৩৫. সান্যালমশাইয়ের বড়োছেলে

সান্যালমশাইয়ের বড়োছেলে নৃপনারায়ণ গ্রামে এলো। কনকদারোগার দপ্তরে খবর পৌঁছনোর আগে নৃপনারায়ণ বুধেডাঙা চিকন্দির সংযুক্ত সীমায় পৌঁছে গেলো। সদর রাস্তা ছেড়ে আলোর পথ বেছে বেছে সে অত্যন্ত দ্রুত চিকন্দির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। তাকে দেখে ইয়াজ বিস্মিত হয়েছিলো। দাদপুরীদের অগ্নিকুমার আর রাবণের কাছে যেন চেনা চেনা লেগেছিলো।

নৃপনারায়ণ খিড়কি-দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে হনহন করে রান্নার মহল পার হয়ে অন্দরের চত্বর পার হয়ে দোতলায় অনসূয়ার ঘরে গিয়ে ঢুকলো। কাঁধের ঝোলাটা ড্রেসিং টেবলে রেখে ধূলিমলিন অবস্থাতেই সে অনসূয়ার বিছানায় গিয়ে বসলো, একটু বা ঘরের মধ্যে পায়চারি করলো। মা এসে কেমন চমকে যাবেন এই চিন্তা করে সে মিটমিট করে হাসলো। কিন্তু দশ মিনিট পরেও যখন অনসূয়া এলেন না তখন সে সান্যালমশাইয়ের স্টাডির দিকে রওনা হলো। সেখানে সান্যালমশাই ছিলেন। নূপনারায়ণ ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতেই সান্যালমশাই কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, বটে?

নৃপনারায়ণ বললো, হ্যাঁ।

তারপর নৃপনারায়ণ একটা চেয়ারে বসলো।

সান্যালমশাই খবরের কাগজটা তুলে ধরলেন; আঙুলগুলি ও হাতের খানিকটা ছাড়া আর সব কাগজে ঢাকা পড়লো। নৃপনারায়ণ দেখতে পেলো না কিন্তু সান্যালমশাইয়ের চোখে তখন সব লেখা অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কাগজ নামিয়ে চশমাটা একটুকরো শ্যাময় চামড়ায় মুছে নিয়ে সান্যালমশাই বললেন, মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে?

একটু লুকোচুরি খেলছি।

নৃপনারায়ণ যখন তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলো তখন ধাত্রী তার নিজের ঘর থেকে তাকে দেখে অবাক হয়েছিলো। কী করা উচিত এই যখন সে ভাবছে, সুমিতি ধাত্রীর ঘরে গেলো ছেলেকে দুধ খাওয়াতে।

ধাত্রী চুপিচুপি বললো, অপরিচিত একজন লোক ঢুকেছে মায়ের ঘরে।

অনসূয়ার ঘরে পরিচিত দাসী ছাড়া যারা তার অনুপস্থিতিতে এ-মহলে আসতে পারে তারা হচ্ছে সদানন্দ, রূপু এবং সান্যালমশাই স্বয়ং। দিনের বেলা এই যা ভরসা।

অপরিচিত?

বলে বোকা হতে চাই নে, অস্বস্তি লাগছে কিন্তু।

তখন অনসূয়ার কাছে খবর পাঠালো সুমিতি। কিন্তু খবর পাঠানোর দরকার ছিলো না। নৃপনারায়ণ রান্নামহলের একজনের চোখে পড়েছিলো। সে চিনতে পারেনি কিন্তু অনসূয়াকে বললো, কে একজন এলেন, মা।

সে কী কথা!

সাহেবের মতো রং। খুব লম্বা, দু লাফে যেন উঠোন পার হয়ে গেলেন।

একটু ভেবে, অসম্ভবটা কি এমন আকস্মিকভাবে সম্ভব হয়, এই ভাবতে ভাবতে অনসূয়া। নিজের ঘরের দিকে চললেন। নিজের ঘরে ঢুকে অনসূয়া ঝোলাটা দেখতে পেলেন, ধুলোভরা স্যান্ডেল জোড়াও দেখতে পেলেন। বুকটা ধকধক করছে। মুখ ফুটে কিছু না বলে তিনি নিজের ঘর থেকে সান্যালমশাইয়ের ঘরের দিকে চললেন। কষ্টের মতো কী একটা বোধ হলো। সুমিতির ঘরের সম্মুখ দিয়ে যাওয়ার সময়ে গ্রীবা না বেঁকিয়ে যতদূর সম্ভব সুমিতির ঘরের ভিতরটা দেখে নিলেন। এ-ঘরে নেই এমন একটা আশাকে রক্ষা করতে করতে তিনি এগোলেন। স্টাডিতে ঢুকে তিনি কিছুই মনে করতে পারলেন না, কারণ, ততক্ষণে নৃপনারায়ণ প্রণাম করেছে, মাকে বুকের মধ্যে জড়িয়েও ধরেছে।

ছেলেকে বসিয়ে, নিজে তার পাশের একটা চেয়ারে বসে অনসূয়া বললেন, চমকে দেওয়ার অভ্যাস এখনো তোর আছে।

কাউকেই বোলো না এখন, আমি এসেছি। আগে কিছুক্ষণ তোমাদের দুজনের মাঝখানে বসে থাকি।

‘তা থাকিস। তোকে বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমি খাবারের ব্যবস্থা করে আসি। বলে অসূয়া চলে গেলেন।

সংবাদটা তখন আর চাপা থাকলো না, সুমিতির কানে গেলো, রূপু শুনলো।

ঈষৎ তপ্তজলে স্নান শেষ করে নৃপনারায়ণ খেতে বসেছিলো মায়ের ঘরে। জলযোগ শেষ হলে অনসূয়া বললেন, তুমি এবার সুমিতির ঘরে গিয়ে বোসো গে, আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

নৃপনারায়ণ যখন সুমিতির ঘরে গেলোতখন সেখানে সুমিতি ছিলো। বললো, ভালো আছেন, গ্রামে এসে কষ্ট হচ্ছে না তো আপনার?

না, কষ্ট হবে কেন? আপনাকে একটু রোগা দেখাচ্ছে।

দুদিনের বিশ্রামে ঠিক হয়ে যাবে।

ওদিকে খবর কী?

দেশের রাজারা নাকি প্রজাদের হাতে সত্যি শাসনভার তুলে দেবে।

নৃপনারায়ণ তখনো বসেনি। সুমিতি বললো, বসুন। আপনাকে কিন্তু ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

নৃপনারায়ণ হাসলো।

এমন সময়ে রূপু এলো। ‘এদিকে’ ‘এদিকে’ বলে কাকে পথ দেখিয়ে আনছে সে। ধাত্রী নৃপনারায়ণের শিশুটিকে নিয়ে প্রবেশ করলো রূপুর সঙ্গে।

ধাত্রী বললো, বিড়োবাবু, এমন সময়ে বকশিশ চাওয়াই প্রথা।

নূপনারায়ণ বললো, নিশ্চয়, নিশ্চয়। আপনাকে নিশ্চয়ই পুরস্কৃত করা উচিত। এই বলে চোখ তুলে চাইতে গিয়ে সুমিতির চোখে চোখ ঠেকে গেলো তার। সুমিতি সিঁদুর হয়ে মুখ নামিয়ে নিলো।নৃপনারায়ণের গালও রক্তিম হয়ে উঠলো। শিশুটির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতে থাকতে নৃপনারায়ণ বললো, এখনো চোখ ফোটেনি যেন।

রূপু হো হো করে হেসে বললো, কী বলল, দাদা, কত বুদ্ধি তা তো জানো না। আঙুল ধরতে চায়।

তুমি যে খুড়োমশাই তা মনে ছিলো না।

ও এখন ঘুমুবে। বলে কিছুপরে ধাত্রী তার অধিকারকে নিয়ে চলে গেলো।

তুমি বিশ্রাম করে নাও।বলে রূপুও চলে গেলো।নৃপনারায়ণ সুমিতিকে বললো, আপনার বাড়ির লোকদের এ-খবর দিয়েছেন?

হ্যাঁ।

কিন্তু আপনাকে যেন সে-সময়ে আমি ‘তুমি’ বলার চেষ্টা করতাম। বিব্রতমুখে নৃপনারায়ণ বললো।

তুমি’ বলতেন। মাঝে-মাঝে গোলমালও হতো। একজনের খুব ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় হয়েছিলো। সুমিতি আবার সিঁদুর হলো।

না, না। এখন আর আপনি’ বলাটা একদম মানায় না, সে তুমি যাই বলো।

নৃপনারায়ণ হাসতে গেলো, রাঙা হয়ে উঠলো, বললো, এখন তা অস্বীকার করতে পারি ।

এরপরে চা এলো। দাসীর হাতে ট্রে, কিন্তু অনসূয়া সঙ্গে এলেন। একটু যেন বাড়াবাড়ি হলো।

অনসূয়া এত সুখ অনুভব করেননি। তিনি মনসাকে পত্র দিলেন-তোর দাদা এসেছে, মণি।

নিজের ঘরের গভীরে অনসূয়া ভাবলেন–একটু স্বার্থপর হয়ে পড়েছি আমি। ছেলে বাড়িতে এসে প্রথমে মাকেই খুঁজেছে। এবং সেটাই উচিত। নতুবা ছেলেও বোধহয় এমন করতো না। ছেলে সুমিতির ঘরে আছে এরকম একটা আশঙ্কাতেই সে-ঘরের দিকে গোপনে চেয়েছিলেন তিনি, এরকম একটা লজ্জাও তার হলো। অনুভব করলেন, কিছুই নয়, অন্যান্যবারের মতো দেখাতে চায়ের ট্রের সঙ্গে গিয়ে ভালো হলো না। ভাগ্যে আয়না সামনে নেই।

.

পুরনো খবর একটু দেওয়া যাক।

দাঙ্গা রাজনীতির ব্যপারটা কমে এসেছেতখন,এক সন্ধ্যায় খবরের কাগজের দাগিয়ে-দেওয়া অংশগুলিতে চোখ বুলিয়ে যখন সান্যালমশাই গ্রামের বাইরের পৃথিবীর খবর নিচ্ছেন এবং রাজনীতির আলাপ করছেন, তখন তিনি মন্তব্য করলেন, সদানন্দ, আমার মনে হচ্ছে বাঁশ যেমন একটি একটি করে গ্রন্থি পার হয়, তেমনি কোনো গ্রন্থি পার হয়েছে তোমার মন।

কেন বলুন তো?

শিপিং ইন্টেলিজেন্সে আমার আগ্রহ থাকার কথা নয়, দেখছি সে-খবরগুলি আজকাল প্রায়ই দাগানো থাকে।

সদানন্দ বললো, তা থাকে, ওটা রূপুর কীর্তি।

চোখের সম্মুখ থেকে কাগজ সরিয়ে সান্যালমশাই প্রশ্ন করলেন, তোমার ছাত্র কি কোথাও যেতে চায়, কিংবা কারো আসার প্রতীক্ষা করছে?

ওটা নিয়ে খুব মাথা ঘামাই নে, কারণ ওটার সঙ্গে লেখাপড়ার ব্যাপারটা তত সংযুক্ত নয়। তবে চারিদিকে একটা সাজোসাজো রব উঠেছে বটে।

কীরকম?

রূপুর বন্ধু, পরে শুনলাম, মন্মথ রায়মশাইয়ের ছেলে বিলেতে যাচ্ছে কী একটা শিখতে। পাঁচ-ছ বছর ধরে নাকি শিখবে। সে রূপুকে চিঠি দিয়েছে।

তখনকার মতো সান্যালমশাই কাগজ ও তামাক নিয়ে ব্যাপৃত রইলেন। পরে তার মনে হলো, যখন তিনি জেনেছেন তখন রূপুকে ডেকে জিজ্ঞেস করাই উচিত। রূপু জানবে যে তিনি জেনেছেন, অথচ কেউই কথাটা উত্থাপন করছে না, সে যেন এক গোপনবৃত্তি। আর বিস্ময়ের এই যে, এ ব্যাপারে অনসূয়া একেবারে নীরব।

বাগানের মেহগনির অংশটিতে কাটবার উপযুক্ত গাছ দুটি সান্যালমশাই নিজেই নিজেই চিহ্নিত করে দিয়েছেন। চারু লোকজন নিয়ে গেছে অতি সন্তর্পণে গাছদুটি কেটেনামাতে। পাশের অপেক্ষাকৃত অপুষ্ট গাছগুলিকে নষ্ট করলে চলবে না। কথাটা ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি, আর তা সবসময়ে সহজও নয়। বাড়িটা তো উঠছেই, যদিও দাঙ্গার পরের আর আগের মন এক নয় যেন। কাঠ সিজনড় হতেও তো সময় নেবে। ভালো কাঠ সব সময়েই মূল্যবান, নিছক পণ্য হিসাবেও। সকাল থেকে সান্যালমশাই রূপুর সঙ্গে আলাপ করবেন বলে মনস্থির করে রেখেছেন। তার মনে হলো, এখন রূপুকে বাগানেই পাওয়া যাবে। বনস্পতি-পতনের মতো ব্যাপার নিশ্চয়ই তাকে আকর্ষণ করবে।

সান্যালমশাই বাগানে গিয়ে খানিকটা সময় এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ালেন। তার সাড়া পেয়ে রূপু তার কাছে এসে দাঁড়ালো এবং তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। এমন ব্যাপার রোজ হয় না। বাগানে অনেক গাছ আছে যার সঙ্গে কোনো গল্প জড়ানো আছে। আমগাছগুলি কোনো কোনোটি বহু অর্থব্যয়ে বিদেশ থেকে আনানো। বোটানি ছাত্রদের জন্য তৈরি বাগান নয় যে টিনের প্লেটে সন-তারিখ নামধাম লিপিবদ্ধ থাকবে। রূপু যেখানে একটি গাছ থেকে আর একটি পৃথক করতে পারে না সান্যালমশাইয়ের কাছে তখন প্রত্যেকটি ব্যক্তিত্বশালী। কোন গাছ কবে মুর্শিদাবাদ থেকে কলম হয়ে এসেছিলো, কোনটা খাঁটি অলফলো, কোন লাইনটা বোম্বাইয়ের, এসব রূপু সাগ্রহে প্রশ্ন করতে লাগলো এবং তেমনি সাগ্রহ উত্তর পেলো। হিমসাগরের লাইনটা যে বাগানের ঠিক মাঝখানে উত্তর থেকে দক্ষিণে গিয়ে জামরুলগাছের কুঞ্জটাতে মিশেছে, এটা যেন একটা আবিষ্কার।

সান্যালমশাই বললেন, হ্যাঁ রে রূপু, তুই নাকি বিলেতে যাচ্ছিস?

রূপু হকচকিয়ে গেলো, তারপর বললো, তুমি না পাঠালে কী করে যাবো?

যদি পাঠাই, কী করবি?

তাও তুমি বলে দেবে।

সেখানে তো সবাই ইংরেজিতে কথা বলে।কথা বলতে বলতে থেমে,দু-একটা কথা বাংলায় বলে জিরিয়ে নিবি এমন উপায় নেই।

রূপু খিলখিল করে হেসে উঠলো। পরে বললো, যদি এখনি যেতে দিতে বড়ো ভালো হতো। নিমাই যাচ্ছে এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে।

তার বাবার খনি আছে। সে ফিরে এসে সেখানে কাজ করবে। তুমি কী শিখে আসবে? তোমার বাবা তো কৃষক।

রূপু বললো, আমি যদি ডাক্তার হই?

তা মন্দ নয়। কিন্তু অনেকদিন যে সেখানে একা একা থাকতে হবে। প্রায় বছরদশেক। সেখানকার স্কুলের পড়া শেষ করে তার পরে ডাক্তারি পড়া।

মাঝে মাঝে ছুটিও তো পাবো।

অনেকক্ষণ গাছের ছায়ায় ঘুরে বেরিয়ে সান্যালমশাই গল্প করলেন রূপুর সঙ্গে। অবশেষে তাঁর মনে হলো ছেলের মন খানিকটা তিনি বুঝতে পেরেছেন।

এক সন্ধ্যায় সেদিনের ডাকে-আসা চিঠিটা পড়ে সান্যালমশাই কথাটাকে অনসূয়ার সম্মুখে উল্লেখ করলেন। বললেন, এতদিন আলাপটা শিশুমহলে ছিলো, এখন দেখছি বতোদের দরবারেই উঠে এলো। তোমার ভাই মন্মট চিঠি লিখেছে।

মন্মথ রায়ের নামোল্লেখ এর আগেও হয়েছে। তিনি অনসূয়ার সহোদর নন, এ-গ্রামের রায়বংশের ছেলে। গ্রামে এরকম একটা প্রবাদ আছে যে, কয়েক পুরুষ আগে জলদস্যু সান্যালদের এক ছেলে রায়দের এক মেয়েকে রাক্ষস-মতে বিবাহ করেছিলো। প্রবাদ এও বলে, রায়দের সেই মেয়েই পলায়নের খিড়কি দরজা দেখিয়ে না দিলে চারজনমাত্র তরোয়ালবাজ রায়-জমিদারের প্রাসাদ-ঘেরা বাড়ির যাত্রার আসরের চিক-ঘেরা অলিন্দ থেকে একশো ঢালির চোখের সম্মুখ দিয়ে পালাতে পারতো কিনা সন্দেহ। মন্মথ রায়, সান্যালমশাই তাকে মন্মট বলেন, এই সুবাদে রসিকতা করে বলেছিলো–আমার বোন অনসূয়া আছেন বলেই লক্ষ্মী তোমার ঘরে বাঁধা। প্রকৃতপক্ষে তোমরা রায়দের লক্ষ্মী চুরি করে এনেছিলে।

অনসূয়া বললেন, মন্মথদাদা লিখেছেন, কই দেখি?

চিঠিটা পড়া শেষ হলে তিনি আবার বললেন, তুমি কী করবে ঠিক করেছে?

সান্যালমশাই বললেন, আজকাল যেন আমি আমার পরিবারের সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারছি নে। তোমরা সকালে এত তাড়াতাড়ি ছুটছো যে আমি ভাবছি কোনো কোনো চাল আমি আগে থাকতে দিয়ে রাখবো কিনা। এখন মনে হচ্ছে রূপুর বিদেশ যাওয়ার কথা আমার অনেক আগেই চিন্তা করা উচিত ছিলো।

ছেলেকে যেতে দেবে?

মন্মট্‌ নিজে যাচ্ছে ছেলেকে সঙ্গে করে। নিজেও কিছুকাল কাটাবে সে দেশে। লোকে জানবে ছেলের শুভকামনায় এই বিদেশে থাকা। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, ছোটোবেলায় সে যে কাল্পনিক ববাহেমিয়ার স্বপ্ন দেখতো সেটা পৃথিবীতে আছে কিনা ত খুঁজে দেখাই তার ইচ্ছা।নতুবা নতুন কোনো ব্যবসা মাথায় ঘুরছে। সে যা-ই হোক। রূপু সেখানে গিয়ে মনস্থির করার সুযোগ পাবে। যদি ভালো না লাগে তার সঙ্গে ফিরবে। অন্তত বেড়ানো হবে।

এইভাবে রূপুর বিদেশ যাওয়া স্থির হয়েছিলো।

.

বাংলোটির নাম হয়েছে সুমিত। রূপুর দেয়া নাম। গেটে রূপুর পরিকল্পনা অনুযায়ী কালোপাথরের ট্যাবলেটে ব্রোঞ্জের অক্ষর বসিয়ে ইংরেজি ও বাংলায় নামটি লেখানো হবে। ট্যাবলেটটা সদর থেকে তৈরি হয়ে এসেছে, আজ মিস্ত্রিরা বসাবে। চারু ওভারসিয়ার রূপুকে ডাকতে এসেছিলো, রূপু দাদা ও বাবাকে সঙ্গে না নিয়ে যাবে না। তার পীড়াপীড়িতে সান্যালমশাই এবং নৃপনারায়ণ দুজনেই গিয়েছিলেন। ফিরে আসার পথে রূপু বললো, বাড়িটা ভালো হয়নি, দাদা?

অনুপম হবে। এবার এসে বাড়িতে কিছু কিছু পরিবর্তন দেখছি।

তুমি ইলেকট্রিকের কথা বলছো? নাকি দীঘির ঘাটের?

হ্যাঁ, ইলেকট্রিকের কথাও বৈকি। বেশ আধুনিক হচ্ছে যেন। নৃপনারায়ণ হাসলো।

ছুতোর মিস্ত্রিদের টিনের চালা থেকে কিছুদূরে বাগান ঘেঁষে আর-একটি খড়ের চালা। সেটার দিকে ইঙ্গিত করে নৃপ বললো, ওখানে কী হচ্ছে রূপু?

টবে গাছ তৈরি হচ্ছে। বেশির ভাগ টবই অবশ্য ‘সুমিত-এর জন্যে’।

নৃপ বললো, যেভাবে বাংলোটাকে সাজাচ্ছে তাতে মনে হয় সমারোহের কিছু একটা প্রতীক্ষা করছো তুমি।

রূপু বললো, আমার সবটুকু প্ল্যান কাজে লাগানো হয়নি। একটা আঁকাবাঁকা ঝিল কাটতে হবে। সেই ঝিলে একটা ছোটো ব্রিজ থাকবে যেমন, তেমনি থাকবে ছোটো একটা বোট।

তাহলে তার পাড়ে তারের জালে ঘেরা ঝোপেঝাড়ে বুনো হাঁস আর সারস রাখা যায় কিনা ভাবতে হয়। কিন্তু বুড়ো মালী শুনেছি বর্তমানে রাতকানা। বিলের জলে ডুবে প্রাণ না দেয়।

তা যদি বলো ব্রিজে একটা লাল আলোর ব্যবস্থা থাকবে।

সান্যালমশাই বললেন, রূপু, তোমার সব পরিকল্পনা দাদাকে শুনিয়েছে? এই বলে নিজেই হাসি মুখে তার দু-একটি পরিকল্পনা ব্যক্ত করলেন। আর একটা বাংলো উঠবে। এটার মতো তত রংদার হবে না, কিন্তু আয়তনে কিছু বড়ো হবে। সেটার নাম হবে ‘অনসূয়া ভবন। সেখানে। নাকি চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে।

রূপু লজ্জায় মুখ নিচু করে রইলো।

নৃপনারায়ণ রূপুর দিকে হাসিমুখে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলো, আর এই সুমিতবাড়িটা?

রূপু বললো, গেস্টহাউস হতে পারে, অনেককিছু হতে পারে, একটা আধুনিক স্কুল হলেই বা দোষ কী?

সদানন্দ মাস্টারমশাইয়েরটি, শুনছি প্রায় উঠে যায়?

তা কেন? সেদিন পোরট্রেট আঁকার সময়ে বউদি মাস্টারমশাইকে অন্যরকম স্কুলের কথা বলছিলেন, যেখানে সিল্কের খদ্দর, তসর এসব বোনা শেখানো যায়, চামড়ার স্যান্ডাল, ব্যাগ এসব তৈরি করা শেখানো যায়। সে রকম হতে পারে।

নৃপ বললো, আচ্ছা! কিন্তু তোমাদের সেই স্কুলে অত লোকে যদি সিল্কের খদ্দর বুনতে শিখে যায় সে তো অনেক খদ্দর হতে থাকবে। কিনবে কে? তুমি বোধ হয় জানোনা কাপড় একরকম ফাইন হলে মিলের কাপড় খদ্দর থেকে সস্তা হয়।

রূপু বললো, সিল্কের খদ্দর পরার লোক নেই? মনে করো, বউদিরই তো তা দরকার।

নৃপ হেসে ফেলে বললো, তা ঠিক, ছোটভাই, তোমার সেই খদ্দর জোগান দেয়ার রাইটও আছে বটে। অন্যদিকে দেখো, তুমি এতসব আধুনিক করছো, টেনিস লনটাকে কিন্তু একদম উপেক্ষা করেছে। দেখলাম আকন্দর জঙ্গল হয়েছে।

রূপু নৃপনারায়ণের খদ্দরের পায়জামা-কুর্তাপরা চেহারাটায় মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, বাঃ! কে খেলবে টেনিস? তুমি?

কেন, আমি, তুমি, মনসা…।

তাহলে কাল থেকেই তোক লাগিয়ে দিলে হয়।

নৃপ চাপা হাসির পিছনে কিছু ভাবছে। সান্যালমশাই হাসছেন কিনা মনে মনে, ভাবছেন কি না, বোঝা গেলো না; মুখটা সন্তুষ্ট কিন্তু নির্লিপ্ত।

সন্ধ্যায় সান্যালমশাই নৃপনারায়ণকে বললেন, তোমার ভাই বিদেশে যাচ্ছে তা বোধহয় শুনেছো?

রূপু নিজেই বলছিলো। জিজ্ঞাসা করছিলো, সে দেশটা কী রকম হবে। ছোটোবেলায় পড়া একটা কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে শুনিয়ে দিলাম, সেখানে চার কুড়িতে আশি হয়, দরজাগুলো কাঠের, এবং এক গজ সেখানেও এক গজ।

তুমি ছিলে না যখন এ ব্যাপারটা ঠিক হয়, তাই এ বিষয়ে তোমার মত জানা যায়নি।

যখন বাঙালিদের কালাপানির ভয় ছিলো সে যুগে য়ুরোপে যাওয়ার কথা আমাদের বংশের কারো মনে হয়নি। ভালোই হয়েছে। তাই বলে এখনো পিছিয়ে থাকার কোনো যুক্তি নেই।

য়ুরোপে যাওয়াকে এগিয়ে যাওয়া বলো? আমি আশ্বস্ত হলাম। ভেবেছিলাম পাছে তুমি বিষয়টিকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করতে না পারা ইংরেজবিদ্বেষ থেকে।

সান্যালমশাই কাগজের পৃষ্ঠা ওল্টালেন। কিন্তু সেটায় মন না দিয়ে বললেন, খোকা, আমার মামার বাড়ির দেশে একটা ঘটনা ঘটেছিলো। তোমাদের কালাপানির গবেষণায় সাহায্য করবে। সেই গ্রামের এক ছেলে বিলেতে গিয়েছিলো কৃষিবিদ্যা শিখতে, ফিরলো এক ঘেসো-মেম সঙ্গে করে। যথারীতি তার পরিবারের হুঁকো বন্ধ হলে। ছেলেটির কী অভাবনীয় মতি হলো যে চাকুরিস্থল থেকে এসে গ্রামকে সে আলোকিত করার চেষ্টা করলো। তখন সে-গ্রামে এক টুলোপণ্ডিত বাস করতো। তার ধারণা ছিলো, সে রূপ-সনাতন কারো একজনের বংশধর। সে ই বললোবাপু হে, বিয়ে করাটা কিছু দোষের নয়। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ জাম্ববতাঁকে তা করেছিলেন। তার ফলে জম্বুবান জাতটাই মানুষ হয়ে গেলো। এই বলে তিনি এমন হাসলেন যে সেই রোগাপটকা বুড়ো বামুনের হাসির ছোঁয়াচ লেগে গেলো সারা গ্রামে। ছেলেটি তার চাকুরিস্থলে ফিরে গিয়ে ডিসকোর্স না ডেসপ্যাঁচ কী একটা অন্ হিন্দুম্যারেজ লিখেছিলো।

নৃপ হো-হো করে হেসে উঠলো। সান্যালমশাইয়ের তামাক এসেছিলো। গড়গড়ার নলটা হাতে নিয়ে ভৃত্য চলে গেলে তিনি বললেন, কালাপানি কথাটা চাটগেয়ে লস্করদের ভাষা কিনা জানা দরকার। তা যদি হয়, তুমি বলতে পারো, যারা কালাপানি নিয়ে হিন্দু সমাজকে ঠাট্টা করেছে তারা যে চাটগেঁয়ে শিককাবাবের দোকানে কথাটা শিখেছিলো তা ধরে নেওয়া যায়। সেকালের কলকাতায় চাটগেঁয়ে রুটি ও চিংড়ি ভাজার দোকান ছিলো বোধহয়।

নৃপ কিছুসময় লঘু সুরে বলা সান্যালমশাইয়ের কথা কয়েকটিকে অনুভব করার চেষ্টা করলো।

কিন্তু একসময়ে আবার নিজের হাতের পত্রিকাখানি বন্ধ করে বললো, একটা ব্যাপার কিন্তু সামঞ্জস্যহীন। তুমি নতুন করে ঘরবাড়ি তুলছো গ্রামে আর রূপুকে পাঠাচ্ছে বিদেশে। সে কি ফিরে এসে এই গ্রামেই থাকবে?

কেন থাকবে না? গ্রামে থাকা না-থাকার সঙ্গে য়ুরোপ যাওয়ার কিছু যোগ আছে? এ কথা তুমি নিশ্চয়ই স্বীকার করবে চাটগাঁয়ের লস্কর যারা বছরে দুবার বিলেতে যায় তারা ছুটি পেলেই গ্রামে ফিরে আসে। অথচ রায়রা এ গ্রাম ছেড়ে গেলো য়ুরোপ না গিয়েই।

তার কারণ, তোমার সঙ্গে পাঞ্জায় পারলো না।

তাও হতে পারে। কিংবা গ্রামমুখো হওয়াটাই একটা আলাদা মানসিক গঠন।

কিন্তু রূপু যে অতবড়ো ডাক্তার হয়ে আসবে সে কি গ্রামে বসে থাকার জন্যে?

তুমি ঠকে যাচ্ছে। আমি খুশি হয়েছি রূপুকে তুমি গ্রামোদ্যোগ করতে বলোনি বলে। কিন্তু তুমি কি বড়ো সুদের কথা ভাবছো না?

নৃপ হাসিমুখে বললো, কেন, কেন?

শিক্ষার খরচটা বৃথা না যায় সেই মতলবই তুমি আঁটছো। চিন্তার কথাই হতো যদি নির্জনতার কোনো মূল্য না থাকতো। ভাবো না হয় সেই ঠাকুর জমিদারের কথা, তোমাদের মা যাঁর কথা বলে থাকেন।

আপাতত এর কোনো উত্তর নেই। শান্তিনিকেতন কি খুব প্রভাবিত করেছে রূপুকে? তবে এ কথা বলা যায় রূপুর হাতে তোমার জমিদারির শ্রীবৃদ্ধি হবে না।

পুত্রকে না দিয়ে পৌত্রদের হাতে ওটাকে তুলে দেওয়ার নজির আছে। বলে সান্যালমশাই হাসতে লাগলেন।

কিন্তু রূপুর বিলেত যাওয়ার ব্যাপারে ডাক্তারি পড়া যে মুখ্য নয় তা যেন সান্যালমশাইয়ের মনোভঙ্গি থেকেই স্পষ্ট।

.

নৃপনারায়ণ গ্রামে আসবার তিন-চার সপ্তাহ পরে কথাটা উঠলোসে বিলমহলে যাবে। অলিন্দে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করা যায় দু-একজন বরকন্দাজ তাদের পিতল বাঁধানো লাঠি আমরুলের পাতা দিয়ে ঘষে ঘষে ঝকঝকে করছে। বিলমহল থেকে কয়েকজন জেলে এসেছে। তাদের ফরমায়েস মতো নৌকোর দাঁড় ইত্যাদি তৈরি হচ্ছে। বাড়ির ভিতরে তারণের মা-ই তোলা-উনুন তৈরিতে সব চাইতে পারদর্শী, সেনানা গড়নের কয়েকটা উনুন তৈরি করে রোদে দিয়েছে, এবং সেগুলির খবরদারি করছে। রান্নার মহলে মুগ শুকিয়ে ডাল তৈরির ব্যবস্থা হচ্ছে। চেঁকিশালে নৈমিত্তিক কাজ ছাড়াও কাজ হচ্ছে, বিল মহলের জন্য দুরকম চালই লাগবে। রান্নার মশলা যেখানে ভাজা হচ্ছে সেখানে দাঁড়ানো যায় না। তীব্র সুগন্ধে নাক জ্বলে ওঠে, চোখে জল আসে।

অনসূয়ার মনে পড়লো তার প্রথম যৌবনের কথা। তখনকার দিনে সান্যালমশাই প্রায়ই বিলমহলে যেতেন। যাবার দিন ছলছল চোখে বিদায় দেওয়াই নয় শুধু, তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত দীর্ঘ দুঃখের রাত্রি অতিবাহিত করা, ঝড়ের রাত্রিতে জানলার গোড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে ভাগ্যবিধাতার কাছে আকুল প্রার্থনা করা বহুকাল তাকে স্বাভাবিক জীবনের উপাদান হিসাবে এগুলিকে গ্রহণ করতে হয়েছিলো।কাজেইনৃপ বিলমহলে যাবে শুনে তিনি ততটা বিস্মিত হলেন না। কিন্তু সেখানকার কাছারি বাংলা কী অবস্থায় আছে, বজরা বা বোটে রাত কাটাতে হবে কিনা, তাহলে বোটের অবস্থা কীরকম আছে, এসব প্রশ্ন তুললেন। তিনি জানতে পারলেন সান্যালমশাইয়ের সেই বজরাটা এখন আর নেই। নায়েবের জন্য যেটি কয়েক বছর আগে তৈরি হয়েছে সেটা আছে। সেটাও খুব ছোটো নয়–চার কামরার।

কিন্তু অনসূয়া জানতে পারলেন জমিদারির কাজে নৃপরায়ণ বিলে যাচ্ছে না, প্রমোদ-ভ্রমণই উদ্দেশ্য এবং তার অংশ হিসাবে শিকারের ব্যবস্থাও হচ্ছে। সদানন্দ সঙ্গে যাচ্ছে না; দু-তিনজন কর্মচারী যাচ্ছে যাদের বন্দুকের লাইসেন্স আছেনৃপনারায়ণের যা নেই।

তিনি সান্যালমশাইকে বললেন, সেখানে কি শিকারের ব্যবস্থা হচ্ছে?

ব্যবস্থা এমন কিছু নয়। সেখান থেকে যারা এসেছিলো তারা বলছিলো বটে বিলে শিকারের মতো পাখি প্রায়ই থাকে, আর তাছাড়াও বিলের জঙ্গলে কয়েকটি বাঘ উৎপাত শুরু করেছে।

আবার যখন অনসূয়া কথা বললেন তিনি মন্তব্য করলেন, শিকারের উদ্যোগ হচ্ছে এ আমি জানতাম না।

তার মনটা ভার হয়ে গেলো। জীবনের একটা ভঙ্গি আছে যার সঙ্গে বিলে-জঙ্গলে পাখি শিকার করে বেড়ানো খাপ খায় না। যেমন খাপ খায় না নাচওয়ালীর নাচ, কিংবা মদের নেশা। অনসূয়ার মনে পড়লো, সেই অনেক আগে একবার মন্মথ রায়ের শিকার ব্যবস্থার মাঝখানে চিঠি লিখে শিকার বন্ধ করতে পেরেছিলেন। দেখা যাচ্ছে চিরকালের জন্য তা বন্ধ হয়নি।

সেই অনেকদিন আগে স্বামীকে যে যুক্তিগুলি দিয়েছিলেন, সেগুলোও মনে ফিরে এলো। তিনি বললেন, শিকার, মদ,নাচওয়ালী এসব সামন্তপ্রথার রোগ, আমি এমন মনে করি না। রোগও নয়, বৈশিষ্ট্যও নয়। শহরের ব্যারিস্টার পাড়ায়, দোকানদারদের মধ্যে, অধ্যাপক, ডাক্তার, হকার, গ্রামের ডোমপাড়ায় মদের কিছু ঘাটতি নেই। তাদের মধ্যেও খেলার ছলে প্রাণীহত্যা পাবে। সিনেমায় যদি, ক্যাবারেতে যদি নাচওয়ালী, নিজের বৈঠকখানায় তুলে আনলেই তারা সামন্তদের বৈশিষ্ট্য হয় না, যে তাকে ধরে রাখতে হবে।

পুরনো অনুভূতির স্মৃতিতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে অনসূয়া যেন কাউকে লক্ষ্য করে বললেন, আসলে, ভেবে দেখো, খদ্দরপরাপর সঙ্গে শিকার করা কি মানায়? খদ্দরটা কি জীবনের একটা ভঙ্গি নয়? ইমেজটাকে এভাবে নষ্ট করে দেবে?

কিন্তু কথাগুলো মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠতে না-উঠতে কে যেন সেখানে বলে উঠলো, তা কেন, তা কেন; আর তাহলেও দোষ দিতে পারি না, একজনের প্রভাব তো সেই সেবার সান্যালমশাইও স্বীকার করে নিয়েছিলেন, নৃপর এই পরিবর্তনেও যদি অন্য কারো প্রভাব?

সান্যালমশাই বললেন, কথা কইছো না।

অনসূয়া যেন ভয় পেলেন। কেউ যেন বললো, সেদিন এখানেই, অনসূয়া, সুমিতির জন্য পৃথক বাড়ি করার কথা বলে ফেলে, নিজেকে ভয় করছে।

অনসূয়া বললেন, তুমি পড়ো না হয় এখন।

তিনি উঠে গেলেন।

রূপু এসে বললো, মা, দাদার সঙ্গে আমি যাবো?

তুমি কোথায় যাবে? এই তো কয়েকদিন পরে কতদিনের জন্যে তুমি চলে যাচ্ছো। এখন কি আর তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি?

রূপু হাসিমুখে চলে গেলো।

কিন্তু নৃপনারায়ণের বিলমহলে যাওয়ার ঠিক আগের সন্ধ্যায় সুমিতি এসে দাঁড়ালো কাছে। আজকাল কাজের ভার কিছু কমে গেছে অনসূয়ার। এটাও দাঙ্গার সময় থেকে শুরু। কতকটা যেন সুমিতিকে অন্যমনস্ক রাখবার জন্যেই সাংসারিক হিসাবপত্র রাখবার দায়িত্বটা সুমিতির হাতে তুলে দিয়েছেন তিনি। প্রচুর রঙিন উল এনে একটা গালিচা বুনতে শুরু করেছেন অনসূয়া সেই অবসরে।

কিছু বলবে তুমি, সুমিতি?

কাল একটু বিল দেখতে যাবো কিছুটা বা সলজ্জ ভঙ্গিতে বললো সুমিতি।

বিল দেখতে মানে, খোকার সঙ্গে? বিল তুমি দ্যাখোনি, দেখতে ইচ্ছে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তোমার ছেলের অসুবিধা হবে না তো?

ধাত্রী বলছিলো তা হবে না। আর তাছাড়া আপনিই তো রইলেন।

অনসূয়া একটু হেসে বললেন, আমার এ সংসারে অনেকদিন হলো, সুমিতি; আমি কিন্তু এ পর্যন্ত বিল দেখিনি। যাও।

অনসূয়া সান্যালমশাইকে পেলেন লাইব্রেরিতে। হেঁট হয়ে নিচের দিকের তাকে একখানি বই খুঁজছিলেন তিনি।

অনসূয়া বললেন, গল্প করতে এলাম।

চলো তাহলে। আমিও বেঁচে গেলাম। সদানন্দর জ্বালায় ‘থরো’র লেখা বই আর খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই।

অনসূয়া বললেন গল্পের ঝেকে, কোন থরো? সেই যে যিনি উত্তরাধিকারের অর্থবিত্ত প্রতিষ্ঠাকে কুকুরের লেজে বাঁধা টিন বলেছেন।

কতকটা বটে।

পুঁথিঘরের একটি কোণে মুখোমুখি দুখানা চেয়ারে বসলেন দুজনে।

সুমিতিও যাচ্ছে।

এ খবর তো জানতাম না। ভালোই হবে। বাইরের পৃথিবীতে গিয়ে ওরা পরস্পরকে আরও ভালো করে চেনে এটা বোধহয় লাভজনক হবে।

নৃপর ছেলের কথা ভেবেছো?

ধাত্রী রয়েছে তো। তোমার উপরে নির্ভর করে এ বাড়ির এতগুলো লোকের যদি চলে, তবে ফিডিং বটু করে একটু দুধই যার একমাত্র দাবি তার কেন চলবে না?

অনসূয়া উঠে নিজের ঘরে গেলেন। কুলুঙ্গিতে শিবমূর্তির সম্মুখে ঘৃতের প্রদীপটি জ্বলছে। সমস্ত বাড়িটার বাসকক্ষগুলোয় যে কয়েকটি প্রদীপ আগে সন্ধ্যায় জ্বলে উঠতো তার মধ্যে এই একটি অবশিষ্ট আছে বলেই যেন এটি আজকাল অনেকক্ষণ জ্বলে। সেখানে গিয়ে কিছুটা সময় তিনি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তাঁর মনে হলো দাঙ্গার সময়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে এই জায়গাটাতেই প্রার্থনা করে তার দিন কেটেছে। একটু লজ্জিত হলেন এইজন্য যে, প্রয়োজন ফুরিয়ে যেতেই প্রার্থনার সময় কমে গেছে, ঐকান্তিকতা ফিকে হয়ে এসেছে। অনসূয়া একটা ছোটো ধূপদানে কিছু কালাগুরু জ্বালিয়ে দিলেন। সেই দাঙ্গার সময়ে তার বাল্যের প্রার্থনাগুলোই যেন বেশি মনে পড়তো। বাবার পাশে বসে অতিশৈশবে যে-প্রার্থনা তিনি করতেন সেগুলো যেন মনকে আশ্বাসে এবং শৈশব নির্ভীকতায় পূর্ণ করেও দিতো। তারই একটা প্রার্থনাকে মনে মনে বেছে নিয়ে তিনি ‘পিতা নোহসি’ বলে শুরু করলেন। কিন্তু অনেকটা সময় চেয়ে থেকেও তন্ময়তা কিছু এলো না। অকস্মাৎ চোখের জলের কাছাকাছি গিয়ে তিনি বিড়বিড় করে বললেন, আমার হৃদয় পুত্রহীন কোরো না, পুত্রহীন কোরো না।

খবরটা পেয়েও মনসা যথাসময়ে আসতে পারেনি। সে ভাবলো অনসূয়া শাশুড়িকে লেখেননি, কাজেই যাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্য অন্য প্রতিবন্ধকও আছে। নুলো বিপিন যে দামী দামী বাজি পটকাগুলো তৈরি করেছিলো সেগুলোর একটা ব্যবস্থা না করলে যাওয়া যায় না। নুলো বিপিনকে বলতেই সে বললো, হাতের কাছে পদ্মা থাকতে চিন্তার কিছু কারণ নেই। কিন্তু প্রয়োজন কি ফুরিয়েছে? বিপিনের কথায় মনসার অস্বস্তি বাড়লো। খবরের কাগজের ভাষায়, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। যা ঘটবে তা কি দাঙ্গার চাইতে ভয়ঙ্কর হতে পারে? তখন কেউ কেউ দাঙ্গাকে মানি না বলেছিলো, এখন? শাশুড়িকে বলতেই তিনি বললেন, সে কী, বউমা, আমি কি কোনোদিন নিষেধ করেছি? তখন মনসা বাধাটার স্বরূপ দেখতে পেলো।শাশুড়ি নিষেধ করবেন না, পদ্মায় পটকাগুলো ডুবিয়ে দেওয়া যায়, এ দুটোর একটিও তার নিজের অজ্ঞাত নয়। মনসার মনে পড়লো, সুমিতিকে নৃপনারায়ণ সম্বন্ধে তার নিজের হৃদয়ের এমন কিছু সে বলে এসেছে যেটা একটা কুণ্ঠার মতো মনে জাগছে। রসিকতার ‘হ’লেও যদি সুমিতি নৃপনারায়ণকে সে সব কথা বলে থাকে তবে অনেক দিক দিয়েই মনসার পক্ষে নৃপনারায়ণের সম্মুখে মুখ দেখানোকঠিন হবে।কী যেন একটা যুক্তি ছিলো কথাগুলো বলার, সেটা মনে করার চেষ্টা করলো মনসা। দু-একদিন সাত-পাঁচ ভেবে এক দুপুরে মনসা শাশুড়িকে বললো, আমি একটু দাদাকে দেখে আসি।

যাও, কিন্তু বেশি দেরি কোরো না, বউমা।

মনসা সান্যালবাড়িতে পৌঁছে দেখলো নৃপনারায়ণ এবং সুমিতি বিলে গেছে। সে শুনলো রূপু বিলেতে যাচ্ছে। ধাত্রীর ঘরে সুমিতির ছেলেকে সে আবিষ্কার করলো। তখন নিজের ছেলে এবং সমিতির ছেলে নিয়ে সে সমস্ত বাড়িটা পরিপূর্ণ করে তুলো। তাদের স্নান করানো খাওয়ানো নিয়ে একদিন ধাত্রীকে ধমকেও দিলো–তুমি পাস করা লোক বাপু, কিন্তু ছেলে হওয়াটা দেখে শেখা যায় না। কিন্তু পাছে ধাত্রী কষ্ট পেয়ে থাকে এই মনে করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ছুতো করে একটা দামী শাড়ি তাকে উপহার দিয়ে বললো। রান্নার মহলে পা ছড়িয়ে বসে গল্প করতে করতে নৃপনারায়ণ ও সমিতির সম্বন্ধে সে খবর সংগ্রহ করলো। একটি অল্পবয়সী পরিচারিকা যখন প্রকারান্তরে বললো তাদের শোবার ঘর আলাদা তখন মনসা গালে হাত দিয়ে বললো, ও মা,বলিস কী!বউদি বুঝি অনেক রাত পর্যন্ত মোটা মোটা বই পড়ে? কিন্তু জেঠিমার সামনে মুখেও আনিস নে।

কিন্তু অনসূয়ার কাছে বসে তার চুল বাঁধবার চেষ্টা করলো না সে কৌশল করে। বরং গম্ভীর সুরে বললো, তোমার কোনো অসুখ করেছে, জেঠিমা?

না।

করেছে বৈকি, নতুবা এমন রুক্ষ দেখাত না। কী হয়েছে বলল, নতুবা মাস্টারমশাইকে বলবো সদর থেকে ডাক্তার আনতে।

অনসূয়া হাসলেন, দোহাই মা-মনসা, তুমি থামো।

মনসা থামলো বটে কথাটাকে ঘুরিয়ে নেওয়ার জন্যই। সে বললো, জেঠিমা, যে-অনুমতি দিতে এত কষ্ট, না-ই বা দিতে।

মেয়েদের কষ্টই সইতে হয়।

তা যদি বলল, তাহলে বলবো হয়তো তুমি ভালোই করেছে।

এ কথা বললি যে?

আজ নয়। পরে জানাবো তোমার এ কষ্ট স্বীকারে লাভ হয়েছে কিনা।

.

বিলমহলে যেতে তখনও দিন সাতেক দেরি। বিলমহলের তহশীলদার এসেছিল খবর পেয়ে। সে বজরা ইত্যাদি, বাংলো ইত্যাদিকে সাজিয়ে নিতে দিন সাতেক আরও সময় নিয়েছে।

তখন একদিন সুমিতিকে অবাক হতে হলো নূপনারায়ণ এরই মধ্যে একদিন বলেছিলো বটে, তার খদ্দরের ঝোলাটাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কথাটা যে সত্যি তা যেন প্রমাণ করতে হলো। খদ্দরের বদলে গরদ উঠলো গায়ে, সদর থেকে ফরাসডাঙার ধুতি এসে গেলো। পিতামহীর কাছে পাওয়া সেই মণিটা আংটি হয়ে আঙুলে উঠলো। এ নৃপনারায়ণ যেন অনির্বচনীয়। কিন্তু কী ঘটেছে, অবাক হয়ে যাচ্ছে সুমিতি, যার ফলে যন্ত্রণা, সুখ, অপমান আর তেজের সেই যোদ্ধার বেশ ত্যাগ করতে হলো?

সেদিন রাতে মশারির ভিতর থেকে খাট থেকে নেমে এলোপ। শোবার ঘরের সরু সোফায় বসে টেবল ল্যাম্পের ছোট সাদা বৃত্তটার মধ্যে বইসমেত দু হাত রেখে সুমিতি পড়ছে। ঘরের নীলাভ আলোর বড় বৃত্তটা ছোট সাদা বৃত্তটাকে তার কোলের উপরে কাটছে।

নৃপনারায়ণ বললো, কী পড়ছে? সুমিতি বই ধরা হাত দুটোকে একটু কাত করলে, মলাট দেখতে পেয়ে নৃপ আবার বললো, ওয়ালডেন, সেই বুড়ো থরো?

সুমিতি হেসে বললো (সে তো না হেসে কোনো কথাই বলে না), ওয়ালডেন, লিখবার সময়ে থরো কি খুব বুড়ো হয়েছিলেন? জানি না।

নৃপ খানিকটা দ্বিধা করলো, বললো পরে, বোধহয় বিশ্বাস হারানোর কথা। আচ্ছা তোমার কি মনে হয় না, আমরা যাকে প্রাণ মনে করতাম, নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে মেনে নিয়েছি, অন্য পথে গিয়েও যাঁর দিকে চেয়ে থাকতাম,ইদানীংতাকে কেউ কেউ অচল সিকি বলতে আরম্ভ করেছে? সেই শুভ্রতা, সেই সবুজ, সেই উদার নীল যেন কোথাও হারিয়েছে।

এ কথা কি বিশ্বাস করবো যে তার প্রভাব ইতিমধ্যে কমে যাচ্ছে?

নৃপ একটু ভেবে বললো, যেন নেতাদের উপরে বেশি তা! আর তিনি নিজেও অনুভব করছেন, আমাদের চিন্তায় অস্বচ্ছতা ছিলো। এ কথা অস্বীকার করা যায় না, আমাদের অহিংসা ভীরু ও দুর্বলের ছিলো। সে অহিংসা না বুদ্ধিদীপ্ত না শক্তিমানের। নতুবা এতবড় দাঙ্গায় সত্য ও অহিংসাকে আশ্রয় করে আর কাউকে দাঁড়াতে দেখা গেলো না, সুমিতি?

সুমিতি বললো, পরিস্থিতিটা জটিল সন্দেহ নেই। তুমিও কি বিশ্বাস হারিয়েছে? সুমিতি বেশ ভঙ্গিভরে হাসলো। হতে পারে খদ্দর ছেড়েছে আজ। অস্বীকার করছি না আমার ধোঁকা লাগছিলো। ওদিকে স্বীকার করছি, আমারই লাভ, নতুন পোশাকে আরও ভালো লেগেছে যেন, কিন্তু এবার কী বলবে বলো। এইরকম অনুভব করতে করতে সুমিতি হাতের মোড়া বইটাকে টিপয়ে টেবল ল্যাম্পের গোড়ায় রাখলো। নৃপর দিকে তার বড় বড় চোখ মেলে দিলো।

নৃপবললো, অস্বীকার করে লাভ নেই। হিংসার্জিত স্বাধীনতার চাইতে অহিংসালব্ধ স্বাধীনতা বেশী ভালো এরকম মানতে দ্বিধা আসছে যেন। খদ্দরকে স্বাবলম্বন আর মিতাচার মনে করতে সন্দেহ আসছে। হয়তো বিদেশী বণিককে আঘাত দেওয়ার কৌশল। জানো, নৌধর্মঘটটা যখন মিটবার পথে, যখন ধর্মঘটীদের মনে কিছুটা কমেছে টেনশান, তাদের কেউ কেউ হেরে যাওয়া মানুষের ক্লান্তিতে হাসছিলো। বলেছিলো, অহিংসা, খদ্দর ও সত্য ছাড়াও তো দেশের অনেকটা জায়গার স্বাধীনতা আসছে, দেশের বাকি অংশে যদি অহিংসায় স্বাধীনতা আসেই।

সুমিতি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, পাওয়ার চেষ্টাটা কীভাবে হলো, তা কি কী পেতে চাই তার সমান মূল্যের নয়?

নৃপ উত্তর দিতে পারলো না সঙ্গে সঙ্গে। কিছুক্ষণ পরে বললো, তুমি কি আর একটু পড়বে? আমি বরং ছাদ থেকে একটু ঘুরে আসি। কত আর হয়েছে রাত!

নৃপ চলে গেলে দরজার বাইরের অন্ধকার দেখে সুমিতি ভাবলো : এটাকে কি খদ্দরকৃচ্ছতার প্রতিক্রিয়ামাত্র ভাবা যাবে না, এই গরদে ফিরে আসা?

কিন্তু এর চাইতেও বড়ো সমস্যা ছিলো সুমিতির। অথবা চিন্তার তুলনায় অনুভূতি গভীরতর বলে এরকম মনে হলো।

নৃপ ফিরে আসার দিনের সন্ধ্যায় সে তার শোবার ঘরের সাজসজ্জার অদলবদল দেখতে পেয়েছিলো। ধাত্রীর ঘরে তার শিশুর খাট সরেছে। তার নিজের পালঙ্কটি সরেছে তার শোওয়ার ঘরের অ্যান্টিচেম্বারে। শোওয়ার ঘরের নতুন চওড়া পালঙ্কে বিছানা পেতে রাখছে দাসী।

সারাদিনই সুমিতির মনের কোথাও নতুন ধরনের শাড়ি পরার, নতুন করে চুল বাঁধবার ইচ্ছা ছিলো। বিশ্রামের সময় হয়ে এলে, সে দাসীদের তৈরি বেণী বাঁধা খোঁপা খুলে চুলগুলিকে মস্ত একটা এলো খোঁপায় জড়িয়ে নিয়েছিলো। শাড়ি পাল্টেছিলো। গলার হারটাকে বদলে নিয়েছিলো। সারাদিনে দু-তিনবার দেখা হয়েছে নৃপর সঙ্গে, কথাও হয়েছে, কিন্তু অন্য অনেক কথা যেন বলা হয়নি। মাঝখানের বিচ্ছেদের দিনগুলি যেন একটা সুদীর্ঘ দ্বিপ্রহর ধন দেখা হয় না। একত্র অতিবাহিত শেষ রাত্রিটির সঙ্গে বর্তমানের সেই রাত্রিটি যেন একই লগ্নের দুটি পর্যায়। কথা বলার অপরিসীম সুখে কথা কবিতা হয়ে ওঠে, কথার চাইতেও অপরিসীম সুখ স্পর্শে। আর কপালে, কপোলে, গলায়, বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হৃৎপিণ্ডে এই এক কবিতা অনুভবকরা,দীঘল, মেদহীন, কিছু বা শ্রান্ত শরীরটা একটা শুভ্র আদর্শ, যা তার পাশের বালিশে। যা তার নিজের।

কিন্তু দশদিনের মধ্যেই এমন রাত্রিও এলো, যে যখন বিশ্রামের সময় হলো, নৃপ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো, আসবো?

এসো।

নৃপহাতে একখানা বই নিয়ে ঢুকেছিলো। বললো, উপন্যাস যে এমন জিনিস তা মনেই ছিলো, সুমিতি। অনায়াসে তুমি নিজের মনের বাইরে যেতে পারো।

নৃপ বই খুলে বললো। সুমিতি আলোর স্ট্যান্ডটা ভাঁজ করে তার বইয়ের দিকে এগিয়ে দিলো, আর দেয়ালের আলোটা যেখানে হালকা নীল হয়ে পড়েছে সেখানে বসে উল বুনতে লাগলো।

সুমিতি সহজে মুখ তুলতে পারলো না; একবার বললো, তুমি পান খাও? পান রেখে গিয়েছে।

না।

সুমিতি মশলা এনে নৃপর হাতে দিয়ে আবার উল নিয়েই বসলো।

নৃপ উপন্যাসের নতুন পরিচ্ছেদের জন্য পাতা উল্টে নিলো। অবশেষে নৃপ বললো, ঘুম পাচ্ছে, সুমিতি।

নৃপ শুতে গেলে, সুমিতি তার মশারি ফেলে দিলো, কোন জানালাটা খোলা থাকা পছন্দ করবেনৃপ তা জেনে নিয়ে অন্য জানালাগুলো বন্ধ করে দিলো। তারপর খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে একসময়ে বললো, ছেলেকে দেখে আসি।

যাও।

সে রাতে আহ্বান ছাড়াই ফিরে এসেছিলো সুমিতি। দেখেছিলো, চিন্তা করার সময়ে গালে হাত রাখা যেমন স্বাভাবিক, ঘুমের মধ্যেও নৃপর একটা হাত তেমন রয়েছে।

কিন্তু রোজ এমন হয় না। সংযুক্ত শয্যা বিবাহিত স্ত্রী-পুরুষের পক্ষে স্বাভাবিক, কেউ বলেন কর্তব্য। সুমিতি নিজেকে কর্তব্য পালনে বাধ্য করলো বটে, কিন্তু অনেক রাত্রিতে শোবার ঘরের অ্যান্টি-চেম্বারে কতকটা পালানোর ভঙ্গিতে রাত কাটিয়েছে সে একাধিকবার–এ অবস্থায় দাসী তাকে আবিষ্কারও করেছে।

এই অবস্থায় নিজের প্রেমকে বিশ্লেষণ করে দেখলো সে একদিন। তা অবশ্য পরীক্ষার উত্তর লেখার মতো ঠাণ্ডাভাবে হয় না। অনুভূতি ঠিকঠাক মনে পড়লে সে রাঙা হয়েও উঠতে থাকলো।

বিশ বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত ভালোবাসার কথা তার আদৌমনেহয়নি। তখন পরীক্ষায় ভালো ফল করা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে ইচ্ছা ছিলো না। আই.সি.এস. অথবা ব্যারিস্টার হওয়ার কথা ভাবতে ভালো লাগতো। সমান বংশের সহপাঠিনীরা বিয়ের কথা, প্রেমের কথা বলতো। সমান বংশের কিছু পরিচিত কোন ছাত্রটি আই. সি. এস. বা আই. পি. এস. বা ব্যারিস্টার হয়ে নিশ্চয়ই আসবে উপযুক্ত প্রেমপাত্র হয়ে, এরকম তারা আলোচনা করতো। সুমিতির কাছে নিছক নিষিদ্ধ আলাপের সাহস দেখানোর বেশি কিছুমনে হয়নি সেসব কথা। যখন গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করতে সে আলাপ, তখন তা সুমিতির কাছে হাস্যকর মনে হতো; কারণ তাদের কথায় সেসব যুবক রবীন্দ্রনাথের তৈরি অমিত রায়ের নামের পরিহাস হতো।

তাদের অনেকেই মাঝে মাঝে খদ্দর পরতো। দেশবন্ধু এবং জে. এম. সেনগুপ্তর পরে তখন খবরের কাগজে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খদ্দর-পরা মানুষদের সংবাদ না-পড়াটাকে অন্যায় মনে হতো, সাহেবদের দিকে ঝোঁকটা নিশ্চয়ই আর আধুনিকতা ছিলো না। স্যার উপাধি পাওয়া তখনও ব্যবসায় সাফল্যের নিরিখ হলেও, তখন আর তা স্বপ্নে দেখা আদর্শ ছিলো না। সহপাঠিনীদের মধ্যে খদ্দর পরে, শোভাযাত্রায় যোগ দিয়ে, সারা দিনের রোদে ক্লান্ত হয়ে ধুলো মেখে বাড়ি ফেরা দুর্লভ উদাহরণ ছিলোনা। জানলা-দরজার পর্দা, বিছানার চাদর ইত্যাদি, ডিনার টেবিলের ঢাকনা ক্রমশ খদ্দরের হয়ে উঠছিলো। এতে অনেকক্ষেত্রে ফ্যাসানমাত্র ছিলো, অনেকক্ষেত্রে আন্তরিকতা ছিলো। কিন্তু লাঞ্চ, ব্রেকফাস্ট, ডিনার ছিলো বহাল। সে সব টেবিলের খদ্দরের ঢাকনার উপরে পাত্রগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে শান্তিনিকেতনের সিরামিক হয়ে উঠলেও টেবল সাজানোটা বিলেতি কায়দার ছিলো। বাইশ থেকে পঁচিশ তো তার থিসিস করতেই কেটে গেলো। তার পক্ষে তখন বিয়েটিয়ের কথা যেমন, তেমন রাজনৈতিক শোভাযাত্রায় যোগ দেবারও সময় ছিলো কি? অন্যদিকে তার থিসিসের বিষয়টাই যেন গ্রামের অর্থনীতির দিকে তাকে টানছিলো, তেমন বিয়ের কথা উঠলে সে সংকীর্ণ হতো, পুরুষ জাতটাকেই এড়িয়ে চলার বিষয় মনে হতো।কথাটা হয়তো ভালো নয়, তেমন স্পষ্ট করে বলাও নয়, কিন্তু তার মনে হতো যেন প্যারাসাইটের মতো যা তোমাকে নোংরা করে। তার মাসতুতো, খুড়তুতো দিদিরা বিয়ের পনরো বছরের মধ্যে গোলালো, মোটা পুতুল হয়ে গিয়েছে, যারা শুধুইংরেজী কায়দায়, হয়তো খদ্দরের, হয়তো শান্তিনিকেতনের চাদর বিছিয়ে, পার্টি দেয়। তাদের মধ্যে বংশপরম্পরায় এই কায়দাই। যদিও খুঁজলে দেখা যাবে, কায়দাটা নিম্নমধ্যবিত্ত ইউরেশিয়ান কোনো গভর্নেসের কাছে শেখা, যার পক্ষে সত্যিকারের ইংরেজি উচ্চমধ্যবিত্তের কায়দা শেখাও সম্ভব নয়। পুরুষরা যেন অপবিত্র, ক্ষুধার্ত কিছু–এরকম মনে হতে থাকলে, সুমিতির এরকম ভয়ও হয়েছিলো, সে কি যাকে ফ্রিজিড বলে তেমন কিছু? একসময় ভেবেছিলো সে হয়তো তাই, আর তার জন্য দায়ী হয়তো তার দিদি, সুকৃতির মৃত্যু। যদিও সেই মৃত্যুর সময়ে তার বয়স হয়তো চার, হয়তো পাঁচ, শোক মনে থাকার কথা নয়।

এইসময়ে থিসিস শেষ করে সে নিঃশাস নিচ্ছে যেন স্বাভাবিকভাবে, ঠিক তখনই শুভ্র খদ্দরে মণ্ডিত দীঘল চেহারার হিবিয়াস কর্পাসের মামলায় হাইকোর্টের রায়ে সেদিন সদ্য বেরিয়েছে এমন নৃপনারায়ণ এসেছিলো তাদের বৈঠকখানায়। কাকারই মক্কেল, কাকা পরিচয় দিয়েছিলেন আমাদের সুকৃতির বড় জায়ের ছেলে। সেদিনের সন্ধ্যাতেই একবার, পরে রাতে ঘুমোতে গিয়ে আবার মনে হয়েছিলো সুমিতির, পুরুষ কখনো কখনন, (দেখো কাণ্ড) খদ্দরের মতো শুভ্র আর পবিত্র হতে পারে!

আর কথার আলোয় ঝকঝকে চোখ নয়, বরং রাত্রির আকাশের মতোরব্ল্যাক আর ভাবনায় গভীর; এত লম্বা যে চিতার মতো রোগাটে মনে হয়, পাতলা ঠোঁট দুটোয় লিপস্টিকের ব্যবহার হয়েছে সন্দেহ হয়; তাড়াতাড়ি চোখ নামালে, মস্তবড়ো দুখানা ধুলোমাখা স্যান্ডেলের উপরে প্রায় লাল এমন মস্ত দুখানা পা।

না, সুমিতি ভাবলো, এরকম সে প্রায় তিনমাস পরে দেখেছিলো। আর তা তাদের কলেজে ছাত্র ধর্মঘটের পরের দিন বিকেলে। ছাত্রছাত্রীরা যখন পড়বেইনা, তখন অধ্যাপিকার বসে থেকে কী লাভ? সুমিতি ছাত্রছাত্রীর জটলার পাশ কাটিয়ে রাস্তায় পড়তে গিয়ে নৃপকে দেখেছিলো বক্তৃতা শেষ করতে। পরদিন বিকেলে নৃপ এসে বলেছিলো, আমাকে ডেকেছেন? সুমিতি যেন লজ্জায় মরে যাচ্ছিলো তা শুনে। তাহলে সে কি মনে মনে শুনছেন’বলার সঙ্গে হাত তুলে কিংবা চোখের ইশারা করেছিলো! যা, এমন নিলাজ সে কী করে হয়!

একদিন নৃপ বলেছিলো, আমাদের দেশ আর সমাজ নিঃশব্দে, সোরগোল না তুলে এত অজস্র আমাকে দিয়েছে, আমি তাদের জন্য তেমনইনীরবে একান্তে কিছু তৈরি করে যেতে চাই। আর এরকম ধরনের কথা যখন সে বলে, তখনই বোঝা যায়, তার গলার স্বর কেমন নিভাঁজ আর গভীর।

আর এমন সব তৈরির কথা, সৃষ্টির কথাই তো জীবনে যা কিছু সুস্বাদ তা এনে দেয়। ভালোবাসা আর সৃষ্টি, একটা গৃহ, একটা গ্রাম, আর সেখানে কিছু সৃষ্টি করার সুযোগ, গড়ে তোলার সুযোগ।

সুমিতি মাস তিন-চারের মধ্যেই বলেছিলো, আপনাদের গ্রামে, আপনাদের বাড়িতে যেতে ইচ্ছে হয় মাঝে মাঝে।

নৃপ, বোধহয়, বলেছিলো, এখন কি গ্রামে যেতে সুবিধা পাবো?মনে হচ্ছে কলকাতার বাইরে গেলে ওরা এখনও আমাকে বাইরে থাকতে দেবে না। আপনি যদি একা বেড়াতে যেতে চান…

এরকম কোনোসময়েই, বোধহয়, আমি প্রোপোজ করি…বলে সুমিতি মুখ লাল করে উঠে পালাচ্ছিলো।

নৃপ বলেছিলো, এ তো, আস্থা, সাগ্রহে। বলে সে হাত বাড়িয়ে সুমিতির হাতের পিঠে হাত রেখেছিলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলো, আমাকে ছেড়ে দেওয়ার অর্থ কিন্তু জজেরা সদয়, এমন নয়। হতে পারে, পুলিস জানতে চায় কার কার সঙ্গে সদ্ভাব, কার কার সঙ্গে ওঠাবসা করি।

কিন্তু এখন? শুধু খবরের কাগজের ঘটনাগুলোকে পড়তে থাকলে কি বোঝা যাবে কেন। এমন হচ্ছে? নৃপ যেন আহত কেউ, যখন ভালোবাসার কথা মনে আনাও হৃদয়হীনতা। ভাবো, তেমন পুরুষ যদি আহত হয় যুদ্ধে।

নৃপর বিলে যাওয়ার প্রস্তাব শুনে কয়েকদিন ধরে ভেবে সুমিতি স্থির করলো, তারও যাওয়া দরকার। হয়তো নৃপকে সেখানে পাওয়া যাবে নিভৃতে, সেখানে সে সুস্থ হয়ে উঠবে। হয়তো বা সেখানে তার কোনো নতুন রূপ ফুটে উঠবে। আর সেই নতুন নৃপকে নিয়ে আবার তেমনি দিশেহারা হতে পারবে সে। একথা বলতে লজ্জায় মাথা নুয়ে আসে, প্রেমকেও তার শিশুটির মতোই উচ্ছল আনন্দে বাড়তে দেখছে না। অথচ নৃপনারায়ণের জন্য প্রতীক্ষা করার সুখে সে ভাবতেই পারেনি, এই দীনতা আসতে পারে তার জীবনে। বইতে আশাভঙ্গ বলে যে কথা থাকে–একেই কি তা বলে?

নৃপনারায়ণ ও সুমিতি বিল থেকে ফিরলো সাতদিন পরে। মনসা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে এমনভাবে উলু দিয়ে উঠলো যে, অনসূয়াও না-হেসে পারলেন না।

জলে ও জঙ্গলে কাটিয়ে সাতদিনে স্বাস্থ্য ভালো হওয়ার কথা নয়। তাদের একটু শীর্ণ দেখালো বরং। পোশাক-পরিচ্ছদ কিছু মলিন। নৃপনারায়ণের কপালে একটুকরো অ্যাঢেসিব প্লাস্টার লাগানো।

সন্ধ্যায় মনসা বললো, দাদার লাভ তো ওইটুকু, তুমি কী এনেছে, বউদি?

সুমিতি উত্তর খুঁজতে লাগলো, তখন নৃপনারায়ণ বললো, হাতে-পায়ে দু-একটা আঁচড়ে যাওয়ার চিহ্ন নেই বললে ঠিক হবে না। স্থায়ী চিহ্নের মধ্যে বোধহয় কয়েকখানা ফালা ফালা করে ছেঁড়া শাড়ি থাকবে বাক্সে। সেগুলো বোধহয় জঙ্গলের কাঁটাগাছগুলোর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে মূল্যবান, মনসা।

কেন?

নতুবা আমি যখন বললাম তারই একটার আঁচল ছিঁড়ে কপালে বেঁধে দিতে, দিলো না তা। বরং দ্যাখো, বাতিল বস্তুর মতো এই ঢ্যাড়া চিহ্ন এঁকে দিলো প্লাস্টার দিয়ে।

যেন কিছুসুখী হয়েছে সে এমন ভঙ্গিতে উপভোগ করতে লাগলো সুমিতি এদের আলোচনা।

নৃপনারায়ণ বইয়ের খোঁজে পুঁথিঘরে গেলো।

মনসা বললো, বাপ রে বাপ। এমনি করে যদি সব সময়েই দুজনে একত্র থাকো আমি কথা কই কখন।

সুমিতি বললো, এখন বলো। তার আগে তুমি ধন্যবাদ গ্রহণ করো। কবে এসেছো?

তা হলো কিছুদিন। কিন্তু আমার কথা নয়, তোমার কথা বলো, যদিও তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। এসে যখন শুনলাম তোমরা বিলে গিয়েছে তখন কিছু করার না পেয়ে বঙ্কিমচন্দ্রকে মনে মনে সমালোচনা করলাম। শৈবলিনীকে চুরি না করলেও চলতো লরেন্স ফস্টরের। শৈবলিনীই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলো। বিল-জঙ্গল তোলপাড় করে দিচ্ছে, জলচর পাখির কোমল বুক ছিন্নভিন্ন করে রক্তাক্ত করে তুলছে বিলের জল, এমন একটি রূপবান কঠোর পুরুষকে কেউ কেউ ভালোবাসে। অতএব–

আমার সঙ্গে শৈবলিনীর মিল আছে কিনা বলা শক্ত, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, শৈবলিনীর ননদের নাম মনসা রাখলেই ভালো হতো। তুমি যখন উলু দিয়ে উঠলে তখন তোমাকে দেখে ভাবলাম, এই মেয়েটিই কি নুলো বিপিনকে দিয়ে বাজি পটকা তৈরি করিয়েছিলো।

খবরটা তোমার জানার কথা নয়।

কিন্তু এসব খবর রূপুর কাছে গোপন থাকে না। আমার পরে মনে হয়েছে, সেদিন যখন তুমি এসেছিলে তখন যেন তোমার পরনে রাজপুতানি ঘাগরা ছিলো, পাল্কিতে লুকোনো তরোয়ালও ছিলো।

মনসা হাসলো। সে বললো, এবার আমায় বল, বউ, দাদা কী ফুল ভালোবাসেন?

কেন?

আমরা গেঁয়ো মেয়ে, বাসর সাজাতে ভালোবাসি। অবশ্য আড়ি পেতে শোনার অভ্যেসও আছে।

তোমার দাদার পছন্দ তোমারই বেশি জানার কথা।

রসিকতাটা উপভোগ করলো মনসা; কিন্তু সে বললো, বউদি, বউভাতের দিন যে গহনাগুলো পরেছিলে সেগুলো বার করো, আমি তোমাকে সাজিয়ে দেবো। দাদার বেশভূষার পরিবর্তন হয়েছে, এখন তোমাকে দেশসেবিকাদের মতো নিরাভরণ দেখতে ভালো লাগছেনা।

সুমিতি মুখ নামালো। অনেকক্ষণ ধরে সে নিজের হাত দুখানার দিকে চেয়ে রইলো। মনসার মনে হলো তার চোখের পাতার দীর্ঘ পক্ষ্মগুলো তার গালের উপরে ছায়া ফেলে মুখটাকেই শ্যামলা করে দিচ্ছে। কথা বলা যাচ্ছে না, এ রকম অনুভব করলো মনসা। অবশেষে সুমিতি বললো, আর একদিন। আজ নয়। সেদিন তোমাকে সাজিয়ে দিতে বলবো।

.

মনসা সেই প্রাসাদে নানা দিক ঘুরে বাড়িভরা লোকজনের মধ্যে কথা বলার মানুষ পেলো না। শেষে সে অন্দর আর কাছারির সংযুক্ত সীমায় একতলার পশ্চিম অংশে সদানন্দর ছোটোমহলে উপস্থিত হলো। তখন বিকেলের আলো আরো আধঘণ্টা থাকবে। সে দেখলো পশ্চিমের জানলার আলোয় ছবি আঁকছে সদানন্দ। অথবা ঠিক আঁকা নয়। বাঁ হাতে তুলির গোছা, ডান হাতের তেলোয় তৈরি শঙ্খে ঠোঁট-চিবুক ডুবানো, ইজেলে লটকানো ছবির সামনে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ সে।

পায়ের শব্দে সদানন্দর স্বপ্ন ভাঙলো না। তখন মনসা এগিয়ে তার হাত দু-তিনের মধ্যে দাঁড়িয়ে বেশ স্পষ্ট করে বললো, এল গ্রেকো?

সদানন্দ চমকে ঘুরে দাঁড়ালো, মনসাকে দেখে হাসতে গিয়ে থেমে প্রশ্ন করলো, নকল বলছো?

তা কি করে হবে? তার সময়ে বউদি ছিলো না স্পেনে, যে নকল করবেন। কিন্তু মানুষটার তুলনায় লম্বা দেখাচ্ছে না?

সদানন্দ সুমিতির পোরট্রেটকে একবার খুঁটিয়ে দেখলো, বললো, বলছো? দীঘল হয়েছে? বল্লী ব্রততী মনে হয়? অর্কিডের মতো?

সদানন্দ তুলির গোছা পেলেটের পাশে রেখে বললো, হয়েছে তা হলে? থ্যাঙ্কু।বলল এবার। কবে এলে? বিপিনের তুবড়ি-ফটকা কি করলে?

বোধ হয় মায়া পড়েছে, নষ্ট করতে চাইছেন না। দাঙ্গার পরে ছ মাস যায়, আপনার স্কুল খুলতে পেরেছেন কিনা জিজ্ঞাসা করেছেন।

কোডে খবর নিচ্ছে দেখছি। বলে দিও এরপরে এখানে সরকারি স্কুল ছাড়া কারো স্কুল চলবে না। তোমাকে বলতে পারি, তা যদি বলল, সুমিতির স্কুলও হবে না।

সুমিতির স্কুলের কথা শুনে মনসা অবাক হলো। কিন্তু যা সুমিতি তাকে নিজে বলেনি তা এভাবে জানতে অনিচ্ছা হলো তার। সে বরং বয়োবৃদ্ধ বন্ধুস্থানীয় মাস্টারমশাইকে খোঁচাতে বললল, সে রকম স্কুল না হওয়ার নিশ্চয় কারণ আছে, যা এখন আপনার মাথায় আসছে না।

সদানন্দ বেশ অবাক হয়ে বললো, কে বলেছে মাথায় আসছে না? সরকারের রেশম বিদ্যালয়ে পাস করা শিক্ষকই উপযুক্ত বেতন দিয়ে আনা যায়। যারা রেশমের সুতো কাটে, তাঁত চালায় সেরকম কয়েকটি পরিবারকে এনে লাখেরাজে বসানো যায়। এসবই ভাবা হয়েছে। রেশম দামী বলে মিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে পারে, সুতোর খদ্দর যা পারে না। কিন্তু…

মনসা সুমিতির পরিকল্পনার আন্দাজ পেয়ে অবাক হচ্ছিলো, কিন্তু তা সদানন্দকে বুঝতে না দিয়ে রহস্য করে বললো, তাহলে বউদি পিছিয়ে যাচ্ছেন কেন? লোকে নিন্দা করবে ভয়ে?

নিন্দা? কৃষকদের তো লাভই হতো, বিশেষ কিষাণীদের।

যদি বলে সামন্ততান্ত্রিক ক্ষয়িষ্ণু লোভকে আড়াল করতে তা শুধু একরকম মুখোস পরা?

সদানন্দ হো-হো করে হেসে উঠলো। যা, এরকম আমি বলিনি কখনও। তা এরকম বলে বটে। আসলে, মাথায় না আসার কথা বলছিলে। তা হবে কেন?, দাদপুরী কৈবর্তদের দেখে শিখেছি। ওদের জমিটমি বাড়ানো, ঘরদোর তোলা, ছেলেমেয়ের বিয়ে এসব কল্পনা ছিলোই। পদ্মায় ভাঙতে ভাঙতে সেসব পরিকল্পনা আর নেই কারো। খোঁজ করে দেখো।

মনসা কিছুনা বলে ভাবতে থাকলে সদানন্দ আবার বললো, তুমি আজ খুবই অমনোযোগী। আচ্ছা, বেশ, শাহাজাদপুরের কথা মনে করো। এখন সেখানে অবশ্য ঠাকুরদের জমিজমা কোর্ট অব ওয়ার্ডসে। মনে করো সেখানে ছিলো শান্তিনিকেতন। কী হতো তার এখন? রসো, এঁকেনি আলো থাকতে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে সদানন্দ তুলির গোছা আর পেলেট সংগ্রহ করলো।

ধুতি-পাঞ্জাবির রূপকে অভ্যস্ত হতে হবে প্যান্ট-কোট-টাইয়ে। তার নিত্য ব্যবহারের জন্য সিল্কের স্যুটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার নালিশ, সেগুলো তাকে আড়ষ্ট করছে। নতুবা নতুন পোশাকে তাকে ভালোই দেখায়।

ওদিকে মন্মথ রায় তাগাদা দিয়েছে যাত্রার দিন স্থির করে। সান্যালমশাইকে লেখা চিঠি, কাজেই রসিকতার সঙ্গে মিশিয়ে লিখেছেন, রূপুকে যেন অবশ্যই আগে থেকে কলকাতায়। পাঠিয়ে দেওয়া হয় টেবল ম্যানার্স শিখবার জন্য।

অনসূয়ার বসার ঘরে তখন অনসূয়া চিঠিটা পড়ে নিয়ে রেডিও খুলেছিলেন। নৃপ আসতে রেডিও বন্ধ করে চিঠিটা তাকে এগিয়ে দিলেন।

নৃপ বললো, দেখো কাণ্ড! ছেলে বিদেশে যাবে বলে এমন দিনরাত রেডিও খুলে বসে থাকতে হয়?

রূপু অনসূয়ার পাশে বসেই স্কেচ করছিলো। খুব যথাযথ না হলেও ধরা যাচ্ছে তা ছেলে কোলে করে বসা সুমিতির। রূপু বললো, তাই বলছো? আমি ভাবছিলাম যে বুঝি মার বড়োছেলের সঙ্গীসাথীরা দিল্লি আর কলকাতায় কী হুইহাই হুটহাট করছে তার খবর নিতে।

নৃপ হো হো করে হাসলো, বললো, রূপু, সত্যি তুই তাহলে বড়ো হলি।

সে চিঠিটা পড়লো। সেটাকে অনসূয়াকে ফিরিয়ে দিলো। বললো, রায়মামা একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছে। তা মিথ্যে নয়তো, দু’দুটো নাবালক সঙ্গে নিয়ে চলা যে।

একটু হেসে আবার বললো, ওটাও এক ফ্যাসাদ, রায়মামার এক কাকিমা মেম বটে, আর রায়মামার এক ভাগ্নী অনেকদিন বিলেতে থেকে ফিরেছে। আমি শুনেছি সেই কাকীমা সে দেশে স্কুলে পড়াতেন, আর সেই ভাগ্নী লন্ডনের ইকোনমিকসের স্কুলে পড়েছে। কেমন টেবল ম্যানার্স যে রূপ শিখবে?

সুমিতির পাশে থেকে মনসা বললো, তাদের টেবল ম্যানার্স ভালো নয় বলছে!

দেখো, দেখো, নেহাৎ মধ্যবিত্তর চাইতে বেশি কিছু কি তা হতে পারে? কপট দুশ্চিন্তায় নৃপ বললো, কী যে হবে রূপুর।

রূপু বললো, দাদা, তুমি ভীষণ সামন্ততান্ত্রিক। আমাদের শিবনারায়ণ বড় হলে যে তুমি কী করবে?

নৃপ বললো, যতদূর মনে পড়ে সামন্ত কিছু মেদিনীপুরে থাকলেও থাকতে পারে। আমরা তো সান্যাল। আর তোমার শিবনারায়ণ কি ওইটি? তা, ওর জন্য যা ভাবনার ভার তা অনেকদিন থেকেই তোমাকে দেয়া হয়েছে। তুমি ভেবে দেখো, ওকে লখনৌতে রাখা যায় কিনা। আমার মনে হয়, দিল্লি বা মুর্শিদাবাদে কিছু এখন নেই আর টেবিল ম্যানার্স।

অনসূয়া বললেন, আমি কিন্তু একটা কথা খুব ভাবি। রূপুকে ওরা কালো বলে ঠাট্টা করবে না তো?

তা একটু করবে। সুমিতি বললো, আপনার ছেলে তো সত্যি দুধে-আলতা নয়।

না হয় রংটা চাপাই হলো, অনসূয়া বললেন, কিন্তু এমন দুটি চোখ, এমন নাক?

মনসা বললো, তুমি ওর হাসির কথাও বলতে পারো। বিলেতের কিশোরীরা হাসি শিখবার জন্য ওকে মাইনে দিয়ে রাখবে দেখো!

রূপু খিল খিল করে হেসে উঠলো।

সুমিতি বললো, নিজের ধনদৌলত দেখিয়ে বেড়ানো—

কিন্তু রূপু আরও জোরে হেসে উঠলো।

নৃপ বললো, জোরে হাসা নাকি ইংল্যান্ডে নিষেধ।

অনসূয়া এই সুখটুকুকে সঙ্গী করে সংসারের তদ্বির করতে গেলেন। সেদিনই সন্ধ্যার আগে লাইব্রেরি আর নৃপর ঘরের সামনে দূরে এক ব্যালকনিতে মনসা নৃপকে আটক করলো। বললো, কথা বলি দাঁড়া। দাদা, তোকে এ পোশাকে ভালো দেখায় না। তুই কি সিল্কের স্যুটও পরবি?

বাহ, খারাপ দেখাবে কেন? সিল্কে খারাপ দেখায়? তুই কড়িয়াল পরে আছিস না? বিয়ের সময়ে বেনারসী পরিসনি?

দেখ্‌, দাদা, ছোটবেলায় মিথ্যা বলার জন্য তোর কাছে বেশ মার খেয়েছি। আমি জানি মিথ্যার উপরে তোর রাগ দিশেহারা। সত্যি করে বল, তুই এমনকী বিয়ের দিনও সিল্ক পরেছিলি? তা আর হতে হয় না। বউদির নিজের তো খদ্দর। আর সে বলমাত্র তুই সিল্ক পরলি?

যা-যা, কি কথা!

বল্‌, খুব ভালোবাসিস বুঝি? সেজন্য এমন সেজে থাকিস? কিন্তু শোন্‌, এভাবে তোকে শুধু বড়লোকের ছেলে মনে হয়। সত্যি করে বল্, খবরের কাগজ পড়ে পড়ে তোর এই দশা? এত রাগ?

এর মধ্যে খবরের কাগজ কেন? কী থাকবে কাগজে? সিল্কের বিজ্ঞাপন? আজকাল কাদোয়ায় বুঝি খুব খবরের কাগজ পড়া হয়?

না হয় আমার ছোট্ট গ্রামে তোর গ্রামের তুলনায় কাগজ খুব কম যায়। তোর গ্রামেও জেঠামশাইয়ের গুলোকে বাদ দিলে কখানা শুনি? তুই আজকাল কথাও কম বুঝিস বুঝি?

নৃপ মনসার সঙ্গে সিল্কের আলোচনায় একরকম লজ্জা বোধ করছিলো। সে তাড়াতাড়ি গ্রামে আসা খবরের কাগজের সংখ্যাকে চেপে ধরলো। বললো, কাগজ না পড়া একদিক দিয়ে ভালো কিনা বল্? গ্রামে রেডিও নেই এটাও ভালো।

কেন ভালো?

অশান্তি নেই। গ্রামে ঘুরে দেখ।

মনসা যেন সিল্কের কথা ভুলে গেলো। সেও তো নিজের মনে আনন্দকে খুঁজে পাচ্ছে না। অশান্তি আর আতঙ্কই আছে সেখানে, যার উপরে যেন হাসি ফুটিয়ে রাখা মুখে, আর তা বাড়ির আর সকলের জন্য। স্বাধীনতা যেন আলোর মতো কিছু নয়, যেন নিছক এক লজ্জায় কিছু দূরে সরা। না, উৎসব কোরো না। যে কথা সে ভাবতে চায় না তাই যেন মনে পড়ে গেলো। সে বললল, আচ্ছা, দাদা জানিস, বিপিনবাবু বলছিলো–যারা দাঙ্গা করেছিলো তাদের হাতে ক্ষমতা গেলে দাঙ্গার দর্শনই প্রতিষ্ঠা পায়।

দু’এক মিনিট নৃপ উত্তর দিলো না। সেই সুযোগে মনসা মনটাকে আবার গুছিয়ে নিলো। বললো, তোর এখন মুড নেই। যা। বউদি এখনই গা ধুয়ে এসেছে ঘরে। রজনীগন্ধার ঝাড়ের পাশে একটা চাপার মালা রেখে এসেছি। ব্যবহার করিস। যা। আমি কফি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

.

একদিন নৃপনারায়ণ অন্য আলাপ করতে করতে কথাটা পাড়লো। রূপুর সঙ্গে কে কে যাচ্ছে?

সদানন্দ যাবে বন্দর পর্যন্ত। আর কেউ নয়? অবিশ্যি আমি যেতে পারি।

সান্যালমশাই বললেন, বেশ তো, সস্ত্রীক যাও না। ঘুরে আসাও হবে। রূপুরও ভালো। লাগবে।

সুমিতি হয়তো অন্যত্র যেতে চাইবে।

আমি ভেবেছিলাম তোমরা এখন এখানেই থাকবে কিছুদিন। সান্যালমশাই বললেন।

আমি তোমাদের এর আগে বলিনি–

না বলে ভালোই করেছে। নতুবা সব সময়েই মনে হতো তুমি দুদিনের জন্যে এসেছে। কিন্তু এই সেদিন বেরিয়েছে, এরই মধ্যে আবার কী প্রয়োজন হলো রাজনীতির?

বর্তমানে কিছু নয়। শাসনভার যে আমাদের হাতেই আসছে এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।

তুমি কী করতে চাচ্ছো?

স্টাডির ম্লান স্নিগ্ধতায় এই কথা কয়েকটি নৃপনারায়ণের চোখের সম্মুখে স্থাপিত করলেন সান্যালমশাই।

ভারতবর্ষের সমস্ত গ্রাম দেখবো এমনটা সম্ভব নয়। এক-একটি বড়ো শহরকে কেন্দ্র করে সেই শহরের রসদ জোগায় যে গ্রাম কয়েকটি, প্রত্যক্ষভাবে যদি সেগুলোর পরিচয় পাই তা হলেই মোটামুটি আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে বুঝতে পারবো। তুমি একে পলায়নবৃত্তি বলতে পারো।

তোমাকে কি এখনই যেতে হবে? অনসূয়া প্রশ্ন করলেন।

এখনই যেতে হবে এমন কথা নয়।

সান্যালমশাই আবার কথা বললেন। অনসূয়া লক্ষ্য করলেন তার গলা অদ্ভুতরকম একটানা শোনাচ্ছে, উঠছে না, নামছে না।

সান্যালমশাই বললেন, কিন্তু তুমি কি পায়ে হেঁটে বেড়াবে?

যেখানে যানবাহন আছে সেখানে নিশ্চয়ই তা করবো না। তাই বলে যানবাহনের কোনো আড়ম্বর থাকবেনা। অনেকসময়েই আমার মনে হয়েছে কোনো কোনো মতবাদকে সত্য প্রতিপন্ন করার জন্যে কতগুলো মিথ তৈরি করে তাতে বিশ্বাস করছি। কাল্পনিক কিছুকে আমরা মানুষ বলছি। মানুষকে যেন ছকে ফেলা যায়। যদি পারি, মানুষ সম্বন্ধে কিছু জানবার চেষ্টা করবো।

সান্যালমশাইয়ের গড়গড়ার শব্দ শুনে তাঁর পরিচিত যে-কেউই বুঝতে পারতো তিনি গভীরভাবে বিষয়টিকে অনুভব করার চেষ্টা করছেন।

তিনি প্রশ্ন করলেন, তুমি কি রাজনীতি নিয়েই থাকবে?

হ্যাঁ। হয়তো সেটাকেই উপজীবিকা করতে হবে।

উপজীবিকা? থামো, থামো।

সব দেশেই যেমন পাণ্ডিত্যকে উপজীবিকা করে একদল লোক আছে, তেমনি আছে রাজনীতিকে উপজীবিকা করে।

কিন্তু উপজীবিকা হিসেবে রাজনীতি ভাড়াটে সৈন্যের মতো ব্যাপার নয় কি?

আমাদের দেশে এখনো হয়নি কিন্তু রাজনীতিতে অগ্রসর দেশে হয়েছে। প্রফেস্যনল রাজনৈতিক কর্মী না হলে অর্থাৎ পুরো সময়টা রাজনীতিতে না দিলে অন্য সব বিষয়ের মতো এতেও সিদ্ধি নেই।

আচ্ছা নৃপ, তোমার যখন টাকা রয়েছে, না হয় অ্যামেচার রাজনৈতিক হয়ে থাকো।

টাকা আছে, এ আমি অস্বীকার করি না। বরং সেটাই প্রতিযোগীদের তুলনায় আমাকে বেশি শক্তি দিচ্ছে। আমার আদর্শবাদ তাদের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে আশা রাখি। আমরা এখনো কিছুদিন ইংরেজী ধারায় চলবো। ইংরেজের দেশেও রাজনীতিওয়ালারা পৈতৃক সম্পত্তিতে অবলম্বন করে কিছুটা অগ্রসর হওয়ার পর প্রফেস্যনল হয়।

সান্যালমশাই চোখ তুলে দেখলেন নৃপ তার কথা শোনার জন্য বসে আছে। তিনি বললেন, তোমার চিন্তায় সততা আছে; স্পেডকে তুমি স্পেড বলতে পারো।

এরপর নৃপনারায়ণ কথা ঘুরিয়ে নিলো। সান্যালমশাই লক্ষ্য করলেন সেটা এবং সহজ হয়ে রইলেন। রূপুর কথায় পৌঁছলো আলাপটা। রূপুকে ছ-সাত বছর কিংবা তারও বেশি সে দেশে থাকতে হবে। বড়ো জোর মাঝে মাঝে ছুটিতে আসবে।

অনসূয়া এতক্ষণ কথা বলেননি। এবার তিনি বললেন, অথচ আমি ভেবেছিলাম, রূপু যখন এবার দূরে যাচ্ছে তুমি আমাদের কাছে থাকছে।

সান্যালমশাই ভাবলেন, রাজনৈতিক মত পরিবর্তন নয়, রাজনীতির প্রতি অতি পরিচয়ের অবহেলা ছিলো নৃপনারায়ণের কথার সুরে।

.

স্বভাবতই মনসা আর সুমিতির অনেকটা সময় একত্র কাটে। মনসার দু’একদিনের মধ্যে ফিরে যাওয়ার কথা, কিন্তু তার দেরি হতে লাগলো। তার মনে ছিলো, অন্য আর একদিন সাজিয়ে। দেওয়ার কথা বলতে সুমিতির গলাটা ক্লান্ত শুনিয়েছিলো, কিন্তু ক্লান্তির চাইতেও বেশি কিছু ছিলো তার ভঙ্গিতে। গত কয়েকদিনে খুব সাধারণ সহজ কথায় বিষয়টাকে সে বুঝতে চেষ্টা করেছে। তার আর সুমিতির বিবাহ দু রকমের। ভালোবাসা আর বিবাহ নিয়ে সেই পুরনো কথা। সে ব্যাপারে সুমিতির মতো সাহস প্রমাণ করার সুযোগ তার জীবনে হয়নি। কোনটা আদর্শ হওয়া উচিত তা নিয়ে সে তর্ক করেনি, কিন্তু বিশেষ করে সুমিতির ভালোবাসার ব্যাপারটাকে সে সহানুভূতি তো বটেই, শ্রদ্ধা দিয়ে বিচার করেছে।

কিন্তু বাইরের ঘটনা কী এমন প্রভাবিত করতে পারে যে সেই ভালোবাসা ইতিমধ্যে প্রাণহীন? একথা কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না, নৃপনারায়ণের মতো একজনের উপর থেকে ভালোবাসা ফিরিয়ে নেয়া যায়।

একদিন মনসার মনে হলো : তুলনা দেওয়া ভালো নয়। তুলনা ছবি তৈরি করে, আর সেই ছবি অবলম্বনহীন আত্মার মতো যেখানে-সেখানে দেখা দিতে পারে। গড় শ্রীখণ্ড ধান আর পাটের হিন্টারল্যান্ড হতে পারে, তাহিতি দ্বীপ নয়। কিছু এক সৃষ্টির জন্য বউদির গ্রামে আসা কি গর্গার প্যারি-পালানো হয়? এখন এই গড় শ্রীখণ্ডে বউদির পক্ষে কিছু আর গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কী এক শক্তি অথবা প্লাবন এখন দাদপুরকে ভাঙার মতো গড় শ্রীখণ্ডকে ভাঙবে মনে হচ্ছে। তাহিতি সমুদ্রোচ্ছ্বাসে ডুবে গেলে গর্গাকে তো ছবির বদলে শুধু রোগ নিয়ে ফিরতে হতো। কিন্তু তুলনাটা নেহাত অসম। বউদির প্রেমের ব্যাপারটা গর্গার ছিলো না নিশ্চয়। সেই প্রেম কি যথেষ্ট যুক্তি নয় সবকিছুর?

অন্য একদিন আলাপে আলাপে তারা পুরুষদের পরিমণ্ডল থেকে সরে গিয়ে মেয়েদের নিজেদের ব্যাপার যেন আলাদা করে নিচ্ছিলো। তখন মনসা বললো, ঠিকই বলছে। বউদি, আমরা প্রায় দু টুকরো হয়ে যাই। পুরুষদের উচ্চাভিলাষ আর বাস্তব কৃতিতে যে পার্থক্য আমাদের এই টুকরো দুটোতে পার্থক্য তার চাইতে বেশি যেন। আমাদের আত্মা আর শরীর আলাদা হয়ে যায় না? তুমি শরীর না বলে প্রবৃত্তি বলবে? নাকি প্রকৃতি, নিয়তি এই সব? নাকি, সন্তানপরম্পরার বৃত্ত?

সুমিতি সাড়া দিলো না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মনসা বললো, তুমি অনেকদিন বাপের বাড়ি যাওনি, বউদি।

কথাটা আমিও ভাবছিলাম। বলে সুমিতি কথাটাকে আঁকড়ে ধরলো।

মনসা বললো, তোমাকে দেখলে মনে হয় তোমার স্বাভাবিক জীবনে বেড়ানোর একটা স্থান ছিলো। যা এই প্রাচীরঘেরা প্রাসাদে চেপে যাচ্ছে।

আমিও ভাবছিলাম ঘুরে আসা মন্দ নয়। কিন্তু খুব ভালো লাগে যদি তুমি আমার সঙ্গী হও।

মনসা হেসে বললো, এই দেখো, তোমাদের সেই হনিমুনে গেলাম কেন? আচ্ছা, কোথাও আস্তানা করে খবর দিয়ে। চেষ্টা করবো যেতে। যদি তুমি বলো, আমি জেঠিমাকে বলতে পারি, তোমার বাপের বাড়িতে কোনো কৌশলে খবর দিয়ে তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে।

সুমিতি একটু ভেবে বললো, তাই দিও।

কোনো কোনো দিন কারো মনের অবস্থা রোজনামচা লেখার মতো হয়। সাধারণত যেটা লেখা হয়ে যায় সেটাতে আত্মরক্ষার বুদ্ধি এসে জোটে, অনেক মিথ্যাও রেখে যায়। বরং চিন্তা করার সময়ে কেউ কেউ দুঃসাহসী হতে পারে।

মনসা চলে গেলে সুমিতি যখন আবার একা হলো, সে ভাবতে বসলো। প্রায়ই দেখা যায় চিন্তাটা যখন নিজেকে নিয়ে তখন সেটা একটা কিছুকে কেন্দ্র করে পাক খেতে থাকে, যেন নানা দিক থেকে কেন্দ্রে থাকা সেটিকে দেখা হচ্ছে। সুমিতির মনে হলো এখানে আসল কথাটা আধুনিকতা।

সে অনুভব করলো, সে কি উঁচু দেয়ালে ঘেরা এক কলেজ-হস্টেলে আছে, যার চারিদিকে অর্ধসভ্য গ্রামগুলি! না না। তা হবে কেন? এমন কী এটা মনসার তুলনার তাহিতি দ্বীপও নয়।

আধুনিকতা, যদি বলল তা, দারিদ্র্য দূর না হলে কোনো গ্রাম আধুনিক হয় না।

এই আধুনিকতা, অদারিদ্র্য সৃষ্টির চেষ্টা করতেই কি তার আধুনিক হওয়া নয়? কিংবা আধুনিক হওয়া আর আধুনিকতা সৃষ্টি করা একই মানুষের সংস্কৃতির দুই প্রকাশ। তার বিয়ের ব্যাপারে প্রথা না মানা, তেমন করে নিজে থেকে এ বাড়িতে আসা কি লজ্জা হয়ে যায় না যদি আধুনিকতা সৃষ্ট না হয়?

এখানে তেমন করে আসতে গিয়ে সে কি নিজেকে মর্যাল কারেজের কথা বলেছিলো? না, সে দিক দিয়ে তার তেমন অসুবিধা হয়নি। এই শ্রীখণ্ডের পুরনো গড়ে যেন একরকমের আধুনিকতা আছে। তা যেন এই, সামান্যমাত্র চঞ্চল হয়ে জীবন যেমন চলেছে তাকে সে রকম চলতে দেয়া। যেন বলেছে, তোমার জন্য আমরা পৃথক মহল করে দিতে পারি, একেবারে আধুনিক পৃথক একটা বাড়িও। এদের যতটুকু মধ্যবৃত্ত ততটুকুই কি চঞ্চল হয়েছিলো প্রথার কথা ভেবে? কিংবা বলা যায়, এদের প্রথার আবরণে তার অভিনবত্বকে আড়াল করেছে এরা যাতে তা রগরগে হয়ে চোখে না পড়ে।

একদিন মনসা চোখ বড় বড়ো করে বলেছিলো, ও মা সে কী! দাদা কিভাবে রমণী সংগ্রহ করবে, কাকে ভালোবাসবে, তা কি আর কারো ভাবার বিষয়? সেই সময়ে সে হাসতে হাসতে বলেছিলো, তুমি তো বিবাহিতা,বউদি। তুমি বাঈজী হলেই বা কি করতাম? সেই সময়েই বোধ হয় সে বলেছিলো, পিতার উপপত্নী থাকতে পারে। ছেলেমেয়েরাও তাতে ভ্রুক্ষেপ করে না।

মনসা ধারালোভাবে তুলেছিলো কথাটা। কিন্তু এই সহনশীলতা মিথ্যা নয় যেন এদের সংস্কৃতির। মনসা আর রূপুর মতো আর কেউ কি তাকে ভালোবাসে? এই সহনশীলতাকে আধুনিকতা বলা হবে কি, আধুনিক সংস্কৃতি?

সুমিতির মনে পড়লো, সেদিন টেবল-ম্যানার্সের কথায় দুরকম সংস্কৃতিকেই ঠাট্টা করেছিলো নৃপ। কী উদ্ভট উপমান যে জোগাড় করতে পারে নৃপ!

কিন্তু সুমিতি হাসতে পারলো না। তার মুখ বরং উদাস হলো, বিশীর্ণ হলো। সে ভাবলো : সত্যকে, অহিংসাকে নির্ভর করা, মানুষের জীবনকে স ধর্ম, সব থিয়োরির চাইতে বেশি মূল্য দেয়া কি আধুনিকতানয়? অর্থর চাইতে বিদ্যা কি বেশি আধুনিক নয়? মিল ফ্যাক্টরির অজস্র মসলিনের তুলনায় কারিগরের হাতে তৈরি খদ্দরের অপ্রতুলতাকে কি আধুনিকতর বলা হবে না আর?

সুমিতির চোখে বেশ বড়ো দু ফোঁটা জল দেখা দিলো। সে তাকে তাড়াতাড়ি গোপন করে হাসতে চেষ্টা করলো। মনে মনে বললো, এটা ভালোই হচ্ছে তার এই প্রথাসিদ্ধ সাধারণভাবে ফিরে যাওয়া।

.

আচ্ছা, নৃপ যখন হলো তখনকার দিনের ফটো-অ্যালবাম যদি একটা থাকতো? সান্যালমশাইকে অনসূয়া প্রশ্ন করলেন।

কী হতো তবে?

কারো কারো কৌতূহল নিবৃত্তি করতো।

সান্যালমশাই কথাটায় বিস্মিত হলেন। অন্যের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য ফটো তুলে রাখার মতো একটি মহিলা নন অনসূয়া।

অনসূয়া বললেন, আচ্ছা, এ কথা কি সত্যি যে মা না থাকলে নৃপকে আমি বাঁচাতে পারতাম না? (মা বলে অনসূয়া তার শাশুড়িকে নির্দিষ্ট করলেন)।

এতদিন পরে এ সমস্যা সমাধানের কোনো সূত্রই যে নেই। কিন্তু এ কথা তোমার মনে হলো কেন?

কথাটা যেন রায় দেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু। মনে মনে বাক্যটা তৈরি হয়ে গেলেও আবার যেন সেটা পড়ে দেখলেন অনসূয়া; স্বতোৎসারিত বাক্যটিকে অসংখ্য অর্ধোফ্ট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিন্তার সাহায্যে মার্জিত করে বললেন অবশেষে, আমি ছেলে মানুষ করতে জানিনি।

আবেগের উত্তাপ নিয়ে সান্যালমশাই বললেন, এটা তোমার অকারণে আত্মপীড়ন, আমি তোমার পুত্রগর্বে গর্বিত।

সহসা চোখে জল এলো অনসূয়ার। পরাজিতের মতো, আত্মপক্ষ সমর্থন করা যার পক্ষে সময়ের অপব্যয়মাত্র তার মতো বললেন, আমরা তখন হয়তো পরস্পরকে বেশি ভালোবাসতাম। ছেলে গৌণ ছিলো। তাই নৃপ কখনো আমাদের ভালোবাসতে পারলো না।

কিন্তু পরক্ষণেই অনসূয়া চোখের জল ও চশমার বাষ্প মুছে ফেললেন। একটু গভীর সুরে বললেন, তুমি বলবে অনেক দিক দিয়ে নৃপ আদর্শ পুরুষ হয়েছে, তুমি বলবে অনেক দিক থেকে সে আমাদের তুলনায় অগ্রসর, কিন্তু এ কথা স্বীকার করবে কী করে নৃপ আমাদের কেউ নয়? কিংবা এ হয়তো আমার শহুরে আচার-আচরণের ফল।

সান্যালমশাই হাসলেন গড়গড়ার নল সরিয়ে, বললেন, আমি জানি না, আমার বা তোমার মন অন্য কারো মন হয় কী করে। তোমার মনের কথা আমি ভাবিনি এমন নয়। আচ্ছা প্রকৃতিঠাকরুণের কথা ভাবো, যার সাধারণ নাম এখন ঠানদিদি। নৃপ জন্মানোর আগে, কতই বা বয়স তখন তোমার, তুমি তাকে তোমার এই বাড়িতে অন্যান্য পরিজনের মধ্যে আশ্রয় দিয়েছিলে। হিসাব সই করতে গিয়ে জানতাম পিতার আমলে মঞ্জুর করা মাসোয়ারাটা যায়। সে তোমাকে বয়সের ভার, দুঃস্থতা জানিয়ে চিঠি দিয়ে থাকবে। তুমি তাকে এই বাড়িতে পৃথক ছোটমহলে নিজের মতো থাকতে দিয়েছে। মনে পড়ছে, বলেছিলে, হতে পারে ঠাকুরের বিবাহিতানয়, কিন্তু তাকে স্ত্রীই বলা যায়। একেই হয়তো অমধ্যবিত্তদেরনলেস অলিজ বলে। হাসতে লাগলেন সান্যালমশাই।

সান্যালমশাই যেন অনসূয়াকে তার আত্মগ্লানি থেকে রক্ষা করছেন না মাত্র, নিজের অন্তরের স্বরূপও যেন ধরতে পারছেন না। তিনি বললেন, তুমি কি বলতে পারো, কিংবা আমি কি নিজেই জানি কোনোদিন আমি নৃপর মতো হতে চেয়েছিলাম কিনা? হয়তো তাকে প্রতি রক্তকণায় বাঁচাতে চাওয়া বলে।

অনসূয়া একটু চেষ্টা করে দৈনন্দিন কথায় চলে গেলেন। কিন্তু তার মনে হলো ‘সুমিত বাংলো’টায় কন্ট্রাক্টর এখনো কাঁচের কাজ করছে বটে, কিন্তু সেটা যেন ফাপা কিছু। সান্যালমশাই স্বেচ্ছায় যে স্তব্ধতার দিকে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সেদিকেই যেন কেউ তাকে জোর করে ঠেলে দিলো ঠিক যখন সান্যালমশাই অন্য জীবন কামনা করছিলেন।

তখন সন্ধ্যা হয় হয়। রূপু এবং নৃপ আলাপ করতে করতে তার ঘরের কাছে এসে দাঁড়ালো। তারা দুজনেই ‘মা’ বলে উল্লেখ করে কী একটা বিষয়ে আলাপ করছিলো। কথাগুলোর সবটুকু কানে গেলো না তাঁর, কিন্তু ‘মা’ শব্দটা কানে গেলো। ব্যাপারটা নতুবা হয়তো এমনটা হতো না যেমন হলো। এ কথাও তিনি ভেবেছিলেন, তার শক্তির চরম প্রকাশ নিজের বিরাগ জানান, কিন্তু তার কি কিছু মূল্য আছে আর?

নিজের ঘর অন্ধকার ছিলো। সম্বিৎ পাওয়ার মতো ভঙ্গিতে আলো জ্বেলে অনসূয়া ছেলেদের ডাকলেন। ছেলেরা এলে বিছানা দেখিয়ে দিয়ে তাদের বসতে বললেন এবং নিজে গিয়ে দাঁড়ালেন ড্রেসিং টেবিলের কাছে।

নৃপ, তুমি শিকারে গিয়েছিলে!

নৃপ লক্ষ্য করলো প্রচলিত সম্বোধনটা ব্যবহার করলেন না অনসূয়া। তবু সে হাসিমুখেই বললো, তাকে শিকার বলে না, আমার নিজের বন্দুক নেই।

অনসূয়ার বক্তব্যটা খাপখোলা তলোয়ারের মতো ঝিকিয়ে উঠলো, যে-প্ৰাণীহত্যা জীবনের পক্ষে অপরিহার্য নয় সেটা মানুষকে টেনে নামায় বলেই এখনো আমার ধারণা।

অনসূয়া ড্রেসিং টেবিলে দুহাতের ভর রেখে দাঁড়ালেন, যেন তিনি একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে প্রস্তুত হচ্ছেন। মানুষের নীতিবোধের তারতম্য, পারিবারিক প্রথার প্রতি মমতা প্রভৃতির কথা বলতে বলতে আকস্মিকভাবে তিনি বললেন, মানুষকে সংবেদনশীলও হতে হয়। তোমরা কি ভেবে দেখেছো, তোমাদের এই চলে যাওয়াও আর একজনের প্রাণে কত বড়ো আঘাত হয়ে লাগতে পারে–যে শুধু তোমাদের ভালোই বেসেছে, শাসনের জন্যে তিরস্কার করেনি?

রূপু বললো, আমি যাবো না, মা। বাবাকে কষ্ট দেওয়া আমার ইচ্ছে নয়।

নৃপ হাসিমুখে কী বলতে যাচ্ছিলো। তার মুখটা একবার লাল হয়ে উঠলো।

সংসার স্বাভাবিকভাবেই চলছে, কিন্তু পরদিন সকালে দরজা খুলে দিতে গিয়ে অনসূয়ার মনে হলো, একটি কুণ্ঠার অবগুণ্ঠন যেন কে পরিয়ে দিয়েছে বাড়িটাকে।

তিনি রান্নার মহলে অন্যদিনের তুলনায় আগে গেলেন। কিছুক্ষণ এটা-ওটা দেখে, এর-তার সঙ্গে দু-একটা কথা বলে তিনি দাসীকে দিয়ে বলে পাঠালেন, একটা বড়ো মাছের দরকার, জেলেদের খবর দেওয়া হোক। সুমিতি ওদের প্রাতরাশ নিয়ে দুজন দাসীকে সঙ্গে করে যাচ্ছিলো অন্দরমহলে। অনসূয়া বললেন, সুমিতি, মাছের কালিয়াটার ভার আজ তোমার উপরে রইলো। রাঁধুনীদের তোমার পরামর্শ নিতে বলেছি।

আসছি, বলে সুমিতি চলে গেলো।

জেলেরা পুকুরে অন্যদিনের তুলনায় আজ ভালো মাছ পেলো। এতে অনসূয়ার সুবিধাই হলো।

কিন্তু নিজেকে শত কাজে ব্যাপৃত রেখেও তিনি ভুলতে পারেননি, কথাটা যখন তিনি বলেছিলেন, খুব কম সময়ের জন্য হলেও লাল হয়ে উঠেছিলো নৃপর মুখ। সে কি অপমানিত বোধ করেছিলো? ছেলে প্রাপ্তবয়স্ক হলে সে কি মায়ের শাসনে অপমানিত বোধ করে? সমস্ত দিনে মনে মনে অন্তত পাঁচ-ছ বার নৃপনারায়ণের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন।

আত্মগ্লানিতে তার মন ভরে উঠলো। যেন তার বাড়িটার এখানে-ওখানে অজস্র ফাটল দেখা। দিচ্ছে, যেন তার সংসারের কোথাও কোথাও পরিবর্তনের সূচনা হচ্ছে, আর তিনি উপযুক্ত প্রতিপক্ষ না পেয়ে নিজের আপনজনগুলিকে আঘাত করছেন। নিজের মনের গভীরে নিয়ে ক্ষোভকে বদলে দিতে পারেননি, নিরুপায়ের হিংস্রতায় তা প্রকাশ হয়ে গেছে। এ লজ্জা তিনি কী করে ঢাকবেন?

সন্ধ্যার পর রূপু এসে যখন খবর দিলো, মা ঘরে নেই, তখন অন্য কাউকে না পাঠিয়ে সান্যালমশাই নিজেই অনসূয়াকে খুঁজতে বার হলেন। কাউকে কোনো প্রশ্ন করলেন না, চটির শব্দ তুলে অন্দরমহলে একটু ঘুরলেন, তারপর রান্নার মহলে গেলেন। দু-একজন তাকে দেখে কী করবে ভেবে পেলো না। কিন্তু তিনি অনসূয়াকে আবিষ্কার করলেন। অনসূয়া তখন মন্দিরের বারান্দায় অস্পষ্ট হয়ে বসে আছেন।

সান্যালমশাই বললেন, দর্জি এসেছে সদর থেকে। রূপুর কী কী বানাতে হবে বলে দিয়ে যাও।

অবশ্য দর্জির ব্যাপারটা এমন কিছু জরুরি নয়।

কিন্তু মনসা এলো পুঁথিঘরে যেখানে সান্যালমশাই ও অনসূয়া ছিলেন। শুধু সিঁথি, কষ্টি ও বাজুবন্দে নয়, সে তার মুখের হাসিতেও ঝকঝক করছে।

কোথায় গিয়েছিলি?

দাদার ঘরে একটা পার্টি ছিলো।

তা অমন একগাল পান মুখে দিয়ে পাগলির মতো হয়ে না বেড়িয়ে এমন করে থাকলেই তো পারিস।

মনসা বললো, তা থাকবো। হ্যাঁ জেঠিমা, তুমি নাকি রূপুকে যেতে দেবে না? দাদাকেও নিষেধ করেছে?

অনসূয়া চট করে উত্তর দিতে পারলেন না; হাসলেন।

এ কি তুমি ভালো করলে? দাদাকে আটকাও, কিন্তু রূপুকে যেতে দিয়ো।

তা যাবে বৈকি।

তাই বলল। আমি ভেবেছিলাম তোমাকে বলবো বউদির বাপের বাড়িতে চিঠি দিতে, যাতে ওরা এসে নিয়ে যায়। এখন সাহস পাচ্ছি না।

অনেকদিন একটানা আছে এখানে, তাই নয়?

তা বৈকি। তাছাড়া ওদের তরফেও তো ছেলেটাকে দেখতে ইচ্ছে হতে পারে।

তা পারে।

তাহলে কাল চিঠিটা লিখে দিয়ো।

মনে করিস কাল।

আর তাছাড়া, আমার মনে হয়, দাদারও বাইরে ঘুরে আসা মন্দ নয়। সেই কবে থেকে সরকার ওর পিছনে লেগে ছিলো, ম্যালেরিয়ার মতো ধরেছে পূর্ণিমায়-পূর্ণিমায়।

অনসূয়া আবার হাসলেন। একটু পরে বললেন, রূপু যাবে, নৃপকেও যেতে দেবো। কিন্তু, মনসা, ছেলে বড় হলে তুই বুঝবি, কখনো কখনো ছেলেদের সম্বন্ধে বিচলিত না হয়ে পারা যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *