১৬. চরনকাশির জোলানয়

চরনকাশির জোলানয় শুধু সমস্ত গ্রামটাই একদিন পদ্মার গর্ভে ছিলো। কোনো সময়ে হয়তো চিকন্দির মাটি গ্রাস করেছিলো পদ্ম, একসময়ে সে মাটি ধীরে ধীরে চর হয়ে মাথা তুলো। কিন্তু তখনো পদ্মার মনোভাব বুঝবার উপায় ছিলো না। চরের তিন দিকে তো বটেই, চরকে দ্বিখণ্ডিত করেও স্রোত চলতো। কালক্রমে সেই মধ্যস্রোতই জোলা হয়েছে। সমস্ত অঞ্চলটাই চিকন্দির তুলনায় এদিকে ভাষায় দোলা অর্থাৎ নিচু জমি। জোলাটার প্রবাহ একটানানয়। আকাবাঁকা গতিপথের কোথাও কোথাও সেটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কোথাও দু-পাশের জমির চাইতে দু’তিন হাত নিচু; মাত্র একটি জায়গায় বারো মাস জল থাকে। প্রগাঢ়তম বর্ষাতেও এখন জোলা পদ্মর স্বপ্ন দেখে না। ভরা বর্ষার একটা দুটো মাস দু-একটি তালের ডোঙা চলে,দুএকটা জালও হয়তোছপছপ করে পড়ে, কিন্তু তখনো বদ্ধজলায় আগাছার মতো জোলার বুকে আমনধানের মাথাগুলি জেগে থাকে জলের উপরে এক-আধহাত করে। আর চৈত্র-বৈশাখে পিচ্ছিল শ্যাওলা-ঢাকা তলদেশ বেরিয়ে পড়ে; তারপর লাঙলের মুখে মাটি উটে শ্যাওলাগুলি ঢাকা পড়ে যায়, কখনো কখনো গত ফসলের বিচুলির অংশও চোখে পড়ে।

তবু প্রবাদ এই : পদ্মার সঙ্গে এর গোপন সংযোগ আছে। তার প্রমাণ নাকি এই যে, এদিকে বর্ষা নামতে একদিন দুদিন করে যখন দেরি হচ্ছে কিন্তু উত্তরের পাটকিলে জল এসে এক সুত দু সুত করে ফুলতে থাকে পদ্মা, তখন জোলার তলদেশও ভিজে ভিজে ওঠে। আসলে জলটা আসে সানিকদিয়ারের কাটা খাল বেয়ে পদ্মার পুরনো প্রবাহ-পথ থেকে।

তা যতইনা দুর্বল হোক, জন্ম যার মহাবংশে–এরকম একটা মনোভাব হয় আলেফ সেখের।

জোলাটার অনেকাংশ হাজিসাহেব গয়রহের দখলে। সানিকদিয়ারে তার বাড়ি থেকে সোজা পুবে হেঁটে এসে যে বাঁশঝাড় তার নিচে থেকে প্রায় সিকি মাইল জোলা ধরে এগিয়ে গেলে একটা বুড়ো পাকুড় গাছ, তার গোড়া পর্যন্ত জোলাটা হাজিসাহেব এবং তার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর। এদিকের চৌহুদ্দিটা আরও পরিষ্কার করে নির্দিষ্ট করা আছে। পাকুড়ের গোড়া থেকে এপার ওপার বিস্তৃত একটা বাঁধ। এপার থেকে বাঁধ ডিঙিয়ে নামা সহজ নয়। এদিক থেকে বাঁধের উচ্চতা প্রায় চার-পাঁচ হাত, ওদিক থেকে হাত দু-তিন। জোলা যখন টইটুম্বুর তখনোবাধটা আধ হাতটাক জলের উপরে জেগে থাকে।

আলেফ সেখ জোলার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে এসে বাঁধটার নিচে হাজিসাহেবদের চৌহুদ্দির এপারে থামলো। হাতের লাঠিটা দিয়ে বাঁধটার গা ঠুকতে ঠুকতে সে স্বগতোক্তি করলোবোধায় ওপারের জমি আরও ভালো।

আলেফ সেখ একটা প্রবাদ শুনেছিলো, সেটা এই পদ্মার প্লাবন হলেই কেউ না কেউ বড়লোক হয়। পুরনো প্রাসাদ যখন ভেঙে পড়ে তখন পদ্মার জলে ঝনঝন করে লোহার শেকল বাঁধা ঘড়া পড়ার শব্দ পাওয়া যায়। যে ভাগ্যবান দুঃসাহসী সেই আবর্তের কাছাকাছি যেতে পারে, তার আর হা-অন্ন করতে হয় না। বালে যেমন এটা প্রাত্যহিক ব্যাপার বলে মনে হতো, এ বয়সে তেমন হবার কথা নয়। তাহলেও পদ্মার ভাঙাগড়ায় ব্যাপারের সঙ্গে হঠাৎ কারো ভদ্রলোক হওয়ার সম্ভাবনা তার মন থেকে একেবারে মুছে যায়নি। যুক্তির সাহায্যে বরং তার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। পদ্মার গতি পরিবর্তন মানেই জমি ভাঙা আর চর জেগে ওঠা। যার জমি ভাঙে সে নিজের কপাল চাপড়ে চাপড়ে ফাটায়, আর যার ভাগ্যে চর পড়ে তার কপাল আপনি ফাটে-বরাতের বরকত, এক আবাদে বিশ ধান, ধানের মাপের বিশ নয়, বিশগুণের বিশ। সে বারের ব্যাপারটাও পদ্মার কূল ভাঙার মতো হয়েছিলো। হেঁউতি ধানের ফলন দেখলেই মাথা ঘুরে যায় ফসল ঘরে ওঠার আগেই। ঘরে যখন উঠলো ধান তখন মতি স্থির রাখা যায় না।

ঠিক সেই বছরেই আলেফ সেখ আর তার ভাই এরফান সেখ শহর থেকে পেন্সান নিয়ে গ্রামে এসেছিলো। বিদায়ের সময়ে তারা কিছু নগদ টাকা পেয়েছিলো, তারই সাহায্যে বহুদিন। পরিত্যক্ত নিজেদের বাড়িঘর মেরামত করে, লাঙল-বিধে বলদ কিনে, দুই ভাই স্থির করেছিলো জীবনের বাকি কয়েকটি দিন শান্তির দিকে মুখ করে একটানা নমাজে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

গ্রামে আসার পর তাদের নিজ গ্রামের কয়েকজন লোক আলেফ সেখ ও এরফান সেখের কাছে এসে কথায় কথায় বলেছিলো, গ্রামে একটা পাঠশালা ছিলো সেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, যদি দু’ভাই এদিকে নজর দেয় ভালো হয়। পাঠশালায় ধর্মকথা শেখানো হবে, এবং তার নাম মক্তব হবে এই শর্তে আলেফ সেখ নজর দিয়েছিলো। অবশ্য গ্রামে বিদ্যোৎসাহী জনতা ছিলো এমন নয়। আমজাদ, যাকে গ্রামের চাষীরা আড়ালে খোঁড়া মৌলবী বলে, তারই উদ্যোগে ব্যাপারটা হয়েছিলো। সে সরকার থেকে পাঠশালায় শিক্ষকতা করার দরুন বৎসরে তিন কুড়ি টাকা পায়। পাঠশালাটাকে একটু ভালো করতে পারলে সেটা বেড়ে বৎসরে তিন কুড়ির উপরে বারো টাকায় দাঁড়াতে পারে। আলেফ সেখ এর পরে মক্তবের সেক্রেটারি হলো এবং তদারক করে পদ্মার তীর থেকে স্বচ্ছন্দজাত কাশ ও নলখাগড়া কাটিয়ে এনে ঘরটিও মেরামত করে দিয়েছিলো।

এরপরেই এলো ধানের বন্যা। সে এরফানের সঙ্গে পরামর্শ করে ধান কেনাবেচার কাজ করেছিলো। চিরকালের অস্থিরমতি ধানের সে এক অবুঝ পাগলামি। এ-হাটে ধান কিনে ও-হাটে যাও, দু’টাকা ব্যাজ মনে। সাতদিনের দিন ধানের দাম বাড়ে পাঁচ টাকা। কিন্তু ভাটার টান লাগলো ধানের বন্যায়। সে-টান এমন যে চড়চড় করে জমি ফেটে যেতে লাগলো। ধান যেন পদ্মা। সে ভাটার টানে মাথা ঠিক রেখে নৌকো চালানো যার-তার কাজ নয় তো! চৈতন্য সাহা আর তার বাঙাল মাল্লারা ছাড়া আর সকলেই সরে দাঁড়ালো।

আলেফ সেখ এরফানকে ডেকে বলেছিলো, কেন্ রে আর ধান কিনবো?

এরফান জানতো আলেফ ধানের হাত-ফেরতার কাজ করছে। সে বললো, কে, হলে কি? কতকে?

গহরজান তিনপটি দিবের চায়,চৌদ্দ মনের দরে।

সব্বোনাশ! চৌদ্দয় উঠেছে। আর কেনা নাই।

কেন্‌?

এবার নামবি।

নামবি তার কি মানি?

নাইলে মানুষ জেরবার হবি। বাঁচবি কে? খোদাই আর দাম উঠবের দিবে নে, নামাবি।

যুক্তিটা হৃদয় দিয়ে গ্রহণ না করলেও আলেফ ধান কিনতে সাহস পায়নি। কিন্তু পরদিন সকালেই আবার এসেছিলো।

এরফান রে–

কী কও বড়োভাই?

জমি ধরবো?

জমি?

হয়। বিশ টাকায় বিঘা, এক বছরের খাইখালাসি।

ভাবে দেখি।

আলেফ তখনকার মতো চলে গেলো। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে সে জমি কিনবে না। এরফানের সঙ্গে পরামর্শ করার আগেই বুধেডাঙার এক সান্দারের পাঁচ বিঘা জমি সে খাইখালাসিতে রেখে টাকা দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু খটকা লেগেছে তারও, জমির এই স্বল্পমূল্য কি প্রকৃত কোনো ব্যাপার, না জিন-পরীর খেলা। সে অপেক্ষা করতে লাগলো, ঘুরঘুর করে বেড়াতে লাগলো সুযোগের অপচয় করে উদাস ভঙ্গিতে এ-মাঠে ও-মাঠে।

এরকম সময়ে একদিন মাঠের পথে রিয়াছৎ মৌলবীর সঙ্গে তার দেখা হয়েছিলো। রিয়াছৎ তখন রাস্তার পাশ থেকে খানিকটা দড়ি কুড়িয়ে নিয়ে তার লজ্রঝড় সাইকেলটার একটা অংশ মজবুত করছে। আলেফকে দেখে সে প্রীতি সম্ভাষণের ভঙ্গিতে বললো, আদাব সেখসাহেব।

আসলাম্।

ইস্কুলডা কেমন চলতেছে?

কোন্ ইস্কুল?

আপনার সেই মক্তবডা।

আলেফ উত্তর দিতে গিয়ে থামলো। মক্তবটার দিকে সে কয়েক মাস নজর দিতে পারেনি। ধান উঠবার আগে সে স্থির করেছিলো মক্তবের নামে একটা ফান্ড খুলে দেবে। কিন্তু ধান ও জমির ভাবনায় সেদিকে আর কিছু করা হয়নি। রিয়াছতের কথায় আলেফের গা চিড়বিড় করে উঠলো। সে যেন আলেফের পায়ের কড়া মাড়িয়ে দিয়েছে। রিয়াছৎ কিছুদিন আগে সানিকদিয়ারের মসজিদের জন্য কিছু অর্থ সাহায্য চাইতে এসেছিলো, আলেফ বলেছিলো মক্তবের জন্যই তার অন্য কোনো সৎকাজে অর্থব্যয় করার সামর্থ্য নেই। সে কথাটা রিয়াছৎ কেচ্ছার মতো আজগুবি করে ছড়িয়ে দিয়েছে।

আলেফ বললো, চলবে না, কেন্, বেশ চলতেছে, জোরের সঙ্গে চলতেছে।

আজ যে বন্ধ দেখলাম।

তা মাঝে-মধ্যে বন্ধ দেয়াও লাগে।

রিয়াছৎ ফিক্‌ করে হেসে সাইকেলে চড়লো। তার হাসিটা বয়স্ক ব্যক্তির পক্ষে স্বাভাবিক প্রফুল্লতার লক্ষণ নয়।

আলেফ ক্রুদ্ধ হলো। যে কটুক্তিটা মুখে এসেছিলো সেটা চেপে সে রিয়াছকে ডাকলো, শোনা শোনন, রিয়াছৎ।

জে। রিয়াছৎ সাইকেল থেকে নামলো।

তুমি শুনছো নাকি মক্তবটার জন্য দুইশ টাকার ফন্ড করে দিছি?

তা তো দিবেনই, আপনার মক্তব। রিয়াছৎ উদাসীন সুরে বললো।

আলেফ আশা করেছিলো খবরটা শুনে রিয়াছৎ বিস্মিত হবে। আশানুরূপ ফল না পেয়ে সে আবার বললো, ধরো যে দুইশ তো নগদ, এছাড়াও মেরামতরে, বেঞ্চিরে, টুলরে, এ সকলেও খরচ-খরচা আছে।

রিয়াছৎ এবার বিস্মিত হয়ে বললো, দেওয়াই তো লাগে, পাঠানের বংশ আপনার।

বলা বাহুল্য, ফান্ড, বেঞ্চ, টুল এসবই কাল্পনিক বদান্যতা; আলেফ আর কথা বাড়ালো না। পায়ে পায়ে বাড়িতে ফিরে সে ভাবতে বসেছিলো। স্ত্রী এসেছিলো খরচের পয়সা চাইতে, আলেফ বললো, নাই, নাই।

কও কী, এত ধান তুললা?

হয়, ধানই তো।

দুপুরের পরে এরফানের বাড়িতে গিয়ে সে বললো, কও দেখি কী অত্যাচার!

অত্যাচার করলো কে?

আলেফ রিয়াছ মৌলবীর ব্যাপারটা বর্ণনা করলো।

এরফান হেসে বললো, দিলা নাকি এসব?  

তুই কি কস?

ভালো কাজ। কিন্তু এখন মানুষ না খায়ে মরে। এখন এ কী কথা?

বাড়িতে ফিরে খানিকটা সময় আলেফ ভাবলো। হয়তো তার সঙ্গে আলাপ করার আগে খোঁড়া মৌলবীর সঙ্গে মক্তব সম্বন্ধে রিয়াছৎ আলাপ করে এসেছিলো এবং ফাণ্ড ইত্যাদি যে সবই কাল্পনিক এ কথাটা এতক্ষণে প্রচার করতে লেগে গেছে। এবং প্রচার করার সময়ে আলেফের পাঠানবংশ সম্বন্ধেও ইঙ্গিত করছে। এরপরে দু-এক দিনের মধ্যে ফাণ্ড খোলা, মক্তবের বেঞ্চ ইত্যাদি তৈরির ব্যাপারে আলেফের টাকার একটা মোটা অঙ্ক খরচ হয়ে গিয়েছিলো; যদিও ছাত্র বা মাস্টারদের তখন আসবার কথা নয়, আসেওনি তারা।

জমি কেনার পথে প্রথম বাধা হিসাবে এ ব্যাপারটি উল্লেখযোগ্য ছিলো এই মনেহলো এখন আলেফের। জোলার খানিকটা জমি হস্তান্তর হবে এ সংবাদ শুনেই আজ সে পরিদর্শনে এসেছে। কিন্তু সেই দুর্ভিক্ষের বছরের তুলনায় এ বৎসর দাম প্রায় পাঁচগুণ! এখন দাঁড়িয়ে বাঁধের গায়ে লাঠি ঠুকে জমির পরখ করতে করতে আলেফের মনে হলো এছাড়া আরও বাধা ছিলো। রিয়াছৎ মৌলবীর ব্যাপার মিটবার পর কিনি-না-কিনি করতে করতে কাউকে কিছুনা বলে পাঁচ-দশ বিঘা জমি বুভুক্ষুদের কাছে কিনে, গ্রামে যতদূর লেখাপড়া করে নেওয়া সম্ভব তা সব শেষ করে আবার একদিন এরফানের বাড়িতে গিয়েছিলো সে।

এরফান ফুর্সিটা আলেফের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে বললো, বড়োভাই, এদিকে আর আসোনা। কাল গিছলাম তোমার বাড়ি, পাই নাই। জমি কেনার কথা বলছিলা, কিনলা?

অল্প-সল্প কিছু।

 দাম কমে যাতেছে। আল্লা, কী হলো দুনিয়ায়!

এরফানের কথা বলার ধরনটা আলেফের ভালো লাগলোনা। জমির দাম কমা যেন খুব একটু খারাপ ব্যাপার এরকমই তার কথায় মনে হলো। সে কথার পিঠে কথা বললো না।

এরফান বললো, ধান কিন্তুক ছাড়ো না।

তুই সবই উল্টা কস। জমির দাম কম তাও খারাপ, ধানের দাম বেশি তাও ধান ছাড়বো না।

ছয় মাসের খাবার রাখে যা হয় করবা। দুর্ভিক্ষ কতদিন চলবি কে বলবি।

আলেফ এবার পাল্টা প্রশ্ন করলো, তুই জমি কিনলি না?

ভাবছিলাম কিনবো, তা কিনলাম না।

কেন, এমন সুবিধা কি আর কখনো পাবি?

এরফান খানিকটা সময় ভাবলো বড়োভাইয়ের মুখের সম্মুখে কথাটা বলা উচিত হবে কিনা, তারপর ধীরে ধীরে বললো, কে বড়োভাই, ওরা খাতে না পায়ে জমি বেচতিছে, সে জমি কেনা কি অধর্ম না?

আলেফ খুঁতখুঁত করে হাসলো।

অভাবে না পড়লে কেউ কোনদিন বেচে সম্পত্তি, সে সান্দারই হোক আর সান্যালই হোক!

এরফান এ কথাটার যৌক্তিকতা অস্বীকার করতে পারলো না। পৃথিবীর সব ক্রয়-বিক্রয়ের মূলকথা এটা। তবু তার দ্বিধা কাটলো না। সে বললো, আমার আর খানেয়ালা কোথায়, কী হবি জমিতে?

এর ফলেও জমি কেনার প্রবৃত্তি কিছুসংহত হয়েছিলো আলেফের কিন্তু আসল বাধাটা এলো অন্যভাবে।

ঠিক এরকম সময়েই শোনা যাচ্ছিলো খানিকটা জোলার জমি বিক্রি করবে রহমৎ খন্দকার। হাজিসাহেবেরই বংশের লোক রহমৎ। শহরে গিয়ে ভিক্ষা করতে পারবে না, ঘরেও ধান নেই যে তারই জোরে ঘরে থাকা যাবে; ঘরে থাকতে হবে ঘরেরই একাংশ বিক্রি করে।

খবরটা শুনে আলেফ সানিকদিয়ারে গেলো হাজিসাহেবের বাড়িতে। হাজিসাহেব নমাজ শেষে উঠে বসতেই কথাটা সে উত্থাপন করলো। গত কয়েক মাসে হাজিসাহেব আর একটু বৃদ্ধ হয়েছেন, চোখে কম দেখছেন। আলেফের কথা শুনে বললেন, ওরা কি গাঁয়ে থাকা নে?

তা থাকবি।

তবে বাপ বড়ো বাপের জমি বেচে কেন্‌? তা কি বেচা লাগে?

মনে কয় জমি বেচে খোরাকির ধান কিনবি।

হাজিসাহেব দুর্ভিক্ষের খবরটা ভালোরকম জানতেন না। নমাজ, ফুর্সি ও বিশ্রামের গণ্ডিবদ্ধ। জীবনে আজকাল পৃথিবীর সংবাদ কমই পৌঁছায়। তিনি জিভ-টাকরায় চুকচুক শব্দ করে প্রশ্ন করলেন, খোরাকির ধান জমি বেচে, কও কি আলেফ?

হয়, তাই শুনি। আপনে জমিটুক্ রাখবেন?

রহমৎ খন্দকারের বাপ-জ্যাঠার সঙ্গে তারা যতদিন বেঁচে ছিলো হাজিসাহেবের মামলা চলেছে। এ জোলা নিয়েও শরিকানী হুজ্জত কম হয়নি তখন। হাজিসাহেবের কপালের পাশে দু’একটা শিরা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। বড়োছেলে ছমিরুদ্দিকে ডাকলেন তখন, তখুনি যেন জমি সম্বন্ধেই কোনো নির্দেশ দেবেন।

শেষ পর্যন্ত হাজিসাহেব কিন্তু জমি কিনলেন না। এখন বাঁধের উপরে উঠে দাঁড়িয়ে অনিচ্ছুকভাবেই আলেফ মাথাটা নত করে মনে করলো ঘটনাটাকে। একটু পরে হাজিসাহেব বলেছিলেন–না আলেফ, লোভ সামলান লাগে;কামটা ভালোনা। লোকে কবি বিপদে পড়ছিলো আপ্তজন; তাক না দেখে, হাজি তার মাথায় বাড়ি মারলো। তোবা। ছমির, দুই বিশ ধান দেও না কেন্ রহমতেক।

আলেফকে তখন-তখনি বাড়ি ফিরতে দেননি হাজিসাহেব। গোসল, খানাপিনা শেষ করে রোদ পড়লে হাজিসাহেব আলেফকে ফিরবার অনুমতি দিলেন। ধানের কথা, জমির কথা তলিয়ে গেলো। হাজিসাহেব বললেন, কে আলেফ, তোমার বাপের সেই মজিদের কী হলো?

আছে সেই রকমই।

কও কী, কলে যে দুই ভাই পিন্সান পাও।

তা পাই।

এবার তাইলে মজিদের ভিত পাকা, রং করে দেও।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভদ্রতা করে আলেফ বলেছিলো, বেআদপ যদি করছি মাপ করবেন, হাজিসাহেব।

কও কী, আলেফ, তুমি সৈয়দ বংশের। আসছিলা তারই জন্য সুক্রিয়া করতেছি।

কিন্তু জমি জমিই। বিশেষ করে জোলার জমি। একসঙ্গে তিন চাষ। আউস, আমন, কলাই। আউস তোলো, নামুক ঢল। জল বাড়বি, আমন বাড়বি। এক হাত বাড়ে জল, সোয়া হাত আমন। কাটো সোনার আমন।জল কমবি, জল শুকায়ে যাবি। একেবারে শুকানের আগে ছলছলায় কাদায় ছিটাও কলাই। ধরো যে চাষই নাই।

কথাগুলি প্রায় সোচ্চার করে আবৃত্তি করতে করতে বাঁধ থেকে নামলো আলেফ। খুবঠকেছে সে এরকম অনুভব হলো তার। এখন কি আর জোলার জমি টাকায় বেড় পাওয়া যায়। লাঠির আগায় খানিকটা এঁটেল মাটি লেগেছিলো। লাঠিটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে মাটিটুকু আঙুলে করে তুলে ডলে ডলে সে স্পর্শটুকু অনুভব করলো; নাকের কাছে এনে সোঁদা সোঁদা গন্ধটা অনুভব করলো। স্বগতোক্তি করলো সে–এতদিন চাকরি না করে জমির চেষ্টা করলে জোলার অনেকখানি আমার হলেও হতে পারতো।

জোলার উপর দিয়ে সে হাঁটতে লাগলো। কচিৎ কোথাও জলের চিহ্ন আছে; তাছাড়া সর্বত্রই শুকনো পলিমাটি। যখন কাদা কাদা ছিলো জমিটা, তখন গোরুর খুরের গর্ত হয়েছে। দেখে মনে হয় শক্ত। পা দিলে ভেঙে সমান হয়ে যায়।

হায়, হায়, এমন সব জমি পড়ে আছে! তার হলে কি এই দশা হয় জমির। জোলার বাঁধের ওপারে যেমন হাজি গোষ্ঠী, এপারে তেমনি সান্যালরা। এদিকের অধিকাংশ জমি পড়েছে মিহির সান্যালের জমিদারীতে, কিছু খাস, অধিকাংশ পত্তনিতে প্রজা বসানো ছিলো। খাসে তবু কিছু চাষ পড়েছে, প্রজাপত্তনি ভূঁইয়েতে চাষ না হওয়ার সামিল। যারা নেই তারা নেই। দু’সন পরে যারা ফিরেছে তাদেরও অধিকাংশ বাকি খাজনার মামলা-হামলায় কোটকাছারি নিয়েই ব্যস্ত, চাষ হয় কী করে? নানা দিক থেকে বাধা পেয়ে ইচ্ছানুরূপ জমি কেনা তার হয়নি। একটা ক্ষোভের মত হয়ে ব্যাপারটা তার মনে ঘুরতে থাকলো।

জোলা ধরে হেঁটে আসতে আসতে মুখ তুলে দেখতে পেলো আলেফ তার সম্মুখে কিছুদূরে জোলার একটি অংশে চাষ হচ্ছে। দুজন কৃষাণ, দুটি লাঙল। জোলার ধারে একজন ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে। এতক্ষণ সে খেয়াল করেনি যে হাঁটতে হাঁটতে নিজের বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে। জমির অবস্থান লক্ষ্য করেই সে বুঝতে পারলো ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে এরফান চাষের তদারক করছে।

জোলার এই অংশটার প্রায় দশ-পনেরো বিঘা জমি আলেফ-এরফানদের পৈতৃক সম্পত্তি। পৈতৃক সম্পত্তি বলতে অন্যত্র যা আছে পেন্সান নিয়ে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে আপোষে ভাগ করে নিয়েছিলো তারা, কিন্তু এটা এজমালি থেকে গেছে। ব্যবস্থা করা ছিলো চাষ ইত্যাদির সব দায়িত্ব এরফানের, ফসল উঠলে সে ভাগ করে দেবে। কথা ছিলো চাষের খরচেরও একটা হিসাব হবে। সেটা এ পর্যন্ত হয়নি, খরচটা এরফানই করে। আর, সব জমি ভাগ করার পর এটা এজমালি রাখার মূলে একটা মেয়েলি সখ ছিলো। আউস উঠবার পর আমন যখন একবুক জলে দাঁড়িয়ে শিরশির করে তখন জোলায় মাছ আসে, ট্যাংরা পাক্কা তত বটেই, সংখ্যায় নগণ্য হলেও পাঁচ দশ সের ওজনের বোয়ালও কখনো কখনো পাওয়া যায়। জোলাটার অন্যতম গভীর অংশে এই জমি, পলাদ’র পরেই এর গভীরতা। জমিটা ভাগ করে নিলে মাছ ধরার কী উপায় হবে সেখবন্ধুরা তা নিয়ে খুব বিচলিত হয়ে পড়ায় এরফান এজমালি রাখার প্রস্তাবটা তুলেছিলো।

এখন এখানে জল নেই বললেই চলে, যেটুকু ছিলো লাঙলের টানে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। বাঁ পাড় থেকে শুরু করে চষতে চুষতে লাঙলজোড়া তলদেশে পৌঁছে গেছে, এবার ডান পাড়ের দিকে লাঙলের মুখ ফিরবে।

সকালে উঠে যখন আলেফ এই পথ দিয়ে বাঁধের দিকে গিয়েছিলো তখন এখানে লাঙল ছিলো না। এরফানের সঙ্গেও তার দু তিনদিন দেখা হয়নি, কাজেই কবে চাষ হতে পারে এটা জানা ছিলো না তার। কথা বলার মতো দূরত্বে পৌঁছে আলেফ বললো, আজই দিলা চাষ?

এরফান ফিরে দাঁড়িয়ে আলেফকে দেখতে পেয়ে বললো, হয়। দেরি করে কাম কি?

দেরি করার কথাও নয়। জল দাঁড়ানোর আগেই আউস কেটে তুলতে হবে; আষাঢ়ে পনেরো দিন থাকতে থাকতে সামাল করতে হয়। কাজেই চৈত্রের গোড়াতেই জোলায় চাষ দিতে হয়। ধান না হলে আর রক্ষা নেই।

আলেফ বললো, আমি যে জানবেরই পারি নাই।

এরফান বললো, আমিও জানতাম না। আজ পেরভাতে ঠিক হলো। চাষের লোক পায়ে গেলাম দুজন, নামায়ে দিলাম।

আজ লোক পালা, আজই নামায়ে দিলা? খুব যেন আগ্রহ করতিছ?

এরফান বললো, রোজ পাবো এমন কী ভরসা।

কথাটা শুনবার জন্য আলেফ অপেক্ষা করলো না। সে ততক্ষণে চাষ দেওয়া জমিতে নেমে গিয়ে লাঙলের কাছাকাছি ঘুরছে। লাঠিটা একবার শুন্যে উঠছে, একবার মাটিতে বিধছে। খুব ঠাহর করে দেখতে দেখতে মনে হয় তার লাঠিচালনা আর চলায় মিলে একটা ছন্দ তৈরি হচ্ছে। বিচালি থেকে ধান আলাদা করার পর ধান থেকে ধুলো আর চিটে উড়ানোর জন্য কুলোর হাওয়া দিতে দিতে চাষীরা যখন একবার এগোয় একবার পিছোয় সে সময়েও কতকটা এমনি হয়। অভ্যস্ত চোখে স্বাভাবিক বলে বোধ হয়, যারা নতুন দেখছে তারা অনুভব করে ছন্দটুকু।

কখনো লাঙলের পেছনে, কখনো আগে খানিকটা সময় ঘুরে ঘুরে আলেফ অবশেষে এরফানের কাছে ফিরে এলো। তখন তার জুতোজোড়া এঁটেল মাটির প্রলেপ লেগে লেগে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে; পায়জামার পায়ের কাছে কাদা লেগেছে, কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে।

এরফান রহস্য করে বললো, লাঙলের মুঠাও ধরছিলে নাকি?

আলেফ বলল, তা ভালো করছিস আজ চাষ নামায়ে। মিঠে মিঠে রোদ্দুর আছে।

আজকের রৌদ্র গতকালের মতোই। এরফান হেসে বললো, হয়, চিনি চিনি।

আলেফ আবার হাসলো, বললো, মস্করা না, মাঠে নামে দ্যাখ।

তুমি কি আর না দেখে কইছো।

ব্যাপারটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়। দুজনে দাঁড়িয়ে লঘুস্বরে কথা বলাই এর একমাত্র সার্থকতা।

কিন্তু কোনো কোনো মনে সুখ নিখাদ অবস্থায় থাকতে পারেনা। পেন্সান নিয়ে বাড়ি আসবার পর থেকে আলেফের মনের গতিটা এরকমই হয়েছে। আহারাদির পর যখন ভালো থাকা উচিত তখনই তার মনটা খারাপ হয়ে উঠলো। নিষেধের পর নিষেধ এসে তাকে যেন কর্তব্যকর্ম থেকে বিচ্যুত করেছে। সামান্য ওইটুকু জোলাজমির চাষে যদি এত আনন্দ, রহম খন্দকারের জোলাটুকু পেলে কত না গভীর আনন্দ সে পেতে পারতো। ওই সামান্য জমি, তবু সবটুকু তার একার নয়।

এমন অবশ্য শোনা গেছেদু ভাইয়ের এজমালি জমি অবশেষে একজনের অধিকারে এসেছে। এক ভাই খাজনা চালাতে পারেনি, অন্যজন সেই সুযোগে খাজনার ব্যবস্থা করে ক্রমে জমিটার দখল নিয়েছে।

চিন্তাটা পাক খেতে খেতে একটা কল্পনা গড়ে উঠছিলো,কাঁচামাটি থেকে মৃৎপাত্র গড়ে ওঠার মতো। সেটা সম্পূর্ণ গড়ে ওঠামাত্র আলেফের চিন্তা বাধা পেলো। চুরি করে ধরা পড়লে যেরকম মুখ হয় তেমনি মুখ করে সে বললো, তোবা, তোবা। এরফানেক ঠকানের কথা ভাবা যায় না।

কিন্তু এত সহজে ঝেড়ে ফেলার নয়, চিন্তাটা আবার অন্যরূপে ফিরে এলো। জমিটা বিক্রি করে না এরফান? ভাবলো সে। অভাবে পড়া চাষীদের মতো নয়, ন্যায্য দাম নিয়ে হাত বদল করে না?

করে হয়তো, কিন্তু কী করে প্রস্তাব তোলা যায়। এরফান যদি হেসে উঠে বলে–কে, বডোভাই, ট্যাকা যে খুবই হলো? কিংবা ধরো যদি সে রাগ করে? কিংবা পাল্টা প্রস্তাব করে-বড়োভাই, নতুন যা কিনছো আমারও তাতে ভাগ দেও না ট্যাকা নিয়ে।

কাজ নাই লোভ করে–এই ভেবে আলেফ কল্পনাকে সংহত করলো। মনের মধ্যে তবু অসন্তোষ প্রশ্ন তুলো–একবার যাচাই করে দেখলে কী হয়? এতই যদি নির্লোভ এরফান, দেখাই যাক না কী বলে সে।

সন্ধ্যার আগে আগে আলেফ এরফানের বাড়িতে গেলো। এরফানের উঠোনে তখন ধান ঝাড়া চলছে। একদিকে আমন অন্যদিকে আউস ঢেলে দুজন কৃষাণ কুলোর বাতাসে ধুলো চিটে উড়িয়ে বেছন বাছাই করছে। ধুলো আর চিটে আবর্তের মতো উড়ছে। সে সব অগ্রাহ্য করে আলেফ প্রথমে বাঁ দিকের স্তূপটার কাছে গিয়ে একমুঠো ধান তুলে নিয়ে নাকেমুখে খানিকটা ধুলো খেয়ে বললো, আউস, কেন্‌? তারপর ডাইনের পটার কাছে গিয়ে অনুরূপভাবে বললো, আমন, কেন?

এরফান বারান্দায় বসে তামাক টানছিলো, সে হাঁ হাঁ করে উঠলো। কো কি, ধুলো খাও কেন্? আঃ হাঃ!

আলেফ হাসিমুখে বারান্দায় গিয়ে বসলো, এত ঝাড়ো যে ধান?

এরফান কৌতুকোজ্জ্বল মুখে বললো, ধান দেখলেই ঘুরানি লাগে বুঝি? লোক পালেম, ঝাড়ে রাখি।

আলেফ বললো, তোর অত অভরসা কেন্‌? এবারও কি লোকে খাটে খাবি নে?

এরফান ফুর্সিতে মুখ দিয়ে দম মেরে রইলো, তারপর বললো, বড়োভাই, দুনিয়ার হাল কে কবি কও? আদমজাদ পয়মাল হয় না খায়ে। শুনছো না খবর? লোক দেশ ছেড়ে যাতেছে।

দেশ ছাড়ে কনে যায়?

কে, শোনন নাই? ওপারের কলে নাকি মেলাই লোক নিতেছে।

গাঁয়ের সব লোক খাবি এত বড়ো পেট কোনো কলেরই নাই, তা তোক কয়ে দিলাম।

তা নয় নাই। সময়মতো হাতের নাগালে তোক না পালে সময়মতো তোমার চাষও হয় না, ধান ছিটানোও হয় না। কে খোঁজ করে দেখলেই পারো বুধেডাঙায় কয়ডা লোক আছে। কয়জন খেত আর লাঙল এক করলো, কও।

কথাটা মিথ্যা নয়, ভাবলো আলেফ। শুধু বুধেভাঙা কেন, চিকন্দি, চরনকাশি আর সানিকদিয়ার কোথাও যেন চাষের তাগাদা নেই এবার।

নিস্পৃহ উদাসীন ভাব যেন কৃষকদের। এরফানের একক প্রচেষ্টার কথা ছেড়ে দিলে জোলাতেও আজ পর্যন্ত চাষ পড়লো না।

আলেফ বললো, হয়, শুনছি। চৈতন সার জমিগুলোতে এবার কেউ চাষ দিবের চায় নাই। মিহির সান্যালও জমি সব খাস করতেছে। লোক পাওয়া কঠিন হলেও হবের পারে। তাইলে আমার জমিতেও চাষ ফেলা লাগে। এজমালিডার ধান ছিটানে কবে করবি?

কাল লাঙল, পরশু মই, তরশুদিন ধান বই।

রঙ্গ রাখেক। বেছন ঝাড়তিছিস?

ঝাড়া লাগে না?

লাগে না কে। আমার নতুন কেনা জমিগুলোতেও কালই চাষ দিবো, কি কস? রাখাল পাঠায়ে আজই লোক ডাকাবো। তা শোনেক এরফান যত ধান ঝাড়ছিস সব তো তোর জোলায় লাগবি নে।

না, তা লাগবি নে।

তাইলে আমার জমিটুকের জন্যে খানটুক রাখিস।

এরফানের হাসি পেলো। তার বড়োভাই যতদিন চাকরি করেছে ততদিন তার এ পরিচয়টা ঢাকা ছিলো। এখনো খরচের জাঁক তারই বেশি। মক্তব করা, মসজিদ তোলা, এসব পরিকল্পনা এরফানের মাথায় আসে না। অথচ এই সামান্য সামান্য ব্যাপারে আলেফের ব্যয় সংকোচের চেষ্টাও হাস্যকর।

তা রাখবো। বললো এরফান হাসিমুখে।

ফুর্সিতে আর দু’একটি টান দিয়ে উঠে দাঁড়ালো আলেফ, বললো, তাইলে আর বসি না। চাষ কালই দি। বুঝিস না গত সন সান্দারদের জমিতে এক ফসল পাইছি। এবার দু ফসল তোলা চাই।

বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে সে বললো, মনে রাখিস বেচনের কথা।

বাড়িতে পৌঁছে সে দেখলো, তার স্ত্রী কুপি ধরে পথ দেখাচ্ছে আর রাখাল ছেলেটি গোরুবাছুরগুলো গোয়ালে তুলছে।

দরজার কোণে লাঠিটা রেখে সে গোয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মনটা তার খুশি খুশি হয়ে উঠেছে। চাষ, চাষ। একটা প্রত্যাশায় অন্য সব অভাববোধ সাময়িকভাবে মন থেকে স্থানচ্যুত হয়েছে। স্ত্রীকে হকচকিয়ে দিয়ে সে হাঁই হাঁই করে বললো, কে, জমি কিনবা, চাষ দিবা না?

বুঝতে না পেরে স্ত্রী বললো, আমি কি মানা করছি?

তা করো নাই, বুদ্ধিও দেও নাই।

স্ত্রী তার মনোভাব বুঝতে না পেরে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো।

স্ত্রীকে ছেড়ে আলেফ রাখালকে আক্রমণ করলো, শালা গিধর, শোনেক!

জে।

জের কাম না। তোর বাপ দাদাক কাল আনবি।

জে, যদি না আসে?

তুমি এ মুখ হবা না, হাড় ভাঙে দেবো তোমার।

রাখাল ছেলেটি মনিবের আকস্মিক রূঢ়তায় ফ্যালফাল করে চেয়ে রইলো।

বোঝ নাই আমার কথা? কাল তোর বাপ-দাদাক আনাই চাই।

ছেলেটি পলায়নের ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করলো। সে চলে যেতেই আলেফের স্ত্রী বললো, নেশা করছো নাকি বুড়াকালে, আচমকা ছাওয়ালোক তাড়লা।

তাড়লাম কই। রঅস্য করলাম। বুঝলা না, কাল ধরে যে তোমার জমিতে চাষ দিবো। ওর বাপ-দাদা না হলি চাষ করে কেডা।

চাষ দিবার জন্যে বউয়েক আর রাখালকে মারপিট করতি হয়? ও, মনে কয়, কাল আসবি নে, বাবা-দাদাক আনা দূরস্তান।

কও কি!

আলেফ বাইরে এসে দাঁড়ালো। চৈত্রের চাঁদের আলোয় ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে রাখাল ছেলেটি হেঁটে যাচ্ছে। আলেফ ডাকলো, ছোবান! উত্তর না পেয়ে মুখের দু পাশে হাত রেখে আলেফ হাঁক দিলো, ছু-বা-না!

জে-এ-এ।

বাপ আমার–শো-নে-ক।

ছেলেটি কাছে এলে আলেফ বললো, তোর আজি ডাকতিছে রে, জলপান দিবি। রাখাল ছেলেটির হাত ধরে বাড়ির ভিতরে এনে স্ত্রীকে বললো আলেফ, দুডে জলপান দেও না।

এখনই তো গরম ভাত রাঁধে দিছি।

তা হোক, তা হোক। কাল কত খাটবি-খোটবি। দেও, দুড়ে দেও।

রাখাল ছেলেটির কেঁচড়ে জলপান এসে পৌঁছুলে আলেফ বললো, ছুবান আমার সোনার ছাওয়াল। কাল তোমার বাপ আর দাদাক আনবা, কেমন? কবা যে, কী যেন কও তুমি, কবা যে সেখের বেটা ডাকছে তোমাদেক। তার বুধেডাঙার জমিতে চাষ দিবি।

ছেলেটির মুখে এবার হাসি দেখা দিলো।

আহারাদির পর আলেফ স্ত্রীকে বললো, তুমি শোও, আমি আসতেছি।

রাত করে জমি দেখবের যাও নাকি?

শোও না, শোও। আমি আসতিছি।

ঘর থেকে বেরিয়ে যেখানে লাঙল-বিঁধে থাকে খানিকটা সময় সেখানে অকারণে ঘোরাঘুরি করে আলেফ মসজিদটার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। লম্বা চওড়ায় বারো-তেরো হাত, টিনের ছাদ, বাঁশের চার উপরে মাটিলেপা বেড়ার ঘর, পাশে একটা পাতকুয়া। এই মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেছিলো আলেফের বাবা। প্রধানত এটা পারিবারিক উপাসনার জন্যই ব্যবহৃত হবার কথা। কখনো কখনো গ্রামের লোকরাও আসে। প্রবাদ এই যে, চরনকাশি ও বুধেডাঙার নতুন মাটিতে লাঙল দেবার নেশায় যখন আদমজাদরা রহমান খোদাকে বিস্মৃত হয়ে গেলো তখন আলেফের বাবা এ দুটি গ্রামের প্রতিষ্ঠাকে শয়তানের দৃষ্টি থেকে দূরে রাখার জন্য প্রায় একক চেষ্টায় এই মসজিদ স্থাপন করে তৎসংলগ্ন পাঁচ-ছ কাঠা জমি পৃথক করে রাখে। আলেফ চাকরি থেকে ফিরে কিছু অর্থব্যয় করে এটাকে আবার ব্যবহারযোগ্য করেছিলো কিন্তু জমির দিকে নজর দিয়ে মসজিদকে বাঁধিয়ে পাকা করার পরিকল্পনা কাজে আসেনি। ফকির বোধ হয় চেরাগের তেল পায়নি আজ। বার্ধক্যের দরুন ঘুমও হয় না, মসজিদের বারান্দার একটেরে চুপ করে বসে আছে।

দুর্ভিক্ষের বৎসরে বোধ করি আহারের আশায় ফকির এই দেশে এসেছিলো। কিন্তু কেউই তাকে আশ্রয় দেয়নি। অবশেষে সে এই মসজিদের কাছে এসে বসে পড়েছিলো। ময়লা ঝুলঝুলে আলখিল্লা আর ছেঁড়া ছেঁড়া কথাগুলো বয়ে বেড়ানোর ক্ষমতাও তার আর অবশিষ্ট নেই তখন। অন্ধকারে লোকটিকে বসে থাকতে দেখে আলেফ রাগ করে বলেছিলো–কে ওখানে?

ফকির ভীতও হলো না, আগ্রহও দেখালো না।

আলেফ উঠে গিয়ে তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো–এখানে কী হতিছে?

–বাবা—

–ভিক্ষা-শিক্ষা এখানে নাই।

–ভালো, বাবা, ভালো।

–নিজেই খাতে পাই না।

–ভালো, বাবা।

–গ্রামের বড়ো বড়ো লোক আছে, উঠে দেখেন।

–তা বেশ, বাবা। আজ রাত থাকি। গ্রামের লোক কলে সৈয়দবাড়ি এটা।

–হুঁ। কী ক’লে?

–সৈয়দবাড়ি।

–হুঁ, সৈয়দবাড়ি। ওয়াজীব।

আলেফ দম্-দম্ করে পা ফেলে অন্দরে গিয়ে বললোলোক না খায়ে মরে দরজায়। স্ত্রী বললো–আমি কী করি কও। আমি মরতে কই নাই।

-–ও কি যাবের আসছে মনে করো? নড়বি নে, থাকবি। খাবের তো দেওয়া লাগবি। ওর জন্যি পাক, মনে কয়, করা লাগে।

সেই থেকে ফকির মসজিদে আছে। প্রথম দু’চার দিনের পর আলেফ নিজের অকারণ অর্থব্যয়ে বিরক্ত ও শঙ্কিত হয়ে ফকিরকে প্রকারান্তরে স্থানত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলো, এমনকী একবেলা আহারও বন্ধ করে দিয়েছিলো। কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। নির্বিরোধ ফকির। যা বলল তাতেই ‘তা বেশ, বাবা’ ছাড়া অন্য কথা মুখে নেই। একটা দিকে অবশ্য সুবিধা হয়েছে, ফকির মসজিদের যত্ন করে। দাওয়া ও ঘরের ভিতরে নিকিয়ে ঝকঝকে করে রাখে। ঘঁাচার বেড়া থেকে মাটির প্রলেপ খসে গেলে নিজেই কাদামাটি ছেনে আস্তর লাগায়। মোটকথা মসজিদ সম্বন্ধে আলেফ নিশ্চিন্ত।

আলেকোম সেলাম।

আশ্লাম আলাইকুম। আলোয় ঘুরতেছেন? ফকির প্রশ্ন করলো মৃদুস্বরে।

আপনের কাছে আসছিলাম। কাল জমিতে চাষ দিবো কিনা।

তা বেশ, বাবা, বেশ।

ধরেন যে আমি তো চৈতন সার মতো মানুষকে জেরবার করি নাই। নগদ দামে জমির স্বত্বও কিনছি, জমিদারের হালতক খাজনাও শোধ করছি।

চাষবাসের কথা আমি বুঝি না বাবা, সেই কোন বয়সে ঘরবাড়ি ছাড়া।

তা না। ধরেন যে বছরের প্রথম খন্দের চাষ। তা ধরেন মৌৎ, হায়াৎ, দৌলৎ, এ তো ধরেন যে মানুষের কাছে থাকে না।

খোদার ফরমায়েস, বাবা।

ধরেন যে মজিদের কাছে আসে একবার তো অনুমতি নেওয়া লাগে।

বেশ, বাবা, বেশ।

.

স্বামী বিছানায় এলে আলেফের স্ত্রী প্রশ্ন করলো, সাঁজে কতি গিছলা?

এরফানের বাড়ি।

কেন?

কথাটা আবার মনে হলো। আলেফ বললো, এজমালিডার সবটুক যদি আমার হতো!

না হলিই বা ক্ষতি কী?

ক্ষতি কী, হলে বৃদ্ধি ছিলো।

ও পক্ষ থেকে কোনো উৎসাহের সঞ্চার হলো না। আর তাছাড়া তখনকার মন আর সকালের মনে পার্থক্য আছে। বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাষের টুকিটাকি বিষয়গুলি শোভাযাত্রা করে তার মনের উপর দিয়ে চলতে লাগলো। লাঙল ঠিক আছে কিনা, মইয়ের দুখানা কাঠ ভেঙে গেছে, কাল সকালে ছোবানের বাপ-দাদা দুজন এলে তাদের জলপান দেওয়া উচিত হবে কিনা।বলদ দু জোড়াকে এতদিন দেখা হয়নি, কাল তারা লাঙল কীরকম টানবে কে জানে। ছোবানের বাপ-দাদা আসবে তো? শেষের এই প্রশ্নটা অনেক সময় ধরে মনের মধ্যে পাক খেয়ে ঘুরলো। এরফানের কথায় ভয় হয় কাজের মানুষ পাওয়া যাবে না।

এ চিন্তাগুলি শেষ করে আলেফ সদ্য চাষ-দেওয়া জমিগুলির চেহারা কল্পনা করতে লাগলো। বুধেভাঙার যে জমিগুলিতে কাল চাষ দেওয়ার কথা সেগুলিকে ভুলে গিয়ে আবার জোলার কথাই চিন্তা করতে লাগলো সে। মানুষের দুখানা হাত একত্র করে যাচ্ঞার ভঙ্গি করলে যেমন দেখায় অঞ্জলিটা, তেমনি যেন জোলার চেহারা। কালো রঙের একজন চাষী অঞ্জলি পেতে আছে। সেই অঞ্জলি ভরে উঠবে ধানে, জলে, কলায়ে।

আলেফ খুশি খুশি মুখে ঘুমিয়ে পড়লো।

.

সব জমিতে আউসের চাষ হয় না। নতুন পুরনো মিলে আউসের সব জমিতে চাষ দেওয়া শেষ করে, ধান ছিটানো শেষ করে এদিকে-ওদিকে চাইবার অবকাশ পেলো আলেফ। চৈতন্য সাহার নামে গান বেঁধেছে ছেলেরা, সেটা কানে এলো তার। প্রথমে শুনে ছেলেদের উপরে রাগ হয়েছিলো। পরে একসময়ে সে কৌতুক বোধ করলো। এরকম সময়ে একদিন চৈতন্য সাহার সঙ্গে মাঠের মধ্যে তার দেখা হয়ে গেলো। সেদিন সন্ধ্যার পর এরফান এসেছিলো। প্রাথমিক আলাপের পরই আলেফ বললো, শুনছ না গান?

কিসের?

চৈতন সার নামে বাঁধেছে। রাখাল কতেছিলো।

হয়, শুনছি। তোমার ছোবানই আমার উঠানে নাচে নাচে শুয়ে আলো।

কাণ্ড! বলে আলেফ খুঁতখুঁত করে হাসলো।

এরফান বললো, এবার যদি তোমার নামে বাঁধে।

সোবানাল্লা, কস কী?

তুমিও তো কিনছে কিছু কিছু জমি, কিছু খাইখালাসিতে রাখছো।

কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, খানিকটা সময় ভাবলো আলেফ।

কস কী, সে তো মুশকিল। তাইলে তো কোনো ব্যবস্থা করা লাগে।

ব্যবস্থা আর কী করবা? এত যদি ডর হাই-হুঁই করে বেড়াও কেন, বয়স তোমার বাড়তিছে না কমে?

কেন রে, কী বাঁধবি গান আমার নামে?

কেন, তুমি নিজেক সৈয়দ কও, তাই নিয়ে যদি চ্যাংড়ামো করে।

তাই করবি নাকি?

করবি তা কই নাই, করবের পারে তো।

আলেফ বিরক্ত হয়ে বললো, মানুষ কি মজিদের ফকির-তার নড়াচড়া নাই?

এরফান এবার হাসলো। ফুসিঁটায় সুখটান দিয়ে দাদার দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ছোটোকালে বাজান যখন এক হাতে লাঙল ধরছে তার থিকে এখন অনেক বাড়ছে। আর কেন, এবার সাজায়ে গুছায়ে আরাম করো। ছাওয়াল বড়ো হতিছে। সে কি চিরকালই মামার বাড়ি থাকবি?

মামার বাড়ি থাকবি কে। গরমের বন্ধেই তো আসবি।

তা আসবি। কী লেখছে জানো?

কই, চিঠি তো পাই নাই আজকালের মধ্যে।

তার চাচীক লেখছে কোলকাতায় নাকি পড়বের যাবি। এট্রেন্স পাস করে সে থামবি নে।

হয়, হয়, পাস করুক! তার পাস করার ব্যাপারটা আলেফ বিশ্বাস করে না।

পাস সে দিবি, নইলে অমন কথা লেখে না। লেখছে কলারসিপ না পালেও সে পড়বি। চাচী যেন চাচাক কয়ে রাখে।

ছেলের কথায় কিছুকাল আলেফ অন্যমনস্ক হয়ে রইলো। সেদিন এরফান উঠে দাঁড়ালে আলেফ বললো, চৈতন সার মত গান যদি বাঁধে, চুপ করে থাকাই ভালো হবি, তাই না?

এরফান বললো, সে তখন দেখা যাবি।

এরফান চলে গেলেও খানিকটা সময় আলেফ বসে বসে চিন্তা করলো–কী সর্বনাশ! কয় কী! ছাওয়াল যদি সে গান শোনে, কী কবি?

রাত্রিতে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আলেফের অভিমান হলো। ছেলে মামার বাড়ি থেকে পড়ে, তারও আগে নিঃসন্তান চাচার কাছেই মানুষ হয়েছে। আলেফকে বহুদিন পর্যন্ত ভয় করে এড়িয়ে এড়িয়ে বেড়াতো। সেসব অল্পবয়সের ব্যাপার। এখন ছেলে বড়ো হয়েছে, তার বাপ মা চেনা উচিত।

আলেফ বললো, কে, ছাওয়ালের মা? তোমার ছাওয়াল নাকি পাস দিবি?

হয়। ওর চাচা কলে মেট্টিক না কী পাস দিবি।

হুম।

কী কও?

বলি ছাওয়ালডা আমার তো?

তার মানি?

মানি আর কি? দুনিয়ার লোক জানে ছাওয়াল পাস দিতেছে, আর আমি জানবের পারলাম না।

তোমাক তো লেখছে। তুমি তো চিঠি হাতে পায়েও চালের বাতায় গুঁজে রাখছিলে, গোঁজাই আছে। সে পেরায় একমাস।

কাল সকালে দিবা। পড়বো। সে নাকি কোলকাতায় পড়বের যাবি।

হয়। ওর ছোটো চাচী কলে, ডাক্তারি পড়বের চায়।

ডাক্তারি! আল্লা, আল্লা, কয় কী? লোক মারে শেষ করবি তাইলে। কিছুকাল চিন্তা করে আলেফ বললো, কে, ঘুমালে?

না, কী কবা?

কেন, আমি কি কিছু কবের জানি না।

কোনোদিন কও নাই।

আলেফ রসিকতার চেষ্টা করে বললো, তোমাক হেঁদুদের আয়োস্ত্রীর মতো দেখায়, কই নাই?

কইছো। স্বামী যখন বাঁচে আমি তখন আয়োস্ত্রী না তো বিধবা হবো নাকি?

চাকরির একসময়ে আলেফকে দীর্ঘকাল হিন্দুপল্লীতে বাস করতে হয়েছিলো। আলেফের স্ত্রীর মিশুক স্বভাবের জন্য হিন্দুমেয়েরা আলেফের বাড়িতে যাতায়াত করতো। কেন তা বলা যায় না, আলেফের স্ত্রী তাদের কাছে লেস বোনা জামা সেলাই করা যেমন শিখেছিলো তেমনি পায়ে আলতা দিতে প্রথমে, পরে কপালে সিঁদুরের টিপ দিতে। এখন অবশ্য সে আলতা বা সিঁদুর ব্যবহার করে না কিন্তু এঁটোকাঁটার বাছবিচার করে। এবং অত্যন্ত কৌতুকের ব্যাপার, কোনো মাংসই খায় না। একসময় ছিলো যখন আলেফ এসব নিয়ে বিদ্রূপ করেছে স্ত্রীকে কিন্তু স্ত্রীর নির্বিরোধ দৃঢ়তাই জয়লাভ করেছে শেষ পর্যন্ত। এসবের গোপন কারণ অবশ্য এরফান জানে। আলেফের স্ত্রী তার ছেলের মঙ্গল কামনা থেকে মাংস খায় না। এটাকে এরফান প্রকাশ্যে সমর্থন না করলেও মনে মনে প্রশংসা করে।

আলেফ বললো, কাল সকালে চিঠি দিয়ো, দেখবো ছাওয়াল তোমার কত লায়েক হইছে।

ওরকম করে কথা কও কেন, ছাওয়াল এখন বড়ো হইছে।

আট-দশদিন পরে আলেফের মনে হলো ছেলেকে একটা চিঠি লেখা দরকার। সহসা এ কর্তব্যবোধটা জাগ্রত হওয়ার কারণ আগের দিন সন্ধ্যায় এরফানের সঙ্গে আলাপ করে সে বুঝতে পেরেছিলো ছেলেকে কলকাতায় রেখে পড়ানোর অর্থ মাসে সত্তর-আশি টাকা খরচ।

আলেফ আঁতকে উঠে বলেছিলোকস কি? সে যে আমার পিন্সানের সব টাকা দিলেও হয় না।

–তা কি করবা। ছাওয়ালেক ডাক্তার করতি গেলে তা লাগে।

আলেফ নিজের অর্থকৃচ্ছতার কাল্পনিক ও অর্ধসত্য কাহিনী দু-একটি উত্থাপন করেছিলো কিন্তু এরফান এতটুকু সহানুভূতি দেখায়নি। বরং ভয় দেখিয়েছিলো বেশি জোরজার করলে ছেলেই হাতছাড়া হবে। এরকম ভালো ছেলে এরকম ঘরে সব সময়ে হয় না। তার মামাবাড়ির দেশের যে কোনো সচ্ছল গৃহস্থ জামাই করে ছেলেকে ধরে রাখতে পারবে, পড়াতেও পারবে।

রাত্রিতে অনেকটা সময় সে চিন্তা করে স্থির করলো ছেলেকে বাড়িতে এনে নিজের খপ্পরে পুরতে হবে, তারপর অন্য কথা।

খুব সকালেই গ্রামের ডাকঘরে চিঠি পোস্ট করতে গিয়েছিলো আলেফ, এরফানও বেরিয়েছিলো লোহারের দোকানে নিড়ানি তৈরি করানোর জন্যে।

ফিরতি-পথে এরফান হঠাৎ থেমে দাঁড়ালো। তার সম্মুখের ঘাসবনটা দুলছে, ভিতর থেকে। একটা ঘোঁত ঘোঁত শব্দও উঠছে। শুয়োর না হয়ে যায় না। এরফান নিঃশব্দে সরে যাবার চেষ্টা করছিলো, এমন সময় সে জঙ্গলের মধ্যে সবুজে রঙের আলখিল্লা ও শাদা দাড়ির কিছু কিছু দেখতে পেলো।

সোভানাল্লা, বড়োভাই! কী করো?

কথাটা শুনতে পেয়ে আলেফ থেমেছিলো, রাস্তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে এরফানকে দেখতে পেয়ে হাসি হাসি মুখে বললো সে, বুঝলি না, লটা ঘাস! কুশেরের মতো লাগে। ছোটোকালে খাইছিস মনে নাই।

তা খাইছি, কিন্তু এখন কি তুমি আবার ছোটোকালের মতো কায়েফলা আর লটা খায়ে বেড়াবা নাকি?

না, না, আমি খাবো কেন্‌? গোরু ভালো খায়।

তোবা। গোরুর ঘাসও কাটবা?

আলেফের মতি স্থির করা কঠিন হলো। ঘাস তুলে তুলে ইতিমধ্যে সে ছোটো একটা আঁটি করে ফেলেছে। করুণ চোখে একবার ঘাসের আঁটির দিকে, একবার এরফানের মুখের দিকে চাইতে লাগলো সে।

থাক থাক, মায়া ছাড়তে না পারো-বাড়ি যায়ে রাখালেক পাঠায়ো।ও আর তোমাক মানায় না।

বিপর্যস্ত আলেফ এরফানে পিছন পিছন চলতে চলতে বললো, ঠিকই কইছিস।

এরফান সে কথায় ফিরে না গিয়ে বললো, ছাওয়ালেক চিঠি লিখলা?

লেখলাম!

গালমন্দ করে নাই তো?

তা করবো কেন।

বাড়ির প্রায় কাছাকাছি এসে আলেফ বললো, ডাকঘরে যায়ে এক কথা শুনে আসলাম।

কী কও?

জমি কিনবি?

জমি-জমি, আবার বুঝি ঘুরানি লাগছে। গান তাইলে ওরা এখনো বাঁধে নাই।

না, না, তাই কই নাই। শুনলাম রামচন্দর মণ্ডল জমি বেচে। বুঝলি এক লপ্তে আট-দশ বিঘা কি তারও বেশি হবের পারে। এ-তো না-খাওয়ার সুঁই না। ন্যায্য দামে কিনব, তার কী কথা কে কবি। আর জমি বুঝলি না, সে যেন কথা শুনে ফসল দেয়। রামচন্দরের জমি!

জোত্‌দার হবের চাও?

জোত্‌দারি আর কনে, একটুক বাড়ায়ে বাড়ায়ে খাতে হয়।

জমি কিনবা, লটা ঘাসও বাঁধবা, এ কেমন বুঝি না।

আলেফ আবার চুপ করে গেলো।

একই বাপ-মায়ের সন্তান আলেফ এবং এরফান সেখ। আলেফ বড়ো, এরফান ছোটো। দু ভাই একই সঙ্গে প্রায় একই অফিসে চাকরি করেছে, একইসঙ্গে পেন্সান নিয়ে ফিরেছে গ্রামে। কথাটার চারিদিকে এক পাক ঘোরা দরকার। ইস্কুলের মাঝামাঝি এসে সে পথে দুজনের কেউই আর চললোনা। আলেফ প্রায় তখন তখনই সরকারি কাজে লেগে গেলো, আর এরফান লাগলো পৈতৃক চাষবাসের কাজে। সকালে গোরু তাড়িয়ে নিয়ে মাঠে যেতো, আর সন্ধ্যায় ফিরতে গোরুগুলিতে তাড়াতে তাড়াতে। তখন তার মুখে না ছিলো সুখের চিহ্ন, না ছিলো বিমর্ষতা। তারপর তার সরকারি চাকরি হলো আলেফের চেষ্টায়। উন্নতিও হয়েছিলো, পিওন থেকে বাবু, এগারো থেকে একশ দশ।উন্নতিটা জোগাড়ের বেলাতেও ছিলো আলেফ।কাকে কোথায় তদ্বির করতে হবে, কাকে এনে দিতে হবে শিলিগুড়ির কমলা, গোয়ালন্দের ইলিশ, এবলে দিতে যেমন আলেফ, সাহেবের বাড়িতে পৌঁছে দিতেও তেমনি সে। লোকে বলে, সেজন্যই নাকি দাদা চাকরির বাইরে যেতে ভাইও স্বেচ্ছায় বিদায় নিলো।

আলেফ এরফানের পাশে হাঁটছে। আলেফের মাথায় ছাতা,হাতে লাঠি। একবুক সাদা দাড়ি। পায়ের জুতোজোড়া বোধ হয় একটু বড়ো। মাটির পথে যত শব্দ হওয়া উচিত তার চাইতে জোরে একটা ফাপা শব্দ হচ্ছে আলেফের পায়ে পায়ে।

ছাতিটা পিঠের উপরে রেখে দুই বাহুতে আটকে সামনের দিকে টেনে ধরলে খানিকটা দেহভারও বোধ হয় তার উপরে হেলিয়ে দেওয়া যায়। তেমনি করে চলছে এরফান। তার গড়ন বলিষ্ঠ, যদিও তার মাথার চুলগুলো ধবধবে শাদা।

এরফানের ঘরে ছেলে নেই, মেয়ে নেই, দুই বউ আছে।

আলেফের সংসারও ছোটো, বহুদিন শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রীর সংসারই ছিলো। ছেলে হওয়ার আশা যখন সে প্রায় ছেড়ে দিয়েছে তখন তার একটি ছেলে হলো। বউ যায় যায়। এরফানের স্ত্রী পলতেয় করে দুধ খাইয়ে মানুষ করেছে। বড় হয়েও ছেলে অধিকাংশ সময় চাচীর কণ্ঠলগ্ন হয়েই থেকেছে মামার বাড়িতে পড়তে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। আলেফের কুটুম্ব মোক্তার। তার বাড়িতে কিছু লেখাপড়ার চর্চা আছে।

এরফানের দ্বিতীয় স্ত্রী দিঘা বন্দরের শালকর ইস্কান্দার বন্দীপুরের মেয়ে। এরফানের প্রথমপক্ষের শ্বশুর সম্পন্ন গৃহস্থ। ধান ও পাটের চাষে তাদের অবস্থা ভালোই বলতে হবে, কিন্তু সে পরিবারে কারো অক্ষরজ্ঞান নেই। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর সম্পর্কিত যে যেখানে আছে সবাই কিছুদিন লেখাপড়া করেছে। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী নিজেও লিখবার মতো জ্ঞান রাখে। তার তিন ভাইয়ের মধ্যে দুজন রেল কোম্পানিতে চাকরি করে, সর্বকনিষ্ঠ যুদ্ধে গেছে। ছোটোবউ সুর্মা চোখে দেয়, জামা গায়ে দেয়, জড়িয়ে জড়িয়ে শাড়ি পরে, মেহেদি পাতার নির্যাস দিয়ে পা রাঙিয়ে রুপোর মল ও চটি পরে, বোরখা ছাড়া পথ চলেনা। কোনো কাজই করেনা সারাদিন। মুটিয়ে গেছে, ছেলেপিলে এরও হবে না।

সম্বন্ধটাও স্থির করেছিলো আলেফ। দুই ভাই যখন চাকরি করে, এবং গ্রামের বাড়িতে খড়ের চালের পরিবর্তে টিনের চাল উঠেছে, আলেফের সখ হলো অভিজাত ঘর থেকে একটি কন্যা আনার। শালকর ইস্কান্দার বন্দীপুরের সঙ্গে তার আলাপ ছিলো। ইস্কান্দারের পূর্বপুরুষরা নাকি অযযাধ্যার নবাব পরিবারের কাজ করতো। এখনও তাদের পরিবারে উর্দু লৰ্জ চালু আছে। আলেফের কথায় ইস্কান্দার অন্য কোথাও খোঁজ না করে নিজের মেয়ের সঙ্গেই বিবাহের প্রস্তাব তুলে বসলো। কিন্তু এবার আলেফ মত বদলালো। দেনমোহর বাবদ দু হাজার টাকার কথা উঠতেই পিছিয়ে গেলো সে, এবং এরফানকে এগিয়ে দিলো। তবু বিবাহের ব্যাপারে কিন্তু আলেফের উৎসাহই বেশি প্রকাশ পেলো। খানাপিনার ধুমধামে, সামাজিকতার উচ্ছ্বাসে সে সর্বত্র এই কথা প্রচার করে দিলো–যেনতেন ঘরের মেয়ে আনেনি সে ভ্রাতৃবধূ হিসাবে। রইরইস না । হতে পারে, কিন্তু অযোধ্যার খানদানি ঘর। বিবাহের সভায় ও ভোজের আসরে আলেফ বেশ সুক্রিয়া, খায়ের প্রভৃতি উচ্চারণ করে বাল্যের উর্দু শিক্ষা কাজে লাগিয়েছিলো।

কথাগুলো মনে পড়ায় এরফানের মুখে এখন একটা হাসি ফুটলো।

মাঝে মাঝে এরফানের দ্বিতীয়পক্ষের শালা-সম্বন্ধীরা আসে। বাড়িতে আনন্দের হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। তিন-চার বছর আগে তার বড়ো সম্বন্ধী ঈদের সময়ে বউকে সঙ্গে করে এসেছিলো। শাদা প্যান্ট শাদা কোট, চকচকে নতুন জুতোয় রেলের চেকারবাবু। কিন্তু একটা কেলেঙ্কারি হয়েছিলো।কুরবানির মাংস হিসাবে এক-আধ সের গোমাংস এর আগেও বাড়িতে আসেনি এমন নয়। ভাই এসেছে এজন্য একটু ভালোরকমের উৎসব করার সাধ হয়েছিলো ছোটোবউয়ের। বাড়ির একটা দামড়া বাছুর কুরবানির জন্য সে পাঠিয়ে দিয়েছিলো। অন্যান্য দিন রান্নাঘরের ভার থাকে বড়োবউয়ের; সেদিন ছোটোবউ রান্না করবে বলেবড়োবউ কাদামাটি গুলে নিয়ে বাইরের ঘরের দাওয়া পৈঠা নিকোতে গিয়েছিলো। চাকর যখন গোমাংস নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকছে তখন লাগলো বিবাদ। অবশ্য সেটাও একই পক্ষের। বড়োবউ মিনমিন করে ভয়ে ভয়ে বলেছিলো–কে, ছোটু, ও মাংস তো রান্নাঘরে রাঁধা হয় না। আর যায় কোথায়! ছোটোবউ ফেটে পড়লো। কুফরির ঘরের মেয়ে, এর থেকে আরম্ভ করে, নমশূদ্র, চাড়াল প্রভৃতি বলে বড়োবউকে নানাভাবে হীন প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে অবশেষে এরফান আসতেই সে বলে বসলো, ও যদি এ বাড়িতে থাকে তবে সে নিজে আজই ভাইয়ের সঙ্গে চলে যাবে। বড়োবউ তরস্কৃত হয়ে কাদামাটি হাতে নীরবে কাঁদতে লাগলো। ব্যাপারটা এতদূর গড়াতে না যদি, ছোটোবউ নিজের বাড়ির দামড়াটা কুরবানিতে না দিতো, কিংবা বড়োবউ তার বক্তব্যটা কুটম্ব-স্ত্রীর সম্মুখে উল্লেখ না করতো।

উৎসব অবসান হলে এরফানের শ্যালক যেন লজ্জিত হয়েই চলে গেলো। এরফান অন্যান্য দিনের তুলনায় গভীর রাত পর্যন্ত বাইরের দাওয়ায় বসে তামাক খেয়ে অন্দরে শুতে এসেছিলো। অন্দরের উঠোনের দুপাশে দুখানা ঘর, ছোটো এবং বড়োবউয়ের। দীর্ঘ আট-দশ বছরে যা মনে হয়নি সেদিন এরফানের তাই হলো। কোন ঘরে শুতে যাবে দ্বিধা করলো সে। ছোটোবউয়ের ঘরে দরজার পাশে ছোটোবউ দাঁড়িয়েছিলো, তবু নীরবে বড়োবউয়ের ঘরে ঢুকলো সে।

মলিন থান পরা বড়োবউ স্নান চেরাগের আলোয় বসে শীতকালের জন্য কাঁথা সেলাই করছিলো। এরফান বিছানায় বসে কেশে গলা সাফ করে বললো, শোবা না?

–তুমি শোও গা, আমি শোবো নে।

–উঠে দুয়ার দেও।

বড়োবউ বুঝতে না পেরে দুয়োরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলো। দশ বছর বাদে এ-ঘরে শোবো একথাটা বলতে এরফানের লজ্জা করছিলো, সে আর কথা না বলে বিছানায় শুয়ে পড়লো। দরজা বন্ধ করে চেরাগ উস্কে দিয়ে বড়োবউ আবার সেলাই নিয়ে বসলো। এরফানের শোয়া হলো না। সে উঠে এসে বড়োবউয়ের পাশে বসলো, কিছুকাল নিচু স্বরে আলাপ করে বড়োবউয়ের মনের গ্লানি দূর করার চেষ্টা করলো, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে যা করলো সেটাই উল্লেখযোগ্য। ঈদের দরুন নতুন কাপড় জামা এসেছিলো। ছোটোবউ, কুটুম্বদের, এরফানের নিজের জন্য, এমনকী বাড়ির চাকরটির জন্যও। এরফানের কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখার ভার বড়োবউয়ের উপরে। এরফান দেখতে পেলো ঘরের এক কোণে কাঠের বাক্সের উপরে তার নিজের জন্য আনা ধোলাই ধুতিজোড়া রয়েছে। সে নিজের হাতে করে নতুন ধবধবে ধুতিখানা এনে বড়োবউকে পরতে দিলো। বিস্মিত বড়োবউ কিছু বলার আগে তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে তারশনের নুড়ির মতো পাকা চুলে, জরাজীর্ণ গালে সেশত শত চুমু দিতে লাগলে। বিছানায় শুয়েও এরফান বড়োবউয়ের মাথা নিজের বাহুর উপরে তুলে নিয়ে আঙুল দিয়ে দিয়ে তার শাদা চুলগুলোতে সিঁথি কেটে দিলো।

অনেক আদরে মুখ খুলে বড়োবউ বলেছিলো–কে, আমার বাপ ভাই যেন মুরুখু, আমি কি ভালোবাসি নাই আপনেক?

-সোনা, সোনা।

কিন্তু গভীর রাত্রিতে এরফান ঘুমন্ত বড়োবউয়ের ঘরের দরজা সন্তর্পণে ভেজিয়ে দিয়ে ছোটোবউয়ের ঘরে ফিরে গিয়েছিলো।

পুরনো ঘটনা, তবুও এরফানের এখন মনে হলো, লুকিয়ে লুকিয়ে থাকা যার অভ্যাস সেদিন তাকে অমন করে আঘাত না দিলেও চলতো। সে কারো পাকা ধানে মই দেবার মতো লোক নয়। পাকা ধান, ধানের হিসাব সবই তো তোমার দখলে, বাপু। এই তো আবার চাদির চন্দ্রহারে গিল্টি করার সখ হয়েছে তোমার, আর সেই কত বৎসর আগে ধান পাকার সময়ে সে শেষবারের মতো হয়তো কিছু চেয়েছিলো। কিছুই চায় না সে।

এসব মনে হওয়ার কারণ এই ছিলো, কাল রাত্রিতে ঘুমটা ভালো হয়নি এরফানের। ছোটোবউ গাল ফুলিয়ে রাগ করতে বসলো। নিদ্রাবঞ্চিত চোখ দুটি করকর করছে। এরফান স্থির করলো আজ থেকে সে বড়োবউয়ের ঘরে ঘুমুবে। ঘুমুলে মুখ দিয়ে ফৎ করে শব্দ হয় বটে, কিন্তু শীতল-স্নিগ্ধ সে। বহুদিন পরে দেখা হলেও চোখ মুখ দেখেই সে বুঝবে।-চেরাগ নিবায়ে দি, ঘুমাও। চুলে হাত বুলায়ে দেবো? হয়তো এসবই বলবে সে।

ছোটোবউয়ের রাগের উপলক্ষ্যগুলি আলোচনা করে সেগুলিকে অকিঞ্চিৎকর বিষয় বলে মনে হলো। তার প্রথম ফরমায়েস হলো–একটা সামাই-এর কল লাগবি।

–কী হবি? বছরে তোমার কয় মন সামাই লাগে? দোকানে কেনা সামাইয়ে হয় না কেন?

মেয়েছেলেদের সখ হয় বটে এমন তুচ্ছ জিনিসে, এরফান ভেবেছিলো এরপর সদরে লোকজন যখন যাবে বলে দেবে আনতে। কিন্তু এ ব্যাপারে মনস্থির করেও গল্পচ্ছলে এরফান বলেছিলো–যাই কও, সামাই যে লোকে খায় কে, বুঝি না। পায়েস যদি খাতে হয় নতুন আমনের আতপ আর খেজুরের গুড় আর দেও ক্ষীর।

এ আলাপের তবু নিষ্পত্তি হয়েছিলো কিন্তু দ্বিতীয় বায়নার বেলায় অন্যরকম হলো। ছোটোবউ বললো, পোশাক-আসাক ভালো করার লাগে।

–কেন, এখন পোশাক-আসাক ভালো করলে কি তাজা হবে?

–তা কই না। তাজা পুরুষ দিয়ে কী করবো? আমার ভাই আসবি, তার সামনে জোলা সাজে বেড়াতে পারবা না।

–জোলা হবো কেন, আমি কি কাপড় বুনবের পারি?

–তানা। তুমি ধুতি পরে থাকো, বেমামান লাগে। ময়লা মোটাধুতি মানায় না যেন তোমাকে।

–কী করা লাগবি?

–কেন, সকলে পায়জামা পরে, তুমিও পরবের পারো।

–তা পরবো কেন, আমি সায়েব না পশ্চিমা যে দু-চুঙ্গি পরবো?

–তাই বলে আমার ভাইয়ের সামনে তুমি ময়লা ধুতি পরে বেড়াবা, তা হবি নে।

–বেশ তো, তোমার ভাই যা চোখে দেখে নাই তাই করবো। সান্যালমশাই চাপড়ির কাপড়-চাদর পরে, তাই পরবো। একটু কড়া মুখেই বলেছিলো এরফান।

এরপরই রাগ হয়েছিলো ছোটোবউয়ের। ভাই চোখে দ্যাখেনি, এই কথাটাই রাগের পক্ষে যথেষ্ট ছিলো, তার উপরেও ছিলো সান্যালমশাইয়ের অনুকরণে কাপড় পরার কথা।

এরফান স্ত্রীকে ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য বলেছিলো : চাপড়ি একটা জায়গার নাম। সেখানকার জোলা-তাঁতীরা সূক্ষ্ম চাদর আর কাপড় বুনতে পারে। এবং সেই কাপড় ও চাদর এখন কয়েকটি বিখ্যাত পরিবারেই ব্যবহৃত হয়, বাজারে বিক্রি হয় না।

দ্বিতীয় দফায় এরফান স্ত্রীর যুক্তির উত্তরে বলেছিলো–আমি যদি চাপড়ি পরলে দোষ হয়, তুমিও পাবনার শাড়ি পরবের পারবা না, পাঞ্জাবি আর ঘাগরা কিংবা পায়জামা পরবা। পারবা? কেন, লজ্জা করে? আমারও করবের পারে তো!

এখন এরফানের মনে হলো ব্যাপারটা অত হাল্কা নয় যতটা সে ভেবেছিলো। তার অনুভব হলো কোনো কোনো বিষয়ে ছোটোবউয়ের সঙ্গে আলেফের চরিত্রগত মিল আছে। পেন্সান পওয়ার আগে থেকেই আলেফের পোশাকের পরিবর্তন হয়েছে। মাথায় ফেজটুপি পরা, হাঁটু ছাড়িয়ে জামার ঝুল দেওয়া, ধুতির বদলে পায়জামা। গ্রামে এসেও সে যেন প্রতিবেশীদের সঙ্গে

নিজের পার্থক্য ফুটিয়ে তুলতে চায়। একদিন আলেফ এরফানকে দাড়ি রাখতেও অনুরোধ করেছিলো। কিন্তু এরফান নিজের পোশাক বদলায়নি, দাড়িও রাখেনি। এক মৌলবী সাহেব বলেছিলোধুতি পরে নমাজ পড়া গুনাহ্। তারই ফলে ঈদের নমাজ পড়ার সময়ে এরফান একজোড়া পায়জামা ব্যবহার করে। অন্য সময়ে সেটা বাক্সে তোলা থাকে।

চরিত্রগত মিলটা সব সময় চোখে না পড়লেও, সে এ বিষয়ে কৃতনিশ্চয় হলো। বাল্যে যাদের সঙ্গে খেলাধুলো করেছে সেই সব প্রতিবেশী ও সে যে এক নয় তার প্রমাণ দেওয়ার জন্যই সুযোগ পেলেই আলেফ বলে–তারা সৈয়দ বংশীয় পাঠান। এরফান বুঝতে পারে না পাঠানত্ব কোথায় অবশিষ্ট আছে। ইতিহাস পড়া থাকলে সে হয়তো সৈয়দ এবং পাঠান একইকালে কী করে হওয়া যায় এ নিয়েও চিন্তা করতো। তেমনি ছোটোবউ প্রচার করে–সে অযযাধ্যার অধিবাসিনী। একটা কথা বলে দেওয়া যায়–দুজনেরই প্রাধান্য পাবার আকাঙ্ক্ষা খুব বেশি।

কিন্তু শান্তি পায় কি? আলেফকে মাঠে মাঠে হুটহাট করে বেড়াতে হয়, মক্তবের জন্য টাকা খরচ করতে হয়। বড়োবউ তাকে শাস্তির হদিশ দিতে পারে এই অনুভব হলো এরফানের।

বাড়ির কাছাকাছি এসে আলেফ বারকয়েক ছোটোভাইয়ের মুখের দিকে চোরা চোখে চেয়ে দেখলো। তারপর বললো, কী কস, রামচন্দ্রর জমিগুলোর একবার খোঁজ নিবি?

এরফান আলেফের মুখের দিকে চেয়ে হেসে ফেলো।

প্রস্তাবের সময় খুব মনোযোগ না দিলেও, বলছে যখন বড়োভাই এরকম মন নিয়ে এরফান গিয়েছিলো রামচন্দ্রর কাছে জমির সংবাদ নিতে। ফেরার পথে সে শুনে এলো চৈতন্য সাহা বিপাকে পড়েছে, চাষীরা জমিতে চাষ দিচ্ছে না, উপর থেকে জমিদার খাজনার জন্য চাপ দিচ্ছে। চৈতন্য সাহার জন্য কিছুমাত্র সমবেদনা অনুভব করলোনা সে,বরং তার মনে হলো অতিলোভের এরকম ফলই হয়ে থাকে।

সন্ধ্যার পরে আলেফের সঙ্গে দেখা করার জন্য এরফান নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আলেফের বাইরের উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালো। আলেফের রাখাল ছেলেটা খবর এনে দিলো আলেফ তখনো বাড়িতে আসেনি, জোলার জমি দেখতে গেছে। দাদার প্রতীক্ষায় এরফান এদিক ওদিক ঘুরে অবশেষে নামিয়ে রাখা গোরুর গাড়িটার জোয়ালের উপরে গিয়ে বসলো। যেখানে সে বসেছিলো সেখান থেকে মসজিদের বারান্দাটা খুব দূরে নয়। সে লক্ষ্য করলো ফকির মসজিদের বারান্দায় বসে একমনে কুলোয় করে চাল বেছে যাচ্ছে। তাকে দেখলে একটা নিবু নিবু চেরাগের কথা মনে হয়। আগেও যেমন, এখনো তেমনি, থরথর করে কাঁপছে কিন্তু হঠাৎ কিছু হবে বলে মনে হয় না। একবেলার আহার্যমাত্র তাকে দেয় আলেফ। যেদিন প্রথম প্রস্তাবটা শুনেছিলো ফকির সে বলেছিলোতা বেশ, বাবা, বেশ। একবেলাই ঢের। আলেফের কাছে ফকির একটা জামা চেয়েছিলো, না পেয়ে নির্বিকার মুখে বলেছিলোতা বেশ, বাবা। বোধ হয় ‘বেশ, বাবা, বেশ’বলাটা ফকিরের মুদ্রাদোষ, কিন্তু শুনে সহসা মনে হয়, সবই ভালো তার কাছে, বেশ চলছে দুনিয়াটা।

এরফান পায়ে পায়ে মসজিদের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো, দরবেশজী, কী করেন, সেলাম।

সেলাম, বাবা, সেলাম।

কী করেন?

চাল কুড়ায়ে আনছি, বাছি।

কেন, একবেলা কি রাঁধে খাওয়া লাগে?

কেন, এবেলা তো আপনার বাড়ি থিকে খাবার দিয়ে যায় আপনার চাকর।বড়োবিবিসাহেবা পাঠায়।

দেয় নাকি? তা কি জানি। চাল দিয়ে কী হয় তবে?

বাবা, একটা জামা লাগবি। জার আসবি, তার আগে একটা যইসই বানায়ে নেওয়া লাগে। পয়সার জন্যি চাল বাঁচাই’

এরফান ফিরে এসে তার আগের আসনে আবার বসলো। সে মনে মনে বললো–বেশ, বাবা, বেশ নয়। এ, বাবা, সংসার। এর নামই তাই। কারো রেহাই নেই না ভেবে। তুমি ফকির, তোমাকেও ফিকির করতে হয়। আমরাই শুধু ধান-পান জমি-জমা হুই-হাই করে বেড়াই না। এই তো আমি ভেবেছিলাম, শান্ত হবো, পারলাম? তার চাইতে ভালো জমির সন্ধান পেয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছিলাম রামচন্দ্রর কাছে খোঁজ করতে। তখন ভাবিনি, রামচন্দ্র যদি গাঁ ছাড়ে তবে সে কত কষ্টে দগ্ধ হয়ে। বড়োভাইকে কী দোষ দেব?

কিন্তু ফকিরের স্থৈর্যও অস্বীকার করা গেলো না। ওই যে চাল বেছে যাচ্ছে সে মাথা নিচু করে, সেও যেন ঘুমের মতো ব্যাপার। হ্যাঁ, এটাই ঠিক চেহারা ফকিরের। ঠিকটা যে কী তা ভাষায় এলো না, অনুভবটা হলো :এই যেমন নড়াচড়া নেই। বাঁচার অনিচ্ছা নয়, বরং বাঁচতেই যেন চাওয়া। ফকির নিজেও বলে, যতদিন বাঁচা যায় আল্লার খিদম করা যায়। তার খিদমদ বলতে এক আজান দেওয়া। বাঁচতেই সে চায় কিন্তু সে যেন গাছের বাঁচা, কিংবা মনে করো, চিৎসাঁতার দিয়ে নদী পার হওয়া।

সাঁতারের তুলনাটা আলেফই দিয়েছিলো। একদিন চারিদিকের অবস্থার কথা উত্থাপন করে এরফান বলেছিলো–দুনিয়ার গজব, বড়োভাই। কী যে দাড়ি ভাসায়ে হুটপাট করে বেড়াও?

প্রত্যুত্তরে আলেফ বলেছিলোকস কী! জলে যেন ডুবতিছি, তাই বলে কি প্রাণী হাত-পাও ছুঁড়বি নে? তখন এরফান লাগসই কথাটা খুঁজে পায়নি। এরপর যদি কখনো আলেফ এই ধরনের কথা বলে, এরফান হাত-পা না-ছুঁড়ে চিৎসাঁতারের কথা বলবে।

এরফান বাল্যে পদ্মায় সাঁতার দিতো। চিৎসাঁতারের আনন্দটা তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। যদি পরপারের কোনো একটা জায়গায় পাড়ি জমানোর গরজ না থাকে তবে চিৎসাঁতার না দিয়ে বুকে যে জল ঠেলে তাকে বেয়াকুফ ছাড়া আর কী বলা যায়।

বড়োভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো না। আর একটু বসে থেকে এরফান ফিরে গেলো। তার নে হলো বড়োবউ এবং ফকিরের দলেই সে থাকবে।

.

দু’এক মাস পরে আলেফ আবার অস্থির হয়ে উঠলো। চিকন্দির চাষীদের জমি সম্বন্ধীয় অবস্থায় অপ্রত্যাশিত একটা পরিবর্তন হয়েছে। চৈতন্য সাহার দুদিক বাঁচানোর চেষ্টায় এই সাব্যস্ত হয়েছে, জমিদার তাকে খাজনা পরিশোধের জন্য ছ মাস সময় দেবে, আর সে নিজে চাষীদের খাইখালাসি জমিগুলি মাত্র আর-এক সন দখলে রেখে ছেড়ে দেবে; এ সনে চাষীরা যদি তার খাইখালাসি বদ্ধ জমিতে চাষ দিয়ে আউস আমন তুলে দেয়, তবে খোরাকির ধানও সে দেবে। কিন্তু রেহানবদ্ধ জমির বেলায় কোনো ব্যবস্থা হয়নি। ওদিকে মিহির সান্যাল বলেছে, সে এমন কোনো প্রস্তাব মানতে রাজী নয়। রেহান বদ্ধ জমি মায় সুদ আসল পেলে খালাস দেবে সে, কিন্তু খাইখালাসিবদ্ধ জমির বেলায় সুদ আসলের কোনো প্রশ্নই নেই, দু বৎসরের ফসলের আনুমানিক মূল্য ও জমির খাজনা পরিশোধ করে দিতে হবে। সে একাধারে মহাজন এবং জমিদার, কাজেই তার প্রজাদের অবস্থা সর্বাপেক্ষা বিপন্ন। চিকন্দির চাষীরা চৈতন্য সাহার শর্ত মেনে নিয়েছে। মিহির সান্যালের প্রজারা জমি বিক্রি করে দেবে এরকম কথা শোনা যাচ্ছে। এরকমই এক প্রজার নাম ইসমাইল আকন্দ। আলেফদের জোলার জমির পাশে প্রায় পাঁচ-সাত বিঘা জমি আকন্দর। বিপাকে পড়ে সে খাইখালাসি বন্ধক রেখেছিলো মিহির সান্যালের কাছে। আলেফ খুঁটে খুঁটে খবর নিতে গিয়ে ইসমাইলের ব্যাপারটা আবিষ্কার করেছে। কিছুক্ষণ আলাপের পর ইসমাইল বলেছিলোবড়োমি, মনে কয় জমি বেচে দিয়ে অন্য কোথাও খানটুক জমি নিই। এমন মহাজন জমিদারের জমি রাখা যায় না।

তা নেও না কেন, সান্যালমশাইয়ের কোনো জমি পত্তনি নেও।

পারি কই, ট্যাকা নাই যে।

কেন, কলে যে এ জমি বেচবা?

কে কেনে কন্? জমির দাম যা হোক তা হোক, মিহিরবাবুর ফসলের দাম কে দেয়।

সে কতকে?

দুই সনের ফসলের দাম ফেলাইছে ছয়শ বিশ।

ই আল্লা! অমন দাম হয়?

তা বাজার দরে দুই সনের ধানে কলাইয়ে হবি। কন্‌, জমির দাম দিয়ে কলাইয়ের দাম দিয়ে কেডা অত টাকা একসাথে বার করে দেয়?

সোভানাল্লা, জমির দাম কতকে!

তা সাত বিঘা সাতশ হবি।

আলেফ ইসমাইলের সম্মুখে উবু হয়ে বসে পড়ে বললো, সাতশ আর হয় না, কেন্‌?

পুরাপুরি হয় না। ছয় বিঘা কয়েক কাঠা জমি। এদিনে হিসাব করে নিলে সাড়ে ছয়শ হবি। দু’তিন দিন আলেফ ছুটোছুটি করে বেড়ালো। পায়চারি করে মনস্থির করার মতো অনুদ্দিষ্ট ঘোরাফেরা। ইতিমধ্যে একদিন গহরজান সান্দারের বাড়িতেও সে গেলো। জোলার জমিতে দুই সনের ফসলের আনুমানিক মূল্যটা স্থির করাই তার উদ্দেশ্য ছিলো। আলেফ মনে মনে হিসাব করে দেখলো জমি কিনে এবারই নিজের দখলে আনতে হলে পনেরোশ টাকা নিয়ে নামতে হয়। নতুবা শুধু জমি হস্তান্তরে কী লাভ? মিহিরবাবুর কাছে খবর নিয়ে সে জানলো ইসমাইল তাকে ঠিক খবরই দিয়েছে।

কিন্তু শেষ পরামর্শটা করা দরকার এরফানের সঙ্গে। পরামর্শ করার আগে জমিটার চৌহুদ্দিগুলি আর একবার পরখ করার জন্য আলেফ প্রত্যুষে বেরিয়ে পড়েছিলো। অনেকটা বেলা পর্যন্ত জমিটার চারিদিকে চষে বেড়ানোর মতো ঘোরাফেরা করে দুপুরের আগে সে এরফানের বাড়ির দরজায় গিয়ে উপস্থিত হলো। এরফানের বাড়িতে যাবার পথ তার নিজের বাড়ির সম্মুখ দিয়ে। তন্ময় হয়ে চলতে চলতে সে লক্ষ্য করেও করলো না, তার বাড়ির দরজায় একটা টোপর দেওয়া গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আল থেকে মাঠ, মাঠ থেকে আবার আল ধরে সে এরফানের দরজায় গিয়ে ডাক দিলো, এরফান রে!

এরফান তেল মেখে স্নানের আগের তামাক টানছিলো, সাড়া দিলো।

পাঁচশ টাকা দিবা?

এরফানের হাসি পেলো–দুপুর রোদে টাকার কথা, পাঁচশ টাকার কথা, তাও না বসে, না জিরিয়ে, বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে প্রায় পথ থেকেই।

এরফান বললো, কেন্, ছাওয়াল চালে বুঝি?

ছাওয়াল? সে আবার কী চায়? সে তো কোলকেতায়।

তাই কও, নেশা করছে। ছাওয়াল আসছে দ্যাখো নাই?

আলেফের এবার মনে হলো বাড়ির সম্মুখ দিয়ে আসার সময়ে অস্পষ্টভাবে একটা আসা যাওয়ার ব্যাপারের মতো কিছু যেন অনুভব হয়েছিলো তার।

আসছে নাকি? কিন্তু তোর কাছে আলাম অন্য কামে।

কী কাম? পাঁচশ টাকার?

হয়। তুই আদ্দেক দে, আমি আদ্দেক। জোলা—

কিসের জোলা? ফসলের আদ্দেক তো পাবাই।

আলেফের দৃষ্টিটা যদি ভাষা হতো তবে এখন সেটা কুণ্ঠা ও গোপন প্রবৃত্তিতে জড়িয়ে তোতলা হয়ে উঠতো। এরফান তার দৃষ্টির পরিবর্তনের কারণ খুঁজে পেলো না। সে বললো, তোমার অংশ বেচবের চাও পাঁচশ টাকা নিয়ে? তা করবা কেন্‌? ওটা পৈতৃক জমি,দুই ভাইয়েই ভোগ করবো। ও জমি আমাকেও না, কাকেও না, বিক্রি করবা না।

কথাগুলি বললো এরফান আলেফের নীরবতার অবকাশে থেমে থেমে তার স্তব্ধতার কারণ কল্পনা করতে করতে। সে আবার বললো, তুমি তো আজকাল কারো কথাই মানোনা, তা একটা কথা কই তোমাক, ছমন করে না বেড়ায়ে ছাওয়ালের দিকে মন দেও, ও ছাওয়াল বংশের গৈরব বাড়াবি।

ফেরার পথে ভাবলো আলেফ, ঝোঁকের মাথায় সামনে পিছনে না তাকিয়ে কী কাজটাই সেকরতে গিয়েছিলো।নগদ এরফানের যত আছে, তার অর্ধেকও তার নিজের নেই। পরে টাকাটা ফিরিয়ে দিলে ইসমাইলের দরুন জমির মালিকানাও এরফান হয়তো ফিরিয়ে দিতে রাজী হতো, শত হলেও ভাই তো, এই ভেবেছিলো সে; কিন্তু–

কিন্তু এরফানের এ পক্ষের সম্বন্ধীরা আবার প্যাচালো লোক। তারাও তো একটা যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বসতে পারে। যদি ফিরিয়ে দিতে না চায়? এমন কী, লাঠি দিয়ে মাটি ঠুকলো আলেফ, উল্টে আলেফের অর্ধাংশও চেয়ে বসতে পারে, কিংবা জমির খবর পেলে সে নিজেই ইসমাইলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বন্দোবস্ত করে নিতে পারে।

আলেফনিজেকে শোনালো গদগদ করে–হয়, কওয়া যায় না জমির কথা। জমি যার নাম। এতক্ষণে যে রোদটা লক্ষ্যের বাইরে থেকেও পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিলো,হঠাৎ বেশ ভালো লাগলো সেটা আলেফের, যেন সেও একখণ্ড কুয়াশা থেকে বেরিয়ে এসেছে। খুশির কারণটা নিজের উপস্থিত বুদ্ধি। প্রয়োজনের মুখে সে যে এমন দম মেরে থাকতে পারে এ সে নিজেও জানতোনা। অন্য কেউ হলে হয়তো জমি কেনার কথা প্রকাশ করেই ফেলত। আলেফ মিটমিট করে হাসলো–ও ভাবছে পৈতিক জোলার আদ্দেক আমি বেচবের চাই। তা ভাবুক, ক্ষেতি কি।

বাড়ির দরজায় পৌঁছে খুশি হওয়ার আর একটা কারণ পেলো সে। ছিলোই কারণটা, এতক্ষণে অনুভূত হলো। এরফান বলেছে–সেবংশের গৈরব। পুত্রগর্বে বুক ভরে উঠলো। সদর দরজার কপাটটায় দোষ ছিলো, ছেড়ে দিলে আচমকা অনেক সময়ে নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। অন্যমনস্ক বা পুত্রমনস্ক হয়ে ঢুকতে গিয়ে আলেফ ফিরে আসা পাল্লায় তো খেলো।

অন্দরের উঠোনে নেমে কথা না বলে সে চোখ মেলে খুঁজলো ছেলেকে, কিন্তু কথা বলেও খুঁজতে হলো, কৈ, গেল কনে?

এই তো। আলেফের স্ত্রী হাসিমুখে বেরিয়ে এলো দরজার কাছে।

হয়। তোমাক খুঁজে চোখ কানা হইছে। গদগদ করে বললো আলেফ।

তা খুঁজবা কে, বুড়া হইছি যে।

ক্ষোভের অভিনয় করে আলেফ জামা খুলতে ঘরে গেলো।

একটু বাদে ফিরে এসে একটা জলচৌকি টেনে নিয়ে রান্নাঘরের দরজায় বসে আলেফ বললো, কী কী রাঁধলা?

ডাল, ভাত, মাছ।

এরফান কী কলে জানো? কয়, ছাওয়াল বংশের গৈরব।

তা হবি।

আমিও কই ছাওয়াল পড়ুক। ডাক্তার হবি, না, উকিল হবি, তা হোক। থাক না কেন কোলকাতায়, যত টাকা লাগে তা দিবো। দেখবো ট্যাকার বাড়ি কনে।

রাখাল ছেলেটি কি একটা কাজে অন্দরে ঢুকছিলো, আলেফ হুংকার দিয়ে উঠলো, তামাক খাবের পলাইছিলি কাম ফেলে?

থমকে দাঁড়ালো ছেলেটি।

আলেফ তো আর রাগ করে বলেনি যে তার কথায় হুংকারের জের থাকবে; একেবারে সাধারণ সুরে সে বললো, তামাক সাজ।

তারা থেকে উদারায় নেমে আলেফ বললো, দুধ দোয়াইছিলি, কেন্‌? এক কাম করো না কেন্‌, সামাই দিয়ে–

রাখাল ছেলেটি ভয়ে ভয়ে বললো বিমূঢ়ের মতো, জে, সামাই দিয়ে—

আলেফ আবার বললো, সামাই দিয়ে, বুঝলা?

দুশ্চিন্তায় মাথা চুলকে রাখাল বললো, জে, সামাই দিয়ে।

আলেফ রাগ করে বললো, থাম ফাজিল, বদ্‌বখ্‌ত।

স্ত্রী বেরিয়ে এসে বললো, আমাক কতিছ বুঝি সামাই দিয়ে পায়েস করবের?

করো না কেন্‌। মনে করো কোলকেতায় কত হরকিসিম খাবার। সে শহর দেখি নাই, কী সে শহর!

স্ত্রী হেসে বললো, এ কি দামাদ আসছে? ছাওয়াল কয়ে গেলো বড্ড খিদে পাইছে, আম্মা। এখন আমার সময় নাই সাতখান রান্না করার।

‘কলে তাই? আম্মা কলে?

তো কি বাজান কবি?

আলেফ উঠোনে পাক খেয়ে বেড়াতে লাগলো। একবার ইতিমধ্যে সদর দরজা পর্যন্ত ঘুরেও এলো। বাইরের পথে উঁকি দিয়েও ধখলো।

ছাওয়ালের জন্যি মন কেমন করে? আলেফের স্ত্রী বললো।

হয়, হয়। তোমাক কইছে, আমি মিয়েছাওয়াল, না?

সংসারগত প্রাণ, সংসারের চাপে নমাজ হয় না রোজ। আজ নমাজ শেষ করে ঘরে ফিরতে ফিরতে আলেফ অবাক হয়ে গেলো। কোথা থেকে একটা মাধুর্য ক্ষরিত হচ্ছে শব্দকে অবলম্বন করে। সংগীত সম্বন্ধে আলেফের ধারণা অকিঞ্চিৎকর। যাত্রার পালাগান সে শুনেছে প্রথম যৌবনে, চাকরির শেষদিকে শহরে সিনেমাও দেখেছে, সে সব জায়গার দু’একটা গানের সুর তার কানে ছিলো। দুর্ভিক্ষের আগে একবার এক বাউল এসেছিলো। হিন্দু-মুসলমান সব ঘরেই তার গতিবিধি ছিলো। একতারা বাজিয়ে সে গান করতো, কী যেন সেই কাণ্ড, ফুল আর ত্বক আর–তার আড়ালে যে প্রাণপাখি থাকে তার কথা। কিন্তু সে সবকিছু দিয়েই এর তুলনা হয় না।

.

শব্দের অনুসরণ করে আলেফ এরফানের বাড়ির অন্দরে গিয়ে দাঁড়ালো। এরফানের বড়োবউয়ের ঘরের বারান্দায় মাদুর পেতে বসে ধবধবে পাঞ্জাবি পায়জামা পরা তার ছেলে কী একটা বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে। যে চাঁদ এখনো ওঠেনি সবটুকু তারই সামান্য আলো এসে পড়েছে যন্ত্রটির উপরে, আলোয় কী একটা চকচক করছে। এরফান চিবুকের নিচে দুই হাত রেখে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে পাশে। রাগরাগিণীকাকে বলে আলেফ জানোনা, কিন্তু অনাস্বাদিতপূর্ব একটি মধুর বিষাদে তার মন ভরে গেলো। কিন্তু শুধু বাজনা নয় তো, তারই ছেলের বাজনা। আলেফের চোখ দুটিও জলে ভরে উঠলো।

বাজনা শেষ করে ছেলে বললো, ভালো লাগলো, চাচা? তোমার, বাজান?

খুব ভালো, এ বাজনা বুঝি সায়েবদের?

ছেলে হেসে বললো, না, বা’জান, এ আমাদের দেশের। একে সেতার বলে।

ছেলে সেতারটা নামিয়ে রেখে আড়মোড়া ভেঙে, তার বড়োচাচীকে বললো, এবার একটু সে জিনিসটা বানাও, আম্মা।

এরফানের বড়োবিবি ফিসফিস করে বললো, আমি পারবো নে।

আচ্ছা তুমি জোগাড় করে নাও, আমি যাচ্ছি।

কী করবা? আলেফ প্রশ্ন করলো।

চা।

আলেফ চাকরির সময়ে মাঝে মাঝে চা খেতে বটে। রাত জেগে কাজ করতে হতো, তখন মাঝে মাঝে দোকান থেকে আনিয়ে নিতো। এখনো সদরে মামলা করতে গেলে পথের ধারের ছোটো একটা দোকানে বসে সে খায় কখনো কখনো। তাই বলে নিজের বাড়িতে? এ যেন সাহেবের বাড়ি হতে চললো। একটু ইতস্তত করে সে বললো, আমাকেও একটু দিয়ে।

এরফানের বড়োবিবি চা করতে উঠে গেলে ছেলে বললো, একটা অন্যায় করে ফেলেছি, বাজান।

কী অধম্ম করলা?

অধর্ম নয়, এটা কিনেছি, দাম দেওয়া হয়নি। এবার ফিরে গিয়ে দিতে হবে।

কতকের?

এটা পুরনো। যার কাছে শিখছি এটা তারই জিনিস। সামান্য দাম ধরে দিলেই হবে।

তাও কত?

সত্তর-আশি টাকা দিলেই হবে।

হঠাৎ আলেফ বুক চিতিয়ে দেওয়ার মতো সুরে বললো, তোর যত লাগে নিয়ে যাস। ট্যাকা, ট্যাকা তো মানুষের সুখের জন্যি। তুই কষ্ট করে পড়িস, আর তোর বাপ বুঝি বসে থাকে!

.

চার-পাঁচ দিন পরে এরফান বাড়ি আছোবলে এরফানের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো আলেফ।

বড়োভাই যে!

হয়, তামুক খাও।

তামাক পুড়তে পুড়তে ফুর্সির নলটা যখন গরম হয়ে উঠলো, তখন আলেফ নিজের মনে একটু হেসে নিয়ে বললো, এক কেচ্ছা জানো? এক ছাওয়ালেক তো তার বাপ টাকা খরচ করে পড়ায়। ছাওয়াল পড়া শেষ করে ডিটি হল। ঢাকার লবাব-বাড়ির এক মিয়েক বিয়ে করে শহরে থাকে। এদিকে ছাওয়ালের মায়ের কান্নায় বাড়ি টেকা যায় না। না থাকতি পারে বাপ গেলো শহরে ছাওয়ালের খবর করবের এক ধামি চিড়ে আর এক হাঁড়ি খেজুরের গুড় নিয়ে।

গল্পটি এরফানেরও জানা ছিলো, সেও যোগ দিয়ে বললো, ছাওয়াল কলে বউকে-বাজান বাড়ি থিকে চাকর পাঠাইছে।

দুজনেই হাসলো। এরফান বললো, ছাওয়াল কলে নাকি কিছু?

কবি কি ছাওয়াল? আমি তোমাকে কতে আলাম, যায়ো সন্ধ্যায় আমার ওখানে।

মেঠাই খাওয়াবা বুঝি?

তা খাও না কেন্ একদিন।

আসলে আলেফ ছেলের বিষয়ে পরামর্শ করতে গিয়েছিলো, কিন্তু দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারলো না। সন্ধ্যায় এরফান এলে আলেফ বললো দু’একটা সাধারণ আলাপের পর, ছাওয়ালের কী করবা ভাবছো?

কী ভাবি কও? ছাওয়ালের দুই চাচী ভাবে। ছোটোচাচীকয় ছাওয়াল গাডের চাকরি করুক। সে চাকরিতে এখন তো পয়সা আছেই। পরে আরও অনেক হবি। তার দাদা নাকি তাক কইছে। বড়োচাচীকয় ছাওয়াল ডাক্তার হবের চায়, হোক না কেন। লোকের প্রাণ বাঁচাবি। লোকে দোয়া দিবি।

তুমি নিজে কী কও?

ডাক্তার হওয়া খারাপ না।

ছাওয়াল নিজেও ডাক্তার হবের চায়। ইন্টাব্যুনা কী যে দিয়ে আসছে। কেবেলে পড়বি। আমিও কই পড়ুক।

ভালো। বংশের এক ছাওয়াল পড়ুক না কেন্‌। এরফান বললো।

তাই কও। ডাক্তার সৈয়দ সাদেক আলি নাম ভালোই শুনতে হবি।

কিন্তুক সবদিকে ভাবে দেখছো? নগদ টাকার কথা ভাবছো?

সে আর কত?

কত না, ঢের। মাসে মাসে সত্তুর-আশি টাকা করে দিতে হবি। সেখানে তো মামুর বাড়ি নাই। হোটেলে থাকা লাগবি।

আলেফ চিন্তা করলো, সেই অবসরে এরফান বললো, আদ্দেক পড়ায়ে থামলিও চলবি নে। ধরো যে চার-পাঁচ বছর একনাগাড়ে পত্তি মাসে ওই টাকা দিবের হবি। আদ্দেক পড়ায়ে থামলি । ছাওয়াল নষ্ট, ট্যাকাও গুনাগার।

আলেফ গুম হয়ে বসে রইলো।  

এরফান আবার বললো, আমি ভাবছি ছাওয়ালেক যদি পড়বের পাঠাও অন্তত এক বছরের টাকা বাঁধে নিয়ে কামে হাত দেও। সে টাকায় ঠেকা না হলে হাত দেবা না, তারপরেও পত্তি মাসে টাকা পাঠাবা জোগাড় করে। আর-এক কথা, মানুষের পরমাইনা কবরখানার চেরাগ। কবে আছি কবে নাই। টাকা তোমার ঠিক করে রাখা লাগে। বাপচাচা নাই, পড়লাম না, এ যেন না হয়।

এরফানের যুক্তি অখণ্ডনীয়। এ তো বড়োমানুষের সখ করে চলা নয়, কৃষকের ধীর অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে এগোনো। ধানের সুগন্ধে যাদের মাথা ঘুরে যায় তেমন কৃষক নয় অবশ্য, ক্ষেত মজুরের থেকে ক্রমোন্নতিতে যারা ভূস্বামী হয় তাদের মতো পাকা চাল যেন এরফানের।

কথা কলে না?

এক বছরের ট্যাকা ধরো হাজারের কাছে।

তা হবি।

সোভানাল্লা!

কেন্‌, হাজার টাকা কি তোমার নাই?

কিন্তু মানুষের তো অন্য কাম আছে। তা ছাড়া পত্তি মাসেও তো পেরায় একশ। পত্তি বছরেই ধরো যে হাজার।

তা তো হিসাবেই পাওয়া যায়।

ইন্‌সেআল্লা!

আমিও তাই কই। বুড়া হলে খোদাতালাক ডাকো। আহিঙে কমাও। দেখো ছাওয়ালেক পড়ান কঠিন হবি নে।

তুই দিনরাত আহিঙের কথা কস। কী আমার আহিঙে দেখলি? আমি পত্তি বছরে নতুন বিবি আনতিছি, না ঘোড়া কিনতিছি?

সে সব কথা কই নাই, বড়োভাই। তুমি ইসমাইলেক আগের জুম্মাবারে জোলার জমির বায়না দিবের চাইছে। ধরো যে সেখানে তোমার দেড় হাজার খরচ। তাতে তোমার দুর্ভাবনা নাই, ছাওয়ালের পড়ার খরচে এক হাজার বাঁধবের কলাম তো মুখ হাঁড়ি করলা।

ইসমাইল?

হয়, ইসমাইল! জোলার জমি বেচার খবর দিতে আসছিলো।

তারপর?

তারপর আর কী। ভাবছিলো বোধায় দু’এক টাকা দাম চড়ালেও চড়াতে পারি।

তার পাছে? আলেফ ভ্রূকুটি করলো।

এরফান হেসে বললো, তোমার বড়ো সন্দেহ বাতিক বড়োভাই। ইসমাইলের কথা সেজন্যিই আমাক কও নাই। ভাবছিলা ভাগ বসাবো। তা আমি তাক কলাম চরনকাশির বড়োসেখ যা কইছে তার থিকে বিঘা প্রতি দশ টাকা কম দাম ধাইরয্য থাকলো ছোটোসেখের। শুনে ইসমাইল হাসতে লাগলো।

আলেফ কথাটা সোজাভাবে না নিয়ে বাঁকাভাবে নিলো। সে খানিকটা মেজাজের সঙ্গে বলে বসলো, কেন রে, খুব যে ঠাট্টা করিস। তুই বুকে হাত রেখে কবের পারিস জোলার জমিতে তোর লোভ নাই?

লোভ ছাড়া আমজাদের পয়দা হয় নাই। ইসমাইলের জমির পাট্টা কবুলতি দেখছো?

নাঃ, না দেখেই আমি জমি কিনতাম!

তা তো গিছলাই কিনবের। যদি দেখে থাকো তো আরও খারাপ। ইসমাইল তার ভাবির হক বেদখল করে খাতেছে। সব জমি ইসমাইলের না। তার ভাবীর মামলার ট্যাকা নাই।

জমিদারে তার ভাবির অংশ খাস করে নিয়ে তাকেই পত্তন করছে।

কথাটা ভাবে দেখো বডোভাই। ইসমাইল যে ট্যাকায় পত্তননজর দিলো সে ট্যাকাও তো তার ভাবির।

কোটে প্রমাণ হবি?

অন্য সময়ে এরফান চুপ করে যায় কিন্তু আজ সেও যেন মরিয়ার মতো হয়ে ধরেছে বিষয়টাকে। সে বললো, কও বড়োভাই, কোট বড়ো না হক্‌-বেহক্‌ বড়ো?

এবার আলেফ ক্রুদ্ধ হলো। সে বেশ চড়া গলায় বললো, তুই চিরকালই বাগড়া দিবি। বাগড়া দেওয়াই তোর স্বভাব। এর আগেও জমি কিনবের যতবার গিছি বাধা দিছিস। এবার তোর কথা শুনবো মনেও ভাবিস না। তোর কথা শুনলে রহমৎ খন্দকারের জোলা অ্যাদ্দিন আমার হলেও হতো। আলেফ দু হাতের বুড়ো আঙুল তুলে এরফানের মুখের সম্মুখে নেড়ে দিলো। এরফান বললো, ছাওয়াল বাড়িতে, চেঁচায়ো না। আমি তোমাক কহ, বড়োভাই, ছাওয়ালেক পড়াবা, জমি কিনবা, এসব একসঙ্গে সামলাতে পারবা না।

এরফান অপ্রসন্ন মুখে বিদায় নিলো। আলেফও ঝাজের সঙ্গে উঠে তার বাইরের ঘর আর মসজিদের মধ্যের ব্যবধানটুকুতে দ্রুতপদে পায়চারি করে বেড়াতে লাগলো।রাত্রিতে ভালো ঘুম হলো না আলেফের। সকালে উঠে মুখ হাত ধুয়ে বাইরের ঘরের বারান্দায় বসে তামাক খেলো সে। প্রথম তামাকের পর দাওয়া থেকে নেমে একপাক ঘুরে এসে আবার সে তামাক সেজে নিয়ে বসলো। দ্বিতীয়বার তামাক খেয়ে অনেক বেলা হয়েছে স্থির করে সে যখন এরফানের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলো তখন সে বাড়িতে মাত্র দু’একজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এরফানের বড়োবিবি বোধহয় রাখালকে হুকুম করছিলো গাই বলদ সম্বন্ধে।

আলেফ ডাকলো, এরফান!

রাখাল সাড়া দিতে এলে আলেফ বললো, ডাকাডাকির কাম নি, তামাক সাজে দিয়ে যা।

অতঃপর আলেফ এরফানের দাওয়ায় বসে তামাক খেতে লাগলো।

অনেকটা সময় পরে এরফান এলো। এত সকালে যে?

ইসমাইলের জমি নেওয়ার কাম নি, কী কস?

এরফান উত্তর না দিয়ে মৃদু মৃদু হাসলো।

কলি নে কিছু?

কাল ভাবে দেখলাম জমির লোভ আমারও কম না। আমি চাপে রাখি। তুমি রাখো না। বুঝবের পারি নে; মন কয় নগদ টাকার উপর আমার মায়া বেশি, সেজন্যেই চাপে রাখি। বোকা বোকা মুখ করে এরফান বললো।

আলেফ বললো, তবে যে? তা শোনেক, আমিও কাল ভাবে ঠিক করলাম, ইসমাইলের জমি নেওয়ার কাম নাই। আর নেওয়াই যদি হয় তবে জমির দামই দেবো। দুই সনের ফসলের দাম আগাম দিয়ে এই সনেই জমি খালাস করার কাম নাই। দুই সন জমি আমার নামে যদি থাকে তবে ইসমাইলের ভাবি যা করার করবি। তারপর আর কী?

এরফান বললো, তা করো। ছাওয়ালেক তাইলে কিছু দিবের পারবা।

হয়, যা তুই কস, বাঁধে থোবো। কনে থুবি তাই থুস।

আমি এক কথা কই।

কী কবা আর?

ইসমাইলের জমি আর যে নেয় নিউক, তোমার নেওয়া লাগে না। জোলার জমি চাও আমি জোগাড় করে দিবের পারি। মুখ নিচু করে এরফান বললো।

আবার ফজরেই ঠাট্টা লাগালি?

ঠাট্টা না। কাল বড়োবিবির সঙ্গে কথা কলাম। সেই-ই কলে।

কী কলে?

কয় যে, ইসমাইলের জমি না কিনে সেই দেড় হাজার ভাসুর ছাওয়ালের নামে বাঁধে থুক, তার বদলা–

কী তার বদলা?

তার বদলা আমাদের এজমালি জোলায় আমার অংশ তোমাক দিবো।

অল্‌-হম্‌-দলিল্লা!

না। বড়োভাই, ভাবে দেখলাম বড়োবিবির এ বুদ্ধি ভালো। তোমারও জোলায় জমি হলো, ছাওয়ালের ট্যাকাও বাঁধা হলো। কিন্তুক এক শর্ত থাকবি কয়ে দিলাম।

ঠাট্টা করিস কেন্?

ঠাট্টা না। তুমি শর্ত মানলি আমি লিখে-পড়ে দেবো। শর্ত এই–যদি বাঁচে থাকো ছাওয়ালের পড়া বন্ধ করবের পারবা না।

অভিভূত আলেফ নির্বাক হয়ে এরফানের মুখের দিকে চেয়ে রইলো।

কোনো কোনো খবর প্রথমে এমন অভিভূত করে দেয় যে তার সবটুকু মাধুর্য সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করা যায় না। তারপর মাটির তলা থেকে পাওয়া যখের ঘড়ার মতো যত মাজা যায় তত চাদিটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্রথম দুদিন আলেফকে বিশ্বাস করার জন্য চেষ্টা করতে হলো। হেলাফেলার জিনিস নয়, পৈতৃক, জোলার জমি। এরফানের মনেও যে জমির লোভ আছে, এ কথা সে নিজেই বলেছে অকপটে। কীসের জোরে এমন দানটা করা যায় আলেফ ভেবে পেলো। না। ছেলেকে টাকা দেওয়াই যদি উদ্দেশ্য হলো জোলার জমিটুকুর স্বামিত্ব ত্যাগ না করে নগদ টাকাই সে দিতে পারতো। এ যেন বাধা দিয়ে দিয়ে আলেফের জমি কেনার সুযোগ নষ্ট করার খেসারত দেওয়া। এ যেন দেখিয়ে দেওয়া, বড়োভাই, জমিতে লোভ ছাড়তে বলেছি তোমাক, লোভ ছাড়তে এই দ্যাখো আমি পারি।

জমি কেনার ব্যাপার নিয়ে এ পর্যন্ত আলেফের যত কথা হয়েছে সে সবই একসঙ্গে মনে পড়লো। যোগ-বিয়োগ করে ফলে আলেফের লাভই দাঁড়িয়েছে। বিনা টাকায় জোলার সবচাইতে ভালো জায়গায় জমি হয়েছে তার।রহম খন্দকারের অভিসম্পাত লাগেনি,হাজিসাহেবের কাছে। মুখ ছোটো হয়নি, আর চিকন্দির ছেলেরা গান বাঁধেনি তার নামে। ভাবো দেখি যদি ওরা গান বাঁধতো আর সে গান শুনতো ছেলে!

একদিন সন্ধ্যায় জমি থেকে ফিরতে ফিরতে আলেফ এসব কথাই ভাবছিলো। আগামীকাল ছেলে কলকাতায় যাবে। তার ডাক্তারি পড়াই স্থির হয়েছে। দূর থেকে মসজিদটাই চোখে পড়লো আলেফের। সে ভাবলো স্বগতোক্তির মতো করে–কেন্ রে, জমি দিছিস, দিছিস; তাই বলে কি তোক ঠকাবো? জমিতে খাটবো-খোটবো, খরচা করবো। ফসল উঠলি নেয্য ভাগ তোক । দিবো। তফাৎ এই, জমিটার সবটু আমার নামে হবি। তোর হক দাবায় কে। ফসলের আদ্দেক যদি তোক না দিছি কইছি কী। তুই ছোটোভাই হয়ে জমি দিবের পারিস আর আমি ফসল দিবের পারি না।

একটা তীব্র চিৎকারের আকস্মিক শব্দে চমকে উঠে আলেফ থেমে দাঁড়ালো। পরক্ষণেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাসি হাসি মুখে বললো সে নিজেকে শুনিয়ে, কে, আজান দেয় নাকি? খোদার কাছে ডাকতেছে ফকির। দ্যাখো দেখি কাণ্ড!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *