০৪. এ আষাঢ়ে রাত নেমেছে

এ আষাঢ়ে রাত নেমেছে এখন পুবের ধলতিতা বীরপুরেও। এখানে জাগে মাছমারা এই গঙ্গার বুকে। ঘরে জাগে বউ-ছেলে মেয়ে-মায়েরা। ঘুম কি আছে। পুরুষ নেই ঘরে, বাপ নেই, ছেলে নেই। ঘুম-ঘুম বুক ছাত করে ওঠে। কে জানে, কোন অকুলে ভাসছে এখন তারা।

যখন যাবৎ সংসার ঘুমোয়, তখন মাছমারার বউঝিয়েরা জাগে। এইটা নিয়ম। তারা জাগে বারোমাস।

বর্ষার মরশুম যায় চার মাস। আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন। মাছমারা তখন অমাবস্যা-পূর্ণিমার, জোয়ার-ভাটার গোন-কোটালের পিছে পিছে ভেসে বেড়ায় গাঙে-নদীতে।

বউ তার ঘুমন্ত সন্তান বুকে নিয়ে জাগে ঘরে। অন্ধকারে দু চোখ মেলে সেও ভেসে বেড়ায় ঘরের মানুষের সঙ্গে সঙ্গে। এ বিধির বিধান নয়। বিধি দেয় রাত আর ঘুম। এই ঘরনি জাগে পোড়া প্ৰাণের বিধানে।

নদীতে পুবে শাওটার ঝড় বয়। বউ এক ঘরে শুয়ে বুকে চাপে দীর্ঘশ্বাস। অমন নিশ্বাস ফেললে অকল্যেণ হয়। নিশ্বাস চেপে সে শুধু প্রহর গোণে।

গাঙে বৃষ্টিতে ভেজে মাছমারা। বউ অন্ধকার ঘর থেকে আচলের ঢাকা দেয়। তবু নৌকার মানুষ জলে-ধোয়া হয়ে যায়। সে ধরে রাখতে পারে না।

তাই তোমার প্রাণ পোড়ে। কেন, না, তুমি মাছমারার বউ।

যখন মীনচক্ষু উত্তাল তরঙ্গের বেশে, ঘূর্ণির ছদ্মবেশে, ঝড়ে রুদ্র দাপটে ঘিরে ধরে মাছমারাকে, তখন ঘরে জাগে সতর্ক দৃষ্টি। মীন যাকে ছিনিয়ে নেবে নদীতে, তার প্রথম হ্যাঁচকা লাগবে এই ঘরে।

কেন? না, সে মাছমারার বউ। তার জন্যে বাঁচে, তার জন্যে মরে।

বর্ষার চার মাস কাটিয়ে যদি গাঙের মানুষ, চাকুন্দে মাকুন্দে খয়রার ফেরে কাটিয়ে আসে কাৰ্তিক, তবে পাঁচ মাস। তারপরে ঘরে ফেরে সে।

তবু বউ জাগে ঘরে। উত্তরে বাতাস বয়। জলে ধরে টান। সমুদ্রে সাই যাওয়ার সময় হয়েছে। হাতে মাত্র কয়েকদিন।

বউয়ের সারাদিন কাটে ঘরকন্নায়। মাছমারা পুরুষ, রক্তে তার আগুন। সেই আচ লাগে বউয়ের রক্তে। এইটা আগুনের ধর্ম। তখন সে মাছমারার সঙ্গে শোয়। এইটা সংসারের ধর্ম। তার পুরুষের সঙ্গে যে যাবে হাল টেনে, সেই সঙ্গীকে বউ গর্ভে ধারণ করে।

তারপর রাতভর বউ জাল বোনে। পাটাজাল পেতে বসে কোলের কাছে। সমুদ্র যাবে পােটা জালের সাই। ছেড়া জাল সারায়, নতুন জাল বোনে। লম্ফর শিস, একেবেঁকে নাচে তার চোখের সামনে। সে জাল বোনে, আর ঘুমন্ত স্বামীকে দেখে চেয়ে চেয়ে। এ জীবন তার মাছ মারার নিয়মের জালে জড়ানো।

দেখতে দেখতে দিন কেটে যায়। সাইদারের ডাক শোনা যায়। ডাক আসে সাগরের। গাঙ, নদী, খাল, বিলের দিন পেরিয়ে, মাছমারা যাবে সাগরে। বউ বসে থাকে না।

বউ জাগে আবার। সতর্ক চক্ষু তার জাগে সমুদ্রে। নীলাম্বুধি অন্ধকারের বুকে, শাবরের আনাচে কানাচে, মাছের চকের পিছনে পিছনে, বনের অদৃশ্য দানোর সঙ্গে সঙ্গে, দক্ষিণ রায়ের পায়ে পায়ে, মা বনবিবির আঁচলে আঁচলে জাগে তার চোখ। আর তার বিনিদ্র আত্মা মাথা কোটে মাছের দেবতা খোকাঠাকুরের পায়ে। বলে, হে দক্ষিণরায়, তোমার খাড়া নজর দূরে রাখো। মা বনবিবি, মাছমারার শাবরে তোমার দৃষ্টি দিয়ে না। খোকাঠাকুর, জাল ভরে, খোল ভরে মাছ দাও। তুমিই মাছমারার দণ্ডমুণ্ডের কতা। তুমি দিলে, আমি আমার সোয়ামির হাসিমুখ দেখব, ঘরে আমার সোহাগের বান ডাকবে। আমার ছায়েরা হেসে খেলে বেড়াবে, আমার হাঁড়ি ভরে থাকবে। নতুন সুতো আসবে, নতুন জাল বুনব আমি। আমি পুজো দেব তোমাদের সকলের পায়ে।

অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্লুন। ফায়ুন পড়তে না পড়তে আসে দখনে বাওড়। সমুদ্র মেতে ওঠে নিজের লীলায়। তার ফোঁসানি গজানি দেখে মরণ আসে দুহাত তুলে।

মাছমারা ফিরে আসে। কিন্তু বউ জাগে। কেন, না, এর নাম চৈত্রমাস। কথায় বলে চৈত-টোটা। অথাৎ চৈত্ৰ-মন্বন্তর। সমুদ্রে পাওয়া কড়ি গেছে মহাজনের বকেয়া সুদ সুধিতে। দুদিন প্ৰাণ খুলে হাসতে না হাসতে হাঁড়িতে যায় টান ধরে। তখন আবার জলে। কিন্তু জল নেই জলাশয়ে। বাওড়ে-বিলে খালে। পুরনো-পাক জলে শুধু পোকা। যা পাওয়া যায়, তাতে ঘরের একবেলার পেটিও ভরে না। ঋণ বারোমাস। মহাজনেরও সময় বুঝে মেজাজ খারাপ হয়। জাল-নৌকা-ভিটে, তখন সব বাঁধা পড়ে আবার।

বউ রাত জেগে বসে ভাবে, রাত পোহালে কী ফোটাবে সে আগুনে, কী বেড়ে দেবে সামনে।

তখন মাছমারা কাপড় ছুপিয়ে সন্ন্যাস নেয়। গাজনের। বলে, জয় বাবা বুড়ো শিবেরো লাগি…

সন্ন্যাসের হাঁকের আড়ালে মাছমারার খিদের কান্না কেউ শুনতে পায় না।

নয়তো পাপ দেখা দেয়। অভাবে অ-কাজে কু-চাল ধরে মাছ-মারাকে। তখন রং, রস, পিরিত সব যায়। পাপ করে সে, পীড়ন করে ঘরের মানুষকে। তখন রাত্রি কাটে কেঁদে কেঁদে।

তারপর বৈশাখে নতুন জল আসতে থাকে, জ্যৈষ্ঠে চলে প্রস্তুতি, আষাঢ়ে আসে অম্বুবাচী।

বউ রাত জেগে আবার জাল বোনে, সারে। ঘরের খরচের জন্যে, মহাজনের সুতোও নেয়। হাত-পিছু ফুরনে বোনে জাল।

তুমি মাছমারার বউ, তুমি জাগো বারোমাস।

এইটা নিয়ম।

এখন এই আষাঢ় রাত। বি-বিীর টানা-ডাকের সঙ্গে তোমার মনেও একরকমের ডাক শোনা যাচ্ছে সর্বক্ষণ। ভাবো, কোথায় ভাসছে। ঘরের মানুষেরা।

পাঁচু ভাবে, ভাসব আর কোথায়। এ তো সমুদ্র নয়, মা-গঙ্গার কোলে এসেছি। যার পেছনে পেছনে এসেছি, সে শুধু জলের তলে নয়। সে আমার জীবনমরণ, সে মেঘে মেঘে, বজে বজে, ঢেউয়ে, দক্ষিণের বাতাসে।

 

বিলাসের হাঁকোর শব্দ থেমেছে অনেকক্ষণ। ছাঁইয়ের মুখে নিভেছেলিম্প। কাঁড়ারেই চোখ বুজে এসেছে পাঁচুর। সমুদ্রের টানে ভাটা নামছে তখনও কলকল করে। এখানে শেষ করে সে অশেষের বুকে যায়। তাই এত কথা। কানে গেল, বিলাস গান করছে। শোনো! কোথায় ভাবছে, ছোঁড়া ঘুমোচ্ছে, তা না, গান ধরেছে গলুয়ে শুয়ে শুয়ে।

আমার প্রাণে নাই সুখ–হে
বড় উথালি পাথালি আমার বুক।

ওদিকে কেদমে পাঁচুর গলা শোনা গেল, হুঁ!

ভাবখানা, বুঝেছি তোমার গানের মানে। একটু বিদ্রুপ যে আছে, তা জানে খুড়ো পাঁচু। কেদমে ভাবছে, তেঁতলে বিলেস মনে মনে দেখছে অমর্তের বউকে। তাই গান ফুটেছে গলায়।

আসলে গাঁ-ঘর ছেড়ে নতুন জায়গায় এসেছে বছর ঘুরে। তাই ঘুম আসছে না। আর অমর্তের বউয়ের কথা! পাঁচু তো জানে, ও সব সত্যি নয়। সত্যি নয়, অর্থাৎ অমর্তের বউয়ের কাছে যাবার জন্য বিলাসের প্রাণ উথালি-পাথালি নয়। বলে, সাপে মানুষকে ছোবলালে, বেশি দূরে যেতে পারে না। মানুষের বিষক্রিয়া হয় তার প্রাণে। সংসারের নিয়ম এইটি। কুড়োল দিয়ে কোপও কাউকে। তোমারও কোপ লাগবে কোথাও। কাউকে প্ৰাণে মারলে, তোমার প্রাণেও লাগবে। সে কি তুমি সব সময় ঠাহর করতে পারবে? তা পারবে না। তুমি মাছ মারো, তোমাকেও সে মারে পলে পলে। সে কি তুমি বুঝতে পারো! কিন্তু মারছে দিবানিশি। কখনও একটু একটু করে, নির্ঘাত কখনও।

সেই দুপুরে অমর্তের বউকে ছুবলে এল বিলাস। কিন্তু বিষ নিয়ে এল। সবটাই এ সংসারের বড় বিস্ময়ের ব্যাপার। এই জল, মাটি, আকাশের মতো, আকাশের চাঁদ-সূৰ্য্য-নক্ষত্রের মতো। সবাইকে তুমি দেখতে পাও, কিন্তু তার সবটুকু তুমি জানতে পারো না। কী দিয়ে অনুমান করবে। পাঁচু বিলাসের এই ব্যাপারটি।

না, এ যেন সেই হেতম পাগলার ব্যাপার ঘটল। কে নাকি ওর সম্পত্তি মেরেছে ফাঁকি দিয়ে। পাড়ার সুরীনকে দেখলেই রোজ ছুটে আসে খাঁড়া নিয়ে। এক দিন, দু দিন, দশ মাস। পাগল হোক ছাগল হোক, হাতে তো আছে খাঁড়াখানি। সুরীনের মনটা আটকা পড়ে গেল ওই খাঁড়ার ধারেই। হাসি পায়, ভয়ও হয়। একদিন খাঁড়া কেড়ে নিয়ে মারলে কষে হেতমকে। সেই থেকে হেতম আর খাঁড়া হাতে করেনি।

কিন্তু সুরীনের মনটা গেল বেজায় খারাপ হয়ে। হেতম আসেনি। আর কোনওদিন ছুটে, দুজনের দেখা-সাক্ষাৎও নেই। কী দরকারই বা ছিল তার। কিন্তু কী জ্বালা বলে। পাগল মেরে সুৱীনের মনটা গেল মুষড়ে।

বিলাসের হল যেন তাই। সবই তো শুনেছে পাঁচু ওর বন্ধু সয়ারামের কাছ থেকে। সয়ারাম বলে, খুড়ো, ভাইপো সামলাও।

–কেন রে?

না, কী যেন ওর হয়েছে।

কী হয়েছে? বলে কী?

সয়ারাম বলে, বিলাশের কেমন ভাব বেরভোম হয়েছে। চলে ফেরে, বলে, আবার থেকে থেকে চুপ মেরে যায়। কী যেন দেখে ইতিউতি। হাত ঝাড়া দেয়, পা ঝাড়া দেয়।

সয়ারাম বলে, কেন? জিজ্ঞেস করি, কী হল রে তোর বিলেস। বলে, কী আবার হবে, হয়নি কিছুই। তবে মনটা দিবানিশি কেমন যে ফসফিস করে। ফসফস করে? কেন? ওই জিজ্ঞেস করলেই চটে গেল। এই এক থাপ্পড় তুলে, ভেংচে বলবে, কেন, তা কি আমি জানিরে মাটো। জানলে তো বলতুম আগেই। ইহঁ। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলি, হ্যাঁ রে বিলেস, অমর্তের বউয়ের জন্যি তো মন আলগা আলগা লাগে না তো।

কথা বলে না। হুঁ। ওইখানেই ওস্তাদের ঘুণ ধরেছে। বলি, বল না, চুপ করে রাইলি কেন কালামুখী আবার কী তুক করল, সেটা দেখতে হবে তো। নইলে শেষে প্ৰাণে মরতে হবে। গুণিন ওঝা দেখাতে হবে তাড়াতাড়ি।

অমনি মারমূর্তি! সয়ারাম এবার মাটো ছেড়ে শালা। বলে, তোর গুণিনের ইয়ে করি। চলছি ফিরছি খাচ্ছি, কাজ করছি, কোথায় তুই আমাকে খারাপ দেখলি।

সয়ারাম বলে, কী আর বলব। চুপ করে থাকতে হয়। শুধু দশটা কথা বলে আর চড়-চাপড় খেতে পারিনে বাপু। শত হলেও বিয়ে-থা করেছি, একটা ছেলে হয়েছে। লোকে দেখলে কী বলবে। কিন্তু চুপ করেই বা থাকি কেমন করে। দেখি, ও পাড়ায় গেলে, গামালি পাঁচি ঠোঁট টিপে হাসে আড় চোখে চেয়ে। বন্ধু আমার মায়ের কোলের ছায়ের মতো হাঁ করে তাকিয়ে থাকে পাঁচির দিকে। তখন আমারই ওকে শালা বলতে ইচ্ছে করে। হয়। হাস, নইলে তাকিয়ে থাকিসনে শুধু। তেরো বছরের গামালি পাঁচি, সেও ভাবে, লোকটার হল কী? যেন নতুন দেখছে পাঁচিকে। খুঁটে খুঁটে দেখছে। তখন বলি, দ্যাখা বিলেস, এটা কথা বলব?

–বল।

—তোর প্রাণে ভাই কোনও দুঃখ আছে।

–আছে।

—আছে? তবে সেইটে কেন বলছিসনে। সয়রামকেও বলতে পারিসনে, যার কাছে তোর কিছুই

ঢাকাটুকি নেই। বলি সেটা বল।

একটু চুপ করে থেকে বলে, কাজটা ভাল হয়নি সয়া।

-কোন কাজ?

—ওই ব্যাপারটা।

বলতে পারে না মুখ ফুটে, অমর্তের বউয়ের ব্যাপারটা। গতিক তো সুবিধের নয়। তা হলে কি মেয়েমানুষটা একটা খারাপ কিছু করে দিলে। ভয়ে আমি দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করি, কী তোর মনে হয় বল দি নি।

আবার রাগ হয়ে গেল। ওই যে, দুহাতে জড়িয়ে ধরে, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেছি! বলে, আমন মেয়ে-ন্যাকড়ামো করছিস কেন?

তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলি, বল।

বলে, কাজটা আমার ভাল হয়নি।

–কেন?

—কী জানি! মন বলছে, কাজটা আমার ভাল হয়নি। হুঁ, ধরেছি। জিজ্ঞেস করি, ওর কাছে যেতে মন করছে আবার, না?

কী যেন ভাবে। ভেবে বলে, না।

না বললে শুনব কেন। বিয়ে-থা করেছি, ও বিষয়ের টান তো বুঝি। ভগবানের ওটা একটা মস্ত বড় খেলা। কত স্বাদ সৃষ্টি করে রেখেছেন সংসারে। তার শেষ নেই, সীমা নেই। এই মায়ার সংসারে বাস করো তুমি। ওই স্বাদ আসলে মায়া। প্রথম মায়া মাটি। মানুষ দূরের কথা, ইট-পাটকেলও ছুড়ে দাও উঁচুতে, ঝুপ করে পড়বে সে মাটিতে। তোমাকে সে টানে দিবানিশি। ওই টান হল মায়া। ওই মায়ার আর এক নাম স্বাদ। তুমি বাঁধা আছ ওই মায়ার বাঁধনে। সে স্বাদ মাটিতে, জলে, গাছে, মানুষে। সংসারের যাবৎ স্বাদ পেলে তুমি পুরো মনুষ্য। আর যে এই সংসারের স্বাদ পেয়েছে, সে আর তা কোনওদিন ভুলতে পারবে না।

বিলেস না বললে শুনব কেন। বলতে বন্ধুর শরম লাগছে। বলি, না কেন? যেতে মন করলে দোষ কী, আমার কাছে বল না।

চুপ করে থাকে। কী যেন ভাবে। —কী রে, বল না। আমি তো আর পাড়াঘরে বলে বেড়াতে যাচ্ছিনে। মুনি-পুরুষের মতি বেরভোম হয়, তোর কী দোষ। তুই তো আর জোরজবরদস্তি করে কিছু করিাসনি। যা করেছে, সে-ই করেছে। তবে হ্যাঁ, পোতনির দশ দিন, ওঝার এক দিন। তা কী করা যাবে। তা বলে এট্টা ভাল-মন্দ দেখতে হবে তো।

ফিসফিস করে বলি, মন করে তো যা। মন করে থাকলে ওইতেই সব ঠিক হয়ে যাবেখনি।

কথা শেষ হল না। আমার ঘাড়ে যেন লোহার মুগুর পড়ল। মারলে আমাকে। খেঁকিয়ে উঠল, বলছি তখন থে না না না, ন্যাকার কানে ঢেকে না। আমি কি তোর মুনিপুরুষ যে আমার বেরভোম হবে?

আমার লজ্জা নেই, তাই আবার বলি, তবে?

দূরের দিকে তাকিয়ে বলে, বড় ঘেন্না করছে নিজেকে।

ঘেন্না করছে নিজেকে! এ তো মনের কথা বলছে এতক্ষণে। বলি, কেন?

-কী জানি! নিজের পরে ঘেন্নায় বাঁচিছিনে সয়া। আর অষ্টপোহর আমার মন ফসফস করে।

–কেমন?

—বুকটা বড় খালি খালি মনে হয়। অমর্তের ভিটের ধারে আমার চোখ তুলে চাইতেও মন করে না। কিন্তুন আমার শরীলের কী যানো গইড়ে বেড়াচ্ছে। ওই যেমন পদ্মপাতায় জল টলমল করে, তেমনি। আমার বুকের ভিতরে ভিতরে। আমি বসতে শুতে টাল সামলে বেড়াচ্ছি। আমার মন, আমার শরীল যেন কে বেঁধে রেখেছে। আমার কী হয়েছে। আমি ছাড়ান চাই। ছাড়ান অর্থাৎ মুক্তি চাই।

সয়ারাম বলে, যাঃ, আমার হাতছাড়া হয়ে গেল। এট্টা কথাও বুঝলুম না। আমার বুদ্ধিতে আর কুলোল না। কিন্তু ভয়ে প্রাণ বাঁচে না। এ যদি গুণ-তুক না হয়, তবে গুণ-তুক কাকে বলে। তবু বলি, হ্যাঁরে, গামালি পাঁচির কাছে যেতে মন করে?

—না। বড় একফোঁটা মেয়ে।

একফোঁটা মেয়ে! পাঁচি যদি একফোঁটা মেয়ে, তবে গাঁয়ের মধ্যে ডাগর আছে কে আর। বাইরে বাইরে বয়স তেরো। ওদিকে ঘরের মধ্যে চোরাবাণ এসে যে পনেরো পার হতে চলল, সে খবর কে রাখে। পুরুষমানুষের খবর কম জানতে পারে সয়ারাম। মেয়েদের খবর তার নখদর্পণে। কেন না, ভাল বলো, মন্দ বলো, মেয়েমানুষের মতন, মেয়েদের সঙ্গে তার ওঠাবসা বেশি। গাঁয়ের বউ-ঝিয়েরা মন খুলে তার সঙ্গে ঘরের কথা বলে শান্তি পায়।

তাই সে জানে, পাঁচি একফোঁটা মেয়ে নয়। গাঁতরে বলো, গাঁতরেও বাড়বাড়ন্ত কম নয়। গামলি পাঁচির। বর্ষার জোয়ার আসেনি। টান মরশুমের জোয়ারে, ছেয়ালো ছেয়ালো ভাবখানি বেশ হয়েছে। নাকখানি একটু বোঁচা। তা, মেয়েমানুষের বেশি তোলা নাকিও ভাল নয়। চোখ দুটি ডাগর। শুধু ডাগর নয়, চোখ দুটিতে কিছু কথা আছে। সব চোখে কথা পাওয়া যায় না। চোখের মতো চোখ হলে কী সব কথা যেন থাকে। সে কথা তোমাকে বুঝতে হবে। মাথায় থুপ-থুপি চুল আছে একরাশ। বলে, মালোপাড়ার জোয়ানেরা অষ্টপ্রহর টুক-টুক করে বেড়ায় কেন হিদে মালোর গাম্বিলতলায়। গামালি পাঁচির জন্যেই তো। নেহাত গাঁয়ের বাছাড়ে বীর তেঁতলে বিলেস আছে, তাই বেশি এগুতে পারে না। সে মেয়ে একফোঁটা হয় কেমন করে বুঝতে পারিনে।

আর মনের কথা বলো, সেটিও কম ডাঁসেনি। চোখ দেখলে তো বুঝতে পারি। কেন, না, মেয়েমানুষ নিয়ে ঘর করি। ঠাওর করতে পারি চলন দেখলে। অত বড় মেয়ে, ঘুরে ঘুরে খালি খালাধারে যায়।

ও পাঁচি, খালাধারে কেন গো?

না, দেইড়ে আছি।

কার জন্যে?

অমনি চোখের কোণে চোরা হাসি চিকচিক করে ওঠে। কিন্তু মুখখানি শুকনো। বলে, কার জন্যে আবার। খালাধারে কে আসবে?

আসে, আমার বন্ধু আসে। তার যাওয়া-আসার এইটি পথ। কিন্তু পাঁচির কথার মধ্যে একটু নালিশ আছে। ওই যে বলে, খালাধারে কে আসবে? অৰ্থাৎ সয়ারাম, খালাধারে সবাই আসে, তোমার বন্ধু আসে না।

মনে মনে হেসে বলি, আচ্ছা, দেখা যদি হয় কারুর সঙ্গে, তবে পেইটে দেবখন খালধারে।

অমনি পাঁচির ঠোঁট দুখানি উলটে যায়। বলে, আহা-হা। দিয়ে, আমার বয়ে গেছে।

তার বেশি বলতে পারে না। সয়ারাম তো পাঁচির ঠাট্টার মানুষ নয়। সে তার সয়া খুড়ো।

বলে, ও সয়াখুড়ো নদীর পারে নাকি আজ মারামারি হয়েছে?

ঠিক খবর পায় পাঁচ। কেন, না, মারামারি হয়েছে বিলাসের সঙ্গে। বলি, হ্যাঁ, এটু আদাঁটু হয়েছে।

পাঁচি বলে, শুদু মারামারি হল? খুনোখুনি হল না কেন?

বোঝে ব্যাপারটা। অথাৎ রাগ হয়েছে বিলাসের ওপর।

সয়া খুড়ির সঙ্গেও বড় ভাব পাঁচির। খুড়ি আবার খুড়োর চেয়ে দড়ো। প্রাণের কথা টেনে বার করে। বলে, পাঁচ ঘুরে ফিরে এ পাড়ায় আসে। ব্যাপার বড় গুরুতর।

বটেই তো। সে মেয়েকে সয়ারাম একফোঁটা মানবে কেমন করে।

বিলাসকে বলি, সে মেয়ে যদি একফোঁট্টা তবে কি এটা ধুমসি মাগি চাই তোর।

দমাস করে একটা ঘুসি মারলে আমাকে। বললে, বানচত, তোর কাছে কি বিলেস মাগি চেয়ে ফিরছে, অ্যাঁ? শালার খালি আড় আনতে কুড়।

যখন মনের ঠিক থাকে না, তখন ভাল কথা বললেই মারতে আসে। তার ওপরে একটু বাঁকা কথা বলে ফেলেছি। পাঁচিকে একফোঁটা বললে তাই। মারবে বইকী। আমার লজ্জা নেই, তাই। আবার বলি, তবে এটু বুঝয়ে বল। অ্যাও নয়, ওয়ে নয়, তবে কোনটা।

—তা কী জানি। জানলে তো বলব। হ্যাঁ, ব্যাপার বড় শক্ত। নইলে, পাঁচিকেও মনে ধরে না। আসলে ওপথেও কাঁটা দিয়েছে অমর্তর বউ।

হুঁ, বন্ধুর আমার মন বুঝলুম না। তাই বলি, পাঁচখুড়ো, গতিক সুবিধের নয়। ভাইপোকে সামলাও।

পাঁচু ভাবে, সামলাব আর কী। কাউকে ছোবলালে, তার বিষক্রিয়া হবেই। তাই হয়েছে বিলাসের। এখন চাই একটি বউ। বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে। ওইটি দরকার তাড়াতাড়ি। এইবার, এই বছরটিই শেষ।

এবার দয়া করুন মা-গঙ্গা, নৌকোর খোল ভরে দিক মাছে। গামলি পাঁচতে মন না। ওঠে, আর কোথাও দেখা যাবে। তবে এই মরশুমটা কাটলেই আর দেরি নয়। বিলাসের দিকে তাকিয়ে যে এমনিতেই কাঁটা ফোটে চোখে। অমন জোয়ান ছেলে, ঠিক থাকে কখনও।

এখন উজানে চলার সময়। ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে, ছিড়ে প্ৰলয় করবে। সে। মাছের দিকে তাকিয়ে দেখো, জলের গতি দেখো। যখন তেমন তখন তেমন।

তবে ছেলে ডাগর মেয়ে চায়। চাইবেই। পোড়-খাওয়া ছেলে কিনা। আলতা পায়ে মল পরে, নথ-পরা মেয়ে খালি মন্দার সোহাগ খাবে, দুটি কথা বললেই পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসবে, তা হবে না। মাছমারার বউ যে হবে, সে হবে ডাটো মেয়েটি। দশ রকম কাজকর্ম করবে, ঘরের মানুষের মন বুঝতে হবে। সব দিক দিয়ে বেশ শক্ত এচীকস হওয়া চাই।

ছেলে পাকা হলে যেমনটি চায়, তেমনি চেয়েছে। সংসারের নানান প্যাঁচের মধ্যে বড় হয়েছে। বাপ হারিয়েছে সাত বছর। কে একটি পুটকে মেয়ে এসে, দুদিন বাদে অমর্তের বউয়ের কথা শুনে, ব্যাপার না বুঝেসুঝে শুধু জ্বলে মরবে, সেটা ঠিক হবে না। সংসারে একটা ওজন বলে বস্তু আছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও একটা ওজন আছে। শরীরের নয়, মনের ওজন। সংসারের পাল্লা-বাটখারায় তার ওজন হয় প্রতিদিনের ঘর করার মধ্যে। ওখানে কোনও কারচুপি চলে না। পাল্লা সমান না হোক, যে-কোনওদিকেই বোঁকতা বেমানান রকম বেশি হলে ঘরে অশান্তি হয়। এইটা নিয়ম।

আরও মানতে হবে, বিলাসেরা একালের ছেলে। ওরা তৈরি মেয়ে চায়। তুমি আমি যে ভয়ে ঘরের মেয়েকে গলার কাটা ভেবে বিদেয় করি, ওরা সেটা মানে না।

মেনে লাভ নেই, তা জানে পাঁচু। তা হলে অনেক কথা বলতে হয়। নিজের যৌবনের কথা, দাদা নিবারণের পাঁচালি আওড়াতে হয় মনে মনে।

থাক সে সব কথা। বিলাসের একটি বউ চাই শুধু। একটি ডাগর-সাগর বউ।

বিলাস থামছে। অন্ধকারে দেখছে এদিক ওদিক। আবার গান ধরছে,

না দেখে তোমারে, আমার নয়নে নাই সুখ-হে
বড় উথালি পাথালি আমার বুক।

বড় উথালি পাথালি আমার বুক। সে তো একজনের নয়, সারা সংসারের বুক উথালি পাথালি। পাঁচুর বুক উথালি পাথালি করছে না! করছে, তবে অন্য কারণে। এই যতগুলি নৌকা রয়েছে, সকলের প্রাণ-ই করছে।

গান থামে না বিলাসের।

টানাছাঁদি টেনে চলি, পাথালি লৌকোর বুক-হে
ওই আওড়ের ঘূর্ণি-জলে দেখব তোমার মুখ।।
বড় উথালি পাথালি আমার বুক।।

হ্যাঁ, টানাছাঁদি জাল বেয়ে সে যাবে। জাল ফেলে স্রোতের মুখে নৌকা সোজা যায় না। তখন নিয়ম আলাদা। নৌকা পাথালি চলে। অথাৎ নদীর আড়াআড়ি চলে। বিলাসের বুক এখন ওই রকম, খাড়া বাতাসের মুখে আড়ে পড়ে গেছে। মনের সোজা পথ গেছে ঘুরে। আওড়ের ঘূর্ণিতে যেখানে মরণ আছে, সেইখানে তার মুখ দেখতে চায়।

কলকাতা শহর চুপ করে না কখনও। কীসের যে শব্দ হচ্ছে চারিদিকে, কে জানে। যেন রাত এখানে আসতেও পারে না একটু নিঝুম শান্তি নিয়ে। এদিকে ওদিকে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা লাল আলো। ওগুলো কলকারখানার চিমনির আলো। বন্দরের দিকে আকাশটি যেন ভোরের সদ্য-উদিত সূর্যের আলো ছড়িয়ে ফুটফুট করছে। ওই দূরে দেখা যাচ্ছে শ্মশান। শ্মশান! সব লীলা সাঙ্গ করে সবাই আসে ওইখানে।

কিন্তু ভেবে অবাক পাঁচু, আমন আলো-ফুটফুটে শ্মশান ঘাটে শেয়াল আসে কী করে। আসে না। নিশ্চয়। বাস করবার জায়গা কোথায় তার আশেপাশে। এত বড় শহর। এ শ্মশানে শেয়াল বড় জব্দ হয়েছে তো।

গঙ্গা কিছুক্ষণ যেন ন যযৌ ন তন্থেী হয়েছিল। এখনও রয়েছে। চাঁদ-ঢাকা মেঘলা আকাশ। শহরের আলো নয়, ওই মেঘলা আকাশেরই আলো যেন চিকচিক করছে অস্পষ্ট গঙ্গার জলে। চিকচিক করে বেশি দু-তিনটি জায়গায়, যেন দু-তিনটি লম্বা রেখা চলছে তরতরিয়ে। কোনওটি উত্তরে। কোনওটি দক্ষিণে। হঠাৎ ঠাহর করতে পারবে না আনাড়িতে, জোয়ার এল, না, ভাটা যায় দক্ষিণে। এ শুধু রাতের অন্ধকারের খেলা নয়। দিনমানেও তাই। আসলে, তোমার সব কটি ধারাই সত্যি। জোয়ারও এসেছে, ভাটাও যাচ্ছে। এক দিক দিয়ে আসে, আর এক দিক দিয়ে যায়। এই হল যাওয়া-আসার মাঝামাঝি। আসলে, যার আসার সে এসে গেছে তলে তলে। যাওয়ার যে সে চলে গেছে অনেক দূরে, অগাধ সমুদ্রে।

তারপর হঠাৎ মনে হল, কাঁড়ার যেন দুলে উঠল একটু। দুলে উঠে সরে এল একটু উত্তরে। চোখের ঝিমুনি ঘসে নিলে পাঁচু। তাকালে ভাল করে। ডাকলে, হ্যাঁরে, বিলেস!

বিলাস জবাব দিল কাঁড়ার থেকে, হ্যাঁ এসে পড়েছে। ওঠো।

পাঁচু ডাক দিল, কই গো, ও কদমপাঁচু।

জবাব এল, হ্যাঁ, টের পেয়েছি। সে আবার ডাক দিল, কই হে অনাথ, ঘুমামে পড়লি নাকি?

জবাব শোনা গেল, না, আন্দাজ লাইছি।

উঠল সবাই। সাত নৌকার সব মাছমারারা, বাছাড়ি নায়ের মাঝি। জোয়ার এসেছে। সাত নৌকা, সবাই উত্তরের যাত্রী। পুব থেকে পশ্চিমে এসে, যাত্রা এবার উত্তরে।

হাওয়ার গতিক কেমন? ভালই। দক্ষিণে বাতাস, তার সঙ্গে আছে একটু পুবে হ্যাঁচকা। সাত নৌকায় উঠল মাস্তুল। পাল খাটানো হল। নিঝুম গঙ্গা সচকিত হয়ে উঠল সাত নৌকার মাঝিদের কথাবাতায়। মাস্তুল দাঁড়াল, পাল উঠল। বাতাস লেগে উঠল। ফুলে। নৌকা কাত হল বাঁয়ে, অর্থাৎ পশ্চিমে। বাতাসের চাপ গলুয়েও কম নয়। নোঙর উঠেছে পালের আগেই।

মেঘ-ঢাকা চাঁদের আলোয়, মাস্তুল আর পালগুলি জীবন্ত অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি হয়ে দেখা দিল।

গলুয়ে বসে বিলাস দাঁড় খাটালে ডাইনে। জলে চাড় দিয়ে বললে, মেঘ উড়ে যাবে মন নিচ্ছে।

সেই রকমই মনে হচ্ছে আকাশের গতিক। বাতাস বেশ জোর। দাঁড় টানার সুযোগও নেই বিশেষ।

সাত নৌকা চলেছে আগে পিছে। বাছাড়ি নৌকা। হাত তিনেকের বেশি চওড়া নয়। লম্বায় আটাশ হাত থেকে একত্ৰিশ হাত। কাঁড়ার আর গলুয়ের উঁচু-নিচু ঠাহর হয় না। ছাঁই না থাকলে বাঁশের গুড়োয় মনে হয়, গোটা নৌকাখানি যেন পোল্লায় একটি জানোয়ার দাঁত বার করে আছে। এই নৌকা সমুদ্রে যায়, নদীতে আসে, খালে বিলে ঘোরে।

কথায় বলে ময়ুরপন্ধি। সেটা হল রাজসিক। যে যাবে লড়াই করতে স্রোত পেছনে ফেলে, বাতাসের আগে, সে হল এই সাপের মতো সরু হিলহিলে বাছাড়ি নৌকা।

পুবের বাচ খেলায়, সে তোমার টাকির বাবুরাই দিন আর গাঁয়ের পয়সাওয়ালা আমুদে লোকেরাই দিন, জয়তিলক আঁকা থাকে বাছাড়ির কপালে। বাছাড়ি নৌকা হারেনি কোনওকালে। বিশেষ পাঁচুর এই বাছাড়ি। ধলতিতার নাম রেখেছে। এই নৌকা। নাম কি আর এমনি এমনি রেখেছে। যেমন নৌকা তার তেমনি ছিল মাঝি। কাঁড়ারের মুখে থাকত স্বয়ং নিবারণ মালো। কালো কুচকুচে হাতে থাকত। কালো বৈঠা। বানের গুণ ছেড়া তীরের মতো সেই বৈঠা বাতাসের আগে সামনে ছুটত যেন। কী একটা হাঁক দিত। সেই হাঁকে যেন অন্য নৌকার বেচুড়েদের হাতে আলগা হয়ে যেত বৈঠা। তাদের নৌকার তলে জল যেত থিতিয়ে। মাঝিরা বলত, গুণ জানে, গুণ করেছে।

মাথায় করে নাচত ধলতিতার মানুষেরা। টাকির অনাথ বেজায় ওস্তাদ মাঝি। সেও হেসে বলত নিবারণকে, পিতি বছরেই তুমি আসো নিবারণদাদা, এ বছরডা কামাই দেও।

পাঁচুর দাদা বলত, দিই কেমন করে বলো। যমে ছাড়ে না যে। গাঁয়ে বাস করতে হয়তো!

অর্থাৎ আদর করে গাঁয়ের লোককে যম বলা হল। জবাব দেওয়া হল অনাথকে। আর উত্তরে সারাপুলের অর্জুন মাঝি বলত, নিবারণের ঠ্যাং না। ভাঙলে ধলতিতার হার হবে না কোনও কালে।

ঠ্যাং ভাঙতে পারেনি, কিন্তু ভাঙতে চেয়েছিল অর্জন। নইলে গাঁয়ে ডেকে নিয়ে, ঘুটঘুটি অন্ধকার রাতে, ভাঙা সাঁকো দেখিয়ে দিত না।

ক্ষমতায় আর আক্ৰোশে ওইখানে তফাত।

আর এই এক বড় খেলুড়ে হয়েছেন। পাঁচুর ভাই-পো। গত সনের আগের সনে, তিনটে মাঝিকে জখম করে, তাদের নৌকা ড়ুবিয়ে, তুলাকালাম কাণ্ড করে, ধলতিতার নাম রেখে এইয়েছেন। অবশ্য দোষ ছিল সারাপুলওলাদেরই। অর্জুন বাপের সঙ্গে পারেনি, বেটাকে জব্দ করতে চেয়েছিল। তার বাঁ দিকে ছিল বিলাসের নৌকা। বাওনদার ছিল সব কটি বিলাসেরই চেলা। অৰ্জ্জুন নিয়ম ভঙ্গ করে, কাঁড়ারের মুখ ঘুরিয়ে আটকাতে চেয়েছিল বিলাসদের।

নিবারণের ব্যাটা হাঁক দিলে, ওপর দে যা।

তাই গেল। অর্জনের কাঁড়ার ভেঙে নৌকা ড়ুবিয়ে নিশানের কাছে গিয়ে পৌঁছল।

বাবুরা মহাজনেরা বললেন, বিলাসের কোনও দোষ নেই। বে-কায়দা করেছিল অৰ্জ্জুন।

এ তো চোখের আড়ালে ঝোপেঝাড়ের বিষয় নয়। সকলের চোখের সামনে। চব্বিশ পরগনার গোটা পুব তল্লাটে মানুষেরা সেখানে। সবাই একবাক্যে সায় দিলে, কোনও দোষ নেই বিলাসের।

খেপে আগুন পাঁচু নিজে। দশজনের সামনেই বিলাসের গালে থাপ্নড় কষিয়ে দিলে, গুয়োটা লৌকো ঘুরিয়ে চলে এলি নে কেন তুই?

দশজন ধরে বলল, আরো করো কী করো কী পাঁচদা?

কিন্তু অর্জুন ছাড়ল না। সেই রাত্ৰেই ফেরবার পথে মারামারি হল। আজও দাগ আছে বিলাসের পিঠে।

দেখতে দেখতে কাশীপুরের সীমানা ছাড়ল। উঁচু পাড়ে মালগুদামে ঠাসাঠাসি। জেটি এসে দাঁড়িয়েছে গঙ্গার কোমর ঘেঁষে।

সাবধান হে! বড় গাধাবোটের ছড়াছড়ি। একে জোয়ারের টান। তায় পালে ঠেলা বাতাসের। ধাক্কা লাগলে আর সামলানো দায় হবে। আর আছে। এপারে ওপারে বড় বড় জেটি। যেন বড় ফাঁদের লোহার জাল। জেটির নীচের জবর-জাং লোহার ফাঁদে পড়লে, রক্ষে থাকবে না।

তারপরে, ওই যে দেখা যায় বরানগরের সেই বাড়ি। নাম মনে নেই আজ আর পাঁচুর, শুনেছে, বাড়ি ছিল কোন রাজার। এখন ভেঙেচুরে একশা। বাড়ির মাথা ফুড়ে উঠেছে অশ্বখ, ভাঙা দেয়াল পাঁচিল জানালা দরজা জড়িয়ে ধরেছে। লতাপাতা। দিনের বেলা দেখলে গা ছমছম করে।

রাজার বাড়ি এখন ভূতের বাড়ি। আগে পুবের মাছমারারা প্রথম এসে ঠাঁই নিত এখানে। তারপর যাত্রা করত। উত্তরে।

তা ছাড়া খালের মোড়ে জায়গা কম। তারপরে কলকাতা শহর বলে কথা। তার ধার ঘেঁষে থাকতে গিয়ে কখন কী ঘটে যায় বলা তো যায় না। সবাই সরে সরে আসত। এই তল্লাটে। আর একটু টান ছিল। উত্তরে যে দেখা যায় টালি আর চালা ঘরগুলির ইশারা, ওইটি মাছমারাদের গ্রাম। অধিকাংশই পাঁচুদের পুবের মানুষ এসে ঠাঁই নিয়েছে। এখানে। গঙ্গার ধারে ওই জোয়ার-ভাটার যাওয়া-আসার মধ্যে একটু দেখাশোনা, একটু সুখ-দুঃখের কথা বলা। যদিও এই শহরের কানায় থেকে মানুষগুলো একটু কেমন ধারা হয়ে গেছে যেন। তবু এক কালের গাঁয়ের মানুষ। মন চায় একটু কথা বলতে।

তা যিনি আছেন ও বাড়িতে, তাঁর সইল না। কী ইট-পাটকেল ছোড়া! বাবারে। ছাঁই ভেঙে, তিবাড়ি ভেঙে, মানুষ ঘায়েল করে এক তছনছ কাণ্ড। একে অশরীরী তায় বাক্যি নেই। ভাবখানা, পালা শিগগির আমাদের কোল ছেড়ে।

মাছমারারা দেখলে গতিক সুবিধের নয়। কে জানে কোন বামুন-বিধবা ব্ৰহ্মচারী আছেন ওই পোড়ো ভিটেয়। মেছো নৌকা দেখলে আর রক্ষে নেই। সেই থেকে এখানে আর কেউ নৌকা বাঁধে না।

এই এক জিনিস, সমুদ্র থেকে গঙ্গায়, গঙ্গা থেকে ইছামতীর কোলে, কুলে কুলে, ফোড়নের মুখে সর্বত্র আছে তোমার সঙ্গে সঙ্গে। বাগে পেলে ছাড়ান নেই। ঘাড় মটকে ছেড়ে দেবে। দিয়েছে। অনেককে। কখনও সে জানান দিয়ে আসে, না দিয়েও আসে।

দুঃখের আড়ালে সে ঘোরে নানান বেশে। আসলে যাকে মারে, সেই ঘোরে তোমার পিছে পিছে।

পাশের নৌকা ডাক দিলে, ও পাঁচু।

পুরোখোঁড়গাছির অনন্ত ডাকছে। পাঁচু বললে, বলো।

নৌকার মুখ ঘোরানো পশ্চিম কোণে। ছলছলাত করে জল আছড়াচ্ছে নৌকার গায়ে। পলকে পলকে পার হচ্ছে চেনাশোনা জায়গাগুলি। কী তীব্ৰ গতি এখন। কোম্পানির স্টিমার থাকলে, পিছনে পড়ে যেত। খুব সাবধানে চলো। একবার ঘুরে গেলে এখন সামলানো দায় হবে। আওড় নেই, ঘূর্ণি নেই, কিন্তু বোঁ করে পাক খেয়ে যাবে নৌকা। গলুই সিঁধোতে পারে জলের মধ্যে নাঙলের ফালের মতো। জোয়ার আসছে কুলে কুলে। তোমার চোখে ঠাহর করতে পারছি না। কিন্তু এতক্ষণে কত উঁচুতে উঠে গেছে, একবার আন্দাজ করো। আষাঢ়ে তেমন বান আসে না সমুদ্রের। কিন্তু তলে তলে, ফুলে ফেঁপে, গঙ্গা এখন ফুসছে নৌকার পিঠে। চাপে, চাপো হাল-বৈঠা। বিলাসের এখন কোনও কর্ম নেই, বসে থাকা ছাড়া। সামনে মায়ের বাড়ি। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি। রেলপুল মাথার পরে। কেমন এক ছমছমানি ছায়া পড়েছে পুলের তলায়। যেন কোন এক দৈত্যের ঠাঙের তলা দিয়ে পার হতে হবে এবার।

ওই শোনো। জলের শব্দ ওখানে যেন কেমন গমগম করছে। যেন, ওই ছায়ার মধ্যে গঙ্গা নেই। ডাকিনীরা ডাকছে বিশাল লোহার গায়ে তাল দিয়ে। জলের টানেও একটু ঘোরপ্যাঁচ। চুবিয়ে মারতে পারবে না, টানবে একটু এদিক ওদিক। হাল তোমার হাতে। শক্ত থাকলে একচুলও এদিক ওদিক হবে না। তা ছাড়া, মায়ের তলা দিয়ে যােচ্ছ। নাম নাও একবার, হ্যাঁ।

চাঁদে মেঘে লড়াই হচ্ছে। দাম আটকে মরছে সোনার চাঁদ। ওই এক পলক, চুক করে একবারটি দেখা দিল মেঘের কোলে, কৃষ্ণপক্ষের ছ। দিনের চাঁদ। ওই যে শ্মশান, দক্ষিণেশ্বরের গাছগাছালি কেমন মাথা নাড়ছে। এদিক ওদিক করে। যেন রাত্ৰিবেলার অবসরে, রাতের জীবেরা সব খেলায় মেতেছে।

তুমি চলে যাও মাছমারা। তোমাকে এরা কেউ কিছু বলবে না। যার বলার, সে ঠিক টের পাইয়ে দেবে। টনক তোমার আগেই নড়বে। নইলে, মানুষের শরীরে টনক পদার্থটি আছে কেন?

তবে, সামলে। বেশি পুবে ঘেঁষো না এখন। একটা আওড় আছে। ধরে রাখতে পারে তোমাকে সাঁড়াশির মতো।

-হ্যাঁ, কী বলছিলে গো অনন্ত।

দুজনেই হালে বসে আছে। কথা শুরু করে, হঠাৎ থেমে এক দণ্ড পরে তার জবাব দিতে হয়। দুজনকেই আবার এদিকে সামলাতে হবে তো। অনন্ত বলল, বলছিলুম মহাজনের কথা। তিন সন ধরে টোটা গেল, ওদিকে মহাজনের ছাড়বার নাম নেই। পালমশাইকে বললুম, সুদটা গেল সনের ছেড়ে দেও। তা রেগে বললে, ও সব বোলো না অনন্ত। তা হলে আমি লৌকেও ছাড়তে পারব না। মকুব কোথায় হয়? না, যেখানে ঠিক ঠিক নেয়া-দেয়া চলে। তোমরা নেবে, দেয়ার বেলায় পুরো শোধ দেবে না। এখানে মকুব-টকুব হবে না।

সকলের প্রাণেই এক কথা। পাঁচুর বুকের মধ্যে এক-ই ভয় শিউরে শিউরে উঠছে বারবার। কী বলবে। বলল, সব মহাজনেরই এক কথা হয়েছে আজকাল। বলে, তোমরা মাছ মারতে পারো না, সে কি আমার দোষ। পেটে খেতে না পেলে এসে লৌকো বাঁধা রেখে টাকা নে যাবে। আবার আষাঢ় মাস পড়তে না পড়তে বিনা উগুলে লৌকো নে যাবে। আমাদেরও দিতে হয়, নইলে উশুল হবে কী করে? তাও তোমরা না পারলে আমরা কী করব।

অনন্ত বলল, হ্যাঁ, অবিশ্যি মহাজনের পিতি বছরেই কিছু শোধ হয়। একেবারে মাঙনা তো আর ছেড়ে দিচ্ছে না গো। গেল সনে দুশ টাকা দিইচি মহাজনকে। দিলে কী হবে, বাকি রয়েছে তার দেড়া। এবারে তোমার বাঁধাছাঁদি জালখানিও দিয়ে দিয়েছিলুম মহাজনকে। বললে মহাজন, বুড়ো হয়েছ অনন্ত, জালখানি রেখে দেও আমার কাছে। যদি বিষয়ি গঙ্গায় না যেতে পারো, মরে ধরে যাও, তবে লৌকোয় আর জালে আমার কিছু শোধ হয়ে যাবে।

অমনি কথা মহাজনের। বড় ভাল মানুষ, ভাজার মাছটি উলটে খেতে জানে না। একখানি তিরিশ-হাত বাছাড়ি নৌকার দাম-ই তো কম করে সাতশো টাকা হবে। বাঁধাছাঁদি জালও কিছু না হোক শ দেড়েক দুয়েক টাকা। তিনশো টাকার দায়ে প্রায় হাজার টাকার ঘা মারবে তুমি। কথার বেলায় বলছি, কিছু শোধ হয়ে যাবে।

মৰ্মে মৰ্মে জানে পাঁচু, হাড়ে হাড়ে পাক দিয়ে রয়েছে মহাজনের ঋণ।। তার নিজের ঘরের পাটা জালখানি রয়েছে মহাজনের কাছে। নিবারণ সাইদারের জাল। পাটাজাল সমুদ্রে মাছ ধরার জাল। বাঁধা দিয়ে মনে করেছিল, বিলাসের সমুদ্রে যাওয়ার পথ মারা গেল। কিছু টাকার দায়ও মিটাল। কিন্তু সমুদ্রে যাওয়া আটকানো গেল না। পরের নৌকায় কাজ নিয়ে চলে গেল বিলাস সমুদ্রে। আর বছরখানেক সময় দেবে মহাজন। তারপর বিক্রি করে দেবে জালখানি।

নিবারণের রয়েছে পানসা জাল। জলে ধুয়ে, পাতলা গাবের জল ছিটিয়ে এখনও প্রতি বছর শুকিয়ে জালখানি তুলে রাখে বউঠান, বিলাসের মা। অত বড় জাল, উঠোনে ধরে না। তিন বাঁশ দিঘলে টাঙিয়ে, মেলে দেয় জাল। দিতে দিতে চোখ ফেটে জল আসে বউঠানের। সমুদ্রের গন্ধ আছে ওতে, নিবারণ মালোর গায়ের গন্ধ। আর তো কোনওদিন সেই হাতে এ জাল ধরা হবে না। বউঠান বলে আপন মনে ফিসফিস করে, একদিন কী করে ছিড়ে ফেনানু পাটাজালের কোনা। কত বকাঝকা করলে আমাকে। মুখে মুখে জবাব দিনু, মেরে আমাকে একশা করলে। আজ যদি ছিঁড়ি…?

পাঁচু হালে চাপ দিয়ে একটি দমকা নিশ্বাস ফেললে। পানসা জাল নিয়ে আবার কে কবে সমুদ্রে যাবে, সে কথা পরের ভাবনা।। ও যে মাছমারার ঘরের সম্পত্তি। তা এ বছরে গঙ্গা কথা না বললে, সেটিও যাবে।

বলল অনন্তকে, জানি হে, জানি। আমার নৌকাখান তো পিতি বছরেই বাঁধা পড়ছে, ছড়িয়েও আনছি। পিতি বছর। তবে ওই, সুদের ট্যাকাটা জমে যাচ্ছে। মহাজনের হল আসলের চেয়ে সুদের মায়া বেশি, আর সুদ হল দেনাদারের যম। আসল ছাইড়ে যেতে চায় কিনা। এবারে আমাকেও বড় কড়কে দিয়েছে মহাজন। বললে, পাঁচু, কিছু না পারো, এবারে আমার তিন বছরের সুদসমেত, এই সনের খোরাকি আর সুদটাও শুধতে হবে। নইলে কিন্তুন চলবে না। বন্ধু, তা কী করে হবে মশায়? মা-গঙ্গার মর্জির ওপরে তো সব। বললে, তোমাদের খাজনা-ট্যাকসো লাগে না গঙ্গায়, রানি রাসমণির জলে মাছ ধরে। এবার পাঁজিতেও লিখেছেন, মৎস্য দিশ।  এবারে ও কথা বললে হবে না। বোঝা এখন। খাজনা-ট্যাকসো লাগলে তো আর গঙ্গায় আসা-ই হত না। কবে পটল তুলতে হত। এখানকার মাছমারাদের। তা বলে, পাঁজি যা লিখেছেন, তা যদি না ফলে, তবে?

বিলাস বলে উঠল গলুই থেকে, তবে মহাজনকে বলো, সে একখান পাঁজি নিয়ে এসে একবার নড়ুই করে যাক গঙ্গার সঙ্গে।

বোঝ এখন। সেই তো পাঁচুর ভাবনা, চোখ বুজলে বিলাস যদি মহাজনের সঙ্গে ওই ওজনের কথা বলে, তার গতি কী হবে। তবে, কথায় ওই রকম কাজ কিন্তু অমনটিন নয়। বললে, হ্যাঁ, খত নিখে ব্যাতো খুশি চোপ কর, মহাজনের কলাটা। তুই চুপ যা।

-কেন?

–কেন? কেন কীরে আবার মাকড়া। ।

—বলছি, মহাজনের কলাটা কেন? কলাটা যে দেখাবে, কলাটা আসে কমনে থেকে। মাছের টাকায় তো?

—তা কী হল?

—তবে মাছের নামে এট্টা খত নিকে গাঙে ভাসসে দিলেই হয়। শালার যাতো মাছ গাঙে আছে, একেবারে মহাজনের পায়ে এইসে ঝাপ্পে পড়বে খনি।

ওই শোনো কথা। পায়ে পা দিয়েই আছে। এই ছেলে নিয়ে সংসার করতে হয় পাঁচুকে।

খেঁকিয়ে উঠল। পাঁচু, গাড়ল কমনেকার! সে মহাজন, ঋণ দে শোধ নেবে, এইটে তার আইন।

—আরো আমার আইন রে!! আমার লৌকো জাল রেখে দেবে, তবে আর কী! তার চে ঋণ নেব না। আমাকে ঋণ দে তো মহাজন খায়। আমি যদি ঋণ না নে না খেয়ে মরি, মহাজনে বাঁচে কমনে? ঋণের জোরেই তো?

পাঁচুর মাথাটা খারাপ হয়ে গেল। কেমন যেন জট পাকিয়ে গেল নানান কথার ভিড়ে। আশেপাশে যারা শুনল, তারাও চুপচাপ। যেন কারুর মুখে কোনও কথা জোগাল না হঠাৎ।

তারপর, একটা দুর্বোধ্য রাগে পাচু চিৎকার করে উঠল, থামবি? তুই চুপ যাবি অ্যাঁ? যাবি, কি না, অ্যাঁ? বড় আমার আইনদার। এইয়েছেন, সোমসারে জন্মেছেন এইসে বড় এক মাছমারা রে।

চুপ করল বিলাস। পাঁচু, পাশের নৌকার অনন্তও চুপচাপ। শুধু নৌকার তলায় ফুলে ওঠা জলের শব্দ। চলক ভাঙার ছল-ছলানি। চলাকা হল নৌকোয় ছিটকে-ওঠা জল।

অনন্ত বললে আগের কথার খেই টেনে, যদি পাঁজির বাক্যি না। ফলে, তবে মাথা গোঁজবার ঠাইখানি আছে, সেটি চাইবে।

পাঁচু বলল, গতিক তো সেই রকমই দেখছি এখন। তা এ বোশেখ চোত জষ্টি, বাওড়ে বিলে নদীতে যত মাছ ধরনু, তার পেরায় আদ্ধেকখানি তো রোজই মহাজনের কাছে গেল, ও সবের তো লেখাজোখা নেই। তারপর, বিল-বাওড়ের ইজারা যানাদের কাছে, তাদেরটাও মিটুতে হয়। যাবে কোথায়!

হঠাৎ মনে হয়, নৌকা যেন চলছে না। বুকের মধ্যে দুভাবনার কাটা এমন অসাড় করে দিল! মনে হল, জল যাচ্ছে না, নৌকাখানিও বুঝি চলে না। সহসা যেন সব থিম মেরে গেছে।

কিন্তু তা নয়। চলেছে, বড় জোর চলেছে। সে থেমে নেই। এদিক ওদিক কোরো না, শরীরের রক্ত দিয়ে হালের আন্দাজ ঠিক রাখো। পেশি তোমার টনক। সে জানান দেবে। কামারহাটির কোল গেছে। পুবের জমি হুড়মুড় করে ছুটে এসেছে গঙ্গায়। ওই দুরে পশ্চিমে, গঙ্গা মস্ত বড় বাঁক নিয়েছে। মনে হয়, সামনে আর জল নেই। পার দাঁড়িয়ে গেছে। তা নয়, বাঁকের সীমানায় গঙ্গা হারিয়ে গেছে উত্তরে। চওড়া হয়ে উঠেছে। পশ্চিমে একটু কোণ মারো, নইলে উলটো আওড়ে পড়ে যাবে। জোয়ার টানছে উত্তরে। পাড় ঘেঁষে গেলে, আবার দক্ষিণে টান ধরে যাবে। ওটা জোয়ারের লীলা। কিছুটি থেমে নেই। এ সংসারে। সব চলছে ফিরছেদিবানিশি। ওই তোমার শেষ থামোটা এমনি করে নাড়া দিয়ে যায় মাঝে মাঝে। তখন তোমার ঠিক ঠিক জল চলবে না, নৌকা থম খেয়ে যাবে।

পাঁচু বলল, মাছমারার ঘরে আর শান্তি নাই।

অনন্তর নৌকা একটু সরে গেছে। শুনতে পেল না। বললে, অ্যাঁ?

পাঁচু—না, বলছি বলে, আর শান্তি নাই। অনন্ত বলল, নাঃ। গত সনে সমুদ্রে গেনু, তাও কিছু হল না। তিন ব্যাটাকে নিয়ে গেছলুম। চারজনের খোরাকিতেই কত হয়ে গেনু।

হ্যাঁ সমুদ্রও তোমায় এমনি করে। মর্জি তো। পাঁচু বলল, খোরাকি কেমন দিলে এবার মহাজনে।

অনন্ত বলল, ওই দিয়েছে, দুমন চাল। তিনটি মনিয্যি এয়েছি। তা ধরো, এক মাস পুরলে হয় ওই চালে। দাম ধরেছে। ষোল ট্যাক মন।

ষোল টাকা মন! পাঁচুর চমকাবার উপায় নেই। বলল, হ্যাঁ, আউসের মোটা লাল চাল দিয়েছে। তোমার নিয়েছে। ষোল, আমার নিয়েছে। পনের। বাজারে দাম হল বারোর মধ্যে।

অনন্ত বলল, বোঝ তবে। এর ওপরের সুদটা ধরে। তাপরেও আছে, পাঁচপো সরষের তেল, আড়াই সের মুসুরি। আর পাঁচপো কলাই। তা ওই মাস। ঘনঘন হবে। ওতেই মহাজনে লাভ রেখেছে, আবার সুদ। বনু, পালমশাই, আর আধমনটাক চাল দে দেও। মাছের মন, না পেলে আবার গঙ্গায় পড়ে শুকোব। ঠোঁট উলটে বললে, শুকোবে কেন, তোমাদের চেনাশোনা জায়গায় যাচ্ছ, ওখেনকার ফড়েরা টাকা ধার দেবে। চাল-ডােলও দেবে, সে আমি জানি। তা সে যা খুশি তাই করোগে, আমার কী। তবে বাপু, একটা কথা বলি, থাকবে মা গঙ্গার বুকে, তবু তোমাদের অত পেটের জ্বালা হয় কেন বল দি নি?

পাঁচু বলল, হ্যাঁ মহাজনের কথা তো। তাই বলি, গঙ্গা, শুনে রাখা গো মা, তোর ছেলেকে কী শুনতে হয়।

বিলাস বলে উঠল, বললে না কেন মহাজনকে, তুমো চল, গঙ্গার পুণ্যর বাতাস খেলে পেট জ্বলে কী না-জ্বলে, এটু ঠাওর করে আসবে।

হ্যাঁ, ওইটা বাকি আছে। মাকড়া কমনেকরি। মনে মনে বলল পাঁচু। কিন্তু কনকন করতে লাগল বুকের মধ্যে। এ পেটের লজ্জা নেই, বেহায়া জিভ। জাল ফেলে, দুই গড়ান দিলে, পেট দানা চায়। জালে কিছু পড়ুক বা না পড়ুক দানা চায় পেট। নুন না ফেলে তখন মুখের ভাত নোনা লাগে চোখের জলে। হাত ওঠে না, পেটের জ্বালায় ওঠে।

মহাজন তো মিথ্যে বলেনি। ঋণ তো এখানেও হয়। চন্দননগরের ফড়েনি, বুড়ি দামিনীর মুখখানি বারবার ভেসে উঠল। পাঁচুর চোখের সামনে। ঘরে বাইরে ঋণ দামিনীর কাছে। এখনও পঞ্চাশ টাকা ধারে পাঁচু। দাদা নিবারণও ঋণ করত দামিনীর কাছে। দামিনীর মায়ের কাছে ঋণ খেয়েছে পাঁচুর বাপ। সবটাই বংশপরম্পরায় চলেছে।

কিন্তু উপায়ই বা কী না নিয়ে। গঙ্গা নির্দয়, এদিকে ডাল-চাল সবই শেষ। হয় ফিরে আসতে হয়, নয়তো দুদিন দেখতে হয়। দেখতে হয় কী, হবেই। গঙ্গা তোমাকে একেবারে না ছাড়লে তুমি ফিরছি কী করে। এক কোটাল যাবে, আর এক কোটাল আসবে। গঙ্গার কোটাল শেষ করে ফিরতে হবে মাছমারাকে।

পাঁচু বলল, হ্যাঁ মহাজনে সব বোঝে, বুঝে ঘাই মারে কিনা! আমাকে চাল দিয়েছে একমন। নগদ এনেছি। দশটা ট্যাকা। নইলে চলে না। ধরে যদি, ফেরবার দরকার হয় বাড়িতে, তবে মরতে মরতেও রেলগাড়িতে করে পৌঁছন যাবে।

অনন্ত বলল, আমার সে গুড়েও বালি। ব্যাটার বউয়ের রুপোর বালা চুড়ি বাঁধা দে, কিছু নগদ এনেছি সঙ্গে।

হ্যাঁ, ওতে প্ৰাণ পোড়ে বইকী। অনন্তর ব্যাটার বউ আছে। বিলাসের বউয়ের হাত থেকে যদি নিতে হয় এমনি! অনন্তর কথা শুনে প্ৰাণে লাগছে। হাতে করে নিতে আরও কতখানি লগত। তবু আসতে হবে, আসছে। অম্বুবাচী গেছে। ওদিকে টনক নড়ে গেছে মাছমারাদের। ইছামতীতে কি তা বলে থাকবে না কেউ। তাও থাকবে। ইছামতীতে থাকবে, আরও নীচে, ডানসা, বিদ্যোধরী, পিয়ালী, ঠাকরুনের কিছুটা পর্যন্ত থাকবে অনেকে। গঙ্গায় আসবে তার অনেক গুণ বেশি। আসবে অনেক দূর তল্লািট থেকে। সংসারের যাবৎ জল, সবই ভগবতীর জল। গঙ্গার জল সাক্ষাৎ ভগবতীর। এত বিস্তার তুমি কোথায় পাবে। ভগবতীর জলে মাছ মারবে, তুমি মাছমারা, তার খাজনা নেবে মানুষে। বিল বলো, বাওড় বলো, তুমি নিজের হাতে গড়েনি। কিন্তু তার প্রাণী থেকে ঘাস কচুরিপানা, সবকিছুর খবরদারি করবে তুমি। গাঙ-বিল-বাওড়ে যে প্ৰাণ দেবে। আর নেবে, তার ওপরে তোমার আইন খাটাতে চাও মানুষ হয়ে! খাজনা ধরো, ট্যাকসো ধরে। মাছ তুমি ছাড়োনি। কিন্তু ভাত না দিয়ে তুমি কিল মারার গোঁসাই। কীসে তোমার হক? না, তুমি জমা নিয়েছ, দেশের তুমি রাজা হয়েছ।

যে দৌলত তুমি দাওনি, আমার বাপ-পিতামোর কৌশল খাঁটিয়ে যাকে পাই, তার ওপরে তোমার খবরদারি। নিযাতন করবে তুমি কেন? না, আমি মাছ মারি। তোমার শক্তি আরও বড়, তুমি আমাকে মারো। জানিনে কার হয়ে মারো। আমাকে যে মারে দিবানিশি, সেই মীনচক্ষু দেখিনে তোমার চোখে।

আমার মাথার পরে আছে অনেকে। মহাজন, আড়তদার, ফড়ে-পাইকের। কিন্তু গঙ্গার এই তল্লাটে খাজনা নেই। একে বলে, ভগবতীর মিঠে জলে সুদিনের বান ডেকেছে।

দুই নৌকা পাল গুটোচ্ছে, মাস্তুল নামাচ্ছে। ওই যে দেখা যায়, পুবে মন্দির। মেঘলা ভাঙা জোছনায় দেখা যায়, সাদা মন্দির। খড়দহ এল। শ্যামরায়ের দোলমঞ্চ না রাসমঞ্চ। এখানে আস্তানা নিচ্ছে দুই নৌকা।

পাঁচু বলল, কারা রইল?

জবাব দিল কেদমে পাঁচু, দণ্ডিরহাট আর শাঁখচূড়োর দুই নৌকা। সনাতন আর সকল মিঞা।

পুবের কয়েকঘর মাছমারা যাবজীবনের বাস নিয়েছে। এখানেও। গঙ্গার ধারে ধারে, আরও কত জায়গায় নিয়েছে। বাবুদের ধরে করে, পেয়েছে একটু জমির বন্দোবস্ত। ভগবতীর কোলে পেয়ে গেছে ঠাঁই। যে পেয়েছে, পেয়েছে। যে পায়নি তাকে আসতে হবে সাত গাঙ ঠেলে।

মাছ মেরে তাকে পচালে চলবে না। বেচিতে হবে। হাট-বাজার দেখতে হবে। এখানে হাট-বাজার ভাল। মাছ নিয়ে ঘুরতে হবে না দোরে দোরে। ঘোরাঘুরি যেখানে, সেখানে দাম ওঠে না মেহনতের। সবাই দয়া করে। দয়া নিয়ে তুমি কাপড়ের খুটে চোখের কোল শুকোতে পারো। তার বেশি কিছু নয়।

তাই তোমাকে আসতে হবে। এই শ্যামরায়ের পায়ের তলে থাকো, বারাকপুরের পুলিশ মিলিটারি আস্তানায় থাকো, নবাবগঞ্জ, শ্যামনগর, জগদ্দল কিংবা আরও দূরে হালিশহর ছাড়িয়ে ত্ৰিবেণীর তল্লাটে যাও, তোমাকে আসতে হবে।

তা ছাড়া, এখনও তোমাকে দখনে বাওড় তাড়িয়ে নিয়ে আসছে। পোষ-পোড়া, চোত-টোটা গেছে তোমার উপর দিয়ে। সে গঙ্গায় থাকলেও দুর্দিন তোমার সঙ্গ ছাড়বে না। সব সময়।

মোহনায়ও টেকা যাবে না। দক্ষিণে বাতাস নিপাত করবে। ওদিকে, সেই পাট-পচানির কাল থেকে, দুর্দিন শুরু হয়েছে। পাট পচতে আরম্ভ করেছে, মাছ পালিয়েছে। যারা পালাতে পারেনি, তাদের মড়ক হয়েছে পাট পচায়।

চৈত্রমাসে সবখানে দুর্দিন। দুভোগের মধ্যে গাজনের সন্ন্যাস নিয়ে কাল কাটে একরকম। অসময়ে তোমার বিবেক বিবেকাছাড়া হয়। ঘরে বাইরে মারপিট দাঙ্গা হাঙ্গামা করো। নেশা ভাঙ করে।

ওদিকে সমুদ্র ধাক্কা দিচ্ছে চৈত-হাঁকায়, কলিযুগের মালোরা তিষ্ঠোতে পারে না সেখানে। এদিকে জল শূন্য, যেন পোকাটিও নেই। তখন কী হয়?

না, গুণ-ছপটি নিয়ে এসে দাঁড়ায় গাঁয়ে গুণিন-ওঝা। কী হয়েছে? না, পোতনির প্রাদুভোব ঘটেছে। গাঁয়ের মুখে দাঁড়িয়ে গুণিন। লিকলিকে গুণ-ছপটি হিলহিল করে। দুচোখ ভরে আগুন নিয়ে, মুখের ভাঁজে ভাঁজে ক্ৰোধ নিয়ে তাকায় একবার ফোড়নের দিকে, বিল-বাওড়ের ন্যাড়াচণ্ডী, কাক-চিলের খপিশ চোখ মেলা, বিষ্ঠা-ছড়ানো গাছগুলির দিকে। তারপর বলে, হুঁ! কাকে ভর করেছে?

ভর করে মেয়েমানুষকে বেশি। যে মাছমারার নৌকা নেই, তার ঘরনির উপর পোতনির নজর বেশি। সে-ই দেখবে স্বচক্ষে, জলের ধারে বসে বসে কে কাঁদছে খোনা গলায়।

গতরে মাংস নেই, হাড়ে কালি পড়েছে। রুক্ষু শুকু শনানুড়ি চুল, ছেড়া কানি পরনে। খোনা গলায় কাঁদছে ইনিয়ে বিনিয়ে।

যাকে ভর করে, ঠিক তার মতো। চুনুরির বউয়ের মতো, নিকিরির বেটির মতো, ঘরনির মতো মালোর। দেখে ভয় হয়। অচৈতন্য হয় থেকে থেকে। আর কাঁদে ঠিক পোতনির মতো। কোনও তফাত নেই।

তুমি পুরুষ। তোমার প্রাণে লাগবে সবচেয়ে বেশি। তোমার অভাব মেটাতে গিয়ে, বউ-বেটি পড়েছে পোতনির খপ্লরে। তোমার ক্ষমতা নেই, তাই। সেই সময়ে মাথা গরম করলে চলবে না। বিবাগি হয়ে পালালে চলবে না। ওই সময়ে মাছমারা সবাই বিবাগি হয়ে, ঘর ছাড়তে চায়। যাবে কোথায়। শহরের রাস্তায় গিয়ে, হাত পেতে বেড়াবে, বাবু এট্টা পয়সা দিন গো অভাগারে।

ভিখিরি সবাই হতে পারে। বুকে হাত দিয়ে বলো মাছমারা, চৈত্র মাসে সন্ন্যাস নিয়ে যখন দাঁড়াও গৃহস্থের দরজায় ও বুড়ো শিবের চরণে সেবা লাগে, বাবা, মহাদেবো, জয় শিবো… তখন কি একবার মনটা তোমার সিটোয় না? মনে গায় না, তুমিও ভিখিরি হয়েছ? একবার বলো না কি মনে মনে, হে মা ধরিত্রী, তোর চোত-টোটার মার বড় জবর গো।

লোকে বলে, শিয়রে সংক্রান্তি। কেন বলে? ওটা যাওয়া-আসার মাঝখানের সময়। একটা মাস শেষ হয়, আর একটি মাস আসে। এর চেয়ে বড় হল, সূর্যগ্রহণ, চন্দ্ৰগ্ৰহণ।। লয়-সৃষ্টির সন্ধিক্ষণ। ওই সময়ে পবিত্র থাকতে হবে। মন শান্ত রাখতে হবে।

সংসারে দুঃখের ভাগ বেশি। সুখ কম। দুঃখ আসবে। তাতে দিশেহারা হলে, দুঃখ তোমার বাড়বে বেশি। চেয়ে দেখো, সেইজন্যে সংসারে অনাচার বেশি, বেশি মনের পাগলামি।

প্ৰাণে তোমার লাগবে, কিন্তু এই অসময়টা সাবধানে পার হও। এই এক-একটি টোটা তোমার এক-একটি সংক্রান্তি।

গুণিন-ওঝা এসে হুঙ্কার ছাড়ে বাড়ির উঠোনে। শুনে কাঁপ ধরে যায় সকলের বুকে। গোবর নিকিয়ে জায়গা করো। লাল ফুল আনো। ধূপ-দীপ জ্বলো।

তারপর যাকে ভর করেছে, তাকে আনা হয় গুণিনের কাছে। ঠিক পেতনি। সেই মাছখাউনি, পেটের জ্বালায় ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদে যে পেতনি ঠিক তার মতো দেখতে, তার মতো হাবভাব। বুড়ির চেয়ে ষ্টুড়ির ভর বেশি।

তখন তো সে আর মানুষ নয়। শনানুড়ি-চুল এলানো। গায়ে গতরে কাপড়ের ঠিক নেই। খবরদার পুরুষ, কামিনী জ্ঞানে দেখিসনে ওই মেয়েমানুষের অঙ্গের দিকে। মাতৃজ্ঞানেও নয়। ও এখন অন্য জগতের জীব, যে জগতে ছায়া নেই।

কী শক্তি মেয়েমানুষের! ধরে রাখতে পারে না পাঁচজনে। খালি বলে, যাঁবঁ নাঁ যাঁবঁ নাঁ যাঁবঁ নাঁ!…

তা বটে, গুণিনের রক্তচোখ ঘুরছে চরকির মতো। হাতের ছপটি করছে ফটাস ফিটাস। আসন করে বসে, ছোঁড়ে গুণ-সরষে। ও হল সরষে-বাণ। তারপরে ধুলো-বাণ। না হলে, খ্যাংরা-বাণ।

তুমি দেখছ সরষে-ধুলো-খ্যাংরা। আসলে ওটা জ্বলন্ত আগুন। নইলে যাকে মারে, সে কেন চিৎকার করে পরিত্রাহি। কেন মাথা কুটে, দাপিয়ে দাপিয়ে পড়ে আর বলে, অগি আর মেরো না, আর মেরো না, আর মেরো না। গ।

তখন জিজ্ঞেস করে গুণিন, তোর নাম কী? জাত কী? আসা হচ্ছে কোথা থেকে?

–আমার নাম মাছখাগি, জাতে পেতনি, বাস নরকে।

–কোথায় ধরলি একে? যার উপরে ভর হয়েছে, তার মুখ দিয়েই খোনাস্বরে শোনা যায়, কেন, ফোড়নের জল গেছে যে পুবের মাঠের নয়ানজুলির মুখে, সেখানি আমার পিটুলিগাছের গোড়ায় ধরনু।

-কেন ধরলি?

—ধরব না। মাথার সিঁথেয় বাসি সিঁদুর, পেটে দুদিন ভাত নেই। এয়োস্ত্রী মানুষ, রুক্ষু চুল, কানি পরনে, লাজ নেই, লজ্জা নেই, আঁচলে গিঠ নেই, পায়ের আঙুলে আংটা নেই, হাতের নোয়ায় মেছো জল নেগে রয়েছে। দিগবিদিগ জ্ঞান নেই, আমার ওপর দোঁ ছলক ছলক করে গেল হাঁটুজল ভেঙে। ফোড়ন আর নয়ানজুলির হাটুভরা কাদায় হাত দে মাছ ধরবে পাঁকাল, সিঙ্গি, মাগুর, শোল, ল্যাঠা, চ্যাং—আহা! লো আমার মাছখাউনি। একদিন ডাইনে যায়। দুদিন ডাইনে যায়। বাঁয়ের দিন কি আর এমনি ছাড়ে।

হ্যাঁ, এমনি করে কথা বার করে ওঝা ) কথাগুলো শুনেছ। বোঝা তা হলে, কেন ধরেছে তোমার ঘরনিকে।

আবার বলে খোনা গলায়, অত যদি পেটের জ্বালা, ভাতার লৌকো করুক, মহাজনের কাছে বাঁধা খালাস করুক, জাল করুক, ভগবতীর মিঠে জলে গে মাছ ধরুক, আমার কী!

ওঝা হাসে ঠোঁট বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে। চোখ আধবোজা করে মাথা নাড়ে দুলে দুলে। বলে, তা তুই দে না কেন, লৌকো দে, বাঁধা খালাস করে দে।

জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরে, শাঁকচুন্নি হয়েছি। আমি জ্বলিয়ে পুড়িয়ে মারব। —কেন, তুই লক্ষ্মী হ।–না না না। বড় সব ঠাউর এইয়েছেন, বড় সব নকীমন্ত ভাতারের ঘর। আবাগের ব্যাটাদের হা-ভাতে ঘরে আবার নকী। থু-থু-থু। …

মাছমারা, তোমার মনে হয় তোমার ঘরের উপবাসী বউ যেন তোমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে। যেন ঝগড়া করছে তোমারই সঙ্গে।

ওঝা বলে, তা তো বুঝলুম, এখন যাবি না থাকিবি।

—যাব কেন। যাব না। মড়মড় করে ঘাড় ভাঙব, মসটে মসটে খাব, শুষে শুষে খাব।

অমনি বলে, কিন্তু অভাগির চোখ ভাসে জলে। তুমি বোঝ একবার মনে মনে, তোমার বউ বেটি কেন পোতনির হাতে পড়েছে।

গুণিন বলে, হঁ। বলে, ভাল ভাল কথা, তোষামোদ করে, খোেশামোদ করে। তোর পিটুলির গোড়ায় দেব ছাঁকা তেলে মাছভাজা ভাত, দেব টোপর করে সাজজে, প্ৰচিত্তির করব। এখন বিদেয় হ।

অমনি খেপে উঠবে মেয়েমানুষ। সে খ্যাপে, যে ভর করে আছে। চোখে গড়ায় নোনাজল। ঠোঁটের কাশে গড়ায় যে জল, সেটুকুন তো মিঠে। তখন তার লজ্জা নেই। বে-আবরু বুক থাপড়ায় চটাস চটাস, খামচায় শুকনো পেট। চেঁচিয়ে বলে, মিছে কথা, মিছে কথা তোদের। নিজেরা পাস নে খেতে, তোরা আমাকে খাওয়াবি। আমি যাব না যাব না যাব না–

ঠিক খিদেয় পাগল হলে, যেমন বলে মানুষে। শুনতে শুনতে তোমার কত কী মনে পড়বে। কত কী! তুমি পুরুষ, বুকে তোমার কেটে কেটে বসছে, মিছে কথা, মিছে কথা, মিছে কথা।

তখন মুখ খারাপ করে ওঝা। সে সব বাছা বাছা গালিগালাজ শোনা যায় কালে ভদ্রে। ভাল মানুষের আত্মা হলে পালায় সেই গালাগালির তোড়েই। তবে, এর নাম মেছো পেতনি, সে সহজে যায় না।

তখন, গুণ-ছপটি পড়ে সপাং সপাং। কালশিরা পড়ে, রক্ত ফুটে ওঠে। বুকে মুখে পাছায়।

বউ-বেটির গায়ে নয়, ছাপটি তোমার গায়ে পড়ছে। কিন্তু, শক্ত করে রাখো নিজেকে। অসবুর হয়ে না, দিশেহারা হয়ো না। তোমার কত আদরের বউ, কত সোহাগের শরীর। দাঁতে দাঁত মেরে যে রোগের যে ওষুধ। তারপরে, বুকে করে তোমাকেই তেল মাখিয়ে দিতে হবে বউয়ের সর্বাঙ্গে।

যত মার, তত চেচনি, যাব না, যাব না। মাছ নেই মাছ নেই মাছ নেই। জল নেই, জাল নেই, লৌকো নেই, ভাত নেই, কাপড় নেই, পান নেই। যাব না যাব না যাব না।

মার মার মার। সারা গায়ে পিঠে ছপটি। সারাদিন চলে যায়, সারারাত্রি চলে যায়।

তারপর সে যায়। যেতে হয়। তখন ভয় যায়, বিভীষিকা যায়। শুধু ফুলে ফুলে উঠতে থাকে কান্না।

তোমার ঘরনিকে ধরে একজন। তোমাকে ধরে আর একজন।

তখন তোমার ধর্মজ্ঞান নষ্ট হয়। গাজনের সন্ন্যাসীর গেরুয়া রঙের মধ্যে তুমি পালাও। ভিক্ষে করো। নইলে তাড়ি খাও। ঋণ করে নেশা-ভাং করে।

বিলাসের দোষ দেখো তুমি। কিন্তু তোমারও মন তখন ছোঁক-ছোঁক করে। এ গাঁয়ে ও গাঁয়ে ঢলানিদের হাসি-মশকরা বড় ভাল লাগে তখন।

মন বলে, এত দুঃখ-ধান্দা করি, ঘরে একটু সুখ পাইনে। কেন না, ঘরের বউয়ের মুখে হাসি নেই, বাঁচি কেমন করে?

হুঁ, আসলে মরণ তোমার পায়ে পায়ে ঘোরে তখন। মরণকেই বাঁচার চোখে দেখো। সু যায়, লোভ দেখায় কু। আসল সুখ যায়, মদের মতো নকল নেশায় থাকো মজে। নকল সোহাগ নকল পিরিতের ঝাঁজি আসলের চেয়ে বেশি। অল্প জলের মতো। হালে পানি নেই, তাই লাফালাফি।

একে বলে অভাব। আর অকাজের মার।

তখন পরের জমা-নেওয়া পুকুরে বাওড়ে বিলে চুরি করে জাল ফেলতে তোমার আটকায় না। পঞ্চায়েতের সামনে তোমাকে অপরাধ স্বীকার করতে হয়, দুঃখে তখন কাঁদতে হয়, জরিমানা দিতে হয়।

দুঃসময়ে কলঙ্ক ছায়া ফেলে। নিবারণের মতো মানুষ শেষ দিনকে সারাপুলের হাবরে যেত লুকিয়ে মাছ ধরতে।

বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি হাবর। তাতে জিয়নো থাকে নোনার মাছ। ভাঙন, ভেটকি, নোনার যত মিঠে মাছ হাবরে পোষা হয়।

দাদা নিবারণের হাবভাব দেখলেই বুঝতে পারত পাঁচু, মানুষটাকে হাবরের সর্বনাশ ডাক দিয়েছে। আর বুঝত বউঠান।

মানুষটা এই এত ঘোরাফেরা করছিল, কথাবার্তা বলছিল। তারপর হঠাৎ একেবারে চুপ হয়ে গেছে। যেন বসে আছে সব ভাবনার অবসান করে।

–কী হল তোমার?

—কিছু না। এক ছিলিম তামাক দে দি নি।

বউঠান কলকেয় ফুঁ দেয়। আর আড়চোখে দেখে। আপন মনেই বলে, হুঁ, মাথায় শনি ঢুকেছেন। থেমে থেমে, একটু একটু করে বলে। বলে, ভাবসাব দেখে। বলা তো যায় না, মেজাজ কেমন আছে। এখন মা-বাপ নেই। মেজাজের। গাঁকি করে উঠে, দু ঘা দিলেই হল। মেজাজ ঠিক থাকে বা কেমন করে। বউঠানেরা মেয়েমানুষ। পেটের ছা না হলেও, ঘরের পুরুষের সব বুঝতে তার দেরি হয় না। সময়ে তার কাছে সোয়ামি ছেলে এক হয়ে যায়। তখন একই বেশে দাঁড়াতে হয় দুজনের কাছে।

জানে, মহাজনের মন গলেনি। সমুদ্রের কাল নয়, গঙ্গার কাল নয়, মহাজনের মন তাই পাথর হয়ে গেছে। এখন সে নিবারণ সাইদারকেও মানে না। মাছমারাদের খারাপ কথা বলে মহাজন। বলে, তোমার বাড়িতে যাব হে। দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলব। বউয়ের শরীলে কাপড়চোপড় আছে তো। শুনেছি, মেয়েটি তোমার ডাগর হয়েছে।

জলে মাছ নেই। ঘরে মেয়েমানুষ আছে। মহাজন উশুল চায়। চায়, শতকরা দু-চারটে বাড়িতে মহাজন যাওয়া-আসা করে।

ইছামতীতে জোয়ার আসে, ভাটা যায়। রাইমঙ্গলে তুফান তুলে বাতাস আসে সমুদ্রের চাপা গর্জন নিয়ে। ইছামতীর কালো টলটলে জল নোনা। মাছমারার চোখের জলের মতো। পুবে, নোনা কালিন্দীও কেঁদে কেঁদে যায় সমুদ্রে।

গোটা জীবনের টোটার সংবাদ নিয়ে সবাই যায় অকুলে। গঙ্গা, ঠাকরুন, পিয়ালী, বিদ্যাধরী, রাইমঙ্গল, কালিন্দী।

শুনে সমুদ্র ফোঁসে। মাছমারার মেজাজের ঠিক থাকে না। কিন্তু মন মানে না ঘরের মেয়েমানুষের। মাছমারার বউ সে।

হুঁকোর ডগায় কলকে চাপিয়ে বলে বউঠান, হুঁ, গতিক বড় জুতের মনে হচ্ছে না। মাথায় পোকা ঢুকেছে বুঝিন?

জবাবে শুধু থেলো ছকের গুড়ক গুড়ুক শোনা যায়। বড় খারাপ লক্ষণ। নাড়িনক্ষত্র চেনা তো। বউঠানের গলা চড়ে। না, ও সবে আমার দরকার নেই। ঘরে শুকে মরব, তবু পান নে খেলা আমি চাইনে।

প্ৰাণ নিয়ে খেলা বটে। হাবরের মাছ চুরি করতে গিয়ে প্ৰাণে মরেছিল অভয় মালো। সাপে কাটেনি। ড়ুবে মরেনি। কোন অন্ধকার থেকে ছুটে এসে এফোঁড় ওফোঁড় করেছিল একখানি মস্ত ধারালো ট্যাঁটা।

শুধু তার হাতে ধরা ভেটকি মাছটার গোল চকচকে চোখে ছিল অপার রহস্য। অন্ধকারে মীন-চক্ষুর হাসিটুকু চোখে পড়েনি। অভয়ের। তার শমন হয়ে এসেছিল সে হাবরের জলে। ওজন ছিল তার বারো সের।

অভয় গিয়ে মরল টাকির পুলিশের ডাক্তারখানায়। বিচারে সাজা পায়নি কেউ। গেছে শুধু একটা মাছমারা।

মরার চেয়ে ধরা পড়ে বেশি। ধরা পড়লেও বেড়ন খাওয়া রুখতে পারে না কেউ।

নিবারণের এ গুম খাওয়া তো সহজ কথা নয়। চেনে যে। চুপচাপ মানুষটার হুঁকো টানার বহর দেখলে বোঝা যায়, বুকের রক্ত কেমন চলকে চলকে উঠছে। হুঁকোর গুড়গুড়োনি যে আসলে ঘরের লোকের বুকে। বউঠান বলে, কথা নেই কেন ছিমুখে, শুনি? আমি যে ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ করে মরছি, জবাব নেই কেন?

বড় শান্ত গলা শোনা যায় নিবারণের, তবে ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ করিস কেন? চুপ মেরেই থাক না।

—আর তুমি সনজে হলে বের হইয়ে যাবে, না?

তাই যায়। একটু ঘোর ঘোর হয়ে এলেই আর পাত্তা নেই। চিতাবাঘের মতো জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এদিকে তো গুণ-জানা মানুষ। গাব আঠার মতো জমাট অন্ধকারেও চোখ জ্বলে দপদপ করে।

থির থাকতে পারে না পাঁচু। তাকে তক্কে থাকে, না ডাকলেও যেতে হয় তাকে। প্ৰাণ ধরে সে এমন জায়গায় একলা ছেড়ে দেবে কেমন করে।

ধরা পড়েনি কোনওকালে। কিন্তু তাতে দুঃখ না থাক, সুখ নেই একফোঁটা। হুতোশেই প্ৰাণ শুকিয়ে যায়।

সেই মাছ বিকোতে যায় গঞ্জে, হাটে। পয়সা পাওয়া যায় ভালই।

কিন্তু মনের ভাল যে থাকে না। চোলাই রস আর মেয়েমানুষ পাওয়া যায় কাছাকাছি।! বারোমাসের বাসিন্দে আদিবাসীগুলির চরিত্রে আর আদি-অন্ত থাকে না। হাট-বাজারের গ কারবারি-ব্যাপারিরা থাকতেও দেয় না। চাষের মরশুমটি গেল। তো, পেটের ভাতও গেল। আরম্ভ হয় অকাজ কুকাজ।

ধান বলো আর মাছ বলো, তার চেয়ে অনেক কম দামে তখন মানুষ বিকোয়। শরীম নেই। মদ খেয়ে, পুরুষের সঙ্গে হুড়-যুদ্ধ করে পথের উপরেই। খিলখিল করে হাসে। হাসির দমকে তার কাপড় থাকে না গায়ে।

গোটা হাটের পুরুষের রক্তে আগুন জ্বলে।

জ্বলবেই। মেয়েমানুষ, অল্প বয়স, তার সবঙ্গে যেন কাঠফাটা পিপাসার জল টলমল করে। তার উপরে, সে কারুর অধীন নয়। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে গণ্ডুষ গণ্ডুষ খায়।

নিবারণ মাতামতি করে ফিরে আসে। পাঁচু আসে রক্তে জ্বালা নিয়ে। বড় তিরিক্ষি, রক্ত-ওঠা মেজাজ নিয়ে।

একজন সব দেখে। সে মীনচক্ষু।

শুধু বউঠান কথা বলে না। ঘরনিকে ফাঁকি দেবে তুমি। তত সাধ্য নেই। সে তোমাকে চেনে। ক্ষমা চাও, হাত টানাটানি করো, পুরুষ হয়েও দুটি ঝটিকা খেতে হবে ওই হাতের।

—কেন, লজ্জা করে না। হাটের মেয়েমানষের মুখে মুখ দে পড়ে থাকো গে।

জায়ের আঁচ লাগে পাঁচুর বউয়েরও। তারও মেজাজ। সপ্তমে উঠে থাকে। বলে, থাক, আর তোমার মুখ-সাপুটি করতে হবে না। পুরুষ জাতকে চিনতে বাকি নেই।

—আমি আবার কী করলাম! মুখ-সাপুটি করলাম কার!

—একই দাদার ভাই তো।

অমনি পাঁচুর মেজাজ খারাপ!—এই চুপ, মুখ সামাল দে। যারটা সে বলছে। তুই আমার দাদার

ওপরে কথা বলিস না।

পাঁচু নিজেও বলে না। সে যোগ্যতা চাই। ওই মানুষই যখন মাছ মারতে যায়, তখন দশটা মেয়েমানুষ এসেও তার নজর ফেরাতে পারে না। মাছমারার জ্বালা তুমি কী বুঝবে।

নিজের আগুনে সে নিজে জ্বলে। লোকে দেখে আর বলে খালাস। সে পোড়ে নিজের ধিক্কারে।

তবু বউঠানের প্রাণ শান্ত হয় না।—মরণ! ঘরে তোমার অত বড় ব্যাটা, বেটির বে দিলেই হয়। সে মেয়ে আমার কলসির গলা ভরতি জল। কখন কতটুনি চলকে এদিক ওদিক পড়ে, সে ভয়ে বাঁচি না, আমার যে কেউ নাই এ সোমসারে।

বলে, আর জ্বলে পুড়ে কাঁদে।

—ও বিলির মা, শোন।

–না।

–ক্ষ্যামা দে। এই মনটায় পাপ আসে গো, সব সময় বশে থাকে না।

ওই শোনো, ওইটি আসল কথা। এই তোমার অভাব আর অকাজের মার। জীবনের পাপকে তুমি দূর করতে চাও সে তোমাকে ঠেসে ধরতে আসে। তুমি সব সময় এঁটে উঠতে পারো না।

আবার এই মাছমারা-ই না ফিরে আসে মিলের শাড়ি নিয়ে, সিঁদুর-আলতা কিনে! স্যাকরার বাড়ি যায় বালা গড়াতে।

বউঠান তা জানে। জানে, তার দুটি হাতে, যতখানি পারা যায়, রক্ষা করতে হবে মানুষটিকে। দুর্দিনে যেন সে দিশেহারা না হয়। যার এদিক আসতে ওদিক যায় ফসকে।

শেষ বার সমুদ্রে যাওয়ার আগের বছর বিয়ে দিয়ে গেল মেয়ের। বাপ বলল, আমার জীবনের সাধ মেটালি রে নিবারণ, লাত-জামায়ের মুখ দেখালি তুই আমাকে।

অমর্তের বউকে যেদিন ধরল। বিলাস, সেদিন সে ফিরে আসছিল মহাজনের কাছ থেকে। পিরিতের যার বড় সাধ ছিল, সেই ছেলে পিরিতের মুখে কালি দিয়ে, কাঁটা নিয়ে ফিরল। মহাজনের কাছ থেকে ফেরবার সময় মন তার বশে ছিল না।

যে-সে কাটা নয়। বড় উথালি-পাথালি এখন বুক।

আরে মাছমারা, তোর লজ্জা নেই। সুদিনে তুই এক, দুর্দিনে তুই আর-এক মানুষ।

এমনি করে তোর ঘরনিকে ধরে একজন। তোকে ধরে আর একজন।

তারপর আসে বৈশাখ মাস। নতুন জল নিয়ে আসে মুখে করে। সমুদ্রে যেতে পারবে না অবিশ্যি তখন। তখন ঝড়ের কাল। নতুন আশা নিয়ে আসে বৈশাখ। পাঁজ-পুঁথি বেরোয়। বান দেখো, জল দেখো, মাছ দেখো। তারপর চলো, যেখানে সুদিনের বান ডাকছে।

নৌকা যদি না থাকে, মহাজনের কাছে যাও। ভাড়া পাবে। মরশুমে নৌকা ভাড়াও পাওয়া যায়।

কতজন আসছে ভাড়া নিয়ে। একবার দেখতে হবে এই সময়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *