• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Book । বাংলা লাইব্রেরি

Read Bengali Books Online @ FREE

  • লেখক
  • অনুবাদ
  • সেবা
  • PDF
  • Bookmarks

লেখক

অনুবাদ

সেবা

কৌতুক

লিরিক

ডিকশনারি

PDF

Bookmarks

১.৫-৬ ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের ড্রইংরুমে

লাইব্রেরি » সেবা প্রকাশনী » মাসুদ রানা সিরিজ » প্রবেশ নিষেধ » ১.৫-৬ ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের ড্রইংরুমে

০৫.

ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের ড্রইংরুমে ঢুকেই মনের বিষণ্ণ ভাবটা কেটে গেল। রানার। সেন্ট্রাল হিটেড ঘরের সবখানে উজ্জল, খুশি খুশি রঙ। জানালার কাঁচে বিড়বিড় করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে, কুলকুল করে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে কাঁচের ওপর দিয়ে। সব শীতলতা, সব মালনতা গলে যাচ্ছে, ধুয়ে মুছে। সাফ হয়ে যাচ্ছে এ ঘরের বাইরে ঢুকতে পারছে না ভিতরে। ভারী ডাচ ফার্নিচারে সুন্দর করে সাজানো ড্রইংরূম, নরম গদি আটা আমচেয়ার রয়েছে। কয়েকটা। রঙচঙে পুরু কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে বসে পড়ল রানা। একটা চেয়ারে। ঘরের এককোণে বড়সড় একটা লিকার কাবার্ডের সামনে। দাঁড়িয়ে কোন বোতলটা বের করবে সে ব্যাপারে মনস্থির করবার চেষ্টা করছে মাগেনথেলার। খানিক ইতস্তত করে একটা তিনকোনা বোতল থেকে দুটো গ্লাসে প্রায় তিন ইঞ্চি পরিমাণ সোনালী তরল পদার্থ ঢেলে নিয়ে চলে এল। রানার সামনে। একটা টিপয়ের ওপর রানার গ্লাসটা নামিয়ে দিয়ে নিজেরটা হাতে নিয়ে বসল মুখোমুখি একটা আর্মচেয়ারে।

একটা কথা জিজ্ঞেস করব আপনাকে, মেজর মাসুদ রানা। আপনার। সম্পর্কে আমরা যতদূর জানি, আপনি এসপিয়োনাজের লোক, দূধর্ষ এক স্পাই…ড্রাগস তো আপনার লাইন নয়? এসবে তো আপনার আগ্রহী হওয়ার। কথা নয়? আপনি এর মধ্যে এলেন কি মনে করে?

 আমি এই লাইনের লোক নই, খবরটা ঠিকই শুনেছেন। আমার চীফ যখন প্রথম আমাকে এ ব্যাপারে কাজ করবার প্রস্তাব দেন, আমি অত্যন্ত। বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম সে প্রস্তাব। এই একই যুক্তিতে। কিন্তু আমার বস্ যখন আমাকে সাথে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে নিয়ে গিয়ে লাশগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, যখন নিজ চোখে দেখলাম সারি সারি বাঙালী যুবক-যুবতীর মৃতদেহ, তখন আর স্থির থাকতে পারলাম না। কিছুতেই। কোন দেশপ্রেমিক স্থির থাকতে পারে না সে দৃশ্য দেখে। আমিও। পারিনি। আমার মনে হয়েছে, কেবল অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যই নয়, ভয়ঙ্কর ধরনের মস্তিষ্কবিকৃতি রয়েছে; তরুণদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড কোন আক্রোশ আর প্রতিশোধের মনোভাব রয়েছে এদের লীডারের মধ্যে। বিকৃত এক ধরনের আনন্দ লাভ করছে লোকটা কাঁচা বয়স, বিক্ষোভ আর হতাশার শিকার। হাজার হাজার সম্ভাবনাময় তরুণ তরুণীর চরম সর্বনাশ করে। ধ্বংসযজ্ঞে নেমেছে যেন এক নির্মম ম্যানিয়াক। মনস্থির করতে আর কোন কষ্ট হয়নি আমার।

রানার বক্তব্যটা বেশ কিছুক্ষণ নিজের মনে নেড়েচেড়ে বুঝে দেখল মাগেনথেলার। চোখ বুজে মাথা ঝাঁকাল বার কয়েক, তারপর বলল, ঠিক বলেছেন।

আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি, এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দিন, বলল রানা মৃদু হেসে। আমাকে মরচুয়ারী থেকে ঘুরিয়ে আনবার পেছনে নিশ্চয়ই আপনার কোন উদ্দেশ্য রয়েছে। কিছু একটা বোঝাতে চাইছেন আপনি আমাকে। কি সেটা?

একটা নয়, কয়েকটা জিনিস বোঝাতে চেয়েছি আমি আপনাকে। ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে একটা সাইড টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল সে গ্লাসটা। রানাকে সিগারেট ধরাবার সময় দিয়ে শুরু করল প্রথমত আমি আপনাকে জানাতে চাই, সমস্যাটা আপনাদের ওখানে ঠিক যতখানি, আমাদের এখানে তার চেয়ে কম প্রকট নয়। বরং বেশি। সিটি মরচুয়ারীতে ওই রকম আরও অন্তত বিশটা লাশ রয়েছে। সব হেরোইনের শিকার। সব সময় এত বেশি হয়। না, মৃত্যুর হারটা জোয়ার ভাটার মত কমে বাড়ে, ইদানীং একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। কচি কচি ছেলেমেয়েদের লাশই বড় কথা নয়, আরও কত হাজার নেশাগ্রস্ত যুবক যে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত, তার হিসেব কোথাও লেখা নেই।

অর্থাৎ, আপনি আমাকে জানাতে চান, যে এই গোপন দলটাকে ধ্বংস করার ব্যাপারে আমার চেয়ে কোন অংশে কম আগ্রহী নন আপনারা–যে, একই শত্রুর বিরুদ্ধে কাজ করছি আমরা; আমাদের আক্রমণের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন?

 ঠিকই ধরেছেন। এক এবং অভিন্ন।

দ্বিতীয় উদ্দেশ্য?

আমি চেয়েছি কর্নেল ডি গোন্ডের সাবধানবাণীটা আপনাকে দিয়ে আরও গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করাতে। ওরা ঠিক কতটা রুথলেস, কতখানি ভয়ঙ্কর। দেখাতে চেয়েছি আমি আপনাকে মরচুয়ারীতে নিয়ে গিয়ে। যদি ওদের বেশি কাছে যান, যদি বেশি বিরক্ত করেন কি বলব, এখনও কয়েকটা সীট খালি। আছে মরচুয়ারীতে।

লম্বা করে টান দিল রানা সিগারেটে। বাড়ির ভিতরে একটা টেলিফোন বেজে উঠল। বিড়বিড় করে ক্ষমা চেয়ে দ্রুতপায়ে চলে গেল মাগেনথেলার। ভিতরে। দরজাটা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা দরজা খুলে গেল, সুন্দরী এক যুবতী ঢুকল ড্রইংরূমে। লম্বা একহারা চেহারা, বয়স বড়জোর বিশ কি বাইশ। একটা ড্রাগন আঁকা রঙচঙে হাউজ কোট দিয়ে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা। কুচকুচে কালো চুল মেয়েটার, ডিম্বাকৃতি মুখ, আয়ত চোখ দুটো বেগুনী রঙের। উঠে দাঁড়াল রানা।

হ্যালো। আমি মাসুদ রানা। আর কি বলবে বুঝে পেল না সে।

হঠাৎ ঘরে ঢুকে মেয়েটাও যেন একটু হতচকিত হয়ে পড়ল। চট করে। বুড়ো আঙুলটা মুখে পুরে চুষে নিল কয়েক সেকেন্ড। তারপর কিক করে। হাসল। পরিপাটি ঝকঝকে একসারি দাঁত।

আমি ইরিন। ভাল ইংরেজি বলতে পারি না কিন্তু। মিষ্টি গলায় বলল মেয়েটা।

 দুপা এগিয়ে হাত বাড়াল রানা হ্যাঁন্ডশেকের জন্যে। কিন্তু হাতটা ধরবার। কোন লক্ষণ দেখা দিল না মেয়েটার মধ্যে। তর্জনী কামড়ে ধরে হেসে উঠল খিলখিল করে। লাল হয়ে উঠেছে লজ্জায়। এত বড় একটা মেয়ের এই রকম ব্যবহারে একেবারে থতমত খেয়ে গেল রানা। স্বস্তির খাস ফেলল পাশের ঘরে রিসিভার নামিয়ে রাখার আওয়াজ হতেই।মাগেনখেলার এসে ঢুকল ড্রইংরূমে।

রুটিন কল। জরুরী কিছু না, এয়ারপোর্ট থেকে মেয়েটাকে দেখে কথার মাঝখানেই থেমে গেল মাগেনথেলার, মৃদুহেসে এগিয়ে এসে সস্নেহে হাত রাখল ইরিনের কাঁধে। পরিচয় হয়েগেছে মনে হচ্ছে?

পরিচয় পর্বের মাঝামাঝি পর্যায়ে ছিলাম বলতে বলতে থেমে গেল রানা। দেখল, মাগেনথেলারের কানে কানে কথা বলছে ইরিন ফিসফিস করে, চকচকে চোখে রানার দিকে চাইছে বাকা দৃষ্টিতে। মদ হেসে মাথা ঝাঁকাল মাগেনথেলার, ছুটে বেরিয়ে গেল ইরিন ঘর থেকে। হতভম্ব রানার দিকে চেয়ে আবার হাসল মাগেনখেলার, ম্লান হাসি।

এক্ষুণি ফিরে আসবে আবার, দেখবেন। অপরিচিত লোকের সামনে। প্রথমটায় লজ্জা পায় ও একট, কিন্তু সহজ হতেও সময় লাগে না মোটেই।

ঠিকই। দশ সেকেন্ডের মধ্যেই ফিরে এল ইরিন। কোলে একটা বড়সড় পুতুল। পুতুলটা এত সুন্দর করে তৈরি যে প্রথম দেখলে মনে হয় সত্যিই জ্যান্ত বাচ্চা বুঝি। প্রায় তিনফুট লম্বা, মাথায় সাদা একটা টুপি, টুপির নিচে কোঁকড়া সোনালী চুল দেখা যাচ্ছে, পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা একটা সিল্কের পোশাক পরা, চমৎকার এমব্রয়ডারি করা বডিস গায়ে। শক্ত করে ধরে আছে ইরিন পুতুলটাকে, যেন সত্যিকারের বাচ্চা, ঢিল দিলে পড়ে যাবে। হাত বাড়িয়ে। কাছে টেনে নিল মাগেনখেলার ইরিনকে, একহাতে জড়িয়ে ধরে পরিচয় করিয়ে দিল, এটা আমার মেয়ে, ইরিন। আর ইনি আমার এক বন্ধু বাংলাদেশের লোক, মেজর মাসুদ রানা।

এবার অসঙ্কোচে এগিয়ে এল ইরিন, হাত বাড়াল মৃদু হেসে।

হাউ ডু ইউ ডু, মেজর রানা?

ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে রানাই বা কম যাবে কেন, স্মিত হাসি হেসে বো করল সে সামান্য, হাতটা ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল, মিস মাগেনথেলার। মাই প্লেযার।

মাই প্লেযার। বলেই কথাটা বলা ঠিক হলো কিনা জানার জন্যে সপ্রশ্ন। দৃষ্টিতে চাইল বাপের দিকে।

 ইংরেজি ভদ্রতার সাথে খুব একটা পরিচয় নেই ইরিনের, কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলল মাগেনথেলার। তারপর শশব্যস্ত হয়ে বলল, আরে! দাঁড়িয়ে কেন? বসুন, বসে পড়ুন। বলে নিজেই ধপাস করে বসে পড়ল চেয়ারে, তুলে নিল ব্র্যান্ডির গ্লাসটা।

রানাও বসল। পুতুল কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ইরিন, ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয়েছে সে রানার মুখের দিকে। অস্বস্তি বোধ করতে, শুরু করল রানা। এই অস্বাভাবিক পরিবেশে ঠিক কি করা উচিত বুঝতে না পেরে ক্রমেই বাড়ছে। অস্বস্তিবোধ। মেয়েটার দিকে চেয়ে বলল, তুমি বসবে না?

চকচকে চোখে চাইল ইরিন বাপের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল রানার কথায়, তারপর পুতুলটা বাপের হাতে দিয়ে সোজা এসে চড়ে বসল রানার। কোলে। একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রানা। কিন্তু কোন রকম ভাবান্তর। নেই ইরিনের মুখে, যেন এটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক কাজ হয়েছে, এমনি ভঙ্গিতে একহাতে জড়িয়ে ধরল রানার গলা, তারপর মিষ্টি করে হাসল চার ইঞ্চি দূর থেকে সোজা রানার চোখের দিকে চেয়ে। রানাও হাসবার চেষ্টা করল, কিন্তু সেটা হাসির চেয়ে ভ্যাংচানোর মতই দেখাল বেশি।

উজ্জ্বল চোখে খানিকক্ষণ রানাকে দেখার পর ঘোষণা করল ইরিন, তুমি খুব ভাল। তোমাকে আমি ভালবাসি।

আমিও তোমাকে ভালবাসি, ইরিন, বলল রানা। কতটা ভালবাসে বোঝাবার জন্যে ওর পিঠে মৃদু চাপড় দিল দুটো। হাসিমুখে চোখ বন্ধ করল ইরিন, মাথাটা রাখল রানার কাঁধে। ওর মাথার ওপর দিয়ে মাগেনহেলারের দিকে চাইল রানা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে। মলিন হাসি হাসল মাগেনথেলার। হাসিতে ঝরছে দুঃখ।

ইরিন আসলে সবাইকে ভালবাসে, মেজর মাসুদ রানা। আশা করি আহত বোধ করবেন না এ খবরে।

 না, না। আহত হওয়ার কি আছে? একটা বিশেষ বয়সের সব মেয়েই তাই করে।

 প্রশংসার দৃষ্টিতে চাইল মাগেনখেলার রানার দিকে। আশ্চর্য তীক্ষ্ণ। আপনার বোধশক্তি!

এর মধ্যে তীক্ষ্ণতাটা কোথায় বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল রানা কিছুক্ষণ। তারপর ইরিনের দিকে ফিরে নরম গলায় ডাকল, ইরিন?

উত্তর দিল না ইরিন। মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে, একটু নড়েচড়ে আরও ভাল করে মাথা গুজল রানার ঘাড়ে, চোখদুটো শক্ত করে টিপে বন্ধ করে রেখেছে। হাসির মধ্যে এতই সহজ সরল নিষ্পাপ একটা তৃপ্ত ভাব দেখতে পেল রানা যে কেন যেন নিজেকে ঠগবাজ মত মনে হলো ওর।

আবার চেষ্টা করে দেখল রানা। ইরিন, আমার মনে হয় তোমার চোখ। দুটো খুব সুন্দর। দেখি তো সত্যি কিনা?

কথাটা ভেবে দেখল ইরিন চোখ বুজেই, হাসল আবার, তারপর রানার কোলের ওপর সোজা হয়ে বসে হাত দুটো সোজা রেখে দুই হাতে ধরল রানার দুই কাঁধ , চোখ দুটো বড় বড় করে চাইল রানার চোখে-ঠিক বাচ্চা মেয়ের মত।

অপূর্ব দুটো আয়ত বেগুনী চোখ, চকচক করছে–কিন্তু ভাল করে লক্ষ করতেই টের পেল রানা, দৃষ্টিটা শূন্য। চকচকে, উজ্জল ভাবটা আসলে বাইরের ব্যাপার, তার পেছনেই আশ্চর্য এক ভাবলেশহীন অন্তঃসারশূন্যতা। আস্তে করে ওর ডান হাতটা সরাল রানা কাঁধ  থেকে, কোটের আস্তিনটা তুলে। ফেলল কনুই পর্যন্ত। ক্ষতবিক্ষত হাত। হাইপোডমিক সূচের অসংখ্য খোঁচায়। দগদগে ঘায়ের মত দেখাচ্ছে। হাসি মুছে গেছে ইরিনের মুখ থেকে, নিচের ঠোঁটটা কাপল একটু, ভয়ে ভয়ে চাইল রানার মুখের দিকে–যেন আশা করছে। এক্ষুণি বকবে ওকে রানা। ঝট করে কোটের হাতা নামিয়ে দিল, পরমুহূর্তে দুই হাতে রানার গলা জড়িয়ে ধরে ফোপাতে শুরু করল। এমনভাবে কাঁদছে, যেন ওর বুক ভেঙে গেছে পুত্রশোকে। ওর পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করল রানা, ওর মাথার ওপর দিয়ে চাইল মাগেনথেলারের দিকে।

এবার বুঝতে পারছি আমাকে আপনার বাসায় নিয়ে আসবার কারণ।

ঠিকই বুঝতে পেরেছেন, বলল মাগেনথেলার। আমার বিশ্বস্ত সহকর্মীদের বিষয়টা জানানো আমি কর্তব্য বলে মনে করি।

ডি গোল্ড জানেন?

অ্যামস্টার্ডামের প্রত্যেক সিনিয়র পুলিস অফিসারই জানেন, বলল মাগেনথেলার সহজ কণ্ঠে। ইরিনের দিকে চাইল। ইরিন?

কোন জবাব না দিয়ে আরও আঁকড়ে ধরল ইরিন রানাকে। দম বন্ধ হওয়ার যোগাড় হলো রানার। এবার একটু কড়া গলায় ডাকল মাগেনথেলার, ইরিন? ঘুমোতে যাও। তুমি জানো ডাক্তার কি বলেছে। সোজা বিছানায় গিয়ে ঢোকো–যাও, লক্ষ্মী।

না, ফুঁপিয়ে উঠল ইরিন। ঘুম আসছে না।

 একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গলার স্বর উঁচু করল ইন্সপেক্টর মারগ্রিয়েট!

ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই যেন এই ডাকের জন্যেই দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়েছিল–এমনি ভাবে, ঘরে ঢুকল খোদাতালার আশ্চর্য এক সৃষ্টি। এত মোটা মেয়েমানুষ জীবনে দেখেনি রানা। দুটো রানা সামনাসামনি দাঁড়িয়ে। দুহাত বাড়ালেও বেড় পাবে না। অবিকল ইরিনের পুতুলের মত জামা-কাপড়। পরা। লাল ফিতে দিয়ে পিগটেল বাধা লম্বা চুল গলার দুপাশ দিয়ে বিশাল বুকের ওপর লুটাচ্ছে। বুড়ি। কমপক্ষে সত্তর বছর বয়স হবে। গালের এবং হাতের ভাজ দেখে বোঝা যাচ্ছে, আরও মোটা ছিল, শুকিয়ে এই হাল হয়েছে। বেচারীর। চেহারা, বয়স, চুলের লাল ফিতে আর রঙেচঙে জামা কাপড়ে মেয়েলোকটাকে রীতিমত বিদঘুটে লাগল–রানার চোখে। কিন্তু মাগেনথেলারের কাছে যে মোটেই বিসদৃশ লাগছে না বোঝা গেল তার সহজ ভঙ্গিতে ইরিনকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে চোখের ইশারা দেখে।

বিশাল বপু নিয়ে সহজ ভঙ্গিতে এগিয়ে এল মারগ্রিয়েট, রানার প্রতি ছোট্ট একটা নড় করে হাত রাখল ইরিনের কাঁধে। চট করে মাথা তুলল ইরিন, মুহূর্তে কান্না ভূলে হেসে উঠল ঝিক করে, রানার গলা ছেড়ে দিয়ে উঠে। দাঁড়াল। মাগেনথেলারের হাত থেকে পুতুলটা নিয়ে চুমো খেল ওর গালে, রানার চেয়ারের সামনে এসে রানার গালেও চুম খেল একটা, তারপর নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে হেলেদুলে ওর পেছনে পেছনে চলে গেল মারগ্রিয়েট। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইন্সপেক্টরের দিকে ফিরল রানা।

আগেই সাবধান করা উচিত ছিল আপনার, অনুযোগের সুরে বলল। রানা। ইরিন আর মারগ্রিয়েট–দুজনের ব্যাপারেই। চমকে গিয়েছি একেবারে। কে মহিলা–মানে, মারগ্রিয়েটের কথা জিজ্ঞেস করছি-নার্স?

যাইডার যীর হাইলার দ্বীপে ওর বাড়ি। বহু পুরানো লোক…আমি ছোট থাকতে কাজে লেগেছিল আমাদের বাড়িতে, মানে বাপের বাড়িতে। বছর। খানেক আগে আবার এসে হাজির কাজ দাও। ইরিনের জন্যে রেখে দিলাম। ওকে। কাপড়চোপড়ে পুরানো আমলের ট্র্যাডিশন বজায় রেখেছে, ওই দ্বীপের। সবাই তাই শহরে দেখতে একটু উদ্ভটই লাগে, কিন্তু ইরিনের ব্যাপারে দারুণ কাজ দিচ্ছে বুড়ি।

আচ্ছা। বলল রানা। আর ইরিন?

আট বছর ওর বয়স। গত পনেরো বছর ধরে আট বছরেরই রয়ে গেছে। চিরকাল ওই আট বছরই থাকবে। আমার নিজের মেয়ে না–হয়তো অনুমান করেছেন; কিন্তু নিজের মেয়ের চেয়ে কমও না। আমার বড় ভাইয়ের পালিতা কন্যা। একটা ডাচ অয়েল কোম্পানীতে সিকিউরিটি অফিসার ছিল আমার বড় ভাই। ওর স্ত্রী মারা গেছে কয়েক বছর আগেই, গত বছর ও আর আমার স্ত্রী মারা গেছে একটা মোটর দুর্ঘটনায়। কে নেবে ইরিনকে? সাত-পাঁচ ভেবে আমিই রেখে দিলাম। প্রথমটায় দায়িত্ব আর ঝামেলা ঘাড়ে করতে চাইনি-এখন এমন দাঁড়িয়েছে, ওকে ছাড়া বাঁচব বলে মনে হয় না। মানসিক বয়স বাড়বে না ওর কোনদিন।

লোকটার অবস্থা চিন্তা করে বেশ দুঃখই হলো রানার। কে ভাবতে পারবে, এমন একটা ডাকসেটে পুলিস অফিসারের অপরাধী ধরে ধরে জেলে। পোরা ছাড়া আরও কোন ব্যক্তিগত গোপন দুঃখ বা সমস্যা থাকতে পারে? বিশেষ করে এই ধরনের সমস্যা। সহানুভূতি বা সান্তনা ওর তেমন ভাল আসে না, তাই সেদিকে না গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করল, এই যে নেশা–কবে এর খপ্পরে পড়ল?

আল্লাই মালুম। বহু বছর আগে। আমার ভাই যখন টের পেল তারও, বেশ কয়েক বছর আগে।

কয়েকটা দাগ দেখলাম নতুন?

উইথড্রয়াল ট্রিটমেন্ট চলছে ওর। ঝট করে বন্ধ করে দিলে মারাই যাবে। বেচারী। কিন্তু আসল সমস্যা সেটা নয়–প্রায়ই কারা যেন ওকে ফুল-ডোজ দিয়ে যায় গোপনে। বাজপাখির মত সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে ওর ওপর মারগ্রিয়েট। রোজ সকালে ভন্ডেল পার্কে নিয়ে যায়-ওখানে পাখিদের বুট খাওয়াতে খুব ভালবাসে ইরিন। দুপুরে ঘুমোয়। বিকেলের দিকে আমি প্রায়ই থাকি না, মারগ্রিয়েটও হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়ে সেই ফাঁকে কাজ হাসিল করে চলে যায়। ওরা।

ওকে ওয়াচ করবার ব্যবস্থা করেননি?

বহুবার। কিভাবে ওর কাছে সাপ্লাই পৌঁছায় কেউ ধরতে পারেনি।

আপনাকে বাগে আনবার জন্যে ওর ওপর ওষুধ প্রয়োগ করছে ওরা?

এছাড়া আর কি হতে পারে? আমার ওপুর চাপ সৃষ্টি করতে চায়। টাকা দিয়ে কেনে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত; টাকা নেই ইরিনের। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই হেরোইন সাপ্লাই দিচ্ছে ওরা ইরিনকে। ওরা জানে না, চোখের সামনে মরে যেতে দেখব ইরিনকে, তব কম্প্রোমাইজ করব না আমি কিছুতেই। যত ভাবে যত চেষ্টাই করুক, নোয়াতে পারবে না ওরা আমার। মাথা। কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি করছে না তাই বলে।

চব্বিশ ঘণ্টা গার্ডের ব্যবস্থা করা যায় না?

 সেটা করতে গেলে খাতিরে হবে না, ব্যাপারটাকে অফিশিয়াল করতে। হবে। এই ধরনের অফিশিয়াল অনুরোধ হেলথ অথোরিটির কানে যেতে বাধ্য। তারপর?

মাথা ঝাঁকাল রানা। পাগলা গারদে পুরে দেয়া হবে ওকে। কোনদিন। ফিরে আসবে না আর।

কোনদিন না। চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেল মাগেনথেলারের। মাথা নাড়ল সে এপাশ-ওপাশ।

 আর কি বলা যায় বুঝতে না পেরে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল রানা ড্রইংরূম থেকে।

.

০৬.

সারাটা দুপুর হোটেল কামরায় বসে কর্নেলের দেয়া ক্রস-ইনডেক্স করা ফাইল ঘটল রানা। ফাইলে গত তিনটে বছর অ্যামস্টার্ডামে ডাগ সংক্রান্ত যত রকমের যত কেস হয়েছে তার বিবরণ সাজানো আছে। প্রত্যেকটাই। দুঃখেরকোনটা মৃত্যু, কোনটা আত্মহত্যা, কোনটা বা পারিবারিক ভাঙন আর সাংসারিক অশান্তির কাহিনী।

নানান ভাবে চোখ বুলাল রানা ওগুলোর ওপর, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ক্রস ইনডেক্সগুলোকে নানান ভাবে সাজাবার চেষ্টা করল; কিন্তু সবই বৃথা। কোন প্যাটার্ন পাওয়া গেল না। ঘণ্টা দুয়েক ফাইলটা নাড়াচাড়া করে প্রবোধ দিল। সে নিজের মনকে কর্নেল ডি গোল্ড আর ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের মত ঘুঘু অফিসার যদি এসব ধৈর্যের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরীক্ষা করে কোন প্যাটার্ন। বের না করতে পেরে থাকে, তাহলে সে কোন ছার? ফাইল ঘাটা কোনদিনই ভাল লাগে না ওর, কাজেই এসব ঘেটে আশ্চর্য কিছু আবিষ্কারের আশা করা বৃথা। নেহায়েত বোকামি। কোন লাভ হবে না ধরে নিয়ে ফাইল বন্ধ করে। ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে উঠল সে শেষ বিকেলে।  

ঘুম থেকে চাঙ্গা হয়ে উঠে স্নান সেরে নিল সে গরম পানিতে। ঘন ছাই রঙের একটা স্যুট গায়ে চড়িয়ে নেমে এল নিচে। রিসিপশন ডেস্কে চাবিটা। বাড়িয়ে দিতেই হাসিমুখে এগিয়ে এল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। আজকের হাসিতে আগেকার সেই অতি স্মার্টনেস দেখা গেল না, রীতিমত একটা সমীহ ভাব টের পেল রানা ওর ব্যবহারে। বুঝল, রানাকে হালকাভাবে গ্রহণ করতে বারণ করা হয়েছে ওকে।

