০৭. মরা কোটাল

মরা কোটাল পড়ে গেল। নবমী গেল, দশমী গেল। মরা কোটালের সময় এখন। সামনে অমাবস্যা। জোয়ান কোটাল আসছে আবার সামনে।

—অমাবস্যা কবে গো পাঁচুদা।

—এক গণ্ডা দিন বাদে।

চার দিন বাকি এখনও। থাকলেও বা কী। সে যে অমাবস্যার কোটাল। বষয়ি তার তেমন জোর নেই। তবু একটু আশা।

কেদমে নোঙর করেছে। দু-নৌকা বাদ দিয়ে। বিলাসের সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পরদিন থেকেই সরে গিয়ে নোঙর করেছে। পাশে চণ্ডীপুরের নৌকা। সে নৌকায় আছে শ্ৰীদাম। শ্ৰীদাম বলল, জলে তো বেশ গোলানি ছেড়েছে।

পাঁচু বলল, হ্যাঁ, পাহাড়ে জল ভেঙেছে।

হ্যাঁ, রক্তের ঢল নেমেছে। এই প্রকৃত গঙ্গা। সন্ন্যাসীর গেরুয়া রঙের জটার মতো। জটা খুলে দিয়েছে। জল আরও ঘোলা হচ্ছে। দিনে দিনে গঙ্গা বাড়ছে। জোয়ারের জল ক্ৰমেই উঠছে তার সাবেক সীমানা ছাড়িয়ে। কুলে কুলে ধরছে না। আর। রক্তাম্বরী হা হা করে ছুটছে দিগদিগন্তে। যেদিকে তাকাও, গঙ্গা তার গোটা বাড়ন্ত সীমাকে লাল করে তুলছে। যতদূর সে যাবে দাগ রেখে আসবে নিজের রং দিয়ে।

এই গঙ্গা। দেখতে বড় শান্ত। কোলে তার সবাই মরতে চায়। মরণের সময়ে মরতে চায়। যখন নিদেন আসে। কিন্তু বিষাঁর মরশুমে, গঙ্গার সব ক্ষুধার এক ভোগ্য হল মানুষ। মাছমারা সাবধান। সমুদ্র ঘুরে এসেছ বলে জাঁক কোরো না। নানান বেশে সে ঘোরে তোমার সামনে।

বড় শান্ত। কিন্তু খবরদার, ভুলেও আর মীয়াজীপিরের দহের সীমানায় যেয়ে না। ভাগাড়ের দক্ষিণে, শ্মশানের ভাঙা ঘাটের আওড় তোমাকে পেলে এ জন্মে। আর ছাড়বে না। জোয়ারের ধাক্কা এখন কম। কিন্তু প্রথম বানের মুখে হাত বাড়িয়ে আছে। শমন। আর সাবধান, টানের মুখে কোম্পানির গাধা বোট, লঞ্চ, স্টিমার সামনে পড়লে আর সামলাতে পারবে না। চুৰ্ণবিচূর্ণ হবে। তার জন্যে কেউ গুনোগাথ দেবে না।

অনেক রকমের বিপদ আছে। সবখানেই আছে, সবখানেই সামলে চলতে হয়। নিকনো ঝকঝকে দাওয়ায় অসাবধানে চলতে নেই মানুষকে। বেঘোরে। আছাড় পড়ে, মানুষ সেখানেও মরে।

গোটা বিষায় কিছু খাবে গঙ্গা। কিছু মানুষ, আরও উত্তরে কিছু মাটি। বন্যা হলে তো কথাই নেই। যত উঁচু দিকেই বন্যা হোক, তা হলেই মাছমারার কাল। গঙ্গা ধুয়ে বেরিয়ে যাবে মাছ নিয়ে।

বিস্তর নৌকা এসেছে। পাকিস্তানের বাস্তুহারা মাঝিরা কিছু বাড়িয়েছে তার সংখ্যা।

সবাই দেখছে জলের দিকে। জলে ঘোলানি ভেঙেছে।

তবে মরা কোটাল পড়ে গেছে।

 

—ও খুড়ো, জোয়ান কোটাল আর মরা কোটাল কাকে বলে?

পাঁচ-ছ বছর আগে, জিজ্ঞেস করত বিলাস। জানতে চাইত মাছমারার ছেলে।

বলতুম, কোটাল জানিসনে? শোন, এই যে দেখছিস বিষয়ে জল বাড়ছে, একেই বলে জোয়ান কোটাল। তার রকম আছে। পারাপারের মাঝির কাছে, এই জোয়ান কোটাল। জল আরও বাড়ে, ধরিত্রী রসস্থ হন অমাবস্যায় পুন্নিমাতে।

তখন শুধু জল বাড়ে না। যত জল বাড়বে, তত টান লাগবে। টের পাওয়া যাবে নৌকায় বসে। নৌকার তলা কাঁপছে থরথর করে। এত টান! ওই টান-কাঁপানিকে বলে জোয়ান কোটাল, বুইলি? সবচেয়ে বাড়াবাড়ির দিন কবে? না, বিষাঁর পুগ্নিমাতে, যখন আকাশে সোনার চাঁদ থাকে। কখন? রাতে। পূর্ণিমার নিশির ভাটিতে হবে ভরা কোটাল। তার ওপরে ষোলো আনার মধ্যে চৌদো আনা ভরসা রাখো। মেঘ থাকবে সারা আকাশ জুড়ে, কখনও মুষলধারে, কখনও গুড়িগুড়ি জল ঢালবে, আর পুবে সাঁওটা ডাক ছাড়বে গোঁ গোঁ করে। এই হল জোয়ান কোটাল। জোয়ান কোটালে সে আসছে, যার পিছনে তুমি ঘোরো। আর একজন আসবে ঘোর নিশিতে, অসাবধান হলে সে তোমাকে ছাড়বে না। টেনে নিয়ে যাবে তলায়। সব কিছু তাকিয়ে দেখো। মেঘাচা। জোছনায়, সব যেন কেমন অস্পষ্ট, ছায়া-ছায়া, মায়া-মায়া। মনে হবে, ডাঙার ওপরে কে যেন ওখানে দাঁড়িয়ে, কে যেন সেখানে বসে আছে ঘাপটি মেরে। খুব সাবধান!

অমাবস্যায়ও জোয়ান কোটাল। তবে বিষাকালে পূর্ণিমার কোটালের জোর বেশি।

কদিন থাকবে? দ্বিতীয়া পর্যন্ত টান-কাঁপানি থাকবে। একেবারে চরমে উঠে, চতুর্থীতে টিল দেবে। দিতে দিতে অষ্টমীতে গিয়ে বাঁধন আলগা হয়ে যাবে। দশমীতে একেবারে শেষ। জোয়ান কোটালের একটা আসে, আর-একটা যায়। মাঝে মরা কোটাল।

ভারী গোন কাকে বলে?

সমুদ্রের বান যখন চেতে ওঠে। ফুলে ফেঁপে হাঁক পেড়ে যখন আসে। সে গঙ্গার চোরাবান নয়। মাথা-উঁচু ঢেউ নিয়ে আসে। সমুদ্রের বান যত বেশি উঠবে, তাকে বলে ভরা গোন। কিন্তু মাছ বানে নয়। জলটা যখন নামবে, তখন। এইটা নিয়ম, যত বেগে উঠবে, নামবে তার চেয়ে অনেক বেশি আগে। তাকে বলে, চলন্তা, মুকড়া জল, বলে একড়ি টান, বুইলি?–

মরা কোটালে ইলিশ মাছ নেই কেন?

অষ্টমী, নবমী, দশমীতে কিছু মাছ পাওয়া যায়।

তারপরে ধরিত্রী শান্ত হল। চোখে দেখতে পােচ্ছ না, পৃথিবী দিবানিশি তাপ বদলাচ্ছেন। রসস্থ শরীরে ভার নেমেছে, জলও শান্ত হয়েছে। তার টান কমে গেছে। যার পিছে পিছে তুমি এসেছ, সেই মাছও তোমার মতোই এসেছে ঘোলা মিঠেন। জলের সুদিনের আশায়। কিন্তুন সে গা ভাসিয়ে আসতে পারে না। উজনি মাছ সে। ওইটাই তার জীবন। সর্বক্ষণ সে বিপরীত পথে চলেছে। ভেসে, তার আহার-মৈথুনে। সেই জন্যে ভাটা ঠেলে সে আসে সমুদ্র থেকে, জোয়ার ঠেলে যায় সমুদ্রে। উজান তার বাঁচা। সে তখন একটানা ভাসবে, যখন মরবে। এই মাছমারার মতন।

কেন আসে এই ঘোলা মিঠে জলে? না, সন্তানের আয়ু নিয়ে আসে। তুমি তোমার ছা-পোনাকে আগলে রাখো শত্রুর হাত থেকে। এও তেমনি, তার রুপোলি পেট জুড়ে আছে সোনা-মানিকেরা। লাখ লাখ সোনা-মানিক।

গঙ্গাকে মা বলেছি তার এক কারণ এখানে দন্তাঘাত হয় না। এই প্রবাদ আছে। কামট-কুমিরের দাঁত পড়বে না। এখানে। সেই কারণে ইনি ভগবতী। তবু অন্য মাছ খেতে পারে। সেজন্যে সে আসে গঙ্গার ঘোলা জলের অতল আধারে, শত্রুর চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যে। এসে পেট থেকে ছেড়ে দিয়ে যায়। তার সোনামানিকদের। আর নোনা জলের চেয়ে মিঠে জলে ফোটে ভাল।

সে উজানে আসে পেটে বাচ্ছা নিয়ে। তাকে মারতে এসেছ তুমি।

গোটা সংসারের বুকে এই ব্যথা। দুঃখ পেয়ে না। তা হলে মাটিতে পা দিয়ে তুমি চলতে পারবে না। ইনি ধরিত্রী। এইখানে তোমার জন্ম কর্ম।

এইটি মানুষের ধর্ম। জীব-ধৰ্ম পালন করছ, তুমি। মরবার সময় সে তোমাকে দেখে যায়।

তুমি দেখতে পাও না, কিন্তু একটা দাগ রেখে যায়। আয়ু-শেষের দাগ। নিদেনে দেখতে পাবে তাকে। কেন? না, মরণের সময় তোমার গোটা জীবনকে সে দেখাবে।

 

মরা কোটাল পড়ে গেছে। পাহাড়ে জল ভেঙেছে বটে। মাছমারারা কাল গুনছে অমাবস্যা কোটালের।

তবু কেউ বসে নেই। সবাই জাল ফেলছে ভাটার টানে।

তল্লাটের পশ্চিম পারের মাছমারারা জোয়ার-ভাটা, কোনওটাই ছাড়ছে না। ঘেয়েকোনা থেকে খুঁটেজাল পর্যন্ত, সবই ফেলছে। পুবের মাছমারা এত জাল নিয়ে আসতে পারে না। নৌকায় ঠাঁই নেই। নিজেদের হাতে রাঁধাবাড়া। লোকাভাবও বটে। তল্লাটের লোকদের সে ভাবনা নেই। নৌকায় বাস নয়তো। ছেলে-বউ সবাই হাত লাগাচ্ছে।

লাগালে কী হবে। মরা কোটাল যাচ্ছে। মেহনত সার। তবু, বসে নেই। কেউ। ওর মধ্যেই, দু-চারটে ছোটখাট যা উঠছে।

হিমি আসছে। রোজ। —ওমা। খুড়ো, আজও নেই। এ যে শুধু কটা শিলিঙ্গে, খয়রা দেখছি।

–হ্যাঁ গো মেয়ে। মরা কোটাল যাচ্ছে তো।

বসে নেই। কেউ। বসে বসে নিদেন জাল সেলাই করছে। বিলাস জাল-সেলাইয়ের ফাঁকে, দেখে চেয়ে হিমিকে। হিমি দেখে কালো হাতে জালের ঘর পরানো। বলে, ঢপের দেখছি সব দিকেই হাত চলে ভাল।

দেখো, দেখো, ছোঁড়ার চোখে যেন চড়া পিন্দিমের শিশ দপদপাচ্ছে। অমর্তের বউয়ের বিষ নিয়ে তোর এত পরান-দগদগনি। বুকে তোর বিঁধে রইল কী? না, ধিক্কার। বুক ভরে চাইলি তুই অমৃত। সেই অমৃতের ধারা হল তোর দামিনী ফড়েনির নাতনি। যেন তোর বুকের মধ্যে সত্যি উথালি পাথালি হচ্ছে সোহাগের। পেলে যেন বুকে করি এখুনি। আমি দেখছি, তোর জোয়ান-কোটাল লেগেছে রক্তে। পুবে সাঁওটা ডাক ছেড়েছে মনের মধ্যে।

আর দেখো বুড়ির নাতিনকে। কালো পায়রার পেখমের মতো খোঁপাটি বেঁধে, কেমন বিজলি হানছে চোখে। যত দূর কোশের মেঘ হোক, বিজলি-চমক ঢাকবে তুমি কী দিয়ে! এই কদিনের মধ্যেই শরীরের কুলে যেন বাতাসের শিউরোনি লেগেছে। মাছমারার ব্যাটাকে দেখে মনের মরা গাঙে বান ডাকল নাকি। সমুদ্রের হ্যাঁকা যে উত্তাল হারে আছড়ে পড়ছে সর্বনাশীর বুকে।

বিলাস বলে, তা, মাছ মেরে খাই। হাত না চললে চলবে কেমন করে বলো? তোমার মতো সুখে তো নেই।

পাঁচু গুড়ক গুড়ুক হঁকো টানে, কাশে খকর খকর। কিন্তু কার কী।

হিমি বলে, সুখ দেখলে কোথায় গো?

–দেখে তো মনে হয়।

—বটে?

হিমি তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। অসীম আকাশের তলায় গঙ্গার বুকে, আদিম মানুষের মতো মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে বিলাস।

হিমির শাড়ির পাড়ে, জলের ঢেউ কেটে চলে ময়ুরপঙ্খ। পুবের বাতাস টানে আচল ধরে। কিন্তু অমন চোখে চোখে তাকিয়ে কী দেখে দুজনে দুজনের। যেন দুটিতে কত কালের চেনা, হারিয়ে গিয়েছিল, ছাড়াছড়ি হয়েছিল। আজ বহু দিন পরে, ভাটার জলে মাঝি ভাসে। আর পলিমাটির পিছনে দাঁড়িয়ে সেই মেয়ে। চোখে চোখে বলে, যেন চেনা-চেনা লাগে, তুমি কি সেই মাঝি?

হঠাৎ হেসে উঠে। হিমি বুকের কাপড় টেনে দেয়। হুঁ। নাতিনের জোয়ান বুক আর মানছে না।

–কাজ কর, কাজ কর।

মনের ভাব চেপে শান্ত গলায় বলে পাঁচু, কিন্তু বুকের মধ্যে যেন কাঁকড়ার দাড়া আচড়ায়। চুপ করে থাকতে পারে না। আমনি একবার হিমি দেখে খুড়োকে আড়চোখে। দেখলে কী হবে। ষ্টুড়ির ভারীগোন ডেকেছে বুকে। দুজনের একজনও মানতে চায় না। আর।

হিমি বলে, সব মানষের সুখ তালে তুমি বোঝ?

বিলাস বলে, দেখে যা মনে নেয়, তাই বলি, বুঝব কেমন করে, বলো?

বিলাসকে ছাড়িয়ে হিমির দৃষ্টি পড়ে দূর জলে, তার ওপারে মেঘ-ঘন আকাশে। যেন নাতনির মন আর এখানে নেই। চোখ দুটি যেন সন্ধ্যাতরার মতো বড় বিবাগি আর বোবা হয়ে যায়। তারপরে আবার বিলাসের দিকে ফিরে হেসে বলে, দেখে কি সব বোঝা যায়? ভেবে দেখো একবার, কেমন করে বোঝা যায়?

তারপর চলে যায়। পিছল। ঠেলে ঠেলে, খোঁপার পেখম দেখিয়ে। উঠতে উঠতে আবার তাকায় পিছন ফিরে।

শুধু বিলাসের জোয়ান কোটালের টানে আওড় দেখা যায়। সেখানে পাক দেয় ঘূর্ণি, ফুলে ফেঁপে ওঠে। জালের সুতো জট পাকায় হাতে। মন তার দামিনীর নাতনির সুখের ঠিকানা খুঁজতে চায়।

পাঁচু প্ৰায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বিলাসের উপর সেই মুহূর্তে। হাতের কাছে যা পায়, ছুড়ে মারে। —মরবি, মরবি শোরের লাতি।

কিন্তু জোয়ান কোটালের টান তো ফেরাতে পারে না পাঁচু। শুধু বুকের মধ্যে বড় আছাড়ি-পিছাড়ি ভয় ও রাগের।

 

মরা কোটাল যাচ্ছে। ۔۔۔۔

পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ জমছে। হিলিবিলি বিজলি হানছে আকাশ। সারা আকাশে যেন সাপ ছুটছে কিলবিলিয়ে।

এর মধ্যেই হাতের পায়ের চামড়ায়, আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে সাদা পাঙাস রং ধরছে। কুঁকড়ে উঠছে চামড়া। ফাটাফুটি বারো মাসই এবার চামড়ার তলে মাংস উকি দিচ্ছে একটু একটু করে। চামড়ায় ফাটল ধরছে। হাজা পচা শুরু হয়েছে।

বৃষ্টি নামল। তুমুল বৃষ্টি। অমাবস্যার কোটাল পড়ল।

অমাবস্যার ভোরবেলা, মেঘে গঙ্গায় মাখামাখি হল। বাতাসেও জোর বেশ। দক্ষিণা বাতাস মাঝে মাঝে মুখ থুবড়ে পড়ছে পশ্চিমে, পুবের দমকা বাতাসে। মোচড় দিচ্ছে। আস্তে আস্তে, পুবে বাতাস দখল করবে। সারা আকাশ।

ভোরবেলা ডাকল বিলাস, খুড়ো, ওঠে। জল চলন্ত।

জল চলন্ত। ছাঁইয়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল পাঁচু। কাজের ছেলে। কী দোষ দেবে তুমি বিলাসের। মাছমারার ব্যাটা। জোয়ান কোটালের একড়ি জলের আশায় ওত পেতে বসে আছে। বিজলি-হানা কালিন্দী আকাশ। তার তলে, কালো কুচকুচে বিলাস। জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে সারা গায়ে। হঠাৎ বড় টনটনিয়ে উঠল। পাঁচুর বুকের মধ্যে। বলল, ঘুমোসনি। সারা রাত?

জবাব দিল, তুমি হালে যাও। তোমার সাংলো রেখেছি ওপাশে। আমি নোঙর তুলছি।

ইস। তাঁর সইছে না। মাছমারার ব্যাটা তো। যা করো, তাই করো, বাপের ব্যাটা। ওর বাপ ছিল কাজের বেলায় এমনি দড়ো। এখন কাজের কথা বলে। সারা রাত ঘুমিয়েছি কি না সে হিসাব নিকাশ হবে গড়ান মেরে এসে।

এমন বাপের ব্যাটাকে কী দিয়ে গুণ করলে শহরের ফড়েনি!

নৌক ভাসল। অনেক নৌকা ভেসেছে। বিলাস বলল, টানাছাঁদি ও পারে ফেলব তো?

-হ্যাঁ।

নৌকা পাড়ি দিল। পাঁচু ডাকল কই হে, ছিদেম?

জবাব এল, এই যে, যাচ্ছি, চলো।

—কদম পাঁচু?

–চলে গেছে।

হ্যাঁ। নৌকার টান দেখে বোঝা যাচ্ছে, জোয়ান কোটাল পড়েছে। ঘোর বৃষ্টি। সামনে নৌকা দেখা য্যা না।

-বিলেস।

–বলো।

—দাঁড় ধর, দাঁড় ধর। শ্মশানঘাটের আওড় সামনে

দাঁড় ধরল বিলাস। ভাঙা ঘাটের পাষাণে বড় খলখল হাসি। শ্মশান ধুয়ে যাচ্ছে। মুমূর্ষ ঘরের মধ্যে কোথায় আশ্রয় নিয়েছে সাধু আর কুকুরেরা। শ্মশান জাগাবার কেউ নেই। বৃষ্টিতে ভিজে যেন নেতিয়ে পড়েছে। ওই দূরে দেখা যায়, কলকারখানার লোক নিয়ে পাড়ি দিয়েছে বড় নৌকা।

নৌকার মুখ পুব-উত্তরে। দাঁড় ঠেলছে বিলাস উত্তরে। কিন্তু ভাটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণে। বড় টান জলের।

পুব কিনারে এসে টানাছদি জাল ফেলল বিলাস।

তারপর খুড়ো-ভাইপো প্রথম সাংলো জাল ফেলল। জলে। একজন কাঁড়ারে, একজন গলুয়ে।

—তুই কোন সাংলোটা নিয়েছিস বিলেস। তোর মা যেটা বুনে দিয়েছিল?

—বোধহয়।

—হ্যাঁ, ওটা আটাশ কাটিমের কোহিনুর সুতোর জাল। দেড়শো সুতো লেগেছিল।

সাংলো জাল থাকে তোমার হাতে। জালের দুই লম্বা মুখ, দুই সলি পরানো আছে তাতে। সলি হল কঞ্চি। জালের মুখে সলি, জালের মুখ। ওপরের সলিতে বাঁধা কাছি। সেই কাছি ভাটার ভিতর দিয়ে বাঁধা আছে নীচের সলির সঙ্গে। জাল তোমার হার করে থাকবে মাটিতে। নীচের সলিতে আছে শিল, অৰ্থাৎ ভার। ওই ভারে জাল নেমে যাবে জলের নীচে। আন্দাজ চাই। ঠেকিয়ে নাও জালটি মাটিতে। যখন ঠেকবে, তখন এক হাত তুলে রাখবে। সব সময়, পাতালের মাটি থেকে সাংলো একহাত উঁচুতে থাকবে।

নৌকা করো পুব-পশ্চিমে আড় পাথালি। ভেসে যাও পাথালি নৌকা নিয়ে ভাটার টানে। যে আসার, সে আসবে উজান ঠেলে তোমার জালে। পড়বে এসে হাঁ-মুখে। খবর পাবে কেমন করে? জালের ঠিক মাঝখানে বাঁধা আছে সরু সুতো। তাকে বলে খুঁটনি। সেই খুঁটনি জড়ানো তোমার আঙুলে, যে আঙুলে তোমার সমস্ত মন বসে আছে। জালে তোমার ছোট চাকুন্দে মাকুন্দে পড়লেও, খবর আসবে তোমার খুঁটনিতে। যেমনি খবর পেলে, অমনি ওকোড় মারো কাছি ধরে। যত জোরে পারো। সাংলোর হাঁ বুজে যাবে কাপটি খেয়ে। দেরি নয়, টেনে তোলো। টিল দিলে হাঁ খুলে যেতে পারে। ওকোড় মারা হল কাছির টান। আর এই সাংলো ফেলে পাথালি নৌকা ভেসে যাওয়াকে বলে গড়ান মারা।

কত দূর যাবে? জেটি ছাড়িয়ে বেশি দূরে নয়। এই মাইলখানেক। তারপরে আছে দহ। জালসুদ্ধ হঠাৎ তোমাকেই হ্যাঁচকা দিয়ে টেনে নামাতে পারে।

নৌকা যায় তাড়াতাড়ি ভাটার টানে। টানাছাঁদি জাল আপনি ভেসে যায় আরও ধীরে। এদিকে সাংলো নিয়ে তিন গড়ান দিলে, টানাছাঁদি জেটির কাছে যাবে। গড়ান দিয়ে চলেছে সব নৌকা। নদী যায় উত্তর-দক্ষিণে। কালো নৌকাগুলি, একে একে পাশাপাশি ভাসে পুবে-পশ্চিমে।

—কী রকম বোঝে ছিদেম?

–হবে, হবে মনে হচ্ছে পাঁচদা।

টিকটিকি টিকটিক করে উঠল। নৌকার ছয়েতেই আছে খনার জিভ-খেগো জীবটি।

প্রথম গড়ান দিচ্ছে খুড়ো-ভাইপো। কলকল করে বৃষ্টি ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে সবাঙ্গ। কিন্তু খবরদার! নড়ো না। কথায় বলে, ইলিশ, বড় কান-খড়খড়ি মাছ। তলার জালে তোমার একটু শব্দ হবে, ল্যাজ ঝাপটা দিয়ে সে অন্য দিকে যাবে।

কাছি কেবলই নামাতে হচ্ছে। জল বড় গহিন।

এক গড়ান গেল, দুই গড়ান গেল। তিন গড়ান শেষ করে, সাংলো তুলে রেখে টানাছাঁদিতে হাত দিল।

তিন গড়ান দিলুম-প্ৰথম অমাবস্যার কোটালে। গঙ্গা সাড়া দেয় না এখনও। জলের দিকে একবার তাকিয়ে, দুফালি চলার পাটাতন সরিয়ে, নৌকার জল ছেঁচতে লাগল পাঁচু।

বিলাস টানাছাঁদি পুরো তুলল জলের কিনা ছিটিয়ে। জাল শূন্য।

হুঁ। মেকোও যেন একটু কমই দেখা যায়। সেও আসে উজান ঠেলে। একবার চোখাচে্যুখি হল। খুড়ো ভাইপোতে। মনের মধ্যে দপদপ করে উঠল। পাঁচুর। পাপ, পাপ ঢুকেছে। এই নৌকায়। ওই শোরের লাতি পাপ মন নিয়ে এসেছে।

কিন্তু সব নৌকার অবস্থাই তো সমান। যত সংশয় থাক, ছেলেটার কাজ দেখে তো মনে হয় না। কিছু।

তবু পুরো ভাটা দেখতে হবে। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। বিলাস লগি ঠেলে চলল। উজানে। টানাছাঁদি এ বেলা আর নয়, শুধু সাংলো।

চার গড়ান গেল। আবার এক মাইল উজান ঠেলে এল।

পাঁচ গড়ানের শেষ গিয়ে, বিলাস ওকোড় মারল। কী ওকোড় ছোঁড়ার। চার হাত সাড়ে চার হাত মারে। অত বড় ভার, আর গভীর জলের তলায়।

টেনে তুলল। একটি পাওয়া গেছে। সেরখানেক হবে।

অমাবস্যার কোটালের প্রথম মাছ। সয়ারাম চেঁচিয়ে উঠল, তোর হাত সাখক রে বিলেস। আজকের সকালে এই পেখম, তোর হাতে বাউনি হল।

বিলাস হাসল একটু শুকনো মুখে। মুখ রক্ষে হয়েছে।

উজান ঠেলে আবার জাল ফেলতে যাচ্ছিল সে। পাঁচু বলল, আর নয়। ও বেলার ভাটিতে হবে আবার। রান্না-খাওয়া আছে।

বৃষ্টিটা ধরেছে খানিকক্ষণ। গায়ের জলও শুকিয়েছে গায়ে, শুধু চোখগুলি লাল-টকটক হয়ে উঠেছে।

দামিনী এল আজ ককাতে ককাতে। সঙ্গে সঙ্গে হিমি চুপড়ি কাঁখালে।

ওই দেখো, এত কাজের দড়ো ছেলে। পাঁচ গড়ান মেরে এসেও তোর চোখে মুখে কীসের ভর হল রে। আমনি দেখি তোর জলে-ভেজা মুখে বাতি দপদপ করে।

বুড়ির নাতিনের চোখেও ভরের ইশারা। রাধে আমার কী কেষ্ট পেল, অ্যাঁ? আজ আবার তিন চোখ নিয়ে এসেছে ছুড়ি। কপালে একটি টিপ দিয়ে এসেছে।

পাঁচু বলল, অমাবস্যের কোটাল তো কোটাল নয় দামিনী দিদি। মরা কোটালের মুখে এট্টুসখান টান জোর। পেয়েছি। একখানি।

–মাত্তর!

মাত্তর! তোমাদের কাছে তাই।

শুনে বড় টনটন করে বুকের মধ্যে। মাছমারার দুঃখ, মাছ-বেচনদার কোনও দিন বোঝে না। ওই না পেলে যে ভাটার টানে ড়ুবে মরতে ইচ্ছে করত।

হিমি বলল, সাংলোতে উঠল?

–হ্যাঁ!

-কার?

—বিলেসের।

তিন চোখ দিয়ে বিধলে হিমি বিলাসের প্রাণে। বললে, ঢপ তালে বেশ পয়মন্ত আছে।

দামিনী বলল, ও মা! ঢপ আবার কে লো?

হিমি হেসে উঠল খিলখিল করে। বলল, কেন, আমাদের খুড়োর ভাইপো।

দামিনী বিলাসের দিকে একবার দেখে, আবার দেখল হিমির দিকে।

বুঝি শিউরে উঠল বুড়ি ফড়েনির বুক। সব-আগুন-নিভে-যাওয়া বুকে একদিন বড় বাসনা ছিল, সমুদ্রের ফড়েনি হবে সে। নাতিনকে যেন সেই নেশায় ধরেছে। বড় যে সর্বনাশের নেশা। ও লো মই সোনার পালদের চেয়ে রাজভোগের চেয়ে, ওর টান যে অনেক বেশি। করেছিস কী

হুঁ, দেখো, দেখো, চেয়ে তোমার গুণবতী সর্বনাশী নাতিনের কাণ্ড। লাখ টাকার মানুষ ফেরায়, ধরে বাঁধে মাছমারার ব্যাটাকে। রাঁড়ের মেয়েকে কত তুক না জানি শিখিয়েছ দামিনীদিদি, তোমারই ছায়া তো!

বিলাস বলল, একটা তো মাছ, এ কী আর পয়মন্ত হলুম।

দেখো, সারা শরীর দুলিয়ে কেমন গলুয়ে উঠে আসছে মেয়ে। মুকড়া জলের টানা ঢল কেমন কলকল করে আসছে।

দামিনী বলল, আবার নৌকায় উঠলি কেন?

পাচু ছিল কাঁড়ারে। নৌকা তখনও নোঙর করেনি। হাল ঠেলে রাখতে হচ্ছে।

দামিনীর কথার কোনও জবাব না দিয়ে বিলাসকে বলল হিমি, দেও, মাছ ওজন করে দেও।।

বিলাস বলল, বসে, লৌকো নোঙর করি আগে।

দুটো মানুষ সামনে পিছনে। ভয় লজ্জা কিছু নেই। কপালের টিপ দিয়ে চিকুর হেনে হিমি বলল গলা নামিয়ে, নোঙর না করলে কী হয় ঢপ?

বিলাস হিমির দিকে চোখ তুলে বলল, ভেসে যাবে।

—অকুল পাথরে নাকি?

বিলাস বলল, হ্যাঁ, বড় আকুল। ডাঙার মানুষের প্রাণ কাঁদবে সেই অকুলে।

–কেন?

–ভয়ে।

-কীসের ভয়?

–প্রাণের।

—প্ৰাণের ভয় না থাকলে?

—মন গুণে ধন। মনের ভয় আছে না?

—তবু অকুলে যে বড় মন টানে ঢপ?

নোঙর করে হেসে বিলাস বলল, টানে? টানবে বইকী, সবাইকে টানে। আমি তাই যাব। আমি সমুদ্রে যাব। এখন নোঙর করেছি। তোমার ঘরের তলায়।

সমুদ্রে যাবে, সমুদ্রে যাবে। এই সর্বক্ষণ ওর কথা। হারামজাদা উজানে মাছ গো। যেখানে মরণ নিয়ে বসে আছে পাষাণের বাধা, সেইখানে মাথা কোটে।

মাছ মেপে দিল বিলাস। দিয়ে বলল, খাঁটি ওজন দিলাম।

হিমি বলল, একটু বেশি ঝোঁকতা দিলে যে!

—তোমার ঘরের তলায় আছি, তাই।

আরো সর্বনেশে, এত যে তোদের রাগ, এত বিরাগ, সে কী শুধু চোরাবানের ছলনা। কখন যে অনুরাগের জোয়ারে গলা-জল হয়েছে, দেখতেও পাইনি।

দামিনীর মুখখানি ভার দেখাচ্ছে।

চলে গেল দিদি-নাতিনে। যাওয়ার আগে বলে গেল হিমি, আমার ঘরের তলায় যদি নোঙর করেছি, দাওয়ায় উঠেসে বসো একদিন।

 

দিদি-নাতনি অদৃশ্য হল। পাঁচু চাপা গলায় গর্জে উঠল, সাবধান, সাবধান রে কেউটে। দাওয়ায় যদি উঠতে চাইবি কোনও দিন, তবে তোর বিষদাঁত ভাঙব আমি।

—বিষদাঁতটা পাবে কমনে তুমি?

শোনো কথা।–হারামজাদা, পাণে মারব তোকে।

ছাইয়ের মুখছাটের কাছে শিল-নোড়া নিয়ে বসে বলল বিলাস, শুদু শুদু মারতে যাবে কেন আমাকে?

—শুদু শুদু গুয়োটা? মাছ মারতে এসে তুই শহরের ফড়েনির সঙ্গে পিরিত করবি?

—তা পিরিত কি কারুর হাত-ধরা।

—চুপ, চুপ ঢ্যামনা কমনেকার।

–ঢ্যামনা তো ঢ্যামনা!

নৌকা দুলিয়ে বিলাস, শিলের বুকে নোড়া দিয়ে হলুদ থ্যাঁতলাতে লাগল।

ভেসে যায় বুঝি সব। বাঁধা সুখের ঠিকানা খোঁজা অনেক দূরে। ঘর-গেরস্থি থাকলে হয়।

 

তিন নৌকা ফিরে এল শূন্য হাতে। কেদমে পাঁচু তার মধ্যে একজন।

বৃষ্টি আর এল না। কিন্তু জল বাড়ছে দুরন্ত গতিতে। জল হয়েছে টকটকে। বিকালের ভাটায় চার গড়ান দিয়ে ফিরতে হল শূন্য হাতে।

দামিনী এল একলা। —ওমা, পাওনি কিছু?

–না।

বিলাস তাকিয়ে আছে উঁচু পাড়ের দিকে। নাতনি আসেনি দিদিমার সঙ্গে।

দামিনী বলল, তা-লে যাই, ঘরটা খালি রয়েছে। নাতিন তার সইয়ের বাড়ি গেছে বেড়াতে।

চলে গেল দামিনী। দেখো, ছেলের মুখ জুড়ে যেন মেঘ নামল। থমকানো মেঘ, বাতাস নেই।

শ্ৰীদাম বলল, জলের গতিক কিছু বুঝিনে পাঁচদা।

—গতিক বোঝার সময় হয়নি ছিদেম। এই হল আসল পাহাড়ে-জল। অম্বুবাচীতে আসে পশ্চিমের গাঙে জমা জল। এখনকার জল ঠাণ্ডা। মাছ আসতে চাইছে না। দেখছি না, মেকো মরছে বিস্তর। তারাও চলে যাচ্ছে।

—কিন্তুন পাঁচদা, দেখতে দেখতে আষাঢ় কাটছে। কাল থেকে শাওন মাস পড়ে যাচ্ছে। এদিকে যে চাল বাড়ন্ত।

চুপ চুপ চুপ। ওই একটি কথা পাঁচু অষ্টপ্রহর গুনগুন করছে মনে মনে। মুখ ফুটে বলেনি, শুনতেও চায়নি। কুড়ি দিনের চাল নিয়ে এসেছিল পাঁচু। তেরো দিন কাটল তার মধ্যে।

তবে সুদিনের বান ডাকবে গঙ্গায়, ভয় কী? সেই আশায় সবাই এসেছে, যুগ যুগ আসছে। বলল, একেবারে বাড়ন্ত নাকি ছিদেম?

—আজ রাত্তিরটা চলবে।

—বড় কম নে এয়েছ ভাই। নগদ কিছু এনেছ?

—আছে, কয়েকটা দিন চলবে।

–দেখো, কী হয়।

আবার রাত্রের ভাটায় ভাসল মাছমারা। মন মানে না। এক ভাটাও ছাড়বার উপায় নেই। এই জোয়ান কোটালের চলন্ত। টানে তার মনে হয়, সংসার ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু যার আসার সে আসে না। জলেঙ্গা জল, তোমার নিশানা দেখাও।

খুব সাবধান। রাত্রের অন্ধকারে আঘাটে গিয়ে পোড়ো না। জেটির কাছ থেকে ফারাক থাক। নৌকার হ্যারিকেনখানি রাখো ঠিক ছাঁইয়ের মুখছাটের কাছে বুলিয়ে। ওইটি তোমার অন্ধকারের চিহ্ন। নইলে লঞ্চ-স্টিমারে ধাক্কা লাগতে পারে। পরের নৌকা ঠোক্কর দিতে পারে। পাঁচাইনে জরিমানা করতে পারে পুলিশ। যদিও পুলিশের মোটেও টান নেই গঙ্গার ধারে।

ফিরে এল খুড়ো-ভাইপো শূন্য হাতে।

রাত পোহাতেই চড়চড়ে রোদ। সবঙ্গে যেন শত শত টিকার আগুন জ্বালিয়ে বিঁধে রেখেছে। গায়ে। সারা গায়ে ঝরে টোপনি। স্বাদে নোনতা। কিন্তু হাত দিয়ে দেখো, তেল। মাছমারা ঘামে না, ওটা তেল বেয়ে বেয়ে পড়েছে। মাছের মতো, মাছমারার ঘাম নেই।

টানাছাঁদি পড়ল। উঠল শূন্য জাল।

তিন গড়ানের উজান ঠেলে, চার গড়ানের মুখে, পাঁচুর সাংলোয় ধরা দিল একটি মাছ।

চোখে চোখে তাকাচ্ছিস মীন। প্ৰাণে মারতে চাস আমাদের। দূর সমুদ্রের কী বাতা নিয়ে এসেছিস তুই, একবার বল। বড় ভয়ংকর হাসি দেখি তোর অপলক চোখে। পাঁচুকে ভয় দেখাচ্ছিস। ভয় পায়, প্ৰাণের জন্যে নয়, তবু প্ৰাণেরই জন্যে। সবাই তোর পথ চেয়ে আছে!

কী সংবাদ নিয়ে এসেছিস তার কাছ থেকে। যাকে আমি রেখে এসেছি তোদেরই রাজ্যে, সাত বছর আগে। আমার বড় ভয়, আমি যে ভুল করে এসেছি। আমি কশার বেঁধে আসিনি। অগুনতি কাশের মুণ্ডু জট পাকিয়ে বেঁধে রেখে আসতে হয়। নতুন কোনও মাছমারা গেলে, সেই দেখে জানতে পারবে, সেখানে কোনও মাছমারার মরণ হয়েছে। দেখে তুমিও সাবধান হও। বশীরও বেঁধে রেখে আসেনি। আবার কেউ প্ৰাণ হারাল কি না, সেই আমার ভয়। রক্তচক্ষু মীন, কী সংবাদ এনেছিস বল।

দক্ষিণে বাতাস বুক চেপে পড়ছে গঙ্গায়। মাঝে মাঝে অস্ফুটে উঠছে। ককিয়ে পুবে বাতাসের মোচড়ে।

আর-একটি গড়ান দিল বিলাস।

গায়ের টোপানি মুছে পাঁচু বলল, তুই দে। আমি আর পারব না এখন সাংলোর ভার নিয়ে বসে থাকতে।

বিলাস কাঁড়ারে বসে, বৈঠা নিল কোলে অথাৎ পায়ে। হুঁকো টেনে দিল পাঁচু ভাইপোর হাতে। তোমার যা কিছু ঘর-গেরস্থি সহবন্ত, তা তুলে রাখো এখন ঘরের জন্যে। যদি মেহনতি হও, তবে মেহনতের সময় বাপ-ছেলের মাঝে কোনও দূরত্ব রেখো না।

বিলাস দুটান দিয়ে ফিরিয়ে দিল হুঁকো।

গড়ান শেষ। সামনে আওড়। আঙুলে জড়ানো খুঁটনি কোনও সংবাদ নিয়ে এল না। নিজের হাতে উজান ঠেলে ফিরে গেল বিলাস উত্তরে। কালো মূর্তি সেদ্ধ বেগুনের মতো হল। বলল, আর এট্টা গড়ান দেখাব?

—না ফিরে চ।

এদিকে মাছমারার জেদ আছে ঠিক। ছেলের প্রাণ বড় অশান্ত। ও যে বড় অশান্ত, ওর বাপের মতো। গড়ান মেরে খালি জাল তোলে আর দূর গঙ্গার জলে তাকিয়ে থাকে। ছেলের মন বুঝি অস্থির করে। দিন হিসেব করে সমুদ্রে যাবার।

বড় রোদ! গামছা বেঁধেছে মাথায়। বিলাস জল ছিটিয়ে দিল গায়ে মুখে। আর দেখো, রক্তগঙ্গা কেমন দগদগ করে রোদ বিকিমিকিতে।

মাছ নিয়ে গেল দামিনী। নাতনি এল না। বলে গেল, কাকে বলি পাঁচুদাদা। সেই চুচড়োর লোকটি আবার এসেছে। বলছে ছুড়িকে, চল। উঁহু। ঘাড় বেঁকিয়ে দিয়েছে। বলে, যেতে-টতে পারব না। ও সবে আর নেই। এসেছ, ব, যা, দু-দণ্ড গল্পগুজব করে যাও। রাজি আছি। পিরিতের খোয়ারি কাটাতে আর আমি পারব না! কত হাতে পায়ে ধরাধরি করছে। একবার ভুল হয়েছে, বারে বারে হবে না। উঁহু! বলে, নিজের সঙ্গে কারচুপি আর ভাল লাগে না। যা হবার তা হয়ে গেছে, আমার মন এখন চায় না। কপাল ভাই পাঁচুদাদা। মন গুনে ধন, দেয় কোনজন। মনের ফাঁদ নিয়ে তুই আবার কোথায় ধরা পড়েছিস, কে জানে।

চলে গেল দামিনী মাছ নিয়ে।

কী দেখিস তাকিয়ে তুই উঁচু পাড়ের দিকে। কে তোকে কোপ দিয়েছে বুকে। কেউ দেয়নি। কোপ খেয়েছিস তুই নিজের হাতে। মাছমারার ব্যাটা মাছমারা থাক। মালোর ঘরের মেয়ে আসবে তোর ঘর আলো করে। শহরের মাছ-বেচুনি ফড়েনিতে তোর কী দরকার।

—তিবাড়িতে আগুন দে বিলেস।

–মন নেই দিতে! তুমি দেও।

শোনো! এ যে বেগড়বাই করছে। কিন্তু বলেই আবার উঠল নিজে। —শালার পেট মানেও না। আগুন দেব পেটে এবার।

বাপের বসানো কথা। এ তো মেয়েমানুষের জন্যে ক্ষোভ নয়। স্রোতের জল থেকে শূন্য জাল ঝেড়ে তোলার যন্ত্রণা।

তৃতীয়ার দিনে খুড়ো-ভাইপো চারটি মাছ পেল।

বড় অনিশ্চিত। পাঁজির কথা টিকতে চায় না। যখন হয় না, তখন পাঁচ ভাগ, দশ ভাগ কিছুই হয় না। হল তো তোমার সব ভরে উঠল। কেদমে পাঁচুও পেয়েছে। সয়ারাম পেয়েছে তিনটি মাছ।

সংসারে দুটো জিনিস হাতের কাছে চেয়ে না পেলে তুমি অনৰ্থ করতে পারো। মহাজন-জোতদারের সঙ্গে বনিবনা না হলে ধর্মের ঘট বসিয়ে পুজো দিয়ে, দশজনে মিলে পারো একটা ব্যবস্থা নিতে।

কিন্তু এখানে! এই অগাধ জলের তলায় বসে কে কলকাঠি নাড়ছে মাছমারার জীবনের, তা আমরা জানিনে। যার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয়, সে মীন।

এই স্রোতের বুকে তুমি ছাপটি হাকিতে পারো, গালাগাল দিতে পারো। কিন্তু সে দৃকপাত করবে না। খিলখিল করে হোসে, দহে ফুলে, ঘূর্ণি পাকিয়ে সে যাবে চলন্তায়, আসবে আগনায়। এই তার নিরন্তর খেলা। মহাসমুদ্রে গিয়ে, হাসবে অট্টহেসে। কত মারা তুমি তাকে দেবে।

তোমাকে সে এমনি করে মারে।

থাক, এ চারটে মাছ আর নিয়ে যাব না। দামিনীর কাছে। দিয়ে যাই পুবপারের পাইকেরকে বেচে।

পাইকেরা ফড়েরা এখন আর শুধু ডাঙায় বসে চেঁচাচ্ছে না, আছে নাকি? আছে নাকি কত্তা? এখন তারা অনেকে নৌকা নিয়ে ঘুরছে জেলের পিছে কেলে হাঁড়ির মতো।

বিলাস বলল, মিছিমিছি। এট্টা অন্যখ করবে। রসিক দেখেছে মাছ পেয়েছ। দামিনী জানলে—

সত্যি কথা। একলা পাঁচু নয়। অনেকেই এ রকম করছে। তার জন্যে দুৰ্গতিও কম হচ্ছে না। পাওনাদারে ধরে রাখছে নৌকা। মাছ ধরাই বন্ধ। এত দিনের চেনাশোনা। ফাঁকি দিলে পরে নিজের ফাঁকি পড়তে পারে। বিশ্বাস একবার ভাঙলে আর ফিরে আসে না। বিক্রি করতে হয়, জানিয়ে করে। অবিশ্বাসী হয়ে না।

পাঁচু বলল, ফিরে চল। পাড়ি দে।

হাল পাঁচুর হাতে। বাতাস আছে ভাল। বিলাস পাল তুলে দিল। দিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে তাকিয়ে রইল দক্ষিণে।

তারপরে হঠাৎ যেন মাথা ঝাড়া দিয়ে বলে উঠল, খুড়ো, সমুদ্রে যাব আমি এবার টানের মরশুমে।

—কী বললি! হাল বেঁকে গেল। জল বাড়ন্ত। চলন্তার চলাকায় ধুয়ে যাচ্ছে গলুই। বেগে বাতাস এল দক্ষিণ থেকে। এমন করে তো কোনও দিন বলে না বিলাস।

—সমুদ্রে যাবি?

–হ্যাঁ, সমুদ্রে যাব।

—তবে কি সকল মানষে এদিন ধরে তোর সঙ্গে মশকরা করেছে? যাওয়ার তোর বারণ আছে না?

–মারব মাছ, তার আবার বারণ। আমি মালো।

কিন্তু পাঁচুর কুটোকোটি মুখখানিতে রাশি রাশি পুঁয়ে যেন কিলবিল করে উঠল। চোখে দেখা দিল রক্ত। বলল,—বুইছি, শোরের লাতি, মেয়েমানুষের জন্যে তুই বিবাগি হতে চাইছিস।

—মেয়েমানুষের জন্যে?

–হ্যাঁ। ওই রাঁড়ের মেয়ের জন্যে।

—না। ভগবতীর মেয়ে এলেও, সমুদ্রে যাব খুড়ো। গঙ্গায় আমার মন মানছে না আর।

পাঁচু দেখল, বিলাসের বিশাল কালো শরীরে ঢেউ লেগেছে। সমুদ্রের। গঙ্গা ওকে ধরে রাখতে পারছে না। বুকের মধ্যে বড় ধুকধুক পাঁচুর। তবু চিৎকার করে উঠল, সাবধান-গেলে তোর অকল্যেন, সোমসারের অকল্যেন। সবাইকে তুই পাণে মারতে চাস রে যম কমনেকার।

বিলাস যেন কোনও এক ভাবের ঘোরে গলা চড়িয়ে বলল, আমার বাপ গেছে, তার বাপ গেছে, তুমি গেছ খুড়ো। মাছ মারি আমি, আমি সাগরে যাব।

সাগরে যাব! সাগরে যাব। গায়ে কাঁটা দিতে লাগল পাঁচুর। ভয়ে চিৎকার করে উঠল, চুপ কর বিলেস, শোরের লাতি।

গলুয়ে চলক ভাঙছে। জালের তলায় যেন কারা ঝাপাই বুড়ে, তোলপাড় ঢেউ তুলে দিয়েছে। বাতাসে ছুটে যেতে চাইছে পাল।

বিলাস যেন দূর থেকে বলল, খুড়ো, মিছে তোমার ভয়। আমি সেই ফোড়নের মুখে গেছলাম, যেখেন থেকে খালি লৌকো ফিরে এয়েছিল। বশীর আমাকে দেখিয়েছে। আমি কশার বেঁধে দে। এয়েছি।

নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল পাঁচুর। ওরে সর্বনেশে, কশার বেঁধে এসেছিস, তবু তুই মরতে যেতে চাস। মরণ বুঝি এমনি করে ডাকে।

ডাকুক, কিন্তু, বাঁধা সুখের ঠিকানাটি কার কাছে রেখে যাবে পাঁচু। বলল, সকলের পাণ মুঠোয় নে সমুদ্রে যেতে চাস তুই? যাওয়াব তোকে আমি। তার আগে তোকে লড়তে হবে আমার সঙ্গে। দুজনের এটা নিকেশ হব, তা পরে যা হবার হবে।

কিন্তু একটানা স্রোতের একড়ি জলের মতো বিলাসের মন যেন ঢলে নেমে গেছে। সে আর কথা বলে না।

চলন্ত হাসছে খলখল করে। দূর গড়কে আগনার লক্ষণ। বাতাসে আঁশটে গন্ধ। মেকোর মরণ ঘটেছে।

মাছ নিতে এল দামিনী। আন্তরবালা এল আর এক দিক দিয়ে। দামিনীর সঙ্গে সঙ্গে এসে দাঁড়াল নৌকার কাছে। আর যেন কেমন করে চেয়ে চেয়ে দেখল। সে বিলাসকে। দেখে দেখে হাসল ঠোঁট টিপে টিপে।

দামিনী চলে যায় মাছ নিয়ে। বিলাস ডাকল, ওগো, ও ঠাকরুণ, শুনছ।

দামিনী ফিরল। — আমাকে বলছ?

—হ্যাঁ। তোমার লাতিন আসে না যে?

শোনো, শোনো ড্যাকরার কথা।

আতর হেসে উঠল খিলখিল করে। বলল, ওমা। কথাটা মিছে শুনিনি তালে মাসি। এদের মরণ ঘটেছে!

দামিনী রেগে উঠে বলল, আমার লাতিনে তোমার পেয়োজন?

—তা কী জানি। মন করল জিজ্ঞেস করতে, করনু। জবাব দেওয়া না দেওয়া তোমার মন।

হ্যাঁ, আরো সর্বনাশ! ঝগড়া করিস তই কাদের সঙ্গে? লজা-শরমের মাথা খেয়েছিস একেবারে এত বে-সামাল হয়েছে তোর প্রাণ? ভয়ও কি নেই একফোঁটা? আরো ইল্লতে, আরো মরণ!

কিন্তু দামিনী বা দেখে কী বিলাসের দিকে আমন করে? বুঝি নিবারণ সাইদারের ছায়া দেখছে বিলাসের মধ্যে। সে যে সমুদ্রের ফড়েনি। হতে চেয়েছিল, সেই কথাটি গায় বুঝি তার মন।

আতর যেন রাধার সখী বৃন্দা দূতী। রুপোর বিছোহারে বাঁধা তার আকুল কোমর। বাসি চুলে পান। রাঙানো ঠোঁটে, রং সর্বক্ষণ। চোেখ ঘুরিয়ে হেসে বলল, আমার ছোটমাসি আর আসবে না। বলেছে। তার মরণ আছে ঘাটে, মরতে আর ঘাটে আসবে না, বুয়েচ?

দামিনীর পাতা-ঝরা ন্যাড়া বুকে বাতাস লাগল। আতরের কথাগুলো শুনতে শুনতে, স্রোতের মতো পাক খেতে লাগল বলিরেখা মুখ। চলে গেল বিড়বিড় করে।

আতর হাসতে হাসতে গেল কেদমে পাঁচুর নৌকার কাছে। মাছ ছিল কেদমের, দিয়ে দিল। কিন্তু যেন চুরি করে দিল। বড় ভয়ে ভয়ে বাপ-ব্যাটারা উঁচু পাড়ের দিকে তাকায়।

যাওয়ার আগে, আতর ঘোমটা তুলে, আর-একবার হেসে বলে গেল, বড় জবর মরা মরেছ খুড়ো, তবে এখেনে কেন?

বিলাস যেন হাঁদা গঙ্গারাম। তাকিয়ে রইল পশ্চিমের উঁচুতে।

রাগে পাঁচু গরগরায়, তার চেয়ে হুতোশ বেশি। ওরে আমন করে তাকাস কী। নিয়ে এলি উথালি-পাথালি বুক। তার উপরে বৃষ্টি নামালি অন্ত্রানের। এবার দেখছি তোর ফতুর হওয়া বাকি।

বিলাস তিবড়িতে আগুন দিয়ে গেয়ে উঠল,

আমার কিছুতে নাই মন ।
আমি ভাসব অকুল পাথরে হে
এই আমার মতি বিলক্ষণ।

হে মা গঙ্গা, হে খোকাঠাকুর, বিলাসের আমার এই বিলক্ষণ মতি। আমি জানি, ও মাছ মারে। জলের তলায় বড় সংশয় তার জীবন। মীনচক্ষু সব সময় ডাক দিয়ে নিয়ে যায়। তাকে অকুল পাথরে। সেইখানে তার আসল মরণ-বাঁচন। চারদিক থেকেই ডাক পড়েছে বিলাসের।

কিন্তু আমার রক্তে আর অকুলের ডাক নেই। ডেকে ডেকে সে মরেছে। যার মরেনি, সে আর ফেরেনি। আমি কুলে ভিড়তে চাই।

বিলেস, অকুল বড় ভয়ের। তোকেও কুলে ফিরতে হবে।

 

একটু বাদেই এলেন ব্ৰজেন ঠাকুরমশাই, কদম পাঁচুর মহাজন।

মাছমারা মানুষ, ঠাকুর তাদের তুই-তোকারি ছাড়া কথা বলেন না। দশ-বিশ গণ্ডা জেলে নিয়ে তাঁর কারবার। সব রকমে বড় পাইকের উনি এই গঞ্জের। বাইরের চালানিও বিস্তর আসে ঠাকুরের। ঠাকুরকে দেখে, কেদমের মুখখানি আমসি হয়ে গেল। বলল শুকনো হোসে, এই যে, আসেন ঠাকুরমশায়!

ঠাকুর বললেন, কী রে, মাছ পাসনি?

হাত দুটি জোড় করল কেদমে। বলল, পেয়েছিলাম গো মশায়, দিয়ে ফেলিচি।

–দিয়ে ফেলিচি?

ঠাকুরের ফরসা মুখখানি লাল হয়ে উঠল। খবর জানতেন আগেই।

বামুন মানুষের ছিরিমুখের কথা শোনো, তোর কোন বাপের ধন দিয়ে ফেলেছিস? গত সনের কটা টাকা শোধ দিয়েছিস, অ্যাঁ? দিয়ে ফেলিচি!

মহাজনের এমনি কথা। তার ওপরে শহুরে বাস। গাঁয়ের মহাজনের ভালমন্দ বুঝতে কষ্ট হয় না। সে প্ৰাণে মারবে কিংবা রাখবে, গতিক দেখে ঠাহর পাওয়া যায়। শহরের ব্যাপার বোঝা দায়।

কেদমে বলল অন্যায় হয়ে গেছে ঠাকুরমশায়, বড় কু-কাজ করেছি। তিনখানি রাত পোহালে আর এ মনিষ্যি কাঁটার পেটে কিছু পড়বে না। তাই নগদা বেচে দিইচি।

যথার্থ কথা, নিৰ্যস প্ৰাণের কথা। ওই এক ব্যায়রামে মরেছে তাবৎ মাছমারা। কোথাও তার সত্যরক্ষা হয় না।

কিন্তু ঠাকুর মানবেন কেন। বললেন, প্ৰাণ জল করে দিলে। এই শ্রাবণ মাস, ভাল চালান নেই, নদীতে আঁকাল, শালা আমাকে তিনটে মনিয্যির পেট দেখাচ্ছে।

শোনো মহাজনের বচন। তাই পাঁচু বলে, ওরে মাছমারা, সুদিনে তুই এক, দুর্দিনে তুই আর-এক মানুষ। তোর মরণ নেই, তাই পেটের দায়ে তুই মিছে কথা বলিস মহাজনকে।

উপরের পাড় থেকে নেমে এল রসিক। সেও ঠাকুরের দাদন খায়। যেন ব্যাপারটি আৗচ করে বলল, মাছ বেচে দিয়েছে বুঝিনি? বুয়েচি বাবা, আতরবালাকে বেচে দিয়েছ। রোজ দেয় ঠাকুরমশাই, একদিন আর কী করবেন। দেখতে সব ভালমানুষ, ভাজার মাছটি উলটে খেতে জানে না। তলে তলে সব ঘুন।

ঠাকুরের মুখ দেখে বোঝা যায়, তেতে এসেছেন আগে থেকেই। কে তাতিয়েছে বোঝা এবার।

বিলাস বলে উঠল, ওই এলেন আবার শানাইয়ের পোঁ।

কথাটা ভাল শুনতে পায়নি রসিক। কিন্তু বিলাসের ভাব দেখে ফিরে তাকাল।

পাঁচু চাপা গলায় খেঁকিয়ে উঠল, চুপো, মাকড়া কমনেকার।

ঠাকুর বললেন, কেন, ও মাগির মুখ বড় মিষ্টি লেগেছে বুঝি? দেখছি। শালার জাত খারাপ।

পাঁচটা নৌকা পাশাপাশি। ঠাকুরের কথাগুলি যেন সবাইকে মেরে উস্তোম খুস্তোম করছে। সবাই হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ।

কেদমে কী বলতে যাচ্ছিল হাত জোড় করে। তার আগে বিলাস বলে উঠল, তা অত গাল দিচ্ছেন কেন গো মশায়?

ওই শোনো! আরে তুই কার মুখের উপর কথা বলছিস। শহরগঞ্জের আড়তদার, ঠাকুরকে তুই চিনিস না।

ঠাকুর ফিরে তাকালেন। বললেন, কী হয়েছে?

বিলাস বলল, বলেছি বলে, হাত জোড় করে ক্ষ্যামা চাইছে মানুষটা, অত জাত বেজাত করছেন কেন?

ঠাকুর বললেন, বড় যে পিরিত দেখছি?

পাঁচু প্ৰায় ড়ুকরে উঠল, এই, এই বিলেস!

রসিক বলল দুচোখে আগুন জ্বেলে, এর বড় চ্যাটাং চ্যাটাং কথা ঠাকুরমশাই।

–কেন, কোন গরমে?

রসিক বলল, বড় গরম। দামিনীর দেনা খায়।

ঠাকুর বললেন, গালাগালে অত যদি লাগে, তুই শোধ দে না।

যেটা মনে আসে, সেটা সহজ করে বলে বিলাস। সেখানে কোনও ঘোরপ্যাঁচ নেই। বলল, সে এজ্ঞে আমার মুরোদ নাই।

–তবে?

—তবে আপনার বড় মুখে ছোট কথা ভাল না। জাত বেজাত কেন? ট্যাকা নিয়েছে, পুলুশে দেন।

পুলুশ, অৰ্থাৎ পুলিশ। পাঁচু ততক্ষণে ভয়ে ও রাগে কাঁপছে। হাতের কাছে কিছু খুঁজে না পেয়ে, অগত্যা খানিকটা পাঁক কাদা তুলে ছিটিয়ে দিল বিলাসের গায়ে। প্ৰায় আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, আরে মড়া রে, শোরের লাতি, আজ তুই মরবি।

বলে, নৌকা থেকে নেমে, ঠাকুরের সামনে গিয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না ঠাকুরমশায়, এই শোরটাকে নে আমার বড় জ্বালা। ওর মুখ বড় খারাপ, মাপ করে দেন।

ঠাকুর যেন কেমন একটু হকচকিয়ে গেছলেন। বিলাস তখন মাথা নিচু করে গায়ের কাদা ধুচ্ছে। খুড়ো-ভাইপোকে দেখে ঠাকুরের রাগের মাত্রােটা কেমন যেন ঝিমিয়ে গেল। বললেন, মুখটা তা হলে একটু মিষ্টি করা দরকার তোমার ভাইপোর। ইজ্জত জ্ঞান থাকা ভাল। সেটা এর মধ্যে তো পাইনে।

বলে কেদমের দিকে দেখালেন। বললেন, তুমি কি মাছ পেলে, দামিনীকে না দিয়ে আমাকে দিতে পারো? জাত বলতে আমি তোমাদের জাত তুলে কথা বলিনি, এই ব্যাটার ছোঁচ-গিরির কথা বলেছি।

তা বটে। কিন্তু এ সংসারে যে মাছমারাকে ঋণ খেতে হয়, তারা সবাই কেদমের মতো ছোঁচা। পাঁচু চুপ করে রইল। ঠাকুর বিলাসকে মাপ করেছেন, সেইটাই অনেকখানি।

ঠাকুর চলে যাওয়ার আগে আর-একবার বললেন কেদমকে, নোলাটা একটু কম কর, বুঝলি? টাকা শোধ না হওয়া ইস্তক মাছ যেন আর কারুর ঝাঁকায় না। ওঠে, বলে গেলুম।

ঠাকুর চলে গেলেন। পিছে পিছে গেল রসিক। সেও মাছমারা। কিন্তু প্ৰাণটি যেন মাছমারার নয়। যে মাছ মারে তার মাৎসৰ্য ভাল নয়। কেন না তোমাদের সকলের বাঁচা-মরা একখানে।

ঠাস করে একটা শব্দ হল। সবাই চমকে ফিরে তাকাল কেদমের নৌকার দিকে। কেদমে তার বড় ছেলের পিঠে একটি চড় মেরেছে। মেরে বলল, গালে হাত দৌ ভাবিছটা কী অ্যাঁ, আমার মানী ব্যাটা? গিলবে তো, তিবড়িতে আগুন দেও।

পরান চমকে উঠে হাঁ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল বাপের দিকে। তারপর উঠে গেল। সকলেই চুপচাপ। কেদমে গিয়ে ছাঁইয়ের মধ্যে লুকাল।

ঠাকুরের অপমানটা যত না লেগেছে, তত লেগেছে বিলাসের প্রতিবাদ। বিলাসের ওপর রাগ নয়, নিজের জোয়ান ব্যাটা বসে রইল কাঠের পুতুলের মতো, ইজতে ঘা লাগল কেদমের। কে? না, যার উপরে মনটা কেদমের বিরূপ, সে।

পাঁচু বলে উঠল, আহা, কর কী কেদম।

জবাব দিল না কেদম। মাথা গোঁজ করে, তাকিয়ে রইল জলের দিকে। চোখ দুটি জ্বলছে দপদপ করে।

সব নৌকার মাঝিরাইচুপচাপ। কথা জোগায় না। কারুর মুখে।

জলের কলকলানিও থেমে এল। জল যেন স্থির হয়ে গেল আগনার মুখে। জোয়ার আসছে। তলে তলে এসে গেছে, তাই গঙ্গাও চুপচাপ। তার বুক ভরে সে নীরব হল। মাছমারা নীরব হল কীসের ভারে।

সন্ধ্যা এখনও নামেনি। দিন তবু যায় যায়। পশ্চিম আকাশের কানকো ছিড়ে যেন রক্ত পড়ছে। সূর্য হেলে গেছে চোখের আড়ালে। দল-দলা মেঘ, পুব-বাতাসে যায় পশ্চিমে। তাতে দিন শেষের আলো পড়ে মনে হয় যেন, রক্তের টোপানি ঝরিছে আকাশের ঢালুতে।

মাছমারার বুকের ঢালুতে কত রক্ত ঝরে, সেটা দেখা যায় না। অপমান আর লাঞ্ছনা নতুন নয়। তবু, নতুন করে বাজে প্রতি বারেই।

সমুদ্রে, পানসা জালের জগৎ-বেড়া ঘের দিয়ে যখন মাছ ধরে, তখন কেনবার লোক পাওয়া যায় না। বন্দরে, মোহনায়, বড় বড় আড়তদার-পাইকেররা দাঁড়িয়ে থাকে বরফ-ভরতি লরি নিয়ে। সাই-ভরা মাছ। প্রতি নৌকাতে পাঁচ-সাত মন করে থাকে। কত মাছ নেবে নাও। দরাদরি হয়।

কত করে মন হে? পাইকিরি দর বল।

মাছমারা বলে, তিরিশ ট্যাকা দেন।

আড়তদার, চালানদার মুখখানি শক্ত করে থাকে। থাকবেই, মাল যে বড় বেশি দেখা যায়।

তবে পচিশ দেন? তাও নয়। কুড়ি? পনর?

মাছমারাকেই দর নিয়ে নামতে হয় মুকড়া জলের টানের মতো। বাজার নেই তার হাতে, মোটর লরি নেই তার। বরফ-কলের সঙ্গে নেই কারবার। ওই জগৎটি তার নাগালের বাইরে।

কিন্তু অকুলে সঁপে দেওয়া প্ৰাণের বিনিময়ে যে মাছ এল, তাতে যে পচন ধরে! কষ্টের কেষ্ট যে একেবারে পেছন দেখাবে। ধরে রাখবার উপায় নেই। নৌকার খোল খালি করতে পারলে সে বাঁচে।

তখন পাঁচে নামে।

মহাজন থুথু ছিটিয়ে টাকা গোনে। হেসে বলে, একদিনের কারবার তো নয়। তোমারও কিছু থাক, আমারও কিছু হোক।

তা বটে। মাছমারা দেখে, মীনচক্ষুর অপলক চোখে বড় হাসি চিকচিক করে। জোয়ার কাটিয়ে, সে আবার চলন্তায় ছোটে অকুল সমুদ্রে। তার প্রাণ পড়ে আছে সেখানে।

শহরের মানুষ বলো, কী দরে তুমি মাছ খাও?

মারার মাছ পেলে জ্বালা, না পেলেও জ্বালা। দেখা যায় যেন এইটিও তার জীবনেরই বিধান।

তবু মাছমারার প্রাণ জ্বলে কেন? না, মন মানে না।

অন্ধকার ঘনিয়ে এল। তিবড়িগুলি জ্বলেছে সব একসঙ্গে। আগুন জ্বলে দপদপিয়ে।

শ্ৰীদাম মাঝি নামগান করে, হরেকৃষ্ণ, হরেকৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ–

শুধু বিলাস তাকিয়ে থাকে উঁচু পাড়ের দিকে।

এমন সময়ে একটি নৌকা এসে ভিড়ল পাঁচুর নৌকার গায়ে। সয়ারামের গলা শোনা গেল, বিলেস!

বিলাস একটু অবাক হয়ে জবাব দিল, হ্যাঁ।

এ নৌকায় নেমে এল সয়ারাম। অন্য নৌকাটি সয়ারামকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল উত্তরে।

পাঁচু বলল, ওটি কার লৌকায় এলে?

সয়ারাম বলল, এদিককারই লৌকো।। ও পার থেকে আসছিল, বললাম, এটু পার করে দেও আমাকে।

–অ!

আসলে সয়ারামের নজর বিলাসের দিকে। কিন্তু বিলাস নির্লিপ্ত ভাবে বাঁশের নল দিয়ে ফুঁ দিচ্ছে উনুনে। খুড়ো আছে গলুয়ে, বিলাস কাঁড়ারে। সয়ারাম কোনও কথা না বলে এসে বসল বিলাসের সামনে। চোখ মিটমিট করে তাকাল। এমনিতেই তার মুখখানি সর্বক্ষণ শুকনো শুকনো। মাছ নেই। তার উপরে নিজেদের নৌকাই ভাড়া খাটছে নিজেদের কাছে। নৌকার সংসার বড় টলমল করছে।

বিলাস বলল, কী মনে করে?

সয়ারাম একবার উঁচু পাড়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, এই এনু একবার। আসব আসব করি, আসা হয় না।

বিলাস বলল, ফিরে যাবি কেমন করে?

সয়ারাম সংশয়-ভরা চোখে তাকিয়ে বলল, রাতটা থাকব তোর কাছে।

–কেন?

—কেন আবার কি, মন চায় না?

বিলাস একবার ভুকুটি করে তাকাল সয়ারামের দিকে। সয়ারাম গালে হাত দিয়ে বসল।

বিলাস বলল, তবে চাল বের করে নে? আয় ছাঁইয়ের মধ্য থেকে।

চাল বের করে, ধুয়ে, হাঁড়িতে দিয়েও সয়ারাম গালে হাত দিয়ে বসল।

বিলাসের কালো চোখে মুখে তিবড়ির আগুন লকলক করছে। সয়ারামের চোখে ভয় ও সংশয়। কী জানি অন্তরে অন্তরে বিলাস হেসে আছে কি রেগে আছে।

গলা নামিয়ে বলল সয়ারাম, কথাটা শুনলুম কেদমে খুড়োর ছেলে পরানের মুখে। সত্যি। তবে?

বিলাস যেন গায়ে মাখে না। কাঠের হাতা দিয়ে, হাঁড়িতে ভাত নেড়ে বলল, কোন কথা?

—বুড়ি ফড়েনির লাতিনের কথা?

-কী কথা?

-বড় নাকি জবর মেয়ে।

-হবেও বা।

—তোকে দেখলে নাকি চোখে মুখে তার বেজায় হাসি দেখা দেয়?

—তা হবে।

হুঁ, গতিক বড় সুবিধের নয়। বিষের ক্রিয়া হয়েছে মনে হয়। বড় খাপচি কেটে কেটে কথা বলে যে বিলাস। বলে, তোকে দেখলে আর থর থাকতে পারে না?

-হতে পারে।

–শুনছি। পয়সাওয়ালা ফড়েনি।

বিলাস জবাব দেয় না।

সয়ারাম আবার বলে, ওখেনে তবে তোর মন বসেছে?

বিলাস ভ্রূ কুঁচকে তাকায়। বলে, মন আবার বসে কেমন করে?

–ও-ই হল। মন টেনেছে তা হলে?

জবাব নেই বিলাসের। চোখ পাকিয়ে তাকাল সয়ারামের দিকে। কিন্তু ভয় করলে তো চলবে না। তার। বলল, চুপ মেরে থাকিসনে বিলেস, বল, বল না কেন?

—কী বলতে হবেটা কী?

—এটা তো আমার অঘটন বলে মন গাইছে। অঘটন ছাড়া কিছু ঘটাস নে তুই। আমাকে বল, তোর মন মানছে না?

বিলাস ঘাড় তুলে, ক্রুদ্ধ চোখের খোঁচা মোরল সয়ারামকে। সয়ারাম বলল, হাত তুলিস নে যেন, খুড়ো দেখে ফেলবে। আমি বুয়েচি তুই মায়ায় পড়েছিস। মন মানছে না তোর?

—কেন? না মানলে তুই দিবি?

সর্বনাশ, এ তো আর রাখ-ঢাক নেই। ডাকিনীর মায়া লেগেছে বন্ধুর। শহর-ফড়েনির সর্বনাশী ফাঁদে পড়ে গেছে। যা শুনেছে, তা হলে মিথ্যে নয়। চোখ-মুখ দেখেই বোঝা গেছে। মনের দিশা নেই। বলল, কী বললি?

—বলব। আবার কীরে ন্যাকা। না মানলে তুই দিবি?

—দেয়াদোয়ির আছে কী। শুনি, সে তো বেবুশ্যে। দমাস করে একটি ঘুসি পড়ল সয়ারামের কাঁধে। ধূপ করে যেন কাঁঠাল পড়ল গাছ থেকে। বলল, শালা আমার, বানচত। যাকে যা-নয়, তাই বলছ? কত লোক তার পায়ে গড়াগড়ি খায়, সে

হাতের কাছে আর কিছু ছিল না। নইলে সয়ারামের মরণ ছিল। কাঁধটায় লেগেছে। সয়ারামের। কাঁধ হাতিয়ে, এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, থাক, মারিসনে, আমার লেগেছে। খুড়ো দেখতে পাবে। ভগমান আমাকে খালি সইতে দিয়েছে।

সয়ারাম গালে হাত দিয়ে বসে রইল চুপ করে। বিলাস আবার বলল, খারাপ যা বলবার, তা আমাকে বল, তাকে কেন?

বিলাস শিলের উপর হলুদ ফেলে, নোড়া দিয়ে ছেচতে লাগল। শব্দহীন ব্যাকুলতায় জোয়ারের জল পাড় ভাসিয়ে দিয়েছে। আকাশে একফালি চাঁদ। আলো তার কেমন যেন কুহকী মায়ায় ঘেরা। সব কিছুই দেখা যায়, আবার দেখা যায় না। আকাশের তারা খসে কিংবা জোনাকি ওড়ে,

সয়ারামের মনটা হঠাৎ উলটো গেয়ে উঠল। তাই তো! বন্ধু আমার অমর্তের বউকে ফেরায়, সেখানে তার মন বসেনি, প্ৰাণ টানেনি। এখানে কেন এমন হল। কিছু বুঝেছে নিশ্চয়। গামলি পাঁচিতেও যার মন ওঠেনি, ওখানে তার বুক উথালি পাথালি করে উঠেছে। তাকে তুমি দ্যাখ-রং বলতে পারবে না। অথাৎ, যাকে দেখি, জোয়ান মেয়েমানুষ হলেই হল, তাকেই আমার ভাল লেগে যায়, তা নয়। বিলাসকে তো চেনে সয়ারাম। কিন্তু এ কোথায় এসে মন পাতলে বিলাস। বন্ধুকে নিয়ে বাড়ি ফেরা যাবে কেমন করে।

সয়ারাম বলল, সে রোজ আসে বিলেস?

বিলাস বলল, না। বলেছে, আসবে না। এখেনে তার মরণ আছে, তাই।

আ পোড়াকপাল! বিলাসের মন পুড়ছে। এ যেন মন ফসফস করার বাড়া। কিন্তু সে যদি না চায়, তবে বিলাস মন পুড়িয়ে মরে কেন?

চিকচিক করে বিদ্যুৎ চমকাল। এর মধ্যেই কুহকী আলোটুকু কখন গেছে। জমাট বেঁধেছে। টুকরো মেঘ। ভরা জোয়ারে জলের স্রোত উঁচু পাড়ে উঠতে চায়।

পাঁচু যেন বিমুচ্ছিল এতক্ষণ। কলসি নিয়ে উঠে এল কাঁড়ারে, জল আনতে যাবে।

সয়ারাম বলল, খুড়ো আমাকে দেও, জল নে আসি। জল ভেঙে। আবার তুমি কেন যাবে।

পাঁচু কলসিখানি দিল সয়ারামের হাতে। সয়ারাম বলল, চ বিলেস, দুজনে যাই।

হাঁরে ক্যাংলা, খাবি? না, হাত ধোব কোথায়? পাঁচু দেখে, জোয়ারের জলে ছপছপ করে, কেমন করে বিলাস চলে যায়। সয়ারামের সামনে পাঁচু কিছু বলতে পারল না। কিন্তু বুকে রইল বড় ধুকধুকুনি।

উঁচু পাড়ে উঠে, সরু রাস্তা গেছে পশ্চিমে। দুপাশে বাড়ি। টালি-খোলা-গোলপাতা-ছাউনি ঘরের সারি। সামনে একটি বিজলি আলো টিমটিম করছে। তার নীচে টেপা-কল।

আশেপাশে গলার স্বর শোনা যায় মেয়ে-পুরুষের। মোটা মেয়ে-গলার গান ভেসে আসছে কোত্থেকে–

মাথা খাও, যেও না কো
পরানে দাগ দিয়ে।

সয়ারাম কলসি ধরেছে, হাতল টিপছে বিলাস। গান শুনে দুজনে তাকাল দুজনের দিকে। কিন্তু, বিলাস বারে বারে একটি বাড়ির দিকেই তাকায় কেন। নাতনির বাড়ি বুঝি ওইটি। বন্ধু বড় কান খাড়া করে আছে। চোখে তার পলক নেই। সেখানে ঘোর মায়া।

কলসি উপচে জল পড়ে যায়। সয়ারাম বলল, চ বিলেস, কলসি ভরে গেছে।

এমন সময়ে মানুষের ছায়া দেখে দুজনে চমকে উঠল। দেখল, দুলাল খুড়ো।

হেসে বলল দুলাল, খুড়ো যে! জল নিতে এসেছ? কিন্তু উলটো হয়ে গেল যে?

–-কেন?

–জল আনতে যাওয়ার কথা তো আর-একজনের গো।

বলে কেশো গলায় হেসে উঠল দুলাল। শব্দটা চাপা, কিন্তু দুলালের খালি গা যেন আওড়ের জলের মতো ফুলে উঠল। বলল, আমার ছোটমাসি গেছে ডাক্তারের বাড়ি। তার রোগ হয়েছে।

বিলাস পাড়ের দিকে মুখ করে বলল, অ।

—হ্যাঁ বড় নাকি হাঁকপাঁক করে বুকের মধ্যে, অবশ্য অবশ্য লাগে, ধড়ফড় করে।

তবু বিলাস চলে যায় দেখে দুলাল বলল, কই গো খুড়ো, দাঁড়াও, একটা বিড়ি খেয়ে যাও নিদেন।

বিলাস বলল, আর-একদিন হবে। খুড়ো একলাটি বসে রয়েছে।

বিলাসের মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে বলল সয়ারাম, ওরে বিলেস, এ কী দেখছি! দেখছি, তোর মন আর মানছে না।

দুলাল আবার বলল, আর একটা কথা শুনলুম। রসিকেরা নাকি বাঁধাছাঁদি জাল পাতবে।

ওই দেখ, কালী গোখরো অমনি ফণা তুলেছে। চকিতে শক্ত ঘাড় ফিরিয়ে বলল বিলাস, এ শরীলে পাণ থাকতে সেটি হতে দেব না খুড়ো। আমরাও মাছ মারতে এয়েছি।

দুলাল বড় ভালবাসে তাকে। একটুক্ষণ বিলাসের রাগ দেখে বলল, নিশ্চয়, সেই জন্যেই তো তোমাকে বললুম।

উঁচু পাড়ের ঢালুতে বিলাসকে দেখে পাঁচুর নিশ্বাস পড়ে। বড় ভয় লাগে। চোখের আড়াল হলেই আন কথা মন্ত্র দেয় বিলাসের কানো। উঁচু পাড় থেকে যে ওর চোখ নামে না।

এখনও জোয়ার ফুলছে। কুল ভেসেছে, তবু শব্দ নেই। তবু যেন কী এক বিচিত্র শব্দ চাপা সুরে বাজে। সে শব্দ দক্ষিণের। পাঁচু বলে, দক্ষিণের জল, বিলেসকে ফিরিয়ে দাও তুমি।

 

দেখতে দেখতে এসে পড়ল শুক্লপক্ষের দশমী। জোয়ান কোটালের এই তো মুখপাত।

অমাবস্যার জোয়ান কোটাল ছুটকির ছেউটি টান। আর এই শুক্লপক্ষের শ্রাবণ্যে গঙ্গা, কুলে আর তাকে ধরে রাখা যায় না। অম্বুবাচীর জলে যে-অনাগত কালের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল, সে কাল আজ। দেখা দিয়েছে দিগন্ত ভাসিয়ে। প্লাবন দেখা দিয়েছে। মেয়ে আর কোনও শরম মানে না। সে আজ বড় রঙ্গিণী হয়েছে। রক্তে তার নেশা, শরীর বড় টলমল মাতালের মতো।

মীয়াজীপিরের দহে, কোমর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কার অত ঘুংড়ি নাচের ঘুঙুর বাজে ঝমঝমিয়ে। দক্ষিণের আওড়ে কোন খ্যাপা মহাকাল বুকে ধরে টানে রঙ্গিণীকে।

সাবধান, সাবধান হে!

কলকল খলখল করে নিরন্তর নামছে ঘোলানি। উত্তরের ঢল এখনও নামছে কলকল নাদে। যেন, সেও প্ৰলয় চায়।

এতদিন কচুরিপানার দেখা ছিল না। কোথায় কোন মজা গোঙ ভেসেছে, মজা পুকুর বিল বাওড়া গ্রাম সুদ্ধ ড়ুবেছে, তাই এত কচুরিপানা।

কিন্তু জলে যে আসল কিছু দেখা যায় না। মেকো কেন নেই জলে একটিও। রসনা চিংড়ির তিড়িংবিড়িং কোথায়। এত জল, কিন্তু গঙ্গায় বেনপোকাটিও নড়ে না।

মাগো গঙ্গা! ভগবতী! তোর বুক জুড়ে যে রক্তের ঢেউ দেখি? গাঢ় লাল রক্ত বয় স্রোতে। কাঁচা দিয়ে গিথলে যেমন রক্ত ওঠে। ভলকে ভলকে, তেমনি রক্ত ওঠে। আওড়ের আবর্তে, দহের পাকে।

শুক্লপক্ষের জোয়ান কোটালের প্রথম মুখে, প্রথম অঘটন ঘটল হাসনাবাদের নুরুলের।

পাঁচু আর বিলাস ফিরে আসছিল পুব থেকে। ভাটা গেছে। শূন্য। নৌকা টানতে মন চায় না। শরীর যেন অবশ্য লাগে।

নুরুল ফেলেছিল বিনজাল। বাঁশের জোল ভাসছে স্রোতের মুখে আটকা-পড়া সাপের মতো। নীচে, মাটির সঙ্গে জাল গাঁথা আছে কাঁকড়া দিয়ে। কাঠের মস্ত বড় লাঙলের মতো খোঁচা। যেন মস্ত বড় বড়শি। তাকে বলে কঁকড়া, কামড়ে ধরে থাকে মাটি।

পাশ দিয়ে আসছিল। পাঁচুর নৌকা। ছোল কাছি ধরেছে। নুরুলের ভাই। ওচোল কাছি, অর্থাৎ ওকোড় কাছি ধরে টানছে নুরুল। জোয়ান নুরুল, শক্তিমান পুরুষ, হাতের পেশি কাঁপে থারথার করে, তবু জাল ওঠে না।

পাঁচু পাশের কানদাড়ি টিল করল। হালে চাপ দিয়ে গতি ধীর করল নৌকার। জিজ্ঞেস করল, কী হল গো নুরুল?

নুরুলের সবঙ্গে ঘাম। একেবারে নেয়ে উঠছে। মাছমারা জানে, ওটা ঘাম নয়। হাত দিয়ে দেখো, মনে হবে তেল। নির্যাস তেল, লালার মতো ভারী। কাছি চেপে বসেছে। হাতে। হাজা ফেটে রক্ত পড়ছে। তবু টানে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, শালার জাল যে ওঠে না পাঁচদা।

ওঠে না? তা বটে, বিন জাল তো। গহিন গাঙের তলায়, একেবারে পাতালে গিয়ে ঠেকে যায়। কিন্তু অত বড় জোয়ান মানুষের টান, ওঠে না কেন জাল?

খাড়া দাঁড়িয়ে, লোহার-তার-জড়ানো কাছিতে আবার টান দিল নুরুল। চিৎকার করে বলল ভাইকে, আমনুলে, ছোলাকাছিতে টান মার।

আমানুলও টান দিল। নৌকা কাত হয়ে জল উঠল বগাবগ করে। ভয়ে পাঁচু হাঁক দিল, সাবধান, নুরুল!

আমানুল ধপাস করে পড়ে গেল পাটাতনের উপর। কী হল?

দেখা গেল, মাটিতে গাঁথা কাঁকড়া জলের উপর ভেসে উঠেছে বিকট বিশাল জন্তুর মতো।

পাঁচুর বুকটা প্রথম ধক করে উঠল। হেই গো মা গঙ্গা, সব্বোনাশ করেছিস।

আমানুল চিৎকার করে উঠল, হোই আল্লা! জালখান বেলিয়ে গেছে গো ভাইজান।

—বেলিয়ে গেছে?

–অঁ।

খুড়ো-ভাইপো চোখাচোখি করে এ নৌকায়। নুরুল দেখল, ওকোড়কাছি ছিঁড়ে গেছে তার হাতে। কাঁচা মাংসের মতো হাত দুখানি রক্তারক্তি হয়েছে। নৌকা ভেসে যায় দেখে, হাল ধরল সে। নৌকা নিয়ে আবার এল সেখানে। অপলক দু-চোখ ভরে, দু-ভাই তাকাল জলের দিকে।

রক্তগম্বরী গঙ্গা হাসে খলখল করে স্রোতের বাঁকে বাঁকে। ছোট ছোট ঘূর্ণি পাক দিয়ে নাচে বেজায়। কী আছে জলের তলায়, কে আছে, কে এমন খেলা খেলে, কিছু দেখা যায় না। তবু চোখের পাতা পড়ে না। জল দেখে দুই ভাই।

গহিন জলের জাল, বালিচাপা পড়ে গেছে। তার নাম বেলিয়ে যাওয়া। বড় সর্বনাশের যাওয়া। আর কোনও দিন ফিরে পাওয়া যাবে না।

এই ঘোলা মিঠেন। জলে, সুদিনের বান ডাকে। দিলে সে ভরে দেয়। না দিলে সে এমনি করে মারে। জলে তার দন্তঘাত হয় না। তাই তাকে মা বলেছ। তুমি। কিন্তু ছেয়ালো শরীরে তার যৌবন এসেছে, এখন তুমি বাঁচিয়ে ফেরো নিজেকে। গহিনে তার নানান রদবদল। নতুন চরের মাথা তুলবে সে কোথায়, তাই টেনে নিয়ে আসছে বিশাল বালুর পাহাড়। তলায় যার জাল পড়ে সেই সময় তার রেহাই নেই।

বাতাস টিল দিল। পাঁচু বলল, দাঁড় ধর বিলেস।

বিলাস তখনও তাকিয়েছিল নুরুলের নৌকার দিকে। দূরে জলের দিকে তাকিয়ে বলল, লদীটা এবারে যেন বড় খাই খাই করে।

পশ্চিমের শ্মশানঘাটে চিতার আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। লেলিহান শিখা আকাশে উঠতে b

পরদিন শূন্য ভাটার বৃথা গড়ান মেরে এসে, বিলাস গেল ছাঁইয়ের মধ্যে চাল বের করতে। চালের ধামার ঢাকা খুলে, বিলাসের বুক চমকে উঠল। ডেকে বলল, আ খুড়ো, চাল যে মাত্তর একজনের মতন আছে? অ্যাঁ? আর কথা সরে না পাঁচুর মুখে। সমুদ্রের হামাল ডাকল বুকে। যে ডাক শুনে সমুদ্রের মাছমারা টানের দিনেও পালাতে পথ পায় না। দখনে বাওড়ে হ্যাঁকা পড়ল আছড়ে। জলের টানে বড় শাসনি। কোন অদৃশ্য থেকে মহা মরণ হাত তুলে তাড়া দেয়, পালা, পালা।

নগদ টাকা বের করল পাঁচু। বের করতে হল মহাজনের কাছ থেকে নিয়ে আসা টাকা। কিছু ঋণ শোধ হয়েছিল দামিনী আর তার নাতনির। ঘরে বাইরে মাথা-বোঝাই ঋণ এখনও বাকি। জোয়ান কোটালের মুখেই আগে নগদ টাকায় হাত। মহাজনের রক্তচোখ দপদপ করে জ্বলছে সেই টাকায়। বলছে, পাঁচু, সুদে আসলে যা হয়েছে, তোমার ভিটের দামে সে ঋণ শোধ হবে না। ওই ভিটেখানি ছাড়া আর তো তোমার কিছু নেই।

গড়ানের পর গড়ান যায় বৃথা। ওকোড় মারার ডাক আসে না খুঁটনির গা বেয়ে। যেমন নাকি ডাক্তার কবিরাজ মশাই তোমার নাড়ি দেখেন হাত টিপে, নাড়ির গায়ে খবর পান, তোমার প্রাণ আছে কি নেই, এও তেমনি। খুঁটনি বেয়ে সেই প্ৰাণের খবর আসে না। উজান ঠেলা সার। তবু আগনায় প্লাবনের লক্ষণ। সহস্ৰ ফণা মেলে, গোঁ গোঁ শব্দে আসে সে দুকুল ভাসিয়ে। মুখে তার ফেনিয়ে-ওঠা গ্যােজলা ওঠে। সামাল সামাল রব পড়ে মাছমারার। নৌকা ঠিক মতো না আগলাতে পারলে, বানের ঝাপটায় চুরমার হতে পারে। আর মুকড়ায় বড় দুর্বিষহ টান। জলের টান নয়, মনে হয়, কে যেন তার শক্ত হাতে নৌকা ধরে হু হু করে টেনে নিতে চায় সমুদ্রে।

বাতাস গেছে একেবারে ঘুরে। পুবে সাঁওটা এসেছে জল মুখে নিয়ে। বড় ভারী বাতাস। আড় পাথালি নৌকার গলুয়ের কুঁটিটা যেন মুচড়ে দিতে চায়। বাতাস সোঁ সোঁ করে ডাক ছাড়ে এই গাঙের বুকে। গঙ্গা যেন আরও অকুল হতে চাইছে।

বিলাস গড়ান মারে আর বলে, হত যদি সমুদ্রের পাটা জালের ঘের, লৌকোর পুরো খোল বোঝাই হত এতক্ষণে।

সমুদ্র, সমুদ্র, সমুদ্র। দক্ষিণের নিশি-পাওয়া বিলাস। শুধু ওই ডাক শুনতে পায় সে। কিন্তু সমুদ্রে মরণ বসে আছে না ওত পেতে?

পাঁচু তাকায় রক্তগোলা জলের দিকে। সমুদ্রের শমন যেন এখানেও এসেছে, থাবা বাড়িয়েছে। সে নেই কোথায়? এ গঙ্গায় কীসের ছদ্মবেশে ঘুরছে সে?

তবু বিলাস তাকিয়ে থাকে উঁচু পাড়ে। ওর গড়ান যায় বৃথা, ধামায় নেই চাল। যেন সমুদ্রের ডাক শোনে উঁচু পাড়ের দিকে চেয়ে।

বউঠান, এ বাতাসে তোমাদের নিশ্বাস শুনতে পাই। জানি তোমরা ফিরছি আমাদের সঙ্গে সঙ্গে। গোটা সংসারের সকলের চোখ এখন এই মাছমারার উপরে। বিলাসকে তুমি ডাক দিয়ে নাও ফিরিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *