০৭. বামদেব ঘর হতে বের হয়ে গেলেন

একটু যেন চঞ্চল পদেই বামদেব ঘর হতে বের হয়ে গেলেন।

সুজাতা বিনয়ের ব্যবহারে একটু যেন বিস্মিতই হয়েছিল। ক্ষণপূর্বে ও বিনয়কে খোঁচা দিয়েই কথা বলেছে এবং ইতিপূর্বে কোনদিনই বিনয় খোঁচা খেয়ে খোঁচা নির্বিবাদে হজম করেনি, বিশেষ করে সুজাতার কাছ থেকে খোঁচা খেলে বরং দ্বিগুণ উৎসাহে দ্বিগুণ চোখা বক্রোক্তিই সে ফিরিয়ে দিয়েছে।

বিনয় বুঝতে পারে কৌতূহলে সুজাতা ফেটে পড়বার উপক্রম, তথাপি সে নির্বিকারভাবে শিস দিয়ে যায়। বেশীক্ষণ কিন্তু বিনয় নির্বিকার থাকতে পারে না। সামনে উপবিষ্ট মেয়েটিকে এবারে শান্ত করা দরকার!

ইঃ মেয়ের মুখখানা দেখ না।–বেজায় চটেছে।

হঠাৎ এমন সময় অন্যমনস্কভাবে পকেটে হাত যেতেই বিনয়ের একটা কথা মনে পড়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ওষ্ঠ্যপ্রান্তে বিচিত্ৰ হাসি দেখা যায়। .

বিনয়-সুজাতার মধ্যে লৌকিক চক্ষে যত গরমিলাই থাক, পরস্পরের মধ্যে যে পরস্পরের একটা সত্যিকারের গাঢ় প্রীতির সম্পর্ক আছে। অন্য কেউ না জানলেও পরস্পরের নিকট সেটা অবিদিত নেই।

তৃতীয় কেউ না জানলেও পরস্পর পরস্পরকে মধ্যে মধ্যে দু-চার ছত্রের এক-আধখানা দেয়। অবশ্য সে চিঠিতে কোন সম্বোধন বা চিঠির নীচে ইতির শেষে কোন নাম বা পরিচয়সংজ্ঞা না থাকলেও, চিঠি যে যখন পায় এবং যে যখন চিঠি লেখে তারা উভয়েই বুঝতে পারে এবং জানেও কার চিঠি এবং কে কাকে লিখেছে। এবং ঐ ভাবে গোপনে চিঠি লেখালেখির ব্যাপারটা দুজনের মধ্যে একটা বিচিত্র আকর্ষণের সূত্র হয়ে দাঁডিয়েছিল এবং অমনি একখানা চিঠি মাত্র দিন দুই আগে বিনয় পেয়েছে এবং পকেটে হাত যেতে সেই চিঠিটাই হাতে ঠেকতে ওর ওষ্ঠ্যপ্রান্তে বিচিত্ৰ হাসি দেখা দিয়েছিল।

উৎসাহে এতক্ষণে বিনয় সোজা হয়ে উঠে বসে। এবং নিজের সঙ্গেই যেন নিজে কথা বলছে এইভাবে বলে ওঠে, তাই তো, সেই মেয়েটির একখানা চিঠি তো পরশু পেয়েছি! জবাব দেওয়া তো এখনো হয়নি। নাঃ, কি ছাই যে ভোলা মন হয়েছে আমার! মেয়েটি এত করে চিঠি লিখলে, অথচ একটা উত্তরও দেওয়া হল না!

কথা বলতে বলতে চিঠিখানা বের করে বেশ একটু উচ্চকণ্ঠেই এবারে বিনয় পড়তে শুরু করে।

সবুজ রংয়ের একটা চিঠির কাগজ। চিঠিটা পকেট থেকে বের করতেই মৃদু মিষ্টি একটা বিলাতী ল্যাভেণ্ডারের গন্ধ পাওয়া যায়। পড়তে গিয়ে কিন্তু বিনয়ের মাথার মধ্যে একটা দুষ্টুমি চাড়া দিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে নিজের মন থেকে কল্পনায় বানিয়ে বানিয়ে ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে পড়তে শুরু করে :

ওগো, তোমার নীরবতা যে আর আমি সহ্য করতে পারছি না! তুমি কি নিষ্ঠুর-হৃদয় বলে কি তোমার কোন পদার্থই নেই! আমার এ রক্তাক্ত হৃদয় তোমার পদতলে লুণ্ঠিত করে–

এই পর্যন্ত বিনয় বলেছে, হঠাৎ মুখ ভেংচে সুজাতা বলে ওঠে বিকৃত কণ্ঠে, এঃ, রক্তাক্ত হৃদয় তোমার পদতলে-মিথ্যুক কোথাকার! বয়ে গিয়েছে লুষ্ঠিত হতে কারো হাতীর মতো গোদা পায়ে!

হো হো করে বিনয় গলা ছেড়ে এবার হেসে ওঠে।

আরো রেগে যায়। সুজাতা বিনয়ের হাসিতে, কোন মেয়ের তো খেয়েদেয় কাজ নেই, ঐ হোঁৎকা নাকেশ্বরের গোদা পায়ে লুষ্ঠিত হতে যাবে!

কিন্তু যদি এমন কোন মেয়ে থাকে–

ককখনো না। থাকতেই পারে না।

কিন্তু শ্ৰীমতী কালোজিরে বোধ হয় সম্যক জ্ঞাত নন যে, বিগত যুগে মুনিঋষিরাও বলে গিয়েছেন যে নারী-মন বিচিত্র! নচেৎ যে মেয়েটি আমার প্রেমে গদগদ হয়ে এই পত্ৰবাণ নিক্ষেপ করেছেন–

বয়ে গিয়েছে নাকানন্দ নাকেশ্বরের প্রেমে গদগদ হতে!

আহা রে! সত্যি বলছি কালিন্দী, ক্যামেরটা এসময় সঙ্গে নেই, নচেৎ ঐ মুখ-চন্দ্ৰিমার এই অবিস্মরণীয় মুহুর্তের একখানি ছবি তুলে নিতে পারলে-হায় হায়, কি ভয়ঙ্কর অপূরণীয় ক্ষতি! হায় পৃথিবীর মনুষ্যগণ, তোমরা কি হারাইলে তোমরা জান না! বাইবেলের ভাষার বঙ্গানুবাদে বলতে ইচ্ছা করছে, ঈশ্বর তোমাদের প্রেম দিতে চাহিয়াছিলেন–

খিলখিল করে এবারে সমস্ত কষ্টকল্পিত গাম্ভীর্য ও বিরাগের মুখোশটা খুলে ফেলে দিয়ে অভিমানের গুমোটটা কেটে যায়।

সুজাতার সঙ্গে হাসিতে যোগ দেয় বিনয়ও। বিনয় জানত, বাইবেলের ঐ ধরনের অদ্ভুত বঙ্গানুবাদ সুজাতাকে কি ভাবে হাসায় —তাই বরাবরই কপট মান-অভিমানের কলহের শেষে ঐ ব্ৰহ্মাস্ত্র প্রয়োগেই সুজাতার সঙ্গে সন্ধি করত। আজও শেষ পর্যন্ত তাকে সেই আশ্রয়ই গ্রহণ করতে হল।

হসির মধ্যে দিয়েই ভাব হয়ে গেল।

সুজাতা অতঃপর প্রশ্ন করে, বাবার সঙ্গে কি আলোচনা হচ্ছিল?

সেই চিরাচরিত সহজাত নারীমনের কৌতূহল। বিনয় হাসতে থাকে।

না না, নাকু সত্যি বল না, কিসের চিঠি তোমাকে পড়তে বাবা দিয়েছিলেন?

জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির—

তার মানে?

সত্যিই তাই। জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি মেসোমশাইকে সাবধান করে দিয়েছেন, রত্নমঞ্জিল যেন বিক্রি করা না হয়। অন্যথায় তাঁকে নাকি সমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।

না, না–be serious!

এমন সময় সিঁড়িতে বামদেবের জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।

বামদেব আসছেন।

দুজনেই ঠিক হয়ে গুছিয়ে সরে বসে। বামদেব ঘরে এসে ঢুকলেন। মুখে তাঁর চিন্তার রেখা সুস্পষ্ট।

সোফার উপরে বসতে বসতে বামদেব বললেন, বোধ হয় তোমার কথাই ঠিক, বিনয়। পিয়ারীলাল কেন এসেছিল জান!

কেন?

পঞ্চান্ন হাজারের উপরে রাণা আরো কিছু বেশী দিতে প্রস্তুত এবং আরো দশহাজার অগ্রিম দিতে চায়। এবং বললে, সামনের মাসের পনের তারিখের আগে বিক্রয়-কোবলাটা রেজোষ্ট্ৰী হয় তাদের ইচ্ছা–

আপিন কি বললেন?—

আমার হাতে অনেক কাজ বর্তমানে—সেটা সম্ভব নয়। তাই বলে দিলাম। কাল-পরশুর। মধ্যে একবার রাণার অফিসে যেতে বলে গেল।

কি বললেন। আপনি? যাবেন নাকি?

তাই ভাবছি।

কিন্তু আমার মনে হয় না যাওয়াই আপনার ভাল। সত্যি আমি যেন ব্যাপারটার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না!

এদিকে আবার কি হয়েছে জান?

কি?

রাঘব সাহা যে আবার এইমাত্র ফোন করেছিল!

রাঘব সাহা-মানে ঐ অ্যাটর্নি?

হ্যাঁ।

সে আবার ফোন করেছিল কেন?

A new offer–

হ্যাঁ, কে এক নাকি আবার নতুন খরিদ্দার জুটেছে বাড়িটার–সে নাকি আরও কুড়ি হাজার বেশী দাম দিতে চায়।

বলেন কি!

তাই তো বললে সাহা।

হুঁ, আমার এখন কি মনে হচ্ছে জানেন মেসোমশাই!

কি?

এই রত্নমঞ্জিলের মধ্যেই কোন একটা রহস্য আছে–

তাই তোমার মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ, নচেৎ একটা ভাঙা বাড়ি নিয়ে এমন টানা-হ্যাচড়া শুরু হত না। তা নতুন খরিদ্দারটি আবার কে এলেন, শুনলেন কিছু?

তার নামধাম তো কিছু বলল না, কেবল বললে টাকার কথা—

বলছিলাম কি, একবার চলুন না। আপনার বন্ধু কিরীটী রায়ের ওখান থেকে ঘুরে আসা যাক এখুনি!

আগে একবার ফোন করে দেখ। তাহলে উনি আছেন কিনা?

বামদেবের নির্দেশে বিনয় ফোন করবার জন্য ফোনের কাছে গিয়ে মাউথপিসটা তুলে নিল।

প্রায় মিনিট দশেক চেষ্টার পর কানেকশন পাওয়া গেল।

মিঃ রায় আছেন?

কথা বলছি, বলুন!

ধরুন, মিঃ অধিকারী আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।

বামদেব এসে ফোনটা ধরলেন, কে কিরীটী নাকি?

হ্যাঁ, বল।

আমি বামদেব কথা বলছি–

ওপাশ হতে মৃদু হাস্যধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন এলো, কি ব্যাপার রত্নমঞ্জিলের আবার কোন নতুন offer এসেছে বুঝি অন্য কারো কাছ থেকে?

আশ্চর্য! ঠিক তাই, কিন্তু তুমি জানলে কি করে?

অনুমান! কিন্তু তোমার কাছে রাণার লোক যায়নি?

আশ্চর্য, তাও তো এসেছিল! তার চাইতেও একটা আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে গতকাল একটা চিঠি পেয়েছি—

চিঠি! কার?

কোন নাম-স্বাক্ষর নেই, লেখা আছে জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি–

চিঠিতে কি লেখা আছে?

বাড়ি বিক্রি করতে নিষেধ করেছে। বিক্রি করলে নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হব!

আমি জানতাম, জানতাম-I smelt it—অস্পষ্ট আত্মগতভাবেই যেন শেষের কথাগুলো উচ্চারণ করে কিরীটী।

অ্যাঁ, কি বললে!

দেখ, আমাদের একবার বহরমপুরে অবিলম্বে যাওয়া প্রয়োজন—

বহরমপুর?

হ্যাঁ। কালই চল, রওনা হওয়া যাক।

কিন্তু—

না, এর মধ্যে আর কোন কিন্তু নেই। প্রস্তুত থেকে-কালই।

বেশ।

তাহলে স্টেশনেই আমাদের দেখা হবে।

***

কালই বহরমপুর যাচ্ছি বিনয়—

আমিও আপনাদের সঙ্গে যাব মেসোমশাই।

তুমি! কিন্তু। তোমার অফিস?

ছুটি পাওনা আছে, ছুটি নিয়ে নেব।

সুজাতা বলে, তাহলে আমিও কিন্তু যাব বাবা তোমাদের সঙ্গে—

তুই! তুই কোথায় যাবি?

ঐ তো বললাম, বহরমপুর তোমাদের সঙ্গে—

দেখি তোর মাকে তাহলে গিয়ে বলি। বামদেব ভিতরে চলে গেলেন।

উঁহু, পথে নারী বিবর্জিত–বিনয় বলে।

মুখ ভেংচে প্রত্যুত্তর দেয়। সুজাতা, কি আমার নির রে! নাকেশ্বর, নাকানন্দ, নাকসর্বস্ব!

তবু কালোজিরে যাচ্ছেন না—

যাচ্ছি—যাব!

উঁহু।

যাবই।

নৈব নৈব চ।

হুঁ, if নাকু goes–I go!

তবে বল বিয়ে করবে আমায়?

নৈব্য নৈব চ। এ জীবনে নয়।

 

বহরমপুর যাওয়ার সময় সুজাতাও ওদের সঙ্গী হল।

কন্যার প্রতি দুর্বলতায় বামদেবের শেষ পর্যন্ত ইচ্ছা না থাকলেও মুখে না করতে পারলেন না। এবং যাবার সময় বিনয় মুখখানা গভীর করে থাকলেও মনে মনে খুশি হল, মেয়েটা শেষ পর্যন্ত তার জিদ বজায় রেখেছে দেখে ও মেশোমশাই বামদেবেও কন্যার প্রতি দুর্বলতার খাতিরে সুজাতাকে সঙ্গে নিলেন দেখে।

যাহোক নির্বিবাদেই সকলে বহরমপুরে এসে পৌঁছল।

সারাটা দিন সুজাতা পুরাতন রত্নমঞ্জিলের সর্বত্র হৈচৈ করেই বেড়াল।

কলকাতার বদ্ধ জীবনের পর বহরমপুরের খোলা মুক্তির মধ্যে সুজাতা যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে এবং না হোক দশ-বারো বার বামদেবকে বললে, এই বাড়ি তুমি কেন বিক্রি করবে। বাবা! এ-বাড়ি তুমি কিছুতেই বিক্রি করতে পারবে না।

কিন্তু বায়না যে নেওয়া হয়ে গিয়েছে মা—

তাতে কি, ফেরত দিয়ে দাও! বায়না নিয়েছ তো কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে! বলবে ভেবেছিলাম বিক্রি করব কিন্তু ভেবে দেখলাম বিক্রি করতে পারছি না, ব্যাস!

বামদেব হাসলেন, পাগলী!

বারন্দায় একটা ইজিচেয়ারের উপর বসে বামদেব ও তাঁর মেয়ে সুজাতা রত্নমঞ্জিল সম্পর্কে যখন কথাবার্তা বলছিল, বিনয় সেই সময় একা একা ঘুরে ঘুরে বাড়ির চারপাশ দেখছিল।

কিছুদিন ধরে বাড়িটার বিক্রয়-ব্যাপার নিয়ে যে সব ঘটনাগুলো ঘটেছে, বিনয়কে সেটা বেশ খানিকটা উত্তেজিত করে তুলেছিল। নিঃসন্দেহে এবং বহরমপুর পৌঁছে রত্নমঞ্জিলে পদার্পণ করবার পর থেকে কেমন যেন তার বার বার মনে হচ্ছিল, কোনক্রমেই এই রত্নমঞ্জিল বিক্রয় করা চলতে পারে না। টাকাই সব ক্ষেত্রে বড় কথা নয়, মানুষের সেন্টিমেন্টেরও একটা মূল্য আছে বৈকি।

পূর্ব ব্যবস্থামত ওদের সঙ্গে বহরমপুরে আসতে পারেনি। কিরীটী হঠাৎ শেষ মুহুর্তে বিশেষ একটা কাজে আটকা পড়ায় ওদের সঙ্গ নিতে পারেনি। তবে বলেছে। দু-চারদিনের মধ্যেই আসছে।

এখানে আসবার পূর্বে বিনয় কিরীটীর সঙ্গে দেখা করেছিল। সেই রাত্ৰেই। কিরীটী বলে দিয়েছে বিশেষ করে কয়েকটি কথা, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে-দিনে বা রাত্রে সর্বদা যেন তারা বিশেষ সাবধানে থাকে।

বিনয় শুধিয়েছিল, কেন বলুন তো? আপনি কি মনে করেন আমাদের আচমকা কোন বিপদ-আপদ ঘটতে পারে। সেখানে?

ঘটলে আশ্চর্য হবেন না বিনয়বাবু!

কিরীটীর সাবধান-বাণী বিনয় তখন হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু এখানে পৌঁছাবার পর ও বাড়িটার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে মনের মধ্যে তার ঠিক শঙ্কা না হলেও কেমন একটা অসোয়াস্তি অনুভব করে যেন সে।