শয়তান ও একটি চারাগাছ

শয়তান ও একটি চারাগাছ

লোকটা কি পাগল? কেউ বললো যাদুকর। কেউ মাথা নাড়লো–তিনি একজন সাধুপুরুষ। অথচ তার পোশাক বা চেহারায় কোনোটাই মনে হয় না। পরনে আধময়লা পাঞ্জাবি আর পায়জামা। স্পঞ্জের স্যান্ডেলের একটা ফিতে চামড়া দিয়ে বাঁধা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চুলগুলো রুক্ষ, লালচে বাতাসে এলোমেলো উড়ছিলো।

একজন নেতার মতো লোকটা বক্তৃতার ভঙ্গিতে কী যেন বলছিলো। মঙ্গলবারে বটতলার হাটের শেষে ঘর মুখে হাটুরেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলো। দু’একটা মন্তব্যও করছিলো। যখন লোকটা বললো, একার জন্য যারা বাঁচে তাদের সঙ্গে শেয়াল কুকুরের কোনো পার্থক্য নেই। আমরা যাদের মানুষ বলি তারা বাঁচে সকলের জন্যে। মানুষ নামের গৌরব সেখানেই।–তখন সবাই বললো, তিনি নিশ্চয়ই কোনো সাধু পুরুষ। তারপর লোকটা বললো, সারা দেশে এতগুলো মানুষ কেন মরলো একবার কি কেউ ভেবে দেখেছো? তোমরা কি ভেবেছো ওরা স্বাধীনতার জন্যে মরেছে? প্রচণ্ড শব্দে হা হা অট্টহাসি চারপাশের বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে লোকটা বললো, ওরা মরেছে বাঁচার জন্যে। তারপর লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো, এ দুঃখ কোথায় রাখবো বলো, ওরা নিজেরাও বাঁচতে পারলো না। আমাদেরও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে গেলো। আমরা মরছি। মরতে মরতে বেঁচে আছি, মরার দিন গুনছি, ওরা আমাদেরও খুন করে গেলো। আবার কিছুক্ষণ কাঁদলো লোকটা। সবাই বললো, কী আশ্চর্য, লোকটা পাগল নাকি? তখন হঠাৎ লোকটা কান্না থামিয়ে বক্তৃতায় ঢংয়ে বললো, তোমরা কি জানো একটা লোক দুটো লোক হতে পারে? একটা শয়তান ঈশ্বরের মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়। তার সাঙ্গ পাঙ্গরা পরে দেবদূতের মুখোশ, আর অন্ধ তোমরা তাদের পবিত্র জেনে মুগ্ধ হয়ে পূজো করো। এটা এক ভয়ঙ্কর সত্য কথা, আসলে আমিও জানি না আমি কে? তবে আজ আমি তোমাদের ছোট্ট এক চারাগাছ দিয়ে যাবো। এই গাছ একদিন বিশাল মহীরুহে পরিণত হবে। তার আগে এর মাহাত্ম শোনো। সবাই বললো, তাই বলো, তুমি একজন যাদুকর।

তখন সন্ধ্যে নেমেছিলো। সূর্য ডুবে গেছে, তবু সারা আকাশে রঙের ছটা। লাল, গোলাপি আর কমলা রঙের আকাশ। সবার তখন বাড়ি ফেরার কথা মনে হলো। কারণ সবাই বুঝে গেছে লোকটা আসলে এক ভেল্কিবাজ। কোথাকার কোন জংলী চারা বেচে পয়সা মারবার তালে আছে। একজন ভয়ে ভয়ে বলে ফেললো, যাদু যদি জানে তাহলে আরো বিপদ। আমাদের পয়সাগুলোও মন্ত্র পড়ে নিজের ঝোলায় চালান করে দেবে। যাদুকরদের বিশ্বাস নেই।

শুনে লোকটা হা হা করে হাসলো। হাসতে হাসতে বললো, ভয় নেই। আমি সে নই। যাদু জানে ঈশ্বররূপী সেই শয়তানটা। মন্ত্রবলে সে তোমার সর্বস্ব শুষে নিচ্ছে। আর তুমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার উপাসনা করছে। হঠাৎ লোকটা আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো, ঈশ্বর তৈরি থেকো। সময় আর বেশি নেই।

লোকটার কথা শুনে সবাই একটু ভয় পেলো। কয়েকজন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো, তখনো সারা আকাশ গনগনে আগুনের মতো লাল।

সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিলো একটা চৌদ্দ বছরের ছেলে, যে মজা দেখবে বলে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো। অথচ লোকটার অদ্ভুত আচরণ ওকে ভয় পাইয়ে দিলো।

একজন দু’জন করে সবাই বাড়ির পথে পা বাড়ালো। বলাবলি বললো, আরো কতো কী যে শুনতে হবে কে জানে। লোকটা তবু বলে চললো, তোমাদের যে চারা গাছের কথা বলেছি আমার কাছে একটাই আছে। সবাইকে আজ দিতে পারবো না। একজনকেই দেবো।

ততোক্ষণে সবাই চলে গেছে। একজনই শুধু দাঁড়িয়েছিলো জড়োসড়ো হয়ে। সে হলো ভয় পাওয়া সেই ছেলেটা, যার ঘর বলতে পথ আর গাছের তলা ছাড়া অন্য কিছুই নেই। তাই ওর কোনো গন্তব্য ছিলো না।

লোকটা হঠাৎ ছেলেটাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো। খুশিতে চেঁচিয়ে উঠে বললো, এই যে রাজাধিরাজ! তোমাকেই আমি খুঁজছিলাম। কোথায় ছিলে তুমি? তুমিই যে সে।

ছেলেটার মনে হলো, লোকটাকে ভয় করার কোনো কারণ নেই, বরং ওকে এখন বন্ধুর মতো মনে হচ্ছে। বললো, তোমার সেই চারাগাছ কি আমাকে দেবে?

আদর করে ছেলেটার কপালে চুমু খেয়ে লোকটা বললো, বোকা ছেলে, এখনো কি বুঝতে পারলে না? আমার সবকিছু তোমার জন্যে।

ছেলেটা তখন আস্তে আস্তে লোকটাকে বললো, জানো, সবাই তোমাকে পাগল আর যাদুকর বলছিলো।

বলতে পারে!’ লোকটা হেসে জবাব দিলো, তুমি তো আর বলছো না! আর পাগল বললে কোনো ক্ষতি নেই। ওরা তো আমায় শয়তান বলেনি! তাহলেই হলো। ওরা এটাই জেনে গেলো আমি শয়তানের দলের লোক নই।

ছেলেটার অভিমান হলো, যেন তাকেই কেউ পাগল বলছে! তা হোক। তবু পাগলই বা কেন বলবে?

লোকটা এবার খুব সুন্দরভাবে হাসলো। বললো, জানো, অনেকেই জানে না শয়তানটা যে ঈশ্বরের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এটাও অনেকে জানে না ওরা সবাই ভীষণ এক ফাঁসিকাঠে ঝুলছে। আমি জানি। এটাও জানি আগামীকাল কী ঘটবে। শয়তান আর তার চ্যালাগুলোকে কীভাবে খতম করতে হবে। সবাই যখন বুঝতে পারবে তখন আর কেউ আমাকে পাগল বলবে না, বুঝলে?

ছেলেটা এমনভাবে মাথা নাড়ালো যেন সে সবই বুঝেছে। লোকটা আবার হাসলো, আমি জানতাম তুমি বুঝবে। সে জন্যেই এই চারাগাছ তোমাকে দিচ্ছি। এটাকে যত্ন করে মাটিতে লাগাবে। সাবধান থেকো, শয়তানের ছায়া যেন এর গায়ে না পড়ে। তাহলে এটা মরে যাবে। জানো, আমার অনেকগুলো চারাগাছ ছিলো। শয়তান সারাক্ষণ ওগুলোকে খুঁজছে। ওর চ্যালারা ওগুলোকে মেরে ফেলেছে।

ছেলেটা বললো, আমার ভয় হচ্ছে। আমি একা কীভাবে এটা বাঁচিয়ে রাখবো?

লোকটা ওকে আদর করে বললো, তুমিই পারবে এটাকে বাঁচাতে। আমার ঈশ্বর তোমাকে সাহায্য করবেন। তিনিই বলবেন কীভাবে শয়তানের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।

ছেলেটা অবাক হয়ে বললো, কোথায় তোমার ঈশ্বর?

লোকটা গভীর বিশ্বাস নিয়ে বললো, তোমার বুকে! তোমার মতো যারা সব হারানোর দলে, আমার ঈশ্বর তাদের সবার বুকের ভেতরে ইচ্ছা হয়ে বাস করেন। আর এই চারাগাছের ভেতর–এই বলে লোকটা ছেলেটার হাতে চারাগাছটা গুঁজে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে অন্ধকারে হারিয়ে গেলো।

আর সেই ছেলেটা শীতের কুয়াশা ঢাকা অন্ধকারে এক বিশাল মাঠে চারাগাছটা হাতের মুঠোয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, যে চারাগাছ তার সারা শরীরে একরাশ বিশ্বাস আর সাহসের উত্তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছিলো।