০৫. মাধাই সন্ধ্যার পরে ফিরলো

মাধাই সন্ধ্যার পরে ফিরলো স্টেশন থেকে। অন্ধকারে ঠাহর করে সুরোকে দেখে সে একটু অবাক হলো–সুরো না?

–হয়।

কী মনে করে আলি, শহরে গেলি না চাল আনবের?

চাল আনবো? পুলিসের তাড়া খেয়ে পলাইছি।

পুলিস তাড়া করছে? কস কী, কনে?

ছোট ইস্টেশনে। মন কয়, দিঘার বড়ো দারোগা।

তাইলে? মাধাই বারান্দার উপরে তার সবুট একখানা পা তুলে দিয়ে দাঁড়ালো। সে জানে না তার এই দাঁড়ানোর কায়দাটা স্টেশনমাস্টার কোলম্যানসাহেবের। সে ভাবলো : রেল পুলিস ধড়পাকড় করার তোড়জোড় করে মাঝে-মাঝে, কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলা যায়, বোঝানোর চেষ্টা করা যায়। দিঘা থানার দাবোগাকে কী বলবে সে।

কিছু ক’লা?

কবনে। এখন খাওয়া-দাওয়া কর। রাত্তিরে তো টেরেন নাই।

চাবি দিয়ে দরজা খুলে মাধাই ঘরে ঢুকলো।

রেলের সবচাইতে ছোট পরিমাপের কোয়ার্টারগুলির একটি। সাত-আট হাত দৈর্ঘ্য ও প্রায়। সমপরিমাণ প্রস্থের একখানা ঘর। ঘরের দুটিমাত্র জানলার একটার নিচে মাধাইয়ের খাঁটিয়া। দেয়ালের গায়ে পেরেক থেকে তার জামাকাপড়গুলো ঝুলছে। ঘরে ঢুকে একটা মাটির কলসি থেকে জল গড়িয়ে খেয়ে বিছানায় বসে একটা বিড়ি ধরালো মাধাই।

সুরো দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলো।

মাধাই লঘুস্বরে বললো, এখনো ভাবতেছিস চালের কথা?

কথাটা মিথ্যা নয়। অপ্রতিভ হয়ে সুরতুন বললো, পুলিস ধরলি কবো–মাধাই বায়েনের লোক আমরা? র‍্যালের লোক ধরলি তা কই।

কইছিস একখান কথা। তোর মাধাই যে র‍্যালের বড়োসাহেব।–মাধাই হো-হো করে হেসে উঠলো।

হাসি থামলে মাধাই বললো, এখন খাওয়া-দাওয়া কর। কাল সকালে ফতেমারা আসবি বোধায়। তাদের সঙ্গে বুদ্ধি করিস। একটা কিছু ব্যবস্থা হবি।

মাধাই যখন বলেছে কিছু নিশ্চিন্ত হওয়া যায় বৈকি। ছোটো স্টেশনের কনকদারোগা কিংবা দুপুর রোদের দু-ক্রোশ পথ স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কিন্তু মাধাইয়ের হাসিও মিথ্যা নয়।

এখন ঘুমাবা?

হয়, ডিব্‌টি দেওয়া লাগবে সারা রাত। স্পেশাল আসবি। বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মাধাই পোশাকপরা অবস্থাতেই খাঁটিয়ার উপরে শুয়ে পড়লো।

সুরো কিছুকাল বারান্দায় বসে থেকে আহার্য সংগ্রহের জন্য বাজারের দিকে গেলো।

বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে মাধাই খানিকটা ভাবলো। তার ভাবনাচিন্তা একখানি স্পেশ্যাল ট্রেনকে কেন্দ্র করে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া দরকার। এখন যে খুব পেয়েছে তা নয়। বরং ঘুমোবার সময়ই এটা নয়। কয়েকদিন আগে শুনেছে সে কথাটা, আজ সেই স্পেশ্যাল আসছে। তাকে সাদর অভ্যর্থনা করার জন্য দেহ ও মন দুটিই সজাগ থাকা চাই। চোখে এতটুকু ঘুম থাকলে হবে না। আগে থেকে ঘুমিয়ে রাতজাগার জন্য প্রস্তুত হতে সে ঘরে এসেছে। কিন্তু ঘুম প্রয়োজনের সময়ে আসে না। মাধাই শুয়ে-শুয়ে বুটসুদ্ধ পা-জোড়া দোলাতে লাগলো।

বোধ হয় একটু তন্দ্রা এসেছিলো। মাধাই ধড়মড় করে উঠে বসলো।

সুরো আসছিস?

বারান্দা থেকে পুরো সাড়া দিলো।

তুই ঘরে আসেও শুতে পারিস। আমি ডিব্‌টিতে চলোম।

ঘুমালে না?

না রে, ঘুম আসতেছে না।

ঠিক এই মুহূর্তে কেউ যদি মাধাইকে তার এই চাঞ্চল্যের কারণ জিজ্ঞাসা করতো, সে উত্তর দিতে–এ কি তোমার মেলোয়ারি ভোগা আর খায়ে না-খায়ে থাকা। এর নাম চাকরি। রেলের কামই লোক পায় না,হলো তোহলো,শালা মেলেটারি।নীল প্যান্টকোটকজন পায়, তার উপরে পাওয়া গেলো খাকি প্যান্ট, কোট, টুপি। পুলিসের দারোগারাও তাকায়ে তাকায়ে দেখে।

খাকি, খাকিই হচ্ছে এই দুনিয়ার সেরা রঙ।

মাধাই যখন গ্রাম ছেড়েছিলো তখন তার বয়স কুড়ি ছাড়িয়েছে। মাধাই এক গণস্কারকে দিয়ে হাত দেখিয়েছে। পাঞ্জাবি গণৎকার পুরোপুরি একটা সিকি পেয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই মাধাই বায়েনকে রাজা করে দিয়েছিলো প্রায়, পুরোপুরি পারেনি মঙ্গলের স্থানে কী একটা দুর্যোগ ছিলো বলে। মাধাই এখন নিজের হাতের রেখা দেখিয়ে বলে–তা দেখ, ঠিক কুড়িতে যদি গাঁ ছাড়া না হতাম, জুটতো এই চাকরি?

গ্রাম থেকে বিতাড়িত হওয়ার ঠিক তিন মাসের মধ্যে মাধাইয়ের চাকরি জুটে গেলো স্টেশনে। তেরো টাকা মাসিক বেতনের চাকরিটা মাস্টারসাহেব তাকে ডেকে দিয়েছিলো। অবশ্য কফিলুদ্দি শেখের চামড়ার ব্যবসায়ে কোথায় মাস্টারসাহেবের সঙ্গে খাতির হওয়ার যোগাযোগ ছিলো।

স্টেশনের কনস্টেবল দোবেজি একদিন এক রাজপুরীর গল্প বলেছিলো। ত্রিশ হাত উঁচু তার প্রাচীর। ভেতরে বাগান। সারি সারি ফুলফলের গাছের মধ্যে লাল আলোকোজ্জ্বল রাস্তা।

বাইরে কাঁটাভরা রাক্ষুসে লতায় ঢাকা জলা। এক-একটা কাঁটা যেন এক-একটা বিষমুখো সাপ। কিছুদিন পরে মাধাই অনুভব করেছিলো তার চাকরিটাও একটা প্রাচীর।

কিন্তু সবটাই যেন এক পূর্বপরিকল্পিত কাহিনী। কোথায় কোন দুই দেশের রাজায় লেগে গেলো যুদ্ধ। দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রচণ্ড প্রচণ্ড ইঞ্জিনগুলো খাকি-পরা লোক নিয়ে ছুটতে লাগলো। ইয়া ইয়া ইঞ্জিন আর হাজার হাজার গাড়ি। হুস হুস ঝম ঝম। যেখানে পাঁচখানা চলতে এখন চলছে পঁচিশখানা। এক সকালে তেমনি কোথা থেকে রাশি রাশি খাকির জামাকাপড় এলো। মাস্টারসাহেব থেকে শুরু করে মাধাই পর্যন্ত সবাই পরলো। প্রথম যেদিন পোশাক বিতরণ শুরু হয়েছিলো হাসাহাসির চূড়ান্ত হলো! কারো ভুঁড়ির বোতাম লাগতে আপত্তি করলো, কারো বা পোশাক আলখিল্লার মতো ঝুলঝুলে হলো গায়ে। কিন্তু এক রাত পার না-হতেই হাসির জায়গায় এলো গাম্ভীর্য। আর মাইনা বেড়ে যে কত হলো লেখাজোখা নেই। তেরো বেড়ে তেষট্টি। ছ মাসের কামাই একমাসে।

অফিসঘরগুলিতে কাজ হচ্ছে যেন ঝড়ের মতো। ফিরিওয়ালা যে এত কোথায় ছিলো কে জানতো! স্টেশনের উপরেই প্রতি প্ল্যাটফর্মে একটি করে বিলিতি খানাঘর তৈরি হয়েছে। আর কোথায় ছিলো এরা, যারা যে-কোনো দামে যে-কোনো জিনিস কিনবার জন্য গাড়ি স্টেশনে আসবার আগে থেকেই জানলায় দাপাদাপি করতে থাকে। গায়ে গায়ে ধাক্কা লেগে মাথা ঘুরে যায়, পায়ের ঠোক্করে মানুষ ঠিকরে পড়ে, মানুষ চটকে যায় পায়ের নিচে। দৃশ্যটা এ বলেও বোঝানো যাবে না। যে না-দেখেছে সে বুঝবে না, ভাবে মাধাই, এ এক নৃত্য। কিছুদিন আগে এক বাজিকর পুতুলনাচ দেখিয়েছিলো। লাল একটা গোল শতরঞ্জির টুকরোর উপরে একটা পুতুলের চারদিকে অন্য কয়েকটি পুতুল নাচতে লাগলো। তাদের নাচের তালে তালে শতরঞ্চিটাও দুলে দুলে উঠতে লাগলো। তারপর নাচ যখন উদ্দাম হয়ে উঠলোতখন শতরঞ্জিটাও বনবন করে ঘুরতে শুরু করলো। সেই শতরঞ্জিই এই স্টেশন।

অন্ধকার পথটা দিয়ে স্টেশনের দিকে যেতে যেতে মাধাই অন্ধকারের শূন্যতাকে বুট ঠুকে একটা স্যালুট করে দিলো। ট্রেনটা এসে দাঁড়ালে শুধু সে নয়, স্টেশনে যে যেখানে আছে সবাই এমন করবে। সাধারণ ট্রেন এলেই কত করতে হয়, তার উপরে আসছে স্পেশ্যাল,ইপেশিয়াল যার নাম। পাঁচ-ছয় দিন আগেই তারে-তারে খবর পেয়েছে সারা দেশ। দক্ষিণের রাজা নাকি উত্তরের রাজাকে খুব হারিয়ে দিয়েছে। ফুল-পাতায় রঙিন কাগজে স্টেশন সাজানো হয়েছে। বড়ো বড়ো গেট। স্টেশনমাস্টারের ঘরে নাকি কয়েকজন বড়ো বড়ো যোদ্ধা চা খাবেন। তার আয়োজন করতে গিয়ে স্টেশনমাস্টার কোলম্যানসাহেবের মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। সেই স্পেশ্যাল!

স্টেশনের চৌহুদ্দিতে পা দিতে না-দিতে মাধাই খবরটা পেলো। জয়হরি তারই মত পোর্টার। সে-ই বললে–একখানা নামে, আসলে দুখানা। সেই উত্তর থেকেই চারখানা ইঞ্জিনের পেছনে দুখানা স্পেশ্যাল আধ মাইল তফাতে থেকে চলছে। দ্যাখো মজা, এক লাইন ক্লেয়ারে দুখান গাড়ি চলে।

মাধাই এমনটা কখনো শোনেনি। সে বললো, পেছনের ড্রাইভার কত ওস্তাদ দ্যাখো। একটু। বে-মাপ চালাবা তো সামনের গাড়িতে ঠোক্কর।

সামনের ড্রাইভার বা কম কী? ইঞ্জিন একটু কমালে চলবি নে?

সব ইষ্টিশনে থুরু পাস?

না, এখানে থামবি।

থামবে সেটা মাধাইও জানে। প্রশ্নটা উত্থাপন করে বন্দর দিঘার স্টেশন সম্বন্ধে গর্ববোধটি নতুন করে অনুভব করার চেষ্টা করলো সে।

বাব্বা, দিঘায় না থামে কারো উপায় নাই।

সামনের ভেন্ডারের ডালা থেকে একটা পান ছিনিয়ে নিয়ে চিবোতে চিবোতে মাধাই মালবাবুর ঘরের দিকে গেলো।

মালবাবু তার ঘরেই ছিলো। মাধাই তার অত্যন্ত ভুল কায়দায় একটা স্যালুট দিয়ে বললো, দুই গাড়িতে নাকি এক ইসপেশিয়াল?

গাড়ি দেখতে এলে বুঝি?

দেখতে আসি নাই। পাস্ করাবো আমি। আমি ঝাণ্ডাদার। বেশ করেছে।

মাধাই মালবাবুর চোখেমুখে একটু উত্তেজনা প্রত্যাশা করেছিলো। মালবাবু যেন কীরকম! অন্য বাবুদের থেকে আলাদা।

প্ল্যাটফর্মে ডাউন গাড়ির প্রবেশপথের কাছে কর্মচারীদের ভিড় বাড়ছে। মাধাই তাড়াতাড়ি সেদিকেই পা চালাতে লাগলো। সেখানে পৌঁছুতে না-পৌঁছুতে দিগন্তে স্পেশ্যালের ধোঁয়া দেখা দিলো। স্টেশনমাস্টার নিজেই ঝাণ্ডা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। সঙ্গে তিন-চারজন বাবু, জন দু-এক পোর্টার, পয়েন্টম্যান। এইনা হলে জীবন? কেবিন আর প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি জায়গায় মাধাই দাঁড়িয়ে পড়লো ঝাণ্ডা নিয়ে। দাঁতে দাঁত লেগে চোয়াল কঠিন হয়ে উঠলো তার। দিগন্তবিস্তৃত রেল দুখানা যেন একটু একটু কাঁপছে। স্পেশ্যাল সে-দুটিকে অবলম্বন করে এগিয়ে আসছে। লাইন দুখানার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মাধাইয়ের অনুভব হলে সে-দুটি তার দেহে প্রবেশ করে শিরা-উপশিরার প্রঋনতম দুটি হয়েছে, গাড়িখানা তার হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করবে সন্দেহ কি।

.

কিন্তু স্পেশ্যাল এসেছিলো, চলেও গেলো। মাধাই মালবাবুর ঘরের দরজায় একটি প্যাকিং বক্সের উপরে বসে পড়লো। একটু উসখুস করে মাধাই বললো, দেখলেন?

না, আমার যে অনেক কাজ।

সিগারেটের ছাই ঝেড়ে সেটাকে আবার মুখে গুঁজে মালবাবু স্টেটমেন্টে মন দিলো। মাধাই মনিরুদ্দির খোঁজে গেলো।

যে ব্যাপারটা সে লক্ষ্য করেছে সেটা আর কারো নজরে পড়লো কিনা এটা জানা দরকার। স্পেশ্যাল যখন ইন করলো তখন মাধাই লক্ষ্য করেছিলো গাড়ি দুখানি ফুলপাতা-পতাকায়। সজ্জিত। ছোটোখাটো অনেক স্পেশ্যাল ট্রেন এর আগে উত্তরে গিয়েছে, অনেক ফিরেছে। দক্ষিণে। কিন্তু এমনটা কখনো হয়নি। মাধাই ভেবেছিলো এবার সব সেরা কিছু দেখতে পাবে। আলোয় ঝলমল করতে করতে প্রথম গাড়িটা থামলো। গাড়ির আলোয় স্টেশনের আলোয় রাত দিন হয়ে গেলো। একসঙ্গে সবগুলো ভেন্ডার তাদের ডালা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার জুড়ে দিলো। সে চিৎকারে মাটির ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু সেই আলোক-উদ্ভাসিত গাড়ি যেন ঘুমিয়েই রইলো। জানলায় যে-মুখগুলি দেখা গেলো তারাও এতটুকু উৎসুক হলো না। একটি দুটি প্রথম শ্রেণীর গাড়ির দরজা খুলে গম্ভীর মুখে দু-একজন খুব বড়ো বড়ো অফিসার নামলো। তারপর তাদের নামা দেখে সাহস পেয়ে আরো দু-একজন করে সৈন্য নামলো। কিন্তু এরা যেন কোনো নতুন পৃথিবীতে পদার্পণ করছে। যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা স্টেশনটার চারিদিক দেখতে লাগলো। ভেন্ডাররা তাদের গাম্ভীর্য দেখে এগোতে সাহস করলো না। কিছুমাত্র সাড়া শব্দ নেই, একটা পয়সা বিক্রি করতে পারলো না ভেন্ডাররা। অবশ্য এটা হয়তো অত্যুক্তি। বিক্রি কি আর হলো না, কিন্তু তাকে বিক্রি বলে না। আগে দু’পয়সার জিনিস কিনতে যে হুংকার ঝনৎকার ছিলো, এখন হাজার টাকার লেনদেনেও তার সিকিটা হলো না। কেউ ডালা থেকে থাবড়া দিয়ে সবগুলি সিগারেট তুলে নিয়ে দশটাকার নোট ছুঁড়ে ফেলে দিলো না। ভেন্ডারের টিকি ধরে টান দিয়ে কেউ হো-হো করে হেসে উঠলো না। এর আগে গাড়ি থামতে-না-থামতে যারা দুদ্দাড় করে ছুটতে ইঞ্জিনের জল নেওয়ার কলামের নিচে, এক-স্টেশন লোকের সামনে উলঙ্গ শিশুর মতো স্নান করতে পারতো, সেই লোকগুলিইবা গেলো কোথায়! দ্বিতীয় গাড়ি প্রথম গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো। একই কথা।

মাধাই মনিরুদ্দির সাক্ষাৎ পেয়ে জিজ্ঞাসা করলো, মুর্দা গাড়ি নাকি রে? মাস্টারসাহেব তো বলে খুব যুদ্ধ জিতছে ওরা।

এ কী রকম জয়লাভ মাধাই বুঝে উঠতে পারে না। জয়লাভ করা মানে চোরের মতো মুখ করে ঘরে ফেরা নাকি?

একটা চায়ের দোকানে বসে পড়লো মাধাই। দোকানিকে চা দিতে বলে সে পাশের যাত্রীটিকে প্রশ্ন করলো’দেখলেন?

দেখলাম।

যুদ্ধে জিতছে তবে আনন্দ করলো না কেন?

এখানে করবে কেন? ওদের দেশে ওদের ছেলে মেয়ে বউ আছে, তাদের কাছে গিয়ে করবে।

মাধাই শ্রদ্ধায় লোকটার দিকে চেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে বসলো। এতক্ষণে একটা কথা একজন বলেছে বটে। ঠিক তো। যুদ্ধজয়ের পর এখন বাড়ি ফেরার তাড়া। এখন কি আর হৈ হৈ ভালো লাগে!

লোকটির ট্রেন ধরার তাড়া ছিলো। সে উঠে গেলো। মাধাই চুষে চুষে চা খেতে লাগলো। দোকানিকে সে কথাটা বললো, যুদ্ধে জিতলে কী হবি, নিজের ঘরে না ফিরলে কি আর আনন্দ হয়!

অথচ মজা দ্যাখো, এই এত বড় ব্যাপারটা কেউ লক্ষ্য করলো না–না জয়হরি, না মনিরুদ্দি।

এটা যে আজই প্রথম হলো নয়। আজ চূড়ান্তভাবে বিষয়টি চোখে পড়েছে, কিন্তু কিছুদিন আগে থেকেই মাধাইয়ের একটা ফাঁকা ফাঁকা বোধ হচ্ছে? জয়হরি কথাটা শুনে ঠিক হেসে উড়িয়ে দেয়নি, বরং মাধাইয়ের পর্যবেক্ষণ শক্তি দেখে বিস্মিত হয়েছিলো। পর্যবেক্ষণটির মূল্য সম্বন্ধে সে কিছু বলেনি, মোটামুটি গভীরে চিন্তা করে সে এটাই তাদের বিস্মিত করেছিলো। তার কথাগুলো যেন কতকটা ভদ্রলোকের আলাপের মতো শোনায়।

জয়হরি বলেছিলো, মানুষ কি চিরকালই লাফায় নাকি? তুই চাকরির প্রথম দিকে ওভারব্রিজে দড়ি বেঁধে দোল খাতি, এখন তা করিস? বয়স বাড়লি ধীরথির হয়। এ-ও তেমনি। যুদ্ধের বয়েস হলো না?

কৌশল করে একটা উপমা দিতে পেরেও সুখী হলো না জয়হরি। অপ্রতিভের মতো মুখ করে সে হাসলো। উপমাটার প্রয়োগের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে তার সন্দেহ ছিলো।

এসব ধরনের কথাবার্তা শুনে মনিরুদ্দি আর-একদিন তাকে বলেছিলো–এত মনমরা কেন?

মাধাই খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলো, আমি কি একা? জেল্লা যেন সকলেরই কমে।

কমে, না বাড়ে?

মাধাই একটু চিন্তা করে বললো–ভাত-ভাত লাগে।

ভাত, সে কি খারাপ? কয় হা অন্ন, যো অন্ন।

এই কথাটা থেকে একটা তুলনা এসেছিলো মাধাইয়ের চিন্তায়। রেলের গ্রেইন-সপ থেকে একবার একরকম চাল দিয়েছিলো। সুন্দর ধবধবে ভাত হতো। কিন্তু চিবিয়ে চিবিয়ে থু-থু করে। ফেলে দিতে হতো। তেতো হলেও তবু স্বাদ থাকে। সে ভাত ছিলো সবরকমে স্বাদহীন। ঘটনাটা মনিরুদ্দিকে মনে করিয়ে দিয়ে মাধাই বলেছিলো–সংসারটা সেই ভাতের মতো। মনিরুদ্দি হো। হো করে হেসে উঠে বলেছিলো–তুমি ভদ্রলোক হলা, বাবুমানুষ হলা, কেন?

এসব ধরনের আলাপ-আলোচনা সম্বন্ধে জয়হরি এবং মনিরুদ্দি দুজনেরই মনোভাব প্রায় এক। অন্তত একটি বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ একমত, দৈনন্দিন সুখদুঃখও প্রয়োজনের বাইরে আলাপ আলোচনা করাটা ভদ্রলোকদের ব্যাপার।

মনিরুদ্দি বললো, মনমরা কেন্‌? ফুর্তি করো, হৈ হৈ করো। মদ খাবা?

ধুর। এক্কেবারে বাজে। গা গুঁটায়।

কও কী, খাইছো?

খাইছিলাম একটু একদিন।

জয়হরির কাছে শুনো, সে কেমন জিনিস। ও তো রোজ খায়। সাহেবরাও খায়।

ওদিক থেকে মনিরুদ্দিকে বাবুরা ডাকলো। সে চলে যেতে যেতে বলেছিলো–তুই ভাবিস? কাম আর কাম। বাড়ি যায়েও তাই। এটা কাঁদে, ওটা চেঁচায়।

আর একটু চা খাবে নাকি ভাবলো মাধাই। চা না খেয়ে সে একটা বিড়ি ধরালো। তার মনে পড়লো মনিরুদ্দির প্রস্তাবটা। সে বলেছিলো সাহেবরাও খায়। ও খেলে কী হয়? স্পেশ্যালে যে সাহেবরা গেলে তারা তো খানাগাড়ির মধ্যে বসে মদ খেতে খেতেই গেলো। তবে অমন মুখের চেহারা কেন তাদের?

এতদিন তার যে অনুভবটা হয়েছে সেটা অত্যন্ত অনির্দিষ্ট ছিলো। সেটা এত লঘুস্পর্শ যে কথা দিয়ে সেটাকে প্রকাশ করতে গেলে অত্যুক্তি হয়ে গেছে। মাধাইয়ের নিজের কাছেই পরে মনে হয়েছে যা সে বললো সেটা সত্য নয়। স্টেশনের এতগুলি লোকের আর কেউ যা নিয়ে আলোচনা করে না সেটা তার নিজের অনুভবের ভ্রান্তিও তো হতে পারে। আজকের স্পেশ্যাল ট্রেনটাকে সে তার ভ্রান্তির বড়ো একটা প্রমাণ হিসাবেই গ্রহণ করতে চেয়েছিলো। এত আলো, এত আয়োজন, তাহলে সংসার স্বাদহীন হবে কেন? কিন্তু স্পেশ্যাল ট্রেনটাই যেন তার অনুভবকে সত্য বলে প্রমাণ করে গেলো।

চায়ের দোকান থেকে উঠে মাধাই নিজের ঘরের দিকে রওনা হলো। অনেক লোক আছে ডিউটি করার এখন। একজন অনুপস্থিত থাকলেও কারো চোখে পড়বে না।

ডাক শুনে সুরতুন উঠে বসলো, তারপর মাধাইয়ের গলা চিনতে পেরে দরজা খুলে দিলো।

সুরতুন বললো–ফিরে আলে এখনই? গাড়ি চলে গিছে?

হয়।

তাইলে আপনে ঘরে আসে শোও। আমি বারেন্দায় শুই।

মাধাই ততক্ষণে বারান্দায় বসে পড়েছে। সে বললো, তুই এখানে আয়। গল্প করি।

পরিস্থিতিটা অভিনব। মাধাইয়ের সঙ্গে তার পরিচয় অনেকদিনের হলো। এর আগেও মাধাইয়ের ঘরে সে অনেক রাত্রিযাপন করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফতেমা তার সঙ্গে ছিলো। অনেকক্ষেত্রে এমন হয়েছে সুরো একা বারান্দায় শুয়ে ঘুমিয়েছে। তখন ভরসা ছিলো মাধাই ঘরের মধ্যে আছে, ডাকলেই সাড়া পাওয়া যাবে। অন্য দু’এক ক্ষেত্রে মাধাই স্টেশনের কাজে ব্যস্ত থেকেছে, দেখা হলে সুরোকে ঘরের চাবি দিয়েছে কিন্তু কখনো ঘুমের মাঝখানে রাত্রির অন্ধকারে এমন করে ফিরে এসে সে ডাকেনি। পুরো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।

মাধাই বললো, বোস না, গল্প করি, তোর কি ঘুম পাতেছে, সুরো?

ঘড়ির মাপে রাত্রির বয়স পরিমাপ করতে না পারলেও আকাশের যেটুকু চোখে পড়লো তাতে সুরো বুঝতে পারলো তখনো এক প্রহর রাত বাকি আছে। সে যন্ত্রচালিতের মতো মাধাইয়ের অদূরে বসে পড়লো।

কথা কস না যে? মাধাই প্রশ্ন করলো।

কী কবো?

রাত্রিতে ঘুম ভাঙিয়ে তুলে কেউ যদি এমন সব কথা বলতে থাকে তবে সাধারণত তার মনের উদ্ভিন্ন অবস্থাটাই ধরা পড়ে যায়। ফতেমা যদি এখানে থাকতে হয়তো তার কাছেও মাধাইয়ের ভাবভঙ্গি অস্বাভাবিক বলে বোধ হতো। কিন্তু সে হয়তোবা মাধাইয়ের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে প্রশ্ন করতো। তার থেকে আলাপের সূত্রপাত হতো। সুরোর মনে পড়ে না আর কবে মাধাই আহার্য এবং তার সংগ্রহের বিষয় ছাড়া তার সঙ্গে কথা বলেছে, সেই এক পক্ষী আঁকার দিনটির কথা ছেড়ে দিলে। হাসিঠাট্টা মাধাই যে একেবারেই করে না তা নয়, কিন্তু সে-সবই ফতেমার সঙ্গে, সুরো শ্রোতামাত্র। প্রশ্নের উত্তর দিতে তবু সম্ভবত সুরো পারতো, কিন্তু নিজে থেকে প্রশ্ন করে আলাপের সূচনা করবে এমন শক্তি নিজের মধ্যে সে খুঁজে পেলো না।

তোর ব্যবসার কথা ক। কতদিন তো ব্যবসা করলি, কত টাকা জমাইছিস। সেব্যবসা নাকি বন্ধ হয়-হয়? মাধাই বললো।

পুলিস আর ব্যবসা করবের দিবিনে, মনে কয়। আর তাছাড়াও–

কী তাছাড়াও?

একদিন মোকামেও যদি চাল অ-পাওয়া হয়?

তা হতে পারে। তোরা কি ঠিক করছিস আর কোনো কালে গাঁয়ে ফিরবি না!

গাঁয়ে ফিরে আমার কী লাভ? সেখানে কেউ খাবের দেয় না। আর তাছাড়াও–

কী?

এখানে তবু আপনে ডাকে কথা কও। সেখানে না-খায়ে মরলেও কেউ কথা কয় না।

হুম। তোর এত ছুটাছুটি ভালো লাগে! আমার আর কাজ কাম ভালো লাগে না। মনে কয় চাকরি ছাড়ে দেই। তা যদি করি, আমাক তুই খাওয়াবের পারবি না? কলি না?

কী কবো? আপনে যদি কও, যাকও তাই করবো। সুরতুন এত বিস্মিত হলো যে মাধাইয়ের বক্তব্যটাকে পরিহাস মনে করতেও পারলো না।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে মাধাই প্রশ্ন করলো, সুরো, এ দুনিয়ার আমার কেউ নাই। তোর কে কে আছে?

সুরতন মাধাইয়ের কথাটা অনুভব করলো। সে বুঝে উঠতে পারলো না এ প্রশ্নের জবাব কী দিতে পারা যায়। আত্মীয়তার হিসাবে ফতেমা তার ভাই বউ, রজব আলি তাই জ্যাঠামশাই। গ্রামের বাইরে অনাত্মীয়ময় পৃথিবীতে তাদের নিকট বলে মনে হয়, গ্রামের ভিতরে তারা প্রতিবেশীর মতো। আর চালের কারবারে নেমে ফতেমার সঙ্গে একটা বন্ধুত্বও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এসবের চাইতে বড়ো মাধাই, নির্ভরযোগ্য কোনো সম্বন্ধই যার সঙ্গে নেই, অকারণে যে প্রাণ বাঁচায়, প্রয়োজনের সময়ে যে পরামর্শ দেয়। তাকে আজকাল সুরোর সব আত্মীয়ের সেরা আত্মীয় বলে বিশ্বাস হয়। তা যদি না হতো তবে তার অনুমতি না নিয়ে কী করে কনকদারোগার তাড়া খেয়ে তার বারান্দায় এসে বসতে পারতো সে। কিন্তু এ সব কথা তো বলা যায় না। প্রকৃতপক্ষে সুরতুনের কেউ-ই নেই এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে।

সুরো সম্মুখের অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলো।

মাধাই একটা বিড়ি ধরালো। লোহার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে সে বললো, ঘুম পালে। ঘুমাতাম, এখন কী করি বুঝি না। আমার আর কিছুই করার নাই। তুই কথা কয়ে যা, আমি শুনে? যাই।

আচ্ছা বায়েন, চাল যখন বেচা যাবিনে নুন বেচলি কি হয়? সে-ও তো দুর্মূল।নুনের মোকাম কনে?

তুই যাবি?

পথ দেখায়ে দেও।

সুমুদুর চিনিস?

হয়, শুনছি পদ্মার চায়েও বড়ো নদী।

সেখানে তালগাছ পেরমান ঢেউ। মনে কর এক-এক ঢেউ উঠতিছে পদ্মার ব্রিজের গায়ে জল লাগতিছে। সেই জল থিকে নুন হয়।

নুন কি ফেনায় ভাসে আসে?

জল শুকায়ে নুন।

জল কি পয়সা দিয়ে কেনা লাগে?

তা লাগে না।

তবে?

সুরতুন নিজেই চিন্তা করে প্রশ্নের উত্তর বার করলো। তার মতো হতভাগ্য আরো আছে। সকলেই তারা তাহলে নুনের মোকামে ছুটতো। সেখানেও নিশ্চয় পুলিস আছে। নতুন একটা হতাশায় তার মন ভরে উঠলো।

কিছুক্ষণ পরে সুরতুন আবার বললো, মনে কয় আবার না-খায়ে থাকার দিন আসতিছে।

মাধাইয়ের মনে হলো, তার নিজের যদি আহারের উপরে এমন রুচি থাকতো! অন্তত এই মুহূর্তে আহারের কথা চিন্তা করতেও তার ইচ্ছা করছে না।

সুরতুন ভাবলো, পুলিস তাহলে এ কী করছে, বেড়াজাল দিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করছে? সহসা তার মধ্যে সান্দারনী ফুঁসে উঠলো। সম্ভবত মাধাইয়ের মতো নির্ভর করার উপযুক্ত পুরুষ কাছে ছিলো বলেই সে ক্রোধকে ভাষা দিতে সাহস পেলো।

সে বললো, জাত-সাপ পুলিস। আমাদের শত্রুর জন্ম-জন্মের। কেন্ শোনো নাই বায়েন, আমার নানা কী কতো? আমার নানা ছিলো আলতাপ, কতো–কোনোদিনই আর মিটবি না। আমার আম্মার আগের পক্ষের সোয়ামি ছিলো এক পুলিসের কনিস্টবল! সেকালে আমার বাপ ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ এ কথা জানতো না। বুধেডাঙার কাছে এক জাহাজ ডুবি হয় গাঙে। সান্দাররা ডুবে ডুবে সেই ডুবি-জাহাজ থিকে চালের বস্তা, লোহার পাত, কাপড়ের বান্ডিল বার করে আনলো। পুলিস ঘোরাফেরা করবের লাগলো। আম্মার সাথে আগে জানাশোনা ছিলো তার আগের সোয়ামির আমলে, এমন একজন কনিস্টবল কী করে না জানি মালের লুকোনো জায়গার খবর পায়; পুলিস বাঁধে নিয়ে গেলো সান্দারদের সব বেটাছাওয়ালকে। কও এই তো পুলিস। আগের সোয়ামির কাছে থাকে পুলিসি শিখছিলো। কী ঘেন্না তাই কও।

গল্পটা বলে সুরো বেপরোয়াভাবে সোজা হয়ে বসলো। জাতিগত ঘৃণার আতিশয্য প্রকাশ করতে গিয়ে সে যে নিজের মাকেই হীন প্রতিপন্ন করলো তা যেন সে বুঝতে পারলো না। কিংবা ক্ষয়িতাবশিষ্ট সান্দারত্বের এইটুকুই বোধ হয় বৈশিষ্ট্য।

মাধাই বললো–তাই বলে তুমিও পুলিসের শত্রুর হবা নাকি?

একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়লো সুরতুনের।

মাধাই আবার একটা বিড়ি ধরালো। খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে সে বললো, তার চায়ে ভালো এক সান্দার খুঁজে বার করে বিয়েসাদি কর। সে-ই খাওয়াবি পরাবি।

কথাটা একেবারেই নতুন নয়। চালের কারবারের সঙ্গীদের মধ্যে বসে এ ধরনের কথা এর আগেও সুরতুন শুনেছে। প্রথম প্রথম উৎকণ্ঠার মতো অনুভব হলেও এখন সয়ে গেছে, কারণ সে সব রং তামাশার কথা। কিন্তু মাধাইয়ের কথাকে হাসিঠাট্টা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তার মনে হলো সে কেঁদে ফেলবে। বিবাহ ব্যাপারটাকেও পুলিসের বেড়াজালের মতো দিগন্তবিস্তৃত বলে মনে হলো। তার মনের মধ্যে যে আকুলতা অস্ফুট আবেগে ছটফট করতে লাগলো সেটার কোনো অংশে যেন এমন কথাও ছিলো–মাধাই, আপনে আমাক পুলিস আর বিয়েসাদি থেকে বাঁচাও।

রাত অনেক হয়েছে। অন্ধকার ঝিমঝিম করছে। বাঁদিকে রেল কলোনির শেষ। সেখানে কিটি ছোটো জঙ্গল-ঢাকা ডোবা আছে। এখন কিছু বোঝার উপায় নেই। চাপা গলায় কোনো নিশাচর ক্ষুদ্র প্রাণী সেখানে তার ক্ষীণ হিংস্রতা প্রকাশ করলো।

মাধাই বললো–রাত পেরায় শেষ হয়ে আলো। ঘুম পায় না তোর?

পায়। আপনে ঘুমাবে না, বায়েন?

হয়। ভাবনা দিনের বেলায় হবি। মাধাই বিড়ি ফেলে আঙুল মটকে সোজা হয়ে বসলো।

উঠে দাঁড়িয়ে সে বললো, তুই বারান্দায় শুবি, আলো জ্বালায়ে দেবো? ভয় করবি না?

না। মাঝেসাজে শুই একা। ঘরে আপনে থাকবা।

তা শো। দুয়ার খোলাই থাকবি।

মাধাই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।

আঁচল বিছিয়ে বারান্দায় শুয়ে পড়ার আগে সুরতুন ভাবলো–আমি আর ভেবে কী করি। না খেয়ে যখন মরতে বসেছিলাম তখন ভেবে কী করেছি।

কিন্তু নিজে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগে সুরতুনের ইচ্ছা হলো, সে উঠে গিয়ে দেখে মাধাই ঘুমিয়ে পড়লো কিনা। এতক্ষণে সহসা একটা অনুভব হলো তার :কী যেন একটা হয়েছে, মাধাইয়ের অসুখ করেনি তো?

একটা তুলনা দিয়ে মাধাইয়ের এই ব্যাপারটার কাছাকাছি যাওয়া যায়। বোধ হয় এই রকম মানসিক অবস্থাতেই পুরুষরা স্ত্রীকে খুঁজে বার করে নিছক কথা বলার জন্যে। কথা বলা প্রয়োজন হয়ে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *