বেকারিতে দ্বিতীয়বার হামলা

বেকারিতে দ্বিতীয়বার হামলা

বেকারিতে হামলা করার ঘটনাটি স্ত্রীকে বলা ঠিক ছিল কিনা এখনও নিশ্চিত নই আমি। কিন্তু তখন হয়ত ঠিক-বেঠিকের প্রশ্নটিই ওঠেনি। এ বাবদে বলা যায়, ভুল পছন্দ যথার্থ ফল বয়ে আনতে পারে আবার এর ঠিক উল্টোটাও ঘটতে পারে। আমি অবশ্য নিজেই অবস্থান নির্ধারণ করি- আসলে আমরা কখনোই কিছু পছন্দ বা বাছাই করি না। ঘটনা ঘটে যায় অথবা ঘটে না।

ব্যাপারটা যদি এভাবে দেখেন, তাহলে বলতে হয় বেকারিতে হামলার ঘটনাটি বলার বিষয়টি ওভাবেই ঘটে গিয়েছিল। ওই ঘটনা প্রকাশ করে দেয়ার ব্যাপারে আমার কোনো পরিকল্পনা ছিল না… ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম…কিন্তু তা এইমাত্র আপনি যা বললেন এমন বিষয় ছিল না।

যে-কারণে বেকারিতে হামলার ঘটনাটি আমার মনে আছে তা হলো সহ্য করা কঠিন এমন প্রচণ্ড ক্ষুধা। ব্যাপারটা শুরু হয় রাত দুটো বাজার খানিকটা আগে। সন্ধ্যে ছ’টার দিকে রাতের খাবার খেয়েছিলাম। বিছানায় গিয়েছিলাম সাড়ে নটার সময়। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যে কোনো কারণেই হোক ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। কয়েক মিনিট পর দ্য উইজার্ড অব দ্য ওজ- এর ঝড়ের মতো আকস্মিক তীব্র বেদনার আঘাত আসে। প্রচণ্ড খিদে আমাদের গ্রাস করে ফেলে।

ফ্রিজে এমন কিছুই ছিল না যাকে সত্যিকারভাবে খাদ্য বলা যায়। থাকবার মধ্যে ছিল কয়েক বোতল ফরাসি তরল মশলা, ছয় ক্যান বিয়ার, গোটা দুয়েক পেঁয়াজ আর এক খণ্ড মাখন। মাত্র দু’ সপ্তাহ আগে আমাদের বিয়ে হয়েছে। কী খাব-না-খাব এ বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তেমন সমঝোতাও গড়ে ওঠেনি এখনও।

সে সময় আমি চাকরি করতাম একটা ল’ফার্মে আর সে সেক্রেটারির কাজ করত একটা ডিজাইন স্কুলে। আমার বয়স তখন আটাশ কিংবা উনত্রিশ… কেন আমি আমার বিয়ের সঠিক বছর মনে করতে পারছি না? আমার স্ত্রী আমার চেয়ে দু’ বছর আট মাসের ছোট। আমাদের মনের মধ্যে সর্বশেষ যে বস্তুটি ছিল তা হচ্ছে মুদিখানার জিনিস।

আমরা দুজনেই এতো ক্ষুধার্ত ছিলাম যে, ঘুমুতে যেতে পারছিলাম না। শুয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। ক্ষুধার তাড়নায় দরকারি কোনো কাজকর্ম করাও সম্ভব হচ্ছিল

আমাদের পক্ষে। বিছানা থেকে নেমে আমরা রান্নাঘরের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। এ রকম প্রচণ্ড খিদের জ্বালা কেন হচ্ছে?

আমরা বার বার ফ্রিজ খুলতে লাগলাম। যতবারই খুলছিলাম ভেতরে ওই একই জিনিসের অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম। বিয়ার, মাখন আর পেঁয়াজ। মাখন দিয়ে অবশ্য পেঁয়াজ ভাজা যায়, কিন্ত শুকিয়ে যাওয়া ওই দুটি পেঁয়াজ দিয়ে তো আর উদরপূর্তি সম্ভব নয়। পেঁয়াজ খেতে হয় অন্য খাবারের সঙ্গে। এ ধরনের খাবারে কারও ক্ষুন্নিবৃত্তি ঘটে না।

আমি বললাম, “চলো গাড়িতে করে সারারাত খোলা এ রকম একটা রেস্তোরাঁ খুঁজে বের করি। হাইওয়ের পাশে পাওয়া যেতে পারে।” আমার ওই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে সে বলল, “না না খাওয়ার জন্য এই মাঝ রাতের পর বাইরে বেরুব নাকি।” এ সব বাবদে তাকে খুব প্রাচীনপন্থী বলে মনে হলো।

একটুখানি শ্বাস গ্রহণ করে আমি বলি, “আমারও তাই মনে হয়।”

আমার স্ত্রীকে যখন এ রকম একটা মত (কিংবা থিসিস) প্রকাশ করল আমার কানে তা কোনো গুপ্ত সংবাদ প্রকাশের অনুমোদন হিসেবে প্রতিধ্বনিত হলো। আমার তখন মনে হতে লাগল, এটা একটা বিশেষ ধরনের ক্ষুধা যা সারারাত খোলা থাকে এমন রেস্তোরাঁয় গিয়ে নিবৃত্ত করা সম্ভব নয়।

এক বিশেষ ধরনের ক্ষুধা। কী হতে পারে এটা? চলচ্চিত্রের চিত্রকল্পের মাধ্যমে যা প্রকাশ করা যেতে পারে? এক- আমি একটা ছোট্ট নৌকায় বসে আছি, শান্ত নিথর সমুদ্রে ভাসছে নৌকাটি। দুই- আমি পানির দিকে তাকিয়ে দেখি, একটি আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ সমুদ্রের তলদেশ থেকে ওপরে উঠে আসছে। তিন আগ্নেয়গিরির চূড়াটি পানির উপরিভাগের খুব কাছে, কত কাছে বলতে পারব না। চার- এটা ঘটছে কারণ, পানির অতিরিক্ত স্বচ্ছতা দূরত্বের ধারণাকে ব্যাহত করছে।

এটা হচ্ছে চিত্রকল্পের যথাযথ বর্ণনা, সারারাত খোলা থাকে এমন রেস্তোরাঁয় যেতে আমার স্ত্রীর অস্বীকৃতির দুই কিংবা তিন সেকেন্ডের মধ্যে আমার মাথায় এসেছিল।

আমরা শেষ পর্যন্ত একটা কাজই করেছিলাম তা হচ্ছে বিয়ারের ক্যান বের করেছিলাম। পেঁয়াজ ভক্ষণ করার চেয়ে ঢের ভাল এটা। আমার স্ত্রী বিয়ার তেমন একটা পছন্দ করে না বলে ওকে দুটি দিয়ে চারটি আমি নিলাম। আমি যখন বিয়ারে মগ্ন সে কাঠবিড়ালের মতো রান্নাঘরের শেভ তন্নতন্ন করে খুঁজে বাটারকুকির একটা প্যাকেট বের করল যার ভেতর চারটি কুকি পাওয়া গেল। ফেলে দেয়া জিনিসের মতো ছিল ওগুলো। নরম আর ভারী হয়ে গিয়েছিল অনেকদিন পড়ে থাকায়। তাতে কী, আমরা দুজনে দুটো করে দিব্যি গ্রাস করে ফেললাম।

কোনো কাজই হলো না। আমাদের উদর সিনাই উপত্যকার মতো শুকিয়ে কাঠ হয়েছিল ফলে ওই দুটো বাটারকুকি কোথায় তলিয়ে গেল টেরই পাওয়া গেল না।

“এতো খিদে আমার জীবনেও কোনো দিন লাগেনি,” আমার স্ত্রী বলল, “বিয়ে হওয়ার সাথে এর কোনো সম্পর্ক আছে নাকি তাই ভাবছি।”

“থাকতে পারে।” আমি বললাম, “আবার না-ও থাকতে পারে।”

সে যখন আরও কিছু খাবারের সন্ধান করছিল আমি তখন আমার নৌকার কিনারায় ঝুঁকে পানির নিচে আগ্নেয়গিরির দিকে তাকালাম। নৌকার চারদিকে সমুদ্রের পানির স্বচ্ছতা আমার ভেতর এক অনির্ণীত অনুভূতির জন্ম দিল, যেন আমার নাভিকুণ্ডের পেছনে কোনো এক স্থানে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে–অদ্ভুতভাবে বন্ধ করে দেয়া একটা গুহা যার না আছে প্রবেশ পথ কিংবা বেরুবার রাস্তা।

তখন হঠাৎ করেই আমার মনের ভেতরে খেলে গেল, আগেও আমার এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তখনও আমার উদর একেবারে শূন্য ছিল… কিন্তু কবে, কখন? হা হয়েছিল এমনটা, নির্ঘাত…

নিজেকে তখন আমি বলতে শুনলাম, “বেকারিতে হালমার সময়!”

“বেকারিতে হামলা? বলছ কী এসব?”

“হ্যাঁ ঠিকই বলছি। সে অনেকদিন আগের কথা। একদিন একটা বেকারিতে হামলা করেছিলাম। বেশি বড় ছিল না বেকারিটা। তেমন বিখ্যাত-ও নয়। ওদের রুটিগুলো বিশেষ ধরনের কিছু ছিল না। আবার একেবারে যে বাজে ছিল তা-ও না। দোকানগুলোর পাশের এলাকার একটা সাদামাটা বেকারি বলতে পার। সাধারণ একটা লোক বেকারিটা চালায়। নিজেই সবকিছু করে। সকালের দিকে রুটি বানায়, বেচাকেনা হয়ে গেলে দোকান বন্ধ করে দেয়।”

“হামলাই যখন করবে তাহলে ওই বেকারিটাকে বেছে নিয়েছিলে কেন?”

“ভালকথা। একটা বড় বেকারিতে হামলা করার কোনো মানেই হয় না। আমাদের দরকার ছিল কয়েকটা রুটির টাকা-পয়সা নয়। আমরা ছিলাম হামলাকারি, ডাকাত নয়।”

“আমরা মানে? আমরা কারা?”

“আমার তখনকার এক বেস্ট ফ্রেন্ড। দশ বছর আগের ব্যাপার। তখন আমাদের অবস্থা এত খারাপ ছিল যে, টুথপেস্ট কেনার পয়সাও থাকত না হাতে। প্রয়োজনীয় খাবারও জোটাতে পারতাম না। খাবার জোগাড় করার জন্য যেসব জঘন্য কাজ আমাদেরকে করতে হয়েছে, বেকারিতে হামলা তার অন্যতম।”

আমার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে আমার স্ত্রী বলল, “কোনো কাজকর্ম জোগাড় করে নিলে না কেন? স্কুলের পরে তো কাজ করার সুযোগ থাকে। বেকারিতে হামলার চেয়ে সহজ ছিল তা।”

“কাজ করার কোনো ইচ্ছে আদৌ আমাদের ছিল না।”

“বেশ। এখন তো দিব্যি কাজ করছ, কি করছ না?”

আমি মাথা নেড়ে আরও একটুখানি বিয়ার খেলাম। তারপর চোখ ঘষলাম। এক ধরণের বিয়ার-বিয়ার টাইপের কাদা আমার মস্তিষ্ক পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত করে তুলছিল আর তা ক্ষুধার ব্যথার সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছিল।

“সময় বদলায়, বদলায় মানুষ,” বললাম আমি, “চল শুয়ে পড়ি, কাল আবার সকালে উঠতে হবে।”

“ঘুম আসছে না আমার। তোমার বেকারি হামলার গল্পটা শুনতে চাই।”

“বলবার মতো তেমন কিছু নেই। কোনো অ্যাকশন কিংবা উত্তেজনা কিছুই ছিল ওতে।”

“সফল ছিল তো হামলাটা?”

ঘুমানোর আশা ছেড়ে দিয়ে আরেকটা বিয়ারের ক্যান খুলোম। একবার কোনো গল্পে মজা পেলে তা না শুনে ছাড়েনা সে, এমনি স্বভাব তার।

“হ্যাঁ এক ধরনের সাফল্য তো ছিলই। আবার অসাফল্যও ছিল। আমরা যা চেয়েছিলাম পেয়েছিলাম তা। তবে হুমকি দিয়ে কাজ হাসিলের বিষয়টি মাঠে মারা যায়। ছিনিয়ে নেয়ার আগেই বেকারির মালিক আমাদের রুটি দিয়ে দেয়।”

“দাম না-নিয়ে দিয়েছিল?”

“ব্যাপারটা ঠিক ওরকম ছিল না। ওটাই গল্পের কঠিন দিক বুঝলে কিনা?”

বললাম আমি, “বেকারির মালিক ছিল ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতের একজন ভক্ত। আমরা যখন তার বেকারিতে ঢুকি সে তখন ভাগনারের একটি রেকর্ড শুনছিল। আমাদের সঙ্গে একটা চুক্তিতে এল সে তখন। আমরা যদি তার সঙ্গে ওই সঙ্গীত শ্রবণ করি তাহলে সে মুফতে আমাদের ইচ্ছেমতো রুটি নিতে দেবে। আমি আমার সঙ্গীর সঙ্গে শলা করে তার প্রস্তাবে সম্মতি জানাই। এতে কোনো পক্ষেরই কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। অতএব আমরা ছুরিটুরি লুকিয়ে ফেললাম। দু’জনে দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম আর টানহাউসার এবং ফ্লাইংডাচম্যান শীর্ষক দু’খানা যন্ত্র সঙ্গীত শ্রবণ করলাম।”

“তারপরেই রুটিগুলো পেয়ে গেলে?”

“ঠিক তাই। ব্যাগে যতগুলো ধরল নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলাম। চার-পাঁচ দিন পেটপুরে খাওয়া হয়েছিল আমাদের।” আমি আর এক চুমুক বিয়ার পান করলাম। সমুদ্রের তলদেশ থেকে আসা ভূমিকম্পের নিঃশব্দ ঢেউয়ের মতো আমার নিদ্রালসা নৌকাটাকে দীর্ঘ ও মন্থর দোলা লাগাল।

“অবশ্যই আমরা আমাদের মিশন সফল করেছিলাম। রুটি পেয়েছিলাম। তবে এ কথা বলা যাবে না, আমরা অপরাধ করেছিলাম। ওটা ছিল এক ধরনের বিনিময়। ভাগনারের সঙ্গীত শোনার কারণে রুটিগুলো পেয়েছিলাম। আইনসঙ্গতভাবে বলতে গেলে বাণিজ্যিক লেনদেনের চেয়েও বেশি কিছু ছিল ব্যাপারটা।”

“কিন্তু সঙ্গীত শোনাটা তো কোনো কাজ নয়।”

“না, সে তো ঠিকই। বেকারির মালিক যদি আমাদেরকে থালা-বাসন মাজতে বলত কিংবা ঘরদোর সাফ করতে বলত আমরা করতাম না। সে তা করেনি। সে শুধু ভাগনারের সঙ্গীতের রেকর্ডখানা প্রথম থেকে শেষ অবধি শুনতে বলেছিল আমাদের। কেউ আসলে ব্যাপারটা আন্দাজ-ই করতে পারেনি। ভাগনারের সঙ্গীতের। কথা বলছি আর কী। ওই অভিশাপটা আমাদের ওপর চাপিয়ে ছিল বেকারির মালিক। এখন আমার মনে হয়, তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা উচিত ছিল আমাদের। চাকু দেখিয়ে রুটি নিয়ে ভেগে পড়া উচিত ছিল, তাহলে কোনো সমস্যা হতো না।”

“কোনো সমস্যা হয়েছিল নাকি তোমাদের?”

আমি আবার চোখ রগড়াই।

“সামান্যই। ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না তা। তবে এরপর থেকেই সবকিছু বদলাতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি হই আবার। গ্রাজুয়েশন করি। ল’ ফার্মে কাজ নিয়ে আইন পরীক্ষাটা দেই। তোমার সঙ্গে দেখা হয় আর বিয়ে করি তোমাকে। ও রকম কাজ অবশ্য আর কখনো করিনি।”

“তাই বল।”

বিয়ারের গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে বলি, “সব ঘটনাই তোমাকে বলা হয়ে গেল।”

“তোমার সেই বন্ধুটি কী করছে এখন?”

“জানি না। কিছু একটা ঘটেছিল, কিছুই না ধরনের ব্যাপার আর কী। আমরা অবশ্য একসাথে ঘোরাঘুরি করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তারপর থেকে ওর সঙ্গে দেখা হয় না। জানি না কী করছে সে এখন।”

খানিকক্ষণের জন্য কোনো কথা বলল না সে। সম্ভবত সে বুঝতে পেরেছে পুরো কাহিনী আমি তাকে বলিনি। কিন্তু সে এসব নিয়ে আমার ওপর চাপ সৃষ্টিতে তৈরি ছিল না।

“সেই কারণেই তোমাদের সম্পর্ক ভেঙে গেল? বেকারিতে হামলাই ছিল মূল কারণ।”

“হতেও পারে। আমাদের উপলব্ধির চেয়েও ব্যাপারটা বেশি তীব্র ছিল বলে ধারণা করি। ওই ঘটনার পরে রুটির সঙ্গে ভাগনারের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছিলাম আমরা। পরস্পরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কাজটা কি আমরা ঠিক করেছিলাম। কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারিনি। ন্যায়সঙ্গতভাবে দেখলে আমরা সঠিক ছিলাম। কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি। প্রত্যাশা অনুযায়ী সবাই পেয়েছে।

“তারপরও আমার ধারণা একটা মারাত্মক ভুল আমরা করেছিলাম। এ কারণেই আমি অভিশাপ শব্দটি প্রয়োগ করেছিলাম। সত্যিই এটি একটি অভিশাপ।”

“তুমি কি মনে কর ওই অভিশাপ এখনও আছে?”

“জানি না। বাজি ধরে বলা যায় এই পৃথিবী অভিশাপে ভরা। কোন অভিশাপের কারণে ভুলভ্রান্তি ঘটে বল শক্ত।”

আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, “তা ঠিক নয়। বিষয়টা নিয়ে ভেবে থাকলে বলতে পার আমাকে। তুমি নিজে অভিশাপটি ভেঙে না দিলে দাঁতের ব্যথার মতো তা চেপে বসবে আর ক্রমাগত পীড়া দেবে তোমাকে। শুধু তোমাকে নয়, আমাকেও।”

“তোমাকে?”

“হ্যাঁ, কেননা আমিই এখন তোমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু, তাই না? কেন তোমার মনে হয় আমরা উভয়েই ক্ষুধার্ত? তোমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে জীবনেও আমি এ রকম তীব্র খিদের মুখোমুখি হইনি। তোমার কি মনে হয় এটা অস্বাভাবিক? তোমার অভিশাপ আমার ওপরও কাজ করছে।”

আমি মাথা নাড়াই। জানি না তার ধারণা ঠিক না বেঠিক; কিন্তু বুঝতে পারছি সে একটা কিছু ভেবে নিয়েছে।

খিদের অনুভূতি আবার ফিরে আসে। এ বার আগের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র। ওই খিদে বয়ে এনেছে প্রচণ্ড মাথাব্যথা। পেটের তীব্র ব্যথা তারের মাধ্যমে আমার মস্তিষ্কের প্রধান অংশে প্রবাহিত হচ্ছে, যেন আমার পেটের ভেতরটা নানা জটিল মেশিনে সজ্জিত।

“মাত্র দু সপ্তাহ আমরা এক সাথে আছি,” বলল আমার স্ত্রী, “এই সময়ের মধ্যেই আমি এক ধরনের রহস্যময় উপস্থিতি টের পাচ্ছি।” সে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকাল, হাত দুটো টেবিলে ওপর রেখে আঙুল জড়াজড়ি করল। “অবশ্যই আমি জানি না অভিশাপ এখনও আছে কিনা। এটা সব কিছুরই ব্যাখ্যা দেয়। একটা অভিশাপের ভেতর আছ তুমি।”

“কোন ধরনের অভিশাপের কথা বলছ?”

“এই যেমন ধর ভারী ধুলোয় ভরা পর্দাটা ছাদ থেকে ঝুলে আছে, পরিষ্কার করা হচ্ছে না বছরের পর বছর ধরে।”

“এটা আবার অভিশাপ হলো নাকি। হয়ত এটা আমি নিজেই।”

সে হাসে না।

বলে, “না ওটা তুমি নও।”

“ঠিক আছে ধরে নাও তুমিই ঠিক। মনে কর এটা একটা অভিশাপ। আমি কী করতে পারি এখন?”

“অন্য একটা বেকারিতে হামলা কর। এখনই। এটাই একমাত্র পথ!”

“এখন?”

“হ্যাঁ, এখনই। এখনও তুমি ক্ষুধার্ত। যা শেষ করতে পারনি তা তোমাকে শেষ করতে হবে।”

“কিন্তু এখন তো মধ্যরাত, কোনো বেকারি কী খোলা পাওয়া যাবে?”

“টোকিও শহরটা তো খুব বড়। আমরা খুঁজে বের করব। সারা রাত খোলা থাকে এমন একটা বেকারি নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।”

“ঠিক আছে, খুঁজে বের কর।”

আমরা দুজনে আমাদের পুরনো করোলাটাতে চেপে বসি আর রাত আড়াইটার সময় টোকিওর রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাতে থাকি, যদি একটা বেকারির সন্ধান মেলে। আমি স্টিয়ারিং হুইল চেপে ধরে থাকি আর সে বসে নেভিগেটর সিটে। ক্ষুধার্ত ঈগলের মতো শিকারের আশায় আমরা রাস্তার দু’পাশে তাকাতে থাকি। পেছনের সিটে মরা মাছের মতো পড়ে আছে লম্বা, শক্ত একটা স্বয়ংক্রিয় রেমিংটন শটগান। এর গুলিগুলো আমার স্ত্রীর আঁটো জামার পকেটে ক্রমাগত ঝরঝর শব্দ তুলছে। আমাদের সঙ্গে দুটো স্কী-মুখোশও আছে। আমার স্ত্রী এ রকম একট শটগানের মালিক কেন হয়েছে জানা নেই। স্কী-মুখোশ দুটোই বা এল কোত্থেকে। দু’জনের একজনও তো কোনো দিন স্কী করিনি। সে এর কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি, আর আমিও চাইনি। মনে হয় বিবাহিত জীবন রহস্যময়।

আমাদের আয়োজন ও সাজসজ্জা নিখুঁত হওয়া সত্ত্বেও সারা রাত খোলা থাকে এ রকম একটা বেকারি আমরা ভোলা পেলাম না। ইয়োয়োগি থেকে শিনজুকি, ইয়োসুইয়া থেকে আকাসাকা, আইওইয়ামা, হিরো, রুপোঙ্গি, দাইকান-ইয়ামা আর শিবুইয়ার ফাঁকা রাস্তা ধরে গাড়ি চালালাম আমি। শেষ রাতের টোকিও শহরে লোকজন, দোকানপাট সবই আছে; কিন্তু কোনো বেকারি নেই।

দু’বার আমরা পেট্রল কারের মুখোমুখি হলাম। একটা গাড়ি রাস্তার পাশে ভিড়ের মধ্যে দাঁড় করান ছিল। অগোচরে আমাদের দেখার চেষ্টা করছিল। অন্যটা ধীর গতিতে আমাদের ওভারটেক করে দূরে চলে গেল। প্রতিবারই হতোদ্যম হয়ে পড়ছিলাম, কিন্তু আমার স্ত্রীর মনোযোগ ক্ষণিকের জন্যও ছিন্ন হয়নি; তার দু’চোখ বেকারির সন্ধান করে ফিরছে।

“বাদ দাও তো” বললাম আমি, “রাতের এই সময়টাতে কোনো বেকারি খোলা পাওয়া যাবে না। এসবের জন্য একটা পরিকল্পনা থাকা চাই, নাহলে…”

“গাড়ি থামাও!”

ব্রেক কষলাম।

“এখানেই আছে।” বলল সে।

রাস্তার দু’পাশের দোকানগুলোর ঝাঁপ নামান। ফলে সেখানে অন্ধকার আর দু’পাশে নীরব দেয়াল। ঠাণ্ডা কাঁচের চোখের মতো একটা হেয়ার কাটিং সেলুনের নিয়নসাইন জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। ওখান থেকে দু’শ গজ দূরে ম্যাকডোনাল্ড হামবার্গারের একটা নিয়ন সাইন দেখা যাচ্ছে, এই তো।

“কোনো বেকারি তো চোখে পড়ছে না।” বললাম আমি।

সে নীরবে গাড়ির ড্যাশবোর্ডের খুপরি থেকে কাপড়ের ফিতা বের করল আর তা হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। আমিও নামলাম। হাঁটু গেড়ে বসে সে কাপড়ের। ফিতা দিয়ে গাড়ির নম্বর প্লেট ঢেকে দিল। তার চলাফেরার মধ্যে বিস্তর অভিজ্ঞতার ছাপ। মনের ভাব গোপন করে আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

“ওই ম্যাকডোনাল্ডটাতে চড়াও হবো আমরা।” সে বলল।

“ম্যাকডোনাল্ড কোনো বেকারি নয়।” ধরিয়ে দিলাম আমি।

“বেকারির মতোই এটা,” সে বলল, “কখনো কখনো আপস করতে হয়। চল যাওয়া যাক।”

ম্যাকডোনাল্ডের সামনে গিয়ে পার্কিং লটে গাড়ি দাঁড় করালাম। কম্বলে মোড়ানো শটগানটা সে আমার হাতে দিল।

আমি প্রতিবাদ করে বললাম, “জীবনেও বন্দুক দিয়ে গুলি করিনি।”

“তোমার গুলি করার দরকার নেই তো, শুধু হাত দিয়ে ধরে রাখ, ঠিক আছে? আমি যা বলছি তাই কর। আমরা সোজা ভেতরে গিয়ে ঢুকব, যখন তারা বলবে ম্যাকডোনাল্ড এ স্বাগতম, তখন আমরা মুখোশ পরে ফেলব। বুঝতে পেরেছ?”

“নিশ্চয়ই, কিন্তু …”

“তখন তুমি কর্মচারী ও খদ্দেরদের একত্র করে তাদের দিকে বন্দুক তাক করে ধরবে। খুব দ্রুত করবে কাজটা। বাকি সব আমি করব।”

“কিন্তু …”

“কয়টা হামবার্গার আমাদের দরকার বলে তুমি মনে কর? তিরিশটা?”

“আমারও তাই মনে হয়।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শটগানটা হতে নেই আর কম্বলটা একটুখানি নামিয়ে দেই। জিনিসটা বালির বস্তার মতো ভারী আর রাতের মতো কালো।

“সত্যিই কী কাজটা করা দরকার আমাদের?” জিজ্ঞেস করি আমি- অর্ধেক নিজেকে, অর্ধেক তাকে।

“নিশ্চয়ই আমাদের করা উচিত।”

ম্যাকডোনাল্ড হ্যাট পরিহিত একটি মেয়ে কাউন্টারের পেছন থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসল। বলল, “ম্যাকডোনাল্ডে স্বাগতম।” ভাবিনি এই মেয়েটি শেষ রাতের পালায় কাজ করে, ফলে তাকে দেখামাত্র সেকেন্ডের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। ত্বরিৎ মুখোশ পরে ফেলি। হঠাৎ মুখোশ পরা মানুষের সামনে পড়ে মেয়েটি হাঁ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

এ রকম অবস্থায় কী করতে হয় নির্ঘাত তা ম্যাকডোনাল্ড-এর অতিথি সেবা ম্যানুয়ালে লেখা নেই। সে রীতি মাফিক ম্যাকডোনাল্ডে স্বাগতম বলতে যাবে; কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো কথা বেরুবে না।

যত শীঘ্র সম্ভব আমি শটগানটা কম্বলের ভেতর থেকে বের করে আনলাম এবং টেবিলগুলোর দিকে তাক করলাম। ওখানে খদ্দের ছিল মাত্তর দু’জন। একটি ছেলে একটি মেয়ে। সম্ভবত তারা ছাত্র তাদের মাথা টেবিলের দিকে ঝুঁকে আছে। গভীর ন্দ্রিায় আচ্ছন্ন তারা। তাদের সামনে টেবিলে রাখা স্ট্রবেরি-মিল্কসেকের গ্লাস দু’টিকে আভা-গাদ স্থাপত্যের মতো লাগছে। মরার মতো ঘুমাচ্ছে তারা। আমাদের অপারেশনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। শটগান ঘুরিয়ে কাউন্টারের দিকে ধরলাম।

সব মিলিয়ে ম্যাকডোনাল্ডের তিনজন কর্মচারী ওখানে। কাউন্টারে একটা মেয়ে, বিবর্ণ ডিম্বাকৃতি চেহারার ম্যানেজার যার বয়স বিশের কোঠায় আর কিচেনে ছাত্র কিসিমের এক হ্যাংলা পাতলা যুবক। এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে শটগানের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল তারা। ট্যুরিস্টরা যেমন ইনকা যুগের কূপের দিকে উঁকি দিয়ে দেখে ঠিক তেমনভাবে। কেউ চিৎকার কিংবা প্রতিবাদী কোনো ভঙ্গি করল না। বন্দুকটা এত ভারী ছিল যে, ব্যারেলটা ক্যাশ কাউন্টারে নামিয়ে ট্রিগারে হাত রাখতে হয়েছিল আমাকে।

“আমরা টাকা দেব আপনাদের,” কর্কশ স্বরে ম্যানেজার বলল, “বেশি দেয়া যাবে না, কারণ এগারটায় ক্যাশ সংগ্রহ করে নিয়ে গেছে। তবে আশ্বাস দিচ্ছি, সম্ভাব্য সবকিছু করব আমরা।”

“সামনে সাটার নামিয়ে নিওন সাইন বন্ধ করে দাও।” আমার স্ত্রী বলল।

ম্যানেজার বলল, “একটুখানি দাঁড়ান। ওটা আমি করতে পারব না। বিনা অনুমতিতে বন্ধ করা হলে আমাকে দায়ী করা হবে।”

আমার স্ত্রী তার হুকুমের পুনরাবৃত্তি করল ধীরে ধীরে।

আমি তাকে সাবধান করে বললাম, “উনি যা বলছেন তা-ই করুন না।”

সে প্রথমে বন্দুকের নলের দিকে তাকাল, তারপর আমার স্ত্রীর দিকে, তারপর আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল বন্দুকের নলের ওপর। অতঃপর সে নিজেকে নিয়তির হাতে ছেড়ে দিল। নিয়ন সাইন বন্ধ করল আর ইলেকট্রিক প্যানেলের সুইচে চাপ দিয়ে সামনের সাটার নামিয়ে দিল। আমি তার দিকে নজর রাখলাম। ভাবনা হচ্ছিল পাছে সে ডাকাতির বিপদ সংকেত না বাজিয়ে দেয়; তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হলো এখানে ওই ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। সম্ভবত এদের এখানে কখনো এই ধরনের কেননা ঘটনা ঘটেনি।

“নিয়ে যাওয়ার জন্য তিরিশটা বড় হামবার্গার চাই আমাদের।” আমার স্ত্রী হুকুম দিল।

ম্যানেজার অনুনয় করে বলল, “তারচে টাকা নিন আপনারা। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি দেব যাতে অন্যখান থেকে এগুলো কিনতে পারেন। নচেৎ আমাদের হিসাব-পত্তর একদম গড়বড় হয়ে যাবে…”

“উনি যা বলছেন তাই করুন।” আমি আবার বললাম।

তিরিশটা বার্গার বানানোর জন্য তিনজন কিচেনের দিকে রওয়ানা হলো। ছাত্রটি মাংস গ্রিল করল, ম্যানেজার তা বনের ভেতর ঢোকাল আর মেয়েটি সেগুলো কাগজে মুড়ালো। কেউ টু শব্দটি করল না।

এক গাদা চমৎকার বার্গার তৈরি এখন প্রায় শেষ। মনে হলো এখনই একটা তুলে এনে খাই। কিন্তু এ কাজ আমাদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে কিনা ভেবে ঠিক করতে পারলাম না। অপেক্ষা করতে হবে আমাকে। প্রচণ্ড গরম কিচেন সংলগ্ন এলাকায় দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামতে লাগলাম।

বার্গার বানানো শেষ হলে আমার স্ত্রী তা গুণে দেখল। দুটি ছোট শপিং ব্যাগ নিয়ে এক-একটিতে পনেরটি করে বার্গার ঢুকাল সে।

“এত কষ্ট করতে গেলেন কেন আপনারা?” মেয়েটি বলল, “টাকা নিয়ে কিছু কিনলেই তো পারতেন। এত বড় বড় তিরিশটা বার্গার খেয়েই বা কী লাভ?”

আমার স্ত্রী ব্যাখ্যা করে বলল, “সত্যিই আমরা দুঃখিত, কিন্তু কী করব বল, কোনো বেকারি খোলা পেলাম না। পেলে ওগুলোর একটাতেই হামলা করতাম আমরা।”

তার ওই বক্তব্যে সন্তুষ্ট হলো তারা। আর কোনো প্রশ্ন করল না। অতঃপর আমার স্ত্রী দু’ বোতল বড় কোকের অর্ডার দিল এবং তা নিয়ে দাম পরিশোধ করে দিল।

“আমরা শুধু বার্গার ছিনতাই করতে এসেছি, অন্যকিছু নয়।” বলল আমার স্ত্রী। এক ধরনের জটিল মাথা নাড়ানোর মাধ্যমে মেয়েটি তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল।

আমার স্ত্রী পাকানো রশির একটা গোলা বের করে একটা থামের সঙ্গে তিনজনকে বেঁধে ফেলল। এত নৈপুণ্যের সঙ্গে সে কাজটি করল যে, আমার মনে হলো সে সূই দিয়ে বোম লাগাচ্ছে। সে তাদের জিজ্ঞেস করল বাধার কারণে তারা ব্যথা পাচ্ছে কিনা এবং কারও বাথরুম পেয়েছে কিনা। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলল না। আমি শটগানটা আবার কম্বল দিয়ে মুড়িয়ে ফেললাম। আমার স্ত্রী শপিং ব্যাগ দুটো তুলে নিতেই ওই স্থান ত্যাগ করলাম। খদ্দের দু’জন তখনও গভীর সমুদ্রের মৎস্য দম্পত্তির মতো গাঢ় নিদ্রায় মগ্ন।

আধা ঘন্টা খানেক গাড়ি নিয়ে ঘুরলাম। একটা ভবনের ফাঁকা পার্কিংলট পেয়ে সেখানে ঢুকে পড়লাম। ছয়টি বার্গার গ্রাস করলাম আমি। আমার স্ত্রী খেল চারটি। বাকি রইল বিশটি। কোক পান করলাম প্রাণ ভরে। মনে হয়েছিল ওই সর্বগ্রাসী ক্ষুধা বোধকরি কোনো দিন যাবে না, কিন্তু ভোর হওয়ার সাথে সাথে তা দূর হয়ে গেল। সূর্যের প্রথম আলো ভবনটির নোংরা দেয়ালের রক্তবর্ণকে আলোয় রাঙাল। আর বড় একটা সনি বেটার বিজ্ঞাপন টাওয়ারকে বেদনাময় তীব্রতায় উজ্জ্বল করে তুলল। আমেরিকান আর্মসফোর্স রেডিও বাজাচ্ছিল কাউবয় সঙ্গীত। আমরা একটা সিগারেট দু’জনে ভাগ করে খেলাম। তারপর সে আমার কাঁধে মাথা রাখল।

“সত্যিই কী এসব করার দরকার ছিল আমাদের?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।

“নিশ্চয়ই দরকার ছিল!” দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার স্ত্রী বলল, তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। তাকে বিড়ালের মতো হালকা আর নরম মনে হলো।

এখন একা আমি। নৌকার কিনারা থেকে সমুদ্রের তলদেশে তাকালাম। আগ্নেয়গিরিটি এখন আর নেই। শান্ত আর স্থির জল আকাশের নীল ছড়াল। আর কিছু ছিল না সেখানে….

নৌকার তলদেশে সমুদ্রের নীল জলে সটান শুয়ে পড়লাম চোখ বুজে। তারপর অপেক্ষা করতে লাগলাম ফুঁসে ওঠা ঢেউয়ের জন্য যাতে আমাকে সেইখানে নিয়ে যাওয়া হয় যেখান থেকে আমি এসেছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *