দেয়াল

দেয়াল

তানাকে মা ভীষণ বকলেন। তোমাকে একশো দিন বারণ করেছি, ওভাবে ফ্রিজ খুলে রেখো না। আমার কথা কি তোমার কানে যায় না? কেন খুলেছিলে?

তানা কোন কথা বললো না। মা আবার বললেন–আর কোনোদিন যেন না দেখি। মনে রেখো।

তানা চলে এলো মার সামনে থেকে। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। ও বলতে চেয়েছিলো! মা, আমি বহুদিন হিমালয় দেখিনি, তুষারের কাছে যাই নি, তোমাদের ফ্রিজে তারই ছায়া দেখছিলাম। আরো অনেক কথা বলতে চেয়েছিলো তানা। সকল কথা গলার কাছে কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে শুধু। সবাইকে সব কথা বলা যায় না।

মা তানাকে বকে বকে শেষটায় মেজদাকে গিয়ে বললেন–তোমার আদরের তানার কাণ্ড শোন জাফর। আমি গিয়ে দেখি হাট করে ফ্রিজ খুলে তিনি দাঁড়িয়ে ধ্যান করছেন। দিন দিন ও যে সব কাণ্ড করছে তাতে কোনো দিন যে কি অঘটন ঘটিয়ে বসে ঠিক নেই।

তুমি বাপু ওকে ফেরত দিয়ে এসো গে তোমার সেই বন্ধুর কাছে।

মেজদা চোখে পুরু কাঁচের চশমা ঝুলিয়ে বই পড়ছিলেন। মার দিকে না তাকিয়েই বললেন–ওতো সিসিলি চলে গেছে মা। সেখান থেকে হয়তো মাদ্রিদ যাবে।

মা রেগে গজ গজ করেন–যেমন চাকর এক পাগল, তেমনি মনিব আরেক পাগল। সেদিন না এলো সবে যা না কোত্থেকে?

মেজদার কপাল একটু কুঁচকে গেলো। চশমাটা খুলে বললেন, তানাকে ওভাবে চাকর বোলো না মা। শুনলে ওর মন খারাপ করবে। তোমাকে তো বলেছি মা, ও একটু অন্যরকম পরিবেশে মানুষ।

মা ভেবে পান না চাকরকে চাকর বললে মন খারাপ করবে কেন। আর চাকরকে এতো মাথায় তোলাইবা কেন। তিনি এসব পছন্দ করেন না।

তানাকে দিয়েছিলেন মেজদার এক বন্ধু। অনেকদিন তার সঙ্গে থেকেছিলো তানা। শুধু ঘুরেছে। হিমালয়কে দেখেছে আকাশের গা ছুঁতে। তেমনি সমুদ্রকেও দেখেছে আকাশের সাথে মিতালি পাতাতে। আকাশ দেখতে ভালো লাগে তানার। আরো ভালো লাগে যখন দেখে হিমালয় আর সমুদ্রকে আকাশের সাথে মিশে যেতে। বাগানে শুয়ে শুয়ে তানা আকাশের নীল দেয়াল দেখে। ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। সেই নীলে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

মা ডেকে বিরক্ত হয়ে যান–কোথায় থাকো তুমি?

তানা কোনো কথা বলে না।

মা রেগে বলেন, যাও ড্রইং রুমটা মুছে ফেলো। আবার যেন একবারের বেশি ডাকতে না হয়।

তানার এ বাড়িটা ভালো লাগে না, সবাই চায় ও চার দেয়ালের ভেতরে আটকে থাকুক। কেউ ওর বাইরে ঘোরা পছন্দ করে না। সবাই এক একটা দেয়ালের মতো ওকে ঘিরে রাখতে চায়। শুধু ভালো লাগে মেজদাকে।

মন খারাপ হলে তানা মেজদার কাছে আসে। মেজদা বুঝতে পারেন। বলেন, আমাদের চার পাশে অনেক দেয়াল তানা!

তানা বলে, আমি দেয়ালের ভেতর চাপা পড়ে মরে যাচ্ছি মেজদা। আমাকে বলুন আমি কী করবো।

মেজদার মনে হয় তানা ওর আঠারো বছর সময়ের বয়সের সীমানা ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। বলেন, তুমি কি করবে না, সেটা সময় হলে নিজেই বুঝবে। কেউ বলে দিতে পারে না। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি নিজেকে কখনো ছোট ভেবো না।

রান্না ঘরে অবুর মাকে তানা প্রশ্ন করে, আচ্ছা অবুর মা, আমাদের চারপাশে এতো দেয়াল কেন?

অবুর মা ভুরু কুঁচকে বলে, কী কইলি?

চারপাশে এতো দেয়াল কেন?

অবুর মা বড়ো বড়ো চোখে বলে, দ্যাল ক্যানে থাকপে নাই বাপ? দ্যাল না থাকলে মোরা থাকপো কনে?

তানা বিড়বিড় করে বলে, আমরা আকাশের নিচে থাকবো।

অবুর মা বলে, তোর মাতাডা খারাপ হইয়ে গ্যাছে বাপ। কী যে কস উয়ার কুনো দিশ নাই!

মা শুধু তানার স্পর্ধা দেখে অবাক হন। তোকে না একশো দিন বারণ করেছি অ্যাকুরিয়ামের কাঁচ সরাবি না? কেন ওখানে হাত দিয়েছিলি?

তানা কোন কথা বলে না। মা আরো রেগে যান বল, কেন হাত দিয়েছিলি?

তানা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, এমনি দেখছিলাম।

আর যেন কখনো মাছের অ্যাকুরিয়ামের কাছে তোকে না দেখি।

ছোড়দা বলেছিলো ওগুলো নাকি সমুদ্রের মাছ। তানা সেখানে সমুদ্রের ছায়া খুঁজছিলো। ভেবে পায় না সমুদ্রের মাছ এতো ছোট জায়গায় বাঁচে কি করে।

তানা অবুর মাকে বলে, আচ্ছা অবুর মা, মাছগুলো ওভাবে আটকে রেখেছে কেন?

অবুর মা অবাক হয়–আইটকে রাখার জন্যিইতো ওগুলি এনেছে।

কেন আটকে রাখবে তাই বলো না?

সোন্দর লাগে বইলে আইটকে রেখেছে।

কোথায় সুন্দর অবুর মা! আমার ভারি বিচ্ছিরি লাগে ওদের এভাবে আটকে থাকাটা।

কী জানি বাপ, বড়লোকের খ্যাল। আমরা ছোডলোকেরা তা কবো ক্যামনে।

কে বললে অবুর মা আমরা ছোট লোক?

তাই তো জেনে এইছিরে বাপ!

কে জানালো তাই বলো না?

কারু জানাতি হয় নারে বাপ। দেখতি দেখতি জানা হয়ি যায়।

কেন জানবে তুমি ছোট লোক? জানো অবুর মা, মেজদা সেদিন পড়ছিলো, মানুষ–যার নামের শব্দ এতো গরীয়ান–আর তুমি তাকে বলবে ছোট লোক? বলতে বলতে তানা উদাস হলে যায়।

অবুর মা তানার দিকে পিট পিট করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, তোর চুলগুলো কেইটে ফেলিস। চুল এতো লম্বা রাখলি পরে মাথার মগজ চুইষে খায়। তুই পাগল হয়ে যাবি বাপ।

একদিন তানা বইয়ের আলমারি খুলে একটা বই বের করেছিলো। মা সেটা দেখতে পেয়ে তক্ষুণি একটা তালা ঝুলিয়ে দিলেন। তালা বন্ধ আলমারির কাঁচের ভেতর দিয়ে বইগুলো দেখলো তানা। চমকে উঠলো, বইগুলো ছটফট করছে দেখে। শেষে দেখলো, বই নয় তার নিজের ছায়াটাই কাঁচের বন্ধ দরজায় ছটফট করছে।

মেজদা শুনে বললো, তুমি ঠিকই দেখেছো তানা। বইগুলোই ছটফট করেছিলো। ওদের কেউ তালাবন্ধ করে রাখতে পারে না।

মা ধাপে ধাপে বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেলেন। একদিন ভীষণ চিৎকার করলেন–ড্রইংরুমের দেয়ালের রঙ তুলছিলে কেন অমন করে?

তানা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। মা আরো রেগে গেলেন–আমার কথার জবাব দাও। কেন নখ দিয়ে খুঁটছিলে ডিস্টেম্পার?

তানা আস্তে আস্তে বললো, এমনি শুধু দেখছিলাম।

কী দেখছিলে?

নীল রঙটার নিচে কী রয়েছে।

ওখানে আবার কী থাকবে?

তাইতো দেখলাম।

কী দেখলে? কোনো রঙ নেই।

ভেতরটা ফ্যাকাশে।

মা শক্ত গলায় বললেন, তোমাকে আমি শেষ বারের মতো সাবধান করে দিচ্ছি। তানা!

তানা চোখ তুলে তাকালো।

কক্ষনো তুমি ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে পারবে না।

তানা চমকে উঠলো।

রান্না ঘরে অবুর মা ঝন ঝন করে কি যেন ভাঙলো।

মা সেদিকে কান না দিয়ে বলে চললেন–কক্ষনো তুমি জাফরের ঘরে যেতে পারবে, কক্ষনো তুমি ড্রইং রুমে যেতে পারবে না। সারাদিন রান্না ঘরে থাকবে। কাজ ছাড়া বসে থাকতে যেন না দেখি–

একের পর এক মা তার সাবধানের কথাগুলো বলে যাচ্ছেন। কিছু শুনলো তানা। কিছু শুনলো না। বাইরের আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। দুপুরের আকাশটা একেবারে ফাঁকা। দূরে শুধু একটা চিল উড়ছে। বার বার ডাকছে ধারালো গলায়। কী যেন খুঁজছে ঘুরে ঘুরে। তানার মনে হলো চিলটা সারাদিন ধরে এমনিভাবে ঘুরছে। সারাদিন ঘুরবে। শুধু ঘুরবে।

সেদিন অনেক রাত অবধি তানা ঘাসের বাগানে ঘাসের বিছানায় একা শুয়েছিলো। আকাশে তারা জ্বলছিলো। তানা ছায়াপথ দেখলো। অসংখ্য তারার মিছিল চলেছে সে পথ বেয়ে। নিজেকে মিছিলের একজন ভাবলো। তারপর তানা এক অচেনা জগতে পৌঁছে গেলো, যেখানে আসবে বলে ভেবেছিলো বহুদিন ধরে।

আমি এখানে থাকলে মরে যাবো। ঘরে ফিরে ভাবলো তানা। বহুদিন আমি পাহাড় দেখিনি। সমুদ্র দেখিনি। আমি সমুদ্রের কাছে যাবো। পাহাড়ের সিঁড়ি বেয়ে আকাশের কাছে যাবো। সেখানে ছায়াপথে তারার মিছিল। আমি মানুষের মিছিলে হারিয়ে যাবো।

তানার মনের ভেতর সহসা সেই মিছিলের আগুন জ্বলে উঠলো। ড্রইং রুমে ঢুকে অ্যাকুরিয়মটা দেখলো। হাতে তার একখানা ধারালো ছুরি। অ্যাকুরিয়ামের মাছগুলো একটা পাত্রে তুলে নিলো। ছুরির ঘায়ে অ্যাকুরিয়ামের কাঁচের দেয়ালটা ভেঙে গেলো। ঘরের রঙিন দেয়ালটা ছুরি দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিলো। তানার মনে হলো দেয়াল বেয়ে রক্ত ঝরছে। তার মুখটা তখন এক অদ্ভুত হাসিতে ভরে গেলো।

আকাশে যখন সূর্যের ছায়া পড়লো, তখন তানা সেই মাছগুলো আর ছুরিটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ছায়াপথে অসংখ্য আলোর কনা। তানা সেই আলোর একজন।

পরদিন বাড়িতে দারুণ হৈ চৈ। শুধু মেজদা অবাক হলেন না। বিড় বিড় করে বললেন, তানা তাহলে সত্যিই চলে গেলো।