২১. ভালবাসতে চাই

মাঝখানে একটা জীবন গেছে, একটা পৃথিবী বদলে গেছে, এই রকম মনে হচ্ছে বাবরের। গোলকাল আর আজ মধ্যিখানে একটা সমুদ্র নিয়ে আছে।

কতবার কতজনের সঙ্গে শুয়েছে বাবর। কিন্তু এর আগে যেন এ রকম করে অবসাদ আসেনি। বড্ড উন্মনা লাগে তার। পেছনে কী রকম একটা টান পড়ে। সর্বক্ষণ মনে হয়, পেছনে ফিরে দেখে।

নাহ, এ আমার কী হচ্ছে?

বাবর নিজেকে বলে। উৎফুল্ল হবার চেষ্টা করে। ফুরফুর গলায় ডাকে, জাহেদা, ও জাহেদা।

কী?

তোমার পায়ে ধুলো। ভারি মিষ্টি লাগছে দেখতে।

জাহেদা চলতে চলতে বলে, জিভ দিয়ে পরখ করবেন নাকি?

বলেছিল। ঠাট্টা করে। কিন্তু বলেই সে বোঝে, বলাটা ঠিক হয়নি। লজ্জা করে তার। সারা শরীর খুস খুস করে উঠে জাহেদার। নিজেকে নগ্ন মনে হয়। হঠাৎ। লুকোতে ইচ্ছে করে। চলছিল সে বাবরের আগে আগে, হঠাৎ গতি শিথিল করে ফেলে সে, কিংবা হয়ে আসে আপন থেকে।

আর বাবরের মাথায় মুহূর্তে একটা রক্তবর্ণের ফুল ফুটে। খেলে যা, খেলারাম, তুই আবার খেলে যা।

ইচ্ছে করে, সত্যি সত্যি জাহেদাকে কোলে করে তার ধুলো পায়ে মুখ দিয়ে দেখে। নাভির কাছে কোমল উষ্ণতা আবার ফিরে আসল বাবরের। এতক্ষণের সেই ভার যেন নেমে যায়। হালকা লাগে নিজেকে। নাহ, সে যে ভাবছিল, ভেতরে একটা কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে তার, তা বোধহয় সত্যি নয়। সে যা ছিল তাই আছে।

খেলারাম, খেলে যা।

বাবর তার দৃষ্টি দিয়ে সমস্ত কাপড় যেন খুলে নেয় জাহেদার। আবার বেরিয়ে পড়ে তার গোলাপি নরম স্পন্দিত মাংস।

দাঁড়িয়ে পড়লেন যে!

জাহেদা জিগ্যেস করে। তখন চৈতন্য হয় বাবরের।

আবার হাসছেন!

হাসিটা আরো দীর্ঘায়িত করে রাখে বাবর। তারপর বলে, সত্যি মন্দির দেখা কিছু নয়। তুমি ঠিকই বলেছ।

তার মানে?

আবার আমার ইচ্ছে করছে। এখুনি। এখানে।

জাহেদা ভ্রুকুটি করে।

সত্যি, এখানে যদি আমাদের শোবার ঘরটা কেউ মন্ত্রবলে উড়িয়ে আনতে পারত জাহেদা। যদি সেটা সত্যি হতো।

চলুন, মন্দির দেখতে যাই।

মন্দির হলো ভেতরের আঙ্গিনায়। বাইরে বিরাট মাঠ পেরিয়ে যেতে হয়। সেই মাঠে, গাছতলায় অসংখ্য মানুষের ভিড়। এরা এসেছিল মেলায়। এক জায়গায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গোল হয়ে বসেছে কলাপাতা নিয়ে। ভাত রান্না হয়েছে মাটির হাঁড়িতে। মা সেই ভাত, গরম ধোয়া ওড়ানো লাল চালের ভাত উপুড় করে ঢেলে দিচ্ছে কলার পাতে। পাশে ওদের বাবা বসে আছে চোখ রক্তবর্ণ করে। সারারাত গাঁজা খেয়েছে নিশ্চয়।

জাহেদা অবাক হয়ে যায়। বলে, এই ধুলোর মধ্যে পাতায় করে ভাত খাবে নাকি ওরা?

হ্যাঁ খাবে।

এহ মা।

সারা শরীর ঝাঁকিয়ে ওঠে যেন জাহেদার। বাবার জিগ্যেস করে, কী হলো তোমার? কী হলো?

মনে হচ্ছে আমারই দাঁতে বালি লেগেছে।

দেশের প্রায় সব মানুষেই এইভাবে খায়।

মাটিতে?

হ্যাঁ মাটিতে। তবু তো খেতে পাচ্ছে ওরা, অনেকে তাও পায় না।

আচ্ছা ওরা সঙ্গে করে প্লেট আনতে পারে না।

হা হা করে হেসে ওঠে বাবর।

হাসির কী হলো?

তোমার কথা শুনে ফ্রান্সের সেই রাণীর কথা মনে পড়ে গেল।

ঠাট্টা করছেন?

না। সেই রাণী বলেছিল, সব ক্ষুধার্ত মানুষ দেখে, ওরা রুটি নেই তো, কেক খায় না কেন?

এ আপনার বানানো গল্প। শুধু শুধু আমাকে ঠাট্টা করবার জন্যে। বলুন, বানানো নয়?

হ্যাঁ, বানানো। বাবর মিথ্যে করে বলল। তারপর বলল, চল এগোই।

আরেকটা গাছের তলায় তখনো একজন বসে আছে রুদ্রাক্ষের তৈরি মালা নিয়ে। বিক্রি করছে।

কত করে?

আট আনা।

মাত্র আট আনা! জাহেদার চোখ হঠাৎ খুশিতে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। এত সুন্দর জিনিস। বলে, গলায় পরে বেরুলে এত মানাবে। আমি কিন্তু এক ডজন নেব।

এক ডজন?

হ্যাঁ, পাপ্পুকে দেব, শরমিনকে দেব, সবাইকে দেব।

কেনা হলো মালা। বাবর দাম দিতে যাচ্ছিল, বাধা দিল জাহেদা। বলল, না। আমি দেব। আপনার কাছে পয়সা নেব কেন?

আমার কাছে শুধু চুমো নিও তুমি!

সত্যি সত্যি রাগ করে এবার জাহেদা। বলে, আপনি শুধু ঐ এক কথা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেন না।

তাই নাকি?

হ্যাঁ তাই। আমাকে কী মনে করেন? দেখব আপনার মন্দির।

মন্দিরটা আমার নয়।

বাবরের ঠাট্টা যেন আরো জ্বলিয়ে দেয় জাহেদাকে।

আপনার মন্দির, আপনিই দেখুন।

মুহূর্তে জাহেদা ফিরে লম্বা পা ফেলে দৌড়ুতে শুরু করল। ফিরতি পথে। হঠাৎ করে এমন রাগ করবে বুঝতে পারেনি বাবর।

আরে, কী হলো শোন।

বাবর তার পেছনে তখন দৌড়ুল তাকে ধরতে। ভাত ফেলে সেই ছেলেরা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। রুদ্রাক্ষের মালা যে বিক্রি করছিল সেও এবার উঠে পেছন থেকে দৌড়ুতে দৌড়ুতে ডাকতে লাগল।

ডাক শুনে তাকাল বাবর। আরে, ওকে দামটা দেয়া হয়নি। পকেটে হাত দিল বাবর। বিরক্ত কণ্ঠে জিগ্যেস করল, কত দাম?

ছয় টাকা।

কিন্তু সঙ্গে দশ টাকার নোট। লোকটার সাথে ভাংতি নেই। কী মুশকিল। বাবর তাকিয়ে দেখল, জাহেদাকেও এখন আর দেখা যাচ্ছে না। কী করবে। সে? দশ টাকার নোটটাই দিয়ে দেবে? না, আরো আটটা মালা নিয়ে পুরো করবে টাকাটা? জাহেদা ভীষণ রাগ করেছে নিশ্চয়। নিজেকে ভেতর থেকে খারাপ লাগছে বাবরের। ছোট্ট একটা মেয়ে হঠাৎ করে খেপে গেলে বাড়িশুদ্ধ মানুষ যেমন আদর করে থামাতে অস্থির হয়ে ওঠে, তেমনি লাগছে তার।

জাহেদার চলে যাওয়া পথের থেকে চোখ ফিরিয়ে বাবর যখন লোকটাকে দশ টাকার নোটটাই দিতে তৈরি, তখন দেখে লোকটা নেই।

আরে, এ আবার গেল কোথায়?

দু একজন মানুষ তখন দাঁড়িয়ে গেছে বাবরের পাশে। তাদের একজন বলল, ভাংতি আনতে গেছে।

নিঃশ্বাস ফেলল বাবর। বড় করে একটা নিঃশ্বাস। কিছু করবার নেই। দাঁড়াতেই যদি হয়, দাঁড়াবে সে। ভাবনা করে লাভ নেই।

জাহেদা হেঁটে ঢাকা ফিরে যাবে না, গাড়িতেই গিয়ে বসবে। এত ভেবে কী হবে? কবে কোনোদিন এত ভেবেছ বাবর?

হাসল বাবর। নিজের দিকেই তাকিয়ে সে হাসল মনে মনে। খেলারাম, খেলে যা। তোর কাজ শুধু খেলে যাওয়া হাঃ।

একটা সিগারেট ধরাল বাবর। ধুলো পায়ের পথ দেখতে লাগল। পাতা ঢাকা। ভিজে ভিজে। যেখানে ছায়া, সেখানে ভারি সুন্দর ঠাণ্ডা। যেন সারা জীবন শুয়ে কাটিয়ে দিতে লোভ হয়। কানে যেন বাঁশির সুর শুনতে পায় বাবর। সেই ছেলেটা খুব ভাল বাঁশি বাজাত।

কোন ছেলেটা?

নামটা মনে নেই। তার বয়সী ছিল। লেখাপড়া করত না। বাপ ছিল বাজারের কুলি। ছেলেটাও ছোটখাট মোট বইতে। আর ফাঁক পেলেই কোমর থেকে বাঁশি বের করে বাজাত। তুতুর-তুয়া-আ-আ–এমনি একটা সুর ছিল। সেই সুরাটাই ঘুরে ফিরে বাজাত। তারপর একদিন সাপে কাটল তাকে।

নাঃ। কবে কোনদিন ভেবেছে বাবর? ভাববে না সে। সব ভাবনার গলা টিপে মেরেছে।

সে বহুকাল আগে। ভাবনা তার শুক্র। এই তো সে বেশ আছে, ভাল আছে।

লোকটা ফিরে এলো খুচরো নিয়ে। টাকা গুনে নিয়ে এগুল বাবর। পেটের কাছে টনটন করে উঠল তার। একটা ঝোপ খুঁজে হালকা হলো। এখান থেকে মন্দিরের চূড়া খানিক দেখা যাচ্ছে। রোদ পড়েছে সূচাল মাথায়। ময়রার দোকানে থরে থরে সাজান চৌকো সন্দেশের চুড়ার মত।

জাহেদা ঠিকই বলেছিল। মন্দির দেখা, রংপুরে আসা, একটা উপায় মাত্র। সে এসেছে অন্য কিছুর লোভে। সেটা তার পাওয়া হয়ে গেছে। আর কী দরকার? মন্দির থাক মন্দিরের ভিতে। আমি চলি।

বাবর বলল, হ্যাঁ চলি।

আবার সেই সাঁকো পেরিয়ে বাবর এলো গাড়ির কাছে। গাড়ির গায়ে মিহি ধুলোর পর্দা পড়েছে। কিন্তু জাহেদা নেই। গেল কোথায়?

চারদিকে চোখ চালিয়েও জাহেদাকে কোথাও দেখা গেল না। তখন একটু উদ্বেগ হলো। আরে, এ যে দেখছি সত্যি সত্যিই রাগ করেছে। বাবর জিগ্যেস করল, পাশেই চায়ের দোকানে। তারা বলল, পথ দিয়ে হেঁটে গেছে। কোনদিকে? পাকা সড়কের দিকে। মেয়েটা পাগল নাকি? হেঁটেই রওয়ানা দিল ঢাকায়?

বাবরের মনে হঠাৎ একরাশ স্নেহ ঝাঁপিয়ে পড়ল। না, সত্যি ছেলেমানুষ। এক মুহূর্তের জন্যে জাহেদাকে মনে হলো তারা যেন ছোট্ট একটা মেয়ে। গাড়িতে বসে মোটর স্টার্ট দিল বাবর। এখানো পাশে জাহেদার ক্ষীণ সুবাস টের পাওয়া যাচ্ছে। সুন্দর সুগন্ধ। সকালে জেগে উঠে। মনে করতে না পারা স্বপ্নের মত।

খানিক দূরে যেতেই চোখে পড়ল জাহেদাকে। একটা কালভার্টের ওপর বসে আছে উল্টো দিক মুখ করে। তার পূর্ণ টানটান পিঠ দেখা যাচ্ছে কেবল। আর মাথায় একরাশ চুল। গাড়ি থামাল তার পাশে বাবর। মেয়েটা তবু মুখ তুলে তাকাল না। বাবর হর্ণ দিল। তন্ময়তা ভাঙ্গল না। তখন নেমে এলো সে গাড়ি থেকে। সামনে দাঁড়িয়ে ডাকল, জাহেদা।

উত্তর নেই।

রাগ করেছ?

উত্তর নেই।

তখন বাবর বসল। তার পাশে। আরেকটা সিগারেট ধরাল। টানতে লাগল নিঃশব্দে। না, সেও কথা বলবে না। তার কেমন যেন মজাই লাগছে। এই ছোট্ট খেলাটুকু করতে।

সিগারেট শেষ হলে বাবর খুব কায়দা করে ছুঁড়ে দিল টুকরোটা। অনেক দূরে গিয়ে পড়ল। ধোঁয়া উঠতে লাগল পাকিয়ে পাকিয়ে। অল্প বয়সী ছেলে একটা যাচ্ছিল, সে হঠাৎ দেখতে পেল তা। যেন পথ চলতে সোনা পেয়ে গেছে, খুশিতে সে তুলে নিল সিগারেটের টুকরোটা। তারপর কষে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে লাফাতে লাফাতে চলে গেল।

হাসল বাবর।

হাসছেন!

না, তোমাকে নয়। ঐ ছেলেটাকে দেখে।

আপনি আমাকে কী মনে করেন?

বলে এমন করে জাহেদা বাবরের দিকে তাকাল বাবর একটা হালকা উত্তর দিতে যাচ্ছিল; থমকে গেল। একেবারে নতুন লাগছে জাহেদাকে। নতুন চেহারা। অর্থটা যেন ভাল বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু মনের মধ্যে টের পাওয়া যাচ্ছে। ভালবাসা? জাহেদা কি তাকে ভালবেসে ফেলেছে? একটা মানুষের ওপর জীবনের দায় দিলেই এমন দৃষ্টি ফুটে উঠে দু চোখে।

না না। ভালবাসা নয়। আমি কাউকে ভালবাসি না; কাউকে না। ভালবাসা বিশ্বাস করি না। এ হতে পারে না। এ আমি চাই না।

বাবর মাথা দোলাতে লাগল।

অসম্ভব; হতে পারে না।

মুখ থেকে কথাগুলো বেরিয়ে পড়ে তার।

জাহেদা ফিরে তাকায়। জিগ্যেস করে, কী হতে পারে না?

কিছু নয়। আসলে কী জান, আমার একটা বস্তুর অভাব বড় বেশি! শুনবে?

জাহেদা তাকিয়ে থাকে।

বাবর বলে, ধৈর্যের অভাব। বাবর মনে মনে বলে, না, আমাকে ফেরাতেই হবে। ভালবাসার সেই হাওয়া যদি বইতে থাকে, যদি সে বইতে দেয়, তাহলে তা ঝড় হয়ে দাঁড়াবে। কিছুতেই সে তা হতে দিতে পারে না। তাকে ফেরাতেই হবে।

বাবর ওর হাত ধরল। বলল, চল গাড়িতে যাই।

প্ৰায় টানতে টানতে গড়িতে এনে বসাল তাকে।

সমস্ত কিছু ভেঙ্গে দেবার আক্রোশ ফুসতে থাকে। বাবরের মনের মধ্যে। গাড়ি চালাতে চালাতে সে কথা খুঁজতে থাকে। এমন কথা, যা গুড়িয়ে দেবে ঐ হৃদয় দিয়ে হৃদয় অনুভব করবার মিথ্যে সাঁকোটা।

বাবর হঠাৎ টের পায়, জাহেদা তার ঊরুতে একটা হাত রেখেছে। সে হাত আমন্ত্রণের নয়, আশ্রয় সন্ধানের।

আরো শঙ্কিত হয়ে ওঠে বাবর। জাহেদা তাকে ভালবেসে ফেলেছে।

তাই তুচ্ছ হয়ে গেছে তার কাছে মন্দির দেখা। এখন তার পৃথিবী কেন্দ্রীভূত হয়ে এসেছে বাবরকে ঘিরে। এ কী হলো? এ রকমটা তো সে চায়নি।

মেয়েটা কি আশা করেছে, এখন সে একটা প্রেমের গান গুন গুন করবে, না, রবি ঠাকুরের একটা কবিতা আবৃত্তি করবে, যেমন সব মেয়ে স্বপ্ন দেখে উপন্যাস আর সিনেমার কল্যাণে।

বাবর হঠাৎ বলে, শুনবে একটা কবিতা?

মনে মনে আবছা একটা নিষ্ঠুরতা অনুভব করে বাবর।

শুনবে?

জাহেদা মুখে কোনো উত্তর দেয় না। কিন্তু বোঝা যায়, শুনতে কোনো আপত্তি নেই তার। মনে মনে হাসে বাবর। ঠিকই সে ধরতে পেরেছে। জাহেদা প্রেমে পড়েছে তার। হাঃ।

বাবর বলে, রবি ঠাকুরের শেষের কবিতায়— মনে আছে শেষের কবিতার কথা কাল না। পরশু তোমায় বলছিলাম?

হ্যাঁ।

সেই শেষের কবিতা যে কী করে গেল, কবিতা শোনান হয়ে দাঁড়াল একটা আচার।

আচার?

আরে না, না, আমের, তেঁতুলের আচার নয়। তোমার বাংলা পড়া থাকলে জানতে এ আচার মানে তোমরা যাকে ইংরেজিতে বল রিচুয়াল।

ও।

আচ্ছা, একটা ইংরেজি কবিতাই শোনাই। ইংরেজি মানে ইটালিয়ান ভাষায় লেখা। সিজার পাভিসের। পড়েছি ইংরেজি অনুবাদ। ইংরেজিটা ভাল মনে নেই। বাংলা করে বলি।

খানিক চুপ করে থেকে মনে করে নেয় বাবর। গাড়ির কাচ তুলে দেয় একটু। বাতাস এত জোরে কাটছে যে কথা হারিয়ে যেতে চায়। বলে শোন, সিজার পাভিসের কবিতাটা এ রকম–

সমস্ত কিছুতে হতাশ ঐ বুড়ো লোকটা
তার ঘরের চৌকাঠে বসে
দেখে চনমনে রোদে
মদ্দা আর মাদি একজোড়া কুত্তা–
তারা রক্তের নিয়মে খেলছে।

চোখ কালো করে তাকায় জাহেদা। বলে, কারা খেলছে?

মদ্দা আর মাদি একজোড়া কুত্তা। কুকুর। ডগস। রাগ কোরো না। ভাল কবিতা। আগে শোনাই তো।

মদ্দা আর মাদি একজোড়া কুত্তা–
তারা রক্তের নিয়মে খেলছে।
ভন ভন করে মাছি বুড়োটার ফোকলা মুখে;
বৌটা মারা গেছে বেশ কিছুদিন।
সে, আর দশটা কুক্তির মত,
জানতে চায়নি কিছু,
কিন্তু ছিল তার রক্তের নিয়ম।
বুড়োটা, তখনো তার দাঁতগুলো যায়নি,
এ ব্যাপারে পরম রসিক; রাত এলে বিছানায় যেত তাকে নিয়ে।
রক্তের নিয়ম, বড় সুন্দর।

জাহেদা বলে, থাক, শুনতে চাই না।

শোন, ভাল কবিতা। সিজার পাভিসের নাম শোননি?

কোনো দরকার নেই।

বাবর সে কথার জবাব না দিয়ে মনে মনে অনুবাদ করে মুখে আবার আবৃত্তি করতে থাকে–

কুত্তার জীবনে এই একটা চমৎকার দিক–
অফুরন্ত স্বাধীনতা।
সকাল থেকে সন্ধে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান :
কখনো একটু আহার :
কখনো একটু ঘুম :
কখনো একটা মাদি কুত্তার সওয়ার হলুম–
রাত না দিন, বিয়েই গেল!
শুঁকে দেখার স্বাভাবিকতায় সে চলে;
যা নাকে লাগে তাইই তার হয়ে যায়!

চুপ করুন। জাহেদা চেঁচিয়ে ওঠে না, মিনতি করে।

নিষ্ঠুরতা যেন আরো প্ৰবল হয়ে ওঠে বাবরের মনের মধ্যে। মেহ, দয়া, ভালবাসা। হাঃ! এ কীসের মধ্যে জড়িয়ে ফেলতে চায় তাকে জাহেদা? জানে না, বাবরের জানা আছে কী করে বেরিয়ে আসতে হয়! বেরিয়ে সে আসবেই। ভালবাসার জন্যে জাহেদাকে সে আনেনি। বাবর বাঁচে এক মুহূর্ত থেকে পরের মূহুর্তে। ছেলেবেলায় টেলিগ্রাফের এক খুঁটি থেকে আরেক খুঁটিতে ছুটে যাবার মত। সেই ভাবনাহীন খেলার মত।

বাবর বলল, এখনো কবিতাটা শেষ হয়নি জাহেদা। বাকিটা শোন।

না।

শোন।

না, না।

বেশ, তবে আমি নিজেকেই শোনাচ্ছি। তোমার ইচ্ছে না হয়, তুমি শুন না। তুলো থাকলে কানে দাও।

আমার কাছে তুলো থাকবে কেন?

মেয়েদের ব্যাগে তুলো থাকেই।

ভারি তো জানেন!

হ্যাঁ, মাসে মাসে তোমাদের দরকার হয় যে।

বাবর নিষ্ঠুর গলায় বলে। সব কিছু গুড়িয়ে দিতে চায় সে। তুচ্ছ করতে চায়। মেয়ে নয় তো, একটা চেন বাধা পশুকে যেন খোঁচাচ্ছে সে।

বাবর আবৃত্তি করে–

বুড়োটা ভাবে
একবার সেও ঐ কুত্তার মত
গমক্ষেতে করেছিল দিনের বেলায়।
এখন মনেও নেই কোন কুত্তির সাথে
কিন্তু মনে আছে
চড়া রোদ
দরদর ঘাম
আর অনন্ত অনন্ত পর্যন্ত করে যাবার ইচ্ছেটা।
অবিকল বিছানায় যেমন।
তাকে আবার অতীত ফিরিয়ে দিলে
সে করবে একমাত্ৰ গমক্ষেতে, দিনের বেলায়।

পথ চলতে চলতে
এক মেয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে গেল দেখতে।
মুখ ঘুরিয়ে গেলেন এক পাদ্ৰী!
রাস্তায় যা খুশি হয়!
এমনকি এক মহিলা–
পুরুষ দেখে চোখ নামান যিনি——
তিনিও দাঁড়িয়ে গেছেন দেখতে।
কিন্তু বালক,
ধৈর্যের অভাববশত
সে ছুঁড়তে লাগল ঢ়িল।
বুড়োটা ক্ষেপে গেল।

আবৃত্তি শেষে হা হা করে হেসে উঠল বাবর। আবার বলল, বুড়োটা ক্ষেপে গেল। কেন ক্ষেপে গেল জান জাহেদা? কারণ, সে বুড়ো হয়েছে, তার নিজের এখন সাধ থাকলেও সাধ্য নেই।

জাহেদা একবার দুহাতে মুখ ঢাকবার চেষ্টা করল নিজের। দুঃখে! কবিতার শৈলী সে জানতে চায় না, বুঝতে চায় না। তার ভীষণ কষ্ট হয়, বাবর কেন বেছে বেছে এই কবিতা শোনাল তাকে।

বাবর বলল, রাস্তায় ঘটনা। কী হচ্ছিল জান? ঐ যে কবিতায়, যা দেখে লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে, এমনকি পাদ্রীটাও! একটা কুত্তা আর একটা—

চুপ করুন।

বাবর একটু থেমে ঘোষণা করল, সিজার পাভিস ওয়াজ এ গ্রেট পোয়েট। আমি কবি হলে ওর সব কবিতা অনুবাদ করে বই বের করতাম।

সাঁ করে গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করাল বাবর।

এখানটা নির্জন। দুপাশে আখের খেত। রোদে আকাশ পুড়ে যাচ্ছে। বিশ্বের স্তব্ধতা এখানে উপুড় হয়ে আছে।

গাড়ি থামতে দেখে জাহেদা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। কী বলবার জন্য রক্তিম ঠোঁট তার কেঁপে উঠল একবার।

হাঃ।

বাবর তাকে হঠাৎ দুহাতে জড়িয়ে ধরে, শক্ত করে বেঁধে, গ্ৰাস করে নিল জাহেদার ঠোঁট। আর জাহেদা তাকে দুহাতে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগল পাগলের মত। চিৎকার করতে চাইল। কিন্তু পারল না। তখন চোখ বেয়ে উষ্ণ অশ্রু হঠাৎ অবিরল ধারায় পড়তে লাগল তার।

ঠোঁট দিয়ে সে অশ্রুর স্বাদ নিতে নিতে বলল, চল ডাকবাংলোয় যাই। আমি আরেক বার তোমাকে ভালবাসতে চাই। ইংরেজিতে কথাটার যে আরেক মানে আছে, তাই, তাই আমি চাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *