পল গোমেজের বাবা

পল গোমেজের বাবা

বাবার কথা বলতেই পল যেন কেমন হয়ে যেতো। আমাদের মিশনারি ইশকুলের ইনফ্যান্ট ক্লাশ থেকে সেভেন অব্দি ওকে দেখে আসছি। নতুন ক্লাশে উঠলে নতুন টিচাররা সবাইকে প্রশ্ন করেন নাম কী, বাবার নাম কী, কী করেন বাবা–এমনিতরো অনেক কথা।

আমাদের কারো বাবা সরকারী অফিসার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ডাক্তার, কেউ হয়তো অধ্যাপক কিম্বা সাংবাদিক বাবা পেয়েছে। কিন্তু পল গোমেজের বাবা হেরাল্ড গোমেজ বুঝি এদের কারো দলে পড়েন না। বাবা কী করেন,–এই প্রশ্নের জবাব পলের কাছে থেকে কোনো টিচার পাননি।

টিচারদের কেউ ওকে চুপ থাকতে দেখে নরোম গলায় বলেন, বাবা মরে গেছেন বুঝি? পল মাথা নেড়ে জানায়, না।

তিনি কি রিটায়ার্ড অফিসার?

পল আবারও মাথা নাড়ে।

তাহলে?

এই তাহলের জবাব ইশকুলের আট বছরের জীবনে আমরাও কোনোদিন পাইনি। এ কী গোয়ার্তুমি-আমরা ভেবে পেতাম না। তবে পলের ইস্তিরি না করা পোশাক দেখে ভাবতাম ওর বাবা বোধহয় খুব গরিব ।

আসলে তা নয়। বিজু একদিন ফিশ ফিশ করে আমাদের ক’জনকে বললো, আসলে আমার কী মনে হয় জানিস?

এইটুকু বলে বিজু অবাক করা কিছু শোনাবার জন্য একটু থামলো। এই এক বিচ্ছিরি স্বভাব ওর। কথা বলতে বলতে হঠাৎ থামবে। আর কথায় কথায় শুধু আসলে বলবে।

কেন্টু অধীর হয়ে বললো, কী বলবি বলেই ফ্যাল না বাপু। তোর এই বিচ্ছিরি অভ্যেসটা কবে যে যাবে তাই ভাবি।

এদিক ওদিক চেয়ে গলাটা আরেক ধাপ নামিয়ে বিজু বললো, আসলে ওর বাবা নিশ্চয় কোনো বড় ধরনের ডিটেকটিভ হবে। এ আমি হলপ করে বলতে পারি।

চিনু অবাক আর অবিশ্বাসের গলায় বললো, এ কথা তোর মনে হলো কেন?

বিজু আরো চুপি চুপি বললো, আসলে আমি বিশ্ব গোয়েন্দা সিরিজে পড়েছি, কখনো যদি ….

রাখ তোর বিশ্ব গোয়েন্দা! ওই পচা বইগুলো পড়ে তোর মাথাটা একেবারে পচে গেছে। চিনুর ধমকে বিজু একেবারে মিইয়ে গেলো।

বিজুর কথাটা আমারও মনে ধরেছিলো। বললাম, ওকে মিছেমিছি বকছিস কেন চিনু? আমার বাবা ইন্টালিজেন্স ব্যুরোতে কাজ করেন। বাবা বলেছেন, ডিটেকটিভদের সব সময় ছদ্মবেশে থাকতে হয়। তাদের ছেলেমেয়েরাও কাউকে বলতে পারবে না বাবা ডিটেকটিভ। নিজেদের লুকিয়ে রাখার জন্য ডিটেকটিভরা অনেক সময় ছেঁড়া জামা কাপড় পরে ঘোরে।

আমার কথা শুনে চিনু চুপ হয়ে গেলো। বিজু বললো, আসলে দ্যাখতো। চিনুটার সব কিছুতেই ফেঁড়ন কাটা চাই।

চিনু কটমট করে বিজুর দিকে তাকালো। ইচ্ছে করলেই সে বিজুর কথার জবাব দিতে পারে, তবে এতে ওর দাম বেড়ে যাবে বলে এ যাত্রা চিনু আর কিছু বললো না।

বনির বাবা মস্তো বড় ব্যবসায়ী। দার্জিলিঙে ওদের কয়েকটা চা বাগান ছিলো। সেগুলো বদল করে ক’বছর আগে সিলেটে কয়েকটা চা বাগানের মালিক হয়েছে। রোজ মুক্তো-সাদা দামী ইম্পালা গাড়িতে করে ইশকুলে আসে। একটু পরে বনি বিজ্ঞের মত বললো, আমি যখন দার্জিলিঙ-এর লরেটোতে পড়তাম তখন একটা মজার ব্যাপার দেখেছিলাম।

বনির এই এক ফুটুনি! যে কোনো কথার মাঝখানে গায়ে পড়ে সবাইকে মনে করিয়ে দেবে, ওরা আগে দার্জিলিঙ থাকতো। ভারি উঁট দেখাতো বনি। কেউ ওকে এ নিয়ে কিছু বলতো না, কারণ আমাদের টিচাররা ছুটির দিনে প্রায় ওদের বাসায় যেতেন আর আজগুবি সব খাবার খেয়ে পরদিন কমনরুমে বসে নিজেরা সেসব নিয়ে গপ্পো করতেন।

আমি যেন খুব একটা পাত্তা দেইনি, এমন এক ভাব করে বনিকে বললাম, কী দেখছিলি তোদের দার্জিলিঙে?

আড়চোখে আমাকে একবার দেখে বনি বললো, দেখেছিলাম, অন্তু বলে এক ছেলেকে। আমাদের চেয়েও বড় চায়ের বাগান ছিলো ওদের। অথচ কোনোদিন গাড়িতে চেপে ইশকুলে আসতো না। পলের মতো পোশাক পরতো। আর বাবার কথা কাউকে বলতে চাইতো না। পরে শুনেছি ওর বাবা নাকি ভীষণ কিপ্টে ছিলো। সব সময় নাকি অন্তু আর ওর মাকে মারতো। তাই অন্তু ওর বাবাকে দুচোখে দেখতে পারতো না। বাবার কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে মুখ ঘুরিয়ে নিতো।

এইভাবে কোনো কোনো দিন আমরা বুড়ো দেবদারু গাছটার তলায় বসে পলের বাবার কথা বলতে গিয়ে পুরো টিফিন পিরিয়ডটাই কাটিয়ে দিতাম। পলের বাবাকে নিয়ে যতো আলোচনা হতো, তার চেয়ে বেশি হতো আমাদের বাবাকে নিয়ে। সুযোগ পেলেই আমরা কজন জানিয়ে দিতাম, আমাদের কার বাবা কতো বড় কাজ করেন।

কথা বলতে বলতে এক সময় পলের বাবা হারিয়ে যেতেন। বনিকে আমার হিংসে হতো ওদের ইম্পালা আর সবুজ পাহাড়ের চা বাগানের জন্যে। বিজু আমাকে হিংসে করতো আমার বাবা গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন বলে। ও চাইতো ওর বাবা আমার বাবার মতো একটা রোমাঞ্চকর কাজ করুক। অথচ ওর বাবা ছিলেন এক নাম করা অধ্যাপক। টিচাররা যখন ওর বাবার লেখা কোনো বই কিম্বা কোনো সেমিনারে বক্তৃতার প্রশংসা করতেন, তখন বনি ঠোঁট উল্টে বলতো, প্রফেসররা কতইবা আর বেতন পায়, তাই নিয়ে এতো!’

আমাদের ছোট্ট এই ঈর্ষার জগতের একেবারে বাইরে ছিলো পল। কারণ টিচাররা সকলের বাবার প্রশংসা করতেন–পলের বাবাকে বাদ দিয়ে। অনেকের বাবা ইশকুলে আসতেন। বাড়িতে কোন পার্টি হলে ইশকুলের টিচারদের নেমন্তন্ন করা হতো। পরদিন টিচাররা সবাই মিলে সেই সব পার্টির গল্প করতেন।

একদিন ফিলিপ্স স্যারকে শুনলাম টিফিন পিরিয়ডে কমনরুমে বসে গাঙ্গুলী স্যারকে বলছেন, চমৎকার পার্টি দিয়েছিলেন বনির বাবা।

গাঙ্গুলী স্যার বললেন, ভদ্রলোকের মনটা খুব ভালো। আমাকে ডেকে বাড়ির খবর টবর নিলেন। বিজুর বাবাও চমৎকার ভদ্রলোক। পার্টিতে আলাপ হলো। কি পাণ্ডিত্য, অথচ এতটুকু অহংকার নেই। বয়েসে আমার ছোট বলে আমাকে স্যার ডাকলেন। আমি তো লজ্জায় মরি।

ফিলিপ্স স্যার বললেন, আচ্ছা এই ছেলেটার ব্যাপার কি বলুন তো? বনিদের ক্লাশে পড়ে, পল না কি যেন নাম! ক্লাশে বাবার নাম জিজ্ঞেস করলাম বললো হেরাল্ড গোমেজ বুঝি। কী করে জানতে চাইলাম–ছোঁড়া একেবারে চুপ। কিছুতেই বললো না কী করে ওর বাপ!

আর বলবেন না ওর কথা। গাঙ্গুলী স্যার বিরক্ত মুখে বললেন, আমিও অনেক বলে দেখেছি। একবার সন্দ হলো, আসলে কোনো ভদ্রঘরের ছেলে তো? দেখে শুনে তো ভালোই মনে হয়, তবু বলা তো যায় না। সন্দ চাপতে না পেরে আগের হেড মাস্টার ব্রাদার ওয়াটসনকে বললাম, ওর বাবার পরিচয় টরিচয় ভালো করে জেনে ওকে ভর্তি করিয়েছিলেন তো? ব্রাদার ওয়াটসন প্রথমটায় ভুরু কুঁচকে বললেন–এ কথা কেন বলছেন? আমি তখন আমার সন্দ লাগার কথা বলেই ফেললাম। অমনি তিনি চটেমটে লাল। বললেন, আমার ইশকুলে সে ধরনের কোনো ছেলে পড়ে না। আমি ভালো করেই পলদের জানি। ভবিষ্যতে এ ধরনের কথা বলবেন না। ব্রাদারের রাগ দেখে আমি পালিয়ে বাঁচি।

এইটুকু, বলে গাঙ্গুলী স্যার থামলেন। দাঁতের ফাঁক থেকে ময়লার কণা খুঁচিয়ে বের করে থুক করে ফেলে বললেন, দূর হোকগে ছাই! কার বাপ কী তা নিয়ে আমি মাথা ঘামই কেন। আমি ঠিক থাকলেই হলো, কী বলেন ফিলিপ্স স্যার?

গাঙ্গুলী স্যারের কথা শুনে বুড়ো ফিলিন্স স্যার খিক খিক করে বেদম হাসলেন। আমার কিন্তু একটুও ভালো লাগলো না। পলকে কেউ খারাপ ভাবুক এটা আমি চাইতাম না। ওর মতো সুন্দর শান্ত চোখের ফুটফুটে চেহারার কারো বাবা খারাপ হতে পারে এ আমি ভাবতেই পারতাম না। গাঙ্গুলী স্যারের কথা ভীষণ খারাপ লেগেছিলো। বড়রা এত খারাপ কথাও ভাবতে পারে!

পলকে আমার খুব ভালো লাগতো। ওকে আমি সব সময় আমাদের দলে পেতে চাইতাম, অথচ ও নিজেকে সারাক্ষণ শামুকের মতো গুটিয়ে রাখতো। একদিন টিফিন খাওয়ার সময় ভাব জমাবার জন্য ওকে ডেকেছিলাম, আমাদের সঙ্গে খেতে। ও বললো, খিদে নেই। আর বনি বললো, ঢং। এরপর ওকে আর দলে টানতে সাহস পাইনি।

একদিন মনে হলো, সবাই পলকে অপছন্দ করা শুরু করেছে। বিজুকে বাড়ি গিয়ে পড়ান গাঙ্গুলী স্যার। ও বললো, জানিস, গাঙ্গুলী স্যার বলেছেন, পলের সঙ্গে যেন না মিশি।

শুনে আমার মুখ কালো হয়ে গেলো। বিজু বললো, আসলে কেন মানা করেছেন। তুই কিছু জানিস?

গাঙ্গুলী স্যার কেন মানা করেছেন আমি জানি। কিন্তু বিজুকে সে কথা বলা যাবে না। বিজু কেন, কাউকেই বলা যায় না। বিজুর কথায় আমি কাষ্ঠ হেসে বললাম, গোয়েন্দাদের ছেলেদের সঙ্গে না মেশাই ভালো।

বিজু বললো, আমিও তাই ভাবছিলাম। আসলে ওর সঙ্গে মিশলে ও বোধ হয় কোনো খবর টবর বার করে ওর বাবাকে বলে দেবে, তাই নারে?

শুনে রাগ হলো, আবার হাসিও পেলো, বললাম, এমন কী খবর তুই জানিস যা পলের বাবাকে জানতে হবে? যা, পালা এখান থেকে। আমার ভালো লাগছে না।

ক্লাশে ছেলেরা পলকে যতো অপছন্দ করছিলো ওর জন্য আমার ততোই কষ্ট হচ্ছিলো। ভাবছিলাম, কিছু একটা করি ওর জন্য। কিন্তু কী করবো ভেবে উঠতে পারছিলাম না। শেষে একদিন পলকে এক লাইনের চিঠি লিখলাম–পল, আমি তোমার বন্ধু হতে চাই।

চিঠিটা পলের হোমটাস্কের খাতায় লুকিয়ে রেখেছিলাম, টিফিন পিরিয়ডের এক ফাঁকে। পরদিন পল সকালে আমাকে দেখে হাসলো। কাছে এসে বললো, ছুটির পর ভিক্টোরিয়া পার্কে এসো।

আমাদের ইশকুল থেকে মাত্র দু’মিনিটের পথ ভিটোরিয়া পার্ক। বাড়ি ফেরার পথেই পড়ে। ইশকুল ছুটির পর বিজু চিনুদের কাটাতেই লাগলো বেশ কিছুক্ষণ। পার্কে এসে দেখি মস্তো বড়ো রেইনট্রি গাছের তলায় পল একা বসে আছে। আমাকে দেখে ও মৃদু হেসে বললো, কখন থেকে বসে আছি!

বললাম, বিজু চিনুদের জন্যে দেরি হয়ে গেলো।

পল কোনো কথা না বলে শুধু একটু হাসলো। আমি ওর পাশে বসে দুব্বো ঘাসের ডগা চিবুচ্ছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললাম, পল কিছু বলছে না যে?

পল আগের মতো হেসে বললো, কি বলবো?

আমি বললাম, আগে চিঠির জবাব দাও।

পল লজ্জা পেলো। বললো, তোমার তো অনেক বন্ধু।

থাক না অনেক বন্ধু! সবাইতো কেবল হিংসে করেই সারা হলো। আর যতো বাজে গপ্পো। আমার একটুও ভালো লাগে না।

পল এবার গম্ভীর হয়ে বললো, তোমার বন্ধুরা কেউ আমাকে পছন্দ করে না।

জানি। সেজন্যে আমার আরো খারাপ লাগে। বলল, তুমি আমার বন্ধু হবে?

আমি পলের দিকে হাত বাড়ালাম। পল হেসে আমার হাতে হাত রেখে শুধু বললো, বন্ধু।

আমি এবার হাসলাম। বললাম, পল, একদিন সবাইকে নিয়ে তোমাদের বাসায় যাবো। পল বললো, আমাদের বাড়ি যে তোমাদের ভালো লাগবে না! যার ভালো না লাগে সে যাবে না। আমি যাবো। পল একটু ভেবে বললো, তাহলে মাকে বলবো।

পরদিন ইশকুলে গিয়ে সবাইকে বললাম, আমি পলের বাড়ি যাচ্ছি। তোমাদের যার ইচ্ছে যেতে পারো।

শুনে দু’একজন প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও পরে সবাই বললো, যাবে। কেন্টু বললো, ওর বাবার সঙ্গে দেখা হবে তো!

বললাম, নিশ্চয়ই হবে।

কদিন পরেই ছিলো বড়দিন। পল আমাকে বললো, মা বলেছে তোমাদের সবাইকে বড়দিনের নেমন্তন্ন জানাতে। সবাই সন্ধ্যেয় আমাদের বাসায় আসবে।

বনি বললো, বিপদ হলো, ওদিকে যে আমাদের গাড়ি যাবে না। কী যেন নাম বললে গলিটার?

আমার ভারি রাগ হলো। বললাম, ইচ্ছে হলে হেঁটে যাবে। তোমাকে তো পা ধরে কেউ সাধছে না।

বনি ঘাড় বাঁকিয়ে বললো, আমি তোমাকে বলিনি। ভারি তো এক–

বনিকে একটা শক্ত কথা বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। বিজু বললো, তুই কোন ড্রেসটা পরবি? আসলে আমি ভাবছি নতুন সুটটা সেদিন পরবো।

আমি রেগে বললাম, যা সব সময় পরি তাই পরে যাবো। আমার অতো ফুটুনি নেই।

আমার কাছে সুবিধে করতে না পেরে বিজু গেলো কেন্টু, চিনু, বনিদের সঙ্গে জামা কাপড় নিয়ে কথা বলতে। এটা যে বিজু বাড়াবাড়ি করেছে তা বলবো না। আমাদের কারো বাড়িতে পার্টি থাকলে আমরা আগে ঠিক করে নিই কে কী পরে যাবো। বিজুকে বলতে শুনলাম, আমার নাকি ভারি দাম বেড়েছে। আর বনিও ওর কথায় সায় জানালো। আমি কিছু বললাম না।

বড়দিনের বিকেলে আগে আমরা ইশকুলে এলাম। সবার পরনে দামী প্যান্ট শার্ট। বিজু আর বনি জ্যাকেট পরেছে। আমি শুধু সাদা প্যান্ট শার্ট আর নীল পুলোভারটা পরে এসেছি। এই পোশাক পরে আমি ক্লাশেও যাই।

পল এলো আমাদের নিয়ে যেতে। ওর পরনেও সাদা প্যান্ট শার্ট। গায়ে নতুন আকাশ নীল পুলোভার। আমাকে দেখে হাসলো। কানে কানে বললো, তোমার মতো একটা পুলোভার পেয়েছি এবার বড়দিনে। ভারি লোভ ছিলো তোমারটার ওপর।

কি যে সুন্দর লাগছিলো পলকে বলে বোঝাতে পারবো না। ও হাসছিলো। এরকম হাসি কোনোদিন ওর মুখে দেখিনি। আমরা সবাই হইচই করে কথা বলতে বলতে ওদের বাড়ি গেলাম।

তিনখানা কামরায় ছোট্ট বাড়ি। সামনে এক চিলতে বাগানে সিজন ফ্লাওয়ারের মেলা বসেছে। সব কিছু সুন্দর সাজানো। বসার ঘরে ক্রিসমাস ট্রি রাখা হয়েছে। জরির সুতো, রূপোলি তারা আর লাল নীল পারদে রাঙানো বল ঝুলছে সেখানে। আরো একটা জিনিস ছিলো সারা ঘর জুড়ে। দেখে আমরা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলাম–কী চমৎকার বেলুন! আর এতো বেলুন! কী আশ্চর্য বেলুন! সারা ঘরে বেলুন ঝুলছে। রঙিন ছবি আঁকা বেলুন সব। কোনটায় মিকি মাউস, কোনটায় ডোনাল্ড ডাক, আবার কোনটায় হাম্পটি ডাম্পটির ছবি।

পলের জন্য আনা উপহারগুলো আমরা ক্রিসমাস ট্রির গোড়ায় রাখলাম। ভেতরের দরজা ঠেলে একজন বসার ঘরে ঢুকলেন। পল বললো, আমার বাবা।

আমরা তাঁকে দেখলাম। মুগ্ধ হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ধুসর প্যান্ট আর সাদা সার্ট পরনে। ওপরে শ্যাওলা সবুজ কার্ডিগান! রূপকথার রাজাদের মতো সুন্দর দেখতে। নীল চোখ, টিকোলো নাক, সোনালি চুল। আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, পল তোমাদের কথা অনেক বলে। আমি কতদিন বলেছি, নিয়ে আয় এক রোববারে। বলে, ওরা কী আসবে!

কেন্টু বললো, কী মিথ্যে কথা! পল একবারও আমাদের বলেনি। এবার তাহলে এলাম কী করে?

পল লজ্জায় হাসলো। ওকে আরো সুন্দর মনে হলো।

পলের বাবা বললেন, এবার বড় দিনটা ভারি চমৎকার মনে হচ্ছে। পলের মাকে ডেকে বললেন, জানো নেলী, আমাদের সারডিনিয়াতে এখন ঠিক বরফ পড়ছে। ওখানে বলে বরফ না পড়লে বড়দিনের সব মজা মাটি। পলের মতো ছোট থাকতে আমি সারাক্ষণ শুধু জানালা দিয়ে বরফ দেখতাম। মাঝে মাঝে এতো বরফ পড়তো যে জানালার কাঁচ বরফের দেয়াল হয়ে যেতো। আমি তখন একটা মোমবাতি জ্বেলে জানালার পাশে রাখতাম। বরফের দেয়ালে একটা গোল ফুটো হতো, তারপর আস্তে আস্তে গলে যেতো।

আমরা অবাক হয়ে শুনছিলাম। মনে হলো রূপকথা শুনছি। পলের বাবা বুঝি রূপকথার পাতা থেকে থেকে উঠে এসে অচেনা এক সারডিনিয়ার বরফ ঝরার গল্প শোনাচ্ছেন। তার নীল চোখে বরফের স্বপ্ন ভাসছিলো। আমরা বললাম, আরো বলুন।

তারপর পুরানো ঢাকার আরো পুরানো এক শ্যাওলা ধরা গলি থেকে আমরা হারিয়ে গেলাম সারডিনিয়ার বিশাল পাইন বনের ধারের ছোট্ট এক লগ কেবিনে। যেখানে বল্লা হরিণ-টানা স্লেজ গাড়িতে চড়ে দাড়ি উড়িয়ে টুপি মাথায় জোব্বা গায়ে সান্টা ক্লজ আসেন বড়দিনের উপহার নিয়ে। বাতাসে ভেসে আসে পাইন আর মেপল পাতার ভেজা মিষ্টি গন্ধ। ঘরের ভেতর ফায়ার প্লেসের আগুনের ধারে বসে গিটার বাজিয়ে পাশের গাঁয়ের হ্যাঁমিল্টন বুড়ো গান গায়। বহু দূরে ট্রেনের হুইসেল শোনা যায়। পাইনের বনে সেই শব্দ কেঁপে কেঁপে ফেরে। একসময় বাতাসে বাইরের সব শব্দ মিলিয়ে গিয়ে শুধু পাইন বনের একটানা শাঁ শাঁ শব্দ হয়। মনে হয়, বুঝি ঝড় আসবে। জানালার ধারে জ্বালিয়ে রাখা মোমবাতিটা গলে গলে শেষ হয়। হ্যাঁমিল্টন বুড়োর গান শেষ হলে দিদিমা পিয়ানোয় সুর তোলেন–সেদিন সবুজ হ্রদের ধারে। মা রান্না করেন ভেড়ার মাংস, মটরসুটি আর বাঁধাকপির স্যুপ। বড়দিনের জন্য বাবা নরোম রুটি আনতেন শহর থেকে। টেবিলে টার্কি মোরগের বড় রোস্ট রাখা হতো। টার্কি ছাড়া কি বড়দিন জমে! সব মিলিয়ে অদ্ভুত সুন্দর ছিলো সারডিনিয়ার বড়দিন।

এরপর পলের বাবা বললেন জাহাজে করে দেশ ঘোরার কথা। জানো আমাদের রক্তে রয়েছে ঘুরে বেড়ানোর নেশা। আমার বাবা এদেশের মানুষ ছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে একদিন কানাডা গিয়ে, সেখানে মাকে বিয়ে করে আস্তানা গাড়লেন। বাবা মা মরে গেলে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। অনেক ঘুরে লস এঞ্জেলেস গিয়ে এক বন্ধুর কাছে উঠলাম। বন্ধু বললো চলো আর্মিতে জয়েন করি। আমিও বললাম, ঠিক আছে। দু’জন আর্মিতে ঢুকলাম। এর কদিন পর শুরু হলো কোরিয়ার যুদ্ধ। আমাদের দুজনকেই পাঠানো হলো কোরিয়ায়।

এই বলে থামলেন পলের বাবা। তাঁর মুখটা হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে গেলো। আস্তে আস্তে বললেন, তোমরা যুদ্ধ দেখোনি। যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস। আমাদের লড়তে বলা হয়েছিলো কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে। প্রথমদিকে উত্তেজনা ছিলো। পরে দেখি যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি তারা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য লড়ছে, আমাদের ওরা বলতো ভাড়াটিয়া সৈন্য। খুব খারাপ লাগতো। একদিন বাঙ্কারের ভেতর আমরা দুজন বসেছিলাম। আমার বন্ধু বললো, যুদ্ধ করতে একদম ভালো লাগছে না। আমরা পালাবার ফন্দি করলাম। রাতে পালাতে গিয়ে আমার বন্ধুটি আমাদের পাহারাদার সৈন্যদের গুলি খেয়ে মারা পড়লো। আমি অনেক ঘুরে এক জাহাজে চাকুরি জুটিয়ে তোমাদের দেশে এলাম।

বলতে বলতে আবার উদাস হয়ে গেলেন পলের বাবা। কিছুক্ষণ। এরপর একবার পলের মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলেন–নেলীর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর এ দেশটাকে এতো ভালো লেগে গেলো যে, এখানেই থেকে গেলাম। এই বলে পলের মায়ের দিকে তাকালেন–কিগো ভালো করিনি!

পলের মা হেসে বললেন, তুমি তো ভালো করেছো, তোমার ছেলে পল কোথায় ভালো করতে যায় দেখো!

পলের বাবা শব্দ করে হাসলেন। আমরাও হাসলাম। পল ভীষণ লজ্জা পেলো। বললো, আমি এদেশ ছেড়ে কোথাও যাবো না মা।

বিজু বললো, আসলে এটাইতো তোমার দেশ পল।

বিজুর আসলে বলা নিয়ে এবার আমরা কেউ হাসাহাসি করলাম না। শুধু পল যখন মুখ টিপে হেসে বললো, আসলেই তাই। তখন সবাই হেসে গড়িয়ে পড়লাম।

বড়দিনের সেই সন্ধ্যেটা যে কি আনন্দে কেটেছিলো বলে বোঝাতে পারবো না। রাতে আমরা সবাই পলের ঘরে বসে গল্প করছিলাম। চিনু বললো, তোমার দাদী যে আমেরিকান ছিলেন এ কথা তুমি আগে বলোনি কেন পল?

পল লজ্জার হাসি হেসে বললো, বারে এতে বলার কী আছে?

কেন্টু বললো, পলের বাবা সেজন্যেই আমেরিকান ছবির নায়কদের মতো দেখতে।

চিনু বললো, আচ্ছা পল এবার তো তুমি বলবে, তোমার বাবা কী কাজ করেন, এটা তুমি বলতে চাও না কেন?

একটু গম্ভীর হলো পল। বললো, বাবা আজ তোমাদের তার যুদ্ধের যাবার কথা বলছেন। এমনিতে বাবা কিন্তু এসব নিয়ে কথা বলা পছন্দ করেন না। বাবা বলেন যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা অপরাধ। তাছাড়া বাবার কথা না বলার আরো একটা কারণ আছে। শুনে তোমরা হাসাহাসি করবে বলে বলিনি।

কেন্টু অবাক হলে বললো, হাসাহাসি করবো কেন?

পল একটু চুপ থেকে লাজুক হাসলো। বললো, মামারা সবাই বাবাকে নিয়ে হাসাহাসি করেন। বলেন বেলুনওয়ালা। আমাদের বাসায় যে বেলুনগুলো দেখেছো এগুলো বাবা বানিয়েছেন। বাবার ছোট্ট একটা বেলুন বানাবার মেশিন আছে। বাবা কী করেন বললে আমাকেও যে বলতে হয় বেলুনওয়ালা।

বনি এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। বললো, তা কেন হবে পল? আমার বাবাকেও যে তাহলে বলতে হয় চাওয়ালা।

কেন্টু হেসে বললো, আমার বাবা তাহলে জুতোওয়ালা।

আমরা সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলাম। পলও হাসলো। আমি পলের কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, তোমার বাবা এত সুন্দর বেলুন বানাতে পারেন এ আমি ভাবতেও পারি না। আমি তোমাকে হিংসে না করে পারছি না পল।

বিজু বললো, আসলে পলের বাবা সারা জীবন কতো অ্যাডভেঞ্চার করেছেন দেখলি?

আমাদের যাবার সময় হলো। পলের বাবা আমাদের সবার হাতে একটা করে রঙিন বেলুনের বাক্স ধরিয়ে দিয়ে বললেন, যতবার আসবে ততবার বেলুন পাবে।

বনি বললো, তাহলে আপনার সব বেলুন ফুরিয়ে যাবে।

পলের বাবা বললেন, তোমাদের জন্য আমার বেলুন কখনো ফুরোবে না।

পলের মা বললেন, আমাদের বেলুন পলের বন্ধুদের জন্য।

আমরা চারজন বড়দিনের সেই রাতে হাঁটছিলাম ফাঁকা রাস্তা দিয়ে। কুয়াশায় ঢেকে আছে সারা রাস্তা। আমরা সবাই ভাবছিলাম, আমাদের বাবা যদি পলের বাবার মতো হতেন। আমরা যখন আলাদা হবো তখন বনি বললো, পলের বাবার সঙ্গে কারো তুলনা হয় না।

বড়দিনের সেই রাতে পলের বাবা আমাদের ঘুমের ভেতরও নিয়ে গিয়েছিলেন সারডিনিয়ার এক বরফঝরা বনের ধারে। যেখানে বড়দিনের রাতের জানালার ধারে মোমবাতি জ্বলে, জানালার কাঁচে জমে থাকা বরফ মোমের মতো গলে গলে পড়ে, আর হ্যাঁমিল্টন বুড়ো গিটার বাজিয়ে গায়–সেই সব দিন, আহা সেই সব দিন…….।