২৬. পুরোপুরি পাকা হওয়ার আগে

পুরোপুরি পাকা হওয়ার আগেই পাকা মসজিদের নাম ছড়িয়ে পড়েছিলো। এখন চুনকাম করা দেওয়ালে মসজিদটি লাল রং করা প্রাচীরের মধ্যে থেকে চরনকাশির মাঠের একটি অবলম্বনীয় দিকচিহ্নের মতো চোখে পড়ে। পাকা মজিদ কথাটি এখন পাশাপাশি তিন-চারখানা গ্রামে প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে।

কেউ কারো অক্ষমতার কথা প্রকাশ করলে তার বিপক্ষরা অনেকসময়ে হাসিমুখে বলে, কে, ভাই তুমি তো পাকা মজিদ দিছো।

হাট থেকে প্রয়োজন মতো সওদা সংগ্রহ করতে না পারলে গৃহিণীর কুটিতে ক্রুদ্ধ হয়েও কৃষকরা বলে ঝাজের সঙ্গে, কেন্, আমি কি পাকা মজিদ দিছি?

কেউ হয়তো একটা ঘর তুলছে। কেমন হলো ভাই, ঘর? পাকা মজিদ-মধুর রসিকতার উত্তর আসে।

এ হেন পাকা মসজিদ তুলেও আলেফ সেখের মনে শান্তি নেই। কিছুদিন আগে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। সদর থেকে এক সাইকেল-চড়া খাকি-পরা সরবরাহ কর্মচারী এসেছিলো। যে পথে পথে বেড়ায় তার সঙ্গেই দেখা হওয়া স্বাভাবিক, আলেফ সেখের সঙ্গেই তার দেখা হলো।

সে বললো, আলেফ সেখ সেক্রেটারির বাড়ি কোনটা?

ওই পাকা মজিদ।

তা শুনেছি, কিন্তু ওখানে তো আরও দু’একটা বাড়ি চোখে পড়ছে। আপনি কি তাকে চেনেন?

আমিই আলেফ সেখ।

লোকটি যেন এই ধরনের রসিকতায় বিরক্ত হয়েই আলেফ সেখকে পিছনে ফেলে পাকা মসজিদ লক্ষ্য করে চলে গেলো। পরে অবশ্য লোকটি তাকে চিনতে পেরে ক্ষমা চেয়েছিলো।

কিন্তু এরকম কেন হবে? এরফানের গায়ের রং তার তুলনায় কিছু পরিষ্কার তার জন্য তো সে দায়ী নয়, তেমনি একবুক শাদা দাড়ি রেখেও এরফানের তুলনায় তাকে গম্ভীর দেখায় না, তার জন্যও তাকে দায়ী করা যায় না। তখন তার পরনে একটা খাটো তফন ছিলো, কাঁধে গামছা ছিলো। কিন্তু পায়ে জুতো এবং মাথায় ছাতাও ছিলো। এরফানকে অবশ্য এরকম বেশে কেউ পথে দেখতে পায় না। কিন্তু ভদ্রলোক বলেই কি তাকে দিনরাত্রি চোগা-চাপকান এঁটে থাকতে হবে? জমিজিরাতের কাজ করতে হবে না?

এক সন্ধ্যায় হাত-পা ধুতে বসে নিজের হাত-পায়ের আঙুলের পিঠে কড়াগুলি তার চোখে পড়লো। সে স্ত্রীকে বললো, একখানা ঝামা দেও তো। দ্যাখো তো এ কি থাবা না হাত? এ কি ভদ্রলোকের পা? জুতাই বদলাবের হবি। এরফানের মতো হাল্কা একজোড়া নেওয়া লাগে।

এসবের চাইতেও বড়ো অশান্তি আছে। বিষয়টি তার সেক্রেটারি হওয়ার সঙ্গে সংযুক্ত। অন্য অনেক প্রবাদ বাক্যের মতো এটাও চরনকাশির খোঁড়া মৌলবীর রচনা। আলেফের কপালে একটা ছোটো অর্বুদ আছে। খোঁড়া মৌলবী বলে, ওটা কিছু নয়, নমাজ পড়তে পড়তে হয়েছে তবে এটা কাপড়ের জন্যে; শীতকালে কমিটির কম্বল দেওয়ার কথা, তখন আরও একটা কড়া পড়বে। আলেফ সেখ জানে, কমিটির কাজে গোলমাল আছে। চৈতন্য সাহা এবং ছমিরুদ্দিন একসঙ্গে হলেই ফিসফাসকরে আলাপ শুরু করে। জমির কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় বলে ব্যাপারটা সে তলিয়ে দেখার চেষ্টা করে না।

কিছুদিন আগে একশ টাকার দুখানা নোট নিয়ে চৈতন্য সাহা এসেছিলো। নেন, সামাইন্য কিছু। লজ্জায় যেন মাথা ভূমি স্পর্শ করবে।

আলেফ সেখ টাকাটা রেখে দিয়েছিলো। তার আট-দশদিন বাদেই চুরির ব্যাপারটা ঘটে গেলো। চুরি করে সরকারি সওদা? রাগে আলেফ ফেটে ফেটে পড়তে লাগলো। সদর থেকে কোনো লোক তদন্তে এলো না, সেজন্য সে সরকারকেই গালাগালি করলো। তারপরই এলো কনক। সংবাদটা একটু বিলম্বে পেয়েছিলো আলেফ। সাজপোশাক করে মাথায় একটা কাবুলি মুরেঠা পরে এরফানের বাড়িতে গেলে সে তাকে নিয়ে তদন্তস্থলে যাবে এই ইচ্ছায়, কিন্তু সেখানেই খবরটা এসে পৌঁছলোকনক দারোগা চৈতন্য সাহাকেই চোর সাব্যস্ত করেছে।

আলেফ কিছু না বলে এরফানের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। এটা ছেলেছোকরাদের গান বাঁধার ব্যাপার নয়। আলেফের নিজের পোশাক তাকে ধিকৃত করতে থাকলো, সেই দুশো টাকা দিয়ে সে এই নতুন আচকান-শিলোয়ারের দাম দিয়েছে।

হঠাৎ সে বলে বসলো, কেন, ছাওয়াল কী কবি?

আলেফ চিন্তায় যতদূর এগিয়ে গিয়েছিলো স্বাভাবিকভাবেই এরফান তা যায়নি। সে বললো, এ কী কও?

টাকার কথা বলতে বলতে সামলে নিয়ে আলেফ বললো, কনকদারোগা তো আমার-তোমার বাড়িও খোঁজ করতি পারে। ছাওয়ালের মনে সন্দেহ হতি পারে। তার মাথা হেঁট হবি। কও, আমরা কি চোর?

আলেফ দমদম করে হেঁটে নিজের বাড়িতে ফিরে পোশাক খুলে ফেলো। তার স্ত্রী বললো, সে কী, ফিরে আলে?

আলেফ তারস্বরে বললো, খবরদার!

তার স্ত্রী বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলো।

ব্যাপারটা থিতিয়ে গেলে আলেফ একদিন চৈতন্য সাহাকে নিজের শারীরিক অসুস্থতার অজুহাতে ডেকে পাঠালো। এরফানকে বলে এলো একটা টাকা-লেনদেনের সাক্ষী থাকতে হবে। চৈতন্য সাহা এলে টাকা দুশো তাকে ফিরিয়ে দিয়ে সে বললো, তোমার টাকা তুমি রাখো। এরফান ফুর্সি টানতে টানতে ব্যাপারটার সাক্ষী হয়ে রইলো।

চৈতন্য-ছমিরের সংস্পর্শে ভদ্রলোকের থাকা উচিত নয়। আলেফ স্থির করলো, এ বিবেচনা থেকেই সান্যালমশাই গ্রামের কোনো ভদ্র ব্যক্তিকে তাদের দিকে এগিয়ে না দিয়ে তাকেই ঠেলে দিয়েছিলেন। তাই যদি হয়, সে এখনো সান্যালমশাইয়ের চোখে ভদ্র হতে পারেনি।

কিন্তু সান্যালমশাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা যায় না। ইতিমধ্যে সে একবার সান্যালমশাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিলো। কলকাতা থেকে তার ছেলে এসেছিলো, সঙ্গে সেও ছিলো। সান্যালমশাই কখনো তাকে, কখনো ছেলেকে প্রশ্ন করে সব খবর জেনে নিলেন। কিছু পরেনায়েবকে ডেকে বললেন–দুশো টাকা দিয়ো তো আমাকে।নায়েব টাকা এনে দিলে টাকাটা তার ছেলের হাতে দিয়ে তার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, কল্যাণ হোক। ছেলে বিস্মিত হয়েছিলো, সান্যালমশাই হেসে বলেছিলেন, বই কিনো।

টাকার অঙ্ক দুটিতেও মিল দ্যাখো। সেটা ছেলের কৃতিত্বের পরিচয়, আর এটা? আলেফ প্রথম কয়েকটি দিন ঘুরঘুর করে বেড়াতে বেড়াতে চিন্তা করলো কনজর রাখতে হবে চৈতন্য সাহা আর ছমিরুদ্দিনের উপরে। কিন্তু পরে ভাবলো, যা হয় করুক, আমি আর ওতে নাই।

.

জমিটা পড়ে আছে। রায়দের জঙ্গলের কাছাকাছি। জঙ্গল এককালে বাগান ছিলো, আর এ জমিটায় ছিলো প্রাসাদ। এখন কলওয়ালাদের হাতে পড়ে ইটগুলিও বিকিয়ে গেছে। ভিত্তির ইটপাথরগুলো ভোলার খরচ বিক্রির দামে পোষাবে না বলে সেগুলি মাটির নিচে থেকে গেছে। বুনো ঘাসে ঢাকা জমিটা। দুটি তালগাছ আছে। দ্বিতীয়টি জন্মাবার আগেই প্রথমটি বাজে পুড়ে নেড়া হয়ে গেছে। সে দুটি চিল-ওড়া নীল গভীর আকাশের মাঝখানে পরস্পরের সঙ্গী।

এটা অত্যন্ত পুরনো সত্য-জমি এবং নারী। আদর যত্ন না পেলে ওরা হাজা-শুখা কিংবা বন্য এবং হিংস্র। একদিন চিন্তায় কিছু রসিকতা মিশিয়ে আলেফ ভাবলো : নারীর সঙ্গে জমির এইটুকুমাত্র তফাত যে নতুন ও লোভনীয় দেখলেই তাকে ভালোবাসা যায়। তার জন্য ছেলে বউয়ের কাছে মাথা হেঁট করতে হয় না।

আলেফ সেখকে এ জমির দিকে অনিবার্যভাবেই আসতে হতো। তার মন চৈতন্যর চুরির ব্যাপারে অবলম্বনহীন হয়ে পড়েছে বলেই সময়ের দিক দিয়ে কিছু আগে হলো।

রেবতী চক্রবর্তী একদিন আলেফকে রায়দের পতিত জমিতে ঘুরে ঘুরে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মাটি পরখ করতে দেখতে পেলো।

ওখানে কী?

না, কিছু না। এমনি ঘুরে দেখলাম।

ভালো জায়গা বটে ঘুরে দেখার। মাটির তলায় একতলা সমান ইটের গাঁথুনি আছে। সাপখোপের আড্ডা। কত গর্তগাড়া দেখছেন না? বাস্তুসাপের বাচ্চারা ধাড়ীদের মতো খাতির রেয়াৎ করে না।

তা তো বটেই, তা তো বটেই, বলে আলেফ জমিটা পার হয়ে রেবতী চক্রবর্তীর কাছে রাস্তায় উঠে এলো।

অন্য কথা দু’চারটে বলে পথ চলতে শুরু করলো দুজনে। খানিকটা দূরে যাওয়ার পর জমিটা আবার চোখে পড়লো আলেফের। আরও দু’চারটে অন্য কথা বলে আর-একবার জমিটা দেখে নিয়ে আলেফ গদগদ করে বললো, বড়োলোকের কাণ্ডকারখানা আলাদা।

কেন, বড়োলোকের জমিতে সোনার টুকরো পেলেন নাকি?

তানা, তবে কওয়া যায়। সোনার টুকরা ছাড়া কি জমিটা?তানা। বলতিছি ধরেন যে এদেশে তো রায়রা আর আসবি নে।

ও পড়ে আছে, পড়েই থাকবে।

তা কেউ কিনে নিলেই পারে। লাট দিতে হয় না, লাখেরাজ ভূঁই। সেসে আর কয় টাকা। এক লটে পঞ্চাশ বিঘা ঢালা, নিখরচা।

এই দ্যাখো! বড়োঘরের জিনিসের দিকে নজর দেওয়া কেন!

বড়োঘরের হলেও এ তো পর্দার বিবি না।

সেবছরে রামচন্দ্ররা কয়েকজন ভাগে কিনতে চেয়েছিলো। তার মধ্যে লেগে গেলো দুর্ভিক্ষ। ও জমিতে লোভ হলেই অনর্থ।

রেবতী চলে গেলো। ধুলোঢাকা পথে একটা পাক খেয়ে আলেফ সেখ ফিরতি পথে আঁকাবাঁকা চলতে লাগলো। আর তারপর ভাবতে ভাবতে ভেবে ওঠার আগেই সে রামচন্দ্র মণ্ডলের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত।

রামচন্দ্র বেরিয়ে এলো। জলচৌকি টেনে দিয়ে তামাক ধরালো, কাঁঠালের পাতা এনে নল তৈরি করে দিলো।

আলাম ঘুরতে ঘুরতে। তা কেমন আছেন? শুনলাম ছাওয়ালের বিয়ে দিছেন।

এই হলো আলেফের ভূমিকা। এখানে আসবার সময়ে সে যেমন আঁকাবাঁকা পথে এসেছিলো তেমনি আঁকাবাঁকা কথায় সে জমির প্রসঙ্গে এসে পৌঁছলো।

রামচন্দ্র বললল, হ্যাঁ, সখ তো হইছিলো একবার। অনেক টাকা লাগে পারলাম না।

তা ধরেন যে মিথ্যা না কথা। বড়লোকের জমি, আমাদের মতো অভাবে তো পড়ে নাই। রায়বাবুদের সরকারকে লিখছিলেন?

হুঁ। পাঁচ হাজার সেলামি দিয়ে পত্তনি বহাল।

কন কী! তাও পত্তনি। তাও ওই সাঁইত্রিশ বিঘা পতিত ভিটা।

কথায় নিরাশা ফুটাতে আলেফ জমির পরিমাণ কমিয়ে আনলো।

রামচন্দ্র বললো, কিন্তুক শুধু জমি দেখেন না সেখের বেটা। ও হতিছে জমিদারের গদি। ওখানে কায়েম হওয়া এই গাঁয়ে কায়েম হওয়ার সামিল।

আলেফ সেখ রামচন্দ্রর প্রতিটি কথার শেষে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে যতি সূচনা করে যাচ্ছিলো। সে বললো, হয়, হয়, ঠাট্টা। জমি নাই তার জমিদারী।

রামচন্দ্রর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আলেফ নিজের বাড়ির পথ ধরলো। রৌদ্র প্রখর হয়ে উঠছে। চারিদিকের দৃশ্যপট প্রখরের তুলিকায় আঁকা। অঙ্কের তৈরি পৃথিবী। পাঁচ হাজার সেলামি, পঞ্চাশ বিঘা জমি। না হয় পঞ্চাশ বিঘার প্রতিটায় আর দু’পাঁচ টাকা করে দেওয়া গেলে সরকারকে গদি-সেলামি। খাজনার হারে দু-পাঁচ আনা ফের-ফার করতে সেই পারবি।

মন যখন কোনো বিষয়ে চঞ্চল হয়ে ওঠে, সমগ্রকে গ্রাস করতে চায়, গভীরভাবে ডুবতেও চায়, তখন সেটা ভঙ্গিতে গোপন রাখা যায় না। আলেফের হাতের লাঠিটা দিগন্তের দিকে কী একটা নির্দেশ করতে গিয়ে একবার আকাশকে কাটছে, আর একবার মাটিকে ফুড়ছে।

চরনকাশিতে পাকা মজিদ ভোলো আর তাকে ঘিরে লাল প্রাচীর দেও। সে তোমার গ্রামের বাইরে চরুয়া ব্যাপার। মানে খানদানি, নাকি; কী যেন বললো রামচন্দ্র-জমিদারের মসনদ।

আলেফ হাসি হাসি মুখে ভাবলো আল মাহমুদ তাকে বোকা ঠকিয়েছে, অকাজের হাঙ্গামায় জড়িয়ে দিয়েছে। সেই একবার ভদ্রলোকের ছেলেরা অনেক কাপড় পুড়িয়ে দিয়ে কাপড়ের দাম চড়িয়ে দিয়েছিলো। গ্রামের লোকরা বোকা ঠকেছিলো। এই হচ্ছে রাজনীতির ব্যাপার। আল মাহমুদ একটা প্রথম শ্রেণীর আহাম্মক। শহরের লোকে ছিনেমা দ্যাখে, তা, সেটা গ্রামে কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *