১০. পাটের গুদাম

রাত কেটে যায়। বাইরে ভোর হয়ে গেলেও ভেতরে অন্ধকার কাটে না। তারপর সূর্য যখন প্রবল হয় তখন ভেতরটা একটু ফিকে হয়ে আসে। সেই অস্বাভাবিক গোধূলিতে দেখা যায় স্তুপাকার পাটের ভেতরে সরু পথের দুই প্রান্তে আছে দুজন। মৃত্যুর যে কনিষ্ঠ ঘুম, মৃত্যুর মতোই আমোঘ ও অনিবার্য। এই দুটি মানুষের গতকালের শ্রম, শোক, আকস্মিকতা এখন নিপুণ হাতে নিরাময় করে চলছে ঘুম। বাইরে, পাটের স্তুপের পেছনে টিনের একটা দেয়ালের ওপারেই লাশের সংখ্যা কম দেখে বিহারীদের বিস্ময়, কোলাহল, দৌড়, সৈন্যদের খবর পেয়ে আসা, শেয়ালে খুড়ে ফেলা খালপাড়ের ঐ কবর আবিষ্কার, আকাশে সৈন্যদের গুলি ছোড়া, কিছুই ঘুমের চিকিৎসাধীন মানুষ দুটির শ্রবণে পশে না। বিহারীরা বাঙালিদের একটা পাড়া দৃষ্টান্ত হিসাবে পুড়িয়ে দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে স্থায়ীন ছাউনির অধিনায়ক মেজর সংক্ষিপ্ত না বলে তাদের নিরস্ত করে। মেজর তাদের জানায় না যে, গত রাতে রংপুর জলেশ্বরী একমাত্র সড়কটির ওপর পাতা মাইনে সেনাবাহিনীর একটা জিপ উড়ে যায়, তিনজন নিহত হয়। বিহারীরা জলেশ্বরীতে কোনো বাঙালির সন্ধান না পেয়ে আলেফ মোক্তারের বাড়িতে ঢোকে এবং গলায় ফাঁস টেনে তাকে হত্যা করে ফেলে রেখে যায়। তাদের অগোচরে জলেশ্বরী বাজারেই দুটি বাঙালি অকাতরে ঘুমায়। যেখানে তারা ঘুমিয়ে সেই গুদামের ঠিক বাইরে দিনের রৌদ্রোজ্জ্বল নিরাপত্তার ভেতরে বিহারী কয়েকটি যুবক বন্দুক ঘাড়ে করে টহল দেয়। তাদের কিছু আত্মীয়, কিছু বন্ধু, বিক্ষিপ্ত লাশগুলো থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসে থাকে, সিগারেট ফোকে। কারো কারো গলায় জরির সরু মালা। সৈন্যরা জলেশ্বরীতে প্ৰথম আসবার পর থেকে এই শখটি বিহারীদের কারো কারো ভেতরে দেখা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *