০৭. মৃতদেহের দিকে এগিয়ে গেল

সুদৰ্শন মৃতদেহের দিকে এগিয়ে গেল।

নীচু হয়ে বসে মৃতদেহের সামনেটা উল্টে দিল সুদৰ্শন। বুকে ও পেটের ক্ষতস্থান দুটো চোখে পড়ল। পেটের খানিকটা ইনটেসটিন বের হয়ে এসেছে—দুহাতের পাতায় রক্ত শুকিয়ে আছে। বুকের ক্ষতটাও প্রায় ইঞ্চি-দুই চওড়া।

চোখে-মুখে অসহ্য একটা বিস্ময় ও যন্ত্রণার চিহ্ন তখনো যেন স্পষ্ট।

সুদৰ্শনের বুঝতে কষ্ট হয় না প্রথমে হয়তো পেটে কোন তীক্ষ্ণধার অস্ত্রের সাহায্যে আঘাত করা হয়েছিল, তারপর বক্ষস্থলে দ্বিতীয় আঘাত করা হয়েছে।

মোক্ষম দুটি আঘাত।

হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে।

ভদ্রলোক চেচাবার বা লোক ডাকবারও সময় পাননি।

ঘরের ঠিক দরজার সামনেই অনেকটা রক্ত কালো হয়ে জমাট বেঁধে আছে। হয়তো ভদ্রলোক ঘুমোচ্ছিলেন বা ঘুমোবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, ঐ সময় আততায়ী এসে দরজায় ধাক্কা দেয়। ভদ্রলোক দরজার গায়ে ধাক্কা শুনে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই আততায়ী সঙ্গে সঙ্গে তাকে অতর্কিতে প্রথমে তার পেটে আঘাত করে, তারপর বুকে।

দেহে রাইগার মরটিস সেট-ইন করেছে।

ঘণ্টা ছয়-সাত আগেই হয়তো মৃত্যু হয়েছে।

নিষ্ঠুর নৃশংস বীভৎস হত্যা।

মাত্র কয়েক ঘণ্টা ব্যবধানে পর পর তিনটি বীভৎস হত্যা একই বাড়ির দুই ফ্ল্যাটে উপরের ও নীচের ফ্ল্যাটে। হত্যা-পদ্ধতিও এক। কোন ধারালো তীক্ষ্ণ অস্ত্রের সাহায্যে।

হঠাৎ মনে পড়ে সুদর্শনের পূর্বে যে অস্ত্রের সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে সেটা পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু এবারে যে অন্ত্রের সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে সেটি কোথায়?

সুদৰ্শন আবার উঠে দাঁড়াল।

ঠিক দোতলার ফ্ল্যাটের মতই উপরের তলার ঐ ফ্ল্যাটটিতেও ব্যবস্থা—ততে চারটি ঘর এবং দুটি বেডরুম।

প্রত্যেক ঘরেই দামী দামী আসবাব।

একটি শোবার ঘরে পাশাপাশি দুটি শয্যা—একটি রাত্রে ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে হয় না। সেই ঘরে একটি গডরেজের আলমারি-তার পাশে একটি দামী ড্রেসিং টেবিল। সেই ঘরটি একেবারে কোণের ঘর-তার আগের ঘরে একটি সিঙ্গল বেডে শয্যা।

সে শয্যাটি দেখলেই বোঝা যায় রাত্ৰে শয্যাটি ব্যবহৃত হয়েছে। ঐ ঘরটি বসবার ঘরের ঠিক পরের ঘর।

শেষোক্ত ঘরের মধ্যে একটি বুক-সেলফ-পাশে ইংরাজী ও বাংলা বই সাজানো।

সেলফের উপরে একটি ফটো। ফ্রেমে একটি ফ্যামিলি-ফটো। দেখলেই বোঝা যায় গোপেন, বসুর ফ্যামিলির ফটো।

গোপেনবাবু, তাঁর পাশে মোটাসোটা মধ্যবয়সী একটি ভদ্রমহিলা, পনের-ষোল বছরের  একটি মেয়ে, আঠার-উনিশ বছরের একটি যুবক ও দশ থেকে বারো বছরের মধ্যে দুটি ফ্রক পরা মেয়ে।

ব্যবহৃত শয্যার পাশে ছোট একটি ত্ৰিপায়ের উপর একটি টেবিল-ক্লক। এক প্যাকেট সিগারেট-একটা ম্যাচ ও ছাইভর্তি একটি কাচের অ্যাশট্রে ও একটা টেবিল ল্যাম্প।

ল্যাম্পটা তখনো জ্বলছিল।

বোতাম টিপে টেবিল-ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিল সুদৰ্শন।

ঘরে দক্ষিণ কোণে একটি মাঝারি সাইজের রাইটিং-টেবিল।

কিছু ফাইলপত্ৰ—একটা ঝর্ণ কলম। আর একটা চাবির রিং। রিংয়ের মধ্যে একগোছা চাবি। টেবিলটার পাশেই একটা ষ্টীলের আলমারি।

রাইটিং-টেবিলের ড্রয়ারগুলো ও আলমারিটা সেই রিংয়ের চাবির সাহায্যে একে একে খুলে দেখল। সুদৰ্শন।–

একটা ড্রয়ারের মধ্যে একটা কালো মোটামত ডাইরি পাওয়া গেল। ডাইরির পাতায় সব হিসাবপত্র।

সংসার ও অন্যান্য জমাখরচের হিসাব।

কিছু ঠিকানাও লেখা আছে।

সেই ঠিকানার মধ্যেই গোপেন বসুর শ্বশুরমশাইয়ের মুর্শিদাবাদের ঠিকানা পাওয়া গেল।

একটা চামড়ার পার্সও পাওয়া গেল—

একগোছা নোট পার্সটার মধ্যে। গুনে দেখল। সুদৰ্শন প্রায় নাশ টাকা। একশ ও দশ টাকার নোট।

ড্রয়ার বন্ধ করে আলমারিটা দেখতে লাগল চাবি দিয়ে খুলে সুদৰ্শন।

হ্যাঙারে কিছু সুট—গোটাকতক টাই, রুমাল ও ভাজকরা ধুতি ও শ্লিপিং-সুট।

আলমারির ড্রায়ারে কিছু প্ল্যানের ব্লু-প্রিন্টও পাওয়া গেল।

আলমারিটা দেখা হয়ে গেলে সেটায় চাবি দিয়ে দিল সুদৰ্শন।

পাশের ঘরে গিয়ে গডরেজের আলমারিটা খুলবার চেষ্টা করল—কিন্তু খুলতে পারল না। চাবির রিংয়ের মধ্যে ঐ আলমারির চাবি নেই।

আবার বসবার ঘরে ফিরে এল সুদৰ্শন।

 

বিকাশ তখন একজন ভদ্রলোককে নানা প্রশ্ন করছিলেন।

ভদ্রলোকটির বেশ পেশীবহুল চেহারা। গায়ের রঙ কালো হলেও সুশ্ৰী, চোখ-মুখের গড়ন ও দু’চোখের দৃষ্টিতে বেশ একটা বুদ্ধিদীপ্তি আছে।

পরনে দামী সুট। হাতে জ্বলন্ত একটা সিগারেট ধরা।

অল্প দূরে স্নান বিষণ্ণমুখে দাণ্ড দাঁড়িয়ে।

ইনি কে বিকাশ?

মিঃ স্বামীনাথন।

ইনি–

ঐ যে পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন।

তাই নাকি! তা একটু আগে দেখেছিলাম দরজায় তালা দেওয়া? সুদৰ্শন বললে।

স্বামীনাথনই জবাব দিল, হ্যাঁ, আমি এইমাত্র ফিরছি। কলকাতার বাইরে গিয়েছিলাম, এসে ট্যাক্সি থেকে নামতেই পুলিস দেখি। তাদের ব্যাপারটা কি জিজ্ঞাসা করতেই তো জানতে পারলাম।

কথায় কেমন যেন একটা অবাঙালী টান—এবং কথা বললে ইংরাজীতেই।

কোথায় গিয়েছিলেন। আপনি? সুদৰ্শন প্রশ্ন করে।

কলকাতার বাইরে—বলে স্বামীনাথন।

কোথায়? ·

দেশে গিয়েছিলাম।

দেশে!

হ্যাঁ, ত্ৰিচিনাপল্লীতে।

আপনি–

আমি একজন সাউথ-ইণ্ডিয়ান।

এখানে কি করেন?

এখানে একটা ইলেকট্রিকাল গুডস ফ্যাকট্রিতে চাকরি নিয়ে এসেছি-সুপারভাইজিং অফিসারের পোস্টে।

কি নাম কোম্পানির?

মরিসন অ্যাণ্ড আটারা।

কতদিন এখানে আছেন?

কলকাতায়?

হ্যাঁ।

মাস-দুই হবে।

এই ফ্ল্যাটে কতদিন আছেন?

জাস্ট এ ফিউ ডেজ বলতে পারেন-দিন-দশেকও হবে না।

আপনার ফ্ল্যাটে আর কেউ নেই?

না, এখনো আমার ফ্যামিলি এসে পৌঁছয়নি-সামনের মাসে আসার কথা তাদের।

তাহলে এখানে আপনি নিউ কামার?

কতকটা তাই বলতে পারেন।

গোপেন বসুকে আপনি চিনতেন?

হ্যাঁ, পরিচয় হয়েছিল সামান্য-কয়েকদিনের পরিচয়-হি ওয়াজ এ নাইস ম্যান, আই অ্যাম রাদার শকড টু হিয়ার দ্য নিউজ। হাউ স্যাড!

মণিশঙ্করবাবুকে চিনতেন?

ওঁর স্ত্রী তো আপনাদেরই দেশের-ময়ে!

হ্যাঁ

তাঁকে চিনতেন?

আগে চিনতাম না-পরে চেনা হয়েছিল।

ওঁদের সংবাদ কিছু জানেন?

না তো। কিন্তু কেন? তারা তো নীচের ফ্ল্যাটেই থাকেন।

গতকাল দুপুরে মণিশঙ্করবাবুর স্ত্রী ও মেয়েটি নিহত হয়েছে।

হোয়াট? কি বললেন?

হ্যাঁ, ব্রটালি মোর্ডারড।

বাট হাউ?

সুদৰ্শন হেসে বলে? সেটা অবিশ্যি জানতে পারিনি এখনো।

এনিবডি অ্যারেস্টড।

না।

কেউ অ্যারেস্ট হননি?

না।

খুনীকে তাহলে ধরতে পারলেন না?

পারিনি এখনো, তবে ধরা সে পড়বেই।

উঃ, হাউ ফ্যানটাসটিক! একই বাড়িতে একই দিনে তিন-তিনটে মার্ডার! হাউ হরিবল! তা মিঃ বোসের ফ্যামিলিকে সংবাদটা দিয়েছেন?

দেওয়া হবে বৈকি।

কুড আই ইনফর্ম দেম?

না, পুলিসই দেবে ইনফরমেশন।

এত বড় সাংঘাতিক ব্যাপার-এরপর এখানে থাকতে আমি আর এক ঘণ্টাও সাহস পাচ্ছি না-আই মাস্ট ইনফর্ম দি ল্যাণ্ড লর্ড, আজই আমি বাড়ি ছেড়ে দেব-এক্সকিউজ মি-মাথাটার মধ্যে আমার যেন কেমন ফীল করছি।–কথাগুলো বলে স্বামীনাথন আর দাঁড়াল না, স্থলিত পদবিক্ষেপে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

 

সুদৰ্শন ফিরে তোকাল দাশুর দিকে।

দাশু না তোর নাম?

আজ্ঞে দাশরথী তা।

বাড়ি কোথায়?

তমলুক।

বাবুর কাছে কতদিন কাজ করছিস?

আজ্ঞে হুজুর পনের বছর তো হবেই।

তুই কোন ঘরে রাত্রে ছিলি?

রান্নাঘরের পাশে ছোট ভাঁড়ার ঘরটা, তারই সামনে বারান্দায় ঘুমিয়ে ছিলাম। দোহাই হুজুরের, মা-বাপ—আমি কিছু জানি না, আমার দেবতার মত মুনিব—হায় হায়, এ কি হল ঈশ্বর–

বাড়িতে তোর কে কে আছে?

ছেলে মেয়ে পরিবোর—সবাই আছে হুজুর।

কাল কত রাত্রে ঘুমিয়েছিলি?

বাবু দশটা নাগাদ খেয়ে নিতেই, আমিও খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।

বাবু কাল অফিস থেকে কখন ফিরেছিলেন?

বাবু কাল অফিসেই যাননি।–কেবল বেলা বারোটা সাড়ে বারোটা নাগাদ একবার বের হয়েছিলেন, কিন্ত একটু পরেই ফিরে আসেন—আর বের হননি।

কাল নীচের তলায় যে খুন হয়েছে জানিস?

জা-জানি হুজুর।

জানিস?

হ্যাঁ, আমরা তো তখন উপরে যখন পুলিস আসে—আমি, বাবু—

তুই আর তোর বাবু তখন উপরেই ছিলি?

আজ্ঞে হুজুর। বাবু ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।

কেন? ভয় পেয়েছিলেন কেন?

কে জানে হুজুর—দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে বসে ছিলেন।

হুঁ। তা নীচে কাল দুপুরে কোন চিৎকার বা চেঁচামেচির শব্দ শুনেছিলি?

না বাবু।

সত্যি কথা বল?

মা কালীর দিব্বি বাবু-কিছু শুনিনি।

তবে জানতে পারলি কি করে যে খুন হয়েছে। নীচের ফ্ল্যাটে —পুলিস এসেছে?

আজ্ঞে বাবু বললেন—

বাবু বললেন!

হ্যাঁ, বাবু ঐ সময় আবার জামাকাপড় পরে কোথায় যেন বেরুচ্ছিলেন—সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পুলিস দেখে তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন।

তা খুন হয়েছেন নীচে জানলেন কি করে?

তা জানি না বাবু—

তারপর কি হল?

বাবু উপরে উঠে এসে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে জামা কাপড় খুলে ফেললেন।

দাশু?

আজ্ঞে হুজুর—

তুই নেশা-টেশা করিস কিছু?

আজ্ঞে!

নিশা-টেশা করিস?

আজ্ঞে এই যৎসামান্য–

তা কিসের নেশা করিস?

দামী নেশা কোথায় পাব হুজুর—সামান্য একটু-আধটু বড় কলকে—

হুঁ। কাল বড় কলকে হয়েছিল?

আজ্ঞে।

যা বলছি তার জবাব দে।

আজ্ঞে–

কাল একটু বেশী নেশা তোর হয়েছিল, তাই না?

আজ্ঞে।

কখন বড় কলকে টেনেছিলি? সন্ধ্যায়?

আজ্ঞে না-বাবু তাহলে জেনে ফেলবেন-রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর—

তারপর?

তারপর তো কিছু জানি না হুজুর—

নীচের বাবুর সঙ্গে তোর আলাপ ছিল?

তা ছিল বৈকি হুজুর।

তোর বাবুর?

বাবুর! হ্যাঁ ছিল বৈকি।

নীচের চাকরিটা-মানে ঐ শম্ভুকে চিনিস না?

হ্যাঁ-একটি ঘুঘু, বয়েস ওর অনেক হুজুর। ও মিথ্যা বলে ওর বয়েস।

তাই নাকি?

আজ্ঞে।