২২. এরফানের শালা এসেছে

এরফানের শালা এসেছে। তার সঙ্গে গত সন্ধ্যার আলাপের মুলতবী অংশটুকু শেষ করে নিতে অতি প্রত্যুষে আলেফ সেখ ছোটোভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলো। এরফানের শালা আল মাহমুদ অনেক জানে-শোনে। তার কাছেই আলেফ জানতে পেরেছে তার মতো গ্রাম্য লোকদের ছেলেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সম্প্রদায়ের শীর্ষস্থানীয়রা চিন্তা করছেন। পুত্রের ভবিষ্যতের কল্পনায় সুখী হয় না এমন পিতা পৃথিবীতে কে আছে?

কিন্তু তার স্বভাবসিদ্ধ প্রথায় তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আলেফ বিব্রত বোধ করলো। গত সন্ধ্যায় যে-সব আলাপ হয়েছিলো তার মধ্যে ধর্ম সম্বন্ধেও অনেক কথা ছিলো। এ বিষয়ে বয়োবৃদ্ধ আলেফের তুলনায় এরফানের যুবক শ্যালক আল মাহমুদ বেশি উৎসাহ প্রকাশ করেছিলো। পরে কুটুম্বের চোখে হীন প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে ধর্ম সম্বন্ধে বেশ খানিকটা ঝোঁক দিয়েই কথা বলেছিলো আলেফ। নমাজ না করে এত সকালে আসা ভালো হয়নি।

আল মাহমুদ বেরিয়ে এলো।

সে কিছু বলার আগেই আলেফ বলে উঠলো, আজ বড়ো কাহিল লাগলো ভাই, নমাজ পড়া হলো না।

আল মাহমুদ শহরের ছেলে, যুদ্ধে গিয়েছিলো, কিছু লেখাপড়া শিখেছে। মোটরগাড়ির কাজে আছে; উচ্চাভিলাষ আছে কালক্রমে নিজে গাড়ি কিনে ভাড়া খাটাবে। সে কৌশল করে বললো, আমিও গেলাম না মসজিদে। গোসল না করে নমাজে বসতি ভালো ঠেকে না। এখানকার জলে গোসলের সাহস হলো না।

আলেফ স্বস্তি পেলো।আল মাহমুদের চায়ের বন্দোবস্ত ছিলো। চা-তামাকের সঙ্গে গল্প জমে উঠলো।

গত সন্ধ্যার আলাপের একটা বিষয়ের জের টেনে এনে আলেফ বললো, তা তোমার শহরের ফুড় কমিটির সেক্রেটারি তুমি হইছো?

শহরের না, পাড়ার কমিটির। লোকজনের দরখাস্ত নিতি হয়, পাস করতি হয়। যে যত বড়োই হোক কমিটির কাছে না আসে তেল চিনি কাপড় পাওয়ার উপায় নাই। হেঁদু পূজা করবি, তাও আমার কাছে আসতি হয়।

তুমি ভালোই করছে, আল্লা তোমার উন্নতি করবি।

আপনার গাঁয়েও তো কমিটি হবি।

কই? শুনি নাই তো।

তখন আল মাহমুদ ব্যাপারটা আর একটু খুলে বললো। সাপ্লাইয়ের এক অফিসার এসে এ বিষয়ে এরফানের সঙ্গে আলাপ করেছিলো। আল মাহমুদ নিজে এবং তার বোন অর্থাৎ এরফানের দ্বিতীয় স্ত্রী এরফানকে কমিটিতে থাকতে অনুরোধ করেছিলো, কিন্তু এরফান তাদের কথা হেসে উড়িয়ে দেয়নি শুধু বলেছে, চাষার ছেলে চাকরি করছি সেই অনেক। আলেফ বললো, তোবা, তোবা, ওর আর বুদ্ধি হবি নে। নিজের বাপ বড়োবাপকে গাল দেওয়া হয়, তা বোঝে না। কও, মামুদ।

তাছাড়া কী। হলাম বা চাষা। তা বলে কি চেরকালই চাষা। ইংরেজ আসার আগে আমরা ছিলাম ভদ্দরলোক আর হেঁদুরা ছিলো চাষা। তারা লেখাপড়া শিখলো, ইংরেজের চাকরি পালো, ভদ্দরলোক হলো, আর আমরা চাষা হলাম। এখন যদি সব চাকরি আমরা পাই, তাইলে?

কথাটা মনে লাগলো আলেফের। চৌকিতে তিনটি টোকা দিয়ে সে বললো, খুব কইছো।

আলেফ ফুর্সিতে গভীর মনঃসংযোগ করলো। চিন্তার রেখা পড়লো তার কপালে। তাজ্জব! এমন খবরটাও এরফান তার কাছে লুকিয়েছে। এরফান নিজে সেক্রেটারি হতে চায় এমন ধরনের কথা তার সম্বন্ধে আর ভাবা যায় না। একগাল ধোঁয়া ছেড়ে আলেফ বললো, আমার কি মনে হয় জানো, এরফান গোল বাধাবি। সারাজীবন সেকয়ে আসছে–ছাড়ো, ছাড়ো, কাম নি। এতেও তাই কবি।

তা হবি কে? ধরেন যে, গাঁয়ের মধ্যি আপনের ছাওয়ালের মতো ছাওয়াল কার! সে কি চাষার ঘরে মানায়?

আলেফের মনে গত রাত্রিতে কিছুটা উত্তেজনা সঞ্চারিত হয়েছিলো। আজ সকালেই সে দ্বিপ্রহরের মতো উত্তেজনায় পূর্ণ হয়ে উঠলো। ফুর্সিতে ঘনঘন টান দিয়ে সে বললো, তুমি এক কাম করবা ভাই, সে সময়ে আসবা।

সন্ধ্যার পর আলেফ আবার এরফানের বাড়িতে গেলো।

আল মামুদ, আছো না?

না, সে এসফন্দিয়ার গেছে তার গাড়ি চালাতি। এরফান বললো। এটা ব্যঙ্গ, তবে এরফানের বিদ্রুপে সহসা রাগ করা যায় না। আরো মসৃণ হয়েছে তার গলার স্বর, অধিকতর শান্ত হয়েছে। দৃষ্টি। সামান্য কয়েক দিনের নমাজেই এগুলি সে অর্জন করেছে।

আলেফ বললো, ঠাট্টা করে না, কুটুমকে অমন কয়ো না।

এরফান নিঃশব্দে হাসলো কিন্তু মনে মনে বললো, যদি জানতে সে আর তার ভগ্নী কেমন করে মানুষের জীবনের শান্তি ব্যাহত করতে পারে তাদের নিজেদের অন্তরের অসন্তোষ উৰ্গীৰ্ণ করে, তাহলে আমার এই বিদ্রূপকে তোমার প্রশ্রয় বলেই বোধ হতো।

আলেফ বললো, একটা কামে আলাম। খবর শুনছো না?

রোজই শুনতিছি, কোনটা কও?

কমিটি নাকি কী হবি?

হবি তো এই মাসেই।

তাইলে সেক্রেটারি কে হয়?

এরফান সহসা হো হো করে হেসে উঠলো।

যেন কিছুই হয়নি, যেন কিছুমাত্র বিচলিত হয়নি সে, এমনি মুখ করে ফুর্সিটা ঘুরিয়ে নিয়ে নিবিষ্টভাবে ধূম্রজাল রচনা করতে লাগলো আলেফ। এরফানের হাসি থামলে অবশেষে সে বললো, একটা কথা আজ কবো তোমাক। ছাওয়ালের কথা ভাবো? কি বলো ভাবো না?

তা ভাবি, বংশের তো ঐ একই ছাওয়াল। কিন্তুক এ কথা আজ হঠাৎ তোলো কে?

না, তুলি না। ভাবে দেখো, তাই কই। শহর কৈলকাতায় পড়ে তোমার ছাওয়াল। তাক হাকিম-হেকিম করবের চাও। আমার কী দুঃখ যদি বাপ বলে না মানে। কিন্তুক তোমাকেও যদি চাচা গণ্য না করে?

কও কী? এরফান মৃদুমন্দ হাসতে লাগলো।

আলেফ বুঝতে পারলো যুক্তিটা বানচাল হয়ে গেলো।

সে এবার সোজাসুজি কথাটার অবতারণা করলো, তাইলে তুমি সেক্রেটারি হও।

না, ঝামেলা।

তাইলে আমাক হতি হয়।

সে তো মামুদের কথাতে বুঝছি। কিন্তুক গাঁয়ের লোক তোমাক সেক্রেটারি করে কেন?

আলেফ খুব তাড়াতাড়ি একটা প্রত্যুত্তর দিতে গিয়ে থেমে গেলো। ভাবলো, তাই তো, কী জন্য গ্রামের লোকরা বিশেষ একজনকে মনোনীত করে ঠাহর হচ্ছে না। সে করুণ করে বললো, তুমি আমি দুজনে চেষ্টা করলি চরনকাশির ভোট তো পাবোই। আল মাহমুদ আসবি, সেও চেষ্টা করবি। যদি কও, ছাওয়ালেক ডাকি, সেও দু’চার কথা কবের পারবি। কেন্ এরফান, চেষ্টা করবা না?

একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়লো এরফানের। ভাইয়ের জন্য দুঃখ বোধ হলো। এত বয়েস হয়েছে তবু প্রাণের ভিতরটা অল্পবয়সের গরম রক্তে পুড়ে যাচ্ছে। ক্লান্ত সুরে সে বললো, করবো।

আলেফের দাড়িটাকা প্রকাণ্ড মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

গ্রামের সাধারণ লোক যত বিস্মিতই হোক, তবু খানিকটা আগ্রহ নিয়ে শুনলো, মাতব্বরস্থানীয়েরা কথাটা তাচ্ছিল্যভরে উড়িয়ে দিয়ে বললো, তা লিবেন ভোট। অন্য কেউ হলে এতে খুশি হয়ে উঠতো কিন্তু আলেফ এদের সরলতায় বিশ্বাস করতে পারলো না। তার ধারণা হলো, এটা গ্রামবাসীদের একটা কূটকৌশল, তাকে তার উদ্যম থেকে নিরস্ত করে প্রস্তুতি থেকে দূরে রাখার। তাহলেও সেটা নিজের গ্রাম। আসল যুদ্ধক্ষেত্র চিকন্দি। সেখানে লোকসংখ্যাও বেশি। সেখানে দুধের ছেলেরাও টক্ট করে কথা বলে।

চিকন্দির প্রবেশপথে আলেফের দেখা হলো ছিদামের সঙ্গে।

আলেফ বললো, কোন গাঁয়ে থাকা হয়?

চিকন্দি।

হয়? আমার কোন গাঁয়ে থাকা হয় জানো?

জানি, চরনকাশির পাকামজিদ আপনের।

খুশি খুশি মুখে গদগদ স্বরে আলেফ বললো, চেনো তাইলে। তা তুমি কার ছাওয়াল?

শ্রীকৃষ্টদাস।

সে তো বন্ধুলোক আমার। ভালোই হইছে তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে। তোমার বাড়ি যাতেছি।

কেষ্টদাসের বাড়িতে কেষ্টদাস ছিলো, রামচন্দ্র ছিলো। আর আলেফ ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেলো তাদের কথা হচ্ছে কমিটি নিয়ে।

রামচন্দ্র বলছিলো, যে ছাওয়াল, সে হয়তো আবার গান বাঁধবি।

শ্রীকৃষ্ট বললো, তা গান বাঁধলি কী হবি, সব তো চ্যাংড়ামো কথা না। চৈতন্য সা ছাড়া আর কার দোকান আছে সরকারের চোখে পড়ার মতো, কও?

তা হোক আর না হোক। যদি সেসব হয়ই চৈতন্য সাক একটু সাহায্য করা লাগবি। ধরো যে তার তো অন্যায় করছি একদিন, একটু উপকার করা লাগবি। রামচন্দ্র বললো।

ঠিক এই সময়ে মঞ্চাবতরণ করলো আলেফ।

আসেন, আসেন।

আলাম বেড়াতি বেড়াতি। কী দিনকাল হলো কন্?

কথাটা আলেফের মুখে মানায় না। রামচন্দ্র হাসিমুখে গোঁফ চারিয়ে দিয়ে বললো, আপনের তো ভালোই হইছে জোলার ধান।

হইছে, না? কথাটা আলেফ অনুভব করলো, কিন্তু এক মুহূর্তমাত্র। নিজের চিন্তার একপ্রান্তে ধানের রং লাগতে লাগতে আত্মসংবরণ করলো সে। নিঃসংশয়ে কমিটির কথাটা চাপা দেওয়ার কৌশল এটা। আলেফ তাড়াতাড়ি কমিটির প্রান্ত চেপে ধরে বলে উঠলো, আল্লা, আল্লা! দিনকালের কথা কয়েন না, মণ্ডল। জোলাই-বা কি, দোলাইবা কি। ধানপানে আর মন দেওয়া নাই। কমিটির কথা কী কতিছিলেন, কন্ শুনি। বাজে বাজে কথা ক, কাজের কথায় প্রাণের কষ্ট বাড়ে।

রামচন্দ্র বললো, তা কমিটি করতিছে সরকার। সস্তায় নাকি কাপড় দিবি, তেল চিনি দিবি। সোবানাল্লা! সরকার ফেল পড়বি নে? তা পড়ে না বোধায়। সরকার দোকান করবি, সেই দোকানটা পাতে চায় চৈতন সা।

আচ্ছা মজা হইছে। আলেফ যেন পরম কৌতুকে হেসে উঠলো। বাঁচে থাকলে আরও কত দেখবো। কমিটিও কি তাই হবি নাকি, মণ্ডল?

তাই তো শুনি।

আলেফ বারদুয়েক দাড়িতে হাত বুলিয়ে যেন চূড়ান্ত কৌতুকে হা হা করে হেসে উঠলো, তাইলে বুঝলা না, মণ্ডল, আমাকেই আপনেরা দশজন কমিটির হেড করে দেন। হাজিসাহেব রাগ করবি নে বোধায়। তার চায়ে দশ শালের ছোটো হলেও হবের পারি, কিন্তুক দাড়ি আমার বেশি পাকা, কী কন্ গোঁসাই?

শ্রীকৃষ্ট বললো, তা হন, আপনেই হন। একজন হলিই হলো।

রামচন্দ্র, কী কন্?

রামচন্দ্র শ্রীকৃষ্টর মতো লঘুস্বরে বললো, হন না, আপনেই হন।

আলেফ এবার আর হাসলো না। শ্রীকৃষ্ট রামচন্দ্রর মুখ থেকে প্রগর্ভ হাসি যে কথা টেনে বার করেছে কৌতুক করলে সেটা লঘু হয়ে যাবে। আলেফ অনুভব করলো, তার একমাত্র করণীয় হচ্ছে কথাটার চারিদিকে গম্ভীর আলাপের ঠাসা বুনুনি বোনা। ক্রমশ আলাপটাকে টাকার লেনদেনের মতো কঠিন করে তুলতে হবে। গম্ভীর কথাবার্তার মাঝখানে পড়ে দানা বাঁধতে থাকবে কথাটা, অবশেষে প্রতিশ্রুতির মতো নিরেট হয়ে উঠবে।

আলেফ বললো, তামাক খাওয়াবেন না, কেন্ গোঁসাই?

নেচ্চায়। শ্রীকৃষ্ট তামাকের জোগাড়ে গেলো।

আলেফ আবার বললো, কী কথাই শোনালেন আজ, মণ্ডল। কমিটি। তা সত্যি হবি? তা ধরেন যে বুড়া হলাম, ধৰ্ম্মকম্ম করা লাগে, দানধ্যান করা লাগে। গরিব তো। পরের ট্যাকায় যদি খোদার খেদমত হয়ে যায় মন্দ কী। গজবের কালে ইস্রাফিল কবি- আলেফ থামলো, গজবের সময়ে ইস্রাফিল কী বলে সেটা চট করে খুঁজে পেলো না। শ্রীকৃষ্টর হাত থেকে তামাক নিয়ে জোরে জোরে কয়েকটা টান দিয়ে সেবললো, বুঝলেন না, আমি আজ ঢোল দিয়ে বেড়াবো গাঁয়ে গাঁয়ে, রাম-চন্দ্র-শ্রীকৃষ্টরা কইছেন আমাকে কমিটির সেক্রেটারি করবি।

‘তা কন্।

কিন্তু ছিদাম এদের থেকে খানিকটা দূরে উবু হয়ে বসে মাটিতে আঁকিজুকি কাটছিলো। সে মাথা নিচু করে অন্যমনস্ক হওয়ার ভঙ্গিতে বসলেও কান দুটি সজাগ রেখেছিলো। সে বললো, দশজনে মানবি কে আপনেক, আপনি দশজনের কী করছেন?

জ্যাঠা ছেলেটির কথায় ক্রোধের উদ্রেক হয়েছিলো আলেফের। কিন্তু ক্রোধের সময় নয়। এটা। আলেফ যে-সে করে একটা হাসি টেনে আনলো মুখে, বললো, কেন্ করি নাই? শোনো নাই আমার মজিদের কথা? কেন, মক্তবটা দ্যাখো নাই?

বাপ-জ্যাঠার সম্মুখে ছিদাম চুপ করে গেলেও আলেফের বুকের পাশে সে নিয়ত খচখচ করতে থাকলো। ছিদাম যা বলেছে সেটা বোঝার বয়স আলেফের হয়েছে বৈকি।

এরফানকে বলতে ভরসা হয় না। সে হয়তো হাসতে হাসতে বলবে, কে, বড়োভাই,ব্যালে কামড় বসাইছো?

দুতিনদিন চিন্তা করে আলেফ আল মাহমুদকে চিঠি লিখলো : অপর এথা সকল মঙ্গল জানিবা। পরে সমাচার এই, তুমি খৎ পাইয়াই চলিয়া আসিবা। কমিটি এ মাহিনাতেই হইবে। তুমি না আসা ত আমার কোনো গতি নাই।

আল মাহমুদ যে এসব ব্যাপারে অত্যন্ত উৎসাহী সেটা বোঝা গেলো। চিঠি পাওয়ার দুদিন পরেই নিজের কাজকর্ম ফেলে সে চরনকাশিতে এলো। প্রথম দিনটা সে এবাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়ালো, দ্বিতীয় দিনের প্রত্যুষে সে আলেফের মসজিদে জমায়েত ডাকলো।

জন পঞ্চাশ লোক এসেছে। কৌতুকপ্রবণ চাষীদের গালগল্পের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উঠে আল মাহমুদ বললো, ভাইসব, আপনাদেক একটা কথা কবো। এই সুরে বাংলার মালেক হতেছি আমরা মোসলমানরা। ইংরেজ আমাদেক দাবানের জন্য রাজ্য কাড়ে নিয়ে হেঁদুকে বড়ো করছিলো। এতদিনে ইংরেজরা বুঝছে সরকার চালাবের ক্ষমতা হেঁদুর নাই। তাই এখন আমাদের ডাকে নিয়ে রাজ্য চালাবের কইছে। আপনেরা গৈগাঁয়ে থাকে খবর পান না, কৈলকাতা নামে এক শহরে আমরা হেঁদুদেক দাবায়ে দিছি। আমাদের মোসলমান উজির আপনাদেক ত্যাল, কাপড়, চিনি পরাবি। তা কন, মাঝখানে হেঁদুক আসবের দেওয়া কেন্? আমাদের সেখসাহেব এই মজিদ করছে। তার মতো বড়ো মোসলমান কে আছে? মোসলমানদের মধ্যি তার বড়ো কে? তাই কই, চিরকাল ঘেঁদুর দাবে না থাকে, ভাইসব, মাথা উঁচু করে ওঠেন। সেখসাহেবেক কমিটির সেক্রটারি বানান।

শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠলো। অধিকাংশই পরস্পরের কাছে আল মাহমুদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো।

ফিরতি পথে তাদের কেউ কেউ আলোচনা করলো, তাইলে কমিটি তোমার হেলাফেলার না।

না বোধায়।

ভাবেচিন্তে কাম করা লাগে, মামু। কইছিলাম সেখসাহেবেক সেক্রেটারি করবো। সে কথাও আবার ভাবে দেখা লাগে।

কিন্তু আল মাহমুদ চালে একটা ভুল করে বসলো। তার জমায়েতের কথা যখন তিনখানি গ্রামে আলোচ্য হয়ে উঠেছে, যখন আলেফ সেখের নাম লোকের মুখে মুখে ফিরছে, বোড়ের কিস্তি দিয়ে বসলো সে তেরচামুখো ঘোড়ার পথে লক্ষ্য না রেখে। হাজিসাহেবের নাকের নিচে সানিকদিয়ারে তার বাড়ির লাগোয়া মসজিদে নমাজের পরে এক জমায়েত ডেকে বসলো সে।

জমায়েত ভাঙলে হাজিসাহেব আলেফ সেখকে কাছে ডাকলেন।

ছাওয়ালডা কে?

আলেফের মনে খুশি ছিলো। বিগলিত স্বরে সে বললো, জে, আমার ভাই এরফানের কুটুম। উয়ের শহরে ও কমিটির সেক্রেটারি হইছে।

ভালো, ভালো।

আলেফ উৎসাহিত হয়ে বললো, ও খুব ধরছে আমাকে, কয় যে, আপনেও সেক্রেটারি হন গাঁয়ের।

ভালো। কিন্তুক একটা কথা ও চ্যাংড়ামানুষ বুঝবের পারে নাই, তুমি ওক বোঝাও নাই কে? গাঁয়ে সেক্রেটারি হবা ভালো, কিন্তু বাইরের লোক আসে কে? আর কৈলকাতা খেস্টান শহরের কথা এখানে কে?

আলেফের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেলো। সে আশেপাশে চেয়ে দেখলো বহু কান উৎকর্ণ হয়ে, শুনছে হাজিসাহেবের কথা, বহু দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে হাজিসাহেবের উন্নীত তর্জনীর দিকে।

হাজিসাহেব বললেন, সবার মালিক সিরাজদেল্লার কথা কলো। কও, সে বিপদ তো অন্য দেশের লোক আসে। কয় যে তোমরা পাঁচ হাজার কয় শ আর হেঁদুরা চার হাজার কয়শ। তা হউক, হেঁদুক দাবাবা কে? আর তারা কী দাববি? হেঁদুর ছাওয়াল ইংরেজেক দাবায়। তোমার ঐ পাঁচে আর চারে নয় হাজারে দাঙ্গায় যদি ইংরেজ-দাবানো হেঁদুর ছাওয়াল ভেড়ে, তবে তোমার এক হাজার বেশি কী করে? তোবা! তুমি সেক্রেটারি হবা কিন্তু আদমজাদেক পয়মাল করবা কে?

বাড়িতে ফিরে আলেফ গুম হয়ে বসে রইলো।

পরদিন আলেফ আল মাহমুদকে বললো, দ্যাখো, ভাইসাহেব, ও কাম কোরো না।

বিস্মিত ব্যথিত আল মাহমুদ বললো, কন্কী, কেন্? ঘাটে ভিড়ানো নৌকা ডুবায়ে সাঁতার পানি?

গাঁয়ের লোক বুঝবের পারে না।

ইন্‌সে আল্লা। বোঝাবো, বুঝায়ে আমি ছাড়বো। আমি লীগের কাম করি।

আল মাহমুদের বেরুবার পোশাক পরাই ছিলো, সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, এখন আপনার সাথে মেলা কথা কবার টাইম নাই।

যাও কোথায়?

চিকন্দিতে জমায়েত হবি। সান্যালগরে বাড়ির গেটে খানটুক্ জমি আছে সেখানে হবি।

আহা, করো কি?

আপনে না চাইলেও আমার কাম চলবি, এ লীগের কাম।

সে চলে যেতে বিতৃষ্ণায় আলেফ কালো হয়ে উঠলো। সময়ের সঙ্গে দুর্ভাবনা এলো। কিছুটা সময় ধরে আল মাহমুদের রক্তাক্ত আহত দেহ তার কল্পনায় ভাসতে লাগলো।শহরের ভদ্রব্যক্তি বলতে যে নির্জীব শ্রেণীকে বোঝায় তেমন নয় সান্যালরা।

দুপুরের রোদ পড়ে গেলে আলেফ তার মসজিদের সম্মুখে এক টুকরো ছায়াশীতল মাটিতে বসে তার ভাগ্যের কথা ভাবছিলো। কী আশ্চর্য, সবই কি, সকলেই কি তার বিরুদ্ধে যাবে? এই দ্যাখো আল মাহমুদকে সে ডেকে নিয়ে এলো, এখন সে-ই হলো পরম শত্রু। জ্যামুক্ত শরের মতো, সামুদ্রিক কলসের দৈত্যের মতো তাকেও আর বশে আনা যাবে না। এইটাই বাকি ছিলো-সান্যালমশাইয়ের সঙ্গে অকারণ প্রাণক্ষয়ী বিবাদ খুঁজে বার করা।

নির্বাক নিস্তব্ধ মসজিদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আলেফের প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠলো। প্রাণের সবটুকু বেদনা কারো কাছে বলার ইচ্ছা হলো তার। পায়ে-পায়ে এগিয়ে গিয়ে সে প্রথমে মসজিদের বাঁধানো চত্বরে উঠে দাঁড়ালো, তারপর ধূলিভরা পায়ে মসজিদের দরজার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। অশুচি অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করতে দ্বিধা হলো, কিন্তু নিজে যে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা সেখানে প্রবেশ করার দ্বিধা সহজেই সে জয় করতে পারলো। মসজিদের দূরতম কোণটি প্রায় অন্ধকার। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তার দীর্ঘনিশ্বাস পড়লো। তারপর তার বেদনা ভাষা পেলো। বললো সে, খোদা, আমি কী অন্যাই করছি, কও? কমিটির সেক্রেটারি হবের চাই, তা কি গুনাহ্? এই দ্যাখো, আল মাহমুদ কী বিপদে ফেলালো আমাকে। বুক ভাঙে যাতেছে আমার। আর কেউ না বুঝুক, তুমি তো বোঝো? খোদা রহমান, আমার জন্যি কি কমিটির সেক্রেটারি নাজেল-মঞ্জুর করবা না? আর তা যদি না করো তবে আমি যে তোমার কাছে এত কথা কলাম সে যেন কেউ না জানে। আর আল মামুদ যেসব কথা কতিছে সেসব লোকের। প্রাণের থিকে মুছে দেও।

আলেফ সেখের গাল বেয়ে অশ্রু নেমে এলো।

সম্ভবত খোদা রহমান আলেফকে তার প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন।

ঘটনাটা এইভাবে ঘটলো :

এক বিকেলে এরফান সান্যালমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলো। সে দূর থেকেই দেখতে পেলো ঘরের মধ্যে সান্যালমশাইকে ঘিরে চারদিকের গ্রামের কয়েকজন ভদ্র ও অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন ব্যক্তি বসে আছে।

চৈতন্য সাহা দরজার কাছে থেকে বললো, আসেন সেখসাহেব। আপনেদের দুই ভাইকে ডাকার জন্যি লোক পাঠানো হইছে। ফুডের নিসপেক্টার কাল সাঁঝে হঠাৎ আসে উপস্থিত। আজই কমিটি হবি। আমার দোকান থিকে সব বেচা হবি। এখন পারমেট দেওয়ার জন্যি একজন সেক্রেটারি চাই।

চৈতন্য সাহা থামলো। এরফানের বলার কথা অনেক ছিলো, বস্তুত যা বলতে সে এসেছে। সেটা আপনা থেকে উঠে পড়ায় তার সুবিধাই হয়েছে, কিন্তু তিন গ্রামের মুরুব্বিস্থানীয়দের সম্মুখে খপ করে কিছু বলতে তার সৌজন্যবোধে আটকালো।

এই সভায় সানিকদিয়ারের হাজিসাহেব ছিলেন। ইতিমধ্যে তার জন্যে একটি ফুর্সি এসে গেছে। চৈতন্য সাহার চাপা গলার কথা থামলেই তাঁর ফুর্সির মৃদু শব্দটায় আবার সকলের মনোযোগ তার দিকে আকৃষ্ট হলো। অনেক দিনের অনেক হেরফের দেখা মানুষ, তাড়াতাড়ি করে এগোনোর পক্ষপাতী নন তিনি।

তিনি বললেন, ধান কেমন হলো, ও রামচন্দ্র?

ভালোই হবি মনে কয়।

তা আজকাল তোবড়ো বার হই নে। আসতে আসতে দেখলাম রামচন্দ্রর পাড়ায় গোরুবাছুর মানুষজন বেশ মোটা মোটা হইছে।

এরফান বললো, হয়, ওদের দিকে আগুই হইছে।

তা আগুই হলেও যা, নাব্‌লাও তাই। সে গল্প জানো নাকি, মুকুন্দবাবু? হাজিসাহেব হেসে বললেন।

গল্পটা এই : কৃষক বিদেশে গিয়েছিলো, তার বউ বড়ো একলা পড়েছিলো। চাষীবউ ধান ঠেকায়, না অন্য কিছু। এরকম বউ-ঝি গ্রামে থাকলে সেকালে দেওর-সম্পর্কে ছোটো ছেলেরা বড়ো উৎপাত করতো। পাখপাখালির মতো হাসাহাসি বলাবলি করতো। বউ ভাবে ধান যদি আগুই হতো কৃষক তাহলে বোধহয় ঘরে আসে। তার কথা শুনে ধান হঠাৎ আগুই হলো। কৃষক দূর থেকে ধানের গন্ধ পেয়ে আ-আ-হৈ করে দৌড়তে দৌড়তে এসে ধান কাটতে বসে গেলো। ধানই কাটে, ধানই কাটে। একদিন চাষী বউ আবার বললো, হা ঈশ্বর, ধান যদি একটু নাব্‌লা হতো দু’একটা কথা বলা যেতে চাষীর সঙ্গে। সেই থেকে বিরক্ত হয়ে ধান আর কথা শোনে না।

গল্পটা সকলেই উপভোগ করলো।

মুকুন্দ রায় বললো, এখন ধানের আগুই নাব্‌লার খোঁজ নেয় শুধু চৈতন্য।

এই কথাতেই হাজিসাহেব গল্প শুরু করলেন, সেই যে কে সাজিমশাইকে ফোঁটাতিলক সরাতে কইছিলো, তা জানো?

রেবতী চক্রবর্তী বললো, গল্প নাকি?

হাজিসাহেবের দ্বিতীয় গল্প এইরকম : এক সাজিমশাইয়ের কাছে কৃষকরা খুচরো ধান পাঠাতো বিক্রি করতে, অল্প ধান, ছোটো ছেলেমেয়েরাই আনতো। দাম নিয়ে খুব কষাকষি করতো। সাজিমশাই। তা করুক। আরো একটা কৌশল ছিলো তার। দামে না বলেও ধান মাপতো সে, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে বলতো, আরে এতে চার সেরও নাই, পাঁচ সের কি বলিস। যা, যা, এরকম করে ঠকাতে আসিস নে। কৃষকরা বুঝতো কাঠায় করে মেপে দেওয়া ধান লোহার। বাটখারার ওজনে চড়ে বিরক্তিতে কমে যায়। কিন্তু এক ছিলো কৃষক যে বাড়ি থেকে বাটখারায় মেপে ধান পাঠালো সাজির কাছে। তবু তার ছেলে ফিরে এসে বললো, ধান মাপে সেরকে আধপোয়া কম।কৃষক ছুটলো সাজিমশাইয়ের বাড়িতে। সাজিমশা, বাড়িতে? আসো, আসো। সাজিমশাই ঘর থেকে বেরুলো, কপালে মস্ত গোপীচন্দনের তিলক। পরনে লাল পাটকাপড়। সাজসজ্জা দেখে কৃষকের মন গেলো দমে। দম নিয়ে সে বললো, এক কাম করেন সাজিমশায়। উই তিলকডা সরান। কেন্‌? নাইলে ওখানে পা বসানো যায় না।

একটা চাপা হাসি এ-মুখ থেকে ও-মুখে ছড়িয়ে পড়লো। চৈতন্য সাহা অকারণে হেঁ-হেঁ করতে লাগলো। সান্যালমশাই সকার আড়ালে গাম্ভীর্য বজায় রাখলেন।

অন্য সকলের হাসাহাসির সময়ে হাজিসাহেব তার ফুর্সিতে অত্যন্ত নিবিষ্ট হয়ে রইলেন। হাসাহাসি থামলে তিনি আবার কথা বললেন। বললেন, কবে আছি, কবে নাই। এমন চাঁদের হাটে আর বসা হবি নে। শেষবার বসে গেলাম। চোখ বোজার কালে তোমাদের সকলের মুখ চোখে যেন ভাসে। কও, সান্যালমশাই, তোমার মনে নাই সেকালে আমি বুড়া ছিলাম না। তখন তোমার বিলমহল শাসন করতাম, চর দখল করে দিতাম।

মনে আছে বৈকি। সবই মনে আছে।

এইটুক্‌, এইটুক্‌। এখন সভার কথা বলা কওয়া হোক, কাজের কথা হোক।

সভার কাজ যখন শুরু হলো তখন এরফান তার দ্রুতগতিতে বিস্মিত হলো। সান্যালমশাই বললেন, এই ভদ্রলোক দিঘা থেকে এসেছেন। যেসব জিনিসের দাম ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে এবং সাধারণের দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে সেগুলি একটা নির্দিষ্ট দামে, নির্দিষ্ট পরিমাণে, সরবরাহ করা হবে।সরবরাহটা যাতে যথাসম্ভব সকলকে উপকৃত করে সেইজন্যে কমিটি। এরফান, চরনকাশির মত তুমি নিশ্চয়ই জানো, না তোমার দাদার জন্য অপেক্ষা করা হবে?

এরফান কিছু বলার আগেই হাজিসাহেবের ছেলে ছমিরুদ্দিন বললো, আলেফ সেখ নিজেই সেক্রেটারি হবে চায়?

তাই চায় নাকি? সান্যালমশাই যেন আগ্রহে সোজা হয়ে বসলেন, এটা ভালো সংবাদ। তাহলে সেই সম্পাদক হবে। যে উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে আসে তাকে সুযোগ দিতে হয়।

ছমিরুদ্দিনের মুখে বিড়ম্বনার চিহ্ন ফুটে উঠলো। যেটাকে সে বিদ্রূপ হিসাবে ব্যবহার করেছিলো সেটা সান্যালমশাইয়ের কাছে সুসংবাদ হয়ে উঠবে ভাবতে পারেনি সে। কিন্তু তার। বিবর্ণ মুখ সান্যালমশাইয়ের দৃষ্টি এড়ায়নি। তার দৃষ্টিতে কৌতুক চকচক করে উঠলো। তিনি বললেন, ছমির, এ-সব কাজে বরাবরই তোমার উৎসাহ আছে। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। হয়েছো তুমি, এটারও হও। তুমি আর আলেফ দুজনে মিলে দ্যাখো গরিব দুঃখীদের উপকার করতে পারো কিনা। তোমাদের কমিটিতে মুকুন্দবাবুকে নিয়ে, রেবতী আর রামচন্দ্রকে নিয়ো। হাজিসাহেব না থাকলে তো কঠিন ব্যাপারে সব সেরা বুদ্ধি তোমরা পাবে না।

প্যান্টকোট-পরা লোকটি বললো, তাহলে এখানকার কমিটি তৈরি হলো?

সভা সমস্বরে জানালো, তা হয়েছে।

এরফানের সঙ্গে আলেফের দেখা হলো পথে।

এরফান প্রশ্ন করলো, দমদম করে যাও কতি?

আলেফ ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললো, সান্যালমশাই ডাকে পাঠাইছে। তুমি চলে আসলা যে?

থাকে আর করবো কী?

আলেফের মুখ রক্তহীন হয়ে গেলো, তাইলে আমি আর যাই না। মনে কয়, আল মামুদের বক্তৃতার কথা হইছে।

দুজনে বাড়ির পথ ধরলো।

পথ চলতে চলতে এরফান বললো, কেন্ ভাই, সেক্রেটারি হবের চাও?

আলেফ একটা কটু কথা বলতে গিয়ে থামলো৷ তিরস্কার ও অভিমানপূর্ণ দৃষ্টিতে সে ছোটো ভাইয়ের মুখের দিকে খানিকটা সময় চেয়ে রইলো।

এরফান হেসে বললো, হবা তো হও।

তার মানি?

সান্যালমশাই তোমাকে সেক্রেটারি করছে।

আল্লা রসুল!

নীরবে কিন্তু অস্থিরভাবে খানিকটা পথ চলে অবশেষে আলেফ ভাবলো, আল মামুদেক হৈচৈ করবের মানা করো। সে যে না কয় তার বক্তৃতায় কাম হইছে। সান্যালমশাই শুনলে ভাবে কী?

হয়! এরফান বিস্ময়ের ভান করলো, যেন আল মাহমুদের কথা এই প্রথম শুনলো সে।

ওর আর এ-গাঁয়ে থাকে কাম নি, চালান করে দেও।

তিন-চারদিন মোহাচ্ছন্ন অবস্থায় কেটে গেলো আলেফের। পঞ্চম দিনে চৈতন্য সাহা এসে কিছু ছাপানো কাগজপত্র, কিছু বইখাতা দিয়ে গেলো।

চৈতন্য সাহা চলে গেলে ছেলেকে সুখবরটা দেওয়ার জন্য পত্র লিখতে বসলো আলেফ। সুসংবাদটা ফলাও করে বর্ণনা করে অবশেষে সে যা লিখলো তার মর্মার্থ এইরকম :

তুমি একবার এসে দেখে যেয়ো। আর আসবার সময়ে আমার জন্যে একটা টুপি এনো। লাল ফেজ না। কালো লোমলোম একরকম টুপির কথা গতবার বলেছিলে, সেইরকম এনো। আর-এক কাজ করবা, কলকাতায় পাঠান যদি থাকে খোঁজ করবা তারা কাবুলি-পাগড়ি বাঁধে, টুপি পরে। মনে রাখবা আমরা পাঠানবংশের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *