০১. বাঙাল নদী পদ্মা

গড় শ্রীখণ্ড – উপন্যাস – অমিয়ভূষণ মজুমদার
প্রথম প্রকাশ : ১৯৫৭ সংস্করণ : ১৯৮৭
আমার সবচাইতে পরিচিত পুরুষ চরিত্র
বাবাকে উৎসর্গ করলাম

.

যেমন সুরতুন। সুরতুন তো প্রেমে পড়ার মুখেই ছিলো, তার অবচেতনে একটা ভয় ছিলো পুরুষের প্রতি-সেই জন্যে যাকে ভালোবাসতো সেই মাধাই বায়েনকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারলো না। কিন্তু ইয়াজ তাকে তাকে উইন করছে কীভাবে? চলল আমি তোমাকে তোমার প্রেমিকের কাছে নিয়ে যাবো, মাধাই বন্যায় ডুবে যেতে পারে, তুমি একলা যেতে পারবে না–এই বলে তার সঙ্গে দুঃখ ভাগ করে বন্যার জলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। সেই অবস্থায় সে-ও তো যুবক, সে-ও তো সুরতুনকে কামনার চোখে দেখে এসেছে–যেহেতু ঠিক জীবনের পরিপোষক নয়, সে মরবিড হয়ে গেছে, সেখানে জীবন ইয়াজের চেহারা নিয়ে সুরতুনকে ফিরিয়ে এনেছে। তারা ফিরে আসছে। যে-চরে উপস্থিত হয়েছে, সেখানে আদিগন্ত সেই চর থেকে জল সরে গেছে, শুধু কাদার পাথর, কিছু দেখা যায় না। শুধু দেখা যাচ্ছে, চরণকাশির আলেফ সেখ–তারও তো কলকাতার দাঙ্গায় ছেলে গেছে, যে-ছেলে জীবনকে রক্ষা করার জন্য প্রাণ দিয়েছে : ডাক্তার ছিলো, ফুটপাথে রোগী পড়েছিলো, তুলে আনতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। তা, সেই আলেফ সেখ এই বন্যা-ছেলের মৃত্যু-দেশভাগ রাজনীতি কিছু ভাবছে না : সে লাঠি হাতে দেখছে উপরে যে বালি পড়েছে তার কত নিচে পলিমাটি, অর্থাৎ পলিটা সরিয়ে সে চাষ করবে–এই দেখছে। এই দেখে সুরতুনকে ইয়াজ বলছে যে আমি আমার কাপড় থেকে আর-একটু ছিঁড়ে দি, তুই গায়ে জড়িয়ে নে। ওই দ্যাখ আলেফ সেখ, মনে হয় ওর কাছে গেলে কিছু খাবার পাওয়া যাবে। অর্থাৎ সেখানে কী? জীবন সৃষ্টি হচ্ছে সুরতুনের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করছে ইয়াজ। দেখছে, এই লাইফটা আমরা হাতে পেয়েছি, দ্যাখো ওই মসজিদটা। এবং সে সময়ে লেখকের একটা কথাই মনে হয়, সেটা হচ্ছে, উপরে মেঘ ডাকছে, পদ্মর মুখ কালো হয়ে উঠছে। পদ্মকে বলছে : হে কাল-পদ্ম যেন কাল, কালের প্রতিমা-তুমি দয়া করো। এই যে কালপ্রবাহ, পদ্মার মতো এদিক-ওদিক টার্ন নিচ্ছে, আমরা কষ্ট পাচ্ছি, বুঝতে পারছি না এর মধ্যে ক্যারাকটার তৈরী হয়ে গেছে। তাই কাল, তুমি দয়া করো, অর্থাৎ ধ্বংস কোরো না। জীবনে যারা সবচাইতে বঞ্চিত, সেই শ্রেণী জীবনে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, তুমি দয়া করো। ছোটোখাটো জিনিস দিয়ে আমরা জীবনের আয়োজনকরছি–এটা কিন্তু চিরস্থায়ী, কালকে সারপাসকরে যাচ্ছে।–১৯৮৩

.

০১.

বাঙাল নদী পদ্মা এখানে বন্ধনে পড়েছে, ‘বিরিজ’ বলে লোকভাষায়। দুর্ধর্ষা গণগামিনী গঙ্গাকে সে কোন তরুণ আদর করে পদুমা–পদ্মা বলেছিলো এবং

আপন করেছিলো তা কেউ বলতে পারে না; সে ভালোবেসেছিলো কিন্তু বন্ধন। করার চেষ্টা করেনি। তার সর্বনাশা কূলনাশিনী গতিকে শ্রদ্ধাও করেছিলো। এখন ভালোবাসা বংশধরদের রক্তে শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভয়ের সমন্বয়ে সব চিন্তা সব ভাবনার পিছনে ধর্মের অদৃশ্য দৃঢ় ভিত্তি হয়ে আছে।

রেলের লোহার আলকাতরা-মাখানো বেড়ায় হেলান দিয়ে বসে পুরো আকাশের দিকে চেয়েছিলো। তার মাথার উপরে একটি বিরলপত্র শিশু ছাতিমের শাখা, বাকিটুকু চৈত্রমাসের আকাশ। ইতিমধ্যে রোদ কড়া হয়ে উঠেছে। দূরের দিকে বায়ুমণ্ডল ঝিলমিল করে কাঁপছে। চিলগুলো খুব উঁচু থেকে পাক খেতে-খেতে খানিকটা নেমে এসে উল্টোপাকে আবার উঁচুতে উঠে যাচ্ছে। ডানদিকে আকাশের গায়ে লোহার ব্রিজ।

স্টেশনে লোকজন নেই। সুরো-সুরতুন্নেছা–প্রায় একা ট্রেনের প্রতীক্ষা করছে। প্ল্যাটফর্মের বিপরীত প্রান্তে একটা হাত-তিনেক উঁচু তাঁবু খাড়া রোদে পুড়ে যাচ্ছে। তাবুর কাছে রূপালী রং করা গুটিকয়েক টেলিগ্রাফের পোস্ট, পাকানো তারের বান্ডিল। সেগুলো এত উত্তপ্ত হয়েছে, মনে হয় চোখে লাগবে সেদিকে চাইলে। পেতলের বড়ো বড়ো থালা মেজে নিয়ে কয়েকজন। মজুর আধঘণ্টা আগে শেষবারের মতো তাঁবুতে ঢুকেছে। কোন দেশীয় এরা কে জানে। পশ্চিমের নয়, তা পুরো ওদের কথায় বুঝতে পেরেছে। কুচকুচে কালো, চুলগুলি ভেড়ার লোমের মতো, চোখগুলো লাল করর্চা। পায়ে ভারি-ভারি জুতো, কালচে-সবুজ রঙের প্যান্ট পরনে।

ব্রিজটা অত্যন্ত উঁচু, তার ধরাছোঁয়া পাওয়ার জন্য গ্রামের জমি থেকে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মও উঁচু। এত উঁচু যে বড়োবড়ো তালগাছগুলিও পায়ের নিচে থাকে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালে। সেই তালগাছগুলির পায়ের কাছে পোডোজমির মধ্য দিয়ে গ্রামে যাওয়ার পথ।

প্ল্যাটফর্ম থেকে ঢালু হয়ে জমি নেমে গেছে গ্রামের মাটির দিকে, সেই ঢালু বেয়ে পাকদণ্ডির মতো আঁকাবাঁকা একটা রাস্তা উঠে এসেছে। সেই রাস্তার পাশে সোনালি-লতায়-ঢাকা আমগাছের আড়াল থেকে একটা ধোঁয়া পাক খেয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। আগুন নাকি? ভাবলো সুরো। নিচের দিকে ভালো করে তাকালো সে আবার। ধোঁয়ার পাকটা এগিয়ে আসছে। ধুলোর থাম–তাহলে বোধহয় পাল্কি আসছে, বেহারাদের পায়ে-পায়ে ধুলো উড়ছে, ঘূর্ণিপাকের মতো হচ্ছে এলোমেলো বাতাস লেগে–এই ভাবলো সুরো। সে ভালো করে চেয়ে দেখলো–একজন। কে আসছে ঘোড়া ছুটিয়ে।

ক্লান্ত অলস অবসর। সে সোজা হয়ে বসলো।

জল ও জঙ্গল নিয়ে জাঙ্গাল-বাঙ্গাল বাংলা দেশের এক গৈ-গাঁয়ের মেয়ে সুরো। ব্রাত্য ‘সান্দার–বংশে তার জন্ম। বাপ নেই ভাববে, মা নেই কাঁদবে। গাঁয়ের পরিসীমার সঙ্গে সম আয়ত ছিলো তার মনের বিস্তার। গ্রামের মধ্যে গাঁ, বড়ো গ্রামের অংশ ছোটো গ্রাম। পদ্মার চরে বসানো গাঁয়ের একটির নাম বুধেভাঙা, তারই মেয়ে সে। বাউলপীরের গানে-গানে ছড়ানো, কথক-পাঠকের মুখে-মুখে রঙানো ধর্ম-দর্শন ন্যায়-নীতির প্রবেশ হয়নি তার মনের সীমায়।

ধান যখন নতুন বউ-এর মতো পাত্রে-অপাত্রে অকাতরে সলজ্জ হাসি বিলোচ্ছে তখন আহার করা, এবং ধানের দিন সরে যেতে-যেতেই উপোস শুরু করার অভ্যাস ছিলো তার। কিন্তু বাঙাল নদীর দু-পাড়ে সেবার এক দুর্ভিক্ষ এলো। তারপর গ্রামের বাইরের জীবন।র্যাল, হাউইজাহাজ, সোলজর। আঘাতে-আঘাতে তার মনের পরিসীমা বিস্তৃত হতে লাগলো। বাঙালনদীর হংসপক্ষ বিধূত একটি দৃশ্যপটে সহসা যদি বনরাজির মাথা ছাড়িয়ে ধোঁয়াকলের চোং জেগে ওঠে, যদি চোং-এর ফাঁকে-ফাঁকে হাঙর রং-এর লোহার পাখি গর্জন করে উড়ে যায়, সুরোর মনের তুলনাটা দেওয়া যায় তাহলে।

ট্রেনের অপেক্ষা নয়, প্রতীক্ষা করছে সে। এ স্টেশনটায় মেল ট্রেন থামে না। কিন্তু ফুলটুসি তাকে বলেছে আজকাল বড়োবড়ো ট্রেনগুলিও আকস্মিকভাবে এ স্টেশনে থেমে যায়, সাহেব সুবো নামে কখনো কখনো, বেশিরভাগই নামে বুট-পরা, প্যান্ট-পরা মজুররা। এখানে সুবিধা এই, পুলিসের ভয় এখানে কম। দিঘার স্টেশনে চালের কারবারিদের পুঁটুলি নিয়ে পুলিসের লোকেরা বড়ো জুলুম করছে কিছুদিন ধরে। এখানে তাদের চোখের আড়ালে কিছু করা যায় কিনা এ-খোঁজ নেওয়াও তার উদ্দেশ্য। কিন্তু কোনো ট্রেন না-থামতেও পারে, কোন ট্রেনটা থামবে তারও নিশ্চয়তা কিছু নেই। সকাল থেকে দু-তিনখানা না-থেমে চলে গেছে, যে-কোন একটা থামবেই এই আশা নিয়ে পুরো প্রতীক্ষা করছে।

ধড়মড় করে উঠে বসলো সুরো এবং অনুভব করলো নিশ্চয়ই সে একটু ঘুমিয়েও পড়েছিলো। চোখ মেলে যা সে দেখলো তাতে মুখে কথা সরলো না। চারহাত উঁচু নিরেট পুলিসের থাম। দিঘা থানার বড়ো দারোগা ছাড়া আর কেউ নয়। পুরো পৃথিবীতে কোনো দারোগাকেই চিনতো না, কনক হোক কিংবা হিরণ। কিন্তু এমন প্রকাণ্ড, এমন সুন্দর কনক ছাড়া আর কে হবে। সান্দারদের মুখে গত দু-তিন বছর ধরে কথা। কিন্তু স্বজাতীয়দের আলাপ থেকে যা কল্পনা করেছিলো সুরো তার চাইতেও দৃঢ় এর দাঁড়ানোর ভঙ্গি, তার চাইতেও ফর্সা। খাকি। রং-এর বুক-খোলা সার্ট; টুপির নিচে কৌশলে বসানো রুমাল দিয়ে দুটি কান, ঘাড়ের অনেকটা ও খানিকটা করে মুখ ঢাকা। সুরো চোখ নামিয়ে পায়ের দিকে তাকালো। চকচকে লাল চামড়ার হাঁটু পর্যন্ত উঁচু জুতো। জুতো নিয়েই জন্মেছিলো নাকি? নতুবা এ-জুতোয় পা যায় কী করে? কিন্তু পরক্ষণেই ধকধক করে উঠলো সুরোর বুক, আর কিছু দেখবার সাহস অবশিষ্ট রইলো না তার।

সান্দারদের জাতশত্রু পুলিস। শত্রুতা এখনকার দিনে আর সক্রিয় নয়। সরকারের কাগজপত্রে সান্দারদের নাম অপরাধপ্রবণ উপজাতি হিসাবে লেখা আছে। তারই নিয়ম অনুসারে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক সান্দারপুরুষকে সপ্তাহে একদিন গিয়ে থানায় হাজিরা দিতে হয়। এটা সয়ে গিয়েছিলো। তবু জাতশত্রুতা এমনই জিনিস, থানা থেকে ফেরার পথে কখনো কখনো কোনো এক সান্দারের মেজাজ বিগড়ে যেত, পুলিসকে উত্ত্যক্ত করার জন্যই পথ চলতে কারো পকেট কাটতো, কিংবা দোকান থেকে দুটো টাকার মাল সরাতে। হৈ-হৈ-পুলিস আর সান্দারে দ্বন্দ্ব। কিন্তু যুদ্ধের পরিবর্তে সে-সব আন্তর্জাতীয় ফুটবল খেলা। কনকদারোগা দিঘায় আসার পর থেকেই ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়িয়েছিলো। সান্দাররা এমন ভয় কোনো দারোগাকে কোনোদিন পায়নি। দুরন্ত ছাত্র যেন হঠাৎ এক কড়া মাস্টারমশাইয়ের সম্মুখে পড়ে কী করে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। কনকের দৃষ্টি সান্দারদের অন্তস্তল দেখতে পায়। অন্য কোনো দারোগা হলে পুরো ব্যাপারটাকে নিছক দুর্ঘটনা মনে করতো। ভাবতো, ভাগ্যের বিরূপতায় দারোগার পরিক্রমায় সে পড়ে গেছে। বে-আইনি চালের কৌশলগুলি প্রয়োগ করে দারোগাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করতো। কিন্তু কনকদারোগা, কনকদারোগাই। এ কথা না-ভেবে বলা যায়, ভাবলো সুরো, কনক তার খোঁজেই এই দুপুর-রোদ মাথায় করে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে।

কনকদারোগা বললো, বাড়ি কোথায় তোর? উত্তর পাওয়ার আগেই ধমক দিয়ে উঠলো, চোপরাও বেটি, মিথ্যে বলবি তো–

জে, বুধেডাঙা।

স্ত্রীলোক না-হলে কনকদারোগা তার অনুশীলিত ইংরেজি গালির বাংলা তর্জমায় তাকে বিধ্বস্ত করে দিতো। নিজেকে একটু সামলে সে বললো, সান্দার?

কুণ্ঠা ও ভয়ের দলাটা গলা থেকে নামিয়ে সুরো বললো, জে, চালের কারবার করি। এখন চাল সঙ্গে নাই।

কনক হো-হো করে হেসে উঠলো। প্ল্যাটফর্মে সুরো ছাড়া দ্বিতীয় শ্রোতা নেই, হাসিটা প্রতিধ্বনিত হয়ে নিজের কানে ফিরে আসতেই হাসিটার মাঝখানে কেটে একটা কথা বসিয়ে দিলো সে–সুরো তুই?

সুরো এবার উচ্ছিত জানুতে মুখ গুঁজে বন্দুকের গুলির প্রতীক্ষা করে কাঁপতে লাগলো।

কনক বললো–আমি সব খবর রাখি। তুই, ফতেমা, এসব কে-কে চালের চোরা কারবার করছিস খবর পেয়েছি। তা কর, কর। কী করবি আর!

সুরো মুখ তুলে দেখলো কনকদারোগা প্ল্যাটফর্মের অপর প্রান্তে চলে গেছে। জুতোর চাপে গুঁড়ো পাথরগুলো সরসর করছে। কী-একটা যন্ত্র বার করে কনক একবার পরীক্ষা করলো। দারোগার কোমরে চামড়ার খাপে যখন ঝুলছে তখন বন্দুক ছাড়া আর কী! ছোটো বন্দুক, এই ভাবলো সে। এই দুপুরের নিস্তব্ধতায় কনক যদি একটা গুলি তার বুকে বসিয়ে দেয়, কেউ জানতেও আসবে না, খোঁজও করবে না। কিন্তু তবে আর দেরি কেন? সহসা তার মনে হলো :কার কাছে যেন সে শুনেছিলো কনক সান্দারদের একরকম ভালোবাসে। কনকের বোধহয় কষ্ট হচ্ছে, অপরাধের শাস্তি দিতে তার মন সরছে না। সুরোর মনে হলো সে কেঁদে ফেলবে।

ঠিক সেই মুহূর্তে কনক আবার তার সামনে এসে দাঁড়ালো।

তুই তো সান্দারদের মেয়ে, চিকন্দির সান্যালবাড়িতে গিয়েছিস কখনো?

জে, গেছি।

সান্যালমশাই-এর ছেলেপুলে কটি জানিস? তাঁর বড়োছেলেকে দেখেছিস?

জে, না।

তুই দেখবি কী করে! কনক আবার দূরে চলে গেলো।

অনেক নিচে স্টেশনবাড়ি। সেখানে ঢং-ঢং করে ঘণ্টা পড়লো। গাড়িটা এখনই এসে পড়বে, তারই প্রস্তুতি। কিন্তু প্রস্তুতি বলতে যা বোঝায় তা নয়। টিকেট কাটার সোরগোল নেই, কুলিদের হাঁকাহাঁকি নেই। দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে মাত্র দুজন লোক স্টেশন থেকে প্ল্যাটফর্মে উঠে এলো। তাদের মধ্যে একজনের হাতে নিশান, আর-একজন সম্ভবত কৌতুকপ্রিয় দর্শক। কনক একবার ঘড়ি দেখলো। তাহলে এ-গাড়ি আজ এখানে থামবে? উঠে দাঁড়ানোর মতো ক্ষণিক একটা তাগিদ সুরো অনুভব করলো, পরমুহূর্তে কনকের উপস্থিতি সেটাকে মিইয়ে দিলো।

গাড়ি থামলো। জানলা দিয়ে কৌতূহলী যাত্রীরা মুখ বাড়িয়ে দেখলো স্টেশনটাকে। কেউবা এই প্রথম পদ্মা দেখছে, বললো তার কথা। নিশানওয়ালা নোকটা গার্ডের সঙ্গে কী কথা বলে ছুটলো ড্রাইভারের কাছে আর-একটি কথা বলতে।কনক ক্ষিপ্র নিপুণ হাতে টান দিয়ে উর্দিটা ঠিক করে নিলো, টুপিটা মাথায় আর-একটু কষে বসিয়ে দিলো, পাশে খাপে-ঢাকা রিভলবারে হাত দিয়ে একবার অনুভব করলো, তারপর প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি জায়গায় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো।

গাড়ির একটি কামরা খুলে আঁকা নিয়ে দুজন গ্রাম্য চাষীনামলো৷ ধুলোমাটির তৈরি সহিষ্ণু ক্লান্তির মুখোশ আঁটা তাদের মুখে, অন্য কোনো অনুভবের লেশ নেই তাতে।কনক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে দেখলো৷ ছ’ফুটের কাছাকাছি উঁচু বলে যাকে বর্ণনা করা হয়েছে এ দুটি চাষীর একটিও সে নয়।

প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি উঁচুশ্রেণীর একটি কামরার দরজা খুলে একটি মহিলা নামলো। একটি সাধারণ মেয়ে, রুক্ষ চুলগুলো উড়ছে, পরনে সাধারণ শাড়ি। নিজের হাতে ছোটো স্যুটকেসটি নামালো, গাড়ির ভিতর থেকে একজন সুবেশ য়ুরোপীয় তার ছোটো হোল্ডঅলটি নামিয়ে দিলো। স্যুটকেস-হোল্ডঅল স্টেশনে নামিয়ে মহিলাটি য়ুরোপীয়টিকে হাত তুলে নমস্কার করলো।কনক এগিয়ে গেলো মহিলাটির দিকে, তাকে দেখতে নয়, য়ুরোপীয়টিকে লক্ষ্য করতে। তার ঋজুতা লক্ষণীয়। কিন্তু কনককে বুট ঠুকে স্যালুট করতে হলো। লোকটি পুলিসসাহেব স্বয়ং। কিন্তু একটা পা কাঠের বলে তিনি যুদ্ধে যেতে পারেননি।

গাড়ি ছেড়ে দিলে কনক প্রথমে ভাবলো ফাঁইলটা যখন ওঁর সামনে যাবে তখন উনি নিশ্চয় বুঝবেন এ-স্টেশনে কী করছিলো কনকদারোগা ধড়াচূড়া এঁটে। খুশি হলো কনক, সেই খুশি মন নিয়ে সে মহিলাটির দিকে ফিরে চাইলো। ছোটো নাক, ছোটো কপাল; দেহবর্ণের। অনুজ্জ্বলতাকে ছাপিয়ে উঠেছে ঠোঁট দুটির গড়ন। আর চোখ! কনক কৌশল করে দ্বিতীয়বার চোখ দুটি দেখে নিলো। যেন একটি মীনের ছায়া জলের তলায় স্থির হয়ে আছে, এখনই চঞ্চল হয়ে উঠবে। চোখের প্রান্ত দুটি রক্তাভ।

আপনি চিকন্দি যাবেন?

মহিলাটি একটা ক্ষীণ হাসি দিয়ে কনকের প্রচেষ্টাকে পুরস্কৃত করলো, পুলিসদের সব খবরই রাখতে হয়। যাব চিকন্দি, কিন্তু কেউ নিতে আসেনি। একটা গাড়ি-টাড়ি–

ওসব এদিকে পাওয়া যায় না। আপনি নিশ্চয়ই এই প্রথম আসছেন। সান্যালদের কারো বাড়িতে যাবেন?

আপনার অনুমান ঠিক।

সান্যালমশাই-এর বড়োছেলেকে আপনি চেনেন?

আপনাদের বড়সাহেব, ওই যে আমাকে নামতে সাহায্য করলেন, তাঁর সঙ্গেও এই আলাপই হচ্ছিলো। খোঁজটা আমিও নেবো। এতদিন ধারণা ছিলো আমার, তিনি আপনাদেরই কাছে আছেন। দিন-পনেরো আগে কলকাতার পুলিস তাকে অ্যারেস্ট করেছে।

তিনি?

তিনি আমার স্বামী।

কনক দৃশ্যত অপ্রতিভ হয়ে উঠলো। রক্তবিন্দুলেশহীন কপাল ও সিঁথি থেকে চোখ নামিয়ে সে বললো, আচ্ছা, আমি একটা পাল্কি পাঠিয়ে দেবো।

মহিলাটি আবার হাসলো, এ জেলায় ঢুকবার সঙ্গে-সঙ্গে প্রথমে পুলিসসুপার, তারপর আপনি, মোটামুটি পুলিসই আমাকে সাহায্য করছে। ধন্যবাদ।

কনক মহিলাটির কাছে বিদায় নিয়ে খানিকটা দূরে গিয়ে টুপি খুলে ঘাম মুছলো। ক্লান্তি বোধ হচ্ছে তার। পিস্তল উচিয়ে একটা সাধারণ ডাকাত ধরতে যাওয়ার চাইতে অনেক বেশি ক্লান্ত হতে হয় এসব ব্যাপারে।

সুরো গাড়ির দিকে এক পা এগিয়েছিলো, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে মহিলাটির সঙ্গে আলাপ। করার জন্য কনক এগিয়ে এলো। সুবোর মনে হলো যথেষ্ট করুণা করেছে কনক, কিন্তু তার সুযোগ নিয়ে তারই সামনে গাড়িতে উঠে বসতে গেলে সে ক্ষমা করবে না।

কিন্তু বিস্ময়ের চাইতে বিস্ময়, উঁচু কেলাসের গাড়ি থেকে নামে যে-ভদ্রলোকের মেয়েছেলে সে-ও কি চালের কারবার করে!নতুবা দারোগা অমন খবরাখবর করে কেন? ওর বোধহয় বাক্স বিছানা বোঝাই চাল। চাল, তুমি কত রঙ্গই দেখালে!কন তাহলে ওর খবর পেয়েই এসেছিলো, তার নিজের মতো পাঁচসের চালের কারবারিকে ধরতে দারোগার নিজের আসা একটু অস্বাভাবিকই বটে, এখন ভাবলো সুরো।

তবু কনকদারোগার ব্যবহার চিরকালই সাধারণ বুদ্ধির অগম্য। ধরতেই যদি আসা, ধরলো না কেন?

সুরো উঠে দাঁড়ালো। আজ আর কোনো গাড়িই ধরবে না। তাহলে কোন দিকে যাবে সে? দেড় ক্রোশ পথ ভেঙে গ্রামে যাওয়া যায়, কিন্তু কাল সকালেই আবার দেড় ক্রোশ পথ বেয়ে আসতে হবে স্টেশনে।নতুবা যাওয়া যেতে পারে দু ক্রোশের পথ দিঘায়। সেখানে অনেক গাড়ি থামে উত্তরে যাওয়ার। না-ও যদি পাওয়া যায়, মাধাই বায়েনের ঘরে এক রাত বিশ্রাম নেওয়া যাবে।

সে দিঘার দিকে হাঁটতে শুরু করলো।

সুমিতি নিস্তব্ধ স্টেশনটির চারিদিকে চেয়ে দেখলো। পুলিসের ছোটোবড়োদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যা হয়নি এখন সেটা হলো, বিজন স্টেশনটায় বসে নির্জনতায় তার গা ছমছম করে উঠলো। ডানদিকের ব্রিজটাই বোধহয় সভ্য জগতের শেষ সীমা। এপারে গাড়ি পাওয়া যায় না এমন দেশ। গ্রাম সম্বন্ধে সমিতির ধারণা একেবারেই নেই তা নয়। রাজনৈতিক কাজে সে গ্রামে গিয়েছে। সেসব গ্রাম ম্যালেরিয়াজীর্ণ; ডোবা-জঙ্গল ও ক্ষয়িষ্ণু ভগ্নস্তূপে ভরা! কিন্তু সেসব গ্রামে গিয়েছে সে পার্টির মোটরে, সঙ্গে সমবয়সী ছাত্রছাত্রী। মোটর না চলেছে তো গোরুগাড়ির বন্দোবস্ত আগেই করা থাকতো। চড়ুইভাতির উন্নততর সংস্করণ সেসব পরিক্রমা–এই ধারণা এখন সুমিতির। এখানে এমনি বসে থাকার চাইতে পুলিসের সাহচর্যও ভালো ছিলো। দারোগাকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া ভুল হয়েছে, মনে হলো সুমিতির। লোকটি ভদ্র, সঙ্গে থাকলে কিছু-একটা ব্যবস্থা না করে পারতো না। পাল্কি পাঠাবে বলে গেছে বটে, কিন্তু অনেক পুরুষের ক্ষেত্রেই সুমিতি দেখেছে, সামনে দাঁড়িয়ে তাদের দিয়ে কাজ করানো যত সহজ, অলক্ষ্যে থেকে নির্দেশে ততটাকরানো যায় না। সুমিতির সেক্সপীয়রকর্ষিত মনে যে কথাটা কাঁটা দিয়ে উঠলো সেটা এই : সৌন্দর্য, সোনার চাইতেও কাউকে কাউকে বেশি প্রলুব্ধ করে।

সান্যালরা জমিদার, কিন্তু তাদের সেই দুর্গকত মাইল দূরে কে জানে। বঙ্কিমচন্দ্রের ইন্দিরার কথা মনে পড়ে গেলো সুমিতির। তার মনে হলো চূড়ান্তভাবে–এতদিন যে-সব প্রতিপক্ষের সম্মুখে বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সে বিখ্যাত হয়েছে তারা ডাকাতে রাজনৈতিক মত পোষণ করে, কিন্তু ডাকাত নয়।

সে চিন্তা করতে লাগলো, ওই মেয়েটির মতো নিরাভরণ এবং মলিন মোটা শাড়ি পরে এদেশে আসা উচিত ছিলো কিনা; ঠিক এমন সময়ে হই-হুঁইশব্দ করে চার-পাঁচজন বেঁটে শুটকো লোক আলকাতরা রাঙানো একটা কাঠের বাক্স নিয়ে তার কাছে এসে দাঁড়ালো। বাক্সটির গায়ে লম্বা দাঁড়া লাগানো, আর সেই দাঁড়ায় কাঁধ দিয়ে বাক্সটিকে লোক ক’টি বয়ে আনছে দেখে সে বুঝলো পাল্কি সেটা। সে তার সজ্ঞান জীবনে এই প্রথম একটি পুলিসকে ধন্যবাদ দিলো এবং ধন্যবাদ দিতে গিয়ে ইংলন্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়কে প্রশংসা করলো। মনে-মনে বললো, লোকটি ইংলন্ডের পুলিসদের মতো।

কিন্তু প্রথম কথা ঐ বাক্সে ঢোকা, দ্বিতীয় কথা বাক্সে ঢোকামাত্র লোক ক’টি তাকে ভুমি থেকে সংস্পর্শশূন্য করে কাঁধে তুলবে। তারপর তাদের খুশির উপর নির্ভর করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

বেহারাদের আভূমি-আনত সেলাম সে দেখতে পায়নি, এবার তাদের সসম্রম আহ্বানে ফিরে দাঁড়িয়ে তাকে হাসতে হলো। হাসিই একমাত্র মনোভাব যেটা টেনে এনে অন্য মনোভাব ঢাকা যায়। সুমিতি ভয় ঢেকে ভয়ে-ভয়ে বললো, সান্যালদের বাড়ি চেনো?

জে, মাঠান, তেনারা মুনিব।

তোমরা পথ চিনে নিয়ে যেতে পারবে তো?

জে, আপনি উঠলিই গেলাম।

যদি দরকার হয় কাল তোমাদের দারোগাসাহেব খুঁজে পাবেন?

তা আর পাবেন না! তিনি তো আমাদের বাড়ির পরে ঘোড়া থামায়ে পাঠায়ে দিলেন।

সুমিতি ওদের প্রদর্শিত উপায়ে পাল্কিতে উঠে বসলো। লোকগুলি অনাহারজীর্ণ কিন্তু অভ্যস্ত হাতে মোটগুলো পাল্কির ছাদে বেঁধে নিয়ে এক নিমেষে পাল্কিটা শূন্যে তুলে ফেলো। দুহাতে পাল্কির দেয়াল আঁকড়ে ধরে, দাঁতে দাঁত চেপে সুমিতি চিকন্দির দিকে রওনা হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *