২০. কিরীটী এল লালবাজার

পরমেশ্বরকে বিদায় দিয়ে কিরীটী সোজা এল লালবাজার। এবং সুভায্যের ঘরে ঢুকল।

সুভাষ বললে, কিরাটী যে, কি ব্যাপার?

একটা কাজ করতে পারবে ভাই?

কি বল?

কি ব্যাপার বলা তো কিরীটী?

হরিদ্ধারে হরকি পিয়ারীর কাছে ভরদ্বাজ আশ্রমে শ্যামসুন্দর চক্রবতী নামে একজন সংসারত্যাগী ভদ্রলোক থাকেন। আমি শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর নামে একটা চিঠি দেব, তাঁর সঙ্গে আলাপ করে বামদেব অধিকারীর পূর্বপুরুষদের যতটা সম্ভব সংবাদ লোকটিকে সংগ্রহ করে আনতে হবে, আর জেনে আসতে হবে তিনি তাঁর পুত্র অনিল চক্রবর্তীর কোন সংবাদ রাখেন কিনা।

ব্যাপারটা খুলে বল ভাই। অতঃপর কিরীটী সংক্ষেপে রত্নমঞ্জিল ও সুবর্ণকিঙ্কন সম্পর্কে সমস্ত বললে সুভাষকে।

এবং পরিদিন কিরীটী বহরমপুর রওনা হয়।

 

অপমানে আক্ৰোশে ফুলতে ফুলতে পিয়ারী রত্নমঞ্জিল থেকে বের হয়ে এল।

বিনয়ের শেষের কথাগুলো তখনও যেন তাঁর সর্বাঙ্গে ছুঁচ ফোটাছিল।

বামদেব যে তার প্রস্তাবে রাজী হবেন না পিয়ারী সেটা কিছটা পূর্বেই অনুমান করেছিল, তাই সে আরো দুজনকে সঙ্গে এনেছিল, তার বিশ্বস্ত ও বহু পাপানুষ্ঠানের সহচর গুপীনাথ ও ছট্টুলালকে।

গুপীনাথের তাঁবে ছিল কলকাতার একদল নিম্নশ্রেণীর জঘন্য প্রকৃতির গুন্ডা।

নিজেও যে সে রাতের অন্ধকারে ও দিনের প্রকাশ্য আলোকে কত লোকের বুকে ছুরি বসিয়েছে তার সংখ্যা ছিল না।

গায়ে যেমন অসুরের মত শক্তি, প্রকৃতিও তেমনি ছিল দুর্ধর্ষ।

পয়সার বিনিময়ে গুপী করতে পারত না দুনিয়ায় এমন কোন কাজই ছিল না।

পিয়ারী বহরুমপুরে এসে কিন্তু কোন হোটেলে ওঠেনি।

ছট্টুর কাছ থেকে পূর্বাহ্নেই সমস্ত সংবাদ সংগ্রহ করে জেনেছিল। রত্নমঞ্জিল থেকে আধ মাইলটাক দূরে গঙ্গার ধারে নবাব আমলের একটা ভগ্ন অট্টালিকা আছে, লোকে বলে সেটাকে আরামবাগ। সেই আরামবাগেই এসে আশ্রয় নিয়েছিল তিনজনে গোপনে।

জঙ্গলাকীর্ণ বুনো আগাছায় ভরা বহু বৎসরের পরিত্যক্ত ভগ্ন জীর্ণ আরামবাগেরই একটা কক্ষ কোনমতে পরিষ্কার করে নিয়ে ওরা তাদের ডেরা বেঁধেছিল।

একটি ভগ্ন অট্টালিকা।

চারিপাশে ও মধ্যস্থলে একদা মনোরম উদ্যান ছিল, শোনা যায় কোন নবাবের বিলাসকেন্দ্র ছিল ঐ সুরম্য আরামবাগ।

বেগম ও তার সুন্দরী সহচরীদের নিয়ে একদা নবাবের হয়তাে কত আনন্দ মুখরিত দিনরাত্রি আরামবাগে কেটে গিয়েছে।

কত মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগের স্মৃতি আজও হয়তো আরামবাগের মন্থর বায়ু তরঙ্গে তরঙ্গে দীর্ঘশ্বাসের

আরামবাগের দেড় ক্রোশের মধ্যে কোন জনমানবের বসতি নেই। শহরের এদিকটা একপ্রকার পরিত্যক্ত বললেও অত্যুক্তি হয় না। নবাবী আমলের কলকোলাহল ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের আড়ম্বর আজ শান্ত ও লুপ্ত। কেবল এখনো সাক্ষ্য দিচ্ছে সব কিছুর ভগ্নজীর্ণ স্তুপে স্তুপে।

পিয়ারী রত্নমঞ্জিল থেকে বের হয়ে প্রথমে সোজা শহরের দিকে গেল। একটা বেস্টটুরেন্টে ঢুকে চায়ের অর্ডার দিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার চিন্তায় সে ডুবে গেল।

কোন পথে এবারে সে অগ্রসর হবে? চিন্তা করতে করতে একটা বুদ্ধি তার মাথার মধ্যে এসে উদয় হল এবং সঙ্গে সঙ্গে তার চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

নিজের চিন্তায় মগ্ন পিয়ারী কিন্তু লক্ষ্য করল না ঠিক সেই সময় মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, পুরুষ্টু গোঁফ, মাথায় শালের টুপি, পরিধানে পায়জামা ও তসরের সেরওয়ানী একজন দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ ভদ্রলোক রেস্টুরেন্টের মধ্যে এসে প্রবেশ করে পিয়ারীর অদূরে একটি টেবিলের সামনে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল। ছোকরা চাকরিটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল নতুন আগন্তুকের।

এক কাপ চা! আগন্তুক বলে।

পিয়ারীর মুখের সিগারেটটা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, হাতের মার্কোভিচের টিনটাি থেকে নতুন একটা সিগারেট বের করে দুই ওষ্ঠে চেপে ধরে, সমাপ্তপ্রায় সিগারেটটার সাহায্যে অগ্নিসংযোগ করে প্রথমটা ফেলে দিল নিঃশেষিত চায়ের কাপটার মধ্যে।

ফ্রেঞ্চকাট-দাড়ি শোভিত মুসলমানী পোশাক পরিহিত আগন্তুক আর কেউ নয়, কিরীটী। এবং মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে সে বহরমপুরে এসেছে।

পিয়ারী যে বহরমপুরে এসেছ কিরাটীর সেটা অজ্ঞাত ছিল না।

মিনিট দশেক বাদে চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে পিয়ারী রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেল।

সাধারণ বেশে মৃত্যুঞ্জয় বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। তার সামনে এসে চাপাকণ্ঠে কয়েকটা উপদেশ উপদেশ দিয়ে কিরীটী আবার রেস্টুরেন্ট গিয়ে প্রবেশ করল।

 

পরের দিন রাত্রে অপেক্ষা করেও প্রায় সারাটা রাত বিনয় কিছুই দেখতে পেল না। কিন্তু হতাশ হল না সে।

তার পরের রাত্রেও বিনয় তার দোতলার শয়নঘরের খোলা জানলার সামনে অন্ধকারে একাকী দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি তার নিবদ্ধ নীচের বাগানে। শুধু কি সেই লাল আলোর সংকেতটুকুই! রাত্রির মত মাধুর্যময়ী অথচ রহস্যময়ী সেই পথপ্রদর্শিকার মিষ্টি কৌতুক সেও ভুলতে পারছে না কিছুতেই।

আজকের রাতেও যে বিনয়ের চোখে ঘুম নেই, শোষোক্তগুলোও তার কারণ বৈকি।

নীচের বাগানে কাল রাত্রে যে পোড়া গিসারের শেষ টুকরোটা পাওয়া গিয়েছে। পরে সেটা পরীক্ষা করে দেখেছে বিনয়।

দামী দগ্ধ সিগারের শেষাংশ। সিগারের টুকরোটা যখন বিনয় বাগানের মধ্যে কুড়িয়ে পায় তখনও সেটা পুড়ছিল। অতএব ক্ষণপূর্বে কেউ নিশ্চয়ই ওখানে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিল নিঃসন্দেহে।

কিন্তু কে?

তারপর এ বাড়ির কেয়ারটেকার মনোহর!

লোকটার গতিবিধি ও হাবভাব স্পষ্ট সন্দেহজনক। বিপক্ষ দলের সংবাদ সরবরাহকারী বলেই মনে হয়।

 

অঘোরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছেন শয্যার ওপরে বামদেব। ঘরের আলোটা নেভানো।

বদ্ধ দরজার মধ্যবর্তী সামান্য ফাঁক দিয়ে স্টিলের একটি পাতি ধীরে ধীরে প্রবেশ করল, তারপর নিঃশব্দে সেই পাতের চাপে দরজার অগালটা উপরের দিকে উঠে যেতে থাকে।

দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে যায়-সেই ফাঁকের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করে কালো একটা হাত ধীরে ধীরে একটা সরীসৃপের মত।

অতি সহজেই অতঃপর সেই হাত দরজার অর্গালটা ধরে নীচের দিকে অৰ্গলাটা নামিয়ে। আনে—দরজার কপাট দুটো খুলে যায়।

নিঃশব্দে পা টিপে টিপে ছায়ার মত একটা মনুষ্যমূর্তি বামদেবের শয়নঘরে প্রবেশ করে।

তার পশ্চাতে আর একজন।

অন্ধকারে আগে পিছে সেই ছায়ামূর্তি দুটো এগিয়ে যায় বামদেবের শয্যার দিকে।

প্রথম ছায়ামূর্তি পকেট থেকে একটা ছোট শিশি ও রুমাল বের করে শিশির মধ্যস্থিত আরক ঢেলে রুমালটা ভিজিয়ে নিল।

প্রথম ছায়ামূর্তি রুমাল হাতে ঘুমন্ত বামদেবের শিয়রের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দ্বিতীয় ছায়ামূর্তি দাঁড়াল এসে পায়ের কাছে।

রুমালটা ছায়ামূর্তি ঘুমন্ত বামদেবের নাকের কাছে ধরল। ঘরের বাতাসে একটা মিষ্টি কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

অজ্ঞান বামদেবকে কঁধের ওপরে তুলে ছায়ামূর্তি দুজন ঘর থেকে বের হয়ে গেল।