১৩. সাপ্তাহিক খোঁজখবর

সাপ্তাহিক খোঁজখবর নেবার দিনে চৈতন্য সাহার এজাহারটা আবার কনকদারোগার নজরে পড়লো। এর আগে পড়ে সে ছোটো দারোগা ছলিমুল্লার সঙ্গে একমত হয়েছিলো। এজাহারটাই উল্টোপাল্টা কথায় তৈরি। যে মারবে বলে লাঠি নিয়ে যায়, সে আবার ধর্মকথা শুনিয়ে বলে–খবরদার ধান কাটবে না। আর এই মূল আসামীর সঙ্গে আর একদল যোগ রাখছে গানের সূত্রে। ছলিমুল্লা বলেছিলো, গানের বিরুদ্ধে এজাহার থানার দারোগা কী করবে? এ কি জাতীয় সংগীত? জমিদারও নাকি রামচন্দ্রর সঙ্গে যোগ দিয়েছে। প্রমাণ কী? জমিদার বাকি খাজনার জন্য মামলা করবে বলেছে। জমিদারের খাজনা আদায় যে ধারার অপরাধ সে ধারা পিনালকোডে নেই। কনক হেসে কিছু মন্তব্য করে ডায়েরি রেখে দিয়েছিলো।

আজ দ্বিতীয়বার পড়তে গিয়ে কনক চুরুট ধরালো। এজাহারে অন্তত একটি বিষয় আছে-মহাজনের বিরুদ্ধে চাষীদের সঙঘবদ্ধ প্রতিকূলতা। আপাতদৃষ্টিতে খাজনার জন্য। মহাজনের উপরে চাপ দেওয়া জমিদারের পক্ষে স্বাভাবিক, সেটির সঙ্গে চাষীদের প্রতিকূলতার কোনো যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু এক্ষেত্রে কনক যোগাযোগের সূত্রটি কল্পনা করে নিলোসান্যালমশাইয়ের সে ছেলেটি তবে গ্রামে ফিরেছে। অন্তরীণ অবস্থা থেকে ইচ্ছামতো বেরিয়ে আসা তার রীতি। এজন্য সে দুবার জেলও খেটেছে।

দশ মিনিটের মধ্যে কনক ঘোড়ায় চড়ে রওনা হলো চিকন্দির দিকে। চিকন্দির গাছগাছড়া ঢাকা পথে তখনো রোদ কড়া হয়ে ওঠেনি, কিন্তু এতখানি পথ জোরে ছুটে এসেদুপুরের রোদে পোড়া ঘর্মাক্ত একজন দারোগার মতো দেখাচ্ছে তাকে। এরকম চেহারা নিয়ে সান্যালবাড়ি যাওয়া চলে না। ঘোড়া থামিয়ে কনক তার প্রকাণ্ড রুমালখানি বার করে ঘাম মুছলো, সিগারেট ধরালো, খানিকটা সময় স্থির হয়ে রইলো; তার ও তার ঘোড়ার নিশ্বাসে সমতা এলে আবার সে চলতে আরম্ভ করলো।

আর খানিকটা যাবার পর কনক, দেখতে পেলো, একজন স্ত্রীলোক ও একটি পুরুষ আসছে। স্ত্রীলোকটির পরনের শাড়িটি দামী নয়, কিন্তু পরিচ্ছন্ন এবং উজ্জ্বল রঙের। উভয়ে পরস্পরের কোমরে হাত রেখে চলেছে। এ বয়সে এরকম চলা প্রথম প্রণয়ী সাঁওতালদের পক্ষে হয়তো সম্ভব। এই ভাবলো কনক এবং জিজ্ঞাসা করলো, দ্যাখো, তোমরা এই গ্রামে থাকো?

হ্যাঁ। পুরুষটির চাইতে স্ত্রীলোকটি সপ্রতিভ; সে-ই এগিয়ে দাঁড়ালো।

তোমরা বলতে পারো, এ গ্রামের লোকদের সঙ্গে চৈতন্য সাহার বিবাদ লাগলো কেন?

বিবাদ লাগেনি, লাগলে ভালো ছিলো। স্ত্রীলোকটি বললো।

তুমি তো এ দেশের লোক নও বাপু, তোমার কথাগুলো তার প্রমাণ।

গোলমাল একটু আছে আমার কথায়।

তুমি বলতে পারো, রামচন্দ্র কেন চৈতন্য সাহাকে মারলো?

কখন মারলো? এই শুনলাম সব মিটে গেছে। কখন মারলো রে মুঙ্‌লা?

তা তো জানিনে। মুঙ্‌লা বললো।

যখন দরকার তখন পলায়ে থাকলো, আর এখন মারলো?

তোমার যেন খুব ভালো লাগলো সংবাদটা,কনক বললো, রামচন্দ্র চৈতন্য সাহাকে মারপিট করলে তুমি খুশি হও, কেমন?

এখন আর তার দরকার নেই। নীলের গাজন গেছে, আউসের চাষ হয় নাই; বৈশাখ যায়, কছু একটা করতে হবে। এখন তো সকলকেই খাটতে হবে। পদ্ম হাসলো।

তাহলে মারপিট হলে তুমি খুশি হতে?

শুধু আমি কে, ভগোমানও হতো।

কনক স্থির করলো এ গ্রামে যদি কোনদিন কোনো গোলমাল হয়, এই মেয়েটিকে আগে খুঁজে বার করতে হবে। কনক ঘোড়া ছেড়ে দিলো, কিন্তু আবার তাকে থামতে হলো। শহরের

কানো মেয়ে নয় তো, পুলিসের চোখের আড়ালে বেড়াচ্ছে।

অ্যাই, শোন!

আজ্ঞে।

পদ্ম কাছে এলে কনক এবার পুলিসি দৃষ্টিতে তার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো। শহরের পলাতক যে কয়টি মেয়ের ছবি তার কাগজপত্রে আছে, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে মনে মনে তুলনা করলো। বৈষ্ণবী ঈষৎ সংকুচিত হয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আচ্ছা যাও। কনক চিন্তা করতে করতে লাগাম আলগা করে দিলো।

কনক চলে গেলে মুঙ্‌লা বললো, শ্বশুরকে ধরতে আইছে, কেন পদ্মমণি?

পদ্ম বললো, তুই বাড়ি যা।

কী করবো?

সাহস দেবা, আমি একটু সান্যালবাড়ি যাবো। ছোটোবাবুকে খুঁজে বার করবো।

নোদিন সে বাড়ি গিছ? সারাদিন ধরে খুঁজলিও তাক খুঁজে পাবা না। আর পালেও কী কবা?

তোক যা কলাম, কর।

মুঙ্‌লা চলে গেলো। তারা যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো সেটা সান্যালদের বাগিচার সীমা। সেখান থেকে ঘোড়ার পথে সদর দরজায় যেতে অন্তত দশ-বারো মিনিট, কিন্তু বাগিচার আড়াআড়ি আম গাছগুলোর তলা দিয়ে ছুটতে পারলে খিড়কির পুকুরের জঙ্গলকে অগ্রাহ্য করতে পারলে পাঁচ-সাত মিনিটে অন্দরে পৌঁছানো যাবে। নিচু হয়ে কাঁটাতারের বেড়া গলে পদ্ম সান্যালবাড়ির দিকে ছুটলো।

কনক সান্যালদের কাছারি-ঘরে ঢুকে দেখলো, দশ বারোজন চাষী বসেছে মেঝেতে গোল হয়ে। একজন জরাজীর্ণ প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। ফরাশের উপরে বৃদ্ধ নায়েব, তার চারিপাশে গুটিকয়েক আমলা। তারা খাতাপত্র, কাগজ কলম নিয়ে ব্যস্ত।

নমস্কার, নায়েবমশাই।

নমস্কার। আসুন, বসুন।

পঞ্চায়েত নাকি? কনক হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলো।

তা একরকম। চৈতন্য কৃষকদের সঙ্গে একটা আপোষ করে ফেলছে। ইনি চৈতন্য সাহা, চেনেন বোধ হয়?

ইনি-ই?

কনকের পুলিসি দৃষ্টি ও নায়েবমশাইয়ের পদোপযুক্ত হাসির সম্মুখে চৈতন্য সাহা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।

এখানে রামচন্দ্রও আছে নাকি? কনক জিজ্ঞাসা করলো।

কৃষকদের মধ্যে স্থূলকায় একজন নড়েচড়ে বসে গোঁফে হাত দিলো।

বেশ। কিন্তু, ব্যাপার কী? রামচন্দ্র চৈতন্য সাহাকে হত্যার চেষ্টা করলো কেন?

রামচন্দ্র ও চৈতন্য সাহার মুখের অবস্থা দেখে মনে হলো কনকমাস্টার তাদের দুজনের মাথা ঠুকে দিয়েছে লেখাপড়ায় অবহেলার জন্য।

নায়েবমশাইয়ের অনুসন্ধানী দৃষ্টি পর্যায়ক্রমে রামচন্দ্র ও চৈতন্য সাহার মুখের উপরে পড়তে লাগলো।

না, না। তা করবি কেন। রামচন্দ্র আমার বন্ধু। ছোটকালে আমরা খেলছি একসাথে। কেন রামচন্দ্র, খেলি নাই? চৈতন্য প্রাণপণ করে বললো।

কিন্তু থানায় মিথ্যা এজাহার দিলে কী হয়, তা বুঝি আপনি জানেন না? কনক চোখ পাকালো।

রামচন্দ্রভাই, তুমি গাঁয়ের সকলের হয়ে কথা কতিছ, আমার হয়ে দারোগা হুজুরেক কও। চৈত্য সাহা করুণ হলো।

কথাটার আকস্মিকতায়, সম্ভাব্য হত্যাকারীর কাছে চৈতন্য সাহার এই আয়ভিক্ষার ভঙ্গিটিতে প্রথমে কনক ও নায়েবমশাই, এবং পরে সকলে হেসে উঠলো।

পদ্ম বৈষ্ণবী কনকের আগে সান্যালবাড়িতে পৌঁছেছিলো, এবং ছোটোবাবুকে খুঁজেও বার করেছিল। খাজনার জন্য চাপ দিয়েছেন তিনি এ-গুজব শুনে বিপদের সময়ে তার কথা মনে পড়লেও, ছটোবাবুর সামনাসামনি কোনো কথা বলা তার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়েছিলো। এমন সময়ে সেখানে সুমিতি এলো। সেতার ঘরের জানলা দিয়ে দারোগাকে দেখে চিনতে পেরেছিলো এবং স্থির করেছিলো, দারোগাকে তার ভদ্র ব্যবহারের জন্য ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।রূপুর হাতে কাজ ছিলো না। দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবির নকল তোলার চাইতে বউদির সঙ্গে একথা সেবলে সময় কাটানো ভালো। তাই করছিলো সে। পদ্ম অনুভব করলো, ছোটোবাবুকে বলা না গেলেও এ বউটিকে বলা যায়। কিছু কিছু আলাপ হলেও তখন সব কথা আলাপ করার সময় ছিলো না। এইরকম যোগাযোগ হওয়ায় কনক যখন রামচন্দ্রর লাঠালাঠির ব্যাপার শেষ করে হাসিমুখে কিন্তু সুকৌশলে বাকি খাজনা আদায়ের জন্য জমিদার ঠিক এই সময়েই কেন চাপ দিলেন এই তথ্যটি জেনে নেওয়ার চেষ্টা করছেনায়েবমশাইকে জেরা করে, একজন ভৃত্য এসে বললো, আপনাকে বাবুমশাইরা ডাকতেছেন।

নায়েব বললো, যান, পরে আলাপ হবে; অবশ্য আলাপ করার আগে আপনাকে বলে রাখা যায় বাকি খাজনা আদায়ের পূর্ণ অধিকার জমিদারের আছে। ১৮২০র কাগজপত্র আছে আমাদের।

কনক ভৃত্যটির পিছনে কিছুদূর চলে কাছারির একটি ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো।দরজায় দামী পর্দা দুলছে। কাছারির ঘরে ঢুকতে গিয়ে যে কলগুঞ্জনের শব্দ কানে এসেছিলো, এদিকে তেমন নেই। কী একটা অজ্ঞাত ফুলের গন্ধ আসছে যেন। সদরের পুলিস-অফিসের গুঞ্জনের পাশে অথচ একেবারে নিস্তব্ধ পুলিস-সাহেবের খাস কামরার কথা মনে হলো কনকের।

ঘরে ঢুকে কনক দেখলো, একটা গোলটেবিলের পাশে তিনজন বসে আছে, একজন প্রৌঢ়, একজন মহিলা এবং একটি কিশোর। কনক সান্যালমশাইকে চেনে, প্রৌঢ়টি সান্যালমশাই নন। কিশোরটিকে চেনা চেনা মনে হলো মুখের আদরায়, কিন্তু আসলে সেও অপরিচিত। মহিলাটির দিকে চোরা চোখে চেয়ে কনক চিনতে পারলো, দিঘার স্টেশনে এঁকে সে দেখেছিলো।

মহিলাটি সুমিতি। সে বলল, আমাদের একটু দরকার আছে, কিন্তু তার চাইতেও বড়ো দরকার আপনাকে ধন্যবাদ জানান। সেদিন আপনি সাহায্য না করলে এতটা পথ আমাকে পায়ে হেঁটে আসতে হতো।

না, না। সে আর কী।

প্রৌঢ়টি সদানন্দ। সে বললো, অনেক সেটা, আপনি যা করেছিলেন, ইংরেজরা যদি অধিকাংশ পুলিস কর্মচারীকে তেমনটি করার সাহস দিতো, তাদের রাজত্ব তাহলে এত শীঘ্র টলটলায়মান হতো না।

তা নয়, সে কিছু নয়। কনক বললো, এখনই টলটলায়মান বলাটা কষ্টকল্পনা।

অতি অবশ্য। কারণ রাজত্ব তো আর চোখের জল নয়। তবে ভাষায় ওটা চলে যাচ্ছে।

আমি সে অর্থে বলিনি।

তা-ও বুঝি, তা-ও বুঝি।

সুমিতি বললো, মাস্টারমশাই, আপনার আর যে কত ছাত্র চাই তা বুঝে উঠতে পারছি না।

সুমিতির কথায় কনকের কানের পাশ লাল হয়ে উঠলো। কিন্তু সুমিতির ঝরঝরে হাসির মধ্যে রাগ করাও কঠিন।

সুমিতি তখন-তখনই বললো, আপনার সঙ্গে একটি মেয়ে কথা বলতে চায়।

আমার সঙ্গে?

তাকে ডাকি?

ডাকুন।

ভিতরদিকের পর্দার কাছে গিয়ে সুমিতি ডাকলো, পদ্ম, এদিকে এসো।

বৈষ্ণবী ঘরে ঢুকে মুখ নিচু করে দাঁড়ালো।

কী বলবে, বলল।

পদ্মমণি বৈষ্ণবী বললো, আপনি রামচন্দ্রকে কয়েদ করতে চান, তা ভালো নয়।

ভালো নয় কেন, বলো তো।

অন্যায় সে করে নাই, চৈতন্য সার পিছনে লাগছিলাম আমরা। গান বাঁধার জন্যে আমি ছিদাম-মুঙ্‌লাকে খোঁচাতাম। গান বাঁধে দিছি আমি। তারপর ওরাও বাঁধছে।

গান বাঁধা অন্যায় নয়।

তাছাড়া আমরা আর কিছু করি নাই।

রামচন্দ্র চৈতন্য সাকে মারতে গিয়েছিলো।

চৈতন্য সা রামচন্দ্রর দুশো হাতের মধ্যেও ছিলো না।

‘কিন্তু, রামচন্দ্র তোমার কে, সেটা আমার জানা দরকার; এবং তার উপরেই নির্ভর করছে রামচন্দ্র সম্বন্ধে তোমার মতামতের মূল্য।

পদ্ম মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।তার মুখে ব্রীড়ার চিহ্ন ফুটি-ফুটি করছিলো, কিন্তু চোখের জল নেমে মুখের আর সব ভাবচিহ্নকে ঢেকে দিলো। সে আমার কেউ নয়–এ কথাটা বলতে তার কেন বা আটকালো!

সান্যালবাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে কনক দারোগা থানার পথ ধরলো। পদ্ম কথা বলতে-না পেরে চলে গিয়েছিলো, তারপরে খানিকটা সময় একথা-ওকথা নিয়ে আলাপ হয়েছিলো এদের সঙ্গে কনকের। সোপকরণ চা এসেছিলো, এবং প্রাথমিক সংকোচের পর কনককে আহার্যে চামচ দিতে হয়েছিলো। সুমিতি একসময়ে হেসে বলেছিলো, দাবোগাবাবু, এর সঙ্গে যখন আমাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো যোগই নেই, আশা করি রামচন্দ্রকে অ্যারেস্ট করা দরকার হবে না।

না, তা নেই।

ধন্যবাদ।

কনকদারোগা মুখোশও এঁটেছিলো মুখে, সে বক্রোক্তির সাহায্যে এ ব্যাপারে সান্যালমশাইয়ের বড় ছেলের যোগাযোগের ইঙ্গিত করেছিলো। সুমিতি রিনরিন করে হেসে বলেছিলো, এব্যাপারে সান্যালদের যোগ হচ্ছে খাজনা আদায় করার চেষ্টা আদালতের মারফত। কিন্তু সে প্ল্যানও আমার এই ছোটোভাইটির, তা যদি এর দাদার বলে চালাতে চেষ্টা করেন তবে এর প্রতি অন্যায় করা হবে।

কিন্তু সদানন্দমাস্টার বলেছিলো, এটাকে বিপ্লব বললে অন্যায় বলা হয় না। চাষীদের শক্তি আছে কিন্তু সব সময়ে চোখে পড়ে না। এটা সমস্যা বটে। আপনি পদ্মার তীর দিয়ে এলেন? ওকে দেখে কি মনে হয়েছে, ইচ্ছামাত্র আপনার থানা, আমাদের এই পাথরের বাড়ি, লোহার ব্রিজ–এ সবই মুছে দিতে পারে? মনে হওয়ার কথা নয়, কিন্তু ও তা পারে। শুধু প্লাবন দিয়ে, নয়, অসহযোগ করে, মুখ ফিরিয়ে নিয়েও যেমন অনেক জনপদকে করছে। যা কোনো কোনো সময়ে করে এবং সব সময়েই পারে, প্রয়োজন হলেই করে না কেন–এটা সমস্যা বটে। অবশ্য বিজ্ঞানসম্মত কারণ আছে, কিন্তু এখন তা আমার মাথায় আসছে না।

থানামুখো কনকের চোখের সম্মুখে এদের ছবিই ভাসতে লাগলো। মাথাভরা টাক, লাল মুখ, পরনে গরদের আগুন জামা, সদানন্দ মাস্টার; সুখলালিত রূপ; আর সুসজ্জিতা সুমিতি। সুমিতির হাতের বলয় দুটির আনুমানিক মূল্য তার পক্ষে আন্দাজ করাও কঠিন। অথচ রূপ? এ কথা কনক চিৎকার করে বলতে পারে তার স্ত্রী শিপ্রার যা ছিলো এবং যা থাকতে পারতো, তার কিছু নেই সুমিতির। সুমিতির হীরক বলয় আছে, এই বাড়ি আছে। কথা বললো যেন অনুগ্রহ করে। যদি নিজেরা দয়া করে ডেকে না পাঠাতে কথা বলাও সম্ভব হতোনা, কারণ ওয়ারেন্ট ছিলো না। কিন্তু ওয়ারেন্ট থাক বা না-থাক অনুরূপ অবস্থায় যে কোনো দারোগা এসে শিপ্রাকে জেরা করতে পারতো।

আর কী অপচয় অর্থের এবং মানুষের শ্রমের। সদানন্দ মাস্টারের অমন মহামূল্য জামা সব সময়ে পরে থাকার কী যুক্তি? সুমিতির পরনে যে শাড়ি ছিলো সেটা তার আটপৌরে, কিন্তু শিপ্রার পোশাকী একমাত্রটির চাইতেও দামী। কে দেখছে বলল, এই গ্রামে।

আর ওই ঘরখানি। আসবাবে গালিচায় সদরের ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবদের খাসকামরাও এমন নয়। কিন্তু গালিচার ধূলা না-ই থাক, ঘরের কোণে কোণে মাকড়সার জাল ছিলো। দু বছরেও এ ঘরখানি একবার ব্যবহৃত হয় কিনা কে জানে। তবু এতগুলো টাকার কী অনর্থক ব্যবহার। এমন কত সুসজ্জিত অব্যবহৃত ঘর এ বাড়িতে আছে কে বলবে!

পথের পরিসরটা এত কম যে পাশের একটা কুঁড়ের নিচু চালা কনকের গায়ে লাগলো। পচা খড়ের কয়েকটা কুচি তার ঝকঝকে খাকির হাতায় লেগে গেলো। বাড়িটার উঠোনে একটা আট দশ বছরের উলঙ্গ মেয়ে গোবর মেখে ঘুঁটে দিচ্ছে। এদের চোখে লাগে না, কিন্তু কনকের চোখে বিবস্ত্রা বলে মনে হলো। কী অশিক্ষা, তার চাইতে কত বেশি এই দারিদ্র্য!

বড়ো রাস্তা পেয়ে কনকের ঘোড়া দুলকি চালে চলতে লাগলো।

নিশ্চয়, নিশ্চয়; এর প্রতিকার চাষীরাই করতে পারে। কেন সহ্য করবে তারা, তাদেরই হাতের তৈরি ওই রাজপ্রাসাদ। সদানন্দমাস্টারের পদ্মার উপমাটি মনে পড়লো কনকের। আভিজাত্য? ছাই ছাই!

চিন্তাগুলি একটু থিতুলে কনক ভাবলো–বাহা রে! বিপ্লবী ধরতে এসে নিজেই বিপ্লবী হলাম!

লোকের মুখে কনক অসন্তোষের কথা এর আগেও শুনেছে, তার সেই সব বন্দী বাবুরা তাকে এরকম ব্যাপারটাই বুঝিয়েছে, কিন্তু কনক সবটুকু বিশ্বাস করেনি। বন্দুকের কুঁদোর কাঠে যে ঘুণ ধরেছে এটা যেন নিজেকে দিয়েই সে অকস্মাৎ বুঝতে পারলো। সে ভাবলো, হয়তো একদিন পুলিস কনস্টেবলরা ধর্মঘট করে বসবে।

কিন্তু একটা কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। তার মতো একজন পুলিসকর্মচারীকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য ব্যক্তিগতভাবে এদের না এলেও চলতো।নায়েবকর্মচারী মারফত জানালেও খুব হতো। এটায় যেন এই বধূটির বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে।

একটা বাতাস উঠেছে। কনক ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দিলো। আর বেশি বাতাস উঠলে বুধেডাঙার বেলেমাটির পথে চলতে কষ্ট হবে। সান্দারদের পাড়ায় ধুলোর ঝড় উঠবে।

কিন্তু হঠাৎ তার ঘোড়াটা থেমে গেলো, কান দুটো খাড়া করে দিলো।

চল্‌।

ঘোড়াটা ধীরে ধীরে চলতে লাগলো।

শুয়োর-টুয়োর নাকি! যেরকম জঙ্গল পথের ধারে, আশ্চর্য হবার কিছু নেই। রিভলবারটা হাতে নিলো কনক। ডানদিকের ঝোঁপটা দুলে উঠলো। প্রাণীটা ওর ভিতরেই আছে।কী সর্বনাশ, মানুষ! কিন্তু এত বড়ো সাহস কার এই গ্রামে যে পুলিসের সশস্ত্র দারোগাকে আক্রমণ করার জন্য গুঁড়ি মেরে বসে থাকবে। সান্যালমশাইয়ের ছেলে? না–তাই বা কী করে হবে। বিপ্লবীরা দারোগা খুন করে বটে, কিন্তু শুধুমাত্র খোঁজখবর নেওয়া ছাড়া সে তো বিপ্লবপন্থী সান্যাল-ছেলের কিছুই ক্ষতি করেনি। কনকের বুকের ভিতরটা হিম হয়ে গেলো। রিভলবার উদ্যত রেখে ঘোড়াকে ধীরে ধীরে চালিয়ে কনক অগ্রসর হলো।

মাথার উপরে হাত তুলে যে উঠে দাঁড়ালো সে চৈতন্য সাহা। ঘোড়র পায়ের শব্দে পিছন ফিরে দূর থেকে কনকদারোগাকে দেখে তার চোখের আড়ালে থাকবার জন্য সে পথের পাশের এই ঝোঁপটাকে আশ্রয় করেছিলো। কিন্তু তার এমন পরিণতি হবে বুঝতে পারেনি।

কনক হো হো করে হেসে উঠলো। থানার ডায়েরিতে লেখা গানের কথা মনে পড়লো তার।

ভাগ্ চিতিসাপ!

চৈতন্য সাহা ঝোঁপঝাড় ভেঙেচুরে, খানাখন্দ ডিঙিয়ে টপকে ছুট দিলো। কনক অমন হাসি অনেকদিন আসেনি। তার হাসির অস্বাভাবিক শব্দে ঘোড়াটা ভয় পেয়ে ফোঁসফোঁস করতে লাগলো।

কিন্তু দেরি করার সময় ছিলো না। দু-একবার গাছপালা নড়ে উঠলো, কয়েকটা বড়ো বড়ো ফেঁটায় জলও পড়লো। আকাশে যুধ্যমান হাওয়াই জাহাজের মতো দ্রুতগতিতে মেঘ চলেছে। কনক ঘোড়ার গতি দ্রুততর করে দিলো। যদি ভালো করে বর্ষা নামে বুধেভাঙার কাদায় ঘোড়া অচল হয়ে পড়বে।

কনকের পিছন দিকে তখন বর্ষা নামলো চিকন্দিতে। চৈতন্য সাহা ভিজলো, বাড়ি ফিরতে ফিরতে রামচন্দ্ররাও। বৈশাখের এত সব বাতাস কোথায় আকাশের কোন দ–এ আটকে ছিলো, রামচন্দ্রর হাসির মতো শব্দ করে বজ্র, বাজ, ঠাটা পড়ে সে-দ–এর বাঁধে চিড় খেয়ে খেয়ে গেলো, বাতাস হু-হুঁ করে বেরিয়ে এলো। সান্যালবাড়ির কাছারির জানলা দিয়ে, লাইমশাখার গন্ধ ধুয়ে নিয়ে তাদের বসবার ঘরে জলের ছাঁট ঢুকলো।

ঝোঁপঝাড়, খানাখন্দ, উঁচুনিচু, তে-ফলন আর হাজা শুখা জমি একসঙ্গে ভিজতে লাগলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *