লাল সূর্য

লাল সূর্য

গলিটা তখন আধো অন্ধকার। দু’পাশের নোনাধরা দেয়াল থেকে ভ্যাপসা গুমোট দম বন্ধ করা গন্ধ বেরুচ্ছে। আকাশটা কুয়াশার চাঁদরে মোড়া। ককনে বাতাস বইছে থেকে থেকে।

পুরোনো রঙওঠা দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে ফেললো শমি। বিশ্রি রকম শব্দ করে যেন প্রতিবাদ জানাতে চাইলো দরজাটা। এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস হু হু করে ভেতরে ঢুকলো। বেরিয়ে এলো শমি। দরজাটা শেষবারের মতো বন্ধ করে দিলো।

তখনো সূর্য ওঠেনি। পূবের আকাশে রঙ ধরেছে শুধু। রমনার কুয়াশা ভেজা কালো পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলো শমি–আমি আজ প্রাণভরে সূর্য দেখবো।

পূব আকাশের লালটা আস্তে আস্তে চোখ ঝলসে দিলো । রমনার সবুজ গাছের ফাঁকে সূর্যকে উঠতে দেখলো শমি। কি সুন্দর সূর্য ওঠা! এত লাল এর আগে কখনো দেখেনি সে। পাখিরা ডাকছে। লাল গোলাপের পাপড়ির ওপর শিশির বিন্দুতে সূর্যের ছায়া পড়েছে। দূরে গির্জার ঘন্টা বাজলো। এক দুই তিন চার করে ঘন্টাগুলো গুনলো শমি।

শমির দীর্ঘ ছায়া ধীরে ধীরে ছোট হচ্ছে। পশ্চিমমুখো হয়ে রমনার ঘোড়দৌড়ের মাঠের ভেতর অনেকক্ষণ হাঁটলো শমি। ইশকুলে ও আজ যাবে না। হয়তো কোনোদিন আর ইশকুলে যাওয়া হবে না।

হাঁটতে হাঁটতে শমি ভাবলো আমি বাড়ি ফিরবো না। সারাদিন ঘুরবো। ইশকুলে এতক্ষণে ক্লাশ শুরু হয়েছে। হলেই বা কি। ইশকুলে শমির কোনো বন্ধু নেই। ভালো লাগে শুধু ফাদার পিটারকে। ফাদার পিটার কখনো ওকে ডেকে আদর করে পিঠে হাত বুলিয়ে দেন। একদিন পেন্সিল হারিয়ে ভয়ে কেঁদেছিলো বলে ফাদার ওকে সুন্দর একটা পেন্সিল দিয়েছিলেন।

এখন ঠিক ফাদার পিটারের ক্লাশ হচ্ছে। কত গল্প যে জানেন ফাদার। সারাক্ষণ বাইবেল থেকে গল্প শোনাবেন। ভাবতে শমির খুব ভালো লাগলো। যীশুখ্রীস্টকে কাটার মুকুট পরিয়ে সে পেরেক ঠুকে রাখার কথা বলতে গিয়ে ফাদার পিটার কখনো কেঁদে ফেলেন। বলেন : পৃথিবীর সকল বেদনাকে নিজের করিয়া লইবার জন্যে প্রভু ক্রুসে গিয়াছেন। ফাদার পিটার বুকে ক্রুস আঁকেন ……. প্রভুকে যখন বলা হলো : কুয়ো ভাদিস ডোমিনি? কোথায় চলেছে প্রভু? তখন প্রভু বলেছিলেন, টু রোম, টু বি কুসি ফাঁইড এগেইন। প্রভু চাইতেন পৃথিবীতে আর যেন কষ্ট না থাকে।

বার বার ফাদার পিটার কুয়ো ভাদিস-এর গল্পটা বলতেন। শমি ভাবলো–আজও কি ফাদার সেই গল্প বলছেন?

শহরের কোলাহল শুনলো শমি। দূরে মিছিল যাচ্ছে। ওদের সবার হাতে প্ল্যাকার্ড। ওরা সবাই ছাত্র। শমি ভাবলো আমিও প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিছিলে সবার সাথে গলা মিলিয়ে কথা বলবো। শমি একটু উত্তেজিত হলো। এপাশ থেকে লরী বোঝাই রাইফেলঅলা পুলিসরা যাচ্ছে। এরা গুলি ছুঁড়বে নাকি? মিছিল এগিয়ে চলছে। শমি হাঁটছে মিছিলের পেছনে।

ঠাণ্ডা কনকনে বাতাসটা এখনো বইছে। দূরের কোলাহলটা সহসা অস্বাভাবিক উত্তেজিত আর অশান্ত বলে মনে হলো শমির। মেডিকেল কলেজের সামনে সারি বাঁধা নাম না জানা গাছগুলোর ফাঁকে ধোয়া দেখতে পেলো শমি। বন্দুকের শব্দ হচ্ছে। ওরা কি গুলি ছুঁড়ছে? শমি উত্তেজিত হয়ে ছুটতে শুরু করলো। শেরে বাঙলা-মাজার শরিফ লেখা কালো সাইন বোর্ডটা পেছনে রেখে ছুটলো শমি।

ওদিকে কোথায় যাচ্ছো? শুনছে না গুলি ছোঁড়া হচ্ছে ওখানে, টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছে ওরা? এসো, পালিয়ে এসো। একজন বুড়ো হন্তদন্ত হয়ে এক বগলে ছাতা আর হাতে স্ত্রাপছেঁড়া স্যান্ডেল জোড়া নিয়ে ছুটতে ছুটতে শমিকে ধমকে দিলেন।

এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালো শমি। বললো না। আবার ছুটলো ইউনিভার্সিটির মাঠের ভেতরে।

সাঁই সাঁই করে পুলিস বোঝাই ট্রাক আর জিপ ছুটছে। চোখ দুটো জ্বালা করতে লাগলো। দু’হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের গ্যালারির সিঁড়িগুলোর কাছে এসে দাঁড়ালো শমি।

লোকজন সবাই ছুটোছুটি করছে। বাচ্চা কোলে ময়লা ছেঁড়া কাপড় পরা একটা মেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো। তীব্র স্বরে কেঁদে উঠলো বাচ্চাটা। মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে বাচ্চাটার মুখ চেপে ধরে পাশের নালার মধ্যে বসে পড়লো।

শমি পাচিলটার কাছে এগিয়ে গেলো। মাথা তুলে দেখলো একটা বুড়ি চার পাঁচ বছরের একটা ছেলেকে বুকে চেপে উপুড় হয়ে বসে আছে। শমি মাথা নামালো। ছেলেটা বলছিলো, আমার ডর লাগতাছে দাদি।

বুড়ির চাপা গলা শুনলো শমি চুপ, চুপ সোনা, কথা কইস না। কথা কইলে মাইরা হালাইবো তোরে।

ক্যা মারবো? ছেলেটাকে প্রশ্ন করতে শুনলো শমি।

বুড়ি আবার বললো, চুপ যারে সোনা। কথা কইস না। কথা হুনলেই মাইরা হালাইবো।

বুড়ির কথা শুনে চমকে উঠলো শমি। কথা বললেই মেরে ফেলবে? কেন? বন্দুক আর রাইফেল নিয়ে যারা রাস্তায় ছুটোছুটি করছে তারা কি কথাকে ভয় পায়?

বড়দার কথা মনে পড়লো শমির। বাবার কাছে শুনেছে বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলনে গিয়ে আর ঘরে ফেরেননি বড়দা.। শমি ভাবলো, বড় হয়ে আমি বড়দার মতো হবো।

ছাত্রদের ছুটোছুটি দেখে শমি আবার মাথা তুললো। ওখানে এত লোক কেন? চমকে উঠলো। কী নিচ্ছে ওরা ধরাধরি করে? একটা হাত ঝুলে পড়েছে। শমি দেখলো লাল–অনেক অনেক লাল, সূর্যের মতো লাল তাজা রক্তে ভেজা শরীর। ভয়ে দু’চোখ বন্ধ করলো শমি। অনেকগুলো রাগী গলায় শ্লোগান শুনলো–শহীদের রক্ত, বৃথা যেতে দেববা না।

একটা লরী আসছে। কে যেন শমির হাত ধরে জোরে টানলো। শমি দেখলো সেই বুড়িটা। বুড়ি বললো, তুমি এই হানে কি কর, বইয়া পড়। দেহ নাই কেমন ছাওলডারে গুলি করছে? তোমারে দেখলে এমুহি আইবো কইলাম।

শমি চলে এলো। আবার গুলির শব্দ হলো। শমি উল্টো দিকে দৌড়ালো। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থম থম করছে।

সারাদিন হাঁটলো শমি। বাড়ি ফেরার ইচ্ছে হলো না। বাড়ি আর কোনোদিন ফিরে যাবে না বলেই তো বেরিয়েছে সে। কাল রাতেও বাড়িতে বকুনি খেয়েছে দেরি করে ফেরার জন্য। মা মরে যাওয়ার পর বাবা যাকে বিয়ে করেছেন সেই নতুন মা দু’চোখে দেখতে পারেন না শমিকে। বার বার শুধু বলেন, আপদ বিদেয় হলেই বাঁচি। বাবা দেখেও দেখেন না, শুনেও শোনেন না।

গত কয়েক বছরে বাবা বড় বেশি বুড়িয়ে গেছেন। সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যেয় বাড়ি ফেরেন। একবাটি মুড়ি খেয়ে টিউশনি করতে যান। ফেরেন রাত দশটায়। নতুন মা শমিকে বলেন, ধাড়ি ছেলে ঘরে বসে কাড়ি কাড়ি ভাত গিলতে লজ্জাও হয় না। কবে যে বিদেয় হবে–তবে আমার হাড় জুড়োবে।

শেষ বিকেলে নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে শমির মনে হলো, যাদের মা নেই তাদের অনেক কষ্ট। মায়ের ওপর রাগ হয় শমির। মা কেন এত তাড়াতাড়ি মরে গেলো?

শমির মা নেই, বাবা থেকেও নেই। শমি কোনোদিন ইশকুলে যায়, কোনোদিন যায় না। ঠিকমতো বেতন দিতে পারে না, টিফিনে কিছু কিনে খেতে পারে না, বাড়ি থেকেও টিফিন আনে না। শমি জানে ক্লাশের ছেলেরা ওকে এড়িয়ে চলতে চায়। ইশকুলে যারা কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে শমি তাই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।

গত কদিন ধরে শহর খুব গরম। মিছিলের পর মিছিল বেরুচ্ছে। রাতে কারফিউ থাকে। কারফিউ ভেঙে মিছিল বেরোয়। শহীদ মিনারের নীচে দাঁড়িয়ে শপথ নেয়া হয়। মিছিলে গুলিও চালানো হয়, আজ যেমন হয়েছে।

শমি কাল ছাত্রদের মিটিঙে শুনেছে, একজন বক্তৃতা দিচ্ছিলো, আমরা স্বৈরাচার চাই । স্বাধীনতা চাই। আমরা মানুষের মতো বাঁচতে চাই। আমরা না খেয়ে শুকিয়ে, বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মরতে চাই না। আমরা এ সমাজ ভাঙতে চাই।

শমি ভাবে কবে ভাঙবে এই সমাজ? কবে আসবে সেই স্বাধীনতা। সন্ধ্যার আকাশে সূর্য ডুবছে। একটু পরে সব অন্ধকার হয়ে যাবে। ভয় পেলো শামি। আকাশের লাল দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। দূরে শ্লোগান শুনে তাকালো শমি। ছাত্রদের মশাল মিছিল বেরিয়েছে। মশালের আগুন সূর্যের চেয়েও লাল।