১৮. কিরীটী বহরমপুর যায়নি

কিরীটী বামদেবের সঙ্গে বহরমপুর যায়নি ইচ্ছা করেই। বহরমপুরের রত্নমঞ্জিল ও সুবৰ্ণকিঙ্গনকে কেন্দ্র করে যে একটা রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠেছে ব্যাপারটা কিরীটীর কাছে আর অজ্ঞাত ছিল না।

আগাগোড়া গত ক’দিনের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে বুঝতে কষ্ট হয় না। সব কিছুর মূলে ঐ রত্নমঞ্জিল।

কঙ্কনটা চুরি করার চেষ্টা। রানার রত্নমঞ্জিলটা ক্রয় করবার বিশেষ আগ্রহ এবং অসম্ভব মূল্যে স্বীকৃত হয়ে বায়না দেওয়া, তারপর কোন এক অপরিচিতের পত্র মারফৎ সাবধান বাণী রত্নমঞ্চিল না বিক্রয় করবার জন্য—সব কিছু জড়িয়ে একটি রহস্যই যেন দানা বেঁধে উঠছিল সব কিছুর মধ্যে।

ঐ রত্নমঞ্জিল!

কিরীটী বুঝেছিল তাকে ঐ রহস্যের কিনারা করতে হলে ভেবেচিন্তে বুঝে অত্যন্ত সাবধানে মাটি বুঝে অতঃপর প্রতিটি পা ফেলে ফেলে এগুতে হবে।

এবং যতটা সম্ভব নিজেকে আড়ালে রেখে কাজ করতে হবে। যেন কোন মতেই কারো না সন্দেহ জাগে এতটুকু যে কিরীটী রত্নমঞ্জিলের ব্যপারে জড়িয়ে পড়েছে।

কিরীটী আড়াল থেকে কাজ করবে। একপ্রকার স্থির করেছিল, যেদিন বামদেবের ওখান থেকে নিমন্ত্রণ সেরে ফিরবার পথে সে অনুসৃত হয়েছিল।

তাই পরের দিন যখন তার বন্ধু অফিসারকে বলে। লালবাজার থেকে দত্ত অ্যাণ্ড সাহার অফিসে রানার সামনে একটা টোপ ফেলবার ব্যবস্থা করেছিল, নিজে তখন চুপ করে বসে থাকেনি।

কিছু পরেই সাধারণ এক ভাটিয়ার ছদ্মবেশ ধারণ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তার উপরে এসে ভাবছে কোন পথে এখন অগ্রসর হওয়া যায়, হঠাৎ পাশ দিয়ে তার পরিচিত একটি ট্যাক্সিকে যেতে দেখে হাত-ইশারায় কিরীটী ট্যাক্সিটা থামাল।

ট্যাক্সি ট্রাইভার পরমেশ্বর কিরীটীর বিশেষ পরিচিত হলেও ছদ্মবেশধারী কিরীটীকে কিন্তু চিনতে পারে না প্রথমটায়।

ট্যাক্সিতে চেপে কিরীটী তাকে নির্দেশ দিতেই ট্যাক্সি ছুটল।

নির্দিষ্ট জায়গায় এসে ট্যাক্সিটা থামিয়ে পরমেশ্বর ট্যাক্সির দরজা খুলে দিতে যেমন উদ্যত হয়েছে কিরীটী বাধা দিল, এখন নামব না, দরজা বন্ধ করে দাও পরমেশ্বর।

সঙ্গে সঙ্গে চমকে ফিরে তাকায় পরমেশ্বর পশ্চাতে আরোহীর দিকে।

কি চিনতে পারছ না? কিরীটী বললে।

এতক্ষণে কিরীটীর স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে পরমেশ্বর তাকে চিনতে পারে।

হেসে বলে, স্যার আপনি! ইস একদম চিনতে পারিনি স্যার!

সঙ্গে সঙ্গেই পরমেশ্বর বুঝতে পারে কোন গোপন তদন্তের ব্যাপারে নিশ্চয়ই কারো গতিবিধির উপর নজর রাখবার জন্য কিরীটীর এই ছদ্মবেশে অভিসার।

পরমেশ্বর রাস্তার একধারে গাড়িটা পার্ক করে রাখে। কিছুক্ষণ গাড়ির মধ্যে অপেক্ষা করে কিরীটী গাড়ি থেকে নামল। পরমেশ্বরকে অপেক্ষা করবার নির্দেশ দিয়ে এগিয়ে গেল সামনের বড় বাড়িটার গেটের দিকে।

মাস্তবড় পাচতলা একটা বাড়ি। অসংখ্য অফিস সেই বাড়িটার ঘরে ঘরে। এবং তখনও সেখানে কর্মব্যস্ততার একটা চাঞ্চল্য।

সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় দত্ত অ্যান্ড সাহার চেম্বারের দিকে এগিয়ে চলে কিরীটী একসময়।

এবং চেম্বারের সুইং ডোরের অল্প দূরে দাঁড়িয়ে থাকে অপেক্ষা করে।

প্রায় কুড়ি মিনিট বাদে কিরীটী লক্ষ্য করে একজন হৃষ্টপুষ্ট ভাটিয়া লিফটে চেপে তিনতলায় এসে উঠল, সঙ্গে তার ঢ্যাঙামত একজন লোক, হাতে তার মার্কোভিচের একটা টিন ও ওষ্ঠে ধৃত সদ্য-জ্বালানো একটি সিগারেট।

আমার আর ভিতরে গিয়ে কি হবে শেঠ! ঢাঙা লোকটি ভাটিয়াকে বলে।

তাহলে তুমি গাড়িতেই গিয়ে অপেক্ষা কর পিয়ারী। দেখি শালা দত্ত আবার ডাকল কেন?

কিরীটির মনে হয় ঐ পিয়ারী লোকটা তার একেবারে অপরিচিত নয়।

তাই বসি গে। তুমি তাহলে কাজ সেরে এস। পিয়ারী নামধারী ঢাঙা লোকটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।

ভাটিয়া দত্ত-সাহার চেম্বারে ঢুকতে যাবে সুইংডোর ঠেলে, একজন ভদ্রলোক বের হয়ে এল মুখোমুখি হতেই বললে, রানা যে, কি খবর?

একটু কাজ আছে ভাই মুখুজ্জে।

ও।

রানা ভিতরে প্রবেশ করল এবং মুখুজ্জে চলে গেল।

তাহলে উনিই সেই স্বনামধন্য শেঠ রতনলাল রানা! কিরিটী মনে মনে ভাবে।

রত্নমঞ্জিল বায়না করেছে পঞ্চান্ন হাজার টাকায় কিনবার জন্য ও-ই!

ভাগ্য সুপ্ৰসন্ন দেখা যাচ্ছে—লোকটির দেখা পাওয়া গেল!

কিরীটী অতঃপর সেখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ছকে ফেলে।

কিরীটীর মনে পড়ল। হঠাৎ ভাবতে ভাবতে, গোপন নোটবুকে তার ঐ পিয়ারী নামটি অনেকদিন আগে থেকেই টোকা আছে।

ক্রমশ সবই মনে পড়ে।

লোকটা গতিবিধি যে কেবল অত্যন্ত সন্দেহজনক শুধু তাই নয়, বছর খানেক আগে একবার ও মাসছয়েক আগে আর একবার দুটো জটিল নোট জাল ও ওপিয়াম স্মাগলিংয়ের কেসের সঙ্গে ঐ নামটি বেশ ঘনিষ্ঠভাবেই জড়িয়ে ছিল কিরীটীর মনে পড়ল।

কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করেও লোকটাকে ধরা ছোঁয়া যায়নি সে সময়।

তেলা মাছের মত হাতের মুঠোর মধ্যে এসেও প্রায় প্রমাণের অভাবে পিছলে গিয়েছিল যেন।

তখনই বুঝেছিল কিরীটী লোকটি যেমনি ধূর্ত, ক্ষিপ্র ও তেমনি শয়তান। অসংখ্য ডেরা আছে লোকটার।

কোথায়ও এক দিন, কোথায়ও দুদিন বা বড়জোর দিন চারেকের বেশী এক নাগাড়ে থাকে না কখনো।

সর্বত্র গতিবিধি।

কি করে কি ভাবে চলে তাও সঠিক জানা যায়নি এখন পর্যন্ত।

তাতে করে আরো সন্দেহটা পিয়ারীর উপর ঘনীভূত হয়েছে কিরীটীর। এবং সেই থেকেই তীক্ষ্ণ নজর আছে পিয়ারীর উপর কিরীটিার। লোক-চরিত্র সম্পর্কে কিরীটীর যতটা জ্ঞান আছে, তাতে করে অন্তত এটুকু তার কাছে অস্পষ্ট নেই যে লোকটা গভীর জলের মাছ।

কিরীটী তাই রানার সঙ্গে পিয়ারীর ঘনিষ্ঠতা দেখে চমকে উঠেছিল।

পিয়ারী রানার সঙ্গে কেন? কতদিনের আলাপ ওদের আর কেনই বা ঐ ঘনিষ্ঠতা? এবং কোন সূত্রে আলাপ ওদের?

প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট পরে রানা চেম্বার থেকে বের হয়ে এল।

কিরীটীও নিঃশব্দে অলক্ষ্যে রানাকে অনুসরণ করে।

রানা তার অফিসে পৌছে পিয়ারীকে সঙ্গে নিয়ে উপরে চলে গেল।

কিরীটী তখন গাড়ি থেকে নেমে পরমেশ্বরের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তাকে বললে, পরমেশ্বর, তুমি একটু দূরে গিয়ে তোমার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা কর।

ঐ যে ড্যাঙা লোকটা দেখলে ও যদি এসে তোমার ট্যাক্সি ভাড়া করে তো তাকে পৌঁছে দেবে ও ঠিকানাটা ওর মনে রাখবে। আর তা যদি না হয় তো আমি না ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। মোট কথা আমার সঙ্গে আজ তোমার দেখা হয় ভালই, নচেৎ কাল সকালে আমার সঙ্গে সকাল নটার মধ্যে দেখা করবে।

পরমেশ্বর সম্মতি জানিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে রাস্তার মোড়ের দিকে এগিয়ে গেল।

আধঘণ্টা পরে প্রায় পিয়ারীকে বের হয়ে রাস্তার মোড়ের দিকে অগ্রসর হয়ে যেতে লক্ষ্য করলে কিরাটী। কিন্তু রানাকে বের হতে দেখল না।

আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন রানা বের হল না, কিরীটী রাস্তার মোড়ের দিকে এগিয়ে চলল।

মোড়ে এসে দেখল পরমেশ্বরের ট্যাক্সিটা সেখানে আশেপাশে কোথায়ও নেই।

খানিকটা আরও এগিয়ে গিয়ে হাত-ইশারায় একটা খালি ট্যাক্সি ডেকে কিরিটী উঠে বসল।

সোজা মেসে ফিরে এল কিরীটী।