৩. ডলি আমার অফিসে

ডলি আমার অফিসে এসে উঠবে কখনো ভাবি নি; তাকে আমার কক্ষে ঢুকতে দেখে আমি কেঁপে উঠি, দাঁড়িয়ে পড়ি, তার দিকে এগিয়ে যাই; আরেকটুকু হলে তাকে ছুঁয়ে ফেলতাম। অনেক আগে যে-মেয়েটিকে দেখলে আমি কেঁপে উঠতাম, সে যদি আমার ছাত্রাবাসের কক্ষে কখনো এসে উঠতো, আমি এমনই কেঁপে উঠতাম। ক-দিন ধরে অদ্ভুত একটা ভার চেপে আছে আমার ওপর, ভারটা যে কী আমি তা বুঝতে পারছি না, কিন্তু ওই ভারের চাপে আমি মাথা তুলতে পারছি না; ডলি ঢোকার সাথে সাথে ভারটা কেটে যায়। ভারটা কীভাবে এতো তাড়াতাড়ি কাটলো? দেলোয়ারের বাবার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আমি ডলিদের বাসায় যাই নি, কিন্তু প্রতিমুহূর্তে গিয়েছি; আর কখনো যাবো না ভেবেছি, এবং আমার ওপর ভারটা ক্রমশ ভারী থেকে আরো ভারী হয়ে উঠেছে। সময় আমার জন্যে দীর্ঘ হয়ে উঠেছে; একেকটি মিনিট একেক ঘণ্টার থেকে দীর্ঘ হয়ে উঠেছে; আমি সময়ের একটা অবর্ণনীয় ভার বহন করেছি। একেকবার আমার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করেছে; আমি চিৎকার করেছি যে-চিৎকার আমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পায় নি। গতকালই একটা শস্তা চায়ের দোকানে বসে আমি পাঁচ পেয়ালা চা খেয়েছি; একটি লোক আমরা সামনে বসে ইলশে মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছিলো, তার মুখ থেকে বারবার ভাত ছিটকে আমার হাতের ওপর পড়ছিলো; ভাত যে মানুষ এত যত্নের সাথে খায়, তা দেখতে দেখতে আমার ভারটা আরো বেড়ে যাচ্ছিলো। এখন নিজেকে আমার খুব হাল্কা লাগে। ডলিকে আমি কখনো নাম ধরে ডাকি নি; ডলিকে নাম ধরে ডাকতে ইচ্ছে করছে; কিন্তু আমি কোনো কথা বলতে পারছি না।

ডলি বলে, চলুন।

আমি তার কথা বুঝতে পারি না।

ডলি আবার বলে, আমার সাথে চলুন।

এবার আমি বুঝতে পারি; বলি, কোথায়?

ডলি বলে, আমি একটু ফেরিঘাটে যাবো।

আমি বলি, কোন ফেরিঘাটে?

 ডলি বলে, আমার ও আপনার জন্যে একটিই ফেরিঘাট আছে।

আমি বলি, সেখানে যেতে আমার ভয় করবে।

ডলি বলে, ভয় করবে কেনো?

আমি বলি, ক-দিন ধরে আমি দেখতে পাচ্ছি ফেরিঘাটে দেলোয়ারের লাশ ভাসছে; দেলোয়ারের লাশ আমাকে ডাকছে।

ডলি বলে, আপনি অপরাধরোধ আর দুঃস্বপ্নে ভুগছেন।

ডলি উঠে দাঁড়ায়; এবং বলে, চলুন।

আমি ডলির সাথে উঠে দাঁড়াই; এবং বেরিয়ে পড়ি। ডলির পেছনে পেছনে হাঁটতে আমার ভালো লাগে; মনে পড়ে কোনো নারীর পেছনে এর আগে আমি হাঁটি নি; আমি মন দিয়ে ডলির পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকি। আমি ডলির ধবধবে গোড়ালি দেখতে পাই; লাল স্যান্ডলের ওপর ধবধবে গোড়ালি দেখে আমার সরোবরের কথা মনে পড়ে। আমরা একটি বেবি নিই, ডলিকে আমি উঠতে বলি, ডলি উঠে ডান দিকে বসে; আমি বাঁ দিকে বসি। বেবি চলতে শুরু করলে একবার আমার মনে হয় দেলোয়ার চালাচ্ছে; আমি ড্রাইভারকে ডাকি, তার মুখের সাথে দেলোয়ারের মুখের কোনো মিল নেই। তখন আমি বাইরের দিকে তাকাই। ডান দিকে তাকাতে সম্ভবত আমার সাহস হয় না।

ডলি জিজ্ঞেস করে, আপনি ড্রাইভারের মুখের দিকে এমনভাবে তাকালেন কেনো?

আমি বলি, মনে হচ্ছিলো দেলোয়ার চালাচ্ছে।

ডলি বলে, আপনি কি সব সময় চারপাশে দেলোয়ারকে দেখতে পান?

আমি বলি, আপনি পান না?

ডলি বলে, না।

আমি আজ মাংসমেশানো তীব্র সুগন্ধটি পাচ্ছি না; ডলির শরীর থেকে একটা মাংসসম্পর্কহীন সুগন্ধ বেরিয়ে আসছে। ডলি অনেক দিন মাংসের জগত থেকে দূরে আছে বলেই হয়তো তার মাংস থেকে আর ঝাঁজালো গন্ধ বেরোচ্ছে না। গন্ধটা আমার ভালো লাগছে, আমি বড়ো একটা নিশ্বাসে অনেকটা সুগন্ধ ভেতরে টেনে নিই; ডলি তা টের পায়, কোনো কথা বলে না। বেবি বেশ তীব্র গতিতে ছুটে চলছে, ডলি না থাকলে আমি মাঝেমাঝেই ভয় পেতাম; একটি ট্রাকের পাশ দিয়ে যেভাবে বেবিটি কেটে বেরিয়ে গেলো তাতে আমি প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠতাম; কিন্তু, মনে হয়, ডলি আমার পাশে বসে আছে বলেই আমি ভয় পেলাম না; ট্রাকের চাকাগুলোকে সুন্দর রঙিন : খেলনার মতো লাগলো। ডলি তার বাঁ হাতটি বাড়িয়ে আমার ডান হাতটি ধরেছে। আমি ভেবেছিলাম ভুল করে সে আমার হাত ধরেছে। আমি আমার হাতটি টেনে নিতে চাই, পারি না; আমার হাতটি ওই হাতের সাথে লেগে থাকে, ওই হাতে আটকে থাকে, আমি সরিয়ে আনতে পারি না।

ডলি বলে, আমার হাতটি একটু শক্ত করে ধরুন।

আমি শক্ত করে ধরার চেষ্টা করি, পারি না; মনে হয় অন্য একটি হাত আমার হাতটিকে সরিয়ে দিচ্ছে। আমার হাত ডলির হাত থেকে খসে পড়ছে।

ডলি বলে, ধরুন, আমার ভয় করছে।

আমি বলি, আমি ধরতে চাচ্ছি, কিন্তু পারছি না।

ডলি বলে, দেলোয়ারের লাশ কি সত্যিই ভেসে উঠতে পারে?

আমি বলি, কঙ্কাল কখনো ভাসে না।

ডলি বলে, আপনি দু-হাত দিয়ে আমাকে একটু জড়িয়ে ধরুন।

আমি ডলিকে জড়িয়ে ধরে একটা মাংসঅস্থিহীন সুগন্ধ পাই। আমি একটু শক্ত করেই ধরি; আমার ভয় হয় নইলে অন্য কোনো হাত আমাকে টেনে ডলির কাছ থেকে সরিয়ে দেবে। আমি মনে মনে সেই হাত দুটিকে ঠেলে সরিয়ে দিই; ডলি শিশুর মতো আমার বাহুর ভেতরে পড়ে থাকে-এখন ওর ভয় করছে না। এমন সময় বৃষ্টি নামে-শ্যামল শুভ্র নিবিড় বৃষ্টি; চারপাশ শাদা হয়ে যায়, বেবি এগিয়ে যেতে যেতে চারপাশ আরো শাদা থেকে আরো শাদা হতে থাকে; আরো অন্ধকার থেকে আরো অন্ধকার হতে থাকে। আমি বেবিঅলাকে আস্তে চালাতে বলি। দু-পাশ থেকে বৃষ্টির ফোঁটা ঢুকে আমাকে শীতল করে দিতে চায়, কিন্তু আমি বিস্ময়কর উষ্ণতা বোধ করি। বাঙলায় এমন আশ্চর্য বৃষ্টি নামতে পারে। দু-পাশের গ্রামগুলোকে ডলির ভুরুর মতো মনে হয়। ডলির মুখটি আমার দিকে এগিয়ে এসেছে, বৃষ্টির ফোঁটায় ডলির মুখ রজনীগন্ধার গুচ্ছ হয়ে উঠেছে; আমি রজনীগন্ধার গন্ধ পেতে থাকি। আমি ডলিকে আরো জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমো খাই। ডলির ঠোঁট আমার ঠোঁটে রজনীগন্ধার পাপড়ির মতো ঝরে পড়ে।

ডলি ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলে, আমি যাবো না।

আমি জানতে চাই, কোথায়?

ডলি বলে, ফেরিঘাটে। আমি ফেরিঘাটে যাবো না; আমি কারো কাছে অপরাধ করি নি।

ডলি বেবি থামাতে বলে; একবার বৃষ্টিতে ভিজে আসতে তার ইচ্ছে হয়; দূরে একটা ঝোঁপ দেখে আমি ভয় পাই। আমার ভয় হতে থাকে এই বৃষ্টিতে নামলে ধীরে ধীরে আমরা ঝোঁপের ভেতরে ঢুকে যাবো; ডলিকে নিয়ে আমি ঝোঁপের ভেতর ঢুকতে পারবো না। আমরা ফিরতে থাকি। ডলির শরীর থেকে সুগন্ধ বেরোচ্ছে; সুগন্ধটি কি ক্রমশ মাংসমেশানো হয়ে উঠছে? আমার দম আটকে আসছে না। আমি ডলিকে তাদের দরোজায় নামিয়ে দিয়েই ফিরতে চেয়েছিলাম; ডলি ফিরতে দেয় না; আমি ডলির গোড়ালির শুভ্রতা দেখতে দেখতে আর সুগন্ধ অনুসরণ করতে করতে তাদের বসার ঘরে ঢুকি। ঢুকে দেখি ডলির আম্মার সাথে দেলোয়ারের আম্মা বসে আছেন। তাকে দেখে আমার হাসি পায়।

দেলোয়ারের আম্মা আমাকে বলেন, তুমি জানো ডলি দেলোয়ারের বউ?

ডলি আর আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি; ডলির আম্মা উঠে ভেতরের দিকে চলে যান।

দেলোয়ারের আম্মা বলেন, তুমি ডলিকে নষ্ট করছো।

ডলি বলে, আপনি এমনভাবে কথা বলবেন না।

দেলোয়ারের আম্মা বলেন, তোমরা দুজন আমার দেলোয়ারকে নদীতে ফেলে দিয়েছো।

ডলি মেঝের ওপর বসে পড়ে, আমি দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।

তিনি বলেন, দেলোয়ারকে নদীতে ফেলে দিয়ে তোমরা সুখে আছো। তোমরা সুখে থাকো, কিন্তু দেলোয়ারকে তোমরা কেনো নদীতে ফেলে দিলে?

আমি বেরিয়ে আসি। আমরাই দেলোয়ারকে নদীতে ফেলে দিয়েছি? আমি ফেলে দিয়েছি? ডলি ফেলে দিয়েছে? ডলি আর আমি ফেলে দিয়েছি? আমরা দেলোয়ারকে নদীতে ফেলে দিই নি? দেলোয়ার কীভাবে নদীতে পড়েছিলো, আমার ঠিক মনে পড়ে; আমার মনে হয় দেলোয়ার ফেরিতে উঠে গাড়ি থামিয়ে ডলি আর আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলো, সিগারেট ধরিয়ে টান দিচ্ছিলো, তখন ডলি আর আমি ঠিক করি দেলোয়ারকে নদীতে ফেলে দেবো: আমরা দুজনে পেছন থেকে তার গাড়িটি ঠেলে পানিতে ফেলে দিই। দেলোয়ার কী করো, কী করো বলে হাসতে হাসতে পানিতে ডুবে যায়। আবার আমার মনে হয় আমি একটা ট্রাক চালাচ্ছিলাম, দেলোয়ার চালাচ্ছিলো তার দামি সুন্দর গাড়ি; দেলোয়ারের গাড়িটা আমার ট্রাকের আগে ছিলো; অতো সুন্দর গাড়িতে কেউ বসে থাকলে আমার সহ্য হয় না, আমি সহ্য করতে পারি নি; আমি আমার ট্রাক দিয়ে ঠেলে দেলোয়ারের গাড়িটাকে নদীতে ফেলে দিই। আমি যাকে ঠেলে নদীতে ফেলে দিয়েছি, তার নাম কী ছিলো?–মাহমুদ, আবদুল হালিম, দেলোয়ার? সে কি আমার বন্ধু ছিলো? বন্ধুকে আমি কী করে ট্রাক দিয়ে ঠেলে নদীতে ফেলে দিতে পারলাম? আমি কি আজ তার বউকে জড়িয়ে ধরেছি? আমি কি আজ তার বউকে চুমো খেয়েছি? আমি কি তার বউকে জড়িয়ে ধরে চুমো খাওয়ার জন্যে তাকে ঠেলে নদীতে ফেলে দিয়েছি? আমার বন্ধু কি তার বউকে কখনো বলেছে যে আমি নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম? বাবাকে চল্লিশ হাজার টাকা দিতে হবে? বাবার নিশ্চয়ই দরকার। চার সদস্য দলের একজন হিশেবে আমাকে রাখবে তো? আমার বেশ টাকা থাকবে? হজও হবে? হজ কাকে বলে? ট্যুরিজম? ধর্মীয় ট্যুরিজম বেড়াতে আমি ওখানে যাবো কেনো? টেকনাফ না গিয়ে? আমার অপরাধের শেষ নেই? আমি নিয়মিত অপরাধ করি? ভিখিরিনিটাকে আমি কেনো জিজ্ঞেস করেছিলাম তার বাচ্চার বাপ কে? বাপ কে তাতে কী আসে যায়? ডলিকে আমি নষ্ট করছি? নষ্ট কাকে বলে? দেলোয়ার ডলিকে পবিত্র করতো? ডলিকে আমি চুমো খেয়েছি-নষ্ট করেছি? ডলি কি আমাকে নষ্ট করেছে? আমি কি এখন বাসায় ফিরবো?

আমি আবদুস সালামের বাসার দিকে হাঁটতে থাকি। সালামকেই আজ মনে পড়ছে। কেনো সালামকে মনে পড়ছে। অনেকবার যাবে বলেও তো তার বাসায় আজো আমার যাওয়া হয় নি। সালাম কি এখন বাসায় আছে? না থাকলেই ভালো; অন্য কোথাও যাওয়া যাবে। সালাম কি আরার চাকুরি নিয়েছে? ও বছরে তিনটা চাকুরি বদলায় কেনো? সালামের বউ দরোজা খুলে আমাকে দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন, ঢুকতে বলেন না। হয়তো একটু বেশি বিস্মিত হয়ে গেছেন; আমি আগে কখনো আসি নি, বারবার আসবে বলেও।

তিনি বলেন, আসুন, ঠিক দিনে এসেছেন।

আমি বলি, তাহলে আমি যাই।

তিনি বলেন, না, না; যাবেন কেনো।

তিনি আমাকে বসার ঘরে না নিয়ে ভেতরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলেন, যার জন্যে এসেছেন, তার ঘরেই চলুন। দেখুন কেমন আছে।

সালাম কি ভালো নেই? ও কি অদ্ভুত রকমে খারাপ আছে? ও কি একটা দেখানোর বস্তু হয়ে উঠেছে? দেখে আমি সহ্য করতে পারবে তো?

সালাম মেঝেতে বসে খাটে মাথা রেখে কাত হয়ে আছে, হাতে বেশ বড়ো একটা গেলাশ-মেঝেতে রাখা; সালাম পান করছে, আমাকে দেখে চিনতে পারছে না। আমার থেকে বছর আটেকের বড়ো সালাম, যখনই দেখা হয় জড়িয়ে ধরা তার অভ্যাস; আজ আমাকে চিনতে পারছে না, কিন্তু জড়িয়ে ধরছে ঠিকই। সালাম এখন পৃথিবীর সব কিছু জড়িয়ে ধরতে পারলে ভালো থাকতো; আমাকে জড়িয়ে ধরে একটু ভালো বোধ করছে। আমারও ভালো লাগছে; এর আগে আমাকে এমন অসহায়ভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে নি; আমি সালামকে বুঝতে দিচ্ছি না যে আমারও সারা পৃথিবীকে জড়িয়ে ধরে থাকতে ইচ্ছে করছে, আমিও তাকে জড়িয়ে ধরে আছি।

সালাম বলে, তুই বোধ হয় সেই ভালো ছেলেটা, যে মদটদ খায় না। সালাম আমার মুখে চুলে আঙুল বুলোতে থাকে।

আমি বলি, খাই না, তা ঠিক নয়।

সালাম বলে, দু-নম্বরের সঙ্গে আজ একটু মনোমালিন্য হচ্ছে। তুই কিছু মনে করিস না; আয়, একটু খা।

সালাম হুহু করে কাঁদতে শুরু করে; শিশুর মতো কান্না, শিশুর থেকে গভীর কান্না। শিশুরা এমন ভেঙে পড়ে কখনোই কাঁদতে পারে না। এই প্রথম আমি কাউকে কাঁদতে দেখলাম।

সালামের বউ বলেন, ওর কান্না দেখে আমার ঘেন্না হচ্ছে। আমাকে ও অপমান করছে।

আমি জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে, ভাবী?

সালামের বউ বলেন, ওর মেয়ের আজ ফল বেরিয়েছে।

সালামের আরো কান্না দরকার, সে আমাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কাঁদে; ভেঙে ভেঙে বলে, আমার মেয়ের আজ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে, মা আমার মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছে, পত্রিকায় আমার মা বলেছে ওর কোনো আব্বা নেই।

সালাম মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে। আমি বুঝতে পারি সালামের এভাবে কান্নার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে; কিন্তু কারো দুঃখ কীভাবে অনুভব করতে হয় আমি জানি না। আমি শুধু চেয়ে থাকতে পারি, সালামের দিকে চেয়ে থাকি।

সালাম ডুকরে উঠে বলে, আমার মাকে আমি দেখতে গিয়েছিলাম, মা আমার সাথে দেখা করে নি; ব’লে পাঠিয়েছে ওর কোনো আব্বা নেই।

সালামের বউ বলেন, আর ফিরে এসেই আমাকে বলছে, তুই চিৎ হয়ে শো, তোর পেটে আমি আজই একটা মেয়ে জন্ম দেবো।

সালাম জড়িয়ে জড়িয়ে বলে, তোর পেটে অমন মেয়ে আসবে না রে আসবে না।

সালামের বউ বলেন, তাহলে সেই রত্নপ্রসবিনীকে নিয়ে থাকলেই পারতে।

সালাম বলে, তোর বাইরটাই রত্নের মতো ঝলমলে, ভেতরে কোনো রত্ন নেই রে, তোর ভেতরে শুধু আবর্জনা।

সালামের বউ বলেন, তোমার মুখে থুতু দিতে ইচ্ছে করছে।

সালাম বলে, অই বউ বেশি ক্ষেপিস না, নিজে একটু খা, আর এই ভালো ছেলেটারে একটু দে।

সালামের বউ আমার জন্যে বেশখানিকটা হুইস্কি ঢালেন, নিজের জন্যে তারও বেশি। আমরা দুজনেই প্রথম চুমুকেই বেশ খানিকটা খাই। খেতে আমার বেশ লাগে, নিজেকে হাল্কা লাগে; আমার মনে হয় আমার ভেতরে একটা শোক আছে, আমার খাওয়া উচিত।

প্রত্যেকটা মানুষ অশ্রুবিন্দুর মতো, সালাম বলে, কখন টলমল করে উঠবে কেউ জানে না। সালামের কণ্ঠ খুব জড়িয়ে গেছে। সে বলে, আমি আজ অশ্রুতে পাপ ধুয়ে ফেলতে চাই।

সালামের বউ খলখল করে হাসতে থাকেন; বলেন, ওই অশ্রুতে পাপ কেনো, চোখের পাতাও ধোয়া হবে না; তোমার চোখের পানিও তোমার মতোই নোংরা।

অই ভালো ছেলে, শোন, সালাম বলতে থাকে, তুই সামনে যে-রত্নটারে দেখছিস, তার মাংসের কণায় কণায় রত্ন জ্বলে; এই রত্নের জন্যেই আমি জীবনটাকে বর্জন করেছি। ওর সঙ্গে যখন শুই আমার জীবনের কথা মনে থাকে না; শোয়া শেষ হলেই মনে পড়ে আমার একটি মা ছিলো, দুটো বাবা ছিলো।

সালাম মেঝেতে গড়িয়ে পড়েছে, ব্যাকুলভাবে বাহু দিয়ে কাদের যেনো জড়িয়ে ধরে সমস্ত হৃৎপিণ্ড দিয়ে চুমো খাচ্ছে। তার আবেগ আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, তবু আমার ভেতরও একটা দুঃখ জেগে ওঠে; কিন্তু সালামের বউ খলখল করে হাসতে আর পান করতে থাকেন। তিনি ঝলমল করতে থাকেন, তার শরীর থেকে অজস্র রত্ন ঝলমল করে মেঝেতে গড়িয়ে পড়তে থাকে।

আমি উঠে দাঁড়াই।

সালামের বউ বলেন, উঠছেন কেনো, বসুন; আরেকটুকু খান।

আমি বলি, আমি কষ্ট পাচ্ছি, আরেকটুকু বসলে আমিও কাঁদতে শুরু করবো।

তিনি বলেন, আপনার আবার কিসের কষ্ট?

আমি বলি, আমি আমার বন্ধুকে নদীতে ফেলে দিয়েছি।

তিনি হা হা করে হেসে ওঠেন, এটুক খেয়েই বন্ধুকে নদীতে ফেলে দিয়েছেন ভেবে কান্না পাচ্ছে, আরেকটু খেলে তো আমাকে খুন করে ফেলেছেন ভেবে জড়িয়ে ধরে আমার বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে ফোঁপাতে থাকবেন।

রাতে খুব ঘুম হয় আমার। ঘুমের মধ্যে আমি নিবিড় বর্ষণের শব্দ শুনতে পাই, আমার চোখ মেলতে ইচ্ছে করে না; ছেঁড়া কাঁথার মতো আমার শরীর বিছানার ওপর এলিয়ে থাকে। একেকবার আমার মনে হয় অজস্র সবুজ পাতা ঝরে পড়ছে বনের ভেতর, আমি সেই পাতার স্তূপের নিচে পড়ে আছি, আমার ওপর সবুজ বৃষ্টি নামছে। বৃষ্টিতে গলে যাচ্ছি আমি, কাদামাটির মতো হয়ে যাচ্ছি। পাতার ভেতর থেকে একটি সবুজ অজগর বেরিয়ে আসে; আমার শরীরের ওপর অজগরটি খেলতে থাকে, আমি অজগরটিকে জড়িয়ে ধরে খেলতে থাকি, অজগর আমার গলা জড়িয়ে ধরে, আমি। অজগরের গলা জড়িয়ে ধরি, অজগর আমাকে চুমো খায় আমি চুমো খাই অজগরকে; খেলতে খেলতে সবুজ পাতার ভেতরে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। কখন ভোর হয় আমি বুঝতে পারি না, ঘুম ভাঙার পরও অজগরের স্মৃতি আমার মনে স্পষ্ট জেগে থাকে; একবার আমি কেঁপেকেঁপে উঠি। আমি বিছানা থেকে উঠি না, উঠতে আমার ইচ্ছে করে না; আমি অফিসে যাই না। আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে, বৃষ্টি হচ্ছে মাঝেমাঝেই; আমি চা খাচ্ছি, আবার চা খাচ্ছি, সিগারেট খেতে আমার ছেলেবেলার মতো ভালো লাগছে। সিগারেটে আমি ছেলেবেলার গন্ধ পাচ্ছি।

দশটার দিকে আমি বেরিয়ে পড়ি; একটু বৃষ্টিতে ভিজি; ডলিদের বাসায় যাই। ডলি অবাক হয়; ডলির অবাক হওয়া দেখে আমি সুখ পাই।

ডলিকে বলি, একটি সুন্দর শাড়ি পরে এসো।

ডলি চমকে ওঠে, কেনো?

আমি বলি, আমরা বাইরে যাবো।

ডলি বেশ তাড়াতাড়ি শাড়ি পরতে পারে; আমার চমৎকার লাগে; আমরা দরোজা খুলে বেরোই। দূরে দাঁড়ানো বেবিটাকে আমি ডাকি।

ডলি জিজ্ঞেস করে, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

আমি বলি, কোর্টে-আমরা বিয়ে করবো।

ডলি একবার আমার দিকে তাকিয়ে উঠে বেবির ডান দিকে বসে, আমি উঠে বা দিকে বসি।

সব কিছু হয়ে গেলে লোকটি বলে, কাজির অফিসে গিয়ে একবার বিয়ে পড়ে নেবেন।

আমি জানতে চাই, কেনো?

লোকটি বলে, আপনারা মুসলমান তো।

আমি বলি, তাহলে এখানে এলাম কেনো?

আমি ডলির ডান হাতটি ধরে পা বাড়াই, ডলিও আমার সাথে পা বাড়ায়।

ডলি বলে, তোমার বউকে তুমি এখন কোথায় নেবে?

আমার রক্তের অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে ঝলমলানো রোদ ঢুকতে থাকে, আমার মাংস ঝলমল করে ওঠে; আমি বৃষ্টির মধ্যেই পা বাড়িয়ে দিই। আমার মনে পড়ে না যে বাইরে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হচ্ছে। ডলিও আমার সাথে পা বাড়ায়। ডলি আমার বা হাতটি ধরে আছে। অনেকগুলো রিকশা ভিড় করে এসেছে, দু-তিনটি বেবি খুব চিৎকার করছে, আমি আর ডলি বেবি বা রিকশার কথা ভাবতে পারছি না, কোনো যানবাহন যে আমাদের দরকার পড়তে পারে, আমাদের তা মনে হচ্ছে না।

আমি ডলিকে জিজ্ঞেস করি, তোমার এখন কী ইচ্ছে করছে?

ডলি বলে, এতো কিছু ইচ্ছে করছে যে ব’লে সারাজীবনেও শেষ করতে পারবো না।

আমি বলি, অন্তত একটি বলো।

ডলি বলে, তোমার হাত ধরে হাঁটতেই ইচ্ছে করছে।

আমি বলি, আমার খুব দূরে যেতে ইচ্ছে করছে।

ডলি বলে, তাহলে তা-ই চলো।

আমি বলি, হেঁটে অতো দূর যাওয়া যাবে না।

ডলি বৃষ্টির থেকেও নিবিড় হেসে বলে, তাহলে একটা প্লেন ভাড়া করো।

কংকর্ডের থেকেও দ্রুত ও শব্দিত একটি বেবি এসে আমাদের সামনে থামে; আমরা উঠে বসি, ডলি ডান দিকে আমি বাঁ দিকে।

আমি ড্রাইভারকে বলি, শহর পেরিয়ে যে-দিক ইচ্ছে যাও, খুব দূরে।

বেবি চলতে শুরু করে। আমরা যে-দুজনই ভিজে গেছি, এটা প্রথম মনে পড়ে। ডলির; সে তার ব্যাগ থেকে একটি ছোটো তোয়ালে বের করে, আমার চশমাটি খুলে নিয়ে মুছে পরিয়ে দেয়, এবং আমি ডলিকে স্বচ্ছভাবে দেখতে পাই। আমি যখন তাকে স্বচ্ছভাবে দেখতে থাকি, সে তোয়ালেটি আমার শরীরের এদিক সেদিক বুলোতে থাকে; ঘষে ঘষে চুলগুলো শুকিয়ে ফেলে; আমি একবার ডলির হাত থেকে তোয়ালেটি নিই, ডলি মনে করে আমি হয়তো আমার এমন কোনো অঙ্গ মুছবো যেখানে তার হাত পৌঁছোবে না; আমি তোয়ালেটি দিয়ে তার মুখটি মুছে দেয়ার চেষ্টা করতেই সে আমার হাতটি তার দু-হাতে আস্তে চেপে ধরে। তোয়ালেটি আমার হাত থেকে খসে পড়ে, আমি তার মুখের একরাশ কোমলতা আমার দু-হাতের অঞ্জলিতে ধরে রাখি। বৃষ্টিতে পৃথিবী তখন শাদা হয়ে গেছে, পথঘাট থেকে মানুষেরা মুছে গেছে, আমরা শুধু ছুটে চলেছি। শহর পেরিয়ে অনেক দূরে এসে গেছি আমরা; পথের পাশে আমি একটি ভাঙা নড়োবড়ো ভাতের দোকান দেখতে পাই; দোকানটি বৃষ্টিতে কাকের মতো কাতর হয়ে পড়েছে, কিন্তু ভেতর থেকে একটা গরম গন্ধ বেরোচ্ছে। আমি বেবি থামাতে বলি।

চলো, আমি বলি, ভাত খাই।

ডলি বলে, ভাত? কোথায়?

এ-দোকানে, আমি বলি, খুব মোটা চালের গন্ধ পাচ্ছি।

ডলি বলে, ভাতের সুগন্ধ এটা?

আমরা নামতেই লোক তিনটি পাগলের মতো ছুটোছুটি শুরু করে; কী খাবো আর কী খাবো না জানার জন্যে অধীর হয়ে ওঠে। তারা কি বুঝে ফেলেছে আমরা এইমাত্র বিয়ে করে এসেছি। আমাদের একটা উষ্ণ সংবর্ধনা জানাতো উচিত? পোলাও রোস্ট তৈরি করা দরকার?

আমি ডলিকে বলি, আগে ওরা খবর পায় নি, ভাগ্য।

ডলি বলে, আগে খবর পেলে কী হতো?

আমি বলি, হয়তো লাল নীল কাগজ কেটে গেইটই তৈরি করে ফেলতো।

ডলি বলে, গেইট দিয়ে ঢুকতে আমার মন্দ লাগতো না।

আমি বলি, তাহলে গেইট সাজাতে বলি?

ডলি বৃষ্টির মতো দিকে দিকে ঝরঝর করে ঝরে পড়তে থাকে।

ডলি বলে, ওই লোকটিকেও বলো।

আমি বলি, কাকে?

ডলি বলে, বেবিঅলাকে।

আমি ডাকি, ড্রাইভার, ড্রাইভার।

ডলি আমার পাতে খাবার তুলে দিতে থাকে, আমার অদ্ভুত লাগে। মা আমার পাতে খাবার তুলে দিলেও আমি থামিয়ে দিই; বলি, রাখো তো, রাখো তো, কিন্তু ডলিকে থামাতে পারি না। আমি ডলির আঙুলের দিকেই তাকিয়ে থাকি; তার আঙুলের ভেতর থেকে স্বাদ গড়িয়ে পড়ছে আমার প্লেটে। লাল টকটকে নলা আর ঝাল কাঁচকি মাছ। দিয়ে আমরা ভাত খাই; আমার ঠোঁটজিভ পুড়ে যেতে থাকে। আমাদের জিভে এতো স্বাদ আছে আমরা আগে কেউ জানতাম না; আমি জানতাম না, ডলিও জানতো না।

ডলি বলে, কী যে স্বাদ লাগলো।

আমি বলি, এসো আরেকবার খাই।

ডলি বলে, আরেক দিন খাবো।

শহরে ফিরে একটি শাড়ির দোকানের সামনে আমি বেবি থামাতে বলি।

ডলি বলে, এখানে কেনো?

আমি বলি, আমার কয়েকটি শুকনো শাড়ি দরকার।

যখন বেরোচ্ছি, সন্ধ্যা অনেকটা হয়ে গেছে, বৃষ্টি থেমে গেছে। আমি একটি বেবির জন্যে ডানে বায়ে তাকাচ্ছি।

ডলি বলে, তোমার বউকে তুমি কোথায় রাখবে?

আমি চমকে উঠি, কথাটি আমি ভাবিই নি; আমি ধরেই নিয়েছিলাম ডলিকে আমি ডলিদের বাড়ি পৌঁছে দেবো, তারপর বাসায় ফিরে আসবো; কিন্তু ডলি যে আজ আমার বউ হয়ে উঠেছে, আমি তা ভুলেই গিয়েছিলাম।

আমি বলি, তাতো ভাবি নি।

ডলি বলে, একলা আমার ঘুম হবে না।

আমি বলি, আমরা কি একসাথে ঘুমোবো?

ডলি হাসতে থাকে।

আমি বলি, তোমার হাসি আমার ভালো লাগছে, কিন্তু তুমি হাসছো কেনো?

ডলি বলে, আমরা তো বিয়ে করেছি।

আমি বলি, হ্যাঁ।

ডলি বলে, তোমার কি বিশ্বেস হচ্ছে আমরা বিয়ে করেছি?

আমি বলি, হ্যাঁ।

ডলি বলে, প্রথম রাতেই দু-বাসায় ঘুমোনোর জন্যে কেউ বিয়ে করে না।

আমি বলি, ঘুমোনোর কথা আমার মনে পড়ে নি।

ডলি বলে, তাহলে বিয়ে করলে কেনো?

আমি বুঝে উঠতে পারি না কেনো বিয়ে করেছি। ডলির সাথে ঘুমোনোর জন্যেও আমি কোনো ব্যগ্রতা বোধ করছি না, আমার সব কিছুই আমার কাছে খুব শীতল ও সুন্দর মনে হচ্ছে, একটি নারীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোনোর কোনো তীব্রতা আমার নেই; বরং আমার মনে হচ্ছিলো ডলিকে ওদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে তাড়াতাড়ি আমি ফিরবো,–প্যান্টটি আমার এখনো ভিজে আছে, সেটি খুলে ফেলে টয়লেটে গিয়ে অনেকক্ষণ প্রস্রাব করবো,–তারপর খেয়ে কিছু একটা পড়বো, এবং এক সময় ঘুমিয়ে পড়বো। ডলি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে বিয়ে করলে একসাথে ঘুমোতে হয়, দু-বাসায় ঘুমানোর জন্যে কেউ বিয়ে করে না। গতকালও আমি ডলির সাথে ঘুমোতে পারতাম না; আমার যদি ইচ্ছে হতো, এবং আমি যদি ঘুমোতে চাইতাম, ডলি নিজেই চিৎকার করে উঠতো; তার সাথে চারপাশের বাড়িঘর, মসজিদ, মন্দির, রাষ্ট্র চিৎকার করে উঠতো; কিন্তু আজ তার সাথে না ঘুমোলে সে কাঁদবে। শুধু কাঁদবে না, সে আমাকে ছেড়ে কোথাও থাকবেই না।

আমি বলি, তোমার কি একসাথে ঘুমোনোর ইচ্ছে হচ্ছে?

ডলি কোনো কথা বলে না।

আমি বলি, তুমি কিন্তু কথা বলছে না।

ডলি বলে, সব কথা বলতে হয় না।

আমরা দোকানগুলোর সামনের পথ দিয়ে হাঁটতে থাকি; শাড়ির প্যাকেটগুলো ডলি বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে আছে, ডলিকে খুব উষ্ণ মনে হচ্ছে। একটি সোনার দোকানের পাশ দিয়ে যেতেই আমি একবার দাঁড়াই।

ডলি বলে, থামলে কেনো?

আমি বলি, দোকানটিতে একবার ঢুকলে কেমন হয়?

ডলি বলে, না, না, এখন না।

আমি সামনের দিকে একবার পা বাড়াতেই ডলির মুখটিকে ম্লান মনে হয়; আমি আবার পিছিয়ে দোকানটিতে ঢুকি।

আমি বলি, একটি আংটি।

ডলি বলে, তাহলে দুটো আংটি।

আমরা বেরিয়ে আবার হাঁটতে থাকি; একটা অষুধের দোকান দেখে আমি থামি; ভেতরে পা দিই।

ডলি বলে, অষুধ কিনবে?

আমি দোকানিকে বলি, কয়েক প্যাকেট কনডম দিন।

ডলি মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকায়।

আমি ডলিকে বলি, ডলি, পিল কিনবো?

ডলি বলে, না।

আমি হাসতে থাকি। ডলি বলে, হাসছো কেনো?

আমি বলি, পিল হচ্ছে আধুনিক নারীদের প্রধান খাদ্য, তুমি তা খেতে চাও না।

ডলি বলে, তুমি খাওয়ালে তো খাবোই।

আমি হাসতে থাকি, আর বলি, না, না দরকার নেই; আধুনিক পুরুষদের প্রধান পোশাকটিই আমি পরবো।

রিকশা নিয়ে আমরা একটি চীনে রেস্তোরাঁয় ঢুকি। ডলির মুখ দেখে আমার ভালো লাগে, ঢোকার সাথে সাথে ডলি ঝলমল করে উঠেছে। আমরা মুখোমুখি বসি; কিন্তু টেবিলটি এতো ছুটো যে মনে হয় আমরা জড়িয়ে ধরে বসে আছি।

লোকটি চলে গেলে আমি ডলিকে বলি, তোমার পা দুটি আমার দিকে বাড়িয়ে দাও তো।

ডলি প্রায় চিৎকার করে উঠে বলে, কেনো?

আমি বলি, চুমো খাবো। ডলি চমকে আরো সুন্দর হয়ে ওঠে।

ডলি বলে, রিকশায় ভেবেছিলাম তুমি জড়িয়ে ধরবে।

আমি বলি, আমার মনে পড়ে নি, চলো রিকশায় ঘুরে আসি।

ডলি হেসে ওঠে, তোমার সঙ্গে জীবনটা অন্য রকম হবে।

ডলি তার পা বাড়িয়ে দেয়, আমি পা দুটো আমার কোলে রেখে চুমো খাই।

আমরা যখন বাসায় পৌঁছি তখন বেশ রাত হয়েছে; মা, বাবা, বেলা–ছোটো বোনটি, উৎকণ্ঠিত হয়ে আছে। আজকাল দেরিতে ফিরলেই তারা সবাই খুব উদ্বিগ্ন থাকে; আমাকে কিছু বলে না, একটু বেশি রাত করে টেলিভিশন দেখে, আমি বুঝতে পারি তারা উদ্বিগ্ন। তিনজনেই একসাথে দরোজা খুলে দেয়। বাবা আর মা ডলিকে চিনতে পারে না; তারা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে ছিলো বলে বেশি অবাক হতে পারে না; বেলা ডলিকে ঠিকই চিনতে পারে, এবং এমনভাবে তাকায় যেনো কিছু খুঁজছে।

বেলা বলে, আম্মা, চিনতে পারছো? উনি দেলোয়ার ভাইর বউ।

আমি বলি, না, আমার বউ।

তারা তিনজনই একসাথে চমকে ওঠে, কিন্তু বেশি চমকাতে পারে না, বেশি রাত হয়ে গেছে বলেই হয়তো। ডলি এর মাঝেই সালামের কাজটি সম্পন্ন করেছে; মা তখনো ডলির মাথায় তার হাত ছুঁয়ে রেখেছে।

আমি বলি, আজ আমি ডলিকে বিয়ে করেছি।

তারা তিনজন একসাথে একটু বেশি নিস্তব্ধ হয়ে ওঠে; তাদের কিছু বলতে বা করতে হবে তাও বুঝে উঠতে পারে না। আমি ডলিকে নিয়ে আমার ঘরের দিকে হাঁটতে থাকি; তারা আমাদের পিছে পিছে আসতে থাকে। আমার ঘরে এসে আমি বিছানায় বসি, ডলি দাঁড়িয়ে থাকে; বাবা, মা, আর বেলাও দাঁড়িয়ে থাকে।

আমি বলি, তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বসো।

বাবা বলেন, তোমাদের যেহেতু আগেই পরিচয় ছিলো, তোমরা আগেই বিয়ে করতে পারতে।

আমি বলি, আগে আমাদের পরিচয় ছিলো না।

মা কোনো কথা বলে না, বেলাও কোনো কথা বলে না।

আমি ডলিকে বলি, তুমি কি বাসায় টেলিফোন করবে?

ডলি বলে, না।

মা বলে, চলো, তোমাদের খেতে দিই।

আমি বলি, আমরা খেয়ে এসেছি।

বেলা ডলিকে জড়িয়ে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

মা বলে, আমাদের আগে বলতে পারতে।

আমি বলি, আমি আগে জানতাম না।

বাবা বলেন, তুমি তো এমন ছিলে না।

আমি বলি, পনেরো বছর হওয়ার পর আপনি আর আমাকে জানেন না।

বাবা উঠে চলে যান।

কাপড় বদলিয়ে আমি টয়লেটে যাই, ফিরে এসে শুয়ে পড়ি; বালিশের নিচে একটি বই পড়ে ছিলো, হাতে ঠেকতেই তুলে নিই বইটি নিষিদ্ধ, আমার প্রিয় বইয়ের একটি পাতা খুলেই আবার দেখতে পাই–উর্বরতার দেবীরাই তখন ছিলো প্রধান দেবী, তাদের হটিয়ে আসে পুরুষ দেবতারা; বিশাল কালো পাথরটি ছিলো উর্বরতার দেবী আফ্রোদিতির মূর্তি, যার যোনিদেশে চুমো খেতে ভক্তরা, কেননা মাটি যেমন জন্ম দেয় শস্য তেমনি নারীর ওই প্রত্যঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসে রহস্যময় সন্তান। পাথর আকাশ থেকে পড়ে নি। শস্য আমার পছন্দ, কিন্তু সন্তান সম্পর্কে আমার দ্বিধা রয়েছে; সন্তান জন্ম দেয়ার প্রণালিটি আমার ভেতরে ঘেন্না জাগায়। বেলা ডলিকে নিয়ে আমার ঘরে ঢোকে। ডলি লাল টকটকে নতুন শাড়িটি পরেছে। আমার নারায়ণগঞ্জের কথা মনে পড়ে; দেলোয়ার আমাকে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে যাচ্ছে; আমি দেখতে পাই মেয়েটি আমাকে ব্লাউজ খুলতে দিচ্ছে না; পুলিশ আমার কাছে দশ টাকা চাচ্ছে; দেলোয়ার বলছে, তুমি অপবিত্র। ডলি কি আমার সাথে ঘুমোবে? আমি কি ডলির সাথে ঘুমোবো? ডলির ওই লাল টকটকে শাড়ি কি আমার খুলতে হবে? ডলি কি খুলতে দেবে? ডলির শাড়ি খোলার কোনো আগ্রহ আমি ভেতরে বোধ করছি না। ডলি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দরোজা বন্ধ করে দেয়, এবং এসে বিছানায় বসে।

আমি বলি, তোমাকে আমি চিনতে পারছি না।

ডলি বলে, আমি তোমার বউ।

আমি বলি, এতো সুন্দর বউর কথা আমি কখনো ভাবি নি।

ডলি বলে, আমি সুন্দর নই।

আমি বলি, তোমার সৌন্দর্য দেখে আমার ভয় লাগছে।

ডলি বলে, এ-সৌন্দর্য নষ্ট হতে বেশি সময় লাগবে না।

আমি বলি, ওঠো, উঠে শুয়ে পড়ো।

ডলি বলে, আমাকে ধরে উঠোও, নইলে আমি উঠতে পারবো না।

আমি ডলিকে ধরে উঠোতে গিয়েই দেলোয়ারের মুখ দেখতে পাই। আমি ডলিকে আর উঠোতে পারি না; দেলোয়ার শক্ত হাতে ডলিকে ধরে রেখেছে, আমার থেকে ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছে, আমি পেরে উঠছি না।

ডলি বলে, আমি তোমার বউ, আমাকে ধরো।

আমি বলি, ডলি, আমি তোমাকে ধরতে পারছি না।

ডলি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার মুখের দিকে তাকাও।

ডলির মুখটি আমার অঞ্জলিতে নেয়ার জন্যে আমি হাত বাড়াই, মুখটি আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে, অঞ্জলিতে স্থান পেতে চায়; আমি দেখতে পাই দেলোয়ার হাত দিয়ে ডলির মুখ ঢেকে রেখেছে, দেলোয়ারের অঞ্জলিতে ওই মুখ আধোঘুমে ঘুমিয়ে রয়েছে; তার অঞ্জলি আমি সরাতে পারি না; বারবার চেষ্টা করতে থাকি, কিছুতেই সরাতে পারি না; দেলোয়ারের আঙুল ডলির মুখে ময়লা দাগের মতো লেগে থাকে; এক সময় তার আঙুল সরিয়ে দুটি উজ্জ্বল রক্তের দাগের মতো ডলির ঠোঁটের দিকে আমি ঠোঁট বাড়াই; বাড়াতে গিয়েই দেখি দেলোয়ারের ঠোঁট লেগে আছে সেখানে, তার ঠোঁট খসতে চাচ্ছে না; দেলোয়ারের ঠোঁটের চাপে ওই ঠোঁট রক্তগোলাপের মতো ফুটে উঠছে; আমি ঠোঁট ফিরিয়ে নিই; ডলি শাদা পাথরের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যেতে থাকে; কিন্তু ডলি আমার, ডলিকে উদ্ধার করতেই হবে, ডলি আমার বউ; আমি টান দিয়ে ডলির লাল শাড়িটি খুলে মেঝের দিকে ছুঁড়ে ফেলি, আমার মনে হয় অন্য কেউ শাড়িটি ছুঁড়ে ফেললো, নোংরা হয়ে গেলো শাড়িটি; তার ব্লাউজ খুলতে গিয়ে অন্য কারো হাতের সাথে আমার আঙুলের ঘর্ষণ লাগে; ওই হাত অনেক আগে থেকেই খুলছে ডলির ব্লাউজ; সে-হাত বারবার আমার আঙুলগুলোকে ফিরিয়ে দিতে থাকে; আমি ডলির ব্লাউজ টেনে চারপাঁচ টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলি, ছেঁড়ার শব্দ মধুর লাগে আমার; ডলির কম্পমান চাঁদের আলোয় আমার চোখ অন্ধকার হয়ে আসে; ওই অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে দেখি অন্ধকারের ভেতরে বসে আছে অন্য কেউ; আমার চোখে আরো গাঢ় অন্ধকার নামে; ডলিকে আর ডলি মনে হয় না, নদীর ওপর দীর্ঘ চর মনে হয়; ওই চরে আমি যেখানেই যেতে থাকি, সেখানেই দেখি দেলোয়ার ঘর বানিয়েছে, চাষ করেছে, লাঙ্গল চালিয়েছে, ধান পাট সরষে তিল যব কাউন কুমড়ো শিম বুনেছে; দিঘি কেটেছে, জল টলমল করছে; এ-জমি থেকে আমন তুলেছে, ওই জমি থেকে আউশ; পুবের জমি থেকে মশুর, পশ্চিমের জমি থেকে কলই; আমি ডলির বাহু থেকে বগল থেকে নাভিতে ছুটতে থাকি; লাল তিল থেকে ধূসর তিলে দৌড়োতে থাকি-প্রত্যেকটিই দেলোয়ারের; হেঁটে হেঁটে। বাহুতে গিয়ে ডলিকে জিজ্ঞেস করি, দেলোয়ার কি এখানে ছিলো;–হ্যাঁ; হেঁটে হেঁটে বগলে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, দেলোয়ার কি এখানে ছিলো;–হ্যাঁ; গড়াতে গড়াতে নাভিতে গিয়ে ডলিকে জিজ্ঞেস করি, দেলোয়ার কি এখানে ছিলো;–হ্যাঁ; হামাগুড়ি দিয়ে জংঘায় গিয়ে জিজ্ঞেস করি, দেলোয়ার কি এখানে ছিলো;–হ্যাঁ; পায়ের তালুতে গিয়ে ডলিকে জিজ্ঞেস করি, দেলোয়ার কি এখানে ছিলো;–হ্যাঁ; শত শত মাইল পেরিয়ে সোনার খনিতে গিয়ে ডলিকে জিজ্ঞেস করি, দেলোয়ার কি এখানে ছিলো;–হ্যাঁ; আমি অন্ধ হয়ে যেতে থাকি, অন্ধত্বের ওপারে এক অদ্ভুত জ্যোৎস্নাই শুধু আমার চোখ দুটিকে। ম্লানালোকিত করে রাখে; ওই অন্ধ আলোর ভেতরে আমি ডলিকে দেখার চেষ্টা করি, দেখতে পাই না; আমার মনে হয় ডলি আমার স্ত্রী নয়, এ-শরীর যার সে আমার স্ত্রী নয়; অন্য কারো; আমি নিঃশব্দে ডলির শরীর থেকে খসে পড়ি।

একটু পর ডলির জন্যে আমি কষ্ট পেতে থাকি; তাকে বিয়ে করতে আমাকে সে বলে নি; বরং সে আমার কথা রেখে একটি সম্পূর্ণ দিন আমাকে সুখী করেছে। একটি সম্পূর্ণ দিন আমি কখনোই সুখী থাকি নি পনেরো বছর হওয়ার পর। আমি যখন আজ তাকে বেবিতে উঠতে বলি, যদি সে উঠতে রাজি না হতো, বলতো, আপনাকে বিয়ে করার কথা আমি ভাবতে পারি না; আপনি ভুল বুঝেছেন আমাকে; আপনাকে আপন মনে করেছি শুধু আমরা একই অপরাধ করেছি বলে, তাহলে একটি সম্পূর্ণ সুখের দিন আমি কখনোই পেতাম না। ডলি কোনো কথা বলছে না, আমি কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি; প্রথম মনে হচ্ছিলো আমি নিজেই কাঁদছি, পরে বুঝতে পারি কাঁদছে ডলি। দেলোয়ার নদীতে ডুবে যাওয়ার পরও ডলিকে কাঁদতে দেখি নি; আজ তার কাঁদার কথা নয়, আজ সম্পূর্ণ একটি দিন আমি তাকে সুখে রেখেছি, পনেরো বছর হওয়ার পর, কাউকে আমি একটি সম্পূর্ণ দিন সুখী রাখতে পারিনি, কেউ আমার কাছে সুখী হতে চায় নি, কাউকে আমি সুখী করে উঠতে পারি এমন কথা কেউ ভাবে নি; শুধু ডলিই আমাকে সুখী করতে চেয়েছে আর সুখী হতে চেয়েছে। ডলিকে আমি চিনিই না, কাউকেই আমি চিনি না; আমাকেও ডলি চেনে না। আমাকে কনডম কিনতে দেখে ডলি কী ভেবেছিলো? আমাকে খারাপ ভাবছিলো? তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার তো মনে হচ্ছিলো তার একটি ভাবনা বাস্তবায়িত হচ্ছে, যে-ভাবনাটি কখনো সে প্রকাশ করে উঠতে পারতো না। এখন ডলি কী পাথরের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে? সে কি বরফ হয়ে গেছে? আমি যদি তাকে ছুঁই সে কি আমাকে সহ্য করবে? ডলির কান্না এখন আর শুনতে পাচ্ছি না, সে কি ঘুমিয়ে পড়েছে? আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছি? আমি যদি ঘুমিয়ে পড়তে না পারি ডলি কী করে ঘুমোতে পারবে? সে হয়তো তার নিজের বিছানাটির কথা ভাবছে। হয়তো দেলোয়ারকে ভাবছে। কেনো ভাববে না? আমার মনে পড়ছে, নারায়ণগঞ্জের মেয়েটিকে। ওই মেয়েটির শরীরে আমি অন্য কাউকে দেখতে পাই নি, কোনো দাগ দেখতে পাই নি, ময়লা দেখতে পাই নি; তাহলে ডলির শরীরে আমি এতো দাগ কেনো দেখলাম?

আমি ডাকি, ডলি।

ডলি বলে, বলো।

আমি বলি, দেলোয়ারকে মনে পড়ছে?

ডলি বলে, না।

আমি বলি, আমি দুঃখিত।

ডলি কোমলভাবে আমার ডান হাতটি ছোঁয়; মনে হয় বেশি ছুঁতে সাহস পাচ্ছে না; আমার মনে হয় ডলি আরো ছুঁক, কিন্তু আমি বলতে পারি না।

আমি বলি, দেলোয়ার আমাকে বহু বছর অপরাধবোধের মধ্যে রেখেছিলো।

ডলি বলে, আমি জানি।

আমি বলি, কী জানো?

ডলি বলে, আমি বলতে পারবো না।

আমি বলি, আমি নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলাম।

ডলি বলে, ওই কথা রাখো, ওই কথা রাখো।

আমি বলি, আমি খুব খারাপ।

ডলি বলে, না।

আমি বলি, দেলোয়ারই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো।

ডলি বলে, দেলোয়ার আমাকে তা বলে নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *