১০. কত রাত হলো

কত রাত হলো? করাচীর লাল নীল সবুজ আলোকমালা ঝিমিয়ে এসেছে আর আমি জেগে আছি? আমি কি মাতাল হয়ে গেলাম?

না, মাতাল হইনি, তবে নেশাগ্রস্ত আছি বৈকি। এ নেশা এক অদ্ভুত নেশা, সব ভুলিয়ে রাখে। সত্তাকে ডুবিয়ে দেয়, ঢেকে রাখে তার মায়াবী আচ্ছাদনে। তিনবন্ধু রাতের অভিসার থেকে ফিরেছে কিনা জানিনে, জানবার ইচ্ছেও নেই। ইতিমধ্যে যদি এসেও থাকে সকাল আটটা নটা অবধি ঘুমাবে সে এক ভালোই। সে কোনো রকম ধাক্কাকে এড়িয়ে যাবার সুবিধে।

কিন্তু বাকি রাতটুকু আমিও যে দুচোখের পাতা এক করতে পারব না। মেঘের আবরণ ছিন্ন হয়েছে কিন্তু কুয়াশা এখনো কাটেনি। ছবি আর তিনা এক ছবিরই দুই রূপ একই শিল্পীর আঁকা, তাই শিল্পী মুজতবার ভারত ভ্রমণ হয়তো বৃথা যাবে না। সেদিন রাতেও আমার তাই মনে হয়েছিল। তাই হয়তো স্বপ্ন দেখেছিলাম, পাহাড়ের ওপর থেকে হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে কে আমাকে ডাকছে, হোঁচট খেয়ে খেয়ে প্রাণপণে উপরে উঠছি কাছাকাছি গিয়ে দেখি ছবি- ও হাত বাড়িয়ে দিল, আমি ধরতে যাচ্ছি এমন সময় পা পিছলে পড়ে গেলাম একেবারে গভীর খাদে। চিৎকার করে জেগে উঠেছিলাম, সর্বাঙ্গ ঘামে ভেজা। একটা গোপন ভয় এসে মনে বাসা বাঁধল। এতে কাছে পেয়ে এমনি করেই তো আমরা হারাই?

এখানকার কাজ সেরে রাঙামাটি যাওয়ার প্ল্যান ছিল। কিন্তু সব বাতিল করে দুদিন পরে আমি চলে এসেছিলাম।

ছবি আমাকে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই দেখে অবাক হয়েছিল। কিন্তু আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে বুকে চেপে বললাম, তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি তাই ছুটে এলাম। তোমার কিছু হয়নি তো?

না না। ওগো কিচ্ছু হয়নি, তোমার কথাই ভাবি শুধু, কিছু হবে কেন?

এবারও করাচীতে সাতদিন থাকার কথা কিন্তু চারদিনের দিন ফিরে গেলেও ছবি এবারে বিস্মিত হবে না। বরং বলবে এ-তো দিন! বড় শহরে গিয়ে আমাকে ভুলে গিয়েছিলে বুঝি? এত দেরি হলো!

দেরি হলো কোথায়? সাতদিন থাকার কথা ছিল, চারদিনে ফিরে এলাম!

চারদিন না ছাই, চার বচ্ছর বলো! ছবির যুক্তির সঙ্গে সত্যি পেরে ওঠা দায়।

সকালে এয়ার অফিসে গিয়ে ভাগ্যক্রমে একটা টিকিট পেয়ে গেলাম। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় ফ্লাইট এরই মধ্যে তৈরি হয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ওখান থেকে বাজারে গিয়ে কিছু ফলমূল কিনি। ভালো কিছু নেই। মালক্কাই নিতে হলো বেশি। টুলটুলের জন্য একটা খেলনা উড়োজাহাজ ও কিছু গরম কামাকাপড় কিনলাম। কিন্তু ছবির জন্য নেব। কি? ও কিছু বলেনি। বলেছিল তুমি শুধু ফিরে এসো ব্যস আর কিছু চাই না।

কিন্তু আমি দোকানে গিয়ে ওর জন্য একটা সুন্দর কাশ্মীরী চাদর একটা হাল্কা নীল নাইলনের শাড়ি ও ব্লাউজের কাপড় কিনে ফেললাম। এসব দেখে জানি প্রথমে ও তিরস্কার করবে কিন্তু সে আর কতক্ষণ! প্রত্যেকটাই মনোমত জিনিস, তাই একটু পরেই ফুটবে ঠোঁটে ভুবন-ভোলানো মধুর হাসি।

এটাই আমি চেয়েছিলাম, এখনো তাই চাই! টুলটুলের জন্মের আগে ও কেমন কাঠির মতো হয়ে গিয়েছিল, হাসতে পারত না। কিন্তু আনন্দিত দেখলে আমি খুশি হই। বলে জোর করে হাসত। একদিন আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে বলল, জানো মেয়েরা কিসে ভাগ্যবতী?

না তো? এমনভাবে বললাম যেন কিছুই জানি না।

ভাগ্যবতী মেয়েরা স্বামীর আগে মরে এবং স্বামীর কোলে মাথা রেখে মরে!

আজ হঠাৎ এসব কথা কেন তুমি বলছো ছবি!

ছবি বুকের ওপরেই কাত হয়ে আমার দিকে চেয়ে বলল, আমার বড় ভয় হচ্ছে, এবার বাঁচবো না! কিন্তু মরতে আমার কোনো দুঃখ নেই। কারণ তোমার বুকে এমনিভাবে মাথা রেখেই মরতে পারবো তো!

আমি ওর মাথার একগোছা চুল নিয়ে বলি, ছিঃ ছবি। এমন কথা বলতে নেই। আমি দুঃখ পাই!

জানো দুঃখ পাওয়া তোমার দরকার। বড় আঘাতে না পেলে বড় শিল্পী হওয়া যায় না। আমি মরে গেলে তুমি সেই আঘাতে পেতে পারো। তখন কত বড় শিল্পী হবে তুমি, সেই খুশিতে আমার কবরে ফুল ফুটবে! ছবি একটু নীরব থাকার পর বলেছিল, কিন্তু আমি বোধ হয় মরতে পারব না, সে যে ডাকে এখনো! আজ দুপুরে জানো কি হয়েছে শুনি স্টুডিওতে শিশুর কান্না দৌড়ে গিয়ে দেখি কেউ নেই মিনিটা মিউমিউ করছে।

আমি গভীর আদরের সঙ্গে হাত দিয়ে ওর মুখটা মুছে দিতে দিতে বললাম, সে যখন কোলে আসবে তখন দেখো সব ঠিক হয়ে গেছে! ভাবনার কিছু নেই।

আমি মিথ্যে বলিনি। টুলটুলকে কোলে পেয়ে ছবি আত্মহারা। ভাবটা হারাই হারাই ভয়ে গো তাই বুকে চেপে রাখতে চাই কেঁদে মরি একটু সরে দাঁড়ালে জানিনে কোন্ মায়ায় কেঁদে বিশ্বের ধন রাখব বেঁধে আমার এ ক্ষীণ বাহুদুটির আড়ালে।

তাই বসুন্ধরার জন্য বিশেষভাবে সিটিং দেওয়াতে হয়নি। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে আমার সত্তায় যে সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছিল সেই তো প্রতিকৃতি!

জিনিসপত্রগুলো হোটেল রেখে একজিবিশনে গেলাম। দুপুরে দর্শকের ভিড় নেই কিন্তু বন্ধুদের আড্ডা জমজমাট। হলঘরে ঢুকতেই কয়জন রৈ রৈ করে এগিয়ে এলো। তবে একজন মেয়ে ছিল বলে খুব বাড়াবাড়ি করতে পারল না।

এসো পরিচয় করিয়ে দিই, রায়হান হাত ধরে টেনে মেয়েটার সামনে নিয়ে বলল, মাদার আর্থের আর্টিস্ট মি. জাহেদ। আর ইনি মিস সারা আহমদ! স্কালপচার কোর্স কমপ্লিট করে লণ্ডন থেকে ফিরেছেন!

আচ্ছা! বেশ বেশ। কিন্তু আর কি বলবো খুঁজে পেলাম না।

সো হ্যাপি টু মিট ইউ মি. জাহেদ। সারা লিপস্টিক মাখা মোটা ঠোঁটজোড়া নড়িয়ে বললেন, আই লাইক ইওর পেইন্টিং মাচ। ইটস রিয়্যালি নাইস।

থ্যাঙ্কইউ ফর ইওর কমপ্লিমেন্টস্। বাট আই থিঙ্ক ইটস অনলি এ পিস অব প্রিলিমিনারি ওয়ার্ক!

ও শিওর শিওর! এভরি জেনুইন আর্টিস্ট স্যুড হ্যাভ দিস নোশন অ্যাবউট হিজ ওয়ার্ক। আদারওয়াজ হি উইল ডিমিনিশ এভরিডে, আই হ্যাভ দি গুড় অপরচুনিটি অব ওয়ার্কিং উইথ অ্যাপসটাইন। আই হ্যাভ সিন হাউ টেরিফিক হি ওজ! অ্যান্ড পিকাসো! ওহ হি ইজ এ ডেভিল! এ জায়ান্ট! এ গড! অ্যান্ড হোয়াট নট! আই কুড নট বিয়ার হিম!

সারার চেহারা যাই হোক মেক আপটি অদ্ভুত। চুলগুলো যোগিনীর মতো ঝুটি করে বাঁধা, গলায় বড় কালো গোটার মালা। কাঁধ অবধি কাটা নীলরঙের ব্লাউজ। বেগুনি রঙের সিল্কের শাড়ির আঁচলটা বুকে পেঁচিয়ে রেখেছেন কিন্তু এসব কিছু নয় আমি নেহাৎ কথা বলবার জন্যই জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা যদি মনে কিছু না করেন আপনাদের বাড়ি কোথায়? দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ!

ইয়েস, ইউ আর রাইট। সারা মুখভঙ্গি করে বললেন, বাট আই হেট দ্যাট কান্ট্রি লাইফলেস এ ল্যান্ড অব মেয়ার মনটোনি। অ্যান আর্টিস্ট কান্ট লিভ দেয়ার, নেভার!

রায়হান মাঝখানে আমাকে চুপি-চুপি জিজ্ঞেস করল, টাকা পেয়েছিলে নাকি?

আমি মাথা নেড়ে সায় দিই। আমেদ লক্ষ্য করছিল সে কটু করে বলল, তা হলে হয়ে যাক না এখনই?

মিস আহমদ আছেন সে ভালোই হয় কি বলিস? রায়হান আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে।

এরপর সারাও লক্ষ্য করেছে দেখে আমি বললাম, আপত্তি নেই। তবে ও জিনিস হবে না!

তোকে নিয়ে সত্যি মুশকিল! তাতে দোষটা কিসের?

ছবির টাকার সঙ্গে একটা পবিত্র স্মৃতি রয়েছে এদের কাছে বলতে যাওয়া অর্থহীন, তবু জানালাম, না ভাই তা হলে আমাকে মাফ করতে হবে।

ঠিক আছে অন্য জিনিসই খাব চ। প্লিজ কাম অন উইথ আস মিস আহমদ! রায়হান হাত বাড়িয়ে আপ্যায়ন করল।

হোয়াই? হোয়াটস্ দা ম্যাটার?

আমেদ হেসে বলল, নাথিং অ্যাট অল! লেট আস হ্যাভ দি প্রিভিলেজ অব অফারিং ইউ এ কাপ অব টি!

সারা হাততালি দিয়ে বললেন, ও নাইস আই ওজ রিয়ালি ফিলিং লাইক দ্যাট!

মিরান্দা রেস্তোরাঁর একটি কেবিনে গিয়ে বসি চারজন, মুজিব আসেনি সত্যি ওর দুর্ভাগ্য!

চা খেতে এসে বড়জোর টা পর্যন্ত গড়ানো উচিত ছিল কিন্তু ওদের কাণ্ডজ্ঞান অতুলনীয়। রায়হান বলল, কিছু খেয়েই ফেলা যাক্ জাহেদ। পাঁচ শ টাকা পেলি কুড়ি টাকাও বন্ধুদের জন্য খরচ করবিনে?

অচেনা মেয়ের সামনে শুকনো হাসি হেসে নীরব হয়ে থাকা ছাড়া আমার উপায় নেই। এটা নিঃসন্দেহে সম্মতির লক্ষণ। রায়হান বান্ধবীকে শুধাল, ওয়েস্টার্ন অর ওরিয়েন্টাল?

সাট্টেনলি ওরিয়েন্টাল! ওয়েস্টার্ন পিপল আর গুড বাট নট দেয়ার ফুড। কথায় এমন সুন্দর একটা মিল দিতে পেরে সারা নিজেই উল্লাসধ্বনি করে ওঠেন।

খাবার এলো জমজমাট ডিস্।

একটা প্লেট নিতে নিতে রায়হান বলল, যাই বলুন উই আর ভেরি মাচ ইনডেটেড টু দি মোঙ্গলস। দে ওয়্যার দ্য রিয়্যাল আর্কিটেক্টস অব দি কান্ট্রি। দে নিউ হাউ টু এনজয় লাইফ। ওরিয়েন্টাল ডিস রিয়্যালি মিনস মোঙ্গল ডিস। অ্যাম আই রং।

সাট্টেনলি নট, সারা আঙুলে একটু চাটনি নিয়ে জিভে লাগান এরপর জিভটা ঠোঁটের সঙ্গে চাটতে চাটতে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ডিল্লিশাস ডিল্লিশাস!

খাওয়া শেষ হয়ে গেলে সংকট অবস্থা। চারজনেই সিগারেট ধরাই। কিন্তু এরপর কি? চা কফি কোক অথবা অন্যকিছু? এক কাপ করে কফি খেতে আপত্তি নেই কিন্তু তবু কি যেন বাকি রয়ে গেল। রায়হান গলাখাকারী দেয়, উসখুস করেন সারা। আমেদ বানায় ধোয়ার রিং!

ওদের মানসিক অবস্থার মর্ম অনুধাবন করতে পেরে বললাম, আমি এখন উঠি রায়হান। আজ সন্ধ্যায় চলে যাচ্ছি, কিছু কেনাকাটা বাকী।

চলে যাচ্ছি মানে! ওরা বিস্মিত হলো যেন।

সত্যি চলে যাচ্ছি। আর তো কোনো কাজ নেই। ভালো লাগছে না মোটেই।

তুই একটা আস্ত-রায়হান গাধা কথাটা উচ্চারণ করল না।

যাই বলিস মেনে নিতে রাজি। সিট বুক হয়ে গেছে চলে যেতে হবেই। বেয়ারা পর্দার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল তাকে বললাম, বিল লাও।

সারা সিগারেটটা এসট্রেতে পিষতে পিষতে বললেন, দেন উই আর ডিপার্টিং টু ডে?

ইয়েস ম্যাডাম আই কান্ট হেলপ ইট। বিল চুকিয়ে দেবার পর সকলের সঙ্গে করমর্দন করে সারাকে বললাম, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম। বাংলাদেশে যাচ্ছেন তো আপনি? ঢাকায় নিশ্চয়ই দেখা হবে।

আই অলসো হোপ সো। ডোন্ট ফরগেট মি প্লিজ।

নিশ্চয়ই না। নিশ্চয়ই না। আমি একটু হেসে বললাম, একবার দেখলে আপনাকে ভোলা অসম্ভব!

ইউ আর সো নাইস মি. জাহেদ। আই সুড হ্যাভ মোর টাইম উইথ ইউ! এনিওয়ে লেট আস হোপ ফরদি ফিউচার!

যাবার সময়টা ঘনিয়ে এলো তাড়াতাড়ি। ভেবেছিলাম একবার দেখা করে যাব কিন্তু খালার ওখানে যাওয়ার মতো একটু ফাঁকও পাওয়া গেল না। সে জন্য অবশ্য আফসোেস নেই। গেলে ভদ্রতাটুকু রক্ষা হতো কিন্তু তার গুরুত্বইবা কত। নিজেদের নিয়মে ওরা চলেছেন যেখানে থেকে এসব চুটকি ব্যাপারের ধার ধারার প্রয়োজন অল্প।

এয়ারপোর্টে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। যা যা সব পেছনে পড়ে থাক্। বন্ধুরা বলেছিল। সি অফ করতে আসবে, না এলেই বরং ভালো।

প্যাসেঞ্জারস বাউন্ড টু ঢাকা এটেনশন প্লিজ। মাইকে এয়ার হোস্টেসের কণ্ঠস্বরে চমকে উঠি। তাহলে ওড়বার সময় হলো?

সুপার কনস্টেলেশন বিমানের ইঞ্জিন চলছে, যেন ঝড়ের শব্দ। আমরা এখান যাচ্ছি সেই দিকে, দেশি বিদেশি বহুযাত্রী কিন্তু কিছুটা অগ্রসর হতেই দৌড়ে এলো চারজন আমার তিন বন্ধু এবং সেই মেয়েটি। ওরা মৌতাত করে ফিরেছে চেহারায় তার স্পষ্ট ছাপ।

আমি দাঁড়ালাম মাত্র কিন্তু আলাপ করার সময় ছিল না। সারা একটু এগিয়ে এসে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, সাতদিন পর আমি যাচ্ছি। আপনার সঙ্গে দেখা হওয়া চাই!

ওর বাংলাকে ঠেকা দেয়ার জন্যই আমি এবার পুরো ইংরেজিতে হাত নেড়ে বললাম, ও সাট্রেনলি! মোস্ট ওয়েলকাম অ্যাট মাই হোম! টাটা!

ভেতরে গিয়ে সব যাত্রী ঠিক হয়ে বসলে পূর্ণবেগে প্রপেলার ঘুরতে লাগল এরপর প্লেন রানওয়েতে ছুটে গিয়ে আকাশে উড়লে এক বিমিশ্রিত আশ্চর্য অনুভূতিতে ভেতরটা অনুরণিত হতে থাকে আমার। তারায় ভরা ওপরে গভীর চিত্রিত আকাশ, নিচে মাটির পৃথিবী, মাঝে মাঝে ছোটো লালচে আলো। কিন্তু অনেক চেষ্টায় পেছনে ফিরে চাইলে নিমেষে চক্ষু স্থির হয়ে যায়। আলো আলো, লাল নীল সবুজ আলো। প্রাচ্যের সিংহদরোজা করাচী নগরীর অফুরন্ত আলোর নৈবেদ্য প্রতিমুহূর্তে ঝিকমিক করছে, ঠিকরাচ্ছে। ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের যুগল সমারোহ।

কিন্তু এই আলোককেও আমি পেছনে ফেলে যাচ্ছি। হয়তো আসবো, না হয় আর কোনদিন হয়তো আসব না। আসি বা না আসি দুইই এক সমান। কারণ আমার চোখে দূর সবুজের মায়া, মনজুড়ে শ্যামল মাটির স্বপ্ন।

বাইরে চেয়ে আচ্ছন্ন হয়েছিলাম, কিন্তু বিপদ প্লেন ঘন ঘন বাষ্প দিতে শুরু করল। এবং আধঘণ্টার মধ্যে জেগে উঠল আবার এই আলোকমালা। আমরা সতর্ক হয়ে যাই।

বিমানটি আবার স্থির হয়ে দাঁড়াবার পর নেমে এসে জানতে পারলাম ইঞ্জিনে গোলমাল দেখা দেওয়ায় ফিরে এসেছে।

এ আবার কি ঘাবলায় পড়া গেল। কোনো অশুভ লক্ষণ নয় তো?

ইঞ্জিনের পরীক্ষা ও মেরামত শেষ হলে বিমান আবার ছাড়ল সোয়া বারোটায়। এবার আকাশের আরো ওপর দিয়ে চলেছে। কাছে দূরে দেখা যায় ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো আবছা মেঘের সম্ভার। মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে এই মেঘকেই কত না কল্পনায় মণ্ডিত করেছি, অথচ এরা সত্যিই নিষ্প্রাণ বাষ্পের আয়োজন মাত্র!

তেমনি বাইরের রঙিন আলোর লেখন দেখে, সোনালি রুপালি চাকচিক্য দেখে, কোনদিন ভুলিনি এমন নয়, এমনকি মোহগ্রস্তও হয়েছি। কিন্তু আজ সে সব যেন মনে হচ্ছে অন্তঃসার শূন্য ফানুসের মতো ফাঁকা!

এই বিমানটি যদি হঠাৎ দুর্ঘটনায় পড়ে এবং সমস্ত সঙ্গীর মতো আমার দেহটিও টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে যায় তবে আমার কোনো দুঃখ থাকবে কি? থাকবে দুঃখ থাকবে মৃত্যুর মুহূর্তে একান্ত সাধারণ একটি মেয়ের আটপৌরে হাতের কোমল স্পর্শ কপালে লাগল না বলে, তার চোখের দুইফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ল না বলে আমার বুকের ওপর! এই দুঃখ সাধারণ, এই দুঃখ অসাধারণ।

যশগৌরবের দাম অনেক এবং কৃতীমাত্রেরই তা কাম্য। কিন্তু আমি উপলব্ধি করেছি এসবের চাইতেও যা বড় তা হচ্ছে একটি ছোট্ট মুখে এক টুকরো হাসি ফোঁটানো।

বন্ধুরা বলবে আমি ভুল করছি, একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ওপর নিজের হাতেই যবনিকা টেনে দিয়েছি।

আমি বলব যথার্থ। কারণ তাঁদের মতো মহান শিল্পী আমি হতে চাই না। সব মানবের শিরোমণি যারা তারা আমার নমস্য কিন্তু একজনের ছোট্ট হৃদয়ের সবটুকু অধিকার করে বেঁচে থাকাই আমার লক্ষ্য। কালের অতল গর্ভে তলিয়ে যাব, হারিয়ে যাব। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। কিন্তু তবু যাওয়ার বেলায় আমার ঠোঁটে থাকবে বিজয়ীর হাসি এবং এটাই আমার বিদ্রোহ, এটাই আমার বিপ্লব। হাওয়ার ওপরে ভেসে বেড়ানো নয়, বসুন্ধরার দৃঢ় ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে কাজ করা। পুরাতন দুর্গকে ভেঙে নতুন প্রাসাদ গড়ে তোলার এই একমাত্র পথ। অন্যথায় আত্মধ্বংসই হবে সার।

ইঞ্জিনের একটানা ঘরঘর শব্দ। না, ইঞ্জিনের নয় আমার মস্তিষ্কের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে অবিচ্ছিন্ন উৎকট সঙ্গীতের ঐকতান। ঘুম আসেনি কিন্তু চোখ মেলবার ক্ষমতাও ছিল না। চোখের পাতা বন্ধ করে মাথাটা এলিয়ে থাকি।

সে কতক্ষণ তাও বলতে পারব না। এরপর একসময় সত্যি চোখ মেলোম। দেখি অন্য দৃশ্য। সূর্য দেখা দিচ্ছে। বিমানটা একটি সুতীক্ষ্ণ তীরের মতো রাতের অন্ধকার থেকে দিনের আলোতে ছুটে গেল। তৎক্ষণাৎ হয়তো ঝকঝক্ করে উঠল ওর ধাতব শরীর।

ক্যাপ্টেনের শান্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ডিয়ার প্যাসেঞ্জারস্ গুডমর্নিং টু ইউ অল। বাই দি গ্রেস অব অলমাইটি, উই হ্যাভ রিচড্‌ ঢাকা যাস্ট অ্যাট্‌ সিক্স ফিফ্‌টিন এ এম। থ্যাঙ্ক ইউ।

বিমানবন্দর থেকে বাসে আসবার সময় হাঁসের পালকের মতো মনটা হাল্কা হয়ে গেল। নগরীতে ফেলে এসেছি কুটিলতা, আকাশে উড়িয়ে দিয়েছি দুশ্চিন্তা এবং এখন যা আছে তা হলো নদীতে ডুব দিয়ে গা জুড়িয়ে নেয়ার আকণ্ঠ আকাক্ষা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ ভাবারও সময় নেই। এয়ার অফিসের কাছে এসে থাকলে বাস থেকে নেমে রিকশায় উঠে পড়ি।

পরিচিত পথঘাট, পরিচিত মানুষের মুখের আদল, পরিচিত দোকান রেস্তোরাঁ কিন্তু তার চেয়েও পরিচিত আমার পাজরের ভেতরে যে এখন হৃৎপিণ্ডটা ঢিঢ়ি করছে তা! এমন ব্যাকুল হয়ে উঠেছি কেন? এ চার দিনে অঘটন কিছু ঘটেনি তো? ছবি ভালো আছে? টুলটুল?

মাথায় টুপি দেওয়া কতকগুলো লোক রাস্তার পাশ দিয়ে মুর্দার খাট বয়ে নিয়ে গেলে ভেতরটা ছাৎ করে ওঠে। না, এদের মধ্যে চেনা কেউ নেই।

গেটের কাছে গিয়ে রিকশা থামতেই জলদি করে নেমে পড়লাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ও কে? চোখ তুলে ভালো করে দেখবার আগেই ছুটে এলো সরুপাড় সালোয়ার কামিজ পরা সেই মূর্তিটি, আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে আমার খুব কাছে এখন, আমি কোনমতে আত্মসম্বরণ করে বলি, ছবি, আমার ছবি!

আমার বুকের ভেতরেই যেন বলছে, আমি জানতাম তুমি আসবে, তুমি আসবে আজ। সেজন্য প্লেনের শব্দ শুনেই বাইরে এসেছিলাম।

বুকের মাঝখান থেকে মুখটা দু’হাতে তুলে দেখি ওর চোখজোড়া অশ্রুজলে ভরা। কিন্তু সে অশ্রুজল নয়, আনন্দের মণিমুক্তা। এত সুন্দর হয়েছে ছবি!

ইস্ কাঁদছ দেখছি? শোনো লক্ষ্মী তোমাকে ছেড়ে আর কখনো কোথায়ও যাব না। বাঁ-হাতে সুটকেসটা তোলবার পর ডানহাতে ওকে ঝাঁপটে ধরে এগুতে এগুতে বললাম, চলো অনেক সুখবর আছে, ঘরে চলো।

তখন ভোরের সূর্যের রঙিন ধারা আমাদের দুজনের ওপর ঝলকে ঝলকে পড়ছে। এই সূর্য আদিম এবং অকৃত্রিম; কিন্তু আজকে যেন তারই পুনরাবৃত্তি নয়; বরং তার সন্ধানী সঙ্কেতে আমাকে নতুন সৃষ্টির মর্মমূলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সত্যি, অনুভূতির এক আশ্চর্য মুহূর্ত, একে ব্যর্থ হতে দেব না। ছবি আমার পাশেই ছিল, আর টুলটুলকে কোলের ওপর ধরে আমরা দুজনে সেই আলোর মুখোমুখি দাঁড়ালাম।

-o-

1 Comment
Collapse Comments

অসাধারণ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *