০২. মাথার উপরে প্রখর সূর্য

মাথার উপরে প্রখর সূর্য, মেঠো ধুলোর পথে পা পুড়ে যাচ্ছে। কাপড়ের পাড় দিয়ে বাঁধা জট-পড়া লালচে চুলের খোঁপাবাঁধা মাথাটা ক্লান্তিতে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আছে। রোদে উত্তপ্ত হয়ে তার কটা রং লালচে দেখাচ্ছে। হাঁটার তালে তালে ডান হাতখানি দুলছে পুরুষালি ভঙ্গিতে। সে-হাতের উপরে নীল উল্কিতে আঁকা ডানা-মেলা-এক পক্ষী।

ডানা ম্যালেছে পক্ষী! স্বগতোক্তি করলো সুবো।কথাটা অন্যের মুখে শোনা। মাধাই বায়েনই বলেছিলো একদিন তার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে।

মাধাই বায়েন (কখনো মাধব বাদ্যকর) আমার-তোমার চোখে নীল, কখনোবা খাকি উর্দিপরা একটি রেলওয়ে পোটারমাত্র।বড়োবড়োচুলে পাতাকাটা সিঁথি, পায়ের মাপের চাইতে বড়ো একজোড়া চপ্পল পায়ে শিশ দিতে-দিতে যে বন্দর দিঘার স্টেশন-প্ল্যাটফর্মে এর-তার সঙ্গে ইয়ার্কি মেরে বেড়ায়, সুবোর হাতে সে-ই নীলপক্ষী আঁকিয়ে দিয়েছে। সুরোর হাতে একজোড়া বাঁকা তোবড়ানোকালচে কাসার চুড়ি ছিলো এককালে। মাধাই একদিন চুড়িজোড়া খুলে ফেলে দিয়েছিলো তার অনুমতি না নিয়ে, তার বদলে কিছুই আর পরতে দেয়নি। ব্যাপার দেখে সুরো সাবধান হয়ে গিয়েছিলো। ছোটোবেলা থেকেই দস্তার যে-চিকটা তার গলায় ছিলো সেটা নিজেই একদিন খুলে ফেলেছে।

এখন সুরা মাধাই বায়েনের ঘরের দিকেই চলেছে। মাধাই তাকে চালের ব্যবসায়ের হদিশ বলে দিয়ে রওনা করে দিয়েছিলো।

সে আর কী করেছে তার জন্য, ভাবতে গিয়ে কোথায় আরম্ভ করা যায় খুঁজে পায় না সুরো। মাধাইয়ের মুখে সে শুনেছে: পশ্চিমের মজুররা ইট তৈরি করছিলো দিঘা আর চিকন্দির মধ্যে এক মাঠে। অনাহারের প্লাবনের মধ্যে আহারের দ্বীপগুলির অন্যতম সেটি। আহারের আশায় না হোক, জলের আশায় ইট তৈরির ভেজানো কাদার একটা তালের কাছে সুরোর দেহটা মুখ গুঁজে পড়ে ছিলো। মাধাই তাকে দিঘা বন্দরে তার নিজের ঘরে তুলে এনেছিলো। কী করে আনলো?মাধাই বলেছে–তুই কী এমন ছিলি, হাড় কখানাই ছিলো। তাই সম্ভব,নতুবা মাধাইয়ের এমন-কিছু মজবুত পালোয়ানি দেহ নয়।

সুরোর যখন খেয়াল করে দেখবার-শুনবার অবস্থা হলো সে দেখেছিলো, একটা স্বল্পপরিসর ইটের ঘরের মেঝেতে সে শুয়ে আছে, আর তার মুখের উপরে ঝুঁকে আছে একটি অপরিচিত পুরুষের মুখ। মাধাই তখন অপরিচিত ছিলো। অন্নের উত্তাপে দেহ আতপ্ত হয়েছে তখন, মনের স্বাভাবিক বৃত্তিগুলি ফুটি-ফুটি করছে। পরিধেয়ের সন্ধান করতে গিয়ে সে দেখেছিলো, একটুকরো কোরাথান যেমন-তেমন করে তার গায়ে জড়ানো।

এবার পুরুষটি কথা বললো–তোর কাপড়টা ফেলে দিলাম। যা ময়লা, আর পিঁপড়ে কত!

একটু পরেই আর-একজন পুরুষ ঘরে এসেছিলো। তখন সুরো বুঝতে পারেনি, এখন তার মনে হয় সে ডাক্তার। কিন্তু মাধাই কী বলেছিলো মনে আছে আমার বুন, গাঁয়ে ছিলো।

সুরতুন্নেছার পক্ষী-আঁকা হাতখানি ঘন-ঘন দুলতে লাগলো। তার মন কল্পনায় বহু সময় লঙঘন করে যাচ্ছে।

একদিন তার প্রশ্নের উত্তরে মাধাই বলেছিলো–যে-কেউ চোখে পড়তো তাকেই আনতাম, তাকেই খাওয়াতাম।

পৃথিবীতে থাকার মধ্যে মাধাইয়ের এক বুড়ি মা ছিলো। যতদিন মাধাই গ্রামে ছিলো মায়ের সঙ্গে তার সদ্ভাব ছিলো না। বুড়ি যদি ক্ষুধার মুখে ভাতের থালা এগিয়ে দিতে না-পারতো মাধাই তাকে মারতো ধরে ধরে। আসের বেহদ্দ ছিলো সে। কিন্তু গ্রামে অনাহার এসেছে এই খবর পেয়ে সে গিয়েছিলো রেল-কোম্পানির-দেওয়া র‍্যাশানের চালডাল নিয়ে মায়ের জন্য। সংবাদটা কেউ তাকে দেয়নি। মায়ের পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা থালাবাসন, ঘেঁড়াখোঁড়া কাপড়চোপড় ঘটনাটা রাষ্ট্র করে দিয়েছিলো। ধূলায় আচ্ছন্ন ক্লান্তমুখ চোখের জলে আবিল করে সে ফিরে আসছিলো। পথের ধারে পড়েছিলো সুরো। মায়ের বুভুক্ষু আত্মার তৃপ্তি হয়েছিলো কিনা কে জানে, মাধাইয়ের শূন্যীভূত আত্মা একটা অবলম্বন পেয়েছিলো।

কিন্তু এ-উত্তরটা মনে-মনে উচ্চারণ করে সুরো সুখী হতে পারে না। মাধাই তার দ্বিতীয় ১ বারের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলো–একদিন তুই আমার হয়ে চোরের মার খেয়েছিলি, সেজন্যে।

সেই বিশ্বব্যাপী অনাহারের দিনের আগেও সুরোর মতো যারা তাদের অনাহারের দিন ধানের । ঋতুগুলির মধ্যেও ইতস্তত ছড়ানো থাকতো। পৃথিবীতে সে একা। তার বাবা বেলাতআলির মৃত্যুর পরও সে কী করে খুঁটে খেয়ে বারো থেকে আঠারোতে সম্পূর্ণ একা-একা পৌঁছেছিলো, ভাববার বিষয়। তার পিতৃধনের মধ্যে ছিলো একখানি কুঁড়ে, একটি গাভী।

তখন একনাগাড়ে দু-দিন ধরে তার অনাহার চলছিলো। ছোটো নিচু খড়ের চালাটার নিচে সে আর তার গর্ভবতী গাভীটি। খালি পেটে এপাশ-ওপাশ করতে করতে ভোরবেলা সে উঠে বসলো। ভাবলো, উঁশ কামড়াচ্ছে বোধ হয়। গাভীটাকে কাল থেকে বাইরে বেঁধে রাখবে স্থির করলো। ওটা বিয়োলে একটা হিল্লে হয়।

ক্ষুধার ব্যাপারটা একবার যদি মনে পড়েছে ঝাড়া দু-ঘন্টা লাগবে তোমার ভুলতে–একথায় ওকথায় ফিরে-ফিরে মনে পড়ে যাবে।

সান্যালবাড়ির তেঁকিশালের কাছে বোকা-বোকা মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলে পেট ভরার মতো ভাত রোজই পাওয়া যায়। কিন্তু পথের প্রতিবন্ধক দেবীদাস আছে। বুধেভাঙা চিকন্দি যাওয়ার পথে তার বাড়ি। মাহিষ্য দাসদের দেবী সান্দার-ছেলেদের খেলার সঙ্গী ছিলো, সুরোর বাল্যপরিচিত। কিন্তু দেবীর গলা একদিন ভার হলো। মাথায় বেড়ে ওঠার চাইতেও স্বরের পরিবর্তনটাই বেশি লক্ষণীয়, সেটা যেন রাতারাতি হলো, এবং তার সঙ্গে সঙ্গে চোখের দৃষ্টি। সুরোকে আগেও দেখেছে দেবী, কিন্তু এ-দেখা অন্যরকম। দেবীদাসের ভয়ে সুরোর এ-পথে চলা কঠিন।

ভয়ের মূলে আছে তার অল্পবয়সের একটি বেদনার ঘটনা। তার বাবা বেলাত আলি তখন জীবিত। তার ফিরবার পথের দিকে চেয়ে দশ-এগারো বছরের সুরতুন্নেছা ঘাটিয়ালের ঘাটের চালায় অপেক্ষা করছিলো। শুকনো খটখটে সন্ধ্যা-আবির ছড়ানো, ঝিঁঝি ডাকা, উদাসকরা সেই সন্ধ্যায় ঘাটের অনতিদূরে ধর্ষিতা হয়েছিলো সে।

গোরুটিকে দড়ি ধরে বাইরে নিয়ে এসে ঘরের সম্মুখে বাবলার চারাটায় বেঁধে দিয়ে চারিদিকে তাকালো সে। তখন সম্ভবত পৌষ মাস। হালকা একটা কুয়াশার আবরণ মাটির আধ হাত উপর পর্যন্ত নেমে এসেছে। রজব আলি সান্দারের বাড়ির দুখানা খড়ের ঘর আর খড়ের গাদাটি আসলগুলির ছায়ার মতো চোখে পড়ছে। রজবআলির বাইরের দিকের ঘরখানির সম্মুখে তার ছোটো ধানের মরাইটার পাশে বাঁশের খাঁচায় বসানো চারিতে মুখ দিয়ে তার দুটি বলদ, দু-তিনটি বকনা গাই হুস হুস করে খড়-ভেজানো জল খাচ্ছে, চপ চপ খস খস শব্দ হচ্ছে। বলদগুলোর মুখে, সট সট করে বাবলার শুকনো বিচি চিবুচ্ছে গাইগোরুগুলো।

আগে রজব আলির মতোই ঘর ছিলো সুরতুনদের। গাই-বলদ ছিলো না তেমন কিছু পাঁঠা বকরি ছিলো। এখন মাত্র একটা কাঠা জমির উপরে একখানা চালা দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের পেছন দিকের বেড়া ঘেঁষেই আজকাল রজব আলির জমি। সামনের দিকের কয়েক পা গিয়েই সুরতুনের জমির সীমানা শেষ, তার পরই রজব আলির ভূঁই। বেলাত আলি নাকি জীবিতকালে রজব আলির কাছে ধান ধার করেছিলো, সেই ধানের মূল্য রূপে রজবআলি জমিগুলি দখল করেছে।পিতামহ আলতাপজীবিত থেকেও রজব আলির কাজকে ধিকৃত করেনি, সেক্ষেত্রে এই নিঃসঙ্গ পৃথিবীতে। সুরো কী করতে পারে?

কুয়াশা প্রায় কেটে গেছে। বাঁ-দিকের দু-তিনটি গোরুর রং স্পষ্ট হয়ে উঠলো। আর দেরি করা যায় না।আল থেকে নরম মাঠে নেমে সোজাসুজি পাড়ি দিয়ে সুরতুন গিয়ে দাঁড়ালো লালচে রঙের বলদটার পাশে। সেটার আড়ালে হেঁট হয়ে পাশের ছোটো বকনাটার চারি থেকে পটু হাতে জানার জল হাতড়ে কুচোনো খড় আর বাবলার বিচি তুলে নিলো কেঁচড়ে। তারপর আল ডিঙিয়ে অন্য আর-একটি খেত পার হয়ে নিজের ঘরের পেছন দিয়ে ঘোরাপথে এসে দাঁড়ালো নিজের গোরুটার সামনে।

–খা, খা। কয় যে খাতি দিবি বাবলার দানা, দুধ হবি বটের আঠা।

গোরুটির খাওয়া হলে তার দড়ি ধরে সুরো পথে বার হলো। আলের পথের শেষে জেলাবোর্ডের পথটা সে আড়াআড়ি পার হলো। পথের ওপারে কাশজাতীয় বুনোঘাস এক কোমরের চাইতেও বেশি উঁচু হয়ে উঠেছে। কিন্তু জমিটা সেদিকে নিচু বলে ঘাসগুলোর মাথা জেলাবোর্ডের রাস্তার এপার থেকে বড়জোর আধ-হাতটাক চোখে পড়ে। ঘাসবনের ভিতর দিয়ে গোরুটাকে টানতে টানতে সুরতুন ওদিকের জমিটায় সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে সেটাকে বেঁধে দিলো।

গোরুকে সে একটু বেশি যত্ন করে দেখে লোকে তাকে ঠাট্টা করে, কিন্তু সে নিরুপায়। অন্য সময়ে গোরু ছেড়ে দেওয়া চলে। রাত-চরা-ধূর্ত গোরু সহজে ধরা পড়ে না, কিন্তু এখন বেচারার বড়ো কাহিল অবস্থা, মস্ত বড়াই বোধ হয় হবে বাছুরটা। কোথাও না বাঁধলে চলে না। গোরু বাঁধতে বাঁধতে তার মনে হলো মেয়েমানুষেরও বোধ হয় এমনি কাহিল অবস্থা হয়, নড়তে-চড়তেও অসুবিধা। কিন্তু সেদিন অসময়ে রজব আলি মাঠ থেকে হন্তদন্ত ফিরে এলো। বাড়ির সামনের জমিটুকু পার হতেও যেন তার তর সয় না, সেখান থেকেই হাঁক দিতে দিতে সে বাড়ির দিকে দৌড়ে এলো–ইয়াকুব, ইয়াকুব!

ছেলে ইয়াকুব ছিলো বাড়িতে, বাপের উত্তেজনায় হাসিমুখে সে বললে–চেঁচাও কেন্, আগুন লাগছে নাকি?

উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে রজব আলি বললোব খাবের দিছিলো কেডা?

–জাব তো আমিই মাখে দিছিলাম, কেন্ হলে কী?

–হলে কী? শালা গিধর, বাড়া মরে যে, ধলিডা।

–কও কী?

মুহূর্তে পিতার উত্তেজনা ইয়াকুবে সংক্রামিত হয়ে গেলো–তাইলে অষুধ করছে বোধায়। হা রে খোদা!–বলে রজব আলি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানেই বসে পড়লো।

ইয়াকুব বললোবসলি কি হবি? বদ্যি খবর দিতি হবি। চিকন্দির রাম মণ্ডলে নাই পাই কেষ্টদাসে আনবো। তুমি তৎক্ষণ উয়ে তেঁতুল-জল খাওয়াও, তামুক-জল খাওয়াও। হাওয়ায় ভেসে ইয়াকুব দৌড় দিলো মাঠের উপর দিয়ে আল টপকাতে টপকাতে।

রজব আলির উত্তেজিত স্বরে আকৃষ্ট হয়ে যারা এসেছিলো তাদের মধ্যে ছিলো ইয়াকুবের স্ত্রী ফতেমা। তার পরীর ভয় ছিলো। জিন পরী মানুষের কাছে ঘোরাফেরা করে তার এই ধারণার কথা পরিবারের সকলেই শুনেছে, তা নিয়ে হাসাহাসিও করেছে।

সে ঘোমটার আড়াল থেকে শাশুড়িকে বললে–আমি যে কই, রোজ সকালে একটা পরী ঘুরঘুর করে চারিগুলার কাছে।

কথাটা রজব আলির কানে গেলল। সে বললে–তুই দেখছিস্ পরী?

–আপনেক আগুনের বোঁদা দিয়ে গোয়াল সুরবের গেলাম, আপনে গেলেন বাড়ির ভিতর। তখন দেখলাম পরী আসে জান্নার চারিতে হাত দিয়ে কী যেন করতিছে।

–ই আল্লা, কস কী! তারপরে করলে কী পরীডা?

কী যেন তুলতিছে চারি থিকে আর চাবাতিছে মটমট করে।

রজব আলি তেঁতুলগোলা জল, তামাকপাতার জল, আগুন জ্বালার কাঠ নিয়ে মাঠের দিকে তেমনি হন্তদন্ত ছুটলো। একটা বড়ো মাঠের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তার গা শিউরে উঠলো পরী ঘোরে? সর্বনাশ। চাবায়ে-চাবায়ে খায় কী পরী? জিন্দা গোরুর কলিজা নাকি?

বকনাটাকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা হলো। চিকন্দির রামচন্দ্র এসেছিলো। ফতেমা কালীর কাছে মানত রেখেছিলো। কিছু করা গেলো না।

রজব আলি অপ্রতিভের মতো মুখ করে বললো–পরীর কামভাই, রোজাকীকরবি? রামচন্দ্র ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাসী রোজা নয়, বৈদ্য। পরীর গল্পটা সে ধৈর্য ধরে শুনলো কিন্তু মাথা নেড়ে বললো–এ যদি কুকুরমারা বিষ না হয় কী কইছি। চিকন্দিতে একমাসে পাঁচটা গোরু মরেছে।

সন্ধ্যায় দুঃখিত মনে অন্য গোরুগুলি তাড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে রজব আলি তামাকে হাত দিয়েছে, গোরুগুলি ছাড়া পেয়ে চারির দিকে ছুটেছে, এমন সময়ে সুরতুন এসে হাঁ-হাঁ করে তাড়ালো সেগুলোকে।

–কেন্ রে, তাড়ালি কেন্‌?

সুরতুন বলেছিলো–আমার মনে কয় উয়েতে বিষ আছে। কোন্ চারিতে আছে কিবা করে কবা।

–ঠিকই কইছি, জল বদলাতি হবি। সরায়ে বাঁধ রে, ইয়াকুব।

সুরতুন উসখুস করে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো। দুঃসংবাদটা সে ঘরে বসেই পেয়েছে। রজব আলির যেবাছুরটা আজ মারা গেছে সেটার চারি থেকেই খড় চুরি করে নিজের গোরুটাকে দিয়েছিলো কিনা, মাথা কুটলেও এ-বিষয়ে নিশ্চিন্ত হবার উপায় নেই। বিষ এখনো ধরেনি, কিন্তু তাতেই কি নিশ্চিন্ত হওয়া যায় যে বিষ ধরার সম্ভাবনা নেই।

শুকনো মুখে পুরো প্রশ্ন করেছিলো–চাচা, এক চারি পানিতে বিষ মেশালে কয়ডা গোরু মরে।

রজব আলির মাথায় তখন অন্য গোরুগুলির নিরাপত্তার কথা ঘুরছে, রাগ হচ্ছিলো গোরুগুলোর উপরে। শালার জেতের খাওয়ার কামাই নি। দুইপর রাতে কলার পাতে মুড়ে সামনে যা কেন দ্যাও, উঁস করে খায়ে ফেলাবি। আর তার উপরে আছে এই ভয়ংকর পাপের প্রতিবিধিৎসা। শিশুর মতো অবুঝ প্রাণী, তাকে কিনা খাবার নাম করে বিষ তুলে দেয়। সুরোর কথা সে শুনতে পেলো না।

ইয়াকুবের স্ত্রী ঘড়ায় জল এনে দিয়েছে হাত-পা ধোবার। সেই কাদায় ভারি ময়লাটে জলে হাত-পা ধুতে ধুতে মনটা যখন রজব আলির একটু স্থির হয়েছে, তখন ইয়াকুবের স্ত্রী বললো–সুরো কচ্ছিলো অও নাকি পরী দ্যাখছে! ও কয় বেটা ছাওয়াল, আমি কই মিয়ে মানুষ।

রজব আলির হাত-পা ধোয়া বন্ধ হয়ে গেলো, সে সাগ্রহে প্রশ্ন করলো–সুরো বেটা-ছোওয়াল দ্যাখছে?

পুরুষই যদি হয় তবে কাল্পনিক জিন বা পরী নয়। তাদের চাইতে শতগুণে বীভৎস দুশমন, মানুষ–যে বিষ দেয় গোরুকে।

ঘরে ফিরে সুরতুন তখন দু-তিনটে পাটকাঠি একত্র করে একটা মশাল বানিয়ে নিজের গোরুটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখছে। যে-চারিটায় খাচ্ছিলো রজবআলির মৃতবৎসটি সেটা থেকেই নিজের গোরুটাকে খড় এনে দেয়নি এমন প্রমাণ নেই,বরং এনে দিয়েছিলো একথাটাই আশঙ্কিত মনে দৃঢ়মূল হয়ে বসেছে। এমন সময় রজব আলি ডাকলো তাকে।

সেই পরীর কথা আবার। ফতেমা যখন চোখ বড়ো বড়ো করে গল্প করেছিলো, সে এক। পরীকে রোজ সকালে গোরুর চারির কাছে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে তখন সুরতুনের অন্তস্তল শুকিয়ে গিয়েছিলো। সে নিজে জিন পরীমানেনা, কাজেই তার বিশ্বাস হলো ফতেমা যদি সত্যিই কাকেও দেখে থাকে তবে সে তাকেই দেখেছে। কী সর্বনাশ! সে তখন ফতেমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য বললো–আমিও দেখছি পরী, খুব কাছে দাঁড়ায়ে দেখছি। ইয়া গালপাট্টা তার, একমাথা ঝাকড়মাকড় চুল। ফতেমার তাক লেগে গিয়েছিলো।

কিন্তু রজব আলি যখন তার দরজায় এসে হাঁক দিয়ে দাঁড়ালো তখন ভয়ে হকচকিয়ে পুরুষ জিনের কথা বলতে পারলো না সে। সে নিজেই সকালে চারির কাছে যায়, বলে ফেলো।

–গেছিলি কে, তাই ক। সুরতুন নির্বাক।

–কেন তাই ক।

সহসা রজব আলির মনে হলো সত্যটার তলদেশও সে দেখতে পেয়েছে : এটা সুরতুনের অকারণ জ্ঞাতিবৈর সাধন। জ্ঞাতির মেয়ে কিনা তাই।

প্রথম চড়টা খেয়ে সুরতুন হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলো, কিন্তু উপর্যুপরি চড় পড়তে লাগলো যখন, বোবা কান্নায় হাহাকার করতে লাগলো সে। পড়শির ভিড় জমে উঠলো রজব আলির উঠোনে। সুরতুনের গায়ের কাপড়টুকু দড়ির মতো পাকিয়ে তার গলা টেনে ধরেছে রজব আলি। অস্পষ্ট আলোয় সুরতুনের পিঠের ও পাঁজরার হাড়গুলো চোখে পড়ছে, তার ধূলিমলিন বুকের মেদহীন আকুঞ্চিত স্তন দুটি।

.

মাধাই বায়েন বিষ দিতো গোরুকে।

চামড়ার ব্যবসায়ী সানিকদিয়ারের কফিলুদ্দি সেখ। বাবোখানা ছাল পৌঁছে দেবার বরাত নিয়ে মাধাই আষাঢ় মাসে পঁচিশ টাকা আগাম নিয়েছিলো তার কাছ থেকে। কিন্তু বরাত রাখা সহজ কথা নয়। সে ছাড়াও ছাল তুলবার লোক এঅঞ্চলে আছে, কেউ-কেউ আবার কফিলুদ্দির মাইনে করা।

তিনখানা ছাল পৌঁছে দেবার পর বিপদে পড়লো মাধাই, আর গোরু মরছে না এ অঞ্চলে। ওদিকে কফিলুদ্দির তাগাদা। তাগাদা শুধু মুখেই নয়,হাটফেরতা পথে গালমন্দও বটে। এই পথে নামলো মাধাই। দুমাসে চারটি গোরুকে বিষ দিয়েছিলো সে; কিন্তু সব ক’টির ছালই যে তার হাতে পৌঁছেছে এমন নয়, তিনটিই অন্যের হাতে পড়েছে। যত ঝুঁকিই সে নিয়ে থাক, যত কৌশলেই সে কাজটা করে থাক, তার দাবির যুক্তিটা প্রতিপক্ষকে বলা যায় না। নীরব দর্শক হওয়া ছাড়া আর কী করতে পারে সে? কিন্তু কফিলুদ্দির কাছে সমব্যথা আশা করার চাইতে তার আত্মহত্যা আশা করা সহজ। সে ছাল চায়, যেমন চৈতন্য সাহা চায় দাদন-দেওয়া পাট। অন্য কোনো কথা বোঝার ব্যাপারে অত্যন্ত নির্বোধ বলে মনে হয় তাদের দুজনকে।

চিকন্দিতে গোরু কম। যাদের আছে তারা হুঁশিয়ার হয়ে গেছে। বুধেডাঙায় গোরুর সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু সান্দারদের ঘরে যেতে সাহস হয় না। সুরতুন যে মারটা খেয়েছিলো তাতেই মাধাই গুড়ো হয়ে যেতো। সব চাইতে মুশকিল করেছে রামচন্দ্র। যে-বিষ কফিলুদ্দি নিজে নারকেলডাঙা থেকে আনিয়ে দিয়েছিলো গোবধের জন্য তার কাছে রামচন্দ্রর ওস্তাদি হার মেনেছে। কিন্তু রামচন্দ্রর মণ্ডলগিরির প্যাঁচে হার মানতে হলো কফিলুদ্দিকে। গোরু মরলে মাটিতে পুঁতে ফেলছে গ্রামবাসীরা।

কয়েকদিন ধরে নানারকম উল্টোপাল্টা ভেবে আবার প্রথম যে রাতে মাধাই কলাপাতায় মুড়ে বিষমাখানো ভাত নিয়ে বেরিয়েছিল রামচন্দ্র মণ্ডলের হাতে ধরা পড়ে গেলো।

বুধেভাঙা আর চিকন্দির সীমায় হাঁক দিলো রামচন্দ্রকে যায়? ছুটে পালাতে গিয়ে মাধাই বুধেভাঙার পথ ধরেছিলো; কিন্তু বুধেডাঙায় রজবআলি সান্দার জেগে ছিলো। মনে হলো সে গলায় খাকরি দিয়ে দাওয়ায় এসে দাঁড়ালো। সেও যেন হাঁক দিলো–কে যায়?

মাধাই আর পারলো না। দৌড়তে গিয়ে তার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে। পিছন থেকে রামচন্দ্র তার বিষসুদ্ধ হাতখানা চেপে ধরেছিলো। বৈদ্যর চোখে দেখামাত্রই ধরা পড়েছে। অপরিসীম ঘৃণায় তার হাত ছেড়ে দিয়ে রামচন্দ্র বললো–তুই না হিঁদু!

মাধাই কাঁদতে পারলোনা।বুকের মধ্যে থেকে আইঢাইটা গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে।

–গাঁ ছাড়বি? মণ্ডলি গলায় বললো রামচন্দ্র।

–ছাড়ব, আজ্ঞা।

–যা!

সম্মুখের দিকে একটা ধাক্কা দিলো রামচন্দ্র। উল্টে পড়ে গিয়ে মাধাই সহসা উঠতে পারলো না। বুকের ভিতরে ছুরি বেঁধার মতো ব্যথা করছে। দম যেন নেওয়া যাবে না আর। খানিকটা সময় বসে থেকে কোনরকমে উঠে মাধাই বুধেভাঙা ছাড়িয়ে দিঘার পথ ধরেছিলো।

সে বলেছিলো একদিন–প্রথমে হাসি-হাসি মুখে শুরু করে শেষের দিকে বাবরিচুলসমেত মাথা দুলিয়ে কথার ফাঁকে ফাঁকে ডাইনে বাঁয়ে থুথু ফেলে। রামচন্দ্র মণ্ডল বলেই নাকি সেদিন তার প্রাণটা রক্ষা পেয়েছিলো। বিড়ালছানার মতোশূন্যের দিকে করে গ্রামের সীমার বাইরে তাকে ফেলে দিয়েছিলো রামচন্দ্র, ইচ্ছা করলে অনায়াসেই মাটিতে দু-চার বার আছড়ে সে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থাও করতে পারতো।

মাধাই বলে–আমার হয়ে তুই সেদিন মারটা খেয়েছিলি, আর তাতেই রজব আলির রাগ পড়ে গিয়েছিলো, নতুবা ঐ মারটা আমাকে মারলে আমি বাঁচতাম না।

এটা এক ধরনের কৃতজ্ঞতা হতে পারে, কিন্তু এরই জন্য একটি মানুষ আর-একজনকে পথ থেকে বুকে করে কুড়িয়ে আনে না। আর যদি এই সামান্যটুকুর জন্যই করে কেউ, তবে সে মহৎ মানুষটিই চামড়ার লোভে কখনো গোরুকে বিষ দিতে পারে না।

অন্তত একাহিনীতে এমন কিছু নেই যাতে বোঝা যাবে সুরাকে চিকন্দির পথ থেকে কুড়িয়ে এনে শুধু তখনকার মতো প্রাণ বাঁচানোই নয়, তার ভবিষ্যতের ব্যবস্থাও কেন সে করে দিয়েছে।

টেপির মায়ের দলে ভর্তি হয়ে এক শহরের চাল পুলিসের চোখ আড়াল করে আর-এক শহরের বাজারে নেবার কাজ করে পুরো পৃথিবী সম্বন্ধে কিছু কিছু জ্ঞান সংগ্রহ করেছে। এখন তাদের নিজেরই একটা দল আছে। যাদের মাধাই নেই তাদেরও কেউ কেউ অবশ্য এই পথ নিজেরাই আবিষ্কার করেছে। কিন্তু সুবোর মতো একটি গেঁয়ো-মেয়ের পক্ষে তা সম্ভব ছিলো না। আর শুধু কি তাই? চেকার বলল, পুলিস বলল, তাদের ভয়ে যখন প্রাণ শুকিয়ে আসে তখন দিঘার শত শত মাইল দূরে থেকেই গাড়ির কামরার জানলায় মুখ গলিয়ে দিঘা বন্দরের মাধাইয়ের জন্য সুরো চোখ মেলে রাখে। পুলিস থাক, চেকার থাক, গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে মাধাইকে কোথাও না কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে। হয় সে স্টেশনের কনেস্টবলদের সঙ্গে রসিকতার গা তুলে দিয়েছে, কিংবা কোনো রেল কর্মচারীর সঙ্গে নিবিড় হয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে গল্প করছে।

এমন যে মাধাই, ভ্রাতা নয় শুধু রক্ষীও, ফতেমা বলে–সোনাভাই, তাকে কি সাহস করে জিজ্ঞাসা করা যায় তার কোনো কাজের কারণ? দেবতাকে কে কবে জিজ্ঞাসা করেছে খরা বা বর্ষার কারণ, বলো?

কিছু-কিছু পরিবর্তন হয়েছে মাধাইয়ের। খরখর করে কথা বলতো, তড়বড় করে চলতো, এ যেন সে মাধাই নয়। গত কয়েক খেপ চাল নিয়ে ফিরে সুরো এটা লক্ষ্য করেছে। মাধাই এমন ধীরস্থির ছিলো না চিরকাল। বরং অসম্ভব ফুর্তিবাজ ছিলো। স্ফুর্তির কথায় ঘটনাটা সুরোর মনে . পড়ে গেল।

সুরো জানতো, টেপির মা এবং অন্য দু’একজন গাঁজা খেতো। দু’একজন চালওয়ালি মদ ধরেছিলো। নেশার ঘোরে তারা অশ্লীল কথাবার্তা বলতো। এই তাদের স্মৃর্তি করা। মাধাই একদিন তাকে বলেছিলো–মাঝে মাঝে ফুর্তি করবি, নইলে কাজে জোর পাবিনা। মাধাই একথা বলার আগে টেপির মা প্রভৃতি দু’একজন সুরোকে তার গম্ভীর চালচলনের জন্য পরিহাস করেছিলো। তখন মাধাই তার স্টেশনের ডিউটিতে যাচ্ছিলো। তাদের পরিহাস শুনে একটু থেমে মাধাই বলেছিলো কতকটা যেন একটি শিশুকে প্রশ্রয় দেয়ার ভঙ্গিতে-ওকে যে অত কও, ফুর্তি ও একদিন আমার সঙ্গে করবি।

মাধাই স্ফুর্তি করার প্রস্তাবটা যখন সোজাসুজি তার কাছে তুলো সুরো একটা বোবা ভয়ে ঘামতে লাগলো। কিন্তু অনাহারের বন্যায় তার ক্ষীণ মুঠি ধরে যে-পুরুষমানুষটা তাকে বাঁচিয়েছিলো, তার হাত হারিয়ে ফেলার ভয়ে সুরো মাধাইয়ের পিছন পিছন বাজারে গিয়েছিলো। অবাক করলো মাধাই। বাজারে ঢুকে মদ-গাঁজার দোকানের ধার-পাশ দিয়েও সে হাঁটলো না। সুরোর হাত ধরে, খুব সম্ভব সুরোই ভয়ে তার হাত চেপে ধরেছিলো, কেবল সে পাক খেয়ে বেড়াতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত তারা গিয়ে বসেছিলো উল্কিওয়ালার সামনে।সুরোর ডান হাতের মণিবন্ধের কিছু উপরে একটি নীলপক্ষী ফরমায়েস করে আঁকিয়ে নিলো মাধাই, একটা লাল জমির ঠেটি শাড়ি কিনলো সুরোর জন্য। অবশেষে মাধাই বলেছিল–হলো ফুর্তি করা? অজ্ঞাত বিভীষিকায় তখনো সুরোর গলা কাঠ হয়ে আছে।

সুরো হাঁটতে-হাঁটতে তার নীলপক্ষীটার দিকে চেয়ে-চেয়ে দেখলো৷ কিন্তু এই দুপুর রৌদ্রের আকাশ, এ কি ফুর্তি করে উড়িয়ে দেয়ার বিষয়? সুরোর গাল বেয়ে ঘাম ঝরছে, ধুলো ও ঘামে মিশে কাদা জমে যাচ্ছে মুখের এখানে-সেখানে।

ফতেমার ব্যাপারে মাধাইকে স্ফুর্তির ব্যবস্থা করে দিতে হয়নি। মাধাই নিজেই বলেছিলোতোতে আর ফতেমাতে তফাত আছে। ভাবল সুরতুন: ফতেমার সঙ্গে তার আগেও পার্থক্য ছিলো, এখনো আছে। রজব আলি সান্দারের বেটা বউ,ইয়াকুবের স্ত্রী ফতেমা গোলগাল একটি একরোখা মুরগীর মত কুঁদুলি ছিলো। জিন পরীর ভয়ে সে বার হতো না বড়ো একটা, কিন্তু যখন বা’র হতো পাড়ার মেয়েরা তাকে মেনে নিয়ে সরে পড়তো। কিন্তু এসব ঘটতে ধানহীন দিনে। ধানের দিনের ফতেমা, সে আর-একজন। কোথায় বা জিনপরী, কোথায় কোন্দল। মাঠের ধান কেটে দিয়ে পুবদেশী মজুররা চলে যেতেই গ্রামের মেয়েরা ভোর রাতের অন্ধকারে মাঠে-পড়ে-থাকা ধান কুড়োতে যেতো। ফতেমা আসতো অন্যান্য সান্দার-মেয়েদের দলে। সেই ভোর রাতে আলো ফোঁটার আগেই ধান খোঁটার কাজ শুরু করতো তারা।কত গল্প, কত রসিকতা ফতেমার ভাঁড়ারে আছে, শুনে সান্দারদের মেয়েদের তাক লেগে যেতো। পাছে কৃষক শুনে। ফেলে তাড়া করে আসে, এই ভয়ে অন্য মেয়েরা যত তাকে হাসি চাপতে বলে তত তার আঁচল চাপা মুখ থেকে ফিনকি দিয়ে হাসি বার হয়।

এখন সে ফতেমা নেই। শিশুদের গালের অতিরিক্ত মেদের মতো তার গায়ের মেদও ঝরে গেছে। তেল-চুকচুকে কাজলমাখা গৃহিণী নয়, রুক্ষ ধূলিমলিন যাযাবরের মতো দেখায় তাকে। কিন্তু সে যেন অনেক লম্বা হয়েছে আগের চাইতে, চোয়াল দুটি গালে স্পষ্ট হয়ে উঠে তাকে পুরুষ-পুরুষ দেখায়। মনে হয়, সে যেন পুরুষের মতো দৈহিক শক্তিও অর্জন করেছে। ধরা পড়ে গেলে হাতজোড় করে পুলিস বা চেকারের সামনে দাঁড়ানোর ব্যাপারে যেমন, অপরিচিত শহরের তেলেভাজা জিলিপির দোকানের পাশে দল নিয়ে বসে হাসি-তামাশা করার বিষয়েও তেমনি সে অগ্রণী। কী করে সে দলের মাথা হয়ে উঠলো কে জানে। অথচ এই চালের ব্যবসায়ে সুরোই তাকে ডেকে এনেছিলো মাধাইয়ের অনুমতি নিয়ে।

.

বন্দর দিঘার এক গলিতে পৌঁছে সুরো পা দুখানিকে একটু জিরিয়ে নেবার জন্য একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়ালো। একটি শুকনো চেহারার বুড়ি দোকানটা চালায়। পানের দোকানের পাশ ঘেঁষে একটা নোংরা গলি পুবদিকে চলে গেছে। গলিটার দুপাশে ভাঙাচোরা ছোটো ছোটো ইটের বাড়ি। সুরোর সম্মুখে উত্তরমুখী পাথর-ছড়ানো রাস্তাটায় আধ মাইলটাক হাঁটলে মাধাই বায়েনের ঘর।

পান নিয়ে সুরো উত্তরের পথ ধরবে এমন সময়ে কে তার কাঁধে হাত দিলো। চমকানো সুরোর অভ্যাসগত। এতদিনের চালের কারবারেও সে এ-বিষয়ে নিঃশঙ্ক হতে পারেনি। তার কাঁধে যে গত দিয়েছিলো তাকে দেখে সুরো সম্ভ্রমে সরে দাঁড়াচ্ছিলো, কিন্তু সেই আগ বাড়িয়ে কথা লিলো, সুরো না?

হ্যাঁ।

তাহলে চমকালি কেন? আমি টেপি।

টেপিই বটে। কিন্তু চেনা অসম্ভব। চালওয়ালি টেপির মায়ের টেপি নয়, এ যেন কোন-এক ভাসান পালাগানের বেহুলা সুন্দরী। তেমনি রঙিন শাড়ি পরনে, তেমনি একগা গহনা। চোখে কাজল, ঠোঁট পানের রসে টুকটুকে। মাস দু’এক আগে টেপি চালের মোকামে দলছাড়া হয়ে পড়েছিলো। এক চেকার তাকে বিনা টিকিটে চলার দায়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে রাখে। সুরোর ধারণা ছিলো টেপি জেলে আছে। কিন্তু দু-মাসেই মানুষের এত পরিবর্তন হয়?

তুই এখন কনে থাকিস, কী করিস? সুরো জিজ্ঞেস করলো।

এইখানেই। ঐ গলিটার মধ্যে এক বাড়ি আছে আমার।

তোর বাড়ি? ওখানে তো পাকাবাড়ি সব, ভদ্দরলোকেরা সব থাকে।

না থাকলেও তারা আসে। কেন, চেকার কি ভদ্দরলোক না?

চেকারবাবুর বাড়িতে কাম কাজ করিস?

কাম কাজ করবো কেন লো, আমি কি চেকারবাবুর ঝি?

সহযাত্রিণীর সৌভাগ্যে খুশি হলো সুরতুন, সে প্রশ্ন করলো, বিয়ে করছে?

টেপির মুখোনি ঈষৎ ম্লান হলো। সে বললো, না করছে ক্ষেতি কী? বউ না যে বকাবকি করবি, অচ্ছেদা করবি। এখানে দাঁড়ায়ে দ্যাখ, তার আসার সময় হতিছে। কিন্তু ফতেমা বুন যা কয় তাই সত্যি। ঠারেঠোরে বোঝার বয়েস তোর কোনোকালেই হবিনে।

টেপির কথার সুরে সুরো বুঝতে পারলো তার প্রশ্নটিতে টেপি খুশি হয়নি, কিন্তু তার বিরক্তির কারণটাও সে ধরতে পারলো না।

টেপি বললো, সে কথা যাক, তুই একা যে?

সুরতুন বললো, কী করি কও, সাহস পালেম না।

এরপর সে যা বললো তার সারমর্ম এই রকম : পরশুদিন দিঘার স্টেশনে পুলিসরা গাড়ি ঘেরাও করে চালের কারবারিদের ধরার চেষ্টা করেছিলো। সেই ভয়ে সে গাড়ির কাছে আর ভিড়তে পারেনি। ফতেমা, ফুলটুসি প্রভৃতি কয়েকজন মরিয়া হয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠেছিলো। শেষ পর্যন্ত তাদের কী হয়েছে কে জানে? এখন সুরতুন ছোটো ইস্টিশন থেকে আসছে। সেখানে পুলিস চেকার থাকে না এই শুনে সে গিয়েছিলো, কিন্তু কপাল যায় সঙ্গে। পুলিস বলতে দিঘা থানার কনকদারোগাই সেখানে ছিলো উপস্থিত। আশ্চর্য হবে তুমি, টেপি, উঁচু কেলাস থেকে যেসব মহিলা নামে তারাও চালের কারবার করে। এ অবস্থায় কী করতে পারে সুরতুন?

টেপি বললো, কিন্তু কোনো এক কিছু তো করা লাগবি।

কী করবো তা কতি পারো?

টেপি কিছুকাল ভেবে বললো, আছে এক ব্যবসা।

কও।

টেপি হেসে বললো, কাল দুইপরে আসিস, কবো।

সুরো আবার হাঁটতে শুরু করলো।

আশ্চর্য পরিবর্তন হয়েছে টেপির, শুধু বেশভূষায় নয়, কথায়, ভঙ্গিতে। সব মিলে সে এক নতুন মানুষ। বয়সে টেপি তার চাইতে ছোটো কিন্তু সে-ও যেন বুদ্ধিতে তাকে ছাড়িয়ে গেলো। এখন সে ব্যবসায়ের ফিকির বলে দেয়।

অন্য কাউকে না বললেও নতুন ব্যবসায়ে নামতে হলে মাধাইকে অবশ্যই বলতে হবে। তার অনুমতি নিয়ে, পুরো স্থির করলো, একদিন সে আসবে টেপির কাছে খোঁজ নিতে। :

আর টেপির নিজের কথা। না, সেটা মাধাইকে বলা যাবে না। তাদের দলের অন্য অনেকে এসব ধরনের কথাবার্তা রসিয়ে রসিয়ে বলে। সুবো স্তব্ধ হয়ে শোনে, শুনতে তার ভালো লাগে না। গা গুলিয়ে ওঠে, পালাতে ইচ্ছা করে তার। আর, তার যে এমন হয় একথাটাও প্রকাশ করার উপায় নেই। একদিন মন খুলে একটু বলতেই টেপির মা ও ফতেমা বলেছিলো–এ এক রকমের রোগ। শুধু ফুলটুসি নামে যে ছোটোখাটো অকালে সন্তান-ভরাক্রান্ত মেয়েটি আজকাল তাদের দলে আসছে সে একদিন বলেছিলো–বিশ্বাস করবা না ভাই পুরুষের জাতকে।

চেকারকে সে এতদিন কালোকাপড়ে-মোড়া-নৈব্যক্তিক একটা আইন বলে মনে করেছে, যার চেহারা খানিকটা পুরুষের মতো। আজ টেপি চেকার জাতটিকেই চিনিয়ে দিয়েছে।কী বোকা সে নিজে! এতদিন চেকারদের থেকে আরো কেন সাবধান হয়ে থাকেনি, ভাবলো সুরতুন।

মাধাইয়ের ঘরের নিচু বারান্দাটায় পৌঁছে কিছুকাল একেবারে ঝিমহয়ে বসে রইলো সুরতুন। দুপুর রোদে দু-ক্রোশ পথ চলে সে যেন অন্তঃসারবিহীন হয়ে গেছে। চলার সময়ে এতটা বোঝ যায়নি।

শরীরটা একটু স্বাভাবিক হলে আবার দুশ্চিন্তা ঘনিয়ে এলো। কী হবে তাহলে? চালের কারবার কি বন্ধ করতে হবে? অনাহারে মৃত্যু? ফতেমার সঙ্গে তার পার্থক্য আছে, আবার মনে হলো তার। ফতেমার গ্রামে ফিরলেও চলবে। কষ্ট হবে, অনেকদিনই তাকে অনাহারে থাকতে হবে, তবু তার শ্বশুর এবং সে দুজনের সম্মিলিত চেষ্টায় অর্ধাহারে দিন কাটাতে পারবে। কিন্তু তার নিজের? এব্যবসা যত কষ্টের হোক, যত বিপজ্জনক হোক, এ ব্যবসায়ে নামার আগে আহার যে এমন নিয়মিত হতে পারে এ-ও সে জানতো না। পুলিসের ভয় ছিলো, চেকারের ভয় ছিলো। কিন্তু ছোট স্টেশনটাতে কনকদারোগার উপস্থিতি পুলিসি ভয়কে সহ্যাতীত করেছে, এবং টেপির কথা শুনে এবং টেপিকে দেখার পর চেকার আজ এক নতুনতর বিভীষণ মূর্তি নিলো। হায় হায়, সে কী করবে!

কিছু পরে সে অবশ্য স্থির করলো, মাধাই আসুক। যা করার সে-ই করুক। তার নিজের বুদ্ধি আর কতটুকু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *