০০৭. পুরনো শত্রু

ভলিউম ৭ – পুরনো শত্রু – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ : সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯

০১.

সবে থেমেছে স্যালভিজ ইয়ার্ডের ট্রাকটা, চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর পাশা, চাচা, দেখো, দেখো!

 বাড়িটা রকি বীচের কাছেই, রেমুডা ক্যানিয়নে। পুরনো মাল কিনতে এসেছেন রাশেদ পাশা। সঙ্গে এসেছে কিশোর আর তার বন্ধু মুসা আমান।

কী? অবাক হয়ে তাকালেন রাশেদ পাশা। কোথায়?

ওই যে, ওই তো বাড়িটার ধারে!

শেষ গোধূলি, দিনের আলো প্রায় শেষ।

কই, কি দেখেছিস, কিশোর?

খাইছে! আমিও তো কিছু দেখছি না, মুসা বললো।

চেয়ে রয়েছে কিশোর। কালো মূর্তিটা নেই। চোখের পলকে যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে। নাকি ছিলোই না ওখানে? চোখের ভুল? বিড়বিড় করলো, দেখেছি! কালো পোশাক পরা একটা মূর্তি!

বিরাট কাঠামোর বাড়িটার দিকে তাকালেন রাশেদ পাশা পাহাড়ী অঞ্চল। গিরিসঙ্কটের দেয়ালের ছায়ায় কেমন নিঃসঙ্গ লাগছে বাড়িটাকে। কাছেই হোট কটেজ। শান্ত, নীরব।

ছায়াটায়া দেখেছিস আর কি, বললেন চাচা।

আলোছায়ার খেলা, বললো মুসা।

আলো কোথায় দেখলে? আমি বলছি, আমি দেখেছি। মনে হলো ওই বাড়ির জানালার ভেতরে ঢুকে গেল।

দ্বিধা করলেন রাশেদ পাশা। সাধারণতঃ ভুল করে না তার ভাতিজা। বললেন, বেশ, চল, বাড়িতে ঢুকেই দেখি। প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানা যাবে।

রাশেদ পাশার পিছু পিছু এগোলো দুই গোয়েন্দা।

অনেক পুরনো বাড়ি। একশো বছর হতে পারে, দুশো হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কাঠের টাওয়ার, ছড়ানো কার্নিশ। গাড়িবারান্দার ঢেউখেলানো হাতটা ধরে রেখেছে মোটা মোটা থাম। আর রিশাল সদর দরজা।

দরজায় ধাক্কা দিলেন রাশেদ পাশা।

সাড়া দিয়ে বেরোলেন লম্বা, রোগাটে একজন মানুষ। প্রৌঢ়, কিন্তু মনে হয় বয়েস আরও বেশি, বৃদ্ধ। চোখের নিচে গভীর ছায়া। এই জুলাই মাসের গরমেও টুইডের একটা জ্যাকেট পরে রয়েছেন, তোকাল ধোয়া হয়নি কে জানে, দোমড়ানো। হাতে বিদেশী ভাষায় লেখা মোটা এক বই।

প্রফেসর হোফার? জিজ্ঞেস কলেন রাশেদ পাশা।

হাসলেন প্রফেসর। আপনি নিশ্চয়ই রাশেদ পাশা? আসুন আসুন।

বাধা দিয়ে বললেন রাশেদ পাশা, প্রফেসর সাহেব, এ-আমার ভাতিজা। ও খানিক আগে নাকি কালো, পোশাক পরা একটা লোককে আপনার জানালা দিয়ে চুতে দেখেছে।

আমার বাড়িতে? চোখ মিটমিট করলেন প্রফেসর। নিশ্চয় ভুল করেছে।

না, স্যার, জবাব দিলো কিশোর। আমি শিওর। দামী কোনো জিনিস আছে। আপনার বাড়িতে? চোরে চুরি করবে, এমন কিছু?

 নাহ। কিচ্ছু নেই।…তবু তুমি যখন বলছো..ওহহো, বুঝেছি, আমার ছেলে, রিকি। কালো কাউবয় পোশাক আছে তার। আর কতোবার বুঝিয়েছি, জানালা দিয়ে ঢোকার চেয়ে দরজা দিয়ে ঢোকা অনেক ভালো। প্রফেসর হাসলেন।

মাথা ঝাঁকালেন রাশেদ পাশা। তাই বলুন।

আপনার ছেলের বয়েস কতো, স্যার? জানতে চাইলো কিশোর।

কতো আর, এই তোমাদের মতোই। তোমার মতোই লম্বা।

আমি যাকে দেখেছি, সে আরও লম্বা।

তাই? সংশয় দেখা দিলো প্রফেসরের চোখে। বেশ, এসো, দেখি কোথায় লুকিয়ে আছে তোমার চোর।

বিরাট বাড়িটার নিচতলার ঘরগুলো ঘুরিয়ে দেখালেন প্রফেসর। বেশির ভাগই খালি, বন্ধ করে রাখা হয়েছে। করি ভাষা নিয়ে গবেষণা, বিষণ্ণ শোনালো তার কণ্ঠ। টাকা নেই। এতো বড় বাড়ি আর রাখার ক্ষমতা নেই আমার। এক মুহূর্ত থেমে বললেন, বাপ-দাদারা ছিলো জাহাজী, ক্যাপ্টেন। ভালো টাকা আয় করতো। কতো যে জিনিস আনতে পুব-দেশ থেকে। তারাই বানিয়েছে এই বাড়ি, টিকিয়ে রেখেছে অনেক দিন। নাবিক হলে হয়তো আমিও পারতাম। হইনি। এখন এখানে থাকি শুধু আমি আর আমার ছেলে। এক চাচাতো ভাই ছিলো আমার, সে-ও অনেকদিন হলো এ-বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। এতো বড় বাড়িতে থাকার লোক কোথায়? বন্ধই করে রাখি ঘরগুলো। কটেজটা যে দেখলেন, কেয়ারটেকার। থাকতত আগে। এখন ওটা ভাড়া দিয়েই সংসারের খরচ চালাই।

নিচতলায় চোরকে পাওয়া গেল না। ওপর তলায় উঠলো সবাই। ওপরেও নিচের মতোই অবস্থা।

ভালোমতো ঘরগুলো দেখে কিশোর স্বীকার করলো, না, চুরি করার মতো। কিছু নেই।

হতাশ মনে হচ্ছে তোমাকে? বললেন প্রফেসর।

হবেই, বললো মুসা। ভেবেছিলো কি জানি একটা রহস্য পেয়ে গেছে। পায়নি তো, তাই।

 আপনার ছেলেকে দেখছি না? চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো কিশোর। কাউকে দেখেছি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আচ্ছা, পুরনো জিনিস বিক্রি করবেন বলে ডেকেছেন আমাদের। তার মধ্যে মূল্যবান কিছু নেই তো?

থাকলে, তো খুশিই হতাম। আছে শুধু বুড়ো ডেনবারের কিছু পুরনো জিনিস। কটেজে থাকতো। কয়েক মাস আগে মারা গেছে। থাকার মধ্যে আছে গোটা দুই সুটকেস, আর কয়েকটা ছবি, তার আঁকা। লোকটার বোধহয় দুনিয়ায় কেউ ছিলো না, অনেকটা সন্ন্যাসীর মতোই থাকতো। টাকাপয়সা ছিলো না। শেষ কমাসের ভাড়াও মিটিয়ে যেতে পারেনি। সেজন্যেই তার জিনিস বিক্রি করতে চাইছি, কটা ডলারও যদি আসে মন্দ কি?

সন্ন্যাসীদের কাছে অনেক সময় মূল্যবান জিনিস থাকে, বললো কিশোর।

কি ব্যাপার, গোয়েন্দার মতো কথা বলছো?

গোয়েন্দাই তো আমরা, মুসা বললো। কিশোর, দেখাও না।

পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার কার্ড বের করে দিলো কিশোর।

মুচকি হেসে মাথা দোলালেন প্রফেসর। কিন্তু এখানে তদন্ত করার কিছু পাবে না। যা দেখেছো, ওটা ছায়া ছাড়া কিছু না।

ঠিক এই সময় চিৎকার শোনা গেল, চোর! চোর! বাবা, জলদি এসো!

স্থির হয়ে গেল সবাই। কান পেতে শুনলেন প্রফেসর। আরে, রিকি! সিঁড়ির দিকে দৌড় দিলেন তিনি। পেছনে ছুটলো অন্য তিনজন।

বাবা, তাড়াতাড়ি! আবার শোনা গেল চিৎকার, বাঁয়ে কটেজের দিক থেকে।

.

০২.

লন মাড়িয়ে ছুটলেন প্রফেসর হোফার। ঠিক পেছনেই রাশেদ পাশা আর মুসা। তাদের পেছনে কিশোর।

কটেজের সামনের ছোট ছাউনির নিচে পৌঁছলো ওরা। এক ধাক্কায় দরজা খুলে ছোট একটা লিভিংরুমে ঢুকলেন প্রফেসর। হাঁপাচ্ছেন। চেঁচিয়ে ডাকলেন, রিকবার!…রিকি!

এই যে এখানে, বাবা, জবাব এলো কটেজের খুদে বেডরুম থেকে।

প্রফেসর ঢুকলেন। পেছনে ঢুকলেন রাশেদ পাশা আর মুসা। লিভিংরুমের মতোই এ-ঘরেও আসবাব তেমন নেই। একটা সিঙ্গল খাট, একটা চেয়ার, আর একটা ভারি টেবিল–উল্টে পড়ে আছে। টেবিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে গায়ের ধুলো ঝাড়ছে একটা ছেলে। রোগী টিনটিনে শরীর।

তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন প্রফেসর।

আমি ঠিকই আছি, বাবা, বললো রিকি। নড়াচড়ার শব্দ শুনে ঢুকে দেখি কালো পোশাক আর, কালো মুখোশ পরা একটা লোক। আমি চেঁচিয়ে উঠতেই টেবিলটা উল্টে আমার গায়ের ওপর ফেললো। ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ে গেলাম। এই সুযোগে পেছনের দরজা দিয়ে পালালো ব্যাটা।

কিশোরের কথাই ঠিক! বলে উঠলো মুসা। তবে একটা ভুল করেছে। লোকটাকে ঢুকতে নয়, বেরোতে..আরি, কিশোর গেল কই?

ফিরে এসে লিভিংরুমে ঢুকলো মুসা। ওখানেও নেই কিশোর। গেল কোথায়?

কিশোর? চিৎকার করে ডাকলেন রাশেদ পাশা।

আমাদের পেছনেই তো ছিলো, ঢোক গিললো মুসা।

ছেলের দিকে তাকালেন প্রফেসর। লোকটার হাতে কিছু ছিলো? ছুরি, পিস্তল…

দেখিনি।

হঠাৎ আরেকটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল কটেজের পেছন দিক থেকে।

পাক খেয়ে ঘুরলেন প্রফেসর। নালার ওদিক থেকে! হয়তো কেউ পড়ে গেছে!

নালাটা কি খুব গভীর? শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন রাশেদ পাশা।

মোটামুটি। পড়লে হাত-পা ভাঙতে পারে। আসুন আমার সঙ্গে।

ওদেরকে কটেজের পেছনে নিয়ে এলেন প্রফেসর। ছোট ঝোপঝাড়, মাঝে মাঝে বড় বড় গাছ। ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটলো ওরা। নালাটার প্রান্তে এসে থমকে দাঁড়ালো। দশ ফুট মতো গভীর নালাটার দুই মাথা, বাঁক নিয়ে চোখের আড়াল হয়ে গেছে। নিচে আলগা পাথরের ছড়াছড়ি, হালকা গাছপালাও আছে।

কিশোরের চিহ্নও নেই।

দেখুন! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

নিচে, ডানের কয়েকটা পাথরের ওপর কালচেমতো কি যেন লেগে রয়েছে। আলো নেই। ওপর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

প্রায় খাড়া ঢাল বেয়ে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে নামলো ওরা।

হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো মুসা। ভেজা। রক্ত! আঁতকে উঠলো সে।

.

কালো মূর্তিটা আবার চোখে পড়লো কিশোরের। কটেজের পেছন থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের দিকে ছুটে যাচ্ছে।

কিশোর বুঝলো, লোকটাকে সে একাই দেখেছে। অন্যেরা ঢুকে গেছে কটেজে। তাদেরকে ডেকে বের করে আনতে সময় লাগবে, ততোক্ষণে বনে ঢুকে। হারিয়ে যাবে লোকটা। এক মুহূর্ত দ্বিধা করলো গোয়েন্দাপ্রধান, তারপর মোড় নিয়ে ধাওয়া করলো মূর্তিটাকে।

কিন্তু তা-ও দেরি হয়ে গেল। লোকটার চেহারা দেখতে পেলো না সে, তার আগেই ঢুকে গেল জঙ্গলে। ঝোপ মাড়ানোর শব্দ কানে আসছে। কয়েক সেকেণ্ড। পরেই কি যেন গড়িয়ে পড়তে লাগলো, ধ্যাপ করে পাথরের ওপর পড়লো ভারি কিছু। যেন একটা বস্তা পড়েছে। পরক্ষণেই শোনা গেল তীক্ষ্ণ চিৎকার।

এক নালাটার কিনারে এসে দাঁড়ালো কিশোর। নিচে উঁকি দিলো। কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়েছে কালো মূর্তিটা। খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড় দিলো ডান দিকে, বা পায়ে চোট লেগেছে। হারিয়ে গেল মোড়ের ওপাশে।

বসে পড়লো কিশোর। পার্কের পারে বাচ্চারা যেমন করে স্লীপ করে, তেমনিভাবে পিছলে নামলো নালায়। পাথরে রক্ত দেখতে পেলো। এগিয়ে গেছে রক্তের দাগ। সাবধানে চিহ্ন ধরে ধরে এগোলো সে। বৃষ্টির সময় পাহাড় থেকে নেমে আসা পানির তীব্র স্রোতের কারণে সৃষ্টি হয়েছে এই নালা। পানি গিয়ে পড়ে ডানের একটা গর্তে, তৈরি করেছে একটা ছোট গিরিখাত, ঘন ঝোপঝাড়ে ভরা। ওটার মধ্যে কেউ লুকিয়ে বসে থাকলে ওপর থেকে দেখা যাবে না।

কিশোর ভাবলো লোকটা ওটার ভেতরেই লুকিয়েছে।

ভুল করেছে। সামনে দড়াম করে বন্ধ হলো একটা গাড়ির দরজা। এঞ্জিন গর্জে উঠলো।

ছুটতে শুরু করলো কিশোর। গিরিখাতের পাশ দিয়ে সরু পথ, সেটা দিয়ে। বেরিয়ে যাওয়া যায় মেইন রোডে।

কিশোর যখন রাস্তার ধারে পৌঁছুলো, গাড়িটা তখন আঁকাবাঁকা পথটার একটা মোড়ের কাছে চলে গেছে। হারিয়ে গেল লাল টেলাইট। শহরের দিকে চলে গেল।

রক্তের দিকে চেয়ে রয়েছে মুসা, চোখে আতঙ্ক। কানে এলো পদশব্দ, কে যেন আসছে।

রাশেদ পাশাও শুনতে পাচ্ছেন। মুসা, শুয়ে পড়ো, জলদি! সবাই…

ছায়ায় লুকিয়ে পড়তে যাবে ওরা, এই সময় দেখতে পেলো, মোড়ের ওপাশ থেকে বেরিয়ে আসছে কিশোর।

কিশোর? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো মুসা, কি হয়েছে?

ব্যাটাকে তাড়া করেছিলাম। ধরতে পারলাম না। পালালো।

কাজটা ভালো করোনি! গম্ভীর হয়ে বললেন রাশেদ পাশা। ছুরিটুরি যদি মেরে বসতো?

ধরতে যাইনি ওকে, চাচা। চেহারা দেখার চেষ্টা করেছি। অন্ধকারে পারলাম। গাড়ি নিয়ে এসেছিলো, পালালো।

 আনমনে মাথা নাড়লেন প্রফেসর। বুঝতে পারছি না, কি নিতে এসেছিলো! আমার মনে হয়, ভুল করেছে। আশপাশে বড়লোকের বাড়ি আছে, আমাকেও বড় লোক মনে করেছে আরকি। তাই ঢুকে পড়েছে।…চলুন, মিস্টার পাশা, কাজ শেষ। করি।

কটেজে ফিরে এলো ওরা।

সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন প্রফেসর। বেডরুমের দেয়াল-আলমারি থেকে বের করলেন চামড়ার দুটো পুরনো সুটকেস। একটার ভেতরে শুধু কাপড় চোপড় পুরনো ফ্যাশনের একটা ড্রেস সুট, ধূসর রঙের একটা ফ্লানেল কাপড়ের সুট, কয়েকটা শার্ট, টাই, আর কয়েক জোড়া মোজা। আরেকটা সুটকেসে রয়েছে ছবি আঁকার কিছু রঙ, স্টাফ করা একটা পেঁচা, গ্রীক পুরাণের দেবি ভেনাসের ছোট একটা মূর্তি, বড় একটা বিনকিউলার, আর এক বাক্স রূপার ছুরি, কাঁটাচামচ, চামচ।

সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকতো ডেনবার, বললেন প্রফেসর। পুরনো একটা প্যান্ট আর শার্ট ছাড়া আর কিছুই পরতো না। তবে লোকটা শিক্ষিত ছিলো। আর খাওয়ার সময় এই ছুরি-চামচ ব্যবহার করতো। সাত মাস ছিলো এখানে। লনে একটা ক্যানভাসের  চেয়ারে বসে থাকতো, আর ছবি আঁকতে, সর্বক্ষণ। রাতেও। বুঝলেন কিছু?

ঘরের কোণ থেকে ক্যানভাসের  আবরণ সরিয়ে বিশটা ছবি বের করে। আনলেন প্রফেসর। এই কটেজ আর তার আশপাশের এলাকার দৃশ্য আঁকা হয়েছে। কোনোটা খুব কাছে থেকে-ক্লোজআপ, আর কোনোটা এতো দূরে, ঘরটা ভালোমতো বোঝাই যায় না।

 মন্দ না, একবার দেখেই নজুর ফেরালেন রাশেদ পাশা। সুটকেস দুটো, বিশেষ করে রূপার জিনিসগুলো দেখে চোখ চকচক করছে তাঁর। ঠিকমতো দরদাম করে কিনতে পারলে পুরনো জিনিসে বেশ ভালো লাভ। তবে কাউকে ঠকাতে চান না তিনি, ন্যায্য দাম দেন। এগুলো বিক্রি করবেন?

হ্যাঁ। মৃত্যুর আগে আমাকে একটা ঠিকানা দিয়ে বললো ডেনবার, ওখানে। চিঠি লিখলেই আমার পাওনা টাকা পেয়ে যাবো। লিখেছি, ভাড়া বাকি আছে সে কথাও জানিয়েছি, কোনো জবাব আসেনি। কেউ খোঁজ নিতেও আসেনি। আর কতো অপেক্ষা করবো? আমার টাকার খুব দরকার?

দাম নিয়ে দর কষাকষি শুরু করলেন রাশেদ পাশা আর প্রফেসর।

রিগ ডেনবারের জিনিসগুলো দেখতে চাইলো কিশোর। একটাও দামী জিনিস নেই, যার জন্যে গাড়িওয়ালা চোর আসতে পারে।

রিকি, জিজ্ঞেস করলো গোয়েন্দাপ্রধান। মিস্টার ডেনবারের কি হয়েছিলো?

অসুখ হয়েছিলো, জানালো রিকি। ভীষণ জ্বর উঠলো। প্রলাপ বকতো, খালি ক্যানভাস আর আঁকাবাঁকা রেখা, না পথ, কি কি সব বলতো। ওর দেখাশোনা তখন আমিই করতাম। শেষে অসুখ এতো বেড়ে গেল, ডাক্তারকে খবর না দিয়ে আর পারলাম না। ডাক্তার আসার আগেই মারা গেল বেচারা। বয়েস, হয়েছিলো, হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বোধহয় বাঁচতো না।

চোরটা ভুলই করেছে, কি বলো, কিশোর? মুসা বললো। দামী কিছুই নেই এখানে।

আস্তে মাথা ঝোঁকালো শুধু কিশোর।

রিগ ডেনবারের জিনিসগুলো কিনে নিয়ে ট্রাকে তোলা হলো। পাহাড়ী পথ ধরে ছুটে চললো গাড়ি। একটা গিরিপথের ভেতর থেকে বেরোতেই বিড়বিড় করলো কিশোর, চোরেরা সাধারণতঃ ভুল করে না, ঘনঘন নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে সে।

কি চুরি করতে এসেছিলো সে, কোনোদিনই জানতে পারবো না আমরা, বললো.মুসা।

তাই তো দেখছি, দীর্ঘশ্বাস ফেললো কিশোর।

.

০৩.

ওই ঘটনার এক হপ্তা পর, এক বিকেলে পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে কাজে ব্যস্ত দুই গোয়েন্দা। রবিনই প্রথমে গাড়িটা ঢুকতে দেখলো। হলুদ রঙের একটা মার্সিডিজ গিয়ে থামলো অফিসের সামনে।

চকচকে গাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলো মার্জিত পোশাক পরা মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ। বিকেলের রোদে তার ধূসর চুল রূপালি দেখাচ্ছে। পরনে শাদা সামার সুট, সিল্কের নীল শার্ট। হাতে সরু কালো একটা বেত, আর একটা কি যেন ঝিক করে উঠলো। এক মুহূর্ত দেখলো ছেলেদের, তারপর ঘুরে রওনা হলো অফিসের দিকে।

চেয়ে রয়েছে ছেলেরা। হঠাৎ বলে উঠলো কিশোর, ওহহহ, ভুলেই গিয়েছিলাম, চাচা-চাচী কেউ নেই অফিসে। চলো, চলো।

গাড়িটার কাছাকাছি এসেছে, এই সময় খুলে গেল পেছনের দরজা। বেরিয়ে এলেন এক লম্বা মহিলা। নীলচে-ধূসর চুল। শাদা সিল্কের পোশাক পরনে। তাতে লাগানো একটা হীরার ব্রোচ। রাজকীয় ভঙ্গিতে তাকালেন ছেলেদের দিকে। মিস্টার রাশেদ পাশা আছেন?

না, ম্যাডাম, জবাব দিলো কিশোর। উনি আমার চাচা। ইয়ার্ডের ভার আমার ওপর দিয়ে গেছেন।

তাই? বয়েস তো বেশি লাগছে না। কাস্টোমার সামলাতে পারো?

পারি।

গুড, হাসলেন মহিলা। কনফিডেন্স থাকা ভালো।

আসলে, হেসে বললো রবিন। পাঁচটার পরে কাস্টোমার বেশি আসেই না।

আবার হাসলেন মহিলা। আমি একজন কাস্টোমার। আর ওই যে অফিসে ঢুকলো, ও আমার এস্টেট ম্যানেজার, ফ্রেড ব্রাউন। চলো ওখানে।

ডেস্কের ওপর ঝুঁকে কি দেখছিলো লোকটা, ছেলেদের ঢুকতে দেখে চট করে সুরে গেল। তবে ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছে কিশোর। ইয়ার্ডের পার্চেজ বুকটা ঘাঁটছিলো ম্যানেজার।

 ফ্রেড, মহিলা বললেন। এরাই এখন দায়িত্বে আছে।

ও, ছেলেদের দিকে চেয়ে মাথা সামান্য নোয়ালো ম্যানেজার। ওরা দেখলো, ঝিক করে উঠেছিলো: যে জিনিসটা, ওটা বেতের রূপার হাতল-মুঠো করে ধরার জন্যে। তাহলে তোমাদেরকেই বলি। প্রফেসর হোফারের কাছ থেকে কিছু জিনিস কিনে এনেছো তোমরা, মিস্টার রিগ ডেনবারের জিনিস। ওগুলো ফেরত চাইছেন আমাদের কাউন্টেস, মহিলাকে দেখালো সে। দাম অবশ্যই দেবো। যা দিয়ে কিনেছ, তার ডাবল।

দামী কিছু আছে নাকি ওগুলোর মধ্যে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

দামী? তা তো আছেই। যতো ফালতু জিনিসই হোক না কেন, মৃত ভাইয়ের। জিনিস, বোনের কাছে তার দাম অসাধারণ। ও হ্যাঁ, কাউন্টেস মিস্টার ডেনবারের বোন।

ভুরু কোঁচকানো রবিন। আপনি সত্যি কাউন্টেস?

আমার মরহুম স্বামী কাউন্ট ছিলেন, হেসে বললেন মহিলা। আর ডেনবার। আমার বড় ভাই, বিশ বছরের বড়। আমাদের মধ্যে মিল ছিলো না খুব একটা। তাছাড়া ভাই ছিলো একটু অন্য রকম, খামখেয়ালী, শামুকের মতো কেমন যেন গুটিয়ে রাখতে নিজেকে। এই দেখোনা, অসুখে ভুগে বিনা চিকিৎসায় মারা গেল, একবার জানালো না পর্যন্ত আমাকে।

আফ্রিকায় ছিলাম আমরা, বুঝেছো? কাউন্টেস থামতেই বলে উঠলো তার ম্যানেজার। কাউন্টের বাড়িতে পৌঁছলো প্রফেসরের চিঠি, সেখান থেকে পাঠিয়ে দেয়া হলো আফ্রিকায়। সঙ্গে সঙ্গে ছুটলাম। তা-ও দেরি হয়ে গেল। এসে দেখি, বেচারা মানুষটার শেষ স্মৃতিগুলোও বিক্রি করে দিয়েছেন প্রফেসর। ওগুলো ফেরত পেলে খুবই খুশি হবেন কাউন্টেস।

বসুন, নিয়ে আসছি, রবিনকে নিয়ে বেরিয়ে এলো কিশোর।

একধারে কাজ করছে ইয়ার্ডের কর্মচারী দুই ব্যাভারিয়ান ভাই বোরিস আর রোভার। জিনিসগুলো খুঁজে না পেয়ে, কোথায় রাখা হয়েছে–ওদেরকে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

কয়েক মিনিট পর অফিসে ফিরে এলো দুই গোয়েন্দা।

সরি, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো কিশোর। কাপড়গুলো ছাড়া আর সব বিক্রি হয়ে গেছে।

ওগুলো রেখে দাও, বললো ম্যানেজার। আর কিছুই নেই? ছবিগুলোও না?

এটাই অদ্ভুত লাগছে আমার কাছে, বললো কিশোর। কতো ভালো ভালো ছবি কিনে এনে ফেলে রাখি, পড়ে থেকে নষ্ট হয়, আর এই ছবিগুলো আনতে না আনতেই বিক্রি হয়ে গেল!

কে নিলো?

মাথা নাড়লো কিশোর। শুধু কেনার রেকর্ড রাখি আমরা, মিস্টার ব্রাউন, বিক্রির রাখি না। লোকে আসে, পছন্দ করে কিনে নিয়ে যায়। পুরনো জিনিস, গ্যারান্টি তো আর দিতে হয় না, তাই রশিদও লাগে না। আমাদের কর্মচারী বোরিস এক লোকের কাছে সবগুলো ছবি বেচে দিয়েছে। কার কাছে, কিছুতেই মনে করতে পারছে না। পারার কথাও নয় অবশ্য।

আমার কপালই বোধহয় খারাপ, হাসি চলে গেছে কাউন্টেসের মুখ থেকে।

কোনো ভাবেই কি খোঁজ বের করা যাবে না? জিজ্ঞেস করলো ম্যানেজার।

উজ্জ্বল হলো কিশোরের চোখ। চেষ্টা করে দেখতে পারি, যদি…, দ্বিধা করতে লাগলো সে।

ভ্রূকুটি করলেন মহিলা। যদি কি, ইয়াং ম্যান? বলো, বলে ফেলো।

যদি আমাদেরকে ভাড়া করেন আপনারা। আমরা গোয়েন্দা। …এই যে, আমাদের কার্ড। পুলিশ চীফের সার্টিফিকেটও আছে আমাদের কাছে, চাইলে দেখাতে পারি।

আবার হাসি ফুটলো কাউন্টেসের মুখে। কিন্তু…

কোনো কিন্তু নেই, কাউন্টেস, বাধা দিয়ে বললো ম্যানেজার। আমরা এখানে নতুন। আর ওরা এখানে থাকে, জায়গাটায়গা চেনে। তাছাড়া গোয়েন্দা। পুলিশ চীফ সার্টিফিকেট দিয়েছে বলছে যখন, নিশ্চয় যোগ্যতা আছে ওদের। খুঁজুক না। খুঁজে বের করতে পারলে তো ভালোই।

বেশ, মাথা কাত করলেন মহিলা। তুমি যখন বলছো… ভাইয়ের আঁকা জিনিস, ওগুলো আমার চাই। দেখে তাকে মনে তো করতে পারবো।

বের করে দেবো আমরা, ম্যাডাম, কিশোর বললো।

পারবে তো?

পারবো।

গুড। তা কার্ডে তো দেখলাম তিনজনের নাম, আরেকজন কোথায়?

নেই এখন। বাড়িতে কাজটাজ করছে হয়তো। ওর নাম মুসা আমান। আমি কিশোর পাশা, আর ও রনি মিলফোর্ড।

ঠিক আছে, ভাড়া করলাম তোমাদেরকে, বললো ম্যানেজার। উপকূলের কাছে সী বীচ মোটেলটা চেনো তো? ওখানেই উঠেছি আমরা। দরকার হলে যোগাযোগ কোরো। এক হপ্তা থাকবো। তারপর ইউরোপে ফিরে যাবো। গুড লাক, বয়েজ।

গাড়িতে উঠে চলে গেল দুজনে।

কিশোর, বলে তো দিলে খুঁজে দেবে, কিন্তু কিভাবে…

থেমে গেল রবিন। কিশোর চেয়ে রয়েছে গেটের দিকে। ছোট নীল একটা সেডান ইয়ার্ডের বাইরে দাঁড়িয়েছিলো, মার্সিডিজটা বেরোতেই ওটার পিছু নিয়েছে।

আশ্চর্য! বললো গোয়েন্দাপ্রধান।

কী?

নিশ্চয় রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলো।

অনুসরণ করছে বলছো?

কিশোর জবাব দেয়ার আগেই দেখা গেল, সাইকেল চালিয়ে গেট দিয়ে ঢুকছে রোগাটে এক কিশোর। মাথায় কালো চুল। প্রফেসর হোফারের ছেলে রিকি।

অফিসের বাইরে বেরোলো দুই গোয়েন্দা।

ওদের দেখেই চেঁচিয়ে উঠলো রিকি, এই যে! কাউন্টেস এসেছিলো?

হ্যাঁ। এইমাত্র গেল, জবাব দিলো রবিন।

ডেনবারের জিনিসগুলো দিয়ে দিয়েছো?

না, বললো কিশোর। প্রায় সবই বিক্রি হয়ে গেছে। তবে ওদেরকে কথা। দিয়েছি, খুঁজে বের করে দেবো।

হুউফ! বাঁচা যাবে তাহলে। বিকেলে আমাদের ওখানে গিয়েছিলো। বাবা। বিক্রি করে দিয়েছে শুনে কাউন্টেস যা রাগ করলো না। বাবাকে ধমকাতে শুরু করলো। বললো, চিঠি যখন দিয়েছে, আরও কিছুদিন দেখা উচিত ছিলো। মহিলাকে শান্ত করলো তার ম্যানেজার। বুঝিয়ে বললো, প্রফেসরের জানার কথা নয় যে ডেনবারের এক বোন আছেন। যাই হোক, শান্ত হলো মহিলা। তবে বাবা চিন্তায় পড়ে গেছে। তার ধারণা, জিনিসগুলো না পেলে গোলমাল কররে কাউন্টেস।

আচ্ছা, রিকি, ওরা, যখন তোমাদের বাড়ি গেল, একটা নীল সেডান দেখেছো?

নীল সেডান…? ভাবলো রিকি। হ্যাঁ, দেখেছি। মার্সিডিজটা চলা শুরু করতেই ক্যানিয়ন রোডের মোড় থেকে বেরোলো নীল গাড়িটা। ওরকম গাড়ি ওখানে কারও নেই। প্রতিবেশী যারা আছে, সবার গাড়ি চিনি আমি। থাকেই তো.। অল্প কয়েকজন। কেন?

আমিও দেখলাম গাড়িটা। মার্সিডিজকে ফলো করছে।

কাউন্টেসের ওপর নজর রাখছে? মানে স্পাইইং?

তাই তো মনে হলো, চিন্তিত দেখাচ্ছে কিশোরকে। প্রথমে একটা রহস্যময় লোক চুরি করে ঢুকলো তোমাদের ঘরে। এখন কাউন্টেসকে ফলো করছে কে জানি। এর কারণ নিশ্চয় রিগ ডেনবারের জিনিসগুলো। কোথায় যেন একটা রহস্য আছে।

দামী কিছু ছিলো নাকি ডেনবারের কাছে? প্রশ্ন করলো রবিন।

কি জানি, নথি, এখনও বুঝতে পারছি না। আগে ডেনবারের জিনিসগুলো খুঁজে বের করতে হবে, তারপর বুঝতে পারবো!

কে কিনেছে? জিজ্ঞেস করলো রিকি। জানো?

না।

তাহলে, অবাক হলো রিকি, কি করে বের করবে?

ভূত-থেকে-ভূতে।

.

০৪.

ভূত-থেকে-ভূতে! হাঁ হয়ে গেল রিকি। তোমাদের পোষা নাকি? ভূত তাহলে। সত্যি আছে?

আজকাল অনেক বিজ্ঞানীও বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছেন, ভূত আছে, বললো, কিশোর। তবে আমাদের ভূত সেই ভূত নয়।

তাহলে কোন ভূত?

বাচ্চা ছেলেমেয়ের দল, হেসে বললো রবিন।

তবুও কিছুই বুঝতে পারলো না রিকি।

গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। ফিরে এসেছেন কিশোরের চাচা-চাচী। এবার তার ছুটি। রিকি আর রবিনকে নিয়ে হেডকোয়ার্টারে ঢুকতে চললো।

তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টার দেখে দ্বিতীয়বার হাঁ হলো রিকি। আর তৃতীয়বার হলো ভূত-থেকে-ভূতে কি, সেটা জেনে। বললো, সব্বোনাশ! কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তো দুনিয়ার সমস্ত ছেলেমেয়ে জেনে যাবে!

না, তা জানবে না, হেসে বললো কিশোর। যেতো, যদি ভাষা সমস্যার সমাধান করা যেতো। যদি দুনিয়াময় একটা সাধারণ ভাষা চালু থাকতো। যাই হোক, রকি বীচ আর আশপাশের এলাকার ওরা খুব শীঘ্রি জেনে যাবে।

আনুমানিক কতক্ষণ? রাতে ডিনারের পর লস অ্যাঞ্জেলেসে যাবে বাবা। আমাকেও নিয়ে যাবে। খবর পাওয়া যাবে কখন?

সকালের আগে না। ডিনারের পরই বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে বাড়ি থাকে। ফোন শুরু করবে ওরা তখনই। রাতেই জানাজানি হয়ে যাবে। খবর আসতে আসতে সকাল।

পুরস্কারের ব্যবস্থা করবো নাকি? জিজ্ঞেস করলো রবিন।

তা তো করতেই হবে, কিশোর বললো। আগে বলবো না, কি দেবো। আনুক আগে, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবো।

রিকি চলে গেল।

প্রথমেই মুসাকে ফোন করলো কিশোর। সব কথা জানালো। বললো, মুসাও যেন তার পাঁচ বন্ধুকে ফোন করে দেয়।

সন্ধ্যা আটটার মধ্যেই রকি বীচের সমস্ত ছেলেমেয়ের জানা হয়ে গেল খবরটা।

.

পরদিন সকাল নটায়, হেডকোয়ার্টারে অপেক্ষা করছে তিন গোয়েন্দা। বার বার তাকাচ্ছে টেলিফোনের দিকে, কখন বেজে ওঠে!

অনেক আজেবাজে জিনিসের খোঁজ দেবে, বললো, কিশোর। তবে। আসলগুলোও পাওয়া যেতে পারে।

দশটা বাজলো।

ফোন বাজলো না।

কিশোরের বিশ্বাসে চিড় ধরতে শুরু করলো। মুসা উসখুস করছে। রবিন স্থির চোখে ফোনের দিকে চেয়ে আছে তো আছেই।

ঠোঁট কামড়ালো গোয়েন্দাপ্রধান। এতোক্ষণে ফোন আসা উচিত ছিলো।

দুই সুড়ঙ্গের ঢাকনায় টোকার শব্দ হলো, চমকে উঠলো তিনজনেই। একে অন্যের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করলো ওরা। শেষে রবিন উঠে গিয়ে ঢাকনার হুক খুলে দিলো। উঠে এলো হোফার।

তোমরা এখনও এখানে বসে আছো? ভুরু কুঁচকে বললো সে। ওদিকে যে ইয়ার্ড ভরে গেছে…

ইয়ার্ড ভরে গেছে! কিশোর অবাক।

কেন, জানো না? ওদের আসতে বলোনি?

এখানে চলে এসেছে নাকি? সর্বনাশ হয়েছে। কিন্তু ওদের তো ফোন করার কথা…

কিশোর, লজ্জিত কণ্ঠে বললো মুসা, আমাদের ফোন নম্বর দিতে ভুলে গেছি। শুধু বলেছি, পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে যেন যোগাযোগ করে।

আমিও তাই করেছি, মুসার কথার প্রতিধ্বনি করলো যেন রবিন।

কিশোরের মুখও লাল হয়ে গেল। পেপারওয়েট সরিয়ে মেসেজটা টেনে নিলো, আগের দিন সন্ধ্যায় যেটা লিখেছিলো। ফোন নম্বর লেখেনি। মেসেজটা দেয়ার সময় রবিন আর মুসাও ভুলটা ধরতে পারেনি।

ভুল হয়েছে, কি আর করা? হাত নাড়লো কিশোর। চলো, বেরোই।

রিকি, ভয় ফুটেছে, মুসার চোখে, অফিসে মেরিচাচী আছে?

দেখলাম না তো। রাশেদ আংকেলকেও না। শুধু বোরিস আর রোভার।

কিশোর, করুণ হয়ে উঠেছে মুসার চেহারা। আমার না গেলে হয় না?

এমন ভাবে দম নিলো কিশোর, যেন গভীর পানিতে অনেকক্ষণের জন্যে ডুব দেবে। চারজনেও সামলাতে পারবো কিনা সন্দেহ আছে। চলো।

.

বাইরে প্রচণ্ড কোলাহল।

আল্লাহরে আল্লাহ! গুঙিয়ে উঠলো মুসা। তুমিই জানো!

আরে, এ-তো খালি আসতেই আছে! চোখ বড় বড় হয়ে গেছে রিকির।

স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর।

রবিন নীরব।

বাচ্চা ছেলেমেয়েতে ভরে গেছে ইয়ার্ডের চত্বর। কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কেউ ছুটছে, কেউ কেউ আবার জঞ্জালের ওপর উঠে বসে আছে। চেঁচাচ্ছে সবাই। শয়ে। শয়ে, যেন পিঁপড়ের দল। ওদের মাঝখানে পড়ে যেন হাবুডুবু খাচ্ছে বিশালদেহী দুই ব্যাভারিয়ান। ইয়ার্ডের জিনিস যার যেটা খুশি তুলে নিচ্ছে বাচ্চারা, তাদের। হাত থেকে কেড়ে নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে গেছে দুই বেচারা! ছেলেমেয়েরা কেউ এসেছে, সাইকেলে, কেউ স্কুটারে। বেশি বয়েসী কিছু ছেলেকেও দেখা গেল, ওরা এসেছে মোটর সাইকেল নিয়ে। গোটা দুই গাড়িও আছে। রঙ মেখে সঙ সাজে যে সার্কাসের ভাড়-গাড়িদুটোরও করা হয়েছে ঠিক সেই অবস্থা। আসল রঙ আর। চেনার জো নেই এখন।

কি চাও তোমরা! আর সহ্য করতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলো রোভার।

কে বলেছে আসতে? চেঁচালো বোরিস।

শুরু হলো তারস্বরে চিৎকার। কারও কথা কিছু বোঝা গেল না। তাড়াতাড়ি কানে আঙুল দিলো দুই ভাই।

হঠাৎ তিন গোয়েন্দার ওপর চোখ পড়লো একটা ছেলের। চেঁচিয়ে বললো, ওই তো, ওই যে এসে গেছে!

এক মুহূর্ত দেরি করলো না আর মুসা। পাঁই করে ঘুরলো, ছুটে পালানোর জন্যে। পারলো না। চোখের পলকে ঘিরে ফেলা হলো তাদেরকে। ধাক্কা খেয়ে আরেকটু হলেই মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলো কিশোর। ফ্যাকাশে হয়ে গেছে চেহারা।

কিশোর! ভিড়ের ভেতর থেকে শোনা গেল রবিনের চিৎকার। কিছু একটা। করো!…ভর্তা করে ফেললো…

ওদেরকে বাঁচালো রিকি। তাড়াতাড়ি একটা তেলের ড্রামের ওপর উঠে জংলী নাচ জুড়ে দিলো। সেই সঙ্গে বিচিত্র ভাষায় গান। বাচ্চাদের জর সরে গেল তার দিকে।

এই সুযোগে ঠেলা-ধাক্কা দিয়ে কয়েকজনকে সরিয়ে-কিশোরের কাছে চলে এলো মুসা। বললো, জলদি! পুরস্কারের কথা বলো! হাতে কিছু ধরিয়ে দিয়ে বিদেয় করতে না পারলে মারা পড়বো।

কি…ক্বি দেবো… এই হৈ-চৈয়ে কিশোরের মাথায়ও কিছু ঢুকছে না। একটা পিপার মধ্যে আর্মিদের ব্যাজ আছে অনেকগুলো, অনেক পুরনো। টেক্সাসে লড়াই করেছিলো যারা…

জলদি আনো গিয়ে… বলতে বলতেই কোনোমতে এসে ড্রামের ওপর উঠলো মুসা, রিকির পাশে। হাত তুলে চেঁচিয়ে বললো, শোনো তোমরা! এই চুপ! আমার কথা শোনো! থেমে গেল কোলাহল। দারুণ একেকখান ব্যাজ পুরস্কার পাবে। সেই ওল্ড ওয়েস্টের জিনিস। আমি শিওর, তোমাদের কারও কাছে নেই একটাও। ওরকম হট্টগোল করলে কাউকে দেয়া হবে না। এদিকে মুখ করে লাইনে। দাঁড়াও। পাঁচ লাইন। যারা সুটকেস এনেছে, তারা এক লাইন করো। পেঁচা আর মূর্তিওয়ালারা আরেক লাইন। বিনকিউলারদের তিন নম্বর লাইন। চার নম্বর লাইনে দাঁড়াবে ছুরি-চামচওয়ালারা। আর শেষ লাইনটা হবে ছবিওয়ালাদের। কোনো হৈ চৈ নয়, ঠেলাঠেলি নয়। হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে যাও। তারপর আমরা দেখবো, কে কি এনেছো।

কথা শুনলো ছেলেমেয়েরা। দ্রুত কিভাবে লাইনে দাঁড়াতে হয়, স্কুলের ট্রেনিং আছে। দেখতে দেখতে তৈরি হয়ে গেল পাঁচটা লাইন। এমনকি বেশি বয়েসী ছেলেগুলোও দাঁড়িয়ে গেল সারির পেছনে।

ব্যাজের পিপেটা নিয়ে আসতে বললো কিশোর বোরিসকে।

প্রথম লাইন থেকে শুরু করলো তিন গোয়েন্দা, তাদেরকে সাহায্য করলো, রিকি। পিপেটা নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রইলো বোরিস আর রোভার।

কে কি এনেছে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো তিন গোয়েন্দা।

যে যা এনেছে, রেখে দিলো, তারপর একটা করে ব্যাজ ধরিয়ে দিলো। একেকজনের হাতে।

এক ঘন্টা পর খালি হয়ে গেল ইয়ার্ডের চতৃর। স্টাফ করা পেঁচা, পুরনো সুটকেস দুটো, আর রূপার চামচ, কাঁটা চামচ, ছুরি, সবই পাওয়া গেল। পাওয়া। গেল না শুধু ভেনাসের মূর্তিটা আর ছবিগুলো।

মূর্তিটা কোথায় আছে, একটা মেয়ে বলেছে আমাকে, রবিন বললো। ঠিকানাও বলেছে। এক মহিলার কাছে আছে ওটা। বিক্রি করবে না।

তুমি গিয়ে একবার বলে দেখো, কিশোর বললো। বুঝিয়ে বললে হয়তো বিক্রি করতেও পারে।…আর মুসা, তুমি কাউন্টেসকে ফোন করো। বলবে, কোনটা কোটা পাওয়া গেছে।

চলে গেল দুই সহকারী গোয়েন্দা।

আরেকটু হলেই মাথা খারাপ করে দিয়েছিলো, ঘাসের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়েছে রিকি। আরিব্বাপরে, কি কাণ্ড! তবে কাজ হয়েছে। এখন মূর্তিটা আর ছবিগুলো পেলেই…

ছবিগুলো মনে হয় শহরের বাইরে চলে গেছে, বললো কিশোর। রকি বীচে থাকলে… থেমে গেল সে। চকচকে একটা গাড়ি ঢুকছে গেট গিয়ে।

ওদের কাছে এসে ঘ্যাচ করে থামলো গাড়িটা।

দরজা খুলে বেরোলো লম্বা, লিকলিকে একটা ছেলে, তাল পাতার সেপাই। কিশোরের দিকে চেয়ে দাঁত বের করে হাসলো, হাতে একটা ছবি।

.

০৫.

এটাই খুঁজছো, তাই না শার্লক পাশা? ছবিটা তুলে দেখালো ছেলেটা।

শুঁটকি! চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। তোমার এখানে কি?

খিকখিক করে হাসলো তিন গোয়েন্দার পুরনো শত্রু টেরিয়ার ডয়েল, ওরফে শুঁটকি টেরি। আমার প্রশ্নের জবাব দাও।

 ছবিটা চিনতে পেরেছে রিকি, মুখ খুলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই তাড়াতাড়ি বলে ফেললো কিশোর, না, বোধহয় না। কোথায় পেলে এটা, শুঁটকি?

সেটা আমার ব্যাপার।

কোথায় পেয়েছে, আমাদেরও জানা দরকার, বললো রিকি। বেচতে পারবে। কিনা বুঝতে চাই।

মানে? ফ্যাকাশে হয়ে গেল টেরিয়ার।

আমাদের এখান থেকে কেনোনি… শুরু করলো কিশোর। শেষ করলো রিকি, তারমানে কোনোখান থেকে চুরি করে এনেছে।

না! সরু হয়ে এলো টেরিয়ারের চোখের পাতা। যাক বোঝা গেল, এটাই খুঁজছিলে। আমিও তাই ভেবেছি।

হ্যাঁ, এটাই খুঁজছি, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর। কিনতে চাই।

কিন্তু আমি তো বেচবো না, কুৎসিত হাসি হেসে গাড়ির দিকে এগোলো টেরিয়ার।

ওকে থামানোর আগেই গাড়িতে ঢুকে গেল। স্টার্ট নিয়ে বেরিয়ে চলে গেল। ইয়ার্ড থেকে।

অফিস থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এলো মুসা। শুঁটকির গাড়ি না?

হ্যাঁ। ডেনবারের একটা ছবি দেখাতে এসেছিলো, বললো রিকি

জিজ্ঞেস করলাম বেচবে কিনা, রাজি হলো না, কিশোর জানালো।

খাইছে! মিস্টার ব্রাউনকে তো আসতে বলে দিলাম। আসছে।

আসুক। যা পেয়েছি সেগুলোই নিয়ে যাবে।

 ব্রাউনের আসার অপেক্ষায় রইলো ওরা। ইতিমধ্যে ফিরে এলো রবিন। বললো, অনেক চেষ্টা করলাম। মূর্তিটা বেচবেই না মহিলা।

মার্সিডিজ নিয়ে এলো ফ্রেড ব্রাউন। যা যা পাওয়া গেছে, ওগুলো দেখেই হাসি ছড়িয়ে পড়লো মুখে। বাহ, ভালো ডিটেকটিভ তো তোমরা। এতো তাড়াতাড়ি কাজ করে ফেলেছে।

কিন্তু মূর্তিটা আনতে পারিনি, রবিন বললো। মিসেস ওয়াগনার নামে এক মহিলার কাছে আছে, বেচতে রাজি নয়। ঠিকানা, একশো তিন নম্বর রোজাস স্ট্রীট।

টেরিয়ার ডয়েলের কথা বললো কিশোর। ছবি নিয়ে এসেছিলো, সে-কথাও জানালো।

ঠিক আছে, ঠিকানা তো পেলাম, বললো ব্রাউন। মিসেস ওযাগনারের সঙ্গে কথা বলে দেখবো। আর ছেলেটার নাম যেন কি বললে…ও, টেরিয়ার ডয়েল। রকি বীচেই থাকে। বড়লোকের ছেলে। এই তো?

হ্যাঁ, স্যার, মাথা ঝাঁকালো মুসা। সৈকতের কাছে বিরাট এক বাড়ি আছে।

তাহলে, আশা আছে ছবিগুলো জোগাড় করবে তোমরা। কাউন্টেস খুব খুশি হবেন। হাজার হোক, ভাইয়ের শেষ স্মৃতি… হ্যাঁ, এই জিনিসগুলোর দামাটা দিয়ে দিই। আর প্রত্যেকটা জিনিসের জন্যে পাঁচ ডলার করে পুরস্না না বলি, গোয়েন্দাগিরির ফিস, হলো গিয়ে পঁচিশ ডলার। খুশি তো?

হ্যাঁ, খুব খুশি, দাঁত বের করে হাসলো মুসা।

বেশ, ব্রাউনও হাসলো। তাহলে ধরে নিচ্ছি ছবিটাও শীঘ্রি পাবো।

 জিনিসগুলোর জন্যে রশিদ লিখে দিলো কিশোর। সবাই মিলে ওগুলো তুলে দিলো গাড়িতে। ছেলেদের দিকে চেয়ে সামান্য মাথা নুইয়ে, হাতের বেতটা দোলাতে দোলাতে গিয়ে গাড়িতে উঠলো ব্রাউন। চলে গেল।

রিকি বললো, আমিও যাই। বাবাকে শান্ত করি গিয়ে।

.

লাঞ্চের পর হেডকোয়ার্টারে মিলিত হলো তিন গোয়েন্দা। চিন্তিত দেখাচ্ছে। কিশোরকে। বললো, শোনো, শুঁটকি ছবিটা বেচার জন্যে আনেনি। আমাদের দেখিয়ে শিওর হয়ে গেল।

কেন? রবিনের প্রশ্ন।

জানি না। হয়তো, সে জানে অন্য ছবিগুলো কোথায় আছে। একটা ছবি দেখিয়ে শিওর হয়ে গেল। বাকিগুলোও আনবে আমাদের কাছে, একসঙ্গে বিক্রি করতে, চড়া দাম হাঁকবে। কিংবা অন্য কারো কাছে বেচবে। হতে পারে, সেই নীল সেডান গাড়িওয়ালার কাছে।

গাড়িটা কার, জানতে পারলে হতো, বিড়বিড় করলো মুসা।

সেকথা এখন ভাবছি না, বললো কিশোর। আগে কুড়িটা ছবি খুঁজে বের করা দরকার। আর সেটা করতে হলে শুঁটকির মাধ্যমেই করতে হবে।

বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে দেখবো নাকি? পরামর্শ দিলো রবিন।

ঠিক বলেছো। তাহলেই বেচে দেরে, মুসারও তা-ই ধারণা।

টেলিফোন লাইনের সঙ্গে লাগানো স্পীকারের সুইচ অন করলো কিশোর। রিসিভার তুলে ডায়াল করলো। শুঁটকিই ধরলো ওপাশ থেকে তুলেই কড়া গলায় বললো, দেখো, শার্লকের বাচ্চা, আমাকে জ্বালিও না। আমি ব্যস্ত।

শুঁটকি, শোনো, শান্ত রইলো কিশোর। ডারল টাকা দেবো তোমাকে। ছবিটা দিয়ে দাও।

ছবি? কিসের ছবি? আকাশ থেকে পড়লো যেন টেরিয়ার, পিত্তি জ্বালানো, হাসি হাসলো।

জানো না কোনটা? রাগে চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। একটু আগে যেটা দেখিয়ে গেছে, পচা শুঁটকি কোথাকার!!

তাই? দেখিয়ে গেছি নাকি? হি হি করে হাসলো টেরিয়ার। কই, আমার তো মনে পড়ে না। ওহহো, বুঝেছি, স্বপ্নে দেখেছো। রাখি, আঁ? গুড বাই।

কেটে গেল লাইন।

একে অন্যের দিকে তাকালো তিন গোয়েন্দা।

শয়তানটার ওপর নজর রাখতে হবে, মুসা বললো। ছায়ার মতো লেগে থাকতে হবে পেছনে।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো কিশোর। ওর গাড়ি আছে, সেকেণ্ড। আর আমাদের আছে শুধু সাইকেল। তবে, চাচার পিকআপটা নিতে পারি, বোরিসকেও ড্রাইভার বানাতে পারি। কিন্তু কোথায় যেতে বলবো? শুঁটকি কোত্থেকে ছবিগুলো এনেছে, তাই তো জানি না।

আমাদের হোমারগুলো কাজে লাগাতে পারি, মনে করিয়ে দিলো রবিন। ওর গাড়িতে লাগিয়ে দেবো। তারপর পিছু নেয়া সোজা।

তা বটে, একমত হলো কিশোর। চেষ্টা করা যেতে পারে। চলো, ওর বাড়িতে যাই। আরেকবার কথা বলে দেখি, রাজি করানো যায় কিনা। না পারলে…

কিশোর! এই কিশোর! মেরিচাচীর ডাক শোনা গেল।

খাইছে! আঁতকে উঠলো মুসা। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে সর্বদর্শনে চোখ রাখলো। স্পষ্ট দেখতে পেলো মেরিচাচীকে। সাথে একটা লোক রয়েছে।

কে লোকটা? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

জিন্দেগীতে দেখিনি। বেঁটে, মোটা, কালো সুট, মাথায় হ্যাট…আর কিশোর, হাতে একটা ব্যাগের মতো। চ্যাপ্টা, বড়।

এক লাফে উঠে এসে প্রায় ধাক্কা দিয়ে মুসাকে সরিয়ে পেরিস্কোপে চোখ রাখলো কিশোর। হুমম! এরকম কেসেই ছবি রাখে লোকে! জলদি চলো।

০৬.

এই যে, এসেছিস, কিশোরকে দেখে বললেন মেরিচাচী, ইনি মিস্টার জন ফেরেনটি। আর্ট ডিলার। হল্যাণ্ড থেকে এসেছেন। তোর সঙ্গে কথা বলতে চান। গত হপ্তায় কতগুলো ছবি কিনে আনলি না, ওগুলো সম্পর্কে। লোকটার দিকে ফিরলেন। আপনারা কথা বলুন। আমি যাই।

অফিসের দিকে রওনা হয়ে গেলেন মেরিচাচী।

আর্ট ডিলারের কালো চোখের দিকে তাকাতেই ভয় লাগে। অ্যামস্টারডাম থেকে এসেছি আমি, ভোঁতা কণ্ঠস্বর, রিগ ডেনবারের সঙ্গে দেখা করতে। এসে শুনলাম মরে গেছে। তারপর শুনলাম, তার ছবিগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে তিন গোয়েন্দা। এখানে তোমরা খুবই পরিচিত, ঠিকানা বের করতে মোটেই অসুবিধে হলো না। ছবিগুলো কিনতে এসেছি। পেয়েছো?

মাথা নাড়লো মুসা। না।

একটাও না? গম্ভীর হয়ে বার দুই পায়চারি করলো ফেরেনটি, তারপর জ্বলন্ত চোখে তাকালো ছেলেদের দিকে। ভালো দাম দেবো।

শুঁটকি টেরি একটা ছবি নিয়ে এসেছিলো, বলে ফেললো রবিন। কিন্তু…

ওলন্দাজ লোকটার কাঁধের ওপর দিয়ে ইয়ার্ডের গেটের দিকে তাকিয়েছিলো কিশোর, ঝট করে মাথা ফেরালো, কিন্তু ওটা আসল না। মানে রিগ ডেনবারের ছবি না।

রিগ ডেনবারের নয়?

না।

গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে চেয়ে চোখ মিটমিট করছে রবিন আর মুসা ৷ মিথ্যা কথা বলছে কেন? নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। চুপ করে রইলো ওরা।

তিনজনের দিকেই একে একে তাকালো জন ফেরেনটি। মিছে কথা বলছো তো?

নাহ, মাথা নাড়লো কিশোর।

শুঁটকি টেরি না কি একটা নাম যেন বললে? ঢেঙা, পাতলা ছেলেটা?

আপনি চিনলেন কিভাবে? অবাক হলো মুসা।

প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে ফেরেনটি বললো, পরিবারটা ধনী, না? আর্ট কালেকশন আছে? ছবি কেনে?

কিছু তো বোধহয় আছেই, রবিন শিওর না।

আসলে, শুঁটকি টেরিকে আমরা ভালোমতো চিনিই না, স্যার। এখানকার ছেলেরা শুঁটকি শুঁটকি করে তো, তাই আমরাও বলছি। কোথায় থাকে, তা-ও জানি না। নির্জলা মিথ্যেগুলো এমনভাবে বলে গেল কিশোর, মুসা আর রবিনেরই বিশ্বাস করে ফেলতে ইচ্ছে হলো।

তারমানে আমাকে সাহায্য করবে না? কড়া চোখে তাকালো ফেরেনটি।

করতে পারলে তো খুশিই হতাম, স্যার।

হু। বেশ, যদি ছবিগুলো তোমাদের হাতে আসে, আমাকে মোটেলে ফোন করো। প্যারাডাইজ মোটেল। ঠিক আছে? মনে রেখো, ভালো দাম দেবো।

মাথা ঝোঁকালো কিশোর।

ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো ফেরেনটি। অল্প অল্প খোঁড়াচ্ছে। চেয়ে রয়েছে রবিন আর মুসা।

কিশোর! লোকটা দূরে সরে গেলে বললো রবিন। দেখেছো…

হ্যাঁ, আগেই খেয়াল করেছি। পাথরের ওপর পড়ে লেগে থাকতে পারে।

ওকেই তাড়া করেছিলাম সেদিন?

এজন্যেই মিছে কথা বলেছো? মুসা বললো।

হ্যাঁ, সেটা একটা কারণ।

আরেকটা? জানতে চাইলো রবিন।

ওর গাড়ি। এখনও খেয়াল করোনি?

জাঙ্কইয়ার্ডের বাইরে গেটের ধারে পার্ক করা ছোট নীল সেডানটাতে উঠছে ফেরেনটি। স্টার্ট নিয়ে চলে গেল।

কাউন্টেসের গাড়ির পিছু নিয়েছিলো ওটাই! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

আর আমি কিনা শুঁটকির কথা সব বলে দিলাম! ছবির কথাও! কপালে হাত রাখলো রবিন।

না, তেমন কিছু বলোনি, সান্ত্বনা দিলো কিশোর। আমার ধারণা, শুঁটকির ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েই এসেছে ফেরেনটি। কাজেই তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমাদের। ওর আগেই গিয়ে শুঁটকিকে ধরতে হবে।

দেরি করছি কেন তাহলে? চলো চলো, তাড়া দিলো মুসা।

কিন্তু আমি তো এখন যেতে পারছি না, রবিন বললো। বাড়িতে কাজ আছে। মা যেতে বলে দিয়েছে।

খানিকক্ষণ চিন্তা করে কিশোর বললো, যাও। হোমিং ট্রান্সমিটার নিয়ে আমরা যাচ্ছি। তোমার কাজ শেষ হলে রিসিভারটা নিয়ে চলে যেও ওখানে। দেরি হবে?

না না, তা হবে না।

বেশ, এসো তাহলে।

.

সৈকতের ধারে অনেকগুলো বাড়ি। সরু একটা পথের ধারে রেডউডে তৈরি বিশাল বাড়িটা ডয়েলদের। রাস্তা থেকে সরু একটা গলি বেরিয়ে ওদেরটা, আর আরেকটা বাড়ির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। পথের ধারে, বাড়িগুলোর আশপাশে, সব জায়গায়ই পামের সারি আর হিবিসকাসের ঘন ঝড়।

বড় একটা ঝাড়ের ধারে সাইকেল থেকে নামলো মুসা আর কিশোর। ওখান থেকে ডয়েলদের বাড়িতে ঢোকার দুটো গেট দেখা যায়–সামনের বড়টা, আর এক পাশের ছোট একটা। গ্যারেজের দরজাও দেখা যায়। টেরিয়ারের স্পোর্টস কারটা ভেতরেই রয়েছে।

আগে ওর সঙ্গে কথা বলি। সাইকেল ঠেলে নিয়ে এগোলো কিশোর। পাশে চললো মুসা।

ডাক শুনে দোতলার একটা জানালা খুলে মুখ বের করলো টেরিয়ার। আরে, শার্লকের বাচ্চারা যে! তা কি মনে করে? পুরনো শত্রু

ছবিটা কিনতে এসেছি, শুঁটকি, বললো মুসা।

হেসে উঠলো টেরিয়ার। কান পাতলো। ভালো শুনি না। কি করতে এসেছো? নাচতে?–

ছবিটা এখনও তোমার কাছেই আছে, শুঁটকি, কিশোর বললো। আমি জানি।

হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি তো সবই জানো। জলদি বেরোও। নইলে পুলিশকে ফোন করবো। বলবো, চুরি করতে ঢুকেছে।

গালিটা এসে গিয়েছিলো মুসার মুখে, অনেক কষ্টে সামলে নিলো।

ফিরে চললো দুজনে। সেই ঘন ঝাড়টার কাছে এসে সাইকেল রেখে লুকিয়ে রইলো।

সৈকতের ওদিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে গ্যারেজে ঢুকবো, বললো কিশোর। ওর .. গাড়িতে লাগিয়ে দেবো তোমারটা। তুমি চোখ রাখ। শুঁটকিকে বেরোতে দেখলেই শিস দিয়ে হুঁশিয়ার করবে আমাকে।

ঠিক আছে।

ঝোপ থেকে বেরোনোর জন্যে ঘুরেই স্থির হয়ে গেল কিশোর। আরি! ওই লোকটা কে?

মুসাও দেখলো। ডয়েলদের বাড়ির একধারে সরু একটা পথের মোড়ে লোকটা। পরনে ইউনিফর্ম। মাথার ক্যাপটা কপালের ওপর টেনে দেয়া। চোখ আড়াল করতে চাইছে বুঝি। হাতে ভারি একটা ব্যাগটুল কিট-ওটার ভারে। কাত হয়ে হাঁটছে।

টেলিফোন মিস্ত্রী, চেপে রাখা নিঃশ্বাস আস্তে করে ছাড়লো মুসা।

ডয়েলদের বাড়িতে ঢুকে গেল লোকটা।

ভ্রূকুটি করে কিশোর বললো, লাগলো তো সেরকমই। কিন্তু…

কিন্তু কি?

না, কিছু না। নির্জন, শূন্য পথের দিকে তাকালো কিশোর। কোথায় যেন একটা ঘাপলা হচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারছি না।

তুমি যাও। আমি কড়া নজর রাখবো।

মাথা নেড়ে বেরিয়ে এলো কিশোর।

.

ডয়েল আর তাদের প্লাশের বাড়ির মাঝখান থেকে গভীর নালা নেমে এসেছে। সৈকতে। গরমকালে এখন শুকনো। লুকিয়ে থাকার উপযুক্ত জায়গা। আর এটার ভেতর দিয়ে গ্যারেজে উঠে যাওয়াও সহজ, কারও চোখে পড়বে না।

উঠতে শুরু করলো কিশোর। টেরিয়ারকে কোথাও দেখা গেল না। হোমার ট্রান্সমিটারটা শেষবারের মতো চেক করলো সে। শক্তিশালী একটা চুম্বক লাগানো রয়েছে, গাড়ির বডিতে লাগিয়ে দিলে শত ঝাঁকুনিতেও খুলে পড়বে না।

আবার এগোতে শুরু করলো সে। কয়েক পা এগিয়েই দাঁড়িয়ে গেল। টেলিফোনের মিস্ত্রী বাড়ির চারপাশে এক চক্কর ঘুরে এখন এগিয়ে আসছে গ্যারেজের দিকে। তারটা খুঁজে বের করলো, যেখান দিয়ে মূল বাড়িতে ঢুকেছে। যন্ত্রপাতি বের করে ঝুঁকলো ওটার ওপর।

হঠাৎ বুঝে ফেললো কিশোর, গোলমালটা কোথায়। মিস্ত্রী এসেছে, কিন্তু ভ্যান গাড়ি নেই। কে কবে শুনেছে, ভ্যান ছাড়া টেলিফোন মিস্ত্রী কাজ করতে আসে? ব্যাটা ছদ্মবেশী! তারমানে হলো, হয় তার কাটছে, কিংবা তারের সঙ্গে চোরা লাইন লাগাচ্ছে, যাতে সূব কথাবার্তা চুরি করে শুনতে পারে। এখান থেকে ভালো দেখা যাচ্ছে না। হেঁটে গেলে লোকটার চোখে পড়ে যেতে পারে, তাই হামাগুড়ি দিয়ে। দ্রুত এগোলো কিশোর। কি করছে লোকটা, জানতে হবে।

চলে এলো একেবারে নালার মাথার কাছে। পরিশ্রমে হাঁপাচ্ছে। কয়েক : সেকেণ্ড চুপ করে পড়ে থেকে দম নিয়ে আস্তে মাথা তুললো।

চমকে উঠলো ভীষণ ভাবে! মিস্ত্রীর চোখে চোখ পড়ে গেছে। মাত্র ফুটখানেক তফাতে রয়েছে লোকটার মুখ। বুকের ভেতর কাঁপুনি তুলে দেয়া ভীষণ একজোড়া চোখ। কালো। জন ফেরেনটি!

হাতে মস্ত এক ছুরি!

.

ঝাড়ের ভেতরে ঘাপটি মেরে রয়েছে মুসা। টেরিয়ার কিংবা কিশোর, কারোরই দেখা নেই। রবিনও আসছে না এখনও।

মুসাআ!

সৈকতের দিক থেকে শোনা গেল চিৎকারটা।

 মুসাআ! বাঁচাও!

হুড়মুড় করে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলো মুসা। ঘুরেই দৌড় দিলো শব্দ লক্ষ্য করে। সরু পথ ধরে ছুটে গিয়ে বাড়ির পেছনে মোড় নিতে যাবে, এলো প্রচণ্ড বাধা। খপ করে তার হাত চেপে ধরলো একটা শক্তিশালী থাবা, মুচড়ে নিয়ে গেল। পেছনে পিঠের ওপর, আরেকটা হাত চেপে ধরলো তার মুখ। যাতে চিৎকার করতে না পারে। আটকা পড়লো সে-ও।

.

০৭.

ঝাড়ের কাছে সাইকেল দুটো দেখতে পেলো রবিন। কিন্তু মুসা আর কিশোর কোথায়? মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো, নির্জন পথ। কেউ নেই, কোনো নড়াচড়া। নেই।

হঠাৎ একটা গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দ হলো ডয়েলদের বাড়ির ধারে। দুটো বাড়ির মাঝের সুরু গলি থেকে শাঁ করে বেরিয়ে এলো নীল সেডানটা। তীক্ষ্ণ মোড় নিয়ে রাস্তায় ওঠার সময় কর্কশ আর্তনাদ তুললো টায়ার।

আর্ট ডিলারের গাড়ি! জন ফেরেনটি এখানে কি করছিলো?

 বিপ বিপ বিপ বিপ! বেজে উঠলো রবিনের পকেটে রাখা রিসিভার। একটানে বের করে দেখলো কাটাটা পথের দিকে নির্দেশ করছে, ধীরে ধীরে কমে আসছে। জোরালো বিপ বিপ। কি ঘটেছে, বুঝে ফেললো সে।

হোমারটা টেরিয়ারের গাড়িতে লাগাতে পারেনি কিশোর কিংবা মুসা। ধরা। পড়েছে। তাদেরকে বন্দী করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে ফেরেনটি।

চোখের আড়ালে চলে গেছে নীল গাড়িটা। বোঝার পর আর বিন্দুমাত্র সময়। নষ্ট করলো না রবিন, সাইকেল নিয়ে ছুটলো ওটার পেছনে। চলতে চলতে উঠে এলো উপকূলের প্রধান সড়কে।

বাঁয়ে মোড় নিলো বিপ বিপ। রকি বীচের উত্তর সীমানার দিকে চলেছে নীল সেডান। ইতিমধ্যে দুই বার সংযোগ হারিয়েছে রবিন, তারপর আবার খুঁজে পেয়েছে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও সাইকেল নিয়ে পেরে উঠছে না গাড়িটার সাথে, পারার কথাও নয়। বোধহয় ট্রাফিক পোস্টের লাল আলো জ্বলায় থামতে বাধ্য হয়েছিলো ফেরেনটি, সেই সুযোগেই দুবার কাছে চলে গিয়েছিলো রবিন।

মুহূর্তের জন্যে থামছে না সে, গতি কমাচ্ছে না।

তার পরেও তৃতীয়বার সংযোগ হারালো। নীরব হয়ে গেল রিসিভার।

উত্তেজনা আর পরিশ্রমে দরদর করে ঘামছে রবিন। বুকের খাঁচায় যেন পাগল হয়ে উঠেছে হৃৎপিণ্ডটা। কিন্তু থামলো না সে। দ্রুত প্যাডাল করে এগিয়ে চললো কোস্ট হাইওয়ে ধরে। সামনে পাতলা হয়ে আসছে শহর, খোলা অঞ্চল দেখা যাচ্ছে।

.

টেলিফোনের তার দিয়ে হাত-পা বেঁধে, মুখে রুমাল গুঁজে মুসা আর রবিনকে গাড়ির বুটে ঢুকিয়ে দিয়েছে ফেরেনটি। হাত বেঁধে ফেলার আগেই সেই সুযোগে হোমারের সুইচটা অন করে দিতে পেরেছে কিশোর। মনে মনে এখন লাথি মারতে ইচ্ছে করছে নিজেকে, আগে আরও ভালোমতো খেয়াল করেনি বলে। ট্রেরিয়ারদের বাড়িতে ঢোকার সময়ও খুঁড়িয়ে হাঁটছিলো ফেরেনটি। তবে দূর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছিলো না। ভালো করে লক্ষ্য করলে অবশ্যই বুঝতে পারতো কিশোর। আর তাহলে এখন এই বিপদে পড়তে হতো না।

পথে বার দুই থেমেছে গাড়ি।

তৃতীয়বার থামলো। এঞ্জিন বন্ধ হলো। কিশোর আন্দাজ করলো, মিনিট দশেক পেরিয়েছে।

উঠে গেল বুটের ডালা। টেনে ছেলেদেরকে বুট থেকে বের করলো ফেরেনটি। তারপর একজন একজন করে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ঢোকালো ছোট মোটেলের শেষ মাথার একটা ঘরে। ইতিমধ্যে ছেলেদের সঙ্গে একটা কথাও বলেনি আর্ট ডিলার।

 পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসিয়ে ছেলেদের মুখের রুমাল খুলে দিলো। ফেরেনটি। বড় ছুরিটা বের করে হাতে নিয়ে ছেলেদের মুখোমুখি বসলো। চোখের দৃষ্টি ভীষণ। তারপর? পুঁটকি টেরিকে চেনো না, না? ও আসল ছবি আনেনি? মিথ্যুক কোথাকার। তোমরা ওই ছবি চুরি করতে গিয়েছিলে।

চুরি বলছেন কেন? গরম হয়ে বললো মুসা। ওই ছবির আসল মালিক কাউন্টেস। তার জন্যেই কিনে আনতে গিয়েছিলাম।

তাই? কাউন্টেস আর ব্রাউনের হয়ে কাজ করছো তাহলে? কি কি বলেছে ওরা?

বলেছে কাউন্টেসের পারিবারিক জিনসগুলো উদ্ধার করতে চায়, জবাব দিলো কিশোর। সবই পেয়েছি আমরা, ছবিগুলো ছাড়া।

আবার মিথ্যে কথা। আরও কিছু জানো তোমরা। ব্রাউনের প্ল্যান কি? ওরা। আসলে কি খুঁজছে? ওদের কাছে কি মেসেজ পাঠিয়েছিলো রিগ ডেনবার?

আমরা শুধু জানি, মেজাজ দেখিয়ে বললো মুসা। আপনি সারাক্ষণ কাউন্টেসকে ফলো করেছেন। হপ্তাখানেক আগে গিয়েছিলেন প্রফেসর এলউড হোফারের বাড়িতে…।

তাড়াতাড়ি মুসাকে থামিয়ে দিয়ে কিশোর বললো, কাউন্টেসকে মেসেজ পাঠিয়েছে ডেনবার, একথা কেন মনে হলো আপনার? আর…

দেখো, আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করো না, ধমক দিয়ে বললো ফেরেনটি। মুসার দিকে তাকালো। এই, তুমি কি বলছিলে? প্রফেসর হোফারের বাড়িতে গিয়েছিলাম?

 ঢোক গিললো মুসা। বুঝতে পেরেছ, কিশোর চায় না, কথাটা ভাঙুক। হপ্তাখানেক আগে রেমুডা ক্যানিয়নে প্রফেসরের বাড়িতে চোর ঢুকেছিলো, একথা ফেরেনটিকে জানাতে চায় না।

 মুসাকে চুপ করে থাকতে দেখে ভয়াল ভঙ্গিতে ছুরিটা নাচালো ওলন্দাজ।

ইয়ে মানে, ছুরিটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো মুসা, কাউন্টেস আর ফ্রেড ব্রাউন যেদিন প্রফেসরের বাড়িতে প্রথম, গেছে, আপনিও সেদিন গিয়েছিলেন।

জ্বলন্ত চোখে ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ ফেরেনটি। না। সেকথা বলতে চাওনি। কাউন্টেস এখানে আসার আগেই কেউ একজন গিয়েছিলো প্রফেসরের বাড়িতে। তোমাদের ধারণা, সেই লোকটি আমি। কেন?

চুপ করে রইলো দুজনেই।

তারমানে, আবার বললো ফেরেনটি। বলবে না, ডেনবার কি মেসেজ পাঠিয়েছিলো? প্রফেসর হোফার আর তার ছেলের সঙ্গে অনেক কথা বলেছো তোমরা। ওরা কিছু জানায়নি? ওদেরকেও কোনো ইঙ্গিত দিয়ে যায়নি বুড়ো, ডেনবার?

 কিসের ইঙ্গিত, স্যার? মোলায়েম কণ্ঠে প্রশ্ন করলো কিশোর।

আবার দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ফেরেনটি। বাহ! আমি ভেবেছিলাম, তোমরা বোকা। কি করছো, জানো না। উঠে দাঁড়ালো সে। দেখে যা মনে হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি চালাক তোমরা। অনেক কিছু জানো, তাই না?

ভুরু কুঁচকে তাকালো ফেরেনটি। শক্ত করে চেপে ধরলো ছুরির হাতল।

.

অনিশ্চয়তায় ভুগছে রবিন। এগিয়ে চলেছে কোস্ট রোড ধরে। ভাবছে, গাড়িটা কি খুঁজে পাবে? আরও এগিয়ে যাবে, নাকি কোথাও থেমে পুলিশের চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে ফোন করবে?

অনেক ভেবে শেষে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলো সে।

চলে এলো শহরের উত্তর প্রান্তে। মোটেলগুলো শুরু হয়েছে এখান থেকে। গভীর আগ্রহে কান পেতে রেখেছে, যাতে রিসিভারের সামান্যতম বিপ শব্দও মিস না করে। নীল সেডানটাকে খুঁজছে দুই চোখ।

.

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘরের ভেতরে পায়চারি করছে ফেরেনটি। ছুরিটা হাতেই রয়েছে। মিনিট দশেক কাটলো। ভাবেসাবে মনে হয়, মনস্থির করতে পারছে না সে।

হঠাৎ ফিরলো। তোমাদেরকে কি করি, তোমরাই বলো? আমার কাজে বাধা দিয়েছে, ছেড়ে দিলে আরও দেবে।

মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলো কিশোর, রিগ ডেনবারের কাছে কি মূল্যবান কিছু…

এই সময় বাজলো টেলিফোন। ঝটকা দিয়ে ঘুরলো আর্ট ডিলার। এমনভাবে। তাকালো যন্ত্রটার দিকে যেন ওটা একটা বিষাক্ত সাপ। ছেলেদের দিকে একবার ফিরে চেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ফোনের কাছে। রিসিভার তুলে কানে ঠেকালো।

হ্যাঁ হ্যাঁ, উজ্জ্বল হলো ফেরেনটির চোখ। কি? একটা ছেলে?… টেরিয়ার?…হ্যাঁ, চিনি ওকে।…না না, এখানে পাঠানোর দরকার নেই। আমিই অফিসে আসছি। রিসিভার রেখে ফিরে চাইলো। টেরিয়ার ডয়েল–যাকে তোমরা চেনোই না–দেখা করতে এসেছে আমার সঙ্গে! কি বুঝলে?

 গোঁ গোঁ করে উঠলো মুসা। তখনই বলেছি, শুঁটকি ব্যাটা কোনো তালে। আছে!

ওকে বিশ্বাস করলে জ্বল করবেন, মিস্টার ফেরেনটি, বললো কিশোর।

তোমাদেরকেও তো বিশ্বাস করতে পারছি না, কাটা জবাব দিলো আর্ট ডিলার। আবার ছেলেদের মুখে রুমাল গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল।

বাঁধন খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করলো দুই গোয়েন্দা। অবধা। খোলী তো দুরের কথা, ঢিলই করতে পারলো না, বরং আরও কেটে বসলো তার। হতাশ হয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো।

হঠাৎ আবার খুলে গেল দরজা।

 হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে রবিন!

 দ্রুত এসে দুজনের বাঁধন খুলে দিলো সে। মুখের রুমাল নিজেরাই খুললো ওরা।

রবিন! বলে উঠলো মুসা। বাঁচালে ভাই। এলে কিভাবে…

হোমারটাকে ফলো করলাম কিছুক্ষণ। তারপর সিগন্যাল হারিয়ে গেল। না থেমে এগিয়ে এলাম কোস্ট রোড ধরে। কোনো সাড়া নেই রিসিভারে। প্রায় ফিরেই যাচ্ছিলাম, এই সময় মনে পড়লো, ফেরেনটি বলেছিলো সে প্যারাডাইজ মোটেলে উঠেছে। চলে এলাম।

খুব ভালো করেছে, প্রশংসা করলো কিশোর। চলো, ভাগি।

কিন্তু শুঁটকি? মনে করিয়ে দিলো মুসা। ওই ব্যাটা এখন মোটেলের অফিসে…

হেসে উঠলো রবিন। শুঁটকি আসবে কোত্থেকে? আমিই মোটেলের রিসিপশনিস্ট সেজে ফোন করেছিলাম। গলাটা ধরতে পারেনি ফেরেনটি। অভিনয় করা সোজা, তাই না কিশোর?

যারা জানে তাদের কাছে সোজাই, বললো কিশোর। বেরোও এখন। সামনের দরজা। কুইক!

বেরিয়ে এলো ওরা। কাউকে দেখা গেল না। তিনজনেই দৌড় দিলো রবিনের সাইকেলের দিকে।

মুসা, তুমি চালাও, বললো কিশোর। আমি পেছনে বসছি। রবিন সামনে বসুক। তোমার একটু কষ্ট হবে আরকি..জলদি!

বড় জোর বিশ গজ এসেছে ওরা, এই সময় পেছনে শোনা গেল উত্তেজিত চিৎকার। যে ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা, ওটার সামনের দরজায় দাঁড়িয়ে। জোরে জোরে হাত নাড়ছে ফেরেনটি। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে লাফিয়ে নামলো দরজার নিচে, দৌড় দিলো। বুঝলো, এভাবে খুঁড়িয়ে দৌড়ে পারবে না সাইকেলের সঙ্গে। ঘুরে আবার ছুটলো মোটেলের দিকে।

গাড়ি আনতে যাচ্ছে! বললো কিশোর। লুকাতে হবে। আশেপাশে তাকালো সে। কোনো জায়গা দেখলো না।

প্যাডালে পায়ের চাপ আরও বাড়ালো মুসা। ভারি বোক্স নিয়েও শাঁই শাঁই করে ছুটেছে।

 আরে এতো তাড়াহুড়োর দরকার নেই বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি রবিন। আসতে পারবে না। ওর গাড়ির ইগনিশনের তার একটাও নেই। সব ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি।

তুমি আজ যা দেখালে না, নথি, এতোক্ষণে হাসি ফুটলো কিশোরের মুখে। মুসা, গতি কমিও না, চালিয়ে যাও…

হু, চালিয়ে যাও, মুখ ভেঙুচালো মুসা। এক সাইকেলে তিনজন, বললেই হলো…

কি করবো, ভাই? তুমি তো তা-ও পারছো, আমি আর রবিন তো চালাতেই পারবো না।

কয়েক মিনিট পর হাইওয়েতে একটা খালি ট্রাক থামালো ওরা। ড্রাইভারকে অনুরোধ করতে সে ওদেরকে সাইকেল সহ তুলে নিলো পেছনে।

 শহরে ফিরে এলো তিন গোয়েন্দা। টেরিয়ারদের বাড়ির কাছে গিয়ে ঝোপের আড়াল থেকে যার যার সাইকেল বের করে নিলো মুসা আর কিশোর।

 স্যালভিজ ইয়ার্ডে ফিরে, খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার হেডকোয়ার্টারে ঢুকলো তিনজনে।

জটিল এক রহস্য দানা বাঁধছে, নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে বললো কিশোর। ফেরেনটির ধারণা, মূল্যবান কোনো জিনিস ছিলো ডেনবারের কাছে। কিভাবে। পেতে হবে, মেসেজ রেখে গেছে। কাউন্টেস আর ব্রাউনের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

ফোনে কয়েকবার চেষ্টা করলো কিশোর। কেউ ধরলো না।

সকালে আবার চেষ্টা করবো, বললো গোয়েন্দাপ্রধান। তবে তার আগে রিগ ডেনবারের সম্পর্কে ভালোমতো খোঁজখবর নেয়া দরকার। লোকটা কে ছিলো, কি। করতো..রবিন, কাল সকালে লাইব্রেরিতে বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখো। বলা যায় না, কিছু বেরিয়েও পড়তে পারে!

.

০৮.

তাকের দিকে চেয়েই অবাক হয়ে গেল রবিন। আর্টের ওপর লেখা মোটা মোটা বইগুলো বেশির ভাগই নেই। সরে এলো ওখান থেকে।

ভুরু কোঁচকালেন লাইব্রেরিয়ান মিস হকিনস। কি হয়েছে, রবিন?

আর্টের রেফারেন্স বইগুলো নেই। কে নিলো?

একজন লোক, ছোট পড়ার ঘরটায় নিয়ে গিয়ে পড়ছে। লাইব্রেরি খোলার সঙ্গে সঙ্গে ঢুকেছে। এখনও বেরোয়নি। কালও এসেছিলো। কেন, কোনো বই তোমার দরকার? গিয়ে বলবো দিতে?

না, থ্যাংক ইউ। আমিই যাচ্ছি।

ছোট ঘরটায় ঢুকলো রবিন। পেছন ফিরে বসে আছে লোকটা। টেবিলে একগাদা বই। আরেকটা বইয়ের জন্যে হাত বাড়াতেই মুখটা দেখতে পেলো সে। চমকে উঠলো। প্রফেসর এলউড হোফার।

দ্রুত বেরিয়ে এলো রবিন। ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলেছে মাথায়। আর্টের বই পড়ছেন ভাষাবিদ প্রফেসর! উত্তেজিত হয়ে উঠলো সে। চেয়ার টেনে নিয়ে এমন একটা জায়গায় বসলো, যেখান থেকে দরজা দিয়ে প্রফেসরকে দেখতে পায়। কি পড়ছেন তিনি? ইস্, যদি দেখা যেতো!–

অবশেষে উঠলেন প্রফেসর। বেরিয়ে গেলেন। রবিন ভাবলো, তাঁকে অনুসরণ করবে? না, তাতে বিশেষ লাভ হবে না। নিশ্চয় এখন বাড়ি ফিরবেন তিনি। তার চেয়ে যে কাজ করতে এসেছে সে, সেটাই করে যাবে। রেফারেন্স বইতে রিগ ডেনবারের সম্পর্কে কি লেখা আছে, দেখবে।

.

প্রফেসর হোফার!

হ্যাঁ, কিশোর, বললো রবিন। আর্টের যে কটা বই আছে ওখানে, সব ঘেঁটেছেন।

খাইছে! মুসা বললো। হঠাৎ করে আর্টের বইয়ের ওপর এই আগ্রহ, * কেন?

হেডকোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে তিন গোয়েন্দা।

আচ্ছা, প্রফেসরের কথা আপাতত থাক, বললো গোয়েন্দাপ্রধান। তো, রেফারেন্স বইতে রিগ ডেনবারের কথা কিছুই লেখা নেই?

না, একটা শব্দও না।

অন্য কোনো বইতে থাকতে পারে। তবে বোঝা যাচ্ছে, তেমন বিখ্যাত কেউ নয়। তাহলে বড় বড় বই সবগুলোতেই থাকতো।

বড়ই যদি না হবে, ওর, ছবির জন্যে পাগল হয়ে গেছে কেন জন ফেরেনটি? মুসার প্রশ্ন।

এমনও হতে পারে, রবিন বললো। আসলে ছবি খুঁজছে না লোকটা। ছবির ছুতোয় অন্য কিছু খুঁজছে। জিনিসটা কী, হয়তো কাউন্টেস আর তার ম্যানেজারও জানে।

মাথা ঝোঁকালো কিশোর। যুক্তি আছে তোমার কথায়। হয়তো সেই জিনিসটাই সেদিন নিতে এসেছিলো কালো পোশাক পরা লোকটা। আগেই, যাতে আর কেউ পেয়ে না যায়। কিন্তু পায়নি। ডেনবারের জিনিসগুলো আমাদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন প্রফেসর, আমরা বেচে দিয়েছি অন্যের কাছে। সেটার খোঁজ এখনও চালিয়ে যাচ্ছে লোকটা।

জন ফেরেনটির মতো, বলে উঠলো মুসা।

আমার এখন অবাক লাগছে, রবিন বললো। হঠাৎ করে আর্টের ওপর। আগ্রহী হয়ে উঠলেন কেন ল্যাংগোয়েজের প্রফেসর?

নাক চুলকালো কিশোর। বোধহয় মেসেজ। মেসেজের কথা বলেছে। ফেরেনটি। হয়তো মৃত্যুর আগে কোনো মেসেজ রেখে গেছে ডেনবার। রিকি, বলেছে প্রলাপ বকেছে। সেই প্রলাপের মধ্যেই কোনো মূল্যবান তথ্য দিয়ে গেছে হয়তো লোকটা।

এবং সেটা প্রফেসর জানেন, কিন্তু কাউন্টেস নয়?

আমার তাই মনে হচ্ছে, নথি। চলো, রেমুডা ক্যানিয়ন থেকে ঘুরে আসি।

 আমার বাবা! শুনে রিকিও অবাক। বাবা আর্টের বই ঘেঁটেছেন?

লনের মধ্যে ছায়ায় বসে কথা বলছে চার কিশোর।

ছবির কথা কি খুব বেশি বলাবলি করতো ডেনবার? জিজ্ঞেস করলো গোয়েন্দাপ্রধান।

নাহ্। আমাকে ছবি আঁকা শেখানোর চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করেছি, পারিনি। একবার একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলো। সে নাকি দুনিয়ার সব চেয়ে দামী পেইন্টার। কিন্তু কেউ জানে না সেকথা। বলেই হেসে উঠেছিলো।

এতে কিছু বোঝা যায় না, মন্তব্য করলো মুসা।

না, তা যায় না, কিশোরও একমত।

রিকি বললো, কি যে ঘটছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। এতোগুলো মাস একা এখানে থাকলে রিগ ডেনবার, কেউ দেখাও করতে আসেনি তার সঙ্গে। কিন্তু যেই মারা গেল, অমনি একের পর এক আসতে লাগলো, আগ্রহী হয়ে উঠলো। কতোজন।…ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, এখন ঘরে বাবার সঙ্গে কথা বলছেন কাউন্টেস আর ব্রাউন।

আবিষ্কার করে ফেলেছে নাকি কিছু?

 চলো না, দেখি, প্রস্তাব দিলো কিশোর।

ম্যানটলপিসে হেলান দিয়ে রয়েছেন প্রফেসর। কাউন্টেস আর তাঁর ম্যানেজারের মুখোমুখি।

 ছেলেদের দেখে হাসলেন কাউন্টেস। এই যে, গোয়েন্দার দল এসে পড়েছে। কাজ চালিয়ে যাচ্ছো তো?

যাচ্ছি, তবে ছবিগুলো এখনও পাইনি, ম্যাডাম, জবাব দিলো কিশোর। আচ্ছা, একটা কথা বলতে পারেন? আপনার ভাই কি কখনও কোনো ছবি কাউকে দেখিয়েছেন? কিংবা বিক্রি করেছেন?

 না, কে কিনবে তার ছবি? একেবারেই নবিস। তবু, ওর ছবিগুলো আমার চাই। ওই যে বলেছি, ভাইয়ের স্মৃতি। তোমরা তদন্ত চালিয়ে যাও, খুঁজে বের করো। ওগুলো।

করবো। যদি আমাদের আগেই কেউ হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।

 কেউ? অবাক মনে হলো ম্যানেজারকে।

জন ফরেনটি নামে এক লোক। আর্ট ডিলার বলে পরিচয় দিয়েছে। আপনাদেরকে অনুসরণ করে। ছবিগুলো চায়।

নীল গাড়ি নিয়ে কিভাবে পিছে লেগে থাকে ফেরেনটি, ছেলেদেরকে কি করে বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিলো, জানালো কিশোর। শুনে শিউরে উঠলেন কাউন্টেস। সর্বনাশ! অল্পের জন্যে বেঁচেছে। আরও সাবধানে থাকা উচিত তোমাদের। কিন্তু বুঝতে পারছি না, আমার ভাইয়ের ব্যাপারে তার এতো আগ্রহ কেন। আসলে কি মাকেও ভৰিম কিনুই পেলাম না। তাহলে কি চায়? ছবি, না অন্য কিছু?

কি জানি, হয়তো ছবিই। আজ প্রফেসর সাহেব লাইব্রেরিতে গিয়েছিলেন। আর্টের বই ঘাটতে।

সবাই তাকালো প্রফেসরের মুখের দিকে। রিকির চোখে অস্বস্তি। ক্ষণিকের জন্যে জ্বলে উঠলো ম্যানেজারের চোখের তারা। সত্যি সত্যি কিছু জানেন আপনি? মাথা ঝাঁকালো সে, নেচে উঠলো রূপালি চুল।

না। স্রেফ কৌতূহল। ডেনবারের ব্যাপারে লোকের এই হঠাৎ আগ্রহ আমাকেও ভাবিয়ে তুলেছে। তাই ভাবলাম, দেখিই না গিয়ে, লোকটা বিখ্যাত কেউ ছিলো কিনা। কিছুই পেলাম না। তাতে কৌতূহল আরও বেড়েছে আমার। সেদিন সেই কালো পোশাক পরা লোকটা তাহলে কি খুঁজতে এসেছিলো?

স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন কাউন্টেস। চোর এসেছিলো? মানে, আমরা এখানে আসার আগেই? নিশ্চয় আমার ভাইয়ের কোনো জিনিস চুরি করতে চেয়েছিলো?

আপনারা আসার এক হপ্তা আগে এসেছিলো, জানালো রবিন। কি যে খুঁজতে এসেছিলো সে-ই জানে।

আই সী, বলেই ম্যানেজারের দিকে তাকালেন কাউন্টেস।

ওই ফেরেনটিটা না তো? তাড়াতাড়ি বললো ম্যানেজার। মিস্টার ডেনবারের জিনিসের ওপর তারই তো বেশি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।

নিশ্চয়ই! বলে উঠলো মুসা।

স্যার, প্রফেসরের দিকে চেয়ে বললো কিশোর। রিকি, তোমাকেও বলছি। ফেরেনটির ধারণা, মৃত্যুর আগে মিস্টার ডেনবার কোনো মেসেজ রেখে গেছেন। আপনারা বলেছেন, জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকেছেন তিনি। উল্টোপাল্টা কথা বলেছেন। কিছু কি বোঝাতে চেয়েছিলেন?

 ভাবলেন প্রফেসর। তারপর মাথা দোলালেন, হতে পারে, কিশোর। অনর্গল কথা বলে চলেছিলো। এখন মনে হচ্ছে, প্রলাপ ছাড়াও বোধহয় আরও কিছু ছিলো তার কথায়। তবে তখন কিছু বুঝিনি, এখনও না। এই যেমন ধরো, বলেছে…আঁকাবাঁকা ভুল, ক্যানভাস। পেইনটিংস শব্দটা অনেকবার বলেছে। …আর বলেছে মাস্টারস। আমি বেশি যাইনি ওর কাছে, তবে রিকি প্রায় সারাক্ষণই ছিলো। তুমি আর কিছু শুনেছো, রিকি?

মাথা নাড়লো রিকি। ঠিক মনে করতে পারছি না। আসলে প্রলাপই বকেছে। বলেছেঃ ওদের বলল, ওদের বলো…আঁকা…আঁকা যখন বাঁকা…ভুল মনে হবে মাস্টার…আমার পেইনটিংস…আমার ক্যানভাস ক্যানভাস থেকে আঁকা বাঁকা…বিব্বলো…ভুল। বার বার এইসব কথা বলেছে। একই রকম শব্দ, হেরফের ছিলো না।

কিছুক্ষণ নীরবতা। সবাই ভাবছে, শব্দগুলোর মানে কি? মুখ দেখেই অনুমান করা যায়, কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। এমনকি কিশোরের দৃষ্টিও শূন্য।

মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না আমি, বললো ম্যানেজার।

বোঝার কথাও নয়, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কাউন্টেস। প্রলাপের কি আর কোনো অর্থ থাকে?,

স্যার, প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করলো কিশোর। মিস্টার ডেনবার কি তাঁর সমস্ত জিনিস কটেজেই রাখতেন?

আমার তো তা-ই বিশ্বাস।

মাথা ঝোঁকালো কিশোর। হু। আমরা তাহলে যাই। আমার এখনও মনে হয়, ছবিগুলো সব কোথায় আছে টেরিয়ার জানে।

বার বার ছেলেদেরকে হুঁশিয়ার করলেন কাউন্টেস। তারপর বললেন, কোনো সমস্যা হলেই সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে।

সায় জানিয়ে বেরিয়ে এলো তিন গোয়েন্দা। সাইকেলে চড়ে বসলো। আগে আগে চলেছে কিশোর। নালার মুখের কাছে এসেই এখান থেকে প্রফেসরের বাড়িটা দেখা যায় না–মোড় নিলো বায়ে, হঠাৎ। অবাক হলো দুই সহকারী।

কোথায় যাচ্ছি? জানতে চাইলো রবিন।

আমি এখন শিওর, প্রলাপের মাধ্যমে কোনো মেসেজ দিতে চেয়েছিলো। ডেনবার, বললো কিশোর। কী, এখনও বুঝতে পারছি না। লোকটা কটেজ থেকে লন, আর লন থেকে কটেজ, এছাড়া আর কোথাও যেতো না। অন্তত যেতে দেখা যায়নি। তাহলে মূল্যবান কিছু যদি থাকেই, ওই কটেজেই রেখে গেছে।

সাইকেল রেখে নালায় নেমে তার ভেতর দিয়ে এগোলো ওরা। চলে এলো কটেজের পেছনে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নীরব বাড়িটার আশপাশে কাউকে চোখে পড়লো না। পা টিপে টিপে এসে ভেতরে ঢুকলো ওরা। কোনখান। থেকে খোঁজা শুরু করবে, ভাবছে কিশোর, এই সময় বাইরে শোনা গেল পদশব্দ।

কুইক! ফিসফিসিয়ে বললো কিশোর। লুকাও।

বেডরুম থেকে দেখলো ওরা, কটেজে ঢুকেছে রিকি। কোনোদিকে খেয়াল, নেই, সোজা এগিয়ে গেল লিভিংরুমের এক কোণে। আঁলগা একটা বোর্ড সরিয়ে, আরও ঝুঁকে হাত ঢুকিয়ে দিলো মেঝের নিচে।

নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়ালো তিন গোয়েন্দা।

তাহলে তুমি জানো, কি লুকিয়েছিলো ডেনবার? শান্ত কণ্ঠে বললো কিশোর।

.

০৯.

হুফ! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রিকি। তোমরা। বুকে কাঁপুনি তুলে দিয়েছে।

তোমার হাতে কি? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

দেখালো রিকি। পুরনো আমলের বড় একটা চাবি। প্রশ্ন করলো, তোমরা এখানে কি করছো? ভাবছো, এই কটেজেই কিছু লুকিয়েছে ডেনবার?

তোমার কি মনে হয়? পাল্টা প্রশ্ন করলো কিশোর।

আমারও তা-ই মনে হয়। তোমরা চলে যাওয়ার পর হঠাৎ মনে পড়লো কথাটা, ছুটে চলে এলাম। বাবা এখনও ওই দুজনের সঙ্গে কথা বলছে।

কি মনে পড়লো? জানতে চাইলো রবিন।  

মাঝে মাঝে অ্যাডোবে যেতে ডেনবার। ক্যানিয়নের ওধারে। ছবিগুলো, ওখানেই রাখতো। ঘরটা খালি থাকে, তালা দিয়ে রাখে বাবা, যাতে কেউ ঢুকে নষ্ট করতে না পারে। ঐতিহাসিক মূল্য আছে ওটার। তবে, বুড়ো ডেনবার ঢুকতো,

আমিই তাকে চাবি এনে দিয়েছিলাম।

এটাই কি সেই চাবি? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

হ্যাঁ। বাবা মেহমানদের সঙ্গে কথা বলছে। তোমরাও, চলে গেলে। ভাবলাম, এইই সুযোগ। অ্যাডোবে গিয়ে খুঁজে দেখি।

ভালোই হলো। চলো, আমরাও যাই।

বাইরে বিকেলের রোদ। তিন গোয়েন্দাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো রিকি। পথ থেকে দূরে নালার ধার দিয়ে হাঁটছে ওরা। হোফার হাউসকে দূর দিয়ে ঘিরে এগিয়ে গেছে নালাটা, তারপর হঠাৎ করেই তীক্ষ্ণ মোড় নিয়ে ঢুকে পড়েছে একটা গিরিসঙ্কটে।

কিছুক্ষণ পর বাঁয়ে ঘুরলো রিকি। ঘন ঝোপের ধার দিয়ে চললো। পেছনে তিন গোয়েন্দা।

আরও সামনে ঘন ঝোপঝাড়, মোটা মোটা লতা। ওগুলোর ভেতর দিয়ে পথ করে হাঁটাই মুশকিল। তবে পথ একটা করাই আছে, রিকি সঙ্গে না এলে খুঁজে পেতো না তিন গোয়েন্দা। ঝোপের ভেতর থেকে বেরোতেই দেখা গেল বনের মাঝে একটা খোলা জায়গা। একধারে শক্ত হয়ে আছে কাদার স্তূপ। আরেকধারে। একটা ছোট কুঁড়ে। কাঠের নিচু ছাত, খড়খড়ি লাগানো জানালা। রোদে শুকানো ইঁট দিয়ে তৈরি। নীরব, নিঃসঙ্গ। এটাই অ্যাডোব।

 এই ক্যানিয়নের প্রথম মালিক এক স্প্যানিশ। সে-ই বানিয়েছিলো ওই কুঁড়েটা, জানালো রিকি। দেড়শো বছরেরও বেশি আগে। ভেতরে শুধু একটা ফায়ারপ্লেস আছে। বাথরুমও নেই।

এই চাবি দিয়ে তালা খুললো রিকি। মোটা তক্তার পাল্লা, তাতে লোহার পাত লাগানো। পাতের এক মাথা গোল করে চৌকাঠে লাগানো মোটা লোহার বাকা শলায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে, এই প্রাচীন কজার ওপরই খেলে পাল্লাদুটো।

 ঠিকই বলেছে রিকি। তিন গোয়েন্দা ঢুকে দেখলো, ভেতরে প্রায় কিছুই নেই। কাঠের মেঝেতে পুরু হয়ে জমেছে ধুলো আর কাঁচা ইটের গুঁড়ো। দুটো ঘর। দুটোই ছোট। একটাকে বোধহয় বসার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো, আরেকটা শোবার ঘর–ওটার সংলগ্ন রান্নাঘর। জানালার পাল্লাগুলো বাইরের দিকে খোলে। ফাঁকফোকর দিয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে ম্লান আলো। ঘরের ভেতর বেশ ঠাণ্ডা।

খাইছে! বলে উঠলো মুসা। দেয়াল কি পুরুরে বাবা। তিন ফুটের কম হবে না।

অ্যাডোব এভাবেই তৈরি হতো, রবিন বললো আগুনে-পোড়া ইটের মতো শক্ত হয় না রোদে পোড়া ইট। ফলে বড় আর পুরু করে বানাতে হতো, যাতে দেয়াল তৈরি করলে ভার রাখতে পারে।

মুসা, রবিনের কথা শেষ হলে কিশোর বললো, রান্নাঘরটায় খোজো। রবিন, তুমি খোজো শোবার ঘরে। আমি আর রিকি খুঁজছি বসার ঘরটায়।

অব্যবহৃত অনেক ক্যানভাস দেখতে পেলো কিশোর। রঙ পাতলা করার তেলের টিনও আছে। কিন্তু কোনো ছবি নেই। অলংকরণ করা একটা সোনালি ফ্রেম রয়েছে। সেটার দিকে চেয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো সে। আনমনে বললো, এটাকে খালি রেখেছিলো কেন ডেনবার?

এটাতে আরেকজনের আঁকা একটা ছবি ছিলো, বললো রিকি। নকল ছবি। ডেনবার বলতো, প্রিন্ট। বলতো, প্রিন্ট মোটেই পছন্দ করে না সে, তাই খুলে ফেলে দিয়েছিলো।

কিন্তু ফ্রেমটা ফেলেনি। ডিজাইনগুলো দেখেছো?

আঁকাবাকা! কিশোর, এটার কথা বলেনি তো?

রিকির কথা যেন শুনতেই পেলো না গোয়েন্দাপ্রধান। বেশ পুরু। ভেতরে অনেক কিছুই লুকিয়ে রাখা সম্ভব।

ফ্রেমটা ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখলো দুজনে। জোড়াগুলো দেখলো। আঁকাবাঁকা অলংকরণগুলোতে আঙুল চালিয়ে, টিপেটুপে দেখলো। অবশেষে মাথা নাড়লো কিশোর, না, নেই কিছু। তাহলে কোথায় কি আছে?

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো মুসা। পেলাম না। কিছু থেকে থাকলে, দেয়ালের মধ্যে লুকানো রয়েছে।

আমরাও কিছু পাইনি, জানালো রিকি।

এই, দেখে যাও! শোবার ঘর থেকে রবিনের ডাক শোনা গেল। এইযে, এখানে।

এক কোণে ফেলে রাখা জীর্ণ মলিন একটা বিছানার গদির কাছে দাঁড়িয়ে আছে সে। খোলের কাপড়ে তির্যক রেখা আঁকা ডিজাইন। আমার বিশ্বাস, এটার ভেতরে কিছু আছে। ফুলে থাকা একটা জায়গা দেখালো।

টিপে দেখলো মুসা। খাইছে! নিশ্চয় পাথর। রত্ন! অনেকগুলো।

কাটো কাটো, জলদি কাটো, বললো কিশোর।

পকেট থেকে পেন্সিল কাটার ছোট ছুরি বের করে গদির ওই জায়গাটা কাটলো মুসা। চারপাশ থেকে বুকে এসেছে অন্যরা। মাথা ঠুকাঠুকি হয়ে যাচ্ছে। গোল গোল পাথরের মতোই কতগুলো জিনিস বেরোলো।

কি ওগুলো? রিকির কণ্ঠে বিস্ময়।

কোনো মেঠো ইঁদুর কিংবা কাঠবেড়ালির রত্ন, নিরাশ হয়ে বললো কিশোর।

মানে?

 দেখছো না? একর আর পাইন নাট।

ওক আর পাইনের ফলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা। প্রথম হাসলো। মুসা। হ্ হুঁহ হাসি থেকে বাড়তে বাড়তে একেবারে অট্টহাসি। সংক্রামিত হলো অন্যদের মাঝেও। হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে গেল ওদের। একজন কোনোমতে থামলে অন্যদের হাসি দেখে আবার হেসে উঠছে।

এই হাসির জন্যেই টের পেলো না, বসার ঘরে যাওয়ার দরজাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যখন পেলো, দেরি হয়ে গেছে।

হাসি থামিয়ে দরজার দিকে চেয়ে বললো মুসা, আরে…?

কথা শেষ হলো না। দরজার ওপাশে খসখস শব্দ। খিল লাগানোর আওয়াজও শোনা গেল।

এই, কে? চেঁচিয়ে উঠলো রিকি। কে তুমি? কে?

খোলো খোলো, দরজা খোলো! রবিন বললো।

পাল্লার ওপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো মুসা। জোরে ঠেলা দিয়ে বললো, এই, বন্ধ করছো কেন?

থামো তোমরা, বললো কিশোর।

চুপ করলে অন্যেরা। বসার ঘরে নড়াচড়া করছে কেউ। জিনিসপত্র নাড়ছে। দরজায় টোকা দেয়ার শব্দ। আছড়ে ভাঙছে ছবি আঁকার ফ্রেম, ছুঁড়ে ফেলছে তেল আর রঙের কৌটা, টিন।

খুঁজছে ব্যাটা, ফিসফিস করে বললো কিশোর।

আরও কয়েক মিনিট ধরে চললো বিচিত্র শব্দ। ক্ষণিকের জন্যে নীরবতা। বাইরের দরজা বন্ধ হলো, তালা লাগানোর আওয়াজও বোঝা গেল।

সর্বনাশ হয়েছে! গুঙিয়ে উঠলো রিকি। তালায় চাবি লাগিয়ে রেখে এসেছিলাম!

.

শোবার ঘরে একটা মাত্র জানালা। পুরু কাঠের শক্ত পাল্লা। খুলে যাতে কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারে সেজন্যে মোটা তক্তা আর পেরেক দিয়ে বাইরে থেকে শক্ত করে বন্ধ করে দিয়েছেন রিকির বাবা। খুলতে হলে ছেনি-হাতুড়ি লাগবে।

বাইরে রাত নেমেছে। পাল্লার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো আসছে ঘরে।

কয়েক ঘন্টা হলো আটকে রয়েছে ছেলেরা। চেঁচিয়ে গলা ব্যথা করে ফেলেছে। কিন্তু কে শুনবে? হোফার হাউস থেকে অনেক দূরে এই অ্যাডোব। চেঁচামেচি করে লাভ হবে না বুঝে বেরোনোর অনেক চেষ্টা করেছে, ছেলেরা। সুবিধে করতে পারেনি। ভীষণ পুরু দেয়াল। মুসার পকেট নাইফ কিংবা কিশোরের আটলার সুইস নাইফ দিয়ে খুঁচিয়ে দেখেছে, প্রায় দাগই ফেলতে পারেনি। দেয়ালে। বুঝেছে, বেশি চাপাচাপি করতে গেলে অযথা ছুরির ফলাই ভাঙবে, দেয়ালে গর্ত হবে না। দরজা খুলতে পারেনি, জানালা তো নয়ই। ঘরের মেঝেতে লাথি মেরে বুঝেছে, নিচে ফাঁপা, বোধহয় বেসমেন্ট আছে। কিন্তু ওখানে নামার পথ খুঁজে পায়নি।

হতাশ হয়ে এখন বসে রয়েছে পুরনো গদিটার ওপর। ডিনারের সময় হয়ে গেছে, আফসোস করে বললো মুসা।

আর ডিনার! জোরে নিঃশ্বাস ফেললো রবিন। কাল সকালের নাস্তা করতে পারবো কিনা সন্দেহ। আটকা পড়লাম ভালোমতোই।

রিকি বললো, বাবা আমাকে না দেখলে খুঁজবে। খুঁজে বের করবে।

কি করে জানবে, এখানে এসেছো? প্রায়ই আলো নাকি? জানেন তোমার বাবা?

না।

 তাহলে কেন এখানে খুঁজতে আসবেন?

আবার নীরবতা।

কিছুক্ষণ পর কি মনে হতে উঠলো মুসা। একদিকে দেয়ালের কোণ ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে একটা দেয়াল আলমারি। সেটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কয়েকবার পা ঠুকলো মেঝেতে। বেসমেন্টে নামতে পারলে হতো। হয়তো বেরোনোর পথ পাওয়া যাবে। কিন্তু নামি কিভাবে?

রিকিও গিয়ে মুসার পাশে দাঁড়ালো। অ্যাডোবের নিচে যে ভাড়ার ঘর আছে, জানতামই না। কেন বানালো বুঝতে পারছি না! বিড়বিড় করলো আপনমনে, ক্যালিফোর্নিয়ায় এসব বানায় না লোকে!

না, তা বানায় না, বললো কিশোর। আর এরকম পুরনো অ্যাডোবের নিচে তো নয়ই। এক মুহূর্ত ভাবলো। তারপর লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো, উত্তেজিত। এখন অ্যাডোবের নিচে ভাড়ার বানায় না। কিন্তু যখন আমেরিকান আর স্প্যানিশরা শত্রু ছিলো? পালানোর জন্যে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে রাখতো। নিশ্চয় এটার তলায়ও ওরকম কিছু আছে। আবছা আলোয় পুরো ঘরে আরেকবার চোখ বোলালো সে। বিড়বিড় করলো, নামার পট। কোথায়?… আলমারিটার দিকে তাকিয়ে রইলো এক মুহূর্ত। ওটার নিচে…

কিশোরের কথা শেষ হওয়ার আগেই হুমড়ি খেয়ে বসে পড়লো রবিন আর মুসা। হাত দিয়ে মুছে ফেললো পুরু ধুলো আর ইট-মাটির গুঁড়ো। একটা চিড়মতো দেখা গেল। ওটার মধ্যে ছুরির ফলা ঢুকিয়ে নেড়েচেড়ে, চাপ দিয়ে দেখলো মুসা। এই, নড়ছে! চেঁচিয়ে উঠলো সে।

 রবিন আর সে মিলে টেনে তুললো একটা তক্তা। নিচেও ধুলো আর মাটির পুরু আস্তরণ। ওগুলো সরাতে বেরিয়ে পড়লো একটা ট্র্যাপড়োর, লোহার মরচে ধরা বড় আঙটা লাগানো। আঙটাটা চেপে ধরে টান দিতেই উঠে এলো। ট্র্যাপোডোর। ফোকরের তলায় ঘন অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না।  

দেখা যায় না, অস্বস্তিতে ভরা রবিনের কণ্ঠ।

নাহ, বললো রিকি। খালি অন্ধকার।

 সুড়ঙ্গ থাক আর যা-ই থাক, আমি নামছি না ওখানে, সাফ বলে দিলো মুসা।

বেশ, থাকো, বললো কিশোর। ফেরেনটির হাতের ছুরির কথা মনে আছে? রাতের বেলা খুন করতে আসতে পারে।

ভয় দেখাচ্ছো? আসুক ছুরি নিয়ে। দরকার হয় লড়াই করবো। কিন্তু আমি ওই অন্ধকারে নামছি না। শুনেছি স্প্যানিশ ভূতগুলো সবচেয়ে পাজি।

অন্য সময় হলে হেসে ফেলতো সবাই, এখন হাসলো না।

ইস, একটা টর্চও যদি থাকতো! জিভ দিয়ে চুক চুক করলো কিশোর। কিন্তু কেউ একজনকে তো নামতেই হবে।

ভয়ঙ্কর লাগছে কালো গহ্বরটা, যেন কোনো দানবের হাঁ করা মুখ।

বেশ, আমিই যাচ্ছি, অসাধারণ দুঃসাহস দেখিয়ে বসলো রবিন। কেউ বাধা দেয়ার আগেই গুড বাই বলে পা নামিয়ে দিলো ফোকরের ভেতরে। দুই হাতে কিনার ধরে রেখে ঝুলে রইলো এক মুহূর্ত। তারপর ঢিল করে দিলো আঙুলগুলো।

পড়তে লাগলো নিচে। কালো অন্ধকার গ্রাস করলো যেন তাকে।

.

১০.

কালো মুখটা দিয়ে নিচে উঁকি দিলো অন্য তিনজন।

রবিন? ডাকলো মুসা।

ভালোই আছি আমি, জবাব এলো নিচে থেকে। সুড়ঙ্গই। বালি আর ইটের ঔড়োয় ভরা। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। হাত বাড়ালে দেয়াল হাতে লাগছে। এক মিনিট দাঁড়াও, আরও ভালোমতো দেখে নিই।

নিচে নড়াচড়া শোনা গেল। ছেলেদের মনে হলো কয়েক ঘন্টা পেরিয়েছে, আসলে পেরোলো মাত্র কয়েকটা মিনিট। আবার শোনা গেল রবিনের কণ্ঠ, একদিকে ছয় ফুট গেছে, বোধহয় লিভিংরুমের তলায়। ওখানে আরেকটা ট্র্যাপডোর আছে। অনেক টেনেটুনে দেখলাম, খুলতে পারলাম না। ওটা খোলা গেলে হয়তো বেরোনো যাবে।

কিশোর, মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি। সুড়ঙ্গটা কোথায় গেছে কি করে জানবো?

 হারিয়ে যেতে পারি, বললো রিকি।

ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। ডেকে জিজ্ঞেস করলো, রবিন? বাতাস কেমন ওখানে?

ভালোই। শ্বাস নিতে অসুবিধে হচ্ছে না। তবে স্থির হয়ে আছে।

কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে দ্বিধা করছে গোয়েন্দাপ্রাধান! কোথায় গেছে সুড়ঙ্গটা? বলা যায় না, কি হবে! সাংঘাতিক বিপদে পড়তে পারি, বললো সে। মারাও যেতে পারি। কিন্তু এখানে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। চেষ্টা করে দেখা দরকার। যে আটকে রেখে গেছে আমাদের, তার উদ্দেশ্যও জানি না। হয়তো ফিরে আসবে ছুরি নিয়ে…

আমি নামছি, কিশোরের কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠলো মুসা। রবিনের মতো একই কায়দায় নেমে গেল।

তার পরে গেল রিকি। সব শেষে কিশোর।

একে অন্যের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলো ওরা। এভোই অন্ধকার, কিছু দেখতে পেলো না। ঠাণ্ডাও বেশ। বেশিক্ষণ এখানে থাকতে হলে শীতেই কাবু হয়ে যাবে।

চলো, এতোক্ষণ ভয় পাচ্ছিলো বটে, কিন্তু সময়মতো ভয়ডর, সব চলে গেল মুসার, নেতা হয়ে গেল। আমি আগে যাচ্ছি। কিশোর, তুমি আমার পেছনে থাকো। রবিন, রিকি, তোমরা কিছুটা দূরে থাকো। যদি খাদেটাদে পড়েই যাই, তোমরা অন্তত… কথা শেষ করলো না সে।

ট্রাপডোরটা খোলা গেল না। উল্টোদিকে আরেকটা সুড়ঙ্গ আছে। সেটা ধরেই এগোনোর সিদ্ধান্ত নিলো মুসা। গাঢ় অন্ধকারে খুব সাবধানে এক পা এক পা করে আগে বাড়লো। ধীরে ধীরে নিচু হয়ে আসছে ছাত। ঝুঁকতে ঝুঁকতে শেষে বাঁকা হয়ে গেল, কুঁজো মানুষের মতো।

মনে তো হয় সোজাই গেছে, বললো, মুসা। ঠিক বুঝতে পারছি না।

এগিয়ে চলেছে ওরা।

প্রতিটি পা মেপে মেপে ফেলছে মুসা। ফেলার আগে দেখে নিচ্ছে সামনে মাটি আছে, নাকি শূন্য। কথা বলছে না কেউ। গভীর অন্ধকার আর ভীষণ নীরবতা– চেপে ধরছে যেন ওদেরকে।

মুসা, এক সময় বললো কিশোর। কি যেন নড়ছে।

জমে গেল চারজনেই।

বাতাস! বলে উঠলো রবিন। বাতাস নড়ছে।

আবার এগোলো মুসা। গতি সামান্য বাড়ালো। সামনে একটা মোড়।

মোড় ঘুরতেই মনে হলো, সামনে অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে আছে।

সুড়ঙ্গমুখ! আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

আর বিশ কদম এগিয়েই খোলা আকাশের নিচে বেরিয়ে এলো ওরা। হাসলো একে অন্যের দিকে চেয়ে। এখন নিরাপদ। বন্ধ কারাগার, ভয়াবহ অন্ধকার থেকে যুক্তি মিলেছে শেষ অবধি। ওই অন্ধকারের পর জ্যোৎস্নাকে মনে হলো উজ্জ্বল সূর্যের আলো।

নালাটায় বেরিয়েছি, চারপাশে দেখে বললো রিকি।

নালার ভাটিতে রয়েছে ওরা। উজানের দিকটা উঠে গেছে অনেক ওপরে। যেখান দিয়ে বেরিয়েছে ওরা, সেটাকে দেখে মনে হয় কালো একটা সাধারণ গর্ত, ঝোপঝাড়ে ছাওয়া। সুড়ঙ্গমুখ যে, বোঝার উপায় নেই।

চলো, বলে পা বাড়াতে গিয়েই থেমে গেল কিশোর।

মাত্র দশ গজ দূরে ধুপ করে নালায় পড়লো কে যেন! অসাবধানে পা বাড়াতে গিয়েই বোধহয় পড়েছি। বাবারে! বলে চেঁচিয়ে উঠলো।

কে? বলে এগিয়ে গেল মুসা।

হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো লোকটা। চাঁদের আলোয় তার চেহারা দেখে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো মুসা। ঘুরেই দিলো দৌড়। চেঁচিয়ে বললো, পালাও, পালাও! জন ফেরেনটি…

অন্যেরাও দৌড়াতে শুরু করলো মুসার পেছনে।

 এই শোনো, থামো থামো।

কিন্তু কে শোনে ডাক? ছুটছে তো ছুটছেই ওরা। পেছনে আসছে ফেরেনটি। পাথরে লেগে তার জুতোর শব্দ হচ্ছে। থামলো তো না-ই, গতি আরও বাড়িয়ে দিলো ছেলেরা।

জলদি করো! বললো মুসা। সাইকেলের কাছে।

মোড় ঘুরতেই হঠাৎ সামনে পড়লো আরেকজন। মুসার হাত চেপে ধরলো। ঝাড়া দিয়ে চুটিয়ে নিয়ে চিৎকার করে বললো সে, খবরদার, কেউ থেমো না! ধরতে যেন না পারে! উত্তেজনায় মানুষটার মুখের দিকেও তাকালো না, হাত। ছাড়িয়ে নিয়েই আবার দৌড়।

এই রিকি! আমি!

আরি, বাবা!

থেমে গেল ছেলেরা।

হাঁপাতে হাঁপাতে মুসা বললো, ফেরেনটি তাড়া করেছে আমাদের।

অ্যাডোবে আটকে রেখেছিলো, জানালো রিকি।

ভাগ্যিস গোপন সুড়ঙ্গটা পেয়ে গেলাম, যোগ করলো রবিন। নইলে এখনও ওখানেই আটকে থাকতাম।

নালার ভাটির দিকে তাকালেন প্রফেসর। কই, কাউকে তো দেখছি না।

ছেলেরাও ফিরে তাকালো। সত্যি, কেউ নেই। শুধু নীরব চাঁদের আলো।

ছিলো তো বললো কিশোর। সংক্ষেপে জানালো অ্যাডোবে ঢোকার পর কি কি ঘটেছে।

হুঁ, মাথা দোলালেন প্রফেসর। কটেজেও আবার কে জানি ঢুকেছিলো। ফেরেনটিই হবে।

হবে কি বলছো, বাবা, নিশ্চয় সে-ই ঢুকেছিলো। আমাদের আটকে রেখে কটেজে গিয়েছিলা। ওখানে খুঁজেছে। কিছু না পেয়ে আবার রওনা হয়েছে অ্যাডভাবে। ল্যাঙড়া তো। পড়ে গিয়েছিলো নালায়। ওখানে আমাদের দেখেই তাড়া করেছে।

ভালো বিপদেই পড়েছিল, বললেন প্রফেসর। কিন্তু ওই ফেরেনটিটা এদিকে এতো ঘুরঘুর করছে কেন? কি চায়?

১১.

বাড়িতে বলে যায়নি। ফলে, রাত করে বাড়ি ফেরার জন্যে, আর দুশ্চিন্তায় রাখার কারণে বকা খেতে হলো তিনজনকেই।

পরদিন আবার হেডকোয়ার্টারে মিলিত হলো তিন গোয়েন্দা।

 মুসা ঢুকে দেখলো, চেয়ারে নেতিয়ে রয়েছে কিশোর আর রবিন।

কি ব্যাপার? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো গোয়েন্দাসহকারী। মানুষ মরেছে। নাকি?

এতো দেরি করলে যে? জোর নেই কিশোরের কণ্ঠে।

ধপ করে বসে পড়ে মুসা বললো, কাল রাতে যে দেরি করেছি, তার, শাস্তি। সকালে পুরো বাগানের ঘাস কাটিয়ে ছাড়লো মা। তা তোমাদের কি। হয়েছে?

ফ্রেড ব্রাউন আমাদের বরখাস্ত করেছে, বিষণ কণ্ঠে জবাব দিলো রবিন।

দীর্ঘশ্বাস ফেললো কিশোর। কয়েক মিনিট আগে ফোন করেছিলো। কাল রাতে অ্যাডোবে কি কি ঘটেছিলো, তাকে জানিয়েছেন মিস্টার হোফার। শুনে, ম্যানেজার বললো, কাজটা আমাদের জন্যে বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে। ফলে, আর কাজ করতে আমাদেরকে বারণ করে দিয়েছে। ছোটখাটো একটা বোনাসও, পাঠিয়েছে।

খাইছে! অন্য দুজনের মতোই মুসাও নেতিয়ে গেল। গোয়েন্দাগিরিতে আমাদের প্রথম ব্যর্থতা!

এবং এতো কষ্টের পর, গুঙিয়ে উঠলো কিশোর। অথচ রহস্যগুলোও এখনও জট পাকিয়েই রইলো!

এবং ওই জট জটই থেকে যাবে, বললো রবিন।–

চুপ হয়ে গেল গোয়েন্দাপ্রধান। বহুদূরে চলে গেছে যেন তার মন, ট্রেলারের গণ্ডিতে নেই।

আর থাকতে না পেরে বলে উঠলো মুসা, রবিন, পিঠ সোজা করো। আমাদের কিশোর মিয়া এতো সহজে ছাড়ার পাত্র না। দেখছে না, ফন্দি আঁটছে।

তিন গোয়েন্দা ব্যর্থ হতে পারে না, বাস্তবে ফিরে এলো যেন কিশোর। এই রহস্যের সমাধান আমরা করবোই।

কিভাবে? বললো রবিন।

রিগ ডেনবারের প্রলাপের মানে বুঝতে পারলেই এই রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে।

কি দরকার কিশোর? মাথা নাড়লো মুসা, নাহয় ছেড়েই দিলাম একটা কেস, ব্রাউন ঠিকই বলেছে, বড় বেশি বিপজ্জনক…

বিপদে আগেও পড়েছি আমরা, মুসাকে থামিয়ে দিলো কিশোর। এখন, এসো, ডেনবারের কথাগুলোর মানে বের করার চেষ্টা করি। টেবিলে দুই কনুই রেখে সামনে ঝুঁকলো সে। এক নম্বরঃ বুড়ো ডেনবারের কাছে দামী কিছু একটা ছিলোই। দুইঃ সেই কথাটা একাধিক লোক জানে। তিনঃ বিশটা ছবির মধ্যে কোনো সূত্র লুকানো রয়েছে। এবং চার নম্বরঃ প্রলাপের মধ্যেই রয়েছে কোনো জরুরী মেসেজ। আবার চেয়ারে হেলান দিলো গোয়েন্দাপ্রধান। এখন ওই প্রলাপগুলোর রহস্য ভেদ করতে হবে আগে। যদি সত্যি বলা হয়ে থাকে।

রিকি আর তার বাবা মিছে কথা বলেছে, ভাবছো? রবিন বললো।

প্রফেসরের টাকা দরকার, ঘুরিয়ে জবাব দিলো কিশোর। ডেনবারের কাছে টাকা পান তিনি। আগাগোড়াই হয়তো জেনে এসেছেন, বুড়োের কাছে মূল্যবান কোনো জিনিস আছে। কিংবা হয়তো আন্দাজ করেছেন, যেদিন পয়লাবার চোর ঢুকলো তাঁর ঘরে।

আমার বিশ্বাস হয় না রিকি মিছে কথা বলেছে, মাথা নাড়লো মুসা।

বেশ, বললো কিশোর, ধরে নিলাম, বলেনি। তাহলে ডেনবারের শেষ কথাগুলোর অর্থ উদ্ধার করা যাক। রিকি আর প্রফেসর যা যা বলেছেন, সব লিখে রেখেছি আমি। একটা কাগজ বের করে টেবিলে রাখলো সে। প্রফেসরের কথামতো ডেনবার বলেছেঃ পেইনটিংস, আঁকাবাঁকা, ভুল, ক্যানভাস আর মাস্টারস। ডেনবারের কাছে কাছে থাকায় আরও বেশি শুনেছে রিকি। সে বলেছেঃ ওদের বলো..আঁকা যখন বাঁকা:..ভুল মনে হবে মাষ্টার:..আমার পেইনটিংস ..আমার ক্যানভাস…ক্যানভাস থেকে আঁকাবাঁকা: বি-ব্বলো..ভুল। মোটামুটি এই কথাগুলোই বার বার বলেছে।

মাথা চুলকালো মুসা। ওদের বলল, একথার মানে বোঝা যায়, কাউকে বলার কথা বলছে। আঁকা যখন বাঁকা আর ভুল মনে হবে বলে বোধহয় দিক-নির্দেশ করতে চেয়েছে। কোনো একটা পথ ভুল। তাহলে কোনটা ঠিক?

হ্যাঁ, মাথা ঝোঁকালো কিশোর। এটা একটা জরুরী প্রশ্ন।

মানে কি? প্রশ্ন করলো রবিন।

জানি না। আরও একটা শব্দ বুঝতে পারছি না, বি-ব্বলো মানে কি?

তোতলামি, বললো মুসা। স্রেফ তোতলামি। প্রলাপ বকার সময় উচ্চারণে। ভুল করেছে। বলতে চেয়েছে বলো, মানে ওদের বলল।

তা হতে পারে।

লেখাগুলো পড়লো রবিন। মাস্টার আর পেইনটিংসের মানে হলো, ডেনবার ভেবেছে তার ছবিগুলো মাস্টার পীস। আর আমার ক্যানভাস, ক্যানভাস থেকে আঁকাবাঁকা, এসব কথা বলতেই পারে যে কোনো আর্টিস্ট।

মুসা বললো, ফেরেনটিও হয়তো ভেবেছে, ছবিগুলো ভালো।

টেবিলে চাপড় মারলো রবিন। ঠিক বলেছো! ডেনবার হয়তো আসলেই ভালো আর্টিস্ট ছিলো। বড় আর্টিস্ট, কিন্তু খামখেয়ালী। তাই তার ছবি কাউকে দেখায়নি, কিংবা বিক্রি করেনি। হয়তো ফেরেনটি ভাবছে, ছবিগুলো পেলে অনেক দামে এখন বিক্রি করা যাবে।

এ-সবই হতে পারে, সন্তুষ্ট হতে পারছে না কিশোর। কিন্তু ডেনবারের মেসেজটা কি? বলেছে, ওদের বলো। কাদেরকে বলতে বলেছে?

কাউন্টেস আর ফ্রেড ব্রাউনকে, বললো মুসা।

ব্রাউনের কথা কেন বলবে? ওই লোক তো কাউন্টেসের সাধারণ একজন কর্মচারী। কেন তাকে বোনের সঙ্গে মেশাতে যাবে? বললেই পারতো, আমার বোনকে বলো। তারমানে একাধিক জনকে জানাতে চেয়েছে। কোনো দলের কথা বলেছে।

দল!

চোর-ডাকাতের দল হওয়াও অসম্ভব নয়। প্রফেসরের বাড়ির সীমানার বাইরে কোথাও যেতো না ডেনবার। ধরে নেয়া যায় না, সে ওখানে কারও ভয়ে লুকিয়ে ছিলো?

তাহলে কি ফেরেনটিও ওই দলের কেউ? চোরাই মাল খুঁজতে এসেছে?

সে-রাতে আমাদের অ্যাডোবে আটকে রেখে খোঁজাখুঁজি করার এটাই সম্ভাব্য ব্যাখ্যা, বললো কিশোর। আর রবিন যে বলেছে, ডেনবারের ছবিগুলো দামী ছিলো, তা নয়। তাহলে ফেরেনটি অ্যাডোবে গিয়ে জিনিসপত্র ভাঙতো না, বরং ছবিগুলো খুঁজে বের করার দিকেই নজর দিতো বেশি। দ্বিধা ফুটলো তার চেহারায়।

 কি হলো, কিশোর? অবাক হলো রবিন।

শিওর না, ধীরে ধীরে বললো গোয়েন্দাপ্রধান। কাল রাতে অ্যাডোবে…নালায় কি যেন একটা ভুল কোথায় যেন কিছু গোলমাল ঠিক ধরতে পারিনি, এখনও পারছি না।

কই, কাল রাতে আমার তো কোনো গোলমাল মনে হয়নি? বললো মুসা।

কি জানি! যাকগে, পরে ভাববো। এখন একবার গিয়ে ফ্রেড ব্রাউনের সঙ্গে  দেখা করা দরকার। আমি আর মুসা যাবো।

আর আমি? জানতে চাইলো রবিন।

আরেকবার যাও শুঁটকির কাছে। ছবিটা কোথায় পেয়েছে, জানার চেষ্টা করো।

.

১২.

রকি বীচের মাইল খানেক দক্ষিণে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে তৈরি হয়েছে অভিজাত বিলাসবহুল মোটেল সী বীচ। বাইরে সাইকেল পার্ক করে চকচকে সুসজ্জিত প্রধান প্রবেশপথের দিকে এগোলো দুই গোয়েন্দা। হলরুমে ঢুকলো। রিসিপশন ডেস্কে বসে রয়েছে লম্বা, বদ-চেহারার এক লোক। ছেলেদের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো, কি চাই?

নার্ভাস হয়ে গেল মুসা। কিন্তু কিশোর এতো সহজে দমবার পাত্র নয়। মাথা সোজা করে কেউকেটা একটা ভাব করে, ইংরেজিতে বিদেশী টান এনে, গম্ভীর ভঙ্গিতে বললো, কাউন্টেসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি আমরা। আমি কিশোর পাশা দ্য ফোর্থ। আর ইনি মিস্টার মুসা আমান। মশিয়ে ব্রাউনকে খবর পাঠান, আমরা এসেছি।

অনেক কষ্টে হাসি দমন করলো মুসা।

কিন্তু লোকটা কিশোরের এই অভিনয় ধরতে পারলো না। দ্বিধা করছে। ভাবছে, ছেলেটাও কোনো হবুকাউন্ট নয় তো?

কিংবা, ক্লার্ককে দ্বিধা করতে দেখে বললো কিশোর। আরেক কাজ করতে পারেন। আপনার কাজ সহজ করে দিচ্ছি। নাম্বার বলুন, আমরা নিজেরাই গিয়ে দেখা করছি। .

ইয়ে, নাক চুলকালো ক্লার্ক। ইয়ে…মিস্টার, ব্রাউন উঠেছেন দশ নম্বর কটেজে। পোর্টারকে ডাকছি…

দরকার নেই, হাত নাড়লো কিশোর। আমরাই খুঁজে নেবো। এসো, আমান।

রাজকীয় চালে হেঁটে হল পেরোলো গোয়েন্দাপ্রধান, একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো মোটেলের চমৎকার চত্বরে। ক্লার্কের চোখের আড়ালে এসেই আবার স্বাভাবিক হলো কিশোর। হেসে বললো, দশ নম্বরটা সম্ভবতঃ বাঁয়ে। …ওই যে, সিরিয়াল নম্বরের সাইন।

এরকম করতে গিয়ে কোনদিন যে কি বিপদে পড়বে, বললো মুসা। মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেবে তখন।

আরে রাখো তোমার বিপদ। ধরতে পারলে তবে তো? আর এসব দামী জায়গার ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা। হোমড়া-চোমড়ারা আসে। পান থেকে চুন খসলেই তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দেবে। ফলে ভয়ে ভয়ে থাকে কর্মচারীরা, সন্দেহে ভোগে। ওদেরকে ধোকা দেয়া তাই সহজ।

এই লেকচারের পর আর কথা চলে না। চুপ হয়ে গেল মুসা।

সরু পথ, দুধারে চিরসবুজ গাছ আর লতার ঝড়। সুইমিং পুলের কাছ থেকে হাসি, কথার আওয়াজ ভেসে আসছে।

 পথটা ধরে এগোলো দুই গোয়েন্দা। কিছু দূর এগোতেই এক ধার থেকে শুরু হলো কটেজের সারি।

নয় নম্বর, এক সময় বললো কিশোর। পরেরটাই দশ নম্বর হবে। ওই পাম গাছটার ওধারে বোধহয়।

গাছের মোটা গুঁড়িটা ঘুরে এসেই থমকে গেল দুজনে। দশ নম্বর কটেজের জানালায় দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে আছে একজন। একটানে মুসাকে নিয়ে আবার গাছের আড়ালে সরে এলো কিশোর। কয়েক সেকেণ্ড জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে ঘুরে দরজার কাছে চলে গেল চোরটা। দরজা খোলার চেষ্টা করলো।

কিশোর! বলে উঠলো মুসা। ব্যাটা…

ঝট করে ফিরে তাকালো চোর।

শুঁটকি টেরি?-মুসার কথাটা শেষ করলো কিশোর।

ক্ষণিকের জন্যে হাঁ হয়ে গেল টেরিয়ার। দুই গোয়েন্দাকে ছুটে আসতে দেখে। ঘুরেই দিলো দৌড়। হুড়মুড় করে গিয়ে ঢুকলো ঝাড়ের মধ্যে।

ধরো, ধরো ব্যাটাকে? চেঁচিয়ে বললো কিশোর।

পামের সারি আর হিবিসকাসের ঝাড়ের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে দৌড়াচ্ছে টেরিয়ার। পেছনে মূসা। কিশোর বুঝলো, ওভাবে দৌড়ে শুঁটকিকে ধরা যাবে না। একটা শর্টকাট বেছে নিয়ে দৌড় দিলো আরেক দিক দিয়ে। টেরিয়ারের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে। পুলের ধার দিয়ে চলে যেতে চায় মেইন গেটের কাছে।

সোজা পুলের দিকে ছুটলো কিশোর। চোখ মুসা আর টেরিয়ারের দিকে। ফলে গায়ের ওপর গিয়ে পড়ার আগে লোকটাকে দেখতে পেলো না।

পেটে গুঁতো খেয়ে গাউক করে উঠলো লোকটা। ফিরে চেয়ে দেখলো কিশোর, ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে রূপালি-চুল এস্টেট ম্যানেজার।

কিশোর! কি করছে এখানে? এভাবে দৌড়াচ্ছো কেন?

শুঁটকি টেরি, স্যার, হাঁপাতে হাঁপাতে বললো কিশোর। টেরিয়ার ডয়েল। আপনার ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছিলো। মুসা গেছে পেছনে। আমি এদিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে ধরতে চেয়েছিলাম…

টেরিয়ার ডয়েল? মানে, যে ছেলেটার কাছে মিস্টার ডেনবারের একটা ছবি আছে?

হ্যাঁ, স্যার। মুসা ধরতে পারলে…

পারলো না। ফিরে এলো মুসা। পালালো ব্যাটা। …সরি..

পালালো, না? ভ্রূকুটি করলো ম্যানেজার। ও আমার কটেজে ঢুকতে চেয়েছে কেন?

সেটা তো আমারও প্রশ্ন, কিশোর বললো। মিস্টার ডেনবারের জিনিসগুলো কি কটেজেই রেখেছেন, স্যার? আমরা যেগুলো খুঁজে বের করে দিয়েছি?

হ্যাঁ। কিন্তু ওগুলো দিয়ে টেরিয়ার কি করবে? একটা পেঁচা… পুলের ধারের চত্বরের দিকে চোখ পড়তে থেমে গেল ম্যানেজার। কাউন্টেস ডাকছেন। বোধহয় কথা বলতে চান।

চত্বরে পাতা রয়েছে অনেকগুলো চেয়ার-টেবিল। তার একটাতে বসে রয়েছেন কাউন্টেস। তিনজনে এগোললা সেদিকে।

কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কাউন্টেস।

ছেলেদেরকে বসতে ইশারা করে, সংক্ষেপে কাউন্টেসকে সব কথা জানালো ম্যানেজার। আবার ফিরলো ওদের দিকে। তোমরা নিশ্চয় টেরিয়ারকে ধরতে এখানে আসোনি?

না, স্যার, বললো মুসা। আপনাদের অনুমতি নিতে এসেছি, আমরা ছবি খোঁজার কাজটা চালিয়ে যেতে চাই…

তাহলে তো ভালোই হতো। কিন্তু…

কিছু ব্যাপার আছে, স্যার, তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। খুলে বললো ওদের অনুমানের কথাঃ রিগ ডেনবারের কাছে কোনো মূল্যবান জিনিস ছিলো। কথাটা অন্য কেউ জানে। হারানো ছবিগুলোর সঙ্গে ওই জিনিসের কোনো যোগাযোগ। রয়েছে। আর, ডেনবারের প্রলাপ শুধুই প্রলাপ নয়, তার মধ্যে মেসেজ রেখে গেছে। শেষে বললো, এর দুটো মানে হতে পারে, স্যার। হয় সত্যি মিস্টার ডেনবার খুব ভালো আর্টিস্ট ছিলেন, তাঁর ছবিগুলোর দাম অনেক, এবং সেটা জানে। জন ফেরেনটি। নয়তো মিস্টার ডেনবার কোনো খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এই যেমন চুরি-ডাকাতি, কিংবা চোরাচালানী…

কি বলছো? হাত নাড়লো ম্যানেজার। কাউন্টেসের ভাই চোর? বুঝেশুনে কথা বলা উচিত।

কিন্তু একটা কথা ঠিকই বলেছে, কাউন্টেস বললেন, জন ফেরেনটিকে ভালো লোক মনে হয় না। কিছু খুঁজছে বোঝা যায়।

আপনার ভাই তার দলের লোকও হতে পারে, ম্যাডাম, বললো কিশোর।

হুম! কাউন্টেসের দিকে তাকালো একবার ব্রাউন। কে জানে, হতেও পারে। খেয়ালী লোক ছিলেন, তো। হয়তো কোনোভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন।…তোমরা তাহলে আর এসবে যেও না। বিপদে পড়বে। এখন, পুলিশকে জানাবো…

কিন্তু, স্যার, আমরা…

আর কোনো কিন্তু নেই। জেনেশুনে বিপদে ফেলতে পারি না আমরা তোমাদেরকে। যাও, বাড়ি যাও।

.

১৩.

দরজার কাছে আটকালো দুজনকে ডোরম্যান। জিজ্ঞেস করলো, তোমরা দুজন গোয়েন্দা?

ঢোক গিললো মুসা। আমরা…

আহ! গোয়েন্দা কিনা বলো। হ্যাঁ, কিংবা না।

হ্যাঁ।

এসো আমার সঙ্গে।

পরস্পরের দিকে তাকালো কিশোর আর মুসা। আড়চোখে দেখলো, চোখ গরম করে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বদ-চেহারার রিসিপশনিস্ট। হলের প্রতিটি দরজায় লোক, পোর্টার আর ম্যাসেঞ্জার বয়, সবাই চেয়ে রয়েছে দুজনের দিকে। যেন চোর আটকেছে।

একটা দরজা দিয়ে ছোট একটা ঘরে দুজনকে নিয়ে এলো ডোরম্যান। তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

কাউন্টেস বসে আছেন। কথা আছে তোমাদের সঙ্গে। ওভাবে মন খারাপ করে চলে যাচ্ছিলে…

তারমানে কাজটা চালিয়ে যেতে বলছেন! উত্তেজনা চাপতে পারলো না মুসা।

আপনার ম্যানেজার মত বদলেছেন তাহলে? বললো কিশোর।

না। ও চায় না, তোমরা কাজ করো। তবে আমার বিশ্বাস, তোমরা পারবে।

 হ্যাঁ, পারবো, দৃঢ়কণ্ঠে বললো কিশোর।

পুলিশ চীফ সার্টিফিকেট দিয়েছেন তোমাদের, সেকথা ভুলিনি আমি। কাজ করার অনুমতি দিতে পারি, তবে আমাকে কথা দিতে হবে, সাবধানে থাকবে তোমরা। কোনও বিপদ ঘটাবে না।

নিশ্চয়ই না, কিছু না ভেবেই বলে ফেললো মুসা।

গুড। আমার ভাই কি করছিলো, জানা দরকার।

নিজে হয়তো খারাপ লোক ছিলেন না তিনি, কিশোর বললো। কিন্তু তাঁকে হয়তো কোন খারাপ কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে

সেটাই জানতে চাই।

কাউন্টেস, একটা কথা বলবেন? যে জিনিসগুলো খুঁজে দিয়েছি, ওগুলোর মাঝে সত্যি কি কোনো মূল্যবান কিছু আছে?

নেই। তোমার কি মনে হয়? জিনিসটা কি?

এখনও জানি না।  

কিন্তু তোমার বিশ্বাস, আমার ভাই কিছু লুকিয়ে রেখে গেছে। কোথায় রেখেছে, সে-কথাও জানিয়ে গেছে?

তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বেশ। পারলে খুঁজে বের করো জিনিসটা। আর জন ফেরেনটির ব্যাপারে সাবধান। অযথা ঝুঁকি নিও না। কিছু জানতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে এসে জানাবে। আমাকে। যাও এখন। গুড বাই।

.

হেডকোয়ার্টারে ঢুকে দেখলো দুজনে, রবিন বসে আছে। ওদের দেখেই চেঁচিয়ে উঠলো, খবর আছে!

আমাদের কাছেও আছে! বসতে বসতে বললো মুসা।

কোত্থেকে জানি এলো শুঁটকি, মনে হলো ভূতের তাড়া খেয়ে এসেছে! ঘরে গিয়ে যে ঢুকলো, আর বেরোলো না।

ওর সঙ্গে, তাহলে কথা হয়নি? জানতে চাইলো কিশোর।

না। গিয়ে পেলাম না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যখন ফিরে আসবো ভাবছি, দেখি আসছে। আমার দিকে চাইলো না।…তবে ওদের মালীর সঙ্গে অনেক কথা বলেছি। জেনেছি, কোথায় কাজ নিয়েছে পুঁটকি।

শুঁটকি ব্যাটা আবার কাজ নিলো কোথায়? তার চাকরির কি দরকার? অবাক হলো মুসা।

কোথায়? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

মিস্টার নরম্যান গালিভারের অ্যাসিসট্যান্ট।

আরও অবাক হলো মুসা। মিস্টার নরম্যান গালিভার! আর্টিস্ট…

বিখ্যাত আর্টিস্ট। চকচক করে উঠলো কিশোরের চোখ। এই রকি বীচেই যিনি থাকেন!

বিশাল একটা বাড়িতে থাকেন, বললো রবিন। স্টুডিওটা আলাদা, তবে বাড়ির লাগোয়া। আমরা ছবি খুঁজছি, আর শুঁটকি আর্টিস্টের ওখানে চাকরি করে, কেমন যেন কাকতালীয় ব্যাপার মনে হয় না?

হয়, মাথা ঝোঁকালো কিশোর। খুব বেশি কাকতালীয়ই মনে হয়। জলদি চলো। লাঞ্চ সেরেই মিস্টার গালিভারের সঙ্গে দেখা করতে যাবো।

.

লোহার উঁচু গেটের বাইরে সাইকেল রাখলো তিন গোয়েন্দা। বিরাট এলাকার ভেতরে দুর্গের মতো মস্ত এক বাড়ির চূড়া চোখে পড়ছে, ঘন গাছপালার জঙ্গলের মাথার ওপর দিয়ে। বিকেলের রোদে আসল বনের মতোই লাগছে দেখতে। গেটটা খোলা। কাউকে চোখে পড়লো না।

চলো, ঢুকে পড়ি, বললো মুসা।

ভেতরে ঢুকলো ওরা। আঁকাবাঁকা সরু একটা পথ চলে গেছে বনের ভেতর দিয়ে। সবে পা বাড়িয়েছে এগোনোর জন্যে, ঠিক এই সময় ভেসে এলো তীক্ষ্ণ এক চিৎকার। যেন তীব্র ব্যথায় চিৎকার করে উঠেছে কোনো মেয়েলোক কিংবা বাচ্চা ছেলে!

কী? ফিসফিস করে বললো রবিন।

ভূত না তো! ভয় পেয়ে গেছে মুসা। চলো, ভাগি!

আবার শোনা গেল চিৎকারটা। বাঁয়ে।

কেউ বিপদে পড়েছে!!

চলো তো, দেখি, কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বললো কিশোর। খবরদার শব্দ করবে না!

পথ থেকে সরে গাছের আড়ালে এগোলো ওরা।

শোনা গেল আবার রক্ত-পানি-করা চিৎকার। ঠিক সামনে। দুহাতে ঠেলে : কয়েকটা পাতা সরালো কিশোর। একটুখানি ভোলা জায়গা! ওখানে বসে রয়েছে। একটা ভয়ানক জানোয়ার। চোখ এদিকেই।

স্তব্ধ হয়ে সবুজ চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ছেলেরা।

তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠলো জীবটা। দেখালো মারাত্মক শ্বদন্ত।

চিতাবাঘ! গলা কাঁপছে কিশোরের। দৌড় দাও! কুইক!

না! মানা করলো মুসা। বাঘটার চোখে চোখে তাকিয়ে রয়েছে। যেখানে রয়েছে দাঁড়িয়ে থাকে। দৌড় দিলেই এসে ধরবে।

 হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে থাকো। একেবারে চুপ, পেছন থেকে বলে উঠলো আরেকটা কণ্ঠ। দৌড় দিলেই মরবে।

ঝট করে ফিরে তাকালো তিনজনে।

বিশালদেহী এক লোক, যেন একটা গ্রিজলি ভালুক। লাল দাড়ি, লাল ঘন চুল। চোখে আগুন। হাতে একটা বল্লম, ঝকঝকে ফলাটা তিন ফুটের কম হবে না।

 পাথর হয়ে গেল যেন তিন গোয়েন্দা। পালানোর পথ নেই। সামনে চিতাবাঘ, পেছনে বল্লম-হাতে এক ভালুক!

বিকট গর্জন করে ওদের দিকে লাফ দিলো চিতাটা।

.

১৪.

মাঝপথে অদৃশ্য কোননা দেয়ালে বাড়ি খেয়ে যেন থেমে গেল চিতাবাঘ, ধুপ করে পড়লো মাটিতে। নাকে মুখে ব্যথা পেয়েছে। আহত কুকুরের মতো একবার কুঁইকুই করে আবার ফিরে গিয়ে বসলো আগের জায়গায়। সবুজ চোখ জ্বলছে। ছেলেদের ধরতে না পেরে রেগে গেছে।

কি-ক্কিভাবে, গলা এতো কাঁপছে, কথাই বলতে পারছে না রবিন।

হাত বাড়ালো মুসা। পাতার ওপাশে, মাত্র ফুটখানেক দূরে ঠেকে গেল হাত। কাঁচ! কাঁচের খাঁচায় ভরে রাখা হয়েছে। এতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, দেখিইনি। পুরো খোলা জায়গাটাই একটা বিশাল কাঁচের খাঁচা!

বুঝেছো তাহলে, বললেন লাল-দাড়িওয়ালা লোকটা। তোমাদের কি ধারণা, চিতাবাঘ ছেড়ে রাখবো মানুষের ঘাড় মটকানোর জন্যে?

না,না, মিনমিন করে বললো কিশোর, তা কেন…

রবিন জিজ্ঞেস করলো, ওটাকে কাঁচের খাঁচায় ভরেছেন কেন, স্যার?

নাহলে স্টাডি করবো কিভাবে? কি করে হাঁটে ওটা, পেশী নাড়ায়, হাঁ। করে…না দেখলে আঁকবো কিভাবে? জ্যান্ত হবে ছবি?

 আপনিই আর্টিস্ট! এতোক্ষণে বুঝলো কিশোর। মিস্টার নরম্যান গালিভার, বিখ্যাত…

চিতাবাঘের ছবি আঁকবেন, বললো রবিন।

হ্যাঁ, আঁকবো। আফ্রিকান অনেক কিছুর ছবিই আমি এঁকেছি। ওসব কথা থাক। বল্লমটা নাড়লেন গালিভার। এটা দেখো। আফ্রিকান মাসাই উপজাতির লোকেরা এ-জিনিস দিয়ে সিংহ মারে। ছেলেদের সই করে তুললেন অস্ত্রটা। আরও অনেক কিছু মারা যায়। এই যেমন ধরো, মানুষ। বলো এখন, আমার স্টুডিওতে ঢুকেছো কেন? চুরি করার জন্যে?

আমরা চোর নই, মেজাজ দেখিয়ে বললো মুসা। কেউ তাকে চোর বললে সাংঘাতিক রেগে যায়।

বাহ, রাগও আছে। তাহলে চুপি চুপি আমার বাড়িতে ঢোকার কারণ?

আমরা, স্যার, ডিটেকটিভ, জবাব দিলো কিশোর। কথা বলতে এসেছি। আপনার অ্যাসিসটেন্ট টেরিয়ার ডয়েল…

টেরিয়ার? ওই শয়তানটার সঙ্গে সম্পর্ক? হুঁ তোমরাও বাজে ছেলে। যাও, আগে বাড়ো। পুলিশে দেবো তোমাদের, হাতের বল্লম নাচালেন আর্টিস্ট।

দুর্গের ভেতরে বড় একটা ঘরে ছেলেদের নিয়ে এলেন। শেলফ ভরতি বই। কেমন বিষণ্ণ পরিবেশ।

পুলিশকে ফোন করবেন তো, স্যার? কিশোর বললো। চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে চান।

কেন?

আমাদের নাম বললেই উনি চিনতে পারবেন। তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড, সেই সঙ্গে পুলিশ চীফের সার্টিফিকেটটা বের করে বাড়িয়ে দিলো কিশোর।

সইটা তো আসলই লাগছে। চীফেরই সই কি করে জানবো?

করুন না, তাঁকে ফোন করুন। নইলে আরেক কাজ করতে পারেন। আর্টিস্ট যখন, নিশ্চয় মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের সঙ্গে পরিচয় আছে… 

ফিল্ম প্রডিউসার? ডিরেক্টর?

হ্যাঁ।

সে-ও তোমাদের চেনে নাকি? এইবার সত্যি সত্যি বিপদে পড়লে, ইয়াং ম্যান। মিছে কথা এবার ফাঁস হবে, বলতে বলতে রিসিভারের দিকে হাত বাড়ালেন গালিভার। কানে ঠেকিয়ে ডায়াল করলেন। কে? ডেভিস? আমি নরম্যান। তিনটে ছেলে চুরি করে ঢুকেছে আমার বাড়িতে, বলছে তিন গোয়েন্দা…কি বললে?…হা হা, ওরকমই চেহারা..তাই নাকি?…ভেরি গুড। আচ্ছা, রাখি। গুড বাই। রিসিভার নামিয়ে রেখে ফিরে চেয়ে হাসলেন আর্টিস্ট। নাহ, ফাসাতে পারলাম না তোমাদের। বল্লমটা নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখলেন ঘরের কোণে। তা এখানে কি রহস্যের খোঁজে এসেছো?

মনে হলো পাহারায় ছিলেন, ঘুরিয়ে কথা বললো কিশোর। নিশ্চয় চোর টোরের খোঁজে। জ্বালাতন করছিলো বুঝি?

হ্যাঁ।

ছবি চোর?

তুমি কি করে জানলে? ঠিক চুরি নয়। আমাকে না জানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো, আবার রেখে গেছে। সেজন্যেই তাড়িয়েছি ওকে। তবে আসল রহস্য সেটা নয়। ইদানীং কিছু ভূতুড়ে ছবির পাল্লায় পড়েছি।

ভূতুড়ে! আঁতকে উঠলো মুসা।

এছাড়া আর কি বলবো? আমার স্টুডিও এই খানিক দূরেই। কাল-পরশু দুদিনই ঘটেছে ঘটনাটা। সকালে কাজ করতে গিয়ে দেখি সরে রয়েছে ছবিগুলো। যেখানে রেখেছিলাম, সেখানে নেই, অন্য জায়গায়। আরও কিছু জিনিসপত্রও অবশ্য নড়েছে। তবে কিছু চুরি যায়নি।

যে ছবিগুলো নড়ে, ওগুলো কি ওই ছবিটার সঙ্গের? যেটা নিয়ে গিয়ে আবার ফিরিয়ে দিয়েছে টেরিয়ার? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

হ্যাঁ। একটা জাঙ্কইয়ার্ড থেকে কিনেছিলাম।

তাহলে ভূতের ব্যাখ্যা বোধহয় দিতে পারি। রিগ ডেনবার, কাউন্টেস, ফ্রেড ব্রাউন আর জন ফেরেনটির কথা বললো কিশোর। কয়েক দিনে যা যা ঘটেছে, তা ও বললো। সবশেষে বললো, তাহলে বুঝতেই পারছেন, ছবিগুলো পরীক্ষা করে দেখার জন্যেই কেউ ঢুকেছিলো আপনার স্টুডিওতে।

 না, পারছি না, মাথা নাড়লেন গালিভার। নাড়াচাড়া করা হয়েছে রাতের ও বেলা। আর রাতে, স্টুডিওর জানালা সব বন্ধ করে দিই আমি। দরজায় তালা লাগিয়ে রাখি।

.

১৫.

চোর ঢোকার কোনো পথই রাখি না, আবার বললেন গালিভার। দেখতে চাও?

তিনজনেই জানালো, চায়।

চিতার খাঁচার পাশ কাটিয়ে, সরু বুনোপথের ভেতর দিয়ে আরেকটা পাথরের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা। জানালায় মোটা মোটা লোহার শিক। দরজার পাল্লা লোহার। বিরাট তালা লাগানো। ওটা খুলতে দক্ষ তালার মিস্ত্রীরও অন্তত একটি ঘন্টা ব্যয় হবে।

কাছে গিয়ে ভালোমতো তালাটা দেখলো কিশোর। কোনো দাগ নেই, সামান্যতম আঁচড়ও নেই। তার মানে জোর করে ভোলা হয়নি তালা।

চাবি দিয়ে তালা খুললেন আর্টিস্ট।

ভেতরে ঢুকলো সবাই।

দরজার কব্জা ভেতরের দিকে, ওগুলোতেও কোনো দাগ নেই। আর, বাইরে থেকে ওই কজা ভাঙা অসম্ভব। ঘরের দরজাও ওই একটাই।

বেশ বড় ঘর। সাজানো স্টুডিও। যা যা জিনিস দরকার, সব আছে। তাক আছে অনেকগুলো, তাকে ছবি আঁকার সরঞ্জাম সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দুটো জানালা, পাল্লাগুলো ভেতরের দিকে খোলে। একটা স্কাইলাইট দিয়ে আলো আসছে, ওটা খোলেই না। কোনো ফায়ার প্রেস নেই, স্টোভ নেই। এদিকের দেয়ালে ছোট একটা একজস্ট ফ্যান লাগানো, লম্বা কর্ড, সকেটে ঢোকানো প্লগ। পাথরের নিরেট মেঝে, তলায় বেসমেন্ট বা কোনো ধরনের পাতালঘর নেই। দেয়াল বা মেঝের কোথাও একটা ফোকর নেই যে চোর ঢুকবে।

ভূতেই তো নাড়ায় দেখছি! বিড়বিড় করলো মুসা।

ছবিগুলো কোথায়? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

ওই তো, র‍্যাকে, হাত তুলে দেখালেন গালিভার।

দেখতে পারি?

নিশ্চয়। দেখো।

সাবধানে ছবিগুলো নামালো কিশোর। বিশটা ছবিই আছে। এক এক করে পাশাপাশি সাজালো সে। ওই তাকে কেন রেখেছেন, স্যার? ওখানে তো সব বাতিল ক্যানভাস দেখছি।

বাতিলই তো। এগুলোও বাতিল বলেই কিনেছি। এগুলোর ওপর নতুন ছবি আঁকার জন্যে। অনেক আর্টিস্টই তাই করে।

 হ্যাঁ, তা করে। তাহলে আপনার ধারণা, এই ছবিগুলো কোনো কাজের নয়?

আমার কাছে তো নয়। রিগ ডেনবারের নামও শুনিনি কোনোদিন। তবে, আঁকার হাত ছিলো লোকটার। ভাবতে অবাকই লাগে, লোকটা বিখ্যাত হলো না কেন? কেন তার নাম কেউ জানলো না?

ছবি কখনও বেচেনি তো, তাই, মুসা বললো।

হতে পারে। তবে দুনিয়া যে একজন ভালো আর্টিস্টকে হারালো, একথা মানতেই হবে। কিন্তু

আপনার কাছে এগুলোর দাম নেই, কিশোর বললো। কিন্তু অন্য কারো কাছে হয়তো আছে? অনেক দাম দিয়ে কিনতে চায়? হতে পারে না এরকম?

পারে, চিন্তিত ভঙ্গিতে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন গালিভার। তবে সন্দেহ আছে। সেরকম বুঝলে আমিও নষ্ট করবো না। এই ছবিগুলো তেমন ভালো না, ঠিক, কিন্তু লোকটার হাত ছিলো অসাধারণ,। ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারতো সে। এই দেখো না, বিশটা ছবি বিশ রকম ভাবে এঁকেছে। যেন। বিশজনের আঁকা। এই গুণটা অনেক বড় আর্টিস্টেরও থাকে না। ফলে একঘেয়ে হয়ে যায় তাদের ছবি।

তাহলে এই ছবিগুলোকে খারাপ বলছেন কেন? প্রশ্ন করলো রবিন।

কারণ, এগুলোতে কেমন যেন নকল, নকল একটা ভাব। অন্য আর্টিস্টের স্টাইল চুরি করেছে ডেনবার, তার সঙ্গে নিজের কিছু মিশিয়েছে, পুরোপুরি নিজস্ব নয়। অ্যাডাপটেশন বলতে পারো।

গভীর মনোযোগে ছবিগুলো দেখছে কিশোর। ফ্রেম নেই, সাধারণ কাঠে। ক্যানভাসটা ছড়িয়ে আটকে নিয়ে ছবি আঁকা হয়েছে।

এগুলোতে কিছু লুকানো নেই, মুসা বললো। আর ছবিতে কোনো মেসেজও নেই।

না, নেই, বললো কিশোর। চেয়েই রয়েছে ছবিগুলোর দিকে। প্রত্যেকটা ছবি যেন রেমুডা ক্যানিয়নের কটেজের প্রতিবিম্ব। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছো? প্রত্যেকটাতে সিরিয়াল নম্বর দেয়া আছে।

তাই তো! ভুরু কোঁচকালো মুসা। কিশোর বলার আগে নজরে পড়লো না। কেন? একেই বলে সূক্ষ্ম দৃষ্টি। রবিন দেখলো। গালিভারও দেখলেন নম্বরগুলো।

ক্রমিক নম্বর অনুসারে ছবিগুলো পর পর সাজালো কিশোর। এক নম্বরটায়। ক্লোজ-আপ, সবচেয়ে বড়, পরেরগুলোয় ধীরে ধীরে ছোট হয়ে গেছে। শেষ ছবিটায় এতো ছোট, ঘরের চেহারা অস্পষ্ট, প্রায় বোঝাই যায় না।

তো, কি বোঝা যাচ্ছে? ভুরু নাচালো মুসা।

আমি কিছু বুঝছি না, রবিন বললো।

ভালো করে দেখো, বললো কিশোর। ধীরে ধীরে ছোট করে ফেলা হয়েছে কটেজটাকে, সঙ্কুচিত। গাছপালা, পাথর, ক্যানভাসের  চেয়ার, ডোরাকাটা ছাউনি, সব কিছুর আকার একই রকম রেখেছে, শুধু ছোট করেছে ঘরটাকে। এই যে দেখো না, শেষটায় ছাউনিটা ছাড়া ঘরের আর কিছুই বোঝা যায় না।

বেশ, দেখলাম। কিন্তু তাতে কি? বললো মুসা।

 ভূতুড়ে ছবির সঙ্গে যোগ হলো সঙ্কুচিত ছবির রহস্য, হাসলেন আর্টিস্ট। ঠেলা সামলাও এখন।

কিছু থাকলে এই ছবিগুলোতেই আছে, আনমনে বললো কিশোর। রাতের বেলা চোর এসে এজন্যেই এগুলোকে নাড়াচাড়া করে।

এখানে কেউ ঢুকতে পারে না, কিশোর। জোর দিয়ে বললেন গালিভার।

কিন্তু ছবি তো আর আপনাআপনি নড়তে পারে না। ভূত বলেও কিছু নেই। লম্বা একটা বেঞ্চের ওপর বসে পড়লো কিশোর, পুরো বেঞ্চটাই ঢেকে রাখা হয়েছে। বড় একটা কম্বল দিয়ে। স্টুডিওর ভেতরে চোখ বোলালো সে।

গালিভার বসলেন একটা কাউচে। রবিন আর মুসা বসলো দুটো আর্মচেয়ারে।

চোর কে জানতে পারলে হতো, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। তাহলে হয়তো বুঝতাম, ছবিগুলো তার কেন দরকার?

জানার উপায় কি? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

উঠে, স্টুডিওর একমাত্র দেয়াল আলমারিটার দিকে এগিয়ে গেল গোয়েন্দা প্রধান। পাল্লা খুললো। আলমারির ওপর দিকে দুটো তাক। নিচের অংশটা বড়। ওপরের তাকে আর নিচে সাজানো রয়েছে রঙের কৌটা, ব্রাশ, ছবি আঁকার অন্যান্য সরঞ্জাম। পেছনে নিরেট পাথরের দেয়াল। ফিরে তাকালো সে। জানার একটাই উপায়। আমাদের কাউকে লুকিয়ে থাকতে হবে এখানে।

বেশ, বললেন গালিভার, আমিই থাকবো।

না, আপনি থাকলে হবে না। দরজা-জানালা বন্ধ করে চোরকে দেখিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে আপনাকে। নইলে সে আসবেই না।

তাহলে কে থাকবে?

আমাদের একজন। মুসা, তুমি থাকবে। আপত্তি আছে?

না। তোমরা কি করবে?

আমাদের অন্য কাজ আছে। ভয় পাবে না তো?

ভূত হলে পাবো। আর চোর এলে তো ধরে কিলই শুরু করবো। ভয় কিসের?

হেসে উঠলো কিশোর আর রবিন। এমনকি আর্টিস্টও লাল দাড়ি নাচিয়ে হাহ হাহ করে হাসলেন। ভূত হলেও ভয় নেই। বাইরেই লুকিয়ে থাকবো আমরা। তোমার চিৎকার শুনলেই এসে পড়বো।

কিভাবে পাহারা দেয়া হবে, তার একটা ছক তৈরি করে সবাইকে শোনালো কিশোর। তারপর দুই সহকারীকে নিয়ে বেরিয়ে এলো স্টুডিও থেকে। বাড়ি ফিরে চললো।

তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে আবার গালিভারের বাড়িতে রওনা হলো কিশোর আর মুসা। রবিন আসতে পারলো না, জরুরী কাজে তাকে ডেকে নিয়ে গেছেন মা। ঘন বনের ভেতর দিয়ে নীরবে এগিয়ে চললো দুজনে। থামলো এসে স্টুডিওর সামনে। চুপ করে বসে রইলো কিছুক্ষণ। সন্দেহজনক আঁওয়াজের আশায় কান পেতে রইলো। কিছু শোনা গেল না। মুসার গায়ে কনুই দিয়ে গুঁতো দিলো কিশোর।

ঝোপ থেকে বেরিয়ে এক ছুটে খোলা দরজা দিয়ে স্টুডিওতে ঢুকে পড়লো মুসা। আলমারির ভেতর লুকিয়ে বসলো। পাল্লা ফাঁক করে রাখলো কয়েক ইঞ্চি। যাতে ঘরের ভেতর চোর ঢুকলে দেখতে পায়।

সূর্য ডোবার আগে আগে শব্দ করে জানালা বন্ধ করলেন গালিভার। বাইরে বেরিয়ে দরজায় তালা দিলেন। রোজকার মতোই। তারপর চললেন বাড়ির দিকে।

১৬.

বাইরে রাত নামছে। আলমারির ভেতরে কি আর আরাম করে বসা যায়? বেকায়দা অবস্থায়ই রয়েছে মুসা। এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে হাত-পায়ে খিল ধরে যাবে, নিদেনপক্ষে ঝিঁঝি যে ধরবে, তাতে তার কোনো সন্দেহ নেই।

এক ঘন্টা পেরোলো।

 কিছুই ঘটলো না। আলমারিতে বসে থাকতে খুব খারাপ লাগছে মুসার। বদ্ধ ঘর, গরম হয়ে উঠছে। আলমারির ভেতরে গুমোট আরও বেশি। বাইরের খোলা বাতাসে কিশোর আর গালিভার বেশ আরামে রয়েছে ভেবে কষ্ট যেন বেড়ে গেল। তার। অবশ হয়ে আসছে পা।

খিদে পেলো তার। সঙ্গে করে স্যাণ্ডউইচ নিয়ে এসেছে। বের করে খেতে শুরু করলো।

পেরোলো আরও এক ঘন্টা।

.

ঝোপের ভেতর আলোআঁধারি সৃষ্টি করেছে উজ্জ্বল জ্যোৎস্না। ঘাপটি বসে দরজার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর আর গালিভার।

দশটা বাজলো। ইতিমধ্যে কাউকে দেখা গেল না। নীরব স্টুডিও।

অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে না। খাঁচার ভেতরে চিতাবাঘটার পদচারণা, মাঝে মাঝে চাপা গোঙানি। পোকামাকড়ের ডাক আর নিশাচর ছোট ঘোট জীবের আনাগোনা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

একভাবে বসে থেকে পা ব্যথা হয়ে গেছে। এক পা থেকে আরেক পায়ে শরীরের ভার বদল করলো কিশোর।

কিছুই ঘটছে না।

ঘুম তাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে মুসা। এই বেকায়দা অবস্থা আর অসহ্য গরমেও চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে তার। কেমন যেন শূন্য লাগছে মাথার ভেতরটা। এমন তো হয় না। এতে খারাপ লাগছে কেন?

 কিছুতেই খুলে রাখতে পারছে না চোখের পাতা। দুবার ঢলে পড়লো তন্দ্রায়। তৃতীয়বার দীর্ঘ তন্দ্রা থেকে চমকে জেগে উঠে মাথা ঝাড়া দিলো। হঠাৎ বুঝতে পারলো, এরকম লাগার কারণটা।

বাম্প!

আলমারি ভরা রঙ, রঙ গোলানোর তেল আর অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য। ভ্যাপসা গরমে ওগুলো থেকে বাষ্প বেরোচ্ছে, বিষাক্ত করে তুলছে আলমারির বাতাস। আর সেই বাতাস ফুসফুঁসে ঢোকাতেই এই অস্বাভাবিক তন্দ্রা।

ভাবতে ভাবতেই আবার ঘুমিয়ে পড়লো মুসা। কতোক্ষণ পরে জানে না, চোখ মেললো। ঘোলাটে হয়ে আছে মাথার ভেতর, ফলে দৃষ্টি অস্বচ্ছ।

ঘরের ভেতরে ঢুকেছে কিছু একটা! স্কাইলাইট দিয়ে চাঁদের আলো আসছে, সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে বটে ওটাকে, কিন্তু স্পষ্ট নয়।

মাথা ঝাড়া দিলো মুসা। সে-কি জেগে আছে? নাকি এখনও ঘুমিয়ে? আশ্চর্য এক ধরনের অনুভূতি! ঘন তরলের মাঝে সাঁতার কাটছে যেন তার মন। কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছে না। এই

স্টুডিওর ভেতরে নড়ছে কিছু। চাঁদের আলোয় হালকা একটা কি যেন, ভেসে বেড়াচ্ছে! কাঁপা কাঁপা একটা মূর্তি নিচু হয়ে যেন তুলে নিলো একটা ছবি, ভাসতে ভাসতে এগিয়ে গেল জানালার কাছে, পলকে বাতাসে মিলিয়ে গেল যেন ছবিটা!

ভূতুড়ে মুর্তিটা দাঁড়িয়েই রয়েছে জানালার কাছে। নড়ে না আর। যুগ যুগ বুঝি পেরিয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু পুরোপুরি সজাগই হতে পারছে না মুসা, ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন, একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে যেন।

আবার ছবিগুলোর কাছে ফিরে এলো মূর্তিটা। নিচু হয়ে তুলে নিলো আরেকটা ছবি। আবার গেল জানালার কাছে। গায়ের হয়ে গেল ছবিটা।

দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো মুসা। পা নড়তে চাইছে না।

তার দিকে ভেসে আসছে মূর্তিটা।

গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে চাইলো মুসা।

.

চাপা চিৎকার শুনতে পেলো কিশোর আর গালিভার। স্টুডিওর ভেতর থেকে এসেছে।

লাফ দিয়ে উঠে দরজার দিকে দৌড় দিলো দুজনে।

তাড়াতাড়ি তালা খুললেন গালিভার।

বাইরের আলোর তুলনায় ঘরের ভেতরে অন্ধকার। দরজার পাশেই সুইচ, বোর্ড। আলো জ্বেলে দিলো কিশোর।

শুন্য ঘর।

আলমারির কাছে ছুটে গেল দুজনে। মেঝেতে বসে রয়েছে মুসা। মাথা ঝুলে পড়েছে বুকের ওপর। সাড়া পেয়ে অনেক কষ্টে সোজা করলো। চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি।

সর্বনাশ! সলভেন্ট আর থিনারের বাম্প! চেঁচিয়ে উঠলেন আর্টিস্ট। ধরো। ধরো, বের করো ওকে।

টেনে আলমারি থেকে বের করা হলো মুসাকে। দাঁড়াতে পারছে না। অসাড় হয়ে গেছে পা।

বগলের নিচে ধরে জোর করে তাকে দাঁড় করালো দুজনে মিলে। হাঁটানোর চেষ্টা করলো। ধীরে ধীরে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে এলো, দাঁড়াতে পারলো মুসা। জোরে নিঃশ্বাস ফেললো।

কি হয়েছিলো? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

ভালোই ছিলাম, ক্লান্ত কণ্ঠে বললো মুসা, কখন জানি ঘুম এসে গেল! চোখ খুলে রাখতে পারলাম না কিছুতেই। তার ঘোরেই দেখলাম ভূতটাকে…

আরি! চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। জানালার দিকে চেয়ে আছে।

একদিকের জানালার নিচে পড়ে রয়েছে ডেনবারের একটা ছবি। জানালার পাল্লা খোলা!

বললাম না, ভূত! কেঁপে উঠলো মুসা। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ধপ করে, বসে পড়লো কম্বলে ঢাকা বেঞ্চটার ওপর। ধীরে ধীরে জানালো, কি করে ছবি সরিয়েছে ভূতটা।

নিশ্চয় কেউ ঢুকেছিলো, বললো কিশোর।

আমিও তো তা-ই বলছি ভূত!

আরে দূর! হাত নাড়লো কিশোর। তুমি তো ছিলে আধাবেহুশ হয়ে। মানুষটাকেই ভূত ভেবেছে।

তাহলে মানুষটা কোথায়? দাড়ি নাচালেন গালিভার। ঢুকলো কিভাবে? ওই জানালা দিয়ে কেউ ঢুকতে পারবে না।

অন্য কোনো পথ দিয়ে ঢুকেছে। হঠাৎ চকচক করে উঠলো চোখ। ওই যে, ওই দেখুন!

তাকালো মুসা আর গালিভার। একজস্ট ফ্যানটা যেখানে ছিলো, সেখানেই এখন একটা চৌকোণা ফোকর। ফ্যানটা নেই। টানটান হয়ে রয়েছে তার, প্লগটা : সকেটেই ঢোকানো।

এগিয়ে গিয়ে তার ধরে আস্তে টানলো কিশোর। বাইরের দেয়ালে ঘষা লেগে মৃদু শব্দ হলো। ফ্যানের স্কু ঢিল করে রাখা হয়েছিলো, মিস্টার গালিভার। বাইরে থেকে সহজেই খুলে ফেলেছে ভূতটা। ফোকরের ভেতর দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে কর্ডে।

কিন্তু কিশোর, প্রতিবাদ করলো মুসা, গর্তটা দেখছো না কতো ছোট? বড়; জোর একফুট বাই, একফুট। ওখান দিয়ে মানুষ ঢুকতে পারবে না।

পারবে, যদি তোমার মতো শরীর বড় না হয়। এমন কেউ ঢুকেছে, যার শরীর খুব সরু।

হাঁ করে ফোকরটার দিকে চেয়ে আছেন আর্টিস্ট। মাথা নাড়ছেন আস্তে আস্তে, বিহ্বল হয়ে গেছেন যেন।

এখন আরেকটা কথা, তর্জনী নাড়লো কিশোর। মুসা চেঁচিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এসে ঢুকেছি। এতো তাড়াতাড়ি পালাতে পারেনি চোর।

ঘরের চারপাশে চোখ বোলালেন গালিভার। তাহলে গেল কোথায়? এখানে, তো নেই।

কই? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

মুসার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কিশোর।

কি হলো?

জানি, কোথায় আছে, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর।

 কোথায়?

ওর ওপরই বসে আছে।

ছিটকে সরে এলো মুসা, যেন বোলতায় হুল ফুটিয়েছে। বড় বড় চোখ করে তাকালো কম্বলে ঢাকা বেঞ্চটার দিকে।

ভারি গলায় ডাকলো কিশোর, এই, বেরিয়ে এসো। আমি জানি, তুমি আছো ওখানে।

এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর নড়ে উঠলো কম্বল। উঁকি দিলো একটা মুখ

 চোখ মিটমিট করলেন গালিভার।

 শুঁটকি! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

.

১৭.

ঘরের কোণে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে টেরিয়ার। চেহারা ফ্যাকাশে। মোটা একটা ডাণ্ডা নিয়ে তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মুসা। উঠলেই মারবে বাড়ি।

ওখানে ঢুকেছে, কি করে বুঝলে? জিজ্ঞেস করলেন গালিভার।

কম্বলটা সরানো দেখলাম, জবাব দিলো কিশোর। বিকেলে অন্যরকমভাবে রাখা ছিলো।

টেরিয়ারের দিকে ঘুরলেন গালিভার। শেষ পর্যন্ত চুরি করতে ঢুকেছো?

আমাকে বরখাস্ত করলেন কেন? তেজ দেখিয়ে বললো টেরিয়ার।

তাই বলে চুরি করবে? আর বরখাস্ত কি অন্যায়ভাবে করেছি? আমাকে না। জানিয়ে ছবি নিয়ে গেলে…

ফেরত দিয়েছি আবার। মেরে তো দিইনি।

ওই ছবি তোমার কি দরকার? এতো আগ্রহ কেন?

সেকথা আপনাকে বলতে যাবো কেন?

জানালা দিয়ে পাচার করতে চেয়েছো, বললো কিশোর। কার কাছে? ছবিগুলো নিয়ে সে কি করবে?

আমি কিচ্ছু বলবো না।

লোকটা কি জন ফেরেনটি? ডাণ্ডা নাচালো মুসা।

 আড়চোখে ডাণ্ডার দিকে তাকালো টেরিয়ার। নামই শুনিনি।

দেখো ছোকরা, ধৈর্য হারালেন গালিভার।.বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না। চুরি করতে ঢুকেছো, হাতেনাতে ধরা পড়েছে। পুলিশকে ফোন…

পু-পুলিশ! আঁতকে উঠলো টেরিয়ার। দোহাই আপনার, ফোন করবেন না। বাবা তাহলে মেরে ফেলবে…

খবরদার! জানালার বাইরে থেকে বলে উঠলো একটা চাপা কণ্ঠ, কেউ নড়বে না। আমার হাতে পিস্তল আছে। টেরিয়ার, জলদি বেরোও।

কণ্ঠস্বরটা চেনা গেল, না, বিকৃত।

নড়লো না কেউ, শুধু টেরিয়ার উঠে দাঁড়ালো। ছুটে বেরিয়ে গেল। ঝনঝন। করে বন্ধ হয়ে গেল লোহার দরজা।

গেল! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। এতো কষ্ট সব বিফল।

যাবে কোথায়? সান্ত্বনা দিলেন গালিভার। দরকার হলে পুলিশকে জানাবো। বাড়ি থেকে গিয়ে ধরে আনবে।

চোর কে, সেটা জানা গেল, বললো কিশোর। আরও বোঝা গেল, কারও সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছে টেরিয়ার। কিন্তু কার সঙ্গে, কেন, করছে জানি না। ডেনবারের ছবি দিয়ে ওই লোকটা কি করবে?

চুরির উদ্দেশ্য ছিলো না, জানালার নিচের ছবিটা দেখিয়ে বললো মুসা। শুঁটকি দিয়েছে, লোকটা নিয়ে আবার ফিরিয়ে দিয়েছে। সেটা আরেক রহস্য!

ছবিটা তুলে আনলো কিশোর। মাথা নেড়ে বললো, কোনো মেসেজ আছে। কিনা বোঝা যাচ্ছে নাঃ স্যার, দেখুন তো! এই কোণটা ভিজে লাগছে!

ভেজা? ছুঁয়ে দেখলেন গালিভার। তাই তো। রিটাচ করেছে।

কেন করলো? মুসাও ছুঁয়ে দেখলো।

ভিজে কোণটা ডলে দেখলেন গালিভার। নিচে অন্য কোনো ছবি আঁকা রয়েছে কিনা দেখেছে হয়তো। তারপর আবার রঙ দিয়ে রিটাচ করে আগের মতো করে রেখেছে।

ছবিটার দিক থেকে চোখ সরালো না কিশোর। বিড়বিড় করলো, অন্য কোনো ছবি…! ঝট করে মুখ তুললো। স্যার, টেলিফোন কোথায়? এখুনি। দরকার। জরুরী!

.

আধ ঘন্টা পর। বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন গালিভার, কিশোর আর। মুসা। রিকিকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে করে এলেন প্রফেসর হোফার।

আর্টিস্টের সঙ্গে প্রফেসরের পরিচয় করিয়ে দিলো কিশোর।

কি হয়েছে, কিশোর? জানতে চাইলো রিকি।

চলো, স্টুডিওতে। বলছি।

ডেনবারের ছবিগুলো দেখেই চিনতে পারলেন প্রফেসর আর তাঁর ছেলে।

 পেয়ে গেছো? চেঁচিয়ে উঠলো রিকি।

কাউন্টেসকে জানিয়েছো? জিজ্ঞেস করলেন- প্রফেসর। শুনে খুশি হবেন।

এখনও জানাইনি, জবাব দিলো কিশোর। আপনাদের ফোন করেছি, তার কারণ, আমার ধারণা ছবিগুলো খুবই মূল্যবান। অনেকেই চাইবে।

চাইবে? মুসার কণ্ঠে সন্দেহ।

হ্যাঁ। রিকি, অ্যাডোবের। সেই সোনালি ফ্রেমটা…বলেছিলে, একসময় ওটাতে একটা ছবি লাগানো ছিলো।

সোনালি ফ্রেম! প্রফেসর বললেন। কই, ওরকম ফ্রেম লাগানো কোনো ছবি দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না? ছেলের দিকে তাকালেন প্রফেসর।

বাবা, রিকি বললো, রিগ ডেনবার যখন প্রথম আমাদের বাড়িতে এলো, একদিন হঠাৎ করেই দেখে ফেললাম। চমকে গেল, বুড়ো। জানালো, ওটা নাকি একটা ইমিটেশন, প্রিন্ট, ফেলে দেবে। তারপর আর একবারও দেখিনি। ফ্রেমটাই। শুধু পড়ে ছিলো অ্যাডোবে।

ছবিটা কেমন ছিলো? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

মাথা চুলকালো রিকি। এই, পাহাড়-পর্বত, ঘোড়া, পাম গাছ, ঘাসের কুঁড়ের সামনে কয়েকজন প্রায় উলঙ্গ মানুষ…পাহাড়ের রঙ বেগুনী, ঘোড়াগুলো নীল, পাম গাছ হলুদ, আর মানুষগুলো লাল

কী! চেঁচিয়ে উঠলেন–গালিভার। চকচক করছে চোখ। সত্যি ওরকম ছিলো?

হ্যাঁ। উল্টোপাল্টা রঙ।

ছবিটা চিনতে পেরেছেন, স্যার? কিশোর বললো।

এক মিনিট! তাড়াতাড়ি গিয়ে তাক থেকে বিরাট একটা বই নামালেন আর্টিস্ট। দ্রুত পাতা উল্টে এক জায়গায় এসে থামলেন। এই যে। রিকি, এরকম ছিলো ছবিটা?

একনজর দেখেই বলে উঠলো রিকি, হ্যাঁ, অবিকল এরকম।

কি জিনিস দেখেছো তুমি জানো না, রিকি! ওটা বিখ্যাত এক ফেঞ্চ আর্টিস্ট ফ্র্যাঙ্কোই ফরচুনার্দ-এর আঁকা। একটা মাস্টার পীস। জার্মানরা দেখতে পারতো না তাঁকে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর আঁকা যতো ছবি পেয়েছে নষ্ট করে দিয়েছে নাৎসী সৈন্যরা। কি বলবো তোমাদেরকে, ছবির জগতে এ-এক অসামান্য। ক্ষতি…, মুখের ভাব দেখে মনে হলো কেঁদে ফেলবেন বুঝি শিল্পী। যা-ই হোক, একটা ছবিও যদি অন্তত পাওয়া যায়..রিকি, কি বলেছিলো ডেনবার? প্রিন্ট? কিন্তু ওই ছবিটার তো কোনো প্রিন্ট হয়েছিলো বলে জানি না!

তাহলে ওটা আসল, বললো কিশোর। কোনোভাবে বুড়ো ডেনবারের হাতে এসে পড়েছিলো?

খাইছে! গালিভারের দিকে তাকালো মুসা। দাম আন্দাজ কতো হতে পারে?

অনেক, অনেক টাকা। এসব জিনিসের দাম কতো উঠবে, আন্দাজ করা মুশকিল। কিশোর, তুমি সত্যি ভাবছো…

ভাবছি না, স্যার। আমি শিওর। প্রলাপ বকার সময় মাস্টার শব্দটা বলেছে। ডেনবার। তারমানে বলতে চেয়েছে মাস্টার পীস। অর্থাৎ ছবিটা আসল। আমার মনে হয়, ওই বিশটা ছবির কোনোটার নিচে লুকানো

কিশোরের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘুরে দাঁড়ালেন গালিভার। সলভেন্ট নরম কাপড় আর আরও কিছু সরঞ্জাম নিয়ে কাজে বসে গেলেন। একটা একটা করে ছবি নিয়ে খুব সাবধানে ঘষে দেখলেন, কোণের দিকটায়। তারপর আবার আগের মত রিটাচ করে রাখলেন।

আধ ঘন্টা পর নিরাশ হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। না, নেই। কিশোর, তোমার ভুল হয়েছে। আসল ছবিটা নেই।

ঠোঁট কামড়ালো কিশোর। ভুল আমি করিনি, স্যার। এগুলোর নিচে যখন নেই, নিশ্চয় অন্য কোথাও আছে। আর এই ছবিগুলো তার চাবিকাঠি, আমার তা-ই বিশ্বাস।

এগিয়ে এলেন প্রফেসর। অনেক রাত হয়েছে। ছবিগুলো আমি নিয়ে যাই। কাল কাউন্টেসকে দিয়ে দেবো। আপনার যা খরচ হয়েছে, সেটা আমি দিয়ে দেবো, মিস্টার গালিভার। :

প্রফেসরের গাড়িতে ছবিগুলো তুলে দিতে সাহায্য করলো ছেলেরা।

প্রফেসর আর রিকি চলে গেলে গোয়েন্দাদের বললেন :গালিভার, তোমরা এখানেই থেকে যাও। এতো রাতে আর গিয়ে কাজ নেই। বাড়িতে ফোন করে দাও। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, কাল সকালে দেখবো, শুঁটকির ব্যাপারে কি। করা যায়।

.

১৮.

পরদিন সকালে। হেডকোয়ার্টারে বসে আছে কিশোর আর রবিন।

আমারও মনে হয়, রবিন বললো। আসল ছবিটা পায়নি ডেনবার। আমিও যতোদূর জানি, ফরচুনার্দের সব ছবি নষ্ট করে ফেলেছিলো নাৎসীরা।

কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওই একটা ছবি নষ্ট করতে পারেনি। ডেনবারের হাতে পড়েছিলো। রিকি দেখে ফেলেছিলো। তাকে মিথ্যে বলেছে বুড়ো, বলেছে ওটা প্রিন্ট। তারপর, যখন অসুখে পড়লো, ঘোরের মধ্যেই একটা মেসেজ রেখে যাওয়ার চেষ্টা করলো। জানাতে. চাইলো, ছবিটা কোথায় লুকিয়েছে। কাগজের পাতাটা আবার বের করলো কিশোর। আঁকাবাঁকা বলে দিক নির্দেশ করতে চেয়েছে বুড়ো, বুঝলাম। কিন্তু ভুল মনে হবে বলে কি বোঝাতে চেয়েছে? ভুল : কিছু খুঁজতে বলেছে হয়তো। এমন কিছু দেখে যা মনে হয়, হয়তো আসলে তা নয় ওটা।

ভুলভাবে কিছু করা হয়েছে বলছো?

তা-ই। মাস্টার মানে মাস্টার পীস। আমার ছবি, আমার ক্যানভাস, আর ক্যানভাস থেকে আঁকাবাঁকা, এই কথাগুলো বলে নিশ্চয় বোঝাতে চেয়েছে তাঁর কুড়িটা ছবির মধ্যেই রয়েছে ধাঁধার সূত্র। ওই ছবিগুলোই বলে দেবে কোথায় রয়েছে আসল ছবিটা।

তাহলে সূত্রটা কি?

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো কিশোর। সেটাই তো বুঝতে পারছি না। সব চেয়ে বেশি যেটা চোখে লেগেছে, ছবিগুলোতে কটেজটার আকার। ধীরে ধীরে ছোট করে ফেলা হয়েছে। অথচ আশপাশে আর যা যা রয়েছে, সব কিছুর আকার একই রেখেছে। কেন?

ভাবছে রবিন। কিছু বুঝতে পারছে না।

মুসা আসুক, বললো কিশোর। দেখি, শুঁটকি ওদেরকে কি বলে?

ও-ব্যাটা বলবে?

মিস্টার গালিভার সঙ্গে গেছেন তো। পুলিশের ভয় দেখালে হয়তো বলবে।

আমার মনে হয় না।

সেটা মুসা এলেই জানা যাবে।…আচ্ছা, রবিন, আরেকটা কথা মনে আছে। তোমার? রিকিকে নাকি বলেছিলো ডেনবারঃ আমি দুনিয়ার সব চেয়ে দামী আর্টিস্ট! কিন্তু কেউ সেটা জানে না। তারপর হেসে উঠেছিলো বুড়ো। কেন হাসলো? কি বোঝাতে চেয়েছিলো?

হয়তো মাস্টার পীসটা তার কাছে ছিলো বলে…

ভেবেছি সেকথা। কিন্তু তার কথার ধরনে তো মনে হয়, নিজের ছবিগুলোর কথাই বলেছে সে। ওগুলো অনেক দামী, এবং কেউ সেটা জানে না।

কিশোর, মেসেজটা কার জন্যে রেখে গিয়েছিলো…

ট্রেলারের নিচে শব্দ হলো। দুই সুড়ঙ্গের ঢাকনা উঠে গেল। ভেতরে ঢুকলো। মুসা। দুই বন্ধুর দিকে চেয়ে মাথা নাড়লো। পাওয়া যায়নি। পুঁটকি গায়েব। কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি। তার মায়ের ধারণা, শুঁটকিকে কিডন্যাপ করা হয়েছে।

কিডন্যাপ! ভুরু কোঁচকালো রবিন।

কে করেছে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

শুঁটকির মা জানে না। বললো, তাদের বাড়ির আশপাশে নাকি একটা নীল সেডানকে ঘুরঘুর করতে দেখেছে। আর ওই গাড়ির লোকটার সঙ্গে কথা বলেছে শুঁটকি।

জন ফেরেনটি! বললো কিশোর।

শুঁটকির মা আরও বললো, ওদের টেলিফোন লাইনও নাকি ট্যাপ করা হয়েছে। সেটা তো আমরাই করতে দেখেছি।

হ্যাঁ, মাথা ঝোঁকালো কিশোর। নিচের ঠোঁটে জোরে জোরে চিমটি কাটলো কয়েকবার। ওর কিডন্যাপ হওয়াটা একটা কথাই প্রমাণ করে, শুঁটকি অনেক কিছু জানে। তাই তাকে ধরে নিয়ে গেছে। কাউকে যাতে কিছু বলতে না পারে।

মেরে না ফেলে! বললো রবিন।

ফেলতেও পারে! ওর জন্যে আমাদের কিছু করার নেই। সেটা পুলিশ দেখবে। চলো এখন, রেমুডা ক্যানিয়নে যাবো।

.

১৯.

সাইকেল চালাতে চালাতে জানালো মুসা, শুঁটকিকে বাড়িতে না পেয়ে থানায় গেছেন মিস্টার গালিভার। রাতে তার স্টুডিওতে যেসব ঘটনা ঘটেছে, জানানোর জন্যে। শুঁটকির বাবাও নাকি গেছে পুলিশের কাছে, ছেলে নিখোঁজ হয়েছে সেকথা জানাতে।

ক্যানিয়নে পৌঁছলো তিন গোয়েন্দা।

কটেজের চতুরে দাঁড়িয়ে ছিলো রিকি, ওদেরকে দেখে দৌড়ে এলো। উত্তেজিত। বললো, জানো, আজ সকালেও কে জানি এসে কটেজে ঢুকেছিলো! তছনছ করে দিয়ে গেছে।

ছবিগুলো কটেজে রেখেছিলে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

না, আমাদের ঘরে। সকালে কাউন্টেসকে ফোন করার চেষ্টা করেছে বাবা, পায়নি। তারা নাকি বাইরে গেছে। শেষে, বাবা গাড়ি নিয়ে নিজেই গেছে। মোটেলে বসে থাকবে। কাউন্টেস ফিরলেই তাকে ধরবে, জানাবে ছবিগুলোর কথা।

সকালে কাউকে দেখেছো এখানে?

হ্যাঁ। গ্যারেজের কাছে। পলকের জন্যে দেখেছি, চিনতে পারিনি। ছুটে চলে গেল নালার দিকে। তারপরই গিয়ে দেখলাম কটেজের ওই অবস্থা।

গ্যারেজের আশপাশে দেখেছো? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

না।

 চলো, দেখি গিয়ে, বললো রবিন।

অনেক খুঁজলো ওরা, কিছু পেলো না। কিছুটা নিরাশ হয়েই এসে দাঁড়ালো। গ্যারেজের সামনে।

কোনো চিহ্ন রেখে যায়নি ব্যাটা, হাত নাড়লো রবিন।

 না, বললো কিশোর। এমনকি পায়ের ছাপও না। চলো, কটেজে। দেখি…

মৃদু একটা শব্দ শোনা গেল। একে অন্যের দিকে তাকালো ওরা। সকালের রোদ এসে পড়েছে চোখেমুখে। অদ্ভুত শব্দ! গোঙানির মতো। যেন গলা টিপে ধরা হয়েছে।

কী?… বললো রিকি।

শ শ শ! তাকে থামিয়ে দিলো কিশোর।

আবার হলো শব্দটা। কাছেই কোথাও।

কান খাড়া করলো মুসা। অন্য তিনজনের চেয়ে তার শ্রবণশক্তি জোরালো। গ্যারেজের ভেতরে! বলেই দৌড় দিলো, দরজার দিকে। কিন্তু দরজা বন্ধ। তালা। লাগানো।

চেঁচিয়ে বললো রিকি, এসো, আরেকটা দরজা আছে পাশে।

এই দরজাটাতেও ভারি তালা আটকানো।

এটাও তো বন্ধ! জিজ্ঞেস করলো রবিন, চাবি আছে?

আছে… বলতে বলতেই দরজার পাশের একটা খোপ থেকে চাবি বের করলো রিকি। তালাটা খুললো।

 হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকলো চারজনে। প্রথমে কিছু চোখে পড়লো না, দরজার কাছে ফেলে রাখা কয়েকটা যন্ত্রপাতি আর কাঠ ছাড়া।

কোণের কাছে নড়ে উঠলো কি যেন। গোঁ গোঁ করলো।

ছুটে গেল ওরা।

শুঁটকি! চমকে উঠলো রবিন।

হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। মুখে রুমাল গোঁজা। গোঙানো ছাড়া আর কোনো শব্দ করতে পারছে না। বাঁধন খুলে দিতে উঠে বসলো টেরিয়ার।

কি হয়েছিলো, শুঁটকি? পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো মুসা।

কেঁপে উঠলো টেরিয়ার। বাঁধনের জায়গাগুলো ডলছে। তো-তোমরা আমাকে বাঁচালে…! গলা ভীষণ কাঁপছে ওর। সরি! তোমাদেরকে সব সময় শত্রু ভাবি…

তা তো ভাবোই, মুসা বললো। এখান থেকে বেরিয়েই আবারও ভাবতে শুরু করবে। সরি-ফরি বাদ দাও। কি হয়েছিলো, তা-ই বলো।

সারা রাত ছিলে কোথায়? এখানেই? প্রশ্ন করলো কিশোর।

না, বললো টেরিয়ার। আমাকে নিয়ে এলো। হাত-পা বাঁধলো। ওদিকে একটা নালার কাছে। না দেখে নালার পাড়ে গিয়েছিলাম। নেমে এসে আমাকে বাঁধলো সে। খুব একচোট হেসে বললো, সবাই নাকি একবার করে পড়েছে ওই নালায়। আমার দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই।

তা পড়েছে! মাথা দোলালো কিশোর। অকস্মাৎ গম্ভীর হয়ে গেছে।

সারা রাত নালার মধ্যে ফেলে রাখলো, আবার বলে চললো টেরিয়ার। সকালে এনে ঢোকালো এখানে। বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ আগে অনেক শব্দ শুনলাম। ভয়ে রা করিনি। ভেবেছি, ও-ই আবার এসেছে। তারপর শুনলাম তোমাদের গলা..তখন চিৎকার করার চেষ্টা করলাম…

খুব ভালো করেছো, টিটকারির ভঙ্গিতে বললো মুসা। কেন, দোস্তের সঙ্গে তো খুব ভাব হয়ে গিয়েছিলো। ধরে বাধলো কেন…

আহ্, মুসা, এখন ওসব কথা রাখো তো, বাধা দিয়ে বললো কিশোর। তা শুঁটকি, লোকটা…

দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল খোলা দরজাটা। তালা লাগানোর শব্দ হলো। জানালাশূন্য অন্ধকার গ্যারেজে বন্দি হলো এখন পাঁচজন।

চেঁচিয়ে ডাকলো রিকি।

কেউ সাড়া দিলো না।

ছুটে গিয়ে সামনের দরজার ফোকরে চোখ রাখলো কিশোর। কে দরজা বন্ধ করলো, দেখতে চায়। রিকি, রবিন, আর মুসাও ছুটোছুটি করে গিয়ে যে যেখানে পারলো, চোখ রাখলো।

আমি দেখছি! বলে উঠলো রিকি। পাশের দরজাটার ফ্রেমের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে সে।

 দরজাটার পাশে ফাঁকফোকর আরও আছে। ওগুলোতে চোখ রাখলো তিন গোয়েন্দা। সকালের রোদে স্পষ্ট দেখা গেল লোকটাকে। বেঁটে, ভারি শরীর। এদিকেই ভুরু কুঁচকে চেয়ে রয়েছে ওলন্দাজ আর্ট ডিলার, জন ফেরেনটি।

মিস্টার ফেরেটি, চেঁচিয়ে বললো রিকি। আমাদের ছেড়ে দিন!

আমরা জানি, আপনি কি খুঁজছেন! বললো রবিন।

গ্যারেজের দিকে চেয়ে থেকে ভুরু আরও বেশি কুঁচকে গেল লোকটার। থাকো, ওখানেই! আমি… ঝট করে ঘুরলো ফেরেনটি। খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল গ্যারেজের পেছনে একটা ঝোপের আড়ালে।

পুরো এক মিনিট আর কিছু ঘটলো না।

তারপর শোনা গেল পায়ের আওয়াজ। এগিয়ে আসতে দেখা গেল আরেকজনকে। ফ্রেড ব্রাউন।

মিস্টার ব্রাউন! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলো মুসা। জন ফেরেনটি, আছে ওখানে! সাবধান!

গ্যারেজের দিকে চেয়ে রইলো এস্টেট ম্যানেজার।

পেছনে! ঝোপের ভেতরে! চেঁচিয়ে বললো রবিন।

ঝোপের দিকে ফিরলো ব্রাউন।

আমাদের আটকে রেখে গেছে, রিকি বললো। তালাটা খুলুন।

দরজার কাছে এগিয়ে এলো ম্যানেজার। জিজ্ঞেস করলো, ফেরেনটি কি একা?

হ্যাঁ, জবাব দিলো মুসা। মিস্টার ব্রাউন, আমাদের সঙ্গে শুঁটকিও আছে।

টেরিয়ার? আই সী। ছেলেটাকে বিশ্বাস কোরো না, বুঝেছো? নানারকম কথা বলবে। পাজি ছেলে।

ঠিক বলেছেন, একমত হলো মুসা।

 দরজার তালা পরীক্ষা করলো ব্রাউন। এটা তো বন্ধ।

চাবি আমার কাছে, রিকি বললো। দরজার নিচ দিয়ে ঠেলে দিচ্ছি। খুলে দিন।

কিশোর…! বলতে গেল টেরিয়ার।

 চুপ! ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলো কিশোর।

চাবিটা দেয়ার জন্যে নিচু হতে গিয়ে জোরে ধাক্কা খেলো রিকি, কিশোরের। গায়ে। তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল সে। ঠনন করে ধাতব শব্দ হলো। চেঁচিয়ে উঠলো, হায়, হায়!

কি হলো? জিজ্ঞেস করলো ব্রাউন।

চাবিটা পড়ে গেছে। যা অন্ধকার, কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

খোজো! খুঁজে বের করা। তাড়াতাড়ি!

খুঁজতে শুরু করলো রিকি, রবিন আর মুসা। ঘরের কোণে আগের জায়গাতেই বসে রয়েছে টেরিয়ার। রিকির গায়ে ধাক্কা লাগানোর পর থেকে চুপ হয়ে আছে। কিশোর, বিন্দুমাত্র নড়েনি।

চাৰিটা খুঁজছে তিনজনে। পাচ্ছে না, আফসোস করছে।

একটা গাড়ি আসছে, হঠাৎ বললো কিশোর।

দরজার ফোকরে চোখ রাখলো সবাই, টেরিয়ার বাদে। সে বসেই রয়েছে। ঘুরে। গ্যারেজের সামনের দিকে চেয়ে রয়েছে ব্রাউন।

না দেখলেও বুঝতে পারলো ছেলেরা, গাড়িটা গিয়ে থামলো মূল বাড়ির ড্রাইভওয়েতে।

দৌড় দিলো ম্যানেজার। হারিয়ে গেল নালার দিকে।

নিশ্চয় ফেরেনটিকে দেখেছে! বললো রিকি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে ফেরেনটি। হাতে পিস্তল। দৌড় দিলো। নালার দিকে, ব্রাউন যেদিকে গেছে।

.

২০.

ফেরেনটিও অদৃশ্য হয়ে গেল। কয়েক সেকেণ্ড পর প্রফেসর হোফার আর কাউন্টেসকে আসতে দেখা গেল কটেজের দিকে।

বাবা! চেঁচিয়ে ডাকলো রিকি।

পাঁই করে ঘুরলেন প্রফেসর। রিকি? কোথায়?

গ্যারেজে, বাবা! আটকে রাখা হয়েছে!

দ্রুত গ্যারেজের দিকে এগিয়ে এলেন দুজনে। সামনের দরজার চাবি প্রফেসরের কাছে, তালা খুলে বের করলেন ছেলেদের। কে তালা দিলো?

জন ফেরেনটি, জানালো মুসা। মিস্টার ব্রাউন বের করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রিকি চাবিটা হারিয়ে ফেললো। তারপর ম্যানেজারকে তাড়া করলো ফেরেনটি। পিস্তল নিয়ে।।

ব্রাউন এখানে এসেছিলো? অবাক মনে হলো কাউন্টেসকে। ফেরেনটিও?

কেন, আপনি জানেন না? জিজ্ঞেস করলো কিশোর। বলে আসেনি?

ইয়ে…কাল বিকেল থেকেই ম্যানেজারকে পাচ্ছি না। রাতে মোটেলে ছিলো! সেকথাই বললাম তখন প্রফেসর হোফারকে। আমাকে কিছুই বলে যায়নি।

প্রফেসর বললেন, কাল নাকি ফেরেনটির নীল সেডানটা মোটেলের কাছে দেখা গেছে, কাউন্টেস বললেন।

পিস্তল নিয়ে তাড়া করেছে ফেরেনটি, উদ্বিগ্ন গলায় রিকি বললো, আমাদের যাওয়া দরকার। ম্যানেজারকে বাঁচানো দরকার।

কোনো দরকার নেই, সবাইকে অবাক করে দিলো কিশোর। ইচ্ছে করেই তখন ধাক্কা দিয়েছিলাম তোমাকে। চাবিটা হাত থেকে ফেলে দেয়ার জন্যে। টেরিয়ারের দিকে ঘুরলো সে। এখন তুমি নিরাপদ। সব কথা খুলে বলতে পারো। কে কিডন্যাপ করেছিলো? কার হয়ে কাজ করছিলে?

অবশ্যই জন ফেরেনটি, বললো মুসা।

না, ফেরেনটি নয়, মাথা নাড়লো গোয়েন্দাপ্রধান।

তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছে, কিশোর। শুকনো ঠোঁট চাটলো টেরিয়ার। ফেরেনটি নয়। ফ্রেড ব্রাউন। সেদিন তোমাদেরকে ছবিটা দেখিয়ে বাড়ি ফিরতেই আমার সঙ্গে দেখা করলো। রাতে গালিভারের স্টুডিও থেকে ছবি বের করে দেয়ার জন্যে আমাকে রাজি করালো।

আমিও তা-ই সন্দেহ করেছি, বললো কিশোর। তখন ব্রাউনকে চাবি দিলে গ্যারেজে ঢুকে আমাদেরকে কি করতো কে জানে! গ্যারেজেই বরং নিরাপদ থেকেছি আমরা।

তুমি শিওর, কিশোর? বললেন কাউন্টেস।

 হ্যাঁ। টেরিয়ার তো নিজেই স্বীকার করছে। এরপর আর সন্দেহ কিসের? নিজেই ভেবে দেখুন না আপনি। বিপজ্জনক বলে আমাদেরকে কাজ করতে। মানা করে দিলো। বললো, পুলিশকে জানাবে সব কথা। জানিয়েছে?

না, জানায়নি।

কেন জানালো না? কারণ, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের করে ফেলবে। পুলিশ। আমরাও বের করে ফেলতে পারি, এটা বুঝেই আমাদেরকেও থামিয়ে রাখতে চেয়েছে। বলে চললো কিশোর, সেদিন শুঁটকি গিয়েছিলো-মোটেলে। কটেজে উঁকিঝুঁকি মারছিলো। আমরা ভাবলাম, ভেতরে ঢোকার জন্যে অমন করছে। আসলে তা নয়। গিয়েছিলো ব্রাউনের সঙ্গে দেখা করতে। তাকেই খুঁজছিলো। এখন বুঝতে পারছি।

অনেক দেরিতে বুঝেছে, নিরাপত্তা পেয়ে আবার আগের খোলসে ঢুকেছে টেরিয়ার। খিকখিক করে গা-জ্বালানো হাসি হাসলো। তারমানে যতোটা ভাবো, ততোটা চালাক তোমরা নও।

তার কথায় কান দিলো না কিশোর। আমার বিশ্বাস, ম্যাডাম, সেই মহিলার কাছে যায়ইনি ব্রাউন। ভেনাসের মূর্তি তার দরকারই ছিলো না। প্রয়োজন ছিলো। ছবিগুলোর।

কি জানি, বলতে পারবো না। হয়তো যায়নি। জিজ্ঞেস করিনি আর।

না, যায়নি। আপনার ভাইয়ের শেষ স্মৃতির চেয়ে ছবিগুলোর প্রয়োজন ছিলো তার অনেক বেশি। মিস্টার ডেনবারের প্রলাপের কথা রিকির মুখে শুনেছে ব্রাউন, বুঝে গেছে, ছবিগুলোতেই রয়েছে চাবিকাঠি।

কিসের চাবিকাঠি?

ফ্র্যাঙ্কোই ফরচুনার্দের মাস্টার পীস কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন আপনার ভাই।

কিন্তু, কিশোর, প্রফেসর বললেন, ব্রাউন কি করে জানলো, ডেনবারের কাছে একটা মাস্টার পীস আছে? কাউন্টেস তো জানেন না। তিনি জানেন না, অথচ তার। ম্যানেজার জানবে…

অদ্ভুত, তাই না, স্যার? ঠিকই ধরেছেন। মনে হয় কাউন্টেসকে ধোকা দিয়েছে ম্যানেজার। আমি এখন শিওর, ফেরেনটি আমাদেরকে অ্যাডোবে আটকায়নি। কালো পোশাক পরে সেদিন যে লোকটা আপনার বাড়িতে ঢুকেছিলো, সে-ও ফেরেনটি নয়।

কিন্তু ব্রাউন কি করে জানলো, একটা মাস্টার পীস আছে আমার ভাইয়ের কাছে?

শুরু থেকেই জানতো, ম্যাডাম, রহস্যময় কণ্ঠে বললো কিশোর। মিস্টার ডেনবার বলেছিলেনঃ বি-ধ্বলো। শুনলে মনে হবে, জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকার সময় কথা জড়িয়ে গেছে, তোতলামি, আসলে তা নয়। বি-ব্বলো মানে হলো, বি কে বলো, অর্থাৎ ব্রাউনকে বলো। কারণ, ব্রাউন ছিলো তার পার্টনার।

পার্টনার! আঁতকে উঠলেন যেন কাউন্টেস। কিসের পার্টনার? কোনো। অপরাধের?

হ্যাঁ। ছবির ব্যাপারেই কোনো কিছু। কী, এখনও শিওর নই, তবে খারাপ। কিছু। জানতে পারলে পুলিশে ধরবে…

তাহলে এখুনি পুলিশে ফোন করা উচিত, বলে উঠলেন কাউন্টেস। ফ্রেডকে পালাতে দেয়া যাবে না।

আমি যাচ্ছি, বললেন প্রফেসর, পুলিশকে ফোন করতে।

 চলুন, আমরাও যাই, কিশোর বললো। দেখি আরেকবার ছবিগুলো, ধাঁধার সমাধান করা যায় কিনা।

২১.

বাড়িতে ঢুকে প্রফেসর গেলেন পুলিশকে ফোন করতে। ছেলেদের সঙ্গে কাউন্টেস এসে ঢুকলেন লিভিং-রুমে, যেখানে কুড়িটা ছবি রাখা হয়েছে।

ক্রমিক নম্বর অনুসারে সাজিয়ে রেখেছে রিকি, বোঝার চেষ্টা করেছে।

 কি ছবিগুলোর দিকে আবার তাকালো কিশোর। সেই একই রকম, কটেজটা ছাড়া আর কোনো কিছুতে কোনো পরিবর্তন নেই।

ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ মিটমিট করছেন কাউন্টেস। মৃত ভাইয়ের জিনিস দেখেই বোধহয় অস্বস্তি বোধ করছেন, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দারুণ। এঁকেছে? ধীরে ধীরে ছোট হয়ে গেছে বাড়িটা যেন…

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো কিশোর, ক্রমান্বয়ে ছোট হয়েছে। অসাধারণ হাত ছিলো আপনার ভাইয়ের। এভাবে আঁকা সোজা কথা নয়।

কি বলছে ছবিগুলো, কিশোর? মুসা কিছুই বুঝতে পারছে না।

দেখো সবাই ভালো করে, গোয়েন্দাপ্রধান বললো। কারো চোখে কোনো খটকা লাগলে বলবে। আমিও দেখছি।

সবাই দেখছে। সেই একই অবস্থা। গাছপালার আকার এক, কটেজের ক্যানভাসের  ছাউনির আকার এক, শুধু ছোট হয়েছে বাড়িটা..

রিকি বললো, মনে হচ্ছে যেন একটা মাইক্রোস্কোপ..না না, টেলিস্কোপের। ভেতর দিয়ে চেয়ে আছি..মানে বোঝাতে পারছি না.কোনো যন্ত্রের ভেতর দিয়ে ফোকাসিং:..

ফোকাসিং? ধীরে ধীরে বললো কিশোর।

রিকি কি বলতে চায় বুঝেছি আমি, রবিন বললো। কটেজের ওপর নজর আকৃষ্ট রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। মোটা কোনো নলের ভেতর দিয়ে তাকালে যেমন যে কোনো একটা জিনিস বা বিশেষ জায়গার ওপর দৃষ্টি সীমাবদ্ধ থাকে…

খাইছে! আস্তে মাথা নাড়লো মুসা। সবাই গ্রীক বলতে আরম্ভ করেছে!

হঠাৎ বড় বড় হয়ে গেল কিশোরের চোখ। দ্রুত এক ছবি থেকে আরেক ছবিতে নজর সরাতে লাগলো। পকেট থেকে বের করলো কাগজটা, যেটাতে লিখে রেখেছে শব্দগুলো। একবার কাগজের দিকে তাকায়, আরেকবার ছবির দিকে। এরকম করলো কয়েকবার। উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। আনমনে বিড়বিড় শুরু। করলো, বি-ধ্বলো, মানে ব্রাউনকে বলো।…আমার ছবি আর মাস্টার মানেঃ আমার। আঁকা ছবির মাঝে লুকিয়ে রয়েছে মাস্টার পীস কোথায় রয়েছে তার সংকেত। কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে ভরলো আবার। ভুল মনে হবে মানে, ভুল জায়গায়। দেখো। অর্থাৎ, এমন জায়গায়, যেখানে সহজেই চোখ যায় অথচ চোখে পড়েও পড়ে না জিনিসটা। আবারও বলেছেঃ আমার ক্যানভাস, আর ক্যানভাস থেকে আঁকাবাঁকা:.., মুখ তুলে তাকালো গোয়েন্দাপ্রধান। কিছু বুঝতে পারছো? ছবিগুলোর দিকে তাকাও।

সবাই তাকালো। বুঝতে পারলো না কিছু।

সব শেষ ছবিটা, বুঝিয়ে বললো কিশোর। কটেজটা ছোট, কিন্তু বড় বেশি বেমানান লাগছে…

ছাউনিটা! চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। অসংখ্য তালি!

ডোরাকাটা ছাউনি! রিকি বললো।

ক্যানভাসের  ছাউনি! মুসাও বুঝে ফেলেছে।

এবং তার মধ্যে আঁকাবাঁকা ডোরাও আছে, বললো কিশোর। আঁকা যখন বাঁকা, কিংবা বলা যায় ভুল দিকে আঁকা! চলো চলো, কুইক!

এক ছুটে ঘর থেকে বেরোলো ছেলেরা। চুপ করে ছিলো টেরিয়ার, কিন্তু সে-ও বেরোলো সঙ্গে। লনের ওপর দিয়ে দৌড় দিলো ওরা। ওদের পেছনে রয়েছেন কাউন্টেস।

ছাউনির নিচে এসে ওপরে তাকালো কিশোর। অন্যেরাও। নানারকম তালির মাঝে চারকোণা টুকরো ক্যানভাসের  একটা তালি লাগানো রয়েছে ডোরাকাটা ক্যানভাসের  ছাউনিটাতে। টুকরোটার ডোরাগুলো আঁকাবাঁকা, মূল ক্যানভাসের  ডোরার সঙ্গে মিল নেই।

দৌড়ে গিয়ে গ্যারেজ থেকে একটা মই বের করে আনলো মুসা আর রিকি।

মই বেয়ে উঠে গেল মুসা। পকেট থেকে ছোট ছুরি বের করে টুকরোটার জোড়ার সেলাই কাটলো। খুলে এলো ওটা। হাতে নিয়ে কিশোরের দিকে ছুঁড়ে দিলো।

 আনমনে টুকরোটাকে রোল পাকাতে পাকাতে ওপর দিকে তাকালো কিশোর। ওটা যেখানে ছিলো, সেখানে আরেক টুকরো ক্যানভাস। অথচ থাকার কথা মূল, ক্যানূভাসে ছিদ্র কিংবা ছেঁড়াটেড়া কোনো কিছু। ছাউনি নষ্ট হলেই শুধু তালি লাগানোর কথা। কিন্তু

দ্বিতীয় টুকরোটার চার কোনায় শুধু চারটে সেলাই। সাবধানে কেটে নামালো মুসা। মূল ছাউনি বেরিয়ে পড়লো, কিন্তু জায়গাটা অক্ষত। টুকরোটা হাতে নিয়ে। নেমে এলো সে।

 চোখ ধাঁধিয়ে দিলো যেন উজ্জ্বল রঙ। ক্যানভাসের  উল্টো পিঠে আঁকা রয়েছে অসামান্য একটা ছবি। বেগুনী পর্বত, নীল ঘোড়া, হলুদ পাম গাছ আর লাল মানুষ। ফ্রাঙ্কোই ফরচুনার্দের হারানো সেই মাস্টার পীস!

চলো, ঘরের ভেতরে নিয়ে চলো, বললো কিশোর।

কটেজে ঢুকে ছবিটা টেবিলে বিছানো হলো।

আলতো করে ছুঁয়ে দেখলেন কাউন্টেস, যেন ভয়, ঘষা লাগলে রঙ উঠে যাবে। বিড়বিড় করলেন। সাত রাজার ধন মিলবে এটা দিয়ে।…আমার বেচারা ভাইটা কি করে পেলো এই জিনিস?

ম্যাডাম…, বাধা পেয়ে থেমে গেল কিশোর।

প্রফেসর হোফার ঢুকলেন। পুলিশ আসছে। ইয়ান ফ্লেচার…আরি! কোথায় পেলে ওটা!

জানানো হলো প্রফেসরকে।

কাজই করেছে একটা, কিশোর, বললেন তিনি। কে ভেবেছিলো ক্যানভাসের  তালির তলায় থাকবে ওরকম একটা জিনিস? চমৎকার জায়গায় লুকিয়েছে। ওয়াটারপ্রুফ, নিরাপদ, আর সব সময় ডেনবারের হাতের কাছেই ছিলো। যাক, পাওয়া গেছে ভালো। গুটিয়ে ফেলো। ওভাবে ভোলা রাখলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

খুব সাবধানে ছবিটাকে রোল করলো রবিন আর মুসা। কিশোরের হাতে দিলো।

বিষণ্ণ হয়ে আছে টেরিয়ার। তাকে কোনো কাজই করতে দেয়া হচ্ছে না। যেন একঘরে করে রাখা হয়েছে।

কাউন্টেস, হাসলেন প্রফেসর, আইনতঃ ছবিটার মালিক এখন আপনি। তবে, আগে জানতে হবে, চোরাই মাল কিনা ওটা। আপনার ভাই কোনোখান থেকে চুরি করে এনেছিলো কিনা।

চুরি? আমার ভাই চোর ছিলো!

না, বললো কিশোর। আমার মনে হয় না ওটা চোরাই। তবে…

দীর্ঘ ছায়া পড়লো ঘরের ভেতরে। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে লোকটা, হাতে পিস্তল। হেসে বললো, তবে আমি এখন ওটা চুরি করবো। কিংবা বলতে পারো, ডাকাতি করবো।

ফ্রেড ব্রাউন। পিস্তলের কুৎসিত নলের মুখটা ছেলেদের দিকে ফেরানো।

তুমি যে এতোবড় শয়তান, জানতাম না। দাঁতে দাঁত চাপলেন কাউন্টেস। এসব করে পার পাবে না।

তা পাবো, হাসি মুছলো না ব্রাউনের মুখ থেকে। বাধা দেয়ার চেষ্টা করবেন না, ম্যাডাম। খুব খারাপ হবে। লোভাতুর চোখে কিশোরের হাতের দিকে তাকালো সে। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, কিশোর। অনেক চেষ্টা করেছি। ধাঁধার সমাধান আমি করতে পারিনি। তুমি… চুপ হয়ে গেল ব্রাউন। কান পাতলো। একদিকে।

সবাই শুনতে পেলো। পুলিশের সাইরেনের শব্দ।

পিস্তল নাচালো ব্রাউন। হাসি হাসি ভাবটা চলে গেছে চেহারা থেকে, সেই জায়গা দখল করেছে উদ্বেগ। দাও, জলদি দাও!

দ্বিধা করছে কিশোর।

দাও বলছি! চেঁচিয়ে উঠলো ব্রাউন।

দিয়ে দাও, কিশোর, প্রফেসর বললেন।

 জলদি! গর্জে উঠলো ব্রাউন।

ঢোক গিললো কিশোর। বাড়িয়ে দিলো একটা ক্যানভাসের  রোল। প্রায় ছো দিয়ে ওটা টেনে নিয়ে আরেকবার পিস্তল নাড়লো ব্রাউন। পিছাতে পিছাতে বেরিয়ে .. চলে গেল।

সবাই ছুটে গেল জানালার কাছে।

ওকে থামান! চেঁচিয়ে উঠলেন কাউন্টেস।

কে থামাতে যাবে পিস্তলধারী একটা ভয়ানক লোককে? সবাই দেখলো, লন পেরিয়ে ছুটে গিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে হারিয়ে গেল ব্রাউন। খানিক পরেই দেখা গেল, হলুদ মার্সিডিজটা ছুটে যাচ্ছে ক্যানিয়নের মেইন রোড ধরে।

এগিয়ে আসছে পুলিশের সাইরেন।

পুলিশ ধরবে ব্যাটাকে, বললেন প্রফেসর।

না, মাথা নাড়লো কিশোর। নীল সেডান হলে আটকাতো। আপনি কি আর হলুদ মার্সিডিজের কথা বলেছেন?

কিশোরের অনুমানই ঠিক। পুলিশ এলো। মার্সিডিজটাকে আটকায়নি।

.

২২.

গাড়ি থেকে নামলো পুলিশেরা। গিয়ে চীফ ইয়ান ফ্লেচারকে কটেজে নিয়ে এলেন প্রফেসর। দ্রুত জানানো হলো তাঁকে ব্রাউন পালিয়েছে।

হলুদ মার্সিডিজটা দেখলাম তো! উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন চীফ। তাড়াতাড়ি রেডিওতে প্রয়োজনীয় নিদের্শ দিলেন তার লোকদের। পালাতে পারবে না।

যেভাবেই হোক, ধরতেই হবে ওকে, চীফ, কাউন্টেস বললেন। ও একটা ক্রিমিনাল। আমার ছবি নিয়ে পালিয়েছে।

না, নিতে পারেনি, হেসে বললো কিশোর। চীফের দিকে তাকালো, আপনার সাইরেন শুনে এতো ঘাবড়ে গেল, খুলে দেখার কথা আর ভাবেনি। যা ধরিয়ে দিয়েছি, নিয়ে পালিয়েছে। আসল ছবি এই যে, বলতে বলতে ক্যানভাসের  দ্বিতীয় রোলটা খুলে আবার টেবিলে বিছালো।

ভুরু কুঁচকে সেটার দিকে তাকিয়ে রইলো ফ্লেচার। সব কথা খুলে বলা হলো। তাঁকে।

এটাই সেই হারানো ফরচুনার্দ বললো কিশোর। ব্রাউন পালিয়েছে তালি মারার একটা টুকরো নিয়ে। অতি সাধারণ ক্যানভাস। হাহ্ হাহ্!

হাসতে শুরু করলো সবাই।

গোয়েন্দাপ্রধানের পিঠ চাপড়ে দিয়ে হেসে বললেন চীফ, ব্রাউন যদি জানতে কার পাল্লায় পড়েছে? হাহ হাহ! আমাদের কিশোর পাশা…

 কিন্তু আরেকটা শয়তান যে ছাড়া রয়ে গেল, বলে উঠলেন প্রফেসর। জন ফেরেনটি।

আমার মনে হয় না, ফেরেনটি আর এখন কিছু করতে পারবে, তিন গোয়েন্দার দিকে চেয়ে হাসলেন কাউন্টেস। ওদের সমস্ত প্ল্যান ভণ্ডুল করে দিয়েছো তোমরা। তুখোড় ছেলে। ভাবছি, বড় রকমের কোনো পুরস্কার দেবো তোমাদের।

তার প্রশংসায় লজ্জা পেলো রবিন আর মুসা। কিন্তু কিশোর যেন খুশি হতে পারছে না। চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে ছবিটার দিকে। কে এ

চীফ, প্রফেসর বললেন। ছবিটার মালিক এখন কে হবে? কাউন্টেসেরই তো পাওয়া উচিত। ছবিটা তাঁর ভাইয়ের ছিলো। অবশ্য যদি ডেনবার কোনোখান থেকে চুরি করে না এনে থাকে…

না, আমার ভাই চুরি করেনি। খামখেয়ালী ছিলো বটে, কিন্তু চোর ছিলো না।

ঠিকই বলেছেন, কাউন্টেসের সুরে সুর মিলিয়ে কিশোর বললো, চোরাই মাল নয় এটা।

তাহলে আর কি? কোনো মিউজিয়ামকে দান করে দেবো ছবিটা। এরকম একটা জিনিস কোনো একজনের হতে পারে না, দুনিয়ার সব মানুষের সম্পত্তি।

আগে আমাদের তদন্ত শেষ করে নিই, চীফ বললেন। যদি দেখা যায় চোরাই নয়, তাহলে অবশ্যই আপনি পাবেন। আপনার জিনিস নিয়ে তখন আপনি যা খুশি করবেন। যে কোনো মিউজিয়াম পেলে লুফে নেবে…

আরি! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন কাউন্টেস। গ্যারেজের পেছনে! জন ফেরেনটি!

চোখের পলকে জানালার দিকে ঘুরলো সবাই। গ্যারেজের পেছনে কাউকে দেখতে পেলো না।

আমি দেখেছি, জোর দিয়ে বললেন কাউন্টেস। হাতে পিস্তল নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। জন ফেরেনটি। বলতে বলতেই পালিয়েছে…

পালাবে কোথায়? বলেই রেডিও তুললেন চীফ, সঙ্গে আসা লোকদেরকে নির্দেশ দিলেন পুরো বাড়ি ঘিড়ে ফেলার জন্যে। রেডিও নামিয়ে বললেন, আমি যাচ্ছি।

ফ্লেচার বেরিয়ে যেতেই কিশোর চেঁচিয়ে উঠলো, কুইক! গ্যারেজের পেছনে। চলো…ডানে ঘুরে যাবে। দরজার দিকে দৌড় দিলো সে। পেছনে চললো মুসা, রবিন, আর রিকি। টেরিয়ারও ছুটলো।

জন ফেরেনটির ছায়াও দেখা গেল না। গ্যারেজের পেছনে চীফ আর দুজন পুলিশের সঙ্গে মিলিত হলো ছেলেরা।

গেল কই? এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন চীফ।

তাই তো! ছেলেদের পেছন থেকে বলে উঠলেন প্রফেসর। কোনো ঝোপঝাড়ে…

না না, লুকানো এতো সোজা নয়া মনে হয়…

চীফ! চেঁচিয়ে উঠলো আবার কিশোর, কুইক! কটেজে চলুন। জলদি!

কি হয়েছে? কেন?

জলদি করুন, স্যার, ছুটতে শুরু করলো কিশোর।

গ্যারেজের সামনে এলে প্রথমে রবিন দেখলো ওদেরকে। দুটো মূর্তি ছুটে যাচ্ছে। ড্রাইভওয়ের দিকে। আরি আরি, ওই তো! ফেরেনটি!

কাউন্টেসকে তাড়া করেছে! রিকি বললো।

 কাউন্টেসের হাতে ছবিটা! বললো মুসা।

আমাদের ফাঁকি দিয়েছে ব্যাটা! বললেন প্রফেসর। আরে, আমার গাড়ির দিকে যাচ্ছে কেন কাউন্টেস?

কাউন্টেসকে তাড়া করেছে ফেরেনটি। ছবিটা মহিলার হাতে। ছুটে যাচ্ছে প্রফেসরের গাড়ির দিকে।

পিস্তল বের করে ফেলেছেন চীফ আর তাঁর দুই সহকারী। চেঁচিয়ে উঠলেন, এই থামো, নইলে গুলি করবো। বলেই ফাঁকা আওয়াজ করলেন।

গাড়ির কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন কাউন্টেস, থমকে দাঁড়ালেন। পেছনে ফেরেনটিও দাঁড়িয়ে গেল।

এগিয়ে গেল সবাই।

যাক, ফেরেনটি ব্যাটাও ধরা পড়লো, বললো রবিন।

হ্যাঁ, ফিরে চেয়ে বললেন কাউন্টেস। ঘরে ঢুকে ছবিটা নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। তুলে নিয়েই দৌড় দিলাম। অ্যারেস্ট করুন, ওকে, চীফ।

হ্যাঁ, ফ্লেচার বললেন, তোমাকে অ্যারেস্ট করা হলো, ফেরেনটি। তুমি…

না, বাধা দিলো কিশোর। মিস্টার, ফেরেনটিকে নয়। কাউন্টেসকে অ্যারেস্ট করুন।

স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই।

যাহ, ঠাট্টা করছো তুমি, কিশোর, তরল কণ্ঠে বললেন কাউন্টেস।

মাথা নাড়লো কিশোর। না, ঠাট্টা নয়, কাউন্টেস। ছবিটা নিয়ে পালাতে চেয়েছিলেন আপনি। জানেন, যদি তদন্ত হয়; মহাবিপদে পড়বেন। এমনকি জেলেও যেতে পারেন। ছবিটা তো পাবেনই না কোনোদিন। মিস্টার ফেরেনটি আসলে আপনাকে আটকাতে চেয়েছিলেন।

কি যা তা বলছো? রেগে গেলেন কাউন্টেস।

ঠিকই বলছি। রিগ ডেনবার আপনার ভাই ছিলো না। তার দুজন সহকারী ছিলো, পার্টনার, একজন ফ্রেড ব্রাউন, আরেকজন আপনি।

তুমি জানো? অবাক হলেন ফেরেনটি। আমিও ভুল করেছি। তোমাদেরকে সহকারী করে নিলে আরও সহজে কাজ সারতে পারতাম। আসলে তোমাদেরকে আণ্ডার এস্টিমেট করেছি আমি।

ফেরেনটি আসলে কে, কিশোর? জিজ্ঞেস করলেন চীফ।

মনে হয় ওলন্দাজ পুলিশের লোক। কাউন্টেস আর ব্রাউনের পিছু নিয়ে আমেরিকায় এসেছেন…ওঁকেই জিজ্ঞেস করুন না?

মাথা, ঝোঁকালেন ফেরেনটি। ছেলেটা ঠিকই বলছে, চীফ। আমি ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের লোক। আমস্টারডাম থেকে ওদের পিছু নিয়েছি। কয়েক বছর ধরেই চেষ্টা করছি, কিন্তু আসলটাকে ধরতে পারছিলাম না। সব চেয়ে পিচ্ছিল ছিলো ডেনবারটা। কোনো প্রমাণ রাখতো না আর পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতো, আজ এখানে, কাল ওখানে। কিশোর, তুমিও বুঝতে পেরেছে, না?

হ্যাঁ, স্যার। ওরা এই বিপাকে পড়তো না। একজন আরেকজনকে ফাঁকি দিতে গিয়েই ধরাটা পড়েছে। ব্রাউন ফাঁকি দিতে চেয়েছিলো কাউন্টেসকে। আসল ছবি ভেবেই এই কাণ্ড করেছে ব্রাউন আর কাউন্টেস্। ব্রাউন নিয়ে গেল সাধারণ ক্যানভাস। কাউন্টেস সেকথা যখন জানলো, আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে ছবি নিয়ে পালাতে চেয়েছিলো। আপনি চোখ না রাখলে…

হয়তো পালাতো। এখন যাবে জেলে।

আসল ছবির কথা কি যেন বললে? প্রশ্ন করলেন চীফ। এই ছবিটা কি আসল ফরচুনার্দ নয়?

না। ওটা সত্যিই ধ্বংস করে দিয়েছে নাৎসীরা। রিকির দিকে ফিরলো কিশোর। তোমার নিশ্চয় মনে আছে, ডেনবার বলেছিলোঃ দুনিয়ার সব চেয়ে দামী আর্টিস্ট সে। কিন্তু কেউ সেটা জানলো না। এক অর্থে ঠিকই বলেছে।

সত্যি, তোমার বুদ্ধি আছে, কিশোর পাশা! উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন ফেরেনটি। তুমি একেবারে জাত-গোয়েন্দা!

খুলে বলো তো, কিশোর, অধৈর্য হয়ে হাত নাড়লো মুসা।

রিগ ডেনবার খুব বড় আর্টিস্ট ছিলো। তবে আসল কাজে না গিয়ে গিয়েছিলো নকল কাজে; জালিয়াতি। টাকা রোজগারের ধান্দায়। বড় বড় আর্টিস্টের ছবি এমনভাবে নকল করতো, ধরার সাধ্য ছিলো না। তার দুই সহকারী, ব্রাউন আর কাউন্টেস সেই ছবি আসল বলে বিক্রি করতো লোকের কাছে। অনেক লোককে ঠকিয়েছে।

তাহলে কি…! অবাক হয়ে কাউন্টেসের হাতের ছবিটার দিকে তাকালেন। ফ্লেচার।

হ্যাঁ, এটাও, বললো কিশোর। রিগ ডেনবারের শেষ মাস্টার পীস। ফরচুনার্দ বলে সহজেই চালিয়ে দেয়া যাবে। অভিজ্ঞ আর্টিস্টদেরও বুঝতে কষ্ট হবে।

.

২৩.

মানে! রবিনকে অবাক করে দিয়ে রেগে গেলেন মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার। কি ভেবেছো নিজেদেরকে? তোমাদের সব কেসের কাহিনী নিয়েই কি ছবি বানাতে হবে নাকি আমাকে?

প্লীজ, স্যার, অনুনয় করলো রবিন। রিপোর্টটা পড়ে দেখুন। নিশ্চয় স্বীকার করবেন, অতি চমৎকার একটা কেস। যা দেখিয়েছে না কিশোর! অনেক কিছু জানতে পারবেন।

কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে নীরব হয়ে গেলেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক। তারপর বললেন, তারমানে কি তুমি বলতে চাইছে, রবিন মিলফোর্ড, যে তোমাদের কিশোর পাশা আমার চেয়ে বুদ্ধিমান?

না না, স্যার, তাড়াতাড়ি বললো রবিন। চেষ্টা করলে আপনি খুব বড় গোয়েন্দা হতে পারতেন…মানে, পারবেন…

বলছো?? আবার কিছুক্ষণ বরফ-শীতল নীরবতা। বেশ, কাল তোমাদের রিপোর্ট নিয়ে এসো আমার অফিসে। পড়ে দেখবো। আর, এক শর্তে এই কাহিনী নিয়ে ছবি করতে পারি।

বলুন, স্যার? অস্বস্তি বোধ করছে রবিন।

আমি বলে যাবো, কিভাবে কি হয়েছে। কোনো একটা পয়েন্ট যদি ভুল করি– যেটা কিশোর করেনি–শুধুমাত্র তাহলেই এই কাহিনী নিয়ে আমি ছবি বানাবো। তা নাহলে আর কোনোদিনই তোমাদের কোনো কাহিনী নিয়ে ছবি বানাবো না।

ঢোক গিললো রবিন। পরিচালকের ব্যবহারে ভীষণ অবাক হয়েছে। সাহস করে বলেই ফেললো, ঠিক আছে, স্যার। তাই হবে।

বেশ। কাল সকালে এসো আমার অফিসে, লাইন কেটে দিলেন পরিচালক।

পরদিন সময়মতো মিস্টার ক্রিস্টোফারের অফিসে গেল তিন গোয়েন্দা।

 রবিনের দেয়া ফাইলটা টেনে নিলেন পরিচালক। শুরুতে কয়েক পাতা পড়লেন। তারপর ফাইল বন্ধ করে বললেন, তাহলে জন ফেরেনটি গোয়েন্দা, যাকে তোমরা ক্রিমিন্যাল ভেবেছিলে প্রথমে। আর ব্রাউন এবং কাউন্টেসই আসল। ক্রিমিন্যাল। কাউন্টেসও কাউন্টেস নয়, মিছে কথা বলেছে তোমাদের কাছে…

ওর আসল নাম মেরি গিলবার্ড… বললো মুসা।

হ্যাঁ, ফাইলে লিখেছে রবিন। মানুষ চেনা বড় কঠিন। মুখ দেখেই যদি সব মানুষকে চিনে ফেলা যেতো, কি ভালোই না হতো তাহলে! তো, ব্রাউন আর মেরি কি মুখ খুলেছে?

খুলেছে, স্যার, মুসা বললো। পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, অনেক বছর ধরে করছে এই জালিয়াতি ব্যবসা। অনেক টাকা কামিয়েছে। ইউরোপের বড়লোকদের কাছে বিক্রি করেছে ওসব নকল ছবি। কয়েক মাস আগে ধরা পড়ে জেল হয় দুজনের। ডেনবার পালিয়ে চলে এসেছিলো, আমেরিকায়, তার শেষ মাস্টার পীসটা নিয়ে…

থামো, হাত তুললেন পরিচালক। এবার আমি বলি। বাড়ি ভাড়া বাকি রেখে মারা গেল ডেনবার। ইউরোপে চিঠি লিখলেন প্রফেসর হোফার। ব্রাউন আর মেরি, দুজনেই তখন জেলে। প্রফেসরকে ব্রাউনের বাড়ির ঠিকানা দিয়েছিলো ডেনবার। কাজেই তাঁর চিঠি জেলখানায় পৌঁছলো না, পড়ে রইলো ব্রাউনের বাড়ির চিঠির বাক্সে। মেরির কয়েক দিন আগে–এই ধরো হপ্তাখানেক বা আরও কিছু বেশি জেল থেকে ছাড়া পেলো ব্রাউন। বাড়ি এসে প্রফেসরের চিঠি পেলো। জানলো, ডেনবার মারা গেছে। বুঝলো, ছবি জালিয়াতির ব্যবসা শেষ। আঁকবে কে? নকল। ফরচুনার্দের কথা জানা আছে ব্রাউনের। ঠিক করলো, ছবিটা বিক্রি করে একাই মেরে দেবে টাকাটা, মেরিকে ভাগ দেবে না। তাড়াতাড়ি ছুটে এলো আমেরিকায়। ছবিটা যেদিন প্রফেসরের বাড়িতে খুঁজতে এলো, সেদিনই তোমরা গেলে পুরানো। মাল কিনতে। ভালোমতো খোঁজার সুযোগই পেলো না ব্রাউন। বরং পালাতে গিয়ে না দেখে নালায় পড়ে পায়ে ভীষণ ব্যথা পেলো। ওই অবস্থায় ছবি খুঁজে বের করতে পারবে না বুঝে আবার বাড়ি ফিরে গেল। গিয়ে দেখলো, মেরিও ছাড়া। পেয়ে গেছে। তাকে ফাঁকি দিতে পারলো না ব্রাউন। পা কিভাবে মচকেছে, বলতেই হলো। তারপর, পা ভালো হলে, দুজনে একসঙ্গে আবার এলো আমেরিকায়। কি, ঠিক বলছি তো?

ঠিকই বলছেন, স্যার, মাথা ঝোঁকালো কিশোর।

বেশ। নাটের গুরু ডেনবার ধরা পড়েনি। কাজেই জন ফেরেনটিও সন্তুষ্ট হতে পারেনি! জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরই আবার চোখ রাখতে লাগলো মেরি আর ব্রাউনের ওপর। ওদের পিছু নিয়ে সে-ও এলো আমেরিকায়। জানলো, ডেনবার মারা গেছে। ব্রাউনের পিছু নিয়ে ডয়েলদের বাড়ি গেল। ওদের টেলিফোন লাইন। ট্যাপ করে জানলো, মিস্টার ডয়েলের কাছে ডেনবারের শেষ ছবিটা বিক্রি করতে চাইছে ব্রাউন ঠিক?

আবার মাথা ঝোঁকালো কিশোর।

আত্মবিশ্বাস বাড়লো পরিচালকের। হাসলেন। রিকি দেখে ফেলেছে। জানাজানি হয়ে যাওয়ার ভয়ে ছবিটা লুকিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলো ডেনবার।

তারপর পড়লো অসুখে। বুঝতে পারলো আর বেশি দিন বাঁচবে না। ততোদিনে যদি জেল থেকে ছাড়া না পায় সহকারীরা? তাই তাদের জন্যে মেসেজ তৈরি করলো, কুড়িটা ছবি এঁকে। জেলে চিঠি লিখে খোলাখুলি জানানো সম্ভব ছিলো না, কারণ কর্তৃপক্ষের হাত হয়ে যায় চিঠি। তবে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলো দুজনকে, চিঠিতে, যে ছবিটা লুকিয়ে রেখেছে। অসুখ বাড়লো তার। শেষ মুহূর্তে জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকার ভান করে আরও কিছু মেসেজ রেখে গেল সে।

ব্রাউন আর মেরি এসে দেখলো, ডেনবারের সমস্ত জিনিসপত্র বিক্রি করে দিয়েছে প্রফেসর হোফার। ছুটে গেল ওরা স্যালভিজ ইয়ার্ডে। ওখানে গিয়ে দেখলো, জিনিসগুলো আবার বিক্রি হয়ে গেছে। ওগুলো বের করে দেয়ার জন্যে ধরলো তোমাদেরকে। আর তোমাদের মাধ্যমেই জানলো, একটা ছবি পেয়েছে। টেরিয়ার। তার সঙ্গে যোগাযোগ করলো ব্রাউন। জানতে পারলো কোথায় আছে ছবিগুলো। চুরি করে মিস্টার গালিভারের স্টুডিওতে ঢুকতে রাজি করিয়ে ফেললো টেরিয়ারকে। সহজেই রাজি হলো ছেলেটা, কারণ, তার তখন গালিভারের ওপর জেদ, তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে সেই জন্যে।

একজস্ট ফ্যানের ফোকর দিয়ে ভেতরে ঢুকতো টেরিয়ার। এক এক করে ছবি বের করে দিতে ব্রাউনকে। ব্রাউন পরীক্ষা করে দেখে আবার ফিরিয়ে দিতো, থামলেন পরিচালক।

 হ্যাঁ, বললো, কিশোর। প্রথমে আমার মতোই ব্রাউনও ভেবেছিলো ওই ছবিগুলোরই কোনোটার নিচে আঁকা আছে আসল ছবিটা!

ফলে ব্যর্থ হলো, আবার বলে চললেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। কিন্তু থামলো না ব্রাউন। খোঁজ চালিয়েই গেল। তোমাদেরকে অ্যাডোবে আটকেছিলো সে-ই। তারপর স্টুডিওতে টেরিয়ারকে তোমরা ধরে ফেললে। নিজেকে বাঁচানোর জন্যে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দি করলো ব্রাউন। টেরিয়ারকে খুঁজতে গিয়ে তোমরাও বন্দি হলে আরেকবার, গ্যারেজে। এবার বন্দি করলো জন ফেরেনটি, তোমাদের ভালোর জন্যেই। আচ্ছা, ভালো কথা, ওর একটা পা খোঁড়া। নিশ্চয় ভেঙেছিলো?

হ্যাঁ, স্যার, বললো রবিন। অনেক বছর আগে।

মাথা ঝাঁকালেন পরিচালক। ছবিটা খুঁজে বের করে তীক্ষ্ণবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছো তুমি, কিশোর। কিভাবে করেছে, রিপোর্টে পড়ে ফেলেছি, কাজেই সেকথায় আর যাচ্ছি না। আসা যাক জালিয়াতির কথায়। তুমি সন্দেহ করেছে, ডেনবার আর ব্রাউন জালিয়াত। কাউন্টেসের রোলটা তখনও বুঝতে পারোনি। তবে তাকেও সন্দেহ করেছে। সেটা বোঝার জন্যেই কটেজে টেবিলের ওপর ছবি রেখে ইচ্ছে করেই বেরিয়ে গিয়েছিলে ফেরেনটিকে ধরার ছুতোয়। নইলে তোমাদের যাওয়ার তো কোনো প্রয়োজনই ছিলো না, যেখানে পুলিশ ফোর্স রয়েছে। তোমার পাতা ফাঁদে পা দিলো কাউন্টেস। ঠিক তো?

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো কিশোর। ঠিক।

কিন্তু, স্যার, মুসা বললো। বুড়ো ডেনবার যে জালিয়াত, কিশোর সেটা কি করে বুঝতে পারলো?

সেটা তো সহজ, মুসা আমান। ডেনবার রিকিকে বলেছে না যে সে দুনিয়ার সব চেয়ে দামী আর্টিস্ট? তাছাড়া মিস্টার গালিভারও স্বীকার করেছেন সেকথা। খুব পাকা হাত ছিলো ডেনবারের। একই দৃশ্য কুড়িবার কুড়িরকম করে আঁকা যা তা কথা নয়। এতোবড় একজন শিল্পী লোকের চোখে না পড়েই পারে না। কেন। পড়লো না তাহলে? একটাই জবাব, জালিয়াত বলে। শুধু অন্যের জিনিসই চুরি করতো, নিজের আইডিয়া থেকে আঁকা কোনো ছবিই ছিলো না তার, ওই কুড়িটা। বাদে। লোকের চোখে পড়বে কিভাবে? কি কিশোর, এভাবেই তো বুঝেছো?

হ্যাঁ, স্যার।

আর কি বাকি রইলো? রবিনের দিকে চেয়ে ভুরু নাচালেন পরিচালক। সবই বুঝতে পেরেছি, তাই না?

মুখ কালো করে ফেলেছে রবিন। তাই তো মনে হচ্ছে, স্যার।

বেশ। তো এখন জানতে পারি কি, কার কি সাজা হয়েছে?

 চিত্রপরিচালকের ব্যবহার আর কথার ধরনে দুই সহকারী অবাক হলেও কিশোর হলো না। শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলো, ব্রাউনের বিরুদ্ধে দুটো কেস। আরেকবার নকল ছবি বিক্রির চেষ্টা, আর শুঁটকি টেরিকে কিডন্যাপ। কিডন্যাপিঙের জন্যে। এখানেই জেলে ভরে দিয়েছে তাকে পুলিশ। এখানকার সাজা শেষ হলে পাঠিয়ে দেবে ইউরোপে, ছবি জালিয়াতির জন্যে ওখানে আরেকবার সাজা খাটতে হবে। তাকে। মেরিকে চালান করে দেয়া হয়েছে ইউরোপে, সঙ্গে গেছেন জন ফেরেনটি। এতোদিনে সন্তুষ্ট হয়েছেন।

 ছবিগুলো কি করেছে?

ডেনবারের শেষ মাস্টার পীসটা পেয়েছেন প্রফেসর হোফার। ডেনবারের কাছে টাকা পেতেন তিনি, তাই আদালত এই রায় দিয়েছে। আদালতের রায় বেরোনোর। পর তাঁর কপাল খুলে দিয়েছে পত্রিকাওয়ালারা। এতো বেশি করে লিখেছে, ছবিটা কেনার জন্যে পাগল হয়ে গেছে লোকে। অনেক দামে কিনে নিয়ে গেছে একজনে। টাকা যা পেয়েছেন, বাড়িঘর সব মেরামতের পরও বেশ কিছু রয়ে গেছে প্রফেসরের হাতে।

আর ওই কুড়িটা ছবি?

মিস্টার গালিভারকে ফেরত দেয়া হয়েছে। আইনতঃ ওগুলোর মালিক তিনিই। কারণ, তখন ন্যায্য দাম দিয়েই কিনেছিলেন। এখন অবশ্য লোকে অনেক বেশি দিতে চাইছে, কিন্তু তিনি আর বিক্রি করবেন না। ওগুলোর ওপর আর ছবিও আঁকবেন না। সাজিয়ে রেখেছেন তাঁর স্টুডিওতে।

টেরিয়ার ডয়েলের কি হয়েছে?

মিস্টার গালিভার তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেননি। কিন্তু শুঁটকির বাবা ভীষণ রেগেছেন। ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন হোস্টেলে। এই ছুটির মধ্যে একা একা কাটাতে হবে বেচারাকে।

উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে। হাত নাড়লেন তিনি, যাও, এবার ওঠো। আর কোনদিন কাহিনী আনবে না আমার কাছে, ছবি করার জন্যে…আমি খুব ব্যস্ত।

এক মিনিট, স্যার, হাত তুললো মুসা। একটা প্রশ্নের জবাব বাকি রয়ে গেছে। আমরা যখন গ্যারেজে বন্দি হলাম, কিশোর কি করে জানলো যে ফেরেনটি নয়, ব্রাউনই আসল শয়তান?

কী? মানে…, ফাইলের প্রথম দিকের কয়েকটা পাতা দ্রুত পড়ে নিলেন। আবার পরিচালক। বুঝেছি। ওই যে ডেনবার বলেছে, বি-ব্বলো, মানে, ব্রাউনকে বলো…

হয়নি স্যার, এতোক্ষণে হাসলো কিশোর। গ্যারেজে আটকা পড়ার পর। শুঁটকির একটা কথা স্ট্রাইক করেছিলো আমার মনে। তখনই বুঝেছি। শুঁটকি বলেছে, তাকে যে বন্দি করেছে সে নাকি বলেছেঃ ওই নালায় সবাই পড়েছে একবার করে। না জেনে।

তাতে কি? ভরু কোচকালেন পরিচালক।

সেরাতে জন ফেরেনটিও পড়েছিলো নালায়, বললো কিশোর। ওই যেদিন। অ্যাডোবে আমরা…

গুঙিয়ে উঠলেন পরিচালক, হায়, হায়, ঠিকই তো! নালাটা রয়েছে ওখানে, জানলে তো আর পড়তো না ফেরেনটি। তারমানে প্রথম যেদিন গেলে হোফারের বাড়িতে, নালায় পড়েছিলো যে লোকটা সে ফেরেনটি নয়! একটাই থাকলো। জবাবঃ ফ্রেড ব্রাউন!

তাহলে হার স্বীকার করে নিচ্ছেন আপনি? হাসিতে উজ্জ্বল এখন রবিনের মুখ।

না নিয়ে আর উপায় কি? মুচকি হাসলেন পরিচালক। তবে, দুঃখ পাচ্ছি না?

কেন, কেন?

কারণ, আমি আগেই জানি সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না। শার্লক হোমস, এরকুল পোয়ারো, কিংবা কিশোর পাশারা ঝাঁকে ঝাঁকে জন্মায় না। তবু একবার চেষ্টা করে দেখলাম পারি কিনা?

এবার কিন্তু সত্যি লজ্জা দিচ্ছেন, স্যার, লাল হয়ে উঠেছে কিশোরের গাল।

খোঁচা মারতে ছাড়লো না মুসা, তাহলে, স্যার, এবার আমরা উঠি। আপনি ব্যস্ত মানুষ…

হো হো করে হেসে উঠলেন পরিচালক। নাহ, তোমরা আমার স্বভাবটাই পাল্টে দিচ্ছো, হাসতে হাসতে বললেন তিনি। কখনও হাসি না বলে যে একটা দুর্নাম ছিলো আমার, সেটা ঘুচিয়ে দিচ্ছো। কথায় বলে না, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস…! হঠাৎ কালো হয়ে গেল তার মুখ। চোখের পলকে হাসি মুছে গেছে। দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন কড়া চোখে।

অবাক হয়ে ফিরে তাকালো তিন গোয়েন্দা। হাতে কয়েকটা বাক্স নিয়ে ঢুকেছে খানসামা। আইসক্রীম! আগেই অর্ডার দিয়ে রেখেছেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। কতোক্ষণ পর ঢুকতে হবে, নিশ্চয় তা-ও বলে রেখেছেন।

এই প্রথম জানলো তিন গোয়েন্দাঃ শুধু বড় পরিচালকই নন মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার, অনেক বড় অভিনেতাও, যদিও কখনও ছবিতে অভিনয় করেননি তিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *