০৮. শ্রাবণের পূর্ণিমা

এল শ্রাবণের পূর্ণিমার কোটাল। জোয়ান কোটাল।

জগন্নাথ ঠাকুর এসেছিলেন, চলে গেছেন। শ্রাবণের ধারায় ধুয়ে গেছে তাঁর রথের চাকার দাগ। এবার শ্ৰীকৃষ্ণ আসছেন বুলন খেলায়। কদমফুল ফুটেছে গাছে গাছে। গঙ্গার তটে তটেও বনহেনার ঝাড় সাদা হয়ে উঠেছে। চারদিকে সবুজ লকলক করছে। ধারায় স্নান করে। বিষকাটারির ঝাড়ে বাতাসের হাহাকার দিবানিশি। নোলোবন মাথা কুটছে।

কদমের তলে পেখম মেলবে ময়ুর। দেখে পাগলিনী হবে ময়ুরী। নীপবনে দুলবে। কৃষ্ণ রাধার সঙ্গে। শোনো, মেলার বাঁশি ডাক দিয়েছে নগর-গ্রামের মানুষকে।

 

মাছমারার কাছে কাছে থাকে পরস্পরের, চোখে চোখে তাকায়। কথা বলে না। যে কথাটি বুকের ভারী গোন ঠেলে উপচে আসে ঠোঁটের কুলে, সেই কথাটি বলতে চায় না কেউ।

মুখ চাপা থাকে। মন দমাবে কে। সে অষ্টপ্রহর বলে, হেই গো গঙ্গা, টোটা পোড়া দেখি তোর বুকে।

হ্যাঁ, নেমেছে শাঙনে টোটা। শ্রাবণের মহা মন্বন্তর। গঙ্গায় মাছমারার এত বড় মন্বন্তর আর হয়। না।

এ কী রূপ দেখি তোর গঙ্গা। কোথায় সর্বনাশ ঘটিয়ে এসেছিস তুই? কোন সর্বনাশের রক্তের দাগ নিয়ে এলি তুই উত্তর থেকে।

পূর্ণিমার দিনই পুব থেকে এল পালমশাই— মাছমারাদের মহাজন। তারপর ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। একবার এর নৌকায়, আবার তার নৌকায়।

কী, জল কী বলে? হুঁ, নৌকা নিয়ে পালাতে চাইছে। সব। সেইজন্যে এসেছে মহাজন পাল। চেয়ে দেখুক, কে এসেছে। দেখে, পালাবার ভাবনা ছাড়ক। ঋণ শোধ করতে হবে।

প্রতি বছরই আসে। মাছ পড়লে নিজেই ফড়ে পাইকেরদের ডেকে দরদপ্তর করে। মাছ বিক্রি করে, টাকা রাখে নিজের পকেটে। হিসাব রাখো, কত শোধ যাচ্ছে। খাবার টাকা নেই? আচ্ছা, এই নাও চালের দাম। কী গেলাটাই গিলতে পারো বাপু তোমরা।

মহাজনের এমনি কথা। আশ্রয় নেয় এসে গঞ্জের চালায়। হোটেলে খায়। কী খেয়ে থাকতে হবে, সে ভাবনা নেই। মহাজন মানুষ, বুলি তার শূন্য থাকে না। নইলে সে মহাজন কেন।

আর শহরে বাজারে এসেছে। একটু ভাল-মন্দ খায়। সুদ কিস্তি হিসাব-নিকাশের গোনা-গাঁথার মধ্যে সময় তো হয় না। এমনি বেড়াতে আসার। কাজের জন্যে আসা, সেই ফাঁকে একটু আধটু শখ মেটানো। পয়সাটি ফেলবে, হাতের কাছে সব হাজির।

আর বড় মেয়েমানুষের ভিড় শহরে। মাছমারার পিছনে পিছনে বা কতক্ষণ ঘোরা যায়। বড় একলা একলা লাগে, রক্তে বড় মোচড় দেয়। তবে পাড়াগাঁয়ের মানুষ, সঙ্গে দু-চার পয়সা থাকে, একটু ভয় ভয় লাগে। কিন্তু মেয়েমানুষের বাজারের টানটা তার চেয়ে বেশি। যে কদিন থাকতে হয়, সে কদিন নেশােটা কাটতে চায় না।

হোটেলে খায়, মেয়েমানুষের ঘরে কাটায় কিছুক্ষণ, তারপর গঞ্জের বড় রাস্তায়, বড় বড় দোকানের বারান্দায় শুয়ে রাতটি কাটায়। তারপরে মাছমারাদের নৌকায়। এইটি আসল কাজ। এর তার খোঁজ-খবর নেয়। অমুকে কোথায়? ওমুকের নৌকো দেখি না যে? টোটা হেঁকেছে বলে বসে থাকলে হবে? কাজ করো, কাজ করো।

তা মিথ্যে নয়। টোটার সর্বনাশা রূপ দেখে যখন হাত-পা গুটিয়ে আসে, জাল ফেলতে মন চায় না, মহাজনের মূর্তি তখন গুণের কাজ করে। বুকের মধ্যে করে ধুকুপুকু।

মহাজন আসে নিজের টানে। মাছমারা ভাসে নিজের তাগিদে। সে যদি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে, জানবে সেটা ন্যায্য। সে কখনও নিজেকে ফাঁকি দেয় না। মহাজন হুতোশের উপর হুতোশ চাপায় শুধু।

রোদ-জল বাঁচিয়ে ছাঁইয়ের মধ্যে বসে বলে, এখেনে ঋণ করেছ। কত? তহঁ, জানি হে সব জানি। তা যা খুশি তাই করো গে, আমারটা না নিয়ে আমি ফিরছি নে।

যদি মাছ পড়ে, তখন আসবে থাউকোর কথা। হোটেলের খাওয়া, মেয়েমানুষের কাছে যাওয়া, এ দুয়ের শোধ তুলতে হবে। মহাজন তো এ সব পকেট থেকে দেবে না। হিসেবের উপরে তখন ফাউ যাবে।

আকাশে পূর্ণিমার পঞ্চদশীকে আর চোখে দেখা গেল না। গোটা আকাশ জুড়ে মেঘের মহাসমারোহ। বিদ্যুৎ-কশা এখানে ওখানে ফাটল ধরায় তার বুকে। চারদিক অন্ধকার করে নামে বৃষ্টি। দিনের বেলা মেঘলাভাঙা রোদে পোড়ায়।

শহরের মানুষ যাতায়াত করে এপার ওপাের। চেয়ে দেখে। বোঝে না কিছু। বলে, কী হল হে। এবারে যে মাছ পড়ছে না। না, খাওয়া হল না। এবারে। খাওয়া হল না। শোন, শোন গো গঙ্গা, মান তোর নয়, মান যায় আমার।

কোথায় কোন সর্বনাশের মোর নিয়ে এলি তুই মাছমারার উপরে।

সর্বনাশ করেছে গঙ্গা আরও উত্তরে। বন্যা নেমেছে। কুশী ভেসেছে, প্লাবন হয়েছে মহানন্দার বুকে। পাহাড়ি ঢল ভেঙেছে। যাদের আসার তারা আসতে পারছে না। সমুদ্রের উত্তাপে আছে তারা। ঠাণ্ডা কনকনানিতে টিকতে পারে না।

কিছু কিছু নৌকা আসতে দেখা যাচ্ছে উত্তর থেকে। ছেলে-মেয়ে-বউ, ঘর-গেরস্থালি নিয়ে, গঙ্গার পাড় ঘেঁষে ঘেঁষে আসছে তারা। বৃত্তান্ত কী? না, বন্যা হয়ে গেছে। যে কয়েকখানি আসছে, সবই প্ৰায় মাছমারাদের নৌকা।। ঘর ভেসে গেছে। জলে কোনও প্ৰাণী নেই। এদিকে আসছে, ভিক্ষে করবে।

দূর হুগলি নদিয়া মুর্শিদাবাদের মরণের সংবাদ তাদের মুখে। দাগ নিয়ে এসেছে তাদের গায়ে।

জিজ্ঞেস করো, কাহিনী শুনতে পাবে। জাল পেতে মাছমারা নৌকা নোঙর করে রেখেছিল উঁচু পাড়ের কিনারে। বিঘাখানেক জমি চাপা পড়ে নৌকোসুদ্ধ নিপাত দিয়েছে। গঙ্গাও খায়, বড় জবর সে খাওয়া। দূর উত্তর থেকে সেই লকলকে জিভ নিয়ে সে এদিকে আসছে।

সমস্ত নৌকাগুলির চেহারা গেছে বদলে। মানুষগুলি রোদো-পোড়া, জলে-ভেজা শকুনের মতো হয়েছে।

আ! কী জ্বালা গো হাতে পায়ে। বড় ব্যথা। পোকা বিড়বিড় করছে দিগদগে হাজায়। দাঁড় বৈঠা ধরা যায় না। সাংলোর কাছি যায় না ধরে রাখা, কাঁচা দিগদগে মাংসে কেটে বসতে চায়। গাবের আঠা মাখছে। সবাই হাতে। যেমন করে প্রলেপ দেয় জালে, নৌকায়। কিন্তু রাষ্ণুসে পোকা। ভেদ করে উঠছে গাবের আঠার আস্তরণ।

রোদে শুকিয়ে জ্বালা। জলে ড়ুবিয়ে টনটনানি। ব্যথায় জ্বর তুলে দেয় গায়ে। দিলে কী হবে। জ্বরের উপর বৃষ্টি ধুয়ে যায়। প্ৰাণে বড় আগুন। ভিতরের জুলুনি তাতে নেভে না।

চোখ-খাবলার মতো খপিশ চোখে তাকিয়ে পালমশাই বলল, এ নৌকো কার বাঁধা রয়েছে? লোক কই?

শ্ৰীদামের নৌকা। নগদ পয়সা যা ছিল, তা নিয়ে বাড়ি চলে গেছে। শ্রাবণ টোটা তাড়া দিয়েছে অনেককে। নৌকা তুলছে শুকনো ডাঙায়। একজনকে রেখে, চলে গেছে দশজন। সেই একজন নৌকার পাহারাদার।

পালমশাই মুখ খারাপ করতে আরম্ভ করে। টোটার মার লাগে যেন তার গায়েও। সব পালালে আসলে ফাঁকি পড়বে তার। মেয়েমানুষের কথা ভুলতে হয় তখন। শখ সুখ ছেড়ে জলে জলে ঘোরে।

গঙ্গা আকাশে উঠছে, গঙ্গা পাতালে নামছে। সমুদ্রের চারিদিকে মরণ থাকে ওত পেতে। গঙ্গায় ডাক ছেড়েছে। শমন। শোনো, পাতাল থেকে উঠছে মরণ-ভেরী।

তবুকান রাখো সজাগ। নজর রাখো কড়া। এখন তুমি বেসামাল হলে, রক্ষে নেই। এই সময়ই সে টেনে নিয়ে যায়। অঘাটে।

দক্ষিণ বাতাস নাড়া দিচ্ছে আমার বুকে। ঘরে ফিরে যাবার উপায় নেই। জলেঙ্গা জলের প্রস্তাবনায় মাঝের আসর জমল না। চারিদিক থেকে ঘিরছে আমাকে মীনচক্ষু।

বিলাস, তবু তুই উঁচু পাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখিস। তোর পেটে ভাত নেই পুরো। তবু তোর বুক উথালি পাথালি। দেখে আমার বুক ফাটে। আমি না তোর জ্বালা জুড়েবার কাল গুনছি। গড়ান দে, গড়ান দে, তবু গড়ান দে।

দেয়, কিন্তু তারও জোয়ান কোটাল যায় যে। বিষরি শুক্লপক্ষে জোয়ান কোটালে গঙ্গা রঙের নেশায় চোখে মুখে দেখতে পায় না। বেটি কানি হয়েছে। তবু তার বড় উলসোনি। বিলাসও উলসে উঠেছে— প্রাণের গহনে যার শূন্য ভাটার ঢল।

ও কে, কেবলই কাছা খুলে খুলে বসছে নৌকার ধারে, ছইয়ে মুখ গুঁজে? চণ্ডীপুরের ফকির।

শমন এসেছে হাতে কলমে। কারাল রোগ, আমাশয়ের মহামারী নিয়ে আসছে। এই জল, রোদ আর বৃষ্টি। পেটে নেই পুরোভাত। মাথা চাড়া দিচ্ছে রোগ।

দেবী ভাগীরথী, এখন মূর্তিমতী সংহারিণী। স্রোতের টানে টানে ফিরছে রোগ-বীজ।

তা ছাড়া, জলে জলে থাকার ওই আসল রোগ। ওই যে জাল ফেলে এক ভাবে বসে থাকা, কম খাওয়া আর পুবে ভারী বাতাস, তারই রোগ। মনে হয়, পেটে যেন দপদপ করে আগুন জ্বলছে। আজিলা আজিলা জল দেয় সবাই পেটে। তবু ঠাণ্ডা হতে চায় না। গড়গড়িয়ে ওঠে, আর নাভিকুণ্ডলের কাছে মোচড় দিয়ে ওঠে ব্যথায়! জিভটা মোটা মোটা লাগে মুখের মধ্যে। নাকের মধ্যে একটা কীসের গন্ধ অষ্টপ্রহর ভোঁতা করে রাখে বাকি গন্ধ। শরীর টলে কিংবা নৌকা দোলে, ঠাহর পাওয়া যায় না। জল পাক খায় না মাথা ঘোরে, অনুমান করতে গিয়ে মুখ গুঁজে পড়ে পাটাতনের উপর। তারপর রক্তে টান পড়ে। ভয়ংকর রক্ত-আমাশা দেখা দেয়। মাছমারা যন্ত্রণায় কাঁদতে চায়, কান্না আসে না। রাগ হয়, ভয়ংকর রাগ। কার উপরে, সে হ্মানে না। শুধু হেঁসে দিয়ে নিজের পেটটা চোপাতে ইচ্ছে করে।

ইতিমধ্যেই কয়েকজনের রোগ দেখা দিয়েছে। গতিক দেখে মনে হয়, আরও হবে। এই সবই টোটার মার। মাছমারারা একটু পেট পুরে যে বারে খেতে পায়, সে বারে রোগের আমদানি কম। সে আসে, ঘোরাফেরা করে কাছে কাছে। দাঁত বসাতে পারে না।

এ বারে ঘরপোড়া গোরুর চোখে যেন সিঁদুরে মেঘ দপদপ করে।

যে দু-একজনের এখনও হালে পানি আছে, তারা যায় শহরের ডাক্তারের কাছে। বোতল পুরে নিয়ে আসে ওষুধ। মাছমারা, এইখানে তোর জীবন-মরণ। শুধু দেখতে হবে, সুদিনের বান ডাকে কি না। বৃথা যেতে দিসনি এই মুকড়া, এই আগনা। নৌকা রাখা আড়ে, গড়ান দে। গড়ান মেরে যা দিনরাত্রে।

দ্বিতীয়া পর্যন্ত কোটালের জোর। মরতে মরতে আরও দু-একদিন যায়। তাও গেল। চাঁদ চাপা। মেঘ-জমাট আকাশ। তবু যেন ভোরের অস্পষ্ট আভাসের মতো সবকিছুই দেখা যায়। থেকে থেকে, মেঘের ফাঁকে উকি দিচ্ছে চাঁদ। হঠাৎ একটু হাসির মতো। যেন মহা সর্বনাশ তার হাসি আর চেপে রাখতে পারছে না সব সময়।

কালো কালো নৌকাগুলি টানে ভেসে যায়। সাড়া-শব্দ নেই। আর। কারও মুখে কথা জোগায় না।

গড়ান চলেছে। পাঁচু বলল, আ ভগবতী, সত্যি টোটা হয়ে গেল গো।

ওই এক কথা। বিলাস জলের দিকে তাকায়।

টিকটিকি উঠল টিকটিক করে। দিপ করে জ্বলে উঠল বিলাসের চোখ।

পাঁচু বলল, সত্যি সত্যি সত্যি।

ছাইয়ের মুখছাটের কপালে টিমটিমে হ্যারিকেন। তার আলোয় দেখল রক্ত-চক্ষু টিকটিকি ছাঁইয়ের বেড়ায়। হাতের কাছে ছিল বৈঠা। নিশানা করে মোরল খোঁচা। টপ করে জলে পড়ল টিকটিকি—শালা। ভালতেও টিকটিক। মন্দতেও টিকটিক? খালি পেছু পেছু টিকটিক। নিকুচি করেছে তোর টকটকানির।

মহা আতঙ্কে ও ক্ৰোধে ড়ুকরে উঠল। পাঁচু, ডাকল বলে মারলি। ওরে সব্বোনেশে, ও যে নির্ঘাত কথার সাক্ষী। খনার জিভ ওর মুখে।

বলতে বলতে, রাগে ও উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে পাঁচু উঠে এল বিলাসের কাছে। যেন খুন চেপেছে চোখে।

বিলাস বলল, যার জিভই থাকুক, ও আসুক আগে জিভের আড় ভেঙে।

ঠাস করে চড় কষালে পাঁচু বিলাসের গালে। হারামজাদা! বিলাসের চোেখও জ্বলে উঠল। হাত দিয়ে গাল মুছে, খুড়োকে দেখল একবার। গায়ের পেশি উঠল কেঁপে। তারপর মাথা নিচু করে বলল, যাও, কাঁড়ারে গে বসোগে।

পাঁচু ওইখানে দাঁড়িয়েই শক্ত হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আবার হঠাৎ বুকের কোথায় বড় কাঁপন ধরে যায়!

কাঁপতে কাঁপতে গেল কাঁড়ারে। বলিরেখা-ভরা এবড়ো খেবড়ো গাল দুটি ভেসে গেল জলে।

শাঙনে টোটা কারসাজি করছে, শান্ত হও পাঁচু। সংসারের গাঙে ঝড় উঠেছে। তোমার জীবন, ঘর-গেরস্থি, সব কিছুর খুটা আসছে উপড়ে। শান্ত হও, বিলাসকে ধরা যাবে না। আর তোমার হাত দিয়ে। শমন ওকে চালাচ্ছে। সর্বনাশের মায়া ওকে দিয়ে নতুন খেলা দেখাচ্ছে। ও উজানে যেতে চায়।

কিন্তু বুক বড় টাটায় মুখ-নিচু বিলাসের দিকে চেয়ে। তুই উনো পেটে থাকিস, দুনো খাঁটিস। পশ্চিমের উঁচু পাড়ে বাতি জ্বললে, কথা শুনলে, মাঝ নদীতেও একবার চমকাস। মালোর আইন আর মান ছাড়া তুই আর কিছু মানতে চাসনে।

কিন্তু মরণ ঘুরছে চারদিকে, বিলাস কেন শান্ত থাকে না এখন। বউঠান, তোমার পা খুঁটে এক চিমটি ধুলো বাতাসে ছিটিয়ে দিয়ো। মাকড়াটার গায়ে এসে পড়ুক।

 

কিন্তু এই খেপি গঙ্গার বুকে, বিলাসও খ্যাপা হয়ে উঠেছে যেন। অঘটন ঘটল একটা। তাকে চৌদোগুণ করলে বিলাস।

কেদমে পাঁচুর ছিল চল্লিশ-হাত খুঁটে জাল। জাল ফেলেছিল। পশ্চিমপার ঘেঁষে, কাঁকড়ার নোঙর দিয়ে গেথে। জোয়ারের বেলা। জালের উপরে ভাসছে ছোল জলের মানুষকে দেখাবার জন্যে। দেখে যাও।

পশ্চিমের মহাজনি নৌক আসছিল বারো-দাঁড়ি। পোল্লায় হাল। আসছিল জাল-বরাবর। দেখে কেদমে চেঁচালে, এটুস বেঁকে যাও মাঝি ভাই, তোমার হালে ঠেকবে।

মাছমারার দুঃখ সে বোঝে না। ওই জালে যে মাছমারার প্রাণ ড়ুবিয়ে বসে আছে, জানে না সে।

বেঁকতে গেলে বিশ হাত বেঁকতে হবে, সময় যাবে। চালিয়ে যাও।

কেদমে চেঁচাতে লাগল, বেঁকে যাও, ভাই, বেঁকে যাও।

আসছে দক্ষিণ থেকে। জোয়ারের টানে, সে আর বাঁকে? দিলে ভাসিয়ে। শুধু দেখা গেল, জালের ছেলে চলেছে ভেসে মহাজনি হালের সঙ্গে। তলারটুকু আর বুঝতে বাকি থাকে না।

মাছমারার প্রাণ। একখানি খুঁটে জাল, দাম তার দুশো আড়াইশো প্ৰায়। অতল জল থেকে লাফ দিয়ে উঠল, খুটে জালের কাঁকড়ার গুড়ো, অর্থাৎ লাঙলের মতো জালের মস্ত নোঙ্গর। মাটিতে গেঁথে থাকে। সে।

কেদমে চেঁচিয়ে উঠল, দিলে দিলে আমার সর্বনাশ করে।

সেই সময় মহাজনির নৌকার সামনে, পাঁচুর নৌকা। গলুই থেকে লাফ দিয়ে উঠল বিলাস মহাজনি নৌকার কানায়। হাতে বৈঠা। — শালা, পাণে মারছ?

–বিলেস, নেমে আয়, নেমে আয়।

বারো-দাঁড়ি উঠল মারমার করে। পাঁচু দেখল, বিলাসের বৈঠা কাকে আঘাত করল মাথায়। —হেই রাম রাম।

এক মাঝি পড়ল জলে। —আয় শালা, মাছমারার প্রাণ খাবি।

বিলেস লাফিয়ে পড়ল। হালে। জলে পড়ল দুজনে জাপটাজাপটি করে।

-বিলেস!—

জোয়ার চলেছে ফুলে ফুলে। মেঘ ডাকে গুরু শুরু। গঙ্গা হাসছে নিঃশব্দে ফুলে ফুলে। যাবৎ মাছমারার নৌকা আসছে ঘিরে চারদিক থেকে।

বিলেস। এ কীসের আগুন তোর বুকে। সংসারে আছে কত অধৰ্ম, পাপ, অন্যায়। সব জায়গায় তো তুই পারবিনে ঝাঁপিয়ে পড়তে। চিৎকার করে ডাক দিল সে, বিলেস!

ওই, ওই দেখা যায়, দুটি মাথা ভেসে চলেছে উত্তরে। একজন পালাচ্ছে, একজন ছুটছে পিছে পিছে। ছুটছে বিলাস।

-ওটা কে?

-বিলেস।

-আমাদের তেঁতলে বিলেস?

–হ্যাঁ।

ছুটিল দুটি বাছাড়ি। গিয়ে তুলল দুজনকেই। মহাজনি নৌকার হালমাঝি সুদ্ধ। তার আগে যেটা পড়েছিল জলে, তাকে তুলেছে কেদমে নিজের নৌকায়।

কে জানে, কোনও বেআইনি মাল ছিল। কিনা নৌকায়। পুলিশ ডাকাডাকি করলে না তারা। পঞ্চাশ টাকা দিল কেদমে পাচুকে।

টাকা হাতে নিয়ে, মরদবুড়ো কেদমে পাঁচু হাঁটুতে মাথা গুঁজে যুঁপিয়ে উঠল। বলল, এ জীবনে আর খুঁটে জাল এতখানি করতে পারব না। আমি।

খবর শুনে গোটা পশ্চিম আর পুবপারের সবাই একবার পাঁচুর কাছেই বৃত্তান্ত জেনে গেল। বিলাসকে বলল, যথার্থ কাজ করেছ, খুব ল্যায্য হয়েছে।

দামিনীও এল, হুতোশ নিয়ে। কী নাকি হয়েছে? দাঙা হয়েছে নাকি? শোরগোল পড়ে গেছে। দেশময়।

লোকে দেখে এক জিনিস, বলে এক কথা। বিলাস দেখে আর। দেখে, দিদিমার সঙ্গে নাতনি আসেনি।

দামিনী সব শুনে ফিসফিস করে বলল, মনে আছে পাঁচুদাদা তোমার দাদার কথা?

মনে আছে। বইকী! এ রকম ভাবে জাল ছিড়েছিল আর একবার এক মহাজনি নৌকা। মাল ভরতি তাদের নৌকা। যাবে মুর্শিদাবাদ। নৌকায় লোকও অনেক। ভাটা পড়ে গিয়েছিল, জাল ছিড়ে বেশি দূর যেতে পারেনি। নোঙর করে রইল মাছমারাদের বুকের ওপরেই।

রাত তখন কত, আন্দাজ নেই পাঁচুর। দেখল, চিতাবাঘের মতো দাদা নিবারণ নৌকা থেকে জলে নামছে। নিঃশব্দে নেমে চলে গেল। মনে হল, একটা সাপ যাচ্ছে একেবেঁকে। তারপরে কোথায় অদৃশ্য হল।

ফিরে যখন এল, তখন চোখ লাল কোকিলের মতো। পাঁচু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিছিলে?

জবাব দিলে, রাত বোধহয় কাবার হল। এক ছিলেম তামাক সাজ দিনি পেচো।

একটু পরেই মহাজনি নৌকা থেকে চিৎকার উঠল, গেল গেল, ড়ুবে গেল। ভোররাত্রে সে নৌকা ভরাড়ুবি হল। আপনি আপনি ড়ুবে গেল জলে। তলার কাঠ খসে গেছে। শুধু প্ৰাণে বেঁচেছিল মানুষগুলি।

হুশ করে নিশ্বাস পড়ে দামিনীর। বিলাসের দিকে তাকায়।

পাঁচু বলল, কিন্তু বড় ভয় করে দামিনীদিদি।

দামিনী যেন চমকে উঠে বলল, করে বইকী দাদা, খুব ভয় করে। তোমার ভাইপোকে একটু সামলে সুমলে রাখো।

বলে আর একবার বিলাসের দিকে তাকিয়ে চলে গেল।

নাতনির কথা আর জিজ্ঞাসা করে না বিলাস।

 

পরদিন সন্ধ্যায়ও শূন্য ভাটা গেছে। মন আর মানছে না। পাঁচুর শরীরটা বড় ভার ভার লাগছে। চোখ দুটি বুজে আসছে যেন। মাথাটাও টিপটপ করছে। বলল, বিলেস, জলটা তুই নে আয়, আমি পারছিনে। ]

টেপা-কলে জল আনতে গেল বিলাস। কোনওদিকে না তাকিয়ে হাতল টিপতে গিয়ে, কানে এল হিমির গলা। দামিনীকে বলছে, এটু দেখে আয় মাছ পল কিনা।

—দেখব। আর কী। জানি পড়েনি। পরশু দশ ট্যাক ধার দিয়েছি পাঁচুকে। শুনি, তাতেও এক বেলা খেয়ে থাকছে। এমন জীবন মানষের হয়।

—তবু যা একবার দি-মা।

—কেন বল তো? তোর সেই ছোঁড়াকে দেখতে মন করে তো, নিজে গিয়ে দেখে আয়।

—মরণ তোর দি-মা। কী যে বলিস। মন করলে তো যেতুমই, সে কি তোর কথার জন্যে বসে থাকতুম।

দিদিমা আপন মনেই বকবক করে চলল, আর কী ডাকাবুকো ছেলে বাবা। মহাজনি লৌকোয় উঠে মাঝি ঠ্যাঙায়?

হিমি বলল, বেশ করেছে। খুন করল না কেন?

তারপর চুপচাপ। রাতের ঘোর নেমেছে। আ কপাল, বিলাসের কল টেপা বন্ধ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি কল টিপল। আশেপাশে নানান গলা শোনা যায়। ভাঙা হারমোনিয়ম হাঁপাচ্ছে যেন কোন ঘরে।

বিলাস দাঁতে দাঁত টিপে হাতল টিপছে। তার পিছনে হিমির বাড়ির দরজা।

জল ভরার আগেই, সেখান থেকে শোনা গেল হিমির গলা, কে হে? গঙ্গার মাঝি নাকি?

শক্ত করে কলসি ধরল বিলাস। পড়ে না যায়।

সামনে আসতে আসতে বলল, কে? কথা নেই যে মুখে।

পরমুহূর্তেই অস্ফুট গলায় বলে উঠল, ঢপ!

বিলাস বলল, না, তোমার কত ঢপ আছে। বলে হনহন করে এগিয়ে গেল।

কালো মূর্তির অন্ধকার ছায়ায় ছায়ায় তরতর করে এগিয়ে গেল হিমি। —শোনো, ঢপ, ওগো ঢাপ শোনো।

বিলাস থামল না। হিমি বললে, মাইরি বলছি, মাথার দিব্যি দেব। দাঁড়াও একটু। একেবারে আমগাছের গোড়ায় এসে দাঁড়াল বিলাস।

হুঁ। যা ভেবেছি তাই। হারামজাদা আবার ডেকে নিয়ে এসেছে ছুড়িকে। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়ার চাঁদ উঠেছে। ওই যে দেখা যায়, কালো ছায়ায় গোরা মেয়েমানুষ।

হিমি দাঁড়াল বিলাসের কাছে এসে। বলল, রাগ করেছ ঢপ?

বিলাস বলল, তুমি মহারানি, আমি মাছমারা। তোমার পরে কখনও রাগ করতে পারি।

হিমি আরও কাছে এল। বড় সুবাস তার গায়ে। এই হাতে পায়ের হাজায় পোকা, পোক-বিড়বিড়, আশটে গন্ধ গায়ের কাছে মানায় না। এই গহনা-পরা মেয়েকে। বলল, ঢপ, বড় রাগ করেছ তুমি।

বিলাস বলল, মাছমারারা মানষের পরে রাগ করে না। যার পরে করে, তাকে দেখা যায় না। এ সোমসারে। আমি যাই।

–না, দাঁড়াও। হিমি হাত ধরল। বিলাসের।

কী ভারী গোন গো আগনার মুখে! সে যে প্রলয়ের মুখে বান হয়ে আসে ছুটে। বুকের মধ্যে বড় পুবে সাঁওটার ঝড়।

হিমির চোখে জল এসেছে। বলল, ঢাপ, আমি অজাতের মেয়ে, বড় দুঃখু পেয়েছি। এই মানুষের সোমসারে। ভেবেছিলাম, আর নয়। সোমসারে নেই মনের মানুষ, থাকব একলাটি। মা আমার রাঁড় ছিল। কিছুটাকা-পয়সা আছে, কেটে যাবে। কিন্তু–

জোয়ারের চাপা কলকলনি শোনা যায়। বিলাস বলল, মহারানি বলো।

হিমি বলল, ঢপ, দোহাই তোমায়, মহারানি বোলো না। তোমার ওই কুচকুচে কালো রং। পেখমদিন দেখে ভয়ে বাঁচিনে। মনে হল, এমন মানুষ দেখিনি কখনও। আমার ঠেকারে ঠেকারে কথায়, তোমার কালো চোখে আগুন দেখলুম। আমার আরও ভয় হল। আবার না এসে পারলুম না সেই ভয় কাটাতে। কে, একী ভয় ধরিয়ে দিলে আমার মনে?

—কোথায় তোমার ভয় ধরালুম?

-কেন আমার বুকে।

-কীসের ভয়?

—আমার একলা থাকার সাহস হারিয়ে গেছে। ঢাপ, তুমি মাছ মেরে খাও, আমি খাব বেচে। কিন্তু এ কী করলে তুমি আমার। আমি যে থাকতে পারিনে।

-মহারানি, তবে গে দোকলা হও।

কাছে লেপে এল হিমি।

ছেউটি গাঙের জল কুল ভাসালে গো। দুহাত দিয়ে বিলাসের কালো কুচকুচে পেশল হাতখানি জড়িয়ে ধরল হিমি। আগনা টুল ডাঙা।

জন্মের নেই ঠিক-ঠিকানা হিমির। প্রথম থেকে জীবনে দেখেছে, বেপরোয়া উশৃঙ্খলতা। নিজেকে পারেনি বাঁচিয়ে ফিরতে। অনেক টানাপোড়েন গেছে। জীবনে কোনও বাধানিষেধ দাঁড়ায়নি মাথা তুলে। প্রেম করতে চেয়েছে, চেয়ে ঘৃণা করেছে বেশি।

সেই আড়ষ্ট প্ৰাণের আড় ভেঙেছে আজ।

বলল, ঢপ, মহারানি যদি বললে, মহারানির মান রাখো।

—কেমন করে, বলো?

—আমার ঘরে এসে বসো, দুটি কথা বলি প্ৰাণ খুলে।

বিলাস তাকাল জলের দিকে। জোয়ার এসেছে। চারদিকে শ্রাবণ্যে টোটার করাল হাত ফিরছে। গঙ্গায়। বলল, মাছমারার কাজ শেষ করি, তা পরে আসব।

— আসবে তো?

–যদি তাড়া না দেও।

বিলাসের প্রকাণ্ড কালো বুকে, ছোট্ট একটি তারার মতো হিমি মিটমিট করে জ্বলে উঠল নিঃশব্দ হাসিতে।

নৌকায় উঠে, কলসি রাখতে না রাখতে, সামনে জ্বলে উঠল লোলচর্ম গর্তে দুটি জ্বলন্ত চোখ। পাঁচু সাংলো তুলে মোরল বিলাসকে সলির ঘা। সপাং সপাং করে মারল।

—পাপ! তোর পাপ ডেকে এনেছে। এই শাঙনে টোটা।

বিলাস সাংলোর ব্যাকারি কেড়ে নিয়ে ফেলে দিল গলুয়ে। বলল, টোটা তোমার জলে, কানা জল, পাপ তার নিজের চোখের।

—হারামজাদা, মাকে গাল দিচ্ছিস তুই।

—মা হলে যদি, তবে গাল খেতে হবে।

–খেতে হবে?

—হাঁ খেতে হবে। মুখ বাইড়ে গাল দিতে যাব এবার সমুদ্রে।

—সমুদ্রে?

-হ্যাঁ। পাঁ

চু দেখছে, মরণ ঘুরছে চারিদিকে। পাহাড়ে ঢলে মহাকাল নেমেছে জগতে। নেমেছে বিলাসকে বাহন করে। এই মহিষমূর্তি, যমের বাহন।

 

জোয়ান কোটালের ভারী গোনে, পাক দিয়ে গেছে। মরা কোটাল। উত্তরের কনকননি তলে তলে থাবা বাড়িয়ে গেছে মোহানায়। দরজা বন্ধ করে বসে আছে সমুদ্রের।

সয়ারাম ভাল করে কথা বলে না বিলাসের সঙ্গে। রাগ করে নয়, এখন কারুর মুখেই কথা নেই। খালি ঠাণ্ডারাম দেখা হলে পাঁচুকে বলে, পাঁচদা, বাড়ি চলে যাব গো! আগে জানলে এবারে ক্ষেতমজুরি করতাম।

-ফিরে গে কী করবে ঠাণ্ডারাম?

—হাসানাবাদ না হয় কালীনগরে গে হাটের দিনে লৌকোয় মাল টানলেও কিছু রোজগার হবে।

–তা হবে। কিন্তু পালমশাই ছাড়বে তো!

-ছাড়তে চায় না। বলে, যেতে চাও, লৌকো রেখে যাও। কীসের বিশ্বেস তোমাদের। ফিরে গে লৌকো বেচে দে। যদি দূর আবাদে চলে যাও, ত্যাখন আবার খুঁজবে কেটা।

পাঁচু ভাবে, তাও মিথ্যে নয়। মাছমারার জীবনে এমনটিও হয়েছে। নিরুপায় মানুষ তার সব বেচে দিয়ে, বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে চলে গেছে দূর বান্দাবনে।

ঠাণ্ডারাম। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলে, আজ এই পর্যন্ত সারাদিনে কিছু খাইনি পাঁচদা। মহাজন বলেছে, রাতে কয়েকটা ট্যাক দেবে। দিক, আমি পালাব, তোমাকে বলে রাখলুম।

পালাতে চায় ঠাণ্ডারাম। এটা জেলখানা নয়, সত্যি সত্যি আর কেউ বেঁধে রাখেনি। গঙ্গা

পুব আকাশে আধখানি চাঁদ উঠেছে। ক্ষয় হয়েছে অনেকখানি। মরা কোটালেও ভাটার টান বড়  জোর। যত দিন যায়, হাতের জোর বোধ হয় কমে। টানের জোর বেশি মালুম দেয় হাতে।

পাঁচু-বিলাস গড়ান দেয়। ঠাণ্ডারাম ফিরে আসে। একটু বাদেই একটা চিৎকার ভেসে এল, গেল, গেল, গেল!

—কে গেল, কী হল?

খুড়ো-ভাইপো জাল তুলে ফেলল, নৌকা ফেরাল উজানে।

—জেটিতে লৌকো ঢুকে গেচে।

-কার হে?

—ঠাণ্ডারামের।

ঠাণ্ডারামের? চারটি নৌকা ছুটে গেল জেটির কাছে। গোটা কাঁড়ারখানি মচকে ভেঙে আটকে রয়েছে জেটির লোহার জালে।

বিলাস চিৎকার করে উঠল, কাঁড়ারে কে ছেলে?

—ঠাণ্ডারাম।

–তবে সয়ারাম কমনে গেল?

সকলে তাকাল দক্ষিণে। দূরে ভেসে যাচ্ছে কে ছাঁই আঁকড়ে ধরে।

কে বলে উঠল, আ সব্বোনাশ, উদিকে পানে সেই আওড়টা আছে। দিয়ে ড়ুববে যে গো?

দুটি নৌকা ছুটিল তীরবেগে দক্ষিণে।

বিলাস বলল, খুড়ো, লৌকো বাঁধো জেটির গায়ে।

থরথর করে কাপে পাঁচুর হাত। এই কতক্ষণ আগে না ঠাণ্ডারাম পালাতে চেয়েছিল। এমন পালানো আর হয় না। পাঁচু দেখল, গঙ্গার স্রোতের বাঁকে তরঙ্গে তরঙ্গে মীনচক্ষুর ছড়াছড়ি। বড় চকচক করে। কিন্তু নৌকা কেন বাঁধতে বলে বিলাস।

নৌকা বাঁধল। বিলাস জেটির রেলিং ধরে নামল জলে। অন্য নৌকার আর-একজন মাঝিও নামল। দুজনেই পা ড়ুবিয়ে ঠাহর করছে, মানুষ পাওয়া যায় কিনা।

জলের বড় চাপ এখানে। নীচে থামের গা থেকে, জল পাক খেয়ে উঠছে, ঘূর্ণি হয়ে যাচ্ছে। যেন টেনে নিতে চায়। একড়ি ঢলে জল নামছে আর যেন খলখল করে হেসে বলছে যা যা, মুখের খাবার কেড়ে নিসনে। পালা, পালা!

—পেয়েছি।

–পেয়েছ?

—হাঁ। ড়ুব দিয়ে উঠে বিলাস বলল, দুটো ডাণ্ডার ফাঁকে মাথাখানি আটকে রয়েছে।

বলে আবার ড়ুব দিল বিলাস। উঠে বলল, অ্যাটটা দড়ি দেও দি নি।

দড়ি নিয়ে ড়ুব দিল। নিশ্বাস বন্ধ করে টানা স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকে পাঁচু। মরণের কাছে বিলাসের ঘোরাফেরা। ভুলে যাসনি, আমি তোর আশায় বসে আছি। এখানে।

দড়ির এক অংশ নিয়ে আবার উঠল বিলাস। বলল, দড়ি দে বেঁধেচি। দড়িটা ধরে থাকো একজন, মাথাটা ঠেলে দিই। আমি।

এক সঙ্গে উঠল জ্যান্ত বিলাস আর ঠাণ্ডারামের মড়া। মাথা ফেটে চৌচির। জলের এত টানেও সব রক্তের দাগ মুছে দিতে পারেনি।

কে একজন বলল, কেমন করে হল? টেনে নিল কী করে?

কেমন করে আর। পেটে ভাত ছিল না। না থাকলে, শমন গিয়ে এমনি করে ডেকে নিয়ে আসে।

আ মারি মা গো গঙ্গা, তবু তোর কী কলকল হাসি। যেন মহা নাগ-নাগিনীর শঙ্খ-লাগা মদমত্ততায় পাক খেয়ে এঁকেবেঁকে চলেছিস। সংসারের মানুষ মহাত্ৰাসে ইষ্ট জপ করে।

পালমশাইয়ের মুখ দেখে বোঝা গেল, মশায় বড় বেকুফ হয়ে গেছে। মুখখানি গেছে শুকিয়ে। অনেক পাওনা ছিল ঠাণ্ডারামের কাছে। খালি বলল, এরা আসে বা কেন, মরে বা কেন।

তা বটে। সংসারে মানুষ আসে কেন, কেন বা মরে। উজান ঠেলে সমুদ্র থেকে মাছ কেন আসে, মরে কেন, ভাবো একবার। সাধু-ফকিরের কথা জানিনে। জীবনের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছি আমি, আমি তার প্রেমে পড়েছি। তাই না জীব-ধৰ্ম আমাকে পালন করতে হয়।

ঠাণ্ডারামকে শ্মশানে পুড়িয়ে ফিরল। সবাই। পাঁচু ভাবে, কিন্তু আমার শরীর যেন আস্তে আস্তে টিল দিচ্ছে। ক্ষয়া-চাঁদ আসে আকাশের মাঝে মেঘ ঠেলে ঠেলে। আগনার জলে কীসের বাতা আসছে দক্ষিণের।

অ বিলেস, তুই কেবলি উঁচু পাড়ে যেতে চাস। যেন মহা নাগ-নাগিনীর শঙ্খ লাগার আশায় বড় উথালি পাথালি আনমনা তোর প্রাণী। কিন্তু ওরা মায়াবিনী। ডাকিনীর ছলনা। ওরা ভালবাসে না।

বিলাস ডাকল, অ খুড়ো।

–অ্যাঁ।

—আমন কঁকাতে লেগেছ কেন?

—হাত দুখান বড় শুলোয় রে বিলেস। মাংস দগদগ করে। পেটটাও যেন কেমন ব্যথা-ব্যথা লাগে।

বিলাস উঠে এল খুড়োর কাছে। বাঁশ-ফালির পাটাতন সরিয়ে গাবের আঠা বের করে, তিবড়িতে চাপিয়ে গরম করে নিল। তারপর মাখিয়ে দিল খুড়োর দুই হাতে। কিন্তু পোকাগুলি মানে না। ভিতরে দাপাদাপি করে।

বিলাস বলল, খুড়ো, সাংলো বাওয়া ছাড়ো তুমি, হাত দুখান যে ছিঁড়ে যাবে।

তোর প্রাণটা, তবে টাটায় রে খুড়োর জন্যে। হাঁটুর উপর হাত দুখানি নিয়ে এমন করে গাবের আঠা মাখাস, মনে হয় মায়ায় ভরা তোর বুক। শুধু কাজে ঠাহর পাইনে। বলল, বিষয়ে মাছমারার হাত আমন হবেই। তা বলে জাল ফেলা বন্ধ রাখব কেমন করে? মরে যাব না?

খুড়োর হাত দুটি ছেড়ে দিয়ে মুখ ঝামটা দিল বিলাস, মলেই হল আর কি, না?

মরতে দিতে চায় না বিলাস। এবার মীনচক্ষুর হাসি পাঁচুর চোখে চিকচিক করে। কথা শুনে বুকের মধ্যে হাসি-কান্না, দুইয়েতেই ওঠে ভরে। তবে আকাশে আমন বিদ্যুৎ-চিকচিক হাসি কীসের। ও হাসিটা চিনতে পারে না বিলাস।

বড় একটি নিশ্বাস ফেলে পাঁচু বলল, যাই, দামিনীদিদির কাছে একবার ঘুরে আসি।

–কেন?

—চাল যা আছে, তাতে আর একটি বেলা চলবে। হাতের নগদ ট্যাকা। সব ফুরিয়ে গেল। পালমশাইও হাত উপুড় করবে না, বোঝাই যাচ্ছে।

পাঁচু উঠে গেল। জোয়ার এখনও আসেনি। আসবার মুখে। পিছল কাদা ঠেলে ঠেলে পাঁচু যায়। মনে হয়, বিলাসের চোখ দুটি তার পিছে পিছে আসছে।

দামিনীর বাড়িতে ঢুকতে বড় সঙ্কোচ হয়। বেচুনির বাড়ি, পরিবেশ অচেনা লাগে। তবে অনেকবার যাওয়া-আসা হয়েছে, ভয় কমে গেছে।

বাড়ি ঢুকে দেখল, একটি ঘরের দাওয়ায় লম্ফ জ্বলছে দাউ দাউ করে। চারটি লোক বসে বসে তাস খেলছে। এরা দামিনীর ভাড়াটে। আগে মেয়েমানুষ ভাড়া থাকত। নাতনি তুলে দিয়েছে।

পাঁচু ডাকল, দামিনীদিদি আছ নিকি গো?

জবাব নেই। লোক চারটেও ফিরে তাকায় না। লম্ফর আলোয় ভূতের মতো মাথা গোঁজ করে খেলে যাচ্ছে। ওদিকে কোথায় রান্নার ছ্যাঁত্ ছ্যাঁত্ শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

আবার ডাকল পাঁচু, দামিনীদিদি আছ?

—কে?

বলতে বলতে, আচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল নাতনি। বেগতিক দেখল পাঁচু। বলল, দামিনীদিদি কমনে গেল?

নাতনিকে বেশ হাসিখুশি দেখা গেল। রূপখানি তো আছে। তার উপরে কালিন্দী আর রাইমঙ্গলের মোহনার হ্যাঁকা লেগেছে। শরীরে। বলল, ওমা, খুড়ো এসেছ? এসো, এসো, দাওয়ায় উঠে সে বসো।

বলে বেড়ায় গোঁজা একখানি চটের আসন পেতে দিল। হ্যাঁ, পাঁচুর বুকের মধ্যেটা যেন খুশি ও সম্মানে কেমন উপচে উপচে পড়ে। মেয়ে সবাহত জানে খুব। খুড়োকে খাতিরও করছে বেশ।

তবু পাঁচুর সঙ্কোচ। মনের মধ্যে ঘোর আতঙ্ক। মায়াবিনী মেয়ে সে। কিন্তু উঠে বসতে হয়। তবে, হিমি যেন ভাল করে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। পাঁচুর দিকে। গায়ে কাপড় একটু বেশি করে গোছাচ্ছে। জিজ্ঞেস করল, কী মনে করে খুড়ো?

সে কথা নাতনিকে বলবে কেমন করে পাঁচু। হয়তো বলতে হবে একদিন। কিন্তু প্ৰথমবার টাকা চাওয়া, দামিনীদিদি মাঝখানে না থাকলে চাওয়া যায় কেমন করে। বলল, কথা এমন কিছু নয়। আসুক দামিনীদিদি, তা পরে বলবখনি। এখন যাই।

হিমি হঠাৎ ঘরে ছুটে যেতে যেতে বলল, না, যেয়ো না খুড়ো, আমি শুনব। রান্নাটা নামিয়ে আসি।

একটু পরেই ফিরে এল হিমি। বলল, আমাকে বললে হবে না খুড়ো?

–সে দামিনীদিদি তোমাকে বলবে মা।

হিমির মনটা আনচান করে উঠল। কী বলবে খুড়ো দিদিমাকে। হিমির কথা নাকি। বলল, তুমিই বলো খুড়ো, তোমার মুখ থেকেই শুনি।

পাঁচুর লজ্জা করে, ভয়ও করে। তবে মহাজন বলে কথা। তা ছাড়া, এখন থেকে তো নাতনির সঙ্গেই কারবার হবে। মুখ কাচুমাচু করে বলল পাঁচু, পালমশাই তো কিছু করবে না মা, তাকে কিছু বলাও যাবে না।

হিমি বলল, পালমশাই কে?

–আমাদের গাঁয়ের মহাজন। ইদিকে, কাল সকালে খাবার মতো চাল আছে। তোমাদের ট্যাকা অবিশ্যি আমার শোধ দেওয়া হয়নি। সব। কিন্তুন শোধ দিতে হলে, দুটি পেটে না দিলে তো চলে না।

পাঁচুর আধ-ফোগিলা মুখে বড় করুণ হাসি। বুকের মধ্যে আকুপাঁকু করে। কী বলে নাতনি। হিমির মুখে ভাবনা দেখা দিল। বলল, তোমাদের তো হাতে করে কখনও ট্যাকা দিইনি, আমার খেয়াল ছিল না। ট্যাকা কিছু ছিল, একজনকে দিয়ে দিয়েছি। তার ঘর ছাওয়া দরকার, বিষায় তার চালাটি গেছে।

দুরু দুরু করে উঠল পাঁচুর বুক। হিমি হঠাৎ উঠে দাঁড়াল।

পাঁচু বলল, কমনে যাও গো?

–এই আসি একটু। মহাজন বলো আর যাই বলো, মেয়েমানুষ তো। শুনে চুপ করে থাকি কেমন করে? ও পিসে।

দাওয়ায় খেলার আসর থেকে একজন উঠে এল। তাকে কী বলে কোথায় পাঠালে হিমি। তারপরে বলল, খুড়ো, তোমাকে যেন নিজকুম নিজকুম লাগছে।

পাঁচু বলল, হ্যাঁ, শাঙনে টোটা পড়ে গেল গো। তার উপরে শরীলটাও ভাল বুঝিনে।

হিমি বলল, জলে জলে থাকা। দু-দিন ডাঙায় বসে বিশ্রেম করো খুড়ো। বয়স হয়েছে তো।

হ্যাঁ, মনটা নাতনির ভাল। মায়াবিনীর ছলনা নয় তো। লাখ টাকার মানুষ ফেরায়, তার মন মাছমারা বুঝবে কেমন করে। তবে কথাগুলি ভাল লাগে। বলল, মাছ মারি মা, যাতেক্ষণ বসে রয়েছি, তাতোক্ষণ শুয়ে থাকতে পারব না। বিদেশে বিভুঁয়ে তুমি যে বললে এইটুকু, সেই আমার অনেক গো মা।

হিমি বলল, শুধু বলা কেন। মহাজন হলেও মানুষ তো। থাকো না দুদিন এসে।

আ বিলেস, দ্যাখ, আমাকেও ফাঁদে ফেলতে চায় শহরের ফড়েনি। মাছ মেরে খাই আমি, এ কথায় আমি ভুলতে পারব না। তার মিষ্টি স্বভাব তার কাছে থাক, আমি যেন মাছমারা থাকি। বিলাস, তুইও থাকিস। এ জলের বড় টান।

পাঁচু খুশি হয়ে হেসে বলল, শাঙনে টোটা কেটে গেলে অসুখ আমার আপনি সারবে গো। সে ভাবনা কোরো না। তোমার ভাগ্যি নে মা গঙ্গা পরান খুলুন তা হলেই বাঁচি।

হিমি হেসে উঠল। বলল, আমার পোড়া ভাগ্যি।

বলে নাতনি গম্ভীর হয়ে গেল। পিসে এসে হাতে টাকা গুঁজে দিল তার। দিয়ে পাঁচুকে একবার দেখে চলে গেল।

হিমি টাকা গুনে দিল পাঁচুর হাতে, এই নাও, কুড়ি ট্যাকা। এর বেশি পারলুম না এখন।

টাকা পেয়ে পাঁচুর বুকে বাতাস লাগল। বলল, এইতেই হবে মা এখন, পোড়া পেট মানবে কটা দিন। যাই, ছোঁড়াটা একলা বসে আছে।

পাঁচু চলে গেল। মন বলে, নাতনির চোখ দুটি যেন পিছে পিছে আসে। আসবার সময় যেমন বিলাসের চোখ দুটি এসেছিল। তা আসবে। রাইমঙ্গল আর কালিন্দী মেশে, ঝিল্পে আর বিদ্যোধরী। মেশে। টানে টানে মেশে। তার ঘূর্ণিতে পড়ে কে মরে, সে খোঁজ তারা রাখে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *