০৫. মোহর প্রাপ্তির কাহিনী

মোহর দুটো দেখে এবং মোহর প্রাপ্তির কাহিনী রাণার মুখে শুনে বন্ধু বলেন, তাজ্জব ব্যাপার! শুনেছি আগেকার দিনে অনেক ধনীরা মাটির নীচে ঘড়া ঘড়া মোহর পুতে যখ করে রাখত। খবর নাও শেঠ, বাড়িটা কতদিনের পুরাতন এবং বর্তমানে মালিক কে!

হরিহর কিছু কিছু সংবাদ রত্নমঞ্জিল সম্পর্কে তার ভাই মনোহরের মুখেই শুনেছিল— সবই শেঠকে বলেছিল।

শেঠের মুখে সেই কাহিনী শুনে বন্ধু বলেন, নিশ্চয়ই ঐ বাড়ির নীচে মাটির তলায় গুপ্তধন পোতা আছে। এক কাজ কর রতনলাল, তুমি ঐ বাড়িটা কিনে নাও!

রতন তখন বলে, আমারও তাই মনে হচ্ছে—

বন্ধু বলেন, মনে হচ্ছে কি হে! নিশ্চয়ই অনেক মোহর আছে। ঐ রত্নমঞ্জিলের মাটির নীচে!

অর্থের প্রলোভন বড় মারাত্মক। একবার সে প্রলোভন মনের মধ্যে এসে বাসা বঁধলে তার হাত থেকে রেহাই পাওয়া দুষ্কর।

নশ্চিত গুপ্তধনের নেশায় মেতে ওঠে রতনলাল।

একদিন গিয়ে সে অধিকারীর সঙ্গে দেখা করলে। বাড়িটা সে কিনতে চায়, খাগড়ার বাসনের কারখানা খুলবে—কি দাম চান অধিকারী?

বামদেব কিন্তু বিস্মিত হন প্রস্তাবটা শুনে। প্রথমটায় তো তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি।

কিন্তু রাণার বারংবার বিশেষ অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বলেন ভেবে দেখি, পরে জানাব।

দিন কয়েক পরে ফের রাণা দেখা করে, কিন্তু সেবারও ঐ একই জবাব পায়।

রাণার কিন্তু সবুর সয় না। দিন দুই পরে আবার তাগাদা দেয়, কি মিঃ অধিকারী ভেবে দেখলেন? বাড়িটা তো আপনার পড়েই আছে! আপনার কলকাতায় বাড়ি আছে, আপনি আর যাবেনও না সে বাড়িতে–

তা ঠিক। তবে পূর্বপুরুষের বাড়ি—একটা স্মৃতি—

স্মৃতি দিয়ে কি হবে বলুন? শিক্ষিত লোক—আপনাদেরও যদি এসব সেন্টিমেন্ট থাকে—তা ছাড়া বাড়িটা তো ভাঙছি না, রইলই যেমন তেমন–

আমাকে আর কটা দিন ভেবে দেখতে দিন!

এর আর ভাববেন কি। চেক-বই আমি সঙ্গেই এনেছি, বলনে তো কিছু আগাম দিয়ে যাই—

ব্যস্ত হচ্ছেন কেন! হবেখন। —তবু বামদেব বলে।

দিন দুই বাদে আবার রতনলালের তাগাদা, কি ঠিক করলেন?

বেশ তো হবে’খন! —সেই পূর্বের জবাব।

হবে’খন নয়, আমাকে কথা দিন–ও-বাড়ি আমাকে ছাড়া বেচবেন না!

বামদেব রতনলালের বাড়ি কেনার অতি মাত্রায় আগ্রহ দেখে কেমন যেন একটু বিস্মিতই হয়, সত্যি কথা বলতে কি।

একটা পুরাতন আমলের বাড়ি তাও দূর শহরে এবং লোকালয় থেকে দূরে তার জন্য রাণার এত আগ্রহই বা কেন?

স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেন বামদেব। স্ত্রী সাবিত্রী বলেন, দাও বিক্রি করে। পড়েই তো আছে। ঐ টাকা দিয়ে কলকাতায় না-হয় আর একটা বাড়ি কেনা যাবে।

ব্যবসায়ী লোক বামদেব। স্ত্রীকে বললে, ভেবে দেখি।

তারপর শুরু হল বাড়ির দর নিয়ে কষাকষি। এবং রাণার গরজ বুঝে বামদেব বাড়ির দাম হাকাতে শুরু করলে।–

শেষ পর্যন্ত দর কষতে কষতে পঞ্চান্ন হাজার টাকায় স্থির হল মূল্য এবং একদিন দশহাজার টাকা অগ্রিম বায়না দিয়ে একটা লেখাপড়াও হল; স্থির হলো পরের মাসের পনেরই বিক্রয়-কোবালা রেজিষ্ট্রি হবে।

উক্ত ঘটনারই দিন তিনেক পর হতে বামদেবের কলকাতার বাড়িতে চোরের উপদ্রব। শুরু হল হঠাৎ।

এবং সেই সূত্রেই বামদেব একদিন তার বন্ধু কিরীটীকে ডেকে পাঠায় তার ওখানে। তার পরামর্শ নেবে স্থির করে ও ঐ ব্যাপারে।

অফিস ঘরে ঢুকে রতনলাল পিয়ারীকে বসতে বললে।

তোমার গাড়িতে বসে যেমন বললাম, সেই ভাবে কাজ করবে পিয়ারী। অধিকারী রাত দশটা নাগাদ বাড়ি ফেরে, তুমি দু-চার মিনিট আগেই তাঁর বাড়িতে বসে অপেক্ষা করবে। আর কাল সকালেই রাঘবের সঙ্গে দেখা করবে।

বেশ। তবে এবারে আমি উঠি।

হ্যাঁ, যাও।

পিয়ারী বের হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই বেয়ারা এসে ঘরে প্রবেশ করল, ছট্ৰলাল হুজ্বরের সঙ্গে দেখা করবে বলে সেই দুপুর থেকে এসে বসে আছে।

ছট্টুলাল নামটা শুনেই রতনলালের ভু, দুটো কেমন কুঁচকে ওঠে, বলে বলগে যা আজ দেখা হবে না। কাল-পরশু আসতে।

বেয়ারা চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ রতনলালের একটা কথা মনে পড়ায় বলে, আচ্ছা দে ঘরে পাঠিয়ে।

একটু পরেই ছট্টুলাল এসে ঘরে প্রবোস করল। ছট্টুলালকে দেখে তার বয়স ঠিক কত নিরূপণ করা শক্ত। দড়ির মত পাকানো শরীর। ঘাড়টা লম্বা। একটা আলপাকার সবুজ রংয়ের রুমাল ফাস দিয়ে বাধা গলায়। পরিধানে ঢোলা অধমলিন পায়জামা, গায়ে একটা পাঞ্জাবি ও গরম জহর কোট। পায়ে ডার্বি সু।

সমগ্র মুখখানায় দীর্ঘ অত্যাচারের চিহ্ন যেন অত্যন্ত সুস্পষ্ট। অত্যধিক ধূমপানের ফলে কালো কুচকুচে ঠোঁট দুটো। ডান ভুর ওপর একটা দেড় ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা ক্ষতচিহ্ন।

সেলাম শেঠজী!

কি খবর ছোট্ট?

বত্রিশটা দাঁত বিকশিত করে ছট্টু বিনয়ে যেন বিগলিত হয়ে গেল, দিন-কাল আর তো চলছে না শেঠজী। পাকিট গড়ের মাঠ। ভোঁ ভোঁ।

কত টাকার দরকার?

হুজুর তো হাত ঝাড়লেই পর্বত! যা দেবেন। দয়া করে——

একটা কাজ করতে পারবি?

গোলাম তো সর্বদাই হুজুরে হাজির! বাতিলান কি করতে হবে! কারোর জান, কলিজা–

না, না—ওসব কিছু না। কিন্তু কাজটা শক্ত। পারবি তো?

বলেনই না। কি এমন শক্ত কাজ আছে!

বহরমপুরে যেতে হবে–

কবে?

আজকালের মধ্যেই, যত তাড়াতাড়ি হয়।

যাব। কিন্তু বহরমপুরে কেন হুজুর?

বলছি।

ছট্টুলাল তাকায় রতনলালের মুখের দিকে।

তোকে ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। একটা বাড়ির ওপরে নজর রাখতে হবে। কেউ আসে কিনা-কেউ এলে সে কেমন দেখতে, কি নাম, কোথা হতে আসছে। যতটা সম্ভব খবর দিবি। পারবি তো? ভেবে দেখ!

কেন পারব না হুজুর? এ আর এমন কাজটা কি—

পকেট থেকে দশ টাকার খান-দশেক নোট বের করে এগিয়ে দিল রতনলাল ছট্টুর দিকে, আপাতত এই টাকা রাখা। ফাস্ট ট্রেনেই যাবি।

শীর্ণ বাঁকানো লোভী আঙুলগুলো সমেত হাত বাড়িয়ে দেয় ছুট্টি, টাকগুলো নেবার জন্য। এবং একপ্রকার প্রায় ছোঁ। মেরেই টাকাগুলো মুঠি করে জামার পকেটে ঢোকায়।

সেলাম শেঠজী। চললাম, সব খরব এনে দেবো।

নিমেষে ছট্টুলাল ঘর হতে বের হয়ে গেল।

আরো ঘন্টাখানেক বাদে অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছে। কর্মচারীরা যে যার ঘরে চলে গিয়েছে।

রতনলাল এগিয়ে গিয়ে ঘরের দরজাটা ভিতর থেকে এটে দিয়ে চেয়ারের ওপরে এসে আরাম করে বসল। চাবি দিয়ে বাঁ পাশের ড্রয়ার খুলে একটা বেঁটে কালো বোতল, একটা গ্লাস ও জলের বোতল বের করল। খানিকটা তরল পদার্থ গ্লাসে ঢেলে কিছুটা জল মিশিয়ে বার দুই সবে চুমুক দিয়েছে, এমন সময় বন্ধ দরজার গায়ে মৃদু টোকা পড়ল।

কে?

কোন জবাব নয়। আবার দুটো টোকা পড়ল।