০৭. একখানা বই মুখের সম্মুখে

একখানা বই মুখের সম্মুখে ধরিয়া দাদা কাৎ হইয়া বিছানায় শুইয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার মন ঠিক বইয়ের পাতার মধ্যে নিবদ্ধ ছিল না। খােলা জানালা দিয়া অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছিল।

আমি ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিলাম, দাদা, রাতদিন পড়া কি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল? চল একটু বেড়িয়ে আসি।

দাদা উদাসভাবে বলিলেন, কই আর পড়া হচ্ছে—একজামিন তো এসে পড়ল।

আমি বলিলাম, তা হোক, চল একটু ঘুরে আসি!

দাদা কপালের উপর দিয়া দক্ষিণ করতল দুবার চালনা করিয়া বলিলেন, না ভাই, আজ থাক। শরীরটা তেমন ভাল নেই।

সেইজন্যেই তো আরও যাওয়া উচিত। এই কদিনে শরীরটাকে কি করে ফেলেছি, বল দেখি।

দাদা উঠিয়া দাঁড়াইলেন; নিজের বাহুর ম্লান পেশীর দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, ভয়ের কোন কারণ নেই। এখনো বেশ শক্ত আছি।

একটা কামিজ গলাইয়া লইয়া দাদা আমার সঙ্গে বাহির হইলেন।

কিন্তু বেশী দূর যাইতে হইল না—অনতিপূর্বেই আমাদের গতিরোধ হইল।

স্বভাবের নিয়মে বিষম বিপর্যয় ঘটাইয়া, কি জানি কেন, আজ ক্ষিতীনবাবু স্বীয় কক্ষ বর্জনপূর্বক বাগানে বেড়াইতেছিলেন। দাদাকে তিনি দেখিয়াই চিনিতে পারিলেন এবং আমাকে আদৌ দেখিতে পাইলেন না। দাদাকে বলিলেন, কি হে, কোথায় যাচ্ছ?

দাদা সবিস্ময়ে বলিলেন, আজ্ঞে একটু বেড়াতে যাচ্ছি।

ক্ষিতীনবাবু আমার যৎপরোনাস্তি বিস্ময় উৎপাদন করিয়া বলিলেন, এ কদিন তোমায় দেখিনি যে? অসুখ করেছিল নাকি?

দাদা বলিলেন, আজ্ঞে না, বেশ আছি।

তখন ক্ষিতীনবাবু বলিলেন, তুমি সেদিন শঙ্করভাষ্য সম্বন্ধে যে বইখানা আমায় দিয়ে গিয়েছিলে আমি তার কয়েক জায়গায় দাগ দিয়ে রেখেছি। সেই দাগ দেওয়া জায়গাগুলো পড়লেই আমি যা বলেছিলুম সব বুঝতে পারবে।

দাদা যে আজ্ঞে বলিয়া যাইবার উপক্ৰম করিতেছেন এমন সময় ক্ষিতীনবাবু বলিলেন, বইখানা ইংরাজীতে হলেও চমৎকার লেখা। তোমার ওখানা আগাগোড়াই পড়া উচিত। লেখকের ইনট্রোডাকশন পড়েছ? পড়নি? এসো দেখিয়ে দিইগে। কি সুন্দর। আমি বোধহয় নিজের মত অত চমৎকার করে বলতে পারতুম না। বলিতে বলিতে তিনি বাড়ির দিকে ফিরিয়া চলিলেন।

দাদা আমার মুখের দিকে চাহিলেন, আমি দাদার মুখের চাহিলাম। ক্ষীণ হাসি দাদার ওষ্ঠ্যপ্রান্তে দেখা দিল। আমি ধীরে ধীরে তাঁহাকে ক্ষিতীনবাবুর দিকে ঠেলিয়া দিলাম।

দাদা নীরবে তাঁহার পশ্চাদ্বতী হইলেন। আমি ক্লাবে গেলাম।

 

সেদিন রাত্রি আটটা বাজিয়া গেলে দাদা চলিয়া আসিবার পর ক্ষিতীনবাবু অনেকক্ষণ বিছানায় চিৎ হইয়া শুইয়া রহিলেন। কিয়ৎকাল পরে আস্তে আস্তে দ্বার ঠেলিয়া সরস্বতী সেই ঘরে ঢুকিল। ক্ষিতীনবাবু একবার চাহিয়া দেখিলেন মাত্র। সরস্বতী দরজা ভাল করিয়া বন্ধ করিয়া দিয়া প্রথমে ঘরের চারিদিকে একবার ঘুরিয়া বেড়াইল। তারপর একটা কোণে গিয়া টিপায়ের উপর কতকগুলা খেলনা নাড়িতে নাড়িতে বেশ স্পষ্ট স্বরে বলিল, বাবা, তারা নাকি কাল আসবে?

ক্ষিতীনবাবু অন্যমনস্কভাবে বলিলেন, কারা?

সরস্বতী জবাব দিল না; কিছুক্ষণ পরে বলিল, এ তো কিছুতেই হতে পারে না বাবা।

এতক্ষণে পিতার কিঞ্চিৎ জ্ঞান হইল। তিনি ঈষৎ সজাগ হইয়া বলিলেন, কি হতে পারে না মা?

সরস্বতী লাল হইয়া উঠিয়া কোন রকমে বলিল, এ বিয়ে হতে পারে না বাবা।

ক্ষিতীনবাবু সবিস্ময়ে উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, কেন?

সরস্বতী বুকে ঘাড় গুঁজিয়া বলিল, না। বাবা, এ কিছুতেই হতে পারে না।

ক্ষিতীনবাবু ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, এই দেখা পাগলামী। আচ্ছা তোর এসব কথায় থাকবার দরকার কি? তুই কি নিজে গিয়ে বিয়ে কচ্ছিস, না-

সরস্বতী রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, বাবা, আমার এসব কথায় থাকবার দরকার হয়েছে। এই দেখ। বলিয়া পিতার সম্মুখে একখানা লেফাফা ফেলিয়া দিল।

ক্ষিতীনবাবু খাম খুলিয়া যাহা বাহির করিলেন তাহা একটি ফটোগ্রাফ। সরস্বতীর ভবিষ্যৎ স্বামীর আবক্ষ প্রতিকৃতি, নিম্নে দুই-ছাত্র কবিতা—যতদিন দেহে প্রাণ রহিবে আমি তোমারি, তুমি আমারি। ক্ষিতীনবাবু স্তব্ধ হইয়া দেখিতে লাগিলেন। সরস্বতী বলিল, নিজে পাঠিয়ে দিয়েছে।

কিছুক্ষণ দেখিয়া ক্ষিতীনবাবু হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিলেন, তা বেশ তো। এতে আর দোষ কি মা?

সরস্বতী জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, দোষ কি বাবা? একটা দুশ্চরিত্র লোকের সঙ্গে তুমি আমার—; এরকম করে যে নিজের ছবি পাঠাতে পারে তার সঙ্গে-বাবা, আমি বিয়ে করব না-ককখনো করব না। তুমি আমায় মেরে ফেল। বলিয়া সরস্বতী ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।

সরস্বতী এতক্ষণ একটু একটু করিয়া খাটের দিকে অগ্রসর হইতেছিল। ক্ষিতীনবাবু তাহাকে টানিয়া নিজের কোলের কাছে বসাইলেন। পিঠে হাত দিয়া স্নেহ-কোমল স্বরে বলিলেন, কি হয়েছে মা বলতো। তাঁহার মত অন্ধ ব্যক্তিও যেন বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে এই অকিঞ্চিৎকর ফটোটাই শুধু তাঁহার কন্যার সুতীব্র মনস্তাপের হেতু নয়।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। সরস্বতীর বুকের মধ্যে কেন যে আজ হু হু করিয়া রোদনের অদম্য বেগ ছুটিয়া আসে সে নিজেই বুঝিতে পারে না। ক্ষিতীনবাবুও কন্যার এই নিদারুণ ব্যথার কারণ ঠিক জানিতে না পারিয়া আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, সত্যি সত্যি কি হয়েছে বলবি না মা?

মার কিন্তু মুখে কথা নাই। পিতা যতই কোমল প্রশ্ন করেন, মেয়ের বুকের মধ্যে কান্না ততই, গুমরিয়া উঠে। অনেক চেষ্টা করিয়াও ক্ষিতীনবাবু কিছুই জানিতে পারিলেন না। সরস্বতী তেমনি ঘাড় গুঁজিয়া রহিল। তখন তিনি বলিলেন, আমি কালই তাদের বলে পাঠাব যে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেব না। তাহলে হবে তো?

সরস্বতী আস্তে আস্তে পিতার উরুর উপর মাথা রাখিয়া বাঁ হাত দিয়া নিজের চোখদুটা মুছিয়া ফেলিল।

ক্ষিতীনবাবু কতকটা নিজের মনেই বলিতে লাগিলেন, ছোঁকরা দেখতে শুনতে তো মন্দ নয়, পড়াশুনোতেও ভাল। কিন্তু তবু কি জানি কেন আমার মনের ভেতরটা খুঁত খুঁত করছিল। —এই ধরনা কেন কেদারনাথ-ঐ যে ছেলেটি সন্তোষের কিরকম ভাই হয়—লেখাপড়ায় তেমন ভাল না। হলেও দিব্যি ছেলেটি-ঠিক আমার মনের মত— যেমন সরল, তেমনি বিনয়ী। এতটুকু বাবুয়ানী আর বিদ্যার প্রতি যথার্থ অনুরাগী। ওর মত একটি ছেলে পাওয়া যেত-তাহলে না হয় কি বলিস—

হঠাৎ মেয়ের দিকে দৃষ্টি পড়ায় তিনি নিরতিশয় বিস্ময়ের সহিত দেখিলেন যে তাহার মুখখানা আগাগোড়া সিঁদুরের মত রাঙ্গ হইয়া উঠিয়াছে। সে উঠিয়া আমি জানিনে বাবা বলিয়া একরকম দৌড়িয়াই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

ক্ষিতীনবাবু কিছুক্ষণ অবাক হইয়া তাকাইয়া রহিলেন। তারপর গড়গড়ার নলটা আস্তে আস্তে তুলিয়া লইয়া শুধু বলিলেন–হুঁঃ-।

রাত্ৰে শুইতে গিয়া গৃহিণী স্বামীকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, তুমিই মেয়েদের আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছি। এমন কথাও শুনিনি কখনো। মা বাপে বিয়ে দেবে মেয়ে বলে বসল-ও বর বিয়ে করব না। তোর ওসব কথায় কাজ কি বাপু!

ক্ষিতিনবাবু চক্ষু মুদিত করিয়া শুইয়া রহিলেন। উত্তর না পাইয়া স্ত্রী আর একটু তীব্র কণ্ঠে বললেন, আচ্ছা জিজ্ঞাসা করি, অমন বর তোমার মেয়ের পছন্দ হল না কেন? জামাই মন্দটা কি? বিদ্বান, বুদ্ধিমান, সুপুরুষ-অমন জামাই হাজারে একটা পাওয়া যায় না।

ক্ষিতীনবাবু আস্তে পাশ ফিরিয়ে বলিলেন, বেদান্ত না পড়লে আজকালকার ছেলেদের চরিত্র গঠন হয় না।

গৃহিণী রাগিয়া উঠিয়া বলিলেন, পোড়াকপাল বেদান্তের! আমার মাথা খাও যদি ওই বইগুলো রাতদিন পড়।

ক্ষিতীনবাবু চক্ষু মুদ্রিত করিয়াই বলিলেন, কি করতে বল?

গৃহিণী বলিলেন, এ সম্বন্ধ ছাড়তে পাবে না।

ক্ষিতীনবাবু। ছাড়তেই হবে-উপায় নেই।

গৃহিণী। কেন?

ক্ষিতীনবাবু। ছেলেটির নৈতিক চরিত্র সম্বন্ধে আমার সন্দেহ আছে।

গৃহিণী মুখ ফিরাইয়া লইয়া বলিলেন, বেদান্ত পড়েনি বলে বুঝি?

ক্ষিতীনবাবু জবাব দিলেন না। ভাবী জামাতার চরিত্র সম্বন্ধে একটা সন্দেহ আছে জানিয়া গৃহিণীরও মন হঠাৎ বিমুখ হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন, তা বেশ, যা হয় কর। কিন্তু তোমার মেয়েটি আর কচি খুকী নেই ভুলে যেও না যেন। আমি বলে দিচ্ছি, আর যা হয় কর কিন্তু ওইদিনে মেয়ের বিয়ে দেওয়া চাই। যেখান থেকে পার জামাই যোগাড় কর। এই বলিয়া কতক ক্ষুন্ন কতক বিষণ্ণ এবং কতক চিন্তান্বিত হইয়া গৃহিণী শয়ন করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে, তন্দ্রায় তাঁহার চক্ষু দুটি মুদিয়া আসিতেছে, এমন সময় ক্ষিতীনবাবু ডাকিলেন, ওগো।

গৃহিণী চোখ মেলিয়া বলিলেন, কি?

ক্ষিতীনবাবু। ও-বাড়ির সন্তোষের এক কিরকম ভাই আছে জান—কেদার বলে? সে জামাই হলে পছন্দ হয়?

গৃহিণীর ঘুম ভালরূপেই ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। তিনি বলিলেন, কে, সন্তোষের দাদা?

হ্যাঁ।

সে তো সন্তোষের চেয়ে নীচে পড়ে।

তাহলেই বা-ছেলেটি ভারি ভাল। আর তোমরা যা চাও, ঘরও চেনা টাকাকড়িও আছে।

গৃহিণী ভাবিতে ভাবিতে বলিলেন, সন্তোষের ভাই বলেই দিতে ইচ্ছে করে। বীণাটার যদি তেমন কপাল হয়, দুজনেই এক জায়গায় পড়বে।

ক্ষিতীনবাবু বলিলেন, তোমার মত আছে তো?

গৃহিণী হাসিয়া বলিলেন, আচ্ছা, হঠাৎ ঐ ছেলেটিকে তোমার পছন্দ হল কেন বলতো? বেদান্ত পড়ে বলে, না? কি ভাগ্যি, আমায় যখন বিয়ে করেছিলে তখন তোমার বেদান্ত ছিল না, নইলে আমাকে তো বিয়েই করতে না।

 

যে ঘরে ক্ষিতীনবাবু শয়ন করিতেন তাহার। দুখানা ঘর পরে বীণা, ও সরস্বতী শুইত। আজ অনেক রাত পর্যন্ত তাহারা জাগিয়াছিল। খোলা জানোলা দিয়া চাঁদের আলো অন্ধকার ঘরের মধ্যে আসিয়া পড়িয়ছিল। ঠিক সেই আলোর কিনারায় দুই বোনে দুটি চেয়ারে বসিয়া ছিল।

ঠং ঠং করিয়া ঘড়ি বাজিল। বীণার ঘুম আসিতেছিল, সে সুপ্তি অলস কষ্ঠে বলিল, দিদি, এগারটা বাজল।

কথাটা দিদির কানে পৌঁছিল না। বীণা আবার বলিল, দিদি, শোবে না?

তখন দিদি বোনের তন্দ্ৰাজড়িত মুখের পানে চাহিল। তাহার চোখে সেই শান্ত জ্যোৎস্নালোকের মত এমন একটি মৃদু জ্যোতি ছিল যে তাহা নিদ্ৰালু বীণার চোখেও পড়িল।

সরস্বতী উঠিয়া বলিল, চল শুইগে। বলিয়া বীণাকে টানিয়া চাঁদের আলোর নীচে আনিয়া দুই বাহুতে তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া একটি চুম্বন করিল। বীণা দিদির বুকে মাথা রাখিয়া চুপটি করিয়া রহিল—কিছু জিজ্ঞাসাও করিল না।

সরস্বতী বীণার চিবুক তুলিয়া ধরিয়া আর একবার বলিল, ঘুম পাচ্ছে, না বীণা? চল শুইগে।  বলিয়া তাহাকে বিছানার দিকে লইয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *