১৪. মহাবীরের গলার শব্দ

মহাবীরের গলার শব্দ পেয়ে যোগানন্দ বাইরে এসে দাঁড়ায়, একলা মাইজীকে রেখে এতক্ষণ তুমি বাইরে ছিলে মহাবীর!

আমি তো যেতে চেয়েছিলাম না হুজুর। কিন্তু মাইজী বললেন—

নারায়ণী চলে গেছে। একটা ঝি তো খুঁজে আনতে পারতে মহাবীর!

আমি তো বলেছিলাম, মাইজী বারণ করলেন।

কালই একটা ঝি খুঁজে আনবে।

মহাবীর ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

ইতিমধ্যে ঘরের মধ্যে স্টেভ জ্বলিয়ে সবিতা চায়ের জল চাপিয়ে দিয়েছিলেন কেতলিতে।

ঘরে ঢুকে যোগানন্দ তাই দেখে বললে, এখন আবার চায়ের জল চাপালেন দিদি!

তা হোক, তুমি তো চা ভালবাস।

যোগানন্দ জানে, প্রতিবাদ জানালে দিদি মনে ব্যাথা পাবেন, তাই আর কোনরূপ প্রতিবাদ জানাল না।

জুতো খুলে হাঁটু মুড়ে আবার মাদুরের ওপরে বসল।

সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে এই গৃহকোণটি সম্পর্কে যোগানন্দের কি যেন দুর্বলতা—তার উচ্ছৃঙ্খল নিয়মকানুনহীন জীবনের এই গৃহকোণটি যে কতখানি অধিকার করে আছে, ভাবতে গেলে নিজেরই তার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। যেদিন হতে এই গৃহকোণটি সে চিনেছে, সেইদিন হতেই যেন সে এক অদৃশ্য বাঁধনে বাঁধা পড়েছে এখানে। ভালবাসা, স্নেহমমতা কোনদিনই এসবের কোন স্থান ছিল না যোগানন্দের জীবনে। জন্মের সঙ্গে-সঙ্গেই মাকে হারিয়েছিল। সতের বছর বয়সের সময় বোপকেও হারায়। এমন কিছু সঞ্চয় বাপ রেখে যাননি যোগানন্দের জন্য বা এমন কিছু শিক্ষাও দিয়ে যেতে পারেননি, যাতে করে সহজ স্বাভাবিক পথে জীবনটাকে যোগানন্দ কাটিয়ে দিতে পারত। অথচ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছিল যোগানন্দের।

পিতার মৃত্যুর পর যোগানন্দ মামার বাড়িতে এসে ওঠে। কিন্তু দুদিনেই বুঝতে পারল সেখানে স্থান তো হবেই না এবং কোনরূপ সাহায্যও মিলবে না।

যোগানন্দ কলকাতায় চলে এল। হাতে সামান্য যা ছিল তারই উপরে নির্ভর করে একটা মেসবাড়িতে এসে উঠল। পনের টাকায় খাওয়া থাকা। সেই মেস বাড়িতেই আলাপ হয় যোগানন্দের শেয়ার মার্কেটের দালাল যতীন মিত্রের সঙ্গে। যতীন মিত্রের পরামর্শেই যোগানন্দ বাজারে ঘোরাফেরা শুরু করল। মাস ছয়েক বাজারে ঘোরাফেরা করে শেয়ার সম্পর্কে বাজারদার ও তার ওঠানামা সম্পর্কে একটা মোটামুটি জ্ঞানলাভ করল এবং খুব অল্পদিনের মধ্যেই যোগানন্দ দালালী করে বেশ দু’ পয়সা উপার্জন করতে শুরু করে।

বছর দশেকের মধ্যে যোগানন্দ তার নিজের বিশিষ্ট আসনটি কায়েম করে নিল। যথেষ্ট অর্থাগম হতে লাগল। এবং অর্থাগমের সঙ্গে সঙ্গে আর একটি বিশেষ বস্তুর ওপরে তার আসক্তি জন্মাল। সুরা। কিন্তু সুরা তাকে ধ্বংস করতে পারেনি।

চা তৈরি করে সবিতা চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলেন যোগানন্দের দিকে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে যোগানন্দ বলে, আচ্ছা দিদি, বলতে পারেন চা তো আপনি বিশেষ খান না। কিন্তু এমন চা তৈরী করেন। কি করে?

সবিতা যোগানন্দের কথায় হাসেন।

নেহাৎ কাজের ঝঞ্ঝাটে রোজ আসতে পারি না, নচেৎ ইচ্ছা করে রোজ এসে আপনার হাতের তৈরী চা খেয়ে যাই–

তা বেশ তো, এলেই তো হয়।

দাঁড়ান, এখন আপনাকে জোর করছি না বটে, সব ঝামেলা মিটে যাক, তারপর আপনাকে আমার বাড়িতে যে নিয়ে যাব। আর ছাড়াছাড়ি নেই। কিন্তু রাত হল, এবারে আমাকে উঠতে হবে। বলতে বলতে যোগানন্দ উঠে দাঁড়াল।

হঠাৎ দরজার গোড়া পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে আবার দাঁড়ায়, তার পর পকেটে হাত দিয়ে কয়েকটা নোট বের করে বলে, টাকা আপনার নিশ্চয়ই শেষ হয়ে গিয়েছে দিদি—এই টাকা কটা রাখুন।

না না, গত মাসে যে টাকা তুমি আমাকে দিয়েছিলে সেই টাকাই তো এখনও শেষ হয়নি!

বলেন কি দিদি! মাত্র তো একশটা টাকা দিয়েছিলাম। সে টাকা এখনো আছে মানে! খরচ আর কি, দুজন মাত্র তো লোক— আজকালকার দিনে একজনেরই খেতে তো একশ টাকা লাগে। নিন রাখুন টাকাটা—

না, ভাই। এখন থাক। প্রয়োজন হলে আমিই চেয়ে নেব তোমার কাছ থেকে।

সে আপনি যা চাইবেন তা আমার জানা আছে। নিন। ধরুন তো টাকাটা! যোগানন্দ টাকা কটা একপ্রকার জোর করেই সবিতা দেবীর হাতে গুজে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল।

অন্ধকার গলিপথটা অতিক্রম করে বড় রাস্তায় যখন এসে পড়ল। রাত তখন প্রায় সাড়ে নটা বেজে গিয়েছে। ট্রাম বাস প্রাইভেট কার ও জনপ্রবাহে আলো-ঝলকিত কলকাতা শহর তখনও প্রাণপ্রাচুর্যে ঝলমল করছে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যোগানন্দ।

সবিতাদির স্বামী ও কন্যা বাণীকে খুঁজে বের করতেই হবে। যেমন করেই হোক তাদের খুঁজে বের করে সবিতাদিকে সুখী করতেই হবে। সবিতাদির মুখের দিকে যেন আর চাওয়া যায় না।

আশ্চর্য চরিত্র অনিলবাবুর!

সাবিতাদির মত স্ত্রী পেয়েও তিনি সংসার বেঁধে সুখী হতে পারলেন না। অথচ সাবিতাদির মত স্ত্রী সংসারে কজনের ভাগ্যে লাভ হয়! আর ওদের বিবাহটাও নাকি হয়েছিল পরস্পরে। পরস্পরকে ভালবেসে।

প্রফেসার বাপের শিক্ষিত মেয়ে, অনিলবাবু নিজেও উচ্চশিক্ষিত, তবু যে কেন সব এমনি হয়ে গেল!

সুখের সংসারই দুজনে পেতেছিলেন, মফস্বল শহরে এক বেসরকারী কলেজে অধ্যাপকের কাজ নিয়ে গিয়ে। দুটো বছর আনন্দেই কেটেছিল। তারপরই লাগল আগুন।

একটি ছাত্রীকে পড়াতেন, হঠাৎ একদিন সেই ছাত্রীকে নিয়ে হলেন পলাতক আনিলবাবু। সবিতাদি তখন পাঁচ মাস অন্তঃসত্ত্বা। ছোট মফস্বল শহরে একেবারে টি টি পড়ে গেল ব্যাপারটা নিয়ে।

 

লজায় অপমানে সবিতা পালিয়ে এলেন কলকাতায় বাপের কাছে। বাপ শশাঙ্কমোহন সব শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কেবল বললেন, যাক ভালই করেছিস। রাস্কেল! হাতের কাছে পেলে চাবুক মেরে পিঠের ছাল তুলে নিতাম। আজ থেকে জানবি তোর বিয়েই হয়নি।

কিন্তু বাবা, তার সন্তান যে আমার গর্ভে! দু হাতে মুখ ঢাকলেন সবিতা।

শশাঙ্কমোহন যেন একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন কথাটা শুনে!

তাঁর গলা দিয়ে কয়েকটা মুহূর্ত কোন শব্দই বের হয় না।

তারপর একসময় ধীরে ধীরে বললেন, ঠিক আছে, ঐ তার সন্তান-যে আসছে তাকে নিয়েই তুই বেঁচে থাক। ঐ অপদার্থটার কথা ভুলে যা—ভুলে যা সব কথা।

যাই হোক, সবিতা পিতা শশাঙ্কমোহনের কাছেই থেকে গেলেন। ঐ একমাত্র মেয়ে শশাঙ্কমোহনের। স্ত্রীর আগেই মৃত্যু হয়েছিল। বড় আদরের মেয়ে। কন্যা বাণী জন্মাল।

দশ বছর অনিলের আর কোন সংবাদই পাওয়া গেল না। সবিতা নিজেও জেনেছিলেন আর হয়তো জীবনে কোনদিনই তার সন্ধান পাওয়া যাবে না।

এমন সময় হঠাৎ একদিন শীতের মধ্যরাত্রে প্রাচীর টপকে অনিল শশাঙ্কমোহনের বাড়িতে এসে প্রবেশ করলেন।

পরিচিত গৃহ।

স্ত্রীর শয়নকক্ষটা চিনে নিতে তার কষ্ট হয়নি। সবিতা একাই তাঁর ঘরে শুয়েছিলেন।

পাশের ঘরে দাদুর সঙ্গে ঘুমিয়েছিল বালিকা বাণী, অনিলের মেয়ে।

সবিতার গাতে হাত দিয়ে ঠেলে তুললেন অনিল তীকে ঘুম থেকে।

কে!

চুপ। চেঁচিও না—আমি অনিল।

তুমি। বিস্ময়ে যেন বোবা হয়ে গেছেন সবিতা।

হ্যাঁ, আমি। আমি আবার ফিরে এসেছি সবিতা।

তুমি ফিরে এসেছ!

ডায়বিটিসের রোগী শশাঙ্কমোহন। রাত্রে ভাল করে ঘুম হয় না।

তিনি যে ইতিমধ্যে পাশের ঘরে আলো জ্বলা ও চাপা কথাবার্তার আওয়াজে উঠে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, দুজনের একজনও তা টের পাননি।

কে রে সাবি? বলতে বলতে শশাঙ্কমোহন ঘরের মধ্যে এসে একেবারে সোজা আচমকা প্ৰবেশ করেন।

বাবা! একটা আর্ত শব্দ বের হয়ে আসে সবিতার কণ্ঠ হতে।

জামাই অনিলকে চিনতে শশাঙ্কমোহনের কষ্ট হয় না।

রুক্ষস্বরে প্রশ্ন করেন, এ বাড়িতে তুমি কোন সাহসে আবার ঢুকেছ? স্কাউনড্রেল! এখুনি বের হয়ে যাও–

বাবা! আর্তকণ্ঠে ডেকে ওঠেন সবিতা।

না। চরিত্রহীন লম্পটের আমার বাড়িতে কোন প্রবেশাধিকার নেই। যাও বেরিয়ে যাও!

আপনার বাড়িতে থাকতে আমি আসিনি। আমি এসেছি আমার স্ত্রীকে নিয়ে যেতে। ঘুরে দাঁড়িয়ে অনিল বলেন।

তোমার স্ত্রী! কে তোমার স্ত্রী? সবিতার তুমি কেউ নও। তোমার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই।

সম্পর্ক আছে কি না আছে সেটা আপনার বিচারে সাব্যস্ত হবে না!

নিশ্চয়ই-একশ বার হবে। যাও বেরিয়ে যাও।

বেশ তো, সবিতারও যদি সেই মত হয়, নিশ্চয়ই বের হয়ে যাব।—সে-ই বলুক। সবিতা আবার কি বলবে! আমিই বলছি—

বলবার যদি কারো অধিকার থাকে তো একমাত্ৰ আছে সবিতারই। আপনি বলবার কে!

লজ্জা করছে না তোমার? নির্লজ্জ বেহায়া–

সবিতা!

সবিতা কিন্তু নিরুত্তর। পাথরের মতই যেন জমাট বেঁধে গিয়েছে। স্থির বোবা।

সবিতা তোমারও কি তাই মত? তাই যদি হয় তো বল, আমি চলে যাচ্ছি!

তবু সবিতার কোন সাড়া নেই।

বেশ তবে চললাম।

অনিল দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যেতেই সবিতা ডাকলেন, দাঁড়াও আসছি। বাণী ঐ ঘরে ঘুমিয়ে আছে, তাকে নিয়ে আসি।

সবিতা! তীক্ষু কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠেন শশাঙ্কমোহন।

ক্ষমা করো বাবা, ওঁর অবাধ্য তো হতে পারব না—

সবিতা, তোর সঙ্গে যে নীচ জঘন্য ব্যবহার করেছে, তার পরেও—

কি করব বাবা, হিন্দুর মেয়ে-স্বামী তাদের যাই হোক না কেন স্ত্রীর তো তাকে ছাড়া অন্য পরিচয় নেই। তাছাড়া ওঁর ভুলকে যদি আমি ক্ষমা না করি, তবে উনি কোথায় দাঁড়াবেন? আমাকে যাবার অনুমতি দাও বাবা–

সবিতা, তুই কি ভুলে গেলি কি জঘন্য অপমান ঐ লোকটা তোকে করেছে, তবু তুই ওর সঙ্গে যাবি?

বাবা!

বেশ যা, কিন্তু এও জেনে যা আজ থেকে এ বাড়ির দরজাও তোর বন্ধ হয়ে গেল। আজ থেকে জানব সবিতা বলে কোন মেয়ে আমার ছিল না।

আজ তুমি আমাকে হয়তো ক্ষমা করতে পারছ না। বাবা, কিন্তু একদিন যখন জানবে কতখানি নিরুপায় হয়েই আমাকে আজ তোমার অবাধ্য হয়ে তোমার মনে আঘাত দিয়ে যেতে হল সেদিন হয়তো আমাকে তুমি ক্ষমা করতে পারবে।

শশাঙ্কমোহন আর একটি কথাও না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

সবিতা চিত্ৰাপিতের মতই দাঁড়িয়েছিলেন।

অনিলও চুপচাপ দাঁড়িয়ে।

সমস্ত ব্যাপারটা যে হঠাৎ ঐভাবে ঘুরে যাবে। এ কথা তিনি আদপেই ভাবেননি। ঝোকের মাথায়ই তিনি সবিতাকে তার সঙ্গে চলে যাবার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। নচেৎ সবিতাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার কোন মতলবই ছিল না।

তিনি এত রাত্রে সবিতার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন সম্পূর্ণ অন্য কারণে। তিনি এসেছিলেন সবিতাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কিছু টাকাকড়ি চেয়ে নিয়ে আপাততঃ চলে যাবেন মনে করে, কিন্তু ঘটনা দাঁড়িয়ে গেল অন্যরকম।

একটা দীর্ঘশ্বাস রোধ করে সবিতাই কথা বললেন, একটু দাঁড়াও, বাণীকে নিয়ে আসি।

বাণী!

হাঁ, আমাদের মেয়ে। একটু পরেই ঘুম হতে তুলে বাণীর হাত ধরে সবিতা এ ঘরে ফিরে এসে স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, চল।

তিনজনে সেই মধ্যরাত্রে জনহীন রাস্তার উপরে এসে দাঁড়ালেন।