৫. কয়েক দিন পর একটি ঘটনা

কয়েক দিন পর একটি ঘটনা ঘটে। অফিসের মাইক্রোবাসে অনেকের সাথে আমিও অফিসে যাই এবং ফিরি; সেদিনও মাইক্রোবাসটি আমাকে নামিয়ে দেয়, আমি নেমে বাসায় উঠে আসি। মাইক্রোবাস থেকে নেমে আমি পেছনের দিকেও তাকাই না, বাসায় ঢুকে কাপড় বদলিয়ে বাথরুমে ঢুকি। বাথরুমে ঢুকেই সেদিন আমি কোলাহল আর কান্না শুনতে পাই। কোলাহল নিয়মিত ব্যাপার, কান্নাটিকেই একটু নতুন সংযোজন মনে হয়। কারো কান্না শুনলেই আমি আর কাতর হয়ে উঠি না, কান্নাকে একটা সাংসারিক কর্তব্য বলেই আমার মনে হয়। আমি মগ দিয়ে মাথায় আর শরীরে পানি ঢেলে চলেছি, কল থেকে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে, কান্না আর কোলাহলও আমি শুনতে পাচ্ছি না। তখন বাথরুমের দরোজায় মা আর ডলি ফুঁ দিয়ে চিৎকার করে আমাকে ডাকতে থাকে; তাড়াতাড়ি বেরোতে বলে; আমি বেরিয়েই বাড়িভর্তি পাড়াবাসীদের দেখতে পাই। তাদের অনেককেই আমি চিনি, অর্থাৎ অনেককেই আমার চেনা মনে হয়; তবে অনেকের সাথে আমার কখনো কথা হয় নি।

চিৎকার করে তারা বলে, আপনি বাইরে চলেন, দেখেন আপনার ড্রাইভার কী করছে।

আমি বলি, আমার তো কোনো গাড়ি নেই, ড্রাইভারও নেই।

তারা বলে, আপনার ড্রাইভার না, আপনার অফিশের ড্রাইভার।

আমি জানতে চাই, ড্রাইভার কী করেছে?

তারা বলে, খুন করছে।

খুনের কথা শুনে আমি চমকে উঠি না, কোনো আর্তনাদও করি না; তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারি তারা আমার মুখে একটা ভীষণ চমকানো ভাব দেখতে চেয়েছিলো, আমার কণ্ঠের একটা আর্তনাদ শুনতে চেয়েছিলো। তা না পেয়ে তারা হতাশ হয়। আমি যে চমকাই নি, আর্তনাদ করি নি, এতে আমারও বিস্ময় লাগে। আমার মনে হয় সংবাদপত্রের পাতার কয়েক শো খুনের খবরের মধ্যে এইমাত্র একটি আমি পড়লাম। খুনের খবর পড়ে সবার মতো আমিও কখনো ছুটে বেরোই না; কে কখন কীভাবে খুন হয়েছে দেখতে যাই না; বরং অন্য কোনো স্তম্ভে খুনের খবর থাকলে তা দ্রুত পড়ে ফেলি; এবং ভুলে যাই। অফিসের ড্রাইভার কাকে পথে খুন করেছে, আমি কেনো দেখতে যাবো? কেনো উত্তেজিত হবো? না, তবে আমাকে যেতে হবে; আমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি ঘোরানোর সময়ই ড্রাইভার কাজটি করেছে। তাই এই খুনের সঙ্গে আমি জড়িয়ে আছি; তাই আমাকে তাদের সাথে বাইরে গিয়ে খুনের পরবর্তী দৃশ্য দেখতে হবে; তাই আমি তাদের সাথে বাইরে যাই। নেমেই দেখি একটি ছোটো শিশুর মাথা পিষে গেছে, তার মাথা থেকে ছোট্ট এক বাটি মগজ একদিকে ছিটকে পড়ে আছে, পাশে একটুকু লাল রক্ত ছড়ানো, শিশুটি চিৎ হয়ে পড়ে আছে। তার শরীরের আর কোথাও একটা দাগও নেই, শুধু তার মাথার ওপর দিয়ে মাইক্রোবাসের একটি চাকা চলে গেছে।

দৃশ্যটি আমার সুন্দর লাগে। শিশুটি বেশ সুন্দর ছিলো; তার গায়ে নতুন জামা, পায়ের জুতোও নতুন। সে নতুন জুতো আর জামা পরে সুন্দরভাবে ঘুমিয়ে আছে। শুধু ঘুম থেকে আর জাগবে না; আর লুকোচুরি খেলবে না। দুটি নারী তার পাশে বসে কাঁদছে, কেঁদে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে; একটি নারী তাই ধারাবাহিকভাবে কাঁদতে পারছে না। থেমে থেমে কাঁদছে। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হয় তারা চাচ্ছে আমি একটুকু কাঁদি। আমি কাঁদলে তারা শান্তি পাবে, তাদের বুকে শক্ত অশান্তি জমে আছে, আমি কাঁদলে তাদের অশান্তিটা গলে যাবে। আমার কান্নার কথা মনে পড়ে না; আমার ভেতরে এমন কিছু ঘটে না, যাতে আমি ডুকরে উঠতে পারি। শিশুটির শুয়ে থাকাটা–আমার সুন্দর লাগে; আরেকবার তাকিয়ে আমি তাকে দেখি।

ঘটনা আর কাহিনী তারা বিস্তৃতভাবে, এলোমেলো ও চিৎকার করে, বিবৃত করতে থাকে। আমি তা নিজের ভেতরে সাজাতে থাকি।

ঘটনা পুনর্গঠন করলে দাঁড়ায় : মাইক্রোবাসটি যখন আমাকে নিয়ে আসে তখন কয়েকটি শিশু লুকোচুরি খেলছিলো, মাইক্রোবাসটি আমাকে নামানোর জন্যে থামলে শিশুটি মাইক্রোবাসের পেছনে লুকোয়; ড্রাইভার গাড়ি ঘোরানোর সময় তার মাথাটি গাড়ির পেছনের চাকার নিচে পড়ে যায়।

কাহিনী পুনর্গঠন করলে দাঁড়ায় : শিশুটি দিনাজপুর থেকে গতকাল নানার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। তার বাবা সেখানে একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক, তিনি আসতে পারেন নিঃ তার মা তাকে নিয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। শিশুটি বাপমায়ের একমাত্র সন্তান; বয়স পাঁচ বছর। বেড়াতে আসার কোনো কথা ছিলো না, শিশুটিই ঢাকায় বেড়াতে আসার জন্যে পাগল হয়ে ওঠে, কয়েক মাস ধরেই সে আসার জন্যে কান্নাকাটি করছিলো; তাই তার মা টিকতে না পেরে গতকাল বাপের বাড়ি আসে। আজ সকালে তার নানা তাকে নতুন জামা আর জুতো কিনে দিয়েছেন; নতুন জামা আর জুতো পরে সে তার মামাতো ভাইদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিলো, আর তখনই আমাদের অফিসের গাড়ি পেছনে ফিরতে গিয়ে তাকে স্তব্ধ করে দেয়। সে আর খেলবে না।

আমার চোখে কোনো অশ্রু জমে না; বুকে কোনো কাঁপন লাগে না; রক্তে কোনো কষ্ট প্রবাহিত হয় না।

গাড়িতে পাঁচজন কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁরা বিধ্বস্ত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছেন। তাঁদের ঘিরে রেখেছে পাড়ার তরুণ সমাজসেবকগণ। একটু দূরে ড্রাইভার অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তাকে হাত ও পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। তার হাত আর পা না বাধলেও চলতো; তার হাত আর পা দুটির এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, ওগুলো সে আর কখনো ব্যবহার করতে পারবে বলে মনে হয় না।

গাড়িটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ে আছে। পাড়ার সমাজসেবকেরা ভাঙার বিস্ময়কর বিজ্ঞান জানে; বোঝার কোনো উপায় নেই ওটি কিছুক্ষণ আগে গাড়ি ছিলো; দ্রুতবেগে চলতো।

আমি দুঃখ পাই গাড়িটির জন্যে, যেটিকে কখনো কখনো আমি অশ্ব ভাবতাম।

আমার বিধ্বস্ত সহকর্মীদের পাশে গিয়ে আমি বসি; তাদের জন্যে আমার কষ্ট লাগে না; যেমন আমি যদি তাদের বাসার সামনের পথে পাড়ার সমাজসেবকগণের উদ্যোগে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে থাকতাম তাদের কষ্ট লাগতো না। তারা সবাই মরে গেলেও আমার কষ্ট হতো না, এমন মনে হয়, যদিও তাদের অন্তত তিনজনকে আমি বেশ পছন্দ করি; আর অন্তত দুজন যদি দিনে একবার আমার ঘরে এসে না বসে আমার খারাপ লাগে, আমি খবর দিয়ে আনি, চা খেতে খেতে অনেকক্ষণ গল্প করি। একজনের স্ত্রীকে আমার খুব পছন্দ; তার স্ত্রী আমাকে দেখলে এতো চঞ্চল হয়ে ওঠে যে আমার মনে হয় অমন একটি কন্যা আমার থাকলে বেশ হতো, যদিও আমি আমার ঔরষে কোনো কন্যা বা পুত্র জন্ম দিতে চাই না। আমি তাদের জন্যে বাসা থেকে পানি আনাই। পাড়ার তরুণ সমাজসেবকেরা, যারা তাদের বিধ্বস্ত করেছে, আনন্দের সাথে পানি আনার দায়িত্ব পালন করতে থাকে; প্রমাণ দিতে থাকে যে তারা সমাজসেবক হিশেবে পুরস্কৃত হওয়ার যোগ্য। তারা বিধ্বস্তদের পানি খাওয়ায়, শরীরের এখানে সেখানে লেগে-থাকা ময়লা পরিষ্কার করে, তাদের কাছে মাফও চায়; এবং তাদের জন্যে বেবিট্যাক্সি ডেকে আনে। তারা আমার সাথে ড্রাইভারকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। হাসপাতালে যাওয়ার সময় একবার আমার মনে হয় ও মরে গেলে ওকে নিয়ে আমার হাসপাতালে যেতে হতো না।

আমার দুঃখ লাগে মাইক্রোবাসটির জন্যে। হঠাৎ মনে হয় মাইক্রোবাসটিকে আমি ভালোবাসি; এমন একটি মাইক্রোবাস আমি কখনো সৃষ্টি করতে পারবো না; আমার ঔরষে এমন একটি মাইক্রোবাস কখনো জন্ম নেবে না। আমার কোনো গাড়ি নেই; এমন একটি মাইক্রোবাস আমার কখনো হবে না। মাইক্রোবাসটি কখনো আমাকে সুখ ছাড়া দুঃখ দেয় নি। আমি সব সময়ই মাইক্রোবাসটির সামনের আসনে বসেছি; অন্যরা যে ওই আসনটি কখনো দখল করতো না, এটা আমাকে সুখ দিতো; পনেরো মিনিটের জন্যে আমি এ-সুখ উপভোগ করতাম। আমাকে সামনের আসনে বসিয়ে মাইক্রোবাসটি সুখ পাচ্ছে, আমার কি এমন মনে হতো? আর কখনো গাড়িটিকে দেখবো না; স্পর্শ পাবো না? মাইক্রোবাসটির স্পর্শের অনুভূতি আমাকে শিউরে দেয়, আমার ত্বকের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত হঠাৎ একটা বাতাস বয়ে যায়। আমার কি কাঁদতে ইচ্ছে করছে? আমার চোখে একবার একবিন্দু জল এসে গেছে বলে আমার মনে হয়; চোখের জল মোছর মতো করে আমি চোখে আঙুল বোলাই। চোখের জল মুছছি দেখে বা ভেবে কয়েকজন সমাজসেবক আমার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকায়।

সন্ধ্যার পর সমাজসেবকগণ, কয়েকজন বৃদ্ধ, আর শিশুটির মা আমাদের বাসায় আসে।

একজন সেবক বলে, আপনি যে জানাজায় গেলেন না?

আমি বিব্রত বোধ করি।

আরেক সেবক বলে, আপনার জন্যেই আমার ভাগনেটা মারা গেলো, আর আপনি একবারও আমাদের বাসায় গেলেন না, জানাজায়ও গেলেন না।

আমি বলি, যাওয়ার কথা আমার মনে পড়ে নি।

তারা সবাই কেঁপে উঠলো বলে মনে হলো।

আরেক সেবক বলে, আপনারা আমলারা খুন করার পর খুনের কথাও মনে রাখতে পারেন না, এজন্যেই আপনারা আমলা। জীবনে আপনারা কতো খুন করেছেন।

আরেক সেবক বলে, আপনার চোখে একটু পানিও আসে নি।

এক বৃদ্ধ বলেন, তোমাকে আমরা ছোটোবেলা থেকেই চিনি, তোমাকে আমরা ভালো বলেই জানি, তুমি ভালো চাকুরি করো, এমন একটা খুন তুমি করবে আমরা ভাবি নি।

তাঁর কথা শুনে মনে হয় আমি সত্যিই খুন করেছি। শিশুটি পথে দাঁড়িয়েছিলো, দেখে আমার ঘেন্না লেগেছিলো, আমি একটি বন্দুক এনে তার মাথা লক্ষ্য করে পর পর কয়েকটি গুলি করেছিলাম। তার মগজ ছিটকে পড়ছে দেখে আমার ভালো লেগেছিলো।

কিন্তু আমি বলি, তখন তো আমি গাড়িতে ছিলাম না।

এক বৃদ্ধ বলেন, গাড়িটা তো তোমাকে নামানোর জন্যেই এসেছিলো।

এক তরুণ সেবক বলে, আপনার জন্যেই শিশুটি খুন হয়েছে।

শিশুটির মা চুপ করে বসে আছেন। তিনি কাঁদছেন না। তিনি কাঁদছেন না দেখে আমার খারাপ লাগে।

আমি জিজ্ঞেস করি, আপনি যে কাঁদছেন না?

মা’টি একটু বিব্রত হয়; অন্যরাও নড়েচড়ে বসে।

আমি আবার জিজ্ঞেস করি, আর কোনো বাচ্চা আপনার নেই।

তিনি বলেন, না।

আমি বলি, বাচ্চার জন্যে আপনি কষ্ট পাচ্ছেন না?

সবাই চিৎকার করে ওঠে।

সেবকেরা বলে, এমন কথা বলার জন্যে আপনাকে মাফ চাইতে হবে। তার বাচ্চা মারা গেছে আর সে কষ্ট পাবে না? সে কি আপনার মতো?

আমি বলি, আমার ভুল হয়ে গেছে; তবে আপনারা আসার আগে শিশুটির মার কথা একবার আমার মনে হয়েছিলো, যদিও কে মা তা আমার জানা ছিলো না; আমি ভেবেছিলাম তিনি এখন শিশুটির কবরের পাশে বসে কাঁদছেন।

এক সেবক বলে, কষ্ট পেলে লাশের সাথে কি কবরে যেতে হবে?

আমি বলি, আমি কখনো কষ্ট পাই নি; কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো কারো জন্যে কষ্ট পেলে আমি তার কবরে নেমে যেতাম, কবরে শুয়ে থাকতাম।

আরেক সেবক বলে, দেখেন, বন্ধুকে পানিতে ফেলে দিয়ে তার বউকে আপনি বিয়ে করেছেন সেই খবর আমরা রাখি।

আমি বলি, আমার বন্ধুর জন্যে আমি বোধ হয় কষ্ট পাই নি, আর তার লাশও পাওয়া যায় নি।

এক সেবক বলে, আপনারা আমলারা যাদের পানিতে ফেলেন, তাদের লাশ কখনো পাওয়া যায় না। আর বন্ধুর জন্যে কেনো কষ্ট পাবেন, তার সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে তো এখন সুখেই আছেন।

আমি বলি, আপনারা সব জানেন না।

এক বৃদ্ধ বলেন, তোমার কাছে আমরা কেনো এসেছি, তুমি কি বুঝতে পারছো?

আমি বলি, না, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

তিনি বলেন, তোমাকে নামাতে এসেই ড্রাইভার শিশুটিকে খুন করেছে।

আমি বলি, হ্যাঁ। তিনি বলেন, আমরা ড্রাইভার আর তোমাদের নামে মামলা করেছি।

আমি বলি, নিয়মমতো কাজই করেছেন।

তিনি বলেন, শিশুটি রহিমার একমাত্র সন্তান ছিলো, বড়ো আদরের সন্তান।

আমি কোনো কথা বলি না।

তিনি বলেন, তবে মামলা আমরা করতে চাই না।

আমি বলি, তা আপনাদের ইচ্ছে।

তিনি বলেন, একটা কথা কী জানো রহিমার আর সন্তান হবে না, তার আর সন্তান ধারণের শক্তি নেই।

চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে; এবং রহিমা, শিশুটির মা, ডুকরে কেঁদে ওঠেন। তাঁর কান্না শুনে ডলি, বেলা, আর মা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে; তারা সবাই মিলে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। সমাজসেবক আর বৃদ্ধরাও অশ্রুভারাতুর হয়ে পড়ে; দুটি সেবক উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, তাদের কান্না আর অশ্রুতে বসার ঘরটি শোকবিহ্বল হয়ে পড়ে। আমার একটি সিগারেট খেতে ইচ্ছে করে। অনেকক্ষণ ধরেই ইচ্ছে করছিলো; কিন্তু শোকাতুর মা আর বৃদ্ধদের সামনে আমি সিগারেট খেতে চাই নি, আমার দ্বিধা লাগছিলো; এবার আমি একটি সিগারেট বের করি; টান দিতেই আমার ভেতরটা সুখে ভরে ওঠে।

এক বৃদ্ধ বলেন, রহিমার যদি সন্তান ধারণের শক্তি থাকতো তাহলে কথাটা বলতাম না, সেই শক্তি নেই বলেই কথাটা বলছি।

আমি বলি, বলুন।

তিনি বলেন, রহিমাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

আমি বলি, ক্ষতি? কার ক্ষতি? আর কিসের ক্ষতিপূরণ?

তিনি বলেন, এই যে রহিমার ছেলেটিকে তোমার ড্রাইভার খুন করেছে।

আমি বলি, একটি শিশু গাড়ির চাকার নিচে পড়ে মারা গেছে, একে কি আপনারা ক্ষতি বলছেন?

তারা সবাই চুপ করে যায়, তাদের মুখে আমি অপরাধবোধের আঁকাবাঁকা দাগ দেখতে পাই। তারা কেউ কথা বলে না।

এক বৃদ্ধ বলেন, হ্যাঁ, এটা তো ক্ষতিই।

আমি বলি, একমাত্র সন্তান মারা যাওয়াটা ক্ষতি?

বৃদ্ধ বলেন, আমাদের তো তাই মনে হয়।

ক্ষতি কাকে বলে? আমি আর ক্ষতি শব্দের অর্থ বুঝতে পারি না। আমার ইচ্ছে হয় অভিধান দেখি, কিন্তু কোনো অভিধানের নাম আমি মনে করতে পারি না।

আমি বলি, কীভাবে তার ক্ষতিপূরণ করা যেতে পারে?

এক বৃদ্ধ বলেন, পঞ্চাশ হাজার টাকা দিলে ওই ক্ষতিপূরণ হতে পারে।

আমি একটা কষ্ট বোধ করি, আর পরমুহূর্তেই আমার কোনো কষ্ট লাগে না।

আমি রহিমাকে জিজ্ঞেস করি, পঞ্চাশ হাজার টাকা দিলে আপনি কি আপনার ছেলেকে ফিরে পাবেন?

তিনি বলেন, না।

আমি বলি, আপনি কি টাকা চান?

তিনি বলেন, হ্যাঁ।

আমি বলি, আপনি কি আপনার ছেলেকে ভালোবাসতেন না?

তিনি চুপ করে থাকেন।

আমি সবাইকে বলি, গাড়ির নিচে পড়ে কেউ মরলে তার জন্যে কে দায়ী তা আমি জানি না।

এক সেবক বলে, ড্রাইভার দায়ী, আপনারা দায়ী।

আমি বলি, আমি ঠিক জানি না, তবে যে মারা গেছে সেও তো দায়ী হতে পারে। সেবকেরা চিৎকার করে ওঠে, কেনো সে দায়ী হবে? তার কোনো অপরাধ নেই। সে ছোট্ট শিশু। সে কোনো অপরাধ করে নি। সে দায়ী হতে পারে না।

আমি বলি, শিশুরাও অপরাধ করতে পারে।

সেবকেরা আবার চিৎকার করে, শিশুরা অপরাধ করতে পারে না; শিশুরা নিষ্পাপ, তারা দেবতা, তারা ফেরেশতা, তারা কোনো অপরাধ করতে পারে না। অপরাধ করেন আপনারা।

পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে; উত্তপ্ত পরিবেশ স্বাস্থ্যকর নয়, কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ারও সহায়ক নয়। তাই পরিবেশকে ভাবগম্ভীর করে তোলার উদ্যোগ নিতে এগিয়ে আসে কেউ কেউ।

এক সেবক ধীরস্থিরভাবে বলে, আপনি আমলা বলেই এমন কথা বলতে পারলেন, দেখতে পাচ্ছি আমলাদের চোখে শিশুরাও অপরাধী।

পরিবেশ ভাবগম্ভীর হয়ে ওঠে না।

আরেকজন বলে, দায়ী আপনারাই।

আমি বলি, আমি আইন জানি না, যারা আইন জানে তারাই বলতে পারবে কে দায়ী।

সেবকেরা বলে, আইন আমরাও জানি। দরকার হলে আইন আমরা শিক্ষাও দিতে পারি।

আমি বলি, দয়া করে আমাকে একটি আইন শেখালে খুশি হবো।

তারা বলে, বলুন।

আমি বলি, আমি তো তখন গাড়িতে ছিলাম না।

তারা বলে, কিন্তু অপরাধটা আপনারই; আপনাকে নামিয়ে দেয়ার জন্যেই গাড়ি এসেছিলো।

আমার নিজেকে উদ্ধার করার ইচ্ছে করে না; ডলি আমাকে উদ্ধার করার দায়িত্ব নেয়; তাকে আমার বাধা দিতেও ইচ্ছে করে না।

ডলি শিশুটির মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আপনার ছেলে আমার ছেলেও হতে পারতো। তার জন্যে আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে।

শিশুটির মা ডলিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। বেদনায় তারা দুজন পরস্পরের ভগিনী হয়ে ওঠে।

ডলি হঠাৎ উঠে দৌড়ে আমাদের ঘরে যায়-তাকে অলৌকিক বাণীপ্রাপ্তর মতো অনুপ্রাণিত মনে হয়; আমি আলমারি খোলার শব্দ পাই। তারপরই দেখি ডলি অধিকতর অনুপ্রাণিতর মতো এসে ঢুকছে।

ডলি তার অলঙ্কারগুলো শিশুটির মার দিকে দু-হাতে তুলে ধরে বলে, আপা, আপনি এগুলো নিন, আমার আর নেই, থাকলে আপনাকে দিতাম।

শিশুটির মা অলঙ্কারগুলোর দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকায়।

আমি বলি, ডলি, তুমি এগুলো তাকে দেবে না।

ডলি বলে, না, এগুলো আমি তাকে দেব, এগুলোতে আমার কোনো দরকার নেই।

এক বৃদ্ধ বলেন, এতোগুলোর দরকার নেই, অর্ধেক দিলেই চলবে; এগুলোর দাম লাখ টাকার বেশি হবে।

ডলি বলে, শিশুটির দাম লাখ টাকার অনেক বেশি, থাকলে আমি আপাকে কোটি কোটি টাকা দিতাম।

শিশুটির মার মুখ প্রশান্ত হয়ে ওঠে।

আমি শিশুটির মাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি কি এগুলো চান?

শিশুটির মা কথা বলে না।

আমি বলি, এগুলো নিতে হলে একটা কথা আপনাকে বলতে হবে।

সবাই আমার দিকে তাকায়। আমার মনে হয় তারা কথাটি বুঝে ফেলেছে, তাই আমার আর কথাটির কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু আমি দেখতে পাই তারা কী কথা বলতে হবে জানার জন্যে অধীর হয়ে আছে; আমি বলছি না দেখে ধৈৰ্য্য হারিয়ে ফেলছে। তবু আমি কথাটি বলতে পারি না।

এক সেবক বলে, বলুন, রহিমা আপাকে কী কথা বলতে হবে।

আমি বলি, না, থাক।

এক বৃদ্ধ বলেন, তুমি বলো, রহিমা কথাটি বলেই এগুলো নেবে।

আমি কথাটি বলতে পারি না।

সেবকেরা বলে, বলুন, কী কথা বলতে হবে?

আমি বলি, আপনি বলুন যে আপনি আপনার ছেলেকে ভালোবাসতেন না, তার মৃত্যুতে আপনি সুখী হয়েছেন।

আমার কথা শুনে সবাই কেঁপে ওঠে, শিশুটির মা ডুকরে ওঠে; আর ডলি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে, তাকে আমার সব অলঙ্কার নিতে দাও, কিন্তু তাঁকে তুমি একথা বলতে বোলো না।

পরদিন অফিসে গিয়েই দেখি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়ে গেছে; এবং এগোরাটায় আমাকে অতিরিক্তর কক্ষে সাক্ষী দিতে যেতে হবে। সাক্ষী নয়, যেতে হবে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে; কমিটি অনেকখানি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যে আমাকে নামাতে গিয়েই রাষ্ট্রের একটি দামি যানবাহন সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং ওই রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি রক্ষার জন্যে আমি কোনো চেষ্টা করি নি। ঠিক সময়ে আমি তিন সদস্যের কমিটির মুখোমুখি হই।

১ম যুগ্ম জিজ্ঞেস করেন, গাড়িটি আপনাকে নামাতে গিয়েই সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এটা কি সত্য?

আমি বলি, জি, স্যার।

২য় যুগ্ম জিজ্ঞেস করেন, মাইক্রোবাসটি রক্ষা করার জন্যে আপনি কোনো চেষ্টা করেন নি, এটা কি সত্য?

আমি বলি, জি, স্যার।

অতিরিক্ত বলেন, তাহলে আমাদের তদন্ত এখানেই শেষ হলো।

আমি বলি, স্যার, আমার কিছু কথা ছিলো।

অতিরিক্ত বলেন, বলুন।

আমি বলি, ড্রাইভার একটি শিশুকে চাপা দিয়েছিলো, শিশুটি মারা গেছে।

১ম যুগ্ম বলেন, শিশুর মৃত্যু গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আমি বলি, আমি তখন গাড়িতে ছিলাম না।

২য় যুগ্ম বলেন, আপনি গাড়িতে ছিলেন না, তাও গুরুত্বপূর্ণ নয়; কথা হচ্ছে গাড়িটি আপনাকে নামাতে গিয়েছিলো।

আমি বলি, শিশুটি খুব সুন্দর ছিলো, স্যার।

১ম যুগ্ম বলেন, তাতে কিছু যায় আসে না।

আমি বলি, সুন্দর মানুষ আজকাল বেশি দেখা যায় না, স্যার।

তিনি বলেন, সৌন্দর্য এবং মানুষ আমাদের বিবেচনার বিষয় নয়।

আমি বলি, শিশুটি তার পিতামাতার একমাত্র সন্তান ছিলো, স্যার।

২য় যুগ্ম বলেন, মাস দশেকেই আরেকটি শিশু তারা উৎপাদন করতে পারবে, কোনো নিষেধ নেই।

অতিরিক্ত বলেন, কিন্তু স্ত্রীদের গর্ভে আমরা মাইক্রোবাস উৎপাদন করতে পারি না।

আমি উঠে আসি। ডলি কি একটা মাইক্রোবাস গর্ভধারণ করতে পারবে? ডলিকে আজ বলবো, আমি একটা সন্তান চাই, মানুষ নয়; একটা মাইক্রোবাস। শুধু মাইক্রোবাস কেনো? ডলির গর্ভে আমি রেলগাড়ি জাহাজ উড়োজাহাজ হেলিকপ্টার উৎপাদন করতে চাই। ডলির গর্ভকে, আমার সাধ হয়, একটা শক্তিশালী কারখানায় পরিণত করতে, যেখানে উৎপাদিত হবে ট্যাংক, ট্যাংকার, বোমারু বিমান, মিসাইল, আণবিক বোমা। ডলির গর্ভকে একটা তেলের খনিতে পরিণত করতে চাই আমি, আমাদের সঙ্গমে প্রতিদিন যা প্রসব করবে লাখ লাখ ব্যারেল পেট্রোলিয়ম। ডলির গর্ভে আমি উৎপাদন করতে চাই টমোটা, টাটা, ফোক্সওয়াগন, মার্সিডিজ; রক্তমাংসের ঘিনঘিনে মানুষ নয়, আমাদের সঙ্গমে আমার ঔরসে ডলির গর্ভে উৎপাদিত হবে সুপারসোনিক বিমান, আণবিক সাবমেরিন, জগন্নাথ ট্রাক, শীততাপনিয়ন্ত্রিত বাস, রঙিন টেলিভিশন, দশতলা দালান, নদীর ওপর সাড়ে তিন কিলোমিটার ব্রিজ।

কিন্তু শিশুটিকে একবার দেখতে ইচ্ছে হয় আমার, এবং আমার হাসি পায় যে শিশুটিকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে। শিশুর অভাব নেই চারপাশে, রাস্তায় নামলেই একটার পর একটা শিশু আমি দেখতে পারি। কিন্তু আবার আমার ওই ইচ্ছেটা হয়। কেনো আরেকটুকু ভালো করে দেখলাম না? এখন ও কোথায় কতোটা মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। ওর মা কি কবরের পাশে বসে কাঁদছে? ওর জানাজায় কি আমি গিয়েছিলাম? না, যাই নি; যাওয়ার কথা মনে পড়ে নি; পড়লেও যেতাম না। আমি কখনো কোনো জানাজায় যাই নি; সেখানে দাঁড়িয়ে কী বলতে হয় জানি না; বললে কী হয় জানি না। ওর মতো ছেলেবেলায় যদি আমি কোনো মাইক্রোবাসের পেছনে লুকোতাম তাহলে এখন আমি এখানে থাকতাম না। ও নিশ্চয়ই কোনো গোরস্থানে শুয়ে আছে। ঢাকায় কততগুলো গোরস্থান আছে? শুধু একটি গোরস্থানই আমি চিনি। সেটা দেখলে আমি অসুস্থ বোধ করি। ও কি সেখানকার মাটির নিচেই পড়ে আছে? ওর জন্যে আমার মায়া হয়। ও কি জানে ওর মার ক্ষতিপূরণ হয়ে গেছে? আমি বেরিয়ে পড়ি, নোংরা গোরস্থানটির গেইটে নামি। যতোই ভেতরে ঢুকতে থাকি, ততোই আমার নোংরা লাগতে থাকে। আমি ভেবেছিলাম ভেতরে শান্তি বিরাজ করবে, যা মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেবে; কিন্তু যতোই এগোতে থাকি ততোই চারপাশ আমাকে নোংরা জীবনকে মনে করিয়ে দিতে থাকে। এখানে যারা শুয়ে আছে মৃত্যুর পরও তারা সুখ পাচ্ছে না; জীবনের অসুখ তাদের ঘিরে আছে। তারা জীবনকে অসুস্থ করে রেখেছিলো, এখন মৃত্যুকেও অসুস্থ করে রাখছে। গোরস্থানটিকে করে তুলেছে কবরের বস্তি। আমি নতুন কবরগুলোর দিকে এগোতে থাকি; একটি লোকের থেকে জেনে নিই গতকালের শিশুদের কবরগুলো কোথায়। একটি নয়, দশবারোটি শিশুদের কবর; প্রায় পাশাপাশি তারা মাটির নিচে লুকিয়ে আছে, ওপরে বাঁশের বেড়া ঝকঝক করছে-ওগুলো হয়তো। জানে না ওদের নিচে ঘুমিয়ে আছে শিশুরা। কিন্তু কোন কবরের খোঁজে আমি এসেছি?

কোন কবরটি ওর? কোন কবরে ও মাইক্রোবাসের পেছনে লুকিয়ে আছে? আমি এক কবর থেকে আরেক কবরে যেতে থাকি। আমার মনে হয় এখনি কবরের মাটিতে ওর মুখের ছাপ দেখতে পাবো। তবে ওর মুখটি কি আমার মনে আছে? মুখ দেখে কি চিনতে পারবো ওকে? বহু দিন আমি ভালো করে কোনো শিশুর মুখ দেখি নি। শিশুর মুখ কেমন? আমি শুধু ছিটকে পড়া একবাটি মগজ দেখতে পাই, পাশে একদাগ রক্ত; ওর মুখ আমার মনে পড়ে না। আমি ওর মুখটি খুঁজতে থাকি, আমার ভেতরে ওর মুখ খুঁজে পাই না। আমার ভেতরে কতো মাটি জমেছে যে মুখটি আমি দেখতে পাচ্ছি না? আমি কোনো শিশুর মুখই মনে করতে পারি না; আমার চোখে শুধু মড়ার খুলি ভেসে উঠতে থাকে। প্রত্যেকটি কবরই কি ওর? প্রত্যেকটি কবরের মাটির নিচে, বাঁশের বেড়ার তলে, ও মাইক্রোবাসের পেছনে লুকানোর চেষ্টা করছে? কবরের পাশে এলে প্রার্থনা করতে হয়? আমি কোনো প্রার্থনা জানি না; আমার ভেতরে কোনো প্রার্থনা জাগছে না। ও কি জানে ওর মার ক্ষতিপূরণ হয়ে গেছে? একটি লোক পাশে এসে দাঁড়ায়, সে বলছে সে প্রার্থনা করতে জানে; পাঁচ টাকা লাগবে। আমি তাকে পাঁচটি টাকা দিই; লোকটি জানতে চায় কোন কবরের জন্যে প্রার্থনা করতে হবে; আমি বলি আমি জানি না।

ডলি বলে, আমাদের এই পাশাপাশি শোয়া নিরর্থক, কী হবে পাশাপাশি শুয়ে, আমার আর ইচ্ছে করে না।

আমি বলি, পাশাপাশি শোয়ার মধ্যে কোনো অর্থ আছে বলে তো আমি জানি না।

ডলি বলে, তাহলে শোও কেনো?

প্রশ্নটিকেই নিরর্থক মনে হয় আমার; তাই বলি, আমি জানি না।

ডলি বলে, এও জানো না? তাহলে কী জানো?

আমি বলি, বেশি কিছু না।

ডলি বলে, আমি তো পাশের বাসার লোকটির সাথে এক বিছানায় শুতে পারি না, এটা জানো?

আমি বলি, জানি; তবে ইচ্ছে হলে তুমি শুতে পারো।

ডলি বলে, এমন করলে এরপর আমার ইচ্ছে হবে।

আমি বলি, কী করছি?

ডলি বলে, তাও বুঝতে পারছো না?

আমি বলি, না তো।

ডলি বলে, পাশাপাশি শুয়ে থাকলেই দেহ জুড়িয়ে যায় না, আমার একটি দেহ আছে, তার ক্ষুধা আছে।

আমি বলি, ক্ষুধা?

ডলি বলে, তোমার মনে আছে ক-মাস ধরে আমরা কিছু করি নি?

আমি বলি, না, হিশেব করি নি।

ডলি বলে, তুমি হয়তো বাইরে কিছু করো, তাই তোমার মনে নেই; আমার মনে আছে, আমি তো বাইরে কিছু করতে পারি না।

আমি বলি, করতে পারো।

ডলি বলে, করতে পারো বললেই মেয়েমানুষ করতে পারে না।

আমি বলি, তুমি ঘুমোও, আমি একটু পড়ি।

ডলি বইটি ছুঁড়ে ফেলে দেয়; বলে, বিছানা শোয়ার জন্যে, পড়ার ইচ্ছে হলে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে কোনো হলে গিয়ে ওঠো।

আমি বইটি কুড়িয়ে বসার ঘরে গিয়ে বসি। বইটি পড়তে শুরু করেই আমার ভেতরে অদ্ভুত শান্তি নামে; শব্দটি ঠিক হলো না, ওই অনুভুতির জন্যে আমি কোনো শব্দ জানি না; ওই বোধকে সুখও বলা ঠিক হবে না। শান্তি বা সুখ ওই অনুভূতির কাছে খুব গরিব শব্দ। তা সুখের থেকে, জীবনের থেকে বেশি; শিশুর মৃত্যুর থেকে, নারীর সাথে পাশাপাশি শোয়া আর কিছু করার থেকে বেশি। লোকটি বড়ো কিছু করতে চায় নি, শুধু তার ছেলেবেলার কথা বলেছে; নিজের কথা বলেই নি, বলেছে গাছপালা নদী জল পুকুর মাছ মেঘ খেজুরগাছ শিশির কুয়াশা ধান বৃষ্টির কথা। লোকটি কী করে তার ছেলেবেলাকে এমনভাবে মনে রেখেছে? তার মনে ছেলেবেলা এমনভাবে ঢুকে আছে কীভাবে? আমি আমার ছেলেবেলাকে মনে করতে চাই, পারি না; তাতে কোনো বৃষ্টি নেই গাছ নেই জল নেই সবুজ নেই মেঘ নেই কুয়াশা নেই শিশির নেই। আমার কোনো বন্ধু ছিলো? মনে করতে পারি না। কোনো কিশোরীকে দেখে কোনো সন্ধ্যায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম আমি? মনে পড়ে না। একরাশ জোনাকিপোকার পেছনে পেছনে ছুটেছিলাম? জোনাকিপোকা আমি কখনো দেখিই নি, শুধু নামটি জানি। শীতে কুয়াশার ভেতর দিয়ে শিশিরভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে আমি কখনো ছুটেছিলাম? শিশির কাকে বলে? ঘাস কেনো শিশিরে ভেজে? কুয়াশা কাকে বলে? ঘাস কী? আমি মনে করতে পারি না। কিন্তু লোকটির সাথে আমি শিশিরে ভিজতে থাকি, কুয়াশায় ভিজতে থাকি, জোনাকিপোকার পেছনে পেছনে দৌড়াতে থাকি; দেখতে পাই বাঁশবাগানের মাথার ওপর একটা ভয়ঙ্কর চাঁদ উঠেছে।

বই পড়তে পড়তে আমার কখনো ঘুম আসে না; কখনো আমি পাশে বই খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়ি নি। যখন আমি ঘুমোতে চাই তখন খুব যত্নের সাথে আমি বই বন্ধ করি, ঠিক জায়গায় রাখি; আজো যত্নের সাথে বইটি বন্ধ করে ঠিক জায়গায় রাখার কথা মনে হয়; তবে রাখতে পারি না। ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু আমি কোথায় ঘুমোবো? ডলি কি জেগে আছে? জেগে থাকলে তার পাশে গিয়ে আমি ঘুমোতে পারবো না, আমার ইচ্ছে করছে না। ডলি কি ঘুমিয়ে আছে? ঘুমিয়ে থাকলে ঘুমন্ত একটি নারীর পাশে গিয়ে চুপচাপ আমি শুয়ে পড়তে পারবো না, আমার ইচ্ছে করছে না। তাহলে আমি বসার ঘরেই ঘুমিয়ে পড়বো? শয্যার বাইরে আমি কখনো ঘুমিয়েছি বলে মনে পড়ে না; আমি মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়তে পারবো না। ডলি ক্ষুধার কথা বলছিলো? শরীর না-জুড়োনোর কথা? আমি কি ক্ষুধা বোধ করছি, আমার শরীর কি উত্তপ্ত হয়ে থাকছেঃ আমি কি বাইরে জুড়োই? আমার ঘুম পাচ্ছে; মেঝেতেই আমি শুয়ে পড়বো? মেঝেতে আমি শুতে পারি না। বসে থাকবো? বসেও থাকতে পারি না। গিয়ে দেখি ডাল ঘুমিয়ে পড়েছে; বিছানায় উঠতে আমার ভয় হয়। অচেনা কেউ ভেবে ডলি চিৎকার করে উঠতে পারে। আমি নিঃশব্দে পাশে শুই, ডলি চিৎকার করে ওঠে না। কিছুক্ষণ আগেই ঘুম পাচ্ছিলো, এখন পাচ্ছে না; অদ্ভুত লাগে শরীরটাকে। ঘুম আসে না; টের পাই শরীরে একটা ক্ষুধা জেগে উঠছে, হঠাৎ শরীরের ভেতরে একটা দেশলাই কাঠি জ্বলে উঠলো; তার আগুন গিয়ে লাগলো খড়কুটোতে, খড়কুটো পুড়তে শুরু করলো। ডলির ভেতরও এমন খড়কুটো পোড়ে, এমনভাবে দেশলাই জ্বলে ওঠে; আগুনের দুর্দান্ত ক্ষুধা জ্বলে? ডলিকে জাগাবো? ডলিকে আমি জাগাতে পারবো না; বলতে পারবো না তোমার মতো একটা ক্ষুধা আমার দেহেও জ্বলছে। এ-আগুন আমার ব্যক্তিগত, এ-ক্ষুধা আমার ব্যক্তিগত; কারো সাথে আমি তা ভাগ করে নিতে পারি না; এবং তখনি আমার মনে পড়ে দিগন্তের ওপারে ফেলে-আসা আমার সেই ক্ষুধাঝলকিত আগুনউজ্জ্বল বজ্রবিদ্যুৎচৌচির বিস্ময়কর দিনগুলোকে। আমি সেই বজ্রে ফিরে যাই সেই বিদ্যুতে ফিরে যাই, ডলি জানতে পারে না, বজ্র আমাকে ফাড়তে থাকে বিদ্যুৎ আমাকে ছিঁড়তে থাকে ক্ষুধা আমাকে ঝলসাতে থাকে আগুন আমাকে পুড়ে পুড়ে সোনার মতো গলাতে থাকে;–আমি ঘুমিয়ে পড়ি।

হাফিজুদ্দিন একদিন হঠাই এসে উপস্থিত হয়; তার চেহারাটি কিছুটা চেনা লাগেলেও আমি আর কিছু মনে করতে পারি না। হাফিজুদ্দিন ঢুকে বসার ঘরে বসার সাথে সাথেই আমি বসার ঘরে যাই; দেখি আমার দ্বিগুণ মোটা গোলগাল বেঁটে কালো একটি লোক বসে আছে। আমাকে দেখেই সে লাফিয়ে ওঠে, তার মাংসল মুখমণ্ডল থেকে একরাশ কালো উজ্জ্বল হাসি উপচে পড়ে।

হাফিজুদ্দিন বলে, দোস, আমারে চিনতে পারছো ত?

আমি বলি, চেনা চেনা লাগছে, ঠিক মনে করে উঠতে পারছি না, তবে এখনি পারবো।

হাফিজুদ্দিন বলে, পরিচয়টা পরে দিতেছি, তবে তুমি আমারে তাজ্জব কইরা দিছো।

আমি বলি, অবাক হওয়ার কী আছে?

হাফিজুদ্দিন বলে, আসনের সময় বুকটা কাঁপতেছিলো তোমার মতন অফিসারের বাসায় ঢোকতে পারুম কি না।

আমি বলি, কেনো, পারবে না কেনো?

হাফিজুদ্দিন বলে, আরে, তোমার মতন অফিসারের বাসায় ঢোকতে হইলে প্রথম আধঘণ্টা বেল বাজাইতে হয়, তিনচাইরটা কামের লোকের কাছে পরিচয় দিতে হয়, তারপর দেখা করনের জইন্য ড্রয়িংরুমে দুই ঘণ্টা বসে থাকতে হয়।

আমি বলে, না, না, আমি অতো বড়ো অফিসার নই।

হাফিজুদ্দিন বলে, তুমি কতো বড়ো অফিসার তা আমি জানি, তাই তো তোমার কাছে আইলাম, দোস। তবে আমারে তোমার মনে হয় ভাল কইরা মনে নাই।

আমি বলি, তোমার চেহারাটা মনে পড়ছে।

হাফিজুদ্দিন বলে, আমি হইলাম হাফিজুদ্দিন, তোমার লগে এইট পর্যন্ত পড়ছিলাম, বাবায় মইরা গেল বইল্যা আর পড়তে পারি নাই। তবে তোমার লগে আমার খাতির আছিল, তোমারে আমি ভালবাসতাম।

আমি বলি, এখন কোথায় আছো?

হাফিজুদ্দিন বলে, নিজের পরিচয়টা আগে দিয়া লই, তারপর সব কই। তোমার কি মনে আছে পড়ায় না পারলে এক ছার কান মলাইতো?

আমি বলি, হ্যাঁ, বেশ মনে আছে।

হাফিজুদ্দিন বলে, তুমি যার কান বেশি মলতা তার কথা মনে আছে?

আমি বলি, দেখি, ভেবে দেখি।

হামিদ স্যারকে মনে পড়ে। তিনি আমাদের ইস্কুলে কয়েক মাস ছিলেন; এসেই নিয়ম করেছিলেন যে পড়ায় পারবে সে যারা পড়ায় পারবে না তাদের কান মলবে। তিনি নিজে কান মলতে আর বেত মারতে পছন্দ করেন না, তবে কান মলা দেখতে পছন্দ করেন। তিনি আমাদের উত্তমভাবে কানমলার কৌশল শিখিয়ে দিয়েছিলেন : কানের লতি দু-ভাঁজ করে জোরে ঘষা দিতে হবে, তাতে কান আর সারা শরীর আগুনের মতো জ্বলে উঠবে; কিন্তু আগুন দেখা যাবে না।

হাফিজুদ্দিন বলে, আর ভাবো কী দোস, আমার কানই বেশি মলতা; তবে আমার কানটা তুমি একটু আস্তে মলতা।

আমি বলি, হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়ছে। কান মলার জন্যে আমি খুব দুঃখিত।

হাফিজুদ্দিন বলে, দুঃখ পাওনের কিছু নাই, দোস, এখন মনে পড়লে মজাই লাগে; তারপর সে খুব আস্তে করে বলে, তোমারে আমি জীবনে প্রথম মাইয়ামাইনষের বুক দেখাইছিলাম, দোস্ত মনে আছে?

আমি বলি, ওহ, তুমি সেই হাফিজ, সেই হাফিজুদ্দিন!

হাফিজুদ্দিন আমাকে জড়িয়ে ধরে, আমিও জড়িয়ে ধরে সুখ পাই।

সেদিন আমি হাফিজুদ্দিনের কান খুব জোরে মলেছিলাম; হাফিজুদ্দিনের কানের লতি বেশ শক্ত হওয়া সত্ত্বেও তার ব্যথা লেগেছিলো।

ছুটির পর হাফিজুদ্দিন আমাকে বলেছিলো, দোস, তর লগে একটা কথা আছে।

আমি বলেছিলাম, বলো।

হাফিজুদ্দিন বলেছিলো, এখানে বলন যাইব না, একটু অই দিকে ল।

আমরা মাঠের এককোণে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। হাফিজুদ্দিন বলেছিলো, দোস, পড়ায় আমি পারি না, তুই পারছ, তুই আমার কানটা একটু আস্তে মলিছ, তাইলে তরে আমি একটা জিনিশ দেখামু।

আমি বলেছিলাম, কী জিনিশ?

হাফিজুদ্দিন বলেছিলো, এমন জিনিশ যা তুই জীবনেও দেখছ নাই, দেখলে আর ভুলতে পারবি না, এমন সোন্দর জিনিশ আর অয় না।

আমি বলেছিলাম, কখন দেখাবে?

হাফিজুদ্দিন বলেছিলো, কাইল ছুটি আছে, তোমারে আমি সকাল আটটার সময় গিয়া লইয়া আসুম, তারপর দেখামু।

পরদিন আটটায় হাফিজুদ্দিন আসে; কিন্তু ছুটির দিনে অতো ভোরে আমি বেরোবে কীভাবে? আমরা একটি বুদ্ধি বের করি।

আমি মাকে বলি, রহমান স্যার আজ আমাদের তার বাসায় যেতে বলেছেন।

মা বলে, স্যাররা আজকাল তো ছাত্রদের বাসায় যেতে বলে না।

আমি বলি, রহমান স্যার বলেছেন এখন থেকে ছুটির দিনে তার বাসায় যেতে হবে। তিনি আমাদের পড়াবেন।

মা বলে, স্যারদের মাথা খারাপ হলো না কি?

আমরা দুজন বেরিয়ে যাই। হাফিজুদ্দিন আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে যায় :

পুরোনো শহরের একটি খুব পুরোনো দালান, কয়েক শো বছরের পুরোনো গন্ধ আর অন্ধকার জমে আছে ভেতরে, ওই গন্ধ আর অন্ধকার আমার ভালো লাগতে থাকে, ভেতরে পা দিয়েই আমি গভীরতর অন্ধকারে পড়ি; একটু দাঁড়াই, একটু গন্ধ আর একটু অন্ধকার আমি ভেতরে টেনে নিই: তারপর আবছা আলো দেখতে পাই। হাফিজুদ্দিন আমাকে আবছা অন্ধকারের ভেতর দিয়ে দু-তিনটি ঘর পেরিয়ে একটি বাকানো লোহার সিঁড়ির কাছে এনে সাবধানে ওপরে উঠতে বলে, সে না বললেও আমার সাবধানতার কোনো অভাব ঘটতো না; আমি সিঁড়ির রেইলিং ধরে আস্তে আস্তে পা ফেলে মাথা নিচু করে তার পেছনে পেছনে উঠতে থাকি; এবং সিঁড়ির পর মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ হেঁটে একটি অন্ধকার ঘরে ঢুকি। খুব ছোটো ঘর; আমার মনে হয় অন্ধকার জমিয়ে রাখার জন্যে এ-ঘরটি তৈরি করা হয়েছিলো; হাফিজুদ্দিন আমাকে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রেখে তারপর চোখ খুলতে বলে। আমি অনেকক্ষণ বন্ধ করে রেখে চোখ খুলে একটু আবছা আলো, মেঝেতে বিছানো হাফিজুদ্দিনের ছেঁড়া ময়লা বিছানা, বালিশ, ছেঁড়া কাঁথা, এদিকে সেদিকে ছড়ানো কয়েকটি বইখাতা, একটা হারিকেন, কয়েকটি ভাঙা মোম দেখতে পাই। ঘরটির দেয়ালে একটা বড়ো ছিদ্রও দেখতে পাই, যা দিয়ে গলগল করে বাইরের আলো ঢুকছে।

হাফিজুদ্দিন বলে, আন্ধারে ভয় পাইছ না দোস, বাইরে আলো আছে।

আমি বলি, না, না, ভয় পাচ্ছি না।

হাফিজুদ্দিন দেয়ালের ছিদ্রে চোখ দেয়, এবং আমাকে বলে, দোস, আয়, দেখ, এমন জিনিশ তুই আর দেখছ নাই, তর সারাদিন দেখতে ইচ্ছা করবো।

আমি ছিদ্রে চোখ দিতেই আমার চোখ অপূর্ব আলোর আক্রমণে অন্ধ হয়ে যায়। আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি, এবং চোখ সরিয়ে নিয়ে দু-হাতে চোখ চেপে ধরি।

হাফিজুদ্দিন বলে, দোস, চোখ সরাইছ না, ভালো কইর‍্যা দেখ, এই জিনিশ দেখতে দেখতেই ত আমার আর বই খোলতে ইচ্ছা করে না।

আমি আবার ছিদ্রে চোখ দিই। ছিদ্রটা ছোটো, একসাথে দু-চোখ দেয়া যায় না; একবার এক চোখ দিয়ে দেখতে হয়, আরেকবার আরেক চোখ দিয়ে। আমি দেখতে থাকি।

হাফিজুদ্দিন বলে, দোস, দেখতে পাইতাছছ?

আমি কথা বলি না, দেখতে থাকি; আমি অন্ধ হয়ে যাই, আমার দু-চোখে অজস্র চোখ জন্ম নিতে থাকে, অজস্র চোখ দিয়ে আমি দেখতে থাকি; এতো আলো, এতো জ্যোত্সা, এতো সৌন্দর্য আমি কখনো দেখি নি।

গোশলখানায় তিনটি মেয়ে গোশল করছে। তাদের বুকের তিন জোড়া স্ফীত আলোকিত গলিত চাঁদ থেকে জ্যোত্সা ঝরে পড়ছে। জ্যোৎস্নার কম্পনে আমার চোখ অন্ধ হয়ে যেতে থাকে, মাংস খসে পড়তে থাকে, রক্ত সমস্ত নালি ভেঙে ফিনকি দিয়ে ছুটতে থাকে। আমি দেয়ালের ছিদ্র থেকে চোখ সরিয়ে চোখ বন্ধ করে জোড়ায় জোড়ায় জ্যোৎস্না দেখতে থাকি।

হাফিজুদ্দিন বলে, তোমার লগে অনেক বছর দেখা নাই, পড়ালেখা আর করতে পারি নাই, তবে ভালই আছি।

আমি বলি, কী করছো তুমি আজকাল?

হাফিজুদ্দিন বলে, ব্যবসাপাতি করছি, ভালই করতাছি; গাড়িবাড়িও কইর‍্যা ফালাইছি। আইজ তোমারে সন্ধ্যায় আমি একটু খাওয়াইতে চাই।

আমি বলি, খাওয়ানোর কী হলো? কিছু বলতে চাইলে এখানেই বলো।

হাফিজুদ্দিন বলে, না, দোস, এইখানে বলুম না; খাইতে খাইতে বলুম। তুমি সন্ধ্যায় বাসায় থাইক।

সন্ধ্যায় হাফিজুদ্দিন আসে; তাকে আমার বেশ ভালো লাগে, যেমন লাগতো এইটে পড়ার সময়; আমার মনে হতে থাকে সে হয়তো আমাকে এমন কিছু দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে যা আমি আগে দেখি নি। তার সাথে আমি হেসে হেসে কথা বলতে বলতে গাড়িতে উঠি; এবং উঠেই খুব গোপনে খুব মসৃণভাবে হাফিজুদ্দিনকে ঈর্ষা করতে থাকি। তাকে ঈর্ষা করতে আমি চাই না; বারবার সুখী হতে চাই ছেলেবেলার বন্ধুকে পেয়ে; নিজেকে বোঝাতে চাই যে হাফিজুদ্দিন আমার বন্ধু, সে জীবনে সফল হয়েছে। এটা আমার জন্যে অত্যন্ত সুখের; ইচ্ছে করলেই আমি তার মতো সফল হতে পারতাম, সে আমার মতো সফল হতে পারতো না। আমি নিজেকে বোঝাই যে হাফিজুদ্দিনের কাছে কোনোদিন আমার যাওয়ার দরকার হবে না, কিন্তু আমার কাছে তাকে আসতে হয়েছে, হয়তো আরো আসতে হবে; হাফিজুদ্দিন যতোগুলো গাড়িই করুক, সে আমার নিচেই আছে, এবং থাকবে। কিন্তু আমি আর আগের মতো হাসতে পারি না যদিও হাসতে চাই, হাফিজুদ্দিনের ‘দোস’ সম্বোধন আমার ভালোই লাগছিলো, কিন্তু এখন আর ভালো লাগছে না; মনে হতে থাকে গাড়িটা আমার নয়, হাফিজুদ্দিনের; এমন একটি গাড়ি কখনো আমার হবে না। হাফিজুদ্দিন এইটের পর আর পড়তে পারে নি; আমি তার কান মলতাম, এখন আমি তার গাড়িতে চলছি; এর আগে এমন একটা সুখকর গাড়িতে আমি চড়ি নি; আর তখনি হাফিজুদ্দিন গাড়ি নিয়েই কথা বলতে শুরু করে।

হাফিজুদ্দিন বলে, দোস, গাড়িটা নতুন কিনলাম; আমার অন্য গাড়িটায় এসি নাই, এসি ছাড়া আমি টিকতে পারি না।

আমি শুনতে পাই নি এমনভাবে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকি।

হাফিজুদ্দিন বলে, সেইজন্য বেডরুমেও আমি এসি লাগাইছি।

এবার আমাকে শুনতেই হয়, বেশিক্ষণ আমি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি না; অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার অস্বস্তি লাগে।

আমি বলি, তুমি বেশ সফল হয়েছে হাফিজুদ্দিন।

হাফিজুদ্দিন বলে, কী বলো, দোস?

আমি বলি, তুমি বেশ সফল হয়েছে।

হাফিজুদ্দিন বলে, ট্যাকাপয়সা করছি কি না তা বলতাছো?

আমি বলি, হ্যাঁ।

হাফিজুদ্দিন বলে, দোস, ল্যাখাপড়া জানি না, তোমাগো মতন অফিসারদের লগে সহজে খাতির জমাইতে পারি না, তাগো লগে ট্যাকাপয়সা দিয়াই খাতির জমাইতে হয়, তবে আল্লার রহমতে কিছু টাকাপয়সা করছি।

আমি বলি, আমাকে তোমার এতোদিন পর কেনো মনে পড়লো?

হাফিজুদ্দিন বলে, খাইতে খাইতে তা তোমারে বলবো; এখন তুমি কও গুলশান বনানীতে কয়টা বাড়ি বানাইছো, ব্যাংকে কয় কোটি জমাইছো, আর গাড়ি কয়টা করছো?

আমি বলি, এসব আমি কিছুই করতে পারি নি হাফিজুদ্দিন।

হাফিজুদ্দিন চিৎকার করে বলে, এইটা কী শুনাইলা দোস, তোমার মতন অফিসারগো নিউইয়র্কেও বাড়ি আছে, আর তোমার একটা গাড়িও নাই?

আমি বলি, না, সত্যিই নেই।

হাফিজুদ্দিন বলে, শুনছি তুমি খাওটাও না; আমাগো কাছে সব অফিসারগো লিস্টি আছে, তারা কত খায় তার হিশাব আছে, আমরা জানি তুমি খাও না; না খাইলে বাড়িগাড়ি কেমনে হইবো, দোস?

আমি বলি, আমার সম্পর্কে তোমাদের ধারণা খুব খারাপ, তাই না?

হাফিজুদ্দিন বলে, খোঁজ নিয়া দেখলাম তুমি আর আমি ইস্কুলে ক্লাশমেট আছিলাম, তুমি আমার কান মলতা, আর আমি তোমারে এমন জিনিশ দেখাইছিলাম যা তুমি আগে দেখো নাই।

গাড়ি একটি পাঁচতারা হোটেলের ভেতরের এলাকায় এসে থামে।

হাফিজুদ্দিন বলে, দোস, এই হোটেলে আমি আইজকাইল প্রত্যেক সন্ধ্যায় খাই। আর গিলি, কিন্তু অই স্বাধীনতাটা না হইলে এইডার দারোয়ানও হইতে পারতাম না।

হাফিজুদ্দিনের ভেতর থেকে খলখল খিলখিল হাসি উপচে পড়তে থাকে। ওই স্বাধীনতাটিকে আমারও একবার মনে পড়ে; ওই স্বাধীনতা হাফিজুদ্দিনকে পাঁচতারায় খাওয়াচ্ছে আর গেলাচ্ছে, এবং আমাকে কী করাচ্ছে? এ-পাঁচতারায় আগে কখনো আসি নি, তা নয়; তবে কখনো খেতে বা পান করতে আসি নি, এসেছি সরকারি অনুষ্ঠানে। ইংরেজিতে দু-তিনবার ক্ষুধার ওপর সভাপতিত্বও করেছি। হাফিজুদ্দিন আমাকে সরোবরের পাশে এক চমৎকার ছায়াচ্ছন্ন স্থানের দিকে নিয়ে যায়-সে কি আজো আমাকে দেয়ালের ছিদ্রের ভেতর দিয়ে বিস্ময়কর কিছু দেখাবে?–পথে পথে সে সালামের পর সালাম পেতে থাকে; আমার মনে হয় হাফিজুদ্দিন তার অফিসে ঢুকছে। আমি কি এই হাফিজুদ্দিনেরই কান মলতাম, এই হাফিজুদ্দিনই কি পড়া পারতো না? আমার ভেতরটা একটু শক্ত হয়ে উঠতে থাকে; মনে হতে থাকে এই কুৎসিত লোকটিকে আমি চিনি না, এই লোকটি কখনো আমার সহপাঠী ছিলো না; সে আমার অন্তরঙ্গ কেউ নয়। আমরা বসার সাথে সাথেই হাফিজুদ্দিন খাবার ও পানীয়র বিপুল নির্দেশ দিতে থাকে; আর আমি বোধ করতে থাকি যে লোকটির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই;–এই লোকটি একটি হাফিজদ্দি, যার সাথে আমি বসতে পারি না।

হাফিজুদ্দিন বলে, দোস, তুমি তো দুনিয়ার অনেক পাঁচতারা দেখছো।

আমি বলি, হাফিজুদ্দিন সাহেব, আপনি আমাকে ‘দোস’ বলবেন না।

হাফিজুদ্দিন আমার কথা শুনে চমকে ওঠে, অনেকটা ভয় পেয়ে যায়।

হাফিজুদ্দিন বলে, জি ছার, আমার ভুল হইয়া গেছে, এখন থিকা ছারই বলবো।

প্রচুর খাবার ও পানীয় এসেছে; হাফিজুদ্দিন আমার জন্যে পানীয় ঢালতে শুরু করে; এবং একটি পানপাত্র এগিয়ে দিয়ে বলে, ছার, একটু খান।

হাফিজুদ্দিন তার পানপাত্রটি ধ’রে আছে, আমি শুরু করলে সে শুরু করতে পারে; তাই আমি শুরু করি না। পান করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই; অনেকক্ষণ পর আমার ইচ্ছে হয়, আমি পাত্র তুলে পান করি, কোনো কথা বলি না। হাফিজুদ্দিন পান করার মুহূর্তের আনন্দব্যঞ্জক শব্দটি করতে গিয়ে থেমে যায়, আর তার উদ্দেশে ওই শব্দটি উচ্চারণ করতে আমার ঘেন্না লাগে।

হাফিজুদ্দিন বলে, ছার, আপনে আমার লগে আসছেন, এইটা আমার ভাইগ্য, এত সম্মান আমি আর পাই নাই।

আমি বলি, কিন্তু আপনি আমাকে কেনো এখানে নিয়ে এসেছেন?

হাফিজুদ্দিন বলে, ছার, বলার সাহস দিলে বলতে পারি, অইটা বলার জইন্যই তো আসছি।

আমি বলি, বলুন।

হাফিজুদ্দিন বলে, ছার, সরকার এক লাখ টান চাউল আনবো থাইল্যান্ড থিকা, কাজটা আপনারই হাতে, আমরা কামটা পাইতে চাই।

আমি কোনো কথা বলি না।

হাফিজুদ্দিন বলে, বারো পার্সেন্ট আমরা দিতে রাজি আছি, ছার, আপনে রাজি হইলে আইজই লাখ পাঁচেক দিতে পারি, গাড়িতে আছে।

আমি পান করতে থাকি, কোনো কথা বলি না।

হাফিজুদ্দিন বলে, খাইতে থাকেন ছার, খাইতে খাইতে ভাবেন ছার, কয়েক গেলাশ খাইলেই ডিসিশন নিতে পারবেন, খান ছার।

আমি পান করতে থাকি। হাফিজুদ্দিন গেলাশের পর গেলাশ শেষ করছে, আমি অতো পেরে উঠছি না, আমার ভালো লাগছে।

হাফিজুদ্দিন বলে, খাইলে মনডা ঠাণ্ডা হয়, দুনিয়ার সব মাইনষেরে ভাল লাগে, আমি সেইজন্য সন্ধ্যা হইলেই খাইতে আসি, খান ছার, আমারে আপনার ভাল লাগবো।

আমি বলি, আপনাকে আমার খারাপ লাগছে না।

হাফিজুদ্দিন বলে, কথাটা শুইন্যা বুকটা ভইরা গেল, খান ছার, কামটা তাইলে আমরাই পামু।

আমি পান করতে থাকি, কথা বলি না, ভাষা আমার কাছে বিরক্তিকর মনে হয়।

হাফিজুদ্দিন বলে, চাইলে আপনে ছার এই হোটেলেই আইজ রাইত থাকতে পারেন, আমি এখনই সব ব্যবস্থা কইর‍্যা দিমু।

আমি কোনো কথা বলি না, মানুষকে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে।

হাফিজুদ্দিন বলে, তাইলে একটা সুটের ব্যবস্থা করি, ছার?

আমি বলি, না, দরকার নেই।

হাফিজুদ্দিন বলে, আপনে চাইলে দুই-একটা হিরোইনেরও ব্যবস্থা করতে পারি, ছার, দুই-তিনটা হিরোইনও আমাগো কারবারে আছে; কইলজার টুকরা, আর জানের দুশমনের হিরোইন দুইটার মধ্যে কোনটা আপনার পছন্দ?

আমি কোনো কথা বলি না, পান করতে আমার বেশ লাগছে, হিরোইন ভালো লাগছে না।

হাফিজুদ্দিন বলে, বুক ত আপনার পছন্দ, আমার মনে আছে, ছার, কইলজার টুকরার হিরোইনটার বুক দুইডা পাহাড়ের মতন; অই দুইডা লইয়া হিরোইনটা হাঁটতে পারে না, অই দুইডা অর বুকে না হইয়া পিঠে হইলেই অর সুবিধা হইত।

আমি পান করতে থাকি, পাঁচ লাখ এক সাথে দেখতে কেমন ভাবতে থাকি।

হাফিজুদ্দিন বলে, জানের দুশমনের হিরোইনটা খ্যালে ভাল, ছার, তারে আমরা কই বেডকুইন, এগারোজনের লগে একলাই খ্যালতে পারে, ছার।

আমি পান করতে থাকি; পাহাড় আর কুইনের কথা ভাবতে আমার ভয় হয়।

আমি বলি, হাফিজুদ্দিন সাহেব, এখন আমি উঠবো।

হাফিজুদ্দিন বলে, ডিসিশনটা লইতে পারছেন, ছার? কামটা আমরা পামু ত?

আমি উঠে দাঁড়াই; হাফিজুদ্দিন আমার সাথে সাথে ওঠে, পেছনে পেছনে আসতে থাকে; পাঁচতারার কর্মচারী কমে গেছে, তবু সে দু-তিনটি সালাম পায়, সে ওইসব সালাম নেয় না, নিতে ভয় পায়।

গাড়িতে ওঠার আগে হাফিজুদ্দিন বলে, ছার, এইখানে ঢোকনের আর বাইর হওনের সময় আমার অই স্বাধীনতাটার কথা মনে পড়ে, অই স্বাধীনতাটা না হইলে এইডার দারোয়ানও হইতে পারতাম না।

গাড়ি চলতে শুরু করে।

আমার বাসার সামনে গাড়ি থামলে হাফিজুদ্দিন জিজ্ঞেস করে, ডিসিশনটা লইতে পারছেন, ছার?

আমি বলি, আসুন।

হাফিজুদ্দিন একটা কাপড়ের ব্যাগ খুঁজে বের করে আমার পেছনে পেছনে আসতে থাকে। আমি তাকে সরাসরি শয্যাকক্ষে নিয়ে আসি, সে বেশ অবাক হয়।

আমি বলি, ব্যাগটা খাটের নিচে রাখুন, ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিন।

হাফিজুদ্দিন মেঝেতে শুয়ে পড়ে খাটের নিচে ব্যাগটা রাখে, ঠেলে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়; তার মাথাটা বেশ ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলো, মাথাটা বের করলে দেখা যায় কিছু মাকড়সার জাল তার চুলে ঝুলে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *