০৯. শ্রাবণ্যে টোটা

শ্রাবণ্যে টোটা খলখল করে বেড়াচ্ছে গঙ্গায়। অনেক মাছমারা পালিয়েছে। আরও পালাচ্ছে প্ৰায় রোজই। যাদের উপায় নেই রয়েছে তারা। পালমশাই ধরে রাখতে পারছে না। মুখ খারাপ করে, গালাগালি দিয়ে বেড়াচ্ছে। ফিরে গিয়ে নাকি নালিশ করবে। ভয় দেখাচ্ছে নিলাম ক্রোকের।

এ তল্লাটের মৎস্যজীবীদের পাড়ায়, বাচ্চা বুড়োরা বেরিয়ে পড়েছে। শহরের রাস্তায়। ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে। পাশের বাড়ির ফ্যান চেয়ে খাচ্ছে। ঘটিবাটি গেছে বন্ধক।

 

পশ্চিম পারের মাছমারাদের সভা বসে গেছে। দল বেঁধে গেছে। সবাই সরকারের প্রতিনিধির কাছে। প্রতিনিধি অনেক। ইনি বলেন, অমুকের কাছে যাও। অমুকে বলেন, আমি নয়, মন্ত্রীর কাছে যাও।

ছুটোছুটি করে মরছে। সবাই। পাঁচুরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে। তারা দূরের মানুষ, এখানে অচেনা। যা করে মহাজন।

পূব পারের জেলেপাড়ার মাছমারারাও হাঁটাহাটি শুরু করেছে। জাগ্ৰত মরণ-দেবতা হানা দিয়েছে ঘরে ঘরে। তার ভয়ংকর সংহার-মূর্তি এক মাসের মারেই সব কিছু ভেঙে ফেলতে চাইছে। বাপ-ছেলেয় মারামারি করছে, বউ-সোয়ামি ছাড়াছড়ি করছে। এই না মাছমারার জীবন। এক কোটালে বাঁচে, আর-এক কোটালে মরে। মাছের প্রাণের চেয়েও তার আয়ু টলমল।

ঘা যখন হয়, তখন তাড়াতাড়ি হয়। দেখতে দেখতে দগদগিয়ে ওঠে। সময় লাগে শুকোতে। এখন কারুর শুকোবার ভাবনা নেই। জ্বালা জুড়োয় কেমন করে, সেই ভাবনা।

তবু রেষারেষি করে এ পার ও পার। কে পাবে আগে সরকারের সাহায্য, তারই রেষারেষি। বাঁচার জ্বালা এমনি, তখন অপরকে মারতে দ্বিধা নেই।

তবু গঙ্গা ফুলছে, রণরঙ্গিণী হয়ে, ভারী গোনের মুখে আসছে উত্তাল বান নিয়ে। আন্-মাছমারারা দলে দলে আসে সেই বান দেখতে। কোম্পানি নাকি নোটিশও দিয়েছে, গঙ্গার গতিক বড় সুবিধার মনে হয় না। উত্তরের বন্যা, দক্ষিণেও সমুদ্র একটু বেশি ফুসছে। দুলালের কথা মনে পড়ে, এনার হিন্দয়খনি বড় আকুলান হয়ে পড়েছে, কাটিয়ে গহিন না করলে আর চলছে না।

তাই জল আরও উঁচুতে উঠছে। রক্তগঙ্গা তার রক্তাক্ত দাগ মেরে আসছে যত দূর পারে।

আকাশ বাতাস জল, সব ঠিক আছে। শুধু যার প্রত্যাশা, সে আসে না। জলে কনকননি। হিমালয়ের রুদ্র দেবতা প্ৰসন্ন না হলে, দক্ষিণের রুদ্রাণীরও প্ৰাণ শান্ত হয় না।

তারপর এল সরকারের সাহায্য। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এল, কিন্তু এক পারে। পশ্চিম পারের চল্লিশ ঘর শুকনো ডোল পেল সরকারের কাছ থেকে। চাল, গম, আর কিছু ডাল। তারও আবার ফ্যাসাদ আছে। নাম রেজিস্ট্রি করো, পরিচয় প্ৰমাণ-পত্র নিয়ে এসো, তারপর পাঁচ মাইল ঠেঙিয়ে যাও ইউনিয়ন বোর্ডের এলাকায়। মিউনিসিপালিটির তল্লাটে সরকারের রিলিফ এখন আইনে অচল।

ছেলে-বুড়ো তাই যাচ্ছে ছুটে ছুটে। তবু তো পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু পুব পাের একেবারে নিঃসাড়। সন্ধ্যার পরে আর বাতিটিও জ্বলে না। দাওয়ায় উঠে শেয়াল হাঁক পাড়লেও সাড়া দেয় না কেউ। তারা তখনও ছুটোছুটি করছে সরকারের কাছে।

কিন্তু গঙ্গা যায়, আসে নিরন্তর। হাসে খলখল করে। আকাশে মেঘের বড় বড় চাংড়া মুখে বিদ্যুৎ হাসে।

পুব-দক্ষিণের মানুষদের কোনও কথাই নেই। কে তাদের জন্যে তদ্বির করবে। তারা দেখছে। চেয়ে চেয়ে গঙ্গার দিকে। খালি পেটে ভালুক দাপাচ্ছে। কাছা খুলে বসেছে সবাই ছাই আঁকড়ে ধরে।

বড় লাঞ্ছনা গো মা। কাকে অভিশাপ দেব আমরা, ঠাহর পাচ্ছিনে। অন্ধ হয়ে কাকে আঘাত করব, তার খোঁজ জানিনে। চিনি শুধু তোকে। সাংলোর সলি দিয়ে মারব নাকি তোকে।

সবশেষে গঙ্গার মুখোমুখি দাঁড়ায় সবাই। নিরুপায় সন্তানেরা দাঁড়ায় মায়ের কাছে। নলেন টানা শুরু হয় গঙ্গার পুব পাড়ের চরায়। একটু বেদি পাতে মাটির। সেখানে হত্যে দিয়ে পড়ে মাছমারা। একে বলে নলেন টানা।

—কে হত্যে দিয়েছে?

—পুরোখোঁড়গাছির ছিনাথ মালো আর পুবপারের এক চুনুরি।

জাল বাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আসে সবাই। বেদির সামনে উপুড় হয়ে পড়ে আছে দুজন। এই দুৰ্জয় সংহারিণী গঙ্গার সাক্ষাৎ চায় তারা। এই তাদের বিশ্বাস। চিরকালের এমনি চেনাশোনা, গঙ্গাকে বলতে হবে, এ তার কী মন, কেমন মতি। গঙ্গা বলুক, নইলে সে উঠবে না, বসবে না, খাবে না। আমরণ এই অনশন। দুকুলপ্লবী এই জল। শুধু জল তো নয়। যে মহাপ্রাণ রয়েছে, মা বলেছে তাকে তারা। তবে কেন বলবে না। যারা আসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে, তারা গোল হয়ে ঘিরে হরিধ্বনি দেয়। জোয়ারের বেলায় এসে নামগান করে। মেটে ধূপদান থেকে ধোঁয়া ওঠে আকাশে।

যারা হত্যে দিয়েছে, তারা ভয়ার্ত ব্যাকুল স্বরে চিৎকার করে, মা—ম গো! কী অপরাধ আছে মাছমারাদের বল মা! আমাদের কী গতি হবে মা! কী আছে তোর গর্ভে এবার বল, নইলে উঠব না।

সেই আর্ত চিৎকারের পাশে, বড় শান্ত বড় ভয়ংকর গঙ্গা হেসে চলে দিবানিশি। উপোসি চিল কাঁদে চিৎকার করে। গভীর বক নিঃশব্দে ফেরে আপলক চোখে, ভাটার পলিতে।

–মা, মা গো!

সারা অঙ্গ কাঁপে থরথর করে। বেদির সামনে মুখ ঘষে গাঁজলা ওঠে বাসি মুখে। —মা…মা গো।

গঙ্গা চলে দুর্বোধ্য হেসে, কুলুকুলু করে।

 

আবার একটা গণ্ডগোল উঠল মাথাচাড়া দিয়ে। প্রতি বছরই ওঠে।

পশ্চিম পারের পাড়ার মাছমারারা পাতলে বাঁধাছাঁদি জাল। বাঁধাছাঁদি জাল বিশাল বেড়, বাঁধে গঙ্গার এপার ওপার জুড়ে।

দুলাল আগেই জানিয়েছিল বিলাসকে। কিন্তু সত্যি সত্যি ফেলবে, এটা বিশ্বাস করেনি। টোটার সময় মানুষ ভাল বুদ্ধি হারায়।

বাকি মাছমারারা চেঁচিয়ে উঠল, এ অনিয়ম হতে পারবে না। আমরা জাল বাইব কোথায়? আমরা কি মরব নাকি?

বাঁধাছাঁদি বড় বাধা। এই জাল ফেললে, এক হাত জায়গা থাকে না গঙ্গায়। সাংলো বলো, টানাছাঁদি বলো, কিছুই ফেলা যাবে না বাঁধাছাঁদি ডিঙিয়ে। শুধু তাই নয়। বাঁধাছাঁদি পেরিয়ে আর কোনও তল্লাটে মাছ যেতে পারবে না, আসতে পারবে না।

এ তো সমুদ্র নয় যে জগৎবেড় জাল ফেলবে তুমি। সমুদ্র অনন্ত। জগৎবেড় নাম শুনেও তিনি হাসেন। কিন্তু গঙ্গার দেহে বাঁধাছাঁদিই আড়ে বাঁধা পড়ে যায়।

পশ্চিম পারের মাছমারারা বললে, আচ্ছা, আর ফেলব না, এই বারটি শেষ।

কিন্তু শেষ হল না। আবার ফেললে। দু-একটা মাছ পড়লও।

কেদমে পাঁচু চিনেছে বিলাসকে। বলল, বিলেস, এটা তো ঠিক হচ্ছে না।

সকলেই গোল হয়ে ঘিরে এল। এ কী অনিয়ম। প্ৰতি বছরই কথা কাটাকাটি হয়, প্ৰতিজ্ঞা করে পশ্চিম পারের মাছমারারা। কিন্তু কাজের বেলা ঠিক খেলাপ করবে। বাকি মাছমারা যায় কোথায় তা হলে। মরতে মরতেও যেটুকু আশা, সেটুকুও টিপে মারতে চায়। একটা বিহিত না করলে তো চলে না।

বিলাস বলল, চল জাল খুলে দে আসি।

সবাই একবাক্যে সায় দিল, তাই চল।

পাঁচু চিৎকার করে উঠল, খবদার বিলেস, মারামারি করিসনে, আপোসে মেটাবি।

বিলাসদের পাঁচ গণ্ডা নৌক এসে লাগল গঞ্জের নীচে, বড় চরায়। পশ্চিম পারের মাছমারাদের ওইখানেই ভিড়, ওইখানেই বেঁধেছে বাঁধাছাদির খুটো, পাহারা বসে আছে দল নিয়ে।

আপোসে মিটতে চাইল না। পশ্চিম পারের লোকেরা এল লাঠি নিয়ে। খবরদার জালে হাত দিলে রক্তারক্তি হবে।

দেখতে দেখতে পশ্চিম পারের লোক ভিড় করে এল।

রসিকের চোখই সবচেয়ে বেশি জ্বলছে ধকধক করে। পালিয়ে বেড়ানো হিংস্ৰ চিতাবাঘটা যেন সুযোগ পেয়ে দাঁড়িয়েছে বিলাসের মুখোমুখি। হাতে তার তেল-চকচকে বাঁশের লাঠি। বলল, বড় যে তড়পাচ্ছিলে কদিন। এখন একবার তড়পাও দেখি, ঘাড়ে কটা মাথা আছে?

রাসিকের মাথা ডিঙিয়ে বিলাস সকলের দিকে চেয়ে দেখল। তার চোখও বাদার বাঘের মতো জ্বলছে দপদপিয়ে। চিৎকার করে বলল, তোমরা মারামারি করতে চাও?

জবাব এল, জাল খোলা চলবে না। এখানে লাঠি আছে।

এদিক থেকে একজন বলে উঠল, এখেনেও টাকির লাঠি আছে।

আর একজন ছড়া কাটল, টাকির লাঠি, সাতক্ষীরের মাটি, গোবরডাঙার হাতি…

বিলাস ক্রুদ্ধ গলায় ফুলে উঠল, আরে ধৌত্তরি তোর লাঠি মাটি হাতির নিকুচি করেছে। মীমাংসা তোমরা করবে না?

ওদিক থেকে জবাব এল, মহারানির জলে মাছ ধরা, মীমাংসা কীসের।

অর্থাৎ রানি রাসমণির খাজনা-বিহীন জলে মাছ ধরার কথা বলছে।

বিলাস ছুটে গেল জলের দিকে। পাঁচু পিছন থেকে হাঁক পেড়ে উঠল, বিলেস, বি-লেস।

বিলাস শুনল না। পাঁচু ছুটিল পিছনে পিছনে। পাঁচ গণ্ডা নৌকার মাছমারা, বিলাসকে ঘিরে ধরে ছুটিল সঙ্গে সঙ্গে।

মরবে, মরণ ধরেছে বিলাসের। ওরে সর্বনেশে, তুই মরে আমাকে মারতে চাস। আমার পেটে মোচড় দিয়ে ব্যথা উঠছে, মাথা ঘুরছে। তোকে আমি কী করে সামলাই। বউঠান! খোকাঠাকুরের নাম নাও।

রসিকের গলাই সবচেয়ে উঁচু শোনা গেল, সাবধান!

বিলাস দেখল জালের খুটোর কাছে রসিক। চকিতে তার হাত থেকে লাঠিগাছটি ছিনিয়ে বিলাস ফেলে দিল জলে। রসিকও সেই মুহূর্তে প্ৰচণ্ড শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিলাসের উপর। অনেকগুলি লাঠি-বৈঠা ঠিকঠকিয়ে উঠল।

বিলাসের চোখে মুখে প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত করছে রসিক। বিলাস চিৎকার করে উঠল, জাল খুলে দিলুম। আমি।

পাঁচুর বুকে ভয়ার্ত কান্না ও ক্ৰোধ উথলে উঠল। এ কী বিলেস, মুখের কাশে তোর রক্ত ছুটছে। সমুদ্রে তুই কশার বেঁধে এসেছিস। গঙ্গায় এসে মরছিস তুই?

জাল খুলে দিল বিলাস। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন পশ্চিম পারের মাছমারা নৌকো নিয়ে ভোসল জাল বাঁচাবার জন্যে।

এবার বিলাস ফিরল রসিকের দিকে। নাকে মুখে তার রক্তের দাগ। কিন্তু কালো কুচকুচে বিলাসের সবঙ্গে যেন মূর্তি ধরেছে স্বয়ং রুদ্র। রসিককে জাপটে ধরে সে জলে নামল। বুক দিয়ে চেপে ঠেসে ধরল জলে।

পাঁচু ভয়ে চিৎকার করে উঠল, ওরে শোরের লাতি, আমার লক্ষ্মী বাবা বিলেস, খুন হয়ে যাবে যে?

বিলাসের হাত শিথিল হল। ছেড়ে দিল রসিককে। রসিক পাড়ে উঠল হেঁচড়ে হেঁচড়ে। নাক দিয়ে জল ঢুকে গেছে। বারে বারে গলায় হাত দিচ্ছে। যেন এখনও একটি সাঁড়াশি-হাত আকড়ে আছে তার গলা। দম ফুরিয়েছে তার। কিন্তু একটা মারামারির লক্ষণ প্রকট হয়ে উঠল।

ব্যাপারটি প্রথমে দেখেছে পালমশাই। সে খবর দিয়েছে ব্ৰজেন ঠাকুরকে। ব্ৰজেন ঠাকুরই এসে থামালেন।

মহাজন মানুষ ব্ৰজেন ঠাকুর, সকলেই ধারে তাঁর কাছে। তিনি ডাকলেন গঞ্জের আরও দু-চারজন মান্যগণ্য লোককে। মারামারি রোধ হল বটে সাময়িক ভাবে। কিন্তু সকলেই গণ্ডগোল করছে।

ব্ৰজেন ঠাকুর বললেন, বেশ, এখানকার যাঁরা নেতারা আছেন তাঁদের ডাকা হোক। সভা বসুক বিকেলে।

পশ্চিম পারের লোকেরা তাই মেনে নিল। কিন্তু বোঝা গেল, তারা একটু মুষড়ে পড়েছে। এ ঘটনা প্ৰায় প্রতি বছরেরই। তবে এতখানি হয় না কোনও বারেই।

নৌকোয় এসে পাঁচু তার অশক্ত হাতে আরও দু-ঘা দিল বিলাসকে। বলল, হারামজাদা, মানুষ খুন করতে চাস তুই! এ ভাটিতে আর জাল ফেলা নয়, তোকে নে, বাড়ি ফিরে যাব আমি।

বিলাস মুখের রক্ত ধুয়ে বলল, হঁয়া, শুক্কে মরতে যাব বাড়িতে, সুখ আর ধরছে না। তুমি বসে। দিনি ঠাণ্ডা হয়ে। শুধু শুধু মেরো না বলে দিচ্ছি।

পাশে পাশে কয়েকটি নৌক চলেছে। কেদমে চেঁচিয়ে বলল, বাবা বিলেস।

—কী বলছি খুড়ো।

—তুই বাবা পিকিতি বাছাড়ি বীর।

আরও কয়েকটি নৌকের মাঝিও সায় দিয়ে উঠল, যথার্থ বলেছ কদম পাঁচু। পুবের মান রেখেছে। যেমন কুকুর তার তেমনি মুগুর দরকার।

উঁচু পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল দামিনী। নৌকো দেখে নেমে এল। বলল, কী হয়েছে পাঁচুদাদা, মারামারি করেছ তোমরা?

বিলাসকে দেখিয়ে পাঁচু বলল, জিজ্ঞেস করো ওঁয়ারে। দামিনী দিদি, আমার শরীল খারাপ, এ হারামজাদা আমাকে নিকেশ না করে ছাড়বে না।

বিলাস কোনও কথা না বলে তিবড়ি নিয়ে বসল। দামিনী গেল ফিরে। নাতনিকে তার সংবাদ দিতে হবে, সেই জন্যেই আসা।

কিন্তু কী হবে মারামারি করে। বাগবিতণ্ডায় কী আসে যায়। গঙ্গার টোটা-হানা বুকে এসেছে। অদৃশ্য রাক্ষসী, সে নিরন্তর হাসে খলখল করে।

পুবের চরায় অনশন চলেছে একটানা। অনশন এমনি অমনি দুয়েতেই।

 

বিকালে সভা বসল। এসেছে সব মাছমারা। অনেক নতুন মানী লোক এসেছেন সভায়।

একজন সোনার বোতাম লাগানো, আঙুলের সোনার আংটি চকচাকিয়ে বললেন, জাল যখন আছে, তখন ফেলতেই হবে। তোমরা সকলেই ফেলতে পারো বাঁধাছাঁদি জাল। ܙ

পশ্চিম পারের লোকেরা বলল, ঠিক ঠিক।

কেমন হল? বিলাস উঠল। পাঁচু তাকে বসিয়ে দিল ঘাড় ধরে। বোস, হারামজাদা, এত বড় বড় সব লোক রয়েছেন। উনি যাচ্ছেন কথা বলতে।

কিন্তু শোরের গোঁ। মালোর ব্যাটা উঠল। আবার ঠেলে।–এটা কেমন কথা হল, শুনি?

এদিকে গুলতোনি উঠল।

-কে? কে কথা বলে?

—বিলেস।

-তেঁতলে বিলেস?

–হ্যাঁ।

–বেশ বেশ।

মান্যলোক এই বাজারের একজন বড় আড়তদার। বললেন, কেন? কথাটা মন্দ কী হল?

–আমাদের তো বাঁধাছাঁদি জাল নেই মশায়।

—নেই? কিন্তু সে দোষ তো এদের নয়।

পশ্চিম পার-ঠিক ঠিক।

বিলাস উঠে দাঁড়াল। বলল, মশায়, বিচার করছেন কেমনধারা। আপনি? আমরা আসি দূর গাঁ থেকে, লৌকোয় বাস। বাঁধাছাঁদি আনতে পারিনে।

-সে দোষ করা?

পশ্চিম পার-ঠিক ঠিক।

পাঁচু হামলে উঠল, বোস বোস বিলেস, শোরের লাতি।

কিন্তু মন বলে পাঁচুর, মানীর মুখে এ কেমন মানের কথা?

বিলাস বলল, আমার যদি বাঁধোছাঁদ না থাকে, তবে কি আমি কলা মুখে দে থাকব। মশায়? এটা কেমন বিচার? তা হলে, গরিব মাছমারারা কী করবে?

ব্ৰজেন ঠাকুর চুপচাপ। সব মাছমারাই তার দাদন খায়। কারুর পক্ষে না যাওয়াই ভাল।

আর একজন মান্য লোক বললেন, গরিব বড়লোকের তো কোনও কথা নেই। তুমিও বাঁধাছাঁদি এনে ফেলো, কেউ বারণ করবে না।

বিলাস বলল, বাবু, বুঝে কথা বলেন। ওটা নিয়ম নয়, আকচাআকচি বাড়বে তাতে।

এমন সময় সভার মঞ্চে আর-একজন উঠলেন। জোয়ান বয়সের মানুষ। কী যেন বললেন মঞ্চের বাবুদের। তারপরে সকলকে বললেন, তুমি ঠিক বলেছ ভাই। গরিব জেলে সবখানে আছে। বাঁধাছাঁদি সেখানে চলে না। একমাত্র টানের দিনে, রাত্রে বাঁধাছাঁদি চলতে পারে। এখন বন্ধ রাখতে হবে।

একটা হইহই হল ভীষণ। কিন্তু শেষ কথাই সাব্যস্ত হল।

রাত হয়ে গিয়েছিল।

ফেরবার পথে, কেদমের সঙ্গে গঞ্জ দিয়ে হেঁটে এল বিলাস। ঘাটে নামবার আগে, হঠাৎ দাঁড়াল হিমির দরজার কাছে।

কেদমে পাঁচুও দাঁড়াল। বলল, তুমি ঘুরে এসো, আমি যাই। কেদমে আর সে কেদমে নেই। বিলাসকে সে ভক্তি করতে আরম্ভ করেছে। অন্ধকার উঠোন।। ঘরেও বাতি নেই। বিলাস ডাকল, মহারানি আছ নাকি?

–কে?

অন্ধকার এক কোণ থেকে ছুটে এল হিমি। —একী, তুমি এসেছ? এসো এসো। মা গো, কী ভয় পেয়েছিলুম।

—এত ভয় কেন মহারানি? ভয় হবে না? মহারানি ডাক শুনে যে চমকে উঠেছি। আজ সারাদিনই আমার ভয়ে ভয়ে কেটেছে, মারামারি করেছ তোমরা।

—দুঃখের সময়ে পায়ে পা দে ঝগড়া বাঁধালে রসিকেরা। সাধ করে কি কেউ মারামারি করে? তা, সে সব মিটে গেছে। তোমার বাড়ির মানুষেরা কমনে গেল?

অন্ধকারেও হিমির চোখ চকচক করছে দেখা যায়। কপালের টিপ, নাকছবির পাথরও বিকমিক করছে। চাপা গলায় বলল, যার যেখানে মন টেনেছে, সে সেখানেই গেছে।

—আর তুমি কোথায় ছিলে এই আঁধারে?

—বসেছিলুম এক কোণে চুপ করে।

—কেন মহারানি।

হিমি গলা নামিয়ে বলল, আমার যেখানে মন টানে, সেখানে যেতে পারিনে, তাই। পা বেঁধে দিয়েছ তুমি, বলেছ, সময় হলে আসবে। নিজে আর যেতে পারিনে ঘাটে। রাত হলে রোজ বসে থাকি এমনি।

—মহারানি!

—ডেকো না গো এমনি করে। আমার বুক বড় কাঁপে।

—কাঁপবে কেন? আমি যে জানি, সত্যি মহারানি। কিন্তু দুলাল খুড়ো বলেছেল, তোমার অসুখ করেছে, ডাকতরবাবুর কাছে নাকি যেতে হয়?

হিমি যেন চুপিচুপি বলল, হঁয়া, তখন যে বড় বেশি কাঁপত, তাই তো ঘাটে যৌতুম না। ডাকতর আমার নাড়ি টিপে দেখলে, চোখ দেখলে, জিভ দেখলে, তা পরে বললে, ও মেয়ে, তোমার রক্ত বড় উতল হয়েছে মা। বে-থা হয়নি? কী লজ্জা, কী লজ্জা! ও মা, ডাকতরবাবু এ কী কথা বলে গো। বললুম, না। বললে, তাই তোমার শরীর খারাপ মা। এর ওষুধ তো আমার কাছে নেই। তা এই নাও, একটু ঘুমের ওষুধ দিলাম।

অন্ধকারের বুকে অন্ধকার বিলাস। অন্ধকারের বুকে মিশতে চায় হিমি। বলল, এসো ঢাপ, বসাসে। দু-হাত দিয়ে টানল হিমি বিলাসকে।

বিলাস বলল, আজ বসতে আসিনি। মন মানে না মহারানি, একবার দেখে গেলুম। আসব, শিগগির আসিব।

—কবে?

—টোটার মার শেষ হলে।

—একটু বসে যাও ঢাপ।

বিলাস দাওয়ায় উঠে বসল। ঘরে উঠে বসবার সময় তার হয়নি।

জোয়ান কোটাল উথলে উঠল। কুলে কুলে। পাড় ভাসল। বিলাসের বুকের অন্ধকারে মিশিয়ে গেল হিমি। অন্ধকার, আদিগন্ত সমুদ্রের মতো নীলাম্বুধি বিলাস। উজনি মাছের মতো ভেসে বেড়াল হিমি সেই সমুদ্রে।

 

কিন্তু শ্রাবণ্যে টোটার থাবা ওঠে না। পিপাসা মেটে না তার রক্তের।

পূর্ণিমার জোয়ান কোটালের জন্ম হয়েছিল মরা মুখ নিয়ে। তারপরের অমাবস্যাও গেছে মরার মতো চুপিচুপি। কদিন রোদ গেছে খুব। আবার মেঘ জমেছে আকাশে। প্রতি দিন মেঘ জমছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, গুরু গুরু। গর্জনে ডাক ছাড়ছে দুরের আকাশ।

পাঁচু আরও নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। অধিকাংশ সময় সাংলো নিয়ে বসে থাকে, জলে ফেলে না। বসে থাকতে পারে না। আর ভার নিয়ে। বিলাস থেকে থেকে খুড়োর দিকে তাকায়। খুড়ো বারে বারে কাছ খোলে, ককায়। বিলাস বলে, খুড়ো, উপরে গে দু-দিন বসে থাকো।

পাঁচু বলে, না, লৌকো ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। কিন্তুন আকাশের এ কী ছিনালিপনা বুঝি নে। ঢালে না কেন?

শুক্লপক্ষের একাদশী এল। সন্ধ্যাবেলা বৃষ্টি এল ফিসফিস করে।

প্রথম রাতের ভাঁটায় হঠাৎ একটি ছোট ইলিশ পড়ল কেদমে পাঁচুর সাংলো জালে। দেখে বুঝি কেদমে খুব খুশি। যেন হেসে বাঁচে না। সবাইকে মাছ দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল, দেখো গো মাছ পেয়েছি।

বলে, হঠাৎ মাছটাকে ল্যাজে ধরে, বাঁশফালির পাটাতনে আছড়াতে লাগল। ক্রুদ্ধ আক্ৰোশে ফুঁসে গর্জে উঠল, কেন, কেন এসেছিস ঢং-মারানি।

পরান ব্যাপকে জড়িয়ে ধরে বলল,-বাবা, বাবা, অমন কোরো না বাবা।

মাছটাকে ছড়কুটে ফেলে দিয়ে, হাঁটুতে মাথা গুঁজল কেদমে।

পাঁচু সাংলো ফেলেছিল। আচমকা বুকটা তার কেমন করে উঠল। মনে মনে বলল, মেরো না, মেরো না এমনি করে। ছোট হোক, যত ছোট, মাছমারা, ও ছাড়া তোমার জীবনে আর কেউ নেই। তোমার জীবনে মরণে সে। তাকে তুমি বুকে করে রাখো।

মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদ উকি দেয়। পুবে সাওটায় মনে হয়, যেন কোন দিগন্তে সে ছুটেছে চুপি চুপি। গঙ্গায় এত নৌকা কিন্তু সব যেন নিঝুম। মড়ক লাগলে গ্রামের যেমন হাল হয়, সেই রকম। ছাঁইয়ের মুখছাটের কাছে সকলের বাতিও জ্বলে না। আজকাল। প্রহরে প্রহরে শেয়াল ডেকে যায়ভাগাড়ে। নীচে তার ঘূর্ণিতে কে যেন মাথা দোলায় অনবরত। আর কাছের পাড়ার মেয়েগুলি মাঝে মাঝে হাসে ভয়ংকর।

হঠাৎ সাংলো খসে পড়ল পাঁচুর হাত থেকে।

বিলাস চমকে উঠে বলল, কী হল খুড়ো?

শব্দ নেই। বিলাস দেখল, খুড়ো ঝুঁকে পড়েছে জলের দিকে। প্ৰাণপণে সাংলো টেনে তুলে, ছুটে এল বিলাস। এসে ধরল খুড়োকে।

খুড়োর গায়ে জ্বর। আমাশায় কাপড় খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু চোখ রয়েছে তাকিয়ে। যেমন অন্ধকারে চকচক করে জল, তেমনি কোটরে চকচক করে খুড়োর দুটি চোখের বিন্দু। না, জল নয়, যেন আপলক মীনচক্ষু।

শক্ত বিলাসের গলায় ভয়ার্ত হুতোশ। ডাকল, ও খুড়ো, তোমার কী হয়েছে।

সুরহীন চাপা-পড়া গলা শোনা গেল পাঁচুর, বাবা বিলেস, আমি মাছমারা। দক্ষিণ থেকে দাদা এয়েছে, আর এয়েছেন। মীনেরা। আমার মরণ হচ্ছে রে।

—আ খুড়ো, তুমি কী বলছ?

—ঠিক বলছি বাবা। আমি মাছমারা। এই মরণ আমার ভাল। বিলেস—

পাঁচুকে ছেলেমানুষের মতো বুকে তুলে বলল বিলাস, খুড়ো আমি তোমাকে বাড়ি নে যাব গো, খুড়ির কাছে নে যাব।

যেন জলের অতল থেকে তেমনি সুরে বললে পাঁচু, না, বিলেস, আমার সময় হয়েছে। যত জনাকে মেরেছি, সবাই এয়েছেন। তোর খুড়িকে বলিস। বোঠানকে বলিস। আর বিলেস–

বিলাসের গলা ভেঙে গেল। বড় শক্ত ছেলে বিলাস, না? তবে এখন খুড়োর জন্যে কাঁদে কেন। বলল, বলো।

বিলেস, বাদার সেই কালো পুরুষকে আমি দেখতে পাচ্ছি, এয়েছেন আমার কাছে।

—কই?

—এই যে, তুই। তুই যে তার ছায়া, বাপের ব্যাটা।

–না, না গো খুড়ো।

—হ্যাঁ। মাছমারাকে কেউ যদি বিধেন দেয়, তুমি মাছ মেরো না, সে বিধেন মানা যায় না। বিলেস, তুই মাছমারা। তুই সমুদ্রে যাস টানের মরশুমে। ওটা মাছমারাদের জীবনের বিধেন। বাতাসের মুখে আমি এই কথাটা শুনি।

এবার বিলাসের বুকটা ফাটতে চাইল। বলল, না, না গো খুড়ো, তোমার সঙ্গে যাব।

দৈববাণীর মতো স্থির স্বরে বলল পাঁচু-না। তুই সাই নে যাবি বিলেস। আর বিলেস—

–বলো।

একটু যেন দম নেয়। পাঁচু। চোখের কোলে তার জল এসেছে। বলল, দামিনীর লাতিনের পাণখানি পোষ্কার বলে বুইছি। ছুড়ি তোকে ভালবাসে। মানুষের জীবনে এমন হয়। দামিনী চেয়েছিল তোর বাবাকে, পায়নি। লাতিন পেয়েছে তোকে। মাছমারার ঘরে যদি মেয়েটা আসতে চায়, তবে নিস। বিলেস–

—বলো।

—আমাকে হাঁটুতে নো হাল ধর। লৌকো ভেসে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সামনে আওড়া। ঘূর্ণিজলের শব্দ শোনা যায়।

বিলাস হাল ধরল। ঠিকই, সামনে দহ। কাউকে চিৎকার করে ডাকতে পারছে না বিলাস। বলল, খুড়ো, পারে চলো। দামিনীর কাছে ধার করে একবার বদ্যি ডাকি।

—না, ওপারে যাচ্ছি। আর সময় নেই বাপ। বিলেস, এটা কথা বলি, মানুষ চিরকাল মাছ ধরবে। এ সোমসারের মানুষ মাছভাত খাবে। তুই মাছ মারিস। জীবনে তাতে তোর কিছু বাদ পড়বে না। তোর কল্যেন হোক। তুই দুধে-ভাতে খাস।

বিলাস গলা চড়িয়ে ডাকল, খুড়ো।

মেঘের ফাঁকে উকি দিয়ে যাচ্ছে চাঁদ। চোখ দুটি পাঁচুর তেমনি অপলক, চিকচিক করে। টেনে টেনে বলল, বা-বা!

বিলাস যেন সেই ছোট ছেলেটি। বলল, আমি দুধে-ভাতে খাব, তুমি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছ কমনে গো?

পাঁচুর গলা ড়ুবে এল। যেন আওড়ে তলিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কিন্তু কথাগুলো আবার যেন পরিষ্কার হল। বলল, আমি এতদিন হালে বসেছি, এবার তুই বসবি বাপ। আমার আগে তোর বাবা বসন্ত। তার আগে আমার বাবা। বিলেস…।

—খুড়ো! —তোর ভাই, আমার ছেলে, আগামী সনে তোর দাঁড় ধরবে। শাঙনে টোটার কথা বলিস তাকে। তুই টোটার শেষ দেখে যাস। মাকে গাল দিসনে। আর—

কথা ফুটল না। ঠোঁট কাঁপতে লাগল।… বৌঠান, পেখম পোহরের শ্যাল ডাকছে এখন ধলতিতেয়, শুনতে পাচ্ছি। গো। হুতোম প্যাচাটা ডেকে মরছে কেন, ঠাহর করতে পারছি না? কেন অমন দমকা দমকা বাতাস আছড়ে আছড়ে পড়ছে বেড়ায়, অনুমান করতে পারছি না? কেন তোমার জায়ের হাত থেকে বাটিখানি পড়ে গেল, তাই ভেবে মরছ? ওই জানান দিচ্ছে। পাঁচু তোমাদের ছেড়ে যায়। বিলেস-বা-বা বি-লে-স…

ও, সংসার ছেড়ে যাচ্ছি, তাই আর সাড়া নেই, না?

হে দক্ষিণরায়, তোমার ভয়ংকর রূপ আমি দেখেছি। মা বনবিবি, তোমার মহামারী বিভীষিকা। দেখেছি সাঁইয়ের শাবরে। হে সমুদ্র, তোমার রুদ্র রূপ আমি দেখেছি। বাদা, হেতাঁল, সুদুরী বনের দানো, তোমার খরা শুনেছি। মাগো গঙ্গা, তোমার অনন্ত বুকের মহাসর্বনাশকে দেখেছি, তোমার আশীর্বাদ পেয়েছি অনেক। তুমি আসছ খোলা জটায় লুটিয়ে, রুদ্রাণী তুমি আমার শিয়রে। তোমাদের মাঝে একদিন মাছধরা আমি ফিরেছি, তোমাদের হাতে রেখে গেলুম বিলেসকে। বিলেস রাখবে ঘর-গেরস্থি।

সহসা নৌকো যেন থেমে গেল। শক্ত হাতে আকড়ায় যেন কে। কে? যক্ষ না রক্ষ না প্ৰেত? নাকি কেউ বসে ছিল ঘূর্ণিদহের ছদ্মবেশে।

কেউ না, জোয়ার আসছে, থম খেয়েছে গঙ্গা। পরমুহূর্তেই প্রবল গর্জন শোনা গেল। বিলাস পিছন ফিরে দেখল, কয়েক হাত উঁচু হয়ে, ফণা-তোলা নাগের মতো বান আসছে।

পাঁচুকে বুকের মধ্যে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে, দু হাতে হাল ধরল। বিলাস। এই প্রথম তার হাল ধরা।

দেখতে দেখতে বিলাসের মাথা ছাড়িয়ে বানের ঢেউ এসে পড়ল। গলুই উঁচুতে উঠে খাড়া হয়ে উঠল। নৌকা। বিলাস কষে চাপ দিল হালে। ঢেউয়ের মাথার সঙ্গে নেমে গেল। আবার। জোয়ার এল। দক্ষিণের জল। বাতাস এল, পুবে সাওটা। ফিসফিসে জল, তবু থেকে থেকে চাঁদ দেখা যায়। আর দেখা যায়, জলে কিলবিল করে চকচাকিয়ে চলেছে জোয়ারের স্রোত। দূর আকাশে হিলিবিলি বিদ্যুতের। মেঘের গুরু গুরু চাপা গর্জন আসছে ভেসে।

পুবের চরায় নলেন টানা চলেছে নিরন্তর। টিমটিম করে বাতি জ্বলছে সেখানে। ছায়ার মতো মানুষেরা হরিধ্বনি করছে। ফাঁকে ফাঁকে শোনা যাচ্ছে, মা, মা গো!…

–সামলে এসো হে। কার নৌকো?

কেদমে পাঁচুর গলা? বিলাস বলল, কেদমে খুড়ো, ইদিকে এসো।

–কে বিলেস?

—হ্যাঁ। একবারটি ইন্দিকে এসো, খুড়ো আমার মরে গেল।

—আ বাবারে বাবা! আ গো মা গঙ্গা! তুই বলিস কী রে বিলেস! পাঁচদা মারা গেল?

ছেলের হাতে হাল দিয়ে, এ নৌকোয় এল কেদম।

পুবপারের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল নৌকা। কেদমের বুঝি কান্না পেয়েছিল। চিৎকার করে বলল, ধলতিতের পাঁচানন মালো মারা পল হো-এ-এ-এ।

ভগবতীর বেদি-ঘেরা মানুষগুলি হঠাৎ থতিয়ে গেল।

গঙ্গা ফুলছে, ফুলছে, ফুলছে। এঁকেবেঁকে, নোচে, হেসে দিগদিগন্তে চলেছে ছুটে।

এখানে কশার বাঁধার চিহ্ন রেখে যাওয়া যায় না। শ্রাবণের জোয়ান কোটালে যখন, গড়ানের পর গড়ানেও খুঁটনি বেয়ে কোনও সংবাদ আসে না, তখন মাছমারা টের পায়। টনক নড়ে তার। মরণ বুঝি আসে।

মাছমারাদের নৌকো এসে লাগল পশ্চিম পারে। খবর পেয়ে ছুটে এল দামিনী। জোয়ারের হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে কাঁদলে বুড়ি। বলল, এই সেদিনেও হাঁপাতে হাঁপাতে গেছল আমার কাছে। বড় যে মান-জ্ঞান ছেলে? তা হাত কচলে কচলে বললে, বড় শরম লাগে দামিনীদিদি, কিন্তু মাছমারার পাণ, শরমে কী হবে। আর দশটি ট্যাক দিও। হিমি দিলে দশটা ট্যাকা। যাওয়ার সময় বললে, গঙ্গার কাণ্ডটা দেখেছ, তো দামিনীদিদি। পাঁচ সন আগের কথা মনে পড়ছে আমার। এবার বুঝি আর বাঁচিনে।…

হিমি জড়িয়ে ধরেছিল দিদিমাকে। নজর তার বিলাসের দিকে। বিলাসের কোলে পাঁচুর শব। হিমি রুদ্ধ গলায় বলল, কত করে বলেছিলুম, খুড়ো দু-দিন থাকো-সে। ওপরে। থাকলে না…

নৌকায় করে শবযাত্রা হল। একটু দক্ষিণেই শ্মশান। পাঁচ-ছটি নৌকা একসঙ্গে চলল। ঠাণ্ডারামের মৃত্যুর দিনও এমনি গিয়েছিল অনেকে।

রাত কাবার হতে বেশি বাকি ছিল না। পাঁচুকে পুড়িয়ে বিলাস নৌকায় উঠল। নৌকার ফালি বাঁশের পাটাতন খুলে পরিষ্কার করল। সব ধুয়ে। স্নান করল। হালে টান দিতে যাবে। কে যেন নৌকায় উঠে এল।

–কে?

–আমি সয়া।

এত দিন পরের নৌকায় ছিল সে। এবার এল বিলাসের নৌকায়। ফিরে যাবারই বা পয়সা ছিল কোথায়? পালমশাই হাত উপুড় করবে না। আর। মরণের সংবাদ নিয়ে যাবে একেবারে সব শেষে।

বিলাসের কাছে এসে বসল। সয়ারাম। শরীর ফুলতে লাগল তার কান্নায়।

আকাশ কালিন্দী রূপ ধরেছে। শেষরাতে পুবে বাতাস আরও ভারী আর ঠাণ্ডা ঝাপটা দিচ্ছে। এ পাশে ও পাশে কয়েকটি নৌকার হালে শব্দ হচ্ছে ক্যাঁচ কোঁচ কর্‌ র্‌ র্‌…

বিলাস বলল, সয়া কাঁদিসনে।

–কাঁদিব না?

–না, কাঁদিসনে।

–আচ্ছা।

বলে সয়ারাম কাঁদতে লাগল।

ভাটা পড়ে গেছে। নৌকাগুলি পুবে সরে গেল। ভাগাড়ের দহ আছে সামনে। কতগুলি শেয়াল নিঃশব্দে ঘোরাফেরা করছে।

খানিকক্ষণ পর সয়ারাম বলল, বিলেস, আমি তোর নৌকোয় থাকব।

জবাবে বিলাস বলল, নৌকের নোঙরটা ফ্যাল দি-নি।

নৌকো নোঙর করতে না করতে, উঁচু পাড় থেকে একটি মূর্তি নেমে এল খানিকটা। জিজ্ঞেস করল, কারা এলে।

বিলাস ফিরে তাকাল। মহারানি! জবাব দিল সয়ারাম, বিলাসের নৌকো এল।

বিলাস উঠে গেল উপরে হিমির কাছে। ঘোর নীলাম্বরী পরেছে হিমি। বিলাসের গায়ের মতো অন্ধকার শাড়ি। চুল বাঁধেনি। এলো চুল সারা পিঠে ছড়িয়ে বাতাসে উড়ছে। অন্ধকারে জেগে আছে গোরা মুখখানি আর দুখানি হাত, তার উঁচু সীমানায় নিটোল কাঁধ।

বিলাস বলল, এ সময়ে এখেনে কেন মহারানি।

হিমি তাকিয়েছিল বিলাসের মুখের দিকে। বুঝি ঢপের শোক কতখানি, জানতে চায়। কিন্তু এই অন্ধকারের মতো, বহু ভাবের ঘোরে একটি নৈর্ব্যক্তিক লয়ের মতো বিলাসও অন্ধকারে মেশামেশি।

হিমি বলল, তোমার পথ চেয়ে। উঠে এসো ঘরে।

বিলাস হিমির মুখখানি কাছে টেনে নিয়ে এসে দেখতে লাগল। হিমি বলল, কী দেখছ ঢপ?

বিলাস বলল, খুড়ো বলে গেল, বিলেস, দামিনীদিদির লাতিনের মনখানি পোষ্কার বুয়েছি।  হিমির গলায় কথা আটকে এল। বিলাস তাকাল দূর গঙ্গার বুকে।

হিমি বলল, ঢপ, ঘরে উঠে এসো।

বিলাস বলল, মহারানি, ঘরে যাবার সময় হয়নি। সামনে পূর্ণিমার জোয়ান কোটাল দেখে তা-পর যাব।

বিলাস জোয়ান কোটাল দেখতে চায়। এত শোকের মধ্যে, হিমির বুকের খালি ঘরেও যেন ভরা কোটাল ভাসিয়ে যায়। মাছমারা সেখানে আসে না।

বিলাস আবার বলল, মহারানি, ঘরে যাও। শাঙনে টোটার মারা এখনও শেষ হয়নি।

 

দুদিন ধরে মহিষকালো আকাশে কেবলই বিদ্যুতের ঘটা গেল। বৃষ্টি হল ফিসফিস করে। তারপরে মহিষগুলি দাপাদাপি শুরু করল ভয়ংকর। বৃষ্টি এল মুষলধারে। মেঘ নামল গড়িয়ে গড়িয়ে, জড়িয়ে ধরতে আসছে যেন গোটা গঙ্গার বুকখানি। বাজ পড়ল। হুঙ্কার দিয়ে। পুব সাগরের রুদ্র ঝড় শুরু হল হঠাৎ।

তারপরেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এল।

ভাদ্র মাস পড়েছে।

সয়ারাম চিৎকার করে উঠল, জলে ওগুলান লাফায় কীরে? বিলেস…ও বিলেস!…

বিলাসও তাকিয়ে ছিল জলের দিকে। ভাটা পড়েছে, সাংলো জালের গড়ান মেরে চলেছে। দুজনে।

বিলাসের গলায় তেমন উল্লাসের সুর শোনা যায় না। বলল, কাল থেকে দেখছি। ভাসনা লাফাচ্ছে জলে।

হ্যাঁ, ভাসনা তিড়িংবিড়িং করে। অথাৎ রসনা চিংড়ি। দূর সমুদ্রের জল এসেছে গঙ্গায়। জলে তার দেখা দিয়েছে আবার জীব। এত দিন কিছুই ছিল না।

চলন্তায় গড়ান দিয়েছে বিলাস।

হ্যাঁ, গড়ান মার, গড়ান মেরে চল বিলেস। মুকড়া টানের জল, প্ৰাণ দেখা দিয়েছে। জল বড় গহিন, সাংলো আরও নামা। চল, আমি আছি তোর কাছে কাছে।

আঃ, পোকা বড় কিলবিল করে হাজার মাংসে। পাটাতন সরিয়ে বিলাস কাটা লেবু বার করল। রস নিংড়ে দিল ফাটা মাংসের মধ্যে। জ্বালা করে উঠল। তারপরে একটু কমল জ্বলুনি। থামল পোকার কিলবিলোনি। লেবুর রসে হাজার পোকা মরে।

আস্তে আস্তে জলের পোকারও বাড়াবাড়ি দেখা যায়। মেকো এসেছে, উজনি পোকা। উজানিদের আসবার সময় হয়েছে বুঝি গঙ্গায়।

সামনে আওড় দেখা যায়। চিকচিক বিদ্যুৎ চমকাল, আর বিলাসের খুঁটনি-জড়ানো আঙুল যেন চকিতে কেঁপে গেল একটু।

ওকোড় মোরল বিলাস। নৌকা কত হয়ে পড়ল।

প্রথম গড়ানেই দুটি ইলিশ। বড় জাতের মাছ, প্রকৃত মেয়েলি গড়ন।

সয়ারামও ওকোড় মারল। মাছ উঠল একটি। বলল, টোটা কাটল নাকি রে বিলেস?

মুখের কাছে মাছ তুলে ধরে বিলাস। বলে, কোথায় ছিলি? খুড়োকে খেয়ে তবে এলি।

তার পরের গড়ানে আবার দুটি পেল বিলাস। শেষ রাতের ভাটায় বিলাসের লোহার মতো হাতের এক ওকোড়ে চারটে মাছ উঠিল সাংলোয়।

সয়ারাম চেঁচিয়ে প্রায় কেঁদে ওঠে। —ও বিলেস, এমনি করে মাছ পলে সাংলো যে বেশিদিন টিকবে না।

বিলাস বলে, জাল আছে আরও।

সয়ারামের জলে-ধোয়া রোদো-পোড়া গালে জল। বিলাস বলে, কাঁদিসনে সয়া।

সয়ারাম বলে, আচ্ছা।

বিলাস বলে, হাতখান বুঝি ছিড়ে পড়ে রে সয়া। হাজা বড় দগদগ করে। ছাঁইয়ে গোঁজা আছে প্যাকাটি, গুড়োর তলায় আছে গাবের আঠা। একটু গরম কর দি নি।

গাবের আঠা গরম করে, বিলাসের দু হাতে মাখিয়ে দিল সয়ারাম, নিজের হাতেও মাখোল। জালের কাছি আর সহজে কেটে বসতে পারবে না।

বৃষ্টি বৃষ্টি আর বৃষ্টি। প্রবল বর্ষণ নয়। পুবে সাঁওটার ঝাপটায় গুঁড়ি গুঁড়ি ভেসে আসে। ইলশে গুঁড়োনি।

এক দিনে, বিলাস একলা ধরল। সতেরো সেরা ইলিশ মাছ।

দামিনীর হাসি আর ধরে না। কেঁদে আর বাঁচে না। কোথায় ছিল এত মাছ? কাকে খেয়ে এল?

সাংলোর সঙ্গে টানাছাঁদি ভাসাল বিলাস। সতেরো সের থেকে পরদিন বাইশ সের। পূর্ণিমার দিন সাঁইত্রিশ সের মাছ একলা ধরল বিলাস।

মাছ মাছ, উজনি মাছ এসেছে।

দিদিমা আর নাতনি নিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না। অষ্টপ্রহর লোক ছুটছে বাজারে। বরফ ভাঙছে, টাটকা রাখছে মাছ।

হিমি আসে ছুটে ছুটে। জোয়ারের বেলায় আসে। এসে নৌকায় উঠে পড়ে। বলে, ওগো ঢাপ, আর কতদিন?

বিলাস বলে, এই যে মহারানি, জোয়ান কোটাল যায়। ভরা কোটাল শেষ করি আগে।

হিমি হাসতে যায়, চোখে জল এসে পড়ে। চুপিচুপি বলে, আমি যে কিছু না দেখে ভেসে পড়েছি। ঢাপ, আমারও যেন ভরা কোটাল যায়।

বিলাস বলে, মহারানি এলুম বলে। ঠিক কোটালে যাব। তোমার কাছে না গে থাকতে পারবে না তেঁতলে বিলেস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *