০৫. সরস্বতীদের বাড়ি

কিছুদিন পরে একদিন দুপুরবেলা বৌদিদি সরস্বতীদের বাড়ি গিয়া সম্মুখে বীণাকে পাইয়া বলিলেন, কোথায় রে বীণা, তোর দিদি?

বৌদিদিকে দেখিয়া বীণা ছুটিয়া আসিয়া বলিল, চল না ভাই বৌদি, আমার পুতুলের বাক্সটা গুছিয়ে দেবে।

বৌদিদি বলিলেন, সে হবে এখন। দিদি কোথায় তোর!

বীণা ঠোঁট ফুলাইয়া বলিল, নিজের ঘরে আছে। সকল সময়েই যে তাহার অপেক্ষা দিদির কাছেই বৌদিদির প্রয়োজন বেশী। ইহাতে তাহার অভিমান হইল।

ঘরে ঢুকিয়া বৌদিদি দেখিলেন সরস্বতী একলাটি চুপ করিয়া খাটের উপর পা ঝুলাইয়া বসিয়া আছে। একজন ঘরে ঢুকিল দেখিয়া সে অন্যমনস্কভাবে মুখ তুলিয়া একটু ভুকুটি করিল। তারপর চমক ভাঙ্গিয়া যাইতেই অপ্রতিভ ও লজ্জিতভাবে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, এই যে বৌদি-? বলিয়া আবার বসিয়া পড়িল।

বৌদিদি তাহার পাশে গিয়া বসিয়া কানে কানে বলিলেন, কার রূপ ধ্যান হচ্ছিল?

সরস্বতী চমকিয়া উঠিল। একটু গম্ভীর হইয়া বলিল, বৌদি, আগে তো তুমি আমাকে এসব কথা বলে ঠাট্টা করতে না?

বৌদিদিও মনে মনে একটু লজ্জিত হইলেন। বীণা অভিমান সত্ত্বেও তাঁহার পিছন পিছন আসিয়াছিল, তাহাকে বলিলেন, তোর পুতুলের বাক্স নিয়ে আয় বীণা।

বীণা পুতুলের বাক্স আনিতে ছুটিল এবং অচিরাৎ তাহা লইয়া উপস্থিত হইল। তখন বৌদিদি তাহাকে বলিলেন, এখন তুই যা৷।

বীণা আপত্তি করিয়া বলিল, বা রে-আমার পুতুল পড়ে রইল। এখানে—

বৌদিদি বলিলেন, বড় জার হুকুম। শিগগির পালা বলছি।

বীণা আর দ্বিরুক্তি করিল না, তৎক্ষণাৎ প্ৰস্থান করিল।

তখন বৌদিদি একটা পুতুলের কাপড় খুলিয়া ফেলিয়া নুতন করিয়া পরাইতে পরাইতে নতনেত্রে বলিলেন, সরস্বতী, আমি সব জানি।

সরস্বতী গলার স্বর সংযত করিতে করিতে বলিল, কিসের?

বৌদিদি দৃঢ়স্বরে বলিলেন, তুই যা ভাবছিলি।

সরস্বতী একটা ঢোক গিলিল, তারপর সহজভাবেই বলিল, কি ভাবছিলুম?

বৌদিদি পুতুলটা বাক্সের মধ্যে ফেলিয়া দিয়া সহাস্যনেত্রে তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, তুই যত বড়ই পণ্ডিত হোস না কেন আমাকে ফাঁকি দিতে পারবি না। সত্যি বলতো তুই তার কথা ভাবছিলি না?

সরস্বতী স্বাভাবিক সুরে বলিল, কার কথা?

বৌদিদি হাসিয়া বলিলেন, ওলো, আমার গুণধর মেজ দেওরটির কথা।

সরস্বতী গম্ভীর হইয়া বলিল, না। বৌদি, তুমি ভুল বুঝেছি। আমি ওকথা ভাবছিলাম না।

বৌদিদি ম্লান হইয়া গেলেন; একটু পরে বলিলেন, তবে কি ভাবছিলে?

সরস্বতী বলিল, যা ভাবছিলুম তা অনেকটা ওই রকমই। ভাবছিলুম কি প্ৰায়শ্চিত্ত হতে পারে।

বৌদিদি প্রজাপতি ঠাকুরের হাতেগড়া শিষ্যা। তিনি হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, এর প্রায়শ্চিত্ত যে ভরি সহজ! আ পোড়াকপাল, তাও বুঝি জানিস না?

সরস্বতী বুঝিতে না পারিয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিল। তখন বৌদিদি তাহার গলাটা জড়াইয়া ধরিয়া কানে কানে যাহা বলিলেন তাহার উত্তরে সরস্বতীর মুখখানা আকৰ্ণ লাল হইয়া উঠিল। সে বলিয়া উঠিল, আঃ বৌদি, কি যে বল তার ঠিক নেই-ছিঃ!

তাহার শেষ কথাটায় সত্যসত্যই একটু তিরস্কারের আভাস ছিল। সে নিজেকে বৌদিদির বাহুমুক্ত করিয়া লইয়া হেঁট মুখে বলিল, বোঁদি, তুমি যা করতে চাও তা হবে না।

বৌদিদি তাহার দৃঢ়তায় আহত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন হবে না শুনি?

সরস্বতী কণ্ঠ স্থির করিয়া বলিল, এতে কেন নেই। আমি বলছি হবে না। বলিতে বলিতে তাহার গলাটা কাঁপিয়া গেল।

বৌদিদি উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, আচ্ছা দেখিস আমার কথা। আমিও বলছি হবে। এই বলে গেলুম সরস্বতী, যদি অক্ষরে অক্ষরে না মিলে যায় তো বলিস তখন।

বাড়ি ফিরিয়া আসিলে বৌদিদির মুখখানা বড় বিষণ্ণ দেখিলাম। বলিলাম, কি হল?

বৌদিদি একটা চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, সরস্বতী বড় শক্ত মেয়ে। সে যেটা অন্যায় মনে করে তাতে কোন প্রশ্রয় দেবে না।

আমি। তা তো জানিই। জানি বলেই তো তোমার মত লোককে পাঠিয়েছিলুম। এখন হল কি? পরাজয় নয় তো!

বৌদিদি। আর ভাই, প্ৰায় তাই বইকি।

আমি। অ্যাঁ! এ কিন্তু বৌদি, সরস্বতীর ভারি অন্যায়। একটা সামান্য অপরাধকে এমন বড় করে তোলা-এ কি তার উচিত হচ্ছে? বৌদি, তোমরা মেয়েমানুষ জাতটা ক্ষমা করতে জান না। তোমাদের দণ্ড আমাদের অপরাধের চেয়ে এত বেশী হয়ে পড়ে যে অসহ্য বোধ হয়।

বৌদিদি ভাবিতে ভাবিতে বলিলেন, অবশ্য এ কিছু মেমসাহেবের ব্যাপার নয় যে মেয়ের মত না হলে বিয়ে হতে পারে না। অনিলের মা মেজ ঠাকুরপোর মত জামাই পেলে খুশিই হবেন। কিন্তু, সরস্বতী যেরকম মেয়ে ও যদি একবার বেঁকে বসে-

আমি বলিলাম, না বৌদি, সে কাজ নেই। গৌরীন্দন তো নয় যে মেয়ের মত বলে কোনও জিনিসের সৃষ্টিই হয়নি। সরস্বতীর মন যদি দাদার প্রতি বিমুখ হয় তাহলে-বুঝলে না?

বৌদিদি ঘাড় নাড়িলেন, শেষে একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, সত্যি বলছি ঠাকুরপো, তোমার নাদার মুখের দিকে চাইতে আমার কষ্ট হয়। খাওয়া-দাওয়া একেবারে কমে গেছে। সর্বদা মনমরা হয়ে বেড়াচ্ছেন।

আমি বলিয়া ফেলিলাম, সত্যি বৌদি, এই কদিন আমি দাদাকে লক্ষ্য করছি। উনি যেন কি রকম হয়ে গেছেন। ওঁর আমন স্বচ্ছ উজ্জ্বল প্ৰাণের ওপর যেন একপুরু কালি পড়ে গেছে। মুখে যাই বলি, যখন মনে হয় যে আমিই ওঁর ঘাড়ে এই অপরাধের ভার চাপিয়েছি, তখন কি বলব বৌদি, আমার চোখ ফেটে জল আসে।

বৌদিদির কোমল হৃদয়টি যে কত শীঘ্ৰ গলিয়া যায় তাহা আমি জানিতাম। আমার কথা শুনিয়া তাঁহার চোখদুটি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল; বুঝিলাম জল আসিয়াছে। কিন্তু তিনি রোদনের আভাসজড়িত মুখখানি হাসিতে ভরিয়া দিয়া বলিলেন, এই নাও ঠাকুরপো, আমি বাজি রাখলুম। আমি সরস্বতীর মন জানি, সে মুখে যাই বলুক না কেন। তাকে রাজী করাতে না পারি তো আমি তোমাদের শালী। এই বলিয়া বৌদিদি দ্রুতপদে প্ৰস্থান করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *