২৮. আলেফ সেখের সঙ্গে

আলেফ সেখের সঙ্গে আবার একদিন রামচন্দ্রর দেখা হলো।

রামচন্দ্র যাচ্ছিলো চৈতন্য সাহার বাড়িতে কিছু কাপড় কিনতে। আলেফ সেখ বিপরীত দিক থেকে আসছিলো। কতি যাওয়া হইছিলো?

এই এদিকে। আলেফ যে রায়দের জমিটাই আবার দেখতে গিয়েছিলো সেটা প্রকাশ করলো না। সে বললো, বিড়ি খান।

রামচন্দ্র বিড়ি নিয়ে ধরালো।

আলেফ বললো, সেই যে জমির কথা কইছিলাম মনে আছে?

আছে।

বসেন না একটু, আলাপ করি। আলেফ পথের ধারে ঘাসে-ঢাকা জমি দেখে উবু হয়ে বসে পড়লো। অগত্যা রামচন্দ্রকেও বসতে হলো।

আলেফ বললো, যা কইছেন মিথ্যা না, মণ্ডলের ব্যাটা। এখন জমি আর কনে আছে এ গের্দে। কী যেন কইছিলেন, মসনদ না কী? বাড়ি করবের হয় তো ওইখানে।

রামচন্দ্র নিরুত্তর। আলেফ বলে চললো, কিন্তুক লোকের কাছে খবর নিয়ে কলকেতায় রায়বাবুদের সরকারের ঠিকানায় চিঠি দিছিলাম। ফিরে আসছে। ধরেন যে রেজেস্টারি চিঠি, বিলি হওয়া লাগতো।

এখানে মিহিরবাবুর কাছে খোঁজ পালেও পাতে পারেন।

কন কী? তার কাছে খোঁজ নিবের গেলে সে কি নিজেই কিনবের চায় না?

রামচন্দ্রর মনে হলো লোকটি বৃথা ঘুরছে। রায়বাবুরা যদি জমি বিক্রিই করবে তবে এটা এতদিন পড়ে থাকতো না। সকলের চোখেই পড়েছে জমিটা। সে আলেফের জন্য একপ্রকার সহানুভূতিও বোধ করলো। সে বললো, মিছা কেন্ ঘোরাফেরা করেন। ও জমি যদি নেওয়ার মতো হবি তাইলে আর কেউ না পারুক, সান্যালকর্তা এক কথায় নিবের পারতো।

কিন্তুক জমি পড়ে থাকবি, কেউ নিবি নে এও বা কেমন কথা।

তা ছাড়াও রায়বাবুদের বাস্তুভিটার সম্মান আছে তো। হিন্দুরাই যখন ওটা নিতে পারে নাই, তখন বাস্তুভিটা মোসলমানের কাছে বেচবি এমন মনে হয় না।

তুমি বুঝি আমার দাড়ি দেখে ঠাট্টা করো?

না, ঠাট্টা না। জমি তো আজকাল খুব পাওয়া যাতেছে। সান্যালকর্তা মেলা খাসজমি বিলাতেছেন।

আলেফ সেখ মিহির সান্যালের কাছে গিয়ে একদিন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জমিটার কথা উল্লেখ করলো।

মিহির বললো, না, ও জমি আমি নেবো এমন কথা রটনা হওয়া উচিত নয়। আপনি কার কাছে শুনলেন?

আমার পাড়ার লোকরা বলাবলি করে।কথার চালটা বজায় রাখার জন্য আলেফ বললো। তা আপনি যদি না নেন, আরও গাহাক আছে।

এ তো বড়ো কৌতুকের কথা। যার জিনিস সে বিক্রি করবে না, খরিদ্দার পিছু নিয়েছে। কে কেনে?

ধরেন, আমরা দু ভাই আছি।

মিহির বললো, এই আশাতে ঘোরাঘুরি? তা আপনাকে এ গ্রামের মধ্যে ঢুকতে দিলাম কেন? আমাদের বিয়ের বাজনায় আপনার ধর্মের ব্যাঘাত হবে, আমাদের গানের জলসায় আপনাদের খোদা নারাজ হবে। আপনাকে গ্রামে ঢুকিয়ে এটাকে আরব মরুভূমি করতে পারব না।

তাইলে আমি মোসলমান বলে পাবো না?

দেওয়ার মালিক আমি নই। তবে এ বিষয়ে আমরা আমাদের মতামত নিশ্চয়ই জানাবো। পৃথক জায়গায় আছি, সদ্ভাব আছে।

মিহির কথাগুলি হাসি হাসি মুখেই বলেছিলো কিন্তু সেগুলি অত্যন্ত ধারালো। আলেফ স্থির করলো এরা রামচন্দ্র নয় যে সহানুভূতি নিয়ে তার প্রস্তাব বিবেচনা করবে। তা ক্ষমতা আছে। বৈকি মিহির সান্যালের। গ্রামের সব হিন্দুদের জোট পাকিয়ে একটা প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করতে পারে। আলেফ সব মুসলমানদের এক করতে পারে না, তাহলেও কিছু পারে। কিন্তু তাতে কী লাভ হবে? সে যদি রায়বাবুদের পাঁচ হাজার দিতে চায় হয়তো মিহির তাকে জব্দ করার জন্য দশ হাজারে দাম তুলে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে হাসতে পারে।

আলেফ চিন্তা করলো। তার মনে পড়লো তখন, আল মাহমুদ একদিন কথায় কথায় বলেছিলো বটে সদরে অনেক রাস্তায় অনেক সময়ে তারা গানবাজনা বন্ধ করে দিতে পেরেছে। এবং সে কথা বলতে বলতে আল মাহমুদ আনন্দে উত্তেজিত হয়ে অনেকবার ইনসাল্লা বলেছিলো। তাহলে তো মিথ্যা বলেনি মিহির, এই ভাবলো আলেফ।

কিন্তু সে বলতে পারেনি অথচ অনায়াসেই বলতে পারতো–তার ছেলের বাজনার কথা। এরফান গেলে সে হাসিমুখেই বলতে পারতো মিহিরবাবু, এ আপনার লোকঠকানো কথা। গানবাজনায় কারো ধর্মের ব্যাঘাত হয় না। আমার ছেলের বাজনা একদিন আপনাকে শোনাবো। তাছাড়া এরফানের কথা বলার ধরনই অনেক মিষ্টি। নিজে না গিয়ে এরফানকে পাঠালে কাজ হতো।

তার ধর্ম সম্বন্ধে কে কী বললো এটা আলেফ ভুলে যেতে পারতো যদি কথাটা কোনো তত্ত্ব আলোচনা মাত্রই হতো। কিন্তু জমিটার সঙ্গে জড়িয়ে জড়িয়ে কথাগুলি অনবরত মনের মধ্যে পাক খেয়ে বেড়াতে লাগলো। ব্যর্থতাবোধের সঙ্গে মিশে ধর্ম সম্বন্ধে মিহিরের উক্তিগুলি একটি বিদ্বেষের রূপ নিতে লাগলো তার মনে।

এরকম কথাও সে চিন্তা করতে লাগলো যে আল মাহমুদকে ডেকে পাঠিয়ে তার সঙ্গে একবার পরামর্শ করে নেবে। একদিন সে ছমিরুদ্দিনকে বললো, কেন, প্রেসিডেক্সাহেব, তুমি না গাঁয়ে পরধান!

ছমিরুদ্দিন রসিকতা করে বললো, কোন ধান কলেন?

আলেফ রসিকতার দিকে না গিয়ে বললো, জমি নিবা?

জমি? নে না। শুনি যে সান্যালমশাইয়ের অনেক সিকস্তি জমি এবার চাষ সামিল হইছে। সে কি পাওয়া যায়? শুনছি হিন্দুরা পাবি।

তাও শুনছি। দাদপুরের দাসেরা নাকি উঠে আসে বসবি বুধেডাঙায়। আর বুধেডাঙার সান্দাররা নদীর কিনারে নামে যাবি।

কও, এ বন্দোবস্ত কে, সান্দাররা মোসলমান বলে?

হয়, তারা আপনের মক্কার মোসলমান!

তাইলেও দ্যাখো! তুমি কি ইচ্ছা করলেই চিকন্দিতে জমি নিবের পারো?

ইচ্ছা করলিই জমি হয়, একথা কবে শুনছেন?

এরপরে আলেফ নিজেকে প্রকাশ করে ফেলো। রায়দের জমির কাহিনীটুকু সে বললো ছমিরুদ্দিনকে। ছমিরুদ্দিন ধৈর্য ধরে শুনলো। কিন্তু আলেফের কথা শেষ হলে বললো, শুনছি এসব কথা। এতদিনে আপনের জমি কেনার কথা সব লোকই জানছে। আপনের খোঁড়া মৌলবী আজকাল কয়ে বেড়ায়-বড়ো যে বাড়বাড়ন্ত, রায়ের ভিটায় বসবা বুঝি! এই তার নতুন শোলোক।

আলেফ অন্যসময়ে এতে বিপর্যস্ত হয়ে যেতো। কিন্তু রায়ের জমির উপরে তার মোহ প্রায় অন্ধ হয়ে উঠেছে। সে বললো, কেন, জমির গায়ে কি নাম লেখা থাকে?

তা থাকে না। তবে এ জমি ধরে আপনেইবা কেন্ চিকন্দিতে ঢুকবের চান?

আলেফ বিস্মিত ছমিরুদ্দিনকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে দমদম করে চলে গেলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *