০৫. কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত

কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত।

সমীরণ তাকিয়ে আছে। সুদর্শনের মুখের দিকে। আর সুদৰ্শন তাকিয়ে আছে। সমীরণের মুখের দিকে। দুজনে যেন দুজনের সমস্ত দৃষ্টি দিয়ে পরস্পরকে যাচাই করছে।

দেবজ্যোতি কিন্তু দাঁড়িয়ে ছিল না। তার কথাটা শেষ করেই সে তাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে গিয়েছিল।

সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সুদৰ্শন আর ধাপ-পাঁচেক নীচে সুটকেসটা হাতে ঝুলিয়ে প্রস্তর মূর্তির মত দাঁড়িয়ে তখনো সমীরণ দত্ত।

স্তব্ধতা ভঙ্গ করল। সুদর্শনই। মৃদু হেসে বললে, আসুন সমীরণবাবু-আপনার কাছেই আমি এসেছিলাম—আমার নাম সুদৰ্শন মল্লিক। এসে শুনি আপনি ম্যাড্রাস চলে গিয়েছেন–

ম্যাড্রাস?

হ্যাঁ-দেবজ্যোতিবাবু বললেন—

সমীরণ দত্ত উঠতে শুরু করেছে তখন সিঁড়ি দিয়ে আবার। সিঁড়িগুলি অতিক্রম করে উপরে এসে মুখোমুখি হয়ে বলে, দেবজ্যোতি ভুল করেছে—

ভুল?

হ্যাঁ—আমার বোম্বাই যাওয়ার কথা ছিল ম্যাড্রাস নয়—

তা গেলেন না?

সুটকেসটা একপাশে নামিয়ে রেখে পকেট থেকে চাবি বের করে দরজার তলাটা খুলতে খুলতে সমীরণ বললে, না—প্লেনটা মিস করলাম—আসুন—

সমীরণের আহ্বানে সুদৰ্শন ঘরের মধ্যে পা দিল।

ঘরটা অন্ধকার ছিল, সমীরণ সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বেলে দেয়।

ঘরটা আকারে বেশ বড়ই। মেঝেতে যদিও কাপেট পাতা কিন্তু কাপেটটায় যে অনেকদিন বঁটা পড়েনি সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। একদিকে একটা হারমোনিয়াম, তার পাশে বাঁয়া তবলা—একরাশ স্বরলিপির বই—গানের বই-খাতা-পেন্সিল, পানের ডিবে, পিকদানি অ্যাশট্রে—, রেকর্ড—সব ছত্রাকার হয়ে পড়ে আছে।

ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে কয়েকটি সোফা। তার পাশে একটা ভাসে কিছু শুকনো গোলাপ।

দেওয়ালে বড় বড় সব গাইয়েদের ফটো।

মধ্যিখানে রবীন্দ্রনাথের ছবি।–

সব কিছুর মধ্যেই যেন একটা অযত্ন—এলোমেলো বিশৃঙ্খলতা।

সমীরণ দত্ত সুদৰ্শনকে বললে—বসুন।

কথাটা বলে মধ্যবর্তী একটা দরজা ঠেলে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল এবং একটু পরে সুটকেসটা সেই ঘরে রেখে বের হয়ে এল আবার।

আপনি বললেন আপনার নাম সুদৰ্শন মল্লিক-আপনাকে তো আমি চিনতে পারলাম না! আমার কাছে কি কিছু প্রয়োজন ছিল?

হ্যাঁ–বসুন না।

সমীরণ কিন্তু বসল না। সুদর্শনের মনে হচ্ছিল সমীরণ দত্ত যেন তাকে দেখা অবধি একটু বিব্রতই বোধ করছে। কেমন যেন একটু অস্থির—চঞ্চল।

বসুন সমীরণবাবু–

সমীরণ বসল। পাশের সোফায়।

সমীরণবাবু—আপনাকে আমার আসল পরিচয়টা ও আসার উদ্দেশ্যটা খুলে বলছি–

সমীরণ চেয়ে আছে। সুদর্শনের দিকে!

আমি স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে আসছি—

কেন?

আপনাকে আমার কিছু প্রশ্ন করার আছে।

কেন?

হ্যাঁ—আপনি বিজিতা ঘোষালকে চিনতেন?

হঠাৎ যেন নামটা শুনে সুদর্শনের মনে হল সমীরণ কেমন একটু চমকে উঠল।

আপনি তাঁকে চিনতেন, মানে অনেকদিন, তাঁর বিবাহের আগে থেকেই, তাই না?

হ্যাঁ।

আপনি বোধ হয় একটা সংবাদ এখনো পাননি!

কি সংবাদ? সমীরণ যেন অতি কষ্টে কথাটা উচ্চারণ করল।

আজ দুপুরে তাঁকে এবং তঁর কন্যা রুণুকে সি. আই, টির ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।

সে কি? কে বললে?

মৃত বললেই সবটুকু বলা হবে না। দে হ্যােভ বীন ব্রটালি মার্ডারড্‌—নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের–

নৃশংসভাবে হত্যা!

হ্যাঁ—আর সেই ব্যাপারেই কয়েকটা প্রশ্ন করতে এসেছি আপনার কাছে।

আমি—

আপনি তো ওদের দুজনেরই বন্ধু ছিলেন। ওদের দুজনকেই ভাল করে জানবার ও চিনবার সুযোগ হয়েছিল। আপনার। তাই—

অতঃপর সুদর্শণ সমস্ত দুর্ঘটনাটা আনুপুর্বিক বলে গেল।

সমীরণ স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ যেন বসে থাকে।

মণিশঙ্কর কোথায় এখন? কেমন যেন মিনমিনে গলায় প্রশ্ন করলে সমীরণ একটু পরে।

কাছেই আছেন তিনি-কালিকা বোর্ডিংয়ে।

আপনি বলছেন যখন ব্যাপারটা ঘটে তখন সে অফিসে ছিল?

হ্যাঁ-ফোনে সংবাদ পেয়ে এসে দেখতে পায়—

সে কিছুই জানে না?

না। অন্তত তাই তো তিনি বললেন।

কিছু অনুমানও করতে পারেনি?

 

না।

ও!

ওকথা বলছেন কেন সমীরণবাবু? আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?

আমি!

হ্যাঁ।

আমি কাকে সন্দেহ করব? তাছাড়া ইদানীং মাসকয়েক তাদের সঙ্গে আমার একদম দেখাসাক্ষাৎও হয়নি।

কাজে ব্যস্ত থাকার দরুনই বোধ হয়?

সমীরণ হাসল মৃদু। বললে, না—

তবে?

মণি পছন্দ করত না।

কি পছন্দ করত না-আপনাদের মেলামেশা?

হ্যাঁ-বিজিতার উপর সেজন্য সে টরচারও করত।

কি ধরনের টরচার?

ঠিক আমি জানি না।–তবে বিজিতার মুখ দেখে তাই মনে হয়েছিল।

তিনি কিছু বলেননি?

না। বিজিতার মত মেয়ে হয় না। এত ভদ্ৰ—এত নম্র-এত শান্ত-অথচ কেন যে মণি একটা কথা বুঝতে পারত না—

কোন কথা?

বিজিতার সমস্ত মন ভরে ছিল মণিশঙ্করই—

মণিশঙ্করের অত্যন্ত সন্দেহবাতিক মন ছিল তাহলে বলুন!

সমীরণ কোন জবাব দেয় না।

আর একটা কথা সমীরণবাবু—

সমীরণ সুদর্শনের মুখের দিকে তাকাল।

আপনি যে সুটকেসটা এইমাত্র সঙ্গে নিয়ে এলেন সেটা একবার আনবেন?

সুটকেসটা!

হ্যাঁ।

কেন?

আনুন না-দরকার আছে–

কিন্তু

নিয়ে আসুন সুটকেসটা।

সমীরণ উঠে গিয়ে পাশের ঘর থেকে সুটকেসটা নিয়ে এল। সুটকেসটা খুলতে গিয়ে দেখল। সুদৰ্শন—গা-তালা বন্ধ সুটকেসের।

সুটকেসের চাবিটা কোথায়? সমীরণের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে সুদৰ্শন।

চাবি!

হ্যাঁ চাবিটা দিন।

চাবি-মানে চাবিটা তো আমার কাছে নেই!

এই সুটকেসের চাবিটা আপনার কাছে নেই?

সমীরণের মুখটা যেন কেমন শুকিয়ে গিয়েছে–কেমন রক্তহীন ফ্যাকাশে।

এই সুটকেসটা আপনারই তো?

হ্যাঁ, মানে, —সমীরণ কেমন যেন তোতলাতে থাকে। তার কথা ভাল করে মুখ দিয়ে বের হয় না।

আপনার নয়। সুটকেসটা?

আপনি—আপনি বিশ্বাস করুন অফিসার—ওই সুটকেসটা সত্যিই আমার নয়।

আপনার নয়!

না। আগে কোন দিন সুটকেসটা আমি দেখিওনি।

তবে আপনার কাছে কি করে এল এটা?

জানি না।

জানেন না!

না। জানি কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না, কিন্তু সত্যি বলছি-সুটকেসটা জীবনে কখনো আমি আগে দেখিনি। আজ বেলা দশটা নাগাদ আমি বের হয়েছিলাম-আমার রিহার্শেল ছিল—বেলা দুটো নাগাদ ফিরে আসি কারণ বিকেলের প্লেনে আমার বোম্বাই যাবার কথা—

বলুন, থামলেন কেন? তারপর?

কপালে সমীরণের বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। ঠোঁট দুটো কেমন যেন কাঁপাছে। সমীরণ একটা ঢোক গিলে বলতে থাকে আবার, ঘরে ঢুকে দেখি মানে আমার শোবার ঘরে, বিছানার উপরে ঐ সুটকেসটা পড়ে আছে। একটু অবাক হই। কোথা থেকে এল সুটকেসটা? কে রেখে গোল—সুটকেসটা তো আমার নয়? সুটকেসটা খোলবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দেখি তালা লাগানো।

তারপর?

আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন করতে লাগল।

কেন?

সুটকেসের ভিতরে কি আছে তখনো জানি না, তবু কেন যেন আমার বুকের মধ্যে সিরসির করতে লাগল-সেই সময় ঘরের মধ্যে হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল—তাড়াতাড়ি গিয়ে ফোনটা ধরলাম, হ্যালো–

কে সমীরণবাবু?

হ্যাঁ—আপনি কে?

আমি যেই হই না কেন আপনার তাতে প্রয়োজন নেই-একটা কথা বলবার জন্য ফোন করছি। আপনার শোবার ঘরে একটা সুটকেস আছে—যদি বাঁচতে চান তো যত তাড়াতাড়ি পারেন সুটকেসটার একটা ব্যবস্থা করবেন–

ওই কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গেই কানেকশনটা কেটে গেল। আমি যে তখন কি করব বুঝতে পারছি না। অবশেষে ঠিক করলাম সুটকেসটা বাইরে কোথাও গিয়ে ফেলে দিয়ে আসব–

সন্ধ্যার অন্ধকারে বের হলাম সুটকেসটা হাতে নিয়ে, কিন্তু কোন ট্যাক্সিতে চাপতে সাহস হল না— হ্যাঁটতে হ্যাঁটতে এগিয়ে চললাম।

তারপর?

ঘণ্টা তিনেক ধরে এ-রাস্তা সে-রাস্তা—লেক অঞ্চল রেল স্টেশন ঘুরে ঘুরে বেড়ালাম সুটকেশটা হাতে ঝুলিয়ে। চারিদিকে কেবল মানুষ আর মানুষ। কোথায় সুটকেসটা ফেলব— কারো নজরে পড়ে যাব।—এই ভয়ে রাত্ৰিতে আবার বেরুব ঠিক করে ফিরে এলাম। আমি জানি, আপনি নিশ্চয় আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু যা বললাম এক বৰ্ণও তার মিথ্যে নয়। সুটকেসটা আমার নয়, জানিও না করি। জানি না কি ওর ভেতরে আছে, কোথা থেকে এল, কেমন করেই বা এল-বলতে বলতে সমীরণের গলার স্বরটা যেন বুজে এল।

আপনি যখন বাড়ি থেকে দশটা নাগাদ বের হয়েছিলেন, তখন দরজায় তালা দিয়ে যাননি? সুদৰ্শন জিজ্ঞাসা করে।

গিয়েছিলাম।

ফিরে এসে দরজায় তালা দেওয়াই আছে দেখেছিলেন?

হ্যাঁ।

গডরেজের লক?

না। সাধারণ একটা দেশী গা-তালা। তাহলেও তালাটা ভাল জাতের।

তবে? যদি কেউ এসেই থাকে। তবে সে খুলল কি করে?

জানি না।

আপনার কোন চাকর-বাকির দেখছি না-নেই নাকি?

চাকরিটা মাসখানেক হল ছুটি নিয়ে দেশে গিয়েছে। একটা ঠিকা-ঝি সব করে দিয়ে যায়।

রান্নাবান্না?

যাহোক কিছু ফুটিয়ে নিই-একা মানুষ–

বিয়ে-থা করেননি?

না।

মা-বাপ, ভাই-বোন নেই?

সবাই আছে।

কোথায় থাকে তারা?

এই কলকাতাতেই।

তবে?

কেউ আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি।

কেন?

ভালভাবে ইকনমিক্স-এ এম. এ. পাস করেও কোন চাকরি-বাকরি করলাম না-গানবাজনা নিয়েই আছি—বাবার সঙ্গে তাই মতবিরোধ হতে লাগল সৰ্ব্বক্ষণ, বাড়ি ছেড়ে তাই চলে এলাম।

কবে?

তা বছর পাঁচেক হবে।

বছর পাঁচেক এই বাসাতেই আছেন?

হ্যাঁ।

কিছু মনে করবেন না, আপনার ইনকাম কি রকম?

যা পাই—আমার তাতে ভাল ভাবেই চলে যায়। উদ্ধৃত্তিও থাকে না-অভাবও নেই।