প্রবেশ নিষেধ ১

মাসুদ রানা ৪৪ – প্রবেশ নিষেধ ১ – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর, ১৯৭৫

০১.

বিশাল ডানা মেলে কে এল এম ডিসি এইট নেমে এল শিফল এয়ারপোর্টের রানওয়ের ওপর, মাইল দেড়েক দৌড়ে গতিটা একটু সামলে নিয়ে ধীরে সুস্থে। এসে দাঁড়াল এয়ারপোর্টের টারমিনাল বিল্ডিং ঘেঁষে। শেষবারের মত ছোট্ট গর্জন ছেড়ে বন্ধ হয়ে গেল এঞ্জিন।

সবার আগে সিটবেল্ট খুলে উঠে দাঁড়াল রানা। সোহানা চৌধুরী এবং তার পাশে বসা, তারই মত চোখা সুন্দরী মারিয়া ডুকুজের দিকে একটি বারও না চেয়ে হালকা এয়ার ব্যাগটা কাঁধে বুলিয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল সে এগজিট লেখা দরজার দিকে। যেন চেনেই না ওদের।

 স্টুয়ার্ডেসের মিষ্টি হাসির প্রত্যুত্তরে যতটা না হাসলেই নয় সেটুকু হেসে ডিজএমবাকেশন টিউবে উঠে পড়ল রানা। হাসি আসছে না ওর। কয়েকটা দুশ্চিন্তা এক সঙ্গে ঘুরছে মাথার মধ্যে। প্রথমত, সোহানা এবং মারিয়া এই দুই বোঝা দুই কাঁধে চেপে যাওয়ায় যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে সে মনে মনে, কিন্তু কিছুই বলার উপায় নেই-একজনকে চাপিয়েছেন বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কর্ণধার মেজর জেনারেল রাহাত খান, অপরজনকে ইন্টারপোলের নার্কোটিকস ডিভিশনের কট্টর চীফ ফিলিপ কাটারেট। এরা মনে করেছেন রানার এবারের বিপজ্জনক অ্যাসাইনমেন্টে ডাইভার্শন তৈরি। করতে হলে দুজন মেয়েকে সাথে নিয়ে যাওয়া ওর একান্ত দরকার। দুই সুন্দরীই জীবনের প্রথম পা রাখছে অ্যামস্টার্ডামের মাটিতে। প্রতি পদে কাজে বাধার সৃষ্টি করবে এরা, সুবিধের চেয়ে অসুবিধে যে কত বেশি হবে নিজে বুঝতে পারছে রানা পরিষ্কার, কিন্তু কিছুতেই বোঝাতে পারেনি সে দুই বুড়োর একজনকেও। এদের দুজনই কাজ করছে ড্রাগসের ওপর বেশ কয়েক বছর। ধরে, তথ্যের দিক থেকে এরা একেকজন তিনটে মাসুদ রানার সমান জ্ঞান। রাখে। কিন্তু ভয়ঙ্কর, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়াতে হলে জ্ঞান••• যাকগে, মেনে যখন নিতেই হবে, মেনে নিয়েছে রানা–আসল কাজের সময় এদের কিভাবে দূরে সরিয়ে রাখবে সে প্ল্যানও ঠিক করে নিয়েছে আগেই; আসল দুশ্চিন্তা এরা নয়, ইসমাইলের পাঠানো কোডেড মেসেজটা। রওয়ানা হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে পেয়েছে মেসেজ বিশেষ জরুরী কিছু তথ্য নিয়ে। অপেক্ষা করবে ইসমাইল শিফল এয়ারপোর্টে। মাটি স্পর্শ করবার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো নাকি রানার দরকার, এবং সেই তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুত। পরিবর্তন করা দরকার প্ল্যান-প্রোগ্রাম। এই রকম একটা মেসেজের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনি রানা, তবে এর মধ্যে একটা জরুরী ভাব যে রয়েছে সেটা অনুভব করতে অসুবিধে হয়নি ওর। কি আবার ঘটল এখানে যার জন্যে, বারণ সত্ত্বেও এইভাবে এয়ারপোর্টে দেখা করতে চাইছে ইসমাইল ওর সঙ্গে? এইভাবে রানাকে এক্সপোজ করে দেয়ার ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে কেন লোকটা?

ইসমাইলের যোগ্যতা সম্পর্কে কোন রকমের কোন সন্দেহ নেই রানার। ঘুঘু লোক সে। গত তিনটে, মাস ধরে কাজ করছে সে অ্যামস্টার্ডামে রানার সুবিধের জন্যে কিছুটা গ্রাউন্ডওয়ার্ক করে রাখবার জন্যে। একটা মাস চুপচাপ থেকে হঠাৎ কি এমন জরুরী তথ্য পেয়ে গেল লোকটা যে গোপনীয়তার ইম্পাদৃঢ় নিয়ম ভঙ্গ করবার দরকার হয়ে পড়ল ওর? যোগ্যতা আছে ঠিকই, কিন্তু ভুলও তো মানুষের হয়রানার ভয়টা ওখানেই। এই লাইনে সামান্য কোন ভুল যে কত মারাত্মক হয়ে দাঁড়াতে পারে, ভাল করেই জানা আছে ওর।

কোরাগেটেড ডিজএমবার্কেশন টিউব ধরে এগিয়ে চলেছে রানা টার্মিনাল ফ্লোরের দিকে। দুটো চলন্ত প্ল্যাটফর্ম দেখতে পেল সে সামনে-ইমিগ্রেশন থেকে একটা এদিকে আসছে, আরেকটা এদিক থেকে চলেছে ইমিগ্রেশনের। দিকে। ওদিক থেকে যে প্ল্যাটফর্মটা এদিকে আসছে সেটার এদিকের মাথায় রানার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাঝারি উচ্চতার এক শুকনো-পাতলা নিষ্ঠুর চেহারার লোক। মাথায় ঘন কালো চুল, মুখে বয়সের ভাজ খুব সম্ভব চুলগুলো কালো করা হয়েছে ডাই করে। দুই চোখের নিচে ফুলে আছে দুটো থলে। কালো একটা স্যুটের ওপর কালো ওভারকোট চাপানো, হাতে একটা সদ্য-কেনা এয়ারব্যাগ। এক নজরেই অপছন্দ হলো রানার লোকটাকে। মনে মনে ঠিক করল, এই ধরনের লোকের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবে না সে কোনদিন অবশ্য, যদি কোনদিন তার মেয়ে হয়।

বেশ অনেকটা কাছে এসে রানা দেখতে পেল, ইমিগ্রেশনের দিক থেকে প্ল্যাটফর্মে চড়ে জনা চারেক লোক আসছে এইদিকে। সবার আগে ছাইরঙা স্যুট পরা দীর্ঘ, একহারা লোকটাকে দেখেই চিনতে পারল সে-ইসমাইল! অবাক হলো রানা লোকটার অস্থিরতা দেখে। এখানে এল কি করে? ইমিগ্রেশন ডিঙিয়ে এতদূর আসতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ইসমাইলকে। ব্যাপারটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ না হলে এত কষ্ট করতে যেত না সে। এতই জরুরী, যে বাইরে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবার ধৈর্য নেই, চলে এসেছে ভিতরে, একেবারে প্লেনের গায়ের কাছে ব্যাপার কি?

রানাকে দেখেই একগাল হেসে হাত নাড়ল ইসমাইল, রানাও হাত। নীড়ল-কিন্তু কেন যেন পলকের জন্যে কালো একটা অশুভ ছায়া পড়ল ওর। মনের আয়নায়। মুহূর্তে মিলিয়ে গেল ওর মুখের হাসি। কেন ব্যাপারটা ঘটল, কি দেখে কি বুঝল সে, কিছুই বলতে পারবে না রানা, কিন্তু মুহূর্তে সজাগ সতর্ক হয়ে উঠল ওর চোখ কান।

 ইসমাইলের চোখের দৃষ্টি সামান্য একটু বাঁকা হতেই ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে নিষ্ঠুর লোকটাকে দেখল সে আবার। লোকটা এখন আর রানার দিকে মুখ করে নেই, একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়িয়েছে ইসমাইলের মুখোমুখি। এয়ারব্যাগটা এখন আর লোকটার হাতে ঝুলছে না, অদ্ভুত ভঙ্গিতে ধরা আছে। বগলের নিচে। চট করে ইসমাইলের মুখের দিকে চেয়ে ভীতি দেখতে পেল। রানা, এবং পরিষ্কার ভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝাঁপ দিল সামনের দিকে।

চোখের পলকে ঘটে গেল কয়েকটা ঘটনা। প্রস্তুত ছিল লোকটা। রানা ঝাঁপ দিতেই সাই করে ব্যাগটা ঘুরিয়ে মারল সে রানার নাভীর ছয় ইঞ্চি ওপরে, সোলার প্লেকসাসে। এয়ারব্যাগ সাধারণত নরম হয়, কিন্তু এটা সেরকম না–অত্যন্ত শক্ত কিছু জিনিসের প্রচণ্ড গুতো খেয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল রানা। তীব্র ব্যথায় গোঙাবার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলল সে। জ্ঞান হারাল না, কিন্তু সারা শরীর অসাড় অবশ হয়ে গেল ওর মুহূর্তে। দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু চোখ ছাড়া আর কিছু নড়াবার ক্ষমতা নেই।

পরবর্তী কয়েকটা সেকেন্ড রানার মনে হলো যেন সো মোশন ছায়াছবি দেখছে। চারপাশে চাইল আতঙ্কিত ইসমাইল, কিন্তু পালাবার পথ পেল না। কোনদিকে। তিনজন লোক, যেন কি ঘটতে চলেছে কিছুই টের পায়নি, দাঁড়িয়ে রয়েছে ইসমাইলের পিছনে। পিছনে পালাবার রাস্তা নেই। সামনে। নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগোনো ছাড়া আর কোন পথ নেই ইসমাইলের।

এদিকে এয়ারব্যাগের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা কালো নলের মাখা। চিনতে পারল রানা-সাইলেন্সর সিলিন্ডার। এরই গুতোয় অবশ হয়ে। গেছে ওর সর্বশরীর। উঠে বসবার চেষ্টা করল সে, পারল না। লোকটার ডান হাত এয়ারব্যাগের মধ্যে। আর একটু উঁচু হলো হাতটা। মুখের ভাবে কোন। পরিবর্তন নেই, ধীরে সুস্থে ঠাণ্ডা মাথায় কাজটা করবে বলে বাড়ি থেকে স্থির। করে এসেছে যেন লোকটা। প্রফেশনাল।

মড়ার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ইসমাইলের মুখটা। কি ঘটতে চলেছে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে সে। চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে আছে ভয়ে, কিন্তু তারই মধ্যে ডান হাতটা চলে গেল ওর কোটের ভিতর। পিছনের তিনজন লোক ঝপ করে বসে পড়ল একসঙ্গে। পরমুহূর্তে হাতটা বের করে আনল। ইসমাইল কোটের ভিতর থেকে, হাতে পিস্তল। ঠিক সেই সময় দুপ করে আওয়াজ হলো একটা এপাশ থেকে, মৃদু। একটা গর্ত দেখা দিল ইসমাইলের কোটে। বাম পাশে, বুকপকেটের ঠিক নিচে। কেঁপে উঠল ওর শরীরটা চমকে ওঠার ভঙ্গিতে, তারপর এলোপাতাড়ি পা ফেলে দুপা সামনে এগিয়ে পড়ে গেল মুখ থুবড়ে। চলন্ত ট্রাভেলেটার বয়ে নিয়ে এল লাশটা, ধাক্কা খেলো সেটা রানার গায়ে।

যাদুমন্ত্রের মত কাজ করল রানার মধ্যে মৃতদেহের স্পর্শটা। টলতে। টলতে উঠে দাঁড়াল সে, ব্যথায় কুঁচকে গেছে মুখ, দাতে দাঁত চেপে রেখেছে শক্ত করে। পিস্তল নেই রানার সাথে, গোপনে ওটাকে কাস্টমস ব্যারিয়ার পার  করবার জন্যে পুরে দিয়েছে সুটকেসের তলার এক গোপন কম্পার্টমেন্টে। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় খুনীর পেছনে ধাওয়া করা ঠিক হবে কি হবে না ভেবে চিন্তে-বুঝে নেয়ার আগেই টলতে টলতে এগোল সে ইমিগ্রেশনে যাওয়ার প্ল্যাটফর্মের দিকে। বমি আসছে রানার, মাথা ঘুরছে। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে এগোচ্ছে সে, মনে হচ্ছে দুলছে সবকিছু, ঠিকমত দেখতে পাচ্ছে না চোখে। থেমে দাঁড়িয়ে চট করে একহাতে চোখ মুছল রানা। দেখল, আসলে রক্তে বুজে গেছে ওর চোখ। মেঝেতে পড়ে কেটে গেছে কপালের একপাশ। রুমাল বের করে বার দুয়েক মুছতেই আবার পরিষ্কার হয়ে গেল ওর দৃষ্টি। অনুভব করল বুকের কাছে,ব্যথাটা কমে আসছে দ্রুত।

সমস্ত ব্যাপারটা ঘটে যেতে লাগল বড়জোর দশ সেকেন্ড, কিন্তু। ইতিমধ্যেই বেশ ভিড় হয়ে গেছে লাশটা ঘিরে। প্লেনের যাত্রী, পিছনের সেই তিনজন লোক, সেই সঙ্গে আরও কয়েকজন হাজির হয়ে গেছে যেন মাটি। ফুড়ে। জটলা হবে, হাঁকডাক হবে, এক-আধজন মহিলা চেঁচিয়ে উঠবে ভয়ে, এখন কি করতে হবে বুঝে উঠতে পারবে না কেউ প্রথমটায়–এই-ই নিয়ম, সেই ফাঁকে গা ঢাকা দেবে খুনী।

 চোখ তুলেই দেখতে পেল রানা লোকটাকে। ইমিগ্রেশনে যাবার প্ল্যাটফর্মের অর্ধেকের বেশি চলে গেছে সে, স্ট্র্যাপ ধরে ব্যাগটা ঝোলাতে। ঝোলাতে হেলেদুলে হাটছে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে। এদিকে কি ঘটে গেছে যেন টেরও পায়নি। সহজ ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে, কোন ব্যস্ততা নেই। লোকটার আত্মবিশ্বাস দেখে অবাক হলো রানা, ওর সহযোগীদের বিরুদ্ধে কেউ কোন প্রমাণ খাড়া করতে পারবে না, কাজেই এই লোকটা হাতছাড়া হয়ে গেলেই ইসমাইলের হত্যার সমস্ত সূত্র ছিন্ন হয়ে যাবে।

দৌড়াতে শুরু করল রানা।

ট্র্যাভেলেটারের মাঝামাঝি পৌঁছেই থমকে দাঁড়াল রানা। পিছনে পায়ের। শব্দে সই করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে লোকটা, এক ঝাঁকিতে ব্যাগটা বগলের নিচে নিয়ে এসে ডান হাতটা পুরে দিয়েছে ভেতরে। নিরস্ত্র অবস্থায় নিশ্চিত খুনীর পিছু ধাওয়া করা যে কতখানি বোকামি, বুঝতে পারল রানা মুহূর্তে। পরিষ্কার। বুঝতে পারল, কোন দ্বিধা করবে না লোকটা গুলি করতে, আগামী কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ইসমাইলের সাথে মোলাকাত হবে ওর পরপারে। ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল রানা মেঝের ওপর, এমনি সময়ে দেখল সামান্য একটু সরে। গেল পিস্তলের মুখ, লোকটার দৃষ্টিও রানার ওপর থেকে সরে সামান্য একটু বায়ে স্থির হয়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড। পিছন ফিরে না চেয়েও রানা বুঝতে পারল মৃতদেহের কাছে দাঁড়ানো লোকগুলো দৌড়োতে দেখে নিশ্চয়ই ইসমাইলকে ছেড়ে ওর দিকেই চেয়ে রয়েছে, এবং তাই দেখে দ্বিধায় পড়েছে। খুনী।

শেষ মাথায় পৌঁছে অপ্রস্তুত অবস্থায় হোঁচট খেলো নিষ্ঠুর চেহারার লোকটা, টাল সামলে নিয়ে দেখল পৌঁছে গেছে ওপারে। ঝট করে ঘুরেই দৌড়াতে শুরু করল সে। এতগুলো লোকের সামনে খুন করতে দ্বিধা হওয়াই স্বাভাবিক, তবে রানা বুঝতে পারল, সেই কারণে যে লোকটা রেহাই দিয়েছে তাকে তা নয়, প্রয়োজন মনে করলে কয়েক হাজার দর্শকের সামনেও খুন করতে পারবে এই নোক, আসলে রানাকে হত্যা করবার প্রয়োজন বোধ করেনি লোকটা। আবার ছুটতে শুরু করল রানা।

শরীরে খানিকটা বল ফিরে পেয়ে জোরে দৌড়ে কাছে চলে আসছিল। রানা, ইমিগ্রেশন অফিসারদের অবাক করে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল সামনের। লোকটা ওপাশের খোলা দরজা দিয়ে। সাধারণত লোকে ধীরস্থির ভাবে ঢেকে ইমিগ্রেশন হলে, অফিসারদের সামনে থেমে দাঁড়িয়ে পাসপোর্ট দেখায়, প্রশ্নের উত্তর দেয়-এটাই নিয়ম; দৌড়ে পেরিয়ে যায় না কেউ এই এলাকা। কিন্তু রানা আবার যখন ওদের অবাক করবার চেষ্টা করল ততক্ষণে হুশ ফিরে। পেয়ে সতর্ক হয়ে গেছে তারা। সাঁ করে একজন লোক বেরিয়ে চলে গেল, তার পিছু পিছু রক্তাক্ত চেহারায় আরেকজনকে ছুটতে দেখে থামাবার চেষ্টা, করল দুজন অফিসার রানাকে। এক ঝটকায় ওদের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে দরজার দিকে ছুটল রানা। কিন্তু কপালের ফেরে বাধা পড়ল ঠিক দরজার মুখেই।

ওপাশ থেকে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে একজন। একটা মেয়ে। ডানদিকে সরল রানা, মেয়েটা সরল বামদিকে; বামদিকে সরল রানা, মেয়েটা সরল ডানদিকে। ফুটপাথে প্রায়ই দেখা যায় এই ঘটনাসামনাসামনি পড়ে যেতেই একজন ভদ্রতা করে একপাশে সরে যায়, অপরজনও ভদ্রতার দিক। থেকে কম যায় না, সে-ও সঙ্গে সঙ্গে সরে পথ দিতে চেষ্টা করে, ফলে দেখা যায় আবার পথ আটকে দাঁড়িয়েছে দুজন দুজনের। অতি বিনয়ী দুজন মুখোমুখি পড়লে অনির্দিষ্টকালের জন্যে চলতে পারে এই ক্যারিক্যাচার। কিন্তু ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা দেখবার মূডে নেই রানা এখন, মোটমাট বার তিনেক ডাইনে-বায়ে করে খপ করে মেয়েটার কাঁধ  চেপে ধরে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল ওকে সামনে থেকে। মেয়েটা কিসের সাথে গিয়ে ধাক্কা খেলো, ব্যথা পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল। কেন, সে সব দেখবার প্রয়োজন বোধ করল না সে, ছুটল সামনের দিকে। পরে ফিরে এসে মাফটাফ চেয়ে নিলেই হবে।

 খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসতে হলো রানাকে। দরজার গোড়ায় রানার কয়েক সেকেন্ড ভদ্রতার সুযোগ নিয়েছে সামনের লোকটা পুরোপুরিই। লোকের ভিড়ে মিশে গেছে বেমালুম। তিন মিনিট খোঁজাখুজি করে ফিরে এল হতাশ রানা। পরিষ্কার বুঝতে পারল, এখন এয়ারপোর্ট পুলিসের কাছে রিপোর্ট করে কোন লাভ নেই, যতক্ষণে সে নিজের পরিচয় দিয়ে এদের কাজে নামতে বাধ্য করবে, ততক্ষণে একেবারেই পগার পার হয়ে যাবে লোকটা। প্রফেশনাল কিলার তার পালাবার পথ প্রশস্ত রেখেই নামে কাজে। এইলোক যে প্রফেশনাল তাতে রানার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আপাতত এর পেছনে। আর সময় নষ্ট করবার কোন অর্থই হয় না। ইমিগ্রেশন হলে ফিরে এল সে। ভারী পায়ে। মাথার ভিতরটা দপ দপ করছে, বেশ খানিকটা ফুলে গেছে কপালের একপাশ, পেটে সেই তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাটা নেই, কিন্তু ব্যথা-ব্যথা একটা ভাব রয়েছে বলে গা-টা গুলাচ্ছে। ঘরে এসে ঢুকতেই ইউনিফর্ম পরা দুই পুলিস দুদিক থেকে ধরল রানার দুই হাত।

ভুল লোককে ধরেছ, বলল রানা। দয়া করে হাত সরাও। সরে দাঁড়াও–শ্বাস নিতে দাও আমাকে।

একটু ইতস্তত করে রানার হাত ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গেল লো দুজন–প্রায় দুই ইঞ্চি দূরে। লম্বা করে দম নিয়ে মেয়েটার দিকে চাইল রানা। বাইশ-তেইশ বছর বয়স হবে, ঘন নীল রঙের কোট পরেছে, কোটের নিচে সাদা পোল-নেক জাম্পার। সুন্দরী। জুলফির কাছে খানিকটা কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে। রুমাল দিয়ে মুছছে। মেয়েটার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একজন সুদর্শন। উচ্চপদস্থ এয়ারপোর্ট অফিশিয়াল-প্রশ্ন করছে ওকে, দেখে মনে হচ্ছে প্রেম। নিবেদন করছে।

ইয়াল্লা! বলল রানা। আমি ওই দশা করেছি বুঝি আপনার?

না, না, মোটেই না, চাপা ফ্যাসফেসে গলায় বলল মেয়েটা। আজ সকালে দাড়ি কামাতে গিয়ে কেটে ফেলেছি।

আমি সত্যিই দুঃখিত, দুঃখ দুঃখ চেহারা করল রানা। একটা খুনীকে তাড়া করছিলাম। খুন করে পালাচ্ছিল লোকটা। আপনি পড়ে গিয়েছিলেন আমার সামনে পালিয়ে গেল লোকটা, সেই সুযোগে।

আমার নাম মর্গেনস্টার্ন। এখানেই কাজ করি এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি। বলল মেয়েটার পাশে দাঁড়ানো লোকটা। চোখা চেহারা, বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে, চেহারায় দায়িত্ববোধের ছাপ পড়েছে। খুনের খবরটা শুনেছি। খুবই দুঃখজনক। এই রকম একটা কাণ্ড শিফল এয়ারপোর্টে ঘটে যাবে, ভাবাই যায় না।

মাথা ঝাঁকাল রানা। বলল, আমার তো মনে হয় আপনাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করায় মৃত লোকটার লজ্জা পাওয়া উচিত।

এই ধরনের কথায় কারও কোন উপকার হয় না, মর্গেনস্টার্নের কণ্ঠে ভর্ৎসনার আভাস। মরা লোকটা আপনার পরিচিত?

কি করে হবে? এইমাত্র নেমেছি আমি প্লেন থেকে। বিশ্বাস না হয়। স্টুয়ার্ডেসকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। এখানকার কিছু চিনি না আমি একেবারে নতুন।

আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি আপনি। গম্ভীর কণ্ঠে বলল মর্গেনস্টার্ন। রানা, বুঝল, শুধু চেহারায় নয়, সবদিক থেকেই লোকটা চোখা।

পরিচিত কিনা? না। এই ভিড়ের মধ্যে লাশটা যদি দাঁড় করিয়ে দেন, চিনতে পারব না।

রানা। মাসুদ রানা।

হয়তো স্বীকার করবেন, মিস্টার রানা, সাধারণ কোন লোক সাধারণত সশস্ত্র খুনীকে তাড়া করে না।

হয়তো সাধারণের চেয়ে একধাপ নিচে আছি আমি।

কিংবা হয়তো আপনার কাছেও পিস্তল রয়েছে?

জ্যাকেটের দুটো বোতাম খুলে লোকটার সন্দেহ ভঞ্জন করল রানা।

আচ্ছা, খুনীকে কি কোনভাবে আপনার পরিচিত মনে হয়েছে? মানে, আগে কোনদিন

কোনদিন না। সত্যি কথাটাই বলল রানা। তবে জীবনে কোনদিন ওই চেহারাটা ভুলতে পারবে না সে, এটাও সত্যি কথা–কিন্তু এ সত্য প্রকাশ করল না সে; মেয়েটির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, আপনাকে দুএকটা কথা। জিজ্ঞেস করতে চাই, মিস–

মিস শেরম্যান, বলল মর্গেনস্টার্ন।

আপনি তো খুনীটাকে দেখেছেন। চেহারাটা মনে আছে? মেয়েটা মাথা। নাড়ছে দেখে বলল, মনে থাকার কিন্তু কথা। কাউকে দৌড়াতে দেখলে সবাই সেইদিকে তাকায়। আপনি একেবারে সামনে থেকে দেখেছেন ওকে।

দেখেছি। কিন্তু চেহারা মনে নেই।

মৃত লোকটাকে হয়তো আপনি চিনতে পারবেন। দেখবেন নাকি এক নজর?

শিউরে উঠে মাথা নাড়ল মেয়েটা।

হঠাৎ সরাসরি প্রশ্ন করল রানা, কাউকে রিসিভ করতে এসেছেন?

 ঠিক বুঝতে পারছি না একটু যেন অবাক দেখাল মেয়েটাকে।

ইমিগ্রেশনের দরজার মুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তাই জিজ্ঞেস করছি। কেউ আসছে এই প্লেনে?

আবার মাথা নাড়ল মেয়েটা। রানা লক্ষ করল, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মেয়েটার মুখ। ঈষৎ বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রয়েছে রানার মুখের দিকে। ভয়। পাচ্ছে পরের প্রশ্নটা কি হবে ভেবে।

 তাহলে কেন এসেছেন? ভুরু নাচাল রানা। দৃশ্য দেখতে? এখানে তো, দেখার মত কিছুই নেই?

এসব প্রশ্নের কোন যৌক্তিকতা দেখতে পেল না মর্গেনস্টার্ন, ঠাণ্ডা দৃষ্টি রাখল রানার চোখে।

হয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে। খামোকা প্রশ্ন করে ভদ্র মহিলাকে আর বিব্রত করলেও চলবে। এ ধরনের প্রশ্ন করবার অধিকার রয়েছে কেবল পুলিস। অফিসারের।

আমি একজন পুলিস অফিসার, বলল রানা। পাসপোর্ট আর ওয়ার‍্যান্ট কার্ড বের করে এগিয়ে দিল অফিসারের দিকে। ঠিক সেই সময়ে ইমিগ্রেশনে। এসে ঢুকল সোহানা ও মারিয়া। কপালকাটা রানার রক্তাক্ত চেহারা দেখেই থমকে দাঁড়াল লোহানা, চোখে-মুখে উদ্বেগের ছায়া ফুটে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু রানার কড়া ভ্রুকুটি দেখে সামলে নিল মুহূর্তে। ঘাড় ফিরিয়ে মর্গেনস্টার্নের দিকে চাইল এবার রানা। মুখের ভাব সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে লোকটার।

তাই বলুন! আবার চোখ রাখল সে ওয়ার‍্যান্ট কার্ডে। মেজর মাসুদ রানা, প্যারিস ব্যুরো অফ ইন্টারপোল। এবার বোঝা যাচ্ছে কেন খুনীর। পেছনে ওভাবে দৌড়েছিলেন আপনি, কেন জেরা শুরু করেছিলেন পুলিসের। মত। যাই হোক, আপনার এই পরিচয়পত্র একটু চেক করে দেখতে হবে। আমার।

দেখুন। যেমন ভাবে খুশি পরীক্ষা করে দেখুন। তবে আমার মনে হয়, সেন্ট্রাল হেডকোয়াটারের কর্নেল ভ্যান গোল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করলে অনেক খাটুনি বেঁচে যাবে আপনার।

কর্নেলকে চেনেন আপনি?

মাথা ঝাঁকাল রানা। বলল, তিনিও আমাকে চেনেন। যাই হোক, যা চেক করবার জলদি করুন, আমি বারে গিয়ে বসছি, ওখানেই পাবেন আমাকে। এগোতে গিয়েও থেমে দাঁড়াল রানা তাগড়া পুলিশ দুজনকে অনসূরণ করতে দেখে। বলল, এদের জন্যে, ড্রিঙ্কস কিনতে পারব না আমি, জানিয়ে দিচ্ছি আগে থেকেই।

ঠিক আছে, হাত নেড়ে পুলিস দুজনকে পিছু নিতে বারণ করল মর্গেনস্টার্ন। মেজর মাসুদ রানা পালাবে না।

 যতক্ষণ পর্যন্ত আমার কাগজপত্রগুলো আপনার কাছে রয়েছে, ততক্ষণ তো নয়ই। মেয়েটার দিকে ফিরল রানা। মিস্ শেরম্যান, আপনার ওই জখমের জন্যে আমি আন্তরিক দুঃখিত। দেখে মনে হচ্ছে খুবই কাহিল হয়ে। পড়েছেন। আসুন না, একটা ড্রিঙ্ক নিন?

আপনার সাথে? জুলফির পাশে রুমাল চাপা দিয়ে এমন ভাবে চাইল মেয়েটা রানার দিকে যেন কুষ্ঠরোগী দেখছে। মুখ ফিরিয়ে নিল।

কাঁধ  ঝাঁকিয়ে এগোল রানা বারের দিকে। হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে অবাক হলো সে। প্লেন থেকে নামার পর মাত্র আট মিনিট পার হয়েছে এতক্ষণে। এই আট মিনিটে কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে ওর কাছে এক–অত্যন্ত সুসংগঠিত দলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সে এবার; দুই-এত গোপনীয়তা সত্ত্বেও কবে, কখন, কোন প্লেনে করে ইন্টারপোলের লোক আসছে জানা হয়ে। গিয়েছিল ওদের, ইসমাইলের হাত নাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রানার চেহারাও চেনা হয়ে গিয়েছে; তিন-হঠাৎ সামনে পড়ে যায়নি মিস শেরম্যান, ইচ্ছে করেই নষ্ট করা হয়েছে রানার কয়েকটা মূল্যবান সেকেন্ড।

কোথাও মস্ত কোন ভুল করেছিল ইসমাইল, সে ভুলের অর্ধেক মাশুল শোধ করে গেছে সে নিজের জীবন দিয়ে, বাকি অর্ধেকটা চেপে গেছে এখন রানার কাঁধে।

.

০২.

আপাতত আগের প্ল্যান-প্রোগ্রামই অনুসরণ করবার সিদ্ধান্ত নিল রানা। হলুদ মার্সিডিজ ট্যাক্সি এসে থামল ফাঁইভ-স্টার হোটেল কার্লটনের সামনে। মালপত্রের ভার ডোরম্যানের হাতে ছেড়ে দিয়ে ঢুকে পড়ল রানা ভিতরে। রিসিপশন ডেস্কের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে ছিমছাম পোশাক পরা স্মার্ট চেহারার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। সরু গোঁফ, ব্যাকরাশ চুল, মুখে উজ্জ্বল হাসি-সামনের লোকটা পিঠ ফেরাবার সঙ্গে সঙ্গেই যেটা অদৃশ্য হয়ে যাবে, কিন্তু ঝট করে পেছন ফিরলে দেখা যাবে মুহূর্তে ফিরে এসেছে হাসিটা, আগের চেয়েও উজ্জ্বল।

ওয়েলকাম, মিস্টার রানা, বলল লোকটা। আশা করি অ্যামস্টার্ডাম আপনার কাছে ভাল লাগবে।

এ ব্যাপারে অতটা আশাবাদী হতে পারল না রানা, কাজেই জবাব না। দিয়ে রেজিস্ট্রেশন কার্ড পূরণে মন দিল সে। যেন মহামূল্যবান রত্নের অলঙ্কার। নিচ্ছে, এমনি ভাবে পূরণ করা কার্ডটা হাতে নিল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। রানাকে আর এক টুকরো হাসি উপহার দিয়ে বুড়ো বেল বয়ের দিকে চাইল সে। শরীরের ওপরের অংশ একপাশে বাকিয়ে রানার ভারী সুটকেস হাতে। এলোমেলো পা ফেলে এদিকে এগোচ্ছে বেল বয়।

বয়! ছশো বাইশ নম্বর।

কথাটা বলেই অত্যন্ত বিনয় সহকারে রানার হাতে তুলে দিল সে একটা, চাবি। চাবিটা পকেটে ফেলে দুই পা এগিয়ে বুড়োর হাত থেকে সুটকেসটা নিল রানা ঝ হাতে, টিপস দিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। আমিই নিতে পারব।

কিন্তু সুটকেসটা অনেক ভারী মনে হচ্ছে, মিস্টার রানা, বলল। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আন্তরিক কণ্ঠে। ওটা ওখানেই নামিয়ে দিন, আমি অন্য লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি ওপরে।

মৃদু হেসে ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল রানা সুটকেস হাতে। ভারী তো মনে হবেই ভাবল সে। পিস্তল, গোলাবারুদ, সাইলেন্সর, বার্গলার্স-টুল, এবং সেই সঙ্গে আরও কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি মিলে কমপক্ষে দশ সের ওজন বাড়িয়ে দিয়েছে সুটকেসের। কিন্তু তাই বলে ওর অনুপস্থিতিতে ভিতরের জিনিসপত্র ঘাঁটবার সুযোগ সে দিতে পারে না কাউকে। একবার হোটেল কক্ষে পৌঁছতে পারলে ওসব লুকিয়ে রাখবার জায়গার অভাব হবে না, কিন্তু তার আগে সুটকেসটা হাতছাড়া করা যায় না।  

সিক্সথফ্লোরের বোতাম টিপে দিল রানা এলিভেটরে উঠে রওয়ানা হওয়ার আগের মুহূর্তে দরজার গায়ের গোল কাঁচের জানালা দিয়ে রিসিপশন ডেস্কের দিকে চাইল সে। হাসি নেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের মুখে। গভীর ভাবে কি সব বলছে লোকটা টেলিফোনের রিসিভারে।

সাততলার লবিতে বেরিয়েই দেখতে পেল রানা ছোট্ট একটা টেবিল, টেবিলের ওপর একটা টেলিফোন, ওপাশে একটা চেয়ার, চেয়ারে বসা ইউনিফর্ম পরা এক স্বাস্থ্যবান ওয়েটার। লোকটার চোখে মুখে একটা বেপরোয়া ভাব লক্ষ করল সে। এই ধরনের লোকের ব্যবহারে আবছা একটা। বেয়াড়াপনা, একটা তির্যক বেয়াদবি মেশানো থাকে, কিন্তু স্পষ্টভাবে কোন দোষ ধরবার উপায় নেই যে নালিশ করা যায় কর্তৃপক্ষের কাছে।

ছশো বাইশ নম্বরটা কোনদিকে? জিজ্ঞেস করল রানা।

ভুরুজোড়া আধ ইঞ্চি ওপরে উঠল লোকটার, বুড়ো আঙুল দিয়ে দেখাল। ডানদিকে। তিনটে ঘর ছেড়ে তার পরেরটা। উঠে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, বাক্যের শেষে ছোট্ট একটা স্যার যোগ করাও বাহুল্য বলে বোধ করল সে। মনে মনে বিরক্ত হলো রানা, ইচ্ছে হলো এক থাবড়া দিয়ে ওর চাদিটা ঘোলা। করে দেয়, কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু না বলে আনন্দটা ভবিষ্যতের জন্যে জমা করে রাখাই স্থির করল। যাবার আগে এই লোকটাকে একটু টাইট করে দিয়ে যাবে সে।

তুমি ফ্লোর ওয়েটার না? যেন বেয়াদবিটা চোখেই পড়েনি ওর, এমনিভাবে জিজ্ঞেস করল রানা।

ইয়েস, স্যার, বলে উঠে দাঁড়াল লোকটা। এত সহজে লোকটা কাবু হয়ে যাওয়ায় মন খারাপ হয়ে গেল রানার। যেন রসভঙ্গ হয়ে গেল।

আমার জন্যে খানিকটা কফির ব্যবস্থা করো।

এগিয়ে গিয়ে ছশো বাইশের দরজায় চাবি লাগাল রানা। প্রশস্ত বেডরূম, একটা মাঝারি সিটিংরূম, ছোট্ট একটা কিচেন আর অ্যাটাচড বাথরূম নিয়ে চমৎকার এক সুইট। পিছনে.চওড়া একটা ব্যালকনি।

সুটকেসটা ঘরের কোণে নামিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল রানা। ঠিক নিচেই ব্যস্ত রাজপথ–প্রায় সত্তর ফুট নিচে। খটখটাং শব্দে ট্রাম চলছে, হর্ন বাজাচ্ছে চলন্ত গাড়ি, কিলবিল করছে শয়ে শয়ে মোটর-স্কুটার আর বাইসাইকেল যেন আত্মহত্যার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে ওরা প্রত্যেকে।

ওপর দিকে চাইল রানা। সুইট রিজার্ভ করবার সময়েই টপ ফ্লোরের। কথা বলে দিয়েছিল সে বিশেষ করে। এখান থেকে সবচেয়ে সহজে কিভাবে ছাতে ওঠা যায় বুঝে নিয়ে ফিরে এল ঘরে। সুটকেস খুলে যেসব জিনিস সে আর কারও চোখে পড়তে দিতে চায় না সেগুলো বের করে রাখল রানা। কার্পেটের ওপর। হোলস্টারে পোরা ওয়ালথার পি.পি.কে. ঝুলিয়ে নিল বগলের নিচে, এক্সট্রা ম্যাগাজিন গুঁজে দিল প্যান্টের পেছনের পকেটে। এবার। ক্যানভাসের বেল্টে আঁটা বার্গলার্সটুল কোমরে বেঁধে নিয়ে ভ্রুড্রাইভারটা বের করুল তার থেকে। কিচেনে রাখা ছোট্ট পোর্টেবল ফ্রিজের পেছনটা খুলে এবার বাদবাকি সব জিনিস ঢুকিয়ে দিল সে ওখানে, তারপর দরজা খুলে হাক ছাড়ল। ওয়েটারের উদ্দেশে।

কি হলো? কফি কোথায়?

এবার এক হাঁকেই উঠে দাঁড়াল ওয়েটার, ভাঙা ইংরেজিতে বলল, আসছে, স্যার। এলেই আমি পৌঁছে দেব।

জলদি করো, বলেই দরজা ভিড়িয়ে দিল রানা।

কোমরে বাঁধা বেল্ট থেকে একগোছা চাবি বের করে দরজার চাবির ফুটোয় একের পর এক লাগাতে শুরু করল সে। সপ্তম চাবিটা লেগে গেল। নম্বরটা দেখে নিয়ে যথাস্থানে রেখে দিল সে গোছাটা আবার। বাথরূমে ঢুকে শাওয়ার খুলে দিয়ে ফিরে এল সে বেডরূমে, স্যুটগুলো ঝুলিয়ে দিল ওয়ারড্রোবের হ্যাঁঙ্গারে, একটা সিগারেট ধরিয়ে কয়েক টান দিয়ে জ্বলন্ত অবস্থায় অ্যাশট্রের ওপর রেখে উঠে দাঁড়াল। ঠিক এই সময়ে বেল বেজে উঠতেই একলাফে চলে গেল সে বাথরূমের দরজার সামনে, ওয়েটারকে ভিতরে আসতে বলে ভিতরে ঢুকে ভিড়িয়ে দিল বাথরুমের দরজা, নিচু হয়ে চোখ রাখল কী হোলে।

 নাহ, যা আশা করেছিল তার কিছুই ঘটল না। রানা ভেবেছিল, ও বাথরূমে মনের সুখে ভিজছে মনে করে এই সুযোগে তালাহীন সুটকেসের মধ্যে কি আছে দেখবার চেষ্টা করবে ওয়েটার, অন্তত চারপাশে উৎসুক দৃষ্টি বুলাবে. সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে কিনা দেখবার জন্যে কিন্তু না, কোনদিকে না চেয়ে সোজা টেবিলের ওপর কফির ট্রে নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল লোকটা। যাবার সময় দরজাটা ভিড়িয়ে দিতে ভুলল না।

এতে অবশ্য কিছুই প্রমাণ হয় না, বুঝতে পারল রানা। এর ফলে, ধরে নেওয়া যায় না যে এই হোটেলে শত্রুপক্ষের কেউ নেই, কিংবা ওর পরিচয় ও উদ্দেশ্য এদের সবার অজানা। বাথরূম থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমেই করিডরে বেরোবার দরজায় তালা দিল, তারপর কফিগুলো বেসিনে ঢেলে দিয়ে বন্ধ করে দিল শাওয়ার। চলে এল ব্যালকনিতে।

ব্যস্ত সড়কের দিকে চেয়ে রানা বুঝল ওখান থেকে ওর কার্যকলাপ দেখার উপায় নেই কারও, সামনের দালানগুলোর কোন জানালা বা ব্যালকনিতেও কাউকে দেখতে পেল না সে। সামনে ঝুঁকে আশেপাশের কোন ঘরের ব্যালকনি থেকে এদিকে কেউ চেয়ে রয়েছে কিনা দেখল ডাইনে বায়ে মাথা ঘুরিয়ে। না। কেউ নেই দুপাশের কোন ব্যালকনিতে। রেলিঙের ওপর দাঁড়িয়ে এক হাতে একটা পাইপ আর এক হাতে হাতের কার্নিস ধরে. উঠে পড়ল সে ওপরে।

 কেউ নেই ছাতে, উঁকি দিয়ে দেখে নিয়ে টেলিভিশনের এরিয়েল বাঁচিয়ে এগোল সে ফায়ার এসকেপের দিকে। তেতলা পর্যন্ত নেমে এল রানা ফায়ার এসকেপের সিঁড়ি বেয়ে, তারপর চাবি লাগাল করিডরের দরজায়। বার কয়েক চেষ্টা করতেই খুলে গেল তালা, দরজাটা সামান্য ফাঁক করে শূন্য করিডর দেখে বেরিয়ে এল সে দরজার ওপাশ থেকে। এবার হেলেদুলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচে।

রিসিপশনে নতুন লোক। সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, বেল বয় বা ডোরম্যান, কাউকেই দেখতে পেল না সে। একদল সদ্য আগত টুরিস্ট ভিড় করে আছে রিসিপশন ডেস্কের সামনে। ভিড় ঠেলে, এর ওর কাঁধে মৃদু টোকা দিয়ে ডেস্কের কাছাকাছি পৌঁছল রানা, হাত বাড়িয়ে ডেস্কে জমা দিল ঘরের। চাবিটা, তারপর ধীর পদক্ষেপে চলে গেল বারে। সেখানেও থামল না, একটা সাইড ডোর দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।

মুষল ধারে বৃষ্টি হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে, রাস্তাঘাট ভেজা। কিন্তু এখন একফোঁটাও পড়ছে না আর। ওভারকোটটা খুলে হাতে ঝুলিয়ে নিল, চারপাশে উৎসুক দৃষ্টি ফেলতে ফেলতে এগোল সে, যেন নৈশ-অ্যামস্টার্ডামের রূপ। একেবারে মুগ্ধ করে ফেলেছে তাকে।

হেরেনগ্র্যাচে সপ্তদশ শতাব্দীর রাজকুমারদের বাড়িগুলো দেখছিল রানা, হঠাৎ ঘাড়ের পেছনে কেমন যেন একটা সুড়সুড়ির মত অনুভূতি হলো ওর। এক্সট্রা সেনসরি পার্সেপশন হোক বা যাই হোক, নিজের মধ্যে একটা ক্ষমতা আছে–অনুভব করে রানা। পরিষ্কার বুঝতে পারল, অনুসরণ করা হচ্ছে ওকে।

কিছুদূর এগিয়ে একটা খালের ধারে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল সে, যেন প্রাকৃতিক শোভা দেখছে। একটা সিগারেটের আধা-আধি শেষ করে বুঝতে পারল আপাতত ওকে খুন করবার ইচ্ছে নেই কারও। সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও বেশি কাছে এল না লোকটা, বিশগজ দূরে আরেকটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে সে-ও শোভা দেখছে। শিফল এয়ারপোর্টের পিস্তল তুলে গুলি করেনি ইসমাইলের হত্যাকারী, এই নির্জন খালের পারে জায়গামত একটা গুলি ঢুকিয়ে দিয়ে সম্মানের সাথে পানিতে নামিয়ে দিলে টেরও পাবে না। কাকপক্ষী–কিন্তু সে চেষ্টা করল না কেউ। আপাতত এরা শুধু ওর গতিবিধি। আর কাজকর্মের ওপর দৃষ্টি রাখতে চাইছে। ভালই তো-রাখুক।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল রানা, হাই তুলল, তারপর উঠে _এল বড় রাস্তায়। ডানদিকে মোড় নিয়ে লীডেস্ট্রাট ধরে এগোল সহজ ভঙ্গিতে। মাঝে মাঝে টুকিটাকি উইন্ডো শপিং করছে, সেই ফাঁকে কাঁচের গায়ের। প্রতিফলন দেখে বুঝে নিচ্ছে অনুসরণকারীর অবস্থান। রানা থামলেই সেই লোকটাও থেমে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করে কোন দোকানের ডিসপ্লে। ছাই রঙের স্যুট ও সোয়েটার নোকটার, টুপিটাও ছাই রঙের।

সামনের মোড়ে আবার ডানদিকে ঘুরল রানা। সিঙ্গেল ক্যানেলের তীরে সারর্বাধা ফুলের দোকান। বেশ কিছুদূর এগিয়ে একটা টকটকে লাল গোলাপ কিনে গুজল কোটের কলারে। ত্রিশ গজ দূরে সেই লোকটাও ফুল কিনছে। রওয়ানা হয়ে গেল রানা।

সামনের মোড়ে আবার ডানদিকে ঘুরল রানা। লোকটা চোখের আড়াল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত দ্রুত পায়ে এগোল ভিযেলস্ট্রাট ধরে। চল্লিশ কদম, গিয়েই চট করে ঢুকে পড়ল একটা ইন্দোনেশিয়ান রেস্তোরাঁর ভেড়ানো দরজা ঠেলে। সোজা গিয়ে টয়লেটে ঢুকল।

দশ সেকেন্ডের মধ্যে বেরিয়ে এল সে টয়লেট থেকে। ওভারকোটটা গায়ে চড়িয়ে নিয়েছে, পকেট থেকে একটা নরম ফেল্টের ট্রিলবি হ্যাট বের। করে পরে নিয়েছে, চোখে চড়িয়েছে জিরো পাওয়ারের একজোড়া পুরানো মডেলের তারের চশমা। রানা যখন রেস্তোরাঁর দরজা দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় পড়ল, ঠিক সেই সময়ে হন্তদন্ত হয়ে চারপাশে চাইতে চাইতে সামনের দিকে চলেছে ছাই-রঙা অনুসরণকারী। ওভারকোট পরা পরিবর্তিত রানাকে ভালমত দেখবারও প্রয়োজন বোধ করল না লোকটা, একবার আবছাভাবে চোখ বুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশে খুজছে সে রানাকে। এই দরজায় ওই দরজায় উঁকি দিয়ে দেখছে সে রানা ঢুকেছে কিনা।

রাস্তা পেরিয়ে ওপাশে চলে গেল রানা। লোকটার বেশ খানিকটা পেছন পেছন চলল। শখানেক গজ গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে আবার ফিরে আসতে শুরু করল লোকটা। চোখেমুখে স্পষ্ট উদ্বেগ। ফিরতি পথে প্রত্যেকটা খোলা। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে খুঁজছে সে রানাকে। ইন্দোনেশিয়ান রেস্তোরাঁতেও ঢুকল, দুশ সেকেন্ড পর বেরিয়ে এল সেখানে রানাকে না পেয়ে। রেমব্র্যান্ট হোটেলে ঢুকে লবি, লাউঞ্জ, বার খুঁজে ফিরে এল সে রাস্তায়। পাগল-দশা হয়েছে ওর। উদভ্রান্ত ভঙ্গিতে চাইছে এদিক ওদিক, দিশাহারার মত পথ চলতে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে লোকের গায়ে। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ একটা টেলিফোন বুদে ঢুকল লোকটা, দুই মিনিট পর বেরিয়ে এল কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে যেন মেরেছে কেউ। সোজা মাল্টপ্লেইনের ট্রাম স্টপেজের দিকে চলল লোকটা। এবার, পিছু পিছু গিয়ে রানাও দাঁড়াল লাইনে।

তিন কোচের একটা ট্রাম এসে দাঁড়াতেই প্রথম কোচে উঠে পড়ল ছাই রঙা লোকটা, দ্বিতীয় কোচে উঠে বসল রানা। একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে বসল, যাতে নজর রাখা যায় লোকটার ওপর।

ড্যাম-এ পৌঁছেই নেমে পড়ল লোকটা, রানাও নামল। এই ড্যামই হচ্ছে। অ্যামস্টার্ডামের মেইন স্কয়ার। রাজপ্রাসাদ, নিউ চার্চ, ইত্যাদি অনেক ঐতিহাসিক দর্শনীয় বস্তু সাজানো রয়েছে রাস্তার দুই ধারে। কিন্তু এসব কোনকিছুর প্রতি ক্ষেপ না করে হোটেল ক্র্যাসনাপোলস্কির পাশ দিয়ে একটা সাইড রোড ধরে এগিয়ে গেল লোকটা, তারপর বায়ে মোড় নিয়ে ডকের। দিকে এগোল আউডেজি ভুর্বাগোয়াল খালের ধার ঘেঁষে। আধ মাইল এগিয়ে ডাইনে ঘুরে গুদাম আর পাইকারী বিক্রেতাদের ওয়্যারহাউজে ঠাসা পূরানো। শহরের দিকে চলল সে এবার। লোকটাকে অনুসরণ করবার ব্যাপারে কোন সমস্যা দেখা দিল না, ডাইনে-বায়ে কোনদিকে না চেয়ে এক মনে হেঁটে, চলেছে সে মাথা নিচু করে, ধমক ও গালাগালির উত্তরে কি কি জবাব দেবে খুব সম্ভব তারই মহড়া চলেছে ওর মাথায়।

সরু একটা গলিতে ঢুকল লোকটা, একটু ইতস্তত করে গলিমুখে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল রানা। যেন পথ হারিয়ে ফেলেছে বিদেশী পর্যটক, কোনদিকে যাবে ভাবছে, যদিও জানে যে কোন একদিকে রওনা দিলেই চলে, ওর কাছে সব রাস্তাই সমান। লোকটার চলার গতি বেড়ে যাওয়ায় রানা বুঝতে পারল, গন্তব্যস্থলের খুব কাছাকাছি এসে গেছে বলেই এই কর্ম তৎপরতার আভাস। ঠিকই। মান আলোকিত গলিটার মাঝামাঝি গিয়ে পকেট থেকে একটা চাবি বের করে তরতর করে উঠে গেল লোকটা কয়েক ধাপ, চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকে গেল একটা স্টোর হাউজের ভিতর।

ধীরে পায়ে এগোল রানা। সরু রাস্তার দুপাশে পাঁচতলা উঁচু সারি সারি পুরানো দালান, মনে হয় এক্ষুণি বুঝি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে ঘাড়ের ওপর। প্রত্যেকটা বাড়ির সামনে সাইনবোর্ড লাগানো কোন না কোন কোম্পানীর। স্টোর হাউজ। কেমন একটা ছমছমে ভাব নির্জন রাস্তাটায়। যেতে যেতে সহজ ভঙ্গিতে চাইল রানা ডানপাশে। যে দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়েছে ছাই-রঙা লোকটা তার গায়ে লেখা–ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানী। যেমন চলছিল। ঠিক সেই গতিতেই এগিয়ে গেল রানা সামনের মোড়ের দিকে।

.

অত্যন্ত সাদামাঠা এক হোটেল-যেমন বাইরেটা, তেমনি ভেতরটা। খটখটে কয়েকটা আসবাব, দেখে মনে হয় নিলামে কেনা। বিছানার ওপর পাশাপাশি বসে আছে সোহানা ও মারিয়া। রানা বসল ঘরের একমাত্র আরাম কেদারাটায়।

কি খবর? মায়াময় নৈশ অ্যামস্টার্ডামের এক নির্জন হোটেলকক্ষে অপরূপ সুন্দরী দুই রমণী–একা। সব ঠিকঠাক তো?

না, জবাব দিল মারিয়া এক অক্ষরে।

না? অবাক হওয়ার ভান করল রানা। না মানে?

হাত তুলে কামরাটার চারদিকে দেখাল মারিয়া। দেখুন, নিজেই চেয়ে। দেখুন না।

চারদিকে চেয়ে কিছুই বুঝতে পারল না রানা। দেখলাম, কিন্তু বুঝলাম না।

এই ঘরে মানুষ বাস করতে পারে? আপনি পারবেন?

ও, এই কথা? হাসল রানা। না। সত্যি বলতে কি, এই ঘরে আমি বাস। করতে পারব না। কিন্তু তোমাদের মত খেটে খাওয়া টাইপিস্টকে তো আর। ফাঁইভ-স্টার হোটেলে নিয়ে গিয়ে তুলতে পারি না। এই ঘর তোমাদের জন্যে। ঠিকই আছে। এখানে কারও চোখে পড়বার সম্ভাবনা নেই। অন্তত এটাই আশা করছি। তোমাদের বক্তব্য কি? তোমাদের চিনতে পেরেছে কেউ? মাথা নাড়তে দেখে বলল, তোমরা কাউকে চিনতে পেরেছ প্লেনে?

ঠিক একই ভাবে মাথা নেড়ে একই সঙ্গে বলল দুজন, না।

শিফলে পৌঁছে পরিচিত কাউকে দেখেছ?

না।

কেউ কোন বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি তোমাদের প্রতি?

না।

ঘরটা পরীক্ষা করে দেখেছ? লুকোনো মাইক্রোফোন বা কিছু পেলে?

না।

বাইরে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ।

কেউ অনুসরণ করেছিল?

না।

তোমাদের অনুপস্থিতিতে সার্চ করা হয়েছে এ ঘর?

না।

মারিয়ার ঠোঁটে হাসির আভাস দেখে হাসল রানা প্রশ্রয়ের হাসি। বলল; বলে ফেলো। মজার ব্যাপারটা কি ঘটল?

না। মানে… একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল মারিয়া, এই চোর-পুলিস খেলার কি সত্যিই কোন মানে, দুজন নিরীহ বিদেশী টাইপিস্ট আমাদের পেছনে কেন কেউ

আহ, থামো! মারিয়াকে থামিয়ে দিল সোহানা। এর মধ্যে হাসির কিছুই নেই।

এয়ারপোর্টের ঘটনা সম্পর্কে জানা আছে তোমাদের? জিজ্ঞেস করল রানা।

খুনের ব্যাপারে তো? বলল মারিয়া। কে একজন খুন হয়েছে। এয়ারপোর্টে। শুনোছ, আপনি নাকি চেষ্টা করেছিলেন খুনীকে ধরতে…

ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম…

কেন? জিজ্ঞেস করল সোহানা।

কি কেন? অবাক হলো রানা।

কে কোথায় খুন হলো, সেজন্যে পুলিস বিভাগ রয়েছে–তুমি কেন তা! করতে গেলে? কোথাও কোন খুন-খারাবি হলেই তোমার পিছু ধাওয়া করতে হবে?

যাকে খুন করা হলো, সে যদি আমার ঘনিষ্ঠ কেউ হয়? ধরো, তুমি বা মারিয়া.. কথাটা শেষ করল না রানা একসঙ্গে ওদের দুজনকে চমকে উঠতে দেখে।

ঘনিষ্ঠ নোক মানে? ছানাবড়া হয়ে গেল মারিয়ার চোখজোড়া। আপনি চেনেন লোকটাকে? যে মারা গেল

আমারই লোক। জরুরী খবর নিয়ে দেখা করতে এসেছিল, আমার সঙ্গে। নিজের মোক বলেই বলছি না, অত্যন্ত সাবধানী এবং বুদ্ধিমান লোক ছিল ও। আমি ছাড়া আর কারও পক্ষেই জানা সম্ভব ছিল না যে ও আসছে শিফলে আমার সাথে দেখা করতে–এতই সাবধানে মেসেজ পাঠিয়েছিল ও তিন হাত ঘুরিয়ে। কিন্তু পৌঁছে কি দেখলাম? আরও কেউ জেনে গিয়েছে এই গোপন সাক্ষাতের কথা, কথা শুরু করবার আগেই শেষ করে দিয়েছে ইসমাইলকে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটা তা হচ্ছে আমার একজন সহকর্মী। সম্পর্কে ওরা এতটা ওয়াকিফহাল; বাকি দুজন সম্পর্কে ঠিক কতটা ওদের জানা আছে বুঝে নেয়া দরকার প্রথমে। আর ইউ শিওর ইউ আর ইন ক্লিয়ার?

 ব্যাপারটার গুরুত্ব টের পেল ওরা। পরস্পরের মুখের দিকে চাইল সোহানা ও মারিয়া। তারপর নিচু গলায় বলল মারিয়া, তা কি করে বলব? আমরা যতদূর জানি এখন পর্যন্ত ঠিকই আছি আমরা। কেউ আমাদের চিনে রেখেছে কিনা সেটা তো সেই বলতে পারবে। আপনার কি মনে হয়। আমাদেরও প্রাণের আশঙ্কা…

আছে। সেইজন্যেই অত আপত্তি করেছিলাম আমি তোমাদেরকে সাথে আনতে।

বিপদের সম্ভাবনা বেশ সহজ ভাবেই গ্রহণ করল ওরা দুজন। রীতিমত ট্রেনিং পাওয়া এজেন্ট ওরা, একটুতেই ঘাবড়ে যাওয়ার মত ঠুনকো নয়। রানার চোখে চোখ রাখল সোহানা। তোমার পেছনে নিশ্চয়ই লেগে গেছে। ওরা? রানাকে মাথা ঝাঁকাতে দেখে বলল, কোথায় কোন হোটেলে উঠেছ। জানা আছে ওদের?

নিশ্চয়ই। তা নইলে হোটেলের অর্ধেক স্টাফ আমার ওপর নজর রাখতে যাবে কেন? সাইড ডোরেও ওয়াচার বসানো হয়েছে, আমি বেরোতেই গুটগুট। করে হাঁটতে শুরু করল পেছন পেছন।

খসিয়ে দিয়েছেন ওকে? জিজ্ঞেস করল মারিয়া।

হয় অযোগ্য ছিল, নয়তো প্রোতভাকেট করবার চেষ্টা করছে। আক্রমণের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। ওদের ছোট ছোট চালে আমার কি রি অ্যাকশন হয় তাই লক্ষ করছে ওরা দূরে বসে।

কিছু দেখতে পেয়েছে? জানতে চাইল সোহানা।

পাবে, উঠে দাঁড়াল রানা। যতটা আঘাত করবে, ঠিক ততটাই প্রত্যাঘাত পাবে ওরা আমার কাছ থেকে। চলি এখন। দেখা হবে কাল।

চট করে রানার হাত ধরল সোহানা।

সাবধানে থেকো, রানা। তুমি একা, ওরা অনেক।

তবু ভয় পাচ্ছে ওরা আমাকে। হাসল রানা। ভেব না, কোন কোন সময় আমি একাই একশো হয়ে যেতে পারি। তোমরা এখন সাবধানে থাকতে পারলে হয়।

.

০৩.

টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে ফিরে এল রানা হোটেলে। সোজা ভেতরে না ঢুকে সাইড স্ট্রীট ধরে চলে এল ফায়ার এসকেপের সিঁড়ির কাছে। ঠিক এক মিনিট পর ছাতের দরজাটা সামান্য একটু ফাঁক করে উঁকি দিল। কেউ নেই ছাতে। প্যারাপেট ডিঙিয়ে শুয়ে পড়ল সে কার্নিসের ওপর। মাথা বাড়িয়ে দেখবার চেষ্টা করল ওর কামরার পেছনের ব্যালকনিটা।

প্রথমটায় কিছুই দেখতে পেল না রানা, কিন্তু গন্ধ পেল ধোয়ার। সিগারেটের নয়–গাঁজার। প্যারাপেটের গায়ে পা বাধিয়ে যতদূর সম্ভব। সামনের দিকে ঝুঁকে প্রায় পড়ি পড়ি অবস্থায় দেখতে পেল সে রেলিঙের ওপর। একজোড়া জুতোর চকচকে মাথা। পরমুহূর্তে দেখা গেল একটা জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরো বাকা হয়ে নেমে গেল নিচের দিকে। ব্যালকনির গায়ে পা তুলে দিয়ে আয়েশ করে অপেক্ষা করছে কেউ ওর জন্যে।

নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল রানা, পা টিপে চলে এল ফায়ার এসকেপের কাছে, কয়েক ধাপ নেমে আস্তে করে খুলল সাততলার দরজাটা। করিডরে কাউকে না দেখে সোজা এসে দাঁড়াল সে নিজের স্যুইটের দরজার সামনে। কান পেতে কোন আওয়াজ পাওয়া গেল না ভিতর থেকে। কোমরে জড়ানো ক্যানভাস বেল্ট থেকে নকল চাবির গোছা বের করে নম্বর মিলিয়ে নিয়ে আলগোছে খুলল দরজার তালা। চট করে ভিতরে ঢুকেই বন্ধ করে দিল সে দরজাটা আবার, কেননা হাওয়া লেগে সিগারেটের ধোয়া দুলে উঠলে লোকটার সতর্ক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কিন্তু সতর্কতার মুডে নেই লোকটা। কয়েক পা এগিয়ে দেখতে পেল রানা একটা চেয়ারে বসে চোখ বুজে সুখটান দিচ্ছে সে মারিজুয়ানা পোরা সিগারেটে। পা দুটো নাচাচ্ছে ব্যালকনির রেলিঙের ওপর তুলে দিয়ে। সেই ফ্লোর ওয়েটার। ডানহাতটা কোলের ওপর, হাতে পিস্তল।

নিশ্চয়ই ঝাঁ ঝাঁ করছে ওর মাথার ভিতরটা কারণ, রানার উপস্থিতি কিছুই টের পেল না সে। চেয়ারের পেছনে এসে দাঁড়াল রানা, লোকটার কানের কাছে পিস্তল ধরে বামহাতটা আলগোছে রাখল ওর কাঁধের ওপর। চমকে উঠে চট করে ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে চাইবার চেষ্টা করল লোকটা, পিস্তলের মাথা দিয়ে ডান চোখে গুতো খেয়ে বিদঘুটে এক শব্দ বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। ব্যথা পেয়ে দুই হাতই চোখের কাছে চলে এল ওর নিজেরই। অজান্তে। কোলের ওপর থেকে টপ করে পিস্তলটা তুলে নিয়ে পকেটে ফেলল। রানা। পরমুহূর্তে ওর থুতনির নিচটা গলা ধাক্কার ভঙ্গিতে ধরে জোরে এক. ঠেলা দিল পেছন দিকে। চেয়ার, উল্টে ডিগবাজি খেয়ে চিৎ হয়ে পড়ে গেল। ফ্লোর ওয়েটার মেঝের ওপর, জোরে ঠুকে গেল মাথার পেছনটা। দশ সেকেন্ড ঝিম ধরে পড়ে রইল লোকটা মেঝেতে, দিশে হারিয়ে ফেলেছে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে। তারপর উঠে বসল ধড়মড়িয়ে। রানাকে চিনতে পেরেই হিংস্র জানোয়ারের মত ছোট্ট একটা গর্জন ছাড়ল লোকটা, ঠোঁট দুটো সরে গিয়ে। নিকোটিনের দাগ লাগা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে, দুই চোখের তীব্র দৃষ্টিতে ঘৃণার। বিষ। চাপা গলায় গোটাকয়েক ডাচ গালি দিয়ে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। ভাঙা ইংরেজিতে বলল, কি চাও তুমি? মারপিট? শক্তি পরীক্ষা?

মারপিট? অবাক হলো রানা। আরে না। অত তাড়াহুড়ো নেই আমার। ওসব হবে পরে। যদি দেখি কথা বেরোচ্ছে না তোমার মুখ থেকে।

বাঁকা এক টুকরো হাসির আভাস খেলে গেল লোকটার ঠোঁটের কোণে। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। সোজা হয়ে যখন দাঁড়াল রানার মাথা ছাড়িয়ে আরও আধ হাত উঠে গেল ওর মাথাটা। শুধু লম্বায় নয়, চওড়াতেও লোকটা। রানার দেড়গুণ। পেটা শরীর। রানার মুখের কথাগুলো তাই হাস্যকর শোনাল। ওর কাছে। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা গ্রহণ করাই স্থির করল লোকটা। ঘাড়টা সামান্য, একটু কাত করে ফাঁইটিং পিকচারের দস্যু-সর্দারের ভঙ্গিতে বলল, কি ব্যাপারে কথা বের করতে চাও?

এই ধরো, আমার ঘরে তুমি কি করছ…সেটা দিয়ে শুরু করা যায়। তারপর আলাপ করা যেতে পারে কে তোমাকে পাঠিয়েছে, কেন পাঠিয়েছে সে সব বিষয়ে।

বিষণ্ণ হাসি হাসল লোকটা। এসব চেষ্টা করে কোন লাভ নেই, মিস্টার। একটা কথাও বের করতে পারবে না আমার মুখ থেকে। অনেক চেষ্টা করে দেখেছে পুলিস, একটা শব্দও বের করতে পারেনি। আইন আমার ভাল করেই জানা আছে। আমাকে দিয়ে কোন কথা বলাতে পারবে না। আইন বলে, কোন কথা প্রকাশ করা বা না করার অধিকার রয়েছে আমার।

দরজার ওই ওপাশ পর্যন্ত এসেই দাঁড়িয়ে গেছে আইন, বলল রানা। এপাশে তুমি আমি দুজনেই রয়েছি আইনের আওতার বাইরে। এখানেও একটা আইন অবশ্য রয়েছে…জঙ্গলের আইন। হয় মারো, নয় মরো।

রানার বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই ডাইভ দিল লোকটা। নিচু হয়ে পিস্তলের লাইন অফ ফায়ার বাঁচাল ঠিকই, কিন্তু রানার হাঁটুর নিচে চিবুক নামাতে পারল না লোকটা। বিদ্যুৎবেগে এক পা এগিয়ে প্রচণ্ড এক গুতো। লাগাল রানা হাঁটু দিয়ে ওর থুতনি বরাবর। তীক্ষ্ণ ব্যথা বোধ করল রানা হাঁটুতে। সেই হিসেবে আধঘণ্টার জন্যে শুয়ে পড়বার কথা লোকটার, কিন্তু আশ্চর্য সহ্য ক্ষমতা ওর, মোক্ষম আঘাত পেয়েও রানার বাম পা ধরে হ্যাঁচকা এক টান দিয়ে ভারসাম্য টলিয়ে দিল রানার। হুড়মুড় করে দুজনেই পড়ল মেঝের ওপর। হাতু থেকে খসে কয়েক ফুট দূরে গিয়ে পড়ল রানার পিস্তলটা। পরবর্তী আধ মিনিট যুদ্ধরত বন্য জন্তুর মত গড়াগড়ি খেলো ওরা মেঝের। ওপর-একবার এ ওপরে, একবার ও। সেই সঙ্গে বৃষ্টির বেগে ঘুসি চালাচ্ছে দুজন একে অপরের ওপর। লোকটার শারীরিক ও মানসিক বল অবাক করল রানাকে। বল প্রয়োগ না করে কৌশল প্রয়োগ করছে রানা এখন। মারিজুয়ানা টেনে স্বাভাবিক রিফ্লেক্স হারিয়ে না ফেললে কি ঘটত বলা যায় না, কারণ আনআর্মড কমব্যাটে সে কোন অংশে কম যায় না রানার থেকে, তার ওপর ওর গায়ে রয়েছে রানার দ্বিগুণ শক্তি। ঠিক আধ মিনিট পর দুজনেই যখন উঠে দাঁড়াল আবার, দেখা গেল বামহাতে চেপে ধরে আছে রানা লোকটার ডান হাত, হাতের কব্জি মুচড়ে ঠেলে তুলে এনেছে ওটাকে একেবারে শোলডার ব্লেডের কাছে।

কব্জিটা আরেকটু ওপরে তুলতেই, গোঙানির মত শব্দ বেরোল লোকটার মুখ থেকে, কিন্তু অভিনয় করছে কিনা সঠিকভাবে বোঝার জন্যে আরও খানিকটা উঁচু করল রানা হাতটা। পিঠের কাছে কড়কড় আওয়াজ পেয়ে বুঝতে পারল সে, আর খানিকটা তুললেই মড়াৎ করে ভেঙে যাবে হাত। এইবার ঠেলে নিয়ে এল সে লোকটাকে ব্যালকনির রেলিঙের ধারে। রেলিংটা ওর পেটে বাধিয়ে ঠেলে শূন্যে তুলে ফেলল ওর শরীরের নিম্নাংশ। বাম হাতে রেলিং আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করল লোকটা, কিন্তু বেকায়দা অবস্থায় ধরতে পারল না শক্ত করে, পেছন থেকে সামান্য একটু ধাক্কা দিলেই সোজা নেমে যাবে সে সত্তর ফুট নিচের রাস্তায় মাথা নিচু পা উঁচু অবস্থায়।

তুমি পুশার না অ্যাডিক্ট? কানের কাছে মধুর কণ্ঠে প্রশ্ন করল রানা।

জান-প্রাণ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল লোকটা, চট করে ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে আরেকটু চাপ দিল রানা ওর মুচড়ে ধরা হাতে, তারপর মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে বলল, চিৎকার করে লোক ডাকবার সুযোগ পাবে। না। উত্তর দাও।

পুশার। ফুঁপিয়ে উঠল লোকটা। বিক্রি করি।

কে পাঠিয়েছে তোমাকে এখানে?

সেটা কিছুতেই বলব নাঃ যা খুশি তাই..উহ।

শেষ পাঁচটা সেকেন্ড একটু ভেবে দেখো। সিদ্ধান্ত তোমার। উত্তর না দিলে ঠেলে ফেলে দেব। ফুটপাথের দিকে একবার চেয়ে দেখো…ওই ওখানটায় হাত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকবে তোমার লাশ, মুখের গন্ধ শুকেই পুলিস বুঝে নেবে কেন তোমার হঠাৎ উড়বার শখ হয়েছিল।

খুন! কঁকিয়ে উঠল লোকটা। শুধু এই খবরটার জন্যে মানুষ খুন করতে পারো না তুমি।

পারি। সহজ কণ্ঠে বলল রানা। তোমরা সে অধিকার দিয়েছ। আমাকে। আজই বিকেলে তোমাদের লোক খুন করেছে আমার এক লোককে, বিনা অপরাধে। কেবল তোমাদেরই হত্যা করবার অধিকার আছে, আর কারও নেই? তাছাড়া এটা হত্যা কোথায়? চেয়ে দেখো, মাত্র সত্তর ফুট, পাঁচ সেকেন্ডও লাগবে না তোমার পৌঁছতে কারও বুঝবার ক্ষমতা নেই যে আমিই দায়ী এজন্যে। দেখো।

উরু দিয়ে ঠেলে রেলিঙের ওপর দিয়ে আরও খানিকটা এগিয়ে দিল রানা ওর শরীর ফুটপাথটা দেখবার সুবিধের জন্যে, ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাচ্ছে দেখে ডানহাতে কলার খামচে ধরে টেনে আনল আবার।

কি দেখলে? কথা বলার ইচ্ছে আছে?

গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বের করল লোকটা। রেলিঙের ওপর থেকে নামিয়ে ঠেলে নিয়ে এল রানা ওকে ঘরের মাঝখানে।

কে পাঠিয়েছে তোমাকে?

লোকটা খুবই টাফ, টের পেয়েছে রানী, কিন্তু ঠিক কতটা তা কল্পনাও করতে পারেনি। এই অবস্থায় ব্যথায় আর ভয়ে আধমরা হয়ে যাওয়ার কথা লোকটার, কিন্তু কোথায় কি–পাই করে ঘুরল সে ডানদিকে, এক ঝটকায়। ছাড়িয়ে নিল হাতটা। পরমুহূর্তে ঝাঁপ দিল সামনের দিকে। যাদুমন্ত্রবলে দশ ইঞ্চি লম্বা একখানা ক্ষুরধার ছুরি চলে এসেছে ওর বাম হাতে। সেকেন্ডের চারভাগের একভাগ সময়ের জন্যে হকচকিয়ে গিয়েছিল রানা, সেই সুযোগে ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে ওর বুকের কাছে নিয়ে এল সে ছুরিটা। কিছুমাত্র চিন্তা করবার সময় পেল না রানা, আত্মরক্ষার তাগিদে খপ করে দুই হাতে ধরে ফেলল। লোকটার কব্জি, ধরেই শুয়ে পড়ল পেছন দিকে, হাত ধরে জোরে টান দিল। নিচের দিকে, সেইসঙ্গে ডান পা-টা ওর তলপেটে বাধিয়ে প্রাণপণে লাথি দিল। ওপর দিকে। রানার শরীরের ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল লোকটা ঘরের কোণে, মাথা নিচু, পা উঁচু অবস্থায় দড়াম করে ধাক্কা খেলো দেয়ালের গায়ে, তারপর চারফুট উঁচু থেকে হুড়মুড় করে পড়ল মেঝের কার্পেটের ওপর। কেপে উঠল সারাটা ঘর। সঙ্গে সঙ্গে কড়াৎ করে বিশ্রী একটা শব্দ এল রানার কানে।

লোকটাকে মাথার ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দিয়েই তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েছিল। রানা আক্রমণের মোকাবিলার জন্যে, আওয়াজটা শুনেই বুঝতে পারল তাড়াহুড়োর আর কোন দরকারই নেই। দেয়াল বরাবর শুয়ে আছে লোকটা, মাথাটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাঁকা হয়ে রয়েছে। এগিয়ে গিয়ে টেনে বসাবার চেষ্টা। করল রানা লোকটাকে। মাথাটা ঝুলে পড়ল বুকের কাছে। কব্জি টিপে পালসটা দেখে নিয়েই ওকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল রানা। দুঃখ হলো লোকটা কোন তথ্য না দিয়েই বেরসিকের মত টপ করে মরে যাওয়ায়।

লোকটার পকেট থেকে নানান ধরনের জিনিস বেরোল রুমাল, চিরুনি, হাতে তৈরি গাঁজার সিগারেট, আইডেন্টিটি কার্ড, বলপয়েন্ট কলম, অর্ডার লিখবার স্ক্র্যাপ প্যাড, ইত্যাদি হরেক রকম আইটেম। প্রত্যেকটা ভালমত পরীক্ষা করে রেখে দিল রানা যথাস্থানে, শুধু স্ক্র্যাপ প্যাডের মাঝামাঝি জায়গা। থেকে খসিয়ে নিল একটা কাগজ। কাগজের ওপর লেখা MOO 144, তার। নিচে আরও দুটো নম্বর 910020 আর 2797.

এসব লেখার মানে কিছুই বোধগম্য হলো না রানার কাছে, তবে কিছু একটা অর্থ থাকতে পারে মনে করে রেখে দিল সে কাগজের টুকরোটা প্যান্টের এক গোপন পকেটে। এক মিনিটের মধ্যেই ঘরটা গোছগাছ করে নিল রানা–ধস্তাধস্তির কোন চিহ্ন রইল না আর। পকেট থেকে ফ্লোর ওয়েটারের পিস্তলটা বের করে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল সে; খাল লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল। সেটা বাম দিকে; কয়েক সেকেন্ড পর হালকা একটা ঝপাং আওয়াজ পেয়ে ফিরে এল আবার ঘরে। জানালাগুলো খুলে ফ্যান চালিয়ে দিল ফুলফোর্সে। সিটিংরূমে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে এল সে লাশটা। করিডরের দরজা ফাঁক করে চোখ রাখল, কেউ নেই কান পাতল, পায়ের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে না কারও। দ্রুতপায়ে লিফটের সামনে চলে এল রানা, বোতাম টিপে দাঁড়িয়ে রইল। খালি লিফট এসে থামল রানার সামনে। ভিতরে না ঢুকে পকেট থেকে একটা ম্যাচবাক্স বের করল রানা, দরজাটা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ম্যাচবাক্সটা গুঁজে দিল দুই দরজার ফাঁকে। ইলেকট্রিক্যাল। সারকিট কমপ্লিট করতে না পেরে আবার দুপাশে খুলে গেল দরজাটা, আবার ফিরে এল, ম্যাচবাক্সের গায়ে বাধা পেয়ে আবার হাঁ হয়ে গেল খুলে। একছুটে নিজের কামরায় ফিরে এল রানা, টেনেহিঁচড়ে লাশটা নিয়ে গিয়ে পুরে দিল। লিফটের মধ্যে। ম্যাচবাক্সটা বের করে নিতেই এবার ক্লিক করে লেগে গেল দরজা। লেগে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সেটা যেখানে ছিল সেখানেই। নিচে থেকে কেউ বোম না টিপলে থাকবে ওটা ওখানেই।

বাইরে থেকে নিজের কামরায় নকল চাবি দিয়ে তালা মেরে আবার ফায়ার এসকেপের মধ্যে গিয়ে ঢুকল রানা, দ্রুতপায়ে নেমে এল নিচে। এপাশ ১ ওপাশ দেখে নেমে পড়ল রাস্তায়। লম্বা পা ফেলে মেইন রোডে বেরিয়ে এল রানা, সদর দরজা দিয়ে ঢুকল এবার হোটেলে।

সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের সঙ্গে আরও দুজন ইউনিফরম পরা সহকারী ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে রিসিপশন ডেস্কের ওপাশে। বেশ জোরে হাঁক ছাড়ল রানা, ছশো বাইশ।

রানার দিকে পেছন ফিরে ছিল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, সঁই করে ঘুরল গলার আওয়াজ পেয়ে। চট করে টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিল, সামলে নিল। তারপর রানার দিকে চেয়ে হাসল ওর ঝকঝকে হাসি।

মিস্টার রানা, আপনি বাইরে গিয়েছিলেন, জানতাম না?

মনে মনে রানা বলল ঠিকই জানতে চাঁদ, এক্ষুণি ফ্লোর ওয়েটারকে সাবধান করতে যাচ্ছিলে। কিন্তু মুখে বলল, এই খানিক ঘুরে ফিরে হেঁটে এলাম আর কি। খিদে বাড়িয়ে আনলাম।

চাবিটা নিয়ে ধীরে সুস্থে লিফটের দিকে এগোল রানা। বেশিদূর যেতে হলো না, অর্ধেক পথ গিয়েই থমকে দাঁড়াল সে সাইরেনের মত তীক্ষ্ণ চিৎকারে। পাঁচ সেকেন্ড পর থামল সাইরেন, তিন সেকেন্ড চারপাশে পিন। পতন স্তব্ধতা, পুরো দম নিয়ে আবার খিচে আর্তনাদ ছাড়ল লিফটের সামনে দাঁড়ানো মহিলা। রঙচঙা কাপড় পরা মাঝবয়সী মহিলা, দুই চোখ বিস্ফারিত, মুখের গোল হাঁ দিয়ে পুরো একটা দুটাকা দামের রসগোল্লা ঢুকিয়ে দেয়া যায়। অনায়াসে। মহিলাকে থামাবার চেষ্টা করছে তার পাশে দাঁড়ানো এক বয়স্ক ভদ্রলোক, কিন্তু বেচারার নিজের অবস্থাও মহিলার চেয়ে কোন দিক থেকে ভাল নেই, রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখে এপাশ ওপাশ চাইছে বৎসহারা গাভীর মত। দেখে মনে হচ্ছে, সেও খানিক চিৎকার করতে পারলে বেঁচে যেত।

রানাকে পাশ কাটিয়ে প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার লিফটের দরজার কাছে। রানাও চলল পেছন পেছন। লিফটের মুখে পৌঁছে দেখল মৃতদেহের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে লোকটা বিবর্ণ মুখে। একবিন্দু রক্ত নেই চেহারার কোথাও।

ইয়াল্লা! বলল রানা চোখ কপালে তুলে। লোকটা অসুস্থ মনে হচ্ছে?

অসুস্থ? কী বলছেন অসুস্থ? কটমট করে চাইল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। রানার দিকে। ওর ঘাড়টা দেখে বুঝতে পারছেন না? মারা গেছে।

সত্যিই তো! খোদা! ঠিকই বলেছেন মনে হচ্ছে। সামনে ঝুঁকে এসে ভাল করে দেখবার ভান করল রানা। লোকটাকে কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে?

আপনার ফ্লোরের ওয়েটার ছিল ও। কথাটা বলতে বলতে চোখজোড়া ছোট হয়ে এল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের। কিছু একটা যেন বুঝত্বে শুরু করেছে সে।

তাই বলুন, সোজা হয়ে দাঁডাল রানা। সেইজন্যেই চেনা চেনা লাগছিল। আহা, অল্প বয়সেই বেচারী দুঃখিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল সে। রেস্তোরাঁটা কোনদিকে?

আকাশ থেকে পড়ল নোকটা রানার নির্বিকার প্রশ্ন শুনে।

কি বললেন? রেস্তোরাঁ…

ঠিক আছে, আমিই খুঁজে নেব। হাত নেড়ে আশ্বস্ত করবার ভঙ্গিতে বলল রানা। বুঝতে পারছি, খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছেন আপনি।

.

হোটেল কার্লটনের রেস্তোরাঁর খ্যাতি শুনেছে রানা আগেই, আজ প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে স্বীকার করে নিল, এখানকার বাবুর্চির রান্নার তুলনা হয় না। ক্যাভিয়ার থেকে শুরু করে অসময়ের তাজা স্ট্রবেরী পর্যন্ত নিখুঁত, অপূর্ব। সোহানা আর মারিয়ার কথা একবার মনে হলো ওর তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে গিয়ে। সামান্য একটু হাসির আভাস খেলে গেল ওর ঠোঁটে। নরম সোফায় হেলান দিয়ে ব্র্যান্ডির গ্লাসটা তুলল সে ওপর দিকে, হাসিমুখে বলল, অ্যামস্টার্ডাম!

অ্যামস্টার্ডাম! বলল কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড। সিটি পুলিসের ডেপুটি হেড কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড মিনিট পাঁচেক হলো বিনা আমন্ত্রণেই এসে যোগ দিয়েছে রানার সঙ্গে। রানার সামনে একটা বড়সড় চেয়ারে বসেছে লোকটা, কিন্তু বসার পর মনে হচ্ছে চেয়ারটা ছোট। ভদ্রলোকের দৈর্ঘ্য মাঝারি, কিন্তু প্রস্থ বিশাল। চুলগুলো লোহাটে সাদা, চোখেমুখে নিভকি একটা ভাব, সেইসঙ্গে রয়েছে একটা ক্ষমতার বিচ্ছুরণ–এক নজর দেখলেই বোঝা যায়, কেবল উচ্চপদস্থ কর্মচারীই নয়, ভদ্রলোক অত্যন্ত ক্ষমতাশালী এবং যোগ্য। শুষ্ক কণ্ঠে বলল, বেশ আমোদেই আছেন দেখছি, মেজর রানা? এতকিছু ঘটার পরও। ভাল, ভেরি গুড।

হেসে নাও, দুদিন বই তো নয়। কিন্তু…এতকিছু কি ঘটল?

রানার এই হালকা ভাবটা পাত্তা দিল না কর্নেল। ধৈর্যের সঙ্গে বলল, ওই ইসমাইল আহমেদ সম্পর্কে কোন কিছুই জানা গেল না।

কোন ইসমাইল আহমেদ? শিফল এয়ারপোর্টে যে খুন হয়েছিল, সেই লোকটা?

হ্যাঁ। শুধু এইটুকু জানা গেছে–মাস তিনেক আগে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে এসেছিল লোকটা, উঠেছিল হোটেল স্কিলারে, কিন্তু এক রাত্রি ওখানে থাকার পর অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, আর কোন খোঁজ ছিল না। যতদূর মনে হয়, আপনি যে প্লেনে এসেছেন সেই প্লেনের কোন যাত্রীর সঙ্গে। দেখা করতে গিয়েছিল লোকটা শিফল এয়ারপোর্টে। একজন বাঙালী এয়ারপোর্টে গেল কাউকে রিসিভ করতে, খুন হয়ে গেল, দেখা যাচ্ছে সে প্লেনের একমাত্র বাঙালী যাত্রী পিছু ধাওয়া করছে খুনীর, অথচ নিহত লোকটার। সঙ্গে পরিচয় ছিল বলে স্বীকার করছে না-এসব থেকে আপনার কি মনে হয়?

আমার মনে হয় লোকটা আমার সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিল শিফল. এয়ারপোর্টে, বলল রানা। কারণ আগে হোক আর পরে থোক, ইসমাইলের পরিচয় বের করে ফেলবে ডি গোল্ড। আমারই লোক।

আশ্চর্য ব্যাপার, বলল ডি গোল্ড মস্ত এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, কিন্তু। একবিন্দুও অবাক হয়েছে বলে মনে হলো না তার চেহারা দেখে। দেখুন। মেজর রানা, এটা বড়ই অন্যায় কথা। আমার দেশে আপনার লোক অপারেট করবে, অথচ আমি তার বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানব না…তাহলে কাজ চলবে কি করে?.আমাদের আগেই জানানো উচিত ছিল ওর কথা। এই যেমন আপনার। ব্যাপারে ইন্টারপোল থেকে ইনস্ট্রাকশন পেয়েছি আমরা, সব রকমে আপনাকে সাহায্য করবার অনুরোধ জানানো হয়েছে আমাদের। আপনার কি মনে হয় না, এই রকম পারম্পরিক সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে কাজ করলে আমাদের সবার জন্যেই মঙ্গল হয়? সেক্ষেত্রে আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারি, আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারেন, তাই না? ব্র্যান্ডির। গ্লাসে ছোট্ট একটা চুমুক দিল ডি গোল্ড। ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে চাইল রানার চোখে। আন্দাজ করা যাচ্ছে, জরুরী কোন তথ্য ছিল এই লোকটার কাছে গেল এখন সব। অথচ আমাদের যদি অ্যালার্ট করা হত, ব্যাপারটা নাও ঘটতে পারত।

হয়তো। বলল রানা। ঠিক আছে, আপনার তরফ থেকে আমাকে খানিকটা সাহায্যের মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতা শুরু করা যেতে পারে। আপনাদের ফাইলটা একটু দেখে আমাকে জানাতে পারবেন মিস বিট্রিক্স শেরম্যানের নামে কিছু এন্ট্রি আছে কিনা? মহিলা একটা নাইট-ক্লাবে কাজ করে।

এয়ারপোর্টে যাকে ধাক্কা মেরেছিলেন? কি করে জানলেন ও নাইট-ক্লাবে কাজ করে?

ও নিজেই বলেছে আমাকে। চোখের পলক না ফেলে ঝাড়া মিথ্যে কথা বলল রানা।

ভ্রূ কুঁচকাল ডি গোল্ড। কিন্তু এয়ারপোর্ট অফিশিয়ালরা তো এই ধরনের কোন মন্তব্য করেনি তাদের রিপোর্টে?

ওদের এফিশিয়েনসি লেভেল খুব একটা উঁচু বলে মনে হয়নি আমার কাছে।

ঠিক বলেছেন। কথাটা পছন্দ হয়েছে কর্নেলের। যাই হোক, এ খবরটা বের করতে আমার বেশি সময় লাগবে না। আপনার আর কোন তথ্য দরকার?

না। আপাতত এই। ধন্যবাদ।

আর একটা ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ করলাম না আমাদের দুজনের কেউই।

বলুন। কোন ঘটনা?

সাততলার ফ্লোর ওয়েটারের কথাটা। দুধে ধোয়া লোক নয়–বেশ। কয়েকবার মোলাকাত হয়েছে ওর আমাদের সঙ্গে, আমাদের ফাইলের দুটো পৃষ্ঠা জুড়ে ওর নানান কীর্তিকলাপের বর্ণনা রয়েছে। এই লোকটাও আপনার। নিজস্ব লোক নয়তো?

বলেন কী, কর্নেল। আকাশ থেকে পড়ল রানা।

না, না। আমি একবারও ভাবিনি ও আপনার লোক। বরং ভেবেছি ও আপনার বিরুদ্ধ পক্ষের লোক হওয়া সম্ভব। জানেন, ঘাড় মটকে হত্যা করা হয়েছে লোকটাকে?

তাই নাকি? বেকায়দা পড়ে গিয়েও ঘটতে পারে ব্যাপারটা। সত্যিই, খুবই দুঃখজনক।

ব্র্যান্ডির গ্লাসটা শেষ করে উঠে দাঁড়াল কর্নেল।

আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার কোনদিন, হয়নি, মেজর রানা। কিন্তু আপনার কর্মপদ্ধতির অনেক খবরই আমরা রাখি। কয়েক হাত ঘুরে হলেও আপনার সম্পর্কে অনেক কথাই এসেছে আমাদের ফাইলে। এই সুযোগে আপনাকে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেব পালারমো, মার্সেই বা ইস্তামবুলে যে রীতি, চলে, অ্যামস্টার্ডামে সেটা প্রয়োগ করতে যাওয়া ভুল হবে।

আমার সম্পর্কে অনেক খবরই রাখেন দেখছি।

সেজন্যেই সাবধান করা দরকার বলে বোধ করছি। অ্যামস্টার্ডামে আমাদের সবাইকে আইনের আওতার মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়। আমাকেও। আপনিও এর রাইরে নন। সরাসরি চাইল আবার সে রানার দিকে। এখানে নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারবেন না আপনি।

তা তো বটেই। আমি সাবধান থাকতে চেষ্টা করব। পারস্পরিক সহযোগিতার কথাটাও মনে রাখব। এবার যে কারণে আমার এখানে আসা। কখন, কোথায় আলোচনায় বসা যায়?

কাল সকাল দশটায়। আমার অফিসে। নিরুৎসুক দৃষ্টি বুলাল কর্নেল রেস্তোরাঁর চারপাশে। এটা আলোচনার উপযুক্ত জায়গা নয়। রানাকে জ্বজোড়া উঁচু করতে দেখে বলল, গোপন আলোচনা আড়ি পেতে শোনার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে হোটেল কার্লটনের।

অবাক করলেন। মুচকে হাসল রানা।

ভারী পা ফেলে বেরিয়ে গেল কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড, হাসিটা আর একটু বিস্তৃত হলো রানার। ভাবল–তাই যদি না হবে, তাহলে আর এই হোটেল বাছাই করলাম কেন? কর্নেল কি ভেবেছে না জেনেই ভুল করে ঢুকে পড়েছি। আমি বাঘের গর্তে?

.

০৪.

কর্নেল ডি গোল্ড বসে আছে টেবিলের ওপাশে নিজের সীট ভর্তি করে, এপাশে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে রানা। মস্ত বড় ঘরটা, অফিসের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ছিমছাম আমি কায়দায় সাজানো–আরাম আয়েশের কোন বন্দোবস্ত নেই। আসবাব বেশির ভাগই স্টীলের। দেয়ালের গায়ে একসারি ফাঁইলিং ক্যাবিনেট, স্টীলের টেবিলের ওপাশে গোটা কয়েক স্টীলের আলমারি। সমস্ত ঘরেই একটা কাজ কাজু ভাব। চেয়ারগুলোও বোধহয়, কর্নেলের ইচ্ছে ছিল স্টীল। দিয়ে তৈরি করবার, কিন্তু এখানে অনেক ধরনের বিশিষ্ট লোকের আগমন হয়। বলে ততদূর যেতে পারেনি–তবে চেয়ারের সীটগুলো এমনই শক্ত করে বানানো হয়েছে, যে স্টীলকেও হার মানায়। কেউ যে এখানে আরাম করে বসে। দুটো সুখ দুঃখের কথা বলবে তার উপায় নেই, কাজের কথা সেরেই বাধ্য, হয়ে উঠে পড়তে হবে চেয়ার ছেড়ে।

রানার সুবিধের জন্যেই অল্প দুচার কথার পরই কাজের কথায় চলে এল কর্নেল।

সব ধরনের ড্রাগের ব্যাপারেই আমরা আগ্রহী-ওপিয়াম, ক্যানাবিস, অ্যামফিটামিন, এল, এস ডি, এস টি পি, কোকেন, অ্যামিল অ্যাসিটেট, সব। এদের প্রত্যেকটাই অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। হয় ধ্বংস করে, নয়তো মানুষকে টেনে। নিয়ে যায় ধ্বংসের মুখে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের কাজের সুবিধের জন্যে আপাতত এদের মধ্যে ভয়ঙ্করতম যেটা, সেই হেরোইনের ব্যাপারেই আমরা আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। রাজি?

রাজি। গভীর একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল দরজার কাছ থেকে। ঘাড় ফিরিয়ে না দেখল একহারা লম্বা, সুপুরুষ চেহারার এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। দরজার গোড়ায়, পরনে চমৎকার কাটের স্যুট; বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে আটচল্লিশের মধ্যে, চোখের দৃষ্টি ঠাণ্ডা, তীক্ষ্ণ, মুখে একটা অমায়িক ভাব, কিন্তু বোঝা যায় পান থেকে চুন খসলেই মুহূর্তে রুদ্রমূর্তি ধারণ করতে পারে এই লোক অধঃস্তন কর্মচারীর ওপর। হ্যাঁ এক নজরেই চেনা যায় কোন পেশায়। রয়েছে লোকটা-পুলিস। শুধু পুলিস নয়, দায়িত্বপূর্ণ পদের পুলিস।

দরজা বন্ধ করে হাসিমুখে এগিয়ে এল লোকটা, হাত বাড়াল সামনের দিকে। আমি ভ্যান ডি মাগেনথেলার। আপনার কথা অনেক শুনেছি আমি, মেজর মাসুদ রানা।

কথাটা পছন্দ হলো না রানার। কোথায় ওর সম্পর্কে কি শুনেছে জানবার আগ্রহ হলো, কিন্তু আপাতত কোন মন্তব্য না করাই স্থির করে হাসল, ঝাঁকিয়ে দিল মাগেনথেলারের বাড়িয়ে ধরা হাতটা।

আনুষ্ঠানিক ভাবে পরিচয় করিয়ে দিল কর্নেল। ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার। হচ্ছেন আমাদের এখানকার নারকোটিক ব্যুরোর হেড। আপনার কাজে সব রকম সাহায্য করবেন ইনি। আপনার যখন যা প্রয়োজন, শুধু মুখে উচ্চারণ করবেন, প্রয়োজন হলে সাগর সেঁচে মুক্তো তুলে আনবে মাগেনথেলার আপনার জন্যে।

সত্যিই সুখী হব, বলল মাগেনথেলার, যদি আমরা দুজন মিলে কিছু একটা কিনারা করতে পারি। চেয়ারে বসে রানার দিকে ঝুঁকে এল। আমরা জানি, বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স থেকে এসেছেন আপনি আসলে। যদিও ফিলিপ কার্টারেটের ছত্রছায়ায় এসেছেন আপনি এখানে, আমরা ধরে নিচ্ছি আপনার আসল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের ট্রাফিক বন্ধ করা। কাজেই। একেবারে গোড়া থেকে আমাদের আলোচনা শুরু হলেই সব দিক থেকে মঙ্গল। শোনা যাক, বাংলাদেশে ঠিক কতটা অগ্রসর হয়েছেন আপনারা। সাপ্লাই রিঙ ব্রেক করবার পর্যায়ে পৌঁছেছেন?

বেশ কয়েক মাস আগেই। বলল রানা। ট্রাফিক চ্যানেল সম্পর্কে মোটামুটি জানা আছে আমাদের, অত্যন্ত সংঘবদ্ধ একটা ডিসট্রিবিউশন পাইপ লাইনেরও সন্ধান পেয়েছি।

কোনদিকে ইন্টারেস্ট আপনাদের ট্রাফিক চ্যানেল নাকি ডিসট্রিবিউশন পাইপ লাইন?

সত্যি কথা বলতে কি, বার্মা, ভারত আর নেপাল থেকে কিভাবে, কাদের মাধ্যমে বিরাট সব কনসাইনমেন্ট চালান হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে সেটা আমরা জানি–অর্থাৎ, ট্রাফিক চ্যানেল আমাদের সমস্যা নয়। আমরা জানি এই মাল কোথায় যাচ্ছে। আমরা জানি ফিনিশড গুড হিসেবে এই মালের বিরাট এক অংশ আবার ফিরে যাচ্ছে বাংলাদেশে। যারা ডিসট্রিবিউট করছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের গতিবিধি আমাদের নখদর্পণে। অনেক কিছুই জানা আছে, কিন্তু আমরা যেটা জানি না সেটা হচ্ছে বাইরে থেকে কোন পথে, কিভাবে ঢুকছে ফিনিশড় গুড় আমাদের দেশে; জানি না, কে বা কারা কলকাঠি নাড়ছে গোটা ব্যবসাটার মাথায় বসে।

আপনি বলতে চান বাংলাদেশ হয়ে যে কাঁচামাল বাইরে যাচ্ছে সে ব্যাপারে আপনারা পূর্ণ ওয়াকিফহাল? অবাক হলো ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার। এমন কি ফিনিশড গুড যারা ডিসট্রিবিউট এবং বিক্রি করছে তাদেরও কারও কারও গতিবিধি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা আছে আপনাদের? তাই যদি হয়। তাহলে চুপচাপ বসে আঙুল চুষছেন কেন? টপাটপ সবটাকে ধরে ফেললেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না?

মাথা নাড়ল রানা, তারপর জিজ্ঞেস করল, তাতে কি লাভ হবে, ইন্সপেক্টর? আমরা একটা রিঙ ব্রেক করব, একটা মাস অচল হয়ে যাবে ওদের সবকিছু, কিন্তু একমাসের মধ্যেই আরও আন্ডারগ্রাউন্ডে আরও সাবধানে চালু হয়ে যাবে আরেকটা রিঙযাদের খুঁজে বের করা আরও মুশকিল হবে। আমরা যতবার ভাঙব, ততবারই ওরা আরও নিত্য নতুন কৌশলের আশ্রয় নেবে। আমরা গোড়াটা ধ্বংস করতে চাই। শুধু কিভাবে পাঠানো হচ্ছে। আমার দেশে হেরোইন সেটা জানলেই চলবে না, আমরা জানতে চাই কে পাঠাচ্ছে ওসব।

আপনার অনুমান–অবশ্য তা নইলে এখানে এসে হাজির হতেন না আপনি যে হেরোইনের সাপ্লাইটা যাচ্ছে এখান থেকে, কিংবা আশেপাশেরই কোন জায়গা থেকে?

আশেপাশের কোন জায়গা থেকে নয়। যাচ্ছে এখান থেকেই। আর এটা অনুমান নয়। আমার ধারণা। আমি জানি। আমরা যাদের গতিবিধির ওপর নজর রেখেছি, তাদের শতকরা নব্বই ভাগেরই যোগাযোগ রয়েছে এদেশের সঙ্গে আরও স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে, অ্যামস্টার্ডামের সঙ্গে। নব্বই ভাগই তাই। এখানে হয় আত্মীয়স্বজন আছে, নয়তো বন্ধুবান্ধব আছে; হয়। বিজনেস কন্ট্যাক্ট আছে, নয়তো নিজেদের ব্যবসা আছে, অথবা ছুটি কাটাতে। আসে এখানে প্রায়ই। গত একটা বছর ধরে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে তৈরি করেছি। আমরা ওদের ডোশিয়ে।

অর্থাৎ, আপনারা সেন্ট পার্সেন্ট শিওর? জিজ্ঞেস করল কর্নেল।

ফাইভ হানড্রেড পার্সেন্ট।

মাগেনথেলার জিজ্ঞেস করল, ওই ডোশিয়ের কপি আছে?

আছে। একটা।

আপনার কাছে?

 হ্যাঁ।

 আপনার সঙ্গেই আছে?

হ্যাঁ। অত্যন্ত নিরাপদ জায়গায়। নিজের মাথায় টোকা দিয়ে দেখাল। রানা।

খুবই নিরাপদ জায়গা, সন্দেহ নেই, বলল কর্নেল ডি গোল্ড। মাথা আঁকাল। তারপর চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনার এমন লোকের সঙ্গে দেখা হচ্ছে যে কিনা আপনারই পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধানে অভ্যন্ত।

আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, কর্নেল।

জটিল ধাঁধা আর রূপকে কথা বলা আমার একটা বদভ্যাস, অমায়িক ভঙ্গিতে বলল কর্নেল, পরমুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেল। ঠিক আছে, স্বীকার করে নিচ্ছি। সবদিক থেকে আঙুল দেখাচ্ছে সবাই এখন নেদারল্যান্ডের দিকে। আমাদের এই দুর্নামের কথা আমরা যে জানি না তা নয়। আমরাও জানি। এই দোষারোপ যদি অসত্য হত, সূখী হতাম। কিন্তু আমরা জানি, বিরাট সব। কনসাইনমেন্ট আসছে বার্মা, ভারত, নেপাল আর টার্কি থেকে। আমরা জানি, পপি রূপান্তরিত হচ্ছে হেরোইনে আমাদের এখানেই; জানি, এখান থেকে। আবার ছড়িয়ে পড়ছে সারা দুনিয়াময়–শুধু জানি না কোথায়, কিভাবে কি হচ্ছে।

অথচ এটা আপনাদের এলাকা। নরম গলায় বলল রানা।

অর্থাৎ?

আইন রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর।

এই দোষারোপের সঙ্গে আমরা অপরিচিত নই, মেজর মাসুদ রানা। জ্ব কুঁচকে বলল মাগেনথেলার। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যে আমরা সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারছি না সেটাও বহুবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে আমাদের বহু দেশ। কিন্তু দোষারোপ করে কি বন্ধুত্ব অর্জন সম্ভব?

আমি এখানে বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে আসিনি, ইন্সপেক্টর। ইন্টারপোল। থেকে দায়িত্ব নিয়ে এসেছি কাজে।

ঠিক বলেছেন, বলল কর্নেল ডি গোল্ড। আপনার কাজটা হচ্ছে, যারা মানুষকে ধ্বংস করছে তাদের ধ্বংস করা। আপনার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি আমরা। আপনার সম্পর্কে চমৎকার একটা ভোশিয়ে রয়েছে আমাদের কাছে। দেখতে চান?

অতীত ইতিহাস ঘাটতে আমার ভাল লাগে না।

সেটাই স্বাভাবিক। ঘন ঘন মাথা দোলাল কর্নেল। তবে একটা কথা আপনাকে আমি বলব, মেজর রানা। পৃথিবীর সেরা পুলিস ফোর্সও কোন না কোন সময় দুর্লংঘ প্রাচীরের সম্মুখীন হতে পারে। আমরা শ্রেষ্ঠ-সে দাবি করছি না, কিন্তু তেমনি বাধার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা। শুধু একটা লীড দিন। আমাদের, সামান্য একটা ছিদ্র দেখিয়ে দিন; তারপর দেখুন আমাদের ক্ষমতা। হয়তো এ ব্যাপারে সাহায্য করবার মত কোন প্ল্যান বা তথ্য রয়েছে আপনার। হাতে?

এত তাড়াতাড়িই? হাসল রানা। পকেট থেকে ফ্লোর ওয়েটারের কাছে। পাওয়া স্ক্র্যাপ প্যাডের পাতাটা বের করে এগিয়ে ধরল কর্নেলের দিকে। মাত্র গতকাল বিকেলে পৌঁছেচি আমি এখানে এসে। আচ্ছা, দেখুন তো, এই অক্ষর আর নম্বরগুলোর কোন অর্থ আপনার মাথায় খেলে কিনা?

কাগজের টুকরোটা হাতে নিয়ে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে কটমট করে চাইল কর্নেল ওটার দিকে, যেন ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে নম্বরগুলোকে; উজ্জ্বল ডেস্কল্যাম্পের আলোর নিচে উল্টেপাল্টে দেখল কাগজটা, তারপর নামিয়ে রেখে মাথা নাড়ল। নাহ।

সত্যিই কোন মানে আছে কিনা বের করার ব্যবস্থা করতে পারেন?

তা পারা যায়। এসব ব্যাপারে যোগ্য লোক আছে আমাদের। আগামী কাল জানাতে পারব আপনাকে। যাই হোক, কোথায় পেলেন এটা?

একজন দিয়েছে।

তার মানে কারও কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন আপনি এটা।

দুটো কথায় তফাৎ আছে?

অবস্থা বিশেষে আকাশ পাতাল তফাৎ হতে পারে, মেজর রানা। ডেস্কের ওপর দিয়ে ঝুঁকে এল কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড বক্তব্যের গুরুত্ব বোঝাবার জন্যে। শুনুন মেজর রানা, আমরা আপনার টেকনিকের কথা জানি। আমরা জানি, মানুষকে কিভাবে বেকায়দায় ফেলে কাজ উদ্ধার করেন; জানি, প্রয়োজন মনে করলে আইনের বেড়া ডিঙিয়ে যেতে আপনার বাধে না…

এসব কী বলছেন, কর্নেল।

 যা বলছি, জেনেশুনেই বলছি। আমরা জানি, আপনার এই মেথডে অনেক দ্রুত কাজ হতে পারে, কিন্তু এটা আত্মহত্যারই নামান্তর। প্রতিপক্ষকে চরম ভাবে উত্যক্ত করলে, তাকে একের পর এক অসুবিধেয় ফেললে, প্রোতভাকেট করলে, শো-ডাউনটা এগিয়ে আসে কয়েক ধাপ সামনে, তা ঠিক; কিন্তু আমার একান্ত অনুরোধ, মেজর রানা, দয়া করে এখানে বেশি লোককে প্রোভোকেট করতে যাবেন না। রিপিট করছি–এটা আত্মহত্যারই নামান্তর। অ্যামস্টার্ডামে খালের সংখ্যা অনেক।

 ঠিক আছে, কর্নেল। কাউকে প্রোডোক করব না। সাবধানে থাকব। যতদূর সম্ভব।

দ্যাটস গুড। স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল কর্নেল। এবার মাগেনথেলার হয়তো আপনাকে খানিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছু দেখাতে চাইবে।

বেশ অনেক কিছুই দেখাবার রয়েছে মাগেনথেলারের, বোঝা গেল। মানিক্সস্ট্রাটের পুলিস হেডকোয়ার্টার থেকে, মাগেনথেলারের কালো ওপেলে। চড়ে সিটি মরচুয়ারীতে পৌঁছল রানা। বিশাল এক ঠাণ্ডা ঘরে ঢুকল অ্যাটেনড্যান্ট আর ইন্সপেক্টরের পিছু পিছু। ঘরের মাঝখানে লাইন দিয়ে সাজানো রয়েছে দুই সারি সাদা স্ল্যাব, দুটো মাত্র খালি-বাদবাকি সবকটার। ওপর সাদা কাপড় ঢাকা লাশ শুয়ে আছে টান টান হয়ে। চারপাশের দেয়াল। জুড়ে ফাঁইলিং ক্যাবিনেটের মত অসংখ্য স্টীলের ড্রয়ার। রানা জানে, এইসব। ড্রয়ারের মধ্যে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে লাশ, রেফ্রিজারেটেড। ডিজিনফেক ট্যান্টের তীব্র গন্ধে নাক কুঁচকাল সে। ইন্সপেক্টরের ইঙ্গিতে দেয়ালের গায়ের একটা স্ল্যাব টেনে বের করল অ্যাটেন্যান্ট ক্যাচ সরিয়ে। সাদা কাপড়ে ঢাকা রয়েছে লাশটা আপাদমস্তক।

ক্রোকুইস্কেড ক্যানেলে পাওয়া গেছে এটা, বলল মাগেনখেলার চেষ্টাকৃত নিরুত্তাপ কণ্ঠে। হ্যাঁন্স গার্বার। বয়স উনিশ। না দেখাই ভাল, বেশ। কয়েকদিন পানিতে ছিল বলে ওটা আর দেখার যোগ্য নেই। তবে হাতটী। দেখতে পারেন।

 চাদরটা সামান্য উঁচু করতেই একটা ফোলা হাত দেখতে পেল রানা। মনে হচ্ছে কেউ যেন মোরব্বার মত কেচেছে হাতটা কাটাচামচ দিয়ে, কিংবা স্পাইক লাগানো জুতো পায়ে আচ্ছামত মাড়িয়েছে ওটাকে। লাল, নীল, সবুজ-নানান রঙ দেখা যাচ্ছে ক্ষতচিহ্নগুলোর আশে পাশে। কোন মন্তব্য না; করেই হাতটা ঢেকে দিয়ে পিছন ফিরল মাগেনথেলার। হড়হড় করে ঢুকিয়ে। দিল অ্যাটেনড্যান্ট স্ল্যাবটা।

খানিক বাঁয়ে সরে আর এক সারি স্ল্যাবের সামনে দাঁড়াল মাগেনথেলার। বলল, এরও মুখটা দেখাতে চাই না আমি আপনাকে। একশ বছরের এক তরুণের মুখ যদি সত্তর বছরের বুড়োর মত দেখতে হয়, সেদিকে তাকানো যায় না। অ্যাটেনড্যান্টের দিকে ফিরল। তেষটি নম্বরটা খোলো। কোথায় পাওয়া গিয়েছিল এটাকে?

উস্টারহুকে। একটা কয়লার বার্জে। ক্যাচ সরিয়ে হ্যাঁচকা টান দিল লোকটা হ্যাঁনডেল ধরে।

মাথা ঝাঁকাল মাগেনথেলার। ঠিক। সঙ্গে বোতল ছিল একটা। খালি বোতল। জিনের। আধ বোতল জিন পাওয়া গিয়েছিল ওর পেটে। হেরোইনের। সঙ্গে জিনের সম্পর্কটা জানা আছে আপনার? রানাকে মাথা ঝাঁকাতে দেখে সাদা কাপড় সরিয়ে এরও হাতটা দেখাল সে কয়েক সেকেন্ড। দার্শনিক ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল, হত্যা-না আত্মহত্যা?

একটু খোঁজ নিলে হয়তো বের করতে পারতেন আসল ব্যাপারটা।

কিভাবে? বোতলটা কার কেনা সে খবর সংগ্রহ করে?

হ্যাঁ। ওর নিজের কেনা হলে এটা হবে হয় আত্মহত্যা, নয়তো দুর্ঘটনা। কেউ যদি আধ বোতল জিন ওর হাতে তুলে দিয়ে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে এটা হত্যা। ঠিক এই ধরনের একটা কেস হয়েছিল মাস ছয়েক আগে আমাদের বাংলাদেশে চট্টগ্রামে। তিনদিনের মধ্যে অ্যারেস্ট করেছিল পুলিস। খুনীকে।

আমরাও চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু বোতলে কারও আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি••এমন কি এই ছেলেটিরও না। ব্যাচ নাম্বার মিলিয়ে যে খোঁজ করব, তারও উপায় ছিল না। লেবেলই ছিল না বোতলে।

এবার ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় চলে এল ওরা। মার্বেল পাথরের মত দেখতে একটা সাদা স্ল্যাবের ধারে দাঁড়িয়ে মুখের কাপড় সরাল এবার মাগেনথেলার একটা লাশের। অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে মনে হচ্ছে ঠিক ঘুমিয়ে আছে। একগোছা সোনালী চুল লেপটে আছে চিবুকের কাছে।

সুন্দর না? জিজ্ঞেস করল মাগেনথেলার। ওর কণ্ঠস্বরে শীতল একটা উন্মা টের পেল রানা। একটী রেখা নেই, নিপাপ, পবিত্র মুখটা। রোজমেরী ডুনিং। আমেরিকান। বয়স–ষোলো। আর কিছুই জানা যায়নি এর সম্পর্কে।

কি হয়েছিল?

সাততলার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়েছিল নিচে ফুটপাথের ওপর।

চট করে হোটেলের ফ্লোর ওয়েটারের কথা মনে পড়ে গেল রানার। হয়তো ওকেও পাওয়া যাবে এই মরচুয়ারীর কোন না কোন স্ল্যাবের ওপর। জিজ্ঞেস করল, নিজেই, নাকি ধাক্কা দিয়ে সাহায্য করেছিল কেউ?,

নিজেই। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ হচ্ছে হিপ্লিদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল মেয়েটা, বাডির জন্যে মন টেনেছিল, হঠাৎ ছাতের প্যারাপেটের। ওপর লাফিয়ে উঠে উড়ে চলে যেতে চেয়েছিল মায়ের কাছে। ভাগ্যিস ফুটপাথের ওপর তখন আর কেউ ছিল না। আরও দেখবেন কয়েকটা? কাল। রাতে কার্লটন হোটেলে মারা পড়েছে একটা জাংকি দেখবেন ওটাকে?

যথেষ্ট হয়েছে, বলল রানা। এসব আমার কাছে নতুন নয়। এই একই দৃশ্য দেখে এসেছি আমি ঢাকার মর্গে। তারচেয়ে কোথাও বসে একটোক বাভি খাওয়া যাক বরং•• কি বলেন?

ঠিক বলেছেন। এসব দেখার চেয়ে ব্র্যান্ডি অনেক ভাল। হাসল। মাগেনুথেলার, কিন্তু সে হাসিতে রসকষ নেই-নিপ্রাণ, নিষ্প্রভ। আমার বাসায় চলুন। বেশি দূরে না। আপনাকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার আরও একটা কারণ আছে।

 কারণ?

চলুন, দেখবেন।

 বাইরে বেরিয়ে রানা দেখল, আঁধার হয়ে এসেছে আকাশটা আজ সকাল সকালই। পুবদিকটা ধূসর মত দেখা যাচ্ছে। খানিক বাদেই বৃষ্টি নামবে বড় বড় ফোঁটায়। সারা আকাশ জুড়ে মলিন বিষণ্ণতা। মনে মনে ভাবল সে, বহুদিন পর মনের ভাবের সঙ্গে প্রকৃতির মিল পাওয়া গেল। ভারাক্রান্ত মনে কালো ওপেলে গিয়ে উঠল সে মাগেনথেলারের পিছু পিছু।

.

০৫.

ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের ড্রইংরূমে ঢুকেই মনের বিষণ্ণ ভাবটা কেটে গেল। রানার। সেন্ট্রাল হিটেড ঘরের সবখানে উজ্জল, খুশি খুশি রঙ। জানালার কাঁচে বিড়বিড় করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে, কুলকুল করে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে কাঁচের ওপর দিয়ে। সব শীতলতা, সব মালনতা গলে যাচ্ছে, ধুয়ে মুছে। সাফ হয়ে যাচ্ছে এ ঘরের বাইরে ঢুকতে পারছে না ভিতরে। ভারী ডাচ ফার্নিচারে সুন্দর করে সাজানো ড্রইংরূম, নরম গদি আটা আমচেয়ার রয়েছে। কয়েকটা। রঙচঙে পুরু কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে বসে পড়ল রানা। একটা চেয়ারে। ঘরের এককোণে বড়সড় একটা লিকার কাবার্ডের সামনে। দাঁড়িয়ে কোন বোতলটা বের করবে সে ব্যাপারে মনস্থির করবার চেষ্টা করছে মাগেনথেলার। খানিক ইতস্তত করে একটা তিনকোনা বোতল থেকে দুটো গ্লাসে প্রায় তিন ইঞ্চি পরিমাণ সোনালী তরল পদার্থ ঢেলে নিয়ে চলে এল। রানার সামনে। একটা টিপয়ের ওপর রানার গ্লাসটা নামিয়ে দিয়ে নিজেরটা হাতে নিয়ে বসল মুখোমুখি একটা আর্মচেয়ারে।

একটা কথা জিজ্ঞেস করব আপনাকে, মেজর মাসুদ রানা। আপনার। সম্পর্কে আমরা যতদূর জানি, আপনি এসপিয়োনাজের লোক, দূধর্ষ এক স্পাই…ড্রাগস তো আপনার লাইন নয়? এসবে তো আপনার আগ্রহী হওয়ার। কথা নয়? আপনি এর মধ্যে এলেন কি মনে করে?

 আমি এই লাইনের লোক নই, খবরটা ঠিকই শুনেছেন। আমার চীফ যখন প্রথম আমাকে এ ব্যাপারে কাজ করবার প্রস্তাব দেন, আমি অত্যন্ত। বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম সে প্রস্তাব। এই একই যুক্তিতে। কিন্তু আমার বস্ যখন আমাকে সাথে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে নিয়ে গিয়ে লাশগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, যখন নিজ চোখে দেখলাম সারি সারি বাঙালী যুবক-যুবতীর মৃতদেহ, তখন আর স্থির থাকতে পারলাম না। কিছুতেই। কোন দেশপ্রেমিক স্থির থাকতে পারে না সে দৃশ্য দেখে। আমিও। পারিনি। আমার মনে হয়েছে, কেবল অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যই নয়, ভয়ঙ্কর ধরনের মস্তিষ্কবিকৃতি রয়েছে; তরুণদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড কোন আক্রোশ আর প্রতিশোধের মনোভাব রয়েছে এদের লীডারের মধ্যে। বিকৃত এক ধরনের আনন্দ লাভ করছে লোকটা কাঁচা বয়স, বিক্ষোভ আর হতাশার শিকার। হাজার হাজার সম্ভাবনাময় তরুণ তরুণীর চরম সর্বনাশ করে। ধ্বংসযজ্ঞে নেমেছে যেন এক নির্মম ম্যানিয়াক। মনস্থির করতে আর কোন কষ্ট হয়নি আমার।

রানার বক্তব্যটা বেশ কিছুক্ষণ নিজের মনে নেড়েচেড়ে বুঝে দেখল মাগেনথেলার। চোখ বুজে মাথা ঝাঁকাল বার কয়েক, তারপর বলল, ঠিক বলেছেন।

আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি, এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দিন, বলল রানা মৃদু হেসে। আমাকে মরচুয়ারী থেকে ঘুরিয়ে আনবার পেছনে নিশ্চয়ই আপনার কোন উদ্দেশ্য রয়েছে। কিছু একটা বোঝাতে চাইছেন আপনি আমাকে। কি সেটা?

একটা নয়, কয়েকটা জিনিস বোঝাতে চেয়েছি আমি আপনাকে। ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে একটা সাইড টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল সে গ্লাসটা। রানাকে সিগারেট ধরাবার সময় দিয়ে শুরু করল প্রথমত আমি আপনাকে জানাতে চাই, সমস্যাটা আপনাদের ওখানে ঠিক যতখানি, আমাদের এখানে তার চেয়ে কম প্রকট নয়। বরং বেশি। সিটি মরচুয়ারীতে ওই রকম আরও অন্তত বিশটা লাশ রয়েছে। সব হেরোইনের শিকার। সব সময় এত বেশি হয়। না, মৃত্যুর হারটা জোয়ার ভাটার মত কমে বাড়ে, ইদানীং একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। কচি কচি ছেলেমেয়েদের লাশই বড় কথা নয়, আরও কত হাজার নেশাগ্রস্ত যুবক যে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত, তার হিসেব কোথাও লেখা নেই।

অর্থাৎ, আপনি আমাকে জানাতে চান, যে এই গোপন দলটাকে ধ্বংস করার ব্যাপারে আমার চেয়ে কোন অংশে কম আগ্রহী নন আপনারা–যে, একই শত্রুর বিরুদ্ধে কাজ করছি আমরা; আমাদের আক্রমণের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন?

 ঠিকই ধরেছেন। এক এবং অভিন্ন।

দ্বিতীয় উদ্দেশ্য?

আমি চেয়েছি কর্নেল ডি গোন্ডের সাবধানবাণীটা আপনাকে দিয়ে আরও গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করাতে। ওরা ঠিক কতটা রুথলেস, কতখানি ভয়ঙ্কর। দেখাতে চেয়েছি আমি আপনাকে মরচুয়ারীতে নিয়ে গিয়ে। যদি ওদের বেশি কাছে যান, যদি বেশি বিরক্ত করেন কি বলব, এখনও কয়েকটা সীট খালি। আছে মরচুয়ারীতে।

লম্বা করে টান দিল রানা সিগারেটে। বাড়ির ভিতরে একটা টেলিফোন বেজে উঠল। বিড়বিড় করে ক্ষমা চেয়ে দ্রুতপায়ে চলে গেল মাগেনথেলার। ভিতরে। দরজাটা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা দরজা খুলে গেল, সুন্দরী এক যুবতী ঢুকল ড্রইংরূমে। লম্বা একহারা চেহারা, বয়স বড়জোর বিশ কি বাইশ। একটা ড্রাগন আঁকা রঙচঙে হাউজ কোট দিয়ে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা। কুচকুচে কালো চুল মেয়েটার, ডিম্বাকৃতি মুখ, আয়ত চোখ দুটো বেগুনী রঙের। উঠে দাঁড়াল রানা।

হ্যালো। আমি মাসুদ রানা। আর কি বলবে বুঝে পেল না সে।

হঠাৎ ঘরে ঢুকে মেয়েটাও যেন একটু হতচকিত হয়ে পড়ল। চট করে। বুড়ো আঙুলটা মুখে পুরে চুষে নিল কয়েক সেকেন্ড। তারপর কিক করে। হাসল। পরিপাটি ঝকঝকে একসারি দাঁত।

আমি ইরিন। ভাল ইংরেজি বলতে পারি না কিন্তু। মিষ্টি গলায় বলল মেয়েটা।

 দুপা এগিয়ে হাত বাড়াল রানা হ্যাঁন্ডশেকের জন্যে। কিন্তু হাতটা ধরবার। কোন লক্ষণ দেখা দিল না মেয়েটার মধ্যে। তর্জনী কামড়ে ধরে হেসে উঠল খিলখিল করে। লাল হয়ে উঠেছে লজ্জায়। এত বড় একটা মেয়ের এই রকম ব্যবহারে একেবারে থতমত খেয়ে গেল রানা। স্বস্তির খাস ফেলল পাশের ঘরে রিসিভার নামিয়ে রাখার আওয়াজ হতেই।মাগেনখেলার এসে ঢুকল ড্রইংরূমে।

রুটিন কল। জরুরী কিছু না, এয়ারপোর্ট থেকে মেয়েটাকে দেখে কথার মাঝখানেই থেমে গেল মাগেনথেলার, মৃদুহেসে এগিয়ে এসে সস্নেহে হাত রাখল ইরিনের কাঁধে। পরিচয় হয়েগেছে মনে হচ্ছে?

পরিচয় পর্বের মাঝামাঝি পর্যায়ে ছিলাম বলতে বলতে থেমে গেল রানা। দেখল, মাগেনথেলারের কানে কানে কথা বলছে ইরিন ফিসফিস করে, চকচকে চোখে রানার দিকে চাইছে বাকা দৃষ্টিতে। মদ হেসে মাথা ঝাঁকাল মাগেনথেলার, ছুটে বেরিয়ে গেল ইরিন ঘর থেকে। হতভম্ব রানার দিকে চেয়ে আবার হাসল মাগেনখেলার, ম্লান হাসি।

এক্ষুণি ফিরে আসবে আবার, দেখবেন। অপরিচিত লোকের সামনে। প্রথমটায় লজ্জা পায় ও একট, কিন্তু সহজ হতেও সময় লাগে না মোটেই।

ঠিকই। দশ সেকেন্ডের মধ্যেই ফিরে এল ইরিন। কোলে একটা বড়সড় পুতুল। পুতুলটা এত সুন্দর করে তৈরি যে প্রথম দেখলে মনে হয় সত্যিই জ্যান্ত বাচ্চা বুঝি। প্রায় তিনফুট লম্বা, মাথায় সাদা একটা টুপি, টুপির নিচে কোঁকড়া সোনালী চুল দেখা যাচ্ছে, পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা একটা সিল্কের পোশাক পরা, চমৎকার এমব্রয়ডারি করা বডিস গায়ে। শক্ত করে ধরে আছে ইরিন পুতুলটাকে, যেন সত্যিকারের বাচ্চা, ঢিল দিলে পড়ে যাবে। হাত বাড়িয়ে। কাছে টেনে নিল মাগেনখেলার ইরিনকে, একহাতে জড়িয়ে ধরে পরিচয় করিয়ে দিল, এটা আমার মেয়ে, ইরিন। আর ইনি আমার এক বন্ধু বাংলাদেশের লোক, মেজর মাসুদ রানা।

এবার অসঙ্কোচে এগিয়ে এল ইরিন, হাত বাড়াল মৃদু হেসে।

হাউ ডু ইউ ডু, মেজর রানা?

ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে রানাই বা কম যাবে কেন, স্মিত হাসি হেসে বো করল সে সামান্য, হাতটা ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল, মিস মাগেনথেলার। মাই প্লেযার।

মাই প্লেযার। বলেই কথাটা বলা ঠিক হলো কিনা জানার জন্যে সপ্রশ্ন। দৃষ্টিতে চাইল বাপের দিকে।

 ইংরেজি ভদ্রতার সাথে খুব একটা পরিচয় নেই ইরিনের, কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলল মাগেনথেলার। তারপর শশব্যস্ত হয়ে বলল, আরে! দাঁড়িয়ে কেন? বসুন, বসে পড়ুন। বলে নিজেই ধপাস করে বসে পড়ল চেয়ারে, তুলে নিল ব্র্যান্ডির গ্লাসটা।

রানাও বসল। পুতুল কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ইরিন, ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয়েছে সে রানার মুখের দিকে। অস্বস্তি বোধ করতে, শুরু করল রানা। এই অস্বাভাবিক পরিবেশে ঠিক কি করা উচিত বুঝতে না পেরে ক্রমেই বাড়ছে। অস্বস্তিবোধ। মেয়েটার দিকে চেয়ে বলল, তুমি বসবে না?

চকচকে চোখে চাইল ইরিন বাপের দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল রানার কথায়, তারপর পুতুলটা বাপের হাতে দিয়ে সোজা এসে চড়ে বসল রানার। কোলে। একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রানা। কিন্তু কোন রকম ভাবান্তর। নেই ইরিনের মুখে, যেন এটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক কাজ হয়েছে, এমনি ভঙ্গিতে একহাতে জড়িয়ে ধরল রানার গলা, তারপর মিষ্টি করে হাসল চার ইঞ্চি দূর থেকে সোজা রানার চোখের দিকে চেয়ে। রানাও হাসবার চেষ্টা করল, কিন্তু সেটা হাসির চেয়ে ভ্যাংচানোর মতই দেখাল বেশি।

উজ্জ্বল চোখে খানিকক্ষণ রানাকে দেখার পর ঘোষণা করল ইরিন, তুমি খুব ভাল। তোমাকে আমি ভালবাসি।

আমিও তোমাকে ভালবাসি, ইরিন, বলল রানা। কতটা ভালবাসে বোঝাবার জন্যে ওর পিঠে মৃদু চাপড় দিল দুটো। হাসিমুখে চোখ বন্ধ করল ইরিন, মাথাটা রাখল রানার কাঁধে। ওর মাথার ওপর দিয়ে মাগেনহেলারের দিকে চাইল রানা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে। মলিন হাসি হাসল মাগেনথেলার। হাসিতে ঝরছে দুঃখ।

ইরিন আসলে সবাইকে ভালবাসে, মেজর মাসুদ রানা। আশা করি আহত বোধ করবেন না এ খবরে।

 না, না। আহত হওয়ার কি আছে? একটা বিশেষ বয়সের সব মেয়েই তাই করে।

 প্রশংসার দৃষ্টিতে চাইল মাগেনখেলার রানার দিকে। আশ্চর্য তীক্ষ্ণ। আপনার বোধশক্তি!

এর মধ্যে তীক্ষ্ণতাটা কোথায় বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল রানা কিছুক্ষণ। তারপর ইরিনের দিকে ফিরে নরম গলায় ডাকল, ইরিন?

উত্তর দিল না ইরিন। মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে, একটু নড়েচড়ে আরও ভাল করে মাথা গুজল রানার ঘাড়ে, চোখদুটো শক্ত করে টিপে বন্ধ করে রেখেছে। হাসির মধ্যে এতই সহজ সরল নিষ্পাপ একটা তৃপ্ত ভাব দেখতে পেল রানা যে কেন যেন নিজেকে ঠগবাজ মত মনে হলো ওর।

আবার চেষ্টা করে দেখল রানা। ইরিন, আমার মনে হয় তোমার চোখ। দুটো খুব সুন্দর। দেখি তো সত্যি কিনা?

কথাটা ভেবে দেখল ইরিন চোখ বুজেই, হাসল আবার, তারপর রানার কোলের ওপর সোজা হয়ে বসে হাত দুটো সোজা রেখে দুই হাতে ধরল রানার দুই কাঁধ , চোখ দুটো বড় বড় করে চাইল রানার চোখে-ঠিক বাচ্চা মেয়ের মত।

অপূর্ব দুটো আয়ত বেগুনী চোখ, চকচক করছে–কিন্তু ভাল করে লক্ষ করতেই টের পেল রানা, দৃষ্টিটা শূন্য। চকচকে, উজ্জল ভাবটা আসলে বাইরের ব্যাপার, তার পেছনেই আশ্চর্য এক ভাবলেশহীন অন্তঃসারশূন্যতা। আস্তে করে ওর ডান হাতটা সরাল রানা কাঁধ  থেকে, কোটের আস্তিনটা তুলে। ফেলল কনুই পর্যন্ত। ক্ষতবিক্ষত হাত। হাইপোডমিক সূচের অসংখ্য খোঁচায়। দগদগে ঘায়ের মত দেখাচ্ছে। হাসি মুছে গেছে ইরিনের মুখ থেকে, নিচের ঠোঁটটা কাপল একটু, ভয়ে ভয়ে চাইল রানার মুখের দিকে–যেন আশা করছে। এক্ষুণি বকবে ওকে রানা। ঝট করে কোটের হাতা নামিয়ে দিল, পরমুহূর্তে দুই হাতে রানার গলা জড়িয়ে ধরে ফোপাতে শুরু করল। এমনভাবে কাঁদছে, যেন ওর বুক ভেঙে গেছে পুত্রশোকে। ওর পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করল রানা, ওর মাথার ওপর দিয়ে চাইল মাগেনথেলারের দিকে।

এবার বুঝতে পারছি আমাকে আপনার বাসায় নিয়ে আসবার কারণ।

ঠিকই বুঝতে পেরেছেন, বলল মাগেনথেলার। আমার বিশ্বস্ত সহকর্মীদের বিষয়টা জানানো আমি কর্তব্য বলে মনে করি।

ডি গোল্ড জানেন?

অ্যামস্টার্ডামের প্রত্যেক সিনিয়র পুলিস অফিসারই জানেন, বলল মাগেনথেলার সহজ কণ্ঠে। ইরিনের দিকে চাইল। ইরিন?

কোন জবাব না দিয়ে আরও আঁকড়ে ধরল ইরিন রানাকে। দম বন্ধ হওয়ার যোগাড় হলো রানার। এবার একটু কড়া গলায় ডাকল মাগেনথেলার, ইরিন? ঘুমোতে যাও। তুমি জানো ডাক্তার কি বলেছে। সোজা বিছানায় গিয়ে ঢোকো–যাও, লক্ষ্মী।

না, ফুঁপিয়ে উঠল ইরিন। ঘুম আসছে না।

 একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গলার স্বর উঁচু করল ইন্সপেক্টর মারগ্রিয়েট!

ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই যেন এই ডাকের জন্যেই দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়েছিল–এমনি ভাবে, ঘরে ঢুকল খোদাতালার আশ্চর্য এক সৃষ্টি। এত মোটা মেয়েমানুষ জীবনে দেখেনি রানা। দুটো রানা সামনাসামনি দাঁড়িয়ে। দুহাত বাড়ালেও বেড় পাবে না। অবিকল ইরিনের পুতুলের মত জামা-কাপড়। পরা। লাল ফিতে দিয়ে পিগটেল বাধা লম্বা চুল গলার দুপাশ দিয়ে বিশাল বুকের ওপর লুটাচ্ছে। বুড়ি। কমপক্ষে সত্তর বছর বয়স হবে। গালের এবং হাতের ভাজ দেখে বোঝা যাচ্ছে, আরও মোটা ছিল, শুকিয়ে এই হাল হয়েছে। বেচারীর। চেহারা, বয়স, চুলের লাল ফিতে আর রঙেচঙে জামা কাপড়ে মেয়েলোকটাকে রীতিমত বিদঘুটে লাগল–রানার চোখে। কিন্তু মাগেনথেলারের কাছে যে মোটেই বিসদৃশ লাগছে না বোঝা গেল তার সহজ ভঙ্গিতে ইরিনকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে চোখের ইশারা দেখে।

বিশাল বপু নিয়ে সহজ ভঙ্গিতে এগিয়ে এল মারগ্রিয়েট, রানার প্রতি ছোট্ট একটা নড় করে হাত রাখল ইরিনের কাঁধে। চট করে মাথা তুলল ইরিন, মুহূর্তে কান্না ভূলে হেসে উঠল ঝিক করে, রানার গলা ছেড়ে দিয়ে উঠে। দাঁড়াল। মাগেনথেলারের হাত থেকে পুতুলটা নিয়ে চুমো খেল ওর গালে, রানার চেয়ারের সামনে এসে রানার গালেও চুম খেল একটা, তারপর নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে হেলেদুলে ওর পেছনে পেছনে চলে গেল মারগ্রিয়েট। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইন্সপেক্টরের দিকে ফিরল রানা।

আগেই সাবধান করা উচিত ছিল আপনার, অনুযোগের সুরে বলল। রানা। ইরিন আর মারগ্রিয়েট–দুজনের ব্যাপারেই। চমকে গিয়েছি একেবারে। কে মহিলা–মানে, মারগ্রিয়েটের কথা জিজ্ঞেস করছি-নার্স?

যাইডার যীর হাইলার দ্বীপে ওর বাড়ি। বহু পুরানো লোক…আমি ছোট থাকতে কাজে লেগেছিল আমাদের বাড়িতে, মানে বাপের বাড়িতে। বছর। খানেক আগে আবার এসে হাজির কাজ দাও। ইরিনের জন্যে রেখে দিলাম। ওকে। কাপড়চোপড়ে পুরানো আমলের ট্র্যাডিশন বজায় রেখেছে, ওই দ্বীপের। সবাই তাই শহরে দেখতে একটু উদ্ভটই লাগে, কিন্তু ইরিনের ব্যাপারে দারুণ কাজ দিচ্ছে বুড়ি।

আচ্ছা। বলল রানা। আর ইরিন?

আট বছর ওর বয়স। গত পনেরো বছর ধরে আট বছরেরই রয়ে গেছে। চিরকাল ওই আট বছরই থাকবে। আমার নিজের মেয়ে না–হয়তো অনুমান করেছেন; কিন্তু নিজের মেয়ের চেয়ে কমও না। আমার বড় ভাইয়ের পালিতা কন্যা। একটা ডাচ অয়েল কোম্পানীতে সিকিউরিটি অফিসার ছিল আমার বড় ভাই। ওর স্ত্রী মারা গেছে কয়েক বছর আগেই, গত বছর ও আর আমার স্ত্রী মারা গেছে একটা মোটর দুর্ঘটনায়। কে নেবে ইরিনকে? সাত-পাঁচ ভেবে আমিই রেখে দিলাম। প্রথমটায় দায়িত্ব আর ঝামেলা ঘাড়ে করতে চাইনি-এখন এমন দাঁড়িয়েছে, ওকে ছাড়া বাঁচব বলে মনে হয় না। মানসিক বয়স বাড়বে না ওর কোনদিন।

লোকটার অবস্থা চিন্তা করে বেশ দুঃখই হলো রানার। কে ভাবতে পারবে, এমন একটা ডাকসেটে পুলিস অফিসারের অপরাধী ধরে ধরে জেলে। পোরা ছাড়া আরও কোন ব্যক্তিগত গোপন দুঃখ বা সমস্যা থাকতে পারে? বিশেষ করে এই ধরনের সমস্যা। সহানুভূতি বা সান্তনা ওর তেমন ভাল আসে না, তাই সেদিকে না গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করল, এই যে নেশা–কবে এর খপ্পরে পড়ল?

আল্লাই মালুম। বহু বছর আগে। আমার ভাই যখন টের পেল তারও, বেশ কয়েক বছর আগে।

কয়েকটা দাগ দেখলাম নতুন?

উইথড্রয়াল ট্রিটমেন্ট চলছে ওর। ঝট করে বন্ধ করে দিলে মারাই যাবে। বেচারী। কিন্তু আসল সমস্যা সেটা নয়–প্রায়ই কারা যেন ওকে ফুল-ডোজ দিয়ে যায় গোপনে। বাজপাখির মত সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে ওর ওপর মারগ্রিয়েট। রোজ সকালে ভন্ডেল পার্কে নিয়ে যায়-ওখানে পাখিদের বুট খাওয়াতে খুব ভালবাসে ইরিন। দুপুরে ঘুমোয়। বিকেলের দিকে আমি প্রায়ই থাকি না, মারগ্রিয়েটও হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়ে সেই ফাঁকে কাজ হাসিল করে চলে যায়। ওরা।

ওকে ওয়াচ করবার ব্যবস্থা করেননি?

বহুবার। কিভাবে ওর কাছে সাপ্লাই পৌঁছায় কেউ ধরতে পারেনি।

আপনাকে বাগে আনবার জন্যে ওর ওপর ওষুধ প্রয়োগ করছে ওরা?

এছাড়া আর কি হতে পারে? আমার ওপুর চাপ সৃষ্টি করতে চায়। টাকা দিয়ে কেনে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত; টাকা নেই ইরিনের। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই হেরোইন সাপ্লাই দিচ্ছে ওরা ইরিনকে। ওরা জানে না, চোখের সামনে মরে যেতে দেখব ইরিনকে, তব কম্প্রোমাইজ করব না আমি কিছুতেই। যত ভাবে যত চেষ্টাই করুক, নোয়াতে পারবে না ওরা আমার। মাথা। কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি করছে না তাই বলে।

চব্বিশ ঘণ্টা গার্ডের ব্যবস্থা করা যায় না?

 সেটা করতে গেলে খাতিরে হবে না, ব্যাপারটাকে অফিশিয়াল করতে। হবে। এই ধরনের অফিশিয়াল অনুরোধ হেলথ অথোরিটির কানে যেতে বাধ্য। তারপর?

মাথা ঝাঁকাল রানা। পাগলা গারদে পুরে দেয়া হবে ওকে। কোনদিন। ফিরে আসবে না আর।

কোনদিন না। চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেল মাগেনথেলারের। মাথা নাড়ল সে এপাশ-ওপাশ।

 আর কি বলা যায় বুঝতে না পেরে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল রানা ড্রইংরূম থেকে।

.

০৬.

সারাটা দুপুর হোটেল কামরায় বসে কর্নেলের দেয়া ক্রস-ইনডেক্স করা ফাইল ঘটল রানা। ফাইলে গত তিনটে বছর অ্যামস্টার্ডামে ডাগ সংক্রান্ত যত রকমের যত কেস হয়েছে তার বিবরণ সাজানো আছে। প্রত্যেকটাই। দুঃখেরকোনটা মৃত্যু, কোনটা আত্মহত্যা, কোনটা বা পারিবারিক ভাঙন আর সাংসারিক অশান্তির কাহিনী।

নানান ভাবে চোখ বুলাল রানা ওগুলোর ওপর, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ক্রস ইনডেক্সগুলোকে নানান ভাবে সাজাবার চেষ্টা করল; কিন্তু সবই বৃথা। কোন প্যাটার্ন পাওয়া গেল না। ঘণ্টা দুয়েক ফাইলটা নাড়াচাড়া করে প্রবোধ দিল। সে নিজের মনকে কর্নেল ডি গোল্ড আর ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের মত ঘুঘু অফিসার যদি এসব ধৈর্যের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরীক্ষা করে কোন প্যাটার্ন। বের না করতে পেরে থাকে, তাহলে সে কোন ছার? ফাইল ঘাটা কোনদিনই ভাল লাগে না ওর, কাজেই এসব ঘেটে আশ্চর্য কিছু আবিষ্কারের আশা করা বৃথা। নেহায়েত বোকামি। কোন লাভ হবে না ধরে নিয়ে ফাইল বন্ধ করে। ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে উঠল সে শেষ বিকেলে।  

ঘুম থেকে চাঙ্গা হয়ে উঠে স্নান সেরে নিল সে গরম পানিতে। ঘন ছাই রঙের একটা স্যুট গায়ে চড়িয়ে নেমে এল নিচে। রিসিপশন ডেস্কে চাবিটা। বাড়িয়ে দিতেই হাসিমুখে এগিয়ে এল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। আজকের হাসিতে আগেকার সেই অতি স্মার্টনেস দেখা গেল না, রীতিমত একটা সমীহ ভাব টের পেল রানা ওর ব্যবহারে। বুঝল, রানাকে হালকাভাবে গ্রহণ করতে বারণ করা হয়েছে ওকে।

গুড ইভনিং, গুড ইভনিং, মিস্টার রানা। ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গি করল সে। কাল হয়তো একটু খারাপ ব্যবহারই করে ফেলেছিলাম কিন্তু সেই সময়…

আরে না, না। ও কিছু না। ভদ্রতার দিক থেকে রানাই বা কম যাবে। কেন? কিছু মনে করিনি আমি। ওই রকম একটা অবস্থায় কার সাথে কে কি ব্যবহার করছে সেসব দেখলে কি চলে? দেখাই যাচ্ছিল, খুবই মুষড়ে পড়েছিলেন আপনি সেটাই স্বাভাবিক। কাঁচের দরজা দিয়ে বাইরের বৃষ্টির দিকে চাইল রানা। ট্যুরিস্ট গাইডে কিন্তু এই বৃষ্টির উল্লেখ নেই মোটেই।

যেন কথাটার মধ্যে মস্ত কিছু রসিকতা রয়েছে এমনি ভাবে হেসে উঠল। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, যেন হাজার টুরিস্টের মুখে হাজার বার শোনেনি। সে-রানার মুখেই প্রথম শুনছে এই রকম একটা কথা। তারপর জিজ্ঞেস করল, বেরোচ্ছেন বুঝি?

হ্যাঁ। য্যানডামের দিকে চলোম। যা মাথায় এল যা খুশি একটা নাম বলে দিল রানা।

য্যানডাম? হুঁ, য্যানডাম! বিজ্ঞের মত মাথা ঝাঁকাল লোকটা। অপেরায়?

ঠিক ধরেছেন, বলেই বেরিয়ে পড়ল রানা সদর দরজা দিয়ে। ডোরম্যানকে ইঙ্গিত করতেই পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে একটা ট্যাক্সি এসে হাজির। হয়ে গেল গেটের কাছে। উঠে বসল রানা পেছনের সীটে, ডোরম্যানকে শুনিয়ে ড্রাইভারকে বলল, শিফল এয়ারপোর্ট।

রওনা হলো ট্যাক্সি। রানা লক্ষ করল, আরেকটা ট্যাক্সিও রওনা হলো। পিছন পিছন। সামনের ট্রাফিক লাইটে গাড়িটা থামতে পেছন ফিরে ভাল করে। দেখে নিল রানা হলুদ স্ট্রাইপ আঁকা মার্সিডিজ ট্যাক্সিটা–আরোহী নেই, ড্রাইভার একা। ট্রাফিক লাইট সবুজ হতেই ভিযেলস্ট্রাট ধরে এগোল ট্যাক্সি, পিছনেরটাও চলল সেই একই দিকে।

ব্যাপারটা ভালমত বুঝে নেয়ার জন্যে ড্রাইভারের কাঁধে দুটো টোকা দিল। রানা।

এখানে থামো একটু, সিগারেট কিনব। ট্যাক্সি থেমে দাঁড়াতেই নেমে পড়ল রানা। দেখল, পেছনের ট্যাক্সিটাও থেমে দাঁড়িয়েছে। কেউ উঠল না, কেউ নামল না–যেন ইচ্ছে হয়েছে তাই দাঁড়িয়েছে ট্যাক্সিটা, এমনি। একটা হোটেল ফোয়ায়ারে ঢুকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে রানা যখন বেরোচ্ছে, তখনও তেমনি দাঁড়িয়ে রয়েছে ওটা। রওয়ানা হয়ে গেল রানার ট্যাক্সিটা, খানিক চলবার পর রানা বলল, ডাইনে মোড় নাও। প্রিনসেনটি ধরে। এগোও।

কিন্তু ওটা তো শিফলের রাস্তা না। আপত্তি জানাল ট্যাক্সি ড্রাইভার।

না হোক। ওই রাস্তা দিয়েই যেতে চাই আমি। ডাইনে ঘোরো।

 ঘুরল ড্রাইভার, পেছনে মার্সিডিজটাও ঘুরল এইদিকেই।

থামো। দাঁড়িয়ে পড়ল ড্রাইভার। মার্সিডিজও দাঁড়িয়ে গেছে। রাগ হলো রানার। সবকিছুরই একটা সীমা আছে। চিড়িয়া মনে করেছে নাকি ওকে। ব্যাটারা? নাকি ননীর পুতুল? গাড়ি থেকে নেমে মার্সিডিজটার দিকে এগিয়ে। গেল রানা, এক ঝটকায় দরজা খুলে বাকা হয়ে ঝুঁকল সামনের দিকে। নীল স্যুট পরা বেটেখাট, মোটা, টাকপড়া এক লোক বসে আছে ড্রাইভিং সীটে, চেহারায় একটা বেপরোয়া ভাব।

গুড ইভনিং, বলল রানা। ভাড়া যাবে?

না। ভুরু কুঁচকে আপাদমস্তক দেখল লোকটা রানাকে, বোঝাবার চেষ্টা করল–খোঁড়াই কেয়ার করে সে রানাকে, তেড়িবেড়ি করে লাভ হবে

তাহলে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

সিগারেট খাওয়ার জন্যে কেউ থামতে পারবে না, এমন কোন আইন আছে?

না, এরকম আইন নেই। কিন্তু তুমি তো সিগারেট খাচ্ছ না, বাছা?হাসল রানা। যাই হোক, মানিক্সস্ট্রাটের পুলিস হেডকোয়ার্টারটা চেনা আছে? লোকটাকে গম্ভীর হয়ে যেতে দেখে রানা বুঝল, ভাল করেই চেনা আছে ওর জায়গাটা। বলল, সোজা চলে যাও ওখানে। ওখানে গিয়ে হয় কর্নেল ডি মোন্ড নয়তো ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের সঙ্গে দেখা করে বলো কার্লটন হোটেলের ছশো বাইশ নম্বরে থাকে মাসুদ রানা–তার বিরুদ্ধে তোমার একটা কমপ্লেন আছে।

কমপ্লেইন্ট? অবাক হয়ে চাইল লোকটা রানার মুখের দিকে। কিসের কমপ্লেইন্ট?

 নালিশটা হচ্ছে এই যে, লোকটা তোমার গাড়ির ইগনিশন কীটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে খালের মধ্যে। কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিদুৎবেগে ইগনিশন কী বের করে নিল রানা। লক থেকে, সাই করে ছুঁড়ে মারল ওটা খালের মাঝ বরাবর। ছপাৎ শব্দ তুলে তলিয়ে গেল চাবিটা। ছানাবড়া হয়ে গেছে লোকটার চোখ। চোখ টিপল। রানা। আর কোনদিন আমাকে অনুসরণ করবার চেষ্টা কোরো না। লোকটা আমি তেমন সুবিধের নই। দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে দ্রুতপায়ে ফিরে এল সে নিজের ট্যাক্সিতে।

মেইন রোডে উঠে এসে আবার থামতে বলল রানা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে। পাওনা চুকিয়ে দিয়ে বলল, ভাবছি, হেঁটেই যাব।

 শিফল যাবেন হেঁটে। চোখদুটো কপালে উঠল ড্রাইভারের। কত। কিলোমিটার জানা আছে আপনার?

মাথা ঝাঁকাল রানা জানো তো না কত হাঁটতে পারি ভঙ্গিতে। ট্যাক্সিটা চোখের আড়াল হতেই লাফিয়ে উঠল সে একটা ট্রামে, সোজা গিয়ে নামল ড্যামে। গাঢ় রঙের একটা লম্বা কোট পরে, গাঢ় রঙের একটা স্কার্ফ দিয়ে মাথা– ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে সোহানা ট্রাম শেলটারে। রানার অপেক্ষায়। স্যাৎসেতে, আবহাওয়ায় চুপসে গেছে।

আধঘণ্টা লেট। সময়জ্ঞান কবে হবে তোমার, রানা?

বসকে ক্রিটিসাইজ করতে নেই, সোহানা। হাঁটতে শুরু করল রানা।

রানার পাশাপাশি এগোল সোহানা। গতরাতে ছাইরঙা লোকটাকে অনুসরণ করে যে পথে গিয়েছিল সেই পথ ধরে এগোল ওরা। ক্র্যাসনাপোলস্কি। হোটেলের পাশ দিয়ে, আউডেজি ভুর্বার্গোয়াল খালের ধার ঘেষে সারি সারি। ওয়েরহাউজ ঠাসা পুরানো শহরের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ হেঁটে হঠাৎ রানার হাত ধরল সোহানা, মুখের দিকে চাইল।

তোমাকে এত ভয় পেতে আগে কোনদিন দেখিনি আমি, রানা।

তাই নাকি? কি করে বুঝলে যে ভয় পেয়েছি?

তোমার গোপনীয়তা দেখে। সাবধানতা দেখে।

আগে খুব অসাবধান ছিলাম বুঝি?

সোহানা বুঝল, এই লাইনে কথা এগোবে না, কাজেই সরাসরি প্রশ্ন। করল, কতদূর এগোলে? কি করে বেড়াচ্ছ দিন রাত? দেখা নেই কেন? মারিয়া বলছিল, আমাদের মানুষ বলে গণ্য করো না তুমি, দাবার ঘুটির মত ব্যবহার করছ। আমারও তাই মনে হচ্ছে এখন। তুমি বদলে গেছ, রানা।

তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ একটু কম রাখছি, এটা বলতে পারো। কিন্তু তোমাদের মানুষ বলে গণ্য করি না, দাবার খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছি,

এসব একটু বাড়াবাড়িই মনে হচ্ছে আমার কাছে। কোন রকম দুর্ব্যবহার…

না। তোমার ব্যবহার সম্পর্কে কারও কোন নালিশ নেই। নালিশ দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে। কাজ করতে এসেছি আমরা এখানে–কিন্তু কাল বিকেল। থেকে আজ সন্ধে পর্যন্ত পচা এক হোটেলে বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কি কাজ করেছি আমরা? কাজ কতটা হয়েছে, কতটা বাকি আছে, কিছুই জানি না কেন আমরা?

আমিই কি জানি? হাসল রানা। দেখো, সোহানা, এখানে এক জঘন্য, অপ্রীতিকর কাজ নিয়ে এসেছি আমরা। প্রতিপক্ষ সম্পর্কে পরিষ্কার কোন ধারণা। নেই আমাদের। অথচ আমাদের আগাপাশতলা সবই জেনে গেছে। শত্রুপক্ষ। তোমাদের কথা জানি না, কিন্তু আমার সম্পর্কে সব কিছু ওদের। কাছে জলের মত পরিষ্কার। এই অবস্থায় কাজ করা কতটা মুশকিল তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। ভয়ও পেয়েছি আমি এই জন্যেই। আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে কতটা শক্তি ধরে ওরা। মানে মানে কেটে না পড়লে আমার কপালে কি ঘটবে সেটা জানাতেও কসুর করেনি। এই অবস্থায় তোমাদের দূরে সরিয়ে না রেখে বুকের কাছে টানলেই কি ভাল হত?

তাই বলে কি ঘটছে সেটা জানবারও অধিকার নেই নাকি আমাদের?

আছে। সময় হলেই সব জানতে পারবে। আগেই যদি হার্টফেল করে। বসো, কাজের অসুবিধে হবে আমার।

অর্থাৎ, আমাদের দিয়েও কাজ আছে?

নিশ্চয়ই। কাজ না থাকলে এখন কোথায় চলেছ? অভিসারে?

ভলেনহোভেন কোম্পানীর গলিটায় ঢুকল ওরা। গত কালকের মতই নির্জন। তেমনি ছমছমে একটা ভাব। রাস্তার দুপাশে দাঁড়ানো সারি সারি উঁচু বাড়ির মাথাগুলো মনে হচ্ছে আরও কাছে চলে এসেছে আজ, আগামীকাল এই সময় নাগাদ লেগে যাবে একটার সঙ্গে আরেকটা। পায়ের তলায়। কাকরগুলোও আজ যেন কড়মড় করছে একটু বেশি বেশি।

নিশ্চিন্ত মনে চলতে চলতে হঠাৎ আৎকে ওঠা ঘোড়ার মত থমকে দাঁড়াল। সোহানা, খপ করে চেপে ধরল রানার হাত। বিস্ফারিত চোখে ওপর দিকে চেয়ে রয়েছে সে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে রানা দেখল, ডাইনীর নখের মত দেখাচ্ছে সারবাধা পাঁচতলা দালানগুলোর মাথার হয়েস্টিং বীমগুলোকে। ওপরে আকাশ-বীমগুলোর সিলুয়েট দেখে মনে হচ্ছে অশুভ কিছু।

পৌঁছে গিয়েছি। ফিসফিস করে বলল সোহানা। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, এসে গেছি আমরা ঠিক জায়গায়।

মেয়েদের থাকে এই ক্ষমতা, জানে রানা, তবু অবাক হলো সে সাহানার। অশুভকে অনুভব করার ক্ষমতা দেখে। অনেক কিছুই বুঝে ফেলে ওরা আগে থেকে। কিন্তু এখন ওসব পাত্তা দিলে চলবে না। সহজ কণ্ঠে বলল সে, এসে তো গেছিই। তাই বলে অমন কুঁকড়ে যাওয়ার কি আছে?

এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিল সোহানা। পছন্দ হয়নি রানার স্বরে টিটকারির ভাবটা। কিন্তু রানা যখন আবার হাতটা তুলে নিয়ে বুকের কাছে চেপে ধরল, বাধা দিল না।

কেমন যেন গা ছমছম ভাব এই গলিটায়। ওই বিদঘুটে জিনিসগুলো কি?

ওগুলো হয়েস্টিং বীম। আগেকার দিনে বাড়ির সামনেটা কতখানি চওড়া, তাই দেখে ট্যাক্স ধরা হত। কৃপণ ডাচরা তাই সরু করে বানাত বাড়ি। ফলে ওপরতলায় ওঠার সিঁড়িটাও চিকন রাখতে হত–ভারী জিনিস ওই সিঁড়ি দিয়ে। ওঠানো নামানো যায় না। তাই বড়সড় জিনিসের জন্যে এই হয়েস্টিং বীমের ব্যবস্থা। ধরো, একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো তুলতে হবে ওপরে, কিংবা কফিন নামাতে হবে

চুপ করো! কাঁধ দুটো একটু উঁচু করে শিউরে উঠল সোহানা। এটা ভয়ঙ্কর এক জায়গা। মনে হচ্ছে মরণের হাতছানি টের পাচ্ছি আমি এখানে। এ কোথায় নিয়ে এলে তুমি আমাকে? রানার মুখের দিকে চাইল, কক্সবাজারের সেই ডক্টর শিকদারের কথা মনে আছে? সেই রকম অশুভ প্রেতাত্মার ছায়া দেখতে পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে।

ব্যাপারটা হালকা করবার চেষ্টা করল রানা। শিকদারের ভয়ে আমার। সাথে কি করেছিলে, সেসব মনে হচ্ছে না?

আমি করেছিলাম?–না তুমি জোর করে হেসে ফেলল সোহানা, পরমুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেল। ঠাট্টা নয়, রানা। তুমি কিছু অনুভব করতে পারছ না? এ গলির আনাচে কানাচে দেখতে পাচ্ছ না মৃত্যুর কালো ছায়া?

না। পাচ্ছি না। কঠিন সুরে বলল রানা। মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে এদিকে, যে শিরশির করে শীতল একটা ভয়ের যোত ওঠানামা শুরু করেছে, বুকের ভিতর গুড়গুড় করছে বিপদের আশঙ্কা, সেকথা ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দিল না সে সোহানাকে। গভীর কণ্ঠে বলল, এসব আজগুবি কল্পনাকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হচ্ছে না, সোহানা। চলো, এগোনো যাক।

আজগুবি কল্পনা! ভয়ানক ভাবে শিউরে উঠল সোহানা একবার। বেত পাতার মত থির থির করে কাঁপছে ওর সর্বাঙ্গ। কয়েক পা এগিয়ে বলল, কল্পনা নয় রানা, আমি মনের ভেতর থেকে অনুভব করতে পারছি। এই ভয়ঙ্কর গলিতে আমাদের না ঢুকলেই কি নয়?

থমকে দাঁড়াল রানা। যে রাস্তায় এসেছ সেটা চিনতে পারবে? অবাক হয়ে মাথা ঝাঁকাল সোহানাপারবে। রানা বলল, ভেরি গুড। সোজা। হোটেলে ফিরে যাও। পরে দেখা করব আমি তোমার সাথে।

হোটেলে ফিরে যাব? রানা যে ঠিক কি বলছে এখনও বুঝতে পারেনি সোহানা। মানে?

হোটেলে ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করো আমার জন্যে। কোন চিন্তা নেই, তোমার ভূতেরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। যাও, রওয়ানা হয়ে যাও।

ঝট করে একটানে হাতটা ছাড়িয়ে নিল সোহানা রানার হাতের নিচ থেকে। রানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই হাতে ওর কোটের দুই কলার। ধরল। পাগলের মত আঁকাবার চেষ্টা করছে সে রানাকে কলার ধরে। বহুবার। বহু ঝগড়া হয়েছে, কিন্তু সোহানার এমন রুদ্রমূর্তি আগে কোনদিন দেখেনি রানা। ভয়ডর কোথায় উড়ে গেছে তার পাত্তা নেই, এখন কাঁপছে রাগে। আঙুলের গিটগুলো সাদা হয়ে গেছে প্রাণপণ শক্তিতে কলার চেপে ধরায়।

 খবরদার। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সোহানা। আর কোনদিন এ ধরনের কথা বলবে না আমাকে।

রানা বুঝল, অপমানিত বোধ করেছে সোহানা ওর কথায়। এখন ওর। মেজাজের গোড়ায় বারুদ ধরা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মৃদুহেসে বলল, ঠিক আছে, আর কোনদিন বলব না।

আচ্ছা। রানার কুঁচকে যাওয়া কলার ছেড়ে দিয়ে ওটাকে সোজা করবার চেষ্টা করল সে হাত বুলিয়ে। মুহূর্তে পানি হয়ে গেছে ওর রাগ। সহজ ভঙ্গিতে খপ করে ওর ডানহাতটা পেঁচিয়ে ধরে টানল সামনের দিকে। ঠিক আছে, চলো এবার। আর…এরকম একটা বাজে ব্যবহার করে বসায় মাফ করে দাও আমাকে। রানার মুখের দিকে চাইল ঘাড় বাকিয়ে। পায়ে ধরতে হবে, না এমনিই মাফ করবে?

আগে শোনা যাক মাফ না করলে কি করবে?

জালাতন করে মারব–শয়নে, স্বপনে।

 শুধু শয়নে করলে চলে না?

তাতে কি লাভ?

তাহলে আর ইমিডিয়েট মাফটাফের মধ্যে না গিয়ে তোমার জন্যে নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করতে পারি আমি বিছানায় শুয়ে।

তোমার ওই এক কথা। ওসব ছাড়া আর কিছু নেই যেন মানুষের জীবনে।

আর কি আছে? শুকনো আদর? ওসবে আমার… গলার স্বর পরিবর্তন। করল রানা। দাঁড়াল। এসে গেছি।

 সাইনবোর্ডটা পড়ল সোহানা মৃদু কণ্ঠে ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানী।

তুমি রাস্তার দুপাশটা লক্ষ রাখো, বলে চার ধাপ সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায়। উঠে পড়ল রানা।

খালি রাস্তাটার দিকে, নাকি

আর আমার পিঠের দিকেও খেয়াল রেখো একটু, কেউ যেন আচমকা ছুরি বসাতে না পারে।

সিঁড়ি দিয়ে দুই ধাপ ওপরে উঠে গলা বাড়িয়ে রাস্তার ওপর চোখ রাখল সোহানা। দুই মিনিটের চেষ্টাতেই খুলে ফেলল রানা দরজাটা। ভিতরে ঢুকে পড়ল দুজন। আবার চাবি মেরে চাবিটা তালার মধ্যেই রেখে দিল রানা। দুজনের হাতে বেরিয়ে এসেছে দুটো টর্চ-বানার হাতেরটা ছোট কিন্তু অত্যন্ত। জোরাল। গোটা একতলায় দেখার মত কিছুই পেল না ওরা। পাশাপাশি তিনটে ঘরে গাদা করা আছে অসংখ্য কাঠের প্যাকিং বাক্স মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত। আর রয়েছে ক্র্যাপ পেপার, কার্ডবোর্ড, খড় এবং বাধাই ও বেলিঙের। যন্ত্রপাতি। মালপত্র প্যাকিং হয় এখানে।

সরু ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলল এবার ওরা। অর্ধেক উঠে ঘাড় ফিরিয়ে পেছন দিকে চাইল রানা, দেখল সোহানাও তাই করছে, চারপাশে টর্চ বুলিয়ে নিশ্চিত হতে চাইছে যে আর কেউ নেই।

দোতলার প্রথম দুটো ঘর হাজার পদের সুভ্যেনিরে ঠাসা। ডাচ পিউটার, উইন্ডমিল, কুকুর, বাঁশি-হরেক রকমের জিনিসে সাজানো রয়েছে দেয়ালের গায়ে বসানো শেলফ আর ঘরের মাঝামাঝি আড়াআড়ি করে রাখা র‍্যাকে। চারপাশে একবার আবছা ভাবে চোখ বুলিয়ে কোন কিছুই সন্দেহজনক বলে। মনে হলো না রানার কাছে। কিন্তু তৃতীয় ঘরের দরজার সামনে এসেই ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠল ওর। সোহানাকে ডেকে দেখাল দরজাটা।

আশ্চর্য! চোখমুখ বকাল সোহানা। টাইম লক। সাধারণ একটা অফিসের দরজায় টাইম লক কেন?

এর সহজ উত্তর হচ্ছে এটা সাধারণ একটা অফিস দরজা নয়। একটু লক্ষ করলেই বুঝতে পারবে দরজাটা কাঠের নয়-স্টীলের। ডায়মন্ডের গুদাম হলে একটা কথা ছিল, বোঝা যেত–না, স্টীলের দরজার একটা যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু এখানে? কী এমন জিনিস আছে এদের এখানে এত সাবধানে। রাখবার মত?

মনে হচ্ছে ঠিক জায়গায়ই হাজির হয়েছি আমরা, বলল সোহানা।

আমি তোমাকে ভুল জায়গায় নিয়ে যাব এমন সন্দেহ ছিল বুঝি তোমার?

না। তা ছিল না। কিন্তু এই বাড়িটা আসলে কি? কিসের স্টোরহাউজ?

এখনও বুঝতে পারোনি? সুভ্যেনির ব্যবসার হোলসেলার এরা। ফ্যাকটরিই বলো, বা কুটির শিল্পের কারখানাই বলো, প্রস্তুতকারক সরাসরি মাল পাঠিয়ে দেয় এই স্টোরহাউজে, এখান থেকে বিভিন্ন দোকানের অর্ডার। অনুযায়ী যার যা দরকার প্যাকিং করে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সহজ, সরল, নিপাপ, নিষ্কলুষ, আইনসম্মত, পরিষ্কার ব্যবসা।

কিন্তু খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়, বলল সোহানা নাক কুঁচকে।

 অস্বাস্থ্যকর কি পেলে?

বিচ্ছিরি একটা গন্ধ পাচ্ছ না?

ও। ক্যানাবিস।কারও কারও কাছে ক্যানাবিসের গন্ধ খুব খারাপ লাগে।

ক্যানাবিস? কি সেটা?

বেণী বেঁধে স্কুলে যাওয়া-আসা ছাড়া আর কিছুই করোনি জীবনে!.. এপাশ-ওপাশ চাইবার সময় পাওনি। কামন। আপ।

তেতলায় উঠে এল ওরা। কয়েক মিনিট আগেকার তেজ বেমালুম উবে গেছে সোহানার চেহারা থেকে। ফ্যাকাসে মুখে চঞ্চল দৃষ্টি বুলাচ্ছে সে চারপাশে। ক্যানাবিসের গন্ধ আরও বেড়েছে এখানটায়, কিন্তু ঠিক কিসের থেকে আসছে বোঝা গেল না। নিস্তব্ধ এই পুরানো দালানটায় থমথম করছে যেন জঘন্য এক পাপীর প্রেতাত্মা। তিন দেয়ালের তিনটে র‍্যাকে সারি সারি। সাজানো রয়েছে দেয়াল ঘড়ি। ছোট, মাঝারি, বড়-হরেক রকম। বেশিরভাগই সস্তা দরের, পালিশ করা হলুদ পাইনের কাঠামো। কিন্তু দামী ঘডিও রয়েছে বেশ অনেকগুলো। ভাগ্যিস পেন্ডুলামগুলো থেমে রয়েছে; যদি সবকটা চলতে থাকত তাহলে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার দশা হত ওদের। ঘরের চতুর্থ দেয়ালের শেলফে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত দশটা তাক ঠাসা রয়েছে অদ্ভুত এক জিনিসে-বাইবেল। একেক তাকে তিন সারি করে। বাইবেল রাখা। সুভ্যেনির ওয়েরহাউজে বাইবেল কেন, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না রানা। এগিয়ে গিয়ে একটা বের করল টেনে। চামড়ার কাভার, তার ওপর সোনালী অক্ষরে এমবস করা রয়েছে দি গ্যাব্রিয়েল বাইবেল। মলাট ওল্টাতেই দেখা গেল প্রথম পাতায় ছাপার অক্ষরে লেখাউইথ দা কমপ্লিমেন্টস অফ দা ফাস্ট রিফর্মড চার্চ অফ দা অ্যামেরিকান হিউগানট সোসাইটি।

ঠিক এই রকম একটা বাইবেল রয়েছে আমাদের হোটেল কামুরায়, বলল সোহানা।  

মাগনা পেয়েছে, রেখে দিয়েছে হয়তো একটা করে সব ঘরে। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে–এগুলো এখানে কেন? প্রিন্টার বা পাবলিশারের গুদাম হলে এক কথা ছিল, এখানে কি করছে এসব? অদ্ভুত ব্যাপার না?

 এখানকার সব কিছুই বিদঘুটে ঠেকছে আমার কাছে, বলল সোহানী। বেরোতে পারলে বাঁচি। কথাটা বলেই শিউরে উঠল নিজের অজান্তেই।

মৃদু একটা থাবড়া দিল রানা ওর পিঠে। শীত করছে? আরও দুটো তলা বাকি রয়েছে। চলো, এবার থার্ডফ্লোর।

চারতলার পুরোটা জুড়ে শুধু পুতুল আর পুতুল। অসংখ্য। হরেক আকৃতির। একেবারে ছোট থেকে নিয়ে ইরিনের হাতে যেটা ছিল তার চেয়েও বড় পুতুল রয়েছে, অতি যত্নের সাথে অপূর্ব সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে প্রত্যেকটা। নানান রঙের ঝকমকে ডাচ ট্র্যাডিশনাল পোশাক পরানো সব পুতুল। বড়গুলো দাঁড় করানো আছে র‍্যাকের পেছনে একটা দড়ির গায়ে। হেলান দিয়ে, ছোটগুলো ঝুলছে সুতো বাধা অবস্থায়। সবুজ, নীল, খয়েরী। চোখের মিষ্টি সব পুতুল।

সাহসিকা সোহানা একহাতে খামচে ধরে আছে রানার কোটের হাতা। ভয়ে ঈষৎ বিস্ফারিত হয়ে গেছে ওরআয়ত চোখ। ফিসফিস করে বলল, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে শিরশির করছে সারা শরীর। মনে হচ্ছে জ্যান্ত সব পুতুল, লক্ষ করছে আমাদের।

ফিসফিস কররার দরকার নেই, বলল রানা মৃদু হেসে। দেখছে ঠিকই, কিন্তু আমি শিওর, একটা কথাও শুনতে পাচ্ছে না পুতুলগুলো। ঠিক এই রকম কাপড় পরা একটা জ্যান্ত পুতুল দেখেছি আমি আজ সকালে ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের বাসায়। ইরিনের নার্স। এগুলো সব এসেছে যাইডার যীর। হাইলার দ্বীপ থেকে। ইরিনের হাতেও দেখেছি একটা পুতুল, ঠিক এই রকম। শেষের কথাগুলো যেন সোহানাকে নয়, নিজেকেই শোনাবার জন্যে বলল রানা।

ইরিন কে?

অ্যামস্টার্ডামের নারকোটিক্স ব্যুরোর চীফ ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারের, পালিতা মেয়ে। ড্রাগ অ্যাডিক্ট।

ইন্সপেক্টরের মেয়ে ড্রাগ অ্যাডিক্ট? কি ব্যাপার ব্ল্যাকমেইল?

মেয়েটার মাধ্যমে পথে আনবার চেষ্টা করছে ওরা মাগেনথেলারকে। গোপনে হেরোইনের ডোজ সাপ্লাই দিচ্ছে ইরিনকে।

রানার হাত ছেড়ে দিয়ে চারপাশে টর্চ বুলাল সোহানা, রানা এগিয়ে গিয়ে মন দিল একটা পুতুল পরীক্ষায়। হঠাৎ দ্রুত শ্বাস টানবার শব্দে ঝট করে পেছন। ফিরল সে। দেখল, পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সোহানা, টর্চের আলোটা ধরা আছে একটা র‍্যাকের গোটা কয়েক পুতুলের দিকে। ধীর, নিঃশব্দ পায়ে পিছিয়ে আসছে সে রানার দিকে, চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে রয়েছে টর্চের আলোয়। আলোকিত জায়গাটার ওপর, পেছনে হাঁটছে আর বাম হাতে খুঁজছে সে রানাকে। কাছে আসতেই ধরল রানা হাতটা, মৃদু চাপ দিল। দৃষ্টিটা সরাল না। সোহানা রানার স্পর্শ পেয়েও। রানা টের পেল প্রবল বেগে কাঁপছে ওর হাতটা।

 চাপা, উত্তেজিত কণ্ঠে বলল সোহানা, একটা লোক! রানা! লক্ষ করছে আমাদের!

আলোকিত র‍্যাকের দিকে চাইল রানা, সঙ্গে সঙ্গেই চোখ সরিয়ে নিল। সোহানার হাত ধরে টেনে ওকে নিজের দিকে ফেরাল। চোখ ফেরাতে পারছিল না সোহানা র‍্যাকের ওপর থেকে, বহুকষ্টে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল সে রানার দিকে–যেন সম্মোহনের প্রভাব কাটিয়ে উঠল। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইল। রানা ওর চোখের দিকে। কি ব্যাপার? হোয়াটস দা ম্যাটার?

আমি দেখেছি! নিজের চোখে দেখেছি! ভয়ে দেড়গুণ বড় হয়ে গিয়েছে। ওর আয়ত চোখ।

কি দেখেছ?

 একজোড়া চোখ! র‍্যাকের ওপাশে!

অবিশ্বাসের প্রশ্নই আসে না, সোহানা যে ভুল দেখেনি সে ব্যাপারেও রানা স্থির নিশ্চিত–কারণ, যত কল্পনাপ্রবণ মেয়েই হোক, কঠোর ট্রেনিং পেয়েছে সে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স থেকে অবজার্ভেশনের সঙ্গে ইমাজিনেশন না মেশাবার ব্যাপারে। হাতের উজ্জল টর্চটা ধরল রানা র‍্যাকের দিকে, অসাবধানে সোহানার চোখে লেগে গেল আলোটা মুহূর্তের জন্যে, চোখ ধাধিয়ে যাওয়ায় চট করে একটা হাত তুলল সে চোখে। কোন মানুষ বা তার চোখ দেখতে পেল না রানা, কিন্তু যেটুকু দেখতে পেল তাতেই বুঝে নিল। সে যা বোঝার। ঘরে দমকা তো দূরের কথা, মৃদু হাওয়া ঢুকবারও কোন ব্যবস্থা নেই–অথচ দুটো পুতুল দুলছে অল্প অল্প; এতই সামান্য, যে ভাল করে লক্ষ না করলে ঠাহর করা যায় না।

সোহানার হাতে মৃদু চাপ দিল রানা। হাসল মিষ্টি করে। দেখো, সোহানা–

বিশ্বাস করছ না তুমি? আমি দেখেছি। ভয়ঙ্কর একজোড়া চোখ! কসম খেয়ে বলতে পারি-সত্যিই দেখেছি আমি।

অফকোর্স ইউ স দেম, সোহানা। সন্দেহ তো করছি না। নো ডাউট অ্যাবাউট ইট। বলল রানা, কিন্তু এমন সুরে বলল যে পাই করে ঘুরল সোহানা ওর দিকে। মর্মাহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সে কয়েক সেকেন্ড রানার মুখের দিকে, যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না সে, এই রকম একটা অবস্থায়। ওকে নিয়ে ঠাট্টা তামাসা করতে পারে রানার মত দায়িত্বশীল এক লোক। একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে সে রানার ব্যবহার দেখে।; একই সুরে রানা। বলল, আই বিলিভ ইউ, সোহানা। ঠিকই দেখেছ তুমি–অবিশ্বাস করছি না।

বিশ্বাস করার নমুনা কি এই? রেগে গেল সে। কিছু করছ না কেন। তাহলে?

করছি না কেন বললে? আবার হাসল রানা। আই অ্যাম গেটিং দা হেল আউট অভ হিয়ার। সোজা বাংলায় ভাগছি। যেন কিছুই ঘটেনি, এমনি ভঙ্গিতে সারা ঘরে একবার টর্চটা বুলিয়ে নিয়ে বাম হাতে সোহানার পিঠ জড়িয়ে ধরল রানা। চলো, কেটে পড়া যাক। দেখার মত কিছুই নেই। এখানে। গলা শুকিয়ে গেছে আমার–একটা ড্রিঙ্ক না হলে আর চলছে না। এখানকার এই ভৌতিক পরিবেশ নার্ভাস করে ফেলেছে আমাকেও।

 এক ঝটকায় রানার হাত সরিয়ে দিল সোহানা। ওর মুখে রাগ, দুঃখ আর। হতাশা দেখতে পেল রানা। ওকে নিয়ে ঠাট্টা করায় এবং ওর কথা বিশ্বাস না। করায় একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছে সে। মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু…রানা, আমি যে বলছি…

চুক চুক শব্দ করল রানা জিভ দিয়ে, তারপর ঠোঁটের উপর আঙুল রাখল। একটা। আর কোন কথা নয়। মনে রেখো, আমি যাহা জানি, তুমি জানো না…বস অলওয়েজ নোজ বেস্ট। চলো, এগোও।

কয়েক সেকেন্ড দুই চোখ দিয়ে আগুন ঝরল সোহানার, তাতে যখন, রানাকে ভস্ম করা গেল না তখন বুঝতে পারল এই লোকের সঙ্গে কথা বলে। কোন লাভ নেই, ঝট করে ঘুরে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দুমদাম পা ফেলে নামতে শুরু করল নিচে। পেছন পেছন নামছে রানা–প্রথম পনেরোটা ধাপ নামতে নামতেই চিকন ঘাম দেখা দিল ওর কপালে, ভয়ের শীতল হোত বইল শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে বারকয়েক ওপর থেকে নিচে, নিচে থেকে ওপরে। একেবারে নিচতলায় নেমে সদর দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে তালা না মারা। পর্যন্ত থামল না শিরশিরানি।

দ্রুতপায়ে ফিরে চলল ওরা মেইন রোডের দিকে। সোহানার হাত ধরবার। চেষ্টা করে বিফল হলো রানা। তিনহাত তফাতে হাঁটছে সে, মাঝে মাঝে। চোখের কাছে হাত তুলতে দেখে আন্দাজ করল হয়তো কাঁদছে ও। গজ পঞ্চাশেক চুপচাপ হেঁটে খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করল রানা।

যে লোক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পশ্চাদপসারণ করতে পারে সে আরেকবার যুদ্ধের সুযোগ পায়। মেজর জেনারেল রাহাত খানের সুপরিচিত কোটেশন ঝাড়ল রানা, কিন্তু কোনই ফল হলো না তাতে। রাগে ফুঁসছে সোহনা।

দয়া করে আমার সঙ্গে কথা বোলো না তুমি। গলার স্বর কাঁপছে আবেগে।

অবস্থা বেগতিক দেখে চুপ হয়ে গেল রানা। কিন্তু বেশ কিছুদূর হাঁটবার পর যেই একটা পাবৃ দেখতে পেল, খপ করে ধরে ফেলল সে সোহানার হাত, টেনে নিয়ে ঢুকে পড়ল ভিতরে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঢুকতে হলো সোহানাকে, নইলে সীন ক্রিয়েট করতে হয়।

সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রায়ান্ধকার এক ড্রিঙ্কিং ডেন। জনাকয়েক সেইলার যার যেমন খুশি একেবেঁকে, কেউ আবার টেবিলের ওপর পা তুলে বসে ছিল গ্লাস সামনে নিয়ে, মহিলাসহ রানাকে ঢুকতে দেখে সোজা হয়ে বসল, শান্তি। ভঙ্গ করায় আহত দৃষ্টিতে চাইল রানার দিকে। কারও দৃষ্টির কোন তোয়াক্কা না করে সোহানাকে নিয়ে কোণের এক টেবিলে গিয়ে বসল রানা। টেবিলটা দেখে মনে হচ্ছে যোড়শ শতাব্দীর অ্যান্টিক–জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত– সাবান বা পানির সঙ্গে কোন সংশ্রব ঘটেনি তার।

আমি স্কচ খাব। তুমি?

স্কচ। নির্বিকার কণ্ঠে বলল সোহানা।

তুমি না স্কচ খাও না?

আজ খাব।

বেপরোয়া ভঙ্গিতে গ্লাসের অর্ধেকটা একঢোকে খাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে কাশতে শুরু করল সোহানা ভড়কে গিয়ে। চোখমুখ লাল হয়ে উঠতে দেখে গোটা কয়েক থাবড়া দিল রানা ওর পিঠে।

হাত সরাও।গা ঝাড়া দিল সোহানা। খবরদার, ছোবে না তুমি আমাকে!

অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে নিজের গ্লাসে মন দিল রানা।

তোমার সঙ্গে কাজ করবার শখ মিটে গেছে আমার, রানা। কান ফিরে যাচ্ছি আমি। গলাটা আবার নিজের আয়ত্তে আসতেই ঘোষণা কম। সোহানা। কালই ফিরে যাব আমি ঢাকায়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আমার ওপর যার আস্থা নেই, যে আমাকে বিশ্বাস করে না, এমন। লোকের সঙ্গে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষ বলে গণ্য করো না তুমি আমাদের। এতটা তাচ্ছিল্য সহ্য করে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কেউ তোমার সঙ্গে কাজ করতে পারবে না।

আমি তোমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করিনি, সোহানা-অমানুষ বলেও গণ্য করিনি, অবিশ্বাসও করিনি, অনাস্থাও প্রকাশ করিনি। সহজ সহজ কণ্ঠেলল রানা।

অফকোর্স ইউ স দেম, সোহানা, তিক্তকণ্ঠে রানার বাচনভঙ্গি আর। রানার গলার সুর নকল করে ভ্যাংচাল সোহানা। আই বিলিভ ইউ, সোহানা। অবিশ্বাস করছি না। ইউ ডোন্ট বিলিভ মি অ্যাটল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ঠাট্টার পাত্রী আমি তোমার। আমাকে টিটকারি মেরে তুমি নিজেকে…

না, সোহানা। মাথা নাড়ল রানা। সত্যিই বিশ্বাস করেছিলাম আমি তোমার কথা। সত্যিই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল আমার। কসম খোদার। বিশ্বাস করেছিলাম বলেই মানে মানে কেটে পড়েছি ওখান থেকে।

অবাক হয়ে চেয়ে রইল সোহানা কয়েক সেকেন্ড রানার মুখের দিকে। বিশ্বাস করেছিলে…তাহলে, তাহলে কেন–

কেন তাড়া করে ধরলাম না ওকে? কারণটা পানির মত সহজ। একটু সামনে ঝুঁকে এল রানা। সত্যিই ওই র‍্যাকের পেছনে লুকিয়ে ছিল একজন লোক। চোখ দেখতে পাইনি, কিন্তু দুটো পুতুলকে সামান্য দুলতে দেখেছি আমি। র‍্যাকটার আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ রেখেছিল লোকটা আমাদের ওপর, দেখছিল আমরা কোন তথ্য প্রমাণ পেয়ে যাই কিনা। আমাদের খুন করবার কোন ইচ্ছে লোকটার ছিল বলে মনে হয় না। থাকলে সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়েই গুলি করতে পারত। কিন্তু তোমার কথামত যদি আমি লোকটাকে খুঁজে বের করবার চেষ্টা করতাম, তাহলে অবধারিতভাবে কি ঘটত কল্পনা। করতে পারো? গুলি করা ছাড়া গত্যন্তর থাকত না ওর আর। লোকটা ঠিক কোন্ জায়গাটায় আছে সেটা বুঝে ওঠার আগেই গুলি খেতে হত আমার। আমাকে খুন করে খুনের সাক্ষী হিসেবে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখত না সে কিছুতেই। বিশ্বাস করো, তোমাকেও মরতে হত ওখানেই। এখন তোমার প্রেম করবার বয়স, হুট করে মরে যাওয়াটা কি উচিত হত? বলো? আর একটা কাজ করা যেত যদি তুমি ওখানে না থাকতে…ওর সাথে লুকোচুরি খেলে ওকে। কাবু করবার চেষ্টা করতে পারতাম আমি। কিন্তু তুমি ছিলে ওখানে মস্ত বড় বাধা হিসেবে। পিস্তল নেই তোমার কাছে, এ ধরনের নোংরা খুনোখুনির অভিজ্ঞতা নেই–কাজেই ভাবলাম এসবের মধ্যে তোমাকে না জড়ানোই ভাল। কাজেই, তোমাকে টিটকারি দিইনি আসলে আমি, ওই লোকটাকে। বোঝাবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম যে তোমার কথা একেবারেই বিশ্বাস। করিনি আমি, কাজেই খোঁজাখুঁজিও করব না। সেই সময়েই ইংরেজি বুলি ছুটে গিয়েছিল আমার মুখ দিয়ে, লক্ষ্য করোনি? ওর সাথে কথা বলছিলাম আমি। আসলে। ওকে কোনমতে একটা কিছু বুঝ দিয়ে মানে মানে কেটে পড়বার তালে ছিলাম। বোঝা গেল? কেমন লাগল বক্তৃতাটা? চমৎকার না?

সত্যিই চমৎকার। দেখতে দেখতে টলটলে দুফোঁটা পানি দেখা দিল সোহানার অপূর্ব সুন্দর চোখে। আমার জন্যে…শুধু আমার জন্যে তুমি…অথচ ভুল বুঝে আমি তোমাকে টপ করে টেবিলের ওপর পড়ল দুফোঁটা পানি, আরও দুফোঁটা ম্যানুফ্যাকচার হচ্ছে। কাঁপা শ্বাস টানল সোহানা। সেজন্যেই সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আমার আগে আগে উঠেছ তুমি, নামার সময় নেমেছ পিছু পিছু–গুলি যদি করে, যেন তোমার ওপর দিয়েই যায়। টেবিলের ওপর রানার একটা হাত চেপে ধরল সোহানা। আমি তোমার। যোগ্য নই রানা। তোমাকে বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে। আমি জানি, কোনদিন তল পাব না আমি তোমার।

দি এন্ড। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল এক সেইলার। তারপর নাকে টোকা দিয়ে। পিড়িং পিড়িং ডাচ,জাতীয় সঙ্গীত বাজাতে শুরু করল। হুড়মুড় করে সব কজন। উঠে দাঁড়াল চেয়ার ছেড়ে। অর্থাৎ, সিনেমা শেষ! কান্নার মধ্যে দিয়ে মিলন হয়েছে নায়ক নায়িকার।

হেসে ফেলল রানা ও সোহানা একসাথে এতক্ষণ যে গভীর মনোযোগের সাথে ওদের নাটক দেখছিল সবাই, টের পেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল সোহানার দুই গাল। এক ঢোকে নিজের স্কচ শেষ করে, আধ ঢেকে সোহানারটুকুও নামিয়ে দিল রানা গলা গিয়ে, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে দর্শকদের উদ্দেশে বো করে বলল, নাড জেন্টলমেন, দা শো ইজ ওভার। ইউ হ্যাভ টু পে ফর দা ড্রিঙ্কস্।

হৈ হৈ করে হাসির হুল্লোড় তুলল নাবিকরা, চার-পাঁচজন একসাথে পকেটে হাত দিল রানাদের ড্রিঙ্কসের বিল দেয়ার জন্যে। হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল ওরা পাব থেকে।

হোটেলের দোরগোড়ায় হঠাৎ দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে চুমো খেলো সোহানা রানাকে। কানের কাছে নরম গলায় বলল, মাফ করেছ?

না তো! অবাক হওয়ার ভান করল রানা। এখন কি? সে সব তো ফয়সালা হবে শয়নে।

অসভ্য। বলেই হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে চলে গেল সোহানা হোটেলের ভিতর।

.

০৭.

অলিগলি বেয়ে সোহানার হোটেল থেকে আধ মাইল খানেক দূরে সরে এল। রানা হেঁটে, তারপর ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ফিরে এল নিজের হোটেলে। ওভারকোটটা হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে পেছন ফিরতেই চোখ পড়ল ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের ওপর। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে রানার দিকে চেয়ে।

য্যানডাম থেকে এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন?

মাঝ রাস্তায় মনে পড়ে গেল বাথরূমের চেইন টানা হয়নি, তাই ফিরে এলাম, বলল রানা। না, না, এক্ষুণি চাবি লাগবে না, আপাতত বারে যাচ্ছি।

হুইস্কির গ্লাস সায়া নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল রানা। কি তথ্য সংগ্রহ করেছিল ইসমাইল যার জন্যে প্রাণ দিতে হলো ওকে? নাকি এটা ওর প্রতি সাবধানবাণী? ইসমাইলকে ব্যবহার করা হয়েছিল শুধু ওকে চিনে নেয়ার। জন্যে? গোপনে ঘর সার্চ করছে, হোটেল থেকে বেরোলেই অনুসরণ করছে, সর্বক্ষণ ওর ওপর নজর রাখছে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আর সেই সঙ্গে আরও কজন কে জানে, পুতুলের পেছনে দেখা যাচ্ছে একজোড়া চোখ, ইন্সপেক্টরের। ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে তার পালিতা মেয়েকে হেরোইন সাপ্লাই দিয়ে, অথচ ধরা যাচ্ছে না কাউকে সব মিলিয়ে কি দাঁড়ায়? সবকিছু জগাখিচুড়ি পাকিয়ে মস্ত একটা ঘোড়ার ডিম হয়ে যাচ্ছে না?

একমাত্র ভরসার কথা, রানার ওজন এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি ওরা। সেইজন্যেই দ্বিধা করছে ওকে সাফ করে দেয়ার ব্যাপারে। আর কোন কারণ থাকতে পারে না ওকে এভাবে অবাধে ঘুরতে ফিরতে দেয়ার, বাঁচিয়ে রাখার। এখনও ওদের যথেষ্ট পরিমাণে উত্যক্ত করতে পারেনি সে, এমন কিছু করতে পারেনি যাতে ওদের পিলে চমকে যেতে পারে। যতক্ষণ না সেটা ঘটছে, ভদ্রতার মুখোশ খসাবে না ওরা-কদিন রাডহাউন্ডের মত হন্যে হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে হতাশ হয়ে যদি সে ফিরে যায় দেশে, সেটাই তো লাভ। ওদের চমকে দিতে হলে গভীর রাতে আজ আর একবার যেতে হবে ওর ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে একা। সোহানাকে ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দিলে চলবে না। অন্য কোন লাইন যখন খুলছে না, এইদিকেই। আর একটু চাপ দিয়ে দেখতে হবে ওদের প্রতিক্রিয়া। ঠিক কটার সময় রওনা হলে ভাল হয় ভেবেচিন্তে স্থির করবার চেষ্টা করছিল রানা, এমনি সময়ে হঠাৎ চোখ তুলে চাইল সে সামনের আয়নার দিকে। ই এস পি বা ষষ্ঠেন্দ্রিয় বা ওই জাতীয় কিছু নয়, পরিচিত একটা গন্ধ নাকে আসতেই কৌতূহলী চোখ তুলল সে গন্ধের উৎসটা দেখবার জন্যে। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই আবছাভাবে পাচ্ছিল সে গন্ধটা, হঠাৎ বুঝতে পারল ওটা চন্দন কাঠের গন্ধ, চট করে মনে পড়ল এর আগে কোথায় পেয়েছিল সে এই গন্ধটা–তাই এই ঔৎসুক্য।

রানার ঠিক পেছনের টেবিলেই বসে রয়েছে মেয়েটা, টেবিলের ওপর। একটা ডিস্ক, হাতে খবরের কাগজ। আয়নার দিকে চোখ তুলেই রানার মনে হলো, ওর দিকেই চেয়ে ছিল মেয়েটা, ও চোখ তুলতেই চট করে নামিয়ে নিল দৃষ্টি। অল্পবয়সী মহিলা, সবুজ একটা কোট পরনে, সোনালী চুল এতই আধুনিক ফ্যাশানে কাটা যে রানার মনে হলো ফুল বাগানের ডাল ছাটবার কাঁচি দিয়ে পাগলের হাতে ছাঁটা হয়েছে চুলগুলো।

আরেক পেগ হুইস্কি চাইল রানা, শেষ হয়ে যাওয়া গ্লাসটা তুলে নিয়ে নতুন একটা গ্লাস নামিয়ে রাখল ওয়েটার টেবিলের ওপর। দ্বিতীয় গ্লাসটা স্পর্শ না করেই অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল সে, ধীরপায়ে এগোল হোটেলের সদর দরজার দিকে। মেয়েটার পাশ কাটিয়ে যাবার সময় ওর দিকে একবার চাইল না পর্যন্ত–এতই চিন্তাময় ভঙ্গি রানার। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে ব্যস্ত। হয়ে উঠতে দেখে সান্তনার ভঙ্গিতে হাত তুলল রানা, বলল, বেশি দূরে। কোথাও যাচ্ছি না, দুই মিনিটেই ফিরে আসছি। ঘাবড়াবার কিছুই নেই।

রাস্তায় নেমে দ্রুতপায়ে চলে এল রানা বিশগজ দূরে মোডের পাবলিক টেলিফোন বুদে। রিঙ করল সোহানাদের হোটেলের নাম্বারে। পুরো দুই মিনিট লাগল ওর রিসিপশনের বুড়িকে বোঝাতে যে সোহানাকে চায় ও। আরও তিন। মিনিট পর ধরল সোহানা।

হ্যালো, কে বলছেন?

বস্। মাসুদ রানা। এই মুহূর্তে রওনা হয়ে যাও তোমরা আমার হোটেলের উদ্দেশ্যে।

এখন? প্রায় আর্তনাদ করে উঠল সোহানা। শ্যাম্পু করছিলাম…

ঠিক আছে, চুল মুছে নেয়ার জন্য দুই মিনিট সময় দেয়া গেল। দুই মিনিটের মধ্যে রওনা হয়ে যাও। মারিয়া কোথায়?

ঘুমোচ্ছে।

তোলো ওকে। ওরও আসতে হবে। দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছবে এখানে এসে। ভেতরে ঢুকবে না। সদর দরজা থেকে বিশ-পঁচিশ গজ দূরে অপেক্ষা করবে কোথাও।

কিন্তু বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে আবার। বৃষ্টি নামলে?

ভিজতে না চাইলে ছাতা আনবে সঙ্গে। শোনো, কিছুক্ষণের মধ্যে। একটা মেয়ে বেরিয়ে আসবে এই হোটেল থেকে। তোমার সমানই লম্বা, তোমারই বয়স, তোমারই মত ফিগার–শুধু চুলটা সোনালী।

কমপক্ষে দশ হাজার মেয়ে আছে এই শহরে ঠিক এই রকম।

উঁহু। এই মেয়েটা সুন্দরীও। তোমার মত অতটা না, তবে সুন্দর। সবুজ একটা কোট থাকবে মেয়েটার গায়ে, সবুজ একটা ছাতাও থাকবে সঙ্গে, স্যান্ডাল উড পারফিউম মেখেছে, যদি কাছে থেকে লক্ষ করবার সুযোগ হয়–দেখবে বামদিকের জুলফির কাছে কায়দা করে ঢাকা-একটা ক্ষতচিহ্ন আছে। গতকাল বিকেলে আমার সাথে এক সংঘর্ষে সৃষ্টি হয়েছে ওই ক্ষতচিহ্ন।

তোমার সাথে সংঘর্ষ! মেয়েমানুষের? আজকাল সুন্দরী মেয়েদের সাথেও মারামারি করছ এ খবরটা তো জানা ছিল না? আমাদের জানাবার। প্রয়োজন বোধ করোনি নিশ্চয়ই?

প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি কথা মনে রাখা এবং অধীনস্থ কর্মচারীদের জানানো আমার জন্যে ফরজ নয়। মেয়েটাকে অনুসরণ করতে হবে তোমাদের। কোথায় যায় দেখবে, একজন পাহারায় থাকবে, আরেকজন ফিরে এসে রিপোর্ট করবে আমার কাছে। না–এই হোটেলে ঢুকতে পারবে না। রেমব্রান্টপ্লেইনের শেষ মাথায় ওল্ডবেল নামে একটা পা আছে–ওখানেই। পাবে আমাকে প্রায় মাতাল অবস্থায়। বোঝা গেছে? ওভার।

দ্রুতপায়ে ফিরে এল রানা। সবুজ কোট পরা মেয়েটা তেমনি বসে আছে সেই টেবিলে, ডুবে আছে খবরের কাগজে। রিসিপশন ডেস্ক থেকে গোটাকয়েক সাদা কাগজ চেয়ে নিয়ে ফিরে এল রানা নিজের টেবিলে, এবার একটু কাত হয়ে বসল, যেন ওর কার্যকলাপ সহজেই লক্ষ করতে পারে। মেয়েটা।

গ্লাসে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে ওয়ালেট থেকে গত রাতের ডিনার বিলটা বের করে টেবিলের ওপর বিছাল রানা, তালু দিয়ে ঘষে সমান করল, তারপর একটা বলপয়েন্ট পেন বের করে সাদা কাগজের ওপর নোট লিখতে শুরু করল। খানিকক্ষণ নোট করবার পর বিরক্ত হয়ে পেনটা নামিয়ে রাখল সে টেবিলের ওপর, কাগজটা দলা-মোচড়া করে ফেলে দিল কাছেই একটা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। আবার লিখতে শুরু করল আরেকটা কাগজে। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই আবার অসন্তোষ ফুটে উঠল ওর চোখেমুখে, ভঙ্গিতে। এই কাগজটাও দলা পাকিয়ে ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে শুরু করল। বারকয়েক এইভাবে হিসেব মেলাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যেন হাল ছেড়ে দিয়েছে, এমনি ভঙ্গিতে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল সে পাঁচমিনিট। একটা সিগারেট শেষ হয়ে যেতেই ধরাল আরেকটা, যেন অত্যন্ত জটিল কোন সমস্যার সমাধান বের করবার চেষ্টা করছে সে, ডুবে আছে গভীর চিন্তায়। আসলে সময় পার করছে রানা। দশ মিনিটের মধ্যে আসতে বলেছে সে। সোহানাকে, কিন্তু আরও অন্তত দশটা মিনিট সময় দেয়া দরকার ওদের হাজার হোক মেয়ে, তৈরি হয়ে নিয়ে বেরোতে একটু দেরি হবেই।

খানিকক্ষণ চিন্তায় মগ্ন থেকে আবার লেখায় মন দিল রানা-কয়েক মিনিট। ধরে লেখে, কয়েক মিনিট সেটা পড়ে, তারপর কাগজটা লাড্ড পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে। এইভাবে বিশ মিনিট পার করে হতাশ। ভঙ্গিতে উঠে পড়ল রানা প্লাসের অবশিষ্ট তরল পদার্থ গলাধঃকরণ করে, বারম্যানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল বার থেকে। বেরিয়ে গেল মানে, প্লাশ কার্টেনের আড়ালে গিয়েই থেমে দাঁড়াল। পর্দার আড়াল থেকে সাবধানে চোখ রাখল মেয়েটার ওপর। উঠে দাঁড়াল মেয়েটা, বার কাউন্টারের কাছে গিয়ে অর্ডার দিল আরেকটা ড্রিঙ্কের, তারপর যেন কোন চেয়ারে। বসেছিল ভুলে গিয়েছে এমনি ভঙ্গিতে বসে পড়ল রানার ছেড়ে যাওয়া চেয়ারে। কেউ লক্ষ করছে কিনা দেখবার জন্যে সহজ দৃষ্টিতে এপাশ-ওপাশ চাইল, তারপর আলগোছে তুলে নিল একটা দলা পাকানো কাগজ।

নিঃশব্দে এগোল রানা মেয়েটার দিকে। কাগজটা সোজা করেই কেমন একটু বিবর্ণ হয়ে গেল মেয়েটার চেহারা। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রয়েছে সে। লেখাগুলোর দিকে। কাগজের ওপর বড় হাতের অক্ষরে লেখা রয়েছে বোকা মেয়ে। কেমন জব্দ?

আর সব কাগজেও এই একই গোপন বার্তা রয়েছে, বলল রানা। গুড ইভনিং, মিস শেরম্যান।

মেয়েটা এত জোরে পাশ ফিরল যে কড়মড় করে পিঠের হাড় ফুটল। রানার মুখের দিকে চেয়েই দপ করে নিভে গেল ওর চোখের জ্যোতি। প্রথমে একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল, তারপরেই লাল হয়ে উঠল ওর মুখটা। লজ্জায়।

বাহ! খুব কম মেয়েই পারে এত সুন্দর ব্লাশ করতে।

আমি দুঃখিত। ইংরেজি বলতে পারি না।

হয় এরকম, সমব্যথীর মত বলল রানা। একে বলে কংকাসিভ অ্যামনেশিয়া। অনেকে বাপের নাম পর্যন্ত ভুলে যায়। তবে ঘাবড়াবার কিছু নেই, সেরে যায় এ রোগ সহজেই। আলতো করে তর্জনী দিয়ে স্পর্শ করল, রানা মেয়েটার জুলফির কাছে। জখমটা এখন কেমন, মিস শেরম্যান?

বলছি তো, আমি দুঃখিত, আমি…।

ইংরেজি বলতে পারো না। শুনেছি। কিন্তু বুঝতে তো কোন অসুবিধে আছে বলে মনে হচ্ছে না? বিশেষ করে লিখিত ইংরেজি। ইংরেজি কথায় লজ্জা পেয়ে লাল হতেও কোন অসুবিধে নেই।

উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। হাতের পত্রিকাটা গোল করে জড়াচ্ছে, আবার খুলছে নিজের অজান্তেই। শত্রুপক্ষের। মেয়ে, সন্দেহ নেই। রানার বিরুদ্ধে কাজ করছে, তাতেও কোন সন্দেহ নেই। এয়ারপোটে ইমিগ্রেশনের দরজার মুখে রানাকে বাধা দিয়ে খুনীকে। পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল, তাও ভাল করেই জানা আছে রানার। কিন্তু। তবু কেন যেন কৃপা হলো রানার মেয়েটির প্রতি। কেন করছে মেয়েটা এই কাজ? স্বেচ্ছায়, না বাধ্য হয়ে? হাবভাব, চালচলনে তো পাজি মেয়ে বলে মনে  হয় না। তাহলে? ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে ওকে? যাই হোক, মেয়েটা শত্রুপক্ষের হোক আর যাই হোক, ওকে এই অপ্রস্তুত, অসহায় অবস্থায় ফেলে মনে মনে খুশি হতে পারল না রানা। তবু তির্যক ভঙ্গিতে বলল, বাকি কাগজগুলো দেব? দেখবে? ইচ্ছে করলে নিতে পারো তুমি ওগুলো, আমার আপত্তি নেই।  

ওয়েস্টপেপার বাস্কেটের দিকে চাইল মেয়েটা। আমতা আমতা করে। বলল, ওগুলো নিয়ে আমি কি…

হুম। ইংরেজি বলবার ক্ষমতা ফিরে আসছে আবার। দেখেছ? বলেছিলাম না?

আরও লাল হয়ে উঠল মেয়েটা ইংরেজিতে কথা বলে ফেলেছে বুঝতে পেরে। প্লীজ, আমি

পরচুলাটা সরে গেছে একপাশে, মিস শেরম্যান।

চট করে হাতটা উঠল ওর চুলে, ঠকানো হয়েছে বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে নামাল হাতটা, নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরেছে দাঁত দিয়ে, খয়েরী চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। এই কাজটা করে নিজের ওপর বিন্দুমাত্র সন্তুষ্ট হতে পারল না। রানা, বরং অনুশোচনা হলো।

প্লীজ। যেতে দিন আমাকে। পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল মেয়েটা।

যে কোন মুহূর্তে কেঁদে ফেলতে পারে এখন, সেই ভয়ে চট করে সরে দাঁড়াল রানা মেয়েটার পথ ছেড়ে। এত সহজে ছাড়া পেয়ে যাবে সেটা হয়তো আশা করেনি, কয়েক সেকেন্ড রানার মুখের দিকে চেয়ে থেকে দ্রুতপায়ে। বেরিয়ে গেল মেয়েটা হোটেল ছেড়ে। ধীর পায়ে পিছন পিছন এসে দাঁড়াল রানা দরজার সামনে। বেশ জোরেশোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে বাইরে। ছাতাটা খুলে নিয়ে দ্রুতপায়ে রওয়ানা হয়ে গেল বিট্রিক্স শেরম্যান ক্যানালের দিকে। বিশ সেকেন্ড পর দেখতে পেল রানা ছাতা মাথায়, ভিজে সপসপে অলেস্টার গায়ে ওই একই দিকে চলেছে সোহানা আর মারিয়া–একবারও চাইল না ওরা হোটেলের সদর দরজার দিকে।

খুব একটা সুখী বলে মনে হলো না ওদের মুখের দিকে চেয়ে।

আবার গিয়ে ঢুকল রানা বারে। অপেক্ষা করতে হবে ওকে আরও অন্তত আধঘণ্টা।

.

০৮.

লোকজনের কথাবার্তায় আর গ্লাসের টুংটাং শব্দে সরগরম ওল্ডবেলে দরজার দিকে মুখ করে বসল রানা একটা টেবিলে। দরজার দিকে পিঠ ফিরে বসবার ব্যাপারে কোন কুসংস্কার বশে নয়, সোহানা বা মারিয়া যেই হোক পৌঁছলে যেন চট করে দেখতে পায় সেইজন্যেই দরজার দিকে মুখ করে বসল সে এক মগ বিয়ার নিয়ে। বিশ মিনিট অপেক্ষার পর ঢুকল মারিয়া। স্কার্ফ আর ছাতা থাকা সত্ত্বেও ভেজা চুল গালের সঙ্গে লেপটে রয়েছে ওর।

খবর সব ভাল? জিজ্ঞেস করল রানা।

সামনের চেয়ারে বসে পড়ল মারিয়া। বার দুয়েক লম্বা করে শ্বাস টেনে বলল, চুপচুপে হয়ে ভেজাটা যদি ভাল মনে করেন, তাহলে খবর খুবই ভাল।

মৃদু হেসে একটা শেরির অর্ডার দিয়ে জিজ্ঞেস করল রানা, আর সোহানা?

সেও ভাল আছে। শেরিতে চুমুক দিল মারিয়া।

এবার তৃতীয়জনের কথা শোনা যাক। যাকে অনুসরণ করছিলে। তার খবর কি? কোথায় ও এখন?

গির্জায়।

কী?

মাথা দুলিয়ে হাইম গাইছে।

 মাশাল্লা। আর সোহানা?

সেও গির্জায়।

ও-ও কি গান গাইছে?

হাসল মারিয়া। তা বলতে পারব না। আমি ভেতরে ঢুকিনি।

 সোহানারও বোধহয় না ঢোকাই উচিত ছিল, ভুরু কুঁচকে বলল রানা।

 গির্জার চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর আছে কোথাও?

তা ঠিক। ঠিকই বলেছ। মুখে বলল ঠিকই, কিন্তু কেন যেন ভিতর ভিতর একটা অস্বস্তিবোধ খোঁচাতে শুরু করল ওকে।

রানার মনের ভাবটা আঁচ করে নিয়ে মারিয়া বলল, আমাদের একজনকে থেকে যেতে বলেছিলেন না?

বলেছিলাম।

সোহানা বলল, গির্জার নামটা শুনলে নাকি অবাক হবেন আপনি।

অবাক হব? নাম শোনার আগেই অবাক হলো রানা। গির্জার নাম শুনে অবাক হওয়ার•• থেমে গেল রানা। বিস্ফারিত চোখে চাইল মারিয়ার মুখের দিকে। দা ফাস্ট রিফর্মড চার্চ অফ দা অ্যামেরিকান হিউগানট সোসাইটি? মারিয়াকে মাথা নাড়তে দেখে একলাফে উঠে দাঁড়াল রানা। এতক্ষণে বলছ সেকথা! উঠে পড়ো। আমি বিলটা দিয়ে আসছি, চট করে শেষ করে ফেলো গ্লাসটা।

কি ব্যাপার, মেজর রানা? গির্জার কথা শুনে…

মারিয়ার কথা শেষ হওয়ার জন্যে আর অপেক্ষা করল না রানা, কাউন্টারে গিয়ে দাম চুকিয়ে এল চট করে। বাইরে বেরিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল মারিয়া, এত ব্যস্ত হওয়ার কি ঘটেছে?

আজ সন্ধ্যায় কোথায় গিয়েছিল, কি কি ঘটেছে, কিছুই বলেনি তোমাকে সোহানা?

বলবার সুযোগ পায়নি, বলল মারিয়া। ও যখন ফিরে আসে, আমি তখন। ঘুমে। রাস্তায় চলতে চলতে শুনছিলাম। সবিস্তারে। কিন্তু ও যখন সেই ভয়ঙ্কর গলিতে দাঁড়িয়ে আপনার কলার ধরে ঝাঁকাচ্ছে ঠিক সেই সময় গির্জার মধ্যে ঢুকে পড়ল সামনের মেয়েটা। ওল্ডবেলে ফিরে গিয়ে আপনাকে খবরটা জানাতে বলেই ঢুকে গেল সেও গির্জার মধ্যে।

হাত নেড়ে একটা ট্যাক্সি ডাকল রানা। দশ মিনিট পর একটা গলির মুখে। ছেড়ে দিল ট্যাক্সিটা। সেই গলি ধরে ডাইনে বয়ে কয়েকটা বাঁক নিতেই হঠাৎ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মারিয়া আশ্চর্য! কোন রাস্তায় কিভাবে এলাম? ওই তো সামনে দেখা যাচ্ছে গির্জাটা!

গজ পঞ্চাশেক দূরে খালের ধারে দেখা যাচ্ছে বিমর্ষ চেহারার এক গির্জা। একেবারে ঝুরঝুরে। দেখলে মনে হয় যে কোন সময়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। রানা আন্দাজ করল, বয়স এটার অন্তত চারশো বছর তো হবেই। একমাত্র বিশ্বাসের জোরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এখনও। এতদূর থেকেও পরিষ্কার বুঝতে পারল সে, গির্জার মাথায় চৌকোণ টাওয়ারটা অন্তত পাঁচ ডিগ্রী হেলে রয়েছে খালের দিকে মনে হয় জোরে একটা ধমক দিলেই গোটা গির্জাটা ঝপাৎ করে ডাইভ দিয়ে পড়বে খালে। অল্পদিনেই ফান্ড, সংগ্রহের কাজে। নামতে হবে হিউগানট সোসাইটিকে গির্জাটা সম্পূর্ণ ধসিয়ে দিয়ে আবার নতুন করে গড়ার জন্যে।

চারপাশে চোখ বুলিয়ে রানা বুঝতে পারল, কেবল গির্জাটাই নয়, পুরো এলাকার প্রায় প্রত্যেকটা বাড়িই তৈরি হয়েছে কয়েক শতাব্দী আগে। খালের। ধারে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে বাড়িঘর। মস্ত লম্বা বুমসহ প্রকাণ্ড এক ক্রেন দাঁড়িয়ে রয়েছে পরিষ্কার করা জায়গার ঠিক মাঝখানে। বুমটা এতই উঁচু যে অন্ধকারে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না ওটার শেষ মাখা। খুব দ্রুত কাজ চলছে বলে মনে হলো–একপাশে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার। করে ফাউন্ডেশন পর্যন্ত উঠে পড়েছে গোটা কয়েক হবু মাটিস্টোরিড বিল্ডিং।

ক্যানেলের ধার ঘেষে এগেল ওরা ধীর পায়ে। কিছুদূর এগিয়েই কানে। এল অর্গানের বাজনা, সেইসাথে মহিলা কণ্ঠের গান। গানের সুরে মধুর একটা নিরাপদ শান্তির বাণী টের পেল রানা–ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল ওর। মনে পড়ে গেল ঢাকায় সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের সেই নিঃসঙ্গ গির্জাটার কথা; ব্রাদার জুড, ব্রাদার লিগোরির কথা, ধনাইয়ের কথা; ছাতখোলা ল্যাট্রিনের নালায় নিমের বীচি আর প্রস্রাবের ঝাঝের কথা; টিফিন আওয়ারে গোল্লাছুটের কথা, কবে এই ধরাবাঁধা নিয়ম আর উঁচু পাঁচিলের বেড়া ডিঙিয়ে বেরোতে পারবে সেই ভেবে বড় হওয়ার তীব্র বাসনার কথা; ধনাইয়ের বাজানো ঢং ঢং ছুটির ঘণ্টার কথা; স্কুল-মাঠের ওপর দিয়ে সুতো ঝুলিয়ে কাটা-ঘুড়ি উড়ে যাওয়ার কথা।

কি ভাবছেন? জিজ্ঞেস করল মারিয়া।

না, কিছু না। ভাবছি, সার্ভিস চলছে এখনও…তুমি বরং এক কাজ করো, ভেতরে গিয়ে… বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল রানা। সাদা রেনকোট পরা কালো চুলের এক মেয়েকে ওদের পাশ কাটিয়ে ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে গির্জার দিকে এগোতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তারপর ডাকল, এ্যাই

নির্জন রাস্তায় পুরুষকণ্ঠে এই ধরনের ডাক এলে কি করতে হয় ভালমতই জানা আছে মেয়েটার-ঝট করে একবার রানার দিকে চেয়েই ঝেড়ে দৌড় দিল সে। কিন্তু কয়েক পা এগিয়েই ভেজা কাকরে পা পিছলে হোঁচট খেলো, সামলে নিয়ে আরও দুই কদম যেতে না যেতেই ধরে ফেলল ওকে রানা। কয়েক সেকেন্ড ধস্তাধস্তি করেই হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল মেয়েটা, দুই হাতে জড়িয়ে ধরল রানার গলা। কাছে এসে দাঁড়াল মারিয়া। হাঁ হয়ে গেছে ওর মুখটা।

পরিচিত কেউ? জিজ্ঞেস না করে পারল না সে।

আজই সকালে পরিচয় হয়েছে। এর কথা বলেছি তোমাকে মারিয়া, এরই নাম ইরিন। ইরিন মাগেনথেলার।

ও। ইরিনের বাহুর ওপর হাত রাখল মারিয়া, কিন্তু ওকে তেমন পাত্তা দিল না ইরিন, আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রানার গলা, মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সে রানার মুখের দিকে, ঠিক চার ইঞ্চি দূর থেকে।

তুমি খুব ভাল, দ্বিতীয়বার ঘোষণা করল ইরিন। আমি তোমাকে ভালবাসি।

হ্যাঁ, সেটা আমি জানি। সকালেই বলেছ তুমি আমাকে। মুসিবত!

 কি করা যায় এখন? জিজ্ঞেস করল মারিয়া।

সেটাই ভাবছি। তুমি চিনতে পারবে না, আমারই পৌঁছে দিতে হবে। ওকে বাড়িতে। ট্যাক্সিতে তুলে দিলে প্রথম ট্র্যাফিক লাইটে পৌঁছেই ভাগবে। গাড়ি থেকে নেমে। খুব সম্ভব নাক ডাকাচ্ছে বুড়িটা, সেই সুযোগে পালিয়েছে ও বাড়ি থেকে। ওর বাপ হয়তো এতক্ষণে চষে বেড়াচ্ছে সারা শহর।

 বেশ কিছুটা জোর খাটিয়েই গলা থেকে ইরিনের একটা হাত খসাল রানা, আস্তিন তুলে ফেলল ওপরে। হাইপোডার্মিকের খোঁচায় খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত। হাতটার দিকে চেয়ে নিজের অজান্তেই ইশশ বলে উঠল মারিয়া। গাল দুটো– কুঁচকে গেছে ওর হাতের অবস্থা দেখে। আস্তিনটা টেনে নামিয়ে দিল রানা। সকালের মত কান্নায় ভেঙে না পড়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে খিল খিল করে। হাসতে শুরু করল ইরিন, যেন খুব মজার কাণ্ড হচ্ছে একটা। বামহাতটাও পরীক্ষা করে দেখল রানা, নামিয়ে দিল আস্তিন।

নতুন কোন দাগ নেই, বলল রানা।

হাতে নেই, বলল মারিয়া। অন্য কোথাও থাকতে পারে।

তাই বলে এতবড় মেয়েকে তো আর রাস্তার ওপর ন্যাংটো করে দেখা যায় না। দাঁড়াও, কথা বোলো না, ভাবতে দাও আমাকে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল ওদের কেউ তোমাকে দেখেছে? গির্জায় যারা আছে, তাদের কেউ?

মনে হয় না।

কিন্তু সোহানাকে নিশ্চয়ই দেখেছে ওদের অনেকেই।

দেখেছে হয়তো, কিন্তু আবার দেখলে চিনতে পারবে, এমন কথা হলপ করে বলা যায় না। স্কার্ফ জড়ানো রয়েছে ওর মাথায়, তার ওপর কোটের হুড রয়েছে। তাছাড়া দরজার বাইরে থেকে দেখেছি, ছায়ার মধ্যে আড়াল হয়ে বসেছিল ও।

ওকে বাইরে নিয়ে এসো। সার্ভিস শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাইরে কোথাও অপেক্ষা করো। শেরম্যান বেরোলে ওকে অনুসরণ করবে তোমরা। আর চেষ্টা করবে ওদের মধ্যে যতগুলো সম্ভব চেহারা মনে রাখতে।

সেটা সহজ হবে না। মাথা নাড়ল মারিয়া।

কেন?

সবাই ওরা একই রকম দেখতে।

তার মানে?

বেশির ভাগই নান। হাতে বাইবেল, কোমরে রশি, মাথা ঢাকা–চুল দেখবার উপায় নেই, সব কজনের লম্বা কালো কাপড়, আর সাদা…

নানরা কি পোশাক পরে আমার জানা আছে। একটু কঠোর শোনাল রানার গলা।

তা ঠিক। কিন্তু একটা কথা আপনার জানা নেই–এদের প্রত্যেকেই কমবয়সী, প্রত্যেকেই সুন্দরী। কয়েকজন তো রীতিমত

নান আর স্কুল মিস্ট্রেস হলেই যে বুড়ি আর কুৎসিত হতে হবে তার। কোন মানে আছে? অসম্ভব কিছু করতে বলছি না আমি তোমাদের যতদূর সম্ভব, মনে রাখার চেষ্টা করবে ওদের চেহারাগুলো। শেরম্যানকে অনুসরণ করে যেখানে গিয়ে পৌঁছবে সে ঠিকানাটা ফোন করে জানাবে তোমাদের। হোটেলে। বলে রাখবে, আমি ফোন করলে যেন জানানো হয় আমাকে। বোঝা গেছে? চলো ইরিন। বাড়ি।

নিতান্ত বাধ্য মেয়ের মত রানার হাত ধরে এগোল ইরিন, কিছুদূর হেঁটেই ট্যাক্সি পেয়ে গেল ওরা, গাড়িতে উঠে আবোল-তাবোল শিশুর প্রলাপ বকে গেল ইরিন, নিজের চিন্তায় ডুবে রইল রানা। মাগেনথেলারের দোরগোড়ায়। ট্যাক্সিটাকে অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে ঢুকল সে ইরিনকে নিয়ে।

ছেলেপিলের ব্যাপারে ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তা থেকে হঠাৎ মুক্তি পেলে বাপ-মা। যেমন স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে এবং ঠিক যতটা কটু ভাষায় বকাবকি করে, তাই জুটল ইরিনের কপালে মাগেনথেলার আর মারগ্রিয়েটের কাছ থেকে। ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো ওকে। ঝটপট দুটো গ্লাসে খানিকটা করে হুইস্কি ঢালল মাগেনথেলার, বসবার জন্যে অনুরোধ করল রানাকে। মাথা নাড়ল রানা।

বাইরে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। কর্নেল ডি গোল্ডকে এখন ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন? একটা গাড়ি ধার নিতে চাই ওর কাছ থেকেফাস্ট কার।

মুদ হাসল মাগেনখেলার। কৌতূহল হচ্ছে, কিন্তু কোন প্রশ্ন করব না। আমি। কনেলকে অফিসেই পাবেন, আজ অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করবেন। উনি অফিসে। গ্লাসটা উঁচু করল সে। আপনাকে লক্ষ-কোটি ধন্যবাদ। কতটা উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলাম, বোঝাতে পারব না আমি আপনাকে।

পুলিস অ্যালার্টের ব্যবস্থা করেছিলেন?

করেছিলাম–কিন্তু আন-অফিশিয়াল পুলিস অ্যালার্ট। মান হাসল ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার। কারণটা বলেছি আপনাকে। বিশ্বস্ত কয়েকজন। বন্ধুকে লাগিয়েছিলাম। কিন্তু অ্যামস্টার্ডামের নয় লক্ষ লোকের মধ্যে থেকে, একজনকে খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়।

আচ্ছা, বলুন তো, বাড়ি থেকে অতটা দূরে কেন গিয়েছিল ও?

প্রায়ই তো যায় ওখানে ও মারগ্রিয়েটের সঙ্গে। গির্জায়। হাইলার দ্বীপের যত লোক এখানে আছে, সবাই যায় ওটাতে। ওটা একটা হিউগানট চার্চ, হাইলারেও আছে একটা। মারগ্রিয়েটের সঙ্গে মাঝে মাঝে দ্বীপেও যায় ইরিন। চার্চ অ্যাটেন্ড করতে। গির্জা আর ভভেল পার্ক-এই দুটোই তো বেচারীর একমাত্র আউটিং।

বিশাল বপু নিয়ে কামরায় ঢুকল মারগ্রিয়েট, উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চাইল মাগেনথেলার ওর দিকে। হাসিহাসি মুখে মাথাটা এপাশ-ওপাশ নেড়ে বেরিয়ে গেল মারগ্রিয়েট ঘর থেকে। মস্ত হাঁপ ছেড়ে রানার দিকে ফিরল ইন্সপেক্টর।

থ্যাঙ্ক গড। নতুন কোন ইঞ্জেকশন পড়েনি। একঢোকে গ্লাসটা শেষ। করে বলল, অন্তত আজকের মত নিশ্চিন্ত।

গ্লাসটা শেষ করেই বিদায় নিল রানা। ট্যাক্সি. সোজা এসে থামল মানিক্সস্ট্রাটে। আগেই ফোনে জানিয়ে দিয়েছে মাগেনথেলার, কাজেই রানার অপেক্ষাতেই বসে রয়েছে কর্নেল ডি গোল্ড। রানা ঢুকতেই ফাইল থেকে চোখ তুলল, খোলা পাতার ওপর একটা অ্যাশট্রে চাপা দিয়ে বন্ধ করে দিল। ফাইলটা।

বেশ অনেকদূর এগিয়েছেন আশা করলে কি ভুল হবে?

হবে।

বলেন কি? আপনার ওপর অনেক আশা করে রয়েছি আমি। কিছুই এগোতে পারেননি?

অতি সামান্য। উল্লেখযোগ্য কিছুই নয়।

গাড়ির ব্যাপারে কি যেন বলছিল ইন্সপেক্টর ফোনে?

হ্যাঁ। একটু দরকার হয়ে পড়েছে।

কি দরকার জিজ্ঞেস করতে পারি?

ওটা চালাব। বলেই হাসল রানা। তবে কেবল ওই কারণেই আসিনি আমি আপনার কাছে।

আমি জানি, নিশ্চয়ই আরও কোন ব্যাপার আছে।

একটা সার্চ ওয়ারেন্ট দরকার।

কিসের জন্যে?

সার্চ করার জন্যে। আবার হাসল রানা। ব্যাপারটাকে আইনসঙ্গত করবার জন্যে সঙ্গে যদি কোন সিনিয়র অফিসার দিতে পারেন, তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়।

কোথায় সার্চ করতে হবে?

ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানী। সুভ্যেনিরের ওয়েরহাউজ। ডকের পাশ দিয়ে যেতে হয়, পুরানো শহরে-ঠিকানাটা বলতে পারব না।

ঠিকানা বের করে নিতে অসুবিধে হবে না। নামটা পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। মাথা ঝাঁকাল ডি গোন্ড। কিন্তু ওদের বিরুদ্ধে কোনদিন কোনকিছু শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। আইনের চোখে টিকবে, এমন কোন চার্জ আছে। আপনার ওদের বিরুদ্ধে?

না। তা নেই।

তাহলে বিশেষ করে ওদের সম্পর্কেই আপনার এই কৌতূহল কেন?

তা বলতে পারব না। কসম। আমি আসলে জানতে চাই, কেন এই কৌতূহল জাগছে আমার মধ্যে। আজ সন্ধের পর গিয়েছিলাম আমি ওদের ওখানে…

বন্ধ দেখে ফিরে এসেছেন।

না ফিরে আসিনি। আবার হাসল রানা। একগোছ চাবি বের করে কর্নেলের নাকের সামনে দোলাল।

 বিপদে ফেলবেন দেখছি! খেপে গেল কর্নেল। আপনি জানেন, এ ধরনের যন্ত্রপাতি সঙ্গে রাখা আইনের চোখে গুরুতর অপরাধ?

চট করে পকেটে ফেলল রানা স্কেলিটন চাবির গোছা। কোন ধরনের যন্ত্রপাতি, কর্নেল?

 না, কিছু না। দৃষ্টিবিভ্রম। চোখ দুটো ছোট হয়ে এল কর্নেলের।

সিগারেট ধরাল রানা। বুক ভরে ধোঁয়া টেনে ছাতের দিকে ছাড়ল। তারপর অনেকটা আপন মনে বলল, ওদের অফিসঘরের স্টীলের দরজায় টাইম লকের ব্যবস্থা কেন করা হলো জানবার কৌতূহল বোধ করছি। আমার কৌতূহল ওদের কাছে বাইবেলের স্টক কেন। ক্যানাবিসের গন্ধ আর পুতুলের আড়ালে সজাগ দুটো চোখের কথা চেপে গেল সে। কিন্তু আমার আসল কৌতূহল ওদের সাপ্লায়ারদের সম্পর্কে। ওদের লিস্ট অভ সাপ্লায়ার হাতে পেতে চাই আমি।

ঠিক আছে। সার্চ ওয়ারেন্ট একটা যে কোন প্রিটেক্সটে তৈরি করে নেয়া যাবে। আমি নিজে যাব আপনার সঙ্গে। কাল সকালে। কিন্তু আপনার এই কৌতূহল সম্পর্কে আরও কিছু জানাতে হবে কাল। এবার গাড়ির প্রসঙ্গে আসা যাক। ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার চমৎকার এক সাজেশন দিয়েছে। স্পেশাল এঞ্জিন লাগানো একটা পুলিস-কার আছে আমাদের, হ্যাঁন্ডকাফ থেকে শুরু করে টু-ওয়ে রেডিও পর্যন্ত সবই রয়েছে ওটাতে–কিন্তু বাইরে থেকে দেখতে সাধারণ একটা ট্যাক্সি। দুই মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাবে ওটা। তবে ট্যাক্সি চালানোর ব্যাপারে রাস্তায় কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে।

হেসে ফেলল রানা। বুঝলাম। বাড়তি কিছু রোজগার করি, সেটা। আপনার সহ্য হচ্ছে না। যাই হোক, আমার জন্যে আর কোন খবর আছে?

আসছে। দুই মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। আপনার ওই গাড়িতে করেই আসছে সংবাদ রেকর্ড অফিস থেকে।

ঠিক দুই মিনিট পর একটা ফাইল দিয়ে গেল একজন সেপাই কর্নেলের ডেস্কের ওপর। মুহূর্তে ওটার মধ্যে ডুবে গেল ভ্যান ডি গোল্ড, কয়েকটা পাতা উল্টে চোখ তুলল।

বিট্রিক্স শেরম্যান। ডাচ ফাদার, গ্রীসিয়ান মাদার। ওর বাপ ছিল এথেন্সের ভাইস কনসাল–মারা গেছে। মা কোথায় কি অবস্থায় আছে, জীবিত কি মৃত জানা যায় না। বয়স চব্বিশ। ওর সপক্ষে বা বিপক্ষে কোন কিছুই নেই। আমাদের হাতে। ফাইলের পাতায় চোখ রেখে গড়গড় করে বলে চলল কর্নেল। তরে ব্যাকগ্রাউন্ড বেশ কিছুটা আবছা বলে মনে হচ্ছে আমার। ব্যালিনোভা নাইট ক্লাবে কাজ করে হোস্টেসের, থাকে কাছেই একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউজে। আত্মীয় বলতে একজনই আছে ওর হেনরী, ছোটভাই, বয়স বিশ। এই দেখুন, এতক্ষণে একটু জমে উঠছে বলে মনে হচ্ছে–ভাইটি ছমাসের জন্যে জেলের ভাত খেয়েছেন।

কি ব্যাপারে? ড্রাগস?

 অ্যাসল্ট এবং অ্যাটেম্পটেড রবারী। অ্যামেচারিশ প্রচেষ্টা। ভুল করে বেচারী এক সাদা পোশাক পরা গোয়েন্দা পলিসকে পাকড়েছিল শিকার হিসেবে। স্বীকার যায়নি, কিন্তু পুলিসের সন্দেই–ছোকরা অ্যাডিক্ট। ড্রাগস। কেনার পয়সার জন্যে ডাকাতি করবার চেষ্টা করেছিল। ব্যস। এই হচ্ছে। বিট্রিক্স শেরম্যান সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য। কয়েকটা পাতা উল্টে আরেক পৃষ্ঠায় স্থির হলো কর্নেলের দৃষ্টি। আর ওই যে নম্বর দিয়েছিলেন অর্থ উদ্ধারের জন্যে…একটা নম্বরের মানে বের করা গেছে। MOO144 হচ্ছে বেলজিয়ান কোস্টার মেরিনোর কল-সাইন। আগামীকাল এসে ভিড়বে আমাদের ঘাটে। বেশ কিছু কাজের লোক আছে আমার, কি বলেন?

হ্যাঁ। কখন পৌঁছবে মেরিনো?

দুপুরে। সার্চ করতে হবে ওটাকে?

সার্চ করে কিছু পাবেন না। কাজেই দয়া করে ওটার কাছেও যাবেন। আমার কাজের অসুবিধে হবে তাহলে কর্নেলকে ফাইল বন্ধ করে দিতে দেখে জিজ্ঞেস করল রানা, বাকি দুটো নম্বর থেকে কিছু বের করা গেল?

উহু। কিছুই বোঝা যায়নি… আবার ফাইলটা খুলল কর্নেল। কত যেন ছিল নম্বরগুলো? নাইন ওয়ান ডাবল জিরো টু জিরো, আরেকটা টু সেভেন। নাইন সেভেন। আচ্ছা! ভুরু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল ডি গোল্ড। শেষেরটা সেভেন নাইন সেভেনের ডবল না তো? দেখুন তো, সেভেন নাইন সেভেন সেভেন নাইন সেভেন-নম্বরটা পরিচিত মনে হয়?

মাথা নাড়ল রানা।

ড্রয়ার টেনে একটা টেলিফোন ডাইরেকটরি বের করল কর্নেল, কিন্তু আবার ওটা রেখে দিয়ে টেলিফোনের রিসিভার কানে তুলে নিল। একটা টেলিফোন নাম্বার দিচ্ছি, লিখে নাও। সেভেন নাইন, ডাব- সেভেন নাইন। সেভেন। টেলিফোনটা কার নামে আছে বের করে জানাও আমাকে। এক্ষুণি।

ঠিক বিশ সেকেন্ড পর বেজে উঠল টেলিফোন। রিসিভারটা কানে তুলে চুপচাপ তিন সেকেন্ড শুনে নামিয়ে রাখল কর্নেল। রানার দিকে চাইল হাসিমুখে।

বালিনোভা নাইট-ক্লাব।

সত্যিই এফিশিয়েনসি আছে আপনাদের, স্বীকার করতেই হয়, বলল রানা মুখে। মনে মনে বলল তবু কি করে বছরের পর বছর কাজ চালিয়ে। যাচ্ছে ভয়ঙ্কর এক গুপ্ত দল আপনাদের নাকের ডগায় বসে? কেন আমাকে আসতে হচ্ছে সুদূর বাংলাদেশ থেকে?

এই বার? কি বুঝছেন?

বুঝতে পারছি, এই নাইট-ক্লাবের সাথে সম্পর্ক ছিল কার্লটন হোটেলের সাততলার ফ্লোর ওয়েটারের।

বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল কর্নেল রানার মুখের দিকে। বুঝতে পেরেছে, নম্বরগুলো কার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল রানা, কিভাবে সংগ্রহ করেছিল সেটাও আঁচ করে নিতে অসুবিধে হলো না তার। পনেরো সেকেন্ড পর ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকাল কর্নেল। বড় বিপজ্জনক খেলায় নেমেছেন, মেজর মাসুদ রানা।

উঠে দাঁড়াল রানা। হাত বুলাল নিজের গালে। অনেক লোকেরই চেনা। হয়ে গেছে মুখটা। ছদ্মবেশের কিছু মালমশলা পাওয়া যাবে না, আপনাদের। হেডকোয়ার্টারে?

ছদ্মবেশ! চোখ মিটমিট করল কর্নেল। হেসে ফেলল। ওহ্ নো! এই যুগে? শার্লক হোমস মারা যাওয়ার এত বছর পরেও?

শার্লক হোমসের অর্ধেক বুদ্ধি যদি থাকত আমার মাথায়, তাহলে ছদ্মবেশের কোন প্রয়োজনই পড়ত না। কথাটা বলল রানা এমন সুরে, যাতে শ্রোতার বিশ্বাস উৎপাদন করা যায়। কিন্তু এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে। এছাড়া আর কোন গত্যন্তর দেখতে পাচ্ছি না।

অল রাইট, বলল কর্নেল। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

দরকারটা আমার এক্ষুণি।

বিশাল শরীরটা টেনে তুলল কর্নেল চেয়ার থেকে।

বেশ। আসুন আমার সঙ্গে।

.

০৯.

 সত্যিই, বাইরে থেকে দেখতে অবিকল একটা ট্যাক্সিই। ওপেল। কিন্তু গাড়িটার স্পীড দেখে রীতিমত খুশি হয়ে উঠল রানা। দারুণ এক এঞ্জিন লাগিয়ে প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে এর শক্তি। এছাড়াও আরও কিছু। কারিগরী রয়েছে এর মধ্যে। সাইরেনের ব্যবস্থা তো আছেই, একটা বোতাম টিপলে একখানা আনরেকেবল ফাঁইবার গ্লাসের শীট নেমে আসে ছাত থেকে, মুহর্তে আলাদা হয়ে যায় গাড়িটা দুটো কম্পার্টমেন্টে-পেছনের আরোহীর। সঙ্গে চোখের দেখা ছাড়া আর কোন সম্পর্ক থাকে না ডাইভারের। আরেকটা বোতাম টিপলে ছাতের একটা অংশ খুলে মাথা তুলবে পুলিস লাইট। আরেকটা টিপলে পেছনের একটা প্যানেলে ফুটে উঠবে উজ্জ্বল লেখা-স্টপ! প্যাসেঞ্জার সীটের তলায়–অর্থাৎ, ড্রাইভারের পাশের সীটের নিচে রয়েছে। পাকানো রশি, ফাস্ট-এইড কিট, টিয়ার গ্যাস-ক্যানিস্টার। দরজার পকেটে রয়েছে একজোড়া হ্যাঁন্ডকাফ, সেই সঙ্গে চাবি। পেছনের বুটে যে আরও কত কি কৌশল রয়েছে জানাবার চেষ্টা করেছিল কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড, কিন্তু শুনতে চায়নি রানা, মাথা নেড়ে বলেছে ওসব আমার কোন কাজে লাগবে না কর্নেল, গাড়িটা জোরে চলে কিনা সেটাই আসল কথা।

ব্যালিনোভা নাইট-ক্লাবের কাছেই নো পার্কিং লেখা একটা জায়গায়। গাড়িটা রাখল রানা রাস্তার অপর পাড়ে দাঁড়ানো এক ইউনিফর্ম পরা। কনস্টেবলের ঠিক নাক বরাবর। তিন সেকেন্ড গাড়িটার দিকে চেয়ে থেকে সামান্য একটু মাথা ঝাঁকাল কনস্টেবল, তারপর মর্যাদার সাথে দূরে সরে গেল হাঁটতে হাঁটতে। রানা বুঝল, পুলিসের গাড়ি চিনতে অসুবিধে হয়নি কনস্টেবলের; কেউ যদি প্রশ্ন করে যেখানে পার্ক করলে সবার গাড়িতেই হলুদ টিকেট সেটে দেয়া হয়, ঠিক সেই জায়গায় তোমার চোখের সামনে পার্ক করল একটা ট্যাক্সি, আর তুমি দেখেও দেখলে না কোন বিশেষ কারণে, ঘুষটুষ খেয়েছে নাকি কোন উত্তর দিতে পারবে না সে; কাজেই মানে মানে কেটে পড়ল লোকটা।

গাড়ি থেকে নেমে পড়ল রানা, দরজায় লক করে এগোল ব্যালিনোভা নাইট-ক্লাবের দিকে। ছোট্ট একটা নিয়ন সাইনে নাম লেখা, নামের দুইপাশে। দুজন প্রায়-উলঙ্গ নর্তকীর ফিগার আউটলাইন–জ্বলছে, নিভছে। সুইংডোরের দুইপাশে খানিকটা করে জায়গা কাঁচটাকা, অনেকগুলো পেইন্টিং আর। ফটোগ্রাফ সাজানো রয়েছে সেখানে আট এগজিবিশনের কায়দায়। এগুলোর। দিকে একনজর চাইলেই ভিতরে কি ধরনের সৌন্দর্যচর্চা চলেছে বুঝতে অসুবিধে হয় না। সবগুলোই মেয়েমানুষের ছবি। কোন কোনটায় কানের দুল আর পায়ের হাইহিল জুতা ছাড়া আর কোন পোশাক পরিচ্ছদের বালাই নেই, এমন সব বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়ানো কিংবা বসা যে ওগুলোর দিকে দশ সেকেন্ড চেয়ে থাকলেই যৌবন ফিরে পাবে অশীতিপর বৃদ্ধ। কাঁচের গায়ে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল রানা। যদি জানা না থাকত ও কে, তাহলে চিনতেই পারত না সে নিজেকে। ঢুকে পড়ল ভিতরে।

বেশ বড়সড় একটা ঘর। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। বিদঘুটে গন্ধ এল রানার। নাকে অনেকটা রাবার-পোড়া মত। বুঝতে অসুবিধে হলো না রানার, স্বাভাবিক কোন কারণে তৈরি হচ্ছে না গন্ধটা-স্প্রে করা হচ্ছে ওটা কয়েক মিনিট পর পর। কেন? নিশ্চয়ই আরও কিছু গন্ধ ঢাকবার উদ্দেশ্যে? মনে মনে ওদের বুদ্ধির প্রশংসা করল রানা। এই বিশেষ গন্ধটির একমাত্র গুণ হচ্ছে কিছুতেই আর কোন গন্ধ নাকে আসবে না, কারও। ভাল। সারাটা ঘর মান আলোয় আলোকিত। ঘরের এককোণে ছোট্ট একটা স্টেজের একপাশে উদ্দাম ছন্দে একটা আফ্রিকান ড্রাম বাজাচ্ছে একজন পেশীবহুল, স্বাস্থ্যবান নিগ্রো, ঘন কালো কোঁকড়া চুল খাড়া হয়ে রয়েছে মাথার ওপর আধহাত। চকচকে, পিচ্ছিল, কালো শরীরে কাপড়চোপড়ের কোন বালাই নেই–কোমরের কাছে কিছু পাতা-টাতা বেঁধে লজ্জা নিবারণ করেছে (অবশ্য যদি লজ্জা বলে কিছু থেকে থাকে), গলায় বন্য জন্তুর দাঁত দিয়ে তৈরি মালা। বিদঘুটে ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, আর দমাদম ড্রাম পেটাচ্ছে লোকটা-স্পট লাইটের বেগুনী আলোয় ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে, ওর অঙ্গভঙ্গি।

দপ করে জ্বলে উঠল একটা গোলাপী আলো। দেখা গেল স্টেজের এক। কোণে পোজ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধবধবে ফর্সা এক যুবতী, এক ইঞ্চি আকৃতির গোটা দুই চকচকে তারা দিয়ে বুক ঢাকা, কোমর থেকে ঝুলছে আধ। হাত লম্বা একটা ঝাঁকিজাল। নাচতে শুরু করল যুবতী দুলে দুলে, প্রতিটা স্টেপিঙের সঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠছে বুক। দুলছে কোমর, যেন ঢেউ উঠছে। ভূমধ্যসাগরে। স্পট লাইটের আলোয় দেখা গেল মেয়েটার পেছনে আবছামত দেখা যাচ্ছে সবুজ পাতা দিয়ে ছাওয়া একটা বড়সড় বাঁশের খাঁচা।

 চারপাশে চেয়ে দেখল রানা। পুরুষের সংখ্যাই বেশি। তবে মেয়েও। নেহায়েত কম নেই। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে দর্শকবৃন্দ নর্তকীর দিকে। ছন্দের গতি বাড়ছে ক্রমে। সাথে সাথে বাড়ছে দর্শকদের হৃৎপিণ্ডের গতি। বেশির ভাগেরই তেরো থেকে পচিশের মধ্যে বয়স, তবে মাঝবয়সী বা.বৃদ্ধও যে একেবারে নেই তা নয়। সবাই সমভাবেই উপভোগ করছে যুবতীর উদ্দাম নৃত্য। দর্শকমণ্ডলীর পোশাক দেখে সচ্ছলতার আভাস পেল রানা। নাইটক্লাব অবশ্য সব দেশেই ধনীদের জন্যে, তবে এটা দেখে মনে হচ্ছে এর চাকচিক্য যেন কয়েক ডিগ্রী চড়া-অ্যামস্টার্ডামের সেরা নাইট-ক্লাবগুলোর মধ্যে এটা যে অন্যতম তাতে কোন সন্দেহ নেই। দরজার কাছাকাছি একটা। টেবিলে এসে থামল রানার দৃষ্টি। বসে আছে মারিয়া আর সোহানা। এমন ভঙ্গিতে, যে ওদের মনের সাথে যে এই ক্লাবের মূল সুরের মিল নেই, বোঝ যাচ্ছে পরিষ্কার। কেমন একটা নিঃসঙ্গ, ছাড়াছাড়া দায়িত্বপালনের ভাব।

ছদ্মবেশের কোন প্রয়োজন ছিল বলে মনে হলো না রানার। কেউ খেয়ালই করল না ওর উপস্থিতি। ছন্দের সাথে সাথে বাড়ছে উত্তেজনা হাতের গ্লাসগুলো এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে সবাই, মনে হচ্ছে ভেঙে ফেলবার চেষ্টা করছে। স্বর্ণকেশী সুন্দরী স্টেজের ওপর কিলবিল করছে মেরুদণ্ডবিহীন গোলাপী সাপের মত। বাশের খাঁচাটার একটা অংশ খুলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে। নীল একটা কম পাওয়ারের স্পট লাইট জ্বলে উঠেছে। কি যেন নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে খাঁচার মধ্যে।

সোহানা আর মারিয়া যে টেবিলে বসে আছে, ঠিক তার পাশের টেবিলে। বসল রানা একটা চেয়ার টেনে। সোহানার এতই গায়ের কাছে বসল যে চট করে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল সে রানার মুখের দিকে। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে উজ্জল একটা হাসি উপহার দিল রানা সোহানাকে। চমকে উঠল সোহানা রানার হাসি দেখে, চট করে সরে সরে গেল ছয় ইঞ্চি।

ভয় কি? বড়জোর অশ্লীল কোন প্রস্তাব দিতে পারি, খেয়ে তো আর ফেলব না? বলল রানা হাসিমুখে। আবার চমকে উঠল সোহানা। এবার ওর সাথে মারিয়াও। ভুরু কুঁচকে চেয়ে রয়েছে ওরা রানার মুখের দিকে।

কি ব্যাপার? বেশ কিছুক্ষণ পর কিছুটা সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল সোহানা, তোমার মুখের জিওগ্রাফি পাল্টে দিল কে?

কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড। মাসুদ রানা দি গ্রেট এখন ছদ্মবেশে। অত জোরে চেঁচিয়ো না, গলাটা নামাও।

কিন্তু… কিন্তু এত তাড়াতাড়ি এখানে পৌঁছলেন কি করে? জিজ্ঞেস করল মারিয়া। দুই মিনিটও হয়নি এই ঠিকানা জানিয়ে ফোন করেছি আমি, আমাদের হোটেলে।

অন্য সোর্স থেকে খবর পেয়ে এসেছি আমি এখানে। গির্জা থেকে সোজা এখানে এসে ঢুকেছে শেরম্যান? সহজ গলায় কথা বলো, ফিসফিস করবার দরকার নেই।

গলা দিয়ে আওয়াজ বের করল না কেউ, মাথা ঝাঁকাল দুজন একসাথে।

বেরিয়ে যায়নি এখান থেকে?

সদর দরজা দিয়ে বেরোয়নি। স্টেজের পাশে একটা বন্ধ দরজার দিকে চাইল সোহানা। ওই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে মিনিট পাঁচেক হলো।

দরজাটার দিকে চাইল রানা। চট করে চোখ গেল স্টেজের দিকে। নীল স্পট লাইনের আলোটা জোরদার হচ্ছে ক্রমে। কালো, লোমশ, বিশাল, বিকট একটা মুর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। বাঁশের খাঁচার একটা অংশ। খুলে গেছে–খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসছে মস্ত এক গরিলা, ঝকঝক করছে। ভয়ঙ্কর সাদা দাঁত, হাতদুটো ঝুলছে হাটুর কাছে। আরও দুই পা এগোতেই পরিষ্কার দেখা গেল পুরুষ গরিলা। যদিও সবাই জানে ওটা গরিলার খোলস। পরা মানুষ ছাড়া আর কিছুই নয়, তবু ভয়ে চিৎকার করে উঠল কয়েকজন। নিগ্রোটা তাল বাড়িয়ে দিয়েছে আরও, পাগলের মত বাজিয়ে চলেছে সারা শরীরে কাঁপন তুলে। মেয়েটা যেন টেরই পায়নি যে পিছন থেকে ভীষণ এক গরিলা এগিয়ে আসছে, আপন মনে নেচে চলেছে সে উদ্দাম অশ্লীল নাচ–এমন সব অঙ্গভঙ্গি করছে যে নিজের অজান্তেই কুঁচকে উঠছে সোহানার নাক।

গির্জার নানগুলোর চেহারা মনে রাখতে বলেছিলাম, রেখেছ?

চেষ্টা করেছি, বলল মারিয়া।

অদ্ভুত, বিসদৃশ বা ওই রকম কিছু চোখে পড়েছে তোমাদের কারও?

তেমন কিছু না, বলল সোহানা। তবে ওখানকার সন্ন্যাসিনী প্রত্যেকেই দেখতে ভাল।

আগেই শুনেছি খবরটা মারিয়ার কাছে। আর কিছু চোখে পড়েনি?

দুজন দুজনের দিকে চাইল, একটু ইতস্তত করে মারিয়া বলল, একটা ব্যাপার একটু অবাক লেগেছে আমার কাছে। গির্জায় ঢুকল অনেক বেশি লোক, বেরোল কম।

তার মানে?

ঠিকই বলছে মারিয়া,বলল এবার সোহানা। প্রার্থনার সময় যত লোক দেখেছিলাম, বের হলো অনেক কম।

অনেক বলতে কি বোঝাতে চাইছ?

একটু ইতস্তত করে সোহানা বলল, মানে… বেশ কিছু।

বা বা! অনেক থেকে এক লাফে চলে এলে বেশ কিছুতে। এরপর আরেক লাফে শূন্যতে নেমে যাবে মনে হচ্ছে? যাই হোক তোমাদের মনে। হচ্ছে, গির্জায় যত লোক ছিল সবাই, বেরোয়নি, এই তো? কেউ কেউ ব্যক্তিগত প্রার্থনার জন্যে থেকে যেতে পারে। খুব একটা অবাক হওয়ার কি আছে এতে?

কেউ কোন জবাব দিল না। দর্শকদের চিৎকারে তিনজনই চাইল স্টেজের দিকে। আপ্রাণ চেষ্টা করছে নর্তকী এখন গরিলার হাত থেকে বাঁচবার জন্যে। ধরে ফেলে ফেলে, এমনি অবস্থায় হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা, চেঁচিয়ে উঠছে ভয়ে, দমাদম বুক পিটছে গরিলা, আবার চেষ্টা করছে ওকে ধরতে। ড্রামের দ্রুত ছন্দ নেশা ধরিয়ে দিয়েছে, নাচন শুরু হয়ে গেছে। দর্শকদের রক্তে। তালে তালে শরীর ঝাঁকাচ্ছে সবাই, পৈশাচিক আনন্দ লাভ করছে ওদের ধর্ষণকামী প্রবৃত্তি। হঠাৎ প্রচণ্ড এক আওয়াজ করে থেমে গেল। ড্রাম। লোমশ বুকের ওপর চেপে ধরেছে গরিলা যুবতাঁকে। ছটফট করছে মেয়েটা ওর হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে। চিৎকার করে উঠল তীক্ষ্ণ কণ্ঠে। টানাহেঁচড়ায় সরু ফিতে দিয়ে বাধা নক্ষত্রদুটো খসে গেল ওর বুক থেকে। মাথার ওপর তুলে নিয়েছে বিকট গরিলা যুবতাঁকে, বিজয়গর্বে মুরল কয়েক পাক, তারপর শুইয়ে দিল ওর জ্ঞানহীন দেহটা মেঝের ওপর। মাথাটা একপাশে হেলে রয়েছে যুবতীর। নিচু হয়ে ঝুঁকে পড়ল গরিলাটা যুবতীর জ্ঞানহীন নগ্ন শরীরের ওপর। দপ করে নিভে গেল সব কটা স্পট লাইট। কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতা। শুধু দর্শকদের উত্তেজিত শ্বাস শোনা যাচ্ছে। পর মুহূর্তে বিকট হৈচৈ আর হাততালিতে ফেটে পড়ল দর্শকবৃন্দ।

এবার আমাদের কাজ কি? জিজ্ঞেস করল মারিয়া।

শহরে যে কটা নাইট-ক্লাব আছে, সবগুলোতে একবার করে ঢুঁ দিতে হবে তোমাদের। খুঁজে দেখবে, চেনা কোন মুখ পাওয়া যায় কিনা। নর্তকী, ওয়েট্রেস বা দর্শকদের মধ্যে কাউকে চিনতে পারো কিনা দেখো।

নাইট-কাবে সন্ন্যাসিনী? চোখ কপালে উঠল সোহানার।

কেন নয়? ওদের মানুষ বলে গণ্য করো না বুঝি? হাসল রানা। বিশেষ করে যাদের দেখবে লম্বা-হাতা জামা, কিংবা কনুই পর্যন্ত লম্বা গ্লাভ তাদেরকে লক্ষ্য করবে ভাল মত। গির্জার কাউকে যদি পেয়ে যাও, তাহলে সে কোথায় থাকে বের করার চেষ্টা করবে। কিন্তু যা-ই করো না কেন, রাত একটার মধ্যে ফিরে যাবে নিজেদের হোটেলে। ওখানে দেখা করব আমি তোমাদের সঙ্গে।

ইতিমধ্যে কোথায় কি কাজ তোমার?

কাজের অভাব নেই। প্রচুর কাজ পড়ে রয়েছে আমার সামনে এখন। কোনটা ছেড়ে কোটা বলি?

অর্থাৎ বলবে না।

হলুদ একটা স্পট লাইট জ্বলে উঠল শূন্য স্টেজের ওপর। নিগ্রো ড্রমবাদক একলাফে অন্ধকার থেকে এসে দাঁড়াল আলোয়, লম্বা করে কুর্নিশ করল দর্শকদের। কুর্নিশরত অবস্থাতেই হ্যাঁচকা টান দিল সে নিজের কোকড়া চুল ধরে। চুলসহ একটা পাতলা রবারের মুখোশ খসে এল ওর হাতে–বেরিয়ে পড়ল লালচুলো এক ধবধবে ফর্সা যুবকের মুখ। প্রচুর হাততালি পড়ল, সেই সঙ্গে সিটি। আরেকবার বো করে একপাশে সরে দাঁড়াল ড্রামরাদক। দৌড়ে এসে দাঁড়াল নর্তকী, বো করতে গিয়ে নিজের বুকের দিকে চোখ পড়তেই জিভ কাটল আধ হাত। চকচকে নক্ষত্র লাগাতে ভুলে গেছে। লজ্জিত হাসি হাসল মেয়েটা, তারপর একহাতে বুক ধরলো, আরেক হাতে চুল–জোরে টান দিতেই খসে এল দুটোই। দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে যোলো-সতেরো বছরের। এক ছোকরা। প্রথমে বিস্মিত গুঞ্জরন, পরমুহূর্তে প্রচুর হাততালি পড়ল। এবার তড়াক করে স্টেজে উঠে এল গরিলাটা। কুৎসিত ভঙ্গিতে এপাশ-ওপাশ ঘুরে। বারকয়েক কুর্নিশ করে লোমশ দুই হাতে ধরল নিজের মাথাটা। কাঁধ  থেকে। নিয়ে ওপরের অংশটা খসে এল ওর হাতে। মাথাটা ঝাড়া দিতেই একরাশ সোনালী চুল ছড়িয়ে পড়ল গরিলার লোমশ কালো পিঠে। মেয়ে একটা। হাসছে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখে। তুমুল হর্ষধ্বনি।

বাঁকা হাসি খেলে গেল সোহানার ঠোঁটে। বলল, কী সুক্ষ্ম রসবোধ, তাই? উঠে দাঁড়াল। চলো, মারিয়া, অন্যান্য নাইট-ক্লাবগুলোও নিশ্চয়ই শিল্প চেতনা আর সৌন্দর্য বোধের ব্যাপারে এদের চেয়ে কম যাবে না। দেরি হলে মিস্ করব আবার।

বেরিয়ে গেল ওরা। কেউ ওদের অনুসরণ করে কিনা দেখবার জন্যে আড়চোখে চেয়ে রইল রানা ওদের গমন পথের দিকে। মস্ত মোটা এক দয়ালু চেহারার লোক পিছু নিল ওদের। এতই মোটা যে থুতনির তিনভাজ চলে এসেছে একেবারে বুক পর্যন্ত, গলা বা ঘাড়ের কোন অস্তিত্বই নেই। মোটা লোকটার পিছু নেয়াটা অনুসরণ কিনা ঠিক বোঝা গেল না, কারণ, কয়েক ডজন লোক আবার পিছু নিল মোটার। আজ রাতের আসল আকর্ষণ শেষ, দ্রুত খালি হয়ে যাচ্ছে ঘরটা। দেখতে দেখতে অর্ধেক টেবিলই খালি হয়ে গেল। হালকা হয়ে যাচ্ছে ধোয়ার আস্তরণ। ব্যস্তপদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওয়েটাররা। একটা নির্জলা স্কচ হুইস্কির অর্ডার দিল রানা। যা নিয়ে আসা হলো, এক চুমুক খেয়েই বুঝতে পারল সে, কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করলে হয়তো এর মধ্যে সামান্য একটু হুইস্কির ছিটেফোঁটা আবিষ্কার করা যেতে। পারে-না-ও যেতে পারে। নির্জলা হুইস্কি নয়, নিহুইস্কি জল। পয়সা লুটবার কোন দিকই আর বাদ রাখেনি এরা। বুড়ো এক লোক নিবিষ্টচিত্তে ভেজা এক ন্যাকড়া দিয়ে মুছছে ডান্সফ্লোরটা।

ভিতর দিকের একটা খোলা দরজার সামনে দেখতে পেল রানা বিট্রিক্স শেরম্যানকে। একটা শাল জড়াচ্ছে কাঁধে, পাশেই আর একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। কি যেন ফিসফিস করে বলছে ওর কানে কানে। দুজনের উত্তেজিত, ব্যস্তসমস্ত হাবভাব দেখে মনে হলো অত্যন্ত গুরুতপূর্ণ কিছু ঘটেছে। বারকয়েক মাখা। ঝাঁকাল বিট্রিক্স, চারপাশে চাইল সতর্ক দৃষ্টিতে, তারপর লম্বা পা ফেলে। বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে। যেন তাড়া নেই রানার, ধীরে সুস্থে বিল চুকিয়ে। দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে-ও বাইরে।

 কয়েক মিনিটের মধ্যেই দূরত্বটা বিশফুটের মধ্যে নিয়ে এল রানা। রেমব্র্যান্টপ্লেইনের দিকে এগোচ্ছে মেয়েটা, বেশ কিছুদূর গিয়ে থামল একটা ছোট্ট কাফের সামনে। কাফের বাইরে ফুটপাথের ওপর একটা ব্যারেল অর্গান। বাজাচ্ছে এক বুড়ো। চট করে রানার মনে পড়ল, কার্লটন হোটেলের বাইরেও এই রকম এক বুড়োকে দেখেছে সে ব্যারেল অর্গান বাজাতে। তবে সে লোকের দাড়ি ছিল। তার অবশ্য শ্রোতার সংখ্যাও এর চেয়ে বেশি ছিল-এর সামনে অর্গানের গায়ে হেলান দিয়ে মগ্ন হয়ে বেসুরো বাজনাঃগুনছে একটি মাত্র ছোকরা। একটু কাছে এগিয়ে পরিচিত ঠেকল রানার ছোকরার চেহারা। মনে হলো, দাড়িওয়ালা বুড়োর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে সে এই ছোকরাটাকে। একেবারে শুকনো, গালবসা, রুগ্ন চেহারা–অর্গানের গায়ে হেলান না দিলে দাঁড়িয়ে থাকবার সাধ্য ছিল না ওর। হঠাৎ হঠাৎ শিউরে উঠছে ছোকরার সর্বশরীর। অর্গান শিল্পী যে ছোকরাকে তেমন পছন্দ করতে পারছে না, বোঝা যাচ্ছে ওর বিরক্ত দৃষ্টি দেখে। বিরক্তি, সেই সঙ্গে ভয়। মাঝে মাঝে চারপাশে চাইছে বুড়ো ভীত চকিত দৃষ্টিতে।

অর্গানের কাছে গিয়ে দাঁড়াল বিট্রিক্স। একটা টুপি তুলে ধরল বৃদ্ধ, তারমধ্যে একটা কয়েন ছেড়ে দিয়ে ছোকরার হাত ধরে টানল মেয়েটা। সোজা হয়ে দাঁড়াল ছোকরা। বিস্ফারিত চোখে চাইল বিট্রিক্সের দিকে। গালদুটো এতই বসা যে মনে হয় একটা দাঁতও নেই ওর। ঢাকার ফুটপাথে মরে পড়ে থাকা দুর্ভিক্ষের লাশ মনে হচ্ছে ওকে দেখে। বিট্রিক্সের ওপর ভর দিয়ে এগোতে গিয়ে হোঁচট খেলে।

কাছে চলে এল রানা। বিনা বাক্যব্যয়ে একহাতে জড়িয়ে ধরল ছোকরার পিঠ–মনে হলো যেন কঙ্কাল জড়িয়ে ধরেছে সে। কিন্তু এই সাহায্যে খুশি হলো না বিট্রিক্স, ওর চোখের দৃষ্টিতে উদ্বেগ আর ভীতি দেখতে পেল রানা।

প্লীজ! মিনতি ফুটে উঠল মেয়েটার গলায়। সাহায্য লাগবে না। আমিই পারব। দয়া করে ছেড়ে দিন ওকে।

তুমি পারবে না, মিস শেরম্যান। একসঙ্গে পড়বে দুজন ড্রেনের মধ্যে।

হতবুদ্ধি বিট্রিক্স যেন কিছুই বুঝতে পারল না কয়েক সেকেন্ড, তারপর অস্ফুট গলায় বলল, মিস্টার মাসুদ রানা!

এটা কিন্তু বড়ই অন্যায় কথা, অনুযোগের কণ্ঠে বলল রানা। এত সুন্দর চেহারা আমার, সেই চেহারাটা চিনতে পারলে না তুমি দুঘন্টা আগে, নামই মনে করতে পারলে না–আর যেই ছদ্মবেশ নিলাম, অমনি ডেকে উঠলে নাম ধরে।

হঠাৎ হাল ছেড়ে দিল ছোকরা, পা ভাঁজ হয়ে পড়ে যাচ্ছিল রানার হাত ফসকে, চট করে ধরে ফেলল রানা আবার। এভাবে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে বেশিদূর যাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে নিচু হয়ে ওকে কাঁধে তুলে নেয়ার। উপক্রম করল সে। খপ করে হাত ধরল মেয়েটা রানার। আতঙ্কিত চোখমুখ।

না, না! ওভাবে তুলবেন না ওকে! প্লীজ!

কেন? এভাবেই তো সহজ হবে।

না, না! পুলিস দেখলে ধরে নিয়ে যাবে ওকে।

 সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল রানা, এক হাতে ওর পিঠ জড়িয়ে ধরে খাড়া রাখবার চেষ্টা করল যতটা সম্ভব, পা বাড়াল সামনে। বলল, ফাঁদে পড়ে গেছ শিকারীর। সামনে এখন শুধু অন্ধকার।

 রানার বক্তব্য পরিষ্কার বুঝতে না পেরে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইল মেয়েটা ওর মুখের দিকে।

হেনরীর জন্যে তোমাকে…

হেনরী! ওর নাম জানলেন কি করে আপনি?

গোপন খবর জানাই তো আমার কাজ, বলল রানা হাসিমুখে। যা বলছিলাম। পুলিসের কাছে ও যদি অপরিচিত হত, তবু এক কথা ছিল। কিন্তু। জেল খাটা দাগী ভাই যদি নেশার খপ্পরে পড়ে তাহলে সত্যিই খুবই অসুবিধের কথা। সমাজে মাথা উঁচু করে চলা মুশকিল হয়ে যায়।

কোন উত্তর দিল না মেয়েটা। পরাজিত, পাংশু মুখে হাঁটছে সে মাথা নিচু করে। চেহারায় হতাশা আর বিভ্রান্তির স্পষ্ট ছাপ। রানার উপস্থিতি যে ওর উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ, রানাকে সহ্য করা যে ওর পক্ষে কতখানি। কঠিন বুঝতে পারল রানা পরিষ্কার। যদি কোন যাদুমন্ত্রের বলে মুহূর্তে নাই হয়ে যেত রানা, মস্ত হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে পারত হয়তো সে। কিন্তু হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না ওর মধ্যে।

থাকে কোথায় ও? জিজ্ঞেস করল রানা।

আমার সঙ্গেই। ব্যাপারটা রানার জানা নেই বলে যেন একটু বিস্মিত হয়েছে সে। কাছেই। বেশি দূরে না।

ব্যালিনোভা ছাড়িয়ে একটা সরু গলি দিয়ে গজ পঞ্চাশেক গিয়েই পৌঁছে গেল ওরা অ্যাপার্টমেন্ট হাউজের সামনে। হেনরীকে কাঁধে নিয়ে সরু সিঁড়ি দিয়ে বহু কষ্টে তেতলায় উঠল রানা বিট্রিক্সের পিছু পিছু। দরজা খুলে দিতেই ঢুকল ভিতরে। বাথরূমের সমান দুটো ঘর–একটা বসবার একটা শোবার। বসবার ঘর পেরিয়ে শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকল রানা, খাটের ওপর কঙ্কালটা শুইয়ে দিয়ে ঘাম মুছল কপালের। চলে এল বসবার ঘরে।

এই সিঁড়ি দিয়ে রোজ ওকে নিয়ে ওঠো কি করে? মই বেয়ে ওঠাও তো এর চেয়ে সহজ।

কি করব… গার্লস হোস্টেল এর চেয়ে অনেক ভাল, সস্তাও, কিন্তু হেনরীকে নিয়ে..নাইট-ক্লাব থেকে বেশি পয়সা দেয় না আমাকে।

ঘরের চারপাশে চাইল রানা। আসবাবের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে। খুবই কম দেয়। বলল, তোমার মত কলে পড়া ইঁদুরকে কিছু যে দেয়, এই তো বেশি।

তার মানে?

মানেটা ভাল করেই জানা আছে তোমার। ফাঁদে আটকা পড়ে হাঁসফাস করছ, অথচ মানে বুঝতে পারছ না, এটা হতেই পারে না, বিট্রিক্স।

এত কিছু কি করে জানলেন আপনি? আমার নাম, আমার ভাইয়ের পরিচয়…।

কি করে জানলাম. বলে মনে হয় তোমার? ভুরু নাচাল রানা। ভুলে যাচ্ছ আমাদের একজন কমোন বয়ফ্রেন্ড ছিল।

বয়ফ্রেন্ড? আমার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই।

আছে বলিনি, বলেছি ছিল। অতীতের বয়ফ্রেন্ড বা মরহুম বয়ফ্রেন্ড-যা। খুশি বলতে পারো।

আমেদ? অস্ফুট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।

ঠিক ধরেছ। ইসমাইল আহমেদ। তোমার পাল্লায় পড়ে ছেলেটা মারা গেছে ঠিকই, কিন্তু মরার আগে কিছু তথ্যও দিয়ে গেছে আমাকে। মিথ্যের আশ্রয় নিল রানা। এমন কি তোমার একটা ছবিও রয়েছে আমার কাছে।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল বিট্রিক্স। কিন্তু তাহলে এয়ারপোর্টে

এয়ারপোর্টে তোমাকে চিনতে পারিনি কেন? ঠিকই চিনেছিলাম। কিন্তু যদি সেটা প্রকাশ করতাম, হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে হাজতে বাস করতে হত তোমাকে এতক্ষণে। যাই হোক, কিছু একটা জেনে ফেলেছিল বলেই মরতে হয়েছে ইসমাইলকে। আমি জানতে চাই কি সেটা।

দুঃখিত। এ ব্যাপারে আমি কোন সাহায্য করতে পারব না আপনাকে।

পারবে না, নাকি করবে না?

নিরুত্তর রইল বিট্রিক্স।

তিনমাসে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তোমাদের মধ্যে—তাই না?

চোখ নিচু রেখে মাথা ঝাঁকাল বিট্রিক্স।

ইসমাইল কেন, কি কাজে এখানে এসেছিল বলেছে তোমাকে?

মাথা নাড়ল মেয়েটা।

কিন্তু তুমি আঁচ করতে পেরেছিলে, তাই না?

এবার মাথা ঝাঁকাল।

এবং কি আঁচ করেছিলে সেটা জানিয়েছিলে কাউকে?

ঝট করে চাইল বিট্রিক্স রানার মুখের দিকে। না। কাউকে কিছুই বলিনি আমি। সত্যি।

তোমাকে দিয়ে ওকে কিছু বলিয়েছিল কেউ, তাহলে?

জানি না। হতে পারে। জেনেশুনে কোন ক্ষতি করিনি আমি আমেদের।

আমার সম্পর্কে কোন কথা বলেছিল ইসমাইল তোমাকে?

না।

কিন্তু তোমার ভাল করেই জানা আছে আমি কে?

চুপ করে রইল বিট্রিক্স। জল ভরে উঠল দুচোখে। চেয়ে রইল রানার। দিকে, কিন্তু জবাব দিল না।

তুমি ভাল করেই জানো যে ইন্টারপোল থেকে এসেছি আমি নারকোটিকসের ব্যাপারে। চুপ করে রইল মেয়েটা। কাঁধ  ধরে ঝাঁকাল ওকে রানা। উত্তর দাও। জানা নেই তোমার?

নীরবে মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা।

ইসমাইল যদি তোমাকে বলে না থাকে, কে বলেছে?

আবার চুপ। দুচোখ থেকে পানি ঝরতে শুরু করল। ফুঁপিয়ে উঠে মাথাটা একপাশে ফিরিয়ে নাড়ল মেয়েটা।

প্লীজ। কিছুই বলতে পারব না আমি। আপনি এখন যান। আপনার পায়ে ধরি, একা থাকতে দিন আমাকে।

অসহায় ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রানা। বুঝল এদিক থেকে আর এগোনো যাবে না। কাজেই দিক পরিবর্তন করল সে। খোলা দরজা দিয়ে ঘুমন্ত হেনরীর কঙ্কালটার দিকে চেয়ে বলল, হেনরী সংসারের কোন খরচ, দেয়? কিছু উপার্জন-টুপার্জন করে?

ও উপার্জন করবে কি করে? কাজ করবার ক্ষমতাই নেই ওর। এক বছর ধরে সম্পূর্ণ বেকার। কিন্তু এসবের মধ্যে আবার ওর কথা কেন? এসবের– সঙ্গে ওর কি সম্পর্ক?

ওর সঙ্গেই জড়ানো আছে সবকিছু। বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াল রানা। স্থিরদৃষ্টিতে পরীক্ষা করল ওর মুখটা। একটা চোখের পাতা তুলে দেখল কিছুক্ষণ, তারপর ওটা নামিয়ে দিয়ে ফিরল বিট্রিক্সের দিকে। এই রকম জ্ঞান। হারালে কি করো?

কি আর করব? কিছুই করার নেই।

মাথা ঝাঁকাল রানা। আস্তিন গুটিয়ে দেখল ক্ষতবিক্ষত কঙ্কালসার হাতটা। কত হাজার বার ছিদ্র করা হয়েছে হাতটা তার ইয়ত্তা নেই। ইরিনের হাতটা এর তুলনায় কিছুই না। সোজা হয়ে দাঁড়াল রানা। ঠিক বলেছ। সীমার বাইরে চলে গেছে একেবারে। কারও কিছু করবার নেই এখন। ওর সেরে ওঠার সব পথ বন্ধ–ব্যাপারটা জানা আছে তোমার?

জানি। একটা রুমাল বের করে চোখ মুছল বিট্রিক্স। জানি, মারা যাচ্ছে। ও কিছুদিনের মধ্যেই।

যারা হত্যা করছে ওকে, তাদের বিরুদ্ধে একটা আঙুল তোলারও সাহস নেই তোমার। ঠিক আছে, এজন্যে দোষ দিচ্ছি না আমি তোমাকে। কয়েকটা সহজ প্রশ্নের উত্তর দাও দেখি? কতদিন নাগাদ এই অবস্থা চলছে হেনরীর?

তিন বছর।

কতদিন যাবৎ কাজ করছ তুমি ব্যালিনোভায়?

তিন বছর।

কাজটা ভাল লাগে তোমার?

ভাল! লক্ষ্মীপেঁচার মত মুখ করে হাসল বিট্রিক্স। ওই রকম একটা জঘন্য নাইট-ক্লাবে কাজ করা যে কি, কল্পনাও করতে পারবেন না আপনি। বাপের বয়সী সব বুড়োরা লোভাতুর

ইসমাইল আহমেদ তো বাপের বয়সী ছিল না?

না। ওর কথা বলছি না…

দেখো, বিট্রিক্স। মারা গেছে ইসমাইল। কেন মারা গেছে জানো? মারা গেছে নাইট-ক্লাবের এক হোস্টেসকে বিশ্বাস করতে গিয়েছিল বলে, সে নিজেই ব্ল্যাকমেইলের শিকার।

আমাকে কেউ ব্ল্যাকমেইল করছে না।

তাই নাকি? তাহলে কারা চাপ সৃষ্টি করছে তোমার ওপর? কাদের ভয়ে চুপ করে থাকছ উত্তর দিচ্ছ না আমার প্রশ্নের? কাদের ভয়ে যে কাজ এত অপছন্দ তোমার সেই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছ? কিসের জোরে চাপ সৃষ্টি করতে পারছে ওরা? হেনরী নয়? কি করেছে ও, যেজন্যে বাধা পড়ে গেছ তুমি? কারা বাধ্য করছে তোমাকে আমার ওপর নজর রাখতে? একটি প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারল না বিট্রিক্স। কাজেই আবার ইসমাইলের প্রসঙ্গে ফিরে গেল ও।, ইসমাইল আহমেদের মৃত্যুর সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক? কিভাবে ও মারা গেছে আমি জানি; দেখেছি নিজের চোখেই। কিন্তু কারা। মারল ওকে? কেন

আমি জানতাম না ওকে মেরে ফেলবে! ফুঁপিয়ে উঠে দুই হাতে মুখ ঢাকল বিট্রিক্স। সত্যিই জানতাম না মেরে ফেলা হবে ওকে।

অন্যান্য সবকিছুই জানতে, শুধু জানতে না যার পালিয়ে যাবার সুবিধের জন্যে দরজার সামনে পথ আটকাতে হবে আমার, সেই লোকের ওপর ইসমাইলকে হত্যার নির্দেশ ছিল। হয়তো সত্যিই তাই। তোমাকে কোন দোষ দিতে চাই না আমি, বিট্রিক্স। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্যে অনেককে। দেখেছি আমি দুনিয়ার অনেক ক্ষতি করতে। তবে তোমার ভালর জন্যেই একটা কথা বলব ভাল করে ভেবে দেখো, তোমার জীবন পড়ে রয়েছে। সামনে। মস্তবড় বিপদের মধ্যে রয়েছ তুমি। হেনরীর কথা ভেবে কোন লাভ নেই এখন, জীবন বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই ওর–তোমার নিজের কথাই অনেক বেশি করে ভাবা দরকার তোমার এখন।

কিছুই করবার নেই আমার, কিছুই বলবার নেই, দুহাতে মুখ ঢেকে রেখে মাথা নাড়ল সে। দয়া করে আপনি যান।

রানা বুঝল, এর পরে ওরও আর কিছুই করবার বা বলবার নেই কিছুতেই জবান খুলবে না আতঙ্কিত মেয়েটা–কাজেই দ্বিরুক্তি না করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

.

ঠিক একটা পাঁচে সোহানা আর মারিয়ার হোটেল কক্ষের অ্যাটাচড বাথরূম। থেকে বেরিয়ে এল প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা মাসুদ রানা। হাতের তোয়ালেটায়। বিশ্রী রকম ছোপ ছোপ দাগ লেগে গেছে মেকাপ তুলতে গিয়ে। বাথরূমের। আয়নায় মোটামুটি নিজের চেহারাটা পরিচিত ঠেকতেই বেরিয়ে এসেছে সে, ঘাড়ে, গলায় এখনও কিছু রঙ লেগে রয়েছে, কিন্তু সেগুলো ঢেকেঢুকে কোনমতে কার্লটনের ছশো বাইশ নম্বর কামরায় ঢুকতে পারলেই চলবে আপাতত।

খাটের ওপর সোজা হয়ে বসে আছে সোহানা ও মারিয়া, দুজনেই এমন নাইট-ড্রেস পরেছে যে সেগুলোকে মশারী না বলে ড্রেস কেন বলে, কিংবা প্রস্তুতকারক কি পরিমাণ কাপড় বাঁচিয়েছে এগুলো থেকে, ইত্যাদি নিয়ে একটা থিসিস লিখে ফেলা যায়। কিন্তু আপাতত হাতে সময় নেই বলে কলারের কাছে লালচে হয়ে যাওয়া শার্টটা গায়ে চড়িয়ে বোতাম লাগাতে শুরু করল সে দ্রুত হাতে।

তাহলে বেশির ভাগ নাইট-ক্লাবের মেয়েই ওই হোস্টেল প্যারিসে থাকে?

তাই তো মনে হলো। যে চারটে দলকে অনুসরণ করলাম, প্রত্যেকটাই ঢুকল গিয়ে হোস্টেল প্যারিসে। আরও কয়েকটা মেয়েকে ঢুকতে দেখেছি আমরা ওই হোস্টেলে–মনে হলো ওরাও ফিরছে নাইট-ক্লাব থেকেই।

একটা মুখও চিনতে পারলে না?

চেনা চেনা লেগেছে এক আধটা মুখ, কিন্তু শিওর হতে পারিনি। তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

হেনরী এবং বিট্রিক্সের কথা বলল রানা।

এত সময় লেগে গেল ওদের ওখানে?

না। আরও দুএকটা জায়গায় গিয়েছি। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। বিট্রিক্স শেরম্যানের ওখান থেকে বেরিয়ে আবার যে সে গিয়েছিল ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে সেকথা চেপে গেল রানা। গলার স্বর পাল্টে নিয়ে বলল, এবার তোমাদের কিছু কাজ দেয়া যাক। অযথা নাইট-ক্লাবে ঘোরাঘুরি রেখে এবার সত্যিকার কিছু কাজ দেখাও দেখি? বিনা দ্বিধায় রানাকে এই ধরনের একটা কথা বলতে দেখে রেগে উঠতে যাচ্ছিল মারিয়া, চট করে সোহানার মুখের দিকে চাইল, তারপর হাসল। রানা বলেই চলল, মারিয়া কাল সকালে যাবে ভন্ডেল পার্কে। রোজ সকালে যায় ওখানে ইরিন। ওর ওপর লক্ষ রাখতে হবে। কিন্তু সাবধান…ও চেনে তোমাকে। পার্কে গিয়ে ও কি করে, কারও সঙ্গে দেখা করে কিনা, কথা বলে কিনা, ইত্যাদির রিপোর্ট চাই আমি কাল। পার্কটা বিরাট, কিন্তু ওকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না; পুতুলের পোশাক পরা। এক বুড়ি থাকবে ওর সঙ্গে; সে বুড়ির পেটের বেড় হবে কমপক্ষে নয় ফিট। আর সোহানা, কাল ওই হোস্টেলের ওপর নজর রাখবে তুমি। যদি চার্চের কোন সন্ন্যাসিনীকে পাও ওদের মধ্যে, পিছু নেবে; কোথায় যায়, কি করে তার পূর্ণ বিবরণ চাই আমার। ভেজা, স্যাৎসেতে কোটটা গায়ে চড়াল রানা। চলি, গুডনাইট।

ত্রিশ গজ দূরে পার্ক করে রাখা ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠল রানা। ভাবল, আজ অন্ধকারে অনেকগুলো ঢিল ছুঁড়েছে সে। এর মধ্যে একটাও কি লাগবে না। ওদের ভীমরুল চাকে? কখন টের পাওয়া যাবে প্রতিক্রিয়া?

.

১০.

 হোটেলে ফিরে দেখল রানা চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। ফুটপাথের ব্যারেল অর্গান বাদক এবং তার ভক্তবৃন্দ কেউ নেই। পোর্টার নেই, ডোরম্যান নেই। একটু অবাক হলো রানা-গেল কোথায় সব? হাত বাড়িয়ে। আলগোছে হুক থেকে চাবিটা খসিয়ে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল সে দোতলায়, তারপর বোতাম টিপল লিফটের জন্যে।

ভেজা কাপড় সব খুলে ফেলে গরম পানিতে ভিজল রানা দশ মিনিট। তারপর শুকনো কাপড় পরে নিয়ে একটা সিগারেট ধ্বংস করল ব্যালকনির রেলিঙে হেলান দিয়ে। নিচের রাস্তায় লোক চলাচল অনেক কমে গেছে। কর্তব্য স্থির করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে ঘরে তালা মেরে।

খটাং করে চাবিটা রাখল রানা ডেকের ওপর। চমকে সোজা হয়ে বসে চোখ মিটমিট করল ঝিমন্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। রানাকে দেখে চট করে। চোখ গেল ওর দেয়াল ঘড়ির দিকে, তারপর ডেস্কের ওপর চাবির দিকে।

মিস্টার মাসুদ রানা। কখন, কখন ফিরলেন, দেখিনি তো?

অনেক আগে, বলল রানা। দুতিনঘণ্টা তো হবেই। বেঘোরে ঘুমোচ্ছিলেন আপনি তখন। চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, যেন দুগ্ধপোষ্য শিশু…

ওর দৃষ্টিটা চট করে ঘুরে এল আর একবার ঘড়ির ওপর থেকে। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, এখন কি আবার বেরোচ্ছেন কোথাও? রাত আড়াইটা!

তাতে কি হয়েছে? চব্বিশ ঘণ্টা পাহারার ব্যবস্থা রাখা উচিত ছিল। হাসল রানা। ডোরম্যান নেই, পোটার নেই, ট্যাক্সিম্যান নেই, অর্গান-ভিখারী নেই, অনুসরণ করবার কেউ নেই–ব্যাপার কি? এজন্যে রীতিমত জবাবদিহি করতে হতে পারে আপনার।

প্লীজ.কি বলছেন ঠিক

বুঝতে পারছেন না। আমি নিজেও কি ছাই বুঝে বলছি? যাই হোক, হেয়ার কাটিং সেলুনটা কোনদিকে?

হেয়ার কাটিং সেলুন! এত রাতে আপনি চুল ছাটতে…

বুঝেছি। আবার হাসল রানা। জানা নেই আপনার। ঠিক আছে, আমি– নিজেই খুঁজে নেব।

বেরিয়ে পড়ল রানা। বিশ গজ গিয়ে একটা ডোরওয়ের আড়ালে দাঁড়াল, উঁকি দিল কেউ অনুসরণ করছে কিনা দেখবার জন্যে। তিন মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হলো সে ওর প্রতি কারও তেমন কোন আগ্রহ নেই দেখে। নজর। রাখবার প্রয়োজন বোধ করছে না কেউ ওর গতিবিধির ওপর। কেউ অনুসরণ করছে না। আরও ত্রিশ গজ গিয়ে পুলিস-কারে উঠে পড়ল রানা। ফাস্ট রিফর্মড চার্চ অফ দা অ্যামেরিকান হিউগানট সোসাইটির দুই গলি আগে রাস্তার ধারে পার্ক করে নেমে পড়ল সে ট্যাক্সি থেকে, ক্যানেলের ধার ঘেয়ে সতর্ক পায়ে এগোল গির্জার দিকে।

ক্যানেলের জলে কোন আলোর প্রতিবিম্ব দেখতে পেল না রানা। খালের দুধারে একটা বাড়িতেও আলো জ্বলছে না। গির্জাটাকে আরও শান্ত, আরও নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। বিশাল ক্রেনের প্রকাণ্ড বুমটা মনে হচ্ছে আকাশ ফুড়ে চলে গেছে ওপরে, ভয় ভয় একটা ভাব বিরাজ করছে ওটার চারপাশে। আশেপাশে প্রাণের কোন সাড়া নেই। মনে হচ্ছে গভীর রাতের গোরস্থান।

কাছাকাছি এসে চট করে রাস্তা পেরোল রানা। সিঁড়ি বেয়ে উঠে দাঁড়াল একটা মোটা থামের আড়ালে, তীক্ষ্ণদৃষ্টি বুলাল চারপাশে। কারও সাড়া বা শব্দ পাওয়া গেল না। দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে, ডানহাতে হ্যাঁনডেল। চাপ দিয়ে বাম হাতে চাবির গোছাটা বের করতে যাচ্ছিল, প্রায় চমকে উঠল। সে দরজাটা খোলা দেখে। গির্জার দরজায় তালা না থাকা তেমন কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, কিন্তু রানা হয়তো মনে মনে স্থির নিশ্চিত ছিল যে দরজাটা তালা মারা থাকবে, তাই এতটা অবাক হয়েছে। নিঃশব্দে ভিতরে ঢুকে বন্ধ করে দিল সে দরজাটা। টর্চটা বেরিয়ে এসেছে, ওর হাতে, দ্রুত একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে আনল সে আলোটা। নিঃসন্দেহ হলো, ও একা।

 এবার আরেকটু যত্নের সাথে গিজার অভ্যন্তরটা পরীক্ষার কাজে মন দিল। রানা। বাইরে থেকে যতটা মনে হয় তার চেয়েও ছোট আসলে গির্জাটা। খুবই প্রাচীন। টর্চটা উঁচু দিকে ধরল সে। কোন ব্যালকনি নেই, গোটা কয়েক ধূলিমলিন বন্ধ কাঁচের জানালা বৃয়েছে কড়া রোদ উঠলেও কাঁচের মালিন্য ভেদ করে ভিতরে আলো ঢুকতে পারবে কিনা সন্দেহ। বেরোবার একমাত্র রাস্তা দেখা যাচ্ছে ওই প্রবেশদ্বারই। দ্বিতীয় একটা দরজা দেখা যাচ্ছে ভিতরের ঘরে ঢুকবার, পুলপিট আর প্রাচীন এক অর্গানের মাঝামাঝি জায়গায়। বন্ধ।

 এই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল রানা, নবের ওপর হাত রেখে নিভিয়ে দিল টর্চটা। জং ধরা কজায় সামান্য আওয়াজ হলো দরজাটা খুলতে। অতি। সাবধানে পা বাড়াল সে সামনে। ভাগ্যিস সাবধানে বাড়িয়েছিল, নইলে হোঁচট খেয়ে সামনে হুড়মুড় করে পড়তে হত। পাশের ঘরটা আসলে ঘর না–সিঁড়ি ঘর। দরজার পরেই একফুট নিচে প্রথম ধাপ। সাবধানে নামতে শুরু করল রানা ঘোরানো সিঁড়ির ধাপ বেয়ে, মনে মনে আঠারো শুনতেই পৌঁছে গেল, নিচে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। অন্ধের মত দুহাত সামনে বাড়িয়ে এগোল রানা। আশা করছে এক্ষুণি একটা দরজা পাওয়া যাবে, কিন্তু কয়েক কদম গিয়েও যখন দরজা পাওয়া গেল না, থেমে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বালল। এবার তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘোরাল সে টর্চ।কেউ নেই। জানালা বিহীন একটা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে সে একা।

গোটা গির্জার আয়তনের প্রায় অর্ধেক হবে ঘরটা। সিলিং থেকে একটা উলঙ্গ বালব ঝুলছে তারের মাথায়। দেয়ালের গায়ে সুইচ খুঁজে বের করে টিপে দিল রানা। শতশত বছরের ধুলো জমে আছে কাঠের মেঝের ওপর। ঘরের মাঝখানে গোটা কয়েক চেয়ার-টেবিল পড়ে রয়েছে এলোমেলো ভাবে, দুপাশের দুই দেয়ালের গায়ে সারি বাধা চারটে চারটে আটটা কেবিন। মনে। হচ্ছে, মধ্যযুগীয় কোন কাফে।

পরিচিত একটা গন্ধে নিজের অজান্তেই নাকটা একটু কুঁচকে উঠল রানার। গন্ধটা ডানদিকের কোন কেবিন থেকে আসছে বলে মনে হলো ওর। ছোট্ট টর্চটা বুক পকেটে গুঁজে পিস্তল বের করল রানা। সাইড পকেট থেকে সাইলেন্সরটা বের করে লাগাল পিস্তলের মুখে। তারপর ওটা বাগিয়ে ধরে প্রেতাত্মার মত নিঃশব্দে এগোল সামনে।

প্রথম কেবিনটা খালি। দ্বিতীয়টার সামনে গিয়েই নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল রানা। অতি সাবধানে উঁকি দিয়ে দেখল, না, এটাও খালি। তৃতীয়। কেবিনের দরজার কাছে এসে গন্ধটা প্রবল হলো। সাইলেন্সারের মুখ আর, রানার বামচোখ একই সাথে উঁকি দিল তৃতীয় কেবিনের ভিতর।

 এত সাবধান না হলেও চলত। ছোট্ট একটা টেবিলের ওপর দুটো জিনিস চোখে পড়ল রানার একটা অ্যাশট্রের মধ্যে আধ ইঞ্চি লম্বা একটা সিগারেটের টুকরো, আর তার পাশে হাতের ওপর রেখে ঘুমিয়ে থাকা একটা মাথা। মুখটা ওপাশে ফেরানো রয়েছে, কিন্তু এক সেকেন্ডও লাগল না রানার ওকে চিনতে। হেনরী। ওকে যে অবস্থায় খাটে শুইয়ে দিয়ে এসেছিল, তাতে রানার। ধারণা হয়েছিল চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে পড়ে থাকবে ছোকরা আউট হয়ে। এত তাড়াতাড়িই জ্ঞান ফিরে পেয়ে কি করে এতদূর এসে হাজির হলো ভেবে একটু অবাকই হলো সে। অবশ্য, জানা আছে রানার, নেশার চরম পর্যায়ে যারা চলে যায় তারা অনেক সময় অবিশ্বাস্য রকম দ্রুত জ্ঞান ফিরে পায়, পেয়েই পাগল হয়ে যায় আবার নেশা করবার জন্যে। আপাতত একে নিয়ে কোন সমস্যা নেই। পা বাড়াল সে সামনে।

কেবিনগুলো সব একবার করে দেখে নিয়ে সামনের দেয়ালের গায়ে একটা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল রানা। কান পেতে শুনল ভিতর থেকে কোন আওয়াজ পাওয়া যায় কিনা। নিশ্চিন্ত হয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। ভিতরে, বাতির সুইচ খুঁজে বের করে টিপে দিল।

এ ঘরে আসবারের কোন বালাই নেই, শুধু চার দেয়ালের গায়ে চারটে উঁচু র‍্যাক রাখা, র‍্যাকগুলোর প্রত্যেকটা তাকে ঠাসা রয়েছে বাইবেলের পর বাইবেল। ফাস্ট রিফর্মড চার্চের বাইবেল। জায়গার অভাবে একেক তাকে। তিন সারি করে সাজানো। ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে এই স্টকেরই একটা অংশ দেখে এসেছে সে। এই কিছুক্ষণ আগেই। কাজেই এগুলোর মধ্যে নতুন কিছু পাওয়া যাবে না বুঝতে পারল সে, তবু এগিয়ে গিয়ে ঘাটতে শুরু করল সে বাইবেলগুলো। অতীত অভিজ্ঞতা রয়েছে। কাজেই প্রথম বা দ্বিতীয় সারি পরীক্ষা করল না সে, দুই সারি থেকে দুটো বই সরিয়ে তৃতীয় সারি থেকে টেনে বের করে আনল একটা বাইবেল। যা আশা করেছিল, তাই। দেখতে অন্যসব বাইবেলের থেকে তফাৎ নেই কোন, কিন্তু আসলে এটা বই-ই নয়, বইয়ের মত দেখতে বাক্স একটা, ভিতরটা ফাঁপা।

বাংলাদেশে বেশ কিছু উকিল আছে, যারা মক্কেলের কাছে নিজেদের পাণ্ডিত্যের বহর দেখাবার জন্যে চেম্বারের কয়েকটা আলমারি ভর্তি করে রেখেছে এই ধরনের চামড়া বাঁধাই করা ফাপা বই দিয়ে কিন্তু ফাস্ট রিফর্মড। চার্চ মুগ্ধ করতে চায় কাকে?

বাইবেলের মলাট, অর্থাৎ ঢাকনিটা খুলে ভিতরে একবার নজর বুলিয়েই বন্ধ করে দিয়ে এদিক ওদিক চাইল রানা। এঘরে দেখবার আর কিছুই নেই। যে দরজা দিয়ে ঢুকেছে, ঠিক তার উল্টোদিকের দেয়ালে ওই রকম আর একটা দরজা। আবার কান পাতল রানা, খুলল, ভিতরে ঢুকে আলো জ্বালল।

ছোট্ট একটা শিস বেরিয়ে এল রানার মুখ থেকে। অত্যন্ত আধুনিক ঝকঝকে সব যন্ত্রপাতি সাজানো রয়েছে এ ঘরে। ছোটখাট একটা ফ্যাক্টরি। কি জিনিস তৈরি হয় তার কৌন নমুনা নেই ঘরের কোথাও, কিন্তু মেশিনগুলো যে নিয়মিত ব্যবহার করা হয়, তার চিহ্ন সুস্পষ্ট। মার্সেই শহরের লাভ লজে ঠিক এই রকম আর একটা ফ্যাক্টরি দেখেছিল সে, মনে পড়ল রানার।

ঘরের মাঝামাঝি গিয়েই ওর মনে হলো যেন আবছা একটা শব্দ কানে, এল। যে দরজা দিয়ে ও এইমাত্র ঘরে ঢুকেছে, সেই দরজার কাছে। ঘাড়ের পিছনে সেই সুড়সুড়ি জাতীয় অনুভূতিটা বোধ করল রানা। মনে হলো, পিছন থেকে কেউ চেয়ে রয়েছে ওর পিঠের দিকে, মাত্র কয়েক ফুট দূর থেকে।

কিছুই টের না পাওয়ার ভান করল রানা, যেমন হাটছিল তেমনি আপন মনে হাঁটতে থাকল সামনের দিকে। কিন্তু স্বাভাবিক থাকা খুব কঠিন হয়ে। পড়ল ওর পক্ষে। মনের ভিতর যখন পাই করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিপদের স্বরূপ চাক্ষুষ করবার, কিংবা সৎ করে সরে কোন কিছুর আড়ালে লুকোবার অদম্য ইচ্ছে, যখন রানা পরিষ্কার জানে যে কোন মুহূর্তে একটা থারটি এইট ক্যালিবার অথবা তার চেয়েও ভয়ঙ্কর বুলেট এসে ঢুকতে পারে মাথার পিছনে-আগামী পদক্ষেপেই ঘটতে পারে ঘটনাটা, তখন সহজু ভঙ্গিতে সোজা হয়ে হাঁটাও সহজ নয়। বিশেষ করে অস্ত্র বলতে যদি বাম হাতে ধরা থাকে, একটা ফাপা ধর্মগ্রন্থের খোলস তাহলে হৃৎকম্প শুরু হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। প্রচণ্ড বেগে লাফাতে শুরু করেছে ওর হৃৎপিণ্ডটা বুকের ভিতর। কোন শাসন মানছে না।

নিজের বোকামিতে ভয়ানক রাগ হলো রানার নিজের ওপর। আর কেউ এই ভুল করলে বিনা দ্বিধায় বলত সে উচিত সাজা হয়েছে ব্যাটা গর্দভের। কি করে নিজে করল সে এই ভুলটা? গির্জার দরজাটা ভোলা দেখে? বাইরের দরজা খোলা, বেজমেন্টে নামবার দরজা খোলা, কোথাও কোন তালা নেই, কোথাও কোন বাধা নেই–যার খুশি আসো, ঢোকো, দেখো। এই অবস্থা দেখে প্রথমেই তো বোঝা উচিত ছিল ওর, একটাই মাত্র কারণ থাকতে পারে এর। সেটা হচ্ছে নিশ্চয়ই সশস্ত্র পাহারাদারের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে, যার ওপর হুকুম রয়েছে, ঢুকতে বাধা দেবে না কাউকে, বাধা দেবে বেরোতে গেলে–প্রাণ নিয়ে যেন কেউ বেরিয়ে যেতে না পারে এখান থেকে। নিশ্চয়ই পুলপিট কিংবা আর কোন গোপন জায়গায় চুপচাপ ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। হয়তো আরও কোন দরজা রয়েছে যেটা লক্ষ্যই করেনি সে।

আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে ঘরের শেষ মাথায় পৌঁছল রানা, বামপাশে লেদ মেশিনের মত দেখতে একটা যন্ত্রের ওপাশে কিছু দেখে যেন অবাক হয়েছে এমনি ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে কিছু বলল, তারপর নিচু হয়ে ঝুঁকল যন্ত্রের। আড়ালে–যেন মেঝেতে রাখা কিছু জিনিস পরীক্ষা করে দেখছে। এতক্ষণ। পর্যন্ত সুযোগ দেয়ায় যার-পর-নাই কৃতজ্ঞ রোধ করল সে লোকটার প্রতি। ঠিক দুই সেকেন্ড পর যখন মাথাটা তুলল রানা, পিস্তল বেরিয়ে এসেছে ওর হাতে।

বারো ফুট দূরে দেখতে পেল রানা লোকটাকে। পায়ে রাবার সোলের মোকাসিন, মুখটা ছুঁচোর মত লম্বাটে, উত্তেজনায় ফ্যাকাসে, চোখদুটো। জ্বলছে। ওর হাতে রানার দিকে মুখ করে ধরা রয়েছে পয়েন্ট থ্রী এইট পিস্তলের চেয়েও কয়েকগুণ ভয়ঙ্কর এক পিলে চমকানো হুইপেট। ডিবিবিএল টুয়েলভ বোর শটগানের ব্যারেল কেটে ফেলে দিয়ে তৈরি হয়েছে এই হুইপেট শটরেঞ্জের খুনোখুনিতে এর বাড়া আর কোন অস্ত্র নেই।

হাতে গুলি করবে, না বুকে, নাকি মাথায় চিন্তা করবার সময় পেল না। রানা। যখন এক সেকেন্ডের মধ্যে নির্ধারিত হয়ে যায় দুজন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে কে বাঁচবে আর কে মরবে, সেকেন্ডের দশভাগের একভাগ সময়ের মধ্যেই যে কোন দিকে চলে যেতে পারে জয় বা পরাজয়, সেই মুহূর্তটা মাথা খাটাবার মুহূর্ত নয়–প্রবৃত্তির তাড়নায় কাজ করে তখন মানুষ। দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রিগারে চাপ দিল রানা।

ছুঁচো মুখো লোকটার একটা চোখ অদৃশ্য হয়ে গেল। দ্বিতীয় গুলিটা ঢুকল দুই চোখের ঠিক মাঝখান দিয়ে। মুহূর্তের মধ্যে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করল ওর মুখটা ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসায়। মরা অবস্থাতেই এক পা পিছিয়ে গেল, তারপর যেমন নিঃশব্দে এগোচ্ছিল তেমনি কোন শব্দ না করে হুইপেটটা আঁকড়ে ধরে গড়িয়ে পড়ল মেঝের ওপর। খোলা দরজা দিয়ে পাশের ঘরের দিকে চাইল রানা। এর সঙ্গে আরও লোক আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। আক্রমণ না করা পর্যন্ত বোঝা যাবেও না। কাজেই দেরি করবার কোন অর্থ। হয় না। লক্ষ করল, কাঁপছে ওর সর্বশরীর।

সোজা হয়ে দাঁড়াল রানা, দ্রুতপায়ে চলে এল বাইবেলের ঘরে কেউ নেই। তার পাশের ঘরে তেমনি ঘুমিয়ে রয়েছে হেনরী, অন্যান্য কেবিন খালি-কেউ নেই। এক হ্যাঁচকা টানে কাঁধে তুলে নিল সে হেনরীকে। উঠতে শুরু করল ওপরে। পুলপিটের পেছনের সংজ্ঞাহীন দেহটা নামিয়ে দিয়ে আর। একবার সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা করল রানা গির্জাটা, তারপর বাইরে বেরোবার। দরজাটা সামান্য একটু ফাঁক করে পুরো একমিনিট চেয়ে রইল বাইরের দিকে। কাউকে দেখতে না পেয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।

তিন মিনিটের মধ্যে ট্যাক্সিটা নিয়ে এল সে গির্জার দোরগোড়ায়। ভিতরে। ঢুকে তুলে নিয়ে এল হেনরীকে, পিছনের সীটে বসিয়ে দিতেই ঢলে পড়ল ও গাড়ির মেঝেতে। চট করে চারটাপাশ দেখে নিয়ে আবার রানা ঢুকল গিয়ে গির্জার ভিতর।

মৃত লোকটার পকেট থেকে কিছুই পাওয়া গেল না। বাইবেলটা যথাস্থানে রেখে বামহাতে হুইপেটটা নিয়ে ডানহাতে কোটের কলার চেপে ধরল লাশটার, তারপর ছেড়ে টেনে নিয়ে এগোল দরজার দিকে। একটা। একটা করে বাতি নিভিয়ে, দরজা বন্ধ করে দিয়ে টেনে নিয়ে এল সে লাশটা। ওপরে, বাইরে বেরোবার দরজার মুখে। বাইরেটা আবার একবার ভাল করে। দেখে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

 যতটা সম্ভব ট্যাক্সির আড়ালে আড়ালে একেবারে খালের ধারে টেনে নিয়ে এল রানা লাশটা, তারপর আস্তে করে নামিয়ে দিল পানিতে, ঠিক যেমন করে নামাত ওই লোকটা রানার লাশ যদি আর একটা সেকেন্ড সময় পেত। হুইপেটটাও নামিয়ে দিল রানা খালের জলে, তারপর দ্রুতপায়ে চলে এল গাড়ির কাছে। গাড়ির দরজা খুলতে যাবে, এমনি সময়ে গির্জার ঠিক পাশের একটা বাড়িতে বাতি জ্বলে উঠল বাইরের দিকে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই খুলে গেল। সদর দরজা। দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল একজন লোক, অনিশ্চিত দৃষ্টিতে চাইল এদিক ওদিক, তারপর এগিয়ে এল ট্যাক্সির দিকে।

লম্বা-চওড়া এক লোক, চকমকে নাইট গাউন গায়ে জড়ানো, একমাথা এলোমেলো পাকা চুল, নাকের নিচে চওড়া একজোড়া পাকা গোঁফ, মুখের ভাবে প্রসন্ন বদান্যতার ছাপ।

 কোন সাহায্য দরকার? ঝনঝনে ভরাট গলায় জিজ্ঞেস করল লোকটা। কোন অসুবিধেয় পড়েছেন?

অসংখ্য ধন্যবাদ, বলল রানা। না, না। অসুবিধে কিসের? কোন অসুবিধে হচ্ছে না আমার।

গির্জার ভিতর থেকে কিসের যেন আওয়াজ শুনলাম মনে হলো?

 গির্জার ভিতর থেকে?

হ্যাঁ। আমার গির্জা। ওই যে। আঙুল তুলে গির্জার দিকে দেখাল। লোকটা। আমিই প্যাসটর। রজার। ডক্টর নিকোলাস রজার। আমি ভাবলাম। কোন গুণ্ডা বা ডাকাত ঢুকে পড়ল নাকি ভেতুরে।

আমি না, রেভারেন্স, বলল রানা। গত দশ বছর কোন চার্চের ভেতর। ঢুকিনি আমি।

সমঝদারের মত পাকা মাথা ঝাঁকাল লোকটা। ঈশ্বরবিহীন এক দুনিয়ায় বাস করি আমরা। যেন তাকে ছাড়াই চলে! যাই হোক, এত রাতে আপনি কি করছেন এখানে, ইয়ংম্যান? রাত একটু বেশি হয়ে গেছে না?

নাইট শিফটের ট্যাক্সি ড্রাইভারের জন্যে খুব একটা রাত কোথায়?

আর এই পাল্টা প্রশ্ন তেমন একটা সন্তুষ্ট করতে পারল না বৃদ্ধকে। কয়েক পা। সামনে এগিয়ে উঁকি দিল গাড়ির ভিতর। হেনরীকে মেঝের ওপর পড়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল ভয়ানকভাবে। মাই গড! গাড়ির ভেতর ডেডবডি!

হেসে উঠল রানা। দাঁড়াল প্যাসটরের মুখোমুখি। ওটা ডেডবডি নয়, রেভারেন্ড। মাতাল এক নাবিক, জাহাজে পৌঁছে দেয়ার জন্যে নিয়ে চলেছি। লোকটা সীট থেকে পড়ে যাওয়াতেই এইমাত্র গাড়ি থামিয়ে সীটে তুলে। বসাতে যাচ্ছিলাম আমি। আবার হাসল রানা। মরা হলে ওকে তুলে বসাবার প্রয়োজন হত না।

এই ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারল না বৃদ্ধ, দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বলল, আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখব।

রানাকে ঠেলে এগোবার চেষ্টা করল বৃদ্ধ, কিন্তু যেখানে ছিল সেখানেই। ঠেলে রেখে দিল ওকে রানা। কাতর মিনতির মত শোনাল ওর গলাটা। আপনি চাপাচাপি করলে আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সটা খোয়া যাবে, রেভারেন্ড। প্লীজ!  

আমি জানতাম! আমি জানতাম! মস্ত কিছু গোলমাল রয়েছে কোথাও। আন্দাজ করতে পেরেছিলাম আমি। স্বীকার করছেন যে, আমি চাপাচাপি। করলে আপনার লাইসেন্স খোয়া যাবে?

 হ্যাঁ। চাপাচাপি করলে আপনাকে খালের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলতে হবে আমার, ফলে ক্যানসেল হয়ে যাবে লাইসেন্সটা। অবশ্য, মুচকি হাসল রানা, যদি সাঁতরে পাড়ে উঠতে পারেন, তবেই।

কি বললেন? খালে ফেললেন? আমাকে? একজন প্যাসটরকে! আপনি দৈহিক হামলার হুমকি দিচ্ছেন আমাকে, স্যার?

হ্যাঁ।

 দ্রুত কয়েক পা পিছিয়ে গেল, ডক্টর রজার। সেখান থেকে বলল, আপনার লাইসেন্স প্লেটের নাম্বার আমার মনে থাকবে, স্যার। কাল সকালেই আমি…

রাত বেড়ে চলেছে। আর কথা না বাড়িয়ে ড্রাইভিং সীটে উঠে গাড়ি। ছেড়ে দিল রানা। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে প্রবল বেগে হাত নাড়াচ্ছে লোকটা মুঠি পাকিয়ে, বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের কোন লক্ষণ নেই ওর ভাবভঙ্গিতে।

হেনরীকে কাঁধে নিয়ে আবার তেতলায় উঠে এল রানা সরু সিঁড়ি বেয়ে। অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় তালা নেই। লাইট জ্বেলে দেখা গেল বেঘোরে। ঘুমোচ্ছে বিট্রিক্স সোফার ওপর। হেনরীকে নিয়ে পাশের ঘরে যাওয়ার সময় ছায়া পড়ল ওর চোখে, চট করে চোখ মেলে চাইল, তারপর উঠে বসল বিট্রিক্স। পাশের ঘরের বিছানায় কঙ্কালসার দেহটা নামিয়ে দিয়ে ফিরে এল, রানা বসবার ঘরে। কোন কথা না বলে চেয়ে রইল চোখ ডলতে থাকা বিট্রিক্সের দিকে।

কখন বেরিয়ে গেছে টের পাইনি, বলল মেয়েটা অনেকটা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে। রানা যখন কোন কথা বলল না, তখন আবার বলল, সত্যিই টের পাইনি আমি। কোথায় পেলেন ওকে?

তুমি কল্পনা করতে পারবে না কোথায় পেয়েছি। হুমড়ি খেয়ে পড়ে ছিল একটা ব্যারেল অর্গানের ওপর।

কিন্তু এত রাতে তো…

ব্যারেল অর্গানের সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়। মাথা ঝাঁকাল রানা। বুড়ো ছিল না। তালা ভাঙার চেষ্টা করছিল ও।

মাথা নিচু করে বসে রইল বিট্রিক্স। আবার কান্নার সেশন শুরু না হয়, সেই ভয়ে চট করে জিজ্ঞেস করল রানা, এর মধ্যে মাথা নিচু করবার কি আছে? আমি ভাবছি, ব্যারেল অর্গানের প্রতি ওর এত ইন্টারেস্ট কেন.। অদ্ভুত ব্যাপার। গানবাজনা খুব পছন্দ করে বুঝি?

না। হ্যাঁ। সেই ছোটবেলা থেকেই গানবাজনা…

হয়েছে। আর গুলপট্টি মারতে হবে না। কঠোর কণ্ঠে বলল রানা। গানবাজনার ভক্ত হলে ওই বেসুরো ব্যারেল অর্গানের বাজনা না শুনে বরং সেলাই মেশিনের আওয়াজই ওর বেশি পছন্দ করবার কথা। খুবই সহজ একটা কারণ রয়েছে ওর ব্যারেল অর্গানের কাছে যাওয়ার। খুবই সহজ। কারণটা তুমিও জানো, আমিও জানি।

 বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল বিট্রিক্স রানার চোখের দিকে। ভীতি দেখতে। পেল রানা ওর চোখে। বসে পড়ল সে সোফায়।

বিট্রিক্স?

 বলুন?

মিথ্যাভাষণে আমার চেয়ে কোন অংশে কম যাও না তুমি। হেনরীকে খুঁজতে যাওনি তুমি, তার কারণ তোমার ভাল করেই জানা ছিল কোথায় গেছে। ও, ভাল করেই জানা আছে কোথা থেকে ধরে এনেছি আমি ওকে। এমন এক জায়গা, যেখানে অত্যন্ত নিরাপদেই থাকবে ও, এমন এক জায়গা, যেখানে ধরা। পড়বে না ও পুলিসের হাতে; এমনই সম্মানিত জায়গা, যে কেউ কোনদিন ভাবতেই পারবে না ওখানে খুজবার কথা। লম্বা এক শ্বাস ফেলল রানা। থোয়াতে সুইয়ের মজা নেই, কিন্তু নাই-মামার চেয়ে কানা-মামা ভাল।

 একেবারে ছাইবর্ণ ধারণ করল বিট্রিক্সের মুখ। ভয় পেয়েছে মেয়েটা এবার। রানা লক্ষ করল থরথর করে কাঁপছে ওর হাত।

কাকে ভয় পাচ্ছ, বিট্রিক্স? ওদের, না আমাকে?

আপনাকে। এতদিন ঠিকই ছিলাম, আপনি

আমি এসেই গোলমাল শুরু করে দিয়েছি। তাই না? কিন্তু একটু ভাল করে ভেবে উত্তর দাও দেখি তোমার কি মনে হয়, কেন আমি তোমার ঘরে আবার ফিরে এসেছি আজ? তোমার ক্ষতি করবার জন্যে? বুঝতে পারছ না, সেটা করতে চাইলে এখানে আসবার কোন প্রয়োজনই ছিল না আমার? তোমার প্রেমে যে পড়িনি সেটা বুঝবার ক্ষমতা তোমার আছে। র‍্যাকমেইলড হচ্ছ, এই ধারণাটা যদি আমার মনে না আসত তাহলে নিজের ঘুম নষ্ট করে তোমার কাছে ছুটে আসতাম না। আমি তোমাকে শুধু একটা কথাই বলতে চাই নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মারছ তুমি। এখনও সময় আছে। ইচ্ছে করলে দিক পরিবর্তন করতে পারো। পরে আর সময় থাকবে না।

ভুল বলছেন। চোখ তুলল বিট্রিক্স। কোন উপায় নেই আমার। শেষ হয়ে গেছি আমি।

মাথা নাড়ল রানা।

হেনরীর কথা যদি বলো, আমি স্বীকার করব, হ্যাঁ, ওর জন্যে কোন রাস্তা খোলা নেই আর। কিন্তু তোমার জন্যে একটা রাস্তা খোলা আছে। একটাই মাত্র রাস্তা। আমার সঙ্গে সহযোগিতা করা। তুমি আমাকে সাহায্য করলে আমি সাহায্য করব তোমাকে।

কিভাবে কি সাহায্য করবেন আপনি আমাকে?

প্রথমত, হেনরীর জীবনটা যারা শেষ করে দিয়েছে, তাদের শেষ করে দিয়ে। তোমার জীবনটা যারা বিষময় করে তুলেছে, তাদের শেষ করে দিয়ে। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে পুলিসের সমস্ত ঝামেলা থেকে তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে। কিন্তু আমার সাহায্য দরকার। পৃথিবীর প্রত্যেকেরই দরকার একে অপরের সাহায্য। আমাকে যদি সাহায্য করো, আমি তোমাকে সাহায্য করব যদি কসম খেতে বলো, খেতে পারি। আমার কথায় নিশ্চয়ই টের পেয়েছ, ওদের দিন শেষ হয়ে এসেছে? কি, সাহায্য করবে আমাকে?

দুশ্চিন্তা, হতাশা, ভয়-নানান রকম ভাবের খেলা খেলে গেল বিট্রিক্সের। মুখের ওপর দিয়ে। দুমিনিট চুপচাপ বসে থেকে তিনবার মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল সে। সঙ্গে সঙ্গেই পকেট থেকে পয়েন্ট টু ওয়ান বোরের ছোট্ট একটা। পিস্তল বের করে দিল রানা ওর হাতে।

এটা রেখে দাও। কাজে লাগতে পারে। প্রয়োজন হলেই ব্যবহার করতে দ্বিধা কোরো না।

 ঠিক তিন মিনিট পর বেরিয়ে এল রানা অ্যাপার্টমেন্ট হাউজ থেকে। রাস্তার অপর পারে একটা সিঁড়ির ওপর বসে গভীর তত্ত্বালোচনায় মত্ত রয়েছে দুই মাতাল, তর্ক করছে ফিসফিস কণ্ঠে। পিস্তল ধরা হাতটা কোটের পকেটে; পুরে দ্রুতপায়ে এগোল রানা বিশ গজ দূরে পার্ক করে রাখা ট্যাক্সির দিকে। ক্লান্তিতে ঘুম আসছে ওর দুচোখ ভেঙে। বেলা নটার বেশি ঘুমানো যাবে না, দশটার সময় কর্নেল ডি গোল্ডের সঙ্গে সার্চ করতে যাওয়ার কথা ওর ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে।

ভোঁ করে ছেড়ে দিল রানা ট্যাক্সি। দেখতে পেল না, ট্যাক্সিটা রওনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়িয়েছে মাতাল দুজন–মাতলামির লেশমাত্র নেই ওদের চেহারায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *