০৪. সঙ্গীর মন্তব্য যথার্থ

সঙ্গীর মন্তব্য যথার্থ কিনা জানিনা। তবে ওর মতো তুখোড় যে এখনো হতে পারিনি তাতো ঠিকই। এক চুমুক দুই চুমুক করে অনেকক্ষণ ধরে চা খাওয়ার সময় নিজেকে সামলে নিই। এখানে বিচলিত বোধ করার কোনো কারণ নেই, সার্থকতাও নেই। মওকা। যখন মিলেছে তার সদ্ব্যবহার করা উচিত।

আঁকার সমস্ত সরঞ্জাম ঘরেই রাখা ছিল, আমরা দু’জনে তৈরি হলে রাধা আস্তে আস্তে কাপড় ছেড়ে দেয়। অঙ্গের অলঙ্কারগুলোও খুলে রাখল। আমাদের সম্মুখে এখন সে নিরাভরণা, সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। বহু পীড়নে শরীরটা কিঞ্চিৎ শ্লথ হয়ে পড়েছে, কিন্তু গড়নটা অটুট এবং সুন্দর। চট করে ভেনাসের কথা মনে আসায় আমি কাছে গিয়ে ওকে। সেই ভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে এলাম। মন্দ লাগছে না।

মুজতবা প্যালেটটা রেখে বসে পড়ে বলল, তুইই আঁক।

কেন, তুমি আঁকবে না? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কমপোজিশনটা ভালো হয়নি?

গেলাসে মদ ঢালতে ঢালতে মুজতবা বলল, তা হয়েছে। কিন্তু আমি দাঁড়ানো ভঙ্গিতে বহু এঁকেছি কিনা। তুই আঁ আমি দেখি!

খানিকক্ষণ স্থিরভাবে থাকার পর রাধা হঠাৎ হাল ছেড়ে দিল। হাত-পা নাড়া দিয়ে বলল, উহ্, রক্ত জমে যাচ্ছে। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় নাকি?

তিন ঘণ্টা তো অন্তত থাকতে হবে। আমি বললাম, তুমি তো এ ব্যাপারে অভ্যস্ত!

তা বটে। রাধা একটা ভেংচি কেটে বলল, কিন্তু নাগর, সে অভ্যাস তোমার কাছে অচল হয়ে পড়েছে।

মুজতবা অবিরাম হাসতে থাকে, হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ। নেশার ঝোঁকে মাথা দুলিয়ে বলল, উই ডোন্ট নো মাই ডিয়ার ফ্রেণ্ড শি রিকোয়ার্স সামর্থিং। হিয়ারর্স দি থিং ডাবলিং।

ও ঢেকুর তুলতে সস্তা দিশি মদের ভোটকা গন্ধে বাতাস ভরে যাচ্ছিল। তা না হয় সহ্য করেই নিতাম; কিন্তু ওর দিকে মদের গেলাস দিতে গেলে বাধা দিই। এখন ওর মদ খাওয়া মানে গোটা পরিকল্পনাটাই বানচাল হয়ে যাওয়া। আমার মনোভাবটা বুঝতে পেরে মুজতবা বলল, ড্যাম ইট। ইউ নো নাথিং মাই ফ্রেণ্ড। দু’এক গেলাস মদে ওর কিচ্ছুই হবে না। এই নাও!

রাধা গেলাসটা নিয়ে এক চুমুকে সবটুকু সাবার করে ফেলল!

হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ! দেখলে? একদম মরুভূমি, সবটুকু শুষে নিল। আরো দাও। কুচ পরোয়া নেই। সব হারিয়ে যাবে একদম বেমালুম। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। হাঃ।

মুজতবা মাতাল হয়ে যাচ্ছে। আমি রাধাকে শুধাই, ঠিক আছ তো? কাজ চলবে?

নিশ্চয়ই, লাগাও। কিন্তুই একবারে আধঘণ্টার বেশি রেখোনা। আধঘণ্টা পর একটু বিশ্রাম নিয়ে পরে আবার দাঁড়াব। কেমন?

রাধার কণ্ঠে চপলা বালিকার আব্দারের সুর। আমি হেসে বলি, ঠিক আছে আগের মতো দাঁড়াও!

রাধা স্থির হয়ে দাঁড়ালো, ক্যানভাসের ওপরে চঞ্চল হয়ে ফেরে আমার হাতের তুলি। আমার সম্মুখে উন্মোচিত, বিকশিত নারীদেহ, চোখের দৃষ্টিতে একেবারে আচ্ছন্ন করে দিতে না পারলেও মগজের কোষে শিরশির করে রক্ত চলেছে।

এ ছবি ব্যর্থ হতে বাধ্য। কারণ জীবনের যে সত্যকেই রূপ দিতে চাইনা কেন, এতো পোর্ট্রেট মাত্র? এবং পোর্ট্রেট ঠিক অন্য ছবির মতো নয়। অন্য যে-কোনো ধরনের ছবি আঁকবার সময় একাকিত্ব একেবারে অপরিহার্য না হলেও, আত্মমগ্নতা বজায় থাকে। সর্বদাই; তাই সেই ছবি প্রদর্শনীতে গিয়েই হয় নিরিখের বিষয়। কিন্তু প্রতিকৃতির বেলায় অন্য ব্যাপার। এ শুধু মডেলের হুবহু চিত্রণ নয়, যত সুন্দরভাবেই সেটা করা হোক না। আসলে প্রতিকৃতির সাফল্য যতটা না নির্ভর করে অঙ্কন দক্ষতায় তার চেয়ে অনেক বেশি অন্য একটি কারণের ওপর এবং সেটাই সারবস্তু। সেজন্য অনেক সময় আনাড়ি লোকের হাত দিয়েও এমন প্রতিকৃতি বেরিয়ে আসে যা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য এবং সেই রহস্যটি হলো সহানুভূতি, মনস্তাত্ত্বিক নৈকট্য। মডেলের আত্মার সঙ্গে শিল্পীর আত্মার গভীর সান্নিধ্য। এই সংবেদনশীলতা প্রায় নীরব সংলাপের মতো, যার মধ্য দিয়ে একদিকে মডেলের আত্মিক চেহারা এবং অন্যদিকে বাইরের জগতে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রূপায়িত। আর জীবনকে প্রকাশের বেলায় তো এর ওপরও নৈর্ব্যক্তিক চেতনারও দরকার।

কিন্তু এক্ষেত্রে কিছুই আশা করবার নেই; বরং একে লাইফক্লাসের একটি কাজ বলাই সমীচীন।

তবু যেটুকু সম্ভাবনা ছিল তাও ভেস্তে গেল। মুজতবা আমার পেছনে বিবস্ত্র হয়ে টলতে টলতে গিয়ে মেয়েটিকে ধরে কোলে তুলে নিলে, একটা ধাক্কা খেয়ে থেমে যায় আমার হাতের তুলি। সে নেশাজড়ানো গলায় টেনে টেনে বলল, ইয়ার! এঁকে যা, চুটিয়ে এঁকে-যা। ভেনাস আঁক্-ছি-লি, এবার আঁক্ ভেনাস অ্যাণ্ড-মা-স! পল ভেরোনেজ দি সেকেণ্ড হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।

শত হলেও আমি মানুষ এবং রক্তমাংসেই গড়া আমার শরীর, কাজেই সেখানে থাকা আর সম্ভব হলো না। তুলিটা ওদের দিকে ছুঁড়ে মেরে দ্রুতপদে বেরিয়ে এলাম।

রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, আনন্দের সত্য কোথায় নিহিত? সে কি মাংসপ্রিয়তায় অথবা কল্পনায়? নগ্নতায় একটা আদিম পবিত্রতা আছে, কিন্তু নগ্নতা যেখানে সভ্যতারই বিকৃতি সেখানে তার রূপও বিকারগ্রস্ত নয় কি? আলো আমি পছন্দ করি সন্দেহ নেই; তবে আলো-আঁধারির খেলাই আমার কাম্য। মানবীকে অর্ধেক স্বপ্ন দিয়ে না ঘিরলে সে তো মাংসেরই এক জলজ্যান্ত যন্ত্রণা? যে অজানা রাজ্য আকৈশোর পরম বিস্ময়ের মতো মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তার ওপর এমন একটা আঘাত আসবে ভাবতে পারিনি। স্পষ্ট দিবালোকে এমন উলঙ্গভাবে আমি তাকে চাইনি; যখনই ভাবি আমি দেখি তাকে আলোছায়ার স্বপ্নেঘেরা, পরনে নীলাম্বরী, আমের বোলের মতো সোঁদা গন্ধেভরা কালো এলোচুল, হাতে চুড়ির রিনিঠিনি, লাজ মুখোনি, প্রতি অঙ্গের সোচ্চার পূর্ণতাই তার সৌন্দর্য। সে আসবে মৃদু পায়ে চুপি চুপি, সে যে শত জনমের আকাক্ষার ধন। ধরা যায় তাকে কিন্তু তবু অধরা, আর সেজন্যই তো অন্তহীন কান্না।

তাকে আমি চিনেছি তাকে পেয়েছি খুঁজে, এরপর আর ভুল করতে পারিনা। নিজেকে নষ্টই যখন করতে চাই সেভাবে করাই ভালো। তার আগুনে দগ্ধ হওয়া পোড়া কয়লার মতো ভস্ম হয়ে যাওয়া ছাড়া আর আমার গতি নেই।

মেসে ফিরে দেখি জামিলের চিঠি আমার চৌকির কাছে টেবিলে ঢাকা দেয়া।

জাহেদ, তুমি আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করবে তা স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। আমি তোমার জন্য খাওয়ার জোগাড়যন্ত্র করলাম আর তুমি কিনা না বলেই চলে এলে? সত্যি আমি খুব ব্যথিত হয়েছি। যাই হোক, আশা করি এ চিঠি পাওয়া মাত্র তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে।

বেলা পড়ে এসেছিল, বিছানায় খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ি। ওখানে যাওয়ার জন্য আমার অগোচরেই হয়তো মনটা চিৎকার করছিল। সুযোগ পেয়ে তাই প্রবলতর হলো মাত্র। এখন কি করছে ছবি? নিশ্চয়ই হারিকেনের চিমনিটা দরজার কাছে বসে মুছছে, নয় সে রান্নাঘরে, ঘরে চাল থাকলে ভাত চড়িয়েছে। একটু আগে মাথা আঁচড়ে হাতেই অনেকক্ষণ বেণী পাকিয়েছে, বারান্দার নিচের গাছ থেকে ছিঁড়ে এনে হয়তো চুলে খুঁজেছে একটা ফুল। কাজ করছে, কিন্তু আনমনা। সে কি আমার কথাই ভাবছে?

এখনও বাড়িতে ঢুকে বুঝতে পারি জামিল নেই আমার বুকের ভেতরটা দুরুদুরু করে উঠল আবার। এ কি বিপদ!

এবারে ছবি আর নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল না, বহুক্ষণ বুকে মিশে রইল। এরপর দন্দর করে আবার দুই চোখের পানি ছেড়ে দেয়। মৃদুস্বরে বলল, সত্যিই তুমি আমায় ভালোবাস?

হ্যাঁ, ছবি! আমি আবেগ-কম্পিত স্বরে বললাম, সে কি মুখের ভাষায় বলতে হবে? সাক্ষী এই সন্ধ্যা, সাক্ষী এই নীল আকাশ, তোমার মাথার রজনীগন্ধা! তোমাকে বুকে পেয়ে আমার জীবন ধন্য হলো! সার্থক হলো!

এমনভাবে বলো, না লক্ষ্মীটি তাহলে আমি যে চিৎকার করে কাঁদতে চাইব! ছবি একটু থেমে বলল, কিন্তু সবসময় তুমি আমাকে ভালোবাসবে তো?

সবসময় মানে? যদি অন্যজীবন হয় সে জীবনেও তোমাকেই ভালোবাসবো।

কিন্তু জান, মিলন হলে ভালোবাসা টেকে না?

সে আমি বিশ্বাস করি না। মিলন ছাড়া ভালোবাসা সম্পূর্ণ হয় না, টিকবে কি করে। দেহে দেহে আত্মায়-আত্মায় বিন্দু-বিন্দু হয়ে মিশে যাওয়ার নামই প্রেম। প্রেম দেহেরই পরম শিখা, সেজন্য দেহের অবসান ঘটলেও শিখা দাউদাউ করে জ্বলতে পারে। তার মৃত্যু হয় না। তুমি বিশ্বাস করো লক্ষ্মী, আমি কোনদিন তোমার অমর্যাদা করব না।

কিন্তু আমার বড্ড ভয় লাগে!

কেন?

জানি না। মনে হয় তুমি যদি আমাকে বুঝতে না পারো?

সে হবে কেন!

তাইতো সে হবে কেন! আমি তো কিছু গোপন করবোনা তোমার কাছে কিছু গোপন করবো না। তুমিও আমাকে বলবে তোমার কথা, সব। আমরা ঠিক থাকলে কেউ আমাদের সম্পর্ক ভাঙতে পারবে না! কেউ না!

ছবিকে হঠাৎ কেমন যেন বিকারগ্রস্ত মনে হলো, নিজেকে আলতোভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে কাছেই দাঁড়াল। স্নিগ্ধ আকাশের ভেতর থেকে নিমেষে বেরিয়ে এসেছে কালো মেঘভার! আমি চেয়ে থাকি। অল্পক্ষণের জন্য ছবি কাছে এসে ধরা দিয়ে সে আবার দূরে সরে গেল। তার ঠোঁটমুখ কাঁপছে শিশির করে, থমথমে ছায়ার শিহরণের মতো। আমি শুধোলাম, এমন করছ যে! কি হয়েছে তোমার ছবি?

কই কিছু হয়নি তো? হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ও বলল, ভাবছিলাম পুরুষমাত্রই একরকম, একেবারে এক ছাঁচে গড়া!

কি রকম?

স্বার্থপর! নিজের স্বার্থটুকু আদায় করতেই সর্বদা ব্যস্ত। না দিলে অভিমান করে, নয় হুমকি দেখায়; কিন্তু সেটাও স্বার্থ আদায়ের ফন্দি। সরল-বিশ্বাসে যে মেয়ে সেই ফাঁদে পা দিল, সে-ই মরল। পুরুষদের কাছে প্রেম জিনিসটা অভিনয়, শিকার ধরবার টোপ মাত্র কিন্তু মেয়েদের সেটাই জীবন।

যেন ছবি নয়, ছবির মুখ দিয়ে অনেক দূরের অচেনা কেউ কথাগুলো বলল মন্ত্রোচ্চারণের মতো।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এসব কথা আমাকে বলছো কেন ছবি?

কেন বলছি বুঝতে পারছ না? তুমিও এইরকম বলে। তুমি শিল্পী, তুমি স্রষ্টা, একটু ভিন্ন হতে পারলে না? বন্ধুর বেশে এসে সেই বন্ধুত্বের মর্যাদা নষ্ট করতে এতটুকু তোমার দ্বিধা হলো না? যা ভেবেছিলাম আসলে তা নয়। কিন্তু সাদাসিধে মেয়েটির ভিতরে এমন আগুন লুকিয়ে আছে তা ওর মুখ দেখে অনুমান করাও সম্ভব ছিল না; ওর তিরস্কারে তাই মাথা নিচু করে থাকি। সে বলল, যাক্ গে! আবারো বলছি ভালোবেসে যদি করে থাক তাহলে আমাকে তুমি ছাড়ো। তোমার মঙ্গল হবে।

যে মঙ্গল আমি চাই না ছবি! তুমি বিশ্বাস করো তোমাকে না পেলে জীবন আমার দুঃখময় হবে।

ছবির মুখের মধ্যে আবার সেই পরিচিত রেখাগুলো ফুটে উঠতে থাকে যা করে তাকে স্নিগ্ধ, মায়াময়ী।

ও পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলে আমি তাকে আগলে ধরে বললাম, বলো তুমি আমার হবে।

হ্যাঁ হবো। আমি তোমারই হবো! ঠোঁটের ফাঁকে ফিসফিস্ করে ছবি বলল, কিন্তু একটা কথা দিতে হবে।

কি কথা বলো। মানুষের অসাধ্য না হলে আমি তা রাখব।

অসাধ্য কিছু নয়। ছবি হঠাৎ অদ্ভুত কাণ্ড করল, মাটিতে লেপটে বসার পর আমার মাথাটা বুকে নিয়ে চুলে আদর করতে করতে বলল, কথা দাও বিয়ের আগে তুমি আমাকে স্পর্শ করবে না?

গম্ভীর আনন্দমগ্ন স্বরে আমি বললাম, তা কি করে সম্ভব, লক্ষ্মী!

সম্ভব খুবই সম্ভব। দেখা হবে কথা হবে কিন্তু ওটি নয় কেমন?

খানিকক্ষণ চুপ হয়ে রইলাম। ও জানেনা ওর সান্নিধ্যে এসে আমার মধ্যে কি বিপ্লব ঘটে গেছে এবং তা বাঁধ দেয়া আমার পক্ষে কত কষ্টকর। তবু বললাম, তুমি যদি চাও তাহলে আর আপত্তি করব না। কেমন, হলো তো?

রাত আটটার দিকে বাসায় ফিরে জামিল দেখেন স্টুডিওতে আমি কাজ করছি। কাউকে বলিনি তবে মনে-মনে আছে ছবিটার নাম হবে সোনালি শস্যের ক্ষেতে পল্লীবালা। পটভূমি পরে আঁকব। এখন ছবিকে টুলে বসিয়ে চরিত্রটা শুধু ফুটিয়ে তুলছি। ছবি সত্যি আশ্চর্য মেয়ে, দেড়ঘণ্টা ধরে সিটিং দিচ্ছে একটানা, তবু একটু নড়তেও চাইল না! যেভাবে হাসতে বলেছি সেই মধুর হাসিটুকু লেগেই আছে সারাক্ষণ। দ্বিতীয় মোনালিসা আঁকাই যেন আমার উদ্দেশ্য; কাজ করতে গিয়ে এমন প্রেরণা আর কোনদিন অনুভব করিনি। আমি তন্ময়। এক মোহনায় নদ ও নদীর মতো দুজনে মিশে গেছি একই আবেগের এলাকায়, ছবি সার্থক না হয়ে যায় না।

জামিল চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ লক্ষ্য করার পর ঘরে ঢুকে বললেন, কি হে, আজ দেখি তোমার তুলি থামছেই না! কি ব্যাপার, জোয়ার এলো নাহি হঠাৎ

আমার মগ্ন চোখদুটো একবার শুধু ঘুরে আসে কিন্তু হাতের তুলি থামে না। জামিল চৌকির কোণে বসে একটা সিগারেট ধরালেন।

কমপোজিশনে হলুদ চড়ানো শেষ হলে সোজা হয়ে দাঁড়াই। হাত দুটো ওপরের দিকে ছুঁড়ে একটা গভীর শ্বাস বুক ভরে টেনে নেয়ার পর বললাম, নিশ্চয়ই রাগ করেননি, দাদা। জরুরি কাজ ছিল একটা তাই চলে গিয়েছিলাম!

জামিলকে আপনি বলাটা আমি কিছুতেই ছাড়তে পারলাম না। হয়তো পারবও না কোনো সময়।

ছবি বলল, আমার কাজ তো শেষ হলো? এখন আমি ভাতটা চড়িয়ে দিই গে।

বোসো, এত ব্যস্ত কেন। আমি পরিবেশটাকে হালকা করবার জন্য বললাম, ছবি সত্যি কাজের মেয়ে দাদা! কি সিটিংটাই দিল, একটুখানি নড়নচড়ন নেই, একেবারে যেন পাথরের মূর্তি। একটা কিছু প্রেজেন্ট করলে হয় ওকে, কি বলেন?

দাদার মুখের ওপর থেকে গাম্ভীর্যের ছায়াটুকু সরে গেল না দেখে ছবি কাজের অছিলায় বেরিয়ে গেল।

একমুখ ধোয়া ছেড়ে জামিল বললেন-দেখ জাহেদ, তোমাকে একটা কথা বলব, কিছু মনে করো না। জীবনকে গড়ে তোলা সত্যি কঠিন কাজ। বিশেষ করে, শিল্পীর জীবন। শিল্পীর জীবনে প্রেম দরকার, কিন্তু তাতে জড়িয়ে পড়লে চলবে না। অথচ আমরা জড়িয়ে যাই। ফলে নৈরাশ্য এবং ব্যর্থতা। দৃষ্টান্ত আমার জীবন। কিছুই করতে পারতাম না এ আমি মনে করিনে; কিন্তু একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম বলেই সখাদ সলিলে ডুবে গেছি। শিল্পী জামিলের মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই, এখন আছে শুধু তার। প্রেতাত্মা।

কিন্তু জামিল তো বেঁচে আছেন! আমি বললাম, এবং কাজও করছেন, তার দ্বারা মহৎ সৃষ্টি হবে না কে বলতে পারে? হয়তো সেই সৃষ্টিরই অগ্নিপরীক্ষা চলছে এখন।

থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইউর কমপ্লিমেন্টস্! জামিল ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি হেসে বললেন, জামিলের দেহটা কবরে যায়নি এখনো একথা ঠিকই; কিন্তু সে যে মরে গেছে। তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। এ যে গায়ের জোরে অস্বীকার করতে চাইবে বুঝব হয় সে তোয়াজ করছে নয় পরিহাস। তুমি নিশ্চয়ই সেরকম ছেলে নও? দেখ জাহেদ, আমি কাউকে গ্রহণ করি না কিন্তু যখন গ্রহণ করি আন্তরিকভাবে করি। তোমাকে আমি অত্যন্ত ভালোবাসি এবং আমি চাই তুমি বড় হও, হও বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী! সেইজন্য বলছি, ভুলপথে পা দিও না!

সুবোধ বালকের মতো বললাম, কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না!

বুঝতে পারছ ঠিকই কিন্তু না বোঝার ভান করছ! জামিল তার প্যাকেট থেকে আমাকে একটা সিগারেট দিতে দিতে বললেন, যাই হোক, তুমি অস্বীকার করবে না কিন্তু ছবির দিকে তুমি এক পা অগ্রসর হয়েছ বলেই আমার ধারণা। তাই শুভাকাক্ষী হিসেবে তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, আর সামনে বেড়ো না। এমন সম্ভাবনাপূর্ণ ভবিষ্যৎটা নষ্ট করে তো কোনো লাভ নেই।

আমি কি বলব হঠাৎ ঠিক করে উঠতে পারিনে। স্বীকার করলেও বিপদ, না করলেও বিপদ। কোন্ দিকে যাই?

একটুখানি ইতস্তত করে বললাম, ছবিকে বললেই ও রাজি হলো। নইলে–

জাহেদ, মিছিমিছি লুকোবার চেষ্টা করো না, পাঁচ বছর একটানা প্রেম করেছি, আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না। চেহারা দেখলেই সব বুঝতে পারি; কার মন কোন্ দিকে ঘুরছে।

এবার আমি উত্তপ্ত হয়ে উঠি। বললাম, বেশ, যদি তাই হয়, আমি ভুল পথে পা বাড়িয়েছি বলে আমার মনে হয় না। ছবির মতো মেয়েকে ভালোবাসতে পারাটা যে কোনো ছেলের পক্ষে সৌভাগ্য।

জামিলের চোখমুখ নিমেষে লাল হয়ে গেল। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো সটান দাঁড়িয়ে গিয়ে তীক্ষ্ণ তির্যক কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, কিন্তু সে চলবে না। তোমাকে শিল্পী হতে হবে, শিল্পী।

আমি শিউরে উঠে একহাত পিছিয়ে যাই। কিন্তু নিরাপদ দূরত্বে যাওয়ার আগেই কোমর থেকে খুলে নেয়া তার মোটা চামড়ার বেল্টের সপাং সপাং আঘাত আমার গায়ে পড়তে থাকে।

ছবি দৌড়ে এসে উচ্চারণ করল, দাদা!

বাধা দিনে ছবি; বাধা দিনে!

কিন্তু ছবি হাতসমেত ওকে সাপটে ধরল। আত্মরক্ষার স্বাভাবিক তাড়নায় কখন বসে পড়েছিলাম জানিনে, জামিলের উন্মত্ততা শেষ হলে বন্য দৃষ্টিতে তাকাই। একি কাণ্ড!

হাতের বেল্টটা ছেড়ে জামিল কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন চৌকির ওপর। ছবি ছুটে এসে আমাকে ধরে। গায়ে হাতড়াতে হাতড়াতে বলল, ইস দাদা! তুমি একটা পশু।

হ্যাঁ পশু! আমি একটা পশু! বিড়বিড় করতে করতে জামিল বাইরে চলে গেলেন।

ছবি আমাকে ধরে তোলে। সামান্য বেল্টের মার তবু লেগেছে মন্দ নয়। প্রত্যেকটা বাড়ি ফুলে ফুলে উঠেছে। আঘাতের স্থানগুলোতে চিচি ব্যথা, অশেষ যন্ত্রণা। ছবি আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মুছে বলল, তুমি কিছু মনে করো না, দাদা পাগল! সত্যি পাগল হয়ে গেছেন!

সে আমি জানি ছবি! অতিকষ্টে আমি বললাম, কিন্তু এতটা ভাবতে পারিনা!

কিছুক্ষণ এমনি ভাবেই কাটল, আঘাতের জ্বালা ভুলে একদম হতভম্ব হয়ে থাকি! এমন পরিস্থিতিও সম্ভব?

কিন্তু সেও বেশিক্ষণ নয়! ছবির হাত ধরে চৌকিতে এসে বসেই শুনি হু হু করে প্রবল কান্নার শব্দ। দু’জনে তাড়াতাড়ি বাইরে গেলাম। জামিল কাঁদছেন, বারান্দায় দুই হাঁটুর ফাঁকে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে জামিল ভাই কাঁদছেন। শরীরটা ঝাঁকুনি খেয়ে ওঠে একেকবার। ছবি বাতি নিয়ে এলো! আমার ভেতরটা তখনো অস্থিরতায় আচ্ছন্ন, লোকটাকে ধরতে প্রবৃত্তি হলো না!

ছবি বাতিটা রেখে তার হাত ধরে বলল, দাদা! ওঠো, চলো তোমাকে বিছানায় শুইয়ে দিই।

জামিল দ্বিরুক্তি না করে উঠে পড়লেন; ছবির কাঁধে ভর করে বড় কামরার চৌকিটার ওপর গিয়ে গা এলিয়ে দিলেন। আমি হারিকেনটা নিয়ে তেপয়ার ওপরে রাখি। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে, উদ্ভ্রান্ত চাউনি। যেন চিনতে পারছেন না। ঘনঘন শ্বাস ফেলছেন। এই অবস্থা আমার অজ্ঞাত নয়। এ যে মৃত্যুর পূর্ব লক্ষণ আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ছবি! মীরাবৌদির ঠিকানাটা বলো।

কেন! ও যেন ঠিক বুঝতে পারছে না।

আমি বললাম, কাজ আছে।

ছবি কম্পিত হাতে ঠিকানাটা লিখে দিতেই ওকে জামিলের মাথায় পানি ঢালতে বলে দ্রুতপদে বেরিয়ে গেলাম। ফাঁড়ির ঘণ্টায় তখন দশটা বাজছে, ঢং ঢং ঢং।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *