও ঘুমাইনি আমি।

ইনসমনিয়ার কথা বলছিনে। ওটা কী জিনিস সে আমি জানি। কলেজ জীবনে এ-রকম একটা ব্যাপার হয়েছিল। এ-রকম একটা ব্যাপার’ বললাম এ জন্য যে, সে সময় আমার ঠিক কী হয়েছিল আমি নিশ্চিত ছিলাম না, আর যা হয়েছিল লোকে তাকে ইনসমনিয়া বলে অভিহিত করে কিনা। আমার ধারণা ডাক্তার তা বলতে পারবে। কিন্তু আমি কোনো ডাক্তার দেখাইনি। জানি তাদে লাভ হতো না। ও রকম ভাবার কোনো কারণ অবশ্য নেই। এটাকে নারী সুলভ তাৎক্ষণিক উপলব্ধি বলা যায় আমার কেন যেন মনে হয়েছে ডাক্তার কিছু করতে পারবে না। কাজেই কোনো ডাক্তারের শরণাপন্ন হইনি কিংবা বাবা-মা বন্ধুবান্ধবদের ব্যাপারটা বলিনি। কারণ তারা ঠিক কী বলবে সে আমার ভাল করে জানা।

তখন থেকেই ইনসমনিয়ার মতো ব্যাপারটা মাসখানেক ধরে চলে। এই সময়টাতে এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারিনি। রাতে বিছানায় গিয়ে শুয়েছি আর নিজেকে বলেছি, “ঠিক আছে চলো ঘুমানোর সময় হয়েছে। এই তো ব্যাপার। তারপর উঠে পড়তে হয়েছে আমাকে। তাৎক্ষণিক একটা ব্যাপার কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্স-এর মতো। ঘুমানোর জন্য যত বেশি চেষ্টা করেছি তত বেশি আমাকে নিঘুম থাকতে হয়েছে। মদ পান করেছি, খেয়েছি ঘুমের বড়ি; কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত যখন ভোরের আকাশ লাল হয়েছে, ভেবেছি হাল ছেড়ে দেয়া উচিত আমার। তার মানে। ঘুম আমার আসেনি। আমার আঙ্গুলের ডগা ঘুমের প্রান্তরেখাকে সামান্য একটুখানি ছুঁয়ে গেছে মাত্র। আর সে সময়টাতে আমার মন জেগে ছিল। ঝিমুনির একটা আভাস পেয়েছি; কিন্তু আমার মন তখনও সেখানে ছিল। আমার শরীরী সত্তা সকালের ক্ষীণ আলোর ভেতর ভেসে যাচ্ছে এবং সারাক্ষণ সেটা অনুভব করল আমার মন তার ঠিক পাশেই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, নিশ্বাস নিচ্ছে। ঘুমের প্রান্ত সীমায় আমি একই সাথে একটি শরীর, আর মন যে কিনা জেগে থাকতে বদ্ধ পরিকর।

এই অসমাপ্ত ঝিমুনি ক্রমাগত চলত সারাদিন। সারাক্ষণ আমার মাথাটা জ্যাম হয়ে থাকত। চারপাশের কোনো জিনিসের ওপর সঠিকভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারতাম না, নির্ধারণ করতে পারতাম না তাদের দূরত্ব অথবা পরিমাণ কিংবা সময়কাল। ঝিমুনি আমাকে হামলা করত থেমে-থেমে- সাবওয়েতে, ক্লাসরুমে আর খাবার টেবিলে। দেহ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেত মন। দুনিয়াটা নিঃশব্দে কাঁপত। জিনিসপত্র পড়ে যেত হাত থেকে। নিজের দেহখানা বিছানায় নিক্ষেপ করে ঘুমাতে চাইতাম শুধু। কিন্তু ঘুম আসত না। অনিদ্রা সব সময় আমার পাশে থাকত। দারুণ শীতল একটা ছায়ার অস্তিত্ব অনুভব করতাম। আমার নিজেরই ছায়া ছিল সেটা। ব্যাখ্যাতীত সব ব্যাপার। ঝিমুনি আমার ওপর দখল নিলে ভাবতাম, নিজের ছায়ার ভেতরেই আছি। ঝিমুনির মধ্যেই হাঁটতাম, খেতাম, লোকজনের সঙ্গে কথা বলতাম। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে, আমার ওজন সেই মাসে পনের পাউন্ড কমে গেলেও কেউ টের পায়নি, কেউ না। পরিবারের কেউ, বন্ধুবান্ধব, ক্লাসমেট কেউ বোঝেনি ভয়ানক এক নিদ্রাহীনতায় জীবন কাটাচ্ছি আমি।

আক্ষরিক অর্থে এটা ঠিক যে, আমি নিদ্রাহীনতায় জীবন কাটাচ্ছি। পতিত মৃতদেহের চেয়ে বেশি অনুভূতি আমার শরীরে নেই। এই পৃথিবীতে আমার অস্তিত্ব যেন একটা হ্যাঁলুসিনেশন, প্রবল বাতাস আমাকে ভাসাবে, আমার শরীর পৃথিবীর একেবারে শেষ মাথায় উড়ে যাবে, এমন এক জায়গায় সেখানে যাইনি আমি কিংবা শুনিনি তার নাম; ওখানে আমার মন ও শরীর চিরদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। নিজেকে বলব, শক্ত করে ধরো, কিন্তু ধরার মতো কিছুই থাকবে না।

আর রাত এলে তীব্র জাগরণ ফিরে আসে। ওই জেগে থাকা মোকাবিলা করতে আমি অক্ষম। বিশাল কোনো শক্তির দ্বারা আমি যেন বন্দি। যা আমি করতে পারি তা হচ্ছে- অন্ধকারে চোখ খোলা রেখে সকাল অবধি জেগে থাকা। এমন কী চিন্তা করার শক্তিও থাকে না। শুয়ে শুয়ে শুনতে পাই ঘড়ির কাঁটার এগিয়ে যাওয়ার শব্দ।

এবং একদিন তা শেষ হয়। কোনো রকম হুঁশিয়ারি ছাড়া, কোনো রকম বাহ্যিক কারণ ছাড়া। নাশতার টেবিলে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি। কিছু না বলে উঠে দাঁড়াই। টেবিলে টোকা মারতে পারি। মনে হয় কেউ কিছু বলবে; কিন্তু নিশ্চিত হতে পারি না। নিজের ঘরের ভেতর টলতে-টলতে হাঁটি, হামাগুড়ি দিয়ে বিছানায় যাই, এবং তারপর গভীর নিদ্রার ভেতর ডুবে যাই। সাতাশ ঘন্টা ওইভাবে থাকি। আমার মা ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আমাকে জাগানোর জন্য প্রবলভাবে নাড়াতে থাকেন। আমার গালে থাপ্পড় মারেন; কিন্তু কোনো রকম বিরতি ছাড়াই ঘুমের ভেতর সাতাশ ঘন্টা পার করে দেই। জেগে উঠে আবার সেই আমার আমিকে ফিরে পাই, সম্ভবত…।

কেন আমি এমন নিদ্রাহীনতার মধ্যে চলে গিয়েছিলাম, কেনই বা আবার তা সেরে যায় জানি না। ঘন কালো মেঘের মতো ছিল ওটা, বাতাসের তোড়ে ভেসে এসেছিল- পুরুষ্টু এক গাদা কালো মেঘ, ভয় জাগানিয়া সব উপাদানে ভরা, যে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। কেউ জানে না এমন জিনিস কোত্থেকে আসে আবার কোথায় চলে যায়। আমি শুধু এইটুকু নিশ্চিত যে, ওটা আমার ওপর ভর করেছিল, তারপর চলে গিয়েছিল।

যে কোনো ভাবেই হোক, ইনসমনিয়ার মতো ওই ব্যাপারটা এখন আর আমার মধ্যে নেই। শুধু ঘুমাতে পারি না। এক সেকেন্ডের জন্যও না। ওইটুকু ছাড়া আমি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। ঘুম ঘুম ভাব নেই, আর মনটা ঠিক আগের মতো পরিষ্কার। শারীরিকভাবেও আমি স্বাভাবিক: ভাল খিদে হয়; অবসন্ন হয়ে পড়ি না। সব ধরনের বাস্তবতার নিরিখে বিচার করলে দেখা যায় কিছুই নেই আমার মধ্যে। কেবল শুধু ঘুমাতে পারি না।

আমার না-ঘুমানোর ব্যাপারটা আমার স্বামী বা আমার ছেলে খেয়াল করেনি। আমিও তাদের কিছু বলিনি। ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারেও কোনো আগ্রহ নেই আমার। জানি ডাক্তার কিছুই করতে পারবে না। আমি জানি। সেই আগের মতো। ব্যাপারটাতো আমার নিজের!

কাজেই তাদের মধ্যে কোনো সন্দেহের সঞ্চার হয়নি। ওপরে ওপরে আমাদের জীবন ধারা ছিল অপরিবর্তিত। শান্তিতে ভরা। একেবারে রুটিন মাফিক। স্বামী ও ছেলেকে সকালে নাশতা খাইয়ে বিদায় করার পর গাড়িটা নিয়ে বাজার করতে বের হই। আমার স্বামী একজন ডেন্টিস্ট। আমাদের বাসা থেকে তার অফিস মাত্র দশ মিনিটের পথ।

সে ও তার এক ডেন্টিস্ট বন্ধু মিলে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। ভালই চলছে। সেটা। তবে ব্যাংক থেকে বিস্তর টাকা ঋণ নিতে হয়েছে কারণ, দন্ত চিকিৎসার সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি জোগাড় করার জন্য প্রচুর বিনিয়োগের দরকার হয়। আর ওখানে প্রতিযোগিতাও খুব বেশি। দরজা খোলার সাথে সাথে দলবেঁধে রোগী আসে। না। রোগীর অভাবে অনেক ডেন্টাল ক্লিনিক বন্ধ হয়ে যায়।

আমাদের যৌবনকালে আমরা দরিদ্রই ছিলাম বলা যায়। সবে আমাদের ছেলেটা হয়েছে। এই কঠিন পৃথিবীতে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা কেউ আমাদের দেয়নি। তারপরেও পাঁচটি বছর কেটে গেছে। না, অভিযোগ করার কিছু নেই আমাদের, যদিও তিনভাগের দু’ভাগু ঋণ এখনও শোধ করা হয়নি।

আমি আমার স্বামীকে প্রায়ই বলি, “জানো তুমি কেন এত বেশি রোগী পাও? তোমার চেহারা খুব সুন্দর।” সামান্য ঠাট্টা আর কী। তার চেহারা মোটেও ভাল নয়। সত্যিকথা বলতে কী সে দেখতে অদ্ভুত। এখনও মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এমন অদ্ভুত দর্শন মানুষকে আমি কেন বিয়ে করতে গেলাম। আমার কয়েকজন ছেলে বন্ধু ছিল। দেখতে তারা ওর চেয়ে অনেক ভাল ছিল।

কী কারণে তার চেহারা অদ্ভুত তা কিন্তু বলতে পারব না। সুদর্শন চেহারা নয় ওটি, আবার কুৎসিতও নয়…। একবার আমি তার ছবি আঁকতে চেষ্টা করেছিলাম; কিন্তু পারিনি। স্মরণ করতে পারব না তখন দেখতে সে কেমন ছিল। খাতা-পেন্সিল নিয়ে তার সামনে বসেছিলাম শুধু, একটা আঁচড়ও দিতে পারিনি। আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। এত দীর্ঘ সময় একটা লোকের সঙ্গে থেকেও তার চেহারা মনে করতে পারিনি। কী করার ছিল আমার? শুধু একটা ব্যাপার মনে করতে পেরেছিলাম তার চেহারাটা অদ্ভুত। ওই স্মৃতি এখনও আমাকে নার্ভাস করে তোলে। তারপরও বলতে হয়, সে এমন একজন মানুষ সবাই তাকে পছন্দ করে। ওটা তার ব্যবসার বড় একটা প্লাস পয়েন্ট। তবে আমার ধারণা, যে কোনো ব্যাপারে তার সাফল্য অনিবার্য। তার সঙ্গে আলাপ করে লোকে নিরাপদ বোধ করে। এমন লোক আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। আমার সব বান্ধবী-ই তাকে পছন্দ করে। সে আমারও খুব প্রিয়। আমার বিশ্বাস তাকে আমি ভাল-ই বাসি। কিন্তু, কঠোরভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, আমি তাকে ঠিক পছন্দ করি না।

যা-ই হোক। সে স্বাভাবিকভাবে হাসে। খুব নিষ্পাপ সেই হাসি- শিশুদের মতো। অনেক পরিণত বয়স্ক লোকের পক্ষেই ওরকমভাবে হাসা অসম্ভব। আমার অনুমান সবাই ডেন্টিস্ট সাহেবের চমৎকার দাঁত প্রত্যাশা করে- তা তার আছে।

ঠাট্টা-মস্করা করার সময় সে সব সময় বলে, আমি দেখতে ভাল এটা কি আমার দোষ? আমরাই শুধু বুঝি আসলে এর প্রকৃত অর্থ কী। এটা হচ্ছে সত্যের স্বীকৃতি বেঁচে থাকার জন্য এসব করতে হয় এবং এটা আমাদের জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ আচার।

সকাল ঠিক সাড়ে আটটায় সে পার্কিং থেকে গাড়ি বের করে। আমার ছেলে ওর পাশের সিটে বসে। অফিসে যাওয়ার পথেই পড়ে ছেলের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। যাওযার সময় আমি বলি, “সাবধানে থেকো।” সে বলে, “ভেবো না।” সব সময় আমরা এই এক কথাই বলি। আমার স্বামী গাড়ির স্টেরিওতে হাইডেন কিংবা মোসার্টের ক্যাসেট ঢোকায় এবং সঙ্গীত শুনতে শুনতে গাড়ি চালায়।

আমার দু’জন পুরুষ’ বিদায় নেয়ার সময় হাত নাড়ে। একই ভাবে তাদের হাত নড়াচড়া করে। খুবই রহস্যজনক আর অদ্ভুত একটা ব্যাপার। একই অ্যাঙ্গেলে তারা নিজেদের মাথা ঝাঁকায় আর হাত বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে, একই ভাবে নিজেদের আসনে বসে মোড়ামুড়ি করে, যেন তারা কোনো নৃত্যশিক্ষকের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছে।

আমার নিজেরও গাড়ি আছে- হোন্ডা সিভিক। বছর দুয়েক আগে এক বান্ধবীর কাছ থেকে কিনেছি। একটা বাম্পার ভাঙ্গা। পুরানো মডেলের গাড়ি। মাসে একবার দু’বার স্টার্ট নিতে চায় না। তারপরেও বলতে হয় কাজ চালিয়ে নেয়া যায়।… এই তো আমার জীবন। আমার স্বামী অবশ্য গাড়িটাকে বলে—”গাধা। কী আর করবে ওটাতো আমারই।”

সুপার মার্কেট থেকে জিনিসপত্র কিনে এনে ঘরদোর সাফ করি। কাপড় ইস্ত্রি করি। তারপর লাঞ্চ বানাই। খুব দ্রুততা আর দক্ষতার সাথে ঘর কন্যার কাজ সামলাই। সম্ভব হলে সকালের দিকেই ডিনার তৈরির কাজটা এগিয়ে রাখি। বিকেলটা সম্পূর্ণরূপে আমার।

আমার স্বামী বাইরের খাবার পছন্দ করে না। খেতে সে দুপুরে বাসায় আসে। সে বলে, রেস্তোরাঁগুলোতে ভিড় থাকে খুব আর খাবারের মানও ভাল না। কাপড় চোপড়ে তামাকের গন্ধ লেগে যায়। যেতে-আসতে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হলেও বাসাতেই খাওয়া পছন্দ করে সে। এখনও বাসায় আমি কোনো সৌখিন খাবার তৈরি করিনি। বেঁচে যাওয়া খাবার তুলে রাখি কিংবা একপট নুডলস সেদ্ধ করে নেই। কাজেই এসব করতে বেশি সময় ব্যয় হয় না। একা-একা কারও সঙ্গে কথা না বলে। খাবার খাওয়ার চেয়ে স্বামীর সঙ্গে খেতে আমি বেশি মজা পাই।

আগে অর্থাৎ যখন আমাদের ক্লিনিকে বেশি রোগীর আনাগোনা ছিল না, আমরা দু’জনে লাঞ্চ করে শুয়ে পড়তাম। ওটা ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে চমৎকার সময়। চারপাশটা থাকত নীরব নিস্তব্ধ। বিকেলের নরম রোদ ঢুকত ঘরের ভেতর। তখন আমাদের বয়স অনেক কম ছিল, আমরা আরও বেশি সুখী ছিলাম। এখনও আমরা সুখী। সত্যিই আমি তাই মনে করি। সংসারের গোলমালের কোনো ছায়া পড়ে না আমাদের গৃহে। তাকে আমি ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। আমি নিশ্চিত সে-ও আমার ব্যাপারে একই মনোভাব পোষণ করে। তবে আস্তে আস্তে, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আর বছরের পর বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর মানুষের জীবনে পরিবর্তন আসে। ব্যাপারটা এমন-ই। আপনার আমার কিছু করার নেই। এখন বিকেলের অবকাশটুকু আর নেই। খাওয়া শেষ হলে আমার স্বামী কর্মস্থলে ছোটে। অসুস্থ দাঁত নিয়ে রোগীরা তার জন্য অপেক্ষা করে। এমনি করেই চলে সবকিছু। আমরা দুজনেই জানি নিজেদের মতো করে সবকিছু আমরা পাব না।

আমার স্বামী চলে যাওয়ার পর আমি তোয়ালে আর স্নানের পোশাক নিয়ে পাশের একটা স্পোর্টস ক্লাবে চলে যাই। আধা ঘন্টার মতো সাঁতার কাটি। সাঁতারের ব্যাপারে আমার উন্মাদনা নেই। শরীরটা শুধু ফিট রাখতে চাই। নিজের দেহখানা আমি খুবই ভালবাসি। তবে নিজের চেহারাটা পছন্দ নয় আমার। নেহাত খারাপও নয় আমার চেহারা; কিন্তু কখনোই আমার মনে হয়নি ওটা আমি পছন্দ করি। শরীরের ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা। আয়নার সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়াতে ভাল লাগে; শরীরের কোমল আকার আকৃতি পরীক্ষা করতে চাই। সেখানে সুষম প্রাণশক্তি খুঁজে পাই। ওটা কী সে সম্পর্কে নিশ্চিন্ত নই, তবে অনুভব করি ভেতরে এমন একটা কিছু আছে যা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ওটা যা-ই হোক না কেন, হারাতে চাই না।

আমার বয়স এখন তিরিশ। তিরিশে পা দিয়ে আপনি অনুধাবন করেন জীবন এখানেই শেষ নয়। বয়স বাড়ায় আমি সুখী নই, তবে এটা কিছু ব্যাপারকে বেশ সহজ করে দেয়। এটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। একটা ব্যাপার নিশ্চিত জানি- তিরিশ বছরের কোনো নারী তার শরীর ঠিক রাখতে চাইলে তাকে বিস্তর চেষ্টা তদবির করতে হয়। মায়ের কাছ থেকে এটা শিখেছি। তিনি একজন হালকা পাতলা সুন্দরী মহিলা ছিলেন। কিন্তু এখন আর তা নেই। আমি চাই না আমারও এমন হোক।

সাঁতার কাটার পর বিকেলের বাকি সময় নানাভাবে অতিবাহিত করি। কখনো কখনো স্টেশন প্লাজা আর দোকানগুলোতে ঘুরে বেড়াই। কোনো সময় আবার বাসায় ফিরে গিয়ে সোফায় শুয়ে বইটই পড়ি, রেডিও শুনি কিংবা শুধুই বিশ্রাম নেই। এরমধ্যেই আমার ছেলে স্কুল থেকে ফিরে আসে। ওকে কাপড় বদলাতে সাহায্য করি। খাওয়া দাওয়া করে ও বন্ধুদের সাথে খেলতে যায়। বয়স কম বলে বৈকালিক। বিদ্যালয়ে দেইনি ওকে কিংবা পিয়ানো শিখতে দিচ্ছি না।

আমার স্বামী বলে, “খেলতে দাও ওকে। স্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে উঠুক সে।” সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ডিনার বানানোর কাজে লেগে যাই। ছ’টার দিকে ছেলেটা ফিরে আসে। টিভিতে কার্টুন দেখতে বসে। জরুরি কোনো রোগী না এলে আমার স্বামী সাতটার মধ্যেই ঘরে ফিরে আসে। মদ সে মোটেও খায় না, অকারণ সামাজিকতা তার পছন্দ নয়। কর্মস্থল থেকে সোজা বাসায় ফিরে আসে।

ডিনার টেবিলে বসে আমরা সারাদিনের কাজকর্ম নিয়ে গল্প করি। আমার ছেলে সবচেয়ে বেশি বলে। তার জীবনে যা কিছু ঘটে তা সব সময়ই নতুন আর রহস্যময়। সে বলে আর আমরা মন্তব্য করি। ডিনারের পর সে টিভি দেখে, পড়ে কিংবা বাবার সঙ্গে খেলে। বাড়ির কাজ থাকলে দরজা বন্ধ করে তা করে সে। সাড়ে আটটায় ঘুমিয়ে পড়ে।

তখন আমরা স্বামী-স্ত্রী একত্র হই। সে সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ে আর আমার সঙ্গে কথা বলে। তারপর সে হাইডেন কিংবা মোৎসার্টের সঙ্গীত শোনে। তার ওই সঙ্গীত শ্রবণে কিছু মনে করি না আমি; কিন্তু ওই দুই সঙ্গীতজ্ঞের মধ্যে পার্থক্যের ব্যাপারটা কোনো সময় বলতে ইচ্ছে হয় না তাকে। দু’জনকে একই রকম মনে হয়। আমার। এ কথা আমার স্বামীকে বললে সে জানায়, এতে কিছু যায় আসে না।

“ওগুলো চমৎকার- শুধু ওটাই ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে।”

“ঠিক তোমার মতো।” বলি আমি।

সে বিশাল একটা হাসি দিয়ে বলে, “ঠিক আমার মতো?” মনে হয় যথার্থ খুশি হয়েছে সে।

হ্যাঁ, ওই রকমই ছিল আমার জীবন অথবা বলা যায় নিদ্রাহীনতা শুরু হওয়ার আগের জীবন ওরকম ছিল। সব সময় ডাইরি লিখতাম। দু তিন দিন লেখা বাদ পড়ে গেলে সে দিনের ঘটনা মনে রাখতে পারতাম না। গতকালের ঘটনার জায়গায় হয়ত তার আগের দিনের ঘটনা বা আগের দিনের ঘটনা গতকালের তারিখে লিখে ফেলতাম। কখনো কখনো মনে হতো এ কেমন ধারার জীবন আমার? যখনই ওরকম মনে হতো বাথরুমের আয়নায় নিজের মুখ দেখতাম- একটানা পনের মিনিট ধরে নিজের চেহারা অবলোকন করতাম। আমার মনটা পুরো ফাঁকা লাগত। শরীরী সত্তা হিসেবে নিজের চেহারা দেখতাম। ধীরে ধীরে তা আমার বাকি সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত…।

কিন্তু এখন আর আমি ঘুমাতে পারি না। নিদ্রাহীনতা শুরু হওয়ার পর থেকে আর ডাইরি লিখি না।

প্রথম যে রাতটাতে ঘুমানোর ক্ষমতা হারিয়েছিলাম সে রাতটির কথা স্পষ্ট মনে আছে আমার। একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম যেটা ছিল গা ঘিনঘিন করা, অন্ধকার ছোট একটা স্বপ্ন। বিষয়টা ভুলে গেছি, তবে মনে আছে কী অশুভ আর ভয়ঙ্কর ছিল সেই স্বপ্ন। পরমক্ষণে জেগে উঠেছিলাম। শুরুটা সম্পর্কে পুরোপুরি সজাগ ছিলাম, যেন কোনো কিছু আমাকে পেছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে…।

‘ওটা ছিল এক স্বপ্ন,’ আপন মনে বলি আমি। স্থির শুয়ে থাকি, অনুভব করি আমার হার্ট প্রচণ্ডভাবে কাজ করছে। আমার ফুসফুস হাপরের মতো সংকুচিত হয়ে অতিদ্রুততার সঙ্গে রক্ত সঞ্চালন করছে হৃদপিণ্ডে। আশ্চর্য হয়ে ভাবছিলাম কটা বাজে। বালিশের পাশে রাখা ঘড়িটা দেখতে চাইছিলাম, কিন্তু ঘাড় ঘোরাতে পারছিলাম না। ঠিক তখনই বিছানার কিনারায় অস্পষ্ট, কালো একটা ছায়া আমার চোখে পড়ল। সেই ছায়াটা দেখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালালাম। যখনই তার দিকে দৃষ্টিপাত করলাম তখনই ওটা একটা সুনির্দিষ্ট আকার ধারণ করতে লাগল, যেন আমার দৃষ্টি আকর্ষণের অপেক্ষায় ছিল। ওটার আকৃতি স্পষ্ট হচ্ছিল আর সারবস্তু যুক্ত হচ্ছিল তাতে, তারপর হচ্ছিল পরিপূর্ণ। ওটা ছিল এক কংকালসার এক বুড়ো, পরনে টাইট একটা কালো সার্ট। চুল ধূসর আর ছোট। চোয়াল ভেতরে ঢুকে আছে। সে আমার পায়ের কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল কিছুই বলেনি আমাকে, তবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল স্থির চোখে। চোখগুলো বড় বড়, চোখের শিরাগুলো আমি দেখেছিলাম। বৃদ্ধের চেহারায় কোনো অভিব্যক্তি ছিল না।

ওটা কোনো স্বপ্ন ছিল না, ছিল একটা বাস্তবতা। ওই বৃদ্ধকে কোনো দিনও দেখিনি। কাজেই আমার একটা কিছু করা উচিত ছিল- বাতি জ্বালানো, আমার স্বামীকে ডেকে তোলা কিংবা চিৎকার করা; নড়াচড়া করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। একটা আঙ্গুল পর্যন্ত নাড়াতে পারিনি। যখন ভাবলাম নড়াচড়া করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, এক ধরনের আশাহত ভয় আমাকে গ্রাস করেছিল। এ রকম ব্যাপার আমার জীবনে কখনো হয়নি। চিৎকার করতে চেষ্টা করেছিলাম; কোনো রকম শব্দ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। শুধু বৃদ্ধ লোকটির দিকেই তাকিয়ে থাকতে পেরেছিলাম। তার হাতে ছিল একটা কলস। কিছুক্ষণ পরে সে কলসটি উঁচু করে ধরে আমার পায়ে পানি ঢালতে লাগল। কিন্তু পানি পড়ার শব্দ শুনলেও অনুভব করতে পারলাম না যে আমার পায়ে পানি পড়ছে। সে পানি ঢালতে ঢালতে কলসটা খালি করে ফেলল। ভয় হলো পানির চাপে আমার পা দুটো না গলে যায়। এক সময় তা আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে চোখ দুটো বন্ধ করে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম; কিন্তু ওই শব্দ বেরুল না। আমার শরীরের ভেতরে তা প্রতিধ্বনিত হতে লাগল আর ছিঁড়ে ফেলতে লাগল আমাকে…।

যখন চোখ খুলোম, বৃদ্ধ লোকটি চলে গেছে। কলসটিও নেই। বিছানার চাদর শুকনো, পায়ের পাতা ভেজার কোনো চিহ্ন নেই। ঘেমে নেয়ে উঠেছি। প্রথমে একটা আঙ্গুল নাড়ালাম, তারপর আর একটা, পরে সবক’টা। হাত-পা নাড়লাম, মাথা বাঁকালাম। আগের মতো কাজ করছিল না অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তবুও তো নাড়ানো যাচ্ছিল কিছুটা। বিছানায় উঠে বসলাম। ডিমলাইটের মৃদু আলোতে সারা ঘরে একবার চোখ বুলালাম। বৃদ্ধ লোকটি নিশ্চয়ই আশপাশে নেই।

ঘড়িতে তখন সাড়ে বারোটা বাজছিল। দেড় ঘন্টার মতো সময় ঘুমের মধ্যে ছিলাম। আমার স্বামী অঘোরে নিদ্রা যাচ্ছে যথারীতি। তার নিশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। প্রায় কোনো কিছুই ওই ঘোর নিদ্রা থেকে জাগাতে পারবে না তাকে।

বাথরুমে ঢুকে ভাল করে স্নান করে পরিষ্কার কাপড় চোপড় পরে লিভিং রুমে গিয়ে আলো জ্বালালাম। পুরো এক গ্লাস ব্র্যান্ডি পান করলাম। তার মানে এই নয় যে, আমার স্বামীর মতো অ্যালকোহলের সাথে আমার শারীরিক অসামঞ্জস্য আছে। এক সময় আমি বিস্তর পান করেছি; কিন্তু বিয়ের পর পানাভ্যাস প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। ঘুমটুম না হলে এক-আধটু খাই, তবে আজ মনে হলো পুরো গ্লাস না খেলে আমার স্নায়ু ঠাণ্ডা হবে না। আমার ঘরে সব সময়ই এক বোতল রেমি মার্টিন থাকে। উপহার হিসেবে এ-ও দেয়।

মনে হলো আমার ভেতর একটা ঘোরের সৃষ্টি হয়েছে। ঘোর লাগার ব্যাপারটা আমি আমার কলেজের এক বান্ধবীর কাছে শুনেছিলাম। আমার নিজের এই অভিজ্ঞতা ছিল না। সে বলেছিল, সব কিছুই ছিল দারুণ স্পষ্ট। বিশ্বাসই করা যায় ওটা স্বপ্ন। আমার বিশ্বাসই হয়নি ওটা স্বপ্ন, এখনও আমার মনে হয় না ওটা স্বপ্ন ছিল। স্বপ্নের মতো ছিল ওটা, তবে স্বপ্নের কোনো অনুভূতি ছিল না।

ভয় কেটে গেলেও আমার শরীরের কাঁপুনি তখনও ছিল। আমার চামড়ার ভেতরে চলে গিয়েছিল তা; ভূমিকম্পের পর জলের ওপর ঘূর্ণায়মান তরঙ্গের মতো। চোখ বন্ধ করে মুখভর্তি করে ব্র্যান্ডি নিলাম। গলা থেকে উদর অবধি উষ্ণ করে দিল, একেবারে সত্যিকারের অনুভব।

ছেলের কথা মনে হতেই হৃদকম্পন শুরু হলো। দ্রুত ওর ঘরে গেলাম। মুখের ওপর হাত রেখে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। আমার স্বামীর মতো সুখে নিদ্রায় ডুবে আছে। তার গায়ের কম্বলটা টেনে টুনে দিলাম। আর তখনই প্রচণ্ড ঘুম নেমে এল আমার চোখে। যেন ঘুম হামলা করল আমার ওপর।

লিভিংরুমে ফিরে গিয়ে অবাক হয়ে ভাবলাম ব্যাপারটা, কিন্তু তখন আর আমার মধ্যে সেই ঘুম ঘুম ভাবটা ছিল না। আরও এক গ্লাস ব্র্যান্ডি পানের সিদ্ধান্ত নিলাম। মনে হলো পান করে করে নার্ভগুলোকে ঠাণ্ডা করিয়ে দেই। কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর ওই সিদ্ধান্ত বাতিলের মতলব এল আমার মনে। ফ্রিজ থেকে কয়েকটা স্ট্রবেরি বের করে। খেলাম। অনুভব করলাম শরীরের কাপুনিটা অনেকাংশে কমে গেছে।

কে ছিল ওই বুড়ো লোকটা? জীবনেও তো দেখিনি তাকে। কেন সে আমার পায়ের পাতায় পানি ঢেলেছিলো? শুধু প্রশ্নই ছিল মনে, কোনো উত্তর ছিল না।

আমার বান্ধবীর সেই ঘোরের সময়টাতে ও ছিল তার বাগদত্তার বাড়িতে। ঘুমিয়ে থাকার সময় প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সের একটা লোক এসে হাজির হতো আর তাকে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হুকুম দিত। এ সব যখন ঘটত সে তার কোনো পেশী নাড়াতে পারত না। আমার মতো তার খুব ঘাম হতো। ওর ধারণা ছিল ওই লোকটা ছিল ওর বাগদত্তার বাবা।

কিন্তু আমার মধ্যে কোনো ঘোর নেই। আর আমি আছি নিজের বাড়িতে। এখানে। ধমক ধামকি দেয়ার মতো কেউ নেই। তাহলে ঘোর লাগবে কেন আমার?

তখন নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করি ওটা সত্যিই একটা স্বপ্ন। এর বেশি কিছু নয়। সম্ভবত অবসাদে আক্রান্ত হয়েছি। সেদিন যে টেনিস খেলেছিলাম তার প্রভাবে নিশ্চয়ই হয়েছে এটা। তারপর থেকেই আমার হাত ও পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছিল।

স্ট্রবেরি খাওয়া শেষ হলে সোফার ওপর গা এলিয়ে দিলাম। ঘুম ঘুম লাগছিল না মোটেও। ভাবলাম আবার ক্লান্ত হয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত একটা বই পড়ি। বেডরুমের সেলফ থেকে একটা উপন্যাস বের করে আনলাম। আলো জ্বালানোর সময় আমার স্বামী একবার এদিক-ওদিকও সরলো না। যে বইটি বের করলাম তার নাম ‘অ্যানাকারনিনা। একটা দীর্ঘ উপন্যাস পড়ার মুড তৈরি হয়েছিল আমার মধ্যে। ওই বইটি অবশ্য স্কুল জীবনে একবার পড়েছি। বইয়ের একটি লাইন আমার স্পষ্ট 16 OC All happy families resemble one another, every uphappy family is unhappy in its own way. উপন্যাসের নায়িকা শেষে ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সোফায় শুয়ে বইটি খুলি। বিকেলের দিকে অবসর থাকলে অবশ্য এক-আধ ঘন্টা বই পড়ি। সেটাকে ঠিক পড়া বলা চলে না। তখন সংসারের নানা কথা মাথায় এসে ভিড় জমায়। এসব ভাবতে ভাবতে সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায়, তখন আর বইয়ের পাতায় মনোনিবেশ করা যায় না। এভাবেই বইটই না পড়ে জীবন চলছে আমার। আশ্চর্যের ব্যাপার না। এখন আমার মনে হয় সেই কথা। তরুণ বয়সে বই ছিল আমার জীবনের বড় একটা ব্যাপার। লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়তাম আবার বই সংগ্রহের জন্য আমার মাসিক বরাদ্দের বড় একটা অংশ খরচ হয়ে যেত। এমন কী বই কেনার জন্য নাশতা খাওয়া বাতিল করতে হতো অনেক সময়। আমার পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে এ রকম বই পড়ার নেশা আর কারও ছিল না। বাবা-মা দুজনেই। কাজ করতেন; আমার ওপর কারও মনোযোগ ছিল না। বই পড়ার জন্য অনেক পুরস্কার আর সার্টিফিকেট পেয়েছি। কলেজে আমার বিষয় ছিল ইংরেজি সাহিত্য। ভাল গ্রেডও পেয়েছিলাম। গ্রাজুয়েশন করার সময় ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ডস-এর ওপর থিসিস করেছিলাম। অনার্সে জুটেছিল ভাল ফল। গাইড আমাকে আরও পড়াশুনা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমিও পৃথিবীটা দেখতে বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। তবে জানতাম পাণ্ডিত্য আমার মধ্যে নেই, শুধু পড়তে আমার ভাল লাগত এই আর কী…।

কবে আমার এই পড়ার জীবনের অবসান ঘটে? কেন মানুষের জীবনের এমন আমূল পরিবর্তন ঘটে? আর ওইসব আবেগের কী মূল্য ছিল আমার জীবনে?

তবে ওই রাতে অখণ্ড মনোযোগের সাথে অ্যানাকারনিনা পাঠের মনোবল আমার ভেতর ছিল। মস্কো রেল স্টেশনে অ্যানা আর ভ্রনস্কির মধ্যে কেমন করে পরিচয় ঘটে এক বসায় ওই পর্যন্ত পড়ে ফেলেছিলাম। ওই জায়গাটিতে বুকমার্ক লাগিয়ে আর এক গ্লাস ব্র্যান্ডি ঢালোম। কী অদ্ভুত উপন্যাস। আঠার নম্বর অধ্যায়ের আগে নায়িকার উপস্থিতি নেই। তখন খেয়াল করলাম রাত তিনটা বাজে আর আমার চোখে ঘুমের চিহ্নমাত্র নেই। কী করব আমি? পড়া চালিয়ে যাব? পরে কী ঘটবে তা জানার আগ্রহও আমার প্রবল; কিন্তু ঘুমাতে তো হবে?

অতীতের সেই ইনসমনিয়ার কথা মনে পড়ল। কী ভয়াবহ-ই না ছিল ব্যাপারটা। তখন তো ছাত্রী ছিলাম। একন আমি সংসারী। একজনের স্ত্রী, একজনের মা। আমার দায়িত্ব এখন অনেক। এ অবস্থায় এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে চলবে কেমন করে? এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। ঘুম যখন আসছেই না, বইয়ের বাকি অংশ পড়ে ফেলতে চাই।

সূর্য ওঠার পূর্ব পর্যন্ত বই পড়া অব্যাহত রেখেছিলাম। অ্যানা আর ভ্ৰনস্কি একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ ধরে তারপর বাঁধা পড়ল সর্বগ্রাসী ভালবাসার জালে। প্রনস্কির ঘোড়া যখন ঘোর দৌড়ের রাস্তায় (ঘোড় দৌড়ের) একটা দৃশ্য ছিল ওখানে) পড়ে গেল, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল আর অ্যানা স্বামীর প্রতি আনুগত্যহীনতার কথা স্বীকার করল। তীব্র বেগে ছোটার জন্য ঘোড়াকে যখন তাড়া দিচ্ছিল অনস্কি তখন তার সঙ্গে আমিও ছিলাম। আমি শুনেছিলাম জনতা চিৎকার দিয়ে উৎসাহিত করছে তাকে। জানালায় যখন সূর্যের আলো এসে পড়ল, বই রেখে কফি বানাতে গেলাম। দু টুকরো রুটি নিয়ে মাখন আর পনির লাগিয়ে তড়িঘড়ি স্যান্ডউইচ বানিয়ে ফেললাম। খিদের জ্বালাটা ছিল অসহনীয়। এই ধরনের খিদে। লাগার ব্যাপার সহজে ঘটে না। ওই স্যান্ডউইচ আমার ক্ষুন্নিবৃত্তিতে ব্যর্থ হলে আর একটা স্যান্ডউইচ এবং আর এক কাপ কফি বানিয়ে নিলাম।

আমার ঘোর লাগা বা নিদ্রাহীনতার কথা স্বামীকে জানালাম না। ব্যাপারটা তাকে লুকানোর জন্য না বরং তাকে এসব বলে কোনো লাভ হবে না এই মনোভাব থেকে বিষয়টা তার কাছে চেপে গেলাম। তাছাড়া মোটে তো একদিন ঘুম হয়নি, যে কোনো সময় যে কারও এমন হতে পারে।

আমার স্বামীকে যথারীতি এক কাপ কফি আর ছেলেকে এক গ্লাস দুধ বানিয়ে দিলাম। নাশতায় আমার স্বামী টোস্ট আর ছেলে এক বাটি কর্নফ্লেক খেল। তারপর সেন্ট্রায় চড়ে বিদায় নিল। স্বামীকে বললাম, “সাবধানে যেও,” সে বলল, “ভেবো না।”

তারা চলে গেলে ভাবলাম, সারাটা দিন কী ভাবে কাটাবো? কী করা উচিত আমার? অতঃপর আমি কিচেনে ঢুকে দেখতে লাগলাম কী আছে, কী নেই। রুটি, দুধ, ডিম, মাংস সবই আছে। আছে প্রচুর সবজি। কাল লাঞ্চ পর্যন্ত আর কিছুই লাগবে না। ব্যাংকে কিছু কাজ আছে, পরে করলেও চলবে।

অতএব, সোফায় ফিরে গিয়ে আবার অ্যানাকারনিনার বাকি অংশ পড়তে লাগলাম। পড়া শুরু করার পর টের পেলাম আগে পড়া সব কিছু ভুলে গেছি। কী আশ্চর্য! মনে হচ্ছে পুরো বইটা আবার নতুন করে পড়ছি। পড়া বন্ধ করে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বসলাম। এর কোনো মানেই ছিল না। কী ভাবছিলাম অচিরেই তার খেই হারিয়ে ফেললাম। বুঝলাম জানালার বাইরে একটা গাছের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আবার পড়ায় ফিরে গেলাম।

তৃতীয় খণ্ডের মাঝামাঝি স্থানে বইয়ের পৃষ্ঠার ফাঁকে কিছু চকোলেটের গুঁড়ো পড়ে আছে। হাইস্কুলে পড়ার সময় এই উপন্যাস পাঠের সময় নিশ্চয়ই চকোলেট খেয়েছিলাম। খেতে-খেতে পড়তে ভাল লাগে আমার। বিয়ের পর অবশ্য চকোলেট ছুঁয়ে দেখিনি; আমার স্বামী চায় না আমি মিষ্টি জাতীয় জিনিস খাই। আমাদের ছেলেকেও ওসব খুব একটা খেতে দেই না, বাড়িতে তেমন একটা আনিও না। এক দশক আগের ওই চকোলেটের গুঁড়ো দেখে অ্যানাকারনিনা পড়তে পড়তে চকোলেট খাবার তীব্র বাসনা আমার মধ্যে জেগে উঠল। এক মুহূর্তও তর সইছিল না।

গায়ে একটা কার্ডিগান চাপিয়ে দ্রুত নিচে নেমে গেলাম। কাছের একটা দোকান থেকে সবচেয়ে মিষ্টি কিছু চকোলেট বার কিনে ফেললাম। দোকান থেকে বেরিয়েই প্যাকেট ছিঁড়ে চকোলেট খাওয়া শুরু করলাম। চকোলেটের স্বাদ আমার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। এর মিষ্টতা ছড়িয়ে পড়ল আমার সারা শরীরে।

ফিরে এসে সোফায় গা এলিয়ে দিলাম, তারপর চকোলেট খেতে খেতে অ্যানা কারনিনা পড়তে লাগলাম। আমার ভেতর তখন ঘুমের লেশমাত্র নেই। শারীরিক অবসাদও নেই। তৃতীয় খণ্ড পড়তে পড়তে চকোলেটগুলোর গোটাটাই সাবাড় করে দিলাম। ঘড়ির দিকে তাকাতে দেখলাম- বেলা সাড়ে এগারটা।

শিগগিরই আমার স্বামী ঘরে ফিরবে। তার জন্য লাঞ্চ বানিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম আর ব্রাশ করে মুখ থেকে চকোলেটের ঘ্রাণ তাড়িয়ে দিলাম। আমরা এক সঙ্গে বসে নুডলস্ খেলাম। আমার স্বামী তাদের ক্লিনিকের জন্য নতুন একটা মেশিন আমদানির কথা বলল যা দিয়ে আরও কম সময়ে দাঁতের ময়লা সাফ করা যায়। ওই যন্ত্রের দাম খুব বেশি। তবে ওটা আনলে রোগীও অনেক বেশি পাওয়া যাবে।

“তোমার কী মত?” আমার স্বামী জানতে চাইল, লোকের দাঁতের ময়লার বিষয়ে ভাবার বা শোনার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না বিশেষ করে খাবার সময়ে তো নয়ই। আমার মনে তখন এনস্কির ঘোড়া থেকে পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটি ভাসছিল। কিন্তু তাকে তো আর এসব বলা যায় না। সে এইসব যন্ত্রপাতি আর সরঞ্জামের বিষয়ে খুবই সিরিয়াস। ফলে আমাকে বলতে হলো, প্রয়োজন থাকলে অবশ্যই কিনবে।” বাইরে তখন একটা গাছের ডালে বসে একটা বড় পাখি কিচির মিচির করছিল। অর্ধ চেতন অবস্থায় আমি তা দেখলাম। ঘুমঘুম ভাব আমার ভেতর ততটা ছিল না। কিন্তু কেন? আমি যখন টেবিল পরিষ্কার করছিলাম সে সোফায় গিয়ে বসল আর খবরের কাগজ পড়া শুরু করল। পাশেই রাখা ছিল অ্যানাকারনিনা বইটি। আমার স্বামী খেয়ালই করল না। আমি কী পড়ি-না-পড়ি সে ব্যাপারে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই।

ধোয়া মোছার কাজ শেষ হলে সে বলল, “দুপুরে প্রথম রোগী তার সিডিউল ক্যানসেল করেছে। দেড় ঘন্টা পরে গেলেই চলবে।” এ কথা বলে হাসল সে। একটু পরেই সে উঠে দাঁড়াল। আমাকে কাছে টেনে বেডরুমের দিকে পা বাড়াল। তার মনে কী আছে বুঝতে বাকি রইল না আমার। ওসব মুড আমার একেবারেই ছিল না। এই সময় কেন মিলতে হবে মাথায় এল না আমার। আমি বইয়ে মন লাগাতে চাইছিলাম। কপালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে আমি বললাম, “ভীষণ দুঃখিত, এমন প্রচণ্ড মাথা ধরেছে না…”

এ রকম মাথা ব্যথা আমার প্রায়ই হয়, কাজেই কোনো কথা না বলে সে আমার ব্যাখ্যা মেনে নিল।

“তাহলে বরং শুয়ে একটু রেস্ট নাও, অনেক খাটুনি যাচ্ছে তোমার। আমার স্বামী বলল।

সোফায় শুয়ে শুয়ে সে আবার খবরের কাগজে মন দিল আর সঙ্গীত শুনতে লাগল। দন্ত বিষয়ক যন্ত্রপাতির কথা ওঠাল আবার।

সে চলে যাওয়ার পর ঘরের চারদিকে একবার চোখ বুলালাম; কিন্তু ঘুম কেন আসছে না? অতীতে এত দীর্ঘ সময় জেগে থাকতে হয়নি আমাকে। সাধারণত বেশ ক’ ঘন্টা অতিক্রান্ত হওয়ার পর ঘুম এসেছে অথবা ঘুম হয়নি, এসেছে অসম্ভব ক্লান্তি।…

কিচেনে ঢুকে এক কাপ কফি বানালাম। ভাবলাম, এখন কী করব? একথা সত্য যে, আমার পুরো ইচ্ছে অ্যানাকারনিনা পড়ার; তবে সাঁতার কাটতে সুইমিং পুলেও যেতে চাই। বেশ খানিকটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠার পর সাঁতার কাটতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ব্যাপারটাকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করব জানি না। তবে আমি নিজের দেহটাকে শুদ্ধ করে তুলতে চাই। কিন্তু কী থেকে শুদ্ধ করব? এ নিয়ে ভেবে ভেবে খানিকটা সময় পার করলাম।

সে যা-ই হোক, সাঁতারের পোশাক ব্যাগে পুরে ক্লাবে চলে গেলাম। পুলে তখন। মাত্র দু’জন লোক। এক যুবক আর মাঝ বয়সী এক দ্রলোক, কাউকে চিনি না। বিরক্তিকর চেহারার এক লাইফ গার্ড ডিউটিতে ছিল তখন। প্রতিদিনকার মতো তিরিশ মিনিট সাঁতরালাম। যথেষ্ট মনে না-হওয়ায় আরও পনের মিনিট সাঁতার কাটা গেল। দম ফুরিয়ে আসছিল; অনুভব করলাম শরীরের ভেতর শক্তি তৈরি হচ্ছে।

তখনও তিনটা বাজেনি, কাজেই কিছুক্ষণের জন্য ব্যাংক-এ গেলাম আর কাজ শেষ করে ফিরে এলাম। কিছু কেনাকাটা করার দরকার ছিল। ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করে সোজা বাড়ি ফিরে এলাম। অ্যানাকারনিনা বইটি খুলে পড়তে পড়তে চকোলেটের বাকি অংশ খেতে লাগলাম। ছেলে স্কুল থেকে ফিরলে ওকে এক গ্লাস জুস দিলাম। তারপর ডিনার বানাতে বসে গেলাম। এতসব করলাম যান্ত্রিকভাবে। তারপর আবার ফিরে গেলাম অ্যানাকারনিনার পাতায়। ক্লান্ত লাগছিল না মোটেও।

ঘুমাতে যাওয়ার ভান করে স্বামীর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। বাতি নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে ও ঘুমিয়ে পড়ল, যেন বাতির সঙ্গে ওর মস্তিষ্কের যোগাযোগ আছে অদৃশ্য কোনো সুতোর মাধ্যমে। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার। এ রকম লোক খুব কমই পাওয়া যায়। অধিকাংশ লোকই খুব সহজে ঘুমের রাজ্যে যেতে পারে না। আমার স্বামী একবার ঘুমালে কোনো কিছুই সকালের আগে তাকে জাগাতে পারে না।

মিনিট দশেক তার পাশে শুয়ে থেকে লিভিং রুমে গেলাম; এক গ্লাস ব্র্যান্ডি গ্লাসে ঢেলে সোফায় গিয়ে পড়তে লাগলাম। একটু পরেই সকাল হবে। তখন বই বন্ধ করে কফি বানিয়ে স্যান্ডউইচের সঙ্গে খাব।

ঠিক এ ভাবেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আমার জীবন। তাড়াহুড়ো করে ঘরের কাজকর্ম সারি আর সকালের বাকি সময় কাটাই বই পড়ে। দুপুরের খানিক আগে বই রেখে স্বামীর জন্য লাঞ্চ তৈরি করি। খেয়ে দেয়ে সে চলে গেলে আমি ক্লাবে গিয়ে পুরো এক ঘন্টা সাঁতার কাটি। কারও সঙ্গে দেখা হলে সাধারণ সৌজন্য রক্ষার বাইরে আর কিছুই করি না। সব ধরনের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করি। বলি, “দুঃখিত, বাড়িতে একটা জরুরি কাজ আছে।” কারও সঙ্গে জড়াতে চাই না।

আমার সবকিছুতেই এখন প্রচন্ড গতি- বাজার করা, রান্নাবান্না, ছেলের সঙ্গে খেলা, স্বামীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম। যা আমাকে করতে হয় তা হচ্ছে মন ও শরীরের মধ্যকার সম্পর্ক ভেঙে দেয়া। শরীর যখন কাজ করে মন তখন তার ভেতরের জায়গায় ভাসতে থাকে। মাথার ভেতরে কোনো রকম ভাবনা না নিয়েই সংসারটা চালাই, ছেলেকে খাওয়া-দাওয়া করাই, স্বামীর সঙ্গে গল্প করি।

ঘুম ছেড়ে দেয়ার পর থেকে আমার মনে হয় বাস্তবতা খুব সাধারণ একটা জিনিস আর তা মোকাবিলা করা কত সহজ। এটাই একটা বাস্তবতা। গৃহকর্ম-ঘর-বাড়ি। সাধারণ একটা মেশিন চালানোর মতো একটা ব্যাপার। একবার যদি শিখে ফেলেন তখন দেখবেন, পুনরাবৃত্তি ছাড়া কিছুই নেই এতে।

তারতম্য যে নেই তা নয়। আমার শ্বাশুড়ি আমাদের সঙ্গে ডিনার করেছিলেন। রোববার আমরা চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম। আমার ছেলে প্রচণ্ড ডায়ারিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল। এই ঘটনাগুলোর কোনো প্রভাব আমার মধ্যে ছিল না। নীরব বাতাসের মতো তা আমার জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে।

কেউ খেয়ালই করেনি ঘুমানো আমি পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছি আর পুরো সময় ব্যয় করছি বই পড়ে; মন আমার বাস্তবতার মাটি থেকে শত শত মাইল দূরে অবস্থান করছে। যতই আমি যান্ত্রিকভাবে কাজকর্ম সারি না কেন কিংবা বাস্তবতা মোকাবিলায় কম আবেগ নিয়োজিত করে চলেছি তাতে কিছুই যায় আসেনি। স্বামী-শ্বাশুড়ি বা ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক আছে আগের মতোই; তারা আমার ব্যবহারে আগের চেয়েও বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে।

এ ভাবে চলে যায় এক সপ্তাহ। উপর্যুপরি জাগরণের এই ব্যাপারটি দ্বিতীয় সপ্তাহে পড়লে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। ব্যাপারটাতো আসলে স্বাভাবিক না। বাঁচতে হলে সবাইকেই ঘুমাতে হয়। বছর কয়েক আগে নির্যাতনের ধরন সম্পর্কে পড়েছিলাম। সেখানে ঘটনার যে শিকার তাকে ঘুমাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হতো। ঠিক নাৎসীদের মতো। তারা মানুষকে ছোটছোট ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখত, চোখ বেঁধে ফেলত, আলো ফেলত মুখের ওপর আর বিরতিহীনভাবে জোরে জোরে শব্দ করত। স্বভাবতই এতে কোনো মানুষ পাগল হয়ে যেত কিংবা মারা যেত। ওটা হতে কত দিন লাগত তা মনে নেই, তবে তিন চার দিনের বেশি হবে না। আমার বেলায় তো গোটা একটা সপ্তাহই কেটে গেছে। বাড়াবাড়িই হয়েছে ব্যাপারটা। তারপরও আমার স্বাস্থ্যের কোনো হানি হয়নি। আগের চেয়ে বেশি শক্তি পাচ্ছি।

একদিন গোসলের পর উদোম হয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। অবাক হয়ে আবিষ্কার করি আমার শরীর প্রাণশক্তিতে ফেটে পড়তে চাইছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরীক্ষা করি, কোথাও কোনো বাড়তি মেদ নেই, নেই কোনো ভজ বা বলিরেখা। মনে হচ্ছিল আমার অনুমানের চেয়েও আমি বেশি সুন্দরী। নিজেকে অতীব বিরক্তিজনক রকম সতেজ আর তরুণ লাগছিল। সম্ভবত চব্বিশ অতিক্রম করছিলাম। আমার ত্বক মসৃণ, চোখ উজ্জ্বল, ঠোঁট ভেজা-ভেজা। বসে বসে তিরিশ মিনিট ধরে নিজের চেহারা দেখলাম। প্রত্যক্ষ করলাম বিভিন্ন কোণ থেকে বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে। না, কোনো ভুল হয়নি- সত্যিই আমি সুন্দরী!

কী ঘটছে আমার জীবনে?

ডাক্তার দেখানোর কথা ভাবলাম। একজন ডাক্তার ছিলেন যিনি ছোটবেলা থেকে আমার চিকিৎসা করে আসছেন। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও আছে। কিন্তু তিনি কি বিশ্বাস করবেন আমার কথা? তাকে যদি বলি এক সপ্তাহ ধরে ঘুমাই না তাহলে তিনি হয়ত ভাববেন আমি আস্তো খ্যাপা। কিংবা নিউরোটিক ইনসমনিয়া বলে উড়িয়ে দেবেন ব্যাপারটা; আর যদি তিনি বিশ্বাস করেন পরীক্ষার জন্য আমাকে বড় কোনো রিসার্চ হাসপাতালে পাঠাবেন। তখন কী হবে?

ও সব আমার সইবে না। আমি আমার মতো থাকতে চাই। নীরবে পড়তে চাই আর রোজ সাঁতার কাটতে চাই ঘন্টাখানেক ধরে। স্বাধীনতা চাই আমার, অন্য কোনো কিছুর চেয়ে ওটা বেশি দরকার আমার। হাসপাতালে যেতে চাইনে। কী করবে ওরা? পাহাড়-পাহাড় টেস্ট করাবে আর পর্বত পরিমাণ অনুমান দাঁড় করাবে। তারপর সব খতম। ও রকম একটা জায়গায় গিয়ে বন্দি হতে চাইনে।

এক বিকেলে লাইব্রেরিতে গিয়ে ঘুমের ওপর ক’টা বই পড়লাম। কিছু বই আছে। যার ভেতর একেবারেই কিছু নেই। বাকিগুলোর মধ্যে যা পেলাম তার সারকথা হচ্ছে- ঘুম হইতেছে বিশ্রাম। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করিবার মোন একখানা ব্যাপার। একখানা গাড়ি যদি অনবরত চলিতে থাকে তাহা হইলে আজ কিংবা কাল তাহা বসিয়া যাইবে।… ইঞ্জিনকে বিশ্রাম দিতে হইবে। উহাকে ঠাণ্ডা রাখিতে হইবে। এক সময় তাহা বন্ধ করিয়া দিতে হইবে। এই যে বন্ধ করিবার কথা বলা হইতেছে, তাহাই আসলে ঘুম।…

অন্য এক পুস্তিকায় এক লেখক বলেছেন, ভাবনা চিন্তার প্রক্রিয়ায় আর শারীরিক নড়াচড়ায় মানুষ তার স্বভাবের কারণেই নিজস্ব ধরনের কর্মোদ্যম থেকে বেরিয়ে আসতে অক্ষম। অন্য কথায় বলতে গেলে মানুষ তার নিজের কর্মোদ্যমের কারাগারে বাস করে।

কিন্তু কর্মোদ্যম জিনিসটা কী? নিজেকেই প্রশ্ন করি। আমার দৃষ্টিতে এটা হচ্ছে। গৃহকর্ম- যা অনুভূতিহীন যন্ত্রের মতো আমি প্রতিদিন করে থাকি। রান্নাবান্না করি, বাজারে যাই, কাপড়-চোপড় ইস্ত্রি করি আর মা হিসেবে যাবতীয় কাজ করে যাই–এই ‘কর্মোদ্যম’ যদি না থাকত তাহলে কী হতো? তাহলে হয়ত চোখ বন্ধ করে রাখতে পারতাম। বোতাম টিপতাম, লিভার টানতাম, শিগগিরই টের পেতাম বাস্তবতা দূরে চলে যাচ্ছে। সারাক্ষণ শুধু একই শারীরিক নড়ন চড়ন। কর্মোদ্যম। ক্ষয় করে চলেছে শুধু, জুতোর হিলের মতো। এসবের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য ঘুম দরকার আমার। প্রয়োজন নিজেকে ঠাণ্ডা করার। …লাইব্রেরির টেবিলে বসে মাথা নাড়ালাম আমি।

ঘুমের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে আমার! যদি পাগল হয়ে যাই তাহলে কী হবে? কাজেই ‘সত্তার ভিত্তি’ হারালে কী হবে আমার? কর্মোদ্যম গ্রাস করে ফেলবে না আমাকে। ঘুম জিনিসটা যদি আমার শরীরের ক্ষয় হয়ে যাওয়া জীবনীশক্তি সময়কালিন ক্ষয়পূরণ ছাড়া কিছুই না হয়, তাহলে ওটার আর দরকার নেই আমার। আমার শরীর ক্ষয় হয়ে যেতে পারে; কিন্তু মন জিনিসটা একান্ত আমার। নিজের জন্য এটাকে রাখতে চাই। কাউকে দিতে চাই না। সারাই কিংবা মেরামতি’ হতে চাই না আমি। ঘুমাব না সে-ও ভাল।

নতুন এক দৃঢ়তা মনের ভেতর নিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসি।

না ঘুমানোর জন্য কোনো ভয় এখন আর আমার মনের মধ্যে নেই। ভয়ের কী আছে? সুবিধার দিকগুলো ভাবলেই তো হয়। রাত দশটা থেকে সকাল ছ’টা পুরো সময়টার মালিক আমি একা। নিজের মতো করে সময়টা ব্যয় করতে পারি। কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। কেউ কিছু দাবি করবে না। আমি আমার জীবনটাকে প্রসারিত করেছি।

আপনি হয়ত বলবেন জৈবিকভাবে এটা অস্বাভাবিক। হয়ত আপনার কথা ঠিক। হয়ত এর জন্য ভবিষ্যতে আমাকে মূল্য দিতে হবে। খুব অকপটে বলতে পারি, অল্প বয়সে মরলেও কাউকে অভিশাপ দেব না।

আমার স্বামী ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা পরীক্ষা করে আমি সোফায় গিয়ে বসি আর খানিকটা ব্র্যান্ডি পান করি। তারপর বইটা খুলি। অ্যানাকরনিনা তিনবার পড়েছি। যতবারই পড়েছি ততবারই এর ভেতর নতুন একটা কিছু আবিষ্কার করেছি। এই উপন্যাসটিতে আছে চমকপ্রদ সব ব্যাপার আর রহস্য। চীনা বাক্সের মতো এ উপন্যাসে আছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জগত; আর এগুলোর ভেতর আছে আরও ছোট জগত। আমি যথাযথভাবে জানি মহান লেখক টলস্টয় কী বলতে চেয়েছেন আর ওই বই থেকে পাঠকের কাছে থেকে কী প্রত্যাশা করেছেন।

যতবার সম্ভব অ্যানাকারনিনা পড়া শেষ করে আমি দস্তয়েভস্কি পড়ি। প্রচণ্ড মনোযোগ সহকারে একটার পর একটা বই পড়তে পারি, কখনোই ক্লান্ত হই না। জটিল সব অনুচ্ছেদগুলো চেষ্টা ছাড়াই বুঝে ফেলি আর গভীর আবেগের সঙ্গে সেগুলোতে সাড়া দেই।

মনে হয় বরাবরই আমি এমন ছিলাম। ঘুম ছেড়ে দিয়ে আমি বরং নিজেকে অনেক প্রসারিত করতে পেরেছি। কোনো বিষয়ে পূর্ণ মনোযোগ স্থাপনের ক্ষমতা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই ক্ষমতা অর্জন না করে জীবন যাপন মানে চোখ খোলা রেখে কিছু না দেখা।

আমার ব্র্যান্ডির বোতলটা শেষমেষ খালি হয়ে যায়। পুরো বোতল একাই সাবাড় করে দিয়েছি। দোকান থেকে আরেক বোতল রেমি মার্টিন কিনে আনলাম।

বই পড়ার সময় মাঝে মাঝে আমি অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ি। এ রকম হলে বই রেখে একটুখানি ব্যায়াম করি কিংবা ঘরের ভিতর পায়চারি করি। ইচ্ছে হলে নৈশ-গাড়ি চালনায় বেরিয়ে পড়ি। কফি পানের জন্য কখনো বা সারারাত খোলা থাকে এমন ফাস্টফুডের দোকানে যাই। তবে লোকজন সামলাতে বিস্তর ঝামেলা হয় বলে গাড়িতেই বসে থাকি। নিরাপদ কোনো জায়গায় গাড়ি থামিয়ে মনটাকে এদিক ওদিক পরিক্রমা করতে দেই। অথবা সোজা বন্দরে চলে যাই আর নৌকা দেখি।

এক রাতে তো পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে পড়তে হয় আমাকে। তখন রাত আড়াইটে। রাস্তার একটা বাতির নিচে গাড়ি পার্ক করে গাড়ির স্টিরিওতে গান শুনতে শুনতে চলমান একটা জাহাজের বাতির দিকে তাকিয়েছিলাম। তখন পুলিশটি আমার গাড়ির কাঁচে টোকা মারে। আমি কাঁচ নামাই। দেখতে হ্যান্ডসাম ছিল সে। আমি ব্যাখ্যা করে বললাম রাতে আমার ঘুম আসে না। সে আমার লাইসেন্স পরীক্ষা করে বলল, “দেখুন গত মাসেই এখানে একটা খুন হয়েছে। তিন যুবক এক দম্পতির ওপর হামলা চালায়; পুরুষটিকে খুন করে মহিলাকে রেপ করে তারা। এই ঘটনা কাগজে পড়েছেন হয়ত।” আমি মাথা নাড়াই। “কোনো কাজ না থাকলে রাতে এখানে না আসাই ভাল।” বলল সে। আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওখান থেকে চলে এসেছিলাম।

ওই একবারই রাতে আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল কারও সঙ্গে। সাধারণত রাতের বেলায় ঘন্টাখানেক বা তার চেয়ে কিছু বেশি সময় ধরে রাস্তায় ঘুরে বেড়াই, কেউ আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। তারপর বাড়ি ফিরে গাড়িটা আমার স্বামীর গাড়ির পাশে রাখি। তখন সে তার বিছানায় গভীর ঘুমে অচেতন।

ঘরে ফিরে পরীক্ষা করি আমার স্বামী ঘুমিয়ে আছে কিনা। সব সময়ই ঘুমন্ত অবস্থায় পাই তাকে। আমার ছেলের কাছেও যাই- তাকেও সব সময় ঘুমুতে দেখি। তারা আমার ব্যাপারে কিছুই জানে না; ভাবে পৃথিবীটা যেমন ছিল তেমনই আছে। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল ছিল। আমি এমনভাবে বদলে যাচ্ছিলাম যে, তারা কিছু আন্দাজই করতে পারেনি। দ্রুত বদলে যাচ্ছিলাম আমি। কিছুতেই আগের মতো হতে পারব না।

এক রাতে ধড়াস করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে স্বামীর ঘরে ছুটে গেলাম। ঘুমের মধ্যে সম্ভবত ঘড়িটা ফেলে দিয়েছে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে। কী ঘটেছে টেরও পায়নি। ঘড়িটা উঠিয়ে টেবিলে রেখে স্বামীর মুখের দিকে তাকাই। কতদিন যাবৎ বছরের পর বছর? বিয়ের পরপর এভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম আমি। ওটা স্বস্তির একটা ব্যাপার ছিল আমার। একটা শান্তির আবহ তৈরি করত- নিজেকে বলতাম এমন শান্তিতে যতক্ষণ সে ঘুমাবে ততক্ষণ নিরাপদ থাকব আমি। এ কারণেই তার ঘুমন্ত চেহারা দেখার জন্য অনেকটা সময় ব্যয় করেছি। পরে অবশ্য এ অভ্যাস ছেড়েছি। কিন্তু কবে থেকে? সম্ভবত সেই সময় থেকে যখন ছেলের নাম দেয়া নিয়ে শ্বাশুড়ির সঙ্গে আমার একটুখানি ঝগড়া মতোন হয়েছিল। কিছু উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছিল আমাদের মধ্যে; কিন্তু আমার স্বামী কাউকে কিছু বলতে পারেনি। সে শুধু আমাদেরকে শান্ত করার চেষ্টা নিয়েছিল। সেদিন থেকেই আমার ভেতর এই অনুভূতির সঞ্চার হয় যে, আমার স্বামী আমার রক্ষাকর্তা নয়। সে অবশ্য অনেক দিন আগের ব্যাপার। শ্বাশুড়ির সঙ্গে আমার আপসরফা হয়ে গিয়েছিল; আমার ইচ্ছে অনুযায়ী ছেলের নাম দিয়েছিলাম। স্বামীর সঙ্গেও কোনো সমস্যা বাঁধেনি এসব নিয়ে।

তাকে প্রায়ই ঘুমুতে দেখি। শান্তিতেই ঘুমায় সে। সব সময়। তাকে দেখতে দেখতে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে আমার ভেতর থেকে। খুব বড় একটা শ্বাস। তাতে খানিকটা শব্দও ছড়ায়; কিন্তু একটু নড়াচড়াও করে না সে। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ আর শব্দময় কোনো শ্বাসও জাগাতে পারবে না তাকে।

বেডরুম থেকে বেরিয়ে লিভিং রুমে যাই। গ্লাসে খানিকটা ব্র্যান্ডি ঢেলে নিয়ে পড়তে শুরু করি। কিন্তু পাঠে মন বসাতে পারি না কেন যেন। বই রেখে ছেলের ঘরে যাই। বাইরে থেকে চুঁইয়ে আসা আলোয় তার দিকে তাকাই। আমার স্বামীর মতো সে-ও গভীর নিদ্রায় অচেতন। সব সময়ই এ রকম নিবিড় নিদ্রায় ডুবে থাকে সে। আমি তাকে ঘুমাতে দেখি। তারপরও ওর ঘুমন্ত মুখ দেখে উদ্বিগ্ন হই। এমন তো হয়নি আগে? কেন হচ্ছে এমন? হাত ভাঁজ করে ওর শয্যা পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। হ্যাঁ, ভীষণ ভালবাসি ওকে। তার পরেও কী যেন একটা আমার ভেতর খটকার সৃষ্টি করে। স্নায়ুকে আঘাত করে। চোখ বন্ধ করে ফেলি। চোখ খুলে আবার ওর দিকে তাকাই। তখনই আঘাতটা আসে। যে ব্যাপারটা আমাকে উদ্বিগ্ন করে তোলে তা হচ্ছে, ওর চেহারাটা ঠিক আমার স্বামীর মতো। ঠিক আমার শ্বাশুড়ির মতো। এক খুঁয়ে আর জেদী। আত্মতুষ্ট। এক ধরনের ঔদ্ধত্য ওদের রক্তের ভেতরই আছে। একথা সত্য আমার স্বামী আমার কাছে খুব ভাল। সে ভদ্র, শান্তশিষ্ট আমার প্রতি যত্নবান, অন্য স্ত্রীলোকদের প্রতি আসক্তি নেই; কঠোর পরিশ্রম করে। আমার বান্ধবীরা সব সময়ই বলে এ রকম একজন স্বামী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কেননা ব্যাপারে কখনো দোষ দিতে পারি না ওকে। আসলে এটাই আমার মর্মপীড়ার কারণ।…

ছেলেটাকে আমার আগম্ভক মনে হয় শেষ অবধি। বড় হওয়ার পরও সে মনে হয় আমাকে বুঝতে পারবে না। যেমন বুঝতে পারে না আমার স্বামী। ছেলেকে যে ভালবাসি তাকে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু আমার মনে হয় এ রকম তীব্রতা নিয়ে কোনো দিন ওকে হয়ত ভালবাসতে পারব না। মা সুলভ ভাবনা নয় এটা। অধিকাংশ মা-ই এমন ভাবতে পারবে না। কিন্তু ঘুমন্ত ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয়, একদিন নির্ঘাত ওকে আমি ঘৃণা করব।

এই ভাবনা আমাকে প্রচণ্ডভাবে বিষণ্ণ করে তোলে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে লিভিংরুমে ফিরে আসি। কয়েক পাতা বই পড়ে ঘড়ির দিকে তাকাই, তিনটে বাজতে অল্প কিছু বাকি।

অবাক হয়ে ভাবি, কতদিন ঘুমাই না? গত সতের দিনে এক ফোঁটাও ঘুমাইনি; সতের দিন সতের রাত। ফেলে দেয়ার মতো সময় না। ঘুম জিনিসটা কী কল্পনাও করতে পারি না এখন। চোখ বন্ধ করে ঘুমের অনুভূতিটা স্মরণে আনার চেষ্টা করি; কিন্তু জাগ্রত-অন্ধকার ছাড়া কিছুই অনুভূত হয় না। মৃত্যুর মতো মনে হয় এটাকে।

তাহলে কী আমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে?

এখন যদি মারা যাই, তাহলে আমার জীবনের হিসাব কী করে গণনা করা হবে? এর উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। ঠিক আছে, তাহলে কোন মৃত্যু এসে হানা দেবে?

এখন পর্যন্ত ঘুমকে মৃত্যুর একটা মডেল বলে মনে হয় আমার কাছে। মৃত্যুকে ঘুমের প্রসারণ বলে কল্পনা করেছি। সাধারণ নিদ্রার চেয়ে আরও অনেক বেশি গভীর নিদ্রা। সম্পূর্ণ চেতনাবিহীন ঘুম। চিরন্তন বিশ্রাম। সম্পূর্ণ আঁধার।

কিন্তু আমার মনে হয় ভুল ছিল আমার ধারণা। মৃত্যু এমন এক অবস্থা যা ঘুমের মতো নয়, এর প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা- গভীর, অফুরান, জাগ্রত অন্ধকারের মতো যা এখন আমি প্রত্যক্ষ করছি। কিন্তু মৃত্যু কেমন কেউ জানে না। কে দেখেছে তা? কেবল মৃতদের পক্ষেই তা দেখা সম্ভব হয়েছে। জীবন্ত কেউই মৃত্যু সম্পর্কে জানে না, শুধু অনুমান করতে পারে…।

আমার চোখ দুটো এখনও বন্ধ। চোখ খোলার শক্তি আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমার সামনে দণ্ডায়মান গভীর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছি। একা। মনে গভীর অভিনিবেশ আর প্রসারমানতা। ইচ্ছে করলেই পৃথিবীর গভীরতম প্রদেশে চলে যেতে পারি। কিন্তু শিগগির যেতে চাই না সেখানে।

মৃত্যু যদি এমন-ই হয়, মৃত্যু যদি হয় অনন্ত জেগে থাকা আর এইভাবে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকা, তাহলে কী করব আমি?

শেষ পর্যন্ত চোখ দুটো খুলতে সক্ষম হলাম। গ্লাসের অবশিষ্ট ব্র্যান্ডিটুকু পান করতে পারলাম।

পাজামা খুলে জিন্সের প্যান্ট আর টিশার্ট পরলাম। চুল বিন্যস্ত করে মাথায় দিলাম আমার স্বামীর একখানা ক্যাপ। আয়নায় দেখলাম আমাকে ছেলেদের মতো লাগছে। নরম সোলের জুতো পরে গ্যারেজে এলাম। স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় গাড়ি নামালাম।

রাত তখন তিনটে। তবুও রাস্তায় গাড়ির কমতি নেই। গাড়ির রেডিও শুনতে শুনতে বন্দরের দিকে এগুলাম। ক্ল্যাসিকাল সঙ্গীত শুনতে ইচ্ছে করছিল; কিন্তু কোনো স্টেশনই তা বাজাচ্ছে না। বাজছে অতিবাজে জাপানি রক সঙ্গীত। কান। পচানোর জন্য প্রেমের গান খুব ভাল। বাধ্য হয়েই ওসব শুনতে হচ্ছিল। আমি অনেক দূরের কোনো জায়গায় চলে এসেছি; মোৎসার্ট আর হাইডেন থেকে অনেক দূরে।

অর্ধ চৈতন্যের ভেতর আমি আশপাশের অন্ধকারের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। কলেজে পড়বার সময় এক ছেলে বন্ধুর সঙ্গে গাড়ি চালিয়ে কোথাও যাবার ঘটনা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগলাম। সে আমার ভেতরে প্রবেশ করতে চেয়েছিল; আমি রাজি হইনি। স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে গান শুনতে শুনতে সেই দৃশ্য মনে আনার চেষ্টা করলাম; কিন্তু তার মুখটি কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। মনে হলো ওই ঘটনাটা ঘটেছে। অনেক-অনেক দিন আগে। ঘুম আমার জীবন থেকে বিদায় নেয়ার আগে আমার যে স্মৃতি আছে তা যেন অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে মিলিয়ে যাচ্ছে, এমন অদ্ভুত লাগছে যে, যে- আমি প্রতিরাতে ঘুমাতে যেতাম সেই আমি প্রকৃত আমি নই। আর সেই স্মৃতিগুলো যেন আমার নয়। মানুষের মধ্যে এভাবেই পরিবর্তন আসে; কিন্তু কেউ তা বুঝতে পারে না। কেউ তা খেয়ালও করে না। কেবল আমিই জানি কী ঘটেছে। আমি সেগুলো বলার চেষ্টা করেছি; কিন্তু তারা বোঝেনি। তারা বিশ্বাস করেনি আমাকে। বিশ্বাস করলেও আমি কী অনুভব করেছি সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। তারা তাদের আবেশমূলক বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে আমাকে হুমকি বলে মনে করেছে।

তবে আমার ভেতর পরিবর্তন ঘটছে, সত্যিই ঘটছে তা। স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে কতক্ষণ যাবৎ আমি এসইব ভেবে চলেছি? কতক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছি নিঘুম অন্ধকারের দিকে।

হঠাৎ মানুষের সাড়া পেয়ে নিজের মধ্যে ফিরে আসি। কে যেন আছে বাইরে। চোখ খুলে চারদিকে তাকাই। গাড়ির বাইরে মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করছি। গাড়ির দরজা লক করা। দু’পাশে গভীর অন্ধকার। বাইরে আছে যারা তাদের চেহারা বা পোশাক-আশাক দেখা যাচ্ছে না; শুধু দু’টি অন্ধকার ছায়া দাঁড়িয়ে আছে।

ওদের দুজনের মাঝখানে আমার হোন্ডা-সিভিক গাড়িটাকে ক্ষুদ্রাকার পেস্ট্রির বাক্সের মতো মনে হচ্ছে। দু’দিক থেকে দুলছে গাড়িটা। ডানের জানালায় ঘুষি মারার শব্দ হচ্ছে। জানি পুলিশের লোক নয় ওরা। তারা গাড়ির জানালায় কখনো। এভাবে কিল ঘুষি মারে না কিংবা গাড়ি আঁকায় না। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে আমার। এখন কী করব? ভাবতেই পারি না। বোগলের নিচটা ঘামে ভিজে যাচ্ছে। এখান থেকে দ্রুত চলে যেতে হবে। চাবি খুঁজি। ডানদিকে মোচড় দেই। স্টার্ট নেয় না। আমার হাত কাঁপতে থাকে। চোখ বন্ধ করে আবার চাবি ঘোরাই। কোনো কাজ হয় না। লোকগুলো অন্ধকারের মধ্যে আমার গাড়ি ঝাঁকিয়ে চলেছে ক্রমাগত। উল্টে ফেলে দিতে চাচ্ছে।

কোনো ভুল হচ্ছে না তো? শান্ত হও, ভাবো, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাবো, একটুখানি ভাবো। ধীরে ধীরে। সতর্কতার সাথে। কোথাও ভুল হচ্ছে। নির্ঘাত। কিন্তু কী? জানি না। গাঢ় অন্ধকার মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। হাত দুটো কাঁপছে। একবার চাবি ঢোকাচ্ছি আবার বের করে আনছি। কিন্তু কীহোলে যথাযথভাবে ঢুকছে না চাবিটা। বার বার চেষ্টা করি, চাবিটা পড়ে যায়। তুলতে চেষ্টা করি। পারি না। গাড়িটা আগুপিছু করে দুলছে। স্টিয়ারিং হুইলের সঙ্গে মাথাটা ঠুকে গেল। চাবিটা আর খুঁজেই পেলাম না। দু’হাতে মুখ ঢেকে সিটের পেছনে এলিয়ে পড়লাম। কাঁদতে লাগলাম। এ ছাড়া করার আর কিছুই ছিল না। চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। যেন একটা বাক্সের ভেতর আটকা পড়েছি, বেরুতে পারছি না। এখন মধ্যরাত। লোক দুটো তখনও গাড়িটা ঝাঁকিয়ে চলেছে, এক সময় হয়ত উল্টে ফেলবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *