৬. তার বয়স বাড়ছে

ডলি বারবার আমাকে জানিয়ে দিচ্ছে তার বয়স বাড়ছে, তার বয়স বেড়ে গেছে, তার আর সময় নেই; আমার সময় থাকতে পারে, তার সময় নেই, সে এক হাজার বছর বাঁচার জন্যে আসে নি। আমার সঙ্গে দশ বছরে তার বিশ বছর বয়স বেড়ে গেছে; তার যে বয়স বাড়ছে, তা আমি দেখতে পাই। ডলি গোশল করে কম, তার বিশেষ কোনো সময় নেই গোশলের; ভোরেও সে গোশল করতে পারে, রাতেও পারে, দুপুরেও পারে; অনেক দিন করেই না। আমি তাকে গোশল করার কথা জিজ্ঞেস করি না, করাটা আপত্তিকর মনে হয়; কে কখন কী করবে বা করবে না তা তার নিজের ব্যাপার। সে সাজে, বা সাজার চেষ্টা করে; যখন তখন শরীরে সেন্ট ছড়িয়ে দেয়, শা শা শব্দ ওঠে, শব্দটা শুনলে আমার শরীর একবার শিউরে ওঠে; শা শা শব্দ করে সে আমাকে জানিয়ে দেয় যারা সুগন্ধ পছন্দ করে, তারা উন্নত রুচির মানুষ, আর যেহেতু সে সুগন্ধ পছন্দ করে, সে উন্নত রুচির অধিকারী, আমার থেকে। একদিন আমি তাকে গোশল করা সম্পর্কে খুব সরল পরোক্ষ একটা প্রশ্ন করে ফেলি; করে বিব্রত হই।

আমি বলি, আজ মনে হয় তুমি গোশল করো নি।

ডলি বলে, কেনো করবো? করার কী দরকার?

আমি বলি, গোশল তো করতেই হয়।

ডলি বলে, কেনো করবো? রাতে কিছু করো না কি যে গোশল করবো?

আমি বলি, রাতে কিছু করার সাথে গোশলের কী সম্পর্ক?

ডলি বলে, নাপাক হলে গোশল করতে হয়, আমি নাপাক না।

আমি বলি, আমি কোনো দিনই তোমাকে নাপাক করি নি।

ডলি বলে, নাপাক করার মুরোদ তোমার নেই।

ডলি সম্ভবত ধর্মে মন দিয়েছে, আমি চুপ করে থাকি। পাক-নাপাকের ব্যাপারটা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম; ইস্কুলের মওলানা সাহেব শব্দ দুটি বলতেন, শুনে মনে হতো আমার শরীরের ছিদ্রে ছিদ্রে ময়লা জমে আছে। ডলি ঘুমোনোর জন্যে চেষ্টা করছিলো, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে; দেখতে পাই সে ঘুমোয় নি, বরং প্রখরভাবে জেগে আছে।

ডলি বলে, শুনলাম তোমার সেক্রেটারির বউটা খুব রূপসী।

আমি বলি, আমিও তাই শুনেছি।

ডলি বলে, তুমি কি শুধু শুনেছেই, এখনো দেখো নি?

আমি বলি, না, দেখি নি।

ডলি বলে, আমার কাছে মিথ্যে বোলো না, তুমি অনেকবারই তাকে দেখেছো। সেক্রেটারি কি তোমাকে না দেখিয়ে শোয়ার সাহস করেছে?

আমি বলি, তার বউর সাথে সে শোবে, তাতে সাহসের দরকার হবে কেনো, আমাকেই বা দেখিয়ে নিতে হবে কেনো?

ডলি বলে, তোমাদের আমলাদের মধ্যে না কি এখনো পুরোনো কালের নিয়মকানুন টিকে আছে, শুনতে পাই বসকে না দেখিয়ে স্ত্রীগমন নিষেধ।

আমি বলি, এতো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ তুমি কোথায় পাচ্ছো, ডলি?

ডলি বলে, তোমাদের আমলাদের সম্পর্কে সবারই ধারণা আছে, তাই আমলাদের বউদের সব সংবাদ রাখতেই হয়; কোন দিন সেক্রেটারির বউকে ভাগাও কে জানে?

আমি বলি, তুমি কি সেজন্যে দুশ্চিন্তায় আছো?

ডলি বলে, দুশ্চিন্তার কী আছে? আমিও কাউকে ধরবো, অনেকেই ঘুরঘুর করে; এখনো বুড়ী হয়ে যাই নি।

আমি আর কথা বলি না, ঘুমিয়ে পড়তে চাই।

ডলি বলে, শুনলাম তোমার সেক্রেটারিকে তুমি কয়েক সপ্তাহের জন্যে বাইরে পাঠাচ্ছো?

আমি বলি, হ্যাঁ, আমেরিকায় যাওয়ার একটা সুযোগ ও পেয়েছে।

ডলি বলে, সুযোগ ও আসলে পায় নি, তুমিই সুযোগ করে দিয়েছে।

আমি বলি, হ্যাঁ, ও খুব চমৎকার ছেলে, আমি রিকমেন্ড করেছিলাম।

ডলি বলে, তাহলে যা শুনেছি তা সত্য।

আমি বলি, কী শুনেছো?

ডলি বলে, ও কয়েক সপ্তাহ বাইরে থাকবে, তখন তুমি ওর বউকে নিয়ে সময় কাটাবে। তোমাদের মধ্যে সেই আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে।

আমি বলি, বউটি তা মানবে কেনো?

ডলি বলে, বড়ো স্যারের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ কি সে ছাড়বে?

আমি বলি, আমি যদি চার মাসের জন্যে বিদেশ যাই, তখন প্রধান মন্ত্রী তোমার সাথে সময় কাটাতে চাইলে কি তুমি রাজি হবে?

ডলি কোনো কথা বলে না।

আমি বলি, ডলি, তুমি কি একটি কথা বুঝতে পারছো?

ডলি বলে, কী কথা?

আমি বলি, আমরা পরস্পরের কাছে অপরিচিত?

ডলি বলে, তোমার কাছে আমি অপরিচিত হতে পারি, কিন্তু তুমি আমার কাছে অপরিচিত নও।

আমি বলি, আমার কতোটুকু পরিচয় তুমি জানো?

ডলি বলে, সবটাই জানি।

আমি বলি, আসলে আমরা কেউ কাউকে জানি না; জানার জন্যেও কোনো। ব্যাকুলতা বোধ করি নি।

ডলি বলে, আমরা বিয়ে করেছি, তুমি আমার দেহ সবটা দেখেছো, আমি তোমার দেহ দেখেছি, আমরা একসাথে বসে খাই, একসাথে থাকি, তুমি বড়ো চাকুরি করো; এর বেশি জানার কী আছে?

আমি বলি, তুমি কি জানো আমি কোন ঋতু পছন্দ করি?

ডলি বলে, আমাকে হাসালে। তুমি কোন ঋতু পছন্দ করো, তা জেনে আমার কী লাভ?

আমি বলি, আমি কি জানি তুমি কোন ঋতু পছন্দ করো?

ডলি বলে, তা তোমার জানতে হবে না।

আমি বলি, তুমি কি জানো আমার শরীরের কোনখানে মাঝেমাঝে ব্যথা করে?

ডলি বলে, তোমার শরীরে আবার ব্যথা আছে না কি; আমার তো মনে হয় লোহা দিয়ে তৈরি।

আমি বলি, আমি কি জানি তোমার শরীরের কোনখানে ব্যথা করে?

ডলি বলে, এসব কথা রাখো, স্বামীস্ত্রীর এসব জানার দরকার নেই।

আমি বলি, তুমি কি জানো তুমি আমার কোনখানে চুমো খেলে আমার ভালো লাগে?

ডলি বলে, তোমার ইতর কথা রাখো।

আমি বলি, তোমার কোন আসনে বেশি সুখ হয় আমি কি জানি?

ডলি বলে, রাখো তোমার আসনটাসন, আমাকে ঘুমোতে দাও।

ডলি সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে, আমি আর কথা বলি না।

অনেক দিন ধরেই একটা অবর্ণনীয় অদ্ভুত ইচ্ছে হচ্ছে আমার, ইচ্ছেটাকে কখনো আমি বাস্তবায়িত করতে পেরে উঠবো না, কিন্তু ইচ্ছেটা হচ্ছে; আমার ভালো লাগছে–ইচ্ছেটার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই ইচ্ছেটাকে আমি দেখি, দেখে আমার সুখ লাগে। অনেক বছর আগে একটি চাষীকে আমি দেখেছিলাম, সে মাঠে গরু নিয়ে যাচ্ছে; সেই চাষীটিকে আর গরুগুলোকে আমি দেখতে পাই-একটি স্বচ্ছ পর্দার ওপারের ছায়ার মতো তারা আমার কাছে। আমি কি ওই চাষীটি হতে, পারতাম? আমি কি ওই চাষীটি হতে পারতাম না? ওই গরুগুলো নিয়ে কি আমি মাঠে যেতে পারতাম না? আমি জানি চাষী হয়ে গরু নিয়ে মাঠে যাওয়া খুব মধুর নয়; কিন্তু তাকে যেভাবে আমি যেতে দেখেছিলাম, তা মধুর। অমন ঘাসের ওপর আমি কখনো পা ফেলি নি; আমি ঘাস আর মাটির ছোঁয়া কেমন তা জানিই না;–অনেক বছর ধরেই আমার পা ঘাস আর মাটির ছোঁয়া পাওয়ার স্বপ্ন দেখে আসছে; ঘাস দেখলেই আমার ইচ্ছে করে জুতো খুলে ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে কোথাও চলে যাই; কিন্তু আজো যেতে পারি নি; কোনো দিন যেতে পারবো না হয়তো। একবার এক দুপুরে দুর থেকে একটি ছোটো নদীতে এক মাঝিকে নৌকো বেয়ে যেতে দেখেছিলাম; সে গান গাইছিলো না, নৌকো বেয়ে যাচ্ছিলো; আমি আজো তাকে দেখতে পাই। আমি কি ওই মাঝিটি হতে পারতাম? আমি কি ওই মাঝিটি হতে পারতাম না? মাঝি হওয়া সুখকর নয়, আমি জানি, কিন্তু ওই মাঝিটিকে, তার নৌকোটিকে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি দেখতে পাই-স্বচ্ছ পর্দার আড়ালে তার নৌকো ভাসছে। কেনো দেখতে পাই। একবার দূর থেকে জঙ্গলের ভেতর আমি একটি বাঁশের ঘর দেখেছিলাম, কোনো মানুষ দেখি নি; ওই ঘরটিকে আমার মনে পড়ে। আমি কি ওই ঘরে থাকতে পারতাম না? ওই গরুগুলো, ওই নৌকো, ওই বাঁশের ঘরের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু ওগুলোকে আমি হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাই; কোনো কালে ওগুলোর সাথে আমার গভীর সম্পর্ক ছিলো; ওগুলোকে আমি ভুলে গেছি; আমার ভুলে যাওয়ার অতল গভীরতা থেকে মাঝেমাঝে ওগুলো জেগে উঠে আমাকে সুখে ভরে দিচ্ছে। আমার জীবন একটা ছকের ভেতর বাধা পড়ে গেছে, আমি খুব প্রচণ্ডভাবেই তা টের পাই; অনেকের কাছেই ওই ছক খুব আকর্ষণীয়, আমার কাছেও; কিন্তু ছকের বাইরের নৌকো আর ঘাস আর বাঁশের ঘর আমাকে কেনো বিহ্বল করে তোলে?

আমার দিকে তাকিয়ে কেউ বুঝে উঠতে পারে না আমার ভেতরে একটি মেঠোপথ আছে, যে-পথ দিয়ে ভোরবেলা একটি চাষী তার গরুর পাল নিয়ে মাঠে যায়; একটি নদী আছে, ছোট্ট, তাতে একটি মাঝি নৌকো বায়; বনের ভেতরে একটি বাঁশের ঘর আছে, তার চারপাশে কাউকে দেখা যায় না। আমি চাই না কেউ বুঝে উঠুক; কেউ আমার ভেতরের চাষীটিকে, মাঝিটিকে, ঘরটিকে দেখে ফেলুক। আমি চাই, হয়তো চাই, আমি চাই কি না আমি জানি না, সবাই বাইরের আমাকে দেখুক, আমার বাইরটাকে দেখুক; আমার ভেতরটাকে দেখে ফেললে আমি খুব বিব্রত হয়ে পড়বো, যারা দেখবে তারা খুব বিচলিত হয়ে পড়বে। দক্ষ আমলা বলে আমার সুনাম রয়েছে (আমলা শব্দটিই আমরা কেউ পছন্দ করি না, আমাদের সামনে কেউ বলে না, পেছনে সবাই’বলে), যা অনেকের কাছে দুর্নাম; পেশায় আমি খারাপ উন্নতি করি নি, সবচেয়ে উঁচু পদটিতে আমার বয়সের অনেকের আগেই আমি পৌঁছে যাবো মনে হচ্ছে; আমি অনেকেরই ঈর্ষার পাত্র; তবে এ-সবই আমার কাছে হাস্যকর, তুচ্ছ, যদিও তা আমি কখনোই কাউকে বুঝতে দিই নি, অর্থাৎ এমন কিছু করি না যাতে তারা বুঝে উঠতে পারে। কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয় আমার কাছে, যদিও ধুলোকণাটিকেও আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি; মানুষও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, যদিও অন্যরা মানুষকে যতোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে তারচেয়ে আমি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি মানুষকে। একটি মানুষ সৃষ্টি করি নি বলে ডলির হাহাকারের শেষ নেই, তার হাহাকারকে আমার নিরর্থক মনে হয়; ওই হাহাকার, আমার মনে হয়, আন্তরিক নয়, তা দুর্মর প্রথার চিৎকার ও আড়ম্বর। কী হতো যদি আমার দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে, বা তিনটি মেয়ে, বা চারটি ছেলে, বা দুটি মেয়ে আর একটি ছেলে, বা শুধুই একটি মেয়ে, বা একটি ছেলে থাকতো? কী সুখ পেতাম আমি তাদের ইস্কুলে পৌঁছে দিয়ে? ইস্কুল থেকে এনে? বুকে জড়িয়ে ধরে? তারা হয়তো এখন দেশেও থাকতো না; তাদের বিদেশে পাঠিয়ে গৌরব উপভোগ করে কী সুখ পেতাম? সুখের কথাই আমার কখনো মনে পড়ে না।

ডলি একদিন বলে, একটা দুর্ঘটনাই আমার জীবনটাকে বদলে দিলো; নইলে অন্য রকম হতো।

আমি বলি, দুর্ঘটনার কাজই হঠাৎ বদলে দেয়া, সুন্দরকে অসুন্দর করে তোলা, স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করা।

ডলি বলে, তোমার দর্শন রাখো, এসব আমার শুনতে ইচ্ছে করে না।

আমি বলি, দেলোয়ারকে তোমার মনে আছে?

ডলি বলে, মনে থাকবে না কেনো? আমি তো পশু নই; সে আমার স্বামী ছিলো।

আমি বলি, কোনোদিন তো বুঝতে দাও নি।

ডলি বলে, তোমাকে বুঝতে দিয়ে কী হবে?

আমি বলি, একজনের সাথে থেকে আরেকজনের কথা বলতে হয়তো তোমার বেঁধেছে।

ডলি বলে, তোমার কি দেলোয়ারকে মনে পড়ে না?

আমি বলি, না।

ডলি বলে, আজকাল আমার মনে হয় তুমি আমাকে ভাগিয়ে এনেছে।

আমি বলি, আমি খুব খারাপ কাজ করেছি।

ডলি বলে, হ্যাঁ, খারাপই করেছে।

আমি বলি, তুমি নাও ভাগলে পারতে।

ডলি বলে, তখন তোমাকে বিশ্বাস করার মতো মনে হয়েছিলো।

আমি বলি, আমি কি অবিশ্বাসের কোনো কাজ করেছি?

ডলি বলে, তোমার সাথে থেকে থেকে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

আমি বলি, যে-কোনো মানুষের সাথেই দীর্ঘকাল থাকা ক্লান্তিকর।

ডলি বলে, ক্লান্তি থেকে আমি একটু মুক্তি চাই।

আমি বলি, তুমি কি আমাকে ছেড়ে অক্লান্তিকর কারো কাছে যেতে চাচ্ছো?

ডলি বলে, না, এই বয়সে তোমাকে ছেড়ে গিয়ে কী হবে? আমার কোনো নতুন জীবন হবে না, বরং কলঙ্ক হবে।

আমি বলি, কলঙ্কের ভয় করছো কেনো?

ডলি বলে, কলঙ্কের ভয়েই তো কিছু করে উঠতে পারলাম না, তোমার সাথে পড়ে রইলাম।

আমি বলি, খুব ভুল করেছে; আমার যদি মনে হতো তোমার সাথে থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তাহলে ছাড়াছাড়ি করে ফেলতাম, কলঙ্কের ভয় করতাম না।

ডলি বলে, তোমরা আমলারা তো এমনই।

আমি বলি, তাহলে কী করতে চাও?

ডলি বলে, আমি কয়েক মাসের জন্যে লন্ডন যেতে চাই।

আমি বলি, তাতে কি ক্লান্তি কাটবে?

ডলি বলে, গিয়ে দেখি।

ডলি লন্ডনে তার বোনের বাসায় বেড়াতে চলে যায়। সে-সন্ধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ এক বৈঠকে আমাকে থাকতে হয়, আমি তাকে বিদায় দিতে যেতে পারি নি। ডলিকে বিদায় দিতে যাওয়ার জন্যে আমার মনে কি কোনো আবেগ ছিলো? আমি তেমন কোনো আবেগ বোধ করি নি; মনে হয় নি যে তাকে অনেক দিন দেখবো না, না দেখে কষ্ট হবে। ডলিরও কি কোনো আবেগ বোধ হয়েছিলো? ওই সন্ধ্যায় বৈঠক ছিলো বলে আমার ভালোই লেগেছে। আর সে যে লন্ডন যাচ্ছে দুপুরবেলাও তার আচরণ দেখে কেউ বুঝে উঠতে পারে নি; এমন কি আমারও মনে হচ্ছিলো সে হয়তো যাওয়া বাতিল করে দিয়েছে। শুধু দুপুরে যখন আমি বেরোতে যাচ্ছি সে সন্ধ্যায় গাড়িটি পাঠিয়ে দিতে বলে, বিমানবন্দরে যাবে বলে। আমি ড্রাইভারকে একবার বলি, এবং তারপর ভুলে যাই; সন্ধ্যার বেশ পর বৈঠক থেকে বেরিয়ে গাড়ি খুঁজি, না পেয়ে খুব উত্তেজিত বোধ করি। আমি হেঁটে হেঁটে বেইলি রোডে ফিরি, এবং বাসায় ঢুকতেই মনে পড়ে যে ড্রাইভার হয়তো ডলিকে নিয়ে বিমানবন্দরে গেছে। নিজেকে আমার খুব হাল্কা লাগে।

অনেক দিন পর আমার ক্লাবে যেতে ইচ্ছে করে; ক্লাবে গিয়ে আমি সোজা দোতলায় উঠে যাই, নতুন কার্পেটের গন্ধটা আমার ভালো লাগে, একটি তাসের টেবিলে বসে পড়ি, পাঁচশো টাকার চাকতি কিনি। চাকতিগুলো ধরতে আমার সব সময়ই শিশুর অনুভূতি হয়, নিজেকে বয়স্ক মনে হয় না, একরাশ খেলনা নিয়ে খেলছি মনে হয়। বেশ ভালো তাস পেতে থাকি, ভালো তাস পেতে পেতে আমার ঘেন্না লাগতে থাকে; উঠে পড়তে ইচ্ছে হয়, তবে উঠে পড়াটা রীতির মধ্যে পড়ে না, কয়েক হাজার টাকা আমি জিতে ফেলেছি, কিন্তু উঠে পড়ার জন্যে আমি পাগল হয়ে উঠি। উঠে পড়ার ভালো উপায় হচ্ছে হারতে থাকা; আমি হারতে শুরু করি, আমার সব কিছু নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকে, শেষ চাকতিটি পর্যন্ত আর আমার থাকে না। আমি আবার পাঁচশো টাকার চাকতি কিনি, পৃথিবীর সব বিমান ও বিমানবন্দরের কথা ভুলে যাই; আবার জিততে শুরু করি। এবার আর আমার উঠতে ইচ্ছে করে না, অজস্র চাকতি জমতে থাকে আমার সামনে; চাকতির লাল নীল রঙে আমার চোখ ঝলমল করে উঠতে থাকে। চাকতিগুলোর বিনিময়ে আমি যে-টাকা পাবো, তা আমার কাছে নোংরা লাগতে থাকে; ওই নোংরা নোটগুলো আমি নিতে পারবো না, আমি যখন উঠবো চাকতিগুলো নিয়েই উঠবো। কিন্তু চাকতিগুলো নিয়ে কি ওঠা যাবে, চাকতি নিয়ে যাওয়ার কি নিয়ম আছে? আমি উঠে পড়তে চাই। আমার আবার ঘেন্না লাগতে শুরু করেছে। ডলির বিমান কি উড়েছে; এখন সেটা আকাশের কোথায় আছে? আমার মনে হয় ডলির বিমানটি ভেঙে পড়বে, মনে হয় ভেঙে পড়ুক; একবার আমি মনে মনে বলে ফেলি বিমানটি ভেঙে পড়ুক; আরেকবার আমি বলি বিমানটি ভেঙে পড়ুক। এটা ভাবতে আমার খারাপ লাগে না; আমি নিজেকে বোঝাই এটা ভাবা আমার ঠিক হচ্ছে না, মনে মনে আমি যা বলেছি, তাতে আমি অপরাধ করেছি, আমার ক্ষমাপ্রার্থনা করা উচিত; আমার দুঃখিত হওয়া উচিত; কিন্তু আমার কোনো দুঃখ লাগে না, মনে কোনো অপরাধবোধ জমে না।

বাসায় ফিরে গিয়েই শুনি টেলিফোন বাজছে; টেলিফোন ধরতে আমার ইচ্ছে করে না। আমি কাপড় বদলাই, তখনও টেলিফোন বাজছে; আমি বাথরুমে যাই, তখনও টেলিফোন বাজছে; আমি চুল আঁচড়াই, তখনও টেলিফোন বাজছে; আমি টেলিভিশন খুলি, তখনও টেলিফোন বাজছে। কোথাও হয়তো আগুন লেগেছে। কোথাও হয়তো সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কোথাও হয়তো সব কিছু প্লাবিত হয়ে গেছে। কোথাও আগুন লাগলে আমার কী, আমি কী করতে পারি? সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেলে আমার কী করার আছে? আমার কী যদি মহাজগত প্লাবিত হয়ে যায়; একটির পর একটি গ্রহ আর সূর্য যদি প্লাবনের তলে লুপ্ত হয়ে যায়? ওই আগুনের সাথে আমার কি কোনো সম্পর্ক আছে? ওই ধ্বংসের সাথে আমি কি সম্পর্কিত? কী সম্পর্ক আমার প্লাবনের সাথে?

টেলিফোন ধরেই ডলির গলা শুনতে পাই।

ডলি বলে, প্লেন ছাড়তে আরো তিন ঘণ্টা বাকি, এক ঘণ্টা ধরে রিং করছি।

আমি বলি, এইমাত্র বাসায় ফিরলাম।

ডলি বলে, এতোক্ষণ কোথায় ছিলে?

আমি বলি, ক্লাবে।

ডলি বলে, আজই ক্লাবে চলে গেছো!

 আমি বলি, অনেক টাকা জিতলাম।

ডলি বলে, এয়ারপোর্টে আসো না, আমাকে বিদায় দিয়ে যাও।

আমি বলি, এখন বেরোতে ইচ্ছে করছে না।

ডলি বলে, অন্য কোনো মেয়েলোক ডাকলে তুমি হয়তো চলে আসতে।

আমি বলি, আমি কি টেলিফোন রেখে দেবো?

ডলি বলে, তাতো দেবেই, আমার কথা শুনতে তোমার ভালো লাগবে কেনো?

আমি বলি, সত্যিই ভালো লাগছে না।

ডলি বলে, তোমার সঙ্গে যেনো আমার আর দেখা না হয়।

আমি বলি, তা তোমার ওপর নির্ভর করছে।

ডলি বলে, আমি না ফিরলে আমাকে তুমি আর ফিরিয়ে নেবে না?

আমি বলি, এসব আমি এখন ভাবছি না।

ডলি বলে, আজ থেকে ভাবার অবসর পাবে।

ডলি টেলিফোন রেখে দেয়। আবার কিছুক্ষণ পর টেলিফোন বেজে ওঠে।

ডলি বলে, তুমি চিরকাল আমাকে একলা রেখে দিলে।

আমি বলি, তার জন্যে আমি দুঃখিত।

ডলি বলে, এয়ারপোর্টেও আমি একলা।

আমি চুপ করে থাকি। আমার বলতে ইচ্ছে হয়, এয়ারপোর্টে একলাই আমার ভালো লাগে, কিন্তু বলি না। সবার ভালো লাগার প্রকৃতি একরকম নয়।

ডলি বলে, আমার ইচ্ছে হয় প্লেনটা যেনো ভেঙে পড়ে।

আমি বলি, ভেঙে পড়বে কেনো?

ডলি বলে, তাহলে আমাকে আর তুমি দেখতে পাবে না।

ডলি ফোন রেখে দেয়।

ডলির প্লেন যদি সত্যিই ভেঙে পড়ে? তাহলে ওই ভেঙে পড়ায় আমার কি কোনো হাত থাকবে; আমি কি মনে করবো যে ভেঙে পড়ায় আমার একটি মানসিক ভূমিকা ছিলো? যদি তখন সবাইকে আমি বলি বা বিবৃতি দিই যে প্লেনটা ভেঙে পড়ুক এমন কামনা আমি করেছিলাম, ওই কামনা আমার ভেতরে অনেকক্ষণ ধরে কাজ করছিলো, সবাই আমাকে কি পাগল না অপরাধী ভাববে? অনেক রাতে আমি আকাশে প্লেনের গম্ভীর আকাশ-ফাড়া শব্দ শুনতে পাই, এমন শব্দ যেনো প্লেনটি পাথর ভেঙে ভেঙে এগোচ্ছে, আর বলে যাচ্ছে ভেঙে পড়বো, ভেঙে পড়বো। ছেলেবেলায় কোনো একটানা শব্দ শুনলেই আমার ভালো লাগে এমন কোনো শব্দ শুনতে শুরু করতাম : রেলগাড়িতে উঠলেই কখনো শুনতাম চলে যাচ্ছি, চলে যাচ্ছি, কখনো আবার আসবো, আবার আসবো, কখনো নদীতে অনেক পানি, নদীতে অনেক পানি, কখনো ইস্কুল বন্ধ, ইস্কুল বন্ধ, কখনো লাল ঘুড়ি, লাল ঘুড়ি। আমার যা শুনতে ইচ্ছে করতো, তাই শুনতে থাকতাম। এবার আমি ভেঙে পড়বো না, ভেঙে পড়বো না শুনতে থাকি, শুনতে শুনতে বিমানের শব্দ আকাশে মিলিয়ে যায়; তারপরও শুনতে থাকি ভেঙে পড়বো না, ভেঙে পড়বো না, কিন্তু হঠাৎ আমার মনে হয় আমি যেনো শুনছি ভেঙে পড়বো, ভেঙে পড়বো।

বয়স কতো হলো আমার? চুয়ান্নো? আমার বয়স কত হলো, প্রশ্ন করে জানতে হয় না; আমার বয়স কতো বছর-মাস-দিন, প্রত্যেক ভোরেই মনে পড়ে; কখনো আমি হেসে উঠি কখনো ভয় পাই। হেসে ওঠার ব্যাপারটি বেশি পুরোনো নয়, এক দশকের মতো; ভয় পাওয়ার ব্যাপারটিই পুরোনো,–আমি ভয় পেয়েই জন্ম নিয়েছিলাম এবং জন্ম নিয়েই ভয় পেয়েছিলাম। মৃত্যু? মনে পড়লে হেসে উঠি এখন, এবং যেহেতু মাঝেমাঝেই মনে পড়ে, ভুলে থাকতে পারি না, তাই মাঝেমাঝেই হেসে উঠি। ডলির সামনেই হেসে উঠেছিলাম একদিন, যা আমার ঠিক হয় নি; ডলি এটাকে কোনো গূঢ় রহস্যময় সত্যের সূত্র মনে করে সত্য উদ্ধারের জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছিলো। ঘরে আর বারান্দায় হেঁটে হেঁটেই আমি শেভ করি; সেদিন শেভ করতে করতে, হয়তো হাতে কালোর সাথে গুঁড়োগঁড়ো শুভ্রতার মিশ্রণ দেখে, আমার মৃত্যুর কথা মনে পড়েছিলো; আমি হেসে উঠেছিলাম।

ডলি বলেছিলো, হাসলে যে।

আমি বলেছিলাম, হাসি পেলো।

ডলি বলেছিলো, খামোখা মানুষের হাসি পায় না কি?

আমি বলেছিলাম, অনেকটা খামোখাই।

ডলি বলেছিলো, আমার বিশ্বাস হয় না; নিশ্চয়ই তোমার কোনো গোপন কথা মনে পড়েছে।

আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ, খুবই গোপন কথা।

ডলি বলেছিলো, তোমার গোপন কথাটি কী জানতে পারি?

আমি বলেছিলাম, তোমাকে বলতে পারবো না।

ডলি বলেছিলো, আমাকে বলবে কেনো, সেক্রেটারির বউকে গিয়ে বলো।

আমি আরেকবার হেসে উঠেছিলাম। ডলিকে বলতে পারি নি শেভ করতে করতে। আমার জরুরি ফাইল নয়, গোপন ফাইল নয়, রাষ্ট্রের অবধারিত উন্নতি নয়-মৃত্যুর কথা মনে পড়ছিলো; মনে হচ্ছিলো এই যে আমি ঘরে আর বারান্দায় পায়চারি করে শেভ। করছি, একদিন আমি শেভ করবো না, শেভারের ঝিঁঝি থেমে যাবে। আমার মনে দুঃখ জাগে নি, আমি ভয় পাই নি, আমার হাসি পেয়েছিলো। অনেক দিন ধরেই মৃত্যুর কথা মনে পড়লে আমার হাসি পায়; আর এমন এক সময় ছিলো যখন ভয়ে বুক কাঁপতো। কিন্তু আমি হেসে উঠি কেনো? মৃত্যু তো হাস্যকর ব্যাপার নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়? পার্কে আর লেকের পারে বন্ধুদের আর সহকর্মীদের আর অচেনা জীবনমুখিদের যখন দ্রুত হাঁটতে দেখি, আমার হাসি পায়; মনে হয় তারা মৃত্যুর আগে আগে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তারা দেখতে পাচ্ছে মৃত্যু তাদের থেকে মাত্র এক পদক্ষেপ পেছনে, তাই তারা এক পা আগে আগে দ্রুত হাঁটছে। কতো দিন পারবে? খুব দণ্ডিত মনে হয় তাদের। বেঁচে থাকার জন্যে কী আপ্রাণ ইতর লোলুপতা। কেনো বেঁচে থাকতে হবে? এক সময় কেনো থেমে যেতে হবে না, মরে যেতে হবে না, মিশে যেতে হবে না, নামপরিচয়হীন হয়ে যেতে হবে না? কী পার্থক্য। পঁচিশ আর পঁচাশির মধ্যে পাঁচ লক্ষ বছর বাঁচতে না পারলে পঁচাশি বছর বেঁচে থেকে কী লাভ? বাল্যকালে আমার পাঁচ হাজার বছর পাঁচ লক্ষ বছর পাঁচ কোটি বছর বেঁচে থাকার ইচ্ছে হতো। মানুষ মরে যায়, এটা কত বছর বয়সে বুঝতে পেরেছিলাম, আমার মনে নেই; মনে পড়ে বোঝার পর আমি ঘুমাতে গিয়েই মাকে জড়িয়ে ধরতাম; নিঃশব্দে চিৎকার করতাম-আমি মরবো না, মা মরবে না; আর সবাই মরে যাবে, আমি মরবো না, মা মরবে না। আমার জগৎ মৃত্যুতে ভরে গিয়েছিলো, মৃত্যুকে এড়িয়ে যাওয়াই ছিলো আমার প্রতিমুহূর্তের সাধনা; মৃত্যুই ছিলো আমার প্রত্যেক মুহূর্তের দেবতা। তখনো জানতাম না যে মানুষ সব কিছু হিশেব করতে পারে; আমিও হিশেব করতে শিখতে থাকি, এবং আমি অনেকটা মেনে নিই যে আমিও মরবো, মাও মরবে। কিন্তু আমি সময় বাড়াতে থাকি, মৃত্যুর সাথে সংখ্যার খেলায় মেতে উঠি, যেনো আমি সংখ্যা দিয়ে মৃত্যুকে ঠেকাতে পারবো।

বিছানায় শোয়ার পরই কে যেনো আমাকে জিজ্ঞেস করতো, কতো বছর বাঁচতে চাও তুমি?

আমি বলতাম, পাঁচ শো বছর।

হাজার শেখার পর আমি সংখ্যাটিকে একটু বদলে দিই।

বিছানায় শোয়ার পর যখন সে আমাকে জিজ্ঞেস করতো, কত বছর বাঁচতে চাও তুমি?

আমি বলতাম, পাঁচ হাজার বছর।

লাখ শেখার পর আমি সংখ্যাটিকে আরেকটুকু বদলে দিই।

বিছানায় শোয়ার পর যখন সে আমাকে জিজ্ঞেস করতো, কত বছর বাঁচতে চাও তুমি?

আমি বলতাম, পাঁচ লাখ বছর।

কোটি শেখার পর আমি সংখ্যাটিকে আরেকটুকু বদলে দিই।

বিছানায় শোয়ার পর যখন সে আমাকে জিজ্ঞেস করতো, কতো বছর বাঁচতে চাও তুমি?

আমি বলতাম, পাঁচ কোটি বছর।

পাঁচ কোটি বছর বলতে বলতে আমার ক্লান্তি ধরে যায়, ঘেন্না লাগে, এবং এক সময় আমি মৃত্যুর কথা সম্পূর্ণ ভুলে যাই। মৃত্যুকে আমার অবাস্তব মনে হয়; যদিও আমি চারদিকে মৃত্যু দেখি, মাঝেমাঝে মৃত্যুর ব্যাপক প্রচণ্ডতা দেখি, তবু আমার সঙ্গে মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। বাবা যে-দিন মারা যান আমি ঢাকায় ছিলাম না, কয়েক শো মাইল দূরে ছিলাম; টেলিফোনে যখন সংবাদটি পাই তখন আমি একটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেখার জন্যে বেরোচ্ছিলাম। টেলিফোন ধরেছিলেন সেখানকার প্রধান কর্মকর্তা; তিনি ধরার পরই বেলার কান্না শুনে নিজেই হাহাকার করে ওঠেন। বেলা সংবাদ দেয়ার থেকে কেঁদেছিলো বেশি, আমাকে ডাকার থেকে বাবার মৃত্যুর কথাই তাকে শুনিয়েছিলো বিস্তৃতভাবে, এবং শেষে আমাকে ডেকেছিলো। তিনি ঘোষণাই করে দেন যে স্যারের পিতা পরলোকগমন করেছেন–তিনি জান্নাতবাসীই বলছিলেন, একবার আমার দিকে তাকিয়ে পরলোকগমন বলতে শুরু করেন, তাই তিনি প্রকল্প পরিদর্শনে যাবেন না; কিন্তু আমি যখন প্রকল্প দেখতে বেরিয়ে পড়ি সবাই আহত বোধ করে। মৃত্যুকে আমি তার প্রাপ্য মর্যাদা দিচ্ছি না দেখে, এবং তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ মৃত্যুর শোক বিশদভাবে উপভোগ করতে না পেরে হতাশ হয়। বাবার লাশ আমার জন্যে রেখে দেয়া হয়েছিলো, এবং পরদিন আমি ফিরে দেখতে পাই সবাই বাস্তবে ফিরে এসেছে, কেউ আর শোকে ভেঙে পড়ছে না। বাবা তখন লাশমাত্র, বাবা নয়; শোকের থেকে তখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাকে বনানীতে কবর দেয়া।

আমি বলেছিলাম, আজিমপুরেই তো কবর দেয়া যেতো।

যেনো আমি একটি পবিত্র গৃহকে অপবিত্র করে ফেললাম, আমার কথাটি সবার মনে এমনভাবেই আঘাত করে; বেলা চিৎকার করে ওঠে, অন্যরাও নিঃশব্দে প্রতিবাদ করে।

ডলির আব্বা বলেন, তোমার আব্বাকে আজিমপুরে কবর দেয়া যায় না, বনানীতেই দিতে হয়; নইলে সম্মান থাকে না, তোমার সম্মান থাকে না।

মৃত্যুর সাথেও সম্মানের ব্যাপার জড়িয়ে আছে, আমি চুপ করে থাকি; এবং বাবার জন্যে বনানীর ব্যবস্থা করে দিই। বাবার একগুচ্ছ পাসপোর্ট আকারের ছবিও তৈরি করা হয়ে গেছে; আমার কাজ ওগুলোকে পত্রিকায় পৌঁছে দেয়া;–আমাকে যেতে হবে না, ছবি ও সংবাদ নিয়ে যাওয়ার লোকের অভাব নেই, আমার কাজ পত্রিকায় ফোন করা, যাতে ছবি আর ইন্নালিল্লাহেসহ মৃত্যু আর কুলখানির সংবাদ ছাপা হয়। বাবা যে আজীবন সমাজসেবক আর শিক্ষানুরাগী ছিলেন, পাড়াকমিটির সহসভাপতি ছিলেন, তা বিস্তৃতভাবে লেখা হয়েছে; তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে আমার নামটি সব পরিচয়সহ সবার আগেই লেখা হয়েছে।

আমি বলি, বাবার মৃত্যুর সংবাদ পত্রিকায় বেরোনোর কোনো দরকার নেই।

সবাই বজ্রাহত বোধ করে।

ডলির আব্বা বলেন, তোমার আব্বার মৃত্যুর খবর পত্রিকায় বেরোবে না তা কি হয়?

আমি বলি, জীবনে বাবার নাম কখনো পত্রিকায় ছাপা হয় নি।

তিনি বলেন, এখন বেরোনো দরকার, নইলে তার ও তোমার সম্মান থাকে না।

আমি বলি, বাবা বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন না; পত্রিকায় তাঁর ছবি দেখলে আমার ঘেন্না লাগবে, তাকে আমার বাবা মনে হবে না।

সবাই হাহাকার করে ওঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *