বেকারিতে হামলা

বেকারিতে হামলা

সেদিন আমাদের পেটে কোনো দানা-পানি ছিল না। বরং বলা ভাল, আমরা উপোস দিচ্ছিলাম। কিন্তু আমাদের ওই সর্বগ্রাসী ক্ষুধার জন্ম কোথায়? এ কথা তো ঠিক খাবার দাবারের অভাব আমাদের ছিল। কেমন করে খাবারের অভাব হলো? এর কারণ হচ্ছে এই যে, আমাদের হাতে কোনো মুদ্রা অর্থাৎ কোনো টাকা পয়সা ছিল না। এর কারণ হয়ত এই যে, আমাদের ভেতর কল্পনা শক্তির অভাব ছিল। না, আমাদের ক্ষুধার জন্য আমাদের কল্পনা শক্তির অভাবই সরাসরি দায়ী।

ঈশ্বর, মার্ক্স আর জন লেনন সবাই মারা গেছেন। যে ভাবেই হোক আমরা ভীষণ ক্ষুধার্ত এখন; আর এ কারণে একটা অপরাধই করতে যাচ্ছি প্রায়। ক্ষুধার কারণে আমরা অপরাধ করতে যাচ্ছি না বরং অপরাধ-ই আমাদেরকে ক্ষুধার সঙ্গে ছুটতে বাধ্য করছে। ব্যাপারটা ভাল করে বুঝি না, তবে এর অস্তিত্ব আছে।

“খারাপ হবে ব্যাপারটা,” খুব অল্প কথায় বলল আমার সঙ্গী আর তাকে আমি সমর্থন করলাম।

গত দু’দিনে পানি ছাড়া আমরা আর কিছুই খাইনি। একবার কেবল সূর্যমুখীর একটা পাতা খেয়েছিলাম শুধু এটা বোঝার জন্য যে, জিনিসটা খেতে কেমন; কিন্তু ভালো লাগেনি বলে আর খাইনি।

আর এ জন্যই রান্নাঘরের কাটাকুটিতে ব্যবহৃত হয় এ রকম একটা ছুরি নিয়ে বেকারিতে এসেছি। একটা শপিং অঞ্চলের কেন্দ্রস্থলে বেকারিটি অবস্থিত। এক টেকো-বুড়ো বেকারিটির মালিক যার বয়স ৫০ এর ওপরে এবং তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।

ছুরি হাতে আমরা ধীরে ধীরে শপিং এলাকার ভিড়বাট্টার ভেতর হাঁটতে লাগলাম। আমার অনুভূতি তখন হাইনুন চলচ্চিত্রের মতোন। হাঁটার সময় রুটির সুঘ্রাণ তীব্র হচ্ছিল আমাদের কাছে। ওই ঘ্রাণ যত তীব্র হচ্ছিল আমাদের ভেতরকার অপরাধের ঝোঁকও তত গম্ভীর হচ্ছিল। আমরা উত্তেজিত ছিলাম এ কারণে যে, একই সঙ্গে আমরা বেকারি ও কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্যকে হামলা করতে যাচ্ছি।

সময়টা বিকেলের শেষ দিকে হওয়ায় বেকারিতে একজন মাত্র লোক ছিল। তবে দেখে রাগ ধরে এমন একজন বুড়ি ছিল সেখানে। তার হাতে ছিল একটা নোংরা শপিং ব্যাগ। তাকে ঘিরে ছিল বিশ্রি একটা গন্ধ। এই ধরনের কদর্য মহিলাদের কারণে অপরাধীদের পরিকল্পনা সবসময়ই বাধাগ্রস্ত হয়। অপরাধ নাটকে বিষয়গুলো এ ভাবেই কাজ করে। চোখের ইশারায় সঙ্গীকে এই বার্তা পাঠালাম যে, ওই বদখত মহিলা না যাওয়া পর্যন্ত আমাদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না। অতএব ছুরিটি লুকিয়ে রুটিক্রেতা হওয়ার ভান করলাম।

জিনিসপত্র বাছাবাছি করতে গিয়ে বুড়ি অতিশয় বেশি সময় নিয়ে ফেলেছিল। দেখে শুনে মনে হচ্ছিল সে তার ট্রেতে ভাজা রুটি আর তরমুজের রুটি রাখার বদলে তিন আয়না লাগানো দেরাজঅলা লেখার ডেস্ক নির্বাচন করছে। তবে তার মানে এই নয় যে, ওগুলো কিনতে যাচ্ছে সে। কিংবা এমনও হতে পারে এটা তার ভাজারুটি আর তরমুজের রুটি সংক্রান্ত তত্ত্বের একটা দিক ছাড়া আর কিছুই নয়। অবশ্য এর একদম বিপরীত একটা কিছুও হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে পরিস্থিতির সঙ্গে জুতসইভাবে খাপ খাওয়ানোর জন্য তার দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন।

ওই তত্ত্বে তরমুজের রুটি তার অবস্থান হারাচ্ছিল। সে এমনভাবে তার মাথা ঝোকাল যেন সে ভাবছিল- এ রকম একটা জিনিস কেন আমি বেছে নেব? সবচেয়ে বড় কথা এটা খুব বেশি মিষ্টি।

খানিকক্ষণ চিন্তা করে তরমুজের রুটি সে শেলভের নির্ধারিত জায়গায় রেখে দিল আর ট্রেতে তুলল বাঁকানো একটা ব্রেডরোল। একট নতুন তত্ত্বের জন্ম হলো। মেঘের মাঝখান থেকে বসন্তের রোদের আলো উপচে পড়ে সমুদ্রের ওপর ভাসমান বরফস্তূপকে গলিয়ে দিল খানিকটা।

“এ কী জ্বালাতন?” নিচুস্বরে আমার সঙ্গী বলল, “এই বজ্জাত বুড়িটাকে দেই শেষ করে। তাকে যথাস্থানে রাখার জন্য একটুখানি ধাক্কা দিয়ে বলি, “থাম না রে বাপু। নট নড়ন চড়ন।”

বেকারির মালিক ক্যাসেট প্লেয়ারে ভাগনারের সঙ্গীত শোনায় মগ্ন ছিলেন বলে এসব ব্যাপারে দৃষ্টি দিলেন না। আমার ঠিক বুঝে এল না ভাগনারের সঙ্গীত শ্রবণ কমিউনিস্ট পার্টির কোনো সদস্যের জন্য সঠিক কাজ কিনা।

বুড়ি বাঁকানো ব্রেডরোল আর ভাজা রুটির দিকে বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। মনে হলো ধাঁধায় পড়ে গেছে। ভাবল, “ব্যাপারটা অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক। কোনোভাবেই বাঁকানো ব্রেড রোল আর ভাজা রুটি পাশাপাশি স্থান পেতে পারে না।” নির্ঘাত তার মনে হচ্ছে দুই ধরনের রুটির দুই ধরনের আদর্শ আছে। বুড়ির হাতে ধরা ট্রেটার ওপর রুটিটা ভাঙা রেফ্রিজারেটরের থার্মোস্ট্যাটের মতো ঠকঠক করে কাঁপছিল। রুটি নিশ্চয়ই সত্যি সত্যি কাঁপছিল না। কাজেই শেষমেষ ওই ঠনঠন করে কপার ব্যাপারটা নেহাতই আলংকারিক।

“শালা মেরে ফেলবো বুড়িটাকে,” বলল আমার সঙ্গী। প্রচণ্ড খিদে, ভাগনারের সঙ্গীত আর বুড়িকে নিয়ে সৃষ্ট টেনশন পরিস্থিতিকে একেবারে যাচ্ছেতাই নাজুক করে তুলেছিল। কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ালাম।

বুড়িটা তখনও ট্রে হাতে ঘুরঘুর করছিল, যেন দস্তয়েভস্কি বর্ণিত নরকের ভেতর দিয়ে চলাফেরা করছে। মনে হচ্ছিল ভাজা রুটিটা একটা মঞ্চে দাঁড়িয়ে রোমের নাগরিকদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছে আর তাতে তারা দারুণ রকম মুগ্ধ। ওই ভাষণে এমনসব চমকার শব্দালংকার ব্যবহার করা হয়েছিল আর পরিবেশিত হয়েছিল এমন সুন্দর ভরাট, গমগমে আর স্নিগ্ধ গভীর কণ্ঠে যে, জনতা করতালিতে ফেটে পড়েছিল মুহুর্মুহু। ভাজা রুটির পরেই মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিল বাঁকানো ব্রেডরোল। ট্রাফিক সিগনালের ওপর একটা বক্তৃতা ঝাড়ল সে যা ছিল খুবই অসংলগ্ন। বলল, সিগনালের বাতি যখন সবুজ থাকে তখন যেসব গাড়ি বাঁয়ে মোড় নেয় তাদের সোজা যাওয়া উচিত, আর কোনো গাড়ি নেই এটা নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের বামে যাওয়া। উচিত। রোমের নাগরিকগণ তার বক্তৃতা ঠিক বুঝতে পারল না, তবে ওটা খুব জটিল প্রকৃতির ছিল বলে প্রশংসা করল। ভাজা রুটির চেয়ে বাঁকানো ব্রেডরোল বেশি প্রশংসা পেয়েছিল বলে ভাজা রুটিকে তার শেলভের এর নির্দিষ্ট স্থানে ফিরিয়ে নিল বুড়ি। তখন বুড়ির ট্রেতে যে দুটি বাঁকানো ব্রেডরোল বসেছিল তারা ছিল সিম্পল পারফেকশনের ভাবমূর্তি। প্রবল সম্ভষ্টি বুকে নিয়ে বুড়ি বেকারি থেকে বেরিয়ে গেল।

এবার আমাদের পালা।

খুব আন্তরিকতা নিয়ে বেকারির মালিককে বললাম, “আমরা খুবই ক্ষুধার্ত,” ছুরিটা তখনও আমার পেছনে লুকান, “তবে আমাদের হাতে একটি পয়সাও নেই।”

মাথা নাড়িয়ে বেকারির মালিক বললেন, “ও তাই নাকি?” আমরা দুজনেই একযোগে কাউন্টারের ওপর রাখা ফিঙ্গারনেইল ক্লিপারের দিকে তাকালাম। ক্লিপার জোড়া ছিল বেশ বড়সড়। সম্ভবত শকুনের নখ কাটার কাজে ব্যবহৃত হয়।

বেকারির মালিক বললেন, “খিদে যখন লেগেছে রুটিফুটি কিছু খেয়ে নাও।

“কিন্তু টাকা-পয়সা নেই যে।”

বিরক্ত হয়ে বেকারির মালিক বললেন, “সে কথা তো বাপু শুনলাম-ই। পয়সা। টয়সা লাগবে না। মনে যা চায় তা ওখান থেকে নিয়ে খেয়ে ফেল।”

সত্যি বলছেন? আমরা তো খারাপ একটা কিছু করতে যাচ্ছিলাম।

“আরে সত্যি বলছি, ভেবো না।”

“কিন্তু আমরা তো এমনি এমনি কিছু নিতে চাইনে।”

“বলো কী হে,” বললেন বেকারির মালিক, “একটা কথা বলি শোন, যত খুশি রুটি তোমরা খেতে পার তবে শর্ত আছে। তোমাদের ঘাড়ে একটা অভিশাপ চাপাব। মানবে তো?”

“অভিশাপ? বলছেন কী আপনি? সেটা আবার কী?”

“অনুমান করা সহজ নয় হে ব্যাপারটা। বাসের সময়সূচির মতো নয়, বুঝলে। কিনা?”

“দাঁড়ান এক মিনিট। আমি কিন্তু অভিশপ্ত হতে চাইনে,” বলল আমার সঙ্গী, “এসব বুজরুকি একদম পছন্দ নয় আমার। তার চেয়ে এখনই মেরে ফেলব আপনাকে।”

“আরে থামো তো ছোকরা। মরবার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই।”

আমার সঙ্গী বলল, “সেটা ভাল। তবে কোনো মতেই অভিশপ্ত হতে চাইনে, এই বলে দিলাম।”

আমি তখন বললাম, “আমাদের মধ্যে কিছু একটা বিনিময় হওয়া দরকার।”

এরপর আর কোনো কথাটথা না বলে আমরা নেইল ক্লিপারের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

“আমার একটা প্রস্তাব আছে,” বেকারির মালিক বললেন, “তোমরা কি ভাগনারের সঙ্গীত পছন্দ করো?”

“একদম না।” বললাম আমি। আমার সঙ্গী বলল, “আমিও না।”

“বেশ ভাল কথা। ভাগনারকে পছন্দ করলেই কেবল বিনে পয়সায় রুটি পাবে।”

মনে হলো আফ্রিকা মহাদেশের কোনো পাদ্রির মুখ থেকে কথাগুলো বেরিয়ে এল। তবে সঙ্গে সঙ্গে আমরা ওই প্রস্তাবে সাড়া দিলাম। না খেয়ে থাকার চেয়ে অভিশপ্ত হওয়া অন্তত ভাল।

“ভাগনার আমার পছন্দ,” বললাম আমি।

“আমারও,” বলল আমার সঙ্গী।

অতএব বিস্তর রুটি ভক্ষণ করতে করতে আমরা ভাগনারের সঙ্গীত শ্রবণ করলাম।

বেকারির মালিক রেকর্ডের কভার পড়তে পড়তে বললেন, ‘সঙ্গীতের ইতিহাসে ত্রিস্তান অ্যান্ড ইসোলদি একটা অনবদ্য সৃষ্টি। ১৮৫৯ সালে বেরোয় এটি। ভাগনারের শেষের দিককার কাজ বুঝতে হলে এটা শোনা অপরিহার্য।”

আমাদের মুখের ভেতর রুটি ছিল বলে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব হলো না আমাদের পক্ষে। আমরা শুধু খানিকটা বিড় বিড় করতে পারলাম।

কর্নওয়ালের রাজার ছেলে ত্রিস্তানকে পাঠানো হয়েছিল তার চাচার বাগদত্তা রাজকুমারী ইসোলদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে; কিন্তু জাহাজে ফেরার সময় ত্রিস্তান ইসোলদির প্রেমে পড়ে। চেলো আর ওবো’র দ্বৈত বাদনের মাধ্যমে সঙ্গীতটি শুরু হয়। থিমটি প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের ভালবাসার মোটিভ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

ঘন্টা দুয়েক পরে উভয় পক্ষেরই সন্তুষ্টি ঘটে। আমরা বিদেয় হই।

“আগামীকাল টানহাউসার শুনব।” বেকারির মালিক বলেছিলেন আমাদেরকে।

আমরা যখন নিজেদের ঘরে ফিরে এসেছিলাম। তখন আমাদের ভেতরকার শূন্যতা একেবারে অন্তর্হিত হয়েছিল আর কাজ করতে শুরু করেছিল কল্পনা করার শক্তি, যেন তারা কোনো ঢালু জায়গার দিকে গড়িয়ে যাচ্ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *