০৬. উত্তর-মীমাংসা

বিকালবেলা দেখিলাম দাদা একখানা বই হাতে করিয়া বাহির হইতেছেন। জিজ্ঞাসা করিলাম, কি বই ওখানা?

দাদা পুস্তকের মলাট দেখাইলেন—উত্তর-মীমাংসা, ইংরাজীতে। অতিশয় বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, কি হবে উত্তর-মীমাংসা?

দরকার আছে বলিয়া তিনি বাহির হইয়া গেলেন।

সন্ধ্যার সময় ক্লাবে যাইতেছি, ক্ষিতীনবাবুর বৈঠকখানায় গৃহস্বামী ও দাদার স্পষ্ট কণ্ঠস্বর শুনিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলাম। কৌতূহল দমন করিতে না পারিয়া বৈঠকখানায় ঢুকিয়া পড়িলাম। দেখি, ঘোর তর্ক বাধিয়া গিয়াছে। তর্কের উত্তেজনায় দাদা একটা চেয়ারে সোজা হইয়া বসিয়া আছেন। সম্মুখে কিয়দূরে ক্ষিতীনবাবু উপবিষ্ট। তাঁহার মুখ হইতে অনর্গল সংস্কৃত শ্লোক এবং তাহার তর্জমা বাহির হইতেছে। বাতির অভাবে ঘর প্রায় অন্ধকার। কিন্তু সেদিকে কাহারও ভুক্ষেপ নাই। অন্ধকারে বসিয়া দুজনে মহোৎসাহে তর্ক করিতেছেন।

আমি ঘরে প্রবেশ করিলাম। কিন্তু কেহই ফিরিয়া দেখিলেন না। তাহার কারণ আমি যে প্রবেশ করিয়াছি তাহা দুজনের একজনও জানিতে পারেন নাই। আমি তো দূরের কথা—সে সময় ইন্দ্রের সন্দেহ। ইহারা আমার কোন সংবর্ধনাই করিলেন না তখন সতাং মানে স্নানে মরণমথবা দূরগমনং এই মহাবোক্য স্মরণ করিয়া সেখানে আর ক্ষণমাত্র বিলম্ব করিলাম না-ক্লাব অভিমুখে ধাবিত হইলাম।

ক্লাবে পৌঁছিবামাত্র যে গুরুতর সংবাদটা অমূল্য পরম উৎসাহের সহিত আমাকে শুনাইয়া দিল তাহাতে সদ্যালক্ষিত দৃশ্যটা মনে করিয়া মন করুণায় ভরিয়া গেল। যেটা মুহূর্তপূর্বে খুব আশাপ্ৰদ বোধ হইয়াছিল এখন সেইটাই নিরাশার কালিমালিপ্ত হইয়া গেল।

অমূল্য যাহা বলিল তাহা এই—সরস্বতীর বিবাহ স্থির হইয়া গিয়াছে, ভাবী বর মেয়ে স্বচক্ষে দেখিবার জন্য আজই প্রাতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন।

সরস্বতীর বিবাহের সমস্ত ঠিক হইয়া গেল অথচ আমরা কিছু জানিতে পারিলাম না, ইহাতে আমি বিস্মিত হইয়া গেলাম। ভাবিলাম অমূল্য যতটা বলিতেছে ততটা কিছু নয়-বোধহয় সংকল্পিত বর কার্যগতিকে এদিকে আসিয়া পড়িয়া থাকিবে। তাই এই সুযোগে মেয়ে দেখিয়া যাইতেছে। সে যাহাই হোক, জিজ্ঞাসা করিলাম, লোকটি কে কিছু জান?

অমূল্য বলিল, অনিলের মা নাকি তাকে আবিষ্কার করেছেন। শুনছি তিনি ক্ষিতীনবাবুর শালার শালা।

এই অজ্ঞাতকুলশীল লোকটার উপর মন বিতৃষ্ণায় ভরিয়া উঠিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, কি করে সে?

অমূল্য বলিল, এবার ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বেরিয়েছে। নাম শরৎচন্দ্র ঘোষাল। এখানে তার, এক দূরসম্পর্কের মাসী আছেন।

প্রশ্ন করিলাম, কেমন দেখতে শুনতে? একটা খুঁত ধরিতে পারিলে বোধহয় আমার মনটা খুশি হইয়া উঠিত। কিন্তু অমূল্য বলিল, ভারি সুন্দর হে। আমি তাকে নিজে দেখেছি–বুদ্ধিমানের মত চেহারা। এখন দেখছ-তোমার দাদার কোন দিকেই আশা নেই। None but the brave deserve the fair.

বিকল অন্তঃকরণ লইয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম।

পরদিন সকালবেলা দাদাকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিলাম, আমাদের এখানে একজন নতুন লোক এসেছে জান?

কে?

শরৎ ঘোষাল বলে একজন-কালই এসেছে।

কালই এক অদ্ভুত উপায়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে।

আমার বিস্ময়ের অবধি রহিল না; বলিলাম, কি রকম?

কাল প্রায় রাত্রি সাড়ে আটটার সময় আমি এই ক্ষিতীনবাবুর বাড়ি থেকে ফিরছিলুম। রাস্তা ঘোর অন্ধকার—হঠাৎ একজনের সঙ্গে মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে গেল। এরকম বেপরোয়া ভাবে যে নিজের মঘাটা অপরের মাথার সঙ্গে লড়িয়ে দেয়। তার ওপর রাগ হবারই কথা। বললুম-কে হে তুমি, কোন হ্যায়? লোকটি কাতর স্বরে বললে—মশায়, দোষ নেবেন না—আমি এখানে নতুন লোক। আর মাথাটাও আমার তেমন শক্ত নয়। আমি দেখলুম। গলা অপরিচিত। জিজ্ঞাসা করলুম-কে আপনি? তারপরই পরিচয় হয়ে গেল।

অন্ধকারে পরিচয়?

হ্যাঁ। কিন্তু লোকটি বেশ ভাল বলেই বোধ হল। তবে যেন একটু বেশী স্মার্ট।

কি করতে এসেছে জান?

ঠিক বলতে পারিনে। হাওয়া বদলাতে বোধ হয়।

হায় অজ্ঞ। দাদার জন্য প্ৰাণটা আনচান করিয়া উঠিল। কিন্তু তবু কি মুখ ফুটিয়া বলা যায়।

 

দিন দুই-তিন পরে বৌদিদি বলিলেন যে সরস্বতীকে দেখিতে আসিয়াছে—আজই কনে দেখা হইবে। বলিলাম, তবে সব শেষ।

বৌদিদি ম্লানমুখে উত্তর করিলেন, এখনো বলতে পারি না। তবে যতদূর বুঝতে পাচ্ছি—বোধ হয় শেষ।

দাদা কিছু জানেন?

না। এখনো জানেন না। জানাব?

খবরদার না। কাজটা চুপি চুপি শেষ হয়ে যাক।–তারপর তো জানতেই পারবেন।

বৌদিদি আর কিছু বলিলেন না।

বিকালবেলা দাদাকে একটু বিশেষ সাজসজ্জা করিয়া বাহির হইতে দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, কোথায় যাচ্ছ?

দাদা বলিলেন, শরৎ ডেকেছে-কোথায় নাকি যেতে হবে। এই কয়দিনে শরতের সহিত দাদার আলাপ বেশ গাঢ় হইয়া উঠিয়াছে।

আমি একটা গভীর নিশ্বাস ফেলিলাম। নিয়তি এত কঠিন পরিহাসও করিতে পারে!

সন্ধ্যার সময় ক্ষিতীনবাবুর বাড়ি উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম তাঁহার দিবানিদ্রার ঘর হইতে খাট ইত্যাদি অদৃশ্য হইয়াছে। তৎপরিবর্তে মেঝের উপর শুভ্র ফরাস পাতা। তাহার উপর কয়েকটা তাকিয়া ছড়ানো রহিয়াছে। পাড়ার দু চারিজন বয়স্ক ভদ্রলোক বসিয়া গল্প করিতেছেন; বরের পার্টি তখনো আসিয়া পৌঁছে নাই। আমাকে আজ ক্ষিতীনবাবু দেখিবামাত্র চিনিতে পারিলেন, বলিলেন, এই যে সন্তোষ, বাড়ির ভেতর যাও। দেখগে যোগাড়-যন্ত্র হল কিনা।

আমি বড় দ্বিধায় পড়িলাম। সরস্বতীর সম্মুখে উপস্থিত হইবার ইচ্ছা আদৌ ছিল না। শরতের সহিত যদি তাহার বিবাহ হয়, তাহা হইলে বিবাহের পূর্বে তাহার মনে কতকগুলা অপ্রীতিকর স্মৃতি জাগাইয়া লাভ কি?

তবু যাইতে হইল। সসঙ্কোচে বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া দেখি দালানে বসিয়া অনিলের মা থালে থালে সন্দেশ সাজাইতেছেন এবং বীণা সন্দেশগুলোতে গোলাপের পাপড়ি বসাইতেছে। তাহার কোলে এক রাশি পাপড়ি।

আমি আবির্ভাব হইয়াই আবার তিরোভাবের চেষ্টা করিতেছি এমন সময় বীণা হঠাৎ মুখ তুলিয়া আমাকে দেখিয়া ফেলিল। সঙ্গে সঙ্গে গোলাপের পাপড়িগুলি মাটিতে ছড়াইয়া ফেলিয়া সে দুড় দুড় করিয়া ছুটিয়া পলায়ন করিল।

মাতা চাহিয়া আমাকে দেখিয়া একটু হাসিলেন, বলিলেন, সন্তোষ, এসেছ বাবা। আজ তোমাদেরই দেখবার শোনবার দিন। তোমরা না করলে কে করবে? ওই ঘরে একবার যাও।

ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম বৌদিদি রহিয়াছেন। সরস্বতীকে সাজানো হইতেছে। সে নির্লিপ্তভাবে বসিয়া আছে, যেন তাহাকে সাজানো হইতেছে না। শুধু মাঝে মাঝে কিরকম ভাবে বৌদিদির মুখের পানে তাকাইতেছিল। বৌদিদি তাহা লক্ষ্য করিয়াছিলেন। কিন্তু একটি কথাও না বলিয়া তিনি তাহাকে পরিপাটি করিয়া সাজাইতে লাগিলেন।

আমাকে দেখিয়া সরস্বতীর পাংশু মুখখানা হঠাৎ একবার লাল হইয়া উঠিয়াই আবার সাদা হইয়া গেল। সে জড়ের মত বসিয়া রহিল, নড়িল না। বৌদিদিও আমাকে দেখিয়া কোন কথা বলিলেন না।

বাহির হইতে সংবাদ আসিল বরের পার্টি আসিয়া পৌঁছিয়াছে। শুনিবা মাত্র সরস্বতী উঠিয়া দাঁড়াইল; বৌদিদির মুখের দিকে একবার চাহিল। বৌদিদি মুখ ফিরাইয়া লইলেন। সরস্বতী আমার দিকে চাহিল, তারপর দৃঢ়স্বরে বলিল, আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে!

আমি তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া যাইতে যাইতে বলিলাম, আমি ওদের অভ্যর্থনা করিগে। অনিলকে ডেকে দিচ্ছি।

বাহিরে গিয়া দেখিলাম। বরপক্ষীয়গণ দ্বারের নিকটে সমাগত হইয়াছেন। তাঁহারা সংখ্যায় গুটি চার-পাঁচ। স্বয়ং বর, বরের কাকা এবং দুই-তিনজন বন্ধু। বরের কাকা আজই আসিয়া পৌঁছিয়াছেন; তিনি এ পর্যন্ত আসিতে পারেন নাই বলিয়া কনে দেখা হয় নাই। বরের দুটি বন্ধুও কাকার সঙ্গে আসিয়াছেন।

আপাদমস্তক শুভ্ৰবেশ পরিহিত বর এবং তৎপক্ষীয়দের অভ্যর্থনা করিয়া ভিতরে আনিলাম। বরের চোখে পাঁশ-নে চশমা। বরের পশ্চাতে যে বন্ধুটি ছিলেন তাঁহাকে দেখিয়া মাথা ঘুরিয়া গেল। আমি ভাবিয়াছিলাম, আসল উদ্দেশ্য জানিতে পারিলে নিশ্চয় দাদা শরতের সঙ্গে আসিবেন না। কিন্তু দাদা পাংশুমুখে একটুখানি মলিন হাসি লইয়া ঠিক আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন।

বরপক্ষীয়েরা আসন গ্রহণ করিলেন। দাদা চুপি চুপি সকলের দৃষ্টি এড়াইয়া একটি কোণে গিয়া বসিলেন।

বরের কাকা প্ৰবীণ ব্যক্তি-তিনি ক্ষিতীনবাবুর সঙ্গে আলাপ করিতে লাগিলেন। বর ঘন ঘন স্বলিত চশমা নাসিকার উপর পুনঃস্থাপিত করিতে লাগিল। চারিদিক হইতে বরের চেহারার যে প্রশংসাগুঞ্জন উঠিতেছিল, সম্পূর্ণ অবিচলিত হইলেও বরটি সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ বলিয়া বোধ হইল না।

সাদর সম্ভাষণ শেষ হইলে কন্যা আনিবার প্রস্তাব হইল। ক্ষিতীনবাবু স্বয়ং বাড়ির মধ্যে গেলেন এবং অল্পকাল পরে সুসজ্জিতা সরস্বতীকে বাহু ধরিয়া লইয়া আসিলেন। সরস্বতী আসিয়া একটি টিপাইয়ের সম্মুখে দাঁড়াইল। আমি তাহার মুখের দিকে আড়চোখে একবার তাকাইলাম—কিছু বুঝা যায় না। শুধু তাহার ঠোঁটদুটি যেন ঈষৎ চাপা। একবার কোণের দিকে না তাকাইয়া থাকিতে পরিলাম না। দাদার মুখ শুষ্ক-চোখ নামাইয়া বসিয়া আছেন। আমি চক্ষু ফিরাইয়া লইয়া বরের দিকে চাহিলাম। সে চশমার ভিতর দিয়া অনেকটা কুমীরের মত স্থির নেত্রে সরস্বতীর পানে তাকাইয়া আছে।

দেখা শেষ হইলে সকলে কন্যাকে ভিতরে লইয়া যাইতে বলিলেন। সরস্বতী তাহার আনত নেত্র একবার তুলিতেই হঠাৎ যেন কিসে লাগিয়া সজোরে প্রতিহত হইয়া গেল। তখনি সে চক্ষু মুদ্রিত করিয়া ফেলিল। অনিল তাহাকে ভিতরে লইয়া গেল।

বরকর্তা সভাস্থলেই স্বীকার করিলেন যে কন্যা রূপসী। এবং তাঁহার যে খুবই পছন্দ হইয়াছে তাহাও বারম্বার প্রচার করিতে লাগিলেন। তারপর হাস্যমুখে বলিলেন, মা-লক্ষ্মীকে তো দেখা হল। এখন বাবাজীকে একটু পরীক্ষা করে নিন।

ক্ষিতীনবাবু সাদরে বরের পৃষ্ঠে হাত দিয়া বলিলেন, বাবাজীর আর পরীক্ষা কি? সব পরীক্ষাই তো উনি সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন।–আচ্ছা বাবাজী, তুমি উত্তর-মীমাংসা পড়েছ?

বর চশমার কাচ রেশমী রুমালে ঘষিতে ঘষিতে বলিল, উত্তর-মীমাংসা? আজ্ঞে না, উত্তর-মীমাংসা আমার পড়া নেই। তবে পশ্চিম–

বরের কাকা তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া বলিলেন, কি জানেন, ওরা তো আর্টস স্টুডেন্ট নয়, চিরকাল সায়েন্সই পড়ে এসেছে; তাই—

ক্ষিতীনবাবু ভাবী জামাতার পৃষ্ঠ হইতে হাতটি ধীরে ধীরে নামাইয়া লইলেন।

তারপরই বরপক্ষীয়গণ প্ৰভুত জলখাবারের ধ্বংস সাধন করিয়া হৃষ্টমনে বাড়ি ফিরিলেন। বরের কাকা প্ৰস্তাব করিয়াছিলেন যে আশীর্বাদ তখনি সম্পন্ন হউক। কিন্তু সকলে বলিলেন যে ব্যস্ত হইবার কোন প্রয়োজন নাই। বিশেষত বাবাজীর কন্যা পছন্দ হইল। কিনা এ বিষয়ে সম্যক না জানিয়া কার্য করা উচিত হয় না। অতএব স্থির হইল যে বাবাজীর সম্মতি লইয়া আশীর্বাদ শীঘ্রই সম্পাদিত হইবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *