০১. দাদার বিয়েটা না হলেই নয়

না, দাদা, তোমার বিয়েটা না হলেই নয়।

অভ্ৰভেদী গাম্ভীর্য রক্ষা করিবার জন্য দাদা টেবিলের উপর পা তুলিয়া দিয়া চেয়ারের উপর আড় হইয়া বসিলেন। চক্ষু অর্ধমুদ্রিত করিয়া বলিলেন, হুঁঃ, নিজের চরকায় তেল দে।

আমি বলিলাম, তেল আর পাব কোথায়। তেলগুদোমের চাবি যে মশায় হস্তগত করে রাখলেন! তুমি না পার হলে আমার যে কোন ভরসাই নেই।

দাদার এত যত্নে রক্ষিত গাম্ভীর্যের বাঁধ ভাঙ্গিয়া গেল। তাঁহার দশনপংক্তি আর আত্মগোপন করিতে পারিল না। তথাপি আনন্দ যথাসাধ্য সংযত করিয়া দাদা বলিলেন, তোর তো বৌ অনেকদিন থেকেই ঠিক হয়ে আছে। তুই কেন আগেই বে করে নে না? আর সব তাতেই তো আমাকে এগিয়ে আছিস, বিয়ের বেলাই বা পেছিয়ে থাকবি কেন? দাদার শেষ কথাগুলিতে একটু গোপন অভিমানের জ্বালা ছিল।

আমার এই দাদাটির একটু পরিচয় আবশ্যক। ইনি-শ্ৰীকেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়—আমার খুড়তুত ভাই। বয়সে আমার অপেক্ষা প্রায় আড়াই বৎসরের বড়; বি. এ. পড়েন। উপর্যুপরি কয়েকবার ফেল হইয়াছেন বলিয়া আমি তাঁহাকে ছাড়াইয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছি।

এইখানেই বলিয়া রাখা উচিত যে পশ্চিমের কোন শহরে আমাদের বাস। পরিচয় গোপনার্থ শহরের নাম বলিলাম না। বাবা এখানে জেলা কোর্টে ওকালতি করেন। আমি তাঁহার দ্বিতীয় পুত্ৰ—এখনো ছাত্রজীবন শেষ করি নাই-কিন্তু প্ৰায় তোরণদ্বরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছি। বলা বাহুল্য, যে কলেজে পড়ি তাহা স্থানীয়।

কাকাবাবু সুদূর মাইশোরে চাকরি লইয়া পড়িয়া আছেন। দাদা এতকাল কলিকাতায় মেসে থাকিয়া কলেজে পড়াশুনা করিতেছিলেন। কিন্তু তিনবার পরীক্ষা দিবার পরও যখন সংবাদপত্রের পাসের তালিকায় তাঁহার নাম পাওয়া গেল না। তখন কাকাবাবু তাঁহাকে কলিকাতার দূষিত জলহাওয়া হইতে দূরে লইয়া যাইতে মনস্থ করিলেন। কিন্তু মাইশোরে লইয়া যাওয়া তাঁহার ইচ্ছা নয়; তাই বাবার তত্ত্বাবধানে দাদাকে সমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন। সেই অবধি-অর্থাৎ প্রায় দেড় বৎসর কাল দাদা এখানে থাকিয়া পাঠকার্য নির্বাহ করিতেছেন।

আমাদের দুইজনের মধ্যে সম্বন্ধটা ঠিক যে জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ ভ্রাতার মত নয় তাহা বোধহয় পাঠক বুঝিয়াছেন। নির্দোষ হাস্য-কৌতুক আমাদের মধ্যে নিয়তই হইয়া থাকে। উপস্থিত দাদার পড়িবার ঘরে বসিয়া আমাদের উল্লিখিত কথাবার্তা হইতেছিল।

আমি বলিলাম, উঁহু, সেটি হচ্ছে না।

তুমি চলবে খুঁড়িয়ে, আমায় নিয়ে যাবে উড়িয়ে।
ইচ্ছে হবে প্রজাপতির মাথাটা দি গুঁড়িয়ে।

আমার বিয়ে যখন পুরোনো হয়ে যাবে তখন তুমি নতুন বিয়ে করবে-তা হবে না। জানতো, দাম্পত্য জীবনে উড়ে চলার চেয়ে খুঁড়িয়ে চলা ঢের বেশী লাভজনক।

দাদা নিরাশকণ্ঠে বলিলেন, কিন্তু ভাই, বাবা যে বলেছেন। পাস না করতে পারলে—

বাধা দিয়া বলিলাম, কাকাবাবুর ওই এক কথা। পাস করাটাই কি জীবনের একমাত্র পরমার্থ নাকি? মনে কর, তুমি ইহজন্মে। যদি পাস নাই করতে পার—তাহলে তোমার বিয়ে হবে না। যিনি তোমার জন্য আজন্ম শিবপুজো করছেন তাঁর সমস্ত ফুল বিশ্বপত্র ব্যর্থ হয়ে যাবে?

দাদা পূর্ববৎ বিমৰ্ষভাবে বলিলেন, কি করব ভাই, উপায় নেই।

আমি বলিলাম, উপায় নেই? আলবৎ আছে।

দাদা চেয়ার হইতে পা নামাইয়া আমার প্রতি গাঢ় দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, দ্যাখ সন্তোষ, চিরকালই আমি তোর বুদ্ধির পক্ষপাতী। একথা স্বীকার করতেই হবে যে সাধারণের চেয়ে তোর বুদ্ধি ঢের বেশী।

বিরসকণ্ঠে আমি বলিলাম, আমারও তাই মনে হয় বটে।

দাদা আগ্রহাতিশয্যে বলিতে আরম্ভ করিলেন, কিন্তু কি করবি বলতো— বলিতে বলিতে আমার অধরপ্রান্তে একটু হাসি দেখিয়া সহসা হতাশ হইয়া বললেন, কিন্তু তুই সত্যি বলছিল তো? না শুধু ঠাট্টা হচ্ছে?

আমি গম্ভীরকণ্ঠে বলিলাম, আমি কখনো তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করি!

আশ্বস্ত হইয়া দাদা পুনরায় আরম্ভ করিলেন, আচ্ছা কি করা যায় বলতো? জেঠাইমাকে গিয়ে বল। নাঃ, ঠিক হয়েছে! মাকে এই বলে চিঠি লিখি যে আমার এ পৃথিবীতে আর থাকবার ইচ্ছে নেই-আমি সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যাব যদি-

আমি হাসিয়া বলিলাম, দুর। পাগল বলবে যে। আমি উপায় করতে পারি। যদি একটা কথা তুমি আমায় বল।

সাগ্রহে দাদা বলিলেন, কি কথা!

না, সে তুমি বলবে না।

বলব বলব। তুই বলনা কি কথা!

আমি ধীরে ধীরে বলিলাম, আমি উপায় করতে পারি। যদি তুমি বল কাকে বিয়ে করবার জন্যে তোমার এত আগ্ৰহ।

দূর শূয়ার- বলিয়া সলজ্জ আনন্দ অব্যক্ত রাখিবার জন্য দাদা অধর কামড়াইতে কামড়াইতে অধোমুখে রহিলেন। শূয়ার—ছুঁচো-র‍্যাসকেল প্রভৃতি আখ্যাগুলি দাদা খুব প্রীতির তিরস্কারের সময় ভিন্ন ব্যবহার করিতেন না।

ভাবগতিক দেখিয়া বুঝিলাম গতিক ভাল নয়। দাদা একটু সৌখীন প্রকৃতির লোক-হঠাৎ • সৌখীন রকম একটা প্রেমে পড়িয়া যাওয়া তাঁহার পক্ষে কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।

আমি বলিলাম, তাহলে আর কি করা হবে! তুমি এই তুচ্ছ কথাটা বলে আমায় বিশ্বাস করতে পার না, আর আমি তোমার জন্য উপায় করব! আমার কি বয়ে গেছে! কৃত্রিম কোপে আমি মুখ ফিরাইয়া লইলাম।

দাদার উভয়-সঙ্কট। তাঁহার মুখের বিচিত্ৰ ভাববিকাশ দেখিয়া আমার পেটে হাসি যতই উদ্বেলিত হইয়া উঠিতেছিল, আমি বাহিরে ততই গভীর হইতেছিলাম।

মাছ টোপ গিলিল। মাছ টোপ গিলিবার জন্য ছটফট করিতেছিল। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া দাদা বলিলেন, তুই যদি কাউকে না বলিস

বলব না।

না তুই বলে ফেলবি।

আমি বলিলাম, না গো না। এইমাত্র তো তুমি স্বীকার করলে যে, তোমাদের চেয়ে আমার বুদ্ধি বেশী। তোমার কম বুদ্ধির চাপ ঠেলে যখন কথাটা প্রকাশ হয়নি তখন আমার বেশী বুদ্ধির বস্তার তলায় পড়ে ওটা অচিরাৎ সমাধিস্থ হবে জেনো।

তথাপি দাদা ইতস্তত করিয়া বলিলেন, না ভাই, তুমি কিন্তু রাগ করবে।

আমি বলিলাম, দেখ, রাগ জিনিসটা ভগবান আমায় কম দিয়েছেন-সেজন্য আমি দুঃখিত।

আমি শপথ করে বলছি। রাগ করব না, এমনকি তুমি যদি আমার ভবিতব্য শ্ৰীমতী বীণাপাণিকে উদ্বাহ বন্ধনে বদ্ধ করতে চাও তাহলেও না।

দাদা বোধহয় সম্বন্ধের পূর্ব হইতেই আমার ভবিষ্যৎ গৃহিণীকে ভাদ্রবধু জ্ঞান করিতেন। তিনি আমার দিকে মুষ্টি তুলিয়া বলিলেন, সে কেন, ছুঁচো কোথাকার। তাঁর বড় এক বোন আছে জানিস তো?

চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিলাম, অ্যাঁ, সরস্বতী! রগ ঘেঁসে আন্দাজ করেছি তাহলে? আরে হাঃ হাঃ হাঃ–

দাদা বিষম অপ্ৰস্তুত হইয়া বলিলেন, আমি বললুম তুই রাগ করবি।

আমি বলিলাম, রাগ করলে বুঝি লোক হাসে? বেশ যাহোক। কিন্তু তোমার এই রোমহর্ষণ প্রেমের সূত্রপাত হল কি করে শুনি। সরস্বতীর মত একগুঁয়ে মেয়ে শহরে আর দুটি নেই।

শুনিয়া দাদা নয়ন অর্ধনিমীলিত করিয়া চেয়ারে হেলান দিয়া পড়িয়া মৃদুকণ্ঠে আবৃত্তি করিলেন,-

I know not I ask not
If guilt is in that heart.
I know that I love thee
Whatever thou art!

[আমি জানি না, জানতে চাই না তোমার হৃদয়ে কোন দোষ আছে কিনা। আমি জানি, আমি তোমায় ভালবাসি-তুমি যাই হও।]

আমি তো স্তম্ভিত। বুঝিলাম দাদার অবস্থা ঘোর সঙ্কটাপন্ন। কবিতাই প্রেমের চরম নিদর্শন। দাদার প্ৰেম যে জমিয়া হিমাদ্রি শিখরের মত শক্ত হইয়া গিয়াছে তাহাতে আর লেশমাত্ৰ সন্দেহ রহিল না।

আমি বলিলাম, তুমি যে রকম কবিতা আওড়ােচ্ছ, তোমাকে আমাদের কোটেশন ক্লাবের (Quotation Club) মেম্বার না করলে আর চলছে না। কিন্তু উপস্থিত আমার প্রশ্নের জবাব দাও। তোমার এই প্রেমের সূত্রপাত কি করে হল বল।

দাদা বলিলেন, না, আগে উপায় কি বল।

আমি বলিলাম, খুব সোজা! আমি বৌদিকে দিয়ে মাকে জানাব যে আমার বিয়ে করবার ইচ্ছে হয়েছে। এতদিন অমত করে এসেছি-মা নিশ্চয় খুব তাড়াতাড়ি করবেন। অথচ তোমার বিয়ে না। হলে আমার কিন্তু বিয়ে হতে পারে না।

মন্ত্রণা শুনিয়া দাদা চমৎকৃত হইয়া গেলেন। লাফাইয়া আসিয়া আমার সঙ্গে সজোরে শেকহ্যান্ড করিয়া বলিলেন, সত্যি সন্তোষ, তোকে আর কি বলব। কিন্তু ভাই, তার সঙ্গেই যে হবে

আমি বলিলাম, কিছু ভেবো না দাদা। আমাদের বৌদি থাকতে কিসের ভাবনা। তাঁকে বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

দাদার মুখে-চোখে কি এক অনির্বচনীয় প্রীতি ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। আমি তাঁহার কনিষ্ঠ না। হইয়া যদি জ্যেষ্ঠ হইতাম তাহা হইলে তিনি তৎক্ষণাৎ আমায় গড় হইয়া প্ৰণাম করিতেন সন্দেহ নাই।

আমি বলিলাম, এবার তোমার প্রেমের কাহিনী বল।

দাদা আর দ্বিরুক্তি করিলেন না। কেশারণ্যের মধ্যে বীথির ন্যায় সিঁথির ভিতর দিয়া সন্তপণে অঙ্গুলি চালনা করিয়া আরম্ভ করিলেন, আমি একদিন কলেজ যাচ্ছি

আমি বাধা দিয়া বলিলাম, নিশ্চয় সেদিন খুব গরম ছিল আর ছাতাটাও বোধ করি নিতে ভুলে গিয়েছিলে?

দাদা বলিলেন, না, গরম তত ছিল না। কেন?

আমি বলিলাম, তারপর–

তারপর আমি ওঁদের বাড়ির সুমুখ দিয়ে যাচ্ছি।-দেখি উনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে (দাদার কণ্ঠস্বর সম্ভ্রমে গাঢ় হইয়া আসিল) ফেরিওয়ালার কাছে জিনিস কিনছেন। তিনি বাঁ হাতে নাকের নোলকটি ধরে নাড়ছিলেন। আর এমন একটি কমনীয় শ্ৰী তাঁর সর্বঙ্গ থেকে ফুটে বার হচ্ছিল যে সে বর্ণনা করা যায় না। তোমায় আর কি বলব। কবি মানুষ, মানস চক্ষে কল্পনা করে নাও।

আমি বলিলাম, হুঁ, ফেরিওয়ালার সঙ্গে দরসস্তুর করতে করতে তাঁর অঙ্গে কমনীয় শ্রীর আবির্ভাব হয়েছিল। তুমি ঠিক জান তিনি ফেরিওয়ালার প্রেমে পড়েননি?

দাদা রাগিয়া বলিলেন, দুর র‍্যাসকেল, সে একটা বুড়ো—

আচ্ছা আচ্ছা, তবে ভরসা আছে।–তারপর? তিনি কি করছিলেন?

দাদা বলিলেন, একখানা আরসি কিনছিলেন। বোধহয় পছন্দ হয়নি। তাই সেখানা ফেরৎ দিচ্ছিলেন। তাঁর মুখের রক্তিম আভা—

আমি। আরসি ফেরৎ দিচ্ছিলেন-মুখে রক্তিম আভা? বুঝেছি। তা সত্যি কথা বলেছিল বলে আরসিখানার উপর রাগ করা অন্যায়। শাস্ত্ৰে আছেহিতং মনোহারি চ দুর্ল্লভং বচঃ।

দাদা স্মিতমুখে বলিলেন, তিনি যে সুন্দরী একথা তুমি অস্বীকার করতে পার না।

আমি। বেশ বেশ, পারি না। তারপর কি হল বল।

দাদা। পকেটে হাত দিয়ে দেখি এক ফুটোর সাহায্যে আমার পেনসিলটি কখন রাস্তায় বিদায় গ্রহণ করেছে। কি করা যায়। কলেজে রাশি রাশি নোট লিখতে হবে। মনিব্যাগ থেকে দুটো পয়সা নিয়ে তৎক্ষণাৎ ফেরিওয়ালা বেটার সুমুখে হাজির।

আমি। অ্যাঁ, বল কি।

দাদা। যা বলছি। তিনি ত্ৰস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন—

আমি। ত্ৰস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন?

দাদা। নিমেষের জন্য। আমাকে তিনি নিশ্চয় আগে দেখে থাকবেন তাই হঠাৎ চিনতে পেরে চলৎশক্তি রহিত হয়ে পড়েছিলেন। পরীক্ষণেই আরক্তিম মুখে চকিতের তরে একবার চেয়েই দ্রুতপদে সেখান থেকে চলে গেলেন।

আমি সুদীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিলাম, দাদা, তুমি গোড়াতেই ব্যাপারটাকে যে রকম করে ফাঁসিয়ে দিয়েছ তাতে তোমার বিশেষ ভরসা আছে বলে বোধ হচ্ছে না। সরস্বতী এমন মেয়েই নয়-কারুর এতটুকু ত্রুটি সে কখনো সহ্য করতে পারে না। সত্যিই তোমার জন্যে ভারী সহানুভূতি হচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *