০৯. অনসূয়া সান্যালমশাইয়ের

অনসূয়া সান্যালমশাইয়ের পুঁথিঘরের দিকে যেতে যেতে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

বিস্মৃতপ্রায় অতীতে সুকৃতি একবার এক সমস্যা সৃষ্টি করেছিলো, আর এতদিন পরে আর-একটির সৃষ্টি করেছে সুমিতি। অন্যের সমস্যা হলে আলোচনা করে বুদ্ধি বাৎলে দেওয়া যায়, কিন্তু যে কথাটা মনে করতে গিয়ে বুকটা মুচড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে কী করে তা আলোচনা করা যাবে।

তিনি মা, সহ্যকরাই তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস কিন্তু ঐ লোকটির কেমন লাগবে? পুরাতনপন্থী লোক, হয়তোবা খোকার বিয়ের ব্যাপারে কত উচ্চাশা পোষণ করেছেন, চাপা লোক তাই প্রকাশ করেন না। খোকা বিয়ে করলো, একটা সংবাদ দেওয়া পর্যন্ত দরকার বোধ করলো না! তবু যা হোক, অশ্রু রোধ করে ভাবলেন সান্যালগিন্নি অনসূয়া, ভিন্ন সম্প্রদায়ে বিয়ে করে এত বড়ো বংশটার মাথা হেঁট করে দেয়নি। কিন্তু এতে প্রবোধ হয় না, অভিমান অত সহজে ভুলবার নয়।

পুঁথিঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অনসূয়া দেখতে পেলেন রূপু আলমারিতে বই খুঁজছে আর টেবিলের সামনে বসে সান্যালমশাই সদানন্দ মাস্টারের সঙ্গে কথা বলছেন।

সান্যালমশাই বললেন–হরিশচন্দ্র ও লঙ দুজনেরই অভাব হলো, খানিকটা ছন্নছাড়া হয়ে গেলো আন্দোলনটা। তা হলেও এটা কিন্তু জাতীয়তার আন্দোলন ছিলো না। ইংরেজদের কাছে। সুবিচার পাওয়ার চেষ্টাই ছিলো।

সদানন্দ বললো–তার চাইতেও বড়ো কথা এমন একটি স্বতঃপ্রবৃত্ত উঠে বসার চেষ্টা চাষীদের মধ্যে সব সময়ে দেখা যায় না, যেমন হয়েছিলো নীল-আন্দোলনের সময়ে কিংবা তার চাইতে ছোটো সিরাজগঞ্জের প্রজাবিদ্রোহে।

রূপু লাল খেরোয় বাঁধানো বড়ো একটা বই এনে টেবিলের উপরে রাখলো। পাতা উল্টোতে উল্টোতে সান্যালমশাই বললেন–সে সময়ের খবরের কাগজের কতগুলি বাবার পুরনো কাগজপত্রের বাক্সে পেয়ে বাঁধিয়ে রেখেছি। কতগুলি হাতে-লেখা কাগজও আছে। এই গ্রামে ও আশেপাশে যে-গান তৈরি হয়েছিলো, তার কিছু কিছু পাবে। পড়ে দেখো সদানন্দ।

রূপু বললে–বাবা, ওদের গান একদিন শুনলে হয় না?

সান্যালমশাই বললেন–ওদের গানে যদি তোমার বাবার নিন্দা থাকে?

রূপু বললে–থাকলেই হলো! আপনি কি কখনো কোনো অন্যায় কাজ করেছেন?

সান্যালমশাই মৃদু মৃদু হাসলেন। কিন্তু বললেন–ওসব পথের গান, বাড়িতে ডেকে আনতে নেই।

সদানন্দ বললো, এখন এসো, একটু ভূগোল পড়ে নিই।

হ্যাঁ, এবার পড়ো তোমরা। সান্যালমশাই উঠে দাঁড়ালেন।

অনসূয়া দরজার কাছ থেকে সরে প্যাসেজে দাঁড়ালেন। তাঁর মনে পড়লো তাঁর বড়োছেলের লেখাপড়ার কথা। সবই যেন অতীত, কত সুদূরের অতীত। কিন্তু অতীত ভাবতে গিয়েই মায়ের মন ছটফট করে উঠলো–আহা, আহা, তা কেন, খোকা মারাত্মক একটা ভুলও যদি করে থাকে তা বলেই তার সব কিছু অতীত হবে কেন?

সান্যালমশাই তাকে দেখতে পেয়ে বললেন–ছেলের লেখাপড়ার খোঁজ করতে এসেছিলে? কিন্তু তোমার বাড়িতে তো আজ অতিথি আছে।

অনসূয়া পাশে পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললেন–বড়োছেলের খবর অনেকদিন পাওয়া যায় না।

যেমহীরাবণ সেটা হয়েছে, ভূমিষ্ঠ হয়েই যুদ্ধ করতে চায়। খবর দেবার সময় কোথায় তার। তাহলেও নিজের বাপ মাকে—

ওর ধর্ম-মায়ের কথা বুঝি শোনোনি?

অনসূয়া নিজের বক্তব্য উপস্থিত করার জন্য যে-সূত্রটা পেয়েছিলেন, সেটা হাতছাড়া হলো। অন্য আর-একটি সূত্র প্রশ্নের আকারে উত্থাপন করলেন তিনি। ধর্ম-মা? বিয়ে করেছে, শাশুড়িদের কারো কথা বলছো? তোমাকে লিখেছে বুঝি?

না, খাঁটি ধর্ম-মা। তার চেহারার বর্ণনাও একদিন পড়লাম ওর চিঠিতে। বোধ হয় জেলের মেয়ে, জলে-জলেই দিন কাটে। দাঁতের বর্ণনা নেই, কিন্তু কপালের বর্ণনা আছে, আকাশছোঁয়া কপাল!

অনসূয়ার সূত্রগুলি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো, তিনি বললেন–বলো কী, সেই জেলের মেয়ে হলো আমার ছেলের মা? আর তার রূপ বর্ণনা করেছে ছেলে তোমার কাছে! চিঠিটা দিও তো।

তাছাড়া মেয়েটির রুচিও বোধ হয় ভালো নয়, ছেলেপুলে আছে, তবু নাকি সবুজে রঙের শাড়ি পরে আঁচল উড়িয়ে বেড়ায়।

‘ধিক্ ধিক্‌!

সান্যালমশাই হেসে বললেন–এতদিন পরে আমার রুচি তোমার অজানা নেই। বড়ো কপাল আমার কোনোদিনই পছন্দ নয়।

অনসূয়া রাগ করে বললেন–তোমার প্রশ্রয়েই ছেলে এমন বেড়ে উঠেছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, তুমি শাসন করো না। ওদের সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করো। তোমার এই সেকেলে পরিহাসও আমার ভালো লাগে না।

সেটা আমার দোষ নয়, অনসূয়া। বিলেতি কায়দায় ছেলে মানুষ করার ঝোঁক ছিলো তোমার। ছেলেদের স্কুল-কলেজে যেতে দিলেন। পাস দিলো না যে চাকরি পাবে।মধ্যের থেকে সদানন্দ বেচারার ভবিষ্যৎটা গেলো। কোনো কলেজে মাস্টারি করবে সে ক্ষমতাও ওর নেই। ভাবছি ওর মাসোহারাটা কিছু বাড়িয়ে দেবো। আর কিছু না করুক ছেলেকে অন্তত বিলেত ফেরতদের মতো জেল খাটা শিখিয়েছে।

জেল খাটার কথায় অনসূয়ার মনে পড়লো কবিদের মধ্যে একজন দেশকে ‘অম্বরচুম্বিতা ভাল-হিমাচল’ বলে বর্ণনা করেছেন বটে। জেলের মেয়ের পরিচয় বুঝতে পেরে তিনি হেসে ফেললেন, বলেন, খুব জেলেবউ-এর গল্প বলেছে।

এবং তখন-তখনই তার বক্তব্যের সূত্র আবার স্থাপন করলেন, কিন্তু এখন তুমি হাসছে তার দেশের কাজের কথায়, যদি সে সবদিক দিয়েই বিপ্লব সৃষ্টি করতে থাকে, সহ্য হবে তোমার? সমাজের বিধানগুলো, গৃহস্থজীবনের রীতিনীতিগুলোও যদি সে অগ্রাহ্য করতে শুরু করে–তা কখনো তোমার ভালো লাগবে না।

তার সেই গৃহ-বিপ্লবের কথা বলছো? সেই দুই হাত দিয়ে পৃথিবীকে সম্মুখে এগিয়ে দেওয়া? মন্দ কী। ওটা এক ইংরেজ কবির ভাষা।

তোমার প্রশ্রয় যে ছেলেগুলিকে আর কতভাবেনষ্ট করবে আমি ভেবে পাইনে। জমিদারের ছেলে হয়েও সে যখন জমিদারী প্রথা ধ্বংস করতে চায় তখনো তুমি চুপ করে থাকো। তুমি কি  বোঝো না ওদের হাতে পড়লে আমার এই শ্বশুরের ভিটের কী দুর্দশা হবে?

আমি তো দোষের কিছু দেখি না। অন্দরের বসবার ঘরে নিজের আসনে বসে সান্যালমশাই বললেন, এ বংশের অনেক ছেলেই বহুদিন ধরে মিনমিন করে জীবন কাটিয়ে দিলো। বহুদিন পরে যদি দু-একটি ছেলে দুর্মদ হয়ে ওঠে ভালোই হবে বোধ হয়।

কিন্তু জমিদারদের উচ্ছেদ করতে গেলে তোমার সঙ্গেই যে প্রথম বিবাদটা বাধবে না তার প্রমাণ কী?

কোনো প্রমাণই নেই। বরং বাধবেই, ধরে নিতে পারো। তবে তোমার বিপন্ন মুখ করার কোনো কারণ নেই। জমিদাররাও আটাশে ছেলে নয় যে হট বললেই হটে যাবে। আমার সঙ্গে তার বিবাদ হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। লোকে বলবে অমুক সান্যালের ছেলে জমিদারী প্রথার ধ্বংস কামনা করে অথচ নিজের পৈতৃক ব্যাপারে অতি ভালো ছেলে। ছেলের এ অপবাদ আমি কখনো সহ্য করতে পারি না, বড়োবউ। বাপ-বেটার বিবাদ, সেটা ঠিক ধর্মযুদ্ধ হবে না। এ যুগের কেউই কূটকৌশলের চেষ্টা না করে ছাড়বে না। শুধু আইন বদলানোর আন্দোলন নয়, রক্তপাতও হতে পারে। বড়ো কাজের জন্য রক্তের মতো দামী জিনিসের প্রয়োজন হয় কখনো কখনো। তোমার ঐ চরনকাশির চরের জন্যে নীলকরদের সঙ্গে মারপিট হয়েছিলো সান্যালদের।

অনসূয়া শঙ্কিত হলেন। এটা রহস্যের সুরে বলা একটা কথামাত্র! তথাপি তার আড়ালে কিছু কিছু দৃঢ়তা লুকিয়ে রইলো। পর পর কয়েকটি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে এ বাড়ির মা হয়েছিলো বলে বর্তমানে সান্যালমশাইয়ের চেহারায় বলবার মতো কোনো বৈশিষ্ট্য সেখে পড়ে না, কিন্তু কয়েকটি পুরুষ ডিঙিয়ে সাধারণ একটি মায়ের কোলে খনাসা একটি শিশু যদি আসতে পারে, এই শান্তিপ্রিয় প্রৌঢ়টির আটপৌরে স্বভাবের ভিতর থেকে সান্যালদের আক্রোশ বা রোষ প্রকাশ পাবে না, এ জোর করে বলা যায় না। বুদ্ধিমান সে-রোষকে আত্মঘাতী বলবে হয়তো, কিন্তু তার প্রতিহিংসা পৃথিবীর যে কোনো প্রতিহিংসার চাইতে কম নয়। হেস্টিংসের লাটগিরিকেও রেয়াত করে না সে-ক্রোধ।

যদি সত্যিই মতবাদ নিয়ে পিতাপুত্রে বিবাদ বেধে ওঠে তাহলে তিনি কী করবেন, এই দুশ্চিন্তা হলো অনসূয়ার। তার যে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে তা থেকে কীকরে তিনি পরিত্রাণ পাবেন? আর তেমনি একটি মত-পার্থক্যের সূচনা ইতিমধ্যে হয়েছে।

সান্যালমশাই হাসছেন, তিনি হেসে বললেন, কিন্তু আপাতত দুশ্চিন্তার কোনো কারণ তোমার দেখছি না, প্রতিপক্ষ অনুপস্থিত। বরং সদানন্দকে একটু সমঝে দিও, চাষীদের কয়েকটা ছেলে কী গান করলো, সেটার সাথে নীল বিদ্রোহের তুলনা রূপুর মাথায় যেন ঢুকিয়ে না দেয়। এরকম চেষ্টা হচ্ছে।

সবতাতেই তোমার ঠাট্টা।

না, পরিহাস নয়। তোমার বড়োছেলের লেখাপড়ার জন্যে আমাকে দায়ী করতে পারো না। তার যুক্তিগুলির গোড়ার কথা যে সদানন্দর, এমন সন্দেহ আজকাল আমার হচ্ছে।

অনসূয়া সান্যালমশাইয়ের হাসি-মাখানো মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। এই মানুষটির সঙ্গে ত্রিশ বছর কাটিয়েও যেন এঁর সবটুকু পরিচয় পাওয়া গেলো না। কোনটি লঘু পরিহাস, কোনটি কঠোর সত্য, এটা এখনো তিনি বুঝতে পারেন না। অকস্মাৎ এঁর একটি মনোভঙ্গি এত নতুন, এত অপরিচিত বলে বোধ হয় যে, অনসূয়া বিবাহিত জীবনের প্রাথমিক সেই দিনগুলির মতো কিছু অনুভব করেন।

সান্যালমশাই যখন ভৃত্যর হাত থেকে নিয়মমাফিক তামাক নিয়ে তাতে মন দিলেন, সেই অবসরে অনসূয়া ভাবলেন–আর যা-ই হোক, যে অপ্রত্যাশিত ও অপ্রিয় বিবাহ ব্যাপারটির কথা তিনি একই কালে স্বামীকে বলতেও চাচ্ছেন, গোপন করারও চেষ্টা করছেন, সেটা বলার সময় এখন নয়। সান্যালমশাইয়ের সম্ভাব্য সুপ্ত রোষ কিংবা তার কথা বলার এই হাসিমাখা মিগ্ধ ভঙ্গি কোনোটিকে আঘাত করাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হলো না।

কিন্তু রাত্রির অনেকটা সময় বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে চিন্তা করতে হলো অনসূয়াকে। তিনি ভাবলেন–তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় সান্যালমশাই নিজে মেনে নিলেন এই বিবাহ; আত্মীয়, পরিজন, বন্ধুবান্ধব এরাও কি মানবে? তার চাইতে বড়ো কথা, গ্রামের লোকেরা কী বলবে। সাধারণ প্রজাদের মনে যদি প্রশ্ন জাগতে থাকে, যদি কুৎসা রটে। সহসা তার চোখে এই প্রজারাই বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালো। প্রজারা ও দাসদাসীরা এবং আশ্রিতরা যারা মুখ তুলে চেয়ে আছে, এসব পরিবারের বিবাহের ব্যাপার যাদের কাছে বহুদিন ধরে আলাপ করার, আনন্দ করার বিষয়; অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য, যাদের মতামতের খোঁজও কেউ করেনি, তাদের গ্রহণ করার ভঙ্গিটির উপরেই যেন বিষয়টি নির্ভর করছে।

তার মনে হলো : ছেলেমেয়েরা একটা কথা বুঝতে চায় না। মানুষ যত বৃদ্ধ হয়, মৃত্যুর দিকে এগুতে থাকে, তার বাঁচার প্রবৃত্তি, মৃত্যুকে অস্বীকার করার প্রবৃত্তি হয় তত তীব্র। সে সন্তানের মধ্যে নিজের আকৃতির প্রতিফলন নয় শুধু, মতামতের অনুসরণও খুঁজে পেতে চায়; সে অন্য আধারে মৃত্যুকে অস্বীকার করে থেকে গেলো এই যেন বলে যেতে চায়।

তারপর তিনি ভাবলেন : বিবাহটা কি শুধু দুটি প্রাণীর? একটা কাহিনী মনে হলো তার। এবংশের একটি স্ত্রী বিবাহের দুবছর পরে স্বামীকে হারিয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যু হয়নি, তিনি ইতর স্ত্রীদের নিয়ে ছন্নছাড়া হয়ে যেতে লাগলেন ক্রমশ। প্রথমে স্বামীকে ফেরাতে চেষ্টা করেছিলেন বউটি, তারপর করলেন অস্বীকার। তার মহলে স্বামীর প্রবেশ নিষিদ্ধ হলো। এতটা হলো যে জমিদারির মালিক হয়েও সে লোকটি স্ত্রীর মহলের দাসীদের মুখে যেতে পারবেন না আপনি এই হুকুম শুনে ফিরে গেলেন। সে যেন এক মাতৃতন্ত্রের পুনঃস্থাপন। স্ত্রীর অধিকার শ্বশুরের প্রতিষ্ঠাতেও, শুধু স্বামীতে নয় এই যেন প্রমাণ করেছিলেন বউটি। শ্বশুরবাড়ি স্বামীর চাইতে অনেক বড়ো। বিবাহটা শুধু দুজনের সম্বন্ধনয়। দুজনের হৃদয়ের গভীরতায় সীমা পাওয়া যায় না এমন বহু হুদয়ের সঙ্গে জড়িত। নতুন বিবাহ আর বাঈজী-প্রণয়ে কি প্রভেদ?

প্রকাশ্যে বিয়ের মন্ত্র পড়ুক ওরা এখানে। সেটা যদি অভিনয় হয়, হোক না। প্রায়শ্চিত্তর মতো লাগছে শুনতে, তাহলে তাই। তোমাদের কাছে হয়তো প্রস্তাবটা হাস্যকর শোনাবে, কিন্তু পিতামাতা যদি আঘাত সহ্য করতে পারে, পরিবর্তে তাদের মুখ রাখার জন্য একটা মিথ্যা অভিনয় করা কি খুব কঠিন হবে, সুমিতি?

মনে মনে এই কথাটি হুকুমের মতো করে বলে অনসূয়া একটু শান্ত হলেন।

.

সকালে স্নান সেরে ঘরে ঢুকে সুমিতি দেখলো আয়নার সামনে টেবিলটার উপরে একটি সিঁদুরের কৌটো। সেটা সেকেলেসোনার, ভারি এবং অত্যন্ত বড়ো। এটা অতিথির জন্য সংরক্ষিত বস্তুগুলির একটি নয়, উপহার দেওয়ার জন্য কিনে আনাও নয়। হয়তো-বা সান্যালগিন্নির নিজের ব্যবহার্য, কিংবা হয়তো এই সেকেল পরিবারের প্রথার সঙ্গে যুক্ত একটি উত্তরাধিকারচালিত সামগ্রী।

আয়নার সম্মুখে বসে সুমিতির মনে হলো, সান্যালবাড়ির প্রথম শাসন কৌটো মারফত তার কাছে এসে পৌঁছেছে। সিঁদুরহীন কপালে এ বাড়ির বউ হওয়া সম্ভব নয়, একটিমাত্র কথা ব্যয় না করেও সে কথাটি অনসূয়া তার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

বিবাহের চিরাচরিত প্রথা যদি না মেনে থাকে তারা, সেটার পিছনে পুরাতনকে অস্বীকার করার ইচ্ছাও যদি থেকে থাকে, তাকে সবসময়ে ঘোষণা করে বেড়াতে হবে এমন কথা নেই। প্রতিবাদ মানে পাহাড়ীদের মতো সর্বদা কোমরে কুকরি বেঁধে বেড়ানো নয়।

গোল করে কপালে টিপ আঁকতে আঁকতে সুমিতি ভাবলো সিঁথিতেও দিতে হবে নাকি? সামান্য একটু চেষ্টাতেই চুলগুলো চিরে সোজা সিঁথি করে সিঁদুর পরতে পারলো সে।

সিঁদুর পরে আয়নার দিকে চেয়ে সে লজ্জিত হলো। তার সে লজ্জাটি অন্য যে কোনো নববিবাহিতা অনুভব করে। এটা বুঝতে না পারলেও তার মনে হলো কেউ বা তাকে দেখে ফেলেছে।

চায়ের অভাব বোধ করছিলো সুমিতি, চায়ের সম্ভার নিয়ে ঝি এলো না, এলেন সান্যালগিন্নি খালি হাতে।

এসো তো।

সুমিতিকে পিছনে নিয়ে ঘর থেকে বার হলেন অনসূয়া। ঠাকুরঘরে প্রণাম করে বেরিয়ে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী সুমিতি দেখলো একটা ছোটোখাটো জনতা তার জন্য অপেক্ষা করছ। অনসূয়ার সঙ্গে সুমিতিকে দেখতে পেয়ে হুলু দিয়ে উঠলো তারা। কে একজন শাঁখও বাজালো। সভা করে অনেক সাবাস বাহবা পেয়েছে সে কিন্তু সহসা এই স্ত্রীমণ্ডলের সমবেত কণ্ঠে ‘বেশ বউ, বেশ বউ’ শুনে সুমিতিকে মাথা নত করতে হলো।

শুধু একজন এদের কথায় সায় দিলেন না। অনেক বয়স হয়েছে তার। কথা বলতে গেলে গলা কোথাও কোথাও কেঁপে যায়, কিন্তু এখনো তার দেহবর্ণ বয়সের নিষ্প্রভতাকে কাটিয়ে দর্শনীয়। তিনি বললেন, আমি ভাবি মেমসাহেব বুঝি। অনসূয়া বলে আমারই মতো, তা তোরাই বিচার কর। এ যে আফ্রিকার বুয়ার।

একটা চাপা হাসি কানে এলো সুমিতির।

প্রসন্ন হাসিতে অনসূয়া বললেন, উনি তোমার ঠানদিদি সুমিতি, প্রথমে ওঁকেই প্রণাম করতে হয়।

প্রণাম পর্ব শেষ করে সুমিতি ঘরে এসে দাঁড়ালো। স্নানের ঘর দেখে সুমিতির যেমন সামন্ততান্ত্রিকতা লক্ষ্য করে সচেতন হয়ে উঠেছিলো সেই মন কাজ করতে লাগলো। বিবাহযজ্ঞের ধোঁয়া শুধু নিশ্বাস ও দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে না, মনকেও করে। সেই মোহাচ্ছন্ন অবস্থায় অকাব্যকে কাব্য বলে ভ্রম হয়, নিছক কতগুলি বস্তুতান্ত্রিক প্রতিজ্ঞা এবং কতগুলি কষ্টবোধ্য মন্ত্রোচ্চারণ রম্য হয়ে ওঠে। তেমনি একটি মোহই যেন এরা বিকিরণ করছে। কিছুক্ষণ আগে প্রভাত হয়েছে। এরই মধ্যে আয়োজনের এতখানি যারা করেছে, রাত্রিতে পৌঁছবার আগে দিনটাকে তারা কীভাবে অনুপ্রাণিত করবে বলা কঠিন।

কাল রাত্রিতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত একটা সন্দেহ হয়েছিলো সুমিতির–এরা আদৌ তাকে বধূ হিসাবে গ্রহণ করবে।কনা, এখন আর সে সন্দেহ নেই; গ্রহণ নয় শুধু, বিপুল আয়োজন করে চিরাচরিত কোলাহলের মধ্যে গ্রহণ করছে।

পদশব্দে চোখ তুলে দেখলো সুমিতি, ঘরের ঠিক মাঝখানে অনসূয়া এবং একজন প্রৌঢ় এসে দাঁড়িয়েছেন। সুমিতির মনে হলো হাত তুলে নমস্কার জানানো উচিত, কিন্তু এগিয়ে গিয়ে অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে সে নতজানু হয়ে প্রণাম করলো।

তোমার শ্বশুর, সুমিতি। অনসূয়া বললেন।

কী বলা উচিত–এই ভাবতে ভাবতে চোখ তুলে সুমিতি সান্যালমশাইয়ের মুখ দেখতে পেলো। অতি সাধারণ একজন মানুষ, অথচ এ-অঞ্চলে এত বড়োমানুষ নাকি কেউ নেই।

সান্যালমশাই বললেন, কল্যাণ হোক। তারপর একটু যেন দ্রুতপদে তিনি চলে গেলেন। সুমিতির মনে হলো, সান্যালমশাইয়ের চোখ দুটি টলটল করছিলো।

দ্বিপ্রহরের আহারের ব্যাপারটা সেদিন সহজ হলোনা। ডালিমফুলি বেনারসি শাড়ি, ফিরোজা ওড়না, সদ্য-কেনা ঝকঝকে অলংকারে সজ্জিত হয়ে বিশেষভাবে নিমন্ত্রিত আত্মীয় ও জ্ঞাতিদের আহারের সম্মুখে দাঁড়াতে হলো তাকে একবার।

খেতে-খেতে কে একজন বললো, দাদা, আপনি যে এত চাপা তা আমি জানতাম না। বড়োছেলের বিয়ে, দশ গাঁয়ের লোক জানবে; জানাজানি হবার আগেও কানাকানি চলবে; তা নয়

সদানন্দ সান্যালমশাইয়ের হয়ে উত্তর দিলো, চারদিকে অশান্তি, প্রজাদের ঘরে হা অন্ন, এখন কি হৈ-হুঁল্লোড়ের বিয়ে ভালো দেখায়।

প্রথম লোকটি হাসতে-হাসতে বললো, মাস্টারমশাই নিজে যেমন, ঠিক তেমনি মানানসই কথাই বলেছেন। তিনি যে গ্রামে আছেন, এটা খোঁজ নিয়ে জানা যায় না বটে।

কয়েকজন মোসাহেবির ভঙ্গিতে হেসে উঠলো।

সান্যালমশাই বললেন, মিহির, তুমি সদানন্দের ব্যাপারে হাসছো, কিন্তু আসল ব্যাপারটা সে গোপন করে যাচ্ছে, তা ধরতে পারেনি।

না-না, গোপন করবো কেন?

 জেল খাটা যাদের উপজীব্য, লোকালয়ে আত্মপ্রকাশ করা যাদের চলে না, তাদের প্রকাশ্যে বিবাহ করারও মুখ নেই, এ কথাটাই সদানন্দ গোপন করছে।

দু’একজন হাসলো।

মিহির বললো, মাস্টার যে আমাদেরসুদ্ধ জেলে পাঠাননি, এটাই আশ্চর্য!

.

ঘরে ফিরে সুমিতি শাড়ি, ওড়না, অলংকার খুলে ফেলতে ফেলতে চিন্তা করলো। শাড়ির রং ও অলংকারের গঠনের কথা গণনীয় নয়। অন্যের রুচিমতো সাজসজ্জা করা জ্ঞান হওয়ার পরে তার এই প্রথম। তা হোক, একটা অভিনয় বলে সেটাকে মেনে নেওয়া যায়। এদের হাসি ও লঘু আলাপের পিছনে একটি প্রয়াস ছিলো, সেটা অতি সহজেই ধরা পড়ে। একজনকে মাঝে মাঝে নিজের মতামত প্রকাশ করার জন্য জেলে যেতে হয়, সেজন্যই যে তাকে বিবাহ ব্যাপারটা গোপনে সমাধা করতে হবে, এটা নিশ্চয়ই এরা বিশ্বাস করে না।

কিন্তু চিন্তার অবসর আজ এরা দেবে না। প্রায় তার সমবয়সী কয়েকটি স্ত্রীলোক এসে তাকে ঘিরে দাঁড়ালো। বেশভূষা ও আকৃতিতে লক্ষণীয় আর্থিক আভিজাত্য নেই তাদের, কিন্তু সুমিতি বিস্ময়ের সঙ্গে অনুভব করলো, তাদের এই কোলাহলে কিছুমাত্র অভিনয় নেই। বিশেষ করে একটি মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তার মনে ছাপ রাখলো। তার বেশভূষা সবচাইতে কম সোচ্চার, কিন্তু তার বড়ো বড়ো চোখ দুটির ক্ষমতা সম্বন্ধে যে সে সম্পূর্ণ সজ্ঞান তার পরিচয় তার চোখের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজলের রেখায়। সুমিতি কিছুক্ষণের মধ্যে পরিচয় পেলো মেয়েটি সম্বন্ধে তার ননদ।

মেয়েরা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলো, সুমিতির এই ননদ বললো, এদিকে জ্যাঠামশাইয়ের ঘর, জোরে হাসাহাসি করলে ওঁর কানে যাবে। বউকে গিরিতার করে নিয়ে চলো। সুমিতির ননদ পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো, আর অন্যান্যদের মাঝখানে সুমিতিকে যেতে হলো অন্দরমহলের দক্ষিণ সীমায় দক্ষিণী একটা ঘরে।

সুমিতির ননদের নামটা একটু অদ্ভুত-মনসা। অবশ্য তাতে মাধুর্যের হানি হয়নি। তার স্বামী তাকে মণি, মণিমালা ইত্যাদি বলে থাকে। এসব একমুহূর্তে জানতে পারলো সুমিতি। কথাগুলো বলেই মনসা বললে, হা বউ, তোমাকে দাদা কী বলেন?

সুমিতি সুন্দর একটা উত্তর ভেবে নেওয়ার আগেই মনসা হেসে বললো, হ্যাঁ গো, দাদার সঙ্গে তোমার কোনোদিন সত্যি দেখা হয়েছিলো তো? তুমি তার বউ তো, নাকি ঠকাতে এসেছো?

সুমিতির মুখে একটা ছায়া পড়ছিলো, সে হেসে-হোক একটু চেষ্টা করে বললো, মণিদিদি, তোমার জিভে বিষ আছে। কিন্তু তা হোক, তোমাকে আমি শিগগির শ্বশুরবাড়িতে ফিরতে দিচ্ছি। না।

মনসা তার চোখ দুটি ব্যবহার করলো।

সুমিতির মনে হলো কথাটা সে শুনতে ভালো শোনাবে বলেই বলেনি, সমস্ত মন দিয়েই বলেছে। মণি ভালোবাসার মতো। ।

.

দুপুর গড়িয়ে গেছে। সুমিতির ঘরে শোফাটায় শুয়ে গল্প করতে করতে মনসা রৌদ্রের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সুমিতি মনসার নিঃসংকোচ শোবার ভঙ্গিটি লক্ষ্য করলো। তারপর সে লক্ষ্য করলো অনসূয়া ক্লান্ত শ্লথ পায়ে ছাদটা পার হয়ে নিজের বসবার ঘরের দিকে যাচ্ছেন। সুমিতি শুনতে পেলো মাটি-উঠোনের বাঁধানো চত্বর থেকে যে থামগুলো দোতলার ছাদ পর্যন্ত উঠেছে, তারই একটা কার্নিশে বসে একজোড়া ঘুঘু ডাকছে। অনসূয়া কার সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলছেন। মাঝে মাঝে রান্নামহলের চত্বর থেকে ক্ষীণ একটা কোলাহল কানে আসছে।

মনসার সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করতে পেরেছে সুমিতি। মনসা সরাসরি প্রশ্ন করেছিলো, বিয়েটা কি গন্ধর্ব মতে হয়েছে, ভাই বউদি? সুমিতি একটু চিন্তা করে, একটু সময় নিয়ে বলেছিলো, না, ইংরেজি মতে। মনসা উত্তরটায় হাসির কী পেলো কে জানে। হাসতে হাসতে সহসা গম্ভীর হয়ে সে বিষ ঢাললো, বললো, ভাই বউদি, যে ইংরেজের সঙ্গে আমার দাদার আকৈশোর বিবাদ, নিজের জীবনে সেই ইংরেজের আদর্শ ছায়া ফেলো! তার এ হার স্বীকারের জন্য কি তুমি দায়ী, না তোমার চোখজোড়া?

সুমিতি নিজের দৃষ্টি আনত করে দেখলো মনসার চোখ দুটিতে টলটল করছে আশ্বাস। সে বললে, গন্ধর্ব মতে হলে কি আমাকে গ্রহণ করতে?

‘আমাদের গ্রহণ করার মূল্য কী তা আমি নিজে জানি না; নিশ্চয় আছে, নতুবা জ্যাঠাইমা তার জন্যে এত আয়োজন করতেন না। তবু তোমাদের কাছে যতটা সাহস আমরা আশা করি, এ ব্যাপারে তার পরিচয় নেই। অবশ্য এও নব গন্ধর্বমত, শুধু বয়স্য কিংবা বনস্পতিকে সাক্ষী রেখে সরকারের দু’একজন কর্মচারীকে রেখেছে কিন্তু সাক্ষীর কী প্রয়োজন হলো?

সুমিতি আবার চিন্তা করলো। এখানে আসবার প্রস্তাবটা তার নিজের। কারো সঙ্গে সে আলোচনা করেনি, কিন্তু অন্তরঙ্গ যারা তাদের সকলেই যে এই প্রস্তাবে সমস্বরেনা না করে উঠতো তাতে সন্দেহ নেই। এমনকী এই বাড়ির বড়োছেলেকে একদিন প্রস্তাব করায় সে বলেছিলো, সম্মানের যদি হানি হয়?

সুমিতি বললো, মণি, সাক্ষ্য থাকা না-থাকায় আমার নিজের কিছু এসে যায় না। তোমার দাদার হাতে কেউ আমাকে সম্প্রদান করলো কিনা তারও খুব বড়ো দাম নেই, কিন্তু গন্ধর্ব মতকে আমরা গ্রহণ করিনি, কারণ–

সুমিতির গাল দুটি লাল হলো। মনসা তার কথা কেড়ে নিয়ে বললো, কারণ বিয়ে শুধুদুজনে শেষ হবে মনে করোনি।

মনসা উঠে এসে সুমিতির পাশে বসে তার একখানা হাত নিজের হাতে নিলো কিন্তু এই ভঙ্গির বিপরীত সুরে কথা বললো, তুমি তো তাহলে আমাদের মতোই সাবধান। প্রেমের জন্য সবকিছু দিতে বসেও হিসেবের নাড়িতে টান লাগছে তোমার। খিলখিল করে হেসে বললো মনসা, দেন মোহর ব্যবস্থা করোনি তো?

কিন্তু, মনসা পরক্ষণেই গভীর সুরে বললো, আমার আর একটা ধারণা পরিচ্ছন্ন হলো আজ। বহুদিন ধারণা ছিলো তোমরা যারা ভালোবাসো তারা বিদ্রোহী, এখন মনে হচ্ছে প্রেমের সে বিদ্রোহ রংদার রাংতা।

কিন্তু তাহলেও সুমিতি নিজের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে স্বেচ্ছায় এসেছে, একথা কেউ কি বিশ্বাস করবে?নিজের বাড়িতে সুমিতি প্রমীলার মতো স্বাধীনা। তার এই যেচে আসা এবং এদের এই গ্রহণ করবার পদ্ধতি সুমিতির চরিত্রে খড় ও বাঁশ ছাড়া আর কিছু কি অবশিষ্ট রাখলো? তার সঙ্গে বিপন্ন আর একটি আশ্রয়কামীর কী পার্থক্য রইলো? সুমিতি অন্তর্বত্নী একথা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কি লোকে বলবে না বেকায়দায় পড়ে এসেছে সে? এদের চোখে মন্ত্রপড়া বিবাহ ছাড়া আর সববিবাহই কি অসংযমের গ্লানিমাত্র নয়? বিবাহের যে কোনো প্রথাই একটি সমাজিক স্বীকৃতিমাত্র। সেই স্বীকৃতি যদি না থাকে কী মূল্য রইলো প্রথার,কী প্রভেদ রইলো এই বিবাহের প্রথাহীন মিলনের সঙ্গে।

তখন কেউ সুমিতিকে দেখলে ভাবতে রৌদ্রের ভয়ংকর উত্তাপে মেয়েটির অত্যন্ত কষ্ট হচ্ছে।

মনসা ঘুমিয়ে পড়েছে। সুমিতি ভাবলো–আর যা-ই হোক, নিজের চরিত্র কী সেটা প্রকাশ । করার জন্য সে এখানে আসেনি, যেমন আসেনি এদের প্রথাগুলিকে আঘাত করে নিজের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে। যদি কেউ বলে–সে আশ্রয় চায়? উত্তরে সুমিতি হাসলো মনে মনে।

.

অনসূয়া অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে ঘরে এলেন। প্রায় বিশ বছর বাদে তিনি আজ কোমরে কাপড় বেঁধে রান্নার মহলে নেমেছিলেন। বিবাহের পরে এমনি আর একটা ঘটনা ঘটেছিলো, সেটা তার দিদিশাশুড়ির শ্রাদ্ধের সময়ে।বু সেদিন ছিলো একটি সুপরিকল্পিত কার্যক্রম।ব্যাপারটির মর্যাদা রক্ষা করাই ছিলো তার দায়িত্ব। কিন্তু আজ সকালে যখন আলাদীনের মতো ইচ্ছা কিন্তু তার প্রদীপনা নিয়েই মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়ালেন তখন হুকুম নির্দেশ দেবার অবসর ছিলোনা।মুখরক্ষা করতে হবে এই দৃঢ় সংকল্প ছিলো।

এ ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা কঠিন কাজ ছিলো সান্যালমশাইকে খবরটা দেওয়া। কাল বিকেল, সন্ধ্যা ও রাত্রিতে যা একান্ত অসম্ভব বলে বোধ হয়েছে, এখন সকালের দু’পাঁচ মিনিটে সেই খবরটা দিতে হবে; এবং খবর দেওয়াই শেষ নয়, তাকে অভিমান করার অবসর দেওয়া যাবে না, বরং সহায়তার জন্য ডাকতে হবে।

সান্যালমশাই তখন শয্যা ত্যাগ করেননি। অনসূয়া তার ঘরে এসে বিছানার একপাশে বসে বলেছিলেন, একটা বউভাতের ব্যবস্থা করে দিতে হয়।

বউভাত! কার? এখনো রাজ্যে বউভাত হচ্ছে নাকি?

খোকার।

খোকার? মানে তোমার বড়োছেলের?

অনসূয়ার ঠোঁট দুটি এই জায়গাটায় কাঁপছিলো। সান্যালমশাই লক্ষ্য করলেন সেটা।

তিনি বলেছিলেন, তোমার বড়োছেলে বিয়ে করেছে? সুমিতি কি সেই বউ? তবে তো বউভাত করতেই হবে।

সর্বাঙ্গসুন্দর না হলেও একটি হাসি আনতে পারলেন সান্যালমশাই, বললেন হাসতে হাসতে, ছেলেটা এতেও বিপ্লব আনলো।

অনসূয়া উঠে দাঁড়ালেন, দ্বিতীয়বার কথা বলার আগে পিছন ফিরে হাতের তেলোয় চোখ দুটি মুছে নিলেন, বললেন, বস্ত্র, আভরণ

নিশ্চয়, সদানন্দ এখনো ঘোড়ায় চড়তে পারে কিনা খোঁজ করি।

সান্যালমশাইয়ের মুখাবয়ব রক্তহীন, যেন একটা মুখোশের আড়ালে ঢাকা রইলো সবসময়ে।

কাজকর্ম মিটিয়ে অনসূয়া ঘরে এসে মনে মনে অনুসন্ধান করে জানতে পারলেন, বড়োছেলের একটিও নতুন ভোলা ফটো নেই ঘরে। প্রায় তিন বৎসর পূর্বে শেষবার তাকে তিনি দেখেছেন। মাঝে মাঝে ভাইদের চিঠিতে তার খবর পান। কিন্তু আজ যেমন করে তার ফটোর অভাব বোধ করলেন এমন অনেকদিন হয়নি।

পদশব্দে চোখ তুলে তার নিজস্ব দাসীকে দেখতে পেলেন অনসূয়া।

এই শরবতটুকু পাঠিয়ে দিলেন বুড়িদিদি।

আহা, তার খাওয়া হয়েছে তো? সব উল্টোপাল্টা ব্যাপার হলো আজ। তোমরা খেয়েছো?

আমরা এবার বসবো, কিন্তু আপনি এটুকু নিন।

বড্ড খাটলে আজ তোমরা।

বুড়িদিদি বলছিলেন–বাড়িতে অনেক আশ্চর্য আশ্চর্য ব্যাপার হয়েছে, কিন্তু পাঁচ ঘণ্টায় এমন বউভাত সাজাতে আর কেউ সাহস করেনি।

দাসী চলে গেলো। দাসপাড়া, সেনপাড়ার লোকেরা জোকার দিয়ে অন্দরের উঠোনে প্রবেশ করছে, খবর পাওয়া গেলো। এবং এ জোকারের স্বীকৃতিটুকু এ-উদ্যমের সার্থকতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *