০১. রংবেরং গাউন শাড়ি

তেইশ নম্বর তৈলচিত্র – উপন্যাস – আলাউদ্দিন আল আজাদ

উৎসর্গ – শিল্পীবন্ধু আমিনুল ইসলামকে মালিবাগের দিনগুলোর স্মরণে

সবিনয় নিবেদন

তেইশ নম্বর তৈলচিত্র আমার প্রথম উপন্যাস। যে কোনো লেখক-শিল্পীর প্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে তার যে অনুরাগ ও দুর্বলতা, এই লেখাটিও আমার হৃদয়ে তেমনি মিঠেকড়া, কাঁটাগুল্মময়, কখনো বা স্বপ্নের মায়াবৃক্ষ। লিখন সময়ই ছিল জীবনের গভীরে নিমজ্জন ও বিচ্ছিন্নতা, যা তখন আমার জানা ছিলো না- আজ বহুদিন পরে কাব্যতত্ত্বের এই উপাদান আবিষ্কার করে আমি বিস্মিত হই। জাহেদ চরিত্রে লেখকের আত্মাবিলুপ্তি ঘটেছে, জিনিসটা তখন বুঝতে পারিনি।

‘পদক্ষেপ’ নামের একটি অনিয়মিত কাগজের ঈদ সংখ্যায় গল্পটি প্রথম ছাপা হয়েছিল (১৯৬০)। একে বই আকারে প্রথম প্রকাশ করেন নওরোজ কিতাবিস্তান, প্রচ্ছদে ছিল মোহাম্মদ ইদ্রিস আঁকা মাতৃমূর্তি। সে সময়কার নওরোজের মোহাম্মদ নাসির আলি সাহেবকে ভুলতে পারি না। তার স্মিতহাস্য ও সহানুভূতি অতুলনীয় ছিল। মুক্তধারা, সাতবার ছেপেছে। সেজন্য অগ্রজপ্রতিম চিত্তরঞ্জন সাহার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তৈলচিত্রের দশম মুদ্রণ, নতুন মুদ্রণ প্রযুক্তিতে প্রকাশ করছেন আহমদ পাবলিশিং হাউস। পরম সুহৃদ মেছবাহউদ্দীন আহমদকে সেজন্য অজস্র ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।

আলাউদ্দিন আল আজাদ
মাঘ ১৯, ১৪০০ ফেব্রুয়ারি ০১, ১৯৯৪
রত্নদ্বীপ, উত্তরা, ঢাকা।

.

০১.

রংবেরং গাউন শাড়ি ওড়নার খসখস্, পালিশ করা কালো চচ্চকে জুতোর মচমচ, বিচিত্র কণ্ঠনিঃসৃত সংলাপের ঐকতান, এখন আর নেই। রাত দশটা, একজিবিশন হলের ভারি দরোজা প্রথম দিনের মতো বন্ধ হয়ে গেল।

প্রথম দিনেই পুরস্কার ঘোষণা। বিদেশি কূটনীতিবিদ, উচ্চ সরকারি কর্মচারী, গণ্যমান্য নাগরিক, সাংবাদিক ও দর্শক নারী-পুরুষে ঘরটা জমজমাট। জাতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনী, হয়তো তাই এতো ভিড়। উদ্বোধনী ভাষণ দেওয়ার জন্য স্যুটপরা গাট্টাগোট্টা মন্ত্রী মহোদয় উঠে দাঁড়ালেন। ললিতকলার ভূত-ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তৈরি করা কথাগুলো শেষ করবার পর বললেন, রিয়্যালি ইট ইজ মাচ এনকারেজিং দ্যাট নিউ ট্যালেন্ট আর কামিং ফরওয়ার্ড টু এনরি দিস্ ফিল্ড অব ন্যাশনাল গ্লোরি। অ্যান্ড আই এ্যাম্ রিয়্যালি হ্যাপি টু এনাউন্স দ্যাট দি পোর্ট্রেট, হুইচ স্টুড় ফার্স্ট ইন দিস একজিবিশন, সো ফার আই রিমেম্বার অয়েল পোর্ট্রেট নাম্বার টুয়েন্টি থ্রি, ইজ নট অনলি এ গুড পিস অব আর্ট, বাট অলসো ভেরি নিয়ার টু এ মাস্টারপিস।

তখন সকলের মধ্যে গুঞ্জন পড়ে গিয়েছিল। বক্তৃতা শেষ হওয়া মাত্র ছবিটা দেখবার জন্য সে কি ঠেলাঠেলি। বেশির ভাগ দর্শক ভিড় জমালো গিয়ে সেখানেই। এই সঙ্গে শিল্পীর খোঁজ নিতেও ছাড়ল না।

ভেরি গ্ল্যাড টু মিটু ইউ। প্রসাধন-করা মুখ, একজন প্রৌঢ়া মহিলা বললেন, স্যার উইল ইউ হ্যাভ এ কাপ অব টি উইথ মি অ্যাট মাই হোম?

মহিলা একজন বিশেষ পরিচিত শিল্প সমঝদার। সময় পাব কিনা জানিনে, তবু বলে ফেললাম, ও সাট্যেলি; ইট উইল বি এ প্লেজার টু মি!

কলেজের দুতিনটে ছোকরা ও একটি মেয়ে আমার অটোগ্রাফও নিয়ে গেল। তাজ্জব এই এক মুহূর্তেই বিখ্যাত হয়ে গেলাম নাকি?

দেহমনে ক্লান্তি নেমে এসেছিল। চারটে বড়ি খেয়েও মাথা ধরাটা ছাড়ল না। কিন্তু তবু এখন গিয়ে যে শুয়ে পড়ব, সে ভরসা নেই। তিন রত্নের জোট। রাস্তায় বেরিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত ঘোরাফেরা করবে, সঙ্গে না গেলে বলবে প্রাইজ পেয়ে পায়াভারী হয়েছে, মাটিতে পা পড়তে চায় না। আমি ভীরু নই, তবু এই অপবাদ স্বীকার করে নেব না বলেই হোটেলে ফিরে গেলাম না।

আমার তিন বন্ধু, তিনজনেই গুণী ছেলে, আর্ট স্কুলের কৃতী ছাত্র ছিল, বিদেশ ঘুরে এসেছে। চিত্রকলার তীর্থভূমি ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ডের গ্যালারি রেস্তোরাঁ গলিঘুজি ওদের নখদর্পণে, কোনো প্রসঙ্গে কথা উঠলেই চিৎকার করে ওঠে একেকবার। লন্ডনের কোন্ বাইলেনের কোন্ ঘুপচি আধো অন্ধকার কফিঘরে রাগী ছোকরাদের আড্ডা নোট বইয়ে তার ঠিকানা লেখা আছে; বুনিয়াদের ওপর নিজেদের ঘর তোলার জন্যই বুনিয়াদের বিরুদ্ধে যাদের অভিযোগ।

এরাও বিদ্রোহী। আর সে শুধু ভেতরে নয় বাইরেও। পোশাক-আশাক কেমন খাপছাড়া, তেরপালের মতো মোটা নীলচে কাপড়ের আটসাঁটো প্যান্ট আর গায়ে হালকা সবুজ রঙের জ্যাকেট। জুতোগুলো অর্ডার দিয়ে তৈরি করা অদ্ভুত সাইজ, বাজারে যার প্রচলন নেই। মাথার চুল কাটে না কখনো, চুলে তেল দেয় না তাই কুঁকড়ে কুঁকড়ে ফুলে। ফুলে থাকে। ছ’মাস দাড়ি রাখে, আর ছ’মাস গোঁফ। দাড়ি যতদিন থাকে গোঁফ প্রায় প্রতিদিন পালিশ করে কামায় এবং গোঁফের কালে দাড়িরও সেই অবস্থা। ওদের অলিখিত রীতিতে গালে চড় দেওয়া মানে ভালোবাসা, হাউমাউ করে কেঁদে ওঠা মানে হাসা। কোনো কারণে কেউ হাসলে অন্যজনে মুখ চেপে ধরে তার-এ নাকি কান্না এবং কান্না জিনিসটা সহ্যের অতীত। নারীর সঙ্গে পুরুষের কি ধরনের সম্পর্ক হবে, সে সম্পর্কে তাদের মতামত অদ্ভুত বটে কিন্তু নিঃসন্দেহে অভিনব।

আসলে সমাজ ও সভ্যতা ছেঁড়াকোটের মতোই জরাজীর্ণ হয়ে গেছে, কাজেই এর মূল্যবোধের কোনো অর্থ নেই। শিল্পে ও জীবনাচরণে কিম্ভুতকিমাকার হওয়াটাই যুগের দাবি এবং এখানেই বিদ্রোহ। বিকৃতি ব্যাপক বলেই আকৃতির কোনো প্রয়োজন নেই। বিকৃতিকে অধিকতর বিকৃতি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। যেমন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা, বিষের ওষুধ বিষ।

তাছাড়া, জীবনটা নাতিদীর্ঘ উত্তেজনা মাত্র, সেনসেসন। প্রতিমূহুর্তে সেই সেনসেসন লাভ করাই প্রধান কাজ। সে যে ভাবেই হোক। একজন মানবীর মাথার চুলে আদর করার চেয়ে কুকুরীর গাল চেটে যদি তা পাওয়া যায় তাহলে সেটাই কাম্য।

মুজিব রোমের একটি প্রাচীন স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। যেখানে সে থাকত সেই বুড়ি বাড়িওয়ালির মধ্যবয়সী মেয়েকে সে ভালোবেসেছিল প্রায় রোমিওর মতো। ছুকরিদের সে পছন্দ করে না মোটেই, বলে মাকাল, বাইরে আকৃতি ও বর্ণ আছে বটে, কিন্তু কোনো স্বাদ নেই, গন্ধ নেই, গভীরতা নেই। ঐ মেয়েটিকে সে পাবে না জানত, তবুও ওর সবজি ব্যবসায়ী স্বামীর সঙ্গে যে খাতির হয়েছিল সেটাই পরম লাভ।

আমেদও প্রেমে ব্যর্থ হয়েই ধাক্কাটা সামলাবার জন্য জোগাড় যন্ত্র করে লন্ডন যায়। সেখানে ওর ভাই থাকতেন। কাজেই বিশেষ অসুবিধে হয়নি। বেশি বেশি টিপ দিয়ে সেও রেস্টুরেন্টের এক নাবালিকার সাথে ভাব জমিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন ওকে দিয়ে গোপনে একটা অস্বাভাবিক কাজের চেষ্টা করে। মলি ম্যানেজারের কাছে রিপোর্ট করে দিলে তাকে অনেক কড়াকথা শুনতে হয়েছিল।

এ বিষয়ে রায়হান সবচে দুঃসাহসী এবং উদার। নিজের নির্বাচিত মেয়েকে অন্য লোকের সাথে কেলিরতা অবস্থায় দেখতেই সে ভালোবাসে আর এভাবে সে যে উত্তেজনা লাভ করে তা অতুলনীয়, অকথ্য। কিন্তু এজন্য তিনটি মেয়ের সঙ্গেই হয়েছে ওর ছাড়াছাড়ি।

এরা আমার বন্ধু সেজন্য গৌরব বোধ না করে পারি না। ইউরোপে প্রত্যেকের একক প্রদর্শনী বহু সমঝদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, খবরের কাগজে সচিত্র সমালোচনার কাটিং দেখেছি। প্রথম পুরস্কার আমি না পেয়ে ওদের যে কেউ পেলে আরও খুশি হতাম। সেজন্য ভেতরে ভেতরে একটু লজ্জিত আছি। বন্দর রোডে পড়ে সোজা হাঁটতে শুরু করলে শুধোলাম, কোথায় যাচ্ছ তোমরা?

তা জানার দরকার কি বাবা! পদাঙ্ক অনুসরণ করো চুপচাপ! এখানে তো আর বৌ নেই? হেঃ হেঃ হেঃ!

ফার্স্ট প্রাইজ পেলি, ফুর্তি লাগছে না? শয়তানের পাছ ধরে নরকে গেলেও এখন আনন্দিত হওয়া উচিত।

আরে ভালো কথা, কালকে কিছু ঢালিস্ তো? ছবি থেকে পাঁচশ’ টাকা পেলি, তিন বোতল খাঁটি মাল চাই, তার একরত্তিও কম নয়।

সাটেলি; সাটেলি! অদ্ভুত মুখ বানিয়ে রায়হান টেনে টেনে বলল, এবং সঙ্গে ঘিয়ে ভাজা পরটা আর মুরগির মাংস!

জিভটা বার করে এমনভাবে ঠোঁট চাটল, আমরা হেসে উঠলাম। আমি বললাম, টাকাটা আগে পেতে দাও। দ্রলোক কিনেছেন, করে নেন তার ঠিক কি।

যবেই নেন, নেবেন তো? ব্যস, সেদিন হবে। কিন্তু আসল কথা কি জানিস? টেনে ফেললে সবশেষ এখন তা ভাবতে যে পাচ্ছি, এটাই আসল! বলে রায়হান বাতাসে সশব্দে একটা চুমুক দিল।

ইয়েস! স্পিকিং জাস্ট লাইক অ্যান অ্যাংরি ইয়ংম্যান! আমেদ রায়হানকে বলল, কনুইটা বাড়িয়ে দে ওস্তাদ, চুমু খাই।

থামতে হলো। গম্ভীর ভঙ্গিতে ওদের কাণ্ডটা শেষ হবার পর আবার চলতে শুরু করি!

রাত সাড়ে এগারোটায় ছ’মাইল পথ হেঁটে গিয়ে দু’কাপ কফি চারজনে ভাগাভাগি করে খাওয়ার মধ্যে রোমাঞ্চ আছে বৈকি! সে রোমাঞ্চ আমিও পেলাম। তবে শরীরটা ঝিমিয়ে এলো, এই যা। রাত একটার সময় পা টেনে টেনে যখন হোটেলে এলাম, তখন মগজে কিছু অবশিষ্ট নেই। উদরে তো নয়ই। দারোয়ানের সঙ্গে ব্যবস্থা ছিল, ডাকতেই উঠে এলো। গেট পেরিয়ে কামরার তালা খুলে ভেতরে গেলাম। দেখি খাবার দিয়ে গেছে বয়। কি আর খাব। নানা রকম খাদ্যদ্রব্যে মনটা ঠাসা, আর এই তো যথেষ্ট। তবু পেটের জ্বালায় খানিকক্ষণ বসে দু’টো রুটি চিবোই।

পীড়াপীড়ি করতে থাকায় আমাকে গালাগালসহ গেটের কাছে পৌঁছে দিয়ে ওরা আবার বেরিয়ে পড়েছিল। রাত তিনটে না বাজলে নেশা জমে না।

পরদিন ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। করাচীর কর্মব্যস্ত উজ্জ্বল সকাল। গোসল করে নাস্তা খাওয়ার পর আস্তে ধীরে বেরুলাম। দিয়ে দেখি একজিবিশন হলের দরোজা খোলা হয়েছে যথারীতি। এ বেলায় লোকের ভিড় নেই, তাছাড়া শিল্পীদের উপস্থিত থাকারও কোনো কথা ছিল না। নেহাৎ ভাড়া দিয়ে এনেছে এবং প্রথম দিন বলে গতকাল উপস্থিত ছিলাম। আজকে আসার প্রধান কারণ, ছবির টাকাটা পাওয়া যায় কি না।

ভাগ্যি ভালো পেয়েও গেলাম বারোটার সময়। আরও ছবি বিক্রি হয় তো হবে, নয় এই যথেষ্ট। কেনাকাটার যে ফিরিস্তি এনেছিলাম তার জন্য চারশ’ টাকার প্রয়োজন ছিল। এখন হাতে আছে পাঁচশ’ মন্দ কি?

মায়ের দুর সম্পর্কের বোন জোবেদা খালা এই শহরেই বাস করেন। নামকরা একজন মাদ্রাজি ব্যবসায়ী তার স্বামী। আমি আসছি চিঠিতে জানিয়েছিলাম। প্রথম দিনই বিমানবন্দরে গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। গাড়িতে এলাম বটে কিন্তু তাঁর বাড়িতে উঠি নি। কারণ থাকবার ব্যবস্থা আগেই করা হয়েছিল। এসেছি দেখবার জন্য, বন্ধু-বান্ধবদের। সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শটাও লোভনীয়।

রাস্তার ধারে প্রাসাদোপম বিরাট বাড়ি। আজ গিয়ে দেখা দিলে জোবেদা খালা ভীষণ খুশি হলেন। আদর করে বললেন, এসেছিস ভালোই হলো। আজ আমরা বেড়াতে যাচ্ছি, ম্যানোরায়। তুইও চল।

বললাম, নিশ্চয়ই যাব, অবশ্যি যদি আপনাদের কোনো অসুবিধে না হয়।

অসুবিধে? কি যে বলিস। যত লোক হয় ততই ভালো। তাছাড়া এই প্রথম এলি করাচী, আমাদের কিছু করার আছে তো? বৌমাকে নিয়ে এলেই পারতিস? বাচ্চাটা কেমন হয়েছে রে?

খালা কথা বলতে শুরু করলে থামতে চান না। উপরন্তু অনেকদিন পর পেয়েছেন দেশের লোক।

দেখতে খারাপ হয় নি। তবে স্বাস্থ্যটা খুব ভালো যায় না। বাচ্চার প্রসঙ্গ ছেড়ে আমি নিচু স্বরে বললাম, খালা, আমার মাদার আর্থ ছবিটা একজিবিশনে ফার্স্ট হলো!

তাই নাকি, এতবড় খবরটা তুই এতক্ষণ চেপে রাখলি? ঘাড়ে গর্দানে মুটিয়ে যাওয়া খালা ভয়ানক ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ইয়ারিং দুলছে। প্রসাধন-বিশুদ্ধ শক্ত চামড়ার গালেও পড়ছে টোল। উচ্ছ্বসিত নানা প্রশ্নের উচ্চারণে মুখের কোণে ফেনা দেখা দিল।

তাঁর উল্লাসটা আন্তরিক, শিল্পসাহিত্যের প্রতি বরাবরই আকর্ষণ ছিল, মাঝে মাঝে লিখেও থাকেন। বড়লোকের বৌ, শখ প্রচুর; কিন্তু এ ধরনের শখ ক’জনের থাকে?

এখানে আসবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্তও করাচীকে মনে হয়েছিল শুকনো, হৃদয়হীন, রাতজাগা ধনী লম্পটের মতো। হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, দু’দিনেই। এতক্ষণে একটু সহজ হলাম। গুনগুন গান জমে ঠোঁটের কোণায়। বাড়িটা সত্যি চমৎকার। আধুনিক স্থাপত্য রীতিতে তৈরি। ত্রিকোণ সিঁড়ি-বারান্দা, দেয়ালে গাঁথা ফিতের মতো ফুলের চাতাল। অবশ্য নকল মুক্তোর মতো, তবু রুচির ছাপ তো আছে খানিকটা? এটুকুতেই আমি খুশি। বাথরুমের টবে ঈষৎ গরম পানিতে অনেকক্ষণ ধরে গা ডুবিয়ে গোসল করার পর খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম নিই। মানুষ ও খাদ্যদ্রব্যে গাড়ি বোঝাই, আড়াইটার সময় বেরিয়ে পড়লাম। খালার ছোট দুটো মেয়ে, মেকানিক ও ড্রাইভারসহ আমরা ছয়জন। তাছাড়া এক বাঙালি নব-দম্পতি এসেছেন। ঠাসাঠাসি করে বসেছি; তবু সকলের চোখেমুখেই স্থূর্তির দীপ্তি, হালকা হাওয়ায় পালক মেলে উড়ে বেড়াতে কোনো ক্লান্তি নেই।

নীল আকাশ, তক্তকে রাস্তা, হরেক রকম মুখের সমারোহ, পৃথিবীটা সত্যি সুন্দর। গাড়ির শব্দের সঙ্গে ডুবিয়ে দুটি কলি গাই বারবার, কান্নাহাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা, তারি মধ্যে চিরদিনের বইব গানের ডালা।

গাইছি বটে, কিন্তু ভাবছি অন্যকিছু। স্বামী বাইরে গেছেন, অথচ জোবেদা খালা নিজেকে নিয়ে বেশ আছেন, এই সূত্র থেকে চিন্তাটা ক্রমে বিস্তারিত হতে থাকে, বেগুনি মেঘের মতো। আসলে তার জীবনটাই তো বর্ণময়। ছোটবেলায় দেশের বাড়িতে দেখেছি দু’একবার, শাদামাটা বোকা বোকা চেহারা। টেনে টেনে কথা বলতেন। একটা সরল স্নিগ্ধ সৌন্দর্য ছিল তাঁর চলনে বলনে কাপড়ে জেওরে সর্বত্র। স্কুল-মাস্টার বাবা তাঁকে স্কুল-মাস্টারের হাতেই সঁপে দিয়েছিলেন কিনা। ছেলেটা আদর্শবাদী, দেশের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। বাবা খুবই স্নেহ করতেন, নিজের ছেলেদের চেয়ে বড়ো।

তাঁর নিজের ছেলেরা কলকাতায় গিয়ে তখন উন্নতির জন্য উঠেপড়ে লেগে গিয়েছিল। একজন এক কুখ্যাত হোটেলে চাকরি নেয়, দ্বিতীয়জন খোলে মদের দোকান।

সেই সূত্রেই সাহেবের সঙ্গে পরিচয়। ভাবির সঙ্গে কলকাতায় বেড়াতে গেলে জোবেদা খালার সঙ্গেও ভদ্রলোকের পরিচয় হয়েছিল।

উনি ডাকসাইটে মার্চেন্টই শুধু নন, পাক্কা মুসলমান। ভারতের প্রত্যেক বড় শহরেই যেমন তাঁর অফিস তেমনি মাদ্রাজ, বোম্বাই, এলাহাবাদ তিন জায়গায় তিন বিবি। প্রত্যেককেই বাড়ি করে দিয়েছেন এবং মাসোহারা নির্দিষ্ট। এক একজনের কাছে এক এক মাস থাকেন, প্রতি তিনমাস অন্তর পালাবদল। কলকাতায় এমন ব্যবস্থা ছিল না, সে জন্য অসুবিধে হতো এবং পরহেজগার হিসেবে সুন্নতও পুরা করতে চাইলেন।

স্কুল-মাস্টার আহাদের ইচ্ছা ছিল না বৌকে তালাক দেন; বরং ভাইয়ের প্ররোচনায় তার পদস্খলন হওয়া সত্ত্বেও ফিরিয়ে আনতেই গিয়েছিলেন। কিন্তু গিয়ে দেখেন, জোবেদা সম্ভ্রান্ত মহিলা। প্রকাণ্ড পাকা বাড়িতে থাকেন। গেটে বিহারি দারোয়ান, চাকর চাকরানী প্রচুর।

একটা পিস্তল জোগাড়ের চেষ্টা করেছিলেন কয়েকদিন; কিন্তু শেষে এমনিতেই ফিরে এসেছিলেন। এরপর আর তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি।

গান কখন থেমে গিয়েছিল খেয়াল নেই, হঠাৎ খালার কণ্ঠস্বর কানে গেল, কি জাহেদ! চুপ হয়ে আছি যে, কেমন লাগছে কিছু বল্।

বেশ ভালো! আমি হেসে বললাম, ক্লিফটন আর ম্যানোরা বুঝি আরও সুন্দর?

হ্যাঁ। খালা বললেন, তবে ক্লিফটন আমার ভালো লাগে না, আউটিং এর জন্য ম্যানোরাই বেস্ট। আর চেঞ্জের জন্য হবে। সেখানে অনেকগুলো কটেজ হয়েছে। ওদিকে যেতে চাও নাকি?

আমার কোথাও যেতে আপত্তি নেই, দেখতেই এসেছি। তাছাড়া নতুন জায়গা মাত্রই আমার প্রিয়।

বেশ যাওয়া যাবে আর একদিন। কটেজ ভাড়া করে একদিন একরাত্রি ওখানে কাটানো যাবে।

আমি চুপ হয়ে থাকি। ভাবছিলাম, জীবন পদার্থটা আশ্চর্যরকম স্থিতিস্থাপক; যে কোনো অবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারদর্শী। সে যতই নিষ্ঠুর হোক না কিংবা অনাত্মীয়। সে খোলস ছাড়ে খোলস বদলায়। নতুন নতুন আচ্ছাদনে হয় চঞ্চকে বিচিত্রিত। আবার চরম ভাগ্যের সময়েও হারিয়ে যায় না, মরতে মরতে বাঁচে। ধুঁকতে ধুঁকতে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সরাসরি। সে মরে না, কারণ বেঁচে থাকাই তার ধর্ম।

জোবেদা খালার নবনব বেশ, নবনব রূপের উৎসও বুঝি এই? কিন্তু একটি জিনিস এখনও রহস্যময়। যে বসন্ত এসেছিল, দেহমনকে সাজিয়েছিল রঙে রঙে মায়াবী নেশায় সে যখন চলে গেল ঝরাপাতার সঙ্গে তাঁর সমস্ত স্মৃতিও কি চির অবলুপ্ত হয়ে গেছে? আজকে অন্য ঋতু অন্য পরিচ্ছদ, কিন্তু পূর্বরাগিনীর সামান্য অংশও কি এর অন্তরালে লুকিয়ে নেই? তা জানতে বড় ইচ্ছে।

গাড়ি থেকে নামবার পর জেটির ধারের একটি পালের নৌকা ভাড়া করে উঠে পড়লাম। আজ শনিবার, ভিড় মন্দ নয়। অনেক দল উপদল, বিভিন্ন জাতের মেয়ে পুরুষ বেরিয়ে পড়েছে। সমস্ত খাড়িটা জুড়েই জাহাজ, নৌকা, লঞ্চের আনাগোনা। চেয়ে চেয়ে দেখি, যেন একটা গতিময় ছবি, নৌকোর গলুইয়ের কাছে বসে স্কেচের খাতাটা খুলোম। ছোট মেয়েদুটো কৌতূহলী হয়ে কাছে এলো।

বাইরে অবশ্যি কাজ করছি, কিন্তু ভেতরটা শান্ত হয় নি। ম্যানোরায় গিয়েও নয়। সামনে আরব সাগর, অন্তহীন খোলা সমুদ্র, একটানা হাওয়ার সঙ্গে ফেনিল ঢেউ সস শব্দে আছড়ে পড়ছে। বালির ওপরে লেপটে বসে চা-খাওয়া, সমুদ্রে নামা, স্বল্প পানি মাড়িয়ে অনেক দূরে হেঁটে যাওয়া, হাসি ঠাট্টা তামাসা হৈ-চৈ চিৎকারের মধ্যে আমার সারাক্ষণের নিভৃত চিন্তা একটি ছোট্ট ইচ্ছেয় এসে কেন্দ্রীভূত হলো। একটা জিনিস শুধু পরীক্ষা করে দেখব আমি একটা জিনিশ যার ওপরে আমার সমগ্র সৃষ্টিকেই দাঁড় করাতে চাই। সে হলো জীবনের উৎসমূলে অবগাহন।

সূর্য ডুবেছে, নেমে আসছে ছায়া অন্ধকার। ক্লান্ত হয়ে এক জায়গায় বসে পড়েছে সবাই, ফেরার সময় হলো। আমরা হাঁটছিলাম পাশাপাশি, কিছুদূরে চলে এলাম। সমুদ্রের দিকে একেবারে চেয়ে নিয়ে হঠাৎ আমি কথা বলে উঠি, আচ্ছা খালা একটা প্রশ্ন জিগ্‌গেস করলে কিছু মনে করবেন না তো?

আমার কণ্ঠস্বর এমন একটা খাদ থেকে বেরিয়ে এলো যে চমকে উঠলেন জোবেদা খালা। হাসবার চেষ্টা করে বললেন, কি যে তুই বলিস, মনে করবার মতো কি এমন কথা?

না তেমন কিছু নয়। আমি অকম্প গম্ভীর স্বরে জিগগেস করলাম, আচ্ছা, আহাদ সাহেবকে আপনার মনে পড়ে না?

কে? বিকারগ্রস্ত রোগীর মতোই তির্যক প্রশ্ন।

আহাদ সাহেব, আপনার প্রথম স্বামী। এরপর কি ঘটল বলতে পারবো না, একটা চোরাবালির ধ্বস বুঝি নিচে ডেবে গেল আচমকা। আসলে এটা আমার মনের ভুল। আর্তনাদের মতো একটা অস্ফুট শব্দ করে জোবেদা খালা বসে পড়লেন শুধু। নিচু হয়ে আমি শুধিয়ে উঠলাম, কি হলো, খালা?

কিছু হয় নি জাহেদ! আমাকে একটু ধর তো! একেবারে নির্বাপিত শীতল কণ্ঠস্বর। হাত ধরে তুলতে গিয়ে দেখি তার দুই চোখ বেয়ে দদর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। ঠোঁট কাঁপছে। এরপর থরথর করে সমস্ত শরীরটাই কাঁপতে লাগল। বিস্মিত হওয়ারও সময় নেই। মুখটা একবার আকাশের দিকে তুলে পরক্ষণেই একটা তীব্র কাতরানির সঙ্গে লুটিয়ে পড়লেন বালির ওপর।

বেশি দূরে ছিল না, আর্তনাদ শুনে সবাই ছুটে এলো। সকলের মুখেই একই প্রশ্ন, কি হলো?

আমি তখন আত্মস্থ শান্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বললাম, বড় মামার ছোট ছেলেটা মারা গেছে বলতেই কেমন হয়ে গেলেন!

আরও কত ঘটনা! ছোটবেলায় কঠিন অসুখ হয়েছিল; নাড়ি বন্ধ, মরে গেছি বলে বাড়িতে ক্রন্দনের রোল উঠেছে এমন সময় সবাই অবাক হয়ে দেখে আবার শ্বাস নিচ্ছি।

পরে একজন আত্মীয় নাকি বলেছিলেন, এ ছেলে জীবনে কিছু করবে, নইলে এমনভাবে বেঁচে উঠল!

জানিনে কথাটা কতখানি ঠিক। তবে যে ক্রমে কেন্দ্রীভূত ও আত্মস্থ হয়ে যাচ্ছি তা স্পষ্টই বুঝতে পারি।

পঞ্চাশ বছরের বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল বলে আমাদের পাশের বাড়ির জহু ফাঁস নিয়েছিল। গিয়ে দেখেছি, সতেরো বছরের ওর ডাগর দেহটা গাছের ডালা থেকে ঝুলছে, চোখ ওলটানো, জিভটা বেরিয়ে পড়েছে, খানিক বিশ্রী বিদঘুঁটে চেহারা। জহু ছিল মুখরা, হরিণীর মতো চঞ্চলা, বনে ঘুরে বেড়াত উড়োচুলে, দেখা হলেই বলতো, আমার একটা ছবি একে দে-না রে জাহেদ, তোকে আমি একটা চৈতা শালিকের বাচ্চা দিব নে। মুন্সীবাড়ির আমগাছের বাসায় ডিম পেড়েছে।

কিইবা আঁকতাম তখন, আমার পেন্সিলের কাজ ড্রয়িং মাস্টার খুবই প্রশংসা করতেন এইমাত্র।– তবু অনেকদিন বলার পর জহুকে নিয়ে বসলাম একদিন, স্কেচের খসড়াও একটা করলাম।

কিন্তু ওটা শেষ করার আগেই ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। আর আসতে পারে নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *