১৮. খেলারাম, খেলে যা

হাঃ। খেলারাম, খেলে যা।

পাশে শুয়ে আছে জাহেদা। ঘুমন্ত, পরিশ্রান্ত, অধিকৃত, শিথিল। দীর্ঘলয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তার নিঃশ্বাস। সমস্ত দেহ এখন মসৃণ, কেবল কীসের স্মৃতিতে স্তনমুখে কিছু পদ্মকাঁটা ধরে আছে। ঋজু বাঁ পায়ের ওপর ডান পা-টা ভাজ হয়ে চেপে আছে দেখাচ্ছে হেনটি মাতিসের বার্নস মিউরাল ডান্স ওয়ানের মধ্য-ফিগারের মত। চুলে ঢাকা গাল চিবুক গলার কোল। চোখের কাজল দুষ্টুমিতে কপালের পাশ কালি করে আছে। সন্তৰ্পণে দেশলাই ধরিয়ে ছবিটা দেখল বাবর। তারপর দ্বিতীয় কাঠিতে জ্বালাল সিগারেট। কম্বল দিয়ে ভাল করে ঢেকে দিল জাহেদাকে। আর সে নিজে তার নগ্ন দেহটাকে হিমেল হাওয়ার হাতে ছেড়ে দিল। এখন এই শীত বড় উপভোগ্য মনে হচ্ছে। থেকে থেকে কাপন লাগছে। কাটা দিয়ে উঠছে। সারা গা। আবার সদ্যস্মৃতিটা ফিরিয়ে আনছে উত্তাপ। সিগারেটের আলোয় থেকে থেকে একটা লাল বেলুন ফুলে উঠছে, হারিয়ে যাচ্ছে, আবার দেখা যাচ্ছে।

সে যেন এইমাত্র প্রচুর হুইস্কি খেয়ে উঠেছে।

জাহেদা পাশে আছে কি নেই সেটা বড় কথা নয়; থাকলে সে আছে, না থাকলে সে নেই। কোনোদিন যেন তাকে দেখেনি, চিরদিন যেন তাকে দেখেছে। জাহেদা মৃত, জাহেদা জীবন্ত। পাশে তাকাল বাবর। জাহেদাকে মনে হলো বিন্দুসমান, অনেক ওপরে প্লেন থেকে দেখলে পদ্মায় নৌকো যেমন দেখায়। জাহেদার পাশ ফেরা ডান ঊরুটাকে মনে হলো তার শরীরের চেয়ে বৃহৎ, হাঁটুর কাছে ক্যামেরা রেখে দেহের ছবি তুললে যেমন হয়।

সমস্ত পৃথিবীতে একমাত্র নিজেকে জীবিত বলে মনে হলো তার। মনে হলো সে একটা প্রাচীন গাছ, মাটিতে সমান্তরাল পড়েছিল কতকাল; সেখানে নতুন ডাল বেরুচ্ছে আবার, সমস্ত কাণ্ড জুড়ে, একে একে, অসংখ্য উজ্জ্বল, জলজ সবুজ, ঋজু, ক্ষীণদেহ। ক্রমশ বড় হতে দেখল। সে ডালগুলো। ক্রমে একটি অরণ্য হয়ে গেল তার সমস্ত দেহ জুড়ে। একটা প্ৰদীপ্ত সূর্য নির্মল কিরণে ভাসিয়ে দিয়েছে সবকিছু। সবকিছু স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ, প্রখর দেখাচ্ছে।

সেই অনন্তগামী মহাস্রোতে অসহায় ভাসমান একটি অণু আর সে নয়, সে সেই স্রোতের একটি সচল সক্রিয় উল্লসিত অংশ।

সচ্ছল প্ৰপাতের মত হাসতে ইচ্ছে করল তাল। সে মনে মনে নির্মল অবিরাম হাসি হয়ে উঠল। উঠে দাঁড়াল। এবং খাটের কার্নিশ দুহাতে শক্ত করে ধরে নগ্নদেহে বসে রইল অনেকক্ষণ।

কিন্তু মনে মনে নয়, সরবে। হেসে উঠতে ভীষণ ইচ্ছে করতে লাগল বাবরের। সে খালি পায়ে দাঁড়াল দুই খাটের মাঝখানে। তারপর ছাদের দিকে মুখ তুলে গ্রীবায় দুহাত চেপে সে হাসতে লাগল, করতলের চাপে প্ৰায় বোবা কিছু ঘরঘর শব্দ নিৰ্গত হলো শুধু। এই সাবধানতা শুধু জাহেদার ঘুম যেন না ভাঙ্গে।

সমস্ত শরীর একটা তরঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। কল্লোলিত, হিল্লোলিত একটা দুর্বার তরঙ্গ। ধরে রাখা যাচ্ছে না নিজেকে। অস্থির হয়ে উঠেছে পায়ের আঙুল; নিতম্বের মাংশপেশিতে দ্রুত সঞ্চরণ অনুভব করা যাচ্ছে। মণিবন্ধে এপোশ ওপোশ একটা মোড়চ বাড়ছে প্ৰতি মুহূর্তে। তার নাচ করতে ইচ্ছে করছে। এই শীতরাত্রে সম্পূর্ণ নগ্ন সংগমতৃপ্ত বাবর অন্ধকারে একটি গাঢ় রক্তবর্ণ বৃহৎ আদি পুষ্পের মত দুলতে লাগল। ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে, একতালে।

তারপর হাতড়ে হাতড়ে বাবর ছোট্ট টেপরেকর্ডারটা বের করল। যে ক্যাসেট হাতে ঠেকল সেটাই পরিয়ে চালিয়ে দিল যন্ত্রটা। ছড়িয়ে পড়ল সুরের মূৰ্ছিনা। কমিয়ে দিল ধ্বনি, এত কমিয়ে দিল যে আর শোনা গেল না, কিন্তু সে তার এখনকার প্রখর। শ্রবণ দিয়ে স্পষ্ট শুনে চলল। জিজি জাঁ মেয়ার গাইছে। ফরাসি জানে না। কিন্তু অর্থগুলো শুনেছিল সে। নিশ্চল দাঁড়িয়ে প্রথম গানটা শুনল বাবর। এসো, নাচবে এসো। নাচঘরে দেখবে কত রূপসী তরুণী। এসো। শোন তাদের উল্লাস্যধ্বনি যা আমার পছন্দ। বড্ড ঠাসাঠাসি হবে। বড্ড ভিড়। তোমাকে একেবারে জড়িয়ে ধরতে হবে। ধরব চুমো দেব আর ঘুরব, সঙ্গীতের ঘূর্ণিতে আমরা ঘুরব। খুলে যাবে তোমার জামা। হারাবে তোমার চেতনা। খুলে যাবে মোজা। খুলে পড়েব সব। আমরা শুধু ঘুরছি, আর ঘুরছি, আর ঘুরছি।

ঘুরতে লাগল বাবর। তালে তালে ঘুরতে লাগল। ডান হাত তুলে, বাঁ হাত নাভির অদূরে ত্রিভুজ করে রেখে, মাথা ঝাঁকিয়ে, তার বহির্চেতনা হারিয়ে— যেমন মাজারে জেকের করতে হয়, মণ্ডপে কীর্তন করতে করতে দশা লাগে, তেমনি।

শেষ হলো গানটা। অভিভূতের মত দাঁড়িয়ে পড়ল বাবর, দাঁড়িয়ে রইল। পরের গান যতক্ষণ না শুরু হয়। শুরু হতেই আবার সে তালে তালে ঘুরে চলল। এবার দুদিকে উত্তোলিত প্রসারিত তার হাত। প্ৰতি দোলায় তার শিশ্ন এ ঊরু, ছুঁয়ে যেতে লাগল অবিরাম। মেট্রোনমের মত ঐ গানের সাথে তার দেহের সাথে তাল রেখে চলছে যেন।

জিজি জাঁ মেয়ার সুরের নদীতে ছিপছিপে নৌকার মত কথা ভাসিয়ে বলে চলেছে–এটা কোনো ওষুধ, কোনো প্ৰসাধনী, কোনো কারখানায় তৈরি কিছু না, সান্টা ক্লজের দোকানে একটা খেলনা? আমি কত অভিধান দেখলাম, কত নিষিদ্ধ পঞ্জিকা খুঁজলাম, কিন্তু পেলাম না। শুধু তাতে লেখা, বলা হয়ে থাকে জিনিসটা…। একটু চেয়ে দেখলাম, পুরোটা খেতে ইচ্ছে করল। আমি এক তরুণী থেকে রূপান্তরিত হলাম আক্রমণ উদ্যত ট্যাঙ্কে। আমি ওটা নিজের করে চেয়েছি। কিন্তু বাইসাইকেল তো আর ওটা নয়, ওর জন্যে দাম দিতে হয় জীবন। তখন এক টুকরো। হাসি দিয়ে ওটা পেলাম। ভাবলম, হয়ে গেল। জয়। আমার জয়। কিন্তু পরিণামে আমিই তার ক্রীতদাসী হয়ে গেলাম। আমার দেহ শেকলে বাধা। আমি সাহায্য চাই। কিন্তু চিৎকার করব না, কারণ প্ৰথমে তো আমি নিজেই চেয়েছিলাম। আমার জিনিস। আমার আনন্দ। আমার মৃত্যু। গলার মৃত্যুফাঁস।

অন্ধকার নগ্নদেহে ভূতের মত নাচ করতে করতে সে তার নিজেরই কণ্ঠ থেকে নিসৃত কিছু অব্যয় ধ্বনি শুনতে পেল।

বিছানায় সটান শুয়ে বাবর। অবলুপ্ত হয়ে গেল সঙ্গীত, শান্ত হলো শরীরের মাংসপেশিগুলো। বাবার স্বপ্ন দেখল, তার বাবা কাঁচাপাকা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলছেন, লেখ বাবারা লেখ, হাতের লেখা লেখ, উর্ধ্বমুখে পথ চলিও না, ইক্ষু রস অতি মিষ্ট।

একপাল ছেলে উবু হয়ে থুথু নিয়ে শেলেট মুছছে আর লিখছে। কেবল বাবরই যেন কোন অপরাধে একেবারে বস্ত্ৰহীন নিলডাউন হয়ে আছে করোগেটের টিন কাটা জানালার কাছে। বাইরে পাকা সোনার মত ধান খেতের ওপর দিয়ে স্রোত হয়ে চোখ ঝলসানো রোদ আসছে। সারাদিন। মন খারাপ করা একটা ঘুঘু ডাকছে ইস্কুল ঘরের কাছেই। দূরে শোনা যাচ্ছে ঢাকের সতেজ একটানা বৃষ্টিমুখর শব্দ। সামনে মহরম। আহা কানা ফকিরের সেই গানটা গো। কাঠের টুকরো কিট কিট করে বাজায় আর বাড়ি বাড়ি গায় ও কাশেম, তুমার সখিনা ছেড়ে কুথাকে যাও নাথ! ঘোমটা টানা বৌদের চোখ ছলছলিয়ে ওঠে, পয়সা দেয়, চাল দেয়। তারা। কান্নার জন্যে দাম দেয়। তখনি খুব অবাক লাগত। বাবরের। কোথায় যেন কী একটা গোপন অর্থ আছে যা ধরা যেত না। স্বপ্নের মধ্যে বাবর দেখল বেড়ার ফাঁকে কানা ফকিরের গান শুনছে জাহেদা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *