০৬. শুধু পাল্কি করে আসা

শুধু পাল্কি করে আসার ব্যাপার নয়, দাঁড়ানোর ভঙ্গিটাও। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন সান্যালগিন্নি, সুমিতি যখন তার সামনে এসে দাঁড়ালো তখন সে অনেকদিনের পরিচিতের মতো রূপনারায়ণের একখানা হাত নিজের হাতে ধরে রেখেছে, হাসছে। একটু বিব্রত হলেও সে-হাসিটা সুন্দর। প্রার্থীর মতো লজ্জার হাসি নয় যে কুণ্ঠিত হতে হবে।

সুমিতি প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালে অনসূয়া বললেন–ঠিক চিনে উঠতে পারলাম না।

আমিও পারছিলাম না। তবু আমার পড়ার টেবিলে আপনার একখানা ফটো আছে, আপনি আমাকে কোনদিন দেখেননি।

কিন্তু চেনা-চেনা লাগছেও বটে।

তা লাগবে। আমি আপনাদের ছোটোবউ সুকৃতির বোন।

সুকৃতি! সুকৃতির বোন? সান্যালগিন্নি অনসূয়া হাত বাড়িয়ে ব্যানিস্টার চেপে ধরলেন।

এক মুহূর্ত পরে সুমিতির কাঁধে হাত রেখে বললেন–এসো, ঘরে এসো। তোমাদের বংশ খুব উদার। তোমাদের পক্ষেই এমন করে আসা সম্ভব। সান্যালগিন্নি দৃশ্যতই বিচলিত হয়েছেন।

সুমিতিকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অনসূয়া বললেন–খবর না দিয়ে এসে আমাকে খুশি করেছে কিন্তু নিজে কত কষ্ট পেলে।

না, কষ্ট হয়নি। একজন দারোগা আমাকে পাল্কি ঠিক করে দিয়েছিলো।

ওঁকে বললো খবর নিতে। লোকটি তাহলে ভদ্র।

ঘরে এসে অনসূয়া সুমিতিকে প্রশ্নের মাধুর্যে ডুবিয়ে দিলেন। কিন্তু কুশল প্রশ্নের মধ্যেই হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–তুমি এখন বিশ্রাম করো। ট্রেনের ক্লান্তিটা আগে যাক, আলাপ করবো।

অনসূয়া হাসিমুখে বেরিয়ে গেলেন কিন্তু কান্না তার বুকের ভিতরে উদ্বেল হয়ে উঠেছিলো। সুমিতিকে নিজের শোবার ঘরে বসিয়ে এসে নিজে কোথায় যাবেন খুঁজতে লাগলেন।

পনেরো-যোলো বছর আগেকার ঘটনা। দেবরকে বিবাহ দিলেন অনসূয়া, কলকাতার ব্যারিস্টার-পাড়ায় আত্মীয়তা করলেন। অনসূয়ার বহুদিনের ব্যবধানে থেকেও সে সব কালের ছোটো-ছোটো ঘটনা, ভুলে-যাওয়া কথাবার্তা মনে পড়তে লাগলো।

সম্বন্ধগুলির মধ্যে অনসূয়া যখন এটাকেই বেছে নিলেন, মাথায় উপরে শাশুড়ি ছিলো না, সান্যাল কপট বিরক্তিতে ভু কুঞ্চিত করে বলেছিলেন–ঐ সাহেবিপাড়ায়? আমাকে কি এখন। তামাক ছেড়ে চুরুট ধরতে হবে?

সান্যালগিন্নি অনসূয়া সুকণ্ঠে ঝংকার দিয়ে বলেছিলেন–আলো আসুক, একটা জানলা কাটো। প্রাগৈতিহাসিক মিনারে বাইরের আলো প্রবেশ করুক একটু।

শুধু বিলেত-ফেরত-পিতামাতার সন্তান বলেই নয়, সুকৃতি নানা দিক দিয়েই প্রশংসনীয়া ছিলো। গায়ের রঙটা বোধ হয় এই সুমিতি মেয়েটির চাইতে আর-একটু প্রকাশিত ছিলো। তার জ্ব দুটির কোনোটিতে যেন একটা কাটা দাগ ছিলো, ছোটোবেলার দুরন্তপনার চিহ্ন। আর সে বোধ হয় কথা বলার সময়ে ঠোঁট দুটিকে কেমন একটু উল্টে দিত। অনভ্যস্ত চোখে মনে হওয়া অস্বাভাবিক ছিলো না, মেয়েটি কোনো ব্যাপারকেই খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না।

সমগ্র দেশের ছোঁয়াছুঁয়ির বাইরে রাজনৈতিক চাঞ্চল্যহীন গড় শ্রীখণ্ডের গড়-অধিবাসীদের জীবনে একবারইমাত্র রাজনীতি প্রবেশ করলো। খবরের কাগজে পড়া রাজনীতির কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলো গ্রামটা। অনসূয়ার প্রার্থনার চাইতেও বেশি আলোক ফুটে উঠলো। কিন্তু সেটা বিদ্যুৎ-জ্বালা। মিনারের খিলানে-খিলানে আলোর উদ্ভাস এলো। মিনারটিও শতধা দীর্ণ হয়ে গেলো।

সান্যালমশাই কাছারিতে এসে বসেছেন। সম্মুখে প্রজাদের একটি ছোটোখাটো জনতা। তারা এসেছিলো পাটের দাদনের টাকা নিতে। লিভোয়ালকুঠির সাহেবরা যে-দাদন প্রতি বৎসর দেয় এবার তারা তা নেবে না, অথচ না-খেয়ে মরতে হবে কোনো দাদন না-পেলে। সান্যালের পক্ষে ব্যাপারটা ছিলো অন্যরকম। পাটের সাহেবের দালালরা এবং তাদের টাকার জোয়ারভাটা যথাক্রমে সান্যালের প্রতিপত্তির ভাগ নিচ্ছিলো এবং খাজনার একমুখী সহজ স্রোতের বাধা হয়েছিলো।

এমন সময়ে পুলিস এলো। ঘোড়া ও সাইকেল চেপেবড়ো ছোটো পুলিস অফিসারের একটি বাহিনী। অভূতপূর্ব দৃশ্য। কাহিনীতে শোনা, খবরের কাগজে পড়া একটা ব্যাপার তার নিজের বাড়িতে ঘটছে।

লিন্ডোয়াল কুঠির সাহেবের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিস সাহেবের সদ্ভাব থাকা খুবই স্বাভাবিক, তবু পুলিসের নির্বোধ অভিযানে সান্যাল হাসতে পারলেন না, অপমানিত বোধ করে স্তব্ধ হয়ে রইলেন। সারা বাড়িটা থমথম করছে।

কিন্তু যা ঘটে গেলো তার আশঙ্কা পুলিসরাও করেনি।

ছোটোবউয়ের বাক্স থেকে বেরুলো একখানা দুখানা নয়, পাঁচ-ছখানা চিঠি, যে-চিঠির হস্তাক্ষর পুলিসের নাকি পরিচিত। এতদিনে বোধ হয় সত্যিকারের নামটা ধরা পড়লো লোকটির।

চিঠিগুলো হাতে নিয়ে পুলিসের বড়োকর্তা সদরে এসে বসলেন। গম্ভীর মুখ করে বললেন আপনাদের ছোটোবউরানীকে কিছু প্রশ্ন করা দরকার। সান্যাল পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো হয়ে গেলেন।

–এই চিঠিগুলো পাওয়া গেছে ছোটো বউরানীর বাক্সে। এগুলোর লেখক আপনার ভাই নয়। ছোটোবউরানীর কোনো আত্মীয়ও নয় বোধ হয়।

চিঠিগুলো সত্যি কোথায় ছিলো, চিঠিতে কী লেখা আছে, আর জানার প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা তাতে আছে কিনা, যতটুকু আছে তাতে ছোটোবউরানী রাষ্ট্রদ্রোহীদের একজন বলে প্রমাণিত হয় কিনা এসব জানারও প্রয়োজন নেই। ছোটোবউরানীর বাক্স থেকে অপরিচিত একজন পুরুষের চিঠি বেরিয়েছে এ-ই যথেষ্ট। চারিদিকে আমলা-কর্মচারীরা দাঁড়িয়ে আছে, তারা কেউ কি খোঁজ করবে চিঠিতে কী লেখা আছে–অপরিচিত পুরুষের চিঠি এই কথাটা শোনার পর? সান্যালমশাই হাতের ইশারায় পুলিসের কর্তাকে নিরস্ত করলেন। তার চোখের কানায় কানায় অশ্রুও দেখা গেলো।

কিন্তু সব উল্টোপাল্টে গেলো। কথাটা অন্দরেও রটেছিলো ইতিমধ্যে। নাকি ভাগ্যের দান হিসাবে এই আবিষ্কার করে রটিয়ে দেওয়াই ছিলো পুলিসের উদ্দেশ্য? পুলিস প্রশ্ন করবে এ বোধ হয় সুকৃতির ভয় হয়েছিলো। বোধ হয় তার মনেও কথাটা বার বার গুটিয়ে গুটিয়ে উঠছিলোপরপুরুষের চিঠি।

খিড়কির পুকুরটার চারিদিকে এখন গভীর জঙ্গল। তারপর থেকেই ওটা অযত্নে পড়েছে। খিড়কির দরজায় যে-পুলিসটি পাহারায় ছিলো সে ছুটে এসে খবর দিলো।

–কী হয়েছে?

পুলিসের কর্তারা এবং সান্যাল নিজেও উঠে দাঁড়ালেন।

কে একজন জলে লাফিয়ে পড়লো। উঠলো না।

ঠিক দেখেছিলো সে। দামী শাড়ি ও অলঙ্কারের একটা ঝিলিক লেগেছিলো তার চোখে। সম্ভ্রমে চোখ নামিয়ে নিয়েছিলো সে। তারপরে ঠাহর করেছিলো বিষয়টি।

তারপরের দৃশ্যগুলি ভাবতে পারেন না সান্যালগিন্নি। অনুকম্পা ও বেদনার সঙ্গে ঘৃণাও মিশে যায় চিন্তায়। মন থেকে ভাবটাকে দূর করার জন্যই তিনি চেষ্টা করেন। মৃত্যুতে মৃত্যুতে বাড়িটা সেদিন ছেয়ে যেতে পারতো। রিভলবারসুদ্ধ সান্যালের হাত দুখানা তিনি প্রাণপণ বলে চেপে ধরেছিলেন। পুলিসদের সঙ্গে আর দেখা করতে দেননি।

রাজনীতি নয়, মিথ্যা একটা কলঙ্ক। তারই জন্য একটা প্রাণের অবসান হলো। সান্যাল লড়েছিলেন। কোর্টে নয়। তখনকার দিনে যতদূর হওয়া সম্ভব ছিলো, মিথ্যা কলঙ্ক রটানোর অভিযোগে পুলিসের বড়োকর্তা তিরস্কৃত হয়েছিলেন তার ওপরওয়ালাদের কাছে। কিন্তু শারি কথা দূরে থাকুক, সান্যালের ক্রোধের উপশমও হয়নি তাতে। সেই ক্রোধ হয়তোবা তাকে রাজনীতিগত প্রতিহিংসার পথে টেনে আনতে, ব্যাক্তিগত ক্রোধ জাতিগত বৈরে মিশে যেতে পারতো, কিন্তু সান্যালের ডান হাতখানাই ভেঙে দিলো তার ছোটোভাই। সান্যালবংশের ছেলে কিনা বৈষ্ণব সন্ন্যাসী হলো!

কিছুক্ষণ সান্যালগিন্নি অস্থিরচিত্তে এঘর-ওঘর করতে লাগলেন। এটা গোছান, ওটা ঝাড়েন নিজের হাতে। অবশেষে সান্যালের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে রূপু এসে খবর দিয়ে গেছে। খবরটা সারা বাড়িতে রাষ্ট্র করার ভার নিজের মাথায় নিয়ে রূপু ততক্ষণ এ-দরজায় ও দরজায় খবর বিলোচ্ছে।

সান্যাল বললেন–এসো।

অনসূয়া বললেন–ও সুমিতি, আমাদের সুকৃতির বোন।

-–শুনলাম তাই।

হোক একটা ছোটোমেয়ে, তবু মহামানী আত্মীয়। তাকে অভ্যর্থনা করা, তার আতিথ্যের যথোচিত ব্যবস্থা করা গুরুতর বিষয়। বেদনাটাও মনে পড়লো সান্যালমশাইয়েরও।

কিন্তু তিনি যা এইমাত্র বললেন তারপরে আর কী বলার থাকতে পারে? বিচলিত হয়ে সান্যালমশাই বললেন–কাউকে একটু তামাক দিতে বলল।

এদিকে অনসূয়া চলে যাওয়ার পরে বিপদ হলো সুমিতির। স্টেশনে নেমে কনকদারোগাকে যা সে বলে এসেছিলো সেকথাটা মনে পড়লো। এখানে নেমে সে নিজের যে-পরিচয় দিয়েছে– তার সঙ্গে কনকদারোগার কাছে দেওয়া আত্মপরিচয়ে পরস্পর বিরোধ না-থাকলেও পরিচয় দুটির পার্থক্য আছে। এ বাড়ির একটি স্ত্রী, আর এবাড়ির একটি স্ত্রীর আত্মীয় হওয়া এক ব্যাপার নয়। আজকের দিনটা এক পরিচয়ে সকলের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর কাল সকালে দ্বিতীয় পরিচয়টা সকলকে জানানো কী করে সম্ভব হবে? সুমিতির মনে হলো ইতিমধ্যে দেরি হয়ে, গেছে। এরপরে তার অন্য পরিচয়টি বলতে গেলে শ্রোতাদের চোখে যে বিস্ময় দেখা দেবে তার সঙ্গে অবিশ্বাসও থাকবেনা কি? অবিশ্বাস যদিনা-ও থাকেনানারকম সন্দেহ থাকবে তাদের গলায়।

কিন্তু একটা বাড়িতে ঢুকে কীকরে বলা যায় আমি আপনাদের বউ। সঙ্গে এবাড়ির ছেলেটি নেই তবুবলতে হবে আমি বেটা বউ আপনাদের। প্রথম পরিচয়ে এই কথা বলা যেন উপন্যাসে পঠিত স্বামী-পরিত্যক্ত স্ত্রীদের আত্ম-অধিকারের দাবির মতো শোনাবে।

সুমিতির আবার মনে হলো এমন সমস্যাসঙ্কুল দেশে আসা ভালো হয়নি। সংসারে চলা রাজনীতির চাইতেও কঠিন এই মনে হলো তার। আসার উদ্যোগ করতে করতে নিজে সে এখানকার সকলকে কী করে গ্রহণ করবে এটাই ভেবেছিলো। তাকে এরা কীভাবে গ্রহণ করবে । সেকথাটা মনে হতেই স্বতঃসিদ্ধের মতো সে ধরে নিয়েছিলো একজন ভদ্রমহিলাকে একটি ভদ্র পরিবার যেভাবে গ্রহণ করে তাই হবে। কিন্তু ঠিক এখন তাকে চিন্তা করতে হলো–এরা তাকে কি গ্রহণ করবে?

দাসী এলো স্নানের ঘরে যাওয়ার তাগিদ দিতে।

স্নানের ঘর সুমিতিকে খানিকটা অন্যমনস্ক করে দিলো। রাজনীতির একটি পুরনো পাঠ মনে পড়ে গেলো তার।কলকাতা শহরনয় যে পাঁচতলায় জল উঠবে বৈদ্যতিক শক্তিতে। এই গ্রামের অধিবাসীদের যদি শয়নকক্ষের কাছাকাছি স্নানের ঘর দরকার হয় কী করে এরা তার ব্যবস্থা? উপায়টা জানা না-থাকলে সেই অত্যন্ত সহজ উপায়টাও চোখে পড়তে চায় না।

কালোপাথরের স্নানের ঘর। পাথরের চৌবাচ্চায় জল টলটল করছে। ঘরটা এমন ঠাণ্ডা, স্নানের ঘর না বলে ঠাণ্ডীগারদ বলা যায়। দেওয়ালে সবুজ শ্যাওলা আছে বোধ হয় এই মনে করে সুমিতি চারদিকে ফিরে দেখলো। কালো পাথরের উপর শাদা দেওয়াল উঠেছে ছাদ পর্যন্ত, দেয়ালগুলি শাদা পাথরের নয় কিন্তু পাথরের মতোই চিক্কণ। দাসদাসীর মাথায় এই জল উঠেছে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে।

সুমিতি গায়ে জল ঢালতে ঢালতে বললো নিজেকে সেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার আর একটা নিদর্শন।

স্নান শেষ করে বেরিয়ে সুমিতি দেখলো শোবার ঘরের একপ্রান্ত ইতিমধ্যে বিলেতি হোটেলের এক টুকরো হয়ে উঠেছে।

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই অনসূয়া ঘরে ঢুকলেন।

এসো। সেই সকালে বেরিয়েছে।

কিন্তু আমি তো থাকতে এসেছি।

সান্যালগিন্নি চিরাচরিত ভাষায় বললেন, সে তো খুব আনন্দেরই হবে। কিন্তু তিনি ভাবলেন: এ তো কখনো সম্ভব নয় সুমিতি তার সঙ্গে পরিহাস করবে, তবে এ কথাটা বলছে কেন? কী জানিঃ আজকালকার মেয়ে, হয়তো বা সম্বন্ধের সুবাদে পরিহাসই করছে।

এসো। মুখে দাও কিছু।

নতুন বউদের ব্রীড়ার কথা শুনেছে সুমিতি। হঠাৎ যেন তেমনি একটা জড়তা এলো তার। অনসূয়া অতিথিকে সহজ করার জন্য বললেন, তুমি বোসো, সুমিতি, খেতে খেতে গল্প করো, শুনি।

সুমিতি টেবিলে বসে বললো, আমার এমন সম্বন্ধ আপনার সঙ্গে,আমাকে এমন করে বসিয়ে খাওয়ালে নিন্দা হবে।

নিন্দা হয় না। পৃথিবীতে সবচাইতে আপন লোকগুলিকেই সামনে বসে খাওয়াতে হয়। সেও নাকি এক স্বার্থের ব্যাপার।

কিন্তু আমি তো আপনার বড়োছেলের স্ত্রী।

স্ত্রী? খোকার? খোকার বউ তুমি?

চশমার আড়ালে অনসূয়ার চোখ দুটির কীকী পরিবর্তন হলো, তার মুখের পেশীগুলো কী করে সংকুচিত হলো এসব দেখতে পেলো না সুমিতি। সে টেবিলের অপ্রয়োজনীয় কাটা চামচগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগলো মুখ নিচু করে।

অনসূয়া বললেন, তোমার অসুবিধা হচ্ছে সুমিতি, আমি রূপুকে পাঠিয়ে দিই। তিনি স্থান ত্যাগ করলেন। দাসী এলো।

সে বললে–বামুনদিদি জানেন না আপনি চা কিংবা কফি খাবেন। তাই দুই-ই পাঠিয়ে

দিয়েছেন।– সুমিতি চেষ্টা করে দাসীকে একটা হাসি উপহার দিলো। দাসী চলে গেলে সুমিতি এক কাপ কফি ঢেলে নিলো। ঢেলে নেবার আগে সে চিন্তা করেছিলো : কিছুই যদি সে স্পর্শ না করে সেটা লক্ষণীয় হয়ে উঠবে দাসদাসীদের চোখেও। দ্বিতীয় পর্যায়ে সে ভেবেছিলো স্নায়ুগুলিকে সতেজ করা দরকার, সামনে যে-সময়টা তাতে একটু শক্ত হওয়ার প্রয়োজন হবে।

সুমিতি ভেবেছিলো, এরপরে বাড়ির ছেলেরা অন্তত দু’একজন আসবে, খবরটা রাষ্ট্র হবার পর মেয়েরাও আসবে।

সন্ধ্যার সময়ে দাসী এসে আলো দিয়ে গেলো। রূপনারায়ণ এলো একবার। হাতের বইগুলি সমিতির সম্মুখে টেবিলে রেখে বললোমা পাঠিয়ে দিলেন আপনার জনে।

দু-একটা সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে রূপনারায়ণ চলে গেলো। রাত্রি বাড়তে লাগলো। সুমিতি লক্ষ্য করলো দরজার বাইরে একজন দাসী ছোটোখাটো কীকাজ নিয়ে বসে আছে। দেখে বোঝা যায় কাজটা উদ্দেশ্য নয়, বসে থাকাই উদ্দেশ্য। সে যে সুমিতির আদেশেরই অপেক্ষা করছে তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না।

সুমিতি উঠে দাঁড়িয়ে শয্যার দিকে অগ্রসর হলো। আলোটাকে টেনে নিয়ে বিছানায় গা ঢেলে দিয়ে একখানা বই তুলে নিলো। সে যে বধূ হিসাবে সমাদৃত হলো না এতে সন্দেহ করার কিছু নেই।

আশ্চর্য হওয়ার কী আছে, বইয়ের মলাটে চোখ রেখে ভাবলো সুমিতি, কপালে তার সিঁদুর পর্যন্ত নেই। সামন্ততান্ত্রিক কথাটা আবার তার মনে হলো। সে-পরিবেশে তার আকস্মিক প্রবেশটা একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার হয়েছে। বিবাহ বলতে বহু অর্থব্যয়ের বহু কোলাহলের শেষেব্রীড়াবনতা একজনকে বরণ করার যে চিরাচরিত পদ্ধতির সঙ্গে এরা পরিচিত তার সঙ্গে আজকের বাহুল্যবিহীনতার বৈপরীত্য অত্যন্ত প্রখরভাবে স্পষ্ট। আভিজাত্যের আত্মাভিমান না-থাকলে হয়তো বা তার আশ্রয় পাওয়াই দুরূহ হতো, এরা অভিজাত বলেই নীরব উপেক্ষায় তাদের মতামতটা পরিস্ফুট করে দিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *