২৩. সারাপথ

সারাপথ প্ৰায় একটা কথাও হয়নি। দুজনের। পীচের পরে মোটরের চাকার শব্দ, বাতাসের শব্দ ফেরিতে জলের ছলছল আর বাজারে মানুষের কোলাহল।

কিন্তু সে স্তব্ধতাও ছিল যেন ভারশূন্য। গাড়ি যতই ঢাকার কাছে আসছে ততই যেন গুরুভার হয়ে উঠছে এই স্তব্ধতা।

নয়ার হাট ফেরি পার হল ওরা।

বাবর বলল, আর ফেরি নেই। এই ছিল শেষ। এবার সোজা ঢাকা।

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সোয়া পাঁচটা বাজে। শীতের ছোট্ট দিন। এরি মধ্যে মলিন হয়ে আসছে বেলা। খেতের পরে এখানে সেখানে ধোয়া আর কুয়াশা দেখা যাচ্ছে। দূরের গাছপালা এরি মধ্যে অস্পষ্ট গম্ভীর।

সত্যি কাল সারা বিকেল সারা সন্ধে বাবর ডাকবাংলো ছেড়ে বেরোয়নি। এমনকি ঘর ছেড়ে পর্যন্ত নয়। চৌকিদার খাবার এসে দিয়েছে। প্রণব বাবু এসেছিলেন একবার। তাকে প্রায় ধুলোপায়েই বিদায় করে দিয়েছে বাবর।

এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম গল্প করে যাই।

জাহেদার শরীরটা ভাল নেই।

বাবর মিছে কথা বলেছিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রণব বাবু বলে উঠেছিলেন, ও তাই বুঝি। সুষমাকে পাঠিয়ে দিই।

না, না, তার দরকার হবে না।

বলেন কী মশাই। আমাদের দেশে এসে অসুখ হবে, সেবাযত্ন পাবে না! ওকী কথা!

অনেক ধন্যবাদ। আপনি কিছু ভাববেন না। কাল দুপুরে আসবেন, মেলা গল্প করা যাবে।

বাবর ভাল করেই জানত, কাল দুপুরে সে থাকবে ঢাকার পথে। বগুড়ার কাছে এসে আজ একবার প্রণব বাবুর কথা মনে হয়েছিল তার। কিন্তু তার চেয়ে বেশি মনে পড়ছিল সুষমার ছায়া-ছায়া মুখখানা।

এরি মধ্যে জাহেদা থেকে অনেক দূরে চলে গেছে বাবর। নতুন কোথাও যাবার জন্যে মনের মধ্যে পাখা ঝাপটাচ্ছে। সুষমার মত কারো জন্যে। সুষমাকে বেশ লেগেছে তার। সুষমার কথা বলতে গেলে সারাদিনই থেকে থেকে মনে পড়েছে তার। শিস দিচ্ছিল প্রায়া সারাটা পথে বাবর।

জাহেদাকে এখন হোস্টেলে ফিরিয়ে দিলে বাঁচে সে।

জাহেদা যে সারা পথ চুপ করে আছে, এটা যেন ভাগ্যের কথা। কথা পর্যন্ত বলতে ইচ্ছে করছে না। আর বাবরের। নিজেকে মনে হচ্ছিল তার ঐ লরী ড্রাইভারদের মত বড় বড় ট্রাকে করে মাল নিয়ে জেলা থেকে জেলা যাচ্ছে খালাস করতে। ফেরিতে বসে পান খাচ্ছে, সস্তা সিগ্রেট টানছে। রোদে পুড়ছে ত্রেপল ঢাকা বস্তার সার, বাক্সের স্তুপ। কোনো আবেগ নেই, ভবিষ্যতের দায় নেই। নিয়ে চল, ফেলে দাও। হাঃ।

কিন্তু এই যে এতক্ষণ সত্যি সত্যি চুপ করে আছে জাহেদা, এটা এখন ধীরে ধীরে অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ভাবছে কী মেয়েটা?

বাবর একবার আড়াচোখে তাকাল জাহেদার দিকে। না, কিছু বোঝা যাচ্ছে না। যে মেয়েকে সে নিয়ে এসেছিল। সে যেন অন্য কেউ।

সত্যি সত্যি তাকে ভালবেসে ফেলেছে নাকি? ভাবছে নাকি বিয়ের কথা! অত বড় বড় বক্তৃতা দিলাম যাবার পথে, সব পানিতে গেল!

শেষে আর থাকতে পারল না বাবর। নীরবতা ভেঙ্গে বলল, কি, একেবারে চুপ করে আছ যে!

জাহেদা চমকে তাকাল তার দিকে। এতক্ষণ পর শব্দগুলো যেন হাততালি দিয়ে পায়রা উড়িয়ে দিল হঠাৎ।

বাবর আবার বলল, পথে এত সাধাসাধি করলাম কিছু খেলে না পর্যন্ত। কী হয়েছে?

জাহেদা তবু কিছু বলল না।

বেশ, নাই বললে কথা।

বাবর ঘাড় কাত করে গাড়ি চালাতে লাগল। শিস দেবার চেষ্টা করল একবার, কিন্তু হলো না। ভালই লাগল না।

জাহেদা পরেছে। কালো রংয়ের পাজামা, আর শাদা জামা। বোধহয় তারি জন্যে মুখ দেখাচ্ছে কেমন পাণ্ডুর। একবার একটু মায়া করে উঠল বাবরের মনটা। পরক্ষণেই ঝেড়ে ফেলে দিল সে। ঢাকায় গিয়ে বাবলিকে আবার দেখতে হবে। বাবলি রাগ করলেও, রাগ তো আর হিমালয় নয় যে আছেও, থাকবেও।

হঠাৎ জাহেদা তাকে ডাকল, শুনুন।

আমাকে বলছ।

হ্যাঁ।

কী বল। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?

কেন, ঢাকায়। এই তো এসে গেলাম। আর এক ঘণ্টা। তার পরই তুমি পৌঁছে যাবে তোমার হোস্টেলে। গোট খোলা পাবে তো? কটায় যেন বন্ধ হয়;

না।

কী, না?

হোস্টেলে যাব না।

হেসে উঠল বাবর। বলল, তার মানে?

জাহেদা কোনো জবাব দিল না সে প্রশ্নের।

বাবর আবার জিগ্যেস করল, তাহলে যাবে কোথায়? কোনো বান্ধবীর বাড়িতে? ঠিকানা বল তবে?

না।

কী, না? ঠিকানা বলবে না? না, বান্ধবীর বাড়িতে যাবে না?

কারো বাড়িতে যাব না। দুষ্টুমি করছ?

না।

সত্যি বলছ?

হ্যাঁ।

তাহলে কোথায় যাবে শুনি?

আপনার বাসায়।

আমার বাসায়?

হ্যাঁ, আপনার বাসায়।

ছেলেমানুষ!

কেন?

আমার বাসায় কী করে যাবে?

যে করে আপনার সঙ্গে রংপুর গেলাম।

বলে জাহেদা সরাসরি তাকাল বাবরের দিকে। সে চোখের দৃষ্টি একরোখা নয়, কম্পিত— যেন দৃষ্টি জোড়া পেছনে পালিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনো পড়েনি বাবর। কিন্তু কোনোদিন কোনো কিছুই বাবরকে অপ্ৰস্তুত করতে পারেনি। বাবর কথা খোঁজার সময় নিতে হেসে উঠল। হাসির অবসরে ভাবতে লাগল, কী বলে।

বলল, রংপুরে গিয়েছিলে গাড়ি করে। গাড়ি করে আমার বাড়িতে অবশ্যই ফেরা যায়। কিন্তু ফিরতে পারা আর ফিরে যাওয়া কি এক কথা?

আমি কিছু বুঝি না।

জাহেদা জেদি মেয়ের মত মাথা নাড়তে লাগল ক্ৰমাগতঃ।

আমি কিছু বুঝি না।

তুমি ছেলেমানুষ।

আমাকে নিতে চান না। আপনার বাড়িতে?

নেব না কেন, যখন খুশি আসতে পার। কিন্তু এখন তুমি যাবে হোস্টেলে।

না।

আমি তোমাকে হোস্টেলে নিয়ে যাচ্ছি।

না।

হ্যাঁ।

না।

সন্ধে হবে এক্ষুণি। ঘরে যাবে, লক্ষ্মী মেয়ের মত ঘুমিয়ে পড়বে। আর যদি চাইনিজ খেতে চাও, পথে থামতে পারি।

না।

বাববার না বলছ কেন?

আপনি আমাকে ফেলে যাচ্ছেন।

বলেই জাহেদ আর নিজেকে সামলাতে পারল না। মাথা নামিয়ে নিল। ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। তার সারা দেহ। কান্নার শব্দ প্রবল হয়ে উঠল।

গাড়ি চালিয়ে চলল বাবর। সাভারের বাজার পেরিয়ে গেল এক্ষুণি। সট সট করে সরে গেল দোকানের ন্যাংটো বিজলি বাতিগুলো।

জাহেদার কান্না থামল না।

তখন ভীষণ রাগ হলো বাবরের। সে একটা সিগারেট ধরাল। শব্দ করে ফোঁস ফোঁস করে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল সে। ইচ্ছে করতে লাগল এখুনি কোথাও নামিয়ে দেয়।

না, কিছুতেই সে প্রশ্রয় দেবে না। তার কেউ নেই। কেউ হবেও না কোনোদিন। মানুষের যত জ্বালা এই মানুষে মানুষে অন্ধ বন্ধন থেকে।

হাঃ। খেলারাম।

চোখে স্পষ্ট দেখতে পায় দেয়ালে সেই অপটু হাতে বড় বড় করে লেখা–খেলারাম খেলে যা।

এই তার দর্শন, এই তার সত্য।

হঠাৎ যেন দম আটকে মরে যাচ্ছে এমনি শব্দ করে উঠল জাহেদা। যাক, মরে যাক।

না, আর পারা যাচ্ছে না। কান্না তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। বাবর সাঁ করে গাড়ি পাশে নিয়ে থামাল।

একদিকে স্তব্ধ নিস্তরঙ্গ মাঠ। আরেক দিক কাঁঠাল বন। কোথাও কেউ নেই। যেন এ গ্রাম ছেড়ে সমস্ত লোক কোথায় কবে চলে গেছে। এমনি যেন কবে, কোন অতীতে একবার দেখছিল বাবর–এমনি স্তব্ধতার মাঠ বন ভেঙ্গে সে হেঁটে যাচ্ছিল একদিন।

বাবর সিগারেট পিষে ফেলে জিগ্যেস করল, এখন বল, কাঁদছ কেন?

জাহেদা মাথা নাড়ল। সেটা তার কথার উত্তরে নয়, কান্নার অভিঘাতে।

বেশ, তবে কাঁদ। যখন থামবে, তখন বল, পৌঁছে দেব।

আপনাকে দিতে হবে না পৌঁছে।

জাহেদা দাঁড়াম করে গাড়ির দরোজা খুলে বেরুল।

আরে, দেখ, দেখ, পেছনে গাড়ি আসছে কিনা।

কিন্তু ততক্ষণে জাহেদা রাস্তা পেরিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। বাবরের একবার ইচ্ছে হলো, ফেলেই চলে যায়। জানে সেটা এক অসম্ভব অবাস্তব ভাবনা; কিন্তু মনের মধ্যে তাই নিয়েই খানিক নাড়াচাড়া করল সে।

তারপর সেও বেরুল।যতটা জাহেদাকে ফিরিয়ে আনবার জন্যে, তারচেয়ে বেশি। শরীর হালকা করতে। তার পর রাস্তা পেরিয়ে কাঁঠাল বনে নেবে একটা গাছ পছন্দ করে প্রশ্রাব করল। তারপর যখন শেষ হলো তখন চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে জাহেদা দূরে একটা গাছের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বাবর কাছে গিয়ে বলল, মেয়েদের এই সিনেমার ভঙ্গিগুলো আমি একেবারেই পছন্দ করি না।

কী বললেন?

জাহেদা ফিরে তাকাল তার দিকে। না, সে চোখে অশ্রু নেই। কখন সে মুছে ফেলেছে, কিংবা শুকিয়ে গেছে। পড়তি বেলায় স্নান আলোয় লাল অঙ্গারের মত দেখাচ্ছে সে মুখ। সত্যি কথা শুনবে? বাবর তাকে বলল।

বলুন।

তুমি যা করছি তা ছেলেমানুষেও করে না।

বারবার আমাকে ছেলেমানুষ বলার অধিকার কে আপনাকে দিয়েছে?

বাবরের মনে হলো গালে একটা চড় বসিয়ে দেয় মেয়েটার। কিন্তু তার বদলে সে হেসে ফেলল, অধিকার দেবার প্রশ্ন নয়। প্রমাণ করছ তুমি। নইলে বলতে না যে তোমাকে ফেলে যাচ্ছি। নইলে, এভাবে গাড়ি থেকে নামতে না এখানে।

মনে করেছেন, আমি খুব বিপদে পড়েছি?

না।

ভেবেছেন, আপনি আমাকে কিনে ফেলেছেন?

তাও না।

আমাকে যা খুশি তাই করতে পারেন ভেবেছেন?

তেমন কিছু ইঙ্গিত দিয়েছি কি?

কী হইছে ভাইসাব?

পেছনে হঠাৎ মানুষের গলা শুনে ফিরে তাকায় বাবর। দ্যাখে তিনটে লোক। হাতে লম্বা ছুরি, আর একরাশ কাঁঠাল পাতা। বোধহয় ছাগলের জন্যে কেটে নিয়ে যাচ্ছে।

মাঝখানের যুবক আবার প্রশ্ন করে, হইছে কী ভাইসাব কন না?

কী চাও তোমরা? বাবর জিগ্যেস করে।

কিছু না। একগাল হেসে বাঁ পাশের যুবক বলে, সোর শুইনা মনে করলাম কাইজা লাগছে। তাই জানিবার আইলাম।

কিছু নয়, যাও তোমরা।

তখন ডান পাশের যুবক বলল, আরে, পিকনিকে গেছিল বোধ করি পিরীতের মানুষ লইয়া, ফেরনের পথে আকাম করতে চায়।

মাইয়াডাও না।

বাবর হঠাৎ টের পায় সন্ধে হয়ে গেছে। দূরের কিছু ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। কোথা থেকে আজান ভেসে আসছে। আর সরসর করে বাতাস বইছে কাঁঠাল গাছের পাতায় পাতায়।

বাবর বলল জাহেদাকে, কি যাবে না। এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?

নারে মাইয়া যাইবার চায় না।

মাঝের যুবককে ঠেলা দিয়ে মন্তব্যটা করল বাঁ পাশের যুবক। তখন সে বলল, হ লাগে যেমুন তাই।

ডান পাশের যুবক বলল, চল যাইগা। শহুরা মানইষের তামশা দেখন লাগবো না।

বাবর বলল জাহেদাকে, চল।

বলে হাত বাড়িয়ে দিল জাহেদার দিকে। হঠাৎ সে হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল বাঁ পাশের যুবক।

কই লইয়া যান। দরকার হয়, ছেড়িরে আমরা পৌঁছাইয়া দিমু।

কিছু বোঝার আগেই বাবরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। বাধা দেবার আগেই গায়ে এসে পুড়ে মারের পর মার। আর অন্যজন চেপে ধরে জাহেদার মুখ। আরেকজন ফিসফিস করে বলে ওঠে, এই শালারে তুই ধইরা রাখা। আমরা কাম সাইরা লই।

বাবরকে যে মার দিচ্ছিল, ততক্ষণে বাবরের ওপর চড়ে বসেছে। সে এবার বলে, আর আমি, আমারে ভাগ দিবি না?

আমরা আগে লই, তারপর তুই লইস।

জাহেদাকে ওরা নিয়ে যায় কোলের মধ্যে ছাগলের বাচ্চার মত। সমস্ত ঘটনা ঘটে মাত্র আধ মিনিটে। কিংবা তারো কম সময়ে। চোখের একটা মাত্র পলকে। এর জনো তৈরি ছিল না বাবর। কিন্তু আশৰ্চয, তার কোনো দুঃখ হচ্ছে না, রাগ হচ্ছে না, বরং মনে হচ্ছে, এই-ই দরকার ছিল। মনে হচ্ছে, জাহেদার হাত থেকে সে এবার অতি সহজে বাচতে পারবে। তার হাসি পেল ভেবে যে লোকটা অহেতুক তাকে এত শক্ত করে ধরে রেখেছে। তাকে ছেড়ে দিলেও, সে চেঁচাবে না, পালটা আক্রমণ করবে না।

যুবক আরো দু চারটে ঘা লাগায় বাবরকে। বুকের ওপর ঘোড়ার মত চড়ে আছে। সে হঠাৎ একটু পাছা আলগা করে আবার সর্বশক্তিতে ধাপ করে বসে পড়ে। ঘোৎ করে আওয়াজ ওঠে। বাবরের; যুবক বলে, শালা, রসের ছেড়ি লইয়া বাইরইছ। একা খাইয়া বাড়ি যাইবা। ভাগ দিয়া যাইবা না সোনার চান।

আবার একটা ঘুষি লাগায় সে বাবরের গলার নিচে। খ্যাক করে থুতু ফেলে বলে, একটা আওয়াজ করবা কি জবাই কইরা ফালামু! ফিলিম স্টার হুসনার লাহান ছেড়ি পাইছি, ছাইরা দিমু না। সাতবার লমু। সামনে পিছনে সাতবার; একেকজন শালার ব্যাটা শালা। টাউনে তোমরা ফুর্তি করো। আর আমরা শালায় ছাগলের পাতা কাইটা মরি।

আবার একটা ঘুষি বসিয়ে দেয় সে বাবরের কণ্ঠার হাড়ে। তারপর ঘাড়ের গামছা দিয়ে মুখ বাঁধতে থাকে। চোখের সামনে যেন অন্ধকার হয়ে আসে সব বাবরের। সে কোথায় আছে, কেন আছে, সমস্ত বোধ হারিয়ে যেতে থাকে তার। একবাব যেন মনে হয়, জন্ম থেকে অনন্তকাল এমনি করে শুয়ে আছে সুদীর্ঘ শীতের মধ্যে অন্ধকার কাঁঠাল বনে এই লোকটাকে বুকে পাথরের মত নিয়ে।

সমস্ত অন্ধকারটাই যেন পাথরের মত চাপ বেঁধে আসে তাব চারপাশে। ক্রমশ এগিয়ে আসে। হৃদপিণ্ডের শব্দ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে আসে। যেন আর কোনো শব্দ নেই পৃথিবীতে, এই কাছে অথচ দূরে, ভেতরে কিন্তু বাইরে, দেখা তবু না দেখা জীবন স্পন্দনের জয়ঢাকা ছাড়া।

হঠাৎ সমস্ত শব্দ আর অন্ধকার ছিঁড়ে আর্তনাদ ফেটে পড়ে জাহেদার।

বা-বা।

বাবরের মনে হলো, স্পষ্ট সে শুনতে পেল কোনো বালিকা তার ছোট্ট জীবনের কার্নিশে দাঁড়িয়ে অতল গহবরে পড়ে যাওয়া থেকে পায়ের নখে সর্বস্ব আঁকড়ে ধরে প্রাণপণে একবার ডেকে উঠল।

দা-দা।

কোথা থেকে দানবের মত শক্তি এলো বাবরের। এক ধাক্কায় বুকে চেপে বসে লোকটাকে ফেলে দিয়ে সেই আর্ত চিৎকারের দিকে দৌড়ুল সে। চিৎকার করতে করতে দৌড়ল, হাসুন, হা-স-নু-উ।

দা-দা! আ-আ-আ!

হা-সু। ভয় নেই হাসু–উ।

নিচু গাছের ডালে ডালে ছড়ে যেতে লাগল বাবরের মুখ, হাত, কাঁধ। সে তবু দৌড়ুতে লাগল। আর বুক ফাটা ডাক দিয়ে খুঁজতে লাগল মেয়েটাকে।

বোনকে ফেলে আর কোনোদিন বাড়ি যাবে না বাবর।

তার বাড়ি আছে। বাড়িতে সবাই আছে। হ্যাঁ, সব তার আছে। আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।

খুঁজে পায় বাবর। একজন জাহেদার মুখ চেপে ধরে আছে, আরেকজন উলংগ হয়ে জাহেদার শরীরের মধ্যে ঢুকতে চাইছে। বাবর লাফিয়ে পড়ে তাদের ওপর। দু কনুয়ে সরিয়ে দেয় দুজনকে। আর জাহেদার হাত ধরে টানতে টানতে বলে, হা-সু, হা-সু, আয়।

কিন্তু ততক্ষণে পালটা আক্রমণ করে তাকে দুজন। আর ছুটে এসে যোগ দেয় তৃতীয় জন। বাবর চিৎকার করে বলতে থাকে, সরে যা, হাসু, পালিয়ে যা, পালা, পালা! হাসু, তোকে আমি বাঁচাব। ভয় নেই হাসু।

হঠাৎ মনে হয়। পিঠের ভেতর গরম আগুনের হালকা বয়ে গেল। বাবরের শরীর একমুহূর্তের জন্য শিথিল হয়ে আসে। অনেকটা মদ এক ঢোকে খেলে যেমন গা ঘুলিয়ে ওঠে ঝাঁকিয়ে ওঠে, তেমনি করে ওঠে শরীর।

জাহেদা বিস্ফারিত চোখে দেখে, বাবরের পিঠে ওরা ছুরি বসিয়ে দিয়েছে। সে চিৎকার করে পিছিয়ে যায় একবার, তারপর ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বাবরকে। ছুরিটা টেনে বের করে। আর লোক তিনটে দাঁড়িয়ে থাকে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে।

বাবর জাহেদার হাত ধরে টানতে টানতে দৌড়ুতে দৌড়তে বলে, চল হাসু, চল, চল চলে আয়।

জাহেদা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। তাকে মাটির ওপর হেঁচড়ে টেনে নিতে নিতে বাবর বলে, হাসনু আয়। হাসু আয়।

কিন্তু শরীরের সমস্ত শক্তি যেন ফুরিয়ে আসছে। জাহেদাকে আর টানতে পারছে না বাবর। সে তখন কোলে তুলে নেয় তাকে। মুখে চুমো দিয়ে টলতে টলতে ছুটতে ছুটতে বলে, ভয় নেই হাসু, আমি এসে গেছি। হাসু, আমি এসে গেছি।

গাড়ির কাছে এসে পৌঁছায় বাবর।

কোনো রকমে গাড়ির দরোজা খুলে জাহেদার অচেতন দেহটা ভেতরে ছুঁড়ে দিয়ে সে এঞ্জিনের চাবিতে হাত রাখে।

দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে আসছে।

চাবি ঘোরায় বাবর।

লাফিয়ে ওঠে এঞ্জিন। গর্জন করে ওঠে। ক্রুদ্ধ এক শ্বাপদের মত। তারপর ছুটে বেরিয়ে যায় সমুখের দিকে।

বাবার স্বপ্নাবিষ্টের মত বলে, হাসু, তোকে আমি ফিরিয়ে এনেছি। আর ভয় নেই। বাড়ি এসে গেছি।

গাড়ির আলোয় সামনে অন্ধকারে তীব্ৰ চলমান দুটি শুভ্ৰ স্রোতের মধ্যে কখন তার নিজের বাড়ি ঘূর্ণিপাকে নৌকার মত ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে আসবে তারই অধীর অপেক্ষায় গতি আরো বাড়িয়ে দেয় বাবর।

কৰ্ণ নদীর পুলের ওপর উঠতে মনে হয় আকাশের ঐ উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলোর উদ্দেশে সে ধাবিত।

হঠাৎ তার গাড়ি পুলের শেষ থামে ধাক্কা খেয়ে ডান দিকে ঘুরে যায় একবার। তারপর সেই নক্ষত্ৰ প্ৰতিফলিত নদীতে গড়িয়ে পড়ে জাহেদাকে নিয়ে, বাবরকে নিয়ে। আরো একজন ছিল, সে হাসনু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *