প্রবেশ
নিষেধ–২
প্রথম
প্রকাশ
জানুয়ারি, ১৯৭৬
০১.
ঠিক সকাল নটায় বালিশের নিচে বেজে উঠল খাপে পোরা ছোট্ট অ্যালার্ম ঘড়িটা।
বিরক্তি লাগল রানার। শুয়ে শুয়েই আড়মোড়া ভাঙল, এপাশ-ওপাশ ফিরল বারকয়েক, হাই তুলে লম্বা ডাক ছাড়ল নিশি রাতে ক্রন্দনরত কুকুরের মত, তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে গিয়ে ঢুকল বাথরূমে। কি শেভ-স্নান সেরে বেরিয়ে এল সে দশ মিনিটের মধ্যেই। জামা-কাপড় পরে তৈরি হয়ে নিতে লাগল আরও পাঁচ মিনিট, তারপর নেমে গেল নিচে, রেস্তোরাঁয়। গতরাতে মিস হয়ে গেছে খাওয়াটা, ডাবল ব্রেকফাস্ট দিয়ে পুষিয়ে নিল সে সুদে আসলে। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে কফির কাপে চুমুক দিয়ে ধরাল। দিনের প্রথম সিগারেট।
ঝকঝকে দিন। আকাশে ছিটেফোঁটাও নেই মেঘের। প্রফুল্ল মনে বেরিয়ে এল রানা হোটেল কার্লটন থেকে, গজ তিরিশেক গিয়ে নজর বোলাল। চারপাশে, কিন্তু এমন কাউকে চোখে পড়ল না যে কিনা ওকে অনুসরণ করতে পারে। কেন যেন দমে গেছে অনুসরণকারীরা, কাল রাত থেকে কেউ পিছু নিচ্ছে না আর। ট্যাক্সিটার কাছে এসে হঠাৎ একটা সন্দেহ দেখা দিল ওর মনে-ওকে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি তো ওরা? গাড়িতে কিছু ফিট করে রেখে যায়নি তো আবার? সামনের এঞ্জিন, পেছনের বুট, গাড়ির তলা। এবং ভেতরটা ভালমত পরীক্ষা করে দেখল সে পাঁচ মিনিট, তারপর স্টার্ট দিল। গাড়িতে। বোমা বিস্ফোরণে মারা গেল না দেখে রওনা হয়ে গেল সে খুশি মনে, সোজা এসে থামল মার্নিক্সট্রার্টের পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। ঠিক দশটায়।
রাস্তার উপরেই একটা মার্সিডিজের মাডগার্ডে হেলান দিয়ে রানার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড। পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার। সংক্ষিপ্ত সম্ভাষণ। রানা টের পেল দুজনেই মনে মনে স্থিরনিশ্চিত-অনর্থক নষ্ট করা হচ্ছে ওদের সময়। ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলছে না, কিন্তু দুজনেই জানে, অহেতুক এই ঝামেলা না করলেও চলত।
সার্চ ওয়ারেন্ট তৈরি?
হ্যাঁ। সোজা হয়ে দাঁড়াল ডি গোল্ড। আপনার কি এখনও মনে হচ্ছে। এই সার্চটা জরুরী? মানে, না করলেই নয়?
শোফার চালিত মার্সিডিজের পেছনের সীটে উঠে বসল রানা, জানালা দিয়ে কর্নেলের মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল।
কাল রাতে যতটা মনে করেছিলাম, আজ সকালে তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরী বলে মনে হচ্ছে।
চট করে উঠে পড়ল কর্নেল গাড়িতে। ইন্সপেক্টর উঠল সামনের প্যাসেঞ্জার সীটে। গাড়ি ছেড়ে দিতেই ঘাড় ফিরিয়ে রানার দিকে চাইল মাগেনথেলার। বিশেষ কোন কারণ ঘটেছে, যেজন্যে আপনার ধারণাটা ঘন হয়েছে আগের চেয়ে?
ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ল রানা। ইনটিউইশন।
নিজেদের মধ্যে চট করে একবার দৃষ্টি বিনিময় করল ডি গোন্ড এবং মাগেনথেলার। এই জিনিসটার উপর নির্ভর করে যে পুলিসী-তৎপরতা চলে না, সেটা ভাল করেই জানা আছে তাদের। রানার প্রতি ঠিক কতটা আস্থা রাখা। যায় বুঝে উঠতে পারছে না ওরা। অনিশ্চিত দৃষ্টিতে রানার মুখের দিকে চেয়ে রইল কর্নেল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, একটা ভ্যানে করে আটজন সাদা পোশাক পরা পুলিস পাঠিয়ে দিয়েছি ওখানে আগেই। গলির মুখে অপেক্ষা। করবে ওরা আমাদের জন্যে। কিন্তু কাল আপনার কথায় মনে হলো, সার্চ করাটা আপনার ঠিক উদ্দেশ্য নয়, আপনার উদ্দেশ্য হচ্ছে
সার্চটাই প্রধান নয়, বলল রানা, কিন্তু সেটাও একটা উদ্দেশ্য। আমি আসলে যা চাইছি সেটা হচ্ছে ওদের ইনভয়েসগুলো–যার থেকে ওদের সমস্ত সাপ্লায়ারদের একটা লিস্ট তৈরি করে নেয়া যায়।
যা করছেন, আশা করি বুঝেশুনেই করছেন? গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল মাগেনথেলার। ভাবছি, আমাদের আবার কোন বিপদে পড়তে না হয়।
জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল রানা- কেন যেন কথোপকথন জমছে না আজ। সবাই চুপচাপ রইল ভলেনহেভেন অ্যান্ড কোম্পানীর গলিখে না। পৌঁছানো পর্যন্ত। মার্সিডিজটা কয়েক সেকেন্ডের জন্যে থামল ভ্যানের পাশে। সিভিলিয়ানের স্যুট পরা এক লোক এগিয়ে এল গাড়ির পাশে। ওর দিকে। একনজর চেয়েই মৃদু হাসি ফুটে উঠল রানার ঠোঁটে। এই লোক যে পোশাকই পরুক, ধুতি পাঞ্জাবি বা মওলানার আলখেল্লা পরলেও এক মাইল দূর থেকে বলে দিতে পারবে সে-এ লোক পুলিসের লোক, এমনই ছাপ পড়ে গেছে চেহারায়।
স্যালিউট করল না বটে, কিন্তু খুট করে জুতোর গোড়ালি না ঠুকে পারল লোকটা। নিচু হয়ে ঝুঁকে বলল, আমরা রেডি, স্যার।…
গুড। আমরা যাচ্ছি আগে, তোমরা লোকজন নিয়ে এসো পিছু পিছু।
ওয়েরহাউজের সামনে থেমে দাঁড়াল মার্সিডিজ। প্যাকিঙের ঘরে ঢুকতেই একজন তোক দোতলায় নিয়ে গেল ওদের। টাইম লক লাগানো অফিসের দরজা এখন দুপাট হাঁ করে খোলা। ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা তিনজন।
চমৎকার সাজানো গোছানো একটা অফিস। ওয়েরহাউজে এমন একটা হাল ফ্যাশনের অফিসঘর আশা করা যায় না। কার্পেট, ড্রেপিং, আসবাব–সবকিছুতেই আধুনিক রুচির ছাপ। বিশাল একটা টেবিলের ওপাশে বসেছিল এক বিশালবপু লোক, ওদের দেখেই উঠে দাঁড়াল হাসিমুখে, হাত বাড়িয়ে সামনের চেয়ার দেখাল।
আসুন, আসুন। বসুন।
চেয়ারের দিকে এগোতে এগোতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল রানা। ফিরল কর্নেল ডি গোন্ডের দিকে।
অল্প কিছুক্ষণের জন্যে ক্ষমা করতে হবে আমাকে, কর্নেল, বলল সে। এক্ষুণি একজনের সাথে দেখা করতে হবে আমার। অত্যন্ত জরুরী। একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম।
অবাক চোখে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল কর্নেল রানার মুখের দিকে। তারপর বলল, এতই জরুরী, এতই গুরুত্বপূর্ণ যে ভুলেই গিয়েছিলেন একেবারে?
টিটকারিটা গায়ে মাখল না রানা। এইভাবে ডেকে এনে হঠাৎ জরুরী কাজ পড়ে গেছে বললে কর্নেলের পক্ষে রেগে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তেমনি। স্বাভাবিক ওর এই হঠাৎ ভয় পাওয়া। এক মুহূর্ত বিলম্ব সহ্য হচ্ছে না ওর যে, ভুল করে ফেলেছে, সেটা এক্ষুণি শুধরে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে, নইলে পরে হয়তো আর সুযোগই পাওয়া যাবে না কোনদিন। লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়। নানান ঝামেলায় ভুলে গিয়েছিলাম। বেশি সময় লাগবে না আমার…
একটা ফোন করলে হয় না? এখান থেকে না হয়… টেবিলের উপর রাখা একটা টেলিফোন সেটের দিকে চোখের ইঙ্গিত করল কর্নেল।
নিশ্চয়, নিশ্চয়, বলে উঠল মোটা লোকটা। ইচ্ছে করলে আপনি এখান থেকেই…
সেটা সম্ভব নয়। আমার নিজের যেতে হবে।
কী এমন জরুরী, গোপনীয় ব্যাপার যেটা… রানার মুখের দিকে চেয়ে থেমে গেল কর্নেল।
আপনার গাড়ি এবং শোফার ধার নিতে পারি কয়েক মিনিটের জন্যে?
পারেন। নিরুদ্যম কণ্ঠে বলল কর্নেল। রানার খ্যাপামি দেখে মনে মনে বিরক্ত হয়েছে, বোঝা গেল।
আর..আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত যদি অপেক্ষা করতে পারেন…
কতক্ষণ? কতক্ষণ বসে থাকতে হবে আমাদের আপনার জন্যে?
কয়েক মিনিট। বেশি না।
মিনিট দুয়েক চলবার পর একটা কাফের সামনে থামতে বলল রানা মার্সিডিজের ড্রাইভারকে। গাড়ি ঘোরাতে বলে প্রায় দৌড়ে ঢুকে গেল। ভেতরে। ওদের টেলিফোন ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে দ্রুতহাতে ডায়াল করল সোহানাদের হোটেলের নাম্বারে। হোটেল ডেস্কের বুড়িকে ডিঙিয়ে ওদের ঘরে পৌঁছুতে আজ দশ সেকেন্ডের বেশি লাগল না।
সোহানা?
হ্যাঁ। কি খবর, রানা?
মারিয়া বেরিয়ে গেছে?
এই তো, ঘণ্টাখানেক হলো। আমিও বেরোচ্ছি…
শোনো। যে কাজ দিয়েছিলাম, তার চেয়েও জরুরী একটা কাজ পড়ে গেছে। এক্ষুণিআই রিপিট, এক্ষুণি এই হোটেল ছেড়ে দাও। এক্ষুণি বলতে আমি বোঝাচ্ছি বড়জোর দশ মিনিট। সম্ভব হলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে তোমাকে।
বেরিয়ে পড়তে হবে মানে
মানে জিনিসপত্র পাক করে বিল চুকিয়ে দিয়ে কেটে পড়তে হবে ওখান থেকে। অন্য কোন হোটেলে গিয়ে উঠবে। যে কোন হোটেল না, না, গভ, কার্লটনে না। তোমাদের যোগ্য যে-কোন হোটেলে। কেউ যেন অনুসরণ করতে না পারে সেজন্যে ট্যাক্সি যতগুলো খুশি ব্যবহার করতে পারো। হোটেলের টেলিফোন নাম্বারটা কর্নেল ডি গোল্ডের অফিসে ফোন করে জানাবে। উল্টে নেবে নাম্বারটা।
উল্টে নেব! সোহানার কণ্ঠস্বরে বিস্ময়। পুলিসকেও তুমি…।
কাউকেই বিশ্বাস করি না। আমরা এখানে কাজ করতে এসেছি, সোহানা, বিশ্বাস করতে নয়।
আর মারিয়া?
আগে হোটেল বদলাও। তারপর যেমনভাবে পারো এই হোটেলে উঠতে বাধা দাও মারিয়াকে। পার্কে না গিয়ে চেষ্টা করবে পথেই ওকে আটকাতে। মারিয়াকে ধরে নিয়ে চলে যাবে দুজন বিট্রিক্স শেরম্যানের আস্তানায়। এখন বাসাতেই পাবে আশা করি, বাসায় না পেলে খোঁজ করবে। ব্যালিনোভায়। ওকে বলবে, ওর ভালর জন্যেই ওর এখন তোমাদের সাথে নতুন হোটেলে থাকা দরকার। যতক্ষণ না ওর বাইরে বেরোনো আমি নিরাপদ মনে করছি ততক্ষণ ওর থাকতে হবে তোমাদের সাথে।
আর ওর ভাই…
ওর ভাই থাকুক যেখানে আছে সেখানেই। আপাতত ওর কোন বিপদ। দেখতে পাচ্ছি না। বিপদ এখন তোমাদের তিনজনের মাথার ওপর। যদি তোমাদের সাথে যেতে ও রাজি না হয়, ওকে বলবে হেনরীর ব্যাপারে পুলিসে। ফোন করবে তাহলে তুমি
পুলিসে ফোন করব!
দরকার হবে না, পুলিসের নাম শুনলেই সুড়সুড় করে তোমাদের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করবে মেয়েটা।
কিন্তু অন্যায় হয়ে যাচ্ছে না? মানে, পুলিসের ভয় দেখিয়ে একটা মেয়েকে…
তর্ক কোরো না, সোহানা। যা হুকুম করছি, পালন করো। বলেই নামিয়ে রাখল রানা রিসিভার।
ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে এল সে ওয়েরহাউজের অফিসরুমে। ইতিমধ্যেই এখানে আসবার কারণ জানানো হয়েছে ভলেনহোভেনকে। রানা ঢুকে দেখল অমায়িক, দয়ালু ভাবটা দূর হয়ে গেছে মোটা লোকটার মুখের চেহারা থেকে, সেই জায়গায় ফুটে উঠেছে অসন্তোষ বিক্ষোভ আর অবিশ্বাস। বুক পর্যন্ত ঝুলে পড়া থুতনি কাঁপছে আবেগে। একহাতে ধরা রয়েছে একটা কাগজ। খসে পড়ে গেল কাগজটা টেবিলের উপর।
সার্চ ওয়ারেন্ট! দুঃখে ফেটে যাচ্ছে ভলেনহোভেনের বুক। পাথরের মূর্তি পর্যন্ত কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেবে ওর এক্সপ্রেশন দেখে। চেহারাটা অর্ধেক। হলে, বেশ মানিয়ে যেত হ্যামলেট হিসেবে। দেড়শো বছর ধরে বাপ দাদারও বাপের আমল থেকে ব্যবসা করছি আমরা ভলেনহোভেন ফ্যামিলি, সম্মানের সাথে, সতোর সাথে। আজ তার এই পরিণতি! ভলেনহোভেন কোম্পানীতে সার্চ ওয়ারেন্ট! হায়রে, এই ছিল কপালে! শুনলে এক্ষুণি হার্টফেল করবে আমার বুড়ো বাপ। নিজের কপালে দুটো চাপড় দিল। লোকটা। এইবার চুনকালি পড়ল গেল গুডউইল! সর্বনাশ! সার্চ ওয়ারেন্ট! নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করল সে কয়েক সেকেন্ড, তারপর চোখ বুজল, ঠিক আছে, সার্চ করুন। যেখানে খুশি, যা খুশি দেখুন সার্চ করে। আমার কোন আপত্তি নেই।
আমরা কি খুঁজতে এসেছি সেটা জানতে চান না আপনি? নরম গলায় জিজ্ঞেস করল কর্নেল।
কী হবে জেনে! দুঃখে ভেঙে গেল ওর গলা! শেষ! মান-সম্মান ইজ্জত-ব্যবসা সব গেল আমার খোদা! একশো পঞ্চাশ বছর ধরে…
সার্চ ওয়ারেন্ট আর পুলিসের নাম শুনলেই কেন যে পাবলিকের এই রকম অবস্থা হয়! হাসিহাসি মুখ করে বলল কর্নেল ডি গোল্ড। শুনুন, মিস্টার ভলেনহোভেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার ধারণা, স্বর্ণমৃগের পেছনে ছুটছি আমরা। এটা রুটিন চেক। অফিশিয়াল অনুরোধ এসেছে আমাদের কাছে, কাজেই নিয়ম অনুযায়ী সার্চ করতেই হবে আমাদের। এতে আপনার। সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে না। ভেঙে পড়বারও কিছু নেই। আমাদের কাছে ইনফরমেশন এসেছে যে আপনাদের এখানে বেআইনীভাবে সংগ্রহ করা কিছু ডায়মন্ড আছে…
ডায়মন্ড! একেবারে আসমান থেকে পড়ল মোটা লোকটা। রানা লক্ষ করল, এই একটি শব্দে অর্ধেক দুশ্চিন্তা যেন দূর হয়ে গেল লোকটার মুখ থেকে। কোলাব্যাঙের মত মাথাটা নাড়ল এপাশ-ওপাশ। মান হেসে বলল, ডায়মন্ড? আশ্চর্য! ঠিক আছে, দেখুন খুঁজে। শুধু একটা অনুরোধ যদি পাওয়া যায়, এক-আধটা দয়া করে দিয়ে যাবেন আমাকে। জীবনে দেখিনি আমি এ জিনিস।
এসব টিটকারি গায়ে না মেখে অবিচলিত দৃঢ়তার সাথে বলল কর্নেল, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে সন্দেহ করা হচ্ছে, আপনাদের এখানে ডায়মন্ড কাটিং মেশিনারিও রয়েছে।
তাই নাকি? আরও সিকিভাগ দুশ্চিন্তা উড়ে গেল লোকটার চেহারা। থেকে। সত্যিই? সেটা তো নিশ্চয়ই লুকিয়ে রাখবার মত জিনিস না, পেয়ে যাবেন একটু খুঁজলেই। দেখুন খুঁজে।
সেইসাথে আপনাদের ইনভয়েস ফাইলটাও দেখতে হবে।
একশোবার। দেখুন, দেখুন। ভাল করে খতিয়ে দেখুন সব। কোন আপত্তি নেই আমার।
আপনার সহযোগিতার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ, বলল কর্নেল ডি গোল্ড। মাথা ঝাঁকিয়ে ইশারা করল ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারকে। চট করে উঠে দাঁড়াল মাগেনথেলার, দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল সার্চের ব্যবস্থা করতে। যেন গোপনীয় কিছু বলছে এমনি ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকে এল কর্নেল। এই অসুবিধে সৃষ্টি করার। জন্যে আমি সত্যিই আন্তরিক দুঃখিত, মি. ভলেনহোভেন। পুলিসের কাজ জনসাধারণকে সাহায্য করা, তাদের স্বাভাবিক কাজে বাধা সৃষ্টি করা নয়। কিন্তু কি করব…জানি, এটা বেহুদা সময় নষ্ট, আপনাকে হয়রানি করা, নিজেরাও হয়রানি হওয়া, তবু…
তিরিশ মিনিটের মধ্যেই হয়রান হয়ে ফিরে এল মাগেনথেলার। ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে এই সার্চ অনুষ্ঠিত হচ্ছে বুঝতে পেরে আবার হাসিখুশি দয়াল ভাবটা ফিরে এসেছে ভলেনহোভেনের মধ্যে! কেক, বিস্কিট, কফি আনিয়ে আপ্যায়ন করল, অবাঞ্ছিত হলেও, ক্ষমতাধারী অতিথিদের। এক ফাঁকে রানাও ঘুরে এল পুরোটা বাড়ি। গতরাতে যেখানে যা দেখে গিয়েছিল, প্রায় তেমনি রয়েছে সবকিছু। শুধু ক্যানাবিসের গন্ধটা অনুপস্থিত। সেই জায়গায় মিষ্টি একটা এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধ। এ ব্যাপারে কাউকে কিছুই বলল না সে।
নিচে নেমে এসে বিদায় দিল ভলেনহোভেন ওদের হাসিমুখে, যতটা না। ওদের কৃতার্থ করতে, তার চেয়ে বেশি প্রতিবেশী আর সব ওয়েরহাউজের মালিক ও কর্মচারীদের জানাতে যে সার্চ হয়েছে বটে, কিন্তু বে-আইনী কিছুই পাওয়া যায়নি ওর ঘরে। গাড়িতে ওঠার আগে ওর হাত ঝাঁকিয়ে দিল কর্নেল।
আপনার অসুবিধের জন্যে সত্যিই আন্তরিক দুঃখিত, মিস্টার। ভলেনহোভেন। আমাদের ভুল তথ্য সরবরাহ করা হয়েছিল। অবশ্য কবেই বা ঠিক তথ্য পাই আমরা। যাই হোক, এই সন্দেহ এবং সার্চ সম্পর্কে সব কিছু কেটে দেব আমরা আমাদের ফাইল থেকে। হাসল। ইনভয়েসের ফাইল ধরা। বামহাতটা নাড়ল। এগুলো পরীক্ষার জন্যে দেব আমরা সেই ইন্টারেস্টেড ডিপার্টমেন্টকে। যে মুহূর্তে ওরা নিশ্চিত হবে যে এর মধ্যে কোন বে-আইনী ডায়মন্ড সাপ্লায়ারের নাম নেই, সাথে সাথেই ফেরত দেয়া হবে ফাইলটা। ঠিক আছে? চলি, গুডমর্নিং।
মাগেনথেলার এবং রানাও ওর হাত ধরে ঝাঁকাল, বিরক্ত করবার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করল, তারপর উঠে পড়ল গাড়িতে। রানার হাসিতে কোন। মালিন্য দেখতে পেল না ভলেনহোভেন। পাওয়ার কথাও নয়, কারণ বেচারা। তো আর থট রিডিং জানে না। জানা থাকলে টের পেত, বন্ধুত্বের বিন্দুমাত্র। ছিটেফোঁটাও নেই ওর ভিতর; বরং শত্রুতা রয়েছে রানার হাসিতে, হাত। ঝাঁকুনিতে–সম্পূর্ণ অন্য ধরনের চিন্তা চলেছে ওর মাথায়।
কারণ, গতরাতে এই লোকটাকেই দেখেছিল সে ব্যালিনোভা নাইট-ক্লাব থেকে সোহানা ও মারিয়ার পিছন পিছন রওনা হতে।
.
০২.
প্রায় নিঃশব্দে ফিরে এল ওরা পুলিস হেডকোয়ার্টারে। ভ্যান ডি গোল্ড আর মাগেনথেলারের মধ্যে যে সামান্য কথা হলো সেটা ভলেনহোভেন বা সার্চ সংক্রান্ত কিছুই না, সম্পূর্ণ অন্য বিষয়ে সাধারণ আলাপ। বোঝা গেল আজকের এই সাৰ্চটা যে একেবারে অনর্থক সময় নষ্ট, বাজে ব্যাপার হয়েছে, সে সম্পর্কে দুজনের কারও মনেই কোন সন্দেহের লেশমাত্র নেই। এই প্রসঙ্গে কোন কথা তুললে পাছে রানা লজ্জা পায় সেজন্যেই নেহায়েত ভদ্রতার খাতিরে অন্য কথা বলছে ওরা। নেমেই নিজের কাজে চলে গেল মাগেনথেলার।
কর্নেলের পিছু পিছু তার অফিসে গিয়ে ঢুকল রানা।
কফি? ভুরু নাচাল কর্নেল ডি গোল্ড। অ্যামস্টার্ডামের সেরা কফি খাওয়াতে পারি আপনাকে।
না, ধন্যবাদ। পরে একদিন হবে। আজ একটু বেশি ব্যস্ত।
ব্যস্ত? তার মানে প্ল্যান তৈরি হয়ে গেছে? কাজে নামতে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই?
আরে না। হাসল রানা। রিছানায় শুয়ে শুয়ে খানিক আকাশ পাতাল ভাবব।
তাহলে… তাহলে কেন
তাহলে কেন এখানে এলাম? ছোট্ট দুটো অনুরোধ আছে আমার। আমার জন্যে কোন টেলিফোন মেসেজ আছে কিনা একটু খোঁজ করে দেখবেন?
মেসেজ?
ওয়েরহাউজে আপনাদের বসিয়ে রেখে যার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তার কাছ থেকে আপনার অফিসে একটা মেসেজ আসবার কথা আছে। দেখবেন একটু?
গভীরভাবে মাথা ঝাঁকাল ডি গোল্ড, একটা রিসিভার কানে তুলে নিয়ে। দুএকটা কথা বলল, ভ্রূ কুঁচকে কি যেন শুনল, তারপর কাগজ কলম টেনে নিয়ে বলল, রিপিট করো।
খসখস করে ইঞ্চি চারেক লম্বা ইংরেজি অক্ষর ও নম্বরযুক্ত একটা মেসেজ লিখে কাগজটা রানার দিকে বাড়িয়ে দিল কর্নেল। অক্ষরগুলো অর্থহীন, রানা। জানে, কিন্তু সংখ্যাগুলো ওল্টালেই পাওয়া যাবে সোহানাদের হোটেলের টেলিফোন নাম্বার। কাগজটা পকেটে ফেলল সে।
অসংখ্য ধন্যবাদ। এটা ডিকোড করতে হবে আমার আবার।
এবার দ্বিতীয় অনুরোধ!
একজোড়া বিনকিউলার ধার দিতে পারবেন?
বিনকিউলার?
আমার হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়ালে বহুদূরে একটা সুইমিং পুল দেখা যায়। আমার বিশ্বাস অনেক সুন্দরী মেয়ে আসে ওখানে, এতদূর থেকে ভালমত দেখা যায় না। একটা বিনকিউলার হলে…
অবশ্যই, অবশ্যই। নিরানন্দ অবিবাহিত জীবনে এইটুকু আনন্দ থেকে আপনাকে বঞ্চিত করা নিতান্তই অন্যায় হবে। এক্ষুণি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কথাগুলো হালকা সুরে বলল ঠিকই, কিন্তু সামান্যতম হাসির আভাসও নেই, কর্নেলের মুখে। গলার সুর পরিবর্তন করে বলল, দেখুন, মেজর মাসুদ রানা, আপনার সাথে আমার কথা ছিল ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার। ছিল কি না?
নিশ্চয়ই ছিল, এবং আছে।
তাহলে এইসব গোপন তৎপরতার কি অর্থ? অনেক কিছুই আপনি। আমাদের এড়িয়ে চেপে যাচ্ছেন।
চাপছি না, বলল রানা। আপনাদের জানাবার মত কোন তথ্য হাতে এলেই জানাব। ভুলে যাবেন না, আপনারা বছরের পর বছর কাজ করছেন এই ব্যাপারটা নিয়ে, আমি এখানে এসে পৌঁছেছি দুদিনও পুরো হয়নি। চেপে যাওয়ার মত তথ্য থাকলে বরং আপনাদের কাছেই থাকা সম্ভব, আমার কাছে তথ্য কোথায় যে চাপবার প্রশ্ন উঠবে? মিথ্যে বলিনি, আমার কাছে কয়েকটা ব্যাপার বেশ বিদঘুটে ঠেকেছে, ঘরে ফিরে শুয়ে শুয়ে ওগুলো নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করব আমি এখন।
রানাকে বেশি ঘাটাল না কর্নেল। বুঝে নিয়েছে, এই লোকটার কাজে কোনরকম বাধা সৃষ্টি করা বোকামি হবে। এর কাজের ধারা আলাদা হতে পারে, কিন্তু যোগ্যতা সম্পর্কে কোনরকমের কোন সন্দেহ নেই তার মনে। পুলিসী নিয়ম মেনে এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে মেমো আর সার্কুলারের মাধ্যমে করবার মত কাজ যে এটা নয়, সেটুকু বুঝবার ক্ষমতা তার আছে–বিশেষ করে গত কয়েকটা বছরের নিষ্ফল চেষ্টার পর ধারণাটা বদ্ধমূল হয়েছে। বিনকিউলারটা কাঁধে ঝুলিয়ে রানা যখন বেরিয়ে গেল, মস্তবড় একটা শ্বাস ছেড়ে মন দিল সে কাজে।
আধমাইল দূরে একটা টেলিফোন বুদের সামনে গাড়ি থামাল রানা। কর্নেলের কাছ থেকে পাওয়া নাম্বারে ডায়াল করতেই একটা পুরুষ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, হোটেল প্লাযা।
রানার মনে পড়ল শহরের পূর্বদিকে এই নামের একটা হোটেল দেখেছে সে। ভাল কোন হোটেল না, কিন্তু ওদের দুজনের পরিচয় অনুযায়ী ঠিক যে। ধরনের হোটেলে ওঠা উচিত, তাই পছন্দ করেছে সোহানা।
আমার নাম রানা। মাসুদ রানা। দুজন মহিলা আজ আপনাদের ওখানে। উঠেছেন। এই ঘণ্টাখানেক কি তার চেয়ে কিছু বেশি হবে। ওদের সাথে কথা বলতে পারি?
আমি দুঃখিত। ওঁরা বেরিয়ে গেলেন একটু আগে।
দুজনই? আরও একটু নিশ্চিত হতে চাইল রানা।
হ্যা! দুজনই। হাঁপ ছেড়ে বাচল রানা। তার মানে মারিয়াকে পেয়ে গেছে সোহানা, এখন হয় বিট্রিক্সের খোঁজে বেরিয়েছে, নয়তো গেছে হোস্টেল প্যারিসের মেয়েদের উপর নজর রাখতে। রানার অকথিত প্রশ্ন আঁচ করে নিয়ে। অপর প্রান্ত থেকে লোকটা বলল, আপনার জন্যে একটা মেসেজ রেখে গেছেন। ওরা, মিস্টার রানা। আপনাকে জানাতে বলেছেন যে আপনার হোস্টেস বান্ধবীকে পাওয়া যায়নি।
ভুরুজোড়া কুঁচকে উঠল রানার। লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নামিয়ে রাখল রিসিভার। একলাফে উঠে পড়ল গাড়িতে। বিট্রিক্সকে পাওয়া না যাওয়ার কি কারণ থাকতে পারে?
একেবারে অ্যাপার্টমেন্ট হাউজের সামনে এসে গাড়ি থামাল রানা। দৌড়ে উঠে গেল তিনতলায়। বন্ধ। তালামারা। খুলতে অবশ্য এক মিনিটও লাগল না। রানার। ভেতরে ঢুকে দেখল, গতরাতে যেমন দেখে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি রয়েছে ঘরটা। সাদামাঠা, বাহুল্যবর্জিত, ছিমছাম। কোথাও ধস্তাধস্তির কোন চিহ্ন নেই। ঘরের যেটা যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে। তন্নতন্ন করে দুটো ঘরই খুজল রানা, কিন্তু এমন কোন তথ্য বা ইঙ্গিত চোখে পড়ল না যা দেখে টের পাওয়া যায় বিট্রিক্স বা হেনরী কি অবস্থায় কোথায় গেছে। বারবার। আশঙ্কার একটা কালো ছায়া ভর করতে চাইল ওর মনের উপর, বারবারই মাথা ঝাঁকিয়ে দূর করে দিল সে অশুভ চিন্তা। দরজায় তালা দিয়ে দ্রুতপায়ে। নেমে এল সে নিচে। ব্যালিনোভা নাইট-ক্লাবে দেখতে হবে খোঁজ করে।
পাঁচ মিনিট দমাদম দরজা পিটবার পর সামান্য একটু ফাঁক হলো ব্যালিনোভা নাইট-ক্লাবের সদর দরজাটা। চট করে ফাঁকের মধ্যে জুতোসুদ্ধ। পা ভরে দিয়ে হাত দিয়ে টেনে আর একটু বড় করল রানা ফাঁকটা। একমাথা সোনালি চুল দেখা গেল প্রথমে, তারপর দেখা গেল আবছামত একটা মেয়ে। দাঁড়িয়ে আছে বুকের কাছে চাদর জাতীয় কিছু একটা দিয়ে লজ্জা ঢেকে। গতরাতে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় দেখেছে রানা একে ড্রিঙ্কস সার্ভ করতে, আজ। দিনের বেলা হঠাৎ এর এত লজ্জার কারণ বুঝে উঠতে পারল না সে।
ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চাই, বলল রানা।
ছটার আগে খুলি না আমরা।
যেটুকু খুলেছ তাতেই চলবে। আমি রিজার্ভেশনের জন্যে আসিনি। চাকরির জন্যেও না। ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চাই। এই মুহূর্তে।
উনি…উনি তো এখানে নেই।
চাকরিটা খোয়াবার ইচ্ছে আছে? কর্কশ কণ্ঠে বলল রানা। আমি এখানে ইয়ার্কি মারতে আসিনি।
চাকরির কথায় বেশ একটু সতর্ক হয়ে গেল মেয়েটা।
মানে?
কণ্ঠস্বর নিচু করল রানা বক্তব্যে গাম্ভীর্য বাড়াবার জন্যে। মানে হচ্ছে যে, মুহূর্তে ম্যানেজার জানতে পারবে যে আমি দেখা করতে চেয়েছিলাম এবং তুমি বোকার মত ব্যাপারটার গুরুত্ব না বুঝে আমাকে বিদায় করে দিয়েছ, তোমার চাকরিটা নাই হয়ে যাবে।
একটু ইতস্তত করল মেয়েটা, অনিশ্চিত দৃষ্টিতে বারকয়েক দেখল রানাকে আপাদমস্তক, তারপর মৃদু গলায় বলল, একটু অপেক্ষা করুন। বলেই দরজাটা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু রানার জুতোর সোল রয়েছে দুই দরজার ফাঁকে, বারকয়েক দরজা বন্ধ করবার বিফল চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে চলে গেল ভেতরে। আধ মিনিটের মধ্যে ফিরে এল প্রায় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা এক লোককে সাথে নিয়ে।
এক নজরেই অপছন্দ করল রানা লোকটাকে। বেশির ভাগ মানুষের মতই রানাও সাপ পছন্দ করে না। কিন্তু একে দেখবার সাথে সাথে ওই প্রাণীটার কথাই মনে পড়ল ওর। এই সাপের বগলের কাছে শোলডার হোলস্টারের আভাস টের পেল সে পরিষ্কার। যেমন লম্বা তেমনি চিকন লোকটা, কিন্তু হাতের কব্জি বক্সারের মত চওড়া। ফ্যাকাসে গায়ের রঙ, চলার ভঙ্গিতে নিশাচর হিংস্র জন্তুর ক্ষিপ্রতা। লম্বা নাক, নাকের দুপাশে কাছাকাছি বসানো একজোড়া তীক্ষ্ণ চোখ। ঠোঁটের কোণে সিগারেট। একগাল ধোয়া ছেড়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে পরীক্ষা করল সে রানার নির্বিকার মুখটা।
কি ব্যাপার, মিস্টার? এই সাতসকালে কি চান? এটা নাইট-ক্লাব– দিনে বন্ধ।
আগেই শুনেছি খবরটা। আপনি ম্যানেজার?
অ্যাসিস্ট্যান্ট। আপনি যদি পরে এক সময়ে আসেন–পরে মানে, এই ধরুন, সন্ধে ছটা নাগাদ আসেন, তাহলে হয়তো ম্যানেজারের সাথে একটা ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা..
ইংল্যান্ড থেকে এসেছি, আমি একজন উকিল, অত্যন্ত জরুরী এক ব্যাপারে। থেমে থেমে বলল রানা। একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে দিল। লোকটার হাতে। এক্ষুণি দেখা করা দরকার আমার ম্যানেজারের সাথে। অনেক টাকার মামলা।
আবার একবার সাপের মত নিষ্পলক দৃষ্টি বোলাল লোকটা রানার উপর। কার্ডটা দেখল। তারপর ঠোঁটে বাকা হাসি টেনে এনে বলল, কোন। কথা দিচ্ছি না, মিস্টার রবার্টসন। ঠিক আছে, কার্ড দেখাই ওকে। হয়তো বলেকয়ে কয়েক মিনিট সময় আদায় করা যাবে ওঁর কাছ থেকে।
লম্বা পা ফেলে চলে গেল লোকটা, ফিরে এল প্রায় সাথে সাথেই। মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত করল সে রানাকে সামনে এগোবার জন্যে, সরে দাঁড়িয়ে পথ করে দিল, সদর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলল পিছু পিছু। এই ধরনের লোক পেছন পেছন হাটলে সবসময় অস্বস্তি বোধ করে রানা, কিন্তু আপাতত কিছুই। করবার নেই, ওপাশের দরজা ঠেলে সরু একটা মান আলোকিত প্যাসেজ ধরে কয়েক পা এগিয়ে ডানদিকে ফিরল। সামনেই একটা ভারী দরজার গায়ে, ছোট্ট নেমপ্লেট-তাতে লেখা ম্যানেজার।
পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে দরজার গায়ে দুটো টোকা দিয়ে হ্যাঁভেলে চাপ দিল লম্বা লোকটা, রানার পিঠে মৃদু চাপ দিল ভেতরে ঢোকার জন্যে। ঢুকে পড়ল রানা।
ছোট্ট অফিসঘর। অত্যন্ত সুসজ্জিত। দুপাশের দুই দেয়াল জুড়ে ফাঁইলিং। ক্যাবিনেট, অন্য দুই দেয়াল ক্রিমসন ও ভায়োলেট রঙের ড্রেপ দিয়ে মোড়া। জানালা আছে কি নেই বোঝা যায় না। কাঁচ ঢাকা মেহগনি-ডেস্কের ওপাশে কাগজপত্রের মধ্যে ডুবে রয়েছে নীল আলপাকা অ্যাটপরা একজন হালকা পাতলা সভ্রান্ত চেহারার মাঝবয়সী লোক। রানা ঢুকতেই চশমাটা খুলে রাখল টেবিলের উপর, আট-দশটা আংটি পরা বামহাতে একটা চোখ ডলতে ডলতে। অন্য চোখ দিয়ে চাইল রানার দিকে।
আসুন, মিস্টার রবার্টসন। উঠে দাঁড়াবার বা হ্যাঁন্ডশেক করবার চেষ্টা করল না সে। বিরক্ত কণ্ঠে বলল, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব সুখী হলাম। বসুন। আমার নাম গুডবডি, আমিও ইংরেজ।
ভদ্রতার হাসি হেসে মাথা ঝাঁকাল রানা, যেন সত্যিই যে ওর নাম গুডবডি তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বসল সামনের চেয়ারে। সাথে সাথেই কাজের কথায় চলে এল গুডবডি।
আমার সাথে জরুরী কোন ব্যাপারে আলাপ আছে আপনার। কি সেটা?
আমার কাজটা ঠিক আপনার সাথে নয়, বলল রানা। আপনার এক কর্মচারীর সাথে।
মুহূর্তে ফ্রিজিং পয়েন্টে চলে এল গুডবডির শীতল দৃষ্টি। আমার কর্মচারীর সাথে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তাহলে আমাকে বিরক্ত করবার মানে?
ওকে ওর বাসায় পেলাম না। ওখানেই জানতে পারলাম আপনার। এখানে কাজ করে মেয়েটা।
মেয়ে?
হ্যাঁ। ওর নাম হচ্ছে বিট্রিক্স শেরম্যান।
কি নাম বললেন? বিট্রিক্স শেরম্যান। উঁহু। যেন রানাকে সাহায্য করতে পারলে সুখী হত, কিন্তু মা পারায় বিব্রত বোধ করছে, এমনি ভঙ্গিতে বলল লোকটা, এখানে কাজ করে? অনেক মেয়েই কাজ করে এখানে, কিন্তু ওই নামেনাহ, ওই নামে কেউ আছে বলে তো মনে পড়ছে না!
কিন্তু ওর প্রতিবেশীরা যে বলল এখানেই কাজ করে? বোকা হয়ে। যাওয়ার ভাব করল রানা।
নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে কোথাও। স্যামুয়েল?
প্যাঁচামুখ করে মাথা নাড়ল লম্বা লোকটা। ও নামে কেউ নেই আমাদের এখানে।
আগে ছিল? সহজে হাল ছাড়তে চাইল না রানা।
বিরক্ত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল স্যামুয়েল, এগিয়ে গিয়ে দেয়ালের গায়ে বসানো ফাঁইলিং ক্যাবিনেটের একটা ড্রয়ার টেনে তার মধ্যে থেকে ফাইল বের করল একখানা। ঝপাং করে সেটা রানার সামনে টেবিলের উপর ফেলে বলল, গত একবছর ধরে যত মেয়ে এখানে কাজ করেছে বা করছে তাদের। সবার নাম ঠিকানা লেখা রয়েছে। নিজেই পরীক্ষা করে দেখুন।
এর উপর আর কোন কথা চলে না। ফাইলের দিকে না চেয়ে সোজা। গুডবডির দিকে চাইল সে, হাসল লজ্জিত ভঙ্গিতে। বোঝা যাচ্ছে, ভুল তথ্য দিয়েছে ওরা। আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত।
রানার উঠি উঠি ভাব দেখে সামান্য একটু প্রসন্নতার আভাস ফুটে উঠল গুডবডির মুখে। হয়তো কৃপা হলো। বলল, আমার মনে হয়, আশেপাশে আরও নাইট-ক্লাব আছে, সেখানে খোঁজ করলে পেয়ে যেতেও পারেন। কথাটা শেষ করবার আগেই চশমাটা লাগিয়ে নিয়ে কাজে মন দিল। ম্যানেজার। খসখস করে লিখছে একটা কাগজের উপর দামী পার্কার বলপেন, দিয়ে। চোখ না তুলেই বলল, গুড ডে, মিস্টার রবার্টসন।
ইতিমধ্যেই দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করছে স্যামুয়েল। রানাও এগোল ওর পেছন পেছন। দরজার কাছে গিয়ে আবার পেছন ফিরল সে। মুখে লজ্জিত হাসি টেনে এনে বলল, সত্যিই অত্যন্ত দুঃখিত
গুড ডে। মাথা তুলবার প্রয়োজন বোধ করল না লোকটা। ব্যস্ত। দুই সেকেন্ড অনিশ্চিত হাসি হেসে সৌজন্যের খাতিরে আস্তে করে ভিড়িয়ে দিল। রানা দরজাটা। মনে মনে আশা করল, কেবল পুরু আর ভারীই নয়, দরজাটা হয়তো সাউন্ডপ্রূফও।
প্যাসেজে দাঁড়িয়ে নিমপাতার রস খাওয়ার হাসি হাসল স্যামুয়েল রানার। দিকে চেয়ে। মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত করল আগে আগে হাঁটবার জন্যে। রানা। বুবল, ওরই মত অস্বস্তি বোধ করে লোকটা বিপজ্জনক কেউ পিছু পিছু হাটলে। মিষ্টি করে হাসল রানা, পাশ কাটিয়ে সামনে যাওয়ার সময় হাসিমুখেই, অত্যন্ত তৃপ্তির সাথে কনুইটা চালাল সে প্রচণ্ডবেগে। নাক দিয়ে। হুক শব্দ বেরোল লোকটার, দুভাজ হয়ে গেল ওর লম্বা শরীরটা পেটের। উপর বেমক্কা গুতো খেয়ে। একটাই যথেষ্ট, তবু ফাউ হিসেবে আরেকটা রদ্দা কষিয়ে দিল সে লোকটার ঘাড়ের পাশে। গুলি খাওয়া সাদা বকের মত ভেঙেচুরে পড়ে গেল লোকটা মেঝের উপর।
পিস্তল বের করে সাইলেন্সরটা পেচিয়ে লাগাল রানা ওটার মাথায়। তারপর কলার চেপে ধরে টেনে নিয়ে এল স্যামুয়েলকে আবার ম্যানেজারের। দরজার সামনে। হ্যাঁন্ডেলে চাপ দিয়েই কাঁধের ধাক্কায় খুলে ফেলল দরজা।
চোখ তুলে আঁতকে উঠল গুডবডি। চশমার ওপাশে বিস্ফারিত চোখ আরও বড় দেখাচ্ছে। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সে রানার হাতে ধরা। পিস্তলটার দিকে। রানা লক্ষ করল, সামান্য একটু পরিবর্তন হলো লোকটার। মুখের চেহারায়–মানুষ মনের কোন ভাব বা ইচ্ছা গোপন করতে চাইলে যেমন হয়, তেমনি।
উঁহু! ভাল হবে না। মাথা নাড়ল রানা। কোন চালাকি করতে যাবেন। না। কোন বোতামে চাপ দিতে গেলে, কিংবা ডান পাশের ড্রয়ার থেকে পিস্তলটা বের করতে গেলে মারা পড়বেন। কেউ কোন সাহায্য করবার অনেক আগেই।
হাত বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল লোকটা রানার কথা শুনে। এবার সত্যিকার ভীতি দেখা দিল ওর চেহারায়।
দুই ফুট পেছনে সরিয়ে নিন চেয়ারটা।
চেয়ার সরিয়ে নিল গুডবডি। ওর উপর থেকে চোখ না সরিয়েই কলার। ধরে টেনে ঘরের ভেতর নিয়ে এল রানা স্যামুয়েলের জ্ঞানহীন দেহ, পেছনে। হাত বাড়িয়ে বন্ধ করে দিল দরজা, ফুটোয় লাগানো চাবি ঘুরিয়ে দিয়ে পকেটে। ফেলল চাবিটা। ছোট একটা হুঙ্কার ছাড়ল গুডবডির প্রতি, উঠে দাঁড়ান।
কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল গুডবডি। টেলিফোনটার দিকে একবার চাইল, তারপর বলল, দয়া করে গোলাগুলি ছুঁড়বেন না, মিস্টার রবার্টসন। যা খুশি নিয়ে যান, আপনার কাজে বাধা দেব না আমি। ডাকাতি করতে…
এদিকে আসুন, মাথা ঝাঁকিয়ে কাছে ডাকল রানা। ভয়ে ভয়ে কাছে এসে দাঁড়াল গুডবডি। আপনি জানেন, আমি কে?
কি করে জানব? গুডবডির চেহারায় বিভ্রান্তির ছাপ। এই একটু আগে আপনি বললেন…
যে আমার নাম রবার্টসন। আসলে কে আমি?
ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি
চেঁচিয়ে উঠল লোকটা কানের উপর সাইলেন্সারের এক ওতো খেয়ে। পিস্তলের ফোরসাইট দিয়ে ইঞ্চি তিনেক লম্বা করে চিরে দিল রানা ওর গালটা। কুলকুল করে রক্ত নেমে এল, টপটপ চিবুক বেয়ে পড়ছে সাদা শার্টের উপর।
কে আমি?
মাসুদ রানা। ভীতির পাশাপাশি ঘৃণাও দেখতে পেল রানা এবার ওর দৃষ্টিতে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল লোকটা, ইন্টারপোল।
এই তো বাছার মুখ ফুটেছে। আবার আঘাত করবার ভঙ্গিতে পিস্তলটা উঁচু করল রানা। কিন্তু আঘাত না করে জিজ্ঞেস করল, বিট্রিক্স শেরম্যান কোথায় কাজ করে?
মারের ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল গুডবডি, প্রশ্নের উত্তরে চট করে জবাব দিল, এখানে।
কোথায় ও?
জানি না। আপন গড, সত্যিই জানি না। রানাকে আবার পিস্তল তুলতে দেখে শেষের শব্দ দুটো বলতে গিয়ে কয়েক পর্দা চড়ে গেল ওর কণ্ঠস্বর। কানের উপর ঠিক একই জায়গায় ঠকাশ করে বাড়ি পড়ল পিস্তলের বাটের। ফুঁপিয়ে উঠল লোকটা। কিছু বললে ঠিক দুই ঘণ্টার মধ্যে মারা পড়ব আমি!
না বললে মারা পড়বেন দুই সেকেন্ডের মধ্যে। কোনটা ভাল? আবার হাত তুলল রানা। কি? বলবেন?
বলব।
কোথায় ও?
পালিয়ে গেছে। এথেন্সে।
এথেন্সে?
হ্যাঁ। ভোরবেলায় এসেছিল এখানে। দুমাসের বেতন পাওনা ছিল, সেই টাকার জন্যে।
একা?
না, ওর ভাইও ছিল সঙ্গে। দুজনেই পালিয়েছে। আজ সাড়ে দশটার। ফ্লাইটে। বিশ্বাস না হয় ফোন করে জেনে দেখতে পারেন এয়ারপোটে। আমি নিজেই এই কিছুক্ষণ আগে…
রানাকে একটু আন্ডার-এস্টিমেট করেছিল লোকটা। মনে করেছিল, আরও দুতিনটা সেকেন্ডের জন্যে আকর্ষণ করে রাখতে পারবে ওর মনোযোগ। অবাক হলো রানার ঠোঁটে মৃদুহাসি খেলে যেতে দেখে। পাই করে ঘুরেই লাথি চালাল রানা।
পিস্তল বের করে ফেলেছিল স্যামুয়েল। খটাং করে লাথি এসে লাগল ওর কনুইয়ের নিচে হাড়ের উপর। সাঁ করে উড়ে গিয়ে পিস্তল পড়ল ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে। ওর পাজরের উপর আরেকটা লাথি লাগিয়ে উঠে বসবার ইঙ্গিত করল রানা। ফিরল গুডবড়ির দিকে। পিস্তল দিয়ে টেলিফোনের দিকে ইশারা করে বলল, ডায়াল করুন।
ডায়াল করে তিনবারের চেষ্টায় কানেকশন পেল গুডবডি, রানার দিকে এগিয়ে দিল রিসিভারটা।
আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার বলছি, বুলল রানা। আজকের এথেন্স ফাঁইট সম্পর্কে জানতে চাই খুব সম্ভব কে এল। এমই হবে। বিট্রিক্স শেরম্যান আর হেনরী শেরম্যান বলে দুজন কি এই। ফ্লাইটে কী বললেন?
অপর প্রান্ত থেকে পরিষ্কার কণ্ঠে উত্তর এল, আজ সকাল সাড়ে দশটার। ফাঁইটে এরা দুজন চলে গেছেন এথেন্সে। হেনরী শেরম্যানের ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি উঠেছিল, কিন্তু তেমন কোন অসুবিধে হয়নি, দুজন একসাথেই উঠেছেন প্লেনে।
ধন্যবাদ জানিয়ে নামিয়ে রাখল রানা রিসিভার।
গুডবডি আর সাপের বাচ্চা স্যামুয়েলকে ঘরের এককোণে পেছন ফিরে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এল রানা। দরজায় তালা মেরে দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে চাবিটা ঢুকিয়ে দিল কার্পেটের নিচে। অ্যালার্ম বেল। রয়েছে, টেলিফোন রয়েছে, স্পেয়ার কী সংগ্রহ করে এই ঘর থেকে বেরোতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না ওদের। দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল সে। ব্যালিনোভার সদর দরজা খুলে।
বিট্রিক্সের এই হঠাৎ অন্তর্ধানে বেশ দুঃখই বোধ করল রানা। সাহায্য করব বলে করেনি, সেজন্যে নয়; নিজের অজান্তেই নিজেরই সব পথ বন্ধ করে দিল বেচারী। ওর উপর ভরসা রাখতে পারেনি মেয়েটা। একটি মাত্র কারণে ওর প্রভুরা এখনও খুন করেনি ওকে–ওরা জানে এই হত্যার সাথে জড়িয়ে। দেবে রানা ওদের।
এখন আর কোন বাধাই রইল না।
Leave a Reply