• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Book । বাংলা লাইব্রেরি

Read Bengali Books Online @ FREE

  • লেখক
  • অনুবাদ
  • সেবা
  • PDF
  • Bookmarks

লেখক

অনুবাদ

সেবা

কৌতুক

লিরিক

ডিকশনারি

PDF

Bookmarks

১.৯-১০ অবিকল একটা ট্যাক্সি

লাইব্রেরি » সেবা প্রকাশনী » মাসুদ রানা সিরিজ » প্রবেশ নিষেধ » ১.৯-১০ অবিকল একটা ট্যাক্সি

০৯.

সত্যিই, বাইরে থেকে দেখতে অবিকল একটা ট্যাক্সিই। ওপেল। কিন্তু গাড়িটার স্পীড দেখে রীতিমত খুশি হয়ে উঠল রানা। দারুণ এক এঞ্জিন লাগিয়ে প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে এর শক্তি। এছাড়াও আরও কিছু। কারিগরী রয়েছে এর মধ্যে। সাইরেনের ব্যবস্থা তো আছেই, একটা বোতাম টিপলে একখানা আনরেকেবল ফাঁইবার গ্লাসের শীট নেমে আসে ছাত থেকে, মুহর্তে আলাদা হয়ে যায় গাড়িটা দুটো কম্পার্টমেন্টে-পেছনের আরোহীর। সঙ্গে চোখের দেখা ছাড়া আর কোন সম্পর্ক থাকে না ডাইভারের। আরেকটা বোতাম টিপলে ছাতের একটা অংশ খুলে মাথা তুলবে পুলিস লাইট। আরেকটা টিপলে পেছনের একটা প্যানেলে ফুটে উঠবে উজ্জ্বল লেখা-স্টপ! প্যাসেঞ্জার সীটের তলায়–অর্থাৎ, ড্রাইভারের পাশের সীটের নিচে রয়েছে। পাকানো রশি, ফাস্ট-এইড কিট, টিয়ার গ্যাস-ক্যানিস্টার। দরজার পকেটে রয়েছে একজোড়া হ্যাঁন্ডকাফ, সেই সঙ্গে চাবি। পেছনের বুটে যে আরও কত কি কৌশল রয়েছে জানাবার চেষ্টা করেছিল কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড, কিন্তু শুনতে চায়নি রানা, মাথা নেড়ে বলেছে ওসব আমার কোন কাজে লাগবে না কর্নেল, গাড়িটা জোরে চলে কিনা সেটাই আসল কথা।

ব্যালিনোভা নাইট-ক্লাবের কাছেই নো পার্কিং লেখা একটা জায়গায়। গাড়িটা রাখল রানা রাস্তার অপর পাড়ে দাঁড়ানো এক ইউনিফর্ম পরা। কনস্টেবলের ঠিক নাক বরাবর। তিন সেকেন্ড গাড়িটার দিকে চেয়ে থেকে সামান্য একটু মাথা ঝাঁকাল কনস্টেবল, তারপর মর্যাদার সাথে দূরে সরে গেল হাঁটতে হাঁটতে। রানা বুঝল, পুলিসের গাড়ি চিনতে অসুবিধে হয়নি কনস্টেবলের; কেউ যদি প্রশ্ন করে যেখানে পার্ক করলে সবার গাড়িতেই হলুদ টিকেট সেটে দেয়া হয়, ঠিক সেই জায়গায় তোমার চোখের সামনে পার্ক করল একটা ট্যাক্সি, আর তুমি দেখেও দেখলে না কোন বিশেষ কারণে, ঘুষটুষ খেয়েছে নাকি কোন উত্তর দিতে পারবে না সে; কাজেই মানে মানে কেটে পড়ল লোকটা।

গাড়ি থেকে নেমে পড়ল রানা, দরজায় লক করে এগোল ব্যালিনোভা নাইট-ক্লাবের দিকে। ছোট্ট একটা নিয়ন সাইনে নাম লেখা, নামের দুইপাশে। দুজন প্রায়-উলঙ্গ নর্তকীর ফিগার আউটলাইন–জ্বলছে, নিভছে। সুইংডোরের দুইপাশে খানিকটা করে জায়গা কাঁচটাকা, অনেকগুলো পেইন্টিং আর। ফটোগ্রাফ সাজানো রয়েছে সেখানে আট এগজিবিশনের কায়দায়। এগুলোর। দিকে একনজর চাইলেই ভিতরে কি ধরনের সৌন্দর্যচর্চা চলেছে বুঝতে অসুবিধে হয় না। সবগুলোই মেয়েমানুষের ছবি। কোন কোনটায় কানের দুল আর পায়ের হাইহিল জুতা ছাড়া আর কোন পোশাক পরিচ্ছদের বালাই নেই, এমন সব বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়ানো কিংবা বসা যে ওগুলোর দিকে দশ সেকেন্ড চেয়ে থাকলেই যৌবন ফিরে পাবে অশীতিপর বৃদ্ধ। কাঁচের গায়ে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল রানা। যদি জানা না থাকত ও কে, তাহলে চিনতেই পারত না সে নিজেকে। ঢুকে পড়ল ভিতরে।

বেশ বড়সড় একটা ঘর। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। বিদঘুটে গন্ধ এল রানার। নাকে অনেকটা রাবার-পোড়া মত। বুঝতে অসুবিধে হলো না রানার, স্বাভাবিক কোন কারণে তৈরি হচ্ছে না গন্ধটা-স্প্রে করা হচ্ছে ওটা কয়েক মিনিট পর পর। কেন? নিশ্চয়ই আরও কিছু গন্ধ ঢাকবার উদ্দেশ্যে? মনে মনে ওদের বুদ্ধির প্রশংসা করল রানা। এই বিশেষ গন্ধটির একমাত্র গুণ হচ্ছে কিছুতেই আর কোন গন্ধ নাকে আসবে না, কারও। ভাল। সারাটা ঘর মান আলোয় আলোকিত। ঘরের এককোণে ছোট্ট একটা স্টেজের একপাশে উদ্দাম ছন্দে একটা আফ্রিকান ড্রাম বাজাচ্ছে একজন পেশীবহুল, স্বাস্থ্যবান নিগ্রো, ঘন কালো কোঁকড়া চুল খাড়া হয়ে রয়েছে মাথার ওপর আধহাত। চকচকে, পিচ্ছিল, কালো শরীরে কাপড়চোপড়ের কোন বালাই নেই–কোমরের কাছে কিছু পাতা-টাতা বেঁধে লজ্জা নিবারণ করেছে (অবশ্য যদি লজ্জা বলে কিছু থেকে থাকে), গলায় বন্য জন্তুর দাঁত দিয়ে তৈরি মালা। বিদঘুটে ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, আর দমাদম ড্রাম পেটাচ্ছে লোকটা-স্পট লাইটের বেগুনী আলোয় ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে, ওর অঙ্গভঙ্গি।

দপ করে জ্বলে উঠল একটা গোলাপী আলো। দেখা গেল স্টেজের এক। কোণে পোজ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধবধবে ফর্সা এক যুবতী, এক ইঞ্চি আকৃতির গোটা দুই চকচকে তারা দিয়ে বুক ঢাকা, কোমর থেকে ঝুলছে আধ। হাত লম্বা একটা ঝাঁকিজাল। নাচতে শুরু করল যুবতী দুলে দুলে, প্রতিটা স্টেপিঙের সঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠছে বুক। দুলছে কোমর, যেন ঢেউ উঠছে। ভূমধ্যসাগরে। স্পট লাইটের আলোয় দেখা গেল মেয়েটার পেছনে আবছামত দেখা যাচ্ছে সবুজ পাতা দিয়ে ছাওয়া একটা বড়সড় বাঁশের খাঁচা।

 চারপাশে চেয়ে দেখল রানা। পুরুষের সংখ্যাই বেশি। তবে মেয়েও। নেহায়েত কম নেই। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে দর্শকবৃন্দ নর্তকীর দিকে। ছন্দের গতি বাড়ছে ক্রমে। সাথে সাথে বাড়ছে দর্শকদের হৃৎপিণ্ডের গতি। বেশির ভাগেরই তেরো থেকে পচিশের মধ্যে বয়স, তবে মাঝবয়সী বা.বৃদ্ধও যে একেবারে নেই তা নয়। সবাই সমভাবেই উপভোগ করছে যুবতীর উদ্দাম নৃত্য। দর্শকমণ্ডলীর পোশাক দেখে সচ্ছলতার আভাস পেল রানা। নাইটক্লাব অবশ্য সব দেশেই ধনীদের জন্যে, তবে এটা দেখে মনে হচ্ছে এর চাকচিক্য যেন কয়েক ডিগ্রী চড়া-অ্যামস্টার্ডামের সেরা নাইট-ক্লাবগুলোর মধ্যে এটা যে অন্যতম তাতে কোন সন্দেহ নেই। দরজার কাছাকাছি একটা। টেবিলে এসে থামল রানার দৃষ্টি। বসে আছে মারিয়া আর সোহানা। এমন ভঙ্গিতে, যে ওদের মনের সাথে যে এই ক্লাবের মূল সুরের মিল নেই, বোঝ যাচ্ছে পরিষ্কার। কেমন একটা নিঃসঙ্গ, ছাড়াছাড়া দায়িত্বপালনের ভাব।

ছদ্মবেশের কোন প্রয়োজন ছিল বলে মনে হলো না রানার। কেউ খেয়ালই করল না ওর উপস্থিতি। ছন্দের সাথে সাথে বাড়ছে উত্তেজনা হাতের গ্লাসগুলো এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে সবাই, মনে হচ্ছে ভেঙে ফেলবার চেষ্টা করছে। স্বর্ণকেশী সুন্দরী স্টেজের ওপর কিলবিল করছে মেরুদণ্ডবিহীন গোলাপী সাপের মত। বাশের খাঁচাটার একটা অংশ খুলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে। নীল একটা কম পাওয়ারের স্পট লাইট জ্বলে উঠেছে। কি যেন নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে খাঁচার মধ্যে।

সোহানা আর মারিয়া যে টেবিলে বসে আছে, ঠিক তার পাশের টেবিলে। বসল রানা একটা চেয়ার টেনে। সোহানার এতই গায়ের কাছে বসল যে চট করে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল সে রানার মুখের দিকে। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে উজ্জল একটা হাসি উপহার দিল রানা সোহানাকে। চমকে উঠল সোহানা রানার হাসি দেখে, চট করে সরে সরে গেল ছয় ইঞ্চি।

ভয় কি? বড়জোর অশ্লীল কোন প্রস্তাব দিতে পারি, খেয়ে তো আর ফেলব না? বলল রানা হাসিমুখে। আবার চমকে উঠল সোহানা। এবার ওর সাথে মারিয়াও। ভুরু কুঁচকে চেয়ে রয়েছে ওরা রানার মুখের দিকে।

কি ব্যাপার? বেশ কিছুক্ষণ পর কিছুটা সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল সোহানা, তোমার মুখের জিওগ্রাফি পাল্টে দিল কে?

কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড। মাসুদ রানা দি গ্রেট এখন ছদ্মবেশে। অত জোরে চেঁচিয়ো না, গলাটা নামাও।

কিন্তু… কিন্তু এত তাড়াতাড়ি এখানে পৌঁছলেন কি করে? জিজ্ঞেস করল মারিয়া। দুই মিনিটও হয়নি এই ঠিকানা জানিয়ে ফোন করেছি আমি, আমাদের হোটেলে।

অন্য সোর্স থেকে খবর পেয়ে এসেছি আমি এখানে। গির্জা থেকে সোজা এখানে এসে ঢুকেছে শেরম্যান? সহজ গলায় কথা বলো, ফিসফিস করবার দরকার নেই।

গলা দিয়ে আওয়াজ বের করল না কেউ, মাথা ঝাঁকাল দুজন একসাথে।

বেরিয়ে যায়নি এখান থেকে?

সদর দরজা দিয়ে বেরোয়নি। স্টেজের পাশে একটা বন্ধ দরজার দিকে চাইল সোহানা। ওই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে মিনিট পাঁচেক হলো।

দরজাটার দিকে চাইল রানা। চট করে চোখ গেল স্টেজের দিকে। নীল স্পট লাইনের আলোটা জোরদার হচ্ছে ক্রমে। কালো, লোমশ, বিশাল, বিকট একটা মুর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। বাঁশের খাঁচার একটা অংশ। খুলে গেছে–খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসছে মস্ত এক গরিলা, ঝকঝক করছে। ভয়ঙ্কর সাদা দাঁত, হাতদুটো ঝুলছে হাটুর কাছে। আরও দুই পা এগোতেই পরিষ্কার দেখা গেল পুরুষ গরিলা। যদিও সবাই জানে ওটা গরিলার খোলস। পরা মানুষ ছাড়া আর কিছুই নয়, তবু ভয়ে চিৎকার করে উঠল কয়েকজন। নিগ্রোটা তাল বাড়িয়ে দিয়েছে আরও, পাগলের মত বাজিয়ে চলেছে সারা শরীরে কাঁপন তুলে। মেয়েটা যেন টেরই পায়নি যে পিছন থেকে ভীষণ এক গরিলা এগিয়ে আসছে, আপন মনে নেচে চলেছে সে উদ্দাম অশ্লীল নাচ–এমন সব অঙ্গভঙ্গি করছে যে নিজের অজান্তেই কুঁচকে উঠছে সোহানার নাক।

গির্জার নানগুলোর চেহারা মনে রাখতে বলেছিলাম, রেখেছ?

চেষ্টা করেছি, বলল মারিয়া।

অদ্ভুত, বিসদৃশ বা ওই রকম কিছু চোখে পড়েছে তোমাদের কারও?

তেমন কিছু না, বলল সোহানা। তবে ওখানকার সন্ন্যাসিনী প্রত্যেকেই দেখতে ভাল।

আগেই শুনেছি খবরটা মারিয়ার কাছে। আর কিছু চোখে পড়েনি?

দুজন দুজনের দিকে চাইল, একটু ইতস্তত করে মারিয়া বলল, একটা ব্যাপার একটু অবাক লেগেছে আমার কাছে। গির্জায় ঢুকল অনেক বেশি লোক, বেরোল কম।

তার মানে?

ঠিকই বলছে মারিয়া,বলল এবার সোহানা। প্রার্থনার সময় যত লোক দেখেছিলাম, বের হলো অনেক কম।

অনেক বলতে কি বোঝাতে চাইছ?

একটু ইতস্তত করে সোহানা বলল, মানে… বেশ কিছু।

বা বা! অনেক থেকে এক লাফে চলে এলে বেশ কিছুতে। এরপর আরেক লাফে শূন্যতে নেমে যাবে মনে হচ্ছে? যাই হোক তোমাদের মনে। হচ্ছে, গির্জায় যত লোক ছিল সবাই, বেরোয়নি, এই তো? কেউ কেউ ব্যক্তিগত প্রার্থনার জন্যে থেকে যেতে পারে। খুব একটা অবাক হওয়ার কি আছে এতে?

কেউ কোন জবাব দিল না। দর্শকদের চিৎকারে তিনজনই চাইল স্টেজের দিকে। আপ্রাণ চেষ্টা করছে নর্তকী এখন গরিলার হাত থেকে বাঁচবার জন্যে। ধরে ফেলে ফেলে, এমনি অবস্থায় হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা, চেঁচিয়ে উঠছে ভয়ে, দমাদম বুক পিটছে গরিলা, আবার চেষ্টা করছে ওকে ধরতে। ড্রামের দ্রুত ছন্দ নেশা ধরিয়ে দিয়েছে, নাচন শুরু হয়ে গেছে। দর্শকদের রক্তে। তালে তালে শরীর ঝাঁকাচ্ছে সবাই, পৈশাচিক আনন্দ লাভ করছে ওদের ধর্ষণকামী প্রবৃত্তি। হঠাৎ প্রচণ্ড এক আওয়াজ করে থেমে গেল। ড্রাম। লোমশ বুকের ওপর চেপে ধরেছে গরিলা যুবতাঁকে। ছটফট করছে মেয়েটা ওর হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে। চিৎকার করে উঠল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে। টানাহেঁচড়ায় সরু ফিতে দিয়ে বাধা নক্ষত্রদুটো খসে গেল ওর বুক থেকে। মাথার ওপর তুলে নিয়েছে বিকট গরিলা যুবতাঁকে, বিজয়গর্বে মুরল কয়েক পাক, তারপর শুইয়ে দিল ওর জ্ঞানহীন দেহটা মেঝের ওপর। মাথাটা একপাশে হেলে রয়েছে যুবতীর। নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়ল গরিলাটা যুবতীর জ্ঞানহীন নগ্ন শরীরের ওপর। দপ করে নিভে গেল সব কটা স্পট লাইট। কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতা। শুধু দর্শকদের উত্তেজিত শ্বাস শোনা যাচ্ছে। পর মুহূর্তে বিকট হৈচৈ আর হাততালিতে ফেটে পড়ল দর্শকবৃন্দ।

এবার আমাদের কাজ কি? জিজ্ঞেস করল মারিয়া।

শহরে যে কটা নাইট-ক্লাব আছে, সবগুলোতে একবার করে ঢুঁ দিতে হবে তোমাদের। খুঁজে দেখবে, চেনা কোন মুখ পাওয়া যায় কিনা। নর্তকী, ওয়েট্রেস বা দর্শকদের মধ্যে কাউকে চিনতে পারো কিনা দেখো।

নাইট-কাবে সন্ন্যাসিনী? চোখ কপালে উঠল সোহানার।

কেন নয়? ওদের মানুষ বলে গণ্য করো না বুঝি? হাসল রানা। বিশেষ করে যাদের দেখবে লম্বা-হাতা জামা, কিংবা কনুই পর্যন্ত লম্বা গ্লাভ তাদেরকে লক্ষ্য করবে ভাল মত। গির্জার কাউকে যদি পেয়ে যাও, তাহলে সে কোথায় থাকে বের করার চেষ্টা করবে। কিন্তু যা-ই করো না কেন, রাত একটার মধ্যে ফিরে যাবে নিজেদের হোটেলে। ওখানে দেখা করব আমি তোমাদের সঙ্গে।

ইতিমধ্যে কোথায় কি কাজ তোমার?

কাজের অভাব নেই। প্রচুর কাজ পড়ে রয়েছে আমার সামনে এখন। কোনটা ছেড়ে কোটা বলি?

অর্থাৎ বলবে না।

হলুদ একটা স্পট লাইট জ্বলে উঠল শূন্য স্টেজের ওপর। নিগ্রো ড্রমবাদক একলাফে অন্ধকার থেকে এসে দাঁড়াল আলোয়, লম্বা করে কুর্নিশ করল দর্শকদের। কুর্নিশরত অবস্থাতেই হ্যাঁচকা টান দিল সে নিজের কোকড়া চুল ধরে। চুলসহ একটা পাতলা রবারের মুখোশ খসে এল ওর হাতে–বেরিয়ে পড়ল লালচুলো এক ধবধবে ফর্সা যুবকের মুখ। প্রচুর হাততালি পড়ল, সেই সঙ্গে সিটি। আরেকবার বো করে একপাশে সরে দাঁড়াল ড্রামরাদক। দৌড়ে এসে দাঁড়াল নর্তকী, বো করতে গিয়ে নিজের বুকের দিকে চোখ পড়তেই জিভ কাটল আধ হাত। চকচকে নক্ষত্র লাগাতে ভুলে গেছে। লজ্জিত হাসি হাসল মেয়েটা, তারপর একহাতে বুক ধরলো, আরেক হাতে চুল–জোরে টান দিতেই খসে এল দুটোই। দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে যোলো-সতেরো বছরের। এক ছোকরা। প্রথমে বিস্মিত গুঞ্জরন, পরমুহূর্তে প্রচুর হাততালি পড়ল। এবার তড়াক করে স্টেজে উঠে এল গরিলাটা। কুৎসিত ভঙ্গিতে এপাশ-ওপাশ ঘুরে। বারকয়েক কুর্নিশ করে লোমশ দুই হাতে ধরল নিজের মাথাটা। কাঁধ  থেকে। নিয়ে ওপরের অংশটা খসে এল ওর হাতে। মাথাটা ঝাড়া দিতেই একরাশ সোনালী চুল ছড়িয়ে পড়ল গরিলার লোমশ কালো পিঠে। মেয়ে একটা। হাসছে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখে। তুমুল হর্ষধ্বনি।

বাঁকা হাসি খেলে গেল সোহানার ঠোঁটে। বলল, কী সুক্ষ্ম রসবোধ, তাই? উঠে দাঁড়াল। চলো, মারিয়া, অন্যান্য নাইট-ক্লাবগুলোও নিশ্চয়ই শিল্প চেতনা আর সৌন্দর্য বোধের ব্যাপারে এদের চেয়ে কম যাবে না। দেরি হলে মিস্ করব আবার।

বেরিয়ে গেল ওরা। কেউ ওদের অনুসরণ করে কিনা দেখবার জন্যে আড়চোখে চেয়ে রইল রানা ওদের গমন পথের দিকে। মস্ত মোটা এক দয়ালু চেহারার লোক পিছু নিল ওদের। এতই মোটা যে থুতনির তিনভাজ চলে এসেছে একেবারে বুক পর্যন্ত, গলা বা ঘাড়ের কোন অস্তিত্বই নেই। মোটা লোকটার পিছু নেয়াটা অনুসরণ কিনা ঠিক বোঝা গেল না, কারণ, কয়েক ডজন লোক আবার পিছু নিল মোটার। আজ রাতের আসল আকর্ষণ শেষ, দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে ঘরটা। দেখতে দেখতে অর্ধেক টেবিলই খালি হয়ে গেল। হালকা হয়ে যাচ্ছে ধোয়ার আস্তরণ। ব্যস্তপদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওয়েটাররা। একটা নির্জলা স্কচ হুইস্কির অর্ডার দিল রানা। যা নিয়ে আসা হলো, এক চুমুক খেয়েই বুঝতে পারল সে, কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করলে হয়তো এর মধ্যে সামান্য একটু হুইস্কির ছিটেফোঁটা আবিষ্কার করা যেতে। পারে-না-ও যেতে পারে। নির্জলা হুইস্কি নয়, নিহুইস্কি জল। পয়সা লুটবার কোন দিকই আর বাদ রাখেনি এরা। বুড়ো এক লোক নিবিষ্টচিত্তে ভেজা এক ন্যাকড়া দিয়ে মুছছে ডান্সফ্লোরটা।

ভিতর দিকের একটা খোলা দরজার সামনে দেখতে পেল রানা বিট্রিক্স শেরম্যানকে। একটা শাল জড়াচ্ছে কাঁধে, পাশেই আর একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। কি যেন ফিসফিস করে বলছে ওর কানে কানে। দুজনের উত্তেজিত, ব্যস্তসমস্ত হাবভাব দেখে মনে হলো অত্যন্ত গুরুতপূর্ণ কিছু ঘটেছে। বারকয়েক মাখা। ঝাঁকাল বিট্রিক্স, চারপাশে চাইল সতর্ক দৃষ্টিতে, তারপর লম্বা পা ফেলে। বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে। যেন তাড়া নেই রানার, ধীরে সুস্থে বিল চুকিয়ে। দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে-ও বাইরে।

 কয়েক মিনিটের মধ্যেই দূরত্বটা বিশফুটের মধ্যে নিয়ে এল রানা। রেমব্র্যান্টপ্লেইনের দিকে এগোচ্ছে মেয়েটা, বেশ কিছুদূর গিয়ে থামল একটা ছোট্ট কাফের সামনে। কাফের বাইরে ফুটপাথের ওপর একটা ব্যারেল অর্গান। বাজাচ্ছে এক বুড়ো। চট করে রানার মনে পড়ল, কার্লটন হোটেলের বাইরেও এই রকম এক বুড়োকে দেখেছে সে ব্যারেল অর্গান বাজাতে। তবে সে লোকের দাড়ি ছিল। তার অবশ্য শ্রোতার সংখ্যাও এর চেয়ে বেশি ছিল-এর সামনে অর্গানের গায়ে হেলান দিয়ে মগ্ন হয়ে বেসুরো বাজনাঃগুনছে একটি মাত্র ছোকরা। একটু কাছে এগিয়ে পরিচিত ঠেকল রানার ছোকরার চেহারা। মনে হলো, দাড়িওয়ালা বুড়োর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে সে এই ছোকরাটাকে। একেবারে শুকনো, গালবসা, রুগ্ন চেহারা–অর্গানের গায়ে হেলান না দিলে দাঁড়িয়ে থাকবার সাধ্য ছিল না ওর। হঠাৎ হঠাৎ শিউরে উঠছে ছোকরার সর্বশরীর। অর্গান শিল্পী যে ছোকরাকে তেমন পছন্দ করতে পারছে না, বোঝা যাচ্ছে ওর বিরক্ত দৃষ্টি দেখে। বিরক্তি, সেই সঙ্গে ভয়। মাঝে মাঝে চারপাশে চাইছে বুড়ো ভীত চকিত দৃষ্টিতে।

অর্গানের কাছে গিয়ে দাঁড়াল বিট্রিক্স। একটা টুপি তুলে ধরল বৃদ্ধ, তারমধ্যে একটা কয়েন ছেড়ে দিয়ে ছোকরার হাত ধরে টানল মেয়েটা। সোজা হয়ে দাঁড়াল ছোকরা। বিস্ফারিত চোখে চাইল বিট্রিক্সের দিকে। গালদুটো এতই বসা যে মনে হয় একটা দাঁতও নেই ওর। ঢাকার ফুটপাথে মরে পড়ে থাকা দুর্ভিক্ষের লাশ মনে হচ্ছে ওকে দেখে। বিট্রিক্সের ওপর ভর দিয়ে এগোতে গিয়ে হোঁচট খেলে।

কাছে চলে এল রানা। বিনা বাক্যব্যয়ে একহাতে জড়িয়ে ধরল ছোকরার পিঠ–মনে হলো যেন কঙ্কাল জড়িয়ে ধরেছে সে। কিন্তু এই সাহায্যে খুশি হলো না বিট্রিক্স, ওর চোখের দৃষ্টিতে উদ্বেগ আর ভীতি দেখতে পেল রানা।

প্লীজ! মিনতি ফুটে উঠল মেয়েটার গলায়। সাহায্য লাগবে না। আমিই পারব। দয়া করে ছেড়ে দিন ওকে।

তুমি পারবে না, মিস শেরম্যান। একসঙ্গে পড়বে দুজন ড্রেনের মধ্যে।

হতবুদ্ধি বিট্রিক্স যেন কিছুই বুঝতে পারল না কয়েক সেকেন্ড, তারপর অস্ফুট গলায় বলল, মিস্টার মাসুদ রানা!

এটা কিন্তু বড়ই অন্যায় কথা, অনুযোগের কণ্ঠে বলল রানা। এত সুন্দর চেহারা আমার, সেই চেহারাটা চিনতে পারলে না তুমি দুঘন্টা আগে, নামই মনে করতে পারলে না–আর যেই ছদ্মবেশ নিলাম, অমনি ডেকে উঠলে নাম ধরে।

হঠাৎ হাল ছেড়ে দিল ছোকরা, পা ভাঁজ হয়ে পড়ে যাচ্ছিল রানার হাত ফসকে, চট করে ধরে ফেলল রানা আবার। এভাবে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে বেশিদূর যাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে নিচু হয়ে ওকে কাঁধে তুলে নেয়ার। উপক্রম করল সে। খপ করে হাত ধরল মেয়েটা রানার। আতঙ্কিত চোখমুখ।

না, না! ওভাবে তুলবেন না ওকে! প্লীজ!

কেন? এভাবেই তো সহজ হবে।

না, না! পুলিস দেখলে ধরে নিয়ে যাবে ওকে।

 সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল রানা, এক হাতে ওর পিঠ জড়িয়ে ধরে খাড়া রাখবার চেষ্টা করল যতটা সম্ভব, পা বাড়াল সামনে। বলল, ফাঁদে পড়ে গেছ শিকারীর। সামনে এখন শুধু অন্ধকার।

 রানার বক্তব্য পরিষ্কার বুঝতে না পেরে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইল মেয়েটা ওর মুখের দিকে।

হেনরীর জন্যে তোমাকে…

হেনরী! ওর নাম জানলেন কি করে আপনি?

গোপন খবর জানাই তো আমার কাজ, বলল রানা হাসিমুখে। যা বলছিলাম। পুলিসের কাছে ও যদি অপরিচিত হত, তবু এক কথা ছিল। কিন্তু। জেল খাটা দাগী ভাই যদি নেশার খপ্পরে পড়ে তাহলে সত্যিই খুবই অসুবিধের কথা। সমাজে মাথা উঁচু করে চলা মুশকিল হয়ে যায়।

কোন উত্তর দিল না মেয়েটা। পরাজিত, পাংশু মুখে হাঁটছে সে মাথা নিচু করে। চেহারায় হতাশা আর বিভ্রান্তির স্পষ্ট ছাপ। রানার উপস্থিতি যে ওর উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ, রানাকে সহ্য করা যে ওর পক্ষে কতখানি। কঠিন বুঝতে পারল রানা পরিষ্কার। যদি কোন যাদুমন্ত্রের বলে মুহূর্তে নাই হয়ে যেত রানা, মস্ত হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে পারত হয়তো সে। কিন্তু হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না ওর মধ্যে।

থাকে কোথায় ও? জিজ্ঞেস করল রানা।

আমার সঙ্গেই। ব্যাপারটা রানার জানা নেই বলে যেন একটু বিস্মিত হয়েছে সে। কাছেই। বেশি দূরে না।

ব্যালিনোভা ছাড়িয়ে একটা সরু গলি দিয়ে গজ পঞ্চাশেক গিয়েই পৌঁছে গেল ওরা অ্যাপার্টমেন্ট হাউজের সামনে। হেনরীকে কাঁধে নিয়ে সরু সিঁড়ি দিয়ে বহু কষ্টে তেতলায় উঠল রানা বিট্রিক্সের পিছু পিছু। দরজা খুলে দিতেই ঢুকল ভিতরে। বাথরূমের সমান দুটো ঘর–একটা বসবার একটা শোবার। বসবার ঘর পেরিয়ে শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকল রানা, খাটের ওপর কঙ্কালটা শুইয়ে দিয়ে ঘাম মুছল কপালের। চলে এল বসবার ঘরে।

এই সিঁড়ি দিয়ে রোজ ওকে নিয়ে ওঠো কি করে? মই বেয়ে ওঠাও তো এর চেয়ে সহজ।

কি করব… গার্লস হোস্টেল এর চেয়ে অনেক ভাল, সস্তাও, কিন্তু হেনরীকে নিয়ে..নাইট-ক্লাব থেকে বেশি পয়সা দেয় না আমাকে।

ঘরের চারপাশে চাইল রানা। আসবাবের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে। খুবই কম দেয়। বলল, তোমার মত কলে পড়া ইঁদুরকে কিছু যে দেয়, এই তো বেশি।

তার মানে?

মানেটা ভাল করেই জানা আছে তোমার। ফাঁদে আটকা পড়ে হাঁসফাস করছ, অথচ মানে বুঝতে পারছ না, এটা হতেই পারে না, বিট্রিক্স।

এত কিছু কি করে জানলেন আপনি? আমার নাম, আমার ভাইয়ের পরিচয়…।

কি করে জানলাম. বলে মনে হয় তোমার? ভুরু নাচাল রানা। ভুলে যাচ্ছ আমাদের একজন কমোন বয়ফ্রেন্ড ছিল।

বয়ফ্রেন্ড? আমার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই।

আছে বলিনি, বলেছি ছিল। অতীতের বয়ফ্রেন্ড বা মরহুম বয়ফ্রেন্ড-যা। খুশি বলতে পারো।

আমেদ? অস্ফুট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।

ঠিক ধরেছ। ইসমাইল আহমেদ। তোমার পাল্লায় পড়ে ছেলেটা মারা গেছে ঠিকই, কিন্তু মরার আগে কিছু তথ্যও দিয়ে গেছে আমাকে। মিথ্যের আশ্রয় নিল রানা। এমন কি তোমার একটা ছবিও রয়েছে আমার কাছে।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল বিট্রিক্স। কিন্তু তাহলে এয়ারপোর্টে

এয়ারপোর্টে তোমাকে চিনতে পারিনি কেন? ঠিকই চিনেছিলাম। কিন্তু যদি সেটা প্রকাশ করতাম, হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে হাজতে বাস করতে হত তোমাকে এতক্ষণে। যাই হোক, কিছু একটা জেনে ফেলেছিল বলেই মরতে হয়েছে ইসমাইলকে। আমি জানতে চাই কি সেটা।

দুঃখিত। এ ব্যাপারে আমি কোন সাহায্য করতে পারব না আপনাকে।

পারবে না, নাকি করবে না?

নিরুত্তর রইল বিট্রিক্স।

তিনমাসে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তোমাদের মধ্যে—তাই না?

চোখ নিচু রেখে মাথা ঝাঁকাল বিট্রিক্স।

ইসমাইল কেন, কি কাজে এখানে এসেছিল বলেছে তোমাকে?

মাথা নাড়ল মেয়েটা।

কিন্তু তুমি আঁচ করতে পেরেছিলে, তাই না?

এবার মাথা ঝাঁকাল।

এবং কি আঁচ করেছিলে সেটা জানিয়েছিলে কাউকে?

ঝট করে চাইল বিট্রিক্স রানার মুখের দিকে। না। কাউকে কিছুই বলিনি আমি। সত্যি।

তোমাকে দিয়ে ওকে কিছু বলিয়েছিল কেউ, তাহলে?

জানি না। হতে পারে। জেনেশুনে কোন ক্ষতি করিনি আমি আমেদের।

আমার সম্পর্কে কোন কথা বলেছিল ইসমাইল তোমাকে?

না।

কিন্তু তোমার ভাল করেই জানা আছে আমি কে?

চুপ করে রইল বিট্রিক্স। জল ভরে উঠল দুচোখে। চেয়ে রইল রানার। দিকে, কিন্তু জবাব দিল না।

তুমি ভাল করেই জানো যে ইন্টারপোল থেকে এসেছি আমি নারকোটিকসের ব্যাপারে। চুপ করে রইল মেয়েটা। কাঁধ  ধরে ঝাঁকাল ওকে রানা। উত্তর দাও। জানা নেই তোমার?

নীরবে মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা।

ইসমাইল যদি তোমাকে বলে না থাকে, কে বলেছে?

আবার চুপ। দুচোখ থেকে পানি ঝরতে শুরু করল। ফুঁপিয়ে উঠে মাথাটা একপাশে ফিরিয়ে নাড়ল মেয়েটা।

প্লীজ। কিছুই বলতে পারব না আমি। আপনি এখন যান। আপনার পায়ে ধরি, একা থাকতে দিন আমাকে।

অসহায় ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রানা। বুঝল এদিক থেকে আর এগোনো যাবে না। কাজেই দিক পরিবর্তন করল সে। খোলা দরজা দিয়ে ঘুমন্ত হেনরীর কঙ্কালটার দিকে চেয়ে বলল, হেনরী সংসারের কোন খরচ, দেয়? কিছু উপার্জন-টুপার্জন করে?

ও উপার্জন করবে কি করে? কাজ করবার ক্ষমতাই নেই ওর। এক বছর ধরে সম্পূর্ণ বেকার। কিন্তু এসবের মধ্যে আবার ওর কথা কেন? এসবের– সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক?

ওর সঙ্গেই জড়ানো আছে সবকিছু। বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা। স্থিরদৃষ্টিতে পরীক্ষা করল ওর মুখটা। একটা চোখের পাতা তুলে দেখল কিছুক্ষণ, তারপর ওটা নামিয়ে দিয়ে ফিরল বিট্রিক্সের দিকে। এই রকম জ্ঞান। হারালে কি করো?

কি আর করব? কিছুই করার নেই।

মাথা ঝাঁকাল রানা। আস্তিন গুটিয়ে দেখল ক্ষতবিক্ষত কঙ্কালসার হাতটা। কত হাজার বার ছিদ্র করা হয়েছে হাতটা তার ইয়ত্তা নেই। ইরিনের হাতটা এর তুলনায় কিছুই না। সোজা হয়ে দাঁড়াল রানা। ঠিক বলেছ। সীমার বাইরে চলে গেছে একেবারে। কারও কিছু করবার নেই এখন। ওর সেরে ওঠার সব পথ বন্ধ–ব্যাপারটা জানা আছে তোমার?

জানি। একটা রুমাল বের করে চোখ মুছল বিট্রিক্স। জানি, মারা যাচ্ছে। ও কিছুদিনের মধ্যেই।

যারা হত্যা করছে ওকে, তাদের বিরুদ্ধে একটা আঙুল তোলারও সাহস নেই তোমার। ঠিক আছে, এজন্যে দোষ দিচ্ছি না আমি তোমাকে। কয়েকটা সহজ প্রশ্নের উত্তর দাও দেখি? কতদিন নাগাদ এই অবস্থা চলছে হেনরীর?

তিন বছর।

কতদিন যাবৎ কাজ করছ তুমি ব্যালিনোভায়?

তিন বছর।

কাজটা ভাল লাগে তোমার?

ভাল! লক্ষ্মীপেঁচার মত মুখ করে হাসল বিট্রিক্স। ওই রকম একটা জঘন্য নাইট-ক্লাবে কাজ করা যে কি, কল্পনাও করতে পারবেন না আপনি। বাপের বয়সী সব বুড়োরা লোভাতুর

ইসমাইল আহমেদ তো বাপের বয়সী ছিল না?

না। ওর কথা বলছি না…

দেখো, বিট্রিক্স। মারা গেছে ইসমাইল। কেন মারা গেছে জানো? মারা গেছে নাইট-ক্লাবের এক হোস্টেসকে বিশ্বাস করতে গিয়েছিল বলে, সে নিজেই ব্ল্যাকমেইলের শিকার।

আমাকে কেউ ব্ল্যাকমেইল করছে না।

তাই নাকি? তাহলে কারা চাপ সৃষ্টি করছে তোমার ওপর? কাদের ভয়ে চুপ করে থাকছ উত্তর দিচ্ছ না আমার প্রশ্নের? কাদের ভয়ে যে কাজ এত অপছন্দ তোমার সেই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছ? কিসের জোরে চাপ সৃষ্টি করতে পারছে ওরা? হেনরী নয়? কি করেছে ও, যেজন্যে বাধা পড়ে গেছ তুমি? কারা বাধ্য করছে তোমাকে আমার ওপর নজর রাখতে? একটি প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারল না বিট্রিক্স। কাজেই আবার ইসমাইলের প্রসঙ্গে ফিরে গেল ও।, ইসমাইল আহমেদের মৃত্যুর সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক? কিভাবে ও মারা গেছে আমি জানি; দেখেছি নিজের চোখেই। কিন্তু কারা। মারল ওকে? কেন

আমি জানতাম না ওকে মেরে ফেলবে! ফুঁপিয়ে উঠে দুই হাতে মুখ ঢাকল বিট্রিক্স। সত্যিই জানতাম না মেরে ফেলা হবে ওকে।

অন্যান্য সবকিছুই জানতে, শুধু জানতে না যার পালিয়ে যাবার সুবিধের জন্যে দরজার সামনে পথ আটকাতে হবে আমার, সেই লোকের ওপর ইসমাইলকে হত্যার নির্দেশ ছিল। হয়তো সত্যিই তাই। তোমাকে কোন দোষ দিতে চাই না আমি, বিট্রিক্স। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্যে অনেককে। দেখেছি আমি দুনিয়ার অনেক ক্ষতি করতে। তবে তোমার ভালর জন্যেই একটা কথা বলব ভাল করে ভেবে দেখো, তোমার জীবন পড়ে রয়েছে। সামনে। মস্তবড় বিপদের মধ্যে রয়েছ তুমি। হেনরীর কথা ভেবে কোন লাভ নেই এখন, জীবন বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই ওর–তোমার নিজের কথাই অনেক বেশি করে ভাবা দরকার তোমার এখন।

কিছুই করবার নেই আমার, কিছুই বলবার নেই, দুহাতে মুখ ঢেকে রেখে মাথা নাড়ল সে। দয়া করে আপনি যান।

রানা বুঝল, এর পরে ওরও আর কিছুই করবার বা বলবার নেই কিছুতেই জবান খুলবে না আতঙ্কিত মেয়েটা–কাজেই দ্বিরুক্তি না করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

.

ঠিক একটা পাঁচে সোহানা আর মারিয়ার হোটেল কক্ষের অ্যাটাচড বাথরূম। থেকে বেরিয়ে এল প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা মাসুদ রানা। হাতের তোয়ালেটায়। বিশ্রী রকম ছোপ ছোপ দাগ লেগে গেছে মেকাপ তুলতে গিয়ে। বাথরূমের। আয়নায় মোটামুটি নিজের চেহারাটা পরিচিত ঠেকতেই বেরিয়ে এসেছে সে, ঘাড়ে, গলায় এখনও কিছু রঙ লেগে রয়েছে, কিন্তু সেগুলো ঢেকেঢুকে কোনমতে কার্লটনের ছশো বাইশ নম্বর কামরায় ঢুকতে পারলেই চলবে আপাতত।

খাটের ওপর সোজা হয়ে বসে আছে সোহানা ও মারিয়া, দুজনেই এমন নাইট-ড্রেস পরেছে যে সেগুলোকে মশারী না বলে ড্রেস কেন বলে, কিংবা প্রস্তুতকারক কি পরিমাণ কাপড় বাঁচিয়েছে এগুলো থেকে, ইত্যাদি নিয়ে একটা থিসিস লিখে ফেলা যায়। কিন্তু আপাতত হাতে সময় নেই বলে কলারের কাছে লালচে হয়ে যাওয়া শার্টটা গায়ে চড়িয়ে বোতাম লাগাতে শুরু করল সে দ্রুত হাতে।

তাহলে বেশির ভাগ নাইট-ক্লাবের মেয়েই ওই হোস্টেল প্যারিসে থাকে?

তাই তো মনে হলো। যে চারটে দলকে অনুসরণ করলাম, প্রত্যেকটাই ঢুকল গিয়ে হোস্টেল প্যারিসে। আরও কয়েকটা মেয়েকে ঢুকতে দেখেছি আমরা ওই হোস্টেলে–মনে হলো ওরাও ফিরছে নাইট-ক্লাব থেকেই।

একটা মুখও চিনতে পারলে না?

চেনা চেনা লেগেছে এক আধটা মুখ, কিন্তু শিওর হতে পারিনি। তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

হেনরী এবং বিট্রিক্সের কথা বলল রানা।

এত সময় লেগে গেল ওদের ওখানে?

না। আরও দুএকটা জায়গায় গিয়েছি। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। বিট্রিক্স শেরম্যানের ওখান থেকে বেরিয়ে আবার যে সে গিয়েছিল ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে সেকথা চেপে গেল রানা। গলার স্বর পাল্টে নিয়ে বলল, এবার তোমাদের কিছু কাজ দেয়া যাক। অযথা নাইট-ক্লাবে ঘোরাঘুরি রেখে এবার সত্যিকার কিছু কাজ দেখাও দেখি? বিনা দ্বিধায় রানাকে এই ধরনের একটা কথা বলতে দেখে রেগে উঠতে যাচ্ছিল মারিয়া, চট করে সোহানার মুখের দিকে চাইল, তারপর হাসল। রানা বলেই চলল, মারিয়া কাল সকালে যাবে ভন্ডেল পার্কে। রোজ সকালে যায় ওখানে ইরিন। ওর ওপর লক্ষ রাখতে হবে। কিন্তু সাবধান…ও চেনে তোমাকে। পার্কে গিয়ে ও কি করে, কারও সঙ্গে দেখা করে কিনা, কথা বলে কিনা, ইত্যাদির রিপোর্ট চাই আমি কাল। পার্কটা বিরাট, কিন্তু ওকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না; পুতুলের পোশাক পরা। এক বুড়ি থাকবে ওর সঙ্গে; সে বুড়ির পেটের বেড় হবে কমপক্ষে নয় ফিট। আর সোহানা, কাল ওই হোস্টেলের ওপর নজর রাখবে তুমি। যদি চার্চের কোন সন্ন্যাসিনীকে পাও ওদের মধ্যে, পিছু নেবে; কোথায় যায়, কি করে তার পূর্ণ বিবরণ চাই আমার। ভেজা, স্যাৎসেতে কোটটা গায়ে চড়াল রানা। চলি, গুডনাইট।

ত্রিশ গজ দূরে পার্ক করে রাখা ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠল রানা। ভাবল, আজ অন্ধকারে অনেকগুলো ঢিল ছুঁড়েছে সে। এর মধ্যে একটাও কি লাগবে না। ওদের ভীমরুল চাকে? কখন টের পাওয়া যাবে প্রতিক্রিয়া?

.

১০.

 হোটেলে ফিরে দেখল রানা চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। ফুটপাথের ব্যারেল অর্গান বাদক এবং তার ভক্তবৃন্দ কেউ নেই। পোর্টার নেই, ডোরম্যান নেই। একটু অবাক হলো রানা-গেল কোথায় সব? হাত বাড়িয়ে। আলগোছে হুক থেকে চাবিটা খসিয়ে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল সে দোতলায়, তারপর বোতাম টিপল লিফটের জন্যে।

ভেজা কাপড় সব খুলে ফেলে গরম পানিতে ভিজল রানা দশ মিনিট। তারপর শুকনো কাপড় পরে নিয়ে একটা সিগারেট ধ্বংস করল ব্যালকনির রেলিঙে হেলান দিয়ে। নিচের রাস্তায় লোক চলাচল অনেক কমে গেছে। কর্তব্য স্থির করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে ঘরে তালা মেরে।

খটাং করে চাবিটা রাখল রানা ডেকের ওপর। চমকে সোজা হয়ে বসে চোখ মিটমিট করল ঝিমন্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। রানাকে দেখে চট করে। চোখ গেল ওর দেয়াল ঘড়ির দিকে, তারপর ডেস্কের ওপর চাবির দিকে।

মিস্টার মাসুদ রানা। কখন, কখন ফিরলেন, দেখিনি তো?

অনেক আগে, বলল রানা। দুতিনঘণ্টা তো হবেই। বেঘোরে ঘুমোচ্ছিলেন আপনি তখন। চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, যেন দুগ্ধপোষ্য শিশু…

ওর দৃষ্টিটা চট করে ঘুরে এল আর একবার ঘড়ির ওপর থেকে। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, এখন কি আবার বেরোচ্ছেন কোথাও? রাত আড়াইটা!

তাতে কি হয়েছে? চব্বিশ ঘণ্টা পাহারার ব্যবস্থা রাখা উচিত ছিল। হাসল রানা। ডোরম্যান নেই, পোটার নেই, ট্যাক্সিম্যান নেই, অর্গান-ভিখারী নেই, অনুসরণ করবার কেউ নেই–ব্যাপার কি? এজন্যে রীতিমত জবাবদিহি করতে হতে পারে আপনার।

প্লীজ.কি বলছেন ঠিক

বুঝতে পারছেন না। আমি নিজেও কি ছাই বুঝে বলছি? যাই হোক, হেয়ার কাটিং সেলুনটা কোনদিকে?

হেয়ার কাটিং সেলুন! এত রাতে আপনি চুল ছাটতে…

বুঝেছি। আবার হাসল রানা। জানা নেই আপনার। ঠিক আছে, আমি– নিজেই খুঁজে নেব।

বেরিয়ে পড়ল রানা। বিশ গজ গিয়ে একটা ডোরওয়ের আড়ালে দাঁড়াল, উঁকি দিল কেউ অনুসরণ করছে কিনা দেখবার জন্যে। তিন মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হলো সে ওর প্রতি কারও তেমন কোন আগ্রহ নেই দেখে। নজর। রাখবার প্রয়োজন বোধ করছে না কেউ ওর গতিবিধির ওপর। কেউ অনুসরণ করছে না। আরও ত্রিশ গজ গিয়ে পুলিস-কারে উঠে পড়ল রানা। ফাস্ট রিফর্মড চার্চ অফ দা অ্যামেরিকান হিউগানট সোসাইটির দুই গলি আগে রাস্তার ধারে পার্ক করে নেমে পড়ল সে ট্যাক্সি থেকে, ক্যানেলের ধার ঘেয়ে সতর্ক পায়ে এগোল গির্জার দিকে।

ক্যানেলের জলে কোন আলোর প্রতিবিম্ব দেখতে পেল না রানা। খালের দুধারে একটা বাড়িতেও আলো জ্বলছে না। গির্জাটাকে আরও শান্ত, আরও নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। বিশাল ক্রেনের প্রকাণ্ড বুমটা মনে হচ্ছে আকাশ ফুড়ে চলে গেছে ওপরে, ভয় ভয় একটা ভাব বিরাজ করছে ওটার চারপাশে। আশেপাশে প্রাণের কোন সাড়া নেই। মনে হচ্ছে গভীর রাতের গোরস্থান।

কাছাকাছি এসে চট করে রাস্তা পেরোল রানা। সিঁড়ি বেয়ে উঠে দাঁড়াল একটা মোটা থামের আড়ালে, তীক্ষ্ণদৃষ্টি বুলাল চারপাশে। কারও সাড়া বা শব্দ পাওয়া গেল না। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে, ডানহাতে হ্যাঁনডেল। চাপ দিয়ে বাম হাতে চাবির গোছাটা বের করতে যাচ্ছিল, প্রায় চমকে উঠল। সে দরজাটা খোলা দেখে। গির্জার দরজায় তালা না থাকা তেমন কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, কিন্তু রানা হয়তো মনে মনে স্থির নিশ্চিত ছিল যে দরজাটা তালা মারা থাকবে, তাই এতটা অবাক হয়েছে। নিঃশব্দে ভিতরে ঢুকে বন্ধ করে দিল সে দরজাটা। টর্চটা বেরিয়ে এসেছে, ওর হাতে, দ্রুত একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে আনল সে আলোটা। নিঃসন্দেহ হলো, ও একা।

 এবার আরেকটু যত্নের সাথে গিজার অভ্যন্তরটা পরীক্ষার কাজে মন দিল। রানা। বাইরে থেকে যতটা মনে হয় তার চেয়েও ছোট আসলে গির্জাটা। খুবই প্রাচীন। টর্চটা উঁচু দিকে ধরল সে। কোন ব্যালকনি নেই, গোটা কয়েক ধূলিমলিন বন্ধ কাঁচের জানালা বৃয়েছে কড়া রোদ উঠলেও কাঁচের মালিন্য ভেদ করে ভিতরে আলো ঢুকতে পারবে কিনা সন্দেহ। বেরোবার একমাত্র রাস্তা দেখা যাচ্ছে ওই প্রবেশদ্বারই। দ্বিতীয় একটা দরজা দেখা যাচ্ছে ভিতরের ঘরে ঢুকবার, পুলপিট আর প্রাচীন এক অর্গানের মাঝামাঝি জায়গায়। বন্ধ।

 এই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল রানা, নবের ওপর হাত রেখে নিভিয়ে দিল টর্চটা। জং ধরা কজায় সামান্য আওয়াজ হলো দরজাটা খুলতে। অতি। সাবধানে পা বাড়াল সে সামনে। ভাগ্যিস সাবধানে বাড়িয়েছিল, নইলে হোঁচট খেয়ে সামনে হুড়মুড় করে পড়তে হত। পাশের ঘরটা আসলে ঘর না–সিঁড়ি ঘর। দরজার পরেই একফুট নিচে প্রথম ধাপ। সাবধানে নামতে শুরু করল রানা ঘোরানো সিঁড়ির ধাপ বেয়ে, মনে মনে আঠারো শুনতেই পৌঁছে গেল, নিচে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। অন্ধের মত দুহাত সামনে বাড়িয়ে এগোল রানা। আশা করছে এক্ষুণি একটা দরজা পাওয়া যাবে, কিন্তু কয়েক কদম গিয়েও যখন দরজা পাওয়া গেল না, থেমে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বালল। এবার তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘোরাল সে টর্চ।কেউ নেই। জানালা বিহীন একটা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সে একা।

গোটা গির্জার আয়তনের প্রায় অর্ধেক হবে ঘরটা। সিলিং থেকে একটা উলঙ্গ বালব ঝুলছে তারের মাথায়। দেয়ালের গায়ে সুইচ খুঁজে বের করে টিপে দিল রানা। শতশত বছরের ধুলো জমে আছে কাঠের মেঝের ওপর। ঘরের মাঝখানে গোটা কয়েক চেয়ার-টেবিল পড়ে রয়েছে এলোমেলো ভাবে, দুপাশের দুই দেয়ালের গায়ে সারি বাধা চারটে চারটে আটটা কেবিন। মনে। হচ্ছে, মধ্যযুগীয় কোন কাফে।

পরিচিত একটা গন্ধে নিজের অজান্তেই নাকটা একটু কুঁচকে উঠল রানার। গন্ধটা ডানদিকের কোন কেবিন থেকে আসছে বলে মনে হলো ওর। ছোট্ট টর্চটা বুক পকেটে গুঁজে পিস্তল বের করল রানা। সাইড পকেট থেকে সাইলেন্সরটা বের করে লাগাল পিস্তলের মুখে। তারপর ওটা বাগিয়ে ধরে প্রেতাত্মার মত নিঃশব্দে এগোল সামনে।

প্রথম কেবিনটা খালি। দ্বিতীয়টার সামনে গিয়েই নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল রানা। অতি সাবধানে উঁকি দিয়ে দেখল, না, এটাও খালি। তৃতীয়। কেবিনের দরজার কাছে এসে গন্ধটা প্রবল হলো। সাইলেন্সারের মুখ আর, রানার বামচোখ একই সাথে উঁকি দিল তৃতীয় কেবিনের ভিতর।

 এত সাবধান না হলেও চলত। ছোট্ট একটা টেবিলের ওপর দুটো জিনিস চোখে পড়ল রানার একটা অ্যাশট্রের মধ্যে আধ ইঞ্চি লম্বা একটা সিগারেটের টুকরো, আর তার পাশে হাতের ওপর রেখে ঘুমিয়ে থাকা একটা মাথা। মুখটা ওপাশে ফেরানো রয়েছে, কিন্তু এক সেকেন্ডও লাগল না রানার ওকে চিনতে। হেনরী। ওকে যে অবস্থায় খাটে শুইয়ে দিয়ে এসেছিল, তাতে রানার। ধারণা হয়েছিল চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে পড়ে থাকবে ছোকরা আউট হয়ে। এত তাড়াতাড়িই জ্ঞান ফিরে পেয়ে কি করে এতদূর এসে হাজির হলো ভেবে একটু অবাকই হলো সে। অবশ্য, জানা আছে রানার, নেশার চরম পর্যায়ে যারা চলে যায় তারা অনেক সময় অবিশ্বাস্য রকম দ্রুত জ্ঞান ফিরে পায়, পেয়েই পাগল হয়ে যায় আবার নেশা করবার জন্যে। আপাতত একে নিয়ে কোন সমস্যা নেই। পা বাড়াল সে সামনে।

কেবিনগুলো সব একবার করে দেখে নিয়ে সামনের দেয়ালের গায়ে একটা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল রানা। কান পেতে শুনল ভিতর থেকে কোন আওয়াজ পাওয়া যায় কিনা। নিশ্চিন্ত হয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। ভিতরে, বাতির সুইচ খুঁজে বের করে টিপে দিল।

এ ঘরে আসবারের কোন বালাই নেই, শুধু চার দেয়ালের গায়ে চারটে উঁচু র‍্যাক রাখা, র‍্যাকগুলোর প্রত্যেকটা তাকে ঠাসা রয়েছে বাইবেলের পর বাইবেল। ফাস্ট রিফর্মড চার্চের বাইবেল। জায়গার অভাবে একেক তাকে। তিন সারি করে সাজানো। ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে এই স্টকেরই একটা অংশ দেখে এসেছে সে। এই কিছুক্ষণ আগেই। কাজেই এগুলোর মধ্যে নতুন কিছু পাওয়া যাবে না বুঝতে পারল সে, তবু এগিয়ে গিয়ে ঘাটতে শুরু করল সে বাইবেলগুলো। অতীত অভিজ্ঞতা রয়েছে। কাজেই প্রথম বা দ্বিতীয় সারি পরীক্ষা করল না সে, দুই সারি থেকে দুটো বই সরিয়ে তৃতীয় সারি থেকে টেনে বের করে আনল একটা বাইবেল। যা আশা করেছিল, তাই। দেখতে অন্যসব বাইবেলের থেকে তফাৎ নেই কোন, কিন্তু আসলে এটা বই-ই নয়, বইয়ের মত দেখতে বাক্স একটা, ভিতরটা ফাঁপা।

বাংলাদেশে বেশ কিছু উকিল আছে, যারা মক্কেলের কাছে নিজেদের পাণ্ডিত্যের বহর দেখাবার জন্যে চেম্বারের কয়েকটা আলমারি ভর্তি করে রেখেছে এই ধরনের চামড়া বাঁধাই করা ফাপা বই দিয়ে কিন্তু ফাস্ট রিফর্মড। চার্চ মুগ্ধ করতে চায় কাকে?

বাইবেলের মলাট, অর্থাৎ ঢাকনিটা খুলে ভিতরে একবার নজর বুলিয়েই বন্ধ করে দিয়ে এদিক ওদিক চাইল রানা। এঘরে দেখবার আর কিছুই নেই। যে দরজা দিয়ে ঢুকেছে, ঠিক তার উল্টোদিকের দেয়ালে ওই রকম আর একটা দরজা। আবার কান পাতল রানা, খুলল, ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালল।

ছোট্ট একটা শিস বেরিয়ে এল রানার মুখ থেকে। অত্যন্ত আধুনিক ঝকঝকে সব যন্ত্রপাতি সাজানো রয়েছে এ ঘরে। ছোটখাট একটা ফ্যাক্টরি। কি জিনিস তৈরি হয় তার কৌন নমুনা নেই ঘরের কোথাও, কিন্তু মেশিনগুলো যে নিয়মিত ব্যবহার করা হয়, তার চিহ্ন সুস্পষ্ট। মার্সেই শহরের লাভ লজে ঠিক এই রকম আর একটা ফ্যাক্টরি দেখেছিল সে, মনে পড়ল রানার।

ঘরের মাঝামাঝি গিয়েই ওর মনে হলো যেন আবছা একটা শব্দ কানে, এল। যে দরজা দিয়ে ও এইমাত্র ঘরে ঢুকেছে, সেই দরজার কাছে। ঘাড়ের পিছনে সেই সুড়সুড়ি জাতীয় অনুভূতিটা বোধ করল রানা। মনে হলো, পিছন থেকে কেউ চেয়ে রয়েছে ওর পিঠের দিকে, মাত্র কয়েক ফুট দূর থেকে।

কিছুই টের না পাওয়ার ভান করল রানা, যেমন হাটছিল তেমনি আপন মনে হাঁটতে থাকল সামনের দিকে। কিন্তু স্বাভাবিক থাকা খুব কঠিন হয়ে। পড়ল ওর পক্ষে। মনের ভিতর যখন পাই করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিপদের স্বরূপ চাক্ষুষ করবার, কিংবা সৎ করে সরে কোন কিছুর আড়ালে লুকোবার অদম্য ইচ্ছে, যখন রানা পরিষ্কার জানে যে কোন মুহূর্তে একটা থারটি এইট ক্যালিবার অথবা তার চেয়েও ভয়ঙ্কর বুলেট এসে ঢুকতে পারে মাথার পিছনে-আগামী পদক্ষেপেই ঘটতে পারে ঘটনাটা, তখন সহজু ভঙ্গিতে সোজা হয়ে হাঁটাও সহজ নয়। বিশেষ করে অস্ত্র বলতে যদি বাম হাতে ধরা থাকে, একটা ফাপা ধর্মগ্রন্থের খোলস তাহলে হৃৎকম্প শুরু হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। প্রচণ্ড বেগে লাফাতে শুরু করেছে ওর হৃৎপিণ্ডটা বুকের ভিতর। কোন শাসন মানছে না।

নিজের বোকামিতে ভয়ানক রাগ হলো রানার নিজের ওপর। আর কেউ এই ভুল করলে বিনা দ্বিধায় বলত সে উচিত সাজা হয়েছে ব্যাটা গর্দভের। কি করে নিজে করল সে এই ভুলটা? গির্জার দরজাটা ভোলা দেখে? বাইরের দরজা খোলা, বেজমেন্টে নামবার দরজা খোলা, কোথাও কোন তালা নেই, কোথাও কোন বাধা নেই–যার খুশি আসো, ঢোকো, দেখো। এই অবস্থা দেখে প্রথমেই তো বোঝা উচিত ছিল ওর, একটাই মাত্র কারণ থাকতে পারে এর। সেটা হচ্ছে নিশ্চয়ই সশস্ত্র পাহারাদারের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে, যার ওপর হুকুম রয়েছে, ঢুকতে বাধা দেবে না কাউকে, বাধা দেবে বেরোতে গেলে–প্রাণ নিয়ে যেন কেউ বেরিয়ে যেতে না পারে এখান থেকে। নিশ্চয়ই পুলপিট কিংবা আর কোন গোপন জায়গায় চুপচাপ ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। হয়তো আরও কোন দরজা রয়েছে যেটা লক্ষ্যই করেনি সে।

আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে ঘরের শেষ মাথায় পৌঁছল রানা, বামপাশে লেদ মেশিনের মত দেখতে একটা যন্ত্রের ওপাশে কিছু দেখে যেন অবাক হয়েছে এমনি ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে কিছু বলল, তারপর নিচু হয়ে ঝুঁকল যন্ত্রের। আড়ালে–যেন মেঝেতে রাখা কিছু জিনিস পরীক্ষা করে দেখছে। এতক্ষণ। পর্যন্ত সুযোগ দেয়ায় যার-পর-নাই কৃতজ্ঞ রোধ করল সে লোকটার প্রতি। ঠিক দুই সেকেন্ড পর যখন মাথাটা তুলল রানা, পিস্তল বেরিয়ে এসেছে ওর হাতে।

বারো ফুট দূরে দেখতে পেল রানা লোকটাকে। পায়ে রাবার সোলের মোকাসিন, মুখটা ছুঁচোর মত লম্বাটে, উত্তেজনায় ফ্যাকাসে, চোখদুটো। জ্বলছে। ওর হাতে রানার দিকে মুখ করে ধরা রয়েছে পয়েন্ট থ্রী এইট পিস্তলের চেয়েও কয়েকগুণ ভয়ঙ্কর এক পিলে চমকানো হুইপেট। ডিবিবিএল টুয়েলভ বোর শটগানের ব্যারেল কেটে ফেলে দিয়ে তৈরি হয়েছে এই হুইপেট শটরেঞ্জের খুনোখুনিতে এর বাড়া আর কোন অস্ত্র নেই।

হাতে গুলি করবে, না বুকে, নাকি মাথায় চিন্তা করবার সময় পেল না। রানা। যখন এক সেকেন্ডের মধ্যে নির্ধারিত হয়ে যায় দুজন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে কে বাঁচবে আর কে মরবে, সেকেন্ডের দশভাগের একভাগ সময়ের মধ্যেই যে কোন দিকে চলে যেতে পারে জয় বা পরাজয়, সেই মুহূর্তটা মাথা খাটাবার মুহূর্ত নয়–প্রবৃত্তির তাড়নায় কাজ করে তখন মানুষ। দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রিগারে চাপ দিল রানা।

ছুঁচো মুখো লোকটার একটা চোখ অদৃশ্য হয়ে গেল। দ্বিতীয় গুলিটা ঢুকল দুই চোখের ঠিক মাঝখান দিয়ে। মুহূর্তের মধ্যে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করল ওর মুখটা ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসায়। মরা অবস্থাতেই এক পা পিছিয়ে গেল, তারপর যেমন নিঃশব্দে এগোচ্ছিল তেমনি কোন শব্দ না করে হুইপেটটা আঁকড়ে ধরে গড়িয়ে পড়ল মেঝের ওপর। খোলা দরজা দিয়ে পাশের ঘরের দিকে চাইল রানা। এর সঙ্গে আরও লোক আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। আক্রমণ না করা পর্যন্ত বোঝা যাবেও না। কাজেই দেরি করবার কোন অর্থ। হয় না। লক্ষ করল, কাঁপছে ওর সর্বশরীর।

সোজা হয়ে দাঁড়াল রানা, দ্রুতপায়ে চলে এল বাইবেলের ঘরে কেউ নেই। তার পাশের ঘরে তেমনি ঘুমিয়ে রয়েছে হেনরী, অন্যান্য কেবিন খালি-কেউ নেই। এক হ্যাঁচকা টানে কাঁধে তুলে নিল সে হেনরীকে। উঠতে শুরু করল ওপরে। পুলপিটের পেছনের সংজ্ঞাহীন দেহটা নামিয়ে দিয়ে আর। একবার সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা করল রানা গির্জাটা, তারপর বাইরে বেরোবার। দরজাটা সামান্য একটু ফাঁক করে পুরো একমিনিট চেয়ে রইল বাইরের দিকে। কাউকে দেখতে না পেয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।

তিন মিনিটের মধ্যে ট্যাক্সিটা নিয়ে এল সে গির্জার দোরগোড়ায়। ভিতরে। ঢুকে তুলে নিয়ে এল হেনরীকে, পিছনের সীটে বসিয়ে দিতেই ঢলে পড়ল ও গাড়ির মেঝেতে। চট করে চারটাপাশ দেখে নিয়ে আবার রানা ঢুকল গিয়ে গির্জার ভিতর।

মৃত লোকটার পকেট থেকে কিছুই পাওয়া গেল না। বাইবেলটা যথাস্থানে রেখে বামহাতে হুইপেটটা নিয়ে ডানহাতে কোটের কলার চেপে ধরল লাশটার, তারপর ছেড়ে টেনে নিয়ে এগোল দরজার দিকে। একটা। একটা করে বাতি নিভিয়ে, দরজা বন্ধ করে দিয়ে টেনে নিয়ে এল সে লাশটা। ওপরে, বাইরে বেরোবার দরজার মুখে। বাইরেটা আবার একবার ভাল করে। দেখে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

 যতটা সম্ভব ট্যাক্সির আড়ালে আড়ালে একেবারে খালের ধারে টেনে নিয়ে এল রানা লাশটা, তারপর আস্তে করে নামিয়ে দিল পানিতে, ঠিক যেমন করে নামাত ওই লোকটা রানার লাশ যদি আর একটা সেকেন্ড সময় পেত। হুইপেটটাও নামিয়ে দিল রানা খালের জলে, তারপর দ্রুতপায়ে চলে এল গাড়ির কাছে। গাড়ির দরজা খুলতে যাবে, এমনি সময়ে গির্জার ঠিক পাশের একটা বাড়িতে বাতি জ্বলে উঠল বাইরের দিকে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খুলে গেল। সদর দরজা। দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল একজন লোক, অনিশ্চিত দৃষ্টিতে চাইল এদিক ওদিক, তারপর এগিয়ে এল ট্যাক্সির দিকে।

লম্বা-চওড়া এক লোক, চকমকে নাইট গাউন গায়ে জড়ানো, একমাথা এলোমেলো পাকা চুল, নাকের নিচে চওড়া একজোড়া পাকা গোঁফ, মুখের ভাবে প্রসন্ন বদান্যতার ছাপ।

 কোন সাহায্য দরকার? ঝনঝনে ভরাট গলায় জিজ্ঞেস করল লোকটা। কোন অসুবিধেয় পড়েছেন?

অসংখ্য ধন্যবাদ, বলল রানা। না, না। অসুবিধে কিসের? কোন অসুবিধে হচ্ছে না আমার।

গির্জার ভিতর থেকে কিসের যেন আওয়াজ শুনলাম মনে হলো?

 গির্জার ভিতর থেকে?

হ্যাঁ। আমার গির্জা। ওই যে। আঙুল তুলে গির্জার দিকে দেখাল। লোকটা। আমিই প্যাসটর। রজার। ডক্টর নিকোলাস রজার। আমি ভাবলাম। কোন গুণ্ডা বা ডাকাত ঢুকে পড়ল নাকি ভেতুরে।

আমি না, রেভারেন্স, বলল রানা। গত দশ বছর কোন চার্চের ভেতর। ঢুকিনি আমি।

সমঝদারের মত পাকা মাথা ঝাঁকাল লোকটা। ঈশ্বরবিহীন এক দুনিয়ায় বাস করি আমরা। যেন তাকে ছাড়াই চলে! যাই হোক, এত রাতে আপনি কি করছেন এখানে, ইয়ংম্যান? রাত একটু বেশি হয়ে গেছে না?

নাইট শিফটের ট্যাক্সি ড্রাইভারের জন্যে খুব একটা রাত কোথায়?

আর এই পাল্টা প্রশ্ন তেমন একটা সন্তুষ্ট করতে পারল না বৃদ্ধকে। কয়েক পা। সামনে এগিয়ে উঁকি দিল গাড়ির ভিতর। হেনরীকে মেঝের ওপর পড়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল ভয়ানকভাবে। মাই গড! গাড়ির ভেতর ডেডবডি!

হেসে উঠল রানা। দাঁড়াল প্যাসটরের মুখোমুখি। ওটা ডেডবডি নয়, রেভারেন্ড। মাতাল এক নাবিক, জাহাজে পৌঁছে দেয়ার জন্যে নিয়ে চলেছি। লোকটা সীট থেকে পড়ে যাওয়াতেই এইমাত্র গাড়ি থামিয়ে সীটে তুলে। বসাতে যাচ্ছিলাম আমি। আবার হাসল রানা। মরা হলে ওকে তুলে বসাবার প্রয়োজন হত না।

এই ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারল না বৃদ্ধ, দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখব।

রানাকে ঠেলে এগোবার চেষ্টা করল বৃদ্ধ, কিন্তু যেখানে ছিল সেখানেই। ঠেলে রেখে দিল ওকে রানা। কাতর মিনতির মত শোনাল ওর গলাটা। আপনি চাপাচাপি করলে আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সটা খোয়া যাবে, রেভারেন্ড। প্লীজ!  

আমি জানতাম! আমি জানতাম! মস্ত কিছু গোলমাল রয়েছে কোথাও। আন্দাজ করতে পেরেছিলাম আমি। স্বীকার করছেন যে, আমি চাপাচাপি। করলে আপনার লাইসেন্স খোয়া যাবে?

 হ্যাঁ। চাপাচাপি করলে আপনাকে খালের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলতে হবে আমার, ফলে ক্যানসেল হয়ে যাবে লাইসেন্সটা। অবশ্য, মুচকি হাসল রানা, যদি সাঁতরে পাড়ে উঠতে পারেন, তবেই।

কি বললেন? খালে ফেললেন? আমাকে? একজন প্যাসটরকে! আপনি দৈহিক হামলার হুমকি দিচ্ছেন আমাকে, স্যার?

হ্যাঁ।

 দ্রুত কয়েক পা পিছিয়ে গেল, ডক্টর রজার। সেখান থেকে বলল, আপনার লাইসেন্স প্লেটের নাম্বার আমার মনে থাকবে, স্যার। কাল সকালেই আমি…

রাত বেড়ে চলেছে। আর কথা না বাড়িয়ে ড্রাইভিং সীটে উঠে গাড়ি। ছেড়ে দিল রানা। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে প্রবল বেগে হাত নাড়াচ্ছে লোকটা মুঠি পাকিয়ে, বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের কোন লক্ষণ নেই ওর ভাবভঙ্গিতে।

হেনরীকে কাঁধে নিয়ে আবার তেতলায় উঠে এল রানা সরু সিঁড়ি বেয়ে। অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় তালা নেই। লাইট জ্বেলে দেখা গেল বেঘোরে। ঘুমোচ্ছে বিট্রিক্স সোফার ওপর। হেনরীকে নিয়ে পাশের ঘরে যাওয়ার সময় ছায়া পড়ল ওর চোখে, চট করে চোখ মেলে চাইল, তারপর উঠে বসল বিট্রিক্স। পাশের ঘরের বিছানায় কঙ্কালসার দেহটা নামিয়ে দিয়ে ফিরে এল, রানা বসবার ঘরে। কোন কথা না বলে চেয়ে রইল চোখ ডলতে থাকা বিট্রিক্সের দিকে।

কখন বেরিয়ে গেছে টের পাইনি, বলল মেয়েটা অনেকটা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে। রানা যখন কোন কথা বলল না, তখন আবার বলল, সত্যিই টের পাইনি আমি। কোথায় পেলেন ওকে?

তুমি কল্পনা করতে পারবে না কোথায় পেয়েছি। হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছিল একটা ব্যারেল অর্গানের ওপর।

কিন্তু এত রাতে তো…

ব্যারেল অর্গানের সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়। মাথা ঝাঁকাল রানা। বুড়ো ছিল না। তালা ভাঙার চেষ্টা করছিল ও।

মাথা নিচু করে বসে রইল বিট্রিক্স। আবার কান্নার সেশন শুরু না হয়, সেই ভয়ে চট করে জিজ্ঞেস করল রানা, এর মধ্যে মাথা নিচু করবার কি আছে? আমি ভাবছি, ব্যারেল অর্গানের প্রতি ওর এত ইন্টারেস্ট কেন.। অদ্ভুত ব্যাপার। গানবাজনা খুব পছন্দ করে বুঝি?

না। হ্যাঁ। সেই ছোটবেলা থেকেই গানবাজনা…

হয়েছে। আর গুলপট্টি মারতে হবে না। কঠোর কণ্ঠে বলল রানা। গানবাজনার ভক্ত হলে ওই বেসুরো ব্যারেল অর্গানের বাজনা না শুনে বরং সেলাই মেশিনের আওয়াজই ওর বেশি পছন্দ করবার কথা। খুবই সহজ একটা কারণ রয়েছে ওর ব্যারেল অর্গানের কাছে যাওয়ার। খুবই সহজ। কারণটা তুমিও জানো, আমিও জানি।

 বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল বিট্রিক্স রানার চোখের দিকে। ভীতি দেখতে। পেল রানা ওর চোখে। বসে পড়ল সে সোফায়।

বিট্রিক্স?

 বলুন?

মিথ্যাভাষণে আমার চেয়ে কোন অংশে কম যাও না তুমি। হেনরীকে খুঁজতে যাওনি তুমি, তার কারণ তোমার ভাল করেই জানা ছিল কোথায় গেছে। ও, ভাল করেই জানা আছে কোথা থেকে ধরে এনেছি আমি ওকে। এমন এক জায়গা, যেখানে অত্যন্ত নিরাপদেই থাকবে ও, এমন এক জায়গা, যেখানে ধরা। পড়বে না ও পুলিসের হাতে; এমনই সম্মানিত জায়গা, যে কেউ কোনদিন ভাবতেই পারবে না ওখানে খুজবার কথা। লম্বা এক শ্বাস ফেলল রানা। থোয়াতে সুইয়ের মজা নেই, কিন্তু নাই-মামার চেয়ে কানা-মামা ভাল।

 একেবারে ছাইবর্ণ ধারণ করল বিট্রিক্সের মুখ। ভয় পেয়েছে মেয়েটা এবার। রানা লক্ষ করল থরথর করে কাঁপছে ওর হাত।

কাকে ভয় পাচ্ছ, বিট্রিক্স? ওদের, না আমাকে?

আপনাকে। এতদিন ঠিকই ছিলাম, আপনি

আমি এসেই গোলমাল শুরু করে দিয়েছি। তাই না? কিন্তু একটু ভাল করে ভেবে উত্তর দাও দেখি তোমার কি মনে হয়, কেন আমি তোমার ঘরে আবার ফিরে এসেছি আজ? তোমার ক্ষতি করবার জন্যে? বুঝতে পারছ না, সেটা করতে চাইলে এখানে আসবার কোন প্রয়োজনই ছিল না আমার? তোমার প্রেমে যে পড়িনি সেটা বুঝবার ক্ষমতা তোমার আছে। র‍্যাকমেইলড হচ্ছ, এই ধারণাটা যদি আমার মনে না আসত তাহলে নিজের ঘুম নষ্ট করে তোমার কাছে ছুটে আসতাম না। আমি তোমাকে শুধু একটা কথাই বলতে চাই নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মারছ তুমি। এখনও সময় আছে। ইচ্ছে করলে দিক পরিবর্তন করতে পারো। পরে আর সময় থাকবে না।

ভুল বলছেন। চোখ তুলল বিট্রিক্স। কোন উপায় নেই আমার। শেষ হয়ে গেছি আমি।

মাথা নাড়ল রানা।

হেনরীর কথা যদি বলো, আমি স্বীকার করব, হ্যাঁ, ওর জন্যে কোন রাস্তা খোলা নেই আর। কিন্তু তোমার জন্যে একটা রাস্তা খোলা আছে। একটাই মাত্র রাস্তা। আমার সঙ্গে সহযোগিতা করা। তুমি আমাকে সাহায্য করলে আমি সাহায্য করব তোমাকে।

কিভাবে কি সাহায্য করবেন আপনি আমাকে?

প্রথমত, হেনরীর জীবনটা যারা শেষ করে দিয়েছে, তাদের শেষ করে দিয়ে। তোমার জীবনটা যারা বিষময় করে তুলেছে, তাদের শেষ করে দিয়ে। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে পুলিসের সমস্ত ঝামেলা থেকে তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে। কিন্তু আমার সাহায্য দরকার। পৃথিবীর প্রত্যেকেরই দরকার একে অপরের সাহায্য। আমাকে যদি সাহায্য করো, আমি তোমাকে সাহায্য করব যদি কসম খেতে বলো, খেতে পারি। আমার কথায় নিশ্চয়ই টের পেয়েছ, ওদের দিন শেষ হয়ে এসেছে? কি, সাহায্য করবে আমাকে?

দুশ্চিন্তা, হতাশা, ভয়-নানান রকম ভাবের খেলা খেলে গেল বিট্রিক্সের। মুখের ওপর দিয়ে। দুমিনিট চুপচাপ বসে থেকে তিনবার মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল সে। সঙ্গে সঙ্গেই পকেট থেকে পয়েন্ট টু ওয়ান বোরের ছোট্ট একটা। পিস্তল বের করে দিল রানা ওর হাতে।

এটা রেখে দাও। কাজে লাগতে পারে। প্রয়োজন হলেই ব্যবহার করতে দ্বিধা কোরো না।

 ঠিক তিন মিনিট পর বেরিয়ে এল রানা অ্যাপার্টমেন্ট হাউজ থেকে। রাস্তার অপর পারে একটা সিঁড়ির ওপর বসে গভীর তত্ত্বালোচনায় মত্ত রয়েছে দুই মাতাল, তর্ক করছে ফিসফিস কণ্ঠে। পিস্তল ধরা হাতটা কোটের পকেটে; পুরে দ্রুতপায়ে এগোল রানা বিশ গজ দূরে পার্ক করে রাখা ট্যাক্সির দিকে। ক্লান্তিতে ঘুম আসছে ওর দুচোখ ভেঙে। বেলা নটার বেশি ঘুমানো যাবে না, দশটার সময় কর্নেল ডি গোল্ডের সঙ্গে সার্চ করতে যাওয়ার কথা ওর ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে।

ভোঁ করে ছেড়ে দিল রানা ট্যাক্সি। দেখতে পেল না, ট্যাক্সিটা রওনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়িয়েছে মাতাল দুজন–মাতলামির লেশমাত্র নেই ওদের চেহারায়।

« পূর্ববর্তী:
« ১.৭-৮ অলিগলি বেয়ে সোহানার হোটেল
পরবর্তী: »
২.১-২ ঠিক সকাল নটায় »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি – জোক্স – লিরিক – রেসিপি – কামসূত্র – হেলথ – PDF

Return to top