গুড ইভনিং, গুড ইভনিং, মিস্টার রানা। ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গি করল সে। কাল হয়তো একটু খারাপ ব্যবহারই করে ফেলেছিলাম কিন্তু সেই সময়…

আরে না, না। ও কিছু না। ভদ্রতার দিক থেকে রানাই বা কম যাবে। কেন? কিছু মনে করিনি আমি। ওই রকম একটা অবস্থায় কার সাথে কে কি ব্যবহার করছে সেসব দেখলে কি চলে? দেখাই যাচ্ছিল, খুবই মুষড়ে পড়েছিলেন আপনি সেটাই স্বাভাবিক। কাঁচের দরজা দিয়ে বাইরের বৃষ্টির দিকে চাইল রানা। ট্যুরিস্ট গাইডে কিন্তু এই বৃষ্টির উল্লেখ নেই মোটেই।

যেন কথাটার মধ্যে মস্ত কিছু রসিকতা রয়েছে এমনি ভাবে হেসে উঠল। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, যেন হাজার টুরিস্টের মুখে হাজার বার শোনেনি। সে-রানার মুখেই প্রথম শুনছে এই রকম একটা কথা। তারপর জিজ্ঞেস করল, বেরোচ্ছেন বুঝি?

হ্যাঁ। য্যানডামের দিকে চলোম। যা মাথায় এল যা খুশি একটা নাম বলে দিল রানা।

য্যানডাম? হুঁ, য্যানডাম! বিজ্ঞের মত মাথা ঝাঁকাল লোকটা। অপেরায়?

ঠিক ধরেছেন, বলেই বেরিয়ে পড়ল রানা সদর দরজা দিয়ে। ডোরম্যানকে ইঙ্গিত করতেই পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে একটা ট্যাক্সি এসে হাজির। হয়ে গেল গেটের কাছে। উঠে বসল রানা পেছনের সীটে, ডোরম্যানকে শুনিয়ে ড্রাইভারকে বলল, শিফল এয়ারপোর্ট।

রওনা হলো ট্যাক্সি। রানা লক্ষ করল, আরেকটা ট্যাক্সিও রওনা হলো। পিছন পিছন। সামনের ট্রাফিক লাইটে গাড়িটা থামতে পেছন ফিরে ভাল করে। দেখে নিল রানা হলুদ স্ট্রাইপ আঁকা মার্সিডিজ ট্যাক্সিটা–আরোহী নেই, ড্রাইভার একা। ট্রাফিক লাইট সবুজ হতেই ভিযেলস্ট্রাট ধরে এগোল ট্যাক্সি, পিছনেরটাও চলল সেই একই দিকে।

ব্যাপারটা ভালমত বুঝে নেয়ার জন্যে ড্রাইভারের কাঁধে দুটো টোকা দিল। রানা।

এখানে থামো একটু, সিগারেট কিনব। ট্যাক্সি থেমে দাঁড়াতেই নেমে পড়ল রানা। দেখল, পেছনের ট্যাক্সিটাও থেমে দাঁড়িয়েছে। কেউ উঠল না, কেউ নামল না–যেন ইচ্ছে হয়েছে তাই দাঁড়িয়েছে ট্যাক্সিটা, এমনি। একটা হোটেল ফোয়ায়ারে ঢুকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে রানা যখন বেরোচ্ছে, তখনও তেমনি দাঁড়িয়ে রয়েছে ওটা। রওয়ানা হয়ে গেল রানার ট্যাক্সিটা, খানিক চলবার পর রানা বলল, ডাইনে মোড় নাও। প্রিনসেনটি ধরে। এগোও।

কিন্তু ওটা তো শিফলের রাস্তা না। আপত্তি জানাল ট্যাক্সি ড্রাইভার।

না হোক। ওই রাস্তা দিয়েই যেতে চাই আমি। ডাইনে ঘোরো।

 ঘুরল ড্রাইভার, পেছনে মার্সিডিজটাও ঘুরল এইদিকেই।

থামো। দাঁড়িয়ে পড়ল ড্রাইভার। মার্সিডিজও দাঁড়িয়ে গেছে। রাগ হলো রানার। সবকিছুরই একটা সীমা আছে। চিড়িয়া মনে করেছে নাকি ওকে। ব্যাটারা? নাকি ননীর পুতুল? গাড়ি থেকে নেমে মার্সিডিজটার দিকে এগিয়ে। গেল রানা, এক ঝটকায় দরজা খুলে বাকা হয়ে ঝুঁকল সামনের দিকে। নীল স্যুট পরা বেটেখাট, মোটা, টাকপড়া এক লোক বসে আছে ড্রাইভিং সীটে, চেহারায় একটা বেপরোয়া ভাব।

গুড ইভনিং, বলল রানা। ভাড়া যাবে?

না। ভুরু কুঁচকে আপাদমস্তক দেখল লোকটা রানাকে, বোঝাবার চেষ্টা করল–খোঁড়াই কেয়ার করে সে রানাকে, তেড়িবেড়ি করে লাভ হবে

তাহলে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

সিগারেট খাওয়ার জন্যে কেউ থামতে পারবে না, এমন কোন আইন আছে?

না, এরকম আইন নেই। কিন্তু তুমি তো সিগারেট খাচ্ছ না, বাছা?হাসল রানা। যাই হোক, মানিক্সস্ট্রাটের পুলিস হেডকোয়ার্টারটা চেনা আছে? লোকটাকে গম্ভীর হয়ে যেতে দেখে রানা বুঝল, ভাল করেই চেনা আছে ওর জায়গাটা। বলল, সোজা চলে যাও ওখানে। ওখানে গিয়ে হয় কর্নেল ডি মোন্ড নয়তো ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের সঙ্গে দেখা করে বলো কার্লটন হোটেলের ছশো বাইশ নম্বরে থাকে মাসুদ রানা–তার বিরুদ্ধে তোমার একটা কমপ্লেন আছে।

কমপ্লেইন্ট? অবাক হয়ে চাইল লোকটা রানার মুখের দিকে। কিসের কমপ্লেইন্ট?

 নালিশটা হচ্ছে এই যে, লোকটা তোমার গাড়ির ইগনিশন কীটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে খালের মধ্যে। কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিদুৎবেগে ইগনিশন কী বের করে নিল রানা। লক থেকে, সাই করে ছুঁড়ে মারল ওটা খালের মাঝ বরাবর। ছপাৎ শব্দ তুলে তলিয়ে গেল চাবিটা। ছানাবড়া হয়ে গেছে লোকটার চোখ। চোখ টিপল। রানা। আর কোনদিন আমাকে অনুসরণ করবার চেষ্টা কোরো না। লোকটা আমি তেমন সুবিধের নই। দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে দ্রুতপায়ে ফিরে এল সে নিজের ট্যাক্সিতে।

মেইন রোডে উঠে এসে আবার থামতে বলল রানা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে। পাওনা চুকিয়ে দিয়ে বলল, ভাবছি, হেঁটেই যাব।

 শিফল যাবেন হেঁটে। চোখদুটো কপালে উঠল ড্রাইভারের। কত। কিলোমিটার জানা আছে আপনার?

মাথা ঝাঁকাল রানা জানো তো না কত হাঁটতে পারি ভঙ্গিতে। ট্যাক্সিটা চোখের আড়াল হতেই লাফিয়ে উঠল সে একটা ট্রামে, সোজা গিয়ে নামল ড্যামে। গাঢ় রঙের একটা লম্বা কোট পরে, গাঢ় রঙের একটা স্কার্ফ দিয়ে মাথা– ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে সোহানা ট্রাম শেলটারে। রানার অপেক্ষায়। স্যাৎসেতে, আবহাওয়ায় চুপসে গেছে।

আধঘণ্টা লেট। সময়জ্ঞান কবে হবে তোমার, রানা?

বসকে ক্রিটিসাইজ করতে নেই, সোহানা। হাঁটতে শুরু করল রানা।

রানার পাশাপাশি এগোল সোহানা। গতরাতে ছাইরঙা লোকটাকে অনুসরণ করে যে পথে গিয়েছিল সেই পথ ধরে এগোল ওরা। ক্র্যাসনাপোলস্কি। হোটেলের পাশ দিয়ে, আউডেজি ভুর্বার্গোয়াল খালের ধার ঘেষে সারি সারি। ওয়েরহাউজ ঠাসা পুরানো শহরের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ হেঁটে হঠাৎ রানার হাত ধরল সোহানা, মুখের দিকে চাইল।

তোমাকে এত ভয় পেতে আগে কোনদিন দেখিনি আমি, রানা।

তাই নাকি? কি করে বুঝলে যে ভয় পেয়েছি?

তোমার গোপনীয়তা দেখে। সাবধানতা দেখে।

আগে খুব অসাবধান ছিলাম বুঝি?

সোহানা বুঝল, এই লাইনে কথা এগোবে না, কাজেই সরাসরি প্রশ্ন। করল, কতদূর এগোলে? কি করে বেড়াচ্ছ দিন রাত? দেখা নেই কেন? মারিয়া বলছিল, আমাদের মানুষ বলে গণ্য করো না তুমি, দাবার ঘুটির মত ব্যবহার করছ। আমারও তাই মনে হচ্ছে এখন। তুমি বদলে গেছ, রানা।

তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ একটু কম রাখছি, এটা বলতে পারো। কিন্তু তোমাদের মানুষ বলে গণ্য করি না, দাবার খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছি,

এসব একটু বাড়াবাড়িই মনে হচ্ছে আমার কাছে। কোন রকম দুর্ব্যবহার…

না। তোমার ব্যবহার সম্পর্কে কারও কোন নালিশ নেই। নালিশ দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে। কাজ করতে এসেছি আমরা এখানে–কিন্তু কাল বিকেল। থেকে আজ সন্ধে পর্যন্ত পচা এক হোটেলে বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কি কাজ করেছি আমরা? কাজ কতটা হয়েছে, কতটা বাকি আছে, কিছুই জানি না কেন আমরা?

আমিই কি জানি? হাসল রানা। দেখো, সোহানা, এখানে এক জঘন্য, অপ্রীতিকর কাজ নিয়ে এসেছি আমরা। প্রতিপক্ষ সম্পর্কে পরিষ্কার কোন ধারণা। নেই আমাদের। অথচ আমাদের আগাপাশতলা সবই জেনে গেছে। শত্রুপক্ষ। তোমাদের কথা জানি না, কিন্তু আমার সম্পর্কে সব কিছু ওদের। কাছে জলের মত পরিষ্কার। এই অবস্থায় কাজ করা কতটা মুশকিল তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। ভয়ও পেয়েছি আমি এই জন্যেই। আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে কতটা শক্তি ধরে ওরা। মানে মানে কেটে না পড়লে আমার কপালে কি ঘটবে সেটা জানাতেও কসুর করেনি। এই অবস্থায় তোমাদের দূরে সরিয়ে না রেখে বুকের কাছে টানলেই কি ভাল হত?

তাই বলে কি ঘটছে সেটা জানবারও অধিকার নেই নাকি আমাদের?

আছে। সময় হলেই সব জানতে পারবে। আগেই যদি হার্টফেল করে। বসো, কাজের অসুবিধে হবে আমার।

অর্থাৎ, আমাদের দিয়েও কাজ আছে?

নিশ্চয়ই। কাজ না থাকলে এখন কোথায় চলেছ? অভিসারে?

ভলেনহোভেন কোম্পানীর গলিটায় ঢুকল ওরা। গত কালকের মতই নির্জন। তেমনি ছমছমে একটা ভাব। রাস্তার দুপাশে দাঁড়ানো সারি সারি উঁচু বাড়ির মাথাগুলো মনে হচ্ছে আরও কাছে চলে এসেছে আজ, আগামীকাল এই সময় নাগাদ লেগে যাবে একটার সঙ্গে আরেকটা। পায়ের তলায়। কাকরগুলোও আজ যেন কড়মড় করছে একটু বেশি বেশি।

নিশ্চিন্ত মনে চলতে চলতে হঠাৎ আৎকে ওঠা ঘোড়ার মত থমকে দাঁড়াল। সোহানা, খপ করে চেপে ধরল রানার হাত। বিস্ফারিত চোখে ওপর দিকে চেয়ে রয়েছে সে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে রানা দেখল, ডাইনীর নখের মত দেখাচ্ছে সারবাধা পাঁচতলা দালানগুলোর মাথার হয়েস্টিং বীমগুলোকে। ওপরে আকাশ-বীমগুলোর সিলুয়েট দেখে মনে হচ্ছে অশুভ কিছু।

পৌঁছে গিয়েছি। ফিসফিস করে বলল সোহানা। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, এসে গেছি আমরা ঠিক জায়গায়।

মেয়েদের থাকে এই ক্ষমতা, জানে রানা, তবু অবাক হলো সে সাহানার। অশুভকে অনুভব করার ক্ষমতা দেখে। অনেক কিছুই বুঝে ফেলে ওরা আগে থেকে। কিন্তু এখন ওসব পাত্তা দিলে চলবে না। সহজ কণ্ঠে বলল সে, এসে তো গেছিই। তাই বলে অমন কুঁকড়ে যাওয়ার কি আছে?

এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিল সোহানা। পছন্দ হয়নি রানার স্বরে টিটকারির ভাবটা। কিন্তু রানা যখন আবার হাতটা তুলে নিয়ে বুকের কাছে চেপে ধরল, বাধা দিল না।

কেমন যেন গা ছমছম ভাব এই গলিটায়। ওই বিদঘুটে জিনিসগুলো কি?

ওগুলো হয়েস্টিং বীম। আগেকার দিনে বাড়ির সামনেটা কতখানি চওড়া, তাই দেখে ট্যাক্স ধরা হত। কৃপণ ডাচরা তাই সরু করে বানাত বাড়ি। ফলে ওপরতলায় ওঠার সিঁড়িটাও চিকন রাখতে হত–ভারী জিনিস ওই সিঁড়ি দিয়ে। ওঠানো নামানো যায় না। তাই বড়সড় জিনিসের জন্যে এই হয়েস্টিং বীমের ব্যবস্থা। ধরো, একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো তুলতে হবে ওপরে, কিংবা কফিন নামাতে হবে

চুপ করো! কাঁধ দুটো একটু উঁচু করে শিউরে উঠল সোহানা। এটা ভয়ঙ্কর এক জায়গা। মনে হচ্ছে মরণের হাতছানি টের পাচ্ছি আমি এখানে। এ কোথায় নিয়ে এলে তুমি আমাকে? রানার মুখের দিকে চাইল, কক্সবাজারের সেই ডক্টর শিকদারের কথা মনে আছে? সেই রকম অশুভ প্রেতাত্মার ছায়া দেখতে পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে।

ব্যাপারটা হালকা করবার চেষ্টা করল রানা। শিকদারের ভয়ে আমার। সাথে কি করেছিলে, সেসব মনে হচ্ছে না?

আমি করেছিলাম?–না তুমি জোর করে হেসে ফেলল সোহানা, পরমুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেল। ঠাট্টা নয়, রানা। তুমি কিছু অনুভব করতে পারছ না? এ গলির আনাচে কানাচে দেখতে পাচ্ছ না মৃত্যুর কালো ছায়া?

না। পাচ্ছি না। কঠিন সুরে বলল রানা। মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে এদিকে, যে শিরশির করে শীতল একটা ভয়ের যোত ওঠানামা শুরু করেছে, বুকের ভিতর গুড়গুড় করছে বিপদের আশঙ্কা, সেকথা ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দিল না সে সোহানাকে। গভীর কণ্ঠে বলল, এসব আজগুবি কল্পনাকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হচ্ছে না, সোহানা। চলো, এগোনো যাক।

আজগুবি কল্পনা! ভয়ানক ভাবে শিউরে উঠল সোহানা একবার। বেত পাতার মত থির থির করে কাঁপছে ওর সর্বাঙ্গ। কয়েক পা এগিয়ে বলল, কল্পনা নয় রানা, আমি মনের ভেতর থেকে অনুভব করতে পারছি। এই ভয়ঙ্কর গলিতে আমাদের না ঢুকলেই কি নয়?

থমকে দাঁড়াল রানা। যে রাস্তায় এসেছ সেটা চিনতে পারবে? অবাক হয়ে মাথা ঝাঁকাল সোহানাপারবে। রানা বলল, ভেরি গুড। সোজা। হোটেলে ফিরে যাও। পরে দেখা করব আমি তোমার সাথে।

হোটেলে ফিরে যাব? রানা যে ঠিক কি বলছে এখনও বুঝতে পারেনি সোহানা। মানে?

হোটেলে ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করো আমার জন্যে। কোন চিন্তা নেই, তোমার ভূতেরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। যাও, রওয়ানা হয়ে যাও।

ঝট করে একটানে হাতটা ছাড়িয়ে নিল সোহানা রানার হাতের নিচ থেকে। রানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই হাতে ওর কোটের দুই কলার। ধরল। পাগলের মত আঁকাবার চেষ্টা করছে সে রানাকে কলার ধরে। বহুবার। বহু ঝগড়া হয়েছে, কিন্তু সোহানার এমন রুদ্রমূর্তি আগে কোনদিন দেখেনি রানা। ভয়ডর কোথায় উড়ে গেছে তার পাত্তা নেই, এখন কাঁপছে রাগে। আঙুলের গিটগুলো সাদা হয়ে গেছে প্রাণপণ শক্তিতে কলার চেপে ধরায়।

 খবরদার। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সোহানা। আর কোনদিন এ ধরনের কথা বলবে না আমাকে।

রানা বুঝল, অপমানিত বোধ করেছে সোহানা ওর কথায়। এখন ওর। মেজাজের গোড়ায় বারুদ ধরা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মৃদুহেসে বলল, ঠিক আছে, আর কোনদিন বলব না।

আচ্ছা। রানার কুঁচকে যাওয়া কলার ছেড়ে দিয়ে ওটাকে সোজা করবার চেষ্টা করল সে হাত বুলিয়ে। মুহূর্তে পানি হয়ে গেছে ওর রাগ। সহজ ভঙ্গিতে খপ করে ওর ডানহাতটা পেঁচিয়ে ধরে টানল সামনের দিকে। ঠিক আছে, চলো এবার। আর…এরকম একটা বাজে ব্যবহার করে বসায় মাফ করে দাও আমাকে। রানার মুখের দিকে চাইল ঘাড় বাকিয়ে। পায়ে ধরতে হবে, না এমনিই মাফ করবে?

আগে শোনা যাক মাফ না করলে কি করবে?

জালাতন করে মারব–শয়নে, স্বপনে।

 শুধু শয়নে করলে চলে না?

তাতে কি লাভ?

তাহলে আর ইমিডিয়েট মাফটাফের মধ্যে না গিয়ে তোমার জন্যে নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করতে পারি আমি বিছানায় শুয়ে।

তোমার ওই এক কথা। ওসব ছাড়া আর কিছু নেই যেন মানুষের জীবনে।

আর কি আছে? শুকনো আদর? ওসবে আমার… গলার স্বর পরিবর্তন। করল রানা। দাঁড়াল। এসে গেছি।

 সাইনবোর্ডটা পড়ল সোহানা মৃদু কণ্ঠে ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানী।

তুমি রাস্তার দুপাশটা লক্ষ রাখো, বলে চার ধাপ সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায়। উঠে পড়ল রানা।

খালি রাস্তাটার দিকে, নাকি

আর আমার পিঠের দিকেও খেয়াল রেখো একটু, কেউ যেন আচমকা ছুরি বসাতে না পারে।

সিঁড়ি দিয়ে দুই ধাপ ওপরে উঠে গলা বাড়িয়ে রাস্তার ওপর চোখ রাখল সোহানা। দুই মিনিটের চেষ্টাতেই খুলে ফেলল রানা দরজাটা। ভিতরে ঢুকে পড়ল দুজন। আবার চাবি মেরে চাবিটা তালার মধ্যেই রেখে দিল রানা। দুজনের হাতে বেরিয়ে এসেছে দুটো টর্চ-বানার হাতেরটা ছোট কিন্তু অত্যন্ত। জোরাল। গোটা একতলায় দেখার মত কিছুই পেল না ওরা। পাশাপাশি তিনটে ঘরে গাদা করা আছে অসংখ্য কাঠের প্যাকিং বাক্স মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত। আর রয়েছে ক্র্যাপ পেপার, কার্ডবোর্ড, খড় এবং বাধাই ও বেলিঙের। যন্ত্রপাতি। মালপত্র প্যাকিং হয় এখানে।

সরু ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলল এবার ওরা। অর্ধেক উঠে ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে চাইল রানা, দেখল সোহানাও তাই করছে, চারপাশে টর্চ বুলিয়ে নিশ্চিত হতে চাইছে যে আর কেউ নেই।

দোতলার প্রথম দুটো ঘর হাজার পদের সুভ্যেনিরে ঠাসা। ডাচ পিউটার, উইন্ডমিল, কুকুর, বাঁশি-হরেক রকমের জিনিসে সাজানো রয়েছে দেয়ালের গায়ে বসানো শেলফ আর ঘরের মাঝামাঝি আড়াআড়ি করে রাখা র‍্যাকে। চারপাশে একবার আবছা ভাবে চোখ বুলিয়ে কোন কিছুই সন্দেহজনক বলে। মনে হলো না রানার কাছে। কিন্তু তৃতীয় ঘরের দরজার সামনে এসেই ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠল ওর। সোহানাকে ডেকে দেখাল দরজাটা।

আশ্চর্য! চোখমুখ বকাল সোহানা। টাইম লক। সাধারণ একটা অফিসের দরজায় টাইম লক কেন?

এর সহজ উত্তর হচ্ছে এটা সাধারণ একটা অফিস দরজা নয়। একটু লক্ষ করলেই বুঝতে পারবে দরজাটা কাঠের নয়-স্টীলের। ডায়মন্ডের গুদাম হলে একটা কথা ছিল, বোঝা যেত–না, স্টীলের দরজার একটা যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু এখানে? কী এমন জিনিস আছে এদের এখানে এত সাবধানে। রাখবার মত?

মনে হচ্ছে ঠিক জায়গায়ই হাজির হয়েছি আমরা, বলল সোহানা।

আমি তোমাকে ভুল জায়গায় নিয়ে যাব এমন সন্দেহ ছিল বুঝি তোমার?

না। তা ছিল না। কিন্তু এই বাড়িটা আসলে কি? কিসের স্টোরহাউজ?

এখনও বুঝতে পারোনি? সুভ্যেনির ব্যবসার হোলসেলার এরা। ফ্যাকটরিই বলো, বা কুটির শিল্পের কারখানাই বলো, প্রস্তুতকারক সরাসরি মাল পাঠিয়ে দেয় এই স্টোরহাউজে, এখান থেকে বিভিন্ন দোকানের অর্ডার। অনুযায়ী যার যা দরকার প্যাকিং করে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সহজ, সরল, নিপাপ, নিষ্কলুষ, আইনসম্মত, পরিষ্কার ব্যবসা।

কিন্তু খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়, বলল সোহানা নাক কুঁচকে।

 অস্বাস্থ্যকর কি পেলে?

বিচ্ছিরি একটা গন্ধ পাচ্ছ না?

ও। ক্যানাবিস।কারও কারও কাছে ক্যানাবিসের গন্ধ খুব খারাপ লাগে।

ক্যানাবিস? কি সেটা?

বেণী বেঁধে স্কুলে যাওয়া-আসা ছাড়া আর কিছুই করোনি জীবনে!.. এপাশ-ওপাশ চাইবার সময় পাওনি। কামন। আপ।

তেতলায় উঠে এল ওরা। কয়েক মিনিট আগেকার তেজ বেমালুম উবে গেছে সোহানার চেহারা থেকে। ফ্যাকাসে মুখে চঞ্চল দৃষ্টি বুলাচ্ছে সে চারপাশে। ক্যানাবিসের গন্ধ আরও বেড়েছে এখানটায়, কিন্তু ঠিক কিসের থেকে আসছে বোঝা গেল না। নিস্তব্ধ এই পুরানো দালানটায় থমথম করছে যেন জঘন্য এক পাপীর প্রেতাত্মা। তিন দেয়ালের তিনটে র‍্যাকে সারি সারি। সাজানো রয়েছে দেয়াল ঘড়ি। ছোট, মাঝারি, বড়-হরেক রকম। বেশিরভাগই সস্তা দরের, পালিশ করা হলুদ পাইনের কাঠামো। কিন্তু দামী ঘডিও রয়েছে বেশ অনেকগুলো। ভাগ্যিস পেন্ডুলামগুলো থেমে রয়েছে; যদি সবকটা চলতে থাকত তাহলে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার দশা হত ওদের। ঘরের চতুর্থ দেয়ালের শেলফে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত দশটা তাক ঠাসা রয়েছে অদ্ভুত এক জিনিসে-বাইবেল। একেক তাকে তিন সারি করে। বাইবেল রাখা। সুভ্যেনির ওয়েরহাউজে বাইবেল কেন, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না রানা। এগিয়ে গিয়ে একটা বের করল টেনে। চামড়ার কাভার, তার ওপর সোনালী অক্ষরে এমবস করা রয়েছে দি গ্যাব্রিয়েল বাইবেল। মলাট ওল্টাতেই দেখা গেল প্রথম পাতায় ছাপার অক্ষরে লেখাউইথ দা কমপ্লিমেন্টস অফ দা ফাস্ট রিফর্মড চার্চ অফ দা অ্যামেরিকান হিউগানট সোসাইটি।

ঠিক এই রকম একটা বাইবেল রয়েছে আমাদের হোটেল কামুরায়, বলল সোহানা।  

মাগনা পেয়েছে, রেখে দিয়েছে হয়তো একটা করে সব ঘরে। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে–এগুলো এখানে কেন? প্রিন্টার বা পাবলিশারের গুদাম হলে এক কথা ছিল, এখানে কি করছে এসব? অদ্ভুত ব্যাপার না?

 এখানকার সব কিছুই বিদঘুটে ঠেকছে আমার কাছে, বলল সোহানী। বেরোতে পারলে বাঁচি। কথাটা বলেই শিউরে উঠল নিজের অজান্তেই।

মৃদু একটা থাবড়া দিল রানা ওর পিঠে। শীত করছে? আরও দুটো তলা বাকি রয়েছে। চলো, এবার থার্ডফ্লোর।

চারতলার পুরোটা জুড়ে শুধু পুতুল আর পুতুল। অসংখ্য। হরেক আকৃতির। একেবারে ছোট থেকে নিয়ে ইরিনের হাতে যেটা ছিল তার চেয়েও বড় পুতুল রয়েছে, অতি যত্নের সাথে অপূর্ব সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে প্রত্যেকটা। নানান রঙের ঝকমকে ডাচ ট্র্যাডিশনাল পোশাক পরানো সব পুতুল। বড়গুলো দাঁড় করানো আছে র‍্যাকের পেছনে একটা দড়ির গায়ে। হেলান দিয়ে, ছোটগুলো ঝুলছে সুতো বাধা অবস্থায়। সবুজ, নীল, খয়েরী। চোখের মিষ্টি সব পুতুল।

সাহসিকা সোহানা একহাতে খামচে ধরে আছে রানার কোটের হাতা। ভয়ে ঈষৎ বিস্ফারিত হয়ে গেছে ওরআয়ত চোখ। ফিসফিস করে বলল, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে শিরশির করছে সারা শরীর। মনে হচ্ছে জ্যান্ত সব পুতুল, লক্ষ করছে আমাদের।

ফিসফিস কররার দরকার নেই, বলল রানা মৃদু হেসে। দেখছে ঠিকই, কিন্তু আমি শিওর, একটা কথাও শুনতে পাচ্ছে না পুতুলগুলো। ঠিক এই রকম কাপড় পরা একটা জ্যান্ত পুতুল দেখেছি আমি আজ সকালে ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের বাসায়। ইরিনের নার্স। এগুলো সব এসেছে যাইডার যীর। হাইলার দ্বীপ থেকে। ইরিনের হাতেও দেখেছি একটা পুতুল, ঠিক এই রকম। শেষের কথাগুলো যেন সোহানাকে নয়, নিজেকেই শোনাবার জন্যে বলল রানা।

ইরিন কে?

অ্যামস্টার্ডামের নারকোটিক্স ব্যুরোর চীফ ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের, পালিতা মেয়ে। ড্রাগ অ্যাডিক্ট।

ইন্সপেক্টরের মেয়ে ড্রাগ অ্যাডিক্ট? কি ব্যাপার ব্ল্যাকমেইল?

মেয়েটার মাধ্যমে পথে আনবার চেষ্টা করছে ওরা মাগেনথেলারকে। গোপনে হেরোইনের ডোজ সাপ্লাই দিচ্ছে ইরিনকে।

রানার হাত ছেড়ে দিয়ে চারপাশে টর্চ বুলাল সোহানা, রানা এগিয়ে গিয়ে মন দিল একটা পুতুল পরীক্ষায়। হঠাৎ দ্রুত শ্বাস টানবার শব্দে ঝট করে পেছন। ফিরল সে। দেখল, পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সোহানা, টর্চের আলোটা ধরা আছে একটা র‍্যাকের গোটা কয়েক পুতুলের দিকে। ধীর, নিঃশব্দ পায়ে পিছিয়ে আসছে সে রানার দিকে, চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে রয়েছে টর্চের আলোয়। আলোকিত জায়গাটার ওপর, পেছনে হাঁটছে আর বাম হাতে খুঁজছে সে রানাকে। কাছে আসতেই ধরল রানা হাতটা, মৃদু চাপ দিল। দৃষ্টিটা সরাল না। সোহানা রানার স্পর্শ পেয়েও। রানা টের পেল প্রবল বেগে কাঁপছে ওর হাতটা।

 চাপা, উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সোহানা, একটা লোক! রানা! লক্ষ করছে আমাদের!

আলোকিত র‍্যাকের দিকে চাইল রানা, সঙ্গে সঙ্গেই চোখ সরিয়ে নিল। সোহানার হাত ধরে টেনে ওকে নিজের দিকে ফেরাল। চোখ ফেরাতে পারছিল না সোহানা র‍্যাকের ওপর থেকে, বহুকষ্টে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল সে রানার দিকে–যেন সম্মোহনের প্রভাব কাটিয়ে উঠল। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইল। রানা ওর চোখের দিকে। কি ব্যাপার? হোয়াটস দা ম্যাটার?

আমি দেখেছি! নিজের চোখে দেখেছি! ভয়ে দেড়গুণ বড় হয়ে গিয়েছে। ওর আয়ত চোখ।

কি দেখেছ?

 একজোড়া চোখ! র‍্যাকের ওপাশে!

অবিশ্বাসের প্রশ্নই আসে না, সোহানা যে ভুল দেখেনি সে ব্যাপারেও রানা স্থির নিশ্চিত–কারণ, যত কল্পনাপ্রবণ মেয়েই হোক, কঠোর ট্রেনিং পেয়েছে সে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স থেকে অবজার্ভেশনের সঙ্গে ইমাজিনেশন না মেশাবার ব্যাপারে। হাতের উজ্জল টর্চটা ধরল রানা র‍্যাকের দিকে, অসাবধানে সোহানার চোখে লেগে গেল আলোটা মুহূর্তের জন্যে, চোখ ধাধিয়ে যাওয়ায় চট করে একটা হাত তুলল সে চোখে। কোন মানুষ বা তার চোখ দেখতে পেল না রানা, কিন্তু যেটুকু দেখতে পেল তাতেই বুঝে নিল। সে যা বোঝার। ঘরে দমকা তো দূরের কথা, মৃদু হাওয়া ঢুকবারও কোন ব্যবস্থা নেই–অথচ দুটো পুতুল দুলছে অল্প অল্প; এতই সামান্য, যে ভাল করে লক্ষ না করলে ঠাহর করা যায় না।

সোহানার হাতে মৃদু চাপ দিল রানা। হাসল মিষ্টি করে। দেখো, সোহানা–

বিশ্বাস করছ না তুমি? আমি দেখেছি। ভয়ঙ্কর একজোড়া চোখ! কসম খেয়ে বলতে পারি-সত্যিই দেখেছি আমি।

অফকোর্স ইউ স দেম, সোহানা। সন্দেহ তো করছি না। নো ডাউট অ্যাবাউট ইট। বলল রানা, কিন্তু এমন সুরে বলল যে পাই করে ঘুরল সোহানা ওর দিকে। মর্মাহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে কয়েক সেকেন্ড রানার মুখের দিকে, যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না সে, এই রকম একটা অবস্থায়। ওকে নিয়ে ঠাট্টা তামাসা করতে পারে রানার মত দায়িত্বশীল এক লোক। একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে সে রানার ব্যবহার দেখে।; একই সুরে রানা। বলল, আই বিলিভ ইউ, সোহানা। ঠিকই দেখেছ তুমি–অবিশ্বাস করছি না।

বিশ্বাস করার নমুনা কি এই? রেগে গেল সে। কিছু করছ না কেন। তাহলে?

করছি না কেন বললে? আবার হাসল রানা। আই অ্যাম গেটিং দা হেল আউট অভ হিয়ার। সোজা বাংলায় ভাগছি। যেন কিছুই ঘটেনি, এমনি ভঙ্গিতে সারা ঘরে একবার টর্চটা বুলিয়ে নিয়ে বাম হাতে সোহানার পিঠ জড়িয়ে ধরল রানা। চলো, কেটে পড়া যাক। দেখার মত কিছুই নেই। এখানে। গলা শুকিয়ে গেছে আমার–একটা ড্রিঙ্ক না হলে আর চলছে না। এখানকার এই ভৌতিক পরিবেশ নার্ভাস করে ফেলেছে আমাকেও।

 এক ঝটকায় রানার হাত সরিয়ে দিল সোহানা। ওর মুখে রাগ, দুঃখ আর। হতাশা দেখতে পেল রানা। ওকে নিয়ে ঠাট্টা করায় এবং ওর কথা বিশ্বাস না। করায় একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছে সে। মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু…রানা, আমি যে বলছি…

চুক চুক শব্দ করল রানা জিভ দিয়ে, তারপর ঠোঁটের উপর আঙুল রাখল। একটা। আর কোন কথা নয়। মনে রেখো, আমি যাহা জানি, তুমি জানো না…বস অলওয়েজ নোজ বেস্ট। চলো, এগোও।

কয়েক সেকেন্ড দুই চোখ দিয়ে আগুন ঝরল সোহানার, তাতে যখন, রানাকে ভস্ম করা গেল না তখন বুঝতে পারল এই লোকের সঙ্গে কথা বলে। কোন লাভ নেই, ঝট করে ঘুরে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দুমদাম পা ফেলে নামতে শুরু করল নিচে। পেছন পেছন নামছে রানা–প্রথম পনেরোটা ধাপ নামতে নামতেই চিকন ঘাম দেখা দিল ওর কপালে, ভয়ের শীতল হোত বইল শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে বারকয়েক ওপর থেকে নিচে, নিচে থেকে ওপরে। একেবারে নিচতলায় নেমে সদর দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে তালা না মারা। পর্যন্ত থামল না শিরশিরানি।

দ্রুতপায়ে ফিরে চলল ওরা মেইন রোডের দিকে। সোহানার হাত ধরবার। চেষ্টা করে বিফল হলো রানা। তিনহাত তফাতে হাঁটছে সে, মাঝে মাঝে। চোখের কাছে হাত তুলতে দেখে আন্দাজ করল হয়তো কাঁদছে ও। গজ পঞ্চাশেক চুপচাপ হেঁটে খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করল রানা।

যে লোক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পশ্চাদপসারণ করতে পারে সে আরেকবার যুদ্ধের সুযোগ পায়। মেজর জেনারেল রাহাত খানের সুপরিচিত কোটেশন ঝাড়ল রানা, কিন্তু কোনই ফল হলো না তাতে। রাগে ফুঁসছে সোহনা।

দয়া করে আমার সঙ্গে কথা বোলো না তুমি। গলার স্বর কাঁপছে আবেগে।

অবস্থা বেগতিক দেখে চুপ হয়ে গেল রানা। কিন্তু বেশ কিছুদূর হাঁটবার পর যেই একটা পাবৃ দেখতে পেল, খপ করে ধরে ফেলল সে সোহানার হাত, টেনে নিয়ে ঢুকে পড়ল ভিতরে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঢুকতে হলো সোহানাকে, নইলে সীন ক্রিয়েট করতে হয়।

সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রায়ান্ধকার এক ড্রিঙ্কিং ডেন। জনাকয়েক সেইলার যার যেমন খুশি একেবেঁকে, কেউ আবার টেবিলের ওপর পা তুলে বসে ছিল গ্লাস সামনে নিয়ে, মহিলাসহ রানাকে ঢুকতে দেখে সোজা হয়ে বসল, শান্তি। ভঙ্গ করায় আহত দৃষ্টিতে চাইল রানার দিকে। কারও দৃষ্টির কোন তোয়াক্কা না করে সোহানাকে নিয়ে কোণের এক টেবিলে গিয়ে বসল রানা। টেবিলটা দেখে মনে হচ্ছে যোড়শ শতাব্দীর অ্যান্টিক–জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত– সাবান বা পানির সঙ্গে কোন সংশ্রব ঘটেনি তার।

আমি স্কচ খাব। তুমি?

স্কচ। নির্বিকার কণ্ঠে বলল সোহানা।

তুমি না স্কচ খাও না?

আজ খাব।

বেপরোয়া ভঙ্গিতে গ্লাসের অর্ধেকটা একঢোকে খাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে কাশতে শুরু করল সোহানা ভড়কে গিয়ে। চোখমুখ লাল হয়ে উঠতে দেখে গোটা কয়েক থাবড়া দিল রানা ওর পিঠে।

হাত সরাও।গা ঝাড়া দিল সোহানা। খবরদার, ছোবে না তুমি আমাকে!

অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে নিজের গ্লাসে মন দিল রানা।

তোমার সঙ্গে কাজ করবার শখ মিটে গেছে আমার, রানা। কান ফিরে যাচ্ছি আমি। গলাটা আবার নিজের আয়ত্তে আসতেই ঘোষণা কম। সোহানা। কালই ফিরে যাব আমি ঢাকায়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আমার ওপর যার আস্থা নেই, যে আমাকে বিশ্বাস করে না, এমন। লোকের সঙ্গে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষ বলে গণ্য করো না তুমি আমাদের। এতটা তাচ্ছিল্য সহ্য করে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কেউ তোমার সঙ্গে কাজ করতে পারবে না।

আমি তোমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করিনি, সোহানা-অমানুষ বলেও গণ্য করিনি, অবিশ্বাসও করিনি, অনাস্থাও প্রকাশ করিনি। সহজ সহজ কণ্ঠেলল রানা।

অফকোর্স ইউ স দেম, সোহানা, তিক্তকণ্ঠে রানার বাচনভঙ্গি আর। রানার গলার সুর নকল করে ভ্যাংচাল সোহানা। আই বিলিভ ইউ, সোহানা। অবিশ্বাস করছি না। ইউ ডোন্ট বিলিভ মি অ্যাটল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ঠাট্টার পাত্রী আমি তোমার। আমাকে টিটকারি মেরে তুমি নিজেকে…

না, সোহানা। মাথা নাড়ল রানা। সত্যিই বিশ্বাস করেছিলাম আমি তোমার কথা। সত্যিই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল আমার। কসম খোদার। বিশ্বাস করেছিলাম বলেই মানে মানে কেটে পড়েছি ওখান থেকে।

অবাক হয়ে চেয়ে রইল সোহানা কয়েক সেকেন্ড রানার মুখের দিকে। বিশ্বাস করেছিলে…তাহলে, তাহলে কেন–

কেন তাড়া করে ধরলাম না ওকে? কারণটা পানির মত সহজ। একটু সামনে ঝুঁকে এল রানা। সত্যিই ওই র‍্যাকের পেছনে লুকিয়ে ছিল একজন লোক। চোখ দেখতে পাইনি, কিন্তু দুটো পুতুলকে সামান্য দুলতে দেখেছি আমি। র‍্যাকটার আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ রেখেছিল লোকটা আমাদের ওপর, দেখছিল আমরা কোন তথ্য প্রমাণ পেয়ে যাই কিনা। আমাদের খুন করবার কোন ইচ্ছে লোকটার ছিল বলে মনে হয় না। থাকলে সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়েই গুলি করতে পারত। কিন্তু তোমার কথামত যদি আমি লোকটাকে খুঁজে বের করবার চেষ্টা করতাম, তাহলে অবধারিতভাবে কি ঘটত কল্পনা। করতে পারো? গুলি করা ছাড়া গত্যন্তর থাকত না ওর আর। লোকটা ঠিক কোন্ জায়গাটায় আছে সেটা বুঝে ওঠার আগেই গুলি খেতে হত আমার। আমাকে খুন করে খুনের সাক্ষী হিসেবে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখত না সে কিছুতেই। বিশ্বাস করো, তোমাকেও মরতে হত ওখানেই। এখন তোমার প্রেম করবার বয়স, হুট করে মরে যাওয়াটা কি উচিত হত? বলো? আর একটা কাজ করা যেত যদি তুমি ওখানে না থাকতে…ওর সাথে লুকোচুরি খেলে ওকে। কাবু করবার চেষ্টা করতে পারতাম আমি। কিন্তু তুমি ছিলে ওখানে মস্ত বড় বাধা হিসেবে। পিস্তল নেই তোমার কাছে, এ ধরনের নোংরা খুনোখুনির অভিজ্ঞতা নেই–কাজেই ভাবলাম এসবের মধ্যে তোমাকে না জড়ানোই ভাল। কাজেই, তোমাকে টিটকারি দিইনি আসলে আমি, ওই লোকটাকে। বোঝাবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম যে তোমার কথা একেবারেই বিশ্বাস। করিনি আমি, কাজেই খোঁজাখুঁজিও করব না। সেই সময়েই ইংরেজি বুলি ছুটে গিয়েছিল আমার মুখ দিয়ে, লক্ষ্য করোনি? ওর সাথে কথা বলছিলাম আমি। আসলে। ওকে কোনমতে একটা কিছু বুঝ দিয়ে মানে মানে কেটে পড়বার তালে ছিলাম। বোঝা গেল? কেমন লাগল বক্তৃতাটা? চমৎকার না?

সত্যিই চমৎকার। দেখতে দেখতে টলটলে দুফোঁটা পানি দেখা দিল সোহানার অপূর্ব সুন্দর চোখে। আমার জন্যে…শুধু আমার জন্যে তুমি…অথচ ভুল বুঝে আমি তোমাকে টপ করে টেবিলের ওপর পড়ল দুফোঁটা পানি, আরও দুফোঁটা ম্যানুফ্যাকচার হচ্ছে। কাঁপা শ্বাস টানল সোহানা। সেজন্যেই সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আমার আগে আগে উঠেছ তুমি, নামার সময় নেমেছ পিছু পিছু–গুলি যদি করে, যেন তোমার ওপর দিয়েই যায়। টেবিলের ওপর রানার একটা হাত চেপে ধরল সোহানা। আমি তোমার। যোগ্য নই রানা। তোমাকে বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে। আমি জানি, কোনদিন তল পাব না আমি তোমার।

দি এন্ড। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল এক সেইলার। তারপর নাকে টোকা দিয়ে। পিড়িং পিড়িং ডাচ,জাতীয় সঙ্গীত বাজাতে শুরু করল। হুড়মুড় করে সব কজন। উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। অর্থাৎ, সিনেমা শেষ! কান্নার মধ্যে দিয়ে মিলন হয়েছে নায়ক নায়িকার।

হেসে ফেলল রানা ও সোহানা একসাথে এতক্ষণ যে গভীর মনোযোগের সাথে ওদের নাটক দেখছিল সবাই, টের পেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল সোহানার দুই গাল। এক ঢোকে নিজের স্কচ শেষ করে, আধ ঢেকে সোহানারটুকুও নামিয়ে দিল রানা গলা গিয়ে, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে দর্শকদের উদ্দেশে বো করে বলল, নাড জেন্টলমেন, দা শো ইজ ওভার। ইউ হ্যাভ টু পে ফর দা ড্রিঙ্কস্।

হৈ হৈ করে হাসির হুল্লোড় তুলল নাবিকরা, চার-পাঁচজন একসাথে পকেটে হাত দিল রানাদের ড্রিঙ্কসের বিল দেয়ার জন্যে। হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল ওরা পাব থেকে।

হোটেলের দোরগোড়ায় হঠাৎ দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে চুমো খেলো সোহানা রানাকে। কানের কাছে নরম গলায় বলল, মাফ করেছ?

না তো! অবাক হওয়ার ভান করল রানা। এখন কি? সে সব তো ফয়সালা হবে শয়নে।

অসভ্য। বলেই হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে চলে গেল সোহানা হোটেলের ভিতর।

« পূর্ববর্তী:
« ১.৩-৪ টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে
পরবর্তী: »
১.৭-৮ অলিগলি বেয়ে সোহানার হোটেল »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি – জোক্স – লিরিক – রেসিপি – কামসূত্র – হেলথ – PDF

Return to top