১১. সাজারের উৎসব

সাজার গেল, সাজারের উৎসব গেল। রসিকের সঙ্গে একদিন ভাব হয়েও গেল। বড় দুঃখী মানুষ সে, ঘরের বউ তার ব্ৰজেন ঠাকুরমশাইয়ের কাছে থাকে। তাই তার খাটো প্ৰাণটা জ্বলে অষ্টপ্রহর।

সয়ারাম খুব শহর দেখছে। কার্তিকের টানের জলে মাছমারার ইচ্ছে নেই তার একটুও।

বিলাস চাকুন্দে-মাকুন্দে ধরল। সময় এল, আর সময় নেই।

এত দিন অগ্নিকোণের মেঘ গেছে। এবার ঈশানে বিদ্যুৎ চমকায় থেকে থেকে। কৃষ্ণপক্ষে জলে বড় বেশি টান দেখা যায়। টানের মরশুম যাচ্ছে।

চলে যাবার আগের দিন, হিমি বলল, চলো, একটু শ্যামনগরের বেহ্মময়ীকে দর্শন করে আসি।

সয়ারাম শহরে গেছে। বিলাস নৌক ভাসিয়ে নিয়ে গেল হিমিকে।

শিবমন্দির, নাটমন্দির, বাগান, রাজবাড়ি সব দেখল দুজনে। বিলাস ঘণ্টা বাজালে।

সন্ধ্যার ঘোরে দু-জনে নৌকায় উঠল। আবার। চার মাইল পথ। তখন জোয়ার এসে গেছে। বাতাস নেই একটুও। নৌকা মাঝগঙ্গায়।

মাইলখানেক আসতে না আসতে হঠাৎ বাতাস উঠল। হাল ধরে বসে ছিল বিলাস। পায়ের কাছে হিমি। দুটিতে নিজেদের চেয়ে দেখতেই মগ্ন।

বিলাস বলল, আরো সব্বোনাশ, ঈশেনে রাক্ষুসে। মেঘ হয়েছে। কেতেনের ঝড় না আসে।

বলতে বলতেই বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে উঠল, কক্কড় করে বাজ পড়ল কোথায়। ঝড় শুরু হয়ে গেল। আশেপাশে নৌকা নেই একটিও। অন্ধকারও ঘনিয়ে এসেছে। গঙ্গা ডাকিনীর মতো খলখলিয়ে উঠল। বৃষ্টি এল বড় বড় ফোঁটায়।

আওড়-ঘূর্ণিগুলির হিসাব কষে বিলাস, কোথায় কোথায় আছে।

গলা চড়িয়ে বলল, মহারানি, কেতেনের ঝড় এয়েছে। ছাঁইয়ের মধ্যে যাও। নইলে ভিজে যাবে।

চড়া বাতাসে নৌকা টাল খেয়ে গেল। সামনের গলুয়ে জল উঠল চলকে।

হিমি দু-হাতে বিলাসের পা আকড়ে ধরল। বলল, ছাঁইয়ের মধ্যে একলা থাকতে পারব না গো ঢাপ।

–তবে জোরে ধরে রাখে আমাকে।

প্ৰাণপণ শক্তিতে চেপে ধরল। হিমি বিলাসকে। বিলাস তার চেয়েও বেশি শক্তিতে হাল চেপে ধরল। জলের তোড় যায় এক দিকে, বাতাস গোঁ গোঁ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে উলটো দিক থেকে। নৌকা আকাশে ওঠে, পাতালে নামে। বৃষ্টির ঝাপটায় ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে সব। বিলাস নৌকা ঘুরিয়ে দিল বাতাসের টানের দিকে। পুব পাড়ে ভিড়ে পড়ার চেষ্টা। কিন্তু নৌকা যেন উড়িয়ে নিয়ে চলল।

হিমি ডাকল, ঢাপ।

বিলাস শুনতে পেল না।

কাঁড়ারে জল উঠল বগাবগ করে। হিমিকে একেবারে ধুয়ে দিল। আবার উঁচু হল কাঁড়ার।

বিলাস চিৎকার করে বলল, মহারানি, কেতেন বড় রাগি। খাবলা মারতে চায়। আমাকে ছেড়ো না।

প্রায় নখ বসিয়ে আঁকড়ে ধরেছে হিমি বিলাসকে। কেতেনের ঝড় বুঝি তাকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। বুকের থেকে কী উঠে আসছে বমি না কান্না? বিলাসের পায়ে মুখ চাপে সে।

কেতেন ঝড় তার মরণের কেতন উড়িয়ে এসেছে। দিগদিগন্ত অন্ধকার। জল ক্রমশই ফুলছে। বিলাসের মনে হল, হাল যেন মড়মড় করে। হ্যাঁ, কেতেন পেয়ে গঙ্গা যেন আরও রুদ্রাণী। রাজাকে ফতুর করে যে সে।–

আবার আছড় খেল নৌকা। যেন কোন দানোয় কাঁড়ার চেপে ধরেছে জলে। আবার জল উঠল কলকল করে। বুক কপিল বিলাসের। বাছাড়ি ড়ুববে না, কিন্তু উলটে যাবে নাকি? মনে হল, মহারানির একটি হাত যেন খসে গেল।

—মহারানি!

–হ্যাঁ।

–কেন? কেন গো?

—হাত খুলে গেছে নাকি তোমার?

–হ্যাঁ।

–কেন? কেন গো?

—হাতে শক্তি নেই আর।

—মনে শক্তি ধরে মহারানি, আমি আছি।

সাহস পেয়েছে বিলাস। কী যেন দেখা যায় সামনে কালোমতো। ভাবতে না ভাবতেই বিদ্যুৎ চমকাল। বিলাস দেখল ডাঙা। এত জোরে ধাক্কা লাগলে গলুই খানখান হয়ে যাবে।

হালে চাপ দিয়ে নৌকা ফেরাল বিলাস। পাথালি নৌকা বেশ জোরেই ঠেকাল পাড়ে। পাড়ে ঢেউ আছাড় খাচ্ছে। নৌকা টালমাটাল করে।

বিলাস দু-হাতে টেনে তুলল হিমিকে। বলল, শিগগির এসো, হামা দে যাও ছাঁইয়ের তলা দে।

হিমি হামা দিয়ে ওপারে গিয়ে উঠল। বিলাস ততক্ষণ ডাঙায় নেমে ধরেছে নৌকার কাছি। হিমি টলমল করে কোনও রকমে এসে জাপটে ধরল। বিলাসকে।

বিলাস বলল, নোঙর করলে এখন ছিড়ে বেইরে যাবে লৌকো। মহারানি, ওই গাছ দেখা যায়, তুমি গাছতলায় যাও।

হিমি কাঁপছে থরথরিয়ে। গলাও কাঁপে। বলল, না। এখানেই তোমার কাছে থাকব।

বাছাড়ি নৌকা যেন বড়শিতে গাঁথা মাছ। ছিটকে টেনে চলে যেতে চায়।

আস্তে আস্তে ঝড় কমল। বৃষ্টি ধরে এল। হিমিকে নিয়ে বিলাস নৌকায় উঠল। অনেকখানি সামলে উঠেছে হিমি।

নৌকায় উঠে বলল, বাবা গো, ঝড় নয়, যেন রাক্ষস। আর আসবে না তো?

–না। ভয় পেয়েছিলে খুব, না?

হিমি বলল, কোনও দিন তো পড়িনি এমন ঝড়ে। তোমার ভয় লাগেনি?

—বড় ভয় লেগেছিল। মহারানি আছে আমার সঙ্গে যে?

হিমি দু-হাত দিয়ে ধরে রইল বিলাসকে।

সমুদ্রের ডাক পড়েছে। কেতেনের ঝড় গেল। চাকুন্দে-মাকুন্দে গেল। টানের জলে সমুদ্রের বাতা পুরোপুরি এসে গেছে।

বিলাস তৈরি হল।

যাত্রা হল রাত্রে। রাত্রি এগারোটায় ভাটা। ভোরবেলা গিয়ে পৌঁছুবে বাগবাজারের খালে।

দামিনী এত দিন মদ খেয়েছে। আজ হিমিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল, রাক্ষুসী, কী তোর মন লো। সত্যি মায়া কাটালি?

হিমিও দিদিমার বুকে পড়ে কাঁদল অনেকক্ষণ। আতর এল। দুলাল এল। আরও দু-চার জন। পাড়ায় ঘরে কথা অনেক দিন হয়েছে। আজ আর হাঁকডাক ফিসফিসানি নেই।

তা ছাড়া এ পাড়ায় এ সব নিয়ে বড় রকমের আন্দোলন কখনও হয় না। এ পাড়া থেকে এমন অনেক মেয়ে গেছে, কত নতুন মেয়ে এসেছে। কখনও ফেরত এসেছে। পুরনো মেয়েরাও। চলতি সমাজজীবনের বন্ধন এদের সমাজে নেই। কিন্তু সমাজ একটা আছে। কতকগুলি রীতি আছে, নীতি আছে। সেগুলিকে সবাইকে মেনে চলতে হয়।

দামিনীর স্বামী অল্প বয়সে মারা গেছে। তারপরেও তার যৌবন ছিল। পিরিত হয়েছে, ঘর করেছে আর-এক জনের। কেঁদোছে হোসেছে, সে যদি চলে গেছে, আর একজনও হয়তো এসেছে। এমনি করে স্বাধীন হয়েছে। যৌবন থাকতে যেন এখানে বৈধব্য নেই। তা বলে ভালবাসা নেই, এ কথা বলা যাবে না। নইলে কাঁদতে হবে কেন?

এখানে কেউ গৃহস্থ, কেউ দেহ ও জীবিকা দুই-ই রেখেছে। কেউ কেউ মাছ বেচছে। পুজো পার্বণ, আটকৌড়ে বিয়ে শ্রাদ্ধ, সবই হয় এখানে।

তবু মেয়ে-পুরুষে কাজ করে, পয়সা থাকলে ব্যবসা করে, না থাকলে, কলে-কারখানায় কাজ করে বাঁচতে হয়। জীবিকা আছে সকলের। স্বামী-স্ত্রীরও। শুধু ঘরের বউ হয়ে, ছেলে বিইয়ে, স্বামীসেবায় মেয়েমানুষ এখানে স্বর্গে যেতে পারে না।

তাই এদের দেখে বড় উচ্ছঙ্খল। লাগে। মনে হয়, সংসারের ওপরতলার পিদিমটার নীচেই সেই ঘোর ঘন অন্ধকার বুঝি এইখানেই।

মানুষ এখানে প্রাণের দায়ে ছোটে যত্রতত্র। পিরিত এখানে জীবনেরই রীতি। কখনও ঘরে না রইতে দেয়, অনলেই পোড়ে কখনও। রং লেগে গেলে তাকে ঢাকতে পারে না, চাপতে যাওয়ার সূক্ষ্ম মুনশিয়ানা অনায়ত্ত এদের। সে জন্য পিরিতের রাশিটা সোনার শিকল নয়, লোহার শিকলও নয়, নেহাতই প্রাণের তন্তুতে পাক খাওয়া সূত্র। মনে না মানলে, মিথ্যা আর লুকোচুরি নেই, তাই হাসেও চেঁচিয়ে, অভিশাপও দেয় সরবে। বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, সবটাই বড় দুরন্ত, ভয়াবহ উচ্ছঙ্খল ও আদিম।

অসত্যকে নিরন্তর আঘাত করে বলেই এদের দেখায় বড় শ্ৰীহীন ভাঙাচোরা। সাধুর বেশে চোর নেই। এদের, বলে অমুক সিঁদেল চোর। দায়ে পড়ে তাকেই টাটে বসাতে হয় না। দীনের কোনও ভান নেই, বলে, বাইরে কোঁচার পত্তন, ভেতরে ছুচোর কোত্তন। পেটে ভাত নেই, ইয়েতে ইয়ে। গোপন করতে জানে না বলেই না গোপন-পটুরা হাসে ওদের দেখে? বুঝি হিংসাও করে।

হিমি একদিন গিয়েছিল একজনের সঙ্গে মনের মানুষ ভেবে। সে ঠকিয়েছে, পালিয়ে এসেছে মেয়ে।

আজ বিলাস তাকে অকুলে টেনেছে। মনে তার অনেক ভয়। তবু ভাসছে।

সয়ারাম চেঁচিয়ে হাঁক দিল, ভাটা পড়েছে রে বিলেস।

দিদিমা-নাতিনে কাঁদতে কাঁদতে এল ঘাটে।

হিমি আজ জামা গায়ে দিয়েছে। নীলাম্বরী পরেছে, মাথায় দিয়েছে ঘোমটা।

আতর-দুলালের কাছ থেকে বিদায় নিল বিলাস আর হিমি।

দামিনীর বুকে মুখ রেখে বলল হিমি, কাঁদিসনে দি-মা, আবার আসব, ঘুরে দেখে যাব তোকে।

নৌকায় উঠল হিমি। বিলাস কাঁড়ারে বসল হাল নিয়ে। হিমি তখনও গলুয়ে দাঁড়িয়ে। নৌকা দক্ষিণের টানে গেল ভেসে।

আকাশ বেশ পরিষ্কার। কৃষ্ণপক্ষের মুখপাত বলা যায়। চাঁদ উঠেছে সামান্য কানা ক্ষয়া। কৃষ্ণপক্ষ বলেই জলের টান বেশি। একড়ি টান জলে। দাঁড়ে বসেছে। সয়ারাম।

কাঁড়ারের ছাঁইয়ের মুখছাটের কাছে বসেছে হিমি। বিলাস দেখছে চোখের জল শুকিয়ে গেল বাতাসে। হিমিও বিলাসকে দেখছে।

বিলাস বলল সয়ারামকে, সয়া, জোয়ারের আগে বাগবাজারের খালের মোড় ধরা যাবে রে?

সয়ারাম বলল, টান ভালই, যেতেও পারে।

মনে মনে বলল, বড় তাড়া লেগেছে বন্ধুর, আর তার সয় না।

হিমি এগিয়ে গিয়ে বসল বিলাসের পায়ের কাছে। বিলাস বসেছে হাল ধরে। হিমি তার হাঁটুতে থুতনি চেপে, মুখের দিকে তাকাল।

বিলাস বলল, কী বলছি মহারানি?

–তোমার মা কেমন?

—বাড়ি গে। দেখ।

–তোমার মা আমাকে নেবে তো?

বিলাসের চোখ ছলছল করে উঠল। বলল, মহারানি, আমার মায়ের বড় বিলাস-অন্ত পাণ, তোমাকে সে ফেরাতে পারে? তা ছাড়া খুড়ো আমাকে বলে গেছে। বলেছে, তাকে তুই নিস।

-সত্যি।

–হ্যাঁ। হিমি সারা দেহ চেপে রইল বিলাসের বলিষ্ঠ দুটি জঙ্ঘায়। বিলাস যেন আদিম মানব। চিৎকার করে গান ধরল–

সজনী আমারে না ডাক পিছে
আমারে ডাক দিয়েছে
মহাসাগরে।।…

বুক চেপে আছে হিমি বিলাসের পায়ে। দু-চোখ ভরে দেখছে কালো কুচকুচে রূপ। বিলাস জামা খুলে ফেলেছে। চাঁদের আলো পিছলে পড়েছে। সারা গায়ে। হিমি আরও ঘন হয়ে এল বিলাসের।

বিলাস বলল, মহারানি, ঝড়ের ভয় করে নাকি?

হিমি মুখ লুকিয়ে বলল, হ্যাঁ গো!

বিলাস হা হা করে হেসে আবার গান গেয়ে উঠল,

ওরে উত্তুরে বাতাস বয় রে
কী ভয় তোর ঝুটো ডাকাবুকো রে,
পানসা জালের সাঁই ডেকেছে। সাগরে।।

হিমি বলল, তুমি সমুদ্রে যাবে কবে?

—তোমাকে বাড়িতে রেখে, ধর্মসাক্ষী করে কঠিখানি বাঁধব তোমার গলায়। তাপর অগানের মুখপাতেই যাব।

বলে হিমির জ্যোৎস্না-ধোয়া মুখখানি তুলে তার সুবাসিত নিশ্বাসের গন্ধ নিল বিলাস। তারপরে বলল, মহারানি, আমার পায়ে য্যানো তোমার বুকখানি বড় ধুকুস ধুকুস করে?

—করে।

-কেন গো?

–তোমাকে যে বড় ভয় করে।

বিলাস হেসে উঠল। মাতাল হয়ে গেছে সে। আবার গান ধরল,

ও তোর কোনও ভাবনা পিছে নাই রে
তোরে ডাক দিয়েছে সাগরে।

একে একে চেনা জায়গা সব পার হয়ে গেল। সয়ারাম ঘুমিয়ে পড়েছে গলুয়ের কাছে। হিমিও বুঝি নিঝুম হয়ে ঘুমোয় বিলাসের কোলে।

তারপরে চাঁদ ঢলে গেল। পুবে আকাশে দেখা দিল রং। পাখিপাখালি ডাকাডাকি শুরু করল। ডাঙার গাছে গাছে। নৌকা এসে লাগল বাগবাজারের খালের মোড়ে।

হিমি মুখ তুলল।

—ঘুমোওনি মহারানি?

হিমি বলল, না।

ওই দেখা যায় খাল। শহরের ভিতর দিয়ে চলে গেছে দূর দূরান্তে।

হিমি তার টিনের বাকসোখানি খুলল। জামা-কাপড় বের করে গায়ের গহনা সব খুলল একটি একটি করে। খুলে বাকসে ভরল।

ভাটার টানে নৌকা খালে ঢোকানো যাবে না। জোয়ারের অপেক্ষায় নোঙর করে, কাছে এসে বলল বিলাস, এ কী হল মহারানি?

হিমি মাথা নিচু করেই বলল, এ সব রইল। ট্যাকা-পয়সা, সোনা-গয়না। তুমি রাখো।

-আর তুমি?

নীলাম্বুধি বিশাল বিলাসের পায়ে পড়ে ফুঁপিয়ে উঠল হিমি, ওগো ঢাপ, আমি যেতে পারব না তোমার সঙ্গে।

সমুদ্রে যেন আবর্ত উঠল। —কেন গো মহারানি?

পায়ে মাথা ঠুকে ঠুকে বলল হিমি, সাহস পাইনে ঢাপ। আমি এতটুকু প্ৰাণী, তোমার অকুলে আমি বেড় পাব না। এই আমার বড় মন-চনমনানি ছিল। তুমি যাবে অকুল সমুদ্রে, আঁধার রাত্রে আমার পাণ পুড়বে, তোমার নাগাল তো আমি পাব না।

বিলাস শান্তভাবেই বলল, আমি মাছমারা মহারানি, অকুলে আমার জীবন, অকুলে আমার মরণ।

হিমির চুল খুলে গেল, কাজল ধুয়ে গেল চোখের। রুদ্ধ কান্নায় বলল, পারব না পারব না গো। আমি এতটুকু, এত বড়কে পাওয়ার ভাগ্যি আমি করিনি।

কলকাতা শহর জাগছে। স্টিমার চলেছে, গাধাবোট টানছে, বয়া ভাসছে। একটি দুটি লোক চলে পোস্তা-বাঁধানো রাস্তার উপরে।

বিলাস অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর একটু হেসে হিমির মুখখানি তুলে ধরল। বলল, কেঁদো না মহারানি।

-আর মহারানি বোলো না ঢপ।

—তা বলব, তুমি যে সত্যি মহারানি। বুঝলুম, এই উচিত হয়েছে। কিন্তু এই বাকসোখানি নে যাও মহারানি।

হিমি বলল পায়ে পড়ি, নিয়ে যাও।

—না গো, না। আমি মাছমারা, এ সব আমার থাকতে নেই। এই তেঁতলে বিলাসকে তুমি যা দিয়েছ, তা আর কেউ কাড়তে পারবে না। সে যে মহারানির দান গো, মহারানির দান। আমার পাণ জুড়িয়েছ তুমি, জুড়িয়েছ বলেই আমি সমুদ্রে যাব।

জীবনের ও মনের বিচিত্র বিড়ম্বনার অপমানে ও বিরহের ভরে। ডাঙায় নেমে এল হিমি। সয়ারাম ঘুম ভেঙে ব্যাপার দেখে তাকিয়ে ছিল হাঁ করে।

বিলাস বলল, যাবে কেমন করে?

হিমির গলা ভরা। চুপিচুপি বলল, হাওড়া ইস্টিশানে যেতে পারব। আমার চেনা রাস্তা শহর।

বিলাস আবার বলল, কেঁদো না মহারানি। তুমি রাস্তায় গে ওঠে।

হিমি জড়িয়ে ধরল। বিলাসকে দু-হাতে। —ঢপ, আর কিছু বলবে না?

বিলাস বলল, শান্তনু রাজার কথা মনে পড়ে মহারানি। মনে হয়, রাজার দুঃখু কাটাবার উপায় ছেল না।

আরও কঠিন পাশে জড়িয়ে ধরল। হিমি, ঢপ, তুমি থাকতে পারো না?

—ও কথা বোলো না গো। পারলে তোমাকে কে ছাড়তে পারে। তবে মহারানি, মনে দুঃখু রেখো না; কেন না, এইটি সত্য বলে ঠাহর পেলুম, তুমি আমাকে অনেক দিলে। তোমাকে ছেড়ে যাবার সাহসও দিলে। যাই, এ জোয়ার ছাড়তে পারব না। সমুদ্রের কালো জল নেমে যায়। হিমি হাত ধরল। বিলাসের। বলল, ঢাপ, আর একটি কথা বলে যাও।

—কী বলব?

—যা খুশি তোমার।

হিমির দিকে তাকিয়ে বিলাসের বুকে ঘূর্ণি লেগে গেল। দেখল, মহারানি তার প্রাণের শেষ সর্বনাশ করেই আছে। অকুলে সে যেতে পারল না। কিন্তু কুলে বাঁচাও তার দায়। ভালবেসে প্ৰাণে তার আগুন লেগে গেছে। কিছু না বলে কেমন করে যায় বিলাস।

ফিরে এসে বলল, মহারানি, জোয়ারের আগনায় আসব তোমার কাছে, চলন্তায় যাব অকুলে। তখন যেন তোমার দেখা পাই।

বিলাস নেমে গেল। হিমি ফিসফিস করে বলতে লাগল, তাই তাই তাই গো। তাই থাকব আমি, তোমার যাওয়া-আসার পথে পথ চেয়ে বসে থাকব।

সয়ারাম বলল, আ বিলেস।

–বল।

—বলব বা কী। বলি, বিলেস, আবার তোর বুক উথালি পাথালি করবে।

—করুক। সোমসারে সকলেরই করে। সয়া, তুই নোঙর তুলে নে।

সয়ারাম নোঙর তুলে নিল। বিলাস শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ফালিবাঁশের পাটাতনের উপর। মাছমারার প্রাণ, বড় শক্ত প্ৰাণ।।

ওই দেখা যায়, ঘোমটা-খাসা হিমি, মহারানি, দাঁড়িয়ে আছে এখনও।

নৌকা ঢুকে গেল খালে জোয়ারের টানে।

 

বেতনা নদীতে, কালীনগরের গঞ্জের ভেড়িতে শাবর করেছে আঠারো গণ্ডা নৌকা। মাছমারাদের নৌকা, সাঁই নিয়ে সমুদ্রে যায় তারা। অগ্রহায়ণ পড়ে গেছে। উত্তরে বাতাস বয়। পালে হাওয়া লেগে গেছে, ডাক দিয়েছে সমুদ্র। ঢেউ লেগেছে রাইমঙ্গল আর ঝিল্লের মোহনায়। কালীনগর গঞ্জ থেকে চাল ডাল নুন তেল জোগাড়যন্ত্র হয়েছে। সাইদারের অপেক্ষা।

—সাঁইদার কে?

—বিলোস। তেঁতলে বিলেস।

তেঁতলে বিলেস সমুদ্রে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